গুনাহ মাফের ‘আমলগুলো কয়েকটি স্তরে বিভক্ত। স্তরগুলো হলো :
[১] এমন ‘আমল যা ব্যক্তির বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেয়;
[২] এমন ‘আমল যা ব্যক্তিকে সেদিনের মতো নিষ্পাপ করে দেয় যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন;
[৩ এমন ‘আমল যা ব্যক্তির গুনাহগুলো মাফ করিয়ে দেয় যদিও তার গুনাহ সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ বা তার থেকেও বেশি হয়;
[৪] এমন ‘আমল যা ব্যক্তির যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়ার গুনাহও মাফ করে দেয়;
[৫] এমন ‘আমল যা ব্যক্তির গুনাহগুলো সাধারণভাবে মাফ করিয়ে দেয় :
উপরে উল্লিখিত স্তরগুলোর অধীনে যেসকল ‘আমল সুন্নাহ্ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে সেগুলো সংক্ষেপে নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
ইসলামে এমন কিছু ‘আমল রয়েছে যেগুলোর কোন একটি যিনি করবেন তার পূর্বের জীবনের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
নিম্নে সেসব ‘আমলগুলো সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো :
১৯. উযূ করা :
কেউ যদি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দেখানো পদ্ধতিতে উযূ করে তার পূর্বের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। একদিন তৃতীয় খলীফা ‘উসমান বিন ‘আফ্ফান উযূ করার পর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আমার এই উযূর মত উযূ করতে দেখলাম। অতঃপর তিনি বললেন,
مَنْ تَوَضَّأَ هَكَذَا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه وَكَانَتْ صَلَاتُه وَمَشْيُه إِلَى الْمَسْجِدِ نَافِلَةً
‘‘যে ব্যক্তি এরূপ উযূ করবে, তার পূর্বের পাপরাশি মাফ করা হবে এবং তার সলাত ও মাসজিদের দিকে চলার সাওয়াব অতিরিক্ত হিসেবে গণ্য হবে।’’[1]
২০. সুন্দর করে উযূ করে দুই রাক্‘আত সলাত আদায় করা :
শুধু উযূ করলেও যেমন গুনাহ মাফ হয় তেমনি অন্য হাদীস মোতাবেক কেউ যদি সুন্দরমত উযূ করে কোন ভুল ছাড়াই পূর্ণ মনোযোগ সহকারে দুই রাক্‘আত সলাত আদায় করে তাহলেও তার বিগত জীবনের সকল পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়।
যায়দ বিন খালিদ আল জুহানী বলেন, নাবী (সা.) বলেছেন :
مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ وُضُوْءَه ثُمَّ صَلّٰى رَكْعَتَيْنِ لَا يَسْهُوَ فِيْهِمَا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে উযূ করে, কোন ভুল না করে (একাগ্রচিত্তে) দুই রাক‘আত সলাত আদায় করে, সেই ব্যক্তির পূর্বেকার সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’’[2]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ تَوَضَّأَ كَمَا أُمِرَ وَصَلّٰى كَمَا أُمِرَ غُفِرَ لَه مَا قَدَّمَ مِنْ عَمَلٍ
‘‘(আল্লাহ ও তার রাসূলের) নির্দেশনা মোতাবেক যে ব্যক্তি উযূ করবে এবং নির্দেশনা মোতাবেক সলাত আদায় করবে তার পূর্বে ‘আমলের গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে।’’[3]
‘উসমান উযূ করা শেষ করে বললেন, আমি নাবী (সা.)-কে দেখেছি, আমি এইমাত্র যেভাবে উযূ করেছি তিনি সেভাবেই উযূ করেছেন। তারপর তিনি বলেন,
مَنْ تَوَضَّأَ نَحْوَ وُضُوئِي هٰذَا ثُمَّ صَلّٰى رَكْعَتَيْنِ لَا يُحَدِّثُ فِيهِمَا نَفْسَه غَفَرَ اللهُ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘যে ব্যক্তি আমার মতো এ রকম উযূ করবে, তারপর দু রাক্‘আত সলাত আদায় করবে, যাতে দুনিয়ার কোন খেয়াল করবে না, তার পেছনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’’[4]
ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :
أما قوله ﷺ لَا يُحَدِّثُ فِيْهِمَا نَفْسَه فالمراد لا يحدث بشئ من أمور الدنيا وما لا يتعلق بالصلاة ولو عرض له حديث فأعرض عنه بمجرد عروضه عفى عن ذلك وحصلت له هذه الفضيلة إن شاء الله تعالى لأن هذا ليس من فعله وقد عفى لهذه الامة عن الخواطر التي تعرض ولا تستقر
‘‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কথা ‘যাতে নিজের কোন বাক্যালাপ করবে না’-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সে দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত এবং সলাতের সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন কোন কাজ করবে না। যদি তার সামনে কোন কথা বলা হয় তাহলে সে তা এড়িয়ে যাবে আর স্বল্প প্রতি উত্তর দিবে। তাহলে তাকে মাফ করে দেয়া হবে এবং হাদীসে বর্ণিত ফযীলত সে পেয়ে যাবে, ইনশা-আল্লা-হ। কারণ এতটুকু তার ইচ্ছকৃত কর্মের অন্তর্ভুক্ত নয়। এই উম্মাতের সেসব ভুল ধরা হয় না যা অনাকাঙিÿতভাবে সামনে চলে আসা পরিস্থিতির কারণে করতে হয় কিন্তু তার উপরে অটল থাকে না।’’[5]
ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন,
المراد بالغفران الصغائر دون الكبائر وفيه استحباب صلاة ركعتين فأكثر عقب كل وضوء وهو سنة مؤكدة
‘‘অত্র হাদীসে গুনাহ মাফ দ্বারা সগীরা গুনাহ মাফের কথা উদ্দেশ্য করা হয়েছে; কাবীরা গুনাহ নয়। আর এই হাদীস দ্বারা প্রত্যেকবার উযূর পরপরই দুই বা ততোধিক রাক্‘আত সলাত আদায় করা মুস্তাহাব ‘আমল প্রমাণিত হলো। এ ‘আমল সুন্নাতে মুয়াক্কাদাও।’’[6]
২১. সলাতের সময় হলে উত্তমরূপে উযূ করে উত্তমরূপে সলাত আদায় করা :
খলীফা ‘উসমান হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :
مَا مِنِ امْرِئٍ مُسْلِمٍ تَحْضُرُه صَلَاةٌ مَكْتُوبَةٌ فَيُحْسِنُ وُضُوءَهَا وَخُشُوعَهَا وَرُكُوعَهَا إِلَّا كَانَتْ كَفَّارَةً لِمَا قَبْلَهَا مِنَ الذُّنُوبِ مَا لَمْ يُؤْتِ كَبِيرَةً وَذٰلِكَ الدَّهْرَ كُلَّه
‘‘কোন মুসলিম ব্যক্তির যখন কোন ফরয সলাত-এর ওয়াক্ত হয় আর সে সলাত-এর উযূকে উত্তমরূপে করে, সলাত-এর ভিতরে বিনয় ও রুকূ‘ উত্তমরূপে আদায় করে, তাহলে যতক্ষণ না সে কোন কাবীরা গুনাহে লিপ্ত হবে, তার এই সলাত তার পূর্ববর্তী যাবতীয় গুনাহের জন্য কাফ্ফারা হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আর এ অবস্থা সর্বযুগেই বিদ্যমান।’’[7]
নাবী (সা.) বলেছেন :
لَا يَتَوَضَّأُ رَجُلٌ مُسْلِمٌ فَيُحْسِنُ الْوُضُوءَ فَيُصَلِّى صَلَاةً إِلاَّ غَفَرَ اللهُ لَه مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الصَّلَاةِ الَّتِى تَلِيهَا
‘‘যেই মুসলিম ব্যক্তি উযূ করবে এবং উযূকে সুন্দরভাবে আদায় করবে, অতঃপর সলাত আদায় করবে সেই ব্যক্তির এই সলাত ও তার পূর্ববর্তী সলাত-এর মধ্যবর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।[8]
২২. ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা শেষে ‘‘আ-মীন’’ বলা :
ইমামের পিছনে জামা‘আতে সলাত আদায়কালে ইমাম সূরা ফাতিহার শেষ আয়াত ‘গাইরিল মাগযূবি ‘আলাইহিম ওয়ালায্ যো-ল্লীন’ পড়া শেষ করে তখন উচ্চৈঃস্বরে[9] ‘আ-মীন’ বলা সুন্নাত।
যে ব্যক্তি এমন করে ‘আ-মীন’ বলবে আর তার ‘আ-মীন’ বলার সাথে ফেরেশতাগণের ‘আ-মীন’ বলা মিলে যাবে তাহলে তার জীবনের পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :
إِذَا قَالَ الْإِمَامُ ﴿غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ﴾ فَقُولُوا آمِينَ فَإِنَّه مَنْ وَافَقَ قَوْلُه قَوْلَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘ইমাম যখন ‘গাইরিল মাগযূবি ‘আলাইহিম ওলায্ যো-ল্লীন’ বলে তখন তোমরা ‘আ-মীন’ বল। কারণ যার ‘আ-মীন’ বলা ফেরেশতাদের ‘আ-মীন’ বলার সাথে মিলে যায়, তার পূর্বেকার সকল পাপ মাফ করে দেয়া হয়।’’[10]
অন্য এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :
إِذَا أَمَّنَ الْإِمَامُ فَأَمِّنُوا فَإِنَّه مَنْ وَافَقَ تَأْمِينُه تَأْمِينَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘ইমাম যখন ‘আ-মীন’ বলবে, তখন তোমরাও ‘আ-মীন’ বল। কারণ, যার ‘আ-মীন’ বলা ফেরেশতাদের ‘আ-মীন’ বলার সাথে সাথে হয়, তখন তার পূর্বেকার গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হয়।’’[11]
আরো এক বর্ণনায় তিনি বলেন,
إِذَا قَالَ أَحَدُكُمْ آمِينَ وَقَالَتْ الْمَلَائِكَةُ فِي السَّمَاءِ آمِينَ فَوَافَقَتْ إِحْدَاهُمَا الْأُخْرٰى غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘তোমাদের কেউ যখন সলাতে ‘আ-মীন’ বলে এবং ফেরেশতারা আকাশে ‘আ-মীন’ বলেন, আর পরস্পরে ‘আ-মীন’ বলা সমস্বরে হয়, তখন তার পূর্বের পাপরাশি মাফ করে দেয়া হয়।’’[12]
উপরে উল্লিখিত হাদীসগুলো দ্বারা জানা গেলো যে, জামা‘আতে সলাত আদায়ের সময় যদি মুক্তাদী ইমাম সাহেবের সূরা ফাতিহা শেষে ‘আ-মীন’ বলা শুনে পূর্ণ মনোযোগ, ভীতি ও একনিষ্ঠতা সহকারে ‘আ-মীন’ বলে এবং তা যদি ফেরেশতাগণের ‘আ-মীন’ বলার সাথে মিলে যায় তাহলে তার পূর্বের সকল সগীরা গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। আর যদি তার ‘আমলনামায় সগীরা গুনাহ না থাকে তাহলে তার কাবীরা গুনাহ (যদি থাকে) হালকা করে দেয়া হবে, ইন্শা-আল্লা-হ।[13]
[2]. সুনান আবূ দাঊদ : ৯০৫; সহীহুত তারগীব : ২২১ হাদীসটি সহীহ।
[3]. সুনান আন্ নাসায়ী : ১৪৪, সুনান ইবনু মাজাহ : ১৩৯৬, হাদীসটির সহীহ।
[4]. সহীহুল বুখারী : ১৫৯, ১৬৪, সহীহ মুসলিম : ৫৬০, ৫৬১।
[5]. শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ৩, পৃ. ১০৮।
[6]. শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ৩, পৃ. ১০৮।
[7]. সহীহ মুসলিম : ৫৬৫।
[8]. সহীহ মুসলিম : ৫৬২।
[9]. গগণবিদারী চিৎকার করে নয়, স্বাভাবিক উচ্চ আওয়াজে বলতে হবে।
[10]. সহীহুল বুখারী : ৭৮২; সহীহ মুসলিম : ৯৪৭।
[11]. সহীহুল বুখারী : ৭৮০, সহীহ মুসলিম : ৯৪২।
[12]. সহীহুল বুখারী : ৭৮০-৭৮২, ৪৪৭৫, ৬৪০২; সহীহ মুসলিম : ৯৪২, ৯৪৪-৯৪৫।
[13]. মিন মুকাফফিরাতিয যুনূব, পৃ. ২৩।
২৩. সলাতে রুকূ‘ থেকে উঠে নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করা :
জামা‘আতের সাথে সলাত আদায়কালে ইমাম যখন রুকূ‘ থেকে উঠার সময় সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ্ বলে, তখন মুক্তাদী আল্লা-হুম্মা রববানা- লাকাল হাম্দ বললে মুক্তাদীর বিগত জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
এ ব্যাপারে নাবী (সা.) বলেছেন :
إِذَا قَالَ الإِمَامُ سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَه. فَقُولُوا اَللّٰهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ . فَإِنَّه مَنْ وَافَقَ قَوْلُه قَوْلَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘যখন ইমাম সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ্ বলে, তখন তোমরা আল্লা-হুম্মা রব্বানা- লাকাল হাম্দ বল। কেননা যার ঐ কথা বলা ফেরেশতাদের বলার সাথে মিলে যায়, তার বিগত জীবনের সকল পাপ মাফ করে দেয়া হয়।’’[1]
২৪. রমাযানের সিয়াম পালন করা :
ঈমানসহ ও সাওয়াবের আশায় কেউ যদি রমাযান মাসের ফরয সিয়াম পালন করে তাহলে তার পূর্বের জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ সাওয়াবের আশায় রমাযানের সিয়াম পালন করে, তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’’[2]
২৫. রমাযানে ক্বিয়ামুল লাইল আদায় করা :
রমাযান মাসে ক্বিয়ামুল লাইল বা রাতের সলাত (তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ) আদায় করলে বিগত জীবনের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। আবূ হুরায়রাহ্ হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘যে ব্যক্তি রমাযানের রাতে ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’’[3]
ইবনু হাজার আল ‘আসক্বালানী (রহিমাহুল্লাহ)[4] বলেন :
ظاهره يتناول الصغائر والكبائر وبه جزم ابن المنذر وقال النووي المعروف أنه يختص بالصغائر وبه جزم إمام الحرمين وعزاه القاضي عياض لأهل السنة قال بعضهم ويجوز أن يخفف من الكبائر إذا لم يصادف صغيرة
