যুব-সমস্যা ও তার শরয়ী সমাধান আবদুল হামীদ ফাইযী ৪৬ টি
যুব-সমস্যা ও তার শরয়ী সমাধান আবদুল হামীদ ফাইযী ৪৬ টি

প্রত্যেক জাতির জন্য তার যুব-সমাজ হল সকল প্রগতি ও উন্নয়নের প্রধান স্তম্ভ। যুবসমাজই হল জাতির মেরুদন্ড, জাতির ভবিষ্যৎ এবং আগামী দিনের আশার আলো।

যুব-সমাজ হল জাতি ও উম্মাহর গর্ব। যে যুবক আল্লাহর দ্বীনের আলোকে আলোকপ্রাপ্ত, কিতাব ও সুন্নাহ-ভিত্তিক ইসলামী চরিত্রে চরিত্রবান, পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রগতিশীল। এমন উন্নত যুবককে নিয়েই উম্মাহ গর্ব করে।

জীবনে সব শ্রেণীর মানুষেরই সমস্যা আছে। সমস্যা আছে যুবক ও তরুণ-সমাজের। সে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে অনেক যুবকই ঘায়েল হয়ে পড়ে। অথচ সমস্যা যতই জটিল হোক না কেন, চেষ্টা ও পথ জানা থাকলে তার সমাধান সহজ হয়ে যায়। ইসলাম হল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে আসা মানুষের জন্য এক পূর্ণ জীবন-বিধান; যাতে আছে জীবনের সব ধরনের সমস্যার সমাধান। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, অজ্ঞানতা অথবা খেয়াল-খুশীবশে বহু যুবক মনে মনে এই ধারণা পোষণ করে যে, জীবনের এটাই হল আনন্দের মুহূর্ত। এ সময়টাই হল স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখ লুটার সময়। এরপরে বার্ধক্য এসে পড়লে জীবনের আর কোন স্বাদ ও সাধ অবশিষ্ট থাকবে না। অতএব এ সময় আমোদ-আনন্দ করে নিয়ে বৃদ্ধ হলে আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য করা যাবে এবং যৌবনকালের সকল বিষয়ের ক্ষতিপূরণ করে দেওয়া যাবে।

অথচ এমন চিন্তাধারা প্রকৃতত্ব থেকে বহু ক্রোশ দুরে। কারণ মহান সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যময় জীবনেই প্রকৃত আনন্দ নিহিত আছে। কেউ তা মানুক, চাহে না মানুক। দ্বিতীয়তঃ এ জীবনের কোন বিকল্প নেই, কোন পরিবর্ত নেই। এ সময় যে আবার ফিরে আসবে তা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়।

‘যৌবন বসন্ত-সম সুখময় বটে,

দিনে দিনে উভয়ের পরিণাম ঘটে।

কিন্তু পুনঃ বসন্তের হয় আগমন,

ফিরে না ফিরে না কভু, ফিরে না যৌবন।

এ বয়সের যে মূল্য, মান ও মর্যাদা আছে, তা জীবনের অন্য কোন বয়সে নেই। এ জন্যই কিয়ামতের মাঠে লোকেদের অবস্থা যখন সঙ্গিন হবে এবং প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার দুরের সুর্য মাথার উপরে মাত্র এক মাইল দূরে এসে উপস্থিত হবে, তখন মহান আল্লাহ কয়েক শ্রেণীর মানুষকে সম্মানের সাথে তার আরশের নীচে ছায়া দান করবেন। এদের মধ্যে এক শ্রেণীর মানুষ হবে সেই যুবকদল, যারা তাদের যৌবনকাল আল্লাহর আনুগত্যে অতিবাহিত করেছে। (বুখারী ৬৬০, মুসলিম ১০৩১ নং) সুতরাং ইলাহী এ পুরস্কারের কাছে পার্থিব যে কোনও সুখ ও সম্পদ অতুলনীয়।

তৃতীয়তঃ মানুষ কাল কিয়ামত কোর্টে তার আয়ু ও যৌবনকাল কোথায় কিভাবে অতিবাহিত করেছে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। তাহলে যে ব্যক্তি তার যৌবনকালকে আল্লাহর অবাধ্য থেকে রঙ্গরসে কাটিয়ে দেবে, সে ব্যক্তি ঐ জিজ্ঞাসার উত্তরে কি বলবে? চতুর্থতঃ মানুষের যৌবনকাল হল শক্তি, সামর্থ, সজীবতা, উদ্যম ও কর্মোদ্যোগের সময়কাল। এই সময়কাল অতিবাহিত হলে মানুষ ধীরে ধীরে দুর্বলতার দিকে ঢলে পড়ে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ, যিনি তোমাদেরকে দুর্বলরূপে সৃষ্টি করেন, দুর্বলতার পর তিনি শক্তি দেন, শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।” (সুরা রূমঃ ৫৪ আয়াত)

সুতরাং এ কথা কোন জ্ঞানী বলতে পারে না যে, শক্তি ও সজীবতার অবস্থায় অবহেলা করে দুর্বল ও বৃদ্ধ অবস্থায় সে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য করবে।

পঞ্চমতঃ এ কথার নিশ্চয়তা কোথায় যে, যুবক অবশ্যই বৃদ্ধকাল পর্যন্ত সুস্থভাবে বেঁচে থাকবে। কারণ, এমনও তো হতে পারে যে, সে যুবক অবস্থাতেই কোন ব্যাধি অথবা দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে ইহজগৎ চিরদিনের মত ত্যাগ করে যাবে।

অতএব জ্ঞানী যুবকের উচিত হল, মহানবী (সা.) এর এই উপদেশ ঘাড় পেতে মেনে নেওয়া। তিনি বলেন, “পাঁচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে গনীমত (অমূল্য সম্পদ) জেনে কদর করো; তোমার মরণের পূর্বে তোমার জীবনকে, তোমার অসুস্থতার পূর্বে তোমার সুস্থতাকে, তোমার ব্যস্ততার পুর্বে তোমার অবসর সময়কে এবং তোমার দারিদ্রের পূর্বে তোমার ধনবত্তাকে।” (আহমাদ, কিতাবুয যুহদ, হাকেম, বাইহাকীর শুআবুল ঈমান, সহীহুল জামে ১০৭৭ নং)

ইসলাম ও মুসলিমদের দুশমনরা বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম ও চিত্তবিনোদনমূলক কেন্দ্র ও যন্ত্রের মাধ্যমে যুব-সমাজকে এমন মাতিয়ে রেখেছে যে, উক্ত কদর করার মত ফুরসৎ তাদের নেই। নেই কিছু ভেবে ও বিবেক করে দেখার মত এতটুকু অবসর। ঐ সবের মাধ্যমে ওরা তাদেরকে পুনঃ পুনঃ এমন আফিং খাইয়ে ফেলছে যে, চৈতন্যপ্রাপ্ত হওয়ার সুযোগটুকুও নেই। এই সংকট-মুহূর্তে প্রয়োজন আছে প্রতিকার ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার। তাদের জীবন ও যৌবনে সৃষ্ট নানা সমস্যার শরয়ী সমাধান দানের।

আমাদের উলামা ও চিন্তাবিদগণ যে এ প্রয়োজন দূর করার কাজে পিছিয়ে আছেন তা নয়। এ মর্মে তারা বহু কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের সেই সাগরের দিকে বেগবান আমার চেষ্টার এ এক ক্ষুদ্র নদী। আল্লাহর কাছে আশা এই যে, তিনি যেন এ নদীর পানি দ্বারা যুব-সমাজের পিপাসিত হৃদয়সমূহকে পরিতৃপ্ত করেন এবং তাদের জীবনের সকল সমস্যাকে দূর করে দিয়ে নিজের পথে টেনে নেন। আমীন।

বিনীত

আব্দুল হামীদ ফাইযী

আল-মাজমাআহ

সউদী আরব।

১৩/৩/১৪২ ১হিঃ ১৫/৬/২০০০খ্রীঃ

মানুষ তার প্রকৃতিগত সৃষ্টিবৈচিত্রে পর্যায়ক্রমে যে সব জীবন লাভ করে থাকে তন্মধ্যে শৈশব ও কৈশর জীবনটাই সব চাইতে নির্মল ও বিঘ্নহীন। শিশুকিশোর মনে পিতা-মাতার স্নেহাশিস্ সুখের ঢেউ তোলে। পিতামাতার সর্বপ্রকার সুখ ও সমৃদ্ধিই তার হৃদয়-কুসুমকে দোলা দেয়। এ সময়কার সকল ভূত-ভবিষ্যৎ ন্যস্ত থাকে অভিভাবকের উপর।

অবশ্য এর পরবর্তী জীবনই হল বড় মধুর, বড় তিক্ত, বড় সুখময়, বড় জ্বালাময়। বড় কোমল, বড় কঠিন। বড় চাঞ্চল্যময়, বড় চিন্তাময়। এ পর্যায়ে এসে তরুণ মন সকল প্রকার, শৃঙ্খল এড়াতে চায়। ছিন্ন করতে চায় সকল বন্ধন। যৌবনের উন্মাদনার ঐ পাগলা ঘোড়া উল্লংঘন করতে চায় সকল বাধা-বিপত্তিকে। ছন্নছাড়া বাধন হারা হয়ে বিচরণ করতে চায়। লাগামহীন প্রবৃত্তির প্রবণতা। হাওয়ার তালে তালে দুলে ওঠা সমুদ্রের তরঙ্গমালার মত, ঝড়ো হাওয়ার ক্ষিপ্র গতির মত, বাদলা মেঘের পাগলা বারিপাতের মত, সুউচ্চ পর্বতের বাধাহীন জলপ্রপাতের মত বুকে এসে প্রতিহত হয় তারুণ্যের মনোবল, যৌবনের যৌনজ্বালা, তাজা শক্তির শৌর্য ও বীর্য।

