পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - শিঙ্গায় ফুৎকার
৫৫২১-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: দুটি ফুঁকের মধ্যখানে দূরত্ব হবে চল্লিশ। লোকেরা প্রশ্ন করল, হে আবূ হুরায়রাহ্! চল্লিশ দিন? তিনি বললেন, আমি উত্তর দিতে অপারগ। (অর্থাৎ আমি জানি না) তারা প্রশ্ন করল, চল্লিশ মাস? তিনি বললেন, আমি উত্তর দিতে অস্বীকার করি। লোকেরা প্রশ্ন করল, চল্লিশ বছর? তিনি বললেন, আমি জবাব দিতে অস্বীকার করি। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তখন মৃত দেহগুলো এমনভাবে জীবিত হয়ে উঠবে, যেমনিভাবে (বৃষ্টির পানিতে) ঘাস-লতা ইত্যাদি গজিয়ে উঠে। অতঃপর তিনি (সা.) বলেছেন, মেরুদণ্ডের নিম্নাংশের একটি হাড় ছাড়া মানবদেহের সকল কিছুই মাটিতে গলে বিলীন হয়ে যাবে এবং কিয়ামতের দিন সেই হাড্ডি হতে গোটা দেহের পুনর্গঠন করা হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
আর মুসলিম-এর অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি (নবী সা.) বলেছেন: মাটি আদম সন্তানের প্রতিটি অংশ খেয়ে ফেলবে, তবে তার মেরুদণ্ডের নিম্নাংশ খাবে না। তা হতেই মানবদেহ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং (কিয়ামতের দিন) তা হতে তাকে পত্তন করা হবে।
الفصل الاول (بَاب النفخ فِي الصُّور )
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا بَيْنَ النَّفْخَتَيْنِ أَرْبَعُونَ» قَالُوا: يَا أَبَا هُرَيْرَةَ أَرْبَعُونَ يَوْمًا؟ قَالَ: أَبَيْتُ. قَالُوا: أَرْبَعُونَ شَهْرًا؟ قَالَ: أَبَيْتُ. قَالُوا: أَرْبَعُونَ سَنَةً؟ قَالَ: أَبَيْتُ. «ثُمَّ يَنْزِلُ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مَاءٌ فَيَنْبُتُونَ كَمَا يَنْبُتُ الْبَقْلُ» قَالَ: «وَلَيْسَ مِنَ الْإِنْسَانِ شَيْءٌ لَا يَبْلَى إِلَّا عَظْمًا وَاحِدًا وَهُوَ عَجْبُ الذَّنَبِ وَمِنْهُ يُرَكَّبُ الْخَلْقُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ» . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ. وَفِي رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ قَالَ: «كُلُّ ابْنِ آدَمَ يَأْكُلُهُ التُّرَابُ إِلَّا عَجْبَ الذَّنَبِ مِنْهُ خُلِقَ وَفِيهِ يركب»
متفق علیہ ، رواہ البخاری (4814) و مسلم (141 / 2955، (7414) و الروایۃ الثانیۃ 142 / 2955)، (7415) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (مَا بَيْنَ النَّفْخَتَيْنِ) দু' ফুঁকের মাঝে অর্থাৎ মেরে ফেলার ফুক ও জীবিত করার ফুঁকের মাঝে ব্যবধান হবে চল্লিশ।
(أَبَيْتُ) অস্বীকার করলাম। অর্থাৎ আমি জবাব দানে অপারগ হলাম। কারণ আমি জানি না কোনটি সঠিক। কাযী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এর অর্থ হলা দু ফুকের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান চল্লিশ বলতে কী বুঝানো হয়েছে তা আমি জানি না, সেটা চল্লিশ দিন, না চল্লিশ মাস, নাকি চল্লিশ বছর? তাই আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপরে মিথ্যা বলা থেকে এবং যা আমি জানি না সেটা সম্পর্কে বর্ণনা থেকে বিরত থাকলাম। ফাতহুল বারী ভাষ্যকার বলেন, (أَبَيْتُ) এর অর্থ হলো চল্লিশ সংখ্যা থেকে উদ্দেশ্য দিন, না মাস, না বছর তা নিশ্চিতভাবে বলতে রাযী হলাম না বরং আমি নিশ্চিতভাবে বললাম যে, তা শুধু চল্লিশই ছিল।
(فَيَنْبُتُونَ) বৃষ্টিতে সৃষ্টজীবের দেহগুলো গজিয়ে উঠবে। এ কথা সুস্পষ্ট যে, এ ঘটনা ঘটবে দ্বিতীয় ফুৎকার দেয়ার পরে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
(كُلُّ ابْنِ آدَمَ يَأْكُلُهُ) বানী আদম-এর দেহের সকল অংশকেই মাটি খেয়ে ফেলবে শুধু একটি হাড্ডি ব্যতীত। এটা বিশেষ হাড্ডি। যেমন বিশেষভাবে নবী-রাসূলদের দেহকে মাটিতে খাওয়া আল্লাহ তা'আলা হারাম করেছেন।
(عَجْبَ الذَّنَبِ) আইন বর্ণে যবর ও জিম বর্ণে সুকূন যোগে এটা এমন সূক্ষ্ম-মিহি হাড্ডি যা পৃষ্ঠদেশের সর্বনিন্মে অবস্থিত। আর সেটা হলো মেরুদণ্ডের হাড়ের নীচের মাথা। আদম সন্তানের এই হাড্ডি সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়। আর এ অংশটুকু অবশিষ্ট থেকে যায় যাতে তার উপর সৃষ্টজীবকে পুনরায় গঠন করা যায়। (ফাতহুল বারী ১৮ খণ্ড, হা. ২৯৫৫)
মিশকাতের (উর্দু অনুবাদে) ব্যাখ্যায় অনুরূপ লিখা হয়েছে, (عَجْبَ الذَّنَبِ) এমন হাড্ডিকে বলা হয় যেখান থেকে জানোয়ারদের লেজ বের হয়। মানব শরীরের এই হাড্ডিকে নিতম্বের হাড় বলা হয়। মানুষের সমস্ত দেহ মাটিতে মিশে যাবে কিন্তু এ হাড্ডি ব্যতীত। মায়ের পেটে মানুষকে সৃষ্টি করার সময় প্রথমে এখান থেকে শুরু করা হয়। কিয়ামতের সময় এ হাড্ডি থেকে দেহ গঠন করা শুরু হবে। সমস্ত দেহের অঙ্গগুলো এর সাথে যুক্ত হয়ে যেমন দেহ ছিল তেমনভাবে প্রস্তুত হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ - মুম্বাই ছাপা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৭৬)।
মিরকাত ভাষ্যকার বলেন, কোন হাদীসে এসেছে, এ অংশকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয় এবং এ অংশ সর্বশেষ জীর্ণ করা হয়। এর রহস্য হলো এটা মানবদেহের ভিত্তি। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - শিঙ্গায় ফুৎকার
৫৫২২-[২] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন জমিনকে মুষ্ঠির মধ্যে নিয়ে নেবেন, আর আকাশকে ডান হাতে পেঁচিয়ে নেবেন। অতঃপর বলবেন, আমিই বাদশাহ, দুনিয়ার বাদশাহগণ কোথায়? (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب النفخ فِي الصُّور )
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَقْبِضُ اللَّهُ الْأَرْضَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَطْوِي السَّمَاءَ بِيَمِينِهِ ثُمَّ يَقُولُ: أَنَا الْمَلِكُ أَيْنَ مُلُوكُ الْأَرْضِ؟ . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (4812) و مسلم (23 / 2787)، (7050) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (الْمَلِكُ) এখানে দুটি অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে। (এক) এর অর্থ ক্ষমতা। তখন সেটা আল্লাহর সত্তাগত গুণ হিসেবে গণ্য হবে। (দুই) তার অর্থ জোর খাটানো বা পরিবর্তন করা। তখন এটা কর্মগত গুণ হিসেবে ধর্তব্য হবে। এ হাদীসে আল্লাহর ডান হাতের প্রমাণ বিদ্যমান যা আল্লাহর জাতের গুণের অন্যতম। তবে তার হাত কোন মাখলুকের হাতের মতো নয়, যেমনটি মুজাসসামাহ তথা কায়াবাদীগণ আকৃতি বর্ণনা করে থাকে। এ হাদীস দ্বারা জামিয়াদের মতো খণ্ডন হয়ে যায়। কারণ সব সৃষ্টি মরে যাওয়ার পরে ধ্বংস হয়ে গেলে কোন কিছু আর মাখলুক হিসেবে থাকে না, তাহলে কিভাবে আল্লাহর কালামকে মাখলুক বলা যাবে? যখন কেউ থাকবে না তখন আল্লাহ বলবেন: আজ কার রাজত্ব? যখন কেউ উত্তর দেয়ার থাকবে না। তখন আল্লাহ তা'আলা নিজেই নিজের উত্তর দিয়ে বলবেন, প্রতাপশালী এক আল্লাহর জন্যই সবকিছু। আর যারা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ তা'আলা কথাকে সৃষ্টি করেন, অতঃপর যাকে ইচ্ছা তাকে শুনিয়ে থাকেন তাদের মতটিও এর দ্বারা বাতিল হয়ে যায়। কারণ যখন আল্লাহ তা'আলা এ কথা বলবেন তখন কোন মাখলুক জীবিত থাকবে না। সেজন্য তিনি নিজেই স্বীয় উত্তর দিয়ে বলবেন, (..لِلّٰهِ الۡوَاحِدِ الۡقَهَّارِ) “অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার অধিকারী এক ও একক আল্লাহর”- (সূরাহ্ ইউসুফ ১২: ৩৯, সোয়াদ ৩৮: ৫, আহ্ যুমার ৩৯: ৪, আল মু'মিন ৪০: ১৬)। অতএব প্রমাণ হলো যে, তিনি এসব কথা বলবেন। আর তার কথাগুলো হচ্ছে। তাঁর সত্তাগতগুণ যা মাখলুক নয়।
ইসহাক ইবনু রহ্ওয়াই বলেন: এ কথা সঠিক যে, কুল মাখলুক ধ্বংস হবার পরে আল্লাহ বলবেন, আজ কার রাজত্ব? যখন এর উত্তর কেউ দিবে না তখন আল্লাহ স্বীয় জবাবে বলবেন, (..لِلّٰهِ الۡوَاحِدِ الۡقَهَّارِ) ..”প্রবল পরাক্রান্ত এক আল্লাহর”- (সূরাহ্ আল মু'মিন ৪০: ১৬)।
হিশাম ইবনু উবায়দুল্লাহ -এর বর্ণনায় রয়েছে: তিনি বলেন, যখন সমস্ত সৃষ্টিজীব মারা যাবে এবং আল্লাহ ব্যতীত যখন কেউ বাকী থাকবে না, তখন আল্লাহ বলবেন, (لِمَنِ الۡمُلۡکُ الۡیَوۡمَ) “আজ একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কার?” (সূরাহ্ আল মু'মিন ৪০: ১৬)। কিন্তু কেউ এর উত্তর দিবে না। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা নিজের কথার জবাব নিজে দিয়ে বলবেন, (..ِلِلّٰهِ الۡوَاحِدُ الۡقَهَّارُ)। অতএব এটা আল্লাহ তা'আলার কথা এতে কারো সন্দেহ নেই। আর এটা কোন ওয়াহীও নয়। কারণ সব প্রাণ মৃত্যুর করাল গ্রাসে নিপতিত হয়েছে, অতএব আল্লাহ নিজেই এর উত্তর দিবেন। (ফাতহুল বারী ১৩ খণ্ড, হা. ৭৩৮২)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - শিঙ্গায় ফুৎকার
৫৫২৩-[৩] ’আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন আসমানসমূহকে গুটিয়ে নেবেন, অতঃপর তাকে ডান হাতে রেখে বলবেন, আমিই বাদশাহ, কোথায় দুনিয়ার অহংকারী ও স্বৈরাচারী যালিমরা? অতঃপর বাম হাতে জমিনসমূহকে গুটিয়ে নিবেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, অপর হাতে নিয়ে বলবেন, আমিই বাদশাহ, কোথায় স্বৈরাচারী অবিচার ও অহংকারীগণ। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب النفخ فِي الصُّور )
وَعَن عبد الله بن عَمْرو قَالَ: قا ل رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَطْوِي اللَّهُ السَّمَاوَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ يَأْخُذُهُنَّ بِيَدِهِ الْيُمْنَى ثُمَّ يَقُولُ: أَنَا الْمَلِكُ أَيْنَ الْجَبَّارُونَ؟ أَيْنَ الْمُتَكَبِّرُونَ؟ ثُمَّ يَطْوِي الْأَرَضِينَ بِشِمَالِهِ - وَفِي رِوَايَة: يَأْخُذُهُنَّ بِيَدِهِ الْأُخْرَى - ثُمَّ يَقُولُ: أَنَا الْمَلِكُ أينَ الجبَّارونَ أينَ المتكبِّرونَ؟ . رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (24 / 2788)، (7051) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: আল্লাহর দুই হাতকে কুদরত অর্থে প্রয়োগ করা বাতিল ব্যাখ্যা। আর এ কাজকে দুই হাত দ্বারা সমাধা করার ইঙ্গিত হাদীসে দেয়া হয়েছে। কারণ আমাদের কাজকর্ম দুই হাত দ্বারাই সম্পাদন হয়। তাই যা দিয়ে বুঝব তা দ্বারা আমাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। যাতে আমাদের অন্তকরণে বিষয়টি আরো অধিক স্পষ্ট হয়ে যায়। আর এখানে ডান ও বাম হাতের উল্লেখ হয়েছে যাতে উদাহরণটি পূর্ণতা লাভ করে। কারণ আমরা যা কিছু ভালো তা ডান হাত দ্বারা সমাধা করি এবং অন্যগুলো বাম হাত দ্বারা সম্পাদন করি। আর আমাদের ক্ষেত্রে ডান হাত বেশি শক্তিশালী যতটুকু শক্তিশালী বাম হাত নয়। বুঝা গেল, আসমানসমূহ জমিনের তুলনায় বেশি বড় তাই তাকে ডান হাতের সাথে যুক্ত করা হয়েছে এবং জমিনকে বাম হাতের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। যদিও আল্লাহর কোন হাতেই কোন কিছু ভারী নয় এবং কোন হাত দুর্বল নয়। আর আল্লাহ তা'আলা এমন গুণে গুণান্বিত নন যে, কোন কিছু তার নিকটে অধিক ভারী বা কঠিন। (শারহু নাবাবী ১৭ খণ্ড, হা, ২৭৮৮)