‘‘হাদীসের বাহ্যিক অর্থ সগীরা-কাবীরা সকল গুনাহকে শামিল করে। ইবনুল মুনযির এই মত পোষণ করেছেন। ইমাম নাবাভীর মতে, এ হাদীস শুধু সগীরা গুনাহের জন্য নির্ধারিত। ইমামুল হারামাইনও এই মত পোষণ করেছেন। ক্বাযী ‘ইয়ায এ মতকে আহলুস্ সুন্নাহ্র দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, ‘আমলনামায় সগীরা গুনাহ না থাকলে কাবীরা গুনাহকে হালকা করা হয় (যদি থাকে)।’’[5]
২৬. লাইলাতুল কদরের সলাত আদায় করা :
লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদরে বেশি বেশি নফল সলাত আদায় করলে পূর্বের জীবনের সমস্ত পাপ মাফ করে দেয়া হয়। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়।’’[6]
উল্লেখ্য যে, নির্দিষ্ট করে প্রতিবছর ২৭ রমাযানের রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে নির্ধারণ করার কোন নিশ্চিত ভিত্তি নেই। ২৭ তারিখও হতে পারে আবার ২১, ২৩, ২৫ বা ২৯ রমাযানের রাতও কদরের রাত হতে পারে। তাইতো রাসূলুল্লাহ (সা.) রমাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করতে আদেশ দিয়েছেন। ‘আয়িশাহ্ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেছেন,
تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنْ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
‘‘তোমরা রমাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’’[7]
২৭. ইসলাম গ্রহণ করা :
কোন অমুসলিম যখন ইসলাম গ্রহণ করে তখন তার পূর্বের সকল গুনাহ ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ يَنْتَهُوا يُغْفَرْ لَهُمْ مَا قَدْ سَلَفَ وَإِنْ يَعُودُوا فَقَدْ مَضَتْ سُنَّتُ الْأَوَّلِينَ
‘‘যারা কুফরী করেছে তুমি তাদেরকে বল, যদি তারা বিরত হয় তাহলে অতীতে যা হয়েছে তাদেরকে তা ক্ষমা করা হবে। আর যদি তারা পুনরায় করে তাহলে পূর্ববর্তীদের (ব্যাপারে আল্লাহর) রীতি তো গত হয়েছে।’’[8]
আবূ সা‘ঈদ আল খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন,
إِذَا أَسْلَمَ الْعَبْدُ فَحَسُنَ إِسْلَامُه” يُكَفِّرُ اللهُ عَنْهُ كُلَّ سَيِّئَةٍ كَانَ زَلَفَهَا وَكَانَ بَعْدَ ذٰلِكَ الْقِصَاصُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلٰى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ وَالسَّيِّئَةُ بِمِثْلِهَا إِلَّا أَنْ يَتَجَاوَزَ اللهُ عَنْهَا
‘‘বান্দা যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার ইসলাম উত্তম হয়, আল্লাহ তা‘আলা তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেন। এরপর শুরু হয় প্রতিদান; একটি সৎ কাজের বিনিময়ে দশ গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত; আর একটি মন্দ কাজের বিনিময়ে ঠিক ততটুকু মন্দ প্রতিফল হয় (তার বেশি নয়)। অবশ্য আল্লাহ যদি মাফ করে দেন তবে ভিন্ন কথা।’’[9]
‘আম্র ইবনুল ‘আস (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তিনি নিজেই বলেন,
أَتَيْتُ النّبِيّ ﷺ فَقُلْتُ : ابْسُطْ يَمِينَكَ فَلأُبَايِعْكَ. فَبَسَطَ يَمِينَه. قَالَ فَقَبَضْتُ يَدِي. قَالَ : مَا لَكَ يَا عَمْرُو؟ قَالَ قُلْتُ : أَرَدْتُ أَنْ أَشْتَرِطَ. قَالَ : تَشْتَرِطُ بِمَاذَا؟ قُلْتُ : أَنْ يُغْفَرَ لِي. قَالَ : أَمَا عَلِمْتَ أَنّ الإِسْلاَمَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَه؟ وَأَنّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا؟ وَأَنّ الْحَجّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَه؟
আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে অনুরোধ জানালাম যে, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, আমি বায়‘আত করতে চাই। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন, তখন আমি আমার হাত টেনে নিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আম্র, কী ব্যাপার? আমি বললাম, পূর্বে আমি শর্ত করে নিতে চাই। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী শর্ত করবে? আমি উত্তর করলাম, আল্লাহ যেন আমার সব গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি বললেন, ‘আম্র! তুমি কি জানো না যে, ইসলাম পূর্ববর্তী সকল অন্যায় মিটিয়ে দেয়। হিজরত পূর্বেকৃত গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয় এবং হাজ্জ ও পূর্বের সকল গুনাহ মিটিয়ে দেয়।[10]
অন্য যে কোন ধর্ম বা নাস্তিক্যবাদ ছেড়ে কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তার পূর্বের সকল ছোট-বড় সকল গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিবেন। তা কুফরী হোক, শির্ক হোক, যা-ই হোক না কেন। ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :
فيه عظم موقع الإسلام والهجرة والحج، وأن كل واحد منها يهدم ما كان قبله من المعاصي
‘‘এ হাদীস দ্বারা ইসলাম গ্রহণ, হিজরত করা ও হাজ্জের মাহাত্ম্য ও বড়ত্ম সাব্যস্ত হয়। আর এগুলোর প্রতিটি ব্যক্তির জীবনের পূর্বের জীবনের সকল গুনাহকে ধ্বংস করে দেয়।’’[11]
২৮. হিজরত করা :
হিজরত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছেন তেমনি অসংখ্য সাহাবী মক্কা থেকে হাবাশায় এবং মদীনায় হিজরত করেছেন। হিজরতও পূর্বের গুনাহ ধ্বংস করে দেয়। ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) বলেছেন :
وَأَنَّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا
‘‘হিজরত তার পূর্বের গুনাহসমুহ মুছে দেয়।’’[12]
২৯. হাজ্জ করা :
হিজরতের মত হজ্জও এর পূর্বের গুনাহ মাফ করিয়ে দেয়। ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) বলেছেন :
وَأَنَّ الْحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَه
‘‘হজ্জও পূর্বের সকল গুনাহ মিটিয়ে দেয়।’’[13]
৩০. খাওয়াদাওয়ার পর নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করা :
খাওয়া-দাওয়ার পর হাদীসে বর্ণিত নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করলে বিগত জীবনের সকল পাপ মাফ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :
مَنْ أَكَلَ طَعَامًا ثُمَّ قَالَ الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِىْ أَطْعَمَنِى هٰذَا الطَّعَامَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِّنِّى وَلَا قُوَّةٍ غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه وَمَا تَأَخَّرَ
‘‘যে ব্যক্তি খাওয়া শেষে এই দু‘আ পড়বে :
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِىْ أَطْعَمَنِى هٰذَا الطَّعَامَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِّنِّى وَلَا قُوَّةٍ
উচ্চারণ : আলহাম্দুলিল্লা-হিল্লাযী আত্‘আমানী হা-যাত্ব ত্ব‘আ-মা ওয়া রযাক্বানীহি মিন গইরি হাওলিম্ মিন্নী ওয়ালা- ক্যুওয়াহ্।
অর্থ : সেই আল্লাহর যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমাকে এই খাদ্য খাওয়ালেন এবং জীবিকা দান করলেন, আমার কোন উপায় ও সামর্থ্য ছাড়াই।
সে ব্যক্তির পূর্বের সমস্ত পাপ মাফ করে দেয়া হবে।’’[14]
৩১. কাপড় পরার সময় নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করা :
যে কোন পোশাক পরিধান করার পরে কেউ যদি নিম্নে উল্লিখিত দু‘আটি পড়ে তাহলে তার বিগত জীবনের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
নাবী (সা.) বলেছেন :
وَمَنْ لَبِسَ ثَوْبًا فَقَالَ الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِى كَسَانِى هٰذَا الثَّوْبَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّى وَلَا قُوَّةٍ غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘আর যে ব্যক্তি কাপড় পরার শেষে এই দু‘আ পড়বে :
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِى كَسَانِى هٰذَا الثَّوْبَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِّنِّى وَلَا قُوَّةٍ
উচ্চারণ : আলহাম্দুলিল্লা-হিল্লাযী কাসা-নী হা-যাস সাওবা ওয়া রযাক্বানীহি মিন গইরি হাওলিম্ মিন্নী ওয়ালা- ক্যুওয়াহ্।
অর্থ : সেই আল্লাহর যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমাকে এই কাপড় পরালেন এবং জীবিকা দান করলেন, আমার কোন উপায় ও শক্তি-সামর্থ্য ছাড়াই।
সে ব্যক্তির পূর্বের সমস্ত পাপ মাফ করে দেয়া হবে।’’[15]
[2]. সহীহুল বুখারী : ৩৮, ২০১৪, সহীহ মুসলিম : ১৮১৭।
[3]. সহীহুল বুখারী : ৩৭, ২০০৯, সহীহ মুসলিম : ১৮১৫-১৮১৬।
[4]. জন্ম : ৭৭৩ হি. - মৃত্যু : ৮৫২ হি.।
[5]. ফাতহুল বারী, খ. ৪, পৃ. ২৫১।
[6]. সহীহুল বুখারী : ১৯০১, ২০১৪, সহীহ মুসলিম : ১৮১৭।
[7]. সহীহুল বুখারী : ২০১৭।
[8] সূরা আল আনফাল ০৮ : ৩৮।
[9]. সহীহুল বুখারী : ৪১।
[10]. সহীহ মুসলিম : ৩৩৬।
[11]. শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ২, পৃ. ৩১৮।
[12]. সহীহ মুসলিম : ৩৩৬।
[13]. সহীহ মুসলিম : ৩৩৬।
[14]. সুনান আবূ দাঊদ : ৪০২৫, শু‘আবুল ঈমান : ৬২৮৫, মুসনাদ আহমাদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ-এর বর্ণনায় শেষ শব্দ ‘‘ওয়ামা তাআখ্খারা’’ নেই।
[15]. সুনান আবূ দাঊদ : ৪০২৫; শু‘আবুল ঈমান : ৬২৮৫; হাদীসটির সনদ হাসান।
হাদীসে এমন কিছু ‘আমলের কথা বর্ণিত হয়েছে, যা করলে মানুষ সেই দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে যায় যেদিন তাকে তার মা জন্ম দিয়েছিলেন। তার মধ্যে থেকে কিছু ‘আমল নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
৩২. উযূ করে সলাত আদায় করা :
উযূ করে সলাত আদায় করা। নাবী (সা.) বলেছেন :
مَا مِنْكُمْ رَجُلٌ يُقَرِّبُ وَضُوءَه فَيَتَمَضْمَضُ وَيَسْتَنْشِقُ فَيَنْتَثِرُ إِلَّا خَرَّتْ خَطَايَا وَجْهِه وَفِيهِ وَخَيَاشِيمِه ثُمَّ إِذَا غَسَلَ وَجْهَه كَمَا أَمَرَهُ اللهُ إِلَّا خَرَّتْ خَطَايَا وَجْهِه مِنْ أَطْرَافِ لِحْيَتِه مَعَ الْمَاءِ ثُمَّ يَغْسِلُ يَدَيْهِ إِلَى الْمِرْفَقَيْنِ إِلَّا خَرَّتْ خَطَايَا يَدَيْهِ مِنْ أَنَامِلِه مَعَ الْمَاءِ ثُمَّ يَمْسَحُ رَأْسَه إِلَّا خَرَّتْ خَطَايَا رَأْسِه مِنْ أَطْرَافِ شَعْرِه مَعَ الْمَاءِ ثُمَّ يَغْسِلُ قَدَمَيْهِ إِلَى الْكَعْبَيْنِ إِلَّا خَرَّتْ خَطَايَا رِجْلَيْهِ مِنْ أَنَامِلِه مَعَ الْمَاءِ فَإِنْ هُوَ قَامَ فَصَلّٰى فَحَمِدَ اللهَ وَأَثْنٰى عَلَيْهِ وَمَجَّدَه بِالَّذِى هُوَ لَه أَهْلٌ وَفَرَّغَ قَلْبَهُ لِلّٰهِ إِلَّا انْصَرَفَ مِنْ خَطِيئَتِه كَهَيْئَتِه يَوْمَ وَلَدَتْهُ أُمُّه
‘‘তোমাদের কোন ব্যক্তির কাছে যখন উযূর পানি পেশ করা হয়, এরপর সে কুলি করে ও নাকে পানি দেয় ও তা পরিষ্কার করে। তখন তার মুখমণ্ডলের মুখ গহববর ও নাকের সকল গুনাহ ঝরে যায়। তারপর যখন সে আল্লাহ পাকের নির্দেশ অনুসারে মুখম-ল ধোয় তখন মুখমণ্ডলের চারিদিক থেকে সকল গুনাহ পানির সাথে ঝরে যায়। এরপর যখন দুই হাত ধোয় কুনুই পর্যন্ত, তখন তার উভয় হাতের গুনাহসমূহ আঙ্গুল দিয়ে পানির সাথে ঝরে পড়ে। এরপর উভয় পা গোড়ালি পর্যন্ত ধৌত করলে উভয় পায়ের গুনাহগুলো আঙ্গুল দিয়ে পানির সাথে ঝরে পড়ে। এরপর যদি সে দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করে আল্লাহর প্রশংসা ও স্ত্ততি বর্ণনা করেও যথাযথভাবে তাঁর অন্তরকে আল্লাহর জন্য একাগ্র করে নেয়, তাহলে সে গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে সেদিনের মত যে দিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।’’[1]
অন্য এক বর্ণনায় আছে,
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَتَوَضَّأَ فَيُسْبِغُ الْوُضُوْءَ ثُمَّ يَقُوْمُ فِىْ صَلَاتِه فَيَعْلَمُ مَا يَقُوْلُ إِلَّا إِنْفَتَلَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمَّه مِنَ الْخَطَايَا لَيْسَ عَلَيْهِ ذَنْبٍ
