গুনাহ মাফের উপায় গুনাহ মাফের আমলগুলোর স্তরবিন্যাস শাহাদাৎ হুসাইন খান ফয়সাল (রহ.)
[১] এমন ‘আমল যা ব্যক্তির বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেয় - ২

২৩. সলাতে রুকূ‘ থেকে উঠে নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করা :

জামা‘আতের সাথে সলাত আদায়কালে ইমাম যখন রুকূ‘ থেকে উঠার সময় সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ্ বলে, তখন মুক্তাদী আল্লা-হুম্মা রববানা- লাকাল হাম্দ বললে মুক্তাদীর বিগত জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।

এ ব্যাপারে নাবী (সা.) বলেছেন :

إِذَا قَالَ الإِمَامُ سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَه. فَقُولُوا اَللّٰهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ . فَإِنَّه مَنْ وَافَقَ قَوْلُه قَوْلَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه

‘‘যখন ইমাম সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ্ বলে, তখন তোমরা আল্লা-হুম্মা রব্বানা- লাকাল হাম্‌দ বল। কেননা যার ঐ কথা বলা ফেরেশতাদের বলার সাথে মিলে যায়, তার বিগত জীবনের সকল পাপ মাফ করে দেয়া হয়।’’[1]


২৪. রমাযানের সিয়াম পালন করা :

ঈমানসহ ও সাওয়াবের আশায় কেউ যদি রমাযান মাসের ফরয সিয়াম পালন করে তাহলে তার পূর্বের জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه

‘‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ সাওয়াবের আশায় রমাযানের সিয়াম পালন করে, তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’’[2]


২৫. রমাযানে ক্বিয়ামুল লাইল আদায় করা :

রমাযান মাসে ক্বিয়ামুল লাইল বা রাতের সলাত (তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ) আদায় করলে বিগত জীবনের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। আবূ হুরায়রাহ্ হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه

‘‘যে ব্যক্তি রমাযানের রাতে ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’’[3]

ইবনু হাজার আল ‘আসক্বালানী (রহিমাহুল্লাহ)[4] বলেন :

ظاهره يتناول الصغائر والكبائر وبه جزم ابن المنذر وقال النووي المعروف أنه يختص بالصغائر وبه جزم إمام الحرمين وعزاه القاضي عياض لأهل السنة قال بعضهم ويجوز أن يخفف من الكبائر إذا لم يصادف صغيرة

‘‘হাদীসের বাহ্যিক অর্থ সগীরা-কাবীরা সকল গুনাহকে শামিল করে। ইবনুল মুনযির এই মত পোষণ করেছেন। ইমাম নাবাভীর মতে, এ হাদীস শুধু সগীরা গুনাহের জন্য নির্ধারিত। ইমামুল হারামাইনও এই মত পোষণ করেছেন। ক্বাযী ‘ইয়ায এ মতকে আহলুস্ সুন্নাহ্র দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, ‘আমলনামায় সগীরা গুনাহ না থাকলে কাবীরা গুনাহকে হালকা করা হয় (যদি থাকে)।’’[5]


২৬. লাইলাতুল কদরের সলাত আদায় করা :

লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদরে বেশি বেশি নফল সলাত আদায় করলে পূর্বের জীবনের সমস্ত পাপ মাফ করে দেয়া হয়। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه

‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়।’’[6]

উল্লেখ্য যে, নির্দিষ্ট করে প্রতিবছর ২৭ রমাযানের রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে নির্ধারণ করার কোন নিশ্চিত ভিত্তি নেই। ২৭ তারিখও হতে পারে আবার ২১, ২৩, ২৫ বা ২৯ রমাযানের রাতও কদরের রাত হতে পারে। তাইতো রাসূলুল্লাহ (সা.) রমাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করতে আদেশ দিয়েছেন। ‘আয়িশাহ্ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেছেন,

تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنْ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ

‘‘তোমরা রমাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’’[7]


২৭. ইসলাম গ্রহণ করা :

কোন অমুসলিম যখন ইসলাম গ্রহণ করে তখন তার পূর্বের সকল গুনাহ ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ يَنْتَهُوا يُغْفَرْ لَهُمْ مَا قَدْ سَلَفَ وَإِنْ يَعُودُوا فَقَدْ مَضَتْ سُنَّتُ الْأَوَّلِينَ