সহীহ মুসলিম-এর অপর বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় হাতকে মুষ্টিবদ্ধ করলেন, অতঃপর হাতকে মুড়ালেন ও খুললেন। এ হাদীস থেকে ভালোভাবে প্রমাণ হয় যে, আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে যে হাতের উল্লেখ রয়েছে তা দ্বারা হাতই উদ্দেশ্য। কিন্তু এই হাতকে কুদরতের ব্যাখ্যা করা বাতিল। এজন্য যে, নবী (সা.) সাহাবীদেরকে হাত, মুষ্টিবদ্ধ করে দেখিয়েছেন। এতে তাদের কোন আশ্চর্যের কারণ ছিল না। এতেই বুঝা গেল, সাহাবীদের ও আক্বীদাহ্ এটাই ছিল। আরো বুঝা গেল আল্লাহ তা'আলা যেমন স্বীয় সত্তার ক্ষেত্রে যেভাবে গুণান্বিত, অনুরূপভাবে হাত মুবারকের ক্ষেত্রেও তেমনভাবে গুণান্বিত। (মিশকাতুল মাসাবীহ - মুম্বাই ছাপা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৭৭)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - শিঙ্গায় ফুৎকার
৫৫২৪-[8] ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন জনৈক ইয়াহূদী পাদ্রি নবী (সা.) -এর কাছে এসে বলল, হে মুহাম্মাদ! আমরা (তাওরাতে) পেয়েছি যে, আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন আকাশমণ্ডলীকে এক আঙ্গুলের উপর স্থাপন করবেন। জমিনকে এক আঙ্গুলের উপর, পর্বতমালা ও গাছসমূহকে এক আঙ্গুলের উপর, পানি এবং কাদা-মাটিকে এক আঙ্গুলের উপর, আর অন্যান্য সমস্ত সৃষ্টিজগতকে এক আঙ্গুলের উপর রাখবেন। অতঃপর এ সমস্ত কিছুকে নাড়া দিয়ে বলবেন, আমিই বাদশাহ, আমিই আল্লাহ! ইয়াহুদী পাদ্রির কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) এই বিস্ময়ে হয়ে হেসে ফেললেন, তিনি যেন তার কথার সত্যতা স্বীকার করলেন। অতঃপর তিনি (সা.) কুরআনের এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন- (وَ مَا قَدَرُوا اللّٰهَ حَقَّ قَدۡرِهٖ ٭ۖ وَ الۡاَرۡضُ جَمِیۡعًا قَبۡضَتُهٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ السَّمٰوٰتُ مَطۡوِیّٰتٌۢ بِیَمِیۡنِهٖ ؕ سُبۡحٰنَهٗ وَ تَعٰلٰی عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ) - “আল্লাহ তা’আলার যতটুকু সম্মান করা দরকার ছিল তারা ততটুকু সম্মান করেনি, অথচ কিয়ামতের দিন সম্পূর্ণ পৃথিবী তাঁর মুষ্টিতে থাকবে এবং আকাশমণ্ডলী ডান হাতে গুটানো থাকবে। তিনি পবিত্র, তারা যাকে শরীক করে তিনি তার উর্ধ্বে"- (সূরা আয যুমার ৩৯: ৬৭)। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب النفخ فِي الصُّور )
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: جَاءَ حَبْرٌ مِنَ الْيَهُودِ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ إِنَّ اللَّهَ يُمْسِكُ السَّمَاوَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى أُصْبُعٍ وَالْأَرَضِينَ عَلَى أُصْبُعٍ وَالْجِبَالَ وَالشَّجَرَ عَلَى أُصْبُعٍ وَالْمَاءَ وَالثَّرَى عَلَى أُصْبُعٍ وَسَائِرَ الْخَلْقِ علىأصبع ثُمَّ يَهُزُّهُنَّ فَيَقُولُ: أَنَا الْمَلِكُ أَنَا اللَّهُ. فَضَحِكَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَعَجُّبًا مِمَّا قَالَ الْحَبْرُ تَصْدِيقًا لَهُ. ثُمَّ قَرَأَ: (وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّماوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يشركُونَ) مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (4811) و مسلم (19 / 2786)، (7046) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: ইয়াহুদী ‘আলিমের কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিস্মিত হয়ে হাসলেন এটা তার কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য নয় বরং তাকে সত্যায়ন করার জন্য এবং তার কথার সঠিকতাকে জানার জন্য। (وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ) এর অর্থ মানুষ আল্লাহকে যেভাবে চেনা দরকার সেভাবে চেনে না। যেভাবে সম্মান করা প্রয়োজন। সেভাবে সম্মান দেখায় না এবং যেভাবে তার উপাসনা করা উচিত সে মতো উপাসনা করে না। এ হাদীস দ্বারা আল্লাহ তা'আলার আঙ্গুলের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। যেমনভাবে কুরআন ও হাদীস থেকে তাঁর হাতের প্রমাণ রয়েছে। এর পূর্বেও বলা হয়েছে যে, আল্লাহর গুণাবলি সংক্রান্ত হাদীসগুলোর ব্যাপারে সালাফে সালিহীনদের ‘আক্বীদাহ্ এই যে, তারা এসব হাদীসকে প্রকাশ্য অর্থের উপর গ্রহণ করেন এবং তার উপর ঈমান আনেন।
আল্লাহ তা'আলার আকৃতিতে আল্লাহ তা'আলার ওপর সোপর্দ করেন এবং সাদৃশ্য প্রদান থেকে বিরত থাকেন। কোন কোন যুক্তিবিদ বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইয়াহুদী ‘আলিমের কথাকে রদ করার জন্য হেসেছিলেন, কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। কারণ ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্উদ-সহ বড় বড় ফকীহ সাহাবী স্বয়ং এ রিওয়ায়াতে সত্যায়ন করেছেন। যদি তিনি (সা.) তার রূপদান করাকে বাধা দিতেন তাহলে নবী (সা.) এ আয়াত পাঠ করতেন না। অতএব পরিষ্কারভাবে বুঝা গেল যে, ঐ এসব যুক্তিবাদীরা চিন্তাভাবনা না করে মনের বশে পড়ে যা ইচ্ছা বলেছেন। এ ব্যাপারে সঠিক কথা হলো, আল্লাহ তা'আলার নাম ও গুণাবলি কী কী তা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। অর্থাৎ যেসব নাম ও গুণাবলি কুরআন ও হাদীসে এসেছে সেগুলো স্বীকার করা এবং যা প্রমাণিত নয় তা না বলা উচিত। (মিশকাতুল মাসাবীহ মুম্বাই ছাপা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৭৮)।
ক্বাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় আঙ্গুলকে মুষ্টিবদ্ধ করলেন এবং সম্প্রসারিত করলেন আসমান ও জমিনকে মুষ্টিবদ্ধ ও সম্প্রসারিত করা হবে শুধুমাত্র মাখলুকের সাথে এর উদাহরণ দেয়ার জন্য।
তিনি আরো বলেন: আল্লাহ তা'আলার গুণাবলি সম্পর্কিত মুশকিল হাদীসগুলোর দ্বারা নবী (সা.)-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহই অধিক অবগত। আমরা আল্লাহ ও তার গুণাবলির উপর বিশ্বাস রাখি। তার সাথে কোন কিছুর সাদৃশ্য দেই না। কারণ কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে,
(لَیۡسَ کَمِثۡلِهٖ شَیۡءٌ ۚ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ) - “কোন কিছুই তাঁর সাদৃশ্য নয়, তিনি সব শোনেন, সব দেখেন”- (সূরাহ আশ শূরা ৪২: ১১)। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) যা বলেছেন এবং তাঁর কাছ থেকে যা নিশ্চিত হয়েছেন তা সঠিক ও সত্য। তার জ্ঞান সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানব তা মহান আল্লাহরই অনুগ্রহে আর যা আমাদের নিকটে অস্পষ্ট থাকবে তার উপর আমরা ঈমান আনব। আর এর প্রকৃত জ্ঞানকে মহান আল্লাহর। নিকটে সোপর্দ করব। (শারহুন নাবাবী ১৭ খণ্ড, হা. ২৭৮৮)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - শিঙ্গায় ফুৎকার
৫৫২৫-[৫] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে এ আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম (يَوْمَ تُبَدَّلُ الأرضُ غيرَ الأَرْض والسَّماواتُ) “যেদিন এ জমিনকে আরেক জমিনে রূপান্তরিত করা হবে এবং আকাশমণ্ডলীকে আরেক আকাশে”- (সূরাহ ইবরাহীম ১৪: ৪৮)। সেদিন সকল মানুষ কোথায় থাকবে? তিনি বললেন, ’পুলসিরাতের উপর। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب النفخ فِي الصُّور )
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: سَأَلَتْ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ قَوْلِهِ: (يَوْمَ تُبَدَّلُ الأرضُ غيرَ الأَرْض والسَّماواتُ) فَأَيْنَ يَكُونُ النَّاسُ يَوْمَئِذٍ؟ قَالَ: «عَلَى الصِّرَاطِ» . رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (29 / 2791)، (7056) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (تُبَدَّلُ الأرضُ...) শারহুস্ সুন্নাতে রয়েছে (تُبَدَّلُ) বলা হয় কোন জিনিসের অবস্থার পরিবর্তন হওয়া এবং (إِبْدَال) বলা হয় কোন কিছুকে অন্য জায়গায় স্থাপন করা।
‘আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: এ পরিবর্তন কখনো সত্তা বা অস্তিত্বে হয়ে থাকে। যেমন তোমার কথা (بَدَّلْتُ الدَّرَاهِمَ دَنَانِيرَ) আমি দিরহামকে দীনারে পরিবর্তন করলাম। আবার কখনো পরিবর্তন গুণের মধ্যে হয়ে থাকে। যেমন তোমার কথা (بَدَّلْتُ الْحَالَقَةَ خَاتَمًا) আমি আংটাকে আংটিতে রূপান্তরিত করলাম। যখন তুমি সেটাকে গলিয়ে আংটিতে পরিবর্তন করবে। জমিনের পরিবর্তন নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, এ পরিবর্তনটা আসমান-জমিনের গুণের মধ্যে হবে। যেমন শিঙ্গার প্রসিদ্ধ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, নবী (সা.) বলেছেন: আল্লাহ তা'আলা জমিনকে সমতল করে উকাযী চামড়ার মতো টানবেন যাতে কোন উচু নীচু না থাকে। আবার কেউ বলেন, পরিবর্তনটা অস্তিত্বে হবে। তখন জমিনকে অন্য এক অপরিচিতরূপে পরিবর্তন করা হবে। আবদুল্লাহ ইবনু মাস'ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি মারফু হাদীসে রয়েছে মানুষকে সাদা রঙের জমিনের উপর জমায়েত করা হবে তাতে খুনাখুনি ও পাপের কাজ হবে না। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
সাহল ইবনু সা'দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: কিয়ামতের দিন মানুষকে চ্যাপ্টা ও গোলাকার রুটির মতো সাদা মাটির জমিনে একত্রিত করা হবে। যেখানে কারো কোন চিহ্ন থাকবে না। (সহীহুল বুখারী)
‘আমর ইবনু মায়মূন (রাঃ) বলেন: এ জমিন পরিবর্তিত হয়ে যাবে এবং তা হবে সাদা রূপার মতো যাতে থাকবে না কোন রক্তারক্তি, না থাকবে কোন পাপকর্ম। ইবনু জারীর (রহিমাহুল্লাহ)-এর বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: সেদিন জমিন রৌপ্যের ন্যায় সাদা বরণ ধারণ করবে। আরেক বর্ণনায় রয়েছে, ঐ দিন জমিন ময়দার ন্যায় সাদা হবে। ‘আলী (রাঃ) বলেন, সেদিন জমিন হবে রৌপ্যের এবং আসমান হবে স্বর্ণের। উবাই ইবনু কা'ব (রাঃ) বলেন, সেদিন আসমান বাগান হয়ে থাকবে।