‘‘যখনই কোন মুসলিম পূর্ণরূপে উযূ করে সলাত আদায় করতে দাঁড়ায় এবং যা বলছে তা বুঝে (অর্থাৎ জেনে মনোযোগ সহকারে তা আদায় করে), তখনই সে প্রথম দিনের শিশুর মতো (নিষ্পাপ) হয়ে সলাত সম্পন্ন করে।’’[2]
৩৩. সলাত আদায়ের পর মাসজিদে অবস্থান করা, জামা‘আতের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে মাসজিদে যাওয়া ও কষ্টকর সময়ে পূর্ণরূপে উযূ করা :
সলাত আদায়ের পর মাসজিদে অবস্থান করা, জামা‘আতের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে যাওয়া এবং কষ্টকর সময়ে পূর্ণরূপে উযূ করলে সে তার জন্মের মত নিষ্পাপ হয়ে যাবে। নাবী (সা.) বলেছেন :
أَتَانِي رَبِّىْ فِي أَحْسَنِ صُورَةٍ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ قُلْتُ لَبَّيْكَ رَبِّ وَسَعْدَيْكَ قَالَ فِيمَ يَخْتَصِمُ الْمَلَأُ الْأَعْلٰى قُلْتُ رَبِّ لَا أَدْرِىْ فَوَضَعَ يَدَه بَيْنَ كَتِفَيَّ فَوَجَدْتُ بَرْدَهَا بَيْنَ ثَدْيَىَّ فَعَلِمْتُ مَا بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ فَقُلْتُ لَبَّيْكَ رَبِّ وَسَعْدَيْكَ قَالَ فِيمَ يَخْتَصِمُ الْمَلَأُ الْأَعْلٰى قُلْتُ فِي الدَّرَجَاتِ وَالْكَفَّارَاتِ وَفِي نَقْلِ الْأَقْدَامِ إِلَى الْجَمَاعَاتِ وَإِسْبَاغِ الْوُضُوءِ فِي الْمَكْرُوهَاتِ وَانْتِظَارِ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ وَمَنْ يُحَافِظْ عَلَيْهِنَّ عَاشَ بِخَيْرٍ وَمَاتَ بِخَيْرٍ وَكَانَ مِنْ ذُنُوبِه كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّه
‘‘আমার রব (স্বপ্নে) সর্বোত্তম সুরতে আমার নিকট আসলেন। তিনি বললেন : হে মুহাম্মাদ। আমি বললাম, হে আমার রব! আমি উপস্থিত, আমি হাযির। তিনি প্রশ্ন করেন : ঊর্ধ্ব জগতের অধিবাসীরা (ফেরেশতারা) কী নিয়ে বিতর্ক করছে? আমি উত্তর দিলাম, হে আমার রব! আমি জানি না। তিনি তাঁর হাত আমার দুই কাঁধের মধ্যখানে রাখলেন। তখন আমি এর শীতলতা আমার উভয় স্তনের মধ্যখানে (বুকে) অনুভব করলাম। এবং পূর্ব-পশ্চিমের মাঝে যা কিছু আছে তা আমি জেনে ফেললাম। অতঃপর তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! আমি বললাম, হে আমার রব! আমি আপনার সামনে উপস্থিত আছি। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, ঊর্ধ্বলোকের অধিবাসীরা (ফেরেশতারা) কী নিয়ে বিতর্ক করছে? আমি জবাব দিলাম, মর্যাদা বৃদ্ধি, কাফফারাত (পাপের ক্ষমা) লাভ, পায়ে হেঁটে জামা‘আতে যোগদান, কষ্টকর অবস্থায়ও উত্তমরূপে উযূ করা এবং এক ওয়াক্তের সলাত আদায় করার পর আরেক ওয়াক্তের সলাতের অপেক্ষায় থাকা ইত্যাদি বিষয়ে তারা বিতর্ক করছে। যে লোক এগুলোর হিফাযাত করবে সে কল্যাণের মধ্যে বেঁচে থাকবে, কল্যাণময় মৃত্যুবরণ করবে এবং তার মা তাকে প্রসব করার দিনের মত গুনাহ মুক্ত হয়ে যাবে।’’[3]
হাফিয ইবনু রজাব (রহিমাহুল্লাহ)[4] বলেন :
‘‘গুনাহ মাফের উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, মাসজিদে জামা‘আতে ও জুমু‘আর সলাত আদায় করতে পায়ে হেঁটে যাওয়া। তবে এই প্রতিদান পেতে হলে ব্যক্তিকে বাড়িতে উযূ করে মাসজিদের উদ্দেশে বের হতে হবে এবং সলাত আদায় করা ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য তার থাকতে পারবে না।’’[5]
তিনি আরও বলেন :
‘‘এই হাদীসে জামা‘আত শেষে বসে থাকা বলতে পরবর্তী সলাতের জন্য অপেক্ষা করাকে বুঝানো হয়েছে। তবে এই বসে থাকার মধ্যে জিকির করা, পাঠ করা, জ্ঞানের কথা শোনা ও তা শিক্ষা দেয়া এবং এই ধরনের যে কোন কাজ করা অন্তর্ভুক্ত।’’
৩৪. বায়তুল মাকদিসে সলাত আদায় করা :
ফিলিস্তিনে অবস্থিত বায়তুল মাকদিসে সলাত আদায় করা। নাবী (সা.) বলেছেন :
أَنَّ سُلَيْمَانَ بْنَ دَاوُدَ عَلَيْهِ الصَّلَاة وَالسَّلاملَمَّا بَنٰى بَيْتَ الْمَقْدِسِ سَأَلَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ خِلَالًا ثَلَاثَةً سَأَلَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ حُكْمًا يُصَادِفُ حُكْمَه فَأُوتِيَه وَسَأَلَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ مُلْكًا لَا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدِه فَأُوتِيَه وَسَأَلَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ حِينَ فَرَغَ مِنْ بِنَاءِ الْمَسْجِدِ أَنْ لَا يَأْتِيَه أَحَدٌ لَا يَنْهَزُه إِلَّا الصَّلَاةُ فِيهِ أَنْ يُخْرِجَه مِنْ خَطِيئَتِه كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّه
সুলায়মান ইবনু দাঊদ (আ.) যখন বায়তুল মাকদিস নির্মাণ করলেন, তখন তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে তিনটি বস্তু চাইলেন : তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করলেন এমন ফায়সালা যা তাঁর ফয়সালার মোতাবেক হয়। তা তাকে প্রদান করা হল। আর তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট চাইলেন এমন বিশাল রাজ্য, যার অধিকারী তার পরবর্তী আর কেউ হবে না। তাও তাকে দেয়া হল। আর যখন তিনি মাসজিদ নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করলেন তখন তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করলেন, যে ব্যক্তি তাতে শুধু সলাতের জন্য আগমন করবে, তাকে যেন পাপ থেকে ঐ দিনের মত মুক্ত করে দেন যেদিন সে তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।’’[6]
৩৫. হাজ্জ করা :
হাজ্জ করলে পাপ থেকে নিষ্পাপ হওয়া যায়। আবূ হুরায়রাহ্ হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) বলেছেন :
مَنْ حَجَّ لِلّٰهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّه
‘‘যে ব্যক্তি রাফাছ ও ফিস্ক থেকে বিরত থেকে আল্লাহর উদ্দেশে হাজ্জ (হজ্জ) করলো, সে এমন নবজাতক শিশু, যাকে তাঁর মা এ মুহূর্তেই প্রসব করেছে, তার ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরবে।’’[7]
হাদীসে বর্ণিত ‘রাফাস’ অর্থ হলো স্ত্রীর সাথে যৌন মিলন বা এর প্রাথমিক কাজ করা ও অশ্লীল কতাবার্তা বলা। আর ‘ফিস্ক’ অর্থ হলো কোন হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া এবং আল্লাহর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে যাওয়া অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্যমূলক ফরয কাজ না করা।[8]
ইবনু হাজার ‘আস্ক্বালানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :
وظاهره غفران الصغائر والكبائر والتبعات
‘‘এই হাদীসের প্রকাশ্য অর্থ হচ্ছে, হাজ্জ হাজ্জকারীর সগীরা-কাবীরা ও তাবি’আত (জীবন ও সম্পদের দায়ভারজনিত) গুনাহগুলো মাফ করিয়ে দেয়।’’[9]
হাজ্জে মাবরূর বা কবূল হাজ্জের মাধ্যমে বান্দার মাযালিম ও আর্থিক দায় রহিত হয়ে যায় না। বরং এর দ্বারা কোন সাধারণ কর্মজনিত গুনাহ ও আদায়যোগ্য দায় আদায়ে দেরি করার কারণে যে গুনাহ হয়েছে তা রহিত করে।[10]
‘আবদুর রওফ আল মুনাভী (রহিমাহুল্লাহ)[11] বলেন :
يغفر له الصغائر والكبائر إلا التبعات إذا كان حجه مبرورًا.
‘‘হাজ্জে মাবরূর হাজ্জকারীর সগীরা-কাবীরা গুনাহগুলো মাফ করবে কিন্তু জীবন ও সম্পদের দায়ভারজনিত গুনাহ মাফ করবে না।’’[12]
মুল্লা ‘আলী ক্বারী (রহিমাহুল্লাহ)[13] বলেন :
إن الله تعالى إذا أراد لعاص أن يعفو عنه وعليه تبعات عوض صاحبها من جزيل ثوابه ما يكون سببا لعفوه ورضاه
‘‘আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন গুনাহগার বান্দাকে ক্ষমা করতে চান অথচ তার উপরে জীবন ও সম্পদের দায়ভারজনিত গুনাহ (তাবি‘আত) রয়েছে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা যার দায়ভার এর উপরে বর্তিত তাকে বিপুল পরিমাণের সাওয়াব দান করেন, যা তাকে মাফের ও তার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ হবে।’’[14]
৩৬. রোগাক্রান্ত হলে আল্লাহর প্রশংসা করা :
একদিন শাদ্দাদ বিন আওস ও সুনাবিহী এক রোগীকে দেখতে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ সকালে তুমি কেমন আছ?’ লোকটি বলল, (আল্লাহর) নি‘আমতে আছি। শাদ্দাদ বলল, পাপসমূহ মাফ হয়ে যাওয়া এবং গুনাহসমূহ ঝরে যাওয়ার সুসংবাদ নাও। আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সা.) বলেছেন :
إِنَّ اللّٰهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ إِنِّىْ إِذَا ابْتَلَيْتُ عَبْدًا مِنْ عِبَادِىْ مُؤْمِنًا فَحَمِدَنِىْ عَلٰى مَا ابْتَلَيْتُه فَإِنَّه يَقُومُ مِنْ مَضْجَعِه ذٰلِكَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّه مِنَ الْخَطَايَا وَيَقُولُ الرَّبُّ عَزَّ وَجَلَّ أَنَا قَيَّدْتُ عَبْدِىْ وَابْتَلَيْتُه وَأَجْرُوا لَه كَمَا كُنْتُمْ تُجْرُونَ لَه وَهُوَ صَحِيْحٌ
‘‘আল্লাহ বলেন, ‘আমি যখন আমার কোন মু’মিন বান্দাকে (রোগ-বালা দিয়ে) পরীক্ষা করি এবং সে ঐ রোগ-বালাতে আমার প্রশংসা করে, তখন সে তার ঐ বিছানা থেকে সেই দিনকার মত নিষ্পাপ হয়ে ওঠে, যেদিন তার মা তাকে ভূমিষ্ঠ করেছিলেন।’ রবব তাবারাকা ওয়া তা‘আলা (কিরামান কাতিবীনকে) বলেন, আমি আমার বান্দাকে (অনেক ‘আমল থেকে) বিরত রেখেছি এবং রোগগ্রস্ত করেছি। সুতরাং তার জন্য সেই ‘আমলের সাওয়াব লিখতে থাক, যে ‘আমলের সাওয়াব তার সুস্থ অবস্থায় লিখতে।’’[15]
[2]. মুসতাদরাক ‘আলাস্ সহীহায়ন : ৩৫০৮; তাবারানী : ১৪৩৭০, সহীহুত তারগীব : ১৯০, হাদীসটি সহীহ।
[3]. জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৩২৩৩-৩২৩৫, হাদীসটি সহীহ, সহীহুত তিরমিযী : ২৫৮১
[4]. জন্ম : ৭৩৬ হি. - মৃত্যু : ৭৯৫ হি.।
[5]. ইবনু রজাব আল হাম্বালী, ইখতিয়ারম্নল ঊলা ফী শারহি হাদীসি ইখতিসামিল মালাইল আ’লা-এর গুনাহ মাফের দ্বিতীয় কারণ শিরোনাম দ্রষ্টব্য।
[6]. সুনান আন্ নাসায়ী : ৬৯৩; সুনান ইবনু মাজাহ : ১৪০৮, হাদীসটি সহীহ।
[7]. সহীহুল বুখারী : ১৫২১, সহীহ মুসলিম : ১৮২০।
[8]. মিন মুকাফফিরাতিয যুনূব, পৃ. ৩৫; এই দু’টি পরিভাষার আরো অনেক অর্থ ও ব্যাখা রয়েছে।
[9]. ফাতহুল বারী, খ. ৮, পৃ. ১০৮।
[10]. মিন মুকাফফিরাতিয যুনূব, পৃ. ৩৫।
[11]. জন্ম : ৯৫২ হি. - মৃত্যু : ১০৩১ হি.।
[12]. ফায়যুল কাদীর, খ. ১, পৃ. ৪৩৮।
[13]. জন্ম : ৯৩০ হি. - মৃত্যু : ১০১৪ হি.।
[14]. মিরকাতুল মাফাতীহ শারহি মিশকাতিল মাসাবীহ, খ. ১, পৃ. ১৮৮।
[15]. মুসনাদ আহমাদ : ১৭১১৮; সহীহুত তারগীব : ৩৪২৩, হাদীসটি সহীহ, সিলসিলা আস-সহীহাহ্ : ১৬১১।
৩৭. প্রত্যেক সলাতের পর নির্দিষ্ট জিকির নির্দিষ্টবার পাঠ করা :
সমুদ্রের ফেনা পরিমাণও যদি কেউ পাপ করে এবং নির্দিষ্ট কতিপয় নেক ‘আমল করে, তাহলে তা মাফ হয়ে যাবে। আর তা হল মুসলিমের জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ করুণা। তার মধ্যে একটি ‘আমল হল, ফরয সলাতের পর যথা নিয়ম ও সংখ্যার জিকির পাঠ করা। নাবী (সা.) বলেছেন :
مَنْ سَبَّحَ اللهَ فِى دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ وَحَمِدَ اللهَ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ وَكَبَّرَ اللهَ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ فَتِلْكَ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ وَقَالَ تَمَامَ الْمِائَةِ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَه لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ غُفِرَتْ خَطَايَاهُ وَإِنْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْرِ
‘‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক সলাতের পরে ‘সুবহা-নাল্লা-হ’ ৩৩ বার, ‘আলহাম্দুলিল্লা-হ’ ৩৩ বার, ‘আল্লা-হু আকবার’ ৩৩ বার সর্বমোট ৯৯ বার এবং ১০০ পূরণ করার জন্য এই দু‘আ-
لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَه لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ
উচ্চারণ : লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহূ লা- শারীকা লাহূ, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুওয়া ‘আলা- কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর।
অর্থ : আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনও ইলাহ নেই, তাঁর কোনও অংশীদার নেই, তাঁর জন্যই রাজত্ব এবং তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা, এবং তিনি সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাবান।
পাঠ করবে, তার পাপরাশি ক্ষমা করে দেয়া হবে যদিও তা সমুদ্রের ফেনার সমান হয়।’’[1]
৩৮. নির্দিষ্ট জিকির ১০০ বার পাঠ করা :
এমন একটি যিক্রের কথা হাদীসে উল্লেখ হয়েছে যেটি প্রতিদিন ১০০ বার পড়লে তার সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ গুনাহ থাকলেও তা মাফ করে দেয়া হবে। নাবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন,
مَنْ قَالَ سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِه فِي يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ حُطَّتْ خَطَايَاهُ وَإِنْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْرِ
‘‘যে ব্যক্তি দৈনিক একশত বার سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِه ‘সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহী’ (আল্লাহর পবিত্রতা ও তাঁর প্রশংসা প্রকাশ করছি) পড়বে তার গুনাহসমূহ মোচন করা হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা সমান হয়।’’[2]
৩৯. সকাল-সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট জিকির ১০০ বার করে পাঠ করা :
কেউ যদি নির্দিষ্ট জিকির সকালে ১০০ বার এবং সন্ধ্যায় ১০০ বার পাঠ করে তাহলে তার সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে, যদিও তার গুনাহ সমুদ্রের ফেনা থেকেও বেশি হয়। এই মর্মে আবূ হুরায়রাহ্ থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি নাবী (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, তিনি (সা.) বলেন :
مَنْ قَالَ إِذَا أَصْبَحَ مِائَةَ مَرَّةٍ وَ إِذَا أَمْسٰى مِائَةَ مَرَّةٍ سُبْحَانَ اللهِ وَ بِحَمْدِه غُفِرَتْ ذُنُوْبُه وَ إِنْ كَانَتْ أَكْثَرَ مِنْ زَبَدِ الْبَحْرِ
‘‘যে ব্যক্তি ‘সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহী’ জিকিরটি সকাল বেলায় ১০০ বার এবং সন্ধ্যায় ১০০ বার পাঠ করবে তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে, যদি তা সমুদ্রের ফেনার চেয়েও বেশি হয়।’’[3]
৪০. বিছানায় ঘুমাবার সময় নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করা :
বিছানায় ঘুমাবার সময় পাঠ করতে হয় এমন একটি যিক্রের ব্যাপারে নাবী (সা.) বলেছেন :
من قال حين يأوي إلى فراشه : لَا إلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيْكَ لَه لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ وَلَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ غفر الله ذنوبه أو خطاياه ـ شك مسعر ـ وإن كان مثل زبد البحر
‘‘যে ব্যক্তি বিছানায় শুয়ে বলবে,
لَا إلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيْكَ لَه لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ وَلَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ
উচ্চারণ : লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহূ লা- শারীকা লাহূ, লাহুল মুল্কু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুওয়া ‘আলা- কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর। লা- হাওলা ওয়ালা- ক্যুওয়াতা ইল্লা- বিল্লা-হ। সুবহা-নাল্লা-হি ওয়ালহাম্দুলিল্লা-হি ওয়ালা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু আকবার।
অর্থ : আল্লাহু ছাড়া সত্যিকারের কোনও ইলাহ নেই, তাঁর কোনও অংশীদার নেই, তাঁর জন্যই রাজত্ব এবং তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা, এবং তিনি সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাবান। আল্লাহ ছাড়া কোনও উপায় ও সামর্থ নেই। আল্লাহ পবিত্র এবং তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা, আল্লাহ ছাড়া কোনও সত্যিকারের ইলাহ নেই এবং আল্লাহ সবার চেয়ে মহান/বড়।
সে ব্যক্তির পাপরাশি মাফ হয়ে যাবে; যদিও তা সমুদ্রের ফেনা সমান হয়।’’[4]
উল্লেখ্য যে ঘুমাবার পূর্বে পঠনীয় আরও একাধিক দু‘আ রয়েছে। তবে সেগুলো পড়লে অন্য ফযীলত পাওয়া যাবে কিন্তু গুনাহ মাফের ফযীলত পাওয়া যাবে মর্মে হাদীসে কিছু বলা হয়নি যেমনটা বলা হয়েছে উপরে উল্লিখিত দু‘আর ক্ষেত্রে।
৪১. নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করা :
এমন একটি জিকির রয়েছে যেটি দিনরাত যেকোন সময় পাঠ করলে সমুদ্রের ফেনা সমান (বা তার থেকে বেশি) পাপরাশিও মাফ হয়ে যাবে। ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আম্র হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَا عَلَى الْأَرْضِ رَجُلٌ يَقُولُ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ وَسُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ إِلَّا كُفِّرَتْ عَنْهُ ذُنُوبُه وَلَوْ كَانَتْ أَكْثَرَ مِنْ زَبَدِ الْبَحْرِ
‘‘পৃথিবীর বুকে যে ব্যক্তি বলবে,
لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ وَسُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ
উচ্চারণ : লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়াল্লা-হু আকবার, ওয়া সুবহা-নাল্লা-হ, ওয়ালহাম্দুলিল্লা-হ, ওয়ালা- হাওলা ওয়ালা- ক্যুওয়াতা ইল্লা- বিল্লা-হ।
অর্থ : আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনও ইলাহ নেই। আল্লাহ সবার চেয়ে মহান, আল্লাহ পবিত্র, সকল প্রশংসা তাঁরই জন্য। আল্লাহ ছাড়া কোনও উপায় ও সামর্থ নেই।
সে ব্যক্তির পাপরাশি মাফ হয়ে যাবে; যদিও তা সমুদ্রের ফেনা সমান (বা তার থেকে বেশি) হয়।’’[5]
তিরমিযীর বর্ণনায় ‘‘ওয়ালহাম্দুলিল্লা-হ’’ জিকিরটি নেই।[6]
৪২. ফজরের সলাতের পর ১০০ বার করে ‘সুবহা-নাল্লা-হ’ ও ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ পড়া :
ফজরের সলাত এমনিতেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ সলাত। এ সময়েরও বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। এই সময়ের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে নিম্নের হাদীসটি।
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ سَبَّحَ فِى دُبُرِ صَلَاةِ الْغَدَاةِ مِائَةَ تَسْبِيحَةٍ وَهَلَّلَ مِائَةَ تَهْلِيلَةٍ غُفِرَتْ لَه” ذُنُوبُه وَلَوْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْرِ
‘‘যে ব্যক্তি সকালের (ফজরের) সলাতের পর একশত বার সুবহা-নাল্লা-হ এবং একশত বার লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ বলবে, তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। যদিও তা সমুদ্রের ফেনার সমপরিমাণ হয়।[7]
হাদীসে বর্ণিত এত বড় পুরস্কার পেতে হলে তাসবীহ, তাহলীলের শব্দ-বাক্যগুলো অর্থ না বুঝে বেখেয়ালে শুধু মুখে আওড়ালেই হবে না। বরং এগুলোর অর্থ বুঝে, পূর্ণ মনোযোগ সহকারে, যার নাম উচ্চারণ করা হচ্ছে তার প্রতি অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি যথাযথ ভক্তি-শ্রদ্ধা-সম্মান অন্তরে ধারণ করে উচ্চারণ করলে হাদীসে বর্ণিত পুরস্কার পাওয়ার দৃঢ় আশা করা যায়।[8]
ইমাম আল গাযালী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :
ولاتظنن ان هذه الحسنات بازاء تحريك اللسان بهذه الكلمات من غير حصول معانيها في القلب فسبحان الله كلمة تدل على التقديس ولا اله الا الله كلمة تدل على التوحيد والحمد لله كلمة تدل على النعمة من الواحد الحق فالحسنات بإزاء هذه المعارف التي هي من ابواب الايمان واليقين
‘‘হাদীসে উল্লিখিত শব্দ-বাক্যসমূহের মর্মার্থ অন্তরে অনুধাবন করা ছাড়াই শুধু মুখে উচ্চারণের মাধ্যমেই (হাদীসে বর্ণিত) সাওয়াব অর্জিত হবে, তা ভাববার অবকাশ নেই। যেমন সুবহা-নাল্লা-হ শব্দটি আল্লাহর পবিত্রতা প্রকাশ করে এবং লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ বাক্যটি আল্লাহর একত্ব প্রমাণ করে আর আলহামদুলিল্লাহ শব্দটি একক সত্য সত্ত্বার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নিয়ামতের স্বীকৃতি। ঈমান ও ইয়াকীনের সাথে সম্পৃক্ত এসব মর্মার্থ বুঝে পড়লেই সাওয়াব অর্জিত হবে।’’[9]
[2]. সহীহুল বুখারী : ৬৪০৫; সহীহ মুসলিম : ৭০১৮।
[3]. আল হাকিম, আল মুসতাদরাক আলাস সহীহায়ন, বৈরূত : দারম্নল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪১১ হি./১৯৯০ ঈ., তাহকীক : মুসতাফা ‘আবদুল কাদির আতা, হাদীস নং-১৯০৬, ইমাম আল আলবানী এই হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। সহীহুত তারগীব ও তারহীব, হাদীস নং-৬৫৩।
[4]. সহীহ ইবনু হিব্বান : ৫৫২৮; ইবনু আবী শাইবা : ২৬৫২৭; আস-সিলসিলা আস-সহীহাহ্ : ৩৪১৪।
[5]. মুসনাদ আহমাদ : ৬৪৭৯; হাদীসটি হাসান।
[6]. জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৩৪৬০।
[7]. সুনান আন-নাসায়ী : ১৩৫৪, হাদীসটি সহীহ।
[8]. মিন মুকাফফিরাতিয্ যুনূব, পৃ. ২৫।
[9]. ইহয়াউ উলূমিদ্দীন, খ. ৪, পৃ. ৮২।
৪৩. ইস্তিগফার ও তাওবাহ্ সম্বলিত নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া অন্যতম কাবীরা গুনাহ। মহান আল্লাহ বলেছেন,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا زَحْفًا فَلَا تُوَلُّوهُمُ الْأَدْبَارَ - وَمَنْ يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَه إِلَّا مُتَحَرِّفًا لِقِتَالٍ أَوْ مُتَحَيِّزًا إِلٰى فِئَةٍ فَقَدْ بَاءَ بِغَضَبٍ مِنَ اللهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ
‘‘হে মু’মিনগণ! তোমরা যখন কাফিরদের মুখোমুখি হবে বিশাল বাহিনী নিয়ে, তখন তাদের থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না। আর যে ব্যক্তি সেদিন তাদেরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে তাহলে সে আল্লাহর গযব নিয়ে ফিরে আসবে। তবে যুদ্ধের জন্য (কৌশলগত) দিক পরিবর্তন অথবা নিজ দলে আশ্রয় গ্রহণের জন্য হলে ভিন্ন কথা এবং তার আবাস জাহান্নাম। আর সেটি কতই না নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল।’’[1]
এ কাজটি হাদীসে বর্ণিত সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজের অন্যতম। নাবী (সা.) বলেছেন :
اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ وَالسِّحْرُ وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِىْ حَرَّمَ اللهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَكْلُ الرِّبَا وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ وَالتَّوَلِّىْ يَوْمَ الزَّحْفِ وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلَاتِ
‘‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ হতে দূরে থাক।’’ সকলে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তা কী কী? তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর সাথে শির্ক করা, যাদু করা, ন্যায় সঙ্গত অধিকার ছাড়া আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা করা হারাম করেছেন তা হত্যা করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতীমের মাল খাওয়া/জবরদখল করা, (যুদ্ধক্ষেত্র হতে) যুদ্ধের দিন পলায়ন করা এবং সতী সরলা মু’মিনা নারীর চরিত্রে মিথ্যা অপবাদ দেয়া।’’[2]