‘‘যারা কুফরী করেছে তুমি তাদেরকে বল, যদি তারা বিরত হয় তাহলে অতীতে যা হয়েছে তাদেরকে তা ক্ষমা করা হবে। আর যদি তারা পুনরায় করে তাহলে পূর্ববর্তীদের (ব্যাপারে আল্লাহর) রীতি তো গত হয়েছে।’’[8]

আবূ সা‘ঈদ আল খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন,

إِذَا أَسْلَمَ الْعَبْدُ فَحَسُنَ إِسْلَامُه” يُكَفِّرُ اللهُ عَنْهُ كُلَّ سَيِّئَةٍ كَانَ زَلَفَهَا وَكَانَ بَعْدَ ذٰلِكَ الْقِصَاصُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلٰى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ وَالسَّيِّئَةُ بِمِثْلِهَا إِلَّا أَنْ يَتَجَاوَزَ اللهُ عَنْهَا

‘‘বান্দা যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার ইসলাম উত্তম হয়, আল্লাহ তা‘আলা তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেন। এরপর শুরু হয় প্রতিদান; একটি সৎ কাজের বিনিময়ে দশ গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত; আর একটি মন্দ কাজের বিনিময়ে ঠিক ততটুকু মন্দ প্রতিফল হয় (তার বেশি নয়)। অবশ্য আল্লাহ যদি মাফ করে দেন তবে ভিন্ন কথা।’’[9]

‘আম্র ইবনুল ‘আস (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তিনি নিজেই বলেন,

أَتَيْتُ النّبِيّ ﷺ فَقُلْتُ : ابْسُطْ يَمِينَكَ فَلأُبَايِعْكَ. فَبَسَطَ يَمِينَه. قَالَ فَقَبَضْتُ يَدِي. قَالَ : مَا لَكَ يَا عَمْرُو؟ قَالَ قُلْتُ : أَرَدْتُ أَنْ أَشْتَرِطَ. قَالَ : تَشْتَرِطُ بِمَاذَا؟ قُلْتُ : أَنْ يُغْفَرَ لِي. قَالَ : أَمَا عَلِمْتَ أَنّ الإِسْلاَمَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَه؟ وَأَنّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا؟ وَأَنّ الْحَجّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَه؟

আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে অনুরোধ জানালাম যে, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, আমি বায়‘আত করতে চাই। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন, তখন আমি আমার হাত টেনে নিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আম্র, কী ব্যাপার? আমি বললাম, পূর্বে আমি শর্ত করে নিতে চাই। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী শর্ত করবে? আমি উত্তর করলাম, আল্লাহ যেন আমার সব গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি বললেন, ‘আম্র! তুমি কি জানো না যে, ইসলাম পূর্ববর্তী সকল অন্যায় মিটিয়ে দেয়। হিজরত পূর্বেকৃত গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয় এবং হাজ্জ ও পূর্বের সকল গুনাহ মিটিয়ে দেয়।[10]

অন্য যে কোন ধর্ম বা নাস্তিক্যবাদ ছেড়ে কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তার পূর্বের সকল ছোট-বড় সকল গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিবেন। তা কুফরী হোক, শির্ক হোক, যা-ই হোক না কেন। ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :

فيه عظم موقع الإسلام والهجرة والحج، وأن كل واحد منها يهدم ما كان قبله من المعاصي

‘‘এ হাদীস দ্বারা ইসলাম গ্রহণ, হিজরত করা ও হাজ্জের মাহাত্ম্য ও বড়ত্ম সাব্যস্ত হয়। আর এগুলোর প্রতিটি ব্যক্তির জীবনের পূর্বের জীবনের সকল গুনাহকে ধ্বংস করে দেয়।’’[11]


২৮. হিজরত করা :

হিজরত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছেন তেমনি অসংখ্য সাহাবী মক্কা থেকে হাবাশায় এবং মদীনায় হিজরত করেছেন। হিজরতও পূর্বের গুনাহ ধ্বংস করে দেয়। ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) বলেছেন :

وَأَنَّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا

‘‘হিজরত তার পূর্বের গুনাহসমুহ মুছে দেয়।’’[12]


২৯. হাজ্জ করা :

হিজরতের মত হজ্জও এর পূর্বের গুনাহ মাফ করিয়ে দেয়। ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) বলেছেন :

وَأَنَّ الْحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَه

‘‘হজ্জও পূর্বের সকল গুনাহ মিটিয়ে দেয়।’’[13]


৩০. খাওয়াদাওয়ার পর নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করা :

খাওয়া-দাওয়ার পর হাদীসে বর্ণিত নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করলে বিগত জীবনের সকল পাপ মাফ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :

مَنْ أَكَلَ طَعَامًا ثُمَّ قَالَ الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِىْ أَطْعَمَنِى هٰذَا الطَّعَامَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِّنِّى وَلَا قُوَّةٍ غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه وَمَا تَأَخَّرَ

‘‘যে ব্যক্তি খাওয়া শেষে এই দু‘আ পড়বে :

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِىْ أَطْعَمَنِى هٰذَا الطَّعَامَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِّنِّى وَلَا قُوَّةٍ

উচ্চারণ : আলহাম্‌দুলিল্লা-হিল্লাযী আত্‘আমানী হা-যাত্ব ত্ব‘আ-মা ওয়া রযাক্বানীহি মিন গইরি হাওলিম্ মিন্নী ওয়ালা- ক্যুওয়াহ্।

অর্থ : সেই আল্লাহর যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমাকে এই খাদ্য খাওয়ালেন এবং জীবিকা দান করলেন, আমার কোন উপায় ও সামর্থ্য ছাড়াই।

সে ব্যক্তির পূর্বের সমস্ত পাপ মাফ করে দেয়া হবে।’’[14]


৩১. কাপড় পরার সময় নির্দিষ্ট দু‘আ পাঠ করা :

যে কোন পোশাক পরিধান করার পরে কেউ যদি নিম্নে উল্লিখিত দু‘আটি পড়ে তাহলে তার বিগত জীবনের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।

নাবী (সা.) বলেছেন :

وَمَنْ لَبِسَ ثَوْبًا فَقَالَ الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِى كَسَانِى هٰذَا الثَّوْبَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّى وَلَا قُوَّةٍ غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه

‘‘আর যে ব্যক্তি কাপড় পরার শেষে এই দু‘আ পড়বে :

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِى كَسَانِى هٰذَا الثَّوْبَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِّنِّى وَلَا قُوَّةٍ

উচ্চারণ : আলহাম্‌দুলিল্লা-হিল্লাযী কাসা-নী হা-যাস সাওবা ওয়া রযাক্বানীহি মিন গইরি হাওলিম্ মিন্নী ওয়ালা- ক্যুওয়াহ্।

অর্থ : সেই আল্লাহর যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমাকে এই কাপড় পরালেন এবং জীবিকা দান করলেন, আমার কোন উপায় ও শক্তি-সামর্থ্য ছাড়াই।

সে ব্যক্তির পূর্বের সমস্ত পাপ মাফ করে দেয়া হবে।’’[15]

[1]. সহীহুল বুখারী : ৭৯৬; সহীহ মুসলিম : ৯৪০।

[2]. সহীহুল বুখারী : ৩৮, ২০১৪, সহীহ মুসলিম : ১৮১৭।

[3]. সহীহুল বুখারী : ৩৭, ২০০৯, সহীহ মুসলিম : ১৮১৫-১৮১৬।

[4]. জন্ম : ৭৭৩ হি. - মৃত্যু : ৮৫২ হি.।

[5]. ফাতহুল বারী, খ. ৪, পৃ. ২৫১।

[6]. সহীহুল বুখারী : ১৯০১, ২০১৪, সহীহ মুসলিম : ১৮১৭।

[7]. সহীহুল বুখারী : ২০১৭।

[8] সূরা আল আনফাল ০৮ : ৩৮।

[9]. সহীহুল বুখারী : ৪১।

[10]. সহীহ মুসলিম : ৩৩৬।

[11]. শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ২, পৃ. ৩১৮।

[12]. সহীহ মুসলিম : ৩৩৬।

[13]. সহীহ মুসলিম : ৩৩৬।

[14]. সুনান আবূ দাঊদ : ৪০২৫, শু‘আবুল ঈমান : ৬২৮৫, মুসনাদ আহমাদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ-এর বর্ণনায় শেষ শব্দ ‘‘ওয়ামা তাআখ্খারা’’ নেই।

[15]. সুনান আবূ দাঊদ : ৪০২৫; শু‘আবুল ঈমান : ৬২৮৫; হাদীসটির সনদ হাসান।