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্'উদ (রাঃ) বলেন, কিয়ামতের দিন সারা জমিন আগুন হয়ে যাবে। এর পিছনে থাকবে জান্নাত, যার নি'আমাতরাশি বাইরে থেকে দেখা যাবে। (তাফসীর ইবনু কাসীর ৪র্থ খণ্ড, মাকতাবাতুস্ সফা, সূরাহ্ ইবরাহীম ৪৮ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
(الصِّرَاطِ) জাহান্নামের উপরে অবস্থিত পুলকে সিরাত বলা হয়। যখন মানুষেরা হিসাবের জন্য অবস্থানস্থল ত্যাগ করার পর পুলের নিকট অন্ধকারে পৌছবে। যেমন ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে জিজ্ঞেস করা হলো যখন আসমান-জমিনকে পরিবর্তন করা হবে তখন মানুষেরা কোথায় থাকবে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তারা পুলের নিকট অন্ধকারের মধ্যে থাকবে। আর এ স্থানে মুনাফিকরা মু'মিনদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে এবং মুমিনদের পিছে পড়বে ও মু'মিনরা এগিয়ে যাবে। তাদের মাঝে একটা দেয়ালের আড় হয়ে যাবে যাতে তারা মু'মিনদের নিকটে পৌছতে বাধাপ্রাপ্ত হয় । ইমাম বায়হাক্বী (রহিমাহুল্লাহ) মাসরূক-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা'আলা মানুষদেরকে কিয়ামতের দিন সমবেত করবেন, অতঃপর তাদেরকে স্বীয় ‘আমলের পরিমাণ অনুসারে নূর দান করবেন, কাউকে এর চাইতেও বেশি, কাউকে তার ডান হাতে খেজুর গাছের সমান দান করবেন, কাউকে তার ডান হাতে এর চাইতে কম। এমনকি সর্বশেষ জনকে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে নূর দান করা হবে যা একবার জ্বলে উঠবে আর একবার নিভে যাবে। যখন তা আলো দিবে তখন সে তার পা এগিয়ে নিবে। আর যখন নিভে যাবে সে দাড়িয়ে পড়বে। তারপর সে এবং অন্যরা পুলসিরাত পার হবে। পুল হবে তরবারির ধারের মত পিচ্ছিল ও স্খলনকারী।
তাদেরকে বলা হবে, তোমরা তোমাদের নূর অনুসারে পার হও। তাদের মধ্যে কেউ তারকা ছুটার গতির ন্যায়, কেউ বাতাসের গতির মতো, কেউ চোখের পলকে, আবার কেউ পুরুষদের দৌড়ের গতিতে। আবার কেউ ধীরে দৌড়ে পার হয়ে যাবে। তারা সবাই আমল অনুযায়ী পার হবে। এভাবে শেষে এক ব্যক্তি আসবে যার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের উপরে নূর থাকবে। এক হাত পড়ে যাবে আর এক হাত লেগে থাকবে এক পা পড়ে যাবে এবং এক পা লেগে থাকবে। আগুন তার পার্শ্বদেশকে ধরে ফেলবে। রাবী বলেন: অতঃপর তারা মুক্তি পাবেন। যখন তারা এখান থেকে রেহাই পাবে তখন তারা বলবে, আলহামদুলিল্লা-হ সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমাদেরকে তোমার কাছ থেকে মুক্তি দিয়েছেন তোমাকে দেখিয়ে দেয়ার পর। আর অবশ্যই আল্লাহ তা'আলা আমাদের এমন বস্তু দিয়েছেন যা আর কাউকে প্রদান করেননি। (হাকিম হা. ৩৪২৪, ৮৭৫১; শারহুল আকীদাতুত্ তহাবীয়া পৃ. ৩৪১-৪২)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - শিঙ্গায় ফুৎকার
৫৫২৬-[৬] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: কিয়ামতের দিন সূর্য ও চন্দ্রকে পেঁচিয়ে নেয়া হবে। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب النفخ فِي الصُّور )
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ مُكَوَّرَانِ يَوْم الْقِيَامَة» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (3200) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (التَّكْوِير) অর্থ (اللَّفُّ) গুটানো, জড়ানো, মোড়ানো। এখান থেকেই (تَكْوِيرُ الْعِمَامَةِ) (পাগড়ি পেঁচানো)। আল্লাহ তা'আলা বলেন, (یُکَوِّرُ الَّیۡلَ عَلَی النَّهَارِ) “রাত দিনকে ঢেকে নেয়”- (সূরা আয যুমার ৩৯: ৫)।
এটা একত্রিত হওয়ার অর্থে ব্যবহৃর হয়। যেমন কুরআনে এসেছে, (وَ جُمِعَ الشَّمۡسُ وَ الۡقَمَرُ) “সূর্য আর চাঁদকে একত্রে জুড়ে দেয়া হবে”- (সূরাহ আল কিয়া-মাহ্ ৭৫:৯)।
‘আল্লামাহ্ তুরিবিশতী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: এখানে কয়েক অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে- (এক) একত্রিত হওয়া বা মোড়ানো অর্থে। (দুই) উত্তোলন অর্থে। (তিন) যখন কোন কিছুকে নিক্ষেপ করে তখন তারা বলে, (طَعْنَةٌ مُكَوَّرَةٌ مِنْ كَوَّرِهِ) অর্থাৎ সূর্য ও চন্দ্রকে নিজ কক্ষপথ থেকে নিক্ষেপ করা হবে। এই অর্থ অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা কোন কোন বর্ণনার শেষে (مُكَوَّرَانِ فِي النَّارِ) “জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে” রয়েছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
ইবনু ওয়াহহাব কিতাবুল আহওয়ালে’ ‘আত্বা ইবনু ইয়াসার-এর সূত্রে আল্লাহর বাণী (وَ جُمِعَ الشَّمۡسُ وَ الۡقَمَرُ) “সূর্য আর চাঁদকে একত্রে জুড়ে দেয়া হবে”- (সূরাহ্ আল কিয়া-মাহ্ ৭৫: ৯); এর ব্যাখ্যায় বলেন, কিয়ামতের দিন চন্দ্র-সূর্যকে একত্রিত করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ দুটোকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশে জাহান্নামে ফেলা হবে না। বরং দুনিয়াতে যারা এ দুটোর ইবাদত করেছে, তাদেরকে তিরস্কার করার জন্য। যাতে তারা বুঝতে পারে যে, চন্দ্র ও সূর্যের 'ইবাদত করা বাতিল ছিল। কেউ কেউ বলেন, এ দুটোকে জাহান্নাম থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সেথায় আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। (ফাতহুল বারী হা. ৩২০০)
সূর্য ও চন্দ্রকে জড়ানো হবে যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং এ পৃথিবী ধ্বংস হবে। তখন আর আলোর কোন প্রয়োজন থাকবে না। আর দ্বিতীয় কারণ এই যে, এগুলোর ক্ষতি ও ধ্বংসের কারণে এর উপাসনাকারীরা লজ্জিত হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ - মুম্বাই ছাপা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৭৮)
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - শিঙ্গায় ফুৎকার
৫৫২৭-[৭] আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আমি কিভাবে আরাম-আয়েশে থাকতে পারি? অথচ শিঙ্গাওয়ালা (ইসরাফীল আলাইহিস সালাম) শিঙ্গা মুখে দাবিয়ে রেখেছেন, কান ঝুঁকিয়ে রেখেছেন, মাথা নুয়ে রেখেছেন। তিনি কেবল এ প্রতীক্ষায় রয়েছেন যে, তাতে ফুঁক দেয়ার জন্য কখন নির্দেশ দেয়া হয়। এ কথা শুনে লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! যখন অবস্থা এমনই, তাহলে আমাদেরকে কি করতে আদেশ দেন? তিনি (সা.) বললেন, তোমরা (حَسْبُنَا اللَّهُ ونِعمَ الْوَكِيل) (আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কার্য নির্বাহক) পড়তে থাক। (তিরমিযী)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب النفخ فِي الصُّور)
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «كَيْفَ أَنْعَمُ وَصَاحِبُ الصُّورِ قَدِ الْتَقَمَهُ وَأَصْغَى سَمْعَهُ وَحَنَى جَبْهَتَهُ يَنْتَظِرُ مَتَى يُؤْمَرُ بِالنَّفْخِ» . فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا تَأْمُرُنَا؟ قَالَ: قُولُوا: حَسْبُنَا اللَّهُ ونِعمَ الْوَكِيل . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
سندہ ضعیف ، رواہ الترمذی (2431 وقال : حسن ، 3243) * عطیۃ العوفی ضعیف
ব্যাখ্যা: (أَنْعَمُ) অর্থাৎ আমি খুশিতে থাকব কিভাবে? বা সুখী জীবন নিয়ে স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন করব কিভাবে? নিহায়াতে রয়েছে, এটা (نَعْمَة) (নূনে যবর যোগে) থেকে গৃহীত, এর অর্থ সুখ, আনন্দ, বিলাসিতা। (التقام) (মুখে বাঁশির মাথা রাখা) এবং (إِصْغَاءِ) (মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা)।
ক্বাযী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: এর অর্থ কিভাবে আমার জীবনযাপন সুখের হবে অথচ শিঙ্গায় ফুঁক দেয়ার সময় অতি আসন্ন। এর দ্বারা এ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, বাঁশিওয়ালা তার মুখে বাঁশির মাথাকে রেখে প্রতিক্ষা করছে যাতে সে নির্দেশ দেয়া মাত্র ফুঁ দিতে পারে।
(حَسْبُنَا اللَّهُ) এটা মুবতাদা ও খবর অর্থাৎ (كَفِينَا اللَّهُ) “আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট”। এখানে (مَخْصُوصُ بِالْمَدْح) উহ্য রয়েছে। যা মূলত ছিল (نِعْمَ الْمَوْكُولُ إِلَيْهِ اللَّهُ) মহাশক্তিশালী হিসেবে আল্লাহ উত্তম। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৬ষ্ঠ খণ্ড, হা. ২৪৩১)
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - শিঙ্গায় ফুৎকার
৫৫২৮-[৮] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন: ’সূর’ হলো একটি শিং যাতে ফুঁ দেয়া হবে। (তিরমিযী, আবূ দাউদ ও দারিমী)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب النفخ فِي الصُّور)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «الصُّورُ قَرْنٌ يُنْفَخُ فِيهِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَالدَّارِمِيُّ
اسنادہ ضعیف ، رواہ الترمذی (2430 وقال : حسن صحیح) و ابوداؤد (4742) و الدارمی (2 / 325 ح 2801)
ব্যাখ্যা: (قَرْنٌ يُنْفَخُ) অর্থাৎ শিঙ্গায় ইসরাফীল আলায়হিস সালাম দু’বার ফুৎকার দিবেন। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৬ষ্ঠ খণ্ড, হা. ২৪৩০)
কেউ কেউ বলেন, শিঙ্গার মাথা আসমান ও জমিনের প্রস্থতার সমান। কেউ কেউ বলেন, শিঙ্গার মাথা আসমান ও জমিনের প্রস্থতার সমপরিমাণ গোলাকার। (মিশকাতুল মাসাবীহ - মুম্বাই ছাপা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৭৯)।
পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ - শিঙ্গায় ফুৎকার
৫৫২৯-[৯] ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলার বাণী- (فإِذا نُقر فِي النَّاقور) “যেদিন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে”- (সূরাহ্ আল মুদ্দাসসির ৭৪: ৮)-এর মধ্যে (نَاقُورِ) (না-কূর) দ্বারা শিঙ্গা এবং (یَوۡمَ تَرۡجُفُ الرَّاجِفَۃُ ۙ) সেদিন ভূকম্পন প্রকম্পিত করবে”- (সূরা আন্ নাযি’আত ৭৯:৬)। এর মধ্যে (الرَّاجِفَۃُ ۙ) (রা-জিফাহ) দ্বারা প্রথম ফুৎকার এবং (تَتۡبَعُهَا الرَّادِفَۃُ ؕ) “তারপর আসবে আরেকটি ভূকম্পন”- (সূরা আন্ নাযি’আত ৭৯: ৭) (الرَّادِفَۃُ ؕ) (রা-দিফাহ) দ্বারা দ্বিতীয় ফুৎকারের অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। (বুখারী)