কিন্তু এমন একটি দু‘আ আছে, যা পড়ে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে ঐ পাপও মাফ হয়ে যায়। নাবী (সা.) বলেছেন :
مَنْ قَالَ أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِىْ لَا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ غُفِرَ لَه وَإِنْ كَانَ فَرَّ مِنَ الزَّحْفِ
‘‘যে ব্যক্তি এ দু‘আ পড়বে,
أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِىْ لَا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণ : আসতাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা- ইলা-হা ইল্লা- হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ূমু ওয়া আতূবু ইলাইহি।
অর্থ : আমি সেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি যিনি ছাড়া কোন সত্য মা’বুদ (‘ইবাদাতের যোগ্য) নেই। যিনি চিরঞ্জীব, অবিনশ্বর। এবং আমি তাঁর কাছে তাওবাহ্ করছি।
সে ব্যক্তির পাপরাশি মার্জনা করা হবে; যদিও সে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে (যাওয়ার পাপ করে) থাকে।’’[3]
অবশ্য এটিও এক প্রকার তাওবাহ্ ও ইস্তিগফার। আর যা শর্তানুযায়ী করলে তার ফলে কাবীরা গুনাহও ক্ষমা করা হতে পারে।
[2]. সহীহুল বুখারী : ২৭৬৬, ৬৮৫৭; সহীহ মুসলিম : ২৭২।
[3]. সুনান আবূ দাঊদ : ১৫১৯; জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৩৫৭৭, হাদীসটি সহীহ।
৪৪. আযান শুনে নির্দিষ্ট দু‘আ পড়া :
নতুন দিনের শুরুতে ফজরে আযান শুনে বা যখনই আযান শুনবে তখনই নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করলে গুনাহ মাফ হতে থাকে।
সা‘দ ইবন আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ قَالَ حِينَ يَسْمَعُ الْمُؤَذِّنَ أَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَه وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَرَسُولُه رَضِيتُ بِاللهِ رَبًّا وَّبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا. غُفِرَ لَه ذَنْبُه
আযান শুনে যে ব্যক্তি এই দু‘আ পড়বে,
أَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَه وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَرَسُولُه رَضِيتُ بِاللهِ رَبًّا وَّبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا
উচ্চারণ : আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহূ লা- শারীকা লাহূ, ওয়া আন্না মুহাম্মাদান ‘আবদুহূ ওয়া রাসূলুহু, রযীতু বিল্লা-হি রব্বাও ওয়াবি মুহাম্মাদিন রাসূলান ওয়াবিল ইসলা-মী দীনা-।
অর্থ : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা‘বূদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও প্রেরিত রাসূল। আল্লাহকে রব্ বলে মেনে নিতে, মুহাম্মাদ (সা.)-কে রাসূলরূপে স্বীকার করতে এবং ইসলামকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করতে আমি সম্মত ও তুষ্ট হয়েছি।’’ সে ব্যক্তির গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।[1]
৪৫. উযূ করা :
কোন মুসলিম যখন উযূ করে, তখনও তার পাপ উযূর পানির সাথে মুছে চলে যায়। নাবী (সা.) বলেছেন :
إِذَا تَوَضَّأَ الْعَبْدُ الْمُسْلِمُ - أَوِ الْمُؤْمِنُ - فَغَسَلَ وَجْهَه خَرَجَ مِنْ وَجْهِه كُلُّ خَطِيئَةٍ نَظَرَ إِلَيْهَا بِعَيْنَيْهِ مَعَ الْمَاءِ - أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ - فَإِذَا غَسَلَ يَدَيْهِ خَرَجَ مِنْ يَدَيْهِ كُلُّ خَطِيئَةٍ كَانَ بَطَشَتْهَا يَدَاهُ مَعَ الْمَاءِ - أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ - فَإِذَا غَسَلَ رِجْلَيْهِ خَرَجَتْ كُلُّ خَطِيئَةٍ مَشَتْهَا رِجْلَاهُ مَعَ الْمَاءِ - أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ - حَتّٰى يَخْرُجَ نَقِيًّا مِنَ الذُّنُوبِ
‘‘কোন মুসলিম কিংবা কোন মু’মিন বান্দা যখন উযূ করে তখন মুখ ধোয়ার সাথে অথবা (তিনি বলেছেন,) পানির শেষ বিন্দুর সাথে তার ঐ সকল গুনাহ বের হয়ে যায় যার দিকে তার দুচোখের দৃষ্টি পড়েছিল; এবং যখন দুই হাত ধোয় তখন পানির সাথে অথবা বলেছেন, পানির শেষ বিন্দুর সাথে তার ঐ সকল গুনাহ বের হয়ে যায় যেগুলো তার দু’ হাতে ধরেছিল; এবং যখন দুই পা ধোয় তখন পানির সাথে অথবা বলেছেন, পানির শেষ বিন্দুর সাথে তার ঐ সকল গুনাহ বের হয়ে যায় যেগুলোর দিকে তার দু’ পা অগ্রসর হয়েছিল; ফলে উযূর শেষে) লোকটি তার সকল গুনাহ থেকে সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার হয়ে উঠে।’’[2]
‘উসমান (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) বলেছেন :
مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ خَرَجَتْ خَطَايَاهُ مِنْ جَسَدِه حَتّٰى تَخْرُجَ مِنْ تَحْتِ أَظْفَارِه
‘‘যে ব্যক্তি উত্তমরূপে উযূ করে তাহলে তার দেহ থেকে সকল গুনাহ বের হয়ে যায়, এমন কি তার নখের ভিতর থেকেও (গুনাহ) বের হয়ে যায়।’’[3]
‘আলিমগণের মতে হাদীসে বর্ণিত গুনাহ বলতে শুধু সগীরা গুনাহ বুঝানো হয়েছে, কাবীরা গুনাহ ও মানুষের হকের সাথে সম্পৃক্ত গুনাহ নয়। কাবীরা গুনাহ তাওবাহ্ বা আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া মাফ হয় না, যে কথা পূর্বে দলীলসহ আলোচনা করা হয়েছে।
৪৬. উযূ করে সলাতের জন্য মাসজিদের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করা :
মাসজিদের উদ্দেশে হাঁটার প্রতি কদমে মুসলিমের গুনাহ মাফ হতে থাকে। আবূ হুরায়রাহ্ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
صَلَاةُ الرَّجُلِ فِى الْجَمَاعَةِ تُضَعَّفُ عَلٰى صَلَاتِه فِىْ بَيْتِه وَفِىْ سُوقِه خَمْسًا وَعِشْرِينَ ضِعْفًا وَذٰلِكَ أَنَّه إِذَا تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ ثُمَّ خَرَجَ إِلَى الْمَسْجِدِ لَا يُخْرِجُه إِلَّا الصَّلَاةُ لَمْ يَخْطُ خَطْوَةً إِلَّا رُفِعَتْ لَه بِهَا دَرَجَةٌ وَحُطَّ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ فَإِذَا صَلّٰى لَمْ تَزَلْ الْمَلَائِكَةُ تُصَلِّىْ عَلَيْهِ مَا دَامَ فِىْ مُصَلَّاهُ اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلَيْهِ اَللّٰهُمَّ ارْحَمْهُ وَلَا يَزَالُ أَحَدُكُمْ فِىْ صَلَاةٍ مَا انْتَظَرَ الصَّلَاةَ
‘‘কোন ব্যক্তির জামা‘আতের সাথে সলাতের সাওয়াব, তাঁর নিজের ঘরে বা বাজারে আদায়কৃত সলাতের সাওয়াব দ্বিগুণ করে ২৫ গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। এর কারণে এই যে, সে যখন উত্তমরূপে উযূ করল, তারপর একমাত্র সলাতের উদ্দেশে মাসজিদে রওয়ানা করল তখন তাঁর প্রতি কদমের বিনিময়ে একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয় এবং একটি গুনাহ মাফ করা হয়। সলাত আদায়ের পর সে যতক্ষণ নিজ সলাতের স্থানে থাকে, ফেরেশতাগণ তার জন্য এ বলে দু‘আ করতে থাকেন- ‘হে আল্লাহ! আপনি তার উপর রহমত বর্ষণ করুন এবং তার প্রতি অনুগ্রহ করুণ।’ আর তোমাদের কেউ যতক্ষণ সলাতের অপেক্ষায় থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সে সলাতরত রয়েছে বলে গণ্য হয়।’’[4]
‘আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
مَنْ سَرَّه أَنْ يَلْقَى اللهَ غَدًا مُسْلِمًا فَلْيُحَافِظْ عَلٰى هَؤُلَاءِ الصَّلَوَاتِ حَيْثُ يُنَادٰى بِهِنَّ فَإِنَّ اللهَ شَرَعَ لِنَبِيِّكُمْ ﷺ سُنَنَ الْهُدٰى وَإِنَّهُنَّ مِنْ سُنَنِ الْهُدٰى وَلَوْ أَنَّكُمْ صَلَّيْتُمْ فِى بُيُوتِكُمْ كَمَا يُصَلِّى هٰذَا الْمُتَخَلِّفُ فِى بَيْتِه لَتَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ وَلَوْ تَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ وَمَا مِنْ رَجُلٍ يَتَطَهَّرُ فَيُحْسِنُ الطُّهُورَ ثُمَّ يَعْمِدُ إِلٰى مَسْجِدٍ مِنْ هٰذِهِ الْمَسَاجِدِ إِلَّا كَتَبَ اللهُ لَه بِكُلِّ خَطْوَةٍ يَخْطُوهَا حَسَنَةً وَيَرْفَعُه بِهَا دَرَجَةً وَيَحُطُّ عَنْهُ بِهَا سَيِّئَةً وَلَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلَّفُ عَنْهَا إِلَّا مُنَافِقٌ مَعْلُومُ النِّفَاقِ وَلَقَدْ كَانَ الرَّجُلُ يُؤْتٰى بِه يُهَادٰى بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ حَتّٰى يُقَامَ فِى الصَّفِّ
‘‘যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, আগামীকাল বিচার দিবসে সে মুসলিম হিসেবে আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করবে, তার উচিত এই সলাতসমূহের সংরক্ষণ করা, যেখানে সলাতের জন্য আহবান করা হয়। কারণ, আল্লাহ তোমাদের নাবীকে হিদায়াতের সকল পথ বাতলে দিয়েছেন। আর এই সমস্ত সলাত হল হিদায়াতের পথ সমূহের অন্যতম। তোমরা যদি এই সকল সলাত ঘরে আদায় কর, যেমন একদল লোক জামা‘আত ছেড়ে ঘরে সলাত আদায় করে, তাহলে তোমরা তোমাদের নাবীর সুন্নাতকে ছেড়ে দিলে। তোমরা যদি নাবীর সুন্নাত ছেড়ে দাও, তাহলে তোমরা অবশ্যই গুমরাহ হয়ে যাবে। যে উত্তমরূপে পবিত্র হয়ে এই সকল মাসজিদের একটির দিকে অগ্রসর হবে তার প্রত্যেক কদমের জন্য একটি করে নেকী লেখা হবে এবং তার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং একটি গুনাহ মাফ করা হবে। তারপর একমাত্র প্রকাশ্য মুনাফিক্ব ছাড়া আর কাউকে জামা‘আত থেকে বাদ পড়তে আমরা দেখিনি। অনেক লোক দু’জনের কাঁধে ভর করে হেচঁড়িয়ে হেচঁড়িয়ে মাসজিদে আসত এবং তাদের সারিতে দাঁড় করে দেয়া হতো।’’[5]
‘উসমান ইবনু ‘আফফান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে,
مَنْ تَوَضَّأَ لِلصَّلَاةِ فَأَسْبَغَ الْوُضُوءَ ثُمَّ مَشٰى إِلَى الصَّلَاةِ الْمَكْتُوبَةِ فَصَلَّاهَا مَعَ النَّاسِ أَوْ مَعَ الْجَمَاعَةِ أَوْ فِى الْمَسْجِدِ غَفَرَ اللهُ لَه” ذُنُوبَه
‘‘যে ব্যক্তি সলাতের জন্য উযূ করে এবং পরিপূর্ণভাবে উযূ করে, অতঃপর ফরয সলাতের উদ্দেশে হেঁটে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে সলাত আদায় করে, কিংবা তিনি বলেন, জামা‘আতের সঙ্গে সলাত আদায় করে, কিংবা তিনি বলেন, মাসজিদে সলাত আদায় করে, আল্লাহ সেই ব্যক্তির গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দিবেন।’’[6]
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ تَطَهَّرَ فِى بَيْتِه ثُمَّ مَشٰى إِلٰى بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ لِيَقْضِىَ فَرِيضَةً مِنْ فَرَائِضِ اللهِ كَانَتْ خَطْوَتَاهُ إِحْدَاهُمَا تَحُطُّ خَطِيئَةً وَالْأُخْرٰى تَرْفَعُ دَرَجَةً
‘‘যে ব্যক্তি গৃহে পবিত্রতা অর্জন করল, তারপর হেঁটে আল্লাহর ঘর সমূহের মধ্যে কোন ঘরে গেল, এই জন্য যে আল্লাহর ফরযগুলোর কোন ফরয আদায় করবে। তাহলে তার এক কদমে একটিতে একটি গুনাহ মাফ হবে এবং আরেকটি কদমে এক ধাপ মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।’’[7]
সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক আনসার সাহাবীর মৃত্যু উপস্থিত হলে তিনি বলেন, আমি তোমাদের নিকট একটি হাদীছ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই বর্ণনা করতে চাই। অতঃপর তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি,
إِذَا تَوَضَّأَ أَحَدُكُمْ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ ثُمَّ خَرَجَ إِلَى الصَّلَاةِ لَمْ يَرْفَعْ قَدَمَهُ الْيُمْنٰى إِلَّا كَتَبَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَه حَسَنَةً وَلَمْ يَضَعْ قَدَمَهُ الْيُسْرٰى إِلَّا حَطَّ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ عَنْهُ سَيِّئَةً فَلْيُقَرِّبْ أَحَدُكُمْ أَوْ لِيُبَعِّدْ فَإِنْ أَتَى الْمَسْجِدَ فَصَلّٰى فِى جَمَاعَةٍ غُفِرَ لَه فَإِنْ أَتَى الْمَسْجِدَ وَقَدْ صَلَّوْا بَعْضًا وَبَقِىَ بَعْضٌ صَلّٰى مَا أَدْرَكَ وَأَتَمَّ مَا بَقِىَ كَانَ كَذٰلِكَ فَإِنْ أَتَى الْمَسْجِدَ وَقَدْ صَلَّوْا فَأَتَمَّ الصَّلَاةَ كَانَ كَذٰلِكَ
‘‘তোমাদের কেউ যখন ভালোভাবে উযূ করে সলাতের জন্য রওনা হয়, তখন সে তার ডান পা উঠানোর সাথে সাথেই তার ‘আমলনামায় একটি নেকী লিখিত হয়। অতঃপর তার বাম পা ফেলার সাথে সাথেই তার একটি গুনাহ মার্জিত হয়। এখন যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে, সে তার আবাসস্থান মাসজিদের নিকটে বা দূরে করতে পারে। অতঃপর ঐ ব্যক্তি মাসজিদে আগমনের পর জামা‘আতের সাথে সলাত আদায় করলে- তার সমস্ত (সগীরা) গুনাহ মাফ হবে। ঐ ব্যক্তি মাসজিদে পৌঁছতে পৌঁছতে মুসল্লীগণ যদি কিছু অংশ আদায় করে ফেলে, তখন সে ইমামের সাথে বাকী সলাত আদায়ের পর ইমাম যা পূর্বে আদায় করেছে, তা পূর্ণ করবে। কিন্তু সাওয়াবের ব্যাপারে ঐ ব্যক্তি পূর্ণ সলাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির অনুরূপ হবে। ঐ ব্যক্তি মাসজিদে আগমনের পর যদি দেখে যে, মুসল্লীগণ তাদের সলাত শেষ করে ফেলেছে, তখন সে একাকী সলাত আদায় করল। তবুও তাকে ক্ষমা করা হবে।’’[8]
[2]. সহীহ মুসলিম : ৬০০।
[3]. সহীহ মুসলিম : ৬০১।
[4]. সহীহুল বুখারী : ৬৪৭; সহীহ মুসলিম : ১৫০৮, এ শব্দগুলো সহীহুল বুখারীর।
[5]. সহীহ মুসলিম : ১৫২০।
[6]. সহীহ মুসলিম : ৫৭১।
[7]. সহীহ মুসলিম : ১৫৫৩।
[8]. সুনান আবূ দাঊদ : ৫৬৩, হাদীসটি সহীহ।
৪৭. সলাতের জন্য আযান দেয়া :
বারা’ ইবনু ‘আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী (সা.) বলেছেন :
إِنَّ اللهَ وَمَلَائِكَتَه يُصَلُّونَ عَلَى الصَّفِّ الْمُقَدَّمِ وَالْمُؤَذِّنُ يُغْفَرُ لَه بِمَدِّ صَوْتِه وَيُصَدِّقُه مَنْ سَمِعَه مِنْ رَطْبٍ وَيَابِسٍ وَلَه مِثْلُ أَجْرِ مَنْ صَلّٰى مَعَه
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ প্রথম কাতারে সলাত আদায়কারীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও তাদের জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন এবং মুয়ায্যিনকে তার আওয়াজের দূরত্ব পরিমাণ ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং যে সকল জীব ও বস্তু তার শব্দ শোনে, তারা তাকে সত্যবাদী বলে ঘোষণা দেয় এবং তাকে তার সাথে সলাত আদায়কারীদের সমপরিমাণ পুরস্কার দেয়া হয়।’’[1]
‘উক্ববাহ্ ইবনু ‘আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি,
«يَعْجَبُ رَبُّكُمْ مِنْ رَاعِى غَنَمٍ فِى رَأْسِ شَظِيَّةٍ بِجَبَلٍ يُؤَذِّنُ بِالصَّلَاةِ وَيُصَلِّى فَيَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ انْظُرُوا إِلٰى عَبْدِى هٰذَا يُؤَذِّنُ وَيُقِيمُ الصَّلَاةَ يَخَافُ مِنِّى فَقَدْ غَفَرْتُ لِعَبْدِى وَأَدْخَلْتُهُ الْجَنَّةَ
‘‘যখন কোন বকরীর পালের রাখাল পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থানকালে আযান দিয়ে সলাত আদায় করে, তখন মহান আল্লাহ পাক তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং বলেন, (হে আমার ফেরেশতারা) তোমরা আমার বান্দার প্রতি তাকাও। এই ব্যক্তি (পাহাড়ের চূড়ায়ও) আযান দিয়ে সলাত আদায় করছে। সে আমার ভয়েই তা করছে। অতএব আমি আমার এই বান্দার যাবতীয় গুনাহ (পাপ) মাফ করে দিলাম এবং আমি তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাব।’’[2]
৪৮. সলাত সম্পর্কিত তিনটি কাজ করা :
সলাতের সাথে সম্পৃক্ত ৩টি কাজ রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার অনেক পাপ ক্ষমা করেন এবং তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।
আবূ হুরায়রাহ্ হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
أَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلٰى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ. قَالُوا بَلٰى يَا رَسُولَ اللهِ. قَالَ إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِه وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ
‘‘আমি কি তোমাদেরকে এমন (কাজের) কথা বলব না, যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা পাপরাশি দূর করে দিবেন এবং মর্যাদা উঁচু করে দিবেন? সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল! তিনি (সা.) বললেন : তা হল, অসুবিধা ও কষ্ট সত্ত্বেও পরিপূর্ণভাবে উযূ করা, মাসজিদে আসার জন্য বেশী পদচারণা এবং এক সলাতের পর অন্য সলাতের জন্য অপেক্ষা করা। জেনে রাখ, এটাই হল রিবাত্ব[3]।[4]
অসুবিধা ও কষ্ট বলতে তীব্র শীত ও শরীরে ব্যাথা নিয়ে উযূ করাকে উদাহরণ হিসেবে বোঝা যেতে পারে। তবে ঠাণ্ডা পানিতে উযূ করলে অসুস্থ হওয়ার বা অসুস্থতা বাড়ার মাধ্যমে নিজের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তা অবশ্যই বর্জনীয়।
৪৯. পাঁচ ওয়াক্ত সলাত আদায় করা :
গুনাহ মাফের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত সলাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবূ হুরায়রাহ্ হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنَّ نَهْرًا بِبَابِ أَحَدِكُمْ يَغْتَسِلُ مِنْهُ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ هَلْ يَبْقٰى مِنْدَرَنِه شَىْءٌ . قَالُوا لَا يَبْقٰى مِنْ دَرَنِه شَىْءٌ.قَالَ فَذَلِكَ مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ يَمْحُو اللهُ بِهِنَّ الْخَطَايَا
‘‘বল তো! তোমাদের মধ্যে কারো দরজার সামনে যদি একটি নদী থাকে এবং সে যদি তাতে দৈনিক পাঁচবার গোসল করে তবে তার (শরীরে) কোন ময়লা থাকতে পারে? তাঁরা বললেন, কোন ময়লাই থাকতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত সলাতের দৃষ্টান্ত এটিই। আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা পাপ মোচন করেন।’’[5]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَتَطَهَّرُ فَيُتِمُّ الطُّهُورَ الَّذِى كَتَبَ اللهُ عَلَيْهِ فَيُصَلِّى هٰذِهِ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ إِلَّا كَانَتْ كَفَّارَاتٍ لِمَا بَيْنَهَا
‘‘কোন মুসলিম যখন পবিত্রতা অর্জন করে এবং আল্লাহ তার উপর যে পবিত্রতা অপরিহার্য করেছেন তা পূর্ণাঙ্গরূপে অর্জন করে এবং তারপর এই পাঁচ ওয়াক্ত সলাত আদায় করে তাহলে এ সকল সলাত তাদের মধ্যবর্তী সময়ের সকল গুনাহের কাফফারাহ্ হয়ে যায়।’’[6]
৫০. মাগরিব ও ফজর সলাতের পর নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করা :
মাগরিব ও ফজর সলাতের পর হাদীসে বর্ণিত নির্দিষ্ট দু‘আ ১০ বার পাঠ করলে ১০টি গুনাহ মাফ হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ قَالَ قَبْلَ أَنْ يَنْصَرِفَ وَيَثْنِىَ رِجْلَه مِنْ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ وَالصُّبْحِ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَه لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ بِيَدِهِ الْخَيْرُ يُحْيِىْ وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ عَشْرَ مَرَّاتٍ كُتِبَ لَه بِكُلِّ وَاحِدَةٍ عَشْرُ حَسَنَاتٍ وَمُحِيَتْ عَنْهُ عَشْرُ سَيِّئَاتٍ وَرُفِعَ لَه عَشْرُ دَرَجَاتٍ وَكَانَتْ حِرْزًا مِنْ كُلِّ مَكْرُوهٍ وَحِرْزًا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ وَلَمْ يَحِلَّ لِذَنْبٍ يُدْرِكُه إِلَّا الشِّرْكَ فَكَانَ مِنْ أَفْضَلِ النَّاسِ عَمَلًا إِلَّا رَجُلًا يَفْضُلُه يَقُولُ أَفْضَلَ مِمَّا قَالَ
‘‘যে ব্যক্তি মাগরিব ও ফজরের সলাত থেকে ফিরে বসা ও পা মোড়ার পূর্বে-
لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه لَا شَرِيكَ لَه لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ بِيَدِهِ الْخَيْرُ يُحْيِىْ وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
উচ্চারণ : লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহূ লা- শারীকা লাহূ, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু বিয়াদিহিল খাইর ইউহয়ী ওয়া ইউমীতু ওয়াহুয়া ‘আলা- কুল্লি শাইয়িন কদীর।
অর্থ : আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই, তাঁরই জন্য সারা রাজত্ব, এবং তাঁরই নিমিত্তে সকল প্রশংসা। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু প্রদান করেন। আর তিনি সর্ববস্তুর উপর উপর সর্বক্ষমতাবান।
এ দু‘আটি ১০ বার পাঠ করে, তার ‘আমলনামায় প্রত্যেক বারের বিনিময়ে দশটি নেকী লিপিবদ্ধ করা হয়, তার দশটি গুনাহ মোচন করে দেয়া হয়, তার দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়, প্রত্যেক অপ্রীতিকর বিষয় এবং বিতাড়িত শয়তান থেকে (ঐ জিকির) রক্ষামন্ত্র হয়, নিশ্চিতভাবে শির্ক ব্যতীত তার অন্যান্য পাপ ক্ষমা হয়। আর সে হয় ‘আমল করার দিক থেকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠব্যক্তি; তবে সেই ব্যক্তি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে, যে তার থেকেও উত্তম জিকির পাঠ করবে।’’[7]
৫১. জুমু‘আর সলাত আদায় করা :
জুমু‘আবার জুমু‘আর সলাত আদায় করলে পাপ মাফ হয়ে যায়। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَاسْتَمَعَ وَأَنْصَتَ غُفِرَ لَه مَا بَيْنَه وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ وَزِيَادَةُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ وَمَنْ مَسَّ الْحَصٰى فَقَدْ لَغَا
‘‘যে ব্যক্তি উত্তমরূপে উযূ করে, এরপর জুমু‘আয় আসে, মনোনিবেশ সহকারে নীরব থাকে, তার তখন থেকে (পরবর্তী) জুমু‘আহ্ পর্যন্ত এবং অতিরিক্ত আরো তিন দিনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি (অহেতুক) কংকর স্পর্শ করল[8]সে অনর্থক কাজ করল[9]।’’[10]
অন্য একটি হাদীসে আরও কিছু বাড়তি কাজের কথা যোগ করে বলা হয়েছে। সালমান ফারসী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَتَطَهَّرَ بِمَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ ثُمَّ ادَّهَنَ أَوْ مَسَّ مِنْ طِيبٍ ثُمَّ رَاحَ فَلَمْ يُفَرِّقْ بَيْنَ اثْنَيْنِ فَصَلّٰى مَا كُتِبَ لَه” ثُمَّ إِذَا خَرَجَ الْإِمَامُ أَنْصَتَ غُفِرَ لَه مَا بَيْنَه وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الْأُخْرٰى
‘‘যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন গোসল করে এবং যথাসম্ভব উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করে, এরপর তেল মেখে নেয় অথবা সুগন্ধি ব্যবহার করে, তারপর (মাসজিদে) যায়, আর দু’জনের মধ্যে ফাঁক করে না এবং তার ভাগ্যে নির্ধারিত পরিমাণ সলাত আদায় করে। আর ইমাম যখন (খুত্ববার জন্য) বের হন তখন চুপ থাকে। তার এ জুমু‘আহ্ এবং পরবর্তী জুমু‘আর মধ্যবর্তী যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’’[11]
[2]. সুনান আবূ দাঊদ : ১২০৫, হাদীসটি সহীহ।
[3]. রিবাত বলতে মূলত নিজেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে আটকে রাখা ও শয়তানের মুকাবিলায় নিজকে প্রস্ত্তত রাখাকে বুঝায়। তবে এই হাদীসে যে রিবাতের কথা বলা হয়েছে তা অধিকাংশ মানুষের জন্য সহজ। (মিন মুকাফফিরাতিয যুনূব, পৃ. ২৭)
[4]. সহীহ মুসলিম : ৬১০।
[5]. সহীহুল বুখারী : ৫২৮, ৫৬৪০, সহীহ মুসলিম : ৬৭৩০, শব্দ মুসলিমের।
[6]. সহীহ মুসলিম : ৫৬৮।
[7]. মুসনাদ আহমাদ : ১৭৯৯০; সহীহ আত-তারগীব : ৪৭৭।
[8]. এখানে কংকর স্পর্শ করা উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো খুতবা শোনায় মনোযোগ নষ্ট করে এমন সকল কাজ।
[9]. এখানে অনর্থক কাজ করা বলতে সে জুমু‘আর সলাতের বিশেষ সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হলো এবং সাধারণ যোহরের সলাত আদায়ের সাওয়াব পেলো।
[10]. সহীহ মুসলিম : ২০২৫।
[11]. সুনান ইবনু মাজাহ : ১০৯৭, হাদীসটি হাসান সহীহ।
৫২. ক্বিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জুদ সলাত) আদায় করা :
ক্বিয়ামুল লাইল বা রাতে দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করা অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সলাত আদায় করা খুবই ফযীলতের ‘আমল। এটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিয়মিত অভ্যাস ছিল। পরবর্তীকালে সাহাবী, তাবি‘ঈ, তাবে তাবি‘ঈ ও সালাফে সালিহীনের নিয়মিত ‘আমল ছিল। আর এটির অনেকগুলো উপকারিতার মধ্যে এটিও একটি যে, এই সলাত তার আদায়কারীর গুনাহ মাফের উপায় হয়। আবূ উমামাহ্ হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللَّيْلِ فَإِنَّه دَأْبُ الصَّالِحَيْنَ قَبْلَكُمْ وَهُوْ قَرْبَةٌ إِلٰى رَبِّكُمْ وَمُكَفِّرَةٌ لِّلسَّيِّئَاتِ وَمُنْهَاةً لِلْإِثْمِ
‘‘তোমরা ক্বিয়ামুল লাইল (রাতের সলাত/তাহাজ্জুদ) আদায় করো। নিশ্চয় এটি তোমাদের পূর্বেকার নেকাকার ব্যক্তিদের অভ্যাস। আর এটি তোমাদের রবের নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম, গুনাহসমূহ মাফের উপায় ও গুনাহে লিপ্ত হওয়ার প্রতিবন্ধক।’’[1]
৫৩. যে কোন সময় দুই রাক্‘আত সলাত আদায় করা :
মক্কার বায়তুল্লাহ ত্বওয়াফ করার পর মাকামে ইবরাহীম-এর পাশে বা অন্য কোথাও যে কোন দুই রাক্‘আত সলাত পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেয়। সা‘ঈদ ইবনু আবূ বুরদাহ্ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি যে,
أَنَّه شَهِدَ ابْنَ عُمَرَ وَرَجُلٌ يَمَانِىٌّ يَطُوفُ بِالْبَيْتِ حَمَلَ أُمَّه وَرَاءَ ظَهْرِه، يَقُولُ : إِنِّىْ لَهَا بَعِيرُهَا الْمُذَلَّلُ إِنْ أُذْعِرَتْ رِكَابُهَا لَمْ أُذْعَرِ ثُمَّ قَالَ : يَا ابْنَ عُمَرَ أَتُرَانِىْ جَزَيْتُهَا ؟ قَالَ : لَا، وَلَا بِزَفْرَةٍ وَاحِدَةٍ ثُمَّ طَافَ ابْنُ عُمَرَ ، فَأَتَى الْمَقَامَ فَصَلّٰى رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ قَالَ : يَا ابْنَ أَبِىْ مُوسٰى إِنَّ كُلَّ رَكْعَتَيْنِ تُكَفِّرَانِ مَا أَمَامَهُمَا
ইবনু ‘উমার একদিন জনৈক ইয়ামেনী যুবককে তার মাকে পিঠে নিয়ে ত্বওয়াফরত অবস্থায় দেখতে পেলেন। সে তখন নিমণরূপ কবিতা আবৃত্তি করছিল : ‘আমি তাঁর অনুগত উষ্ট্রের মতো। যদি তাঁর রেকাব (পা-দানী) দ্বারা আমি আঘাতপ্রাপ্ত হই, তবুও নিরুদ্বেগে তা সহ্য করে যাই।’ অতঃপর সে বলল : আমি কি আমার প্রতিদান দিতে পেরেছি বলে আপনি মনে করেন? তিনি বললেন : না, তাঁর একটি দীর্ঘশ্বাসের প্রতিদানও তো হয়নি! অতঃপর ইবন উমর ত্বওয়াফ করলেন এবং মাকামে ইবরাহীমে পৌঁছে দুই রাক্‘আত সলাত আদায় করলেন এবং বললেন : হে আবূ মূসার পুত্র! প্রত্যেক দুই রাক্‘আত সলাত পূর্ববর্তী পাপের জন্য কাফ্ফারা স্বরূপ।[2]
৫৪. গুনাহ করার পর সুন্দর করে উযূ করে দুই রাক্‘আত সলাত আদায় করে ইস্তিগফার করা :
‘আলী (রাঃ) বলেন, আমার নিকট আবূ বাকর (রাঃ) হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,
مَا مِنْ رَجُلٍ يُذْنِبُ ذَنْبًا ثُمَّ يَقُومُ فَيَتَطَهَّرُ ثُمَّ يُصَلِّىْ ثُمَّ يَسْتَغْفِرُ اللهَ إِلَّا غَفَرَ لَه ثُمَّ قَرَأَ هٰذِهِ الْآيَةَ وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ إِلٰى آخِرِ الْآيَةِ
‘‘কোন ব্যক্তি যদি গুনাহ করে, অতঃপর সেখান থেকে উঠে ভালোভাবে উযূ করে দুই রাক্‘আত সলাত আদায় করে এবং ঐ নির্দিষ্ট গুনাহ থেকে আল্লাহর কাছে মাফ চায় তাহলে আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন।’’ তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন :
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ
‘‘আর যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করে ফেলে অথবা নিজদের প্রতি যুল্ম করে বসে এবং (পরক্ষণেই) আল্লাহকে স্মরণ করে...।’’[3]
৫৫. আল্লাহর জন্য সাজদাহ্ প্রদান :
সাজদাহ্ বিনয়ের সর্বোচ্চ প্রকাশ। তাই এই বিনয় প্রকাশক ভঙ্গিটি শুধু আল্লাহর জন্য নির্ধারিত। আর আল্লাহর সবচেয়ে কাছে যাওয়া যায় সাজদার মাধ্যমে। আবার এই সাজদার মাধ্যমে বান্দা তার গুনাহও মাফ পেতে পারেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْجُدُ لِلّٰهِ سَجْدَةً إِلَّا رَفَعَهُ اللهُ بِهَا دَرَجَةً وَحَطَّ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةً
‘‘যখনই কোন বান্দা আল্লাহর উদ্দেশে সাজদাহ্ করে, তখনই এতে আল্লাহ তা‘আলা তার দরজা উঁচু করে দেন এবং তার গুনাহ মাফ করে দেন।’’[4]
অন্য বর্ণনায় নাবী (সা.) বলেছেন :
عَلَيْكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ لِلّٰهِ فَإِنَّكَ لَا تَسْجُدُ لِلّٰهِ سَجْدَةً إِلَّا رَفَعَكَ اللهُ بِهَا دَرَجَةًوَحَطَّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً
‘‘আল্লাহর উদ্দেশে অধিক সাজদাহ্ কর। কেননা, তুমি যখনই আল্লাহর উদ্দেশে একটি সাজদাহ্ করবে, তখন এ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তোমার মর্যাদা এক ধাপ বাড়িয়ে দিবেন এবং তোমার একটি পাপ মোচন করে দিবেন।’’[5]
‘উবাদাহ্ ইবনুস্ সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন,
مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْجُدُ لِلّٰهِ سَجْدَةً إِلَّا كَتَبَ اللهُ لَه بِهَا حَسَنَةً وَمَحَا عَنْهُ بِهَا سَيِّئَةً وَرَفَعَ لَه بِهَا دَرَجَةً فَاسْتَكْثِرُوا مِنْ السُّجُودِ
‘‘যখনই কোন বান্দা আল্লাহর উদ্দেশে সাজদাহ্ করে, তখনই এর বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তার ‘আমলনামায় একটি সাওয়াব লিখে দেন, তার একটি গুনাহ মাফ করে দেন এবং তার মর্যাদার একটি স্তর উঁচু করে দেন এবং অতএব তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে অধিক সাজদাহ্ কর।’’[6]
৫৬. রমাযানে ‘ইবাদাত করা :
রমাযান ‘ইবাদাতের মৌসুম। বছরের সবচেয়ে ফযীলতের মাস। এই মাসে সিয়াম পালন, ক্বিয়ামুল লাইল (তারাবীহ/তাহাজ্জুদের সলাত) আদায়, দান-সদাক্বাহ্ ইত্যাদির মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করে। এই মাস গুনাহ মাফ পাওয়ারও মাস। এই মাসে বিভিন্ন ‘ইবাদাত, তাওবাহ্ ও দু‘আ করার মাধ্যমে জীবনের সকল গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে হয়। এই মাসে গুনাহ মাফের অনেক উপলক্ষ রয়েছে। সেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে গুনাহ থেকে মুক্ত না হতে পারাটা গুনাহগার বান্দার জন্য লজ্জাকর ও ক্ষতির কারণ। জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ বলেন,
أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ رَقَى الْمِنْبَرَ ، فَلَمَّا رَقَى الدَّرَجَةَ الْأُولٰى قَالَ : آمِينَ ، ثُمَّ رَقَى الثَّانِيَةَ فَقَالَ : آمِينَ ، ثُمَّ رَقَى الثَّالِثَةَ فَقَالَ : آمِينَ ، فَقَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ ، سَمِعْنَاكَ تَقُولُ : آمِينَ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ ؟ قَالَ : لَمَّا رَقِيتُ الدَّرَجَةَ الْأُولٰى جَاءَنِىْ جِبْرِيلُ ﷺ فَقَالَ : شَقِىَ عَبْدٌ أَدْرَكَ رَمَضَانَ ، فَانْسَلَخَ مِنْهُ وَلَمْ يُغْفَرْ لَه” ، فَقُلْتُ : آمِينَ . ثُمَّ قَالَ : شَقِىَ عَبْدٌ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ أَوْ أَحَدَهُمَا فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنَّةَ ، فَقُلْتُ : آمِينَ . ثُمَّ قَالَ : شَقِىَ عَبْدٌ ذُكِرْتَ عِنْدَه” وَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ ، فَقُلْتُ : آمِينَ
একদিন নাবী (সা.) মিম্বরে আরোহণ করলেন। যখন প্রথম সিঁড়িতে আরোহণ কররেন, তখন বললেন : আ-মীন! অতঃপর যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে আরোহণ করলেন এবং বললেন, আ-মীন! অতঃপর তৃতীয় সিঁড়িতে আরোহণ করলেন এবং বললেন : আ-মীন! তখন সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আজ আমরা আপনাকে তিনবার ‘আ-মীন’ বলতে শুনলাম, এর অর্থ কী? তিনি বললেন, যখন আমি প্রথম সিঁড়িতে আরোহণ করলাম তখন জিব্রাঈল (আ.) আসলেন এবং বললেন, দুর্ভাগ্য হোক সেই ব্যক্তির যে রমাযান পেল এবং ওটা অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার মাগফিরাত (গুনাহ মাফ) হয়নি। আমি বললাম, আ-মীন! অতঃপর তিনি বললেন দুর্ভাগ্য হোক সেই ব্যক্তির যে তার পিতামাতা উভয়কে অথবা তাঁদের যে কোন একজনকে পেল, অথচ তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাল না। আমি বললাম, আ-মীন! অতঃপর বললেন, দুর্ভাগ্য হোক সেই ব্যক্তির যার সম্মুখে আপনার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল অথচ সেই ব্যক্তি আপনার প্রতি সলাত আদায় করল না। আমি বললাম, আ-মীন।[7]
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বলেন,
أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ رَقَى الْمِنْبَرَ فَقَالَ : آمِينَ ، آمِينَ ، آمِينَ ، قِيلَ لَه : يَا رَسُولَ اللهِ ، مَا كُنْتَ تَصْنَعُ هٰذَا ؟ فَقَالَ : قَالَ لِىْ جِبْرِيلُ : رَغِمَ أَنْفُ عَبْدٍ أَدْرَكَ أَبَوَيْهِ أَوْ أَحَدَهُمَا لَمْ يُدْخِلْهُ الْجَنَّةَ ، قُلْتُ : آمِينَ . ثُمَّ قَالَ : رَغِمَ أَنْفُ عَبْدٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ لَمْ يُغْفَرْ لَه فَقُلْتُ : آمِينَ . ثُمَّ قَالَ : رَغِمَ أَنْفُ امْرِئٍ ذُكِرْتَ عِنْدَه” فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ ، فَقُلْتُ : آمِينَ
একদিন নাবী (সা.) মিম্বরে আরোহণ করলেন এবং বললেন, আ-মীন! আ-মীন!! আ-মীন!!! তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এটা কি করলেন? জবাবে বললেন : ধুলায় ধূসরিত হোক তার নাক যে ব্যক্তি তার পিতামাতা দু’জনকে বা তাঁদের কোন একজনকে পেল অথচ তারা তার জান্নাতে প্রবেশের কারণ হল না! আমি বললাম : আ-মীন (অর্থাৎ তাই হোক)। অতঃপর (দ্বিতীয়বার) তিনি বললেন : ধূলায় ধূসরিত হোক তার নাক যে রমাযান মাস পেল অথচ তার মাগফিরাত হল না, আমি বললাম : আ-মীন! অতঃপর জিব্রীল পুনরায় বললেন, ধূলায় ধূসরিত হোক তার নাক যার সম্মুখে আপনার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল অথচ সে আপনার প্রতি সলাত আদায় করল না। তখনও আমি বললাম : আ-মীন।[8]
৫৭. ‘উমরাহ্ করা :
‘উমরাহ্ করলে পাপ মাফ হয়ে যায়। নাবী (সা.) বলেছেন :
الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَه جَزَاءٌ إِلَّا الْجَنَّةُ
‘‘একটি ‘উমরাহ্ পরবর্তী ‘উমরাহ্ পর্যন্ত ঐ দুয়ের মধ্যবর্তী সময়ে কৃত পাপরাশির জন্য কাফফারাহ্ (মোচনকারী) হয়। আর ‘মাবরূর’ (বিশুদ্ধ বা গৃহীত) হাজ্জের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।’’[9]
৫৮. হাজ্জের জন্য যাওয়ার বাহনের পা উঠানামা করা :
হাজ্জে যাওয়ার বাহন যদি পশু হয় তাহলে সেই পশুর প্রতি কদমে হাজীর গুনাহ মাফের সুযোগ রয়েছে। ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নাবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি,
مَا يَرْفَعُ إِبِلُ الْحَاجِّ رِجْلًا وَلَا يَضَعُ يَدًا إِلَّا كَتَبَ اللهُ لَه بِهَا حَسَنَةً أَوْ مَحَا عَنْهُ سَيِّئَةً أَوْ رَفَعَه بِهَا دَرَجَةً
‘‘হাজীর উটের (প্রত্যেকবার) পা উঠানামার বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা হাজীর ‘আমলনামায় একটি করে সাওয়াব লিখেন অথবা তার ‘আমলনামা থেকে একটি গুনাহ মোচন করেন কিংবা এর মাধ্যমে তিনি তার মর্যাদা উন্নীত করেন।’’[10]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
فَإِنَّكَ إِذَا خَرَجْتَ مِنْ بَيْتِكَ تَؤُمُّ الْبَيْتَ الْحَرَامَ لَا تَضَعُ نَاقَتُكَ خَفَا وَلَا تَرْفَعَه إِلَّا كَتَبَ اللهُ لَكَ بِه حَسَنَةٌ وَمَحَا عَنْكَ خَطِيْئَةً
‘‘যখন তুমি (হাজ্জ করার জন্য) বাইতুল্লাহিল হারাম-এর উদ্দেশে তোমার বাড়ি থেকে বের হবে তখন থেকেই তোমার উট যতবারই তার পা উঠানামা করে তার প্রতিটির বিনিময়ে আল্লাহ তোমার জন্য একটি সাওয়াব লেখেন এবং একটি গুনাহ মুছে দেন।’’[11]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
فَإِنَّ لَكَ مِنَ الْأَجْرِ إِذَا أَمَّمْتَ الْبَيْتَ الْعَتِيْقَ أَلَّا تَرْفَعَ قَدَمًا أَوْ تَضَعَهَا أَنْتَ وَدَابَّتُكَ إِلَّا كُتِبَتْ لَكَ حَسَنَةً وَرُفِعَتْ لَكَ دَرَجَةً
‘‘যখন তুমি (হাজ্জ করার জন্য) বাইতুল ‘আতীক্ব (কা‘বাহ্)-এর উদ্দেশে বের হবে তখন থেকেই তুমি ও তোমার বাহন (পশু) যতবারই তার পা উঠানামা করে তার প্রতিটির বিনিময়ে তোমার জন্য একটি সাওয়াব লেখা হয় এবং একটি মর্যাদার স্তর উন্নীত করা হয়।’’[12]
[2]. আছারটি সহীহ; আল আযরাকী, আখবারে মাক্কাহ, খ. ১, পৃ. ৩১২; আলবানী তাখরীজ আল আদাব আল মুফরাদ গ্রন্থে বর্ণনাটিকে সহীহ বলেছেন, হাদীস নং ১১।
[3]. সূরা আ-লি ‘ইমরা-ন ০৩ : ১৩৫; সুনান আবূ দাঊদ : ১৫২৩, জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৩০০৬, সুনান ইবনু মাজাহ : ১৩৯৫, সহীহ আল জামি‘ : ৫৭৩৮, হাদীসটি সহীহ।
[4]. জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৩৮৮, হাদীসটি সহীহ।
[5]. জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৩৮৮, হাদীসটি সহীহ।
[6]. সুনান ইবনু মাজাহ : ১৪২৪, হাদীসটি সহীহ।
[7]. আদ্ দুর্ আল মানসুর, খ. ৬, পৃ. ৬৫১; হাদীসটি সহীহ।
[8]. আল আদাবুল মুফরাদ : ৬৪৬; হাদীসটির সনদ হাসান সহীহ।
[9]. সহীহুল বুখারী : ১৭৭৩; সহীহ মুসলিম : ৩৩৫৫।
[10]. শু‘আবুল ঈমান : ৪১১৬।
[11]. সহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব : ১১১২, হাদীসটি হাসান লিগাইরিহী।
[12]. আল মু‘জামুল আওসাত : ২৩২০, হাদীসটি হাসান লিগাইরিহী।
৫৯. হাজ্জ ও ‘উমরাহ্ পরপর করা :
পরপর হাজ্জ ও ‘উমরাহ্ করলে জীবনের গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। নাবী (সা.) বলেছেন :
تَابِعُوا بَيْنَ الْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الْفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ
‘তোমরা হজ্জকে ‘উমরাহ্ ও ‘উমরাহকে হজ্জের অনুগামী কর। (অর্থাৎ হাজ্জ করলে ‘উমরাহ্ ও ‘উমরাহ্ করলে হাজ্জ কর।) কারণ হাজ্জ ও ‘উমরাহ্ উভয়েই দারিদ্র্য ও পাপরাশিকে সেরূপ দূরীভূত করে যেরূপ (কামারের) হাপর লোহার ময়লাকে দূরীভূত করে ফেলে।’[1]
৬০. হাজরে আসওয়াদ ও রুক্নে ইয়ামানী স্পর্শ করা :
হাজারে আসওয়াদ চুম্বন ও রুক্নে ইয়ামানী স্পর্শ করলে পাপ মাফ হয়। নাবী (সা.) বলেছেন :
إنَّ مَسْحَ الحَجَرِ الْأسْوَدِ والرُّكْنِ اليَمانِي يَحُطَّانِ الخَطايا حَطًّا
‘‘হাজারে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী উভয়কে স্পর্শ পাপ মোচন করে।’’[2]
‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,
إِنَّ مَسْحَهُمَا يَحُطَّانِ الْخَطِيئَةَ
‘‘উভয়কে স্পর্শ পাপ মোচন করে।’’[3]
ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :
فالسنة في الحجر الاسود استلامه وتقبيله والسنة في الركن اليماني استلامه ولا يقبل
‘‘হাজরে আসওয়াদের ক্ষেত্রে সুন্নাহ্ হলো সেটি স্পর্শ করা ও চুমু দেয়া আর রুকনুল ইয়ামানীর ক্ষেত্রে সুন্নাহ্ হলো সেটি শুধু স্পর্শ করা, চুমু দেয়া (সুন্নাহ) নয়।’’[4]
অতএব যেহেতু রুকনে ইয়ামানী চুমু দেয়ার কোন দলীল নেই। সুতরাং তা বৈধ নয়।
৬১. কা‘বাহ্ ঘর ত্বওয়াফ করা :
মুসলিমদের কিবলা কা‘বাহ্ ঘর ত্বওয়াফ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদাত। হাজ্জ ও ‘উমরাহ্ পালনের সময় ত্বওয়াফ করা জরুরি। কিন্তু সাধারণভাবে নফল হিসেবেও কা‘বাহ্ ঘর ত্বওয়াফ করা অনেক ফযীলতের ‘আমল। ত্বওয়াফের মাধ্যমে ত্বওয়াফকারীর গুনাহও মাফ হয়। নাবী (সা.) বলেছেন :
مَنْ طَافَ بِهٰذَا الْبَيْتِ أُسْبُوعًا يُحْصِيهِ كُتِبَ لَه بِكُلِّ خُطْوَةٍ حَسَنَةٌ وَكُفِّرَ عَنْهُ سَيِّئَةٌ وَرُفِعَتْ لَه دَرَجَةٌ وَكَانَ عَدْلَ عِتْقِ رَقَبَةٍ
‘‘যে ব্যক্তি এই (কাবা) ঘর সাতবার চক্কর দেয় (অর্থাৎ একবার ত্বওয়াফ করে) তার প্রতি পদক্ষেপের (হাঁটার সময় পা রাখা-উঠানো) বিনিময়ে একটি করে সাওয়াব তার ‘আমলনামায় লেখা হয় ও তার থেকে একটি করে গুনাহ মাফ করা হয় এবং তার মর্যাদা বাড়ানো হয় আর পুরো ত্বওয়াফ একটি দাসমুক্তির সমতুল্য।’’[5]
‘উমায়র (রহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন,
أَنَّ ابْنَ عُمَرَ كَانَ يُزَاحِمُ عَلَى الرُّكْنَيْنِ زِحَامًا مَا رَأَيْتُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ ﷺ يَفْعَلُه فَقُلْتُ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمٰنِ إِنَّكَ تُزَاحِمُ عَلَى الرُّكْنَيْنِ زِحَامًا مَا رَأَيْتُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ ﷺ يُزَاحِمُ عَلَيْهِ فَقَالَ إِنْ أَفْعَلْ فَإِنِّىْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ ﷺ يَقُولُ إِنَّ مَسْحَهُمَا كَفَّارَةٌ لِلْخَطَايَا وَسَمِعْتُه” يَقُولُ مَنْ طَافَ بِهٰذَا الْبَيْتِ أُسْبُوعًا فَأَحْصَاهُ كَانَ كَعِتْقِ رَقَبَةٍ وَسَمِعْتُه” يَقُولُ لَا يَضَعُ قَدَمًا وَلَا يَرْفَعُ أُخْرٰى إِلَّا حَطَّ اللهُ عَنْهُ خَطِيئَةً وَكَتَبَ لَه” بِهَا حَسَنَةً
ইবনু ‘উমার চাপাচাপি করে হলেও হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী বায়তুল্লাহর এই দুই রুকনে যেতেন। আমি একদিন তাঁকে বলাম, আপনি এ দু’টি রুকনে ভীড়ে চাপাচাপি করে হলেও গিয়ে উপস্থিত হন কিন্তু অন্য কোন সাহাবী তো এমন চাপাচাপি করে সেখানে যেতে দেখি না। তিনি বললেন, যদি আমি এরূপ চাপাচাপি করি তাতে দোষ কী? কেননা আমি তো রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, এ দু’টো রুকন স্পর্শ করা স্পর্শকারীর গুনাহসমূহের কাফফারাহ্ হয়ে যায় তাঁকে আরো বলতে শুনেছি, কেউ যদি যথাযথ ভাবে বায়তুল্লাহর সাতবার ত্বওয়াফ করে (অর্থাৎ সাত চক্কর দিয়ে এক ত্বওয়াফ সম্পন্ন করে) তাহলে তাতে একটি ক্রীতদাস মুক্ত করার মত সাওয়াব হয়। আমি তাঁকে আরো বলতে শুনেছি, ত্বওয়াফ করতে গিয়ে এমন কোন কদম সে রাখেনা বা তা উঠায় না যা দ্বারা তার একটি গুনাহ মাফ না হয় এবং একটি নেকী লেখা না হয়।[6]
৬২. ‘আরাফাত দিবসের সিয়াম রাখা :
হাজ্জের মৌলিক কাজ হচ্ছে যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখে মক্কার অনতিদূরে ‘আরাফাত ময়দানে সারাদিন অবস্থান করা। কিন্তু এই দিনে যারা ‘আরাফাতের ময়দানের বাইরে থাকেন, অর্থাৎ হাজ্জ করেন না তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ্সম্মত ‘আমল হচ্ছে এই দিন সিয়াম পালন করা। আর এই একটি সিয়ামের মাধ্যমে ব্যক্তির পূর্বের একবছর ও পরের একবছরের গুনাহ মাফ করা হয়। ক্বাতাদাহ্ বলেন, নাবী (সা.) ‘আরাফার দিবসের সাওম পালন করার ফযীলত সম্পর্কে বলেছেন,
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِى قَبْلَه وَالسَّنَةَ الَّتِى بَعْدَه
‘‘আর ‘আরাফাত দিবসের সাওম (রোযা) সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, এর মাধ্যমে তিনি পূর্ববর্তী বছর ও পরবর্তী বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।’’[7]
ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :
والمراد بها الصغائر … أنه ان لم تكن صغائر يرجى التخفيف من الكبائر فان لم يكن رفعت درجات
‘‘এর দ্বারা সগীরা গুনাহ উদ্দেশ্য।... যদি সগীরা গুনাহ ব্যক্তির ‘আমলনামায় না থাকে তাহলে তার কাবীরা গুনাহ (থাকলে) হালকা করা হবে বলে আশা করা যায়। আর যদি কাবীরা গুনাহও না থাকে তাহলে তার মর্যাদা উন্নীত করা হয়।’’[8]
সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, নাবী (সা.) বলেন :
مَنْ صَامَ يَوْمَ عَرَفَةَ غُفِرَ لَه ذَنْبٌ سَنَتَيْنِ مُتَتَابِعَتَيْنِ
‘‘যে ব্যক্তি ‘আরাফার দিন সিয়াম রাখে তার উপর্যুপরি দুই বছরের পাপরাশি মাফ হয়ে যায়।’’[9]
৬৩. মুহার্রমের ১০ তারিখে (‘আশূরার) সিয়াম রাখা :
রমাযানের ফরয সিয়ামের পরে সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ সিয়াম হচ্ছে ‘আশূরা দিনের (অর্থাৎ মুহাররম মাসের ১০ তারিখের) সিয়াম। এই সিয়াম পূর্বের এক বছরের গুনাহ মাফ করায়। কাতাদাহ্ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী (সা.) ‘আশূরার সাওম (মুহাররম মাসের দশ তারিখে সিয়াম) পালন করার ফযীলত সম্পর্কে বলেন,
صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِى قَبْلَه
‘‘আর ‘আশূরার সাওম (রোযা) সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তিনি এর মাধ্যমে বান্দার পূর্ববর্তী বছরের গুনাহসমূহ মাফ করে দিবেন।’’[10]
উল্লেখ্য যে, এই দিনের সাথে সাথে আগের দিন (৯ তারিখ) বা পরের দিন (১১ তারিখ) মোট দুই দিন সিয়াম পালন করা মুস্তাহাব ও অধিক ফযীলতের।
৬৪. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সলাত ও সালাম পাঠ করা :
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সলাত ও সালাম পেশ করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি ‘আমল। তাঁর প্রতি সলাত পেশ করলে শুধু সাওয়াবই হয় না বরং গুনাহও মাফ হয়। আনাস ইবন মালিক নাবী (সা.)-এর বরাত দিয়ে বলেন যে, তিনি বলেছেন :
مَنْ صَلّٰى عَلَيَّ وَاحِدَةً صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ عَشْرًا وَحَطَّ عَنْهُ عَشْرَ خَطِيئَاتٍ
‘‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার সলাত আদায় করবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করেন এবং তার দশটি গুনাহ মোচন করেন।’’[11]
আবূ ত্বলহাহ্ আল আনসারী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَصْبَحَ رَسُولُ اللهِ ﷺ يَوْمًا طَيِّبَ النَّفْسِ يُرٰى فِي وَجْهِهِ الْبِشْرُ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ أَصْبَحْتَ الْيَوْمَ طَيِّبَ النَّفْسِ يُرٰى فِي وَجْهِكَ الْبِشْرُ قَالَ أَجَلْأَتَانِي آتٍ مِنْ رَبِّىْ عَزَّ وَجَلَّ فَقَالَ مَنْ صَلّٰى عَلَيْكَ مِنْ أُمَّتِكَ صَلَاةً كَتَبَ اللهُ لَه عَشْرَ حَسَنَاتٍ وَمَحَا عَنْهُ عَشْرَ سَيِّئَاتٍ وَرَفَعَ لَه عَشْرَ دَرَجَاتٍ
একদিন সকালে রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রফুল্ল মনে সকাল করলেন। তখন তার চেহারায় আনন্দের ছাপ দেখা যাচ্ছিল। তখন সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আজ আপনি প্রফুল্লচিত্তে সকাল করেছেন, এতে আপনার চেহারায় খুশির ছাপ দেখা যাচ্ছে। (এর কারণ কী?) তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমার কাছে আমার সম্মানিত রবের পক্ষ থেকে একজন আগমণকারী এসে বললো, ‘‘আপনার উম্মাতের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি তোমার প্রতি একবার সলাত পাঠ করবে আল্লাহ তার জন্য দশটি সাওয়াব লিখে দেন, তার দশটি গুনাহ মোচন করেন এবং তার মর্যাদার দশটি স্তর বৃদ্ধি করে দেন।’’[12]
[2]. আল মু‘জামুল কাবীর : ১৩৪৩৮, সহীহ আল জামি‘ : ২১৯৪।
[3]. মুসনাদ আহমাদ : ৫৭০১; সুনান আন্ নাসায়ী : ২৯১৯, হাদীসটি সহীহ।
[4]. আল মাজমূ’, খ. ৮, পৃ. ৩৭।
[5]. মুসনাদে আহমাদ : ৫৭০১।
[6]. জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৯৫৯, হাদীসটি সহীহ।
[7]. সহীহ মুসলিম : ২৮০৩।
[8]. শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ৮, পৃ. ২৯২।
[9]. আল মু‘জামুল কাবীর : ৫৯২৩; সহীহুত তারগীব : ১০১২।
[10]. সহীহ মুসলিম : ২৮০৩।
[11]. মুসনাদ আহমাদ : ১১৯৯৮; আলবানী আস্ সহীহাহ্ গ্রন্থে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, হাদীস নং ৮২৯।
[12]. মুসনাদ আহমাদ : ১৬৩৫২; সনদ হাসান।