ইসলামে এমন কিছু ‘আমল রয়েছে যেগুলোর কোন একটি যিনি করবেন তার পূর্বের জীবনের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
নিম্নে সেসব ‘আমলগুলো সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো :
১৯. উযূ করা :
কেউ যদি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দেখানো পদ্ধতিতে উযূ করে তার পূর্বের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। একদিন তৃতীয় খলীফা ‘উসমান বিন ‘আফ্ফান উযূ করার পর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আমার এই উযূর মত উযূ করতে দেখলাম। অতঃপর তিনি বললেন,
مَنْ تَوَضَّأَ هَكَذَا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه وَكَانَتْ صَلَاتُه وَمَشْيُه إِلَى الْمَسْجِدِ نَافِلَةً
‘‘যে ব্যক্তি এরূপ উযূ করবে, তার পূর্বের পাপরাশি মাফ করা হবে এবং তার সলাত ও মাসজিদের দিকে চলার সাওয়াব অতিরিক্ত হিসেবে গণ্য হবে।’’[1]
২০. সুন্দর করে উযূ করে দুই রাক্‘আত সলাত আদায় করা :
শুধু উযূ করলেও যেমন গুনাহ মাফ হয় তেমনি অন্য হাদীস মোতাবেক কেউ যদি সুন্দরমত উযূ করে কোন ভুল ছাড়াই পূর্ণ মনোযোগ সহকারে দুই রাক্‘আত সলাত আদায় করে তাহলেও তার বিগত জীবনের সকল পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়।
যায়দ বিন খালিদ আল জুহানী বলেন, নাবী (সা.) বলেছেন :
مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ وُضُوْءَه ثُمَّ صَلّٰى رَكْعَتَيْنِ لَا يَسْهُوَ فِيْهِمَا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে উযূ করে, কোন ভুল না করে (একাগ্রচিত্তে) দুই রাক‘আত সলাত আদায় করে, সেই ব্যক্তির পূর্বেকার সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’’[2]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ تَوَضَّأَ كَمَا أُمِرَ وَصَلّٰى كَمَا أُمِرَ غُفِرَ لَه مَا قَدَّمَ مِنْ عَمَلٍ
‘‘(আল্লাহ ও তার রাসূলের) নির্দেশনা মোতাবেক যে ব্যক্তি উযূ করবে এবং নির্দেশনা মোতাবেক সলাত আদায় করবে তার পূর্বে ‘আমলের গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে।’’[3]
‘উসমান উযূ করা শেষ করে বললেন, আমি নাবী (সা.)-কে দেখেছি, আমি এইমাত্র যেভাবে উযূ করেছি তিনি সেভাবেই উযূ করেছেন। তারপর তিনি বলেন,
مَنْ تَوَضَّأَ نَحْوَ وُضُوئِي هٰذَا ثُمَّ صَلّٰى رَكْعَتَيْنِ لَا يُحَدِّثُ فِيهِمَا نَفْسَه غَفَرَ اللهُ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘যে ব্যক্তি আমার মতো এ রকম উযূ করবে, তারপর দু রাক্‘আত সলাত আদায় করবে, যাতে দুনিয়ার কোন খেয়াল করবে না, তার পেছনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’’[4]
ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :
أما قوله ﷺ لَا يُحَدِّثُ فِيْهِمَا نَفْسَه فالمراد لا يحدث بشئ من أمور الدنيا وما لا يتعلق بالصلاة ولو عرض له حديث فأعرض عنه بمجرد عروضه عفى عن ذلك وحصلت له هذه الفضيلة إن شاء الله تعالى لأن هذا ليس من فعله وقد عفى لهذه الامة عن الخواطر التي تعرض ولا تستقر