اَلْفصْلُ الثَّالِثُ (بَاب النفخ فِي الصُّور)
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ فِي قَوْلِهِ تَعَالَى (فإِذا نُقر فِي النَّاقور) : الصّور قَالَ: و (الرجفة) : النَّفْخَةُ الْأُولَى وَ (الرَّادِفَةُ) : الثَّانِيَةُ. رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ فِي تَرْجَمَة بَاب
رواہ البخاری (کتاب الرقاق باب 43 قبل ح 6517 تعلیقًا) * اسندہ ابن جریر فی تفسیرہ (29 / 95) و سندہ ضعیف ، علی بن ابی طلحۃ عن ابن عباس : منقطع کما تقدم 5117) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (نَاقُورِ) থেকে উদ্দেশ্য শিঙ্গা। আয়াতের অর্থ হলো যখন শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে সেদিন কাফিরদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে। (یَوۡمَ تَرۡجُفُ الرَّاجِفَۃُ ۙ) আয়াতে (راجِفَةُ) থেকে উদ্দেশ্য হলো এতে পৃথিবী ও পাহাড় নড়ে উঠবে এবং কম্পিত হবে। (راجِفَةُ) শব্দটি (رجف) থেকে বের হয়েছে। যার অর্থ নড়াচড়া করা, প্রকম্পিত হওয়া। (تَتۡبَعُهَا الرَّادِفَۃُ ؕ) আয়াতে (رَادِفَةُ) থেকে উদ্দেশ্য দ্বিতীয় ফুৎকার যা প্রথমটির পরে হবে। এর অর্থ একটি বস্তুর পরে আরেকটি পৌছা। (মিশকাতুল মাসাবীহ - মুম্বাই ছাপা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৭৯)
‘আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (الرَّاجِفَۃُ) হলো সে মহাপ্রলয় যখন আসমান জমিন প্রকম্পিত হবে। আর সেটা প্রথম ফুৎকারের সময় ঘটিতব্য অবস্থা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। আর (الرَّادِفَۃُ ؕ) হলো সে মহাঘটনা যা প্রথমটার পরে সংঘটিত হবে। আর সেটা হচ্ছে দ্বিতীয় ফুৎকার।
(الصُّورُ) এর আলোচনা কুরআনের সূরাহ্ আ'আম, মু'মিনূন, নামল, যুমার, কাফ বিভিন্ন সূরায় একাধিকবার বর্ণিত হয়েছে। শব্দটি সোয়াদ বর্ণে পেশ ও ওয়াও বর্নে সুকূনযোগে। এভাবে প্রসিদ্ধ কিরাআতে ও হাদীসসমূহে রয়েছে। এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, দেহসমূহে ফুৎকার দেয়ার উদ্দেশ্য হলো যাতে আত্মাগুলো দেহে ফিরে আসে। তবারী একদল মানুষ থেকে বর্ণনা করে বলেন, তারা বলেন: শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া থেকে উদ্দেশ্য হলো দেহসমূহে যাতে আত্মাগুলো ফিরে আসে। যেমন আল্লাহ বলেন (وَ نَفَخۡتُ فِیۡهِ مِنۡ رُّوۡحِیۡ) “আর তাতে আমার পক্ষ হতে রুহ ফুঁকে দেব”- (সূরা আল হিজর ১৫: ২৯, সোয়াদ ৩৮:৭২)।
আবূ শায়খ ‘কিতাবুল উযমায় ওয়াহ্ ইবনু মুনাব্বিহ-এর সূত্রে বলেন, আল্লাহ তা'আলা শিঙ্গাকে সৃষ্টি করেছেন সাদা মতি দ্বারা নির্মল কাঁচপাত্রে, অতঃপর ‘আরশকে বললেন, শিঙ্গাকে নিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে। তারপর বললেন, (كن) (হয়ে যাও)। এতে ইসরাফীল আলায়হিস সালাম সৃষ্টি হলেন। অতঃপর তিনি ইসরাফীলকে শিঙ্গা নিয়ে থাকার জন্য নির্দেশ দিলে তিনি তা গ্রহণ করলেন। তাতে সৃষ্টিকুলের রূহ সংখ্যক ছিদ্র রয়েছে। তারপর তিনি লম্বা হাদীস বর্ণনা করলেন। এতে আছে সমস্ত আত্মাকে শিঙ্গায় জমা করা হবে। অতঃপর আল্লাহ ইসরাফীল আলায়হিস সালাম-কে আদেশ দিলে তাতে ফুৎকার দিবেন। ফলে সব আত্মা দেহে প্রবেশ করবে। এভাবে প্রথমে শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। (ফাতহুল বারী ১১ খণ্ড, ৪৩ নং অধ্যায় باب نفخ الصور এর তা'লীক)
পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ - শিঙ্গায় ফুৎকার
৫৫৩০-[১০] আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) শিঙ্গা ফুৎকারকারীর (অর্থাৎ ইসরাফীল-এর) বর্ণনায় বলেছেন, তার ডান পার্শ্বে জিবরীল আলায়হিস সালাম এবং বাম পার্শ্বে মীকাঈল আলায়হিস সালাম থাকবেন।
اَلْفصْلُ الثَّالِثُ (بَاب النفخ فِي الصُّور)
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ: ذَكَرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَاحِبُ الصُّورِ وَقَالَ: «عَن يَمِينه جِبْرِيل عَن يسَاره مِيكَائِيل»
ضعیف ، رواہ رزین (لم اجدہ) [و ابوداؤد (3999)] * عطیۃ العوفی ضعیف ۔
(ضَعِيف)
ব্যাখ্যা: তাফসীরে বায়যাবীতে (جِبْريْل) (জিবরীল) সম্বন্ধে আট রকম শব্দ রয়েছে। যার মধ্যে ৪টি প্রসিদ্ধ- [جِبْرءِيْل(١) جِبْرِيْلُ (٢) جِبَْرَءِيْلُ (٣) جَبْرِيْلُ (٤)] ('আওনুল মাবুদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, হা. ৩৯১১ ও ৯২)
পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ - শিঙ্গায় ফুৎকার
৫৫৩১-[১১] আবূ রযীন আল ’উক্কায়লী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তা’আলা তাঁর সৃষ্টিজগতকে কিভাবে পুনরুত্থান করবে, তার সৃষ্টির মধ্যে তার কোন চিহ্ন আছে কি? তিনি (সা.) বললেন, আচ্ছা বল দেখি। তুমি কি তোমার এলাকার (খরার সময়) কোন তৃণ মাঠের উপর দিয়ে অতিক্রম করনি? অতঃপর (বৃষ্টি বর্ষণের পরে) যখন তুমি সেই মাঠের উপর দিয়ে চলাচল কর তখন তা বাতাসে দোলায়িত তরতাজা ঘাস ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়? আমি বললাম, হ্যা দেখেছি। এবার তিনি (সা.) বললেন, আল্লাহর সৃষ্টিজগতে এটাই তার বাস্তব নিদর্শন। এভাবেই আল্লাহ তা’আলা মৃতকে জীবিত করবেন। (হাদীস দুটি রযীন রিওয়ায়াত করেছেন)
اَلْفصْلُ الثَّالِثُ (بَاب النفخ فِي الصُّور)
وَعَن أبي رزين الْعقيلِيّ قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ يُعِيدُ الله الْخلق؟ مَا آيَةُ ذَلِكَ فِي خَلْقِهِ؟ قَالَ: «أَمَا مَرَرْتَ بِوَادِي قَوْمِكَ جَدْبًا ثُمَّ مَرَرْتَ بِهِ يَهْتَزُّ خَضِرًا؟» قُلْتُ: نَعَمْ. قَالَ: فَتِلْكَ آيَةُ اللَّهِ فِي خلقه (كَذَلِك يحيي اللَّهُ الْمَوْتَى) رَوَاهُمَا رزين
اسنادہ حسن ، رواہ رزین (لم اجدہ) [و احمد (4 / 11 ، 12 ح 16294 ، 16297)
ব্যাখ্যা: (جَدُبٌ) যেটা (الْخِصْبُ) (উর্বর)-এর বিপরীত। ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (يَهْتَزُّ) অবস্থাসূচক বাক্য (خَضِرًا) শব্দটি (تَمْيِيز) এর ভিত্তিতে নসব হয়েছে। উপত্যকার গাছপালার সাথে (اهْتِزَازَ) শব্দের ব্যবহার দ্বারা সুন্দর চিত্রের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। যেমন বলা হয় (اهْتَزَّفُلَانٌ فَرَحًا) (অমুক ব্যক্তি আনন্দে আলোড়িত হয়েছে) অর্থাৎ সে কারণে চঞ্চল হয়েছে।
আর যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে চঞ্চল হয় এবং আনন্দিত হয় সে তখন শিহরিত হয়। (فَتِلْكَ آيَةُ اللَّهِ) অর্থাৎ তার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতার নিদর্শন। আল্লাহ তা'আলা বলেন, ( وَ هُوَ الَّذِیۡ یَبۡدَؤُا الۡخَلۡقَ ثُمَّ یُعِیۡدُهٗ وَ هُوَ اَهۡوَنُ عَلَیۡهِ) “তিনিই সৃষ্টির সূচনা করেন, অতঃপর তার পুনরাবৃত্তি করেন আর তা তার জন্য খুবই সহজ”- (সূরা আর রূম ৩০: ২৭)।
(کَذٰلِکَ یُحۡیِ اللّٰهُ الۡمَوۡتٰی) “এভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবন দান করেন”- (সূরা আল বাকারাহ ২: ৭৩)। সুস্পষ্ট কথা হল- এসব আয়াত আল্লাহ তা'আলার ক্ষমতার চিহ্নের প্রমাণস্বরূপ। ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, নতুনভাবে সৃষ্টি করা এবং পুনরায় সৃষ্টি করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহ তা'আলার বাণী-
(قُلۡ یُحۡیِیۡهَا الَّذِیۡۤ اَنۡشَاَهَاۤ اَوَّلَ مَرَّۃٍ ؕ وَ هُوَ بِکُلِّ خَلۡقٍ عَلِیۡمُۨ) “বল, তাকে তিনিই জীবন্ত করবেন যিনি ওগুলোকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন, আর তিনি প্রতিটি সৃষ্টি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অবগত- (সূরাহ্ ইয়া-সীন ৩৬: ৭৯)। অর্থাৎ নতুন সূচনা এবং পুনরাবৃত্তির প্রত্যেকটির ব্যাপারে জ্ঞান রাখেন। এ হাদীসের মতো অর্থ আল্লাহ তা'আলার আয়াতে বিদ্যমান। যেমন- তিনি বলেন, (فَانۡظُرۡ اِلٰۤی اٰثٰرِ رَحۡمَتِ اللّٰهِ کَیۡفَ یُحۡیِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِهَا ؕ اِنَّ ذٰلِکَ لَمُحۡیِ الۡمَوۡتٰی ۚ وَ هُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ) “অতএব আল্লাহর রহমতের ফল দেখে নাও, কিভাবে তিনি ভূমিকে তার মৃত্যুর পর জীবিত করেন, এভাবেই নিশ্চয় তিনি মৃতকে জীবিত করবেন, কেননা সব কিছুর উপর তিনি সর্বশক্তিমান”- (সূরা আর রূম ৩০: ৫০)। মানে যিনি মৃত্যু জমিনকে জীবিত করতে পারেন তিনিই মানুষকে মরার পরে জীবিত করতে ক্ষমতা রাখেন। তিনিই সব নির্ধারিত বস্তুর উপর ক্ষমতাবান। সৃষ্টির দলীলের উপর ভিত্তি করেই বলা যায় যে, তিনি সামগ্রিক ক্ষমতার অধিকারী। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাশর
৫৫৩২-[১] সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: কিয়ামতের দিন মানবমণ্ডলীকে লাল-শ্বেত মিশ্রিত এমন এক সমতল ভূমিতে একত্রিত করা হবে যেমন তা সাফাই করা আটার রুটির মতো। সে জমিনে কারো (ঘর বা ইমারতের) কোন চিহ্ন থাকবে না। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَشْر)
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يُحْشَرُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى أَرْضٍ بَيْضَاءَ عَفْرَاءَ كَقُرْصَةِ النَّقِيِّ لَيْسَ فِيهَا عَلَمٌ لأحدٍ» . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (6521) و مسلم (28 / 2790)، (7055) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (أَرْضٍ عَفْرَاءَ) খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (الْعَفَرُ) হলো সাদা যা তুষারশুভ্র নয়। কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (الْعَفَرُ) এমন সাদা যাকে কিছুটা লাল করা হয়। এজন্য বলা হয়, (عَفَرُالْأَرْضِ) তা হচ্ছে জমিনের উপরিভাগ। ইবনু ফারিস বলেন, (عَفْرَاءَ) অর্থ নির্ভেজাল সাদা। দাউদী বলেন, (شَدِيدَةُ الْبَيَاضِ) প্রচুর সাদা। তিনি বলেন, প্রথম অর্থটি অধিক নির্ভরযোগ্য।
(كَقُرْصَةِ ا لنَّقِيِّ) আটা যা ভেজাল ও আবর্জনামুক্ত। এটা খত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ)-এর মত।
(لَيْسَ فِيهَا مَعْلَمٌ لِأَحَدٍ) অন্য বর্ণনায় (مَعْلَم) রয়েছে। (عَلَمٌ) ও (مَعْلَم) একই অর্থে ব্যবহার হয়। খত্তাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো চিহ্ন। (مَعْلَم) মীম ও লাম বর্ণের যবর এবং এ দুটোর মাঝে ‘আইন সাকিন। আর তা এমন জিনিস যার দ্বারা পথের নির্দেশনা লাভ করা যায়। কাযী ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ)। বলেন, উদ্দেশ্য হলো তাতে কোন বসবাস, বাড়িঘর বা প্রাচীন ঐতিহ্যের কোন চিহ্ন নেই। আর নেই তাতে এমন কোন প্রকারের নিদর্শন যাতে পথের দিশা পাওয়া যায়। যেমন- পাহাড় বা স্পষ্ট বড় প্রস্তরখণ্ড। আবূ মুহাম্মাদ ইবনু জামরাহ্ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন- এতে আল্লাহর মহান ক্ষমতার দলীল রয়েছে। আর এর দ্বারা কিয়ামত দিবসের আনুসাঙ্গিক বিষয়াদি জানানো যায়। যাতে শ্রোতারা জাগ্রত জ্ঞানসম্পন্ন হতে পারে এবং এ বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। কারণ কোন কিছুতে পতিত হওয়ার পূর্বে তার বিশেষ বিষয়াদি সম্পর্কে জানা থাকলে অন্তরকে প্রস্তুত ও উদ্দীপ্ত করা যায়। হঠাৎভাবে আপতিত হতে হয় না। সে দিনটা হবে ন্যায়নীতি কায়িম করার দিন ও হক প্রকাশের দিন। অতএব হিকমতের দাবী হলো যে স্থানে এসব কিছু হবে সে স্থানটা গুনাহ ও যুলুমের কর্মকাণ্ডমুক্ত থাকবে। আর এতে মু'মিন বান্দাদের নিকটে আল্লাহ তা'আলা তার মর্যাদার সাথে উপযুক্ত জমিনে সমাসীন হবেন। কারণ সেখানে কর্তৃত্ব শুধুমাত্র এক আল্লাহর জন্য নিবেদিত ও নির্ধারিত, আর সে স্থান শুধুমাত্র তার জন্য হওয়াই সমীচিন। [সংক্ষেপিত] (ফাতহুল বারী ১১ খণ্ড, হা. ৬৫২১)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাশর
৫৫৩৩-[২] আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: কিয়ামতের দিন দুনিয়ার এই জমিনটি হবে একটি রুটির মতো, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাকে হাতের মাঝে নিয়ে এমনভাবে উলট-পালট করবেন যেমন তোমাদের কেউ সফর অবস্থায় তাড়াতাড়ি করে এই হাতে সেই হাতে নিয়ে রুটি তৈরি করে এবং এই রুটি দিয়ে জান্নাতবাসীদের আপ্যায়ন করা হবে। নবী (সা.) -এর আলোচনা এ পর্যন্ত পৌছলে তখন জনৈক ইয়াহুদী এসে বলল, হে আবূল কাসিম ! আল্লাহ তা’আলা আপনাকে কল্যাণ দান করুন। আমি কি আপনাকে অবগত করব না যে, (তাওরাতে উল্লেখ আছে,) কিয়ামতের দিন জান্নাতবাসীদেরকে কি বস্তু দিয়ে সর্বপ্রথম আপ্যায়ন করা হবে? তিনি (সা.) বললেন, হ্যা, বল! সে বলল, এ জমিন হবে একটি রুটি, যেরূপ নবী (সা.) বলেছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, ইয়াহূদীর কথা শুনে নবী (সা.) আমাদের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসলেন যে, তাঁর চোয়ালের দাঁত পর্যন্ত প্রকাশ হয়ে পড়ল। অতঃপর ইয়াহুদী বলল, আমি কি আপনাকে জানাব না যে, সে খাদ্যের তরকারি কি হবে? তা হবে বালাম ও নূন। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, এটা আবার কী? সে বলল, ষাঁড় ও মাছ। সে দু’টির কলিজার উপরের অতিরিক্ত যে মাংস তা সত্তর হাজার লোকে খাবে। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَشْر)
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «تَكُونُ الْأَرْضُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ خُبْزَةً وَاحِدَةً يَتَكَفَّؤُهَا الْجَبَّارُ بِيَدِهِ كَمَا يَتَكَفَّأُ أَحَدُكُمْ خُبْزَتَهُ فِي السّفر نُزُلاً لِأَهْلِ الْجَنَّةِ» . فَأَتَى رَجُلٌ مِنَ الْيَهُودِ. فَقَالَ: بَارَكَ الرَّحْمَنُ عَلَيْكَ يَا أَبَا الْقَاسِمِ أَلَا أُخبرُك بِنُزُلِ أهل الجنةِ يومَ القيامةِ؟ قَالَ: «بَلَى» . قَالَ: تَكُونُ الْأَرْضُ خُبْزَةً وَاحِدَةً كَمَا قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. فَنَظَرَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَيْنَا ثُمَّ ضَحِكَ حَتَّى بَدَتْ نَوَاجِذُهُ ثُمَّ قَالَ: أَلَا أُخْبِرُكَ بِأَدَامِهِمْ؟ بَالَامٌ وَالنُّونُ. قَالُوا: وَمَا هَذَا؟ قَالَ: ثَوْرٌ وَنُونٌ يَأْكُلُ مِنْ زَائِدَةِ كَبِدِهِمَا سَبْعُونَ ألفا. مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (6520) و مسلم (30 / 2792)، (7057) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (خُبْزَةً) অর্থ রুটি আর তা এমন আটা যা চুলায় আগুনে জ্বালানোর পর তার গর্তে রাখা হয়। সে গর্তকে মানুষ গরম ছাই বা খাক বা মাটি বলে।
(يَتَكَفَّؤُهَا)-এর অর্থ নোয়ানো, ঝুকানো। এ থেকে ব্যবহৃর হয় (كَفَأْتُ الْإِنَاءَ) (যখন তুমি তাকে উল্টাবে)।
(خُبْزَتَهُ فِي السّفر) খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এমন রুটি যা মুসাফিরের জন্য তৈরি করা হয়। কারণ এটাকে বিছানো হয় না যেমন পাতলা রুটিকে বিছানো হয়। মূলত হাতের উপরে উলটপালট করা হয় যাতে সেটা সমান হয়।
(نُزُلاً لِأَهْلِ الْجَنَّةِ) তা হলো এমন জিনিস যা আহলে জান্নাতদের মেহমানদারী হিসেবে তৈরি করা হবে। বলা হয়, (أصلح القوم نزلهم) অর্থাৎ খাবারের পূর্বে মেহমানের জন্য তাড়াতাড়ি যা পেশ করা হয়। হাদীসের জমিনের রুটির সাদৃশ্য তার দুটি অর্থ হতে পারে (এক) সেদিন জমিনের আকৃতি বর্ণনা করা। অন্যটি হলো রুটির বর্ণনা সম্পর্কে যা জান্নাতীদের জন্য আতিথেয়তা হবে। অথবা নতুনভাবে এবং বিরাট পরিমাণের বর্ণনা সম্পর্কে।
হাফিয ইবনু হাজার (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: দুনিয়ার জমিন আগুনে পরিবর্তিত হওয়া হাক্বীকৃী বা আসল অর্থে ধরতে হবে এবং অবস্থান স্থলের ব্যক্তিদের খাদ্যের জন্য রুটিতে পরিবর্তিত হওয়াকে রূপক অর্থে গণ্য করতে হবে।
(بَالَامٌ) শব্দটির ব্যাপারে মতভেদ আছে। শব্দটি হাদীসের বর্ণনায় হিব্রু ভাষায় রয়ে গেছে। যে কারণে সাহাবীগণ শব্দটির ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। আল্লামাহ্ নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে বলেন, এটা হিব্রু ভাষা যার অর্থ বলদ।
(يَأْكُلُ مِنْ زَائِدَةِ كَبِدِهِمَا سَبْعُونَ ألفا) কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, অতিরিক্ত অংশ বলতে কলিজার সাথে যুক্ত আলাদা অংশ বুঝানো হয়েছে যা উৎকৃষ্ট। সে কারণে তা খাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে সত্তর হাজার জনকে। আর তারাই বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদেরকে উৎকৃষ্টমানের খাদ্য সামগ্রী দ্বারা আপ্যায়ন করা হবে। আর সত্তর হাজার সংখ্যা দ্বারা অধিক সংখ্যককে বুঝানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এতে কোন সীমাবদ্ধতা নেই। (ফাতহুল বারী ১১ খণ্ড, হা, ৬৫২০-২১)।
জমিন খাদ্যে রূপান্তরিত হওয়া বিবেকবিরোধী নয়। এখন জমিনের মাটি থেকে নতুন নতুন চমৎকার সাদযুক্ত ফলমূল উৎপাদন হচ্ছে। আবার আল্লাহ তা'আলা যদি জমিনকে দুধে ময়দায় রূপান্তর করেন, এটা আল্লাহর নিকটে দূরের ব্যাপার নয়। যে দলটি জমিনী রুটিকে খাবে তারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশকারী দল। তাদের চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ - মুম্বাই ছাপা, ৪র্থ খণ্ড, ৩৮১ পৃ.)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাশর
৫৫৩৪-[৩] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: (কিয়ামতের দিন) তিন ধরনের মানবমণ্ডলীর হাশর হবে। জান্নাতের আকাক্ষী, জাহান্নাম হতে ভীত-সন্ত্রস্ত; আর একদল হবে এক উটে (সওয়ারীতে) দু’জন কোন একটিতে তিনজন, কোন এক উটে চারজন, আবার কোন এক উটে দশজন ধারাক্রমে আরোহণ করবে। অবশিষ্ট আরেক দল তাদেরকে আগুনে একত্রিত করবে। দিনের বেলায় তারা যেখানে অবস্থান করবে, আগুনও সেখানে তাদের সাথে অবস্থান করবে। তারা রাতে যেখানে অবস্থান করবে, আগুনও সেখানে তাদের সঙ্গে রাত্রে অবস্থান করবে। অনুরূপভাবে ভোরে ও সন্ধ্যায় তারা যেখানে থাকবে, আগুনও তাদের সঙ্গে সেখানে থাকবে। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَشْر)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى ثَلَاثِ طَرَائِقَ: رَاغِبِينَ رَاهِبِينَ وَاثْنَانِ عَلَى بَعِيرٍ وَثَلَاثَةٌ عَلَى بَعِيرٍ وَأَرْبَعَةٌ عَلَى بَعِيرٍ وَعَشَرَةٌ عَلَى بَعِيرٍ وَتَحْشُرُ بَقِيَّتَهُمُ النَّارُ. تَقِيلُ مَعَهُمْ حَيْثُ قَالُوا وَتَبِيتُ مَعَهُمْ حَيْثُ باتو وَتُصْبِحُ مَعَهُمْ حَيْثُ أَصْبَحُوا وَتُمْسِي مَعَهُمْ حَيْثُ يمسوا . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (6522) و مسلم (59 / 2861)، (7202) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (عَلَى ثَلَاثِ طَرَائِقَ) মানুষকে তিন স্তরে জমায়েত করা হবে। (رَاغِبِينَ رَاهِبِينَ) জান্নাতের আকাক্ষী এবং জাহান্নাম থেকে ভীত, এরা প্রথম উপায়ে আসবে।
(وَاثْنَانِ عَلَى بَعِيرٍ وَثَلَاثَةٌ عَلَى بَعِيرٍ وَأَرْبَعَةٌ عَلَى بَعِيرٍ وَعَشَرَةٌ عَلَى بَعِيرٍ) সহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় সবগুলোর পূর্বে (واو) রয়েছে। তবে বুখারীর বর্ণনায় শুধু প্রথমে (واو), আছে। দু' বর্ণনায় এরা দ্বিতীয় উপায়ে জমায়েত হবে।
(تَحْشُرُ بَقِيَّتَهُمُ النَّارُ) সহীহ মুসলিম-এর অপর বর্ণনাতে কিয়ামতের পূর্বের ঘটিত নিদর্শনাদির উল্লেখ রয়েছে। যেমন পশ্চিমদিকে সূর্যোদয় হওয়া। এর শেষে আছে এগুলোর শেষে বের হবে আগুন যা এডেনের গর্ত থেকে বের হবে এবং মানুষকে খেদিয়ে প্রস্থান করাবে। তাদের সাথে আগুন অবিচ্ছিন্নভাবে থাকবে। এরা তৃতীয় উপায়ে জমায়েত হবে। খত্তাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: এ হাশর কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে হবে। মানুষদেরকে জীবিত অবস্থায় শামের দিকে জমা করা হবে। এদের ব্যাপার ইবনু আব্বাস (রাঃ) -এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে তারা খালি পায়ে বিবস্ত্র হয়ে পায়ে হেটে আসবে।
ক্বাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: এই হাশর তথা জমায়েতটা হবে দুনিয়াতে কিয়ামতের পূর্বে। এটা হচ্ছে কিয়ামতের শেষ নিদর্শন, যা আলোচ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়। কারণ তাতে সকাল, সন্ধ্যা, রাত্রি যাপন ও কায়লূলাহ বা বিশ্রামের বিষয়ে উল্লেখ হয়েছে যা আখিরাতে থাকে না। আবার অন্য হাদীসে রয়েছে, যতক্ষণ হিজায থেকে আগুন বের না হবে ততক্ষণ কিয়ামত হবে না। মুসলিম ব্যতীত অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন তোমরা এ আগুনের কথা শুনবে তখন তোমরা শামের উদ্দেশে বের হও এ যেন তিনি তাদেরকে কষ্ট দেয়ার পূর্বে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন।
হুলায়মী ও গাযালী (রহিমাহুয়াল্লাহ) উল্লেখ করেন যে, এটা আখিরাতের হাশর। হুলায়মী বলেন, তিন ধরনের মানুষকে তিন উপায়ে আখিরাতে জমা করা হবে। প্রথম শ্রেণি হলো (أبرار) তথা নেককারগণ যারা আল্লাহর সাওয়াবের প্রত্যাশী বা রাগিবীন এবং ভয় ও আশার মধ্যে অবস্থানকারী বা রাহিবীন।
২য় শ্রেণি- মিশ্রিত ব্যক্তি যারা উটের উপরে আসবে। আর ৩য় শ্রেণি হলো কাফির, যাদেরকে আগুনে একত্রিত করবে। তাদের দলীল নাসায়ীতে রয়েছে, (يُحْشَرُالنَّاسُ يَوْمَ الْقِيَاماَةِ)
সিনদী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, অধিকাংশ বিদ্বানের মত হলো, এটা দুনিয়ার হাশর এবং কিয়ামতের সর্বশেষ নিদর্শন। এটাই উপযুক্ত মত, এতে কায়লূলাহ্ বা আরাম নেয়া অথবা অনুরূপ বিষয়ের উল্লেখ হয়েছে।
ইসমাঈলী আলোচিত আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)-এর হাদীস ও ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর নগ্ন, খালি পা ও পব্ৰজের হাদীসের মাঝে সমন্বয় করেছেন এভাবে যে, হাশর থেকে ধর্তব্য হলো বিক্ষিপ্ত মানুষকে একত্রিত করা। যেটা মাখলুককে কবর থেকে খালি পায়ে বিবস্ত্র অবস্থায় বের করা, অতঃপর হাঁকিয়ে হিসাবের জন্য একত্রিত করা হবে। এ সময় মুত্তাকীদেরকে উটের উপর আরোহণ করে জমায়েত করা হবে। আবার অন্য কেউ এভাবে দুই বিপরীত হাদীসকে একত্রিত করেছেন যে, মানুষদের কবর থেকে উঠার বর্ণনা দেয়া হয়েছে ইবনু আব্বাস-এর হাদীসে, অতঃপর সেখান থেকে অবস্থানস্থলে যাওয়ার বিভিন্ন অবস্থা বর্ণিত হয়েছে আবূ হুরায়রাহ (রাঃ)-এর হাদীসে।
এ মতটিকে আরো শক্তিশালী করেছে আহমাদ, নাসায়ী ও বায়হাকীতে বর্ণিত আবূ যার (রাঃ)-এর হাদীস। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে বর্ণনা করেছেন যে, মানুষেরা কিয়ামতের দিন তিন দলে একত্রিত হবে- এক) কাপড় পরিহিত, আগ্রহী আরোহী দল। দুই) পদব্রজে চলা দল। তিন) এমন দল যাদেরকে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) মুখের ভরে টেনে আনবেন। কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ)-এর মতকে সঠিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। (ফাতহুল বারী ১১ খণ্ড, হা, ৬৫২২; নাসায়ী ২য় খণ্ড, হা. ২০৮৪)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাশর
৫৫৩৫-[৪] ইবনু আব্বাস (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন: (হে লোক সকল!) কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে খালি পায়ে, খালি দেহে ও খতনাবিহীন অবস্থায় একত্রিত করা হবে। তারপর তিনি (সা.) এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন- (کَمَا بَدَاۡنَاۤ اَوَّلَ خَلۡقٍ نُّعِیۡدُهٗ ؕ وَعۡدًا عَلَیۡنَا ؕ اِنَّا کُنَّا فٰعِلِیۡنَ) “আমি তোমাদেরকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে আনব যেমন প্রথমবার তৈরি করেছিলাম, এটা আমার প্রতিশ্রুতি, যা আমি অবশ্যই পূরণ করব"- (সূরাহ আল আম্বিয়া ২১: ১০৪)। [অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন,] সর্বপ্রথম যাকে কাপড় পরিধান করানো হবে, তিনি হবেন ইবরাহীম আলায়হিস সালাম। তিনি (সা.) আরো বলেছেন, আমি দেখব যে, আমার উম্মতের কিছুসংখ্যক লোককে গ্রেফতার করে বামদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন আমি বলব, তারা যে আমার উম্মতের কিছু লোক, তারা যে আমার উম্মতের কিছু লোক। (কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?) তখন আল্লাহ বলবেন, যখন থেকে আপনি তাদেরকে রেখে পৃথক হয়ে চলে এসেছেন, তখন হতেই তারা দীনকে পরিত্যাগ করে উল্টা পথে চলেছিল। তিনি (সা.) বলেন, তখন আল্লাহর নেক বান্দা ’ঈসা আলায়হিস সালাম যেমন বলেছিলেন অনুরূপ বলব, ’আমি যতদিন তাদের মাঝে ছিলাম ততদিনই আমি তাদের অবস্থা অবহিত ছিলাম..... আপনি সর্বশক্তিমান ও মহাজ্ঞানী’ পর্যন্ত। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَشْر)
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِنَّكُمْ مَحْشُورُونَ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلًا» ثُمَّ قَرَأَ: (كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُعِيدُهُ وَعْدًا عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فاعلين) وَأَوَّلُ مَنْ يُكْسَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِبْرَاهِيمُ وَإِنَّ نَاسًا مِنْ أَصْحَابِي يُؤْخَذُ بِهِمْ ذَاتَ الشِّمَالِ فَأَقُولُ: أُصَيْحَابِي أُصَيْحَابِي فَيَقُولُ: إِنَّهُمْ لَنْ يَزَالُوا مرتدين على أَعْقَابهم مذْ فَارَقْتهمْ. فَأَقُول كَمَا قَالَ الْعَبْدُ الصَّالِحُ: (وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دمت فيهم) إِلى قَوْله (الْعَزِيز الْحَكِيم) مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (3349) و مسلم (58 / 2860)، (7201) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (الْغُرْلُ يُحْشَرُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلًا) এর অর্থ (غَيْرُمَخْتُونِينَ) (খতনাহীন)। (قُلْفَةٌ) অর্থাৎ এমন চামড়াকে বলা হয় যাকে খতনা দেয়াতে কেটে ফেলতে হয়। এটা কাটাবিহীন উঠানো হবে। (শারহু নাবাবী ১৭শ খণ্ড, হা. ২৮৬)
(حُفَاة) এমন ব্যক্তি যার কোন জুতা এবং মোজা নেই। (عُرَاة) যার কোন আবরণ বা সতর নেই। বায়হাকী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, আবূ দাউদে বর্ণিত আবূ সাঈদ-এর হাদীসে রয়েছে, যখন আবূ সাঈদ-এর মৃত্যু হাজির হলো তখন তিনি নতুন কাপড় নিয়ে ডাকলেন ও তা পরিধান করে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে বলতে শুনেছি। তিনি (সা.) বলেন, নিশ্চয় মৃত্যু ব্যক্তি যে কাপড়ে মারা গেছে, সে কাপড়ে তাকে পুনরুত্থান করা হবে। ইবনু 'আব্বাস-এর হাদীস ও আবূ সাঈদ (রাঃ)-এর হাদীসকে এভাবে এক করা যায় যে, কারো হাশর হবে বিবস্ত্র হয়ে। আর কারো হাশর হবে কাপড় পরে অথবা সবাইকে উলঙ্গ করে জমা করা হবে। অতঃপর নবী 'আলায়হিস সালাম-দেরকে কাপড় পরানো হবে। আর যাকে প্রথমে কাপড় পরানো হবে তিনি হলেন ইবরাহীম আলায়হিস সালাম। অথবা মানুষ যে কাপড়ে মারা গেছে সে কাপড়সহ কবর থেকে উত্থিত হবে। অতঃপর কাপড় তাদের থেকে খুলে পড়বে হাশরের সূচনালগ্নে। তারপর তারা উলঙ্গ হয়ে জমায়েত হবে। অতঃপর প্রথমে ইবরাহীম আলায়হিস সালাম-কে কাপড় পরিধান করানো হবে। আবার কেউ আবূ সা'ঈদ-এর হাদীসকে শহীদের জন্য ধরেছেন। কারণ তাদের ব্যাপারে নির্দেশ হলো যে, তাদেরকে স্ব স্ব কাপড়ে ঢেকে দাফন করতে হবে। আবূ সাঈদ শহীদদের ব্যাপারে উপরোক্ত নির্দেশনা শুনেছেন কিন্তু তা সবার জন্য ধরে নিয়েছেন। যারা সাধারণের জন্য ধরেছেন, তাদের মধ্যে মু'আয ইবনু জাবাল (রাঃ) অন্যতম।
ইবনু আবদ্ দুনিয়া ‘আম্র ইবনু আসওয়াদ-এর সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা মু'আয ইবনু জাবাল-এর আম্মাকে দাফন করতে গেলে তিনি নির্দেশ দিলেন মায়ের জন্য। তাই আমরা নতুন কাপড়ে কাফন দিলাম। আর তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের মৃত ব্যক্তিদের উত্তম কাফনের ব্যবস্থা কর। কারণ এতেই তাদেরকে উঠানো হবে। কোন বিদ্বান কাপড়কে ‘আমলের অর্থ গ্রহণ করেছেন। কাপড় ‘আমল অর্থে ব্যবহার হওয়ার উদাহরণ হলো আল্লাহ তা'আলার বাণী: (وَ لِبَاسُ التَّقۡوٰی ۙ ذٰلِکَ خَیۡرٌ ؕ) “আর তাকওয়ার পোশাক হচ্ছে সর্বোত্তম পোশাক”- (সূরাহ্ আল আ'রাফ ৭: ২৬)।
(وَ ثِیَابَکَ فَطَهِّرۡ) “তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ”- (সূরাহ্ আল মুদ্দাসসির ৭৪: ৪)।
এটা কতাদাহ্ (রহিমাহুল্লাহ)-এর ব্যাখ্যা। তিনি এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এর অর্থ হলো (وَعَمَلَكَ فَأَخْلِصْهُ) আর তোমার আমাকে নির্ভেজাল কর।
এ কথাটা আরো মজবুত হয় জাবির (রাঃ)-এর মারফু হাদীস দ্বারা, বলা হয়েছে, (يُبْعَثُ كُلُّ عَبْدٍ عَلَى مَا مَتَ عَلَيْهِ) “প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার শেষ ‘আমলের সাথে উঠানো হবে” হাদীসটিকে মুসলিম বর্ণনা করেন। কুরতুবী (রহিমাহুল্লাহ) হাদীসকে প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করেন। তার মতটি কুরআনের আয়াত দ্বারা সুদৃঢ় হয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন, (وَ لَقَدۡ جِئۡتُمُوۡنَا فُرَادٰی کَمَا خَلَقۡنٰکُمۡ اَوَّلَ مَرَّۃٍ) “(কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন) তোমরা আমার নিকট তেমনই নিঃসঙ্গ অবস্থায় হাজির হয়েছ যেমনভাবে আমি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম”- (সূরা আল আন'আম ৬: ৯৪)।
তিনি আরো বলেন, (...کَمَا بَدَاَکُمۡ تَعُوۡدُوۡنَ) “...যেভাবে প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পুনরায়ও সেভাবেই সৃজিত হবে”- (সূরা আল আ'রাফ ৭: ২৯)। অতএব আবূ সা'ঈদ-এর হাদীসকে শহীদদের জন্য প্রযোজ্য হিসেবে ধরতে হবে। কারণ তাদেরকে স্বীয় কাপড়ে দাফন করতে হয় এবং তাতেই তাদেরকে উঠানো হবে যাতে তাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করা যায়।
(أَوَّلُ مَنْ يُكْسَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِبْرَاهِيمُ) কুরতুবী (রহিমাহুল্লাহ) সহীহ মুসলিম-এর শারাহতে বলেন, (خلائق) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আমাদের নবী ব্যতীত বাকী সব। অতএব তিনি নিজের সম্বোধনের ব্যাপকতার মধ্যে প্রবেশ করবেন না। কিন্তু কুরতুবী (রহিমাহুল্লাহ)-এর ছাত্র পরে বলেন, যদি ‘আলী (রাঃ) বর্ণিত হাদীস না থাকত তবে তাঁর কথা ঠিক হত। আলী (রাঃ) বর্ণনা করেন, কিয়ামতের দিন প্রথম খলীলুল্লাহ আলায়হিস সালাম-কে দুটি কিবতী কাপড় পরানো হবে। অতঃপর মুহাম্মাদ (সা.)-কে ‘আরশের ডানে চমৎকার এক সেট পোশাক পরানো হবে।
‘উবায়দ ইবনু উমায়র-এর মুরসালে বর্ণিত হয়েছে, মানুষকে খালি পায়ে উলঙ্গ করে উঠানো হবে। তখন আল্লাহ তা'আলা বলবেন, আমি আমার খলীলকে উলঙ্গ দেখেছি। তাই ইবরাহীম আলায়হিস সালাম-কে সাদা কাপড় পরানো হবে। তিনি হবেন প্রথম কাপড় পরিহিত ব্যক্তি। ইবরাহীম 'আলায়হিস সালাম প্রথম কাপড় পরা ব্যক্তি হওয়ার রহস্য হলো তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করার সময় বিবস্ত্র করা হয়েছিল। কেউ বলেন, পায়জামা দ্বারা সতর ঢাকার সুন্নাত তিনিই প্রথম চালু করেছিলেন। সে কারণে তাকে প্রথম কাপড় পরানো হবে। আল্লাহ বলবেন, তোমরা আমার খলীলকে কাপড় পরাও যাতে মানুষেরা বুঝতে পারে যে, তাদের ওপর তার শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে।
হাফিয ইবনু হাজার (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইবরাহীম আলায়হিস সালাম প্রথম কাপড় পরিহিত ব্যক্তি হিসেবে বিশেষিত হওয়াতে এ কথা আবশ্যক হয় না যে, তিনি আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা.) থেকে সাধারণভাবে উত্তম।
(إِنَّهُمْ لَنْ يَزَالُوا مرتدين على أَعْقَابهم مذْ فَارَقْتهمْ) এটা রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর বাণী (ما احد ثوابعدك) এর ব্যাখ্যা। নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ কথার উদ্দেশ্য নিয়ে ‘আলিমগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেন।
(এক) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মুনাফিক মুরতাদগণ। তাদেরকে উজ্জ্বল চিহ্নসহ হাশর করা হবে। অতঃপর নবী (সা.) তাদের ওপর থাকা চিহ্ন দেখে ডাকতে থাকবেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলা হবে এরা সেসব লোক নয় যাদের সাথে আপনি ওয়াদা করেছেন। এরা আপনার পরে পরিবর্তন হয়ে গেছে। অর্থাৎ তাদের জন্য যে ইসলাম প্রকাশ পেয়েছিল তার উপর তারা মৃত্যুবরণ করেনি।
(দুই) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সে সমস্ত ব্যক্তিরা যারা রাসূল (সা.) -এর যামানায় ছিল, পরে তারা মুরতাদ হয়েছে। তাদের ওপরে উযূর চিহ্ন না থাকলেও নবী (সা.) তাদেরকে ডাকবেন। কারণ তিনি (সা.) স্বীয় জীবদ্দশায় তাদের ইসালাম সম্পর্কে জানতেন। তাদের ব্যাপারে বলা হবে, আপনার পরে তারা মুরতাদ হয়েছে।
(তিন) এ কথার অর্থ হলো উদ্দেশ্য হবে কবীরা গুনাহগার ব্যক্তি, যারা তাওহীদের উপরে মৃত্যুবরণ করেছে এবং বিদআতী ব্যক্তি যারা বিদ'আতের কারণে ইসালামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যায়নি।
(তুহফাতুল আহওয়াযী, ৬ষ্ঠ খণ্ড হা, ২৪২৩)
বায়যাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (مرتدين) শব্দটি তাঁদের ইসালাম থেকে মুরতাদ হওয়ার দলীল নয়। বরং তারা গণ্য হবে মু'মিনদের বিরুদ্ধাচরণকারী হিসেবে এবং ঈমানের দৃঢ়তা থেকে বিচ্যুত মুরতাদ হিসেবে। তারা সৎ ‘আমলকে মন্দ দিয়ে বদলিয়ে দিত। (ফাতহুল বারী ১১ খণ্ড, হা. ৬৫২৬)
(الْعَبْدُ الصَّالِحُ) থেকে উদ্দেশ্য ‘ঈসা আলায়হিস সালাম। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাশর
৫৫৩৬-[৫] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন মানুষদেরকে খালি পায়ে, খালি দেহে ও খতনাবিহীন অবস্থায় সমবেত করা হবে। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! নারী পুরুষ সকলে কি একজন আরেকজনের লজ্জাস্থান দেখতে থাকবে না? তিনি (সা.) বললেন, হে ’আয়িশাহ্! সে সময়টি এত ভয়ঙ্কর হবে যে, কেউ কারো প্রতি দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ পাবে না। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَشْر)
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «يُحْشَرُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلًا» . قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ الرِّجَالُ وَالنِّسَاءُ جَمِيعًا يَنْظُرُ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ؟ فَقَالَ: «يَا عَائِشَةُ الْأَمْرُ أَشَدُّ مِنْ أَنْ يَنْظُرَ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ» . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (6527) و مسلم (56 / 2859)، (7198) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: ‘আবদুল্লাহ ইবনু উনায়স থেকে মুসনাদে আহমাদ ও হাকিমে বর্ণিত আছে, আল্লাহ বান্দাদেরকে একত্রিত করবেন। তিনি (সা.) স্বীয় হাত দ্বারা শামের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, (عُرَاةً غُرْلًا، بُهْمًا بُهْمًا) আমরা বললাম, (بُهْمًا) কাকে বলে? তিনি (সা) বললেন, যার কাছে কিছু নেই।
সহীহ মুসলিমে ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ-এর বর্ণনায় রয়েছে, (يَا عَائِشَةُ الْأَمْرُ أَشَدُّ مِنْ أَنْ يَنْظُرَ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ) নাসায়ী এবং হাকিম-এর বর্ণিত হয়েছে, 'আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে যে, (يَا رَسُولَ اللَّهِ فَكَيْفَ بِالْعَوْرَاتِ) আমি বললাম, লজ্জাস্থানের কি অবস্থা হবে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, (لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأَنٌ يُغْنِبهِ) তিরমিযী ও হাকিমে একটু বেশি এসেছে। তাতে রয়েছে পুরুষ ও নারীগণ অপরকে বাদ দিয়ে নিজকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পুরুষেরা মহিলার দিকে বা নারীরা পুরুষের দিকে তাকাবে না। ইবনু আবদ দুন্ইয়াতে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) নবী (সা.) -কে জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে মানুষের হাশর হবে? তিনি (সা.) বললেন, খালি পায়ে বিবস্ত্র হয়ে। তিনি আবার বললেন, লজ্জাস্থানের কি হবে? তিনি (সা.) বলেন, আমার ওপরে একটি আয়াত নাযিল হয়েছে যে, তোমার গায়ে কাপড় থাকুক বা না থাকুক তোমার এতে কোন ক্ষতি হবে না। তা হলো (لِكُلِّ امْرِئٍ الْآيَةَ) (ফাতহুল বারী ১১শ খণ্ড, হা, ৬৫২৭)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাশর
৫৫৩৭-[৬] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামতের দিন কাফিরদেরকে কিরূপে মুখের উপরে হাঁটিয়ে একত্রিত করা হবে? উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, যিনি দুনিয়াতে মানুষকে দুই পায়ে চালিয়েছিলেন তিনি কি কিয়ামতের দিন তাকে মুখের উপর চালানোর সাধ্য রাখেন না? (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَشْر)
وَعَنْ أَنَسٍ أَنَّ رَجُلًا قَالَ: يَا نَبِيَّ اللَّهِ كَيْفَ يُحْشَرُ الْكَافِرُ عَلَى وَجْهِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ قَالَ: «أَلَيْسَ الَّذِي أَمْشَاهُ عَلَى الرِّجْلَيْنِ فِي الدُّنْيَا قَادِرًا عَلَى أَنْ يُمْشِيَهُ عَلَى وَجْهِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟» . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (4760) ومسلم (2806)، (7087) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (يُحْشَرُ الْكَافِرُ) আনাস (রাঃ) থেকে অন্য সূত্রে হাকিম-এর বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে প্রশ্ন করা হলো, জাহান্নামীদেরকে মুখের ভরে জমা করা হবে। বাযযারে বর্ণিত আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)-এর হাদীসে রয়েছে, মানুষকে তিনভাবে জমায়েত করা হবে। একদল বাহনের উপরে, আরেক দল পদব্রজে এবং একদল মুখের ভরে। বলা হলো কিভাবে তারা মুখের ভরে চলবে? এসব হাদীসের সামষ্টিক অর্থ হলো নৈকট্যশীলরা আরোহণ করে, অন্য মুসলিমরা পায়ে হেঁটে আর কাফিরদেরকে মুখের ভরে এনে জমা করা হবে। (ফাতহুল বারী ৮ম খণ্ড, হা, ৪৭৬০)
অন্য এক বর্ণনায় আছে, সে ব্যক্তি বলল, কুরআনে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন যে, কাফিররা মুখের উপর ভর করে চলবে। এটা কিভাবে সম্ভব? হাদীসের উদ্দেশ্য হলো, যে সত্তা পায়ে চলার ক্ষমতা দেন তিনি মুখমণ্ডলকেও ক্ষমতা দিতে পারেন। অর্থাৎ আল্লাহর নিকটে সব কঠিন বিষয় সহজ। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাশর
৫৫৩৮-[৭] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন: কিয়ামতের দিন ইবরাহীম আলায়হিস সালাম তার পিতা আযর-এর সাক্ষাৎ পাবেন। তখন আযর-এর চেহারা হবে কালো ধুলাবালি মিশ্রিত। তখন ইবরাহীম আলায়হিস সালাম তাকে বলবেন, আমি কি আপনাকে (দুনিয়াতে) বলেছিলাম না যে, আপনি আমার কথা অমান্য করবেন না? তখন তার পিতা তাকে বলবেন, আজ আমি তোমার অবাধ্যতা করব না। অতঃপর ইবরাহীম আলায়হিস সালাম বলবেন, হে প্রতিপালক! আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, হাশরের দিন আমাকে অপমানিত করবেন না। অথচ আজ আমার পিতা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত, অতএব এর চেয়ে অধিক লাঞ্ছনা ও অপমান আর কি হতে পারে? তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, আমি কাফিরদের জন্য জান্নাত অবৈধ করে রেখেছি। অতঃপর ইবরাহীম আলায়হিস সালাম-কে বলা হবে, তুমি তোমার পায়ের তলার দিকে দেখ। তিনি সে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হঠাৎ দেখবেন যে, তার সামনে কাদা গোবরে লণ্ডভণ্ড শিয়াল আকৃতি একটি নিকৃষ্ট পশু দাঁড়িয়ে আছে। তখনি তাকে চার পা ধরে জাহান্নামে ফেলে দেয়া হবে। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب الْحَشْر)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يَلْقَى إِبْرَاهِيمُ أَبَاهُ آزَرَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَى وَجْهِ آزَرَ قَتَرَةٌ وَغَبَرَةٌ فَيَقُولُ لَهُ إِبْرَاهِيمُ: أَلَمْ أَقُلْ لَكَ: لَا تَعْصِنِي؟ فَيَقُولُ لَهُ أَبُوهُ: فَالْيَوْمَ لَا أَعْصِيكَ. فَيَقُول إِبراهيم: يَا رب إِنَّك وَعَدتنِي أَلا تخزني يَوْمَ يُبْعَثُونَ فَأَيُّ خِزْيٍ أَخْزَى مِنْ أَبِي الْأَبْعَدِ فَيَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى: إِنِّي حَرَّمْتُ الْجَنَّةَ عَلَى الْكَافِرِينَ ثُمَّ يُقَالُ لِإِبْرَاهِيمَ: مَا تَحْتَ رِجْلَيْكَ؟ فَيَنْظُرُ فَإِذَا هُوَ بِذِيخٍ مُتَلَطِّخٍ فَيُؤْخَذُ بقوائمه فَيُلْقى فِي النَّار . رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (3350) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (عَلَى وَجْهِ آزَرَ قَتَرَةٌ) এটা কুরআনের প্রকাশ্য অর্থের সাথে মিল রয়েছে; যেমন আল্লাহর বাণী, (وَ وُجُوۡهٌ یَّوۡمَئِذٍ عَلَیۡهَا غَبَرَۃٌ ﴿ۙ۴۰﴾ تَرۡهَقُهَا قَتَرَۃٌ ﴿ؕ۴۱﴾) “সেদিন কতক মুখ হবে ধূলিমলিন। তাদেরকে কালিমা আচ্ছন্ন করে রাখবে”- (সূরা আল ‘আবাসা ৮০: ৪০-৪১)। অর্থাৎ তাকে ধুলোই ঢেকে ফেলবে। (غَبَرَۃٌ) বলা হয় মাটির ধুলোকে। আর (قَتَرَۃٌ) বলা হয় হতাশায় বা দুঃখে সৃষ্ট মলিনতাকে। কেউ বলেন, দুঃখ বা বিপদে মুখমণ্ডল ঢেকে ফেললে তাকে (قَتَرَۃٌ) বলা হয়। আর যার গায়ে ধুলো পড়ে তাকে (غَبَرَۃٌ) বলা হয়। এটি একটি বাহ্যিক বা অনুভবযোগ্য, অন্যটি আত্মিক বা মানসিক। কেউ বলেন, অধিক এমন ধুলোকে (قَتَرَۃٌ) বলা হয় যা মুখমণ্ডলকে মলিন করে দেয়। কেউ বলেন, ধোয়াশে কালোকে (قَتَرَۃٌ) বলা হয়। এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
(فَأَيُّ خِزْيٍ أَخْزَى مِنْ أَبِي الْأَبْعَدِ) এখানে ইবরাহীম আলায়হিস সালাম স্বীয় পিতার ব্যাপারে তাঁর শাফা'আত কবুল না হওয়ায় নিজকে (أَبْعَدِ) বলে ধরে নিয়েছেন। কেউ বলেন, (أَبْعَدِ) শব্দটি (ابيه) থেকে (صِفَةُ) হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর পিতা আল্লাহর রহমত থেকে অনেক দূরে। কারণ পাপী ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকে। আর কাফির তো আরো দূরে। কেউ বলেছেন, (أَبْعَدِ) ইসমে তাফযীল (بعيد) সিফাতুল মুশাববাহার অর্থে ব্যবহার হয়েছে যার অর্থ ধ্বংস। ইসমে তাফযীলের অর্থে ব্যবহার হওয়াই অধিক মজবুত। কারণ ইবরাহীম ইবনু তহমান-এর বর্ণনায় রয়েছে, (وَإِنْ أَخْزَيْتَ أَنِي فَقَدْ أَخْزَيْتَ الْأَبْعَدَ)
(فَإِذَا هُوَ بِذِيخٍ مُتَلَطِّخٍ فَيُؤْخَذُ بقوائمه فَيُلْقى فِي النَّار) এ বাক্যের মধ্যে (زِيخٍ) শব্দটি ‘যাল' বর্ণে যের, ইয়া সার্কিন ও পরে ‘খা অর্থ পুরুষ হায়েনা। কেউ কেউ বলেন, অধিক চুলবিশিষ্ট হলে তাকে (زِيخ) বলা হয়। (مُتَلَطِّخ) শব্দের অর্থ মেখে যাবে। কোন ভাষ্যকার বলেন, গোবর, রক্ত বা মাটিতে মেখে যাবে। কোন বর্ণনায় আছে, তার কাছ থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হবে। অতঃপর বলবেন, হে ইবরাহীম! তোমার পিতা কোথায়? তিনি বলবেন, আপনি তো আমার নিকট থেকে তাকে সরিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলবেন, নিচে লক্ষ্য কর। তিনি যখন তাকাবেন তখন দেখবেন একটি প্রাণী ময়লায় গড়াগড়ি দিচ্ছে।
অন্য বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তাঁর পিতাকে বিকৃত করে হায়েনা করবেন। আবূ সাঈদ-এর হাদীসে রয়েছে, হায়েনার আকৃতিতে দুর্গন্ধযুক্ত বিভৎস চেহারায় পরবর্তিত হবে।
আইয়ুব-এর বর্ণনায় রয়েছে, তার নাক ধরে বলবেন, হে আমার বান্দা! এটা তোমার পিতা। তিনি বলবেন, তোমার কসম! এটা নয়।
বলা হয়, তার চেহারাকে বিকৃত করার হিকমত হলো ইবরাহীম আলায়হিস সালাম-এর মন যেন তার থেকে সরে যায় এবং সে আসল চেহারায় জাহান্নামে না থাকে। কারণ এতে ইবরাহীম আলায়হিস সালাম অপমানিত হবেন।
কেউ বলেন, হায়েনার চেহারায় বিকৃত হওয়ার হিকমত হলো, হায়েনা প্রাণীর মধ্যে সর্বাধিক আহমাদ। আর আযর মানুষের মাঝে সবচাইতে বড় আহাম্মক। কারণ তার ছেলের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শন প্রকাশিত হবার পরেও কুফরীর উপর অনঢ় থেকেছে আমৃত্যু। ইবরাহীম আলায়হিস সালাম তার পিতার প্রতি অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। আর তিনি তার জন্য বাহুকে কোমল করেছেন। কিন্তু সে অমান্য করেছে এবং অহংকারবশত কুফরীর উপর গো ধরেছে। সে কারণে কিয়ামতের দিন তার সাথে অপমানজনক আচরণ করা হবে।
কেবলমাত্র তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে যা সে তার পিতাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন এটা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন সে তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। দেখুন- সূরাহ্ আত্ তাওবাহ্ ৯: ১১৪। (ফাতহুল বারী ৮ম খণ্ড, হা. ৪৭৬৮-৬৯)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাশর
৫৫৩৯-[৮] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: কিয়ামতের দিন সকল মানুষ ঘর্মাক্ত হয়ে পড়বে, যা তাদের ঘাম জমিনের সত্তর গজ পর্যন্ত ছড়িয়ে যাবে, এমনকি তা দু’কান পর্যন্ত পৌছে লাগামে পরিণত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَشْر)
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَعْرَقُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يَذْهَبَ عَرَقُهُمْ فِي الْأَرْضِ سَبْعِينَ ذِرَاعًا وَيُلْجِمُهُمْ حَتَّى يَبْلُغَ آذَانَهُمْ» . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (6532) و مسلم (61 / 2863)، (7205) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: বায়হাক্বীতে ‘আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, সেদিনের বিপদ খুব কঠিন হবে। এমনকি ঘাম কাফিরের মুখ বরাবর হবে। তাঁকে বলা হলো, মু'মিনরা কোথায় থাকবে? তিনি (সা.) বললেন, তারা থাকবে স্বর্ণের চেয়ারের উপরে। আর তাদেরকে মেঘ ছায়া দান করবে। আবূ মূসা (রাঃ)-এর বর্ণনায় রয়েছে, কিয়ামতের দিন মানুষের মাথার উপর সূর্য থাকবে। আর তাদের ‘আমালসমূহ মাথার উপর ছায়া দিবে।
ইবনু আবূ শায়বায় সালমান (রাঃ) বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন সূর্যকে দশ বছরের তাপ প্রদান করা হবে। অতঃপর তা মানুষের খুলির কাছাকাছি করা হবে যেন তা ধনুকের রশির সমান। মানুষেরা ঘর্মাক্ত হবে, এতে ঘাম চুয়ে মানুষের দেহের সমান হয়ে যাবে। এত উঁচু হয়ে যাবে যে, মানুষেরা ঘড় ঘড় আওয়াজ করবে। সে তাপে সেদিন মুমিন নারী-পুরুষের কোন ক্ষতি হবে না।
আবূ ইয়ালা (রাঃ)-এর বর্ণনায় আছে, কিয়ামতের দিন ঘাম মানুষের মুখ পরিমাণ হবে যেমন মুখে লাগাম থাকে। এতে সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! জাহান্নামে দিয়ে হলেও এখান থেকে আমাকে অবকাশ দিন। এসব অবস্থা হাশরের ময়দানে ঘটবে। তাদের ‘আমল অনুযায়ী শাস্তির অবস্থা বিভিন্ন রকম হবে। আর কাফিররা তো কঠিন বিপদে অবস্থান করবে।
হাদীসের প্রকাশ্য অর্থানুযায়ী মানুষ এই বিপদের অন্তর্ভুক্ত। তবে অন্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, এটা বিশেষ এক শ্রেণি, তারা সংখ্যায় বেশি। এর মধ্য থেকে বাদ দেয়া হয়েছে নবীদেরকে, শহীদদের ও আরো যাদেরকে আল্লাহ ইচ্ছা করেন। অতএব সবচেয়ে বেশি ঘাম হবে কাফিরদের, অতঃপর কবীরা গুনাহগারদের, অতঃপর পরবর্তী শ্রেণিদের। কাফিরদের সংখ্যার তুলনায় মুসলিমদের সংখ্যা অতি নগণ্য হবে।
এগুলো সব অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনয়নের অন্তর্ভুক্ত, যে এথেকে বিরত থাকবে, সে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব জানিয়ে দেয়ার উপকারিতা হলো যাতে শ্রোতাগণ সতর্ক হয় এবং ঐসব বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। (ফাতহুল বারী ১১শ খণ্ড, হা. ৬৫৩২)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাশর
৫৫৪০-[৯] মিকদাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন সূর্যকে সৃষ্টিকুলের অতি কাছাকাছি করে দেয়া হবে। এমনকি তা প্রায় এক মাইলের ব্যবধানে হয়ে যাবে। অতএব তখন তার তাপে মানব সম্প্রদায় আপন আপন ’আমল অনুযায়ী ঘামের মধ্যে ডুবে থাকবে। কারো ঘাম টাখনু পর্যন্ত হবে। কারো হাঁটু অবধি। কারো কোমর অবধি আর কারো জন্য এ ঘাম লাগাম পর্যন্ত হয়ে যাবে (অর্থাৎ তার মুখের ভিতরে লাগামের ন্যায় ঢুকে যাবে) এ কথাটি বলে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের মুখের দিকে হাত দ্বারা ইঙ্গিত করলেন। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَشْر)
وَعَنِ الْمِقْدَادِ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «تُدْنَى الشَّمْسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنَ الْخَلْقِ حَتَّى تَكُونَ مِنْهُمْ كَمِقْدَارِ مِيلٍ فَيَكُونُ النَّاسُ عَلَى قَدْرِ أَعْمَالِهِمْ فِي الْعَرَقِ فَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ إِلَى كَعْبَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ إِلَى رُكْبَتَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ إِلَى حَقْوَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يُلْجِمُهُمُ الْعَرَقُ إِلْجَامًا» وَأَشَارَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِيَدِهِ إِلَى فِيهِ. رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (62 / 2864)، (7206) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (كَمِقْدَارِ مِيلٍ) এটা মূলত (حَتَّى يَكُونَ مِقْدَارُقُوْبِ الشَّمْسِ مِنْهُمْ مِثْلَ مِقْدَارِمِيلٍ) সূর্য তাদের কাছে দূরত্ব হবে এক মাইলের সমপরিমাণ।
কেউ কেউ এ হাদীসে এ সন্দেহের সৃষ্টি করেছে যে, সূর্য পৃথিবী থেকে কয়েক লক্ষ মাইল দূরে থাকার পরেও এত তাপ অনুভূত হয় তাহলে এক মাইল উপরে হলে তার কিরণ বা তার অগ্নিশিখা দ্বারা সব কিছু মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে মাটিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। এসব বিষয় আখিরাতের বর্ণনা। তথাকার দেহে সে মতোই হবে। ফলে সে দেহ এত তাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখবে। যেমন বুধ গ্রহ সূর্যের এ পরিমাণ কাছে যে, জমিনবাসী এক মুহূর্ত টিকতে পারবে না। এ সত্ত্বেও বুধ গ্রহের মাখলুকরা আরামে রয়েছে। যাদের ঘাম পায়ের টাখনু পর্যন্ত পৌছবে তাদের ভালো আমল খুব বেশি। এদের উপরে অন্যদেরকে অনুমান করে নিতে হবে যে, যার যত নেক আমল কম হবে, তার ততটুকু পরিমাণ ঘামে ডুবে যাবে।
ইবনু মালিক (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, তুমি যদি বল, যখন ঘাম হবে সমুদ্রের মতে, এতে কারো মুখ পর্যন্ত পৌঁছবে, তাহলে কিভাবে অন্যের টাখনু পর্যন্ত হবে? এর জবাবে আমরা বলব যে, আল্লাহ তা'আলা কারো পায়ের নীচে জমিনকে উঁচু করবেন। অথবা বলা যায়, মানুষের ‘আমাল অনুযায়ী তার ঘামকে আটকিয়ে রাখবেন। ফলে এর বিপরীত কারো নিকটে পৌছবে না। যেমন আল্লাহ তা'আলা মূসা আলায়হিস সালাম-এর জন্য নদীর স্রোতকে আটকিয়ে ছিলেন। মিরক্বাতুল মাফাতীহ প্রণেতা বলেন, শেষের মতটি গ্রহণযোগ্য। কারণ আখিরাতের সব বিষয় স্বাভাবিক ব্যাপারগুলোর ব্যতিক্রম। সবকিছুই বিবেকের কাছে স্পষ্টভাবে প্রকশিত হয় না।
তুমি কি দেখ না এক কবরে দু’জন ব্যক্তির একজনকে শাস্তি দেয়া হয় এবং অন্যজন সুখে আরামে থাকে। একজন তো অন্যজনের ব্যাপারে কিছুই বুঝে না। এর উদাহরণ দুনিয়াতেও দু’জন ঘুমন্ত ব্যক্তির স্বপ্ন দু' রকম। একজন চিন্তিত ও পেরেশান হয়। আর অন্যজন আনন্দে থাকে। উপরন্তু একই জায়গায় দু’জন উপবিষ্ট থাকে। তন্মধ্যে একজন উপরে থাকে। আবার অন্যজন সর্বনিম্নে অবস্থান করে। অথবা একজন সুস্থ থাকে অন্যজন ব্যথায় অথবা দুঃখ কষ্টে থাকে। (মিকাতুল মাফাতীহ)।