‘তুমি কে? তুমি মদোন্মত্ত মানবের যৌবন,

তুমি বারিদের ধারা জল মহাগিরির প্রস্রবণ।

জীবনের এই পর্যায়ে বগাহীন পাগলা ঘোড়ার লাগাম জরুরী। এমন কুলকুল তান নদীর দুকুলে বাধ হওয়া আবশ্যিক। যৌবনের এ চাঞ্চল্যময় ক্ষিপ্র গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই দরকার। তা না হলে বিপদ অনিবার্য। পরিণাম বড় মন্দ।

মানুষের মন বড় মন্দপ্রবণ হলেও বৃদ্ধের তুলনায় যুবকের মন বড়ই সরল। বৃদ্ধের মনে যে কট্টর মনোভাব ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থাকে তা দুর করা ততটা সহজ নয়, যতটা সহজ। একজন যুবকের মন থেকে তা দূর করা। সুতরাং জীবনের এ পর্যায়ে যুবক যে তরবিয়তী বিশেষ তালীম পাওয়ার যোগ্য তা বলাই বাহুল্য। যদিও এ উদ্ধৃঙ্খলতার যুগে এ কাজ ততটা সহজ নয়। মেনে নেওয়া ও মানানো উভয় কাজের ক্ষেত্রেই পরিবেশ আমাদের প্রতিকূলে। তবুও মানতে হবে, মানাতে চেষ্টা করতে হবে। হেদায়াত আল্লাহর হাতে। আর সহজ নয় বলেই কিয়ামতের সে ছায়াহীন প্রখর রৌদ্রতপ্ত প্রান্তরে এমন যুবক আল্লাহর ছায়ায় আশ্রয় পাবে, যে তার ঐ যৌবনকালকে আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে অতিবাহিত করে। সত্যই তো, যে রাজপথে চলে সে তার মত নয়, যে দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’ লংঘন করে উদ্দিষ্ট পথে অগ্রসর হয়।

অবশ্য সংস্কার ও সংশোধনের পথে যেমন যুবগোষ্ঠীর নিজস্ব মন ও ঐকান্তিক আগ্রহ থাকা দরকার, ঠিক তেমনি আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকা দরকার বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ সমাজের। নচেৎ মসজিদের ইমাম যুবক হলে যদি বৃদ্ধরা দুরে দুরে থাকে এবং বৃদ্ধ হলে যুবকদল তার কাছ না ঘেসে, তাহলে অভীষ্ট ফল যে লাভ হবে না তা বলাই বাহুল্য। সমাজে বিভিন্নমুখী অবনতি ও অজ্ঞানতার অন্যতম মৌলিক কারণ হল, যুবক ও বৃদ্ধদের মাঝে ব্যবধান ও বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে এককে অপরের মজলিসে বসতে দেখা যায় না।

বয়োজ্যেষ্ঠরা যুবকদের পাপাচরণ দেখেও যেন হতবাক ও অক্ষম সেজে তাদেরকে তাতে বাধা দিতে সাহস করে না। তরুণদের সদাচরণ ও সংশোধনের ব্যাপারে তারা নৈরাশ্য প্রকাশ করে। যার ফলশ্রুতিতে বৃদ্ধের মাঝে যুবকদের প্রতি কেমন এক প্রকার বিদ্বেষ, বিরাগ ও বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয় এবং যুবক চাহে ভালো হোক অথবা মন্দ তার প্রতি কোনও ক্ষেপও করে না। কখনো বা একটি যুবকের অসদাচরণ দেখে সমগ্র যুব-সমাজের উপর একই কুধারণা রেখে থাকে। ফলে প্রত্যেক যুবক ও তরণের প্রতি তার মন ভেঙ্গে যায়। যার কারণে সমাজ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যুবক ও বৃদ্ধ একে অপরকে অবজ্ঞা, ঘৃণা, অশ্রদ্ধা ও অস্নেহ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। আর এই মহা আপদ তখন গোটা সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। কিন্তু এই ব্যাধির প্রতিকার করতে যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলকেই সেই চেষ্টা রাখা উচিত, যাতে তাদের আপোসের উক্ত ব্যবধান ও বিচ্ছিন্নতা দূরীভূত হয়।

আর সকলেই যেন এই বিশ্বাস রাখে যে, যুবক ও বৃদ্ধের মিলিত প্রচেষ্টায় গঠিত সমাজ একটি মাত্র দেহের ন্যায়; যার কোন এক অঙ্গ বিকল হলে সারা দেহ বিকল হয়ে যেতে পারে। যেমন বৃদ্ধদের উচিত, যুবকদের ব্যাপারে তাদের কর্তব্য ও স্কন্ধে অর্পিত ভার সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং যুবকদের সদাচরণের ব্যাপারে তাদের হৃদয়ে ঘনীভূত নৈরাশ্যকে দূর করা। যেহেতু আল্লাহ তাআলা সকল বস্তুর উপর সর্বশক্তিমান। কত পথভ্রষ্টকে তিনি সুপথপ্রাপ্ত করেছেন। যারা অপরের জন্য সুপথের দিশারী ও সমাজ সংস্কারক রূপে পরিচিত হয়েছে। যুবকদেরও কর্তব্য, যেন তারা তাদের বৃদ্ধ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি। রাখে। তাদের মতামতকে সম্মানের চোখে দেখে, তাদের নির্দেশনা সাদরে গ্রহণ করে। যেহেতু বৃদ্ধরা দীর্ঘ জীবনের বহু ঘটনাঘটনের মাধ্যমে অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে; যা যুবকরা করতে পারেনা। অতএব যদি নবীনদের উদ্যম ও শক্তির সাথে প্রবীণদের অভিজ্ঞতা ও হিকমত সংযুক্ত ও মিলিত হয় তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় সমাজ সাফল্য ও মর্যাদা লাভ করবে। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব, ইবনে উসাইমীন ১৬-১৭পৃঃ)

তরুণ ও যুবকদল সমাজের শক্তি ও বাহুবল। তরণের উপরেই সন্নিবিষ্ট থাকে সমাজের বহু আশা, আকাঙ্খা ও ভরসা। যে কোন জাতিই তার যুবগোষ্ঠীকে নিয়েই গর্ব করে থাকে। জাতির অমূল্য সম্পদ তার যুবশক্তি। অতএব এমন সম্পদের অপচয় হতে দেওয়া কোন জাতিরই উচিত নয়। তাই বিশেষ করে এ অমূল্য সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বর্তায় দ্বীনের আহ্বায়ক ও সংস্কারকদের উপরে। উলামা সমাজ যুবশক্তির ব্যাপারে যত্নবান না হলে, সে শক্তির যে অপচয় ও অপব্যবহার হয়, বর্তমান জাতির অবস্থাই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

সমাজ গঠনের প্রাথমিক স্তর থেকেই যুবগোষ্ঠী ও তার চিন্তাধারার উপর সমীক্ষা করা এবং তার মঙ্গলময় দিককে সমৃদ্ধি দান করা ও অমঙ্গলময় দিকের সংশোধন ও পরিবর্তনের চেষ্টা করা সমাজ সংস্কারকের সমুচিত কর্তব্য। যেহেতু আজকের কাঁচা যুবক আগামী কালের পুরুষ ও সমাজ। যুব সমাজ এমন এক ভিত্তি, যার উপর উম্মতের ভবিষ্যত প্রতিষ্ঠিত হয়।

তাইতো শরীয়ত যুবগোষ্ঠীর প্রতি যত্নবান হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যুবকের যুবাবস্থা সময়কালকে বড় মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে। যেহেতু যুব সমাজ যদি সত্যের

উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, যার উপর উম্মতের ভবিষ্যত প্রতিষ্ঠিত, তাহলে সমাজের প্রভূত কল্যাণের আশা করা যাবে। ঐ যুব সমাজের ধর্মনিষ্ঠা ও সুন্দর চরিত্রে উম্মতের জ্যোতির্ময় ভবিষ্যত উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং বর্তমানের প্রকৃত ও মুসলিম ও ওলামা সমাজের উপযুক্ত ওয়ারেস ও প্রতিনিধি হবে তারাই।

বর্তমান যুবসমাজের প্রতি যদি সমীক্ষ্য দৃষ্টিতে দেখা যায় তাহলে সাধারণভাবে পরিদৃষ্ট হবে যে, ঐ সমাজে তিন প্রকার যুবক রয়েছে, সত্যানুসারী ও ধর্মনিষ্ঠ, সত্য ও ধর্মত্যাগী, এবং এই দুয়ের মাঝে দোটানায় দোদুল্যমান যুবক। ধর্মনিষ্ঠ ও সত্যানুসারী যুবক, যে কলেমা তওহীদের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখে, তার দাবী অনুসারে কাজ করে, ধর্মে প্রগাঢ় বিশ্বাসী ভক্তি ও প্রেমের সহিত আত্মসমর্পণকারী, ধর্মীয় অনুশাসনে সন্তুষ্ট, স্বধর্ম নিয়ে গর্বিত, ইসলামের অনুসরণকে যে চির কল্যাণ ও মুক্তিদাতা ভাবে এবং এই ধর্ম থেকে বহির্গত হওয়াকে যে চির ক্ষতিকর ও সর্বনাশী মনে করে। যে যুবক আল্লাহকে বিশ্বাস করে; যিনি তার ও সমগ্র আকাশ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা।

যেহেতু সে আল্লাহর বহু নিদর্শন লক্ষ্য করে; যাতে তার নিকট আল্লাহর অস্তিত্বে কোন সন্দেহ ও দ্বৈধের অবকাশ থাকে না। সুতরাং সে এই বিস্ময়কর বিশাল জগতের সৃষ্টি-বৈচিত্র এবং তার নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা-ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করলে তার স্রষ্টার অস্তিত্বের, তার পরিপূর্ণ বিজ্ঞান ও শক্তির। এবং তার মহা প্রকৌশলের স্পষ্ট দলীল ও প্রমাণ খুঁজে পায়। কারণ, এই বিশ্ব-জাহান অযাচিতভাবে আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়ে যায়নি। এই বিশাল বিশ্ব এক সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার অনুবর্তী। যে শৃঙ্খলাবদ্ধ নিয়মের কোন পরিবর্তন ও বিবর্তন নেই। সারা বিশ্ব ঠিক সেই নিয়মেই চলছে, যে নিয়মে চলতে সৃষ্টিকর্তা তাকে আদেশ করেছেন। কিন্তু তুমি আল্লাহর নিয়মের কোন পরিবর্তন পাবে না এবং আল্লাহর বিধানে কোন ব্যতিক্রমও দেখবে।”(কুঃ ৩৫/৪৩) “দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবেনা; সুতরাং আবার তাকিয়ে দেখ কোন ত্রুটি দেখতে পাও কিনা? অতঃপর তুমি বার বার তাকাও তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ এবং ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে।” (কুঃ ৬৭/৩-৪)।

সুতরাং যদি এ বিশ্বচরাচর সুশৃঙ্খল ও সুনিপুণ ব্যবস্থাযুক্ত হয় তাহলে তা কোনক্রমেই অযাচিতভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। যেহেতু অযাচিতভাবে সৃষ্ট বস্তুর ব্যবস্থা-বিধানও অযাচিত হয়। যার ফলে যে কোন মুহূর্তে তাতে বিবর্তন ও বিশৃঙ্খলা ঘটে। যে যুবক আল্লাহর সমূদয় ফিরিশ্যাকুলের উপর ঈমান রাখে। যেহেতু কুরআন ও সুন্নায় তাদের বিভিন্ন গুণাবলী, ইবাদত ও কর্তব্যাদি সম্পর্কে বহু বিবরণ এসেছে। অতএব তাঁদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। যে যুবক আল্লাহর সমূদয় রসুলের উপর এবং তার অবতীর্ণ সমূহ আসমানী কিতাবের উপর বিশ্বাস রাখে। যেহেতু তা হল মানুষের সরল পথের দিশারী এবং এ ছাড়া মানুষ জ্ঞান, ইবাদত, অধিকার ও ব্যবহারের যাবতীয় বিস্তারিত বিষয়াবলীকে জানতে অক্ষম ছিল। যে যুবক আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত সকল আম্বিয়া ও রসুলগণের প্রতি ঈমান রাখে। যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান এবং সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। যাতে তাদের আগমনের পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের যেন কোন অভিযোগ না থাকে।

যে যুবক পরকালের (জান্নাত ও জাহান্নামের) অনন্ত জীবনের প্রতি বিশ্বাস রাখে। সেই হিসাবের দিন ও পুনরুত্থান-দিবস কিয়ামতকে বিশ্বাস করে; যেদিন আল্লাহ তাআলা সকলকে মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করবেন এবং নিজ নিজ কর্মফল প্রদান করবেন। “সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎ কাজ করলে তা সেদিন দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কাজ করলে তাও সেদিন দেখতে পাবে।”(কুঃ ৯৯/৭-৮) যেহেতু সেটাই দুনিয়ার ফল। আর যদি এমন দিন সংঘটিত না হয়, যেদিন সৃষ্টি তার সৎকার্যের প্রতিদান এবং অসৎকার্যের প্রতিফল। পাবে তাহলে এ জীবনের পশ্চাতে লাভ ও যুক্তি কি? যে যুবক ভাগ্যের ভালো ও মন্দের প্রতি ঈমান রাখে; অর্থাৎ এই বিশ্বাস রাখে যে, জগতে যা কিছু ঘটে সবই আল্লাহর লিখিত নিয়তি অনুসারে ঘটে।

বান্দার হক্কে মঙ্গল-অমঙ্গল সবই তার নির্ধারিত। পরন্তু বান্দার এখতিয়ার, কর্মে হেতু ও তদবীর তথা তার প্রভাবের উপরেও বিশ্বাস রাখে এবং মানে যে, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য উভয়েরই কোন না কোন হেতু ও কারণ আছে। যে যুবক একনিষ্ঠতার সহিত কেবলমাত্র শরীক-বিহীন এক আল্লাহর উপাসনা ও ইবাদত করে। যে যুবক তার সকল প্রকার কথা ও কাজে রসূল ২ এর অনুসরণ ও অনুকরণ করে, তিনি যা আদেশ করেছেন তা নির্দ্বিধায় পালন করে এবং যা নিষেধ করেছেন তা সন্তুষ্ট চিত্তে পরিহার করে। যে যুবক যথাযথভাবে নামায পড়ে। যেহেতু সে বিশ্বাস করে যে, ঐ নামাযে ইহলৌকিক-পারলৌকিক, ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনে অতিশয় মঙ্গল নিহিত আছে এবং তা পরিত্যাগ করায় ইহ-পরকালে বড় মন্দ পরিণাম আছে।

যে যুবক তার মালের যাকাত তার যথার্থ হকদারের প্রতি পূর্ণরূপে আদায় করে। কারণ, সে জানে যে, তাতে ইসলামও মুসলিমদের বহু প্রয়োজন পূর্ণ হয়। তাই যাকাত ইসলামের স্তম্ভসমূহের তৃতীয় স্তম্ভরূপে পরিগণিত হয়েছে। যে যুবক রমযান মাসের রোজা পালন করে। শীত ও গ্রীষ্মে পানাহার ও যৌন-সম্ভােগ করা থেকে দূরে থাকে। যেহেতু সে জানে যে, আল্লাহর এই আদেশ পালনে তার সন্তুষ্টি লাভ হয়। তাই নিজের প্রবৃত্তি চাহিদার উপর তার প্রতিপালকের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়।

যে যুবক (সামথ্যবান হলে) কাবাগৃহের হজ পালন করে। যেহেতু সে আল্লাহকে ভালোবাসে, তাই তার গৃহকেও ভালোবাসে এবং তার করুণা ও ক্ষমার বিশেষ স্থানে উপস্থিত হয়ে ঐ স্থানে অন্যান্য আগত মুসলিমদের সহিত জামাআতে শরীক হওয়া পছন্দ করে।

যে যুবক আল্লাহ ও তার গ্রন্থ, রাসুল, মুসলিমদের নেতা এবং মুসলিম সর্বসাধারণের জন্য হিতাকাঙ্খী হয়। উদার ও উন্মুক্ত মনে প্রত্যেক মুসলিমের সাথে সুব্যবহার করে। যার মাঝে কোন প্রকারের প্রবঞ্চনা, ধোকাবাজি, লুকোচুরি, কুটিলতা ও কপটতা নেই। যে যুবক সজ্ঞানে ও সঠিক পদ্ধতি মতে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করে। মহান আল্লাহ বলেন, “তুমি (মানুষকে) হিকমত (বিশেষ কৌশল, যুক্তি বা প্রজ্ঞা) এবং সদুপদেশ দ্বারা তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর এবং ওদের সাথে সদ্ভাবে তকালোচনা কর।” (কুঃ ১৬/১২৫) যে যুবক সৎকার্যের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজে বাধা দান করে। যেহেতু সে জানে যে, এতে সমাজ ও উম্মাহর শান্তি ও কল্যাণ নিহিত আছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির জন্য যার অভ্যুত্থান হয়েছে। তোমরা সৎকার্যের আদেশ দান করবে এবং অসৎকার্য করতে নিষেধ করবে, আর আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে।” (কুঃ ৩১১০)

যে যুবক রসুলুল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত পর্যায়ক্রম অনুযায়ী অসৎকর্ম দুরীকরণে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা রাখে। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজ হতে দেখে তার উচিত, তা নিজের হাত দ্বারা অপসারণ করা (শক্তি প্রয়োগ করে বাধা দান করা।) কিন্তু তাতে অক্ষম হলে জিহ্বা দ্বারা (নসীহত ও প্রতিবাদ করে তা বন্ধ করা), যদি তাতেও অক্ষম হয় তবে অন্তর দ্বারা (ঘৃণা করা)। আর এ হল দুর্বলতম ঈমানের পরিচায়ক।”

যে যুবক সদা সত্য বলে, সত্য স্বীকার ও গ্রহণ করে। যেহেতু সত্য সততার প্রতি এবং সততা বেহেস্তের প্রতি পথ প্রদর্শন করে। আর মানুষ সদা সত্য কথা বলতে থাকলে এবং সত্যবাদিতার চেষ্টা ও কামনা রাখলে আল্লাহর নিকট ‘সত্যবাদী’ বলে তার নাম লিখিত হয়ে থাকে।

যে যুবক মুসলিম জনসাধারণের জন্য সদা কল্যাণ কামনা ও পছন্দ করে, যেহেতু সে নবী এর এ কথায় বিশ্বাসী, “তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার (মুসলিম) ভায়ের জন্য তাই পছন্দ করেছে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।”

যে যুবক আল্লাহর দ্বীন, মুসলিম উম্মাহ ও স্বদেশের মঙ্গলবিষয়ক দায়িত্ব স্বীকার ও পালন করে। তাই সর্বদা সেই প্রচেষ্টা ও প্রয়াসে থাকে, যাতে দ্বীন, উম্মাহ ও দেশের কল্যাণ লাভ হয়। আর এই মহান প্রচেষ্টায় তার কোন অহমিকা থাকে না এবং নিজের স্বার্থ কায়েম করতে গিয়ে অপরের স্বার্থে আঘাত হানে না।

যে যুবক আল্লাহর জন্য, আল্লাহরই কাছে সাহায্য ভিক্ষা করে, আল্লাহরই পথে জিহাদ ও সংগ্রাম করে। ইখলাস ও চিত্তবিশুদ্ধতার সাথে সংগ্রামে তার উদ্দেশ্য, লোক-প্রদর্শন, ব্যক্তিগত অথবা স্বজনগত কোন স্বার্থলাভ, অথবা সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন থাকে না। আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করে, কোন প্রকার আত্মগর্ব প্রকাশ না করে, শক্তি ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর ভরসা ও নির্ভর না করে, দ্বীনের আওতাভুক্ত কোন কিছুতে অতিরঞ্জন অথবা অবহেলা না করে দ্বীন ও জাতির প্রয়োজন অনুপাতে জিহ্বা, কলম, হস্ত, জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করে।

যে যুবক ধর্মভীর ও সদাচারী। যে চরিত্রে সভ্য, ধর্মে অটল, মনে উদার, ব্যবহারে বিনয়ী ও ভদ্র, আত্মমর্যাদায় সন্ত্রমশীল, হৃদয়ে সুন্দর, দ্বীনের দাওয়াতে সহিষ্ণ ও ধৈর্যশীল এবং জ্ঞানী ও দূরদর্শী, যে সুযোগের সদ্ব্যহার করে এবং জ্ঞান ও সংস্কারের উপর আবেগ ও উত্তেজনাকে প্রাধান্য দেয় না। যে যুবক মিতাচারী, সময় ও নিয়মানুবর্তী, কৌশল, হিকমত ও দুরদর্শীতার সাথে, নিপুণতা ও শৃঙ্খলতার সহিত প্রতি কাজ করে। তার জীবনের কোন অবকাশকে নিজের অথবা সমাজের কোন উপকার ব্যতীত বিনষ্ট করে না।

এই যুবক যেমন তার দ্বীন, চরিত্র ও ব্যবহারের সুরক্ষা করে তেমনি তার প্রতিকূল প্রত্যেক চিন্তা, মতবাদ, নাস্তিক্য, দুস্ক্রিয়া, পাপাচার, চরিত্রহীনতা ও দুব্যবহার থেকে সুদূরে থাকে।

সুতরাং এই শ্রেণীর যুবক দল উম্মতের গর্ব এবং তার দ্বীন, সমৃদ্ধ জীবন ও সৌভাগ্যের সংকেত। সেই যুবকদল; যাদের জন্য আল্লাহর নিকট আমরা আশা রাখি যে, তিনি তাদের

মাধ্যমে মুসলিমদের বিকৃত অবস্থার সংস্কার ও সংশোধন সাধন করবেন এবং সেই যুবকদলই ইহ-পরকালে বড় সৌভাগ্যবান হবে। দ্বিতীয় প্রকার যুবক, যে বিশ্বাসে ভ্রান্ত, চরিত্রে ভ্রষ্ট, আত্নগর্বী, নোংরামী ও অশ্লীলতায়। নিমজ্জিত। যে অপরের নিকট হতে সত্য গ্রহণ করে না এবং বাতিলকে বাতিল বলে স্বীকার ও তা পরিহার করে না। যে ব্যবহারে অহংকারী; যেন সে দুনিয়ার জন্য এবং দুনিয়াটা তারই জন্য সৃষ্টি হয়েছে।

যে যুবক স্বেচ্ছাচারী ও উদ্ধত; যে ন্যায় ও সত্যের কাছে বিনয়ী নয়, অথচ অন্যায় ও বাতিলের একান্ত অনুগত।

যে যুবক আল্লাহর অধিকার এবং সৃষ্টির কত অধিকার বিনষ্ট করে, পরন্তু তার মনে কোন পরোয়া নেই। যেহেতু পরকাল ও হিসাবের প্রতি তার দৃঢ় অথবা মোটেই বিশ্বাস নেই।

যে যুবক সমাজে বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ সৃষ্টিকারী, বিবেক ও চিন্তায় ভারসাম্যহীন, চরিত্রে বিকারগ্রস্ত, ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণহারা, লাগামছাড়া।

যে যুবক নিজের অভিমত নিয়ে গর্বিত। যেন সত্য কেবল তারই রসনায় নিঃসৃত হয়। তাই সে যেন নিজের কাজে পদস্থলনমুক্ত এবং অন্য কেহ পদস্খলন ও ভ্রান্তিগ্রস্ত, যেহেতু তাদের রায় তার রায়ের পরিপন্থী।

যে যুবক ইসলামের সরল পথ থেকে বিচ্যুত, সামাজিক আচার অনুকরণ থেকে বৈমুখ এবং অধিকাংশে পাশ্চাত্য-সভ্যতায় প্রভাবিত। যার মন্দ কর্ম পরিশোভিত; যাকে সে উত্তম মনে করে থাকে। এমন যুবক স্বকর্মে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, যার পার্থিব জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা পণ্ড হয়, - যদিও সে মনে করে যে, সে সৎকর্ম করেছে।

এমন যুবক নিজের জন্য অশুভঙ্কর, সমাজের জন্য বালাই। যে সমাজকে অধঃপতনের অতল তলের দিকে টেনে নিয়ে যায়। যার কারণে উম্মাহর মান মর্যাদা ও গৌরব উঠে যায়। এই শ্রেণীর তরুণ দল দুরারোগ্য সর্বনাশী মহামারীর জীবাণুর মত। অবশ্য আল্লাহ চাইলে কারো চিকিৎসা করেন এবং তিনি সর্ববস্তুর উপর সর্বশক্তিমান।

তৃতীয় প্রকার যুবক ও যে দুটানায় দোদুল্যমান, কর্মে যার দ্বৈধ থাকে। বিভিন্ন পথ ও মতের সম্মুখে সে হয়রান। যে যুবক সত্যের সন্ধান পায়, গ্রহণ করে সানিত হয় এবং আদর্শ সমাজে সে বসবাসও করে। কিন্তু অন্যদিকে তার জন্য মন্দের দুয়ার খোলা যায়, ফলে তার। আকীদাহ ও প্রতীতিতে সন্দেহ জন্মে, চরিত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি আসে, কর্মে নানান কলঙ্ক দৃষ্ট হয়। পুণ্যের মহফিলে যোগদান করলেও পাপের আখড়ায়ও তার আসন থাকে। ইসলামী সমাজে থেকে অনৈসলামী সমাজের অনুকরণ করে। বাতিলের প্রবাহমান স্রোতে কখনো গা ভাসিয়ে দেয়। তাই সে মানসিক দিক দিয়ে অস্থির থেকে ঐ স্রোতে ঘুরপাক খেতে থাকে। কখনো বা ঐ গতির সামনে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে হয়রান হয়ে ভাবতে থাকে; কি জানি এই নতুনত্বে ও আধুনিকতায় প্রকৃত সত্য নিহিত? নাকি সেই প্রাচীন মত ও পথে যার উপর বিগত সলফে সালেহীন ছিলেন এবং বর্তমানে আদর্শ সমাজ যার উপর প্রতিষ্ঠিত? যার ফলে সে সন্দিহান ও উদ্বিগ্ন থাকে, কখনো বা এটাকে সমর্থন করে কখনো বা ওটাকে। এই শ্রেণীর যুবক দলের জীবন নেতিবাচক। এদের জন্য এমন এক শক্তিশালী আকর্ষক হেদায়াতের প্রয়োজন; যার দ্বারা তারা সত্যের আঙিনা ও কল্যাণের পথে আকৃষ্ট হয়ে ফিরে আসে এবং তা খুবই সহজ হয় তখনই, যখন আল্লাহ পাক তাদের জন্য কোন প্রজ্ঞাবান সৎ ও বিশুদ্ধ নিয়তে ইসলামের প্রতি আহ্বানকারী আলেমকে নির্বাচিত করে দেন।

এই শ্রেণীর যুবক তারাই অধিক হয়ে থাকে; যারা কিছু ইসলামী সভ্যতায় সভ্য হয়েছে, কিন্তু তার সাথে অন্যান্য পার্থিব ইলম (জেনেরাল এডুকেশনে)ও শিক্ষিত হয়েছে; যে ইলম ও শিক্ষা প্রকৃতই ইসলাম পরিপন্থী অথবা তাদের ধারণা মতে পরস্পর-বিরোধী। যার ফলে দুই সভ্যতার সামনে তারা হয়রান ও বিমুঢ় হয়ে পড়ে।

অবশ্য এই ধাঁধা, আকর্ষণ ও বিমূঢ়তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব; যদি তারা ইসলামী সভ্যতাকে জীবনাদর্শে মূলীভূত করে এবং মুখলেস ওলামাদের কাছে ঐ সভ্যতাকে তার আসল উৎস কুরআন ও হাদীস থেকে চয়ন করে। আর তা তাদের পক্ষে দুরূহ ও নয়। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব, ইবনে উসাইমীন ৬- ১৪ পৃঃ দ্রঃ)

যুবকের পথ-বিচ্যুতির কারণ এবং তার জীবনের সমস্যা একাধিক ও বিভিন্ন। যেহেতু যুবক অবস্থায় মানুষের দেহ, চিন্তাশক্তি ও জ্ঞানের অধিকতর ক্রমোন্নতি হয়ে থাকে এবং এই সময়ই তার অভ্যুদয়ের সময়। যাতে তার বিভিন্ন পরিবর্তন ও বিবর্তনের শীঘ্র প্রসার লাভ হয়। তাই এই অবস্থায় সরল পথে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য তার প্রয়োজন হয়, হৃদয়াত্মাকে দমন ও তার ছুটন্ত ঘোড়াকে বগাধীন করার জন্য বিশেষ উপকরণ এবং প্রজ্ঞাময় প্রশিক্ষণ ও পথ প্রদর্শনের।

এই অবস্থায় যুবক বিভিন্ন কারণে পথচ্যুত ও ভ্রষ্ট হয়। তবে এই ভ্রষ্টতার বিশেষ মারাত্মক কারণ সমূহের এক কারণ হল, অবসর ও বেকারী। কর্মহীনতা এক সর্বনাশী ব্যাধি; যা চিন্তাশক্তি, জ্ঞান এবং দৈহিক শক্তিকে ধ্বংস করে। যেহেতু আত্মার জন্য কোন এক প্রকারের বিচরণ বা কর্ম একান্ত জরুরী। কিন্তু তা যদি একেবারেই শূন্য হয় তাহলে চিন্তাশক্তি নিস্তেজ, বুদ্ধি স্কুল এবং আত্মার বিচরণ দুর্বল হয়ে যায়। আর তারপরই কুচিন্তা ও কুমন্ত্রণা অন্তরকে সমাচ্ছন্ন করে ফেলে। কখনো বা এই কর্মহীনতা-জনিত মানসিক পরাজয়ের কারণে মানুষের মনে নানান কবাসনা, কৃকল্পনা ও মন্দ ইচ্ছার জন্ম হয়।

এই সমস্যার সমাধানকল্পে যুবকের উচিত, নিজের জন্য উপযুক্ত কোন কাজ বেছে নিতে চেষ্টা করা, অধ্যয়ন বা অন্য কোন ব্যবসায়ের মাধ্যমে মন ও মস্তিষ্ককে ব্যাপৃত রাখা। যাতে মন্দ কামনা ও কল্পনার পথে বিশেষভাবে বাধা পড়ে। আর এই প্রচেষ্টায় সে সমাজের এক কলস্কহীন অঙ্গ হয়ে জীবন ধারণ করতে পারবে এবং নিজের ও সমাজের জন্য একজন কাজের মানুষ হওয়া অত্যাবশ্যক মনে করবে। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব, ইবনে উসাইমীন ১৬পৃঃ)

পক্ষান্তরে মুসলিমের জন্য কোন এমন এক সময় নেই যাকে ‘অবসর’ বা ‘অবকাশ’ বলা। যায়। যার হৃদয়ে ঈমান ও ইসলাম স্থান পেয়েছে, মালাকুল মওত যাকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য প্রহর গুনছেন, যার সঙ্গে আছেন দুই সম্মানিত ফিরিশ্মা -কিরামান কাতেবীন- যারা তার নেকী-বদী নোট করে যাচ্ছেন। সে ব্যক্তির কোন ফুরসত নেই, যার হৃদয়ে রয়েছে ঈমানের তাকীদ। সে জাতির কোন ফাঁকা সময় থাকতে পারেনা, যে জাতির আছে মহান লক্ষ্য। সে সমাজের জীবনের কোন সময় অবসর নামে অভিহিত হতে পারে না, যে সমাজের সমগ্র জীবনটার নামই ইবাদত। যে জাতি ও সমাজকে তাদের পরোয়ারদেগার বলেন, “আমি মানব ও দানবকে কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াত) সে। মুসলিমের জীবনে অবকাশ বলে কোন বিরতি থাকতে পারে না, যে মুসলিম আল্লাহ বা তদীয় রসুলের একটা না একটা আনুগত্যের মাঝে কালাতিপাত করে।

যার চিন্তা, গবেষণা, পানাহার, নিদ্রা, জাগরণ, ভ্রমণ, বিচরণ, যাওয়া, আসা, প্রভৃতি সবকিছুই ইবাদত। নিয়ত বিশুদ্ধ হলে এবং আনুগত্যের সততা প্রমাণিত হলে মুসলিমের জীবন-মরণ সবটাই ইবাদতে পরিণত হয়। “বল, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সেই মহান আল্লাহ রব্বল আলামীনের জন্য।” (সূরা আনআম ১৬২ আয়াত)। সে বান্দার জীবনে আর খালি সময় কোথায়, যার প্রভু ঘোষণা করেছেন, “অতএব যখন অবসর পাও, তখন পরিশ্রম কর এবং তোমার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ কর।” (সুরা ইনশিরাহ ৭-৮ আয়াত) সে জাতি অবসর আর কোত্থেকে পেতে পারে, যার সারা জীবনটাই হল জিহাদে পরিবেষ্টিত। এই জীবন-সংগ্রামে বিরতি কোথায়? আর বিরতি ও বিশ্রাম নিলে শত্রু (শয়তান ও ধর্মদ্রোহীর) হাত থেকে নিস্তার কোথায়?

সে জাতির আর বিরতির সময় কোথায়, যে জাতি লম্বা সফরে পথ হেঁটে চলেছে? চলেছে। অবিরামভাবে বেহেস্তের পথে, তার সেই প্রথম ও আসল ঠিকানা এবং প্রিয় চিরস্থায়ী আবাসস্থলের দিকে। প্রেমের পরিধি যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, প্রেমের পাত্র যত বেশীই হোক না কেন, আসল ও প্রকৃত প্রেমের টান থাকে সেই প্রথম প্রেমিকের প্রতি। তুলনায় তার তুল্য পরবর্তীকালের আর কেউ অধিক প্রিয় হতে পারে না। মানুষ যত দেশেই যাক, যেখানেই বাস করুক এবং যত সুখেই থাকুক না কেন, তবুও মনের টান থাকে তার সেই প্রথম দেশ, পরিবেশ ও মাতৃভূমির প্রতি মানুষের প্রথম দেশ ও বাসস্থান হল জান্নাত। তাকে ফিরে যেতে হবে তার আপন দেশে।

কিন্তু বিদেশে বের হয়ে সে ডাকাত শয়তানের দলবলের হাতে বন্দী, অথবা তাদের কাছে লুণ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা পদে পদে। তাই তো সন্দেহ হয় যে, সে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে। স্বদেশে ফিরে যেতে পারবে কি না? এমন আশঙ্কাময় পথে বিরতির সময় কোথায়? প্রিয় নবী ৪ বলেন, “যে ব্যক্তি গভীর রাত্রিকে ভয় করে, সে ব্যক্তি যেন সন্ধ্যা রাত্রি থেকেই সফর শুরু করে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যা রাত্রি থেকেই চলতে লাগে সে গন্তব্যস্থলে পৌছে যায়। সাবধান! আল্লাহর পণ্য বড় আক্রা। শোনো! আল্লাহর পণ্য হল জান্নাত।” (সহীহ তিরমিযী ১৯৯৩নং)

সে জাতির জীবনে অবসর কোথায়, যে জাতির জান-মালকে মহান আল্লাহ বেহেস্তের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন? স্বর্ণ-রৌপ্য, মনিমুক্তা, হীরে-কাঞ্চন যাই বলি না কেন, সময়ের তুল্য কোন অন্য মূল্যবান ধাতুর মূল্য নেই। সময়ের সে মূল্য মানুষ সেদিন অনুভব করবে, যেদিন হবে তার জীবনের শেষ দিন। যেদিন সে নিরস্ত ও ক্ষান্ত হয়ে সময় অপচয় করার ভুল বুঝতে পারবে আর বলবে, “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরো কিছু দিনের জন্য অবকাশ দিলে আমি দানখয়রাত করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্গত হতাম। কিন্তু নির্ধারিত কাল উপস্থিত হলে আল্লাহ কাউকে কোন অবকাশ দেন না।” (সূরা মুনাফিকূন ১০-১১ আয়াত) তখন হবে শত আফশোষ; যখন আফশোষ কোন কাজে দেবে না।

তখনই মানুষ সময়ের মূল্য বুঝতে পারবে, যখন “অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে অধোবদন হয়ে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা দেখলাম ও শুনলাম। এখন তুমি আমাদেরকে পুনরায় (পৃথিবীতে পাঠিয়ে দাও, আমরা এবারে সৎকাজ করব, আমার এখন দৃঢ় বিশ্বাসী।” (সূরা সাজদাহ ১২ আয়াত) কিন্তু তখনকার সে বিশ্বাস কোন কাজে দেবে না।

অলস লোকেদের জন্য দিন বড় ভারি জিনিস। রাত্রি এলে খুশীতে এমন লোকেদের মন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটি বছর অতিবাহিত হলে ‘জন্মদিন পালনের আনন্দে মাতোয়ারা হয় বহু বুড়োবুড়িও। অথচ হয়তো তারা ভুলে বসে যে, জীবনের আকাশ হতে তাদের একটি তারা খসে পড়ল। এবং মৃত্যুর দিকে একদিন বা এক বছরের পথ তারা আরো অগ্রসর হল! আর এই ভুলের কারণেই তারা দিন বা বছর শেষে দুঃখ প্রকাশ করে সচেতন না হয়ে আনন্দের সুনিদ্রায় সুষুপ্ত থাকে। পক্ষান্তরে সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। হৃদযন্ত্রের ঘড়ি ধকধক করে বাজতে আছে। যে ঘড়ি মানুষকে সতর্ক করে যেন সর্বদা বলছে, 'ওহে মানুষ! তোমার জীবন তো মাত্র কয়েক মিনিট ও সেকেন্ডের সমষ্টির নাম। সুতরাং সাবধান হও। সে জীবনের কি কোন অবসর থাকতে পারে, যে জীবন সূর্যালোকের নীচে বরফের মত গলে গলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে অথবা আগুনের নীচে মোমবাতির মত দ্রবীভূত হয়ে লয়প্রাপ্ত হচ্ছে।

সুতরাং মুমিনের জন্য অবসর’ হল এক বড় সম্পদ। এ অবসর সময়ের ব্যাপারে উদাসীন হওয়া অথবা এর যথার্থ কদর না করা তার পক্ষে মহাভুল। প্রিয় নবী ও বলেন, “দু'টি নেয়ামত এমন আছে; যার ব্যাপারে বহু মানুষ ধোকার মধ্যে রয়েছে। আর সে দু’টি নেয়ামত হল সুস্থতা ও অবসর।” (বুখারী ৬৪১২, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) অতএব এমন নেয়ামতের ব্যাপারে ভুল করার খেসারত তাকে দিতে হবে। কারণ, “কিয়ামতের দিন কোন বান্দার পদযুগল ততক্ষণ পর্যন্ত সরবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে তার আয়ু প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হবে। যে, সে তা কিসে ক্ষয় করেছে?----” (তিরমিযী, সিলসিলাহ সহীহাহ ৯৪৬নং)

আর এ জন্যই প্রিয় নবী (সা.) উম্মতকে সতর্ক করে বলেন, “পাঁচটি বস্তুকে পাঁচটির পূর্বে গনীমত জেনে মূল্যায়ন করো; বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবনকে, অসুস্থতার পূর্বে তোমার। সুস্থতাকে, দারিদ্রের পূর্বে তোমার ধনবত্তাকে, ব্যস্ততার পুর্বে তোমার অবসরকে এবং মরণের পূর্বে তোমার জীবনকে।” (হাকেম ৪/৩০৬, আহমদ, সহীহুল জামে ১০৭ ৭নং)

উমার বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেন, 'দিবারাত্র তোমার মাঝে নিজ কাজ করে যাচ্ছে। সুতরাং তুমিও তার মাঝে কাজ করে যাও।

সময় নষ্ট করা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যারা, তারাই তো প্রকৃত জ্ঞানী। যে ছাত্র পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হতে চায়, সে কোনদিন সময় নিয়ে অবহেলা করে । হীরের টুকরা কুড়াতে সে যত আলস্য প্রদর্শন করবে ক্ষতি হবে তার তত বেশী। বেকারত্ব ও কর্মবিমুখতা যুবকের জন্য ঔদাস্য সৃষ্টি করে। আর তা যুবতীর জন্য এমন ক্ষতিকর যে, তার মনের গোপনে যৌনানুভুতি সঞ্চারিত করে তোলে।

উমার (রাঃ) বলেন, কোন কোন মানুষকে দেখে আমি বড় পছন্দ করি। অতঃপর খোজ নেওয়ার পর যখন জানতে পারি যে, ওর কোন কাজ-ধান্দা নেই, তখন সে আমার। চোখে ছোট হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, 'আমি তোমাদের কাউকে বেকাররূপে দেখতে অপছন্দ করি; যে ব্যক্তি কোন দুনিয়ার কাজ করে, আর না-ই কোন আখেরাতের কাজ। একথা বড় সত্য যে, যে ব্যক্তি তার জীবনের একটি দিনকে ক্ষয় করে দেয় অথচ সে তার মধ্যে কারো একটি অধিকার প্রদান করতে পারে না, অথবা কোন কর্তব্য পালন করে না, অথবা কোন একটা গৌরব অর্জন করে না, অথবা কোন প্রকার প্রশংসা লাভ করতে পারে না, অথবা কোন কল্যাণ সাধন করতে পারে না, অথবা কোন জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয় না, তাহলে সে ব্যক্তি নিশ্চয়ই সেদিনকার মত নিজের জন্য বড় যালেম প্রতিপন্ন হয়।

জাতি বড় উপকৃত ও লাভবান হত, যদি তার মধ্যে বিভিন্নমুখী উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড উদ্ভব করে জাতির মানুষের খালি ও অবসর সময়কে সুষ্ঠুরূপে কাজে লাগাতে এবং কেবল সৎ ও বৈধ কাজে নিয়ন্ত্রিত রাখতে পারত। কিন্তু হায়! তার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন অবসর-বিনোদন কেন্দ্র, মাধ্যম ও যন্ত্র। ফলে যারা ডুবছিল তাদেরকে আরো ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে অধঃপতনের অতল তলে। যারা ছোট কাজ পেয়ে সামান্য মজুরী উপার্জন করে কিছু খেয়ে কিছু সঞ্চয় করছিল তারাও তাদের অবসর-বিনোদনের জন্য, বরং অনেক সময় কাজ ছেড়ে দিয়ে চিত্তবিনোদনের জন্য সেই উপার্জিত অর্থটুকু এবং সেই সাথে অপর্যাপ্ত সময়ও ব্যয় করে ফেলেছে ঐ সব কেন্দ্রে ও যন্ত্রে। যার ফলশ্রুতিতে বহু মানুষ তাদের দ্বীন হারিয়েছে এবং দুনিয়াও। যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নত যুগে মানুষের শারীরিক পরিশ্রম কম হয়ে গেছে। অবসর ও আরামআয়েশের সময় বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে ক্ষিধেও লাগে কম। কিন্তু খাবার সময় হলেই খেতে হয়। ক্ষুধা না লাগলেও উদরপুর্তি করতে হয়। এতে না খাওয়ায় রুচি থাকে, আর না হজম ঠিকমত হয়। এ জন্য অধিকাংশ লোকের পেট খারাপ হয় এবং বিভিন্ন পেটের রোগও দেখা দেয় এরই কারণে।

অন্য দিকে কাজ না থাকলে বসে থাকতে হয়। বসলে শুতে ইচ্ছে করে। আর রাত্রে সকালসকাল শুলেও তো আর ঘুম আসে না। কারণ দিনে কোন মেহনতের কাজ না করে থাকলে শরীর ক্লান্ত হয়ে চটপট ঘুম আসবে কোত্থেকে? ফলে অনেকেই কয়েক ঘন্টা ধরে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে ছটফট করে। রাত পার হয়ে যাবে এই ভয় মনে থাকলে ঘুম আসতে আরো দেরী হয়। রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে যেমন একটার পর একটা নক্ষত্র ফুটতে থাকে, তেমনি ঘুম না আসা লোকের মনের আকাশে একটার পর একটা চিন্তার তারা ফুটে উঠতে থাকে। দিনের বেলায় তাকে কথায় কে আঘাত দিয়েছে তার চিন্তা, কে তার কথা মানেনি তার অপমান চিন্তা, সংসারের কোন খরচ চিন্তা, কারো ধোকাবাজির চিন্তা, প্রেম। থাকলে প্রেম ও তার সাফল্য বা অসাফল্যের চিন্তা, স্বামী বা স্ত্রী বিদেশে থাকলে সে অন্যের প্রেমে পড়ছে কি না তার চিন্তা, নানা প্রকার সুমধুর যৌনচিন্তা, আরো কত রকম অশুভ চিন্তা, কুচিন্তা ও দুশ্চিন্তা তার মনের দুয়ারে এসে ভিড় জমায়।

আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যাদের কাজ নেই অথবা থাকলেও কম এবং অবসর বেশী, তাদেরকেই মানসিক রোগ অধিক আক্রমণ করে থাকে। আর সে জন্যই যারা যত বিলাসী তারা তত মনের রোগে অধিক পীড়িত। পক্ষান্তরে যারা খেটে খাওয়া পরিশ্রমী মানুষ, যারা সারাদিন কল-কারখানা অথবা ক্ষেতখামারে মেহনত করে তাদেরকে ক্ষুধা লাগে বেশী। তাদের খাবারে সে রকম স্বাদ ও উল্লেখ্য ‘ভ্যারাইটিজ’ না থাকার ফলে স্বল্প আহার করে। আর পেট খালি রেখে খেলে অসুখ-বালা। কম হয়। মামুলী ধরনের খাবার হওয়ার ফলে তাদের হজম ও পরিপাকের কোন ক্ষতি হয়। অতঃপর বিছানায় আসার আগেই তন্দ্রায় তাদের চোখ দুটি ঢুলুঢুলু করে। আর বিছানায় যেতেই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে মৃতপ্রায় হয়ে পরম তৃপ্তি সহকারে রাত্রি যাপন করে। অতএব মুসলিম যুবকের উচিত, নিজেকে কর্মমুক্ত না করা। প্রকারান্তরে কর্মবিমুখ ও শ্রমকাতর হওয়া তো মোটেই উচিত নয়।

সংসারের কাজ না থাকলে সমাজের কাজ তো আছে, তা না থাকলে কোন প্রতিবেশীর কাজ অবশ্যই থাকবে। বসে থাকার চেয়ে বেগাড় যাওয়া তো অনেক ভালো। লোকেও বলে, ‘বেকারের চেয়ে বেগাড় ভালো। মানুষের উপকার করা নিশ্চয় মানবিক কাজ। তা ছাড়া তাও এক প্রকার ইবাদত। মুসলিম ভায়ের সাহায্য করলে, আল্লাহ সাহায্যকারীকে সাহায্য করে থাকেন। আর কোন প্রকার সাংসারিক কাজ না পাওয়া গেলে আখেরাতের কাজ তো আছেই। একটা ইসলামী বই নিয়ে বসা, তসবীহ ও দুআ-দরূদ পাঠ করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, তফসীর ও হাদীস বুঝে পড়া ইত্যাদি বহু কাজ আছে; যা বুঝে করতে পারলে অবসর পাওয়া তো দূরের কথা, হাতে সময়ই পাওয়া যাবে না। আল্লাহর প্রতি ঈমান ও জিহাদের পরবর্তী পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ আমল হল, সব চাইতে ভালো ও দামী ক্রীতদাস মুক্ত করা। কেউ যদি তা না পারে তবে তার জন্য উত্তম কাজ হল, কোন কারিগরের সহযোগিতা করা অথবা যে কারিগর নয় তার কাজ করে দেওয়া। (মুসলিম ৮৪নং)।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, কারিগরকে সহযোগিতা করা যদি উত্তম কাজ হয় তাহলে নিজে কারিগর হওয়াটা কত বড় উত্তম কাজ হতে পারে! ছুতোর, কামার, কুমোর, তাঁতী, ঘরামী প্রভৃতি কারিগরের কারিগরি কাজ কোন জাতের সহিত সম্পৃক্ত ও নির্দিষ্ট নয়। এর প্রত্যেকটাই মুসলিমের গর্বের কাজ। নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মেহনতের বাহুবলে যারা অর্থোপার্জন করে দ্বীন ও দুনিয়া করে তাদের তা নিয়ে গর্ব হওয়া উচিত। তা ছাড়া শুধু কারিগরি কাজই নয়, বরং কাজ যত ছোটই হোক না কেন, তা করতে লেগে যাওয়া উচিত এবং তার সঙ্গে ঐ কাজের মাধ্যমে বড় কিছু করার বা উত্তম। আরো কিছু হওয়ার আশা ও প্রচেষ্টা রাখা অবশ্যই উচিত। ঐ সময় ছোট কাজ করব না’ বলে বা আভিজাত্যে বাধে বলে কোন অনিশ্চিতের আশায় কোন নিশ্চিত কিছুকে ত্যাগ করে বেকারত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে কুঁড়ের জীবন অতিবাহিত করা পুরুষের জন্য একটা বড় মানসিক পরাজয়। পথ ও উপায় বৈধ হলে হালাল রুজী কামিয়ে খাওয়ার মাঝে পুরুষের পৌরুষ লুকিয়ে আছে। অতএব অপেক্ষা কিসের? বড়র আগে ছোটতেই লেগে যাও।

অতঃপর বড় কিছু পাওয়া গেলে তো ভালোই; নচেৎ ছোট থেকেই বড় হওয়ার চেষ্টা কর। নিষ্কর্মা থেকে মা-বাপের ঘাড়ে বোঝা হয়ে বসে থেকো না। সোনার স্বপ্ন দেখে মুক্তার সময় নষ্ট করার চাইতে বাস্তবে কর্মক্ষেত্রে উঠে-পড়ে লেগে গিয়ে সোনার খনি আবিষ্কার করাটাই হল জীবনের মহাজয়।

শোন, আল্লাহর রসূল সঃ কি বলেন; তিনি বলেন, “স্বহস্তে উপার্জন করে যে খায়, তার চেয়ে উত্তম খাদ্য অন্য কেউ ভক্ষণ করে না। আল্লাহর নবী দাউদ (আঃ) স্বহস্তে উপার্জিত খাদ্য ভক্ষণ করতেন।” (বুখারী ২০৭২ নং) “তোমরা যে খাদ্য ভক্ষণ কর তার মধ্যে সব চাইতে উত্তম খাদ্য হল, তোমাদের নিজের হাতে কামাই করা খাদ্য।” (তিরমিযী, নাসাঈ, বাইহাকী সহীহুল জামে' ১৫৬৬ নং) নিরুপায়ে এই শ্রেণীর কাজ করতে যদি তোমার আভিজাত্যে বাধে তাহলে জেনে রেখো যে, সৃষ্টির সেরা মানুষ আম্বিয়াগণও ঐ শ্রেণীর ছোট কাজ করেছেন। প্রত্যেক নবীই ছাগল চড়িয়েছেন। (বুখারী ৩৪০৬নং, মুসলিম) কেউ ছিলেন ছুতোর, কেউ বা কামার। সুতরাং তোমার আভিজাত্য যে আসলে জাতের আভিজাত্য নয়; বরং স্বভাবের কুঁড়েমি ও আলসেমি তা বলাই বাহুল্য।

অতএব যুবক বন্ধু! সংকোচ ও দ্বৈধের সকল জড়তা কাটিয়ে উঠে কাজ শুরু করে দাও। তোমার শিক্ষা ও কোয়ালিফিকেশন’ অনুযায়ী কিছু একটা কর। বেকার বসে থেকে সময় নষ্ট করো না। অলসদের আখড়ায়, তাসের আডড়ায় এবং ভুয়া ফুটানিবাজদের বৈঠকে থেকে নিজেকে শ্রম-বিমুখ কুঁড়ে করে তুলো না। কাজ করে খাও। কাজে গর্ব আছে, আনন্দ আছে। পরিশ্রম কর, পরিশ্রমে সুখ আছে। পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসুতি। যোগ্যতা ও ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও চাকরী না পাওয়া গেলে লোকেরা তাকে ‘বেকার’ বলে।

কিন্তু তুমি নিজেকে ‘বেকার’ বলে পরিচিত করো না। নাই বা হল চাকুরী। হালাল ব্যবসায় নেমে পড়। যতটুকু পুঁজি যোগাড় করতে পার ঠিক তত বড়ই ব্যবসা আল্লাহর নাম নিয়ে খুলে বস। ধীরে ধীরে বড় হও। ছোট্ট দোকানের মাধ্যমেই উন্নতি করতে শিখ। তারই মাঝে দয়াময় আল্লাহর কাছে বর্কত চাও। আর তুমি তো জানই যে, চলে যদি মনোহারী, কি করবে জমিদারী? তবে হ্যা, ব্যবসা চালাবার মত ব্যবহার শিখো, বৈধ কৌশল ও উপায় অবলম্বন করো। তাহলেই দেখবে, অন্যান্যের মত তুমিও চায়ের দোকান খুলে এঁটো কাপ ধুতে ধুতে অথবা সবজী ব্যবসা করতে করতে কখন বিল্ডিং বানিয়ে ফেলেছ।

ব্যবসার মাধ্যমেও তুমি হালাল রুজী উপার্জন করতে পার। এ বিষয়ে প্রিয় রসূল (সা.) বলেছেন, “সর্বাপেক্ষা উত্তম উপার্জন হল সৎ ব্যবসা এবং নিজের হাতের মেহনত।” (আহমদ, সহীহুল জামে ১১২৬নং) সুতরাং চাকুরীর পয়সা থেকেও উত্তম রজী হল, ব্যবসা ও শ্রম দ্বারা উপার্জিত রুজী।

অবশ্য ব্যবসা করলে হালালী পথে করো। ব্যবসায় কোন সময় মিথ্যা বলো না, কথায় কথায় কসম খেয়ো না, নচেৎ লাভের বর্কত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সৎপথে লাভ কম মনে হলেও তাতেই বৰ্কত আছে। হারাম উপার্জনে বর্কত নেই। তাতে ‘নাই-নাই, খাই-খাই, চাই-চাই’ মিটে না। দুআ কবুল হয় না। ভেজাল দিয়ে, ধোকা দিয়ে, দুনম্বরী করে, কালোবাজারী করে, দাড়ি মেরে প্রচুর লাভ করে বিল্ডিং ঠোকা যায় ঠিকই; কিন্তু সেই বিল্ডিং-এ সুখের পায়রা বাসা। বাঁধে না। আর কথায় তো আছে যে, ফাকি দিলে ফাঁকে পড়ে, মারা পয়সা যায় ডাক্তার ঘরে।

সুতরাং 'হঠাৎ বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন ও শক ত্যাগ করা হারামী পথে কোটিপতি না হতে চেয়ে হালালী পথে তুমি তোমার প্রয়োজনীয় রুজী সন্ধান কর। আমাদের প্রিয় নবী বলেন, “রজী সন্ধানের ব্যাপারে জলদিবাজি করো না। পৃথিবীতে কোন বান্দাই তার ভাগ্যে নির্ধারিত সর্বশেষ রুজী অর্জন না করা পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। অতএব আল্লাহকে ভয় কর এবং রুজী সন্ধানে মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন কর। হালাল উপায় গ্রহণ কর এবং হারাম উপায় বর্জন কর।” (হাকেম, বাইহাকী, সহীহুল জামে ৭৩২৩ নং)

তিনি আরো বলেন, “মৃত্যু বান্দাকে যত খুঁজে বেড়ায় তার চাইতে বেশী খুঁজে বেড়ায় তার রুজী।” (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে' ১৬৩০ নং) সুতরাং প্রত্যেক ঘরে তার দরজা দিয়েই প্রবেশ করা হল জ্ঞানী মানুষের কাজ। আর হালাল পথ ও উপায় অবলম্বন করা অবশ্যই মুসলিমের গুণ। নচেৎ একথারও সাক্ষ্য বিদ্যমান রয়েছে যে, “ব্যবসাদার লোকরাই ফাজের (ফাসেক, সত্যত্যাগী ও মিথ্যাবাদী) হয়ে থাকে।” (আহমদ, হাকেম, ত্বাবারানী, সহীহুল জামে ১৫৯৪ নং) আর এ জন্যই লোকেরা বলে, 'মিথ্যা না বললে কি ব্যবসা চলে নাকি? তবে এ শ্রেণীর ব্যবসায়ী হল তারা, যারা সাঝে বড়লোক হতে চায়।

মুসলিমের কিন্তু এ ধরনের অতিলোভী হওয়া উচিত নয়। পরন্তু হারাম উপায়ে কামাই করে যারা ফুলে-ফেঁপে মোটা হয়েছে তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে চোখ টাটানো বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়াও সমীচীন নয়। সুতরাং তুমি সন্তুষ্টচিত্তে চেষ্টা বজায় রাখ, ফল পরোয়ারদেগারের হাতে। আর এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) এর কয়েকটি উপদেশ শোনোঃ তিনি বলেন, “আল্লাহ তাআলা বান্দাকে যা দান করেছেন তার মাধ্যমে তাকে পরীক্ষা করে থাকেন। সুতরাং সে যদি আল্লাহর ভাগ করে দেওয়া ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হয়, তাহলে তিনি তার। ঐ দানে বর্কত (প্রাচুর্য) প্রদান করেন এবং (তার রুযী) আরো প্রশস্ত করে দেন। পক্ষান্তরে সে যদি তা নিয়ে তুষ্ট না হয়, তাহলে তার রুযীতে বৰ্কত বিলীন হয়ে যায় এবং লিখিত রুযী ছাড়া বাড়তি কিছু বৃদ্ধি করা হয় না।” (আহমদ, সহীহুল জামে ১৮৬৯ নং)

“সে ব্যক্তি সফলকাম ও কৃতার্থ হয়েছে, যে ইসলামের হেদায়াত (আলো) পেয়েছে, প্রয়োজন মোতাবেক স্বচ্ছল রুযী পেয়েছে এবং তাতে সে সন্তুষ্টও আছে।” (তাবারানী হায়ে সহীহুল জামে ১১৩৮ নং)

“তোমাদের থেকে যারা নিয়ে তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর এবং তোমাদের থেকে যারা উর্ধে তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করো না। তাহলে হবে এই যে, তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামতকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছজ্ঞান করবে না।” (আহমদ, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে' ১৫০৭ নং)

আসল ধনবত্তা হল হৃদয়ে। মন ধনী না হলে যতই ধন অর্জন হোক ধনী হওয়া সভব নয়। তাই লোহার সিন্দুক ভর্তি বা ব্যাংক ব্যালেন্স করার আগে মনের সিন্দুক ও ব্যাংক ভর্তি ও ব্যালেন্স করতে হবে। লোভাতুর মন থেকে অপ্রয়োজনীয় চাই-চাই, খাই-খাই’ দুর করতে হবে। তাহলেই প্রকৃত ধনী হওয়া সম্ভব ও সহজ। নচেৎ হাজার হলেও অভাব ঘুচবে না। লক্ষলক্ষ সুখের সামগ্রী থাকা সত্ত্বেও সুখের মিষ্টি স্বাদ অনুভব করা যাবে না। ধনী হয়েও গরীবরূপে চিহ্নিত হবে লেবাসে-পোশাকে, আচারে-ব্যবহারে। অথচ “আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে তার অনুগ্রহ ও নেয়ামত প্রদান করেন তখন তার প্রভাব ও চিহ্ন তার দেহের উপর দেখা যাক -এ কথা তিনি পছন্দ করেন। পক্ষান্তরে তিনি দীনতা প্রকাশ করাকে এবং দারিদ্রের ভান করাকে অপছন্দ করেন। আর ঘৃণা করেন, নাছোড়বান্দা হয়ে যাজ্ঞাকারীকে এবং ভালোবাসেন, লজ্জাশীল এমন বান্দাকে; যে যা করে না।” (বাইহাকীর শুআবুল ঈমান, সহীহুল জামে' ১৭১১ নং)।

সুতরাং দীনতা প্রকাশের হীনতা বর্জন করে, সকল প্রকার আলস্য কাটিয়ে, গড়িমসি ও কুঁড়েমি ত্যাগ করে মাথা উচু করে বাঁচার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ কর। এমন উদ্যমের সাথে অদম্যভাবে কাজ করে যাও যাতে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, তুমি অকর্মণ্য নও এবং তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। হ্যাঁ, আর ভাগ্যের উপর ভরসা করে বসে যেও না। উট বেঁধে আল্লাহর উপর ভরসা করো, উট ছেড়ে রেখে নয়।' তকদীর তো আছেই; কিন্তু তদবীর করে যাওয়া তোমার কাজ। হাল ছেড়ে বসা যুবক ও পুরুষের কাজ নয়। পেঁচা ও কাকের ডাকে পিছপা হওয়া তওহীদবাদী মুসলিম সুপুরুষের গুণ নয়। কুকুর-বিড়ালের কান্নায় ভয় পেয়ে ঘর ঢােকাও তার জন্য শোভনীয় নয়। আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রেখে সমস্ত বাধা উল্লংঘন করা পুরুষের

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যদি তোমরা আল্লাহর উপর যথার্থ ভরসা রাখ তাহলে তিনি তোমাদেরকে সেইরূপে রুযী দান করবেন, যেরূপে দান করে থাকেন পক্ষীকুলকে; তারা খালি পেটে সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যায় এবং ভরা পেটে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে।” (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ হাকেম, সহীহুল জামে” ৫২৫৪নং)।

উক্ত হাদীস শরীফে তিনটি কথার প্রতি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে। প্রথম কথা এই যে, রুযী সন্ধানের জন্য আল্লাহর উপর আস্থা রাখতে হবে। দ্বিতীয় কথা এই যে, ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতে হবে। আর তৃতীয় কথা এই যে, সকালে বের হতে হবে। কারণ, প্রভাতকালের একটা বিশেষ মাহাত্ম আছে; এ সময়ের কাজে বিশেষ বৰ্কত আছে। (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) সুতরাং এ সময়ে যে ঘুমিয়ে থাকে সে সমূহ বৰ্কত থেকে বঞ্চিত হয়।

আর ঘর থেকে বের হওয়া এবং হর্কত ৰ্মে বৰ্কত হওয়ার কথা মহান আল্লাহ বলেন, “অতঃপর নামায শেষ হলে তোমরা বাইরে (মাঠে-হাটে) ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর। আর আল্লাহকে (কর্মক্ষেত্রে) অধিকরূপে স্মরণ কর; যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (সূরা জুমুআহঃ ১০ আয়াত)

তিনি রাত্রি সৃষ্টি করেছেন বিরতি ও আরাম নেওয়ার জন্য এবং দিন সৃষ্টি করেছেন রুযী সন্ধানের জন্য। রযী সন্ধান সহজসাধ্য করার লক্ষ্যেই পানির বকে জাহাজ ভাসিয়েছেন। কিন্তু মানুষ যদি হাত-পা নিয়ে ঘরেই বসে থাকে তাহলে তার অনুগ্রহ ও রুযী তো বাতাসের ‘ইথর’-এ ভেসে আসবে না। স্ত্রীর প্রেমের নামে তার শাড়ীর আঁচলে জড়িয়ে থাকলে, সন্তানের মায়ার বাঁধনে নিজেকে বেঁধে রাখলে অথবা পিতা-মাতার স্নেহ-মমতায় গৃহবন্দী হয়ে থাকলে এমন পুরুষ কাপুরুষ বৈ কি? অথচ এ কথা সত্য যে, কেউ তাকে বসে খেতে দেবে। আর বসে খেলে যাবেই বা কতদিন? গোলেমালে কতদিন চলতে পারে? চিরদিন তো চলতে পারে না। তা ছাড়া কথায় বলে, 'বসে খেলে কুলায় না, করে খেলে ফুরায় না। বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। বুদ্ধি গুণে খা ভাত, আবার বুদ্ধি গুণেই হা-ভাত।

বাপের জমি-জায়গা দেখে হয়তো অনেকে ভাবে, এতেই আমার বেশ চলবে। অনেকে স্ত্রীর ধন দেখে শ্বশুর বাড়ির আশ্রিত হয়ে জীবন কাটানোর মাঝেই সুখ আছে বলে মনে করে। কিন্তু এদের মন যে হীন তা বলাই বাহুল্য। বাপ-মা যত ধনবানই হন না কেন, তাদের চেষ্টা থাকে তাদের ছেলে আরো বড় ধনী হোক। কিন্তু ছেলে তার বিপরীত হলেই মুশকিল। পিতা চান ছেলে স্বনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠুক। কিন্তু কিছু ছেলে আছে যারা তীর্থের কাক হতে চায়। পরনির্ভরশীল হয়