‘‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কথা ‘যাতে নিজের কোন বাক্যালাপ করবে না’-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সে দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত এবং সলাতের সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন কোন কাজ করবে না। যদি তার সামনে কোন কথা বলা হয় তাহলে সে তা এড়িয়ে যাবে আর স্বল্প প্রতি উত্তর দিবে। তাহলে তাকে মাফ করে দেয়া হবে এবং হাদীসে বর্ণিত ফযীলত সে পেয়ে যাবে, ইনশা-আল্লা-হ। কারণ এতটুকু তার ইচ্ছকৃত কর্মের অন্তর্ভুক্ত নয়। এই উম্মাতের সেসব ভুল ধরা হয় না যা অনাকাঙিÿতভাবে সামনে চলে আসা পরিস্থিতির কারণে করতে হয় কিন্তু তার উপরে অটল থাকে না।’’[5]
ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন,
المراد بالغفران الصغائر دون الكبائر وفيه استحباب صلاة ركعتين فأكثر عقب كل وضوء وهو سنة مؤكدة
‘‘অত্র হাদীসে গুনাহ মাফ দ্বারা সগীরা গুনাহ মাফের কথা উদ্দেশ্য করা হয়েছে; কাবীরা গুনাহ নয়। আর এই হাদীস দ্বারা প্রত্যেকবার উযূর পরপরই দুই বা ততোধিক রাক্‘আত সলাত আদায় করা মুস্তাহাব ‘আমল প্রমাণিত হলো। এ ‘আমল সুন্নাতে মুয়াক্কাদাও।’’[6]
২১. সলাতের সময় হলে উত্তমরূপে উযূ করে উত্তমরূপে সলাত আদায় করা :
খলীফা ‘উসমান হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :
مَا مِنِ امْرِئٍ مُسْلِمٍ تَحْضُرُه صَلَاةٌ مَكْتُوبَةٌ فَيُحْسِنُ وُضُوءَهَا وَخُشُوعَهَا وَرُكُوعَهَا إِلَّا كَانَتْ كَفَّارَةً لِمَا قَبْلَهَا مِنَ الذُّنُوبِ مَا لَمْ يُؤْتِ كَبِيرَةً وَذٰلِكَ الدَّهْرَ كُلَّه
‘‘কোন মুসলিম ব্যক্তির যখন কোন ফরয সলাত-এর ওয়াক্ত হয় আর সে সলাত-এর উযূকে উত্তমরূপে করে, সলাত-এর ভিতরে বিনয় ও রুকূ‘ উত্তমরূপে আদায় করে, তাহলে যতক্ষণ না সে কোন কাবীরা গুনাহে লিপ্ত হবে, তার এই সলাত তার পূর্ববর্তী যাবতীয় গুনাহের জন্য কাফ্ফারা হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আর এ অবস্থা সর্বযুগেই বিদ্যমান।’’[7]
নাবী (সা.) বলেছেন :
لَا يَتَوَضَّأُ رَجُلٌ مُسْلِمٌ فَيُحْسِنُ الْوُضُوءَ فَيُصَلِّى صَلَاةً إِلاَّ غَفَرَ اللهُ لَه مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الصَّلَاةِ الَّتِى تَلِيهَا
‘‘যেই মুসলিম ব্যক্তি উযূ করবে এবং উযূকে সুন্দরভাবে আদায় করবে, অতঃপর সলাত আদায় করবে সেই ব্যক্তির এই সলাত ও তার পূর্ববর্তী সলাত-এর মধ্যবর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।[8]
২২. ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা শেষে ‘‘আ-মীন’’ বলা :
ইমামের পিছনে জামা‘আতে সলাত আদায়কালে ইমাম সূরা ফাতিহার শেষ আয়াত ‘গাইরিল মাগযূবি ‘আলাইহিম ওয়ালায্ যো-ল্লীন’ পড়া শেষ করে তখন উচ্চৈঃস্বরে[9] ‘আ-মীন’ বলা সুন্নাত।
যে ব্যক্তি এমন করে ‘আ-মীন’ বলবে আর তার ‘আ-মীন’ বলার সাথে ফেরেশতাগণের ‘আ-মীন’ বলা মিলে যাবে তাহলে তার জীবনের পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :
إِذَا قَالَ الْإِمَامُ ﴿غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ﴾ فَقُولُوا آمِينَ فَإِنَّه مَنْ وَافَقَ قَوْلُه قَوْلَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘ইমাম যখন ‘গাইরিল মাগযূবি ‘আলাইহিম ওলায্ যো-ল্লীন’ বলে তখন তোমরা ‘আ-মীন’ বল। কারণ যার ‘আ-মীন’ বলা ফেরেশতাদের ‘আ-মীন’ বলার সাথে মিলে যায়, তার পূর্বেকার সকল পাপ মাফ করে দেয়া হয়।’’[10]
অন্য এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :
إِذَا أَمَّنَ الْإِمَامُ فَأَمِّنُوا فَإِنَّه مَنْ وَافَقَ تَأْمِينُه تَأْمِينَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘ইমাম যখন ‘আ-মীন’ বলবে, তখন তোমরাও ‘আ-মীন’ বল। কারণ, যার ‘আ-মীন’ বলা ফেরেশতাদের ‘আ-মীন’ বলার সাথে সাথে হয়, তখন তার পূর্বেকার গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হয়।’’[11]
আরো এক বর্ণনায় তিনি বলেন,
إِذَا قَالَ أَحَدُكُمْ آمِينَ وَقَالَتْ الْمَلَائِكَةُ فِي السَّمَاءِ آمِينَ فَوَافَقَتْ إِحْدَاهُمَا الْأُخْرٰى غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه
‘‘তোমাদের কেউ যখন সলাতে ‘আ-মীন’ বলে এবং ফেরেশতারা আকাশে ‘আ-মীন’ বলেন, আর পরস্পরে ‘আ-মীন’ বলা সমস্বরে হয়, তখন তার পূর্বের পাপরাশি মাফ করে দেয়া হয়।’’[12]
উপরে উল্লিখিত হাদীসগুলো দ্বারা জানা গেলো যে, জামা‘আতে সলাত আদায়ের সময় যদি মুক্তাদী ইমাম সাহেবের সূরা ফাতিহা শেষে ‘আ-মীন’ বলা শুনে পূর্ণ মনোযোগ, ভীতি ও একনিষ্ঠতা সহকারে ‘আ-মীন’ বলে এবং তা যদি ফেরেশতাগণের ‘আ-মীন’ বলার সাথে মিলে যায় তাহলে তার পূর্বের সকল সগীরা গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। আর যদি তার ‘আমলনামায় সগীরা গুনাহ না থাকে তাহলে তার কাবীরা গুনাহ (যদি থাকে) হালকা করে দেয়া হবে, ইন্শা-আল্লা-হ।[13]
[2]. সুনান আবূ দাঊদ : ৯০৫; সহীহুত তারগীব : ২২১ হাদীসটি সহীহ।
[3]. সুনান আন্ নাসায়ী : ১৪৪, সুনান ইবনু মাজাহ : ১৩৯৬, হাদীসটির সহীহ।
[4]. সহীহুল বুখারী : ১৫৯, ১৬৪, সহীহ মুসলিম : ৫৬০, ৫৬১।
[5]. শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ৩, পৃ. ১০৮।
[6]. শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ৩, পৃ. ১০৮।
[7]. সহীহ মুসলিম : ৫৬৫।
[8]. সহীহ মুসলিম : ৫৬২।
[9]. গগণবিদারী চিৎকার করে নয়, স্বাভাবিক উচ্চ আওয়াজে বলতে হবে।
[10]. সহীহুল বুখারী : ৭৮২; সহীহ মুসলিম : ৯৪৭।
[11]. সহীহুল বুখারী : ৭৮০, সহীহ মুসলিম : ৯৪২।
[12]. সহীহুল বুখারী : ৭৮০-৭৮২, ৪৪৭৫, ৬৪০২; সহীহ মুসলিম : ৯৪২, ৯৪৪-৯৪৫।
[13]. মিন মুকাফফিরাতিয যুনূব, পৃ. ২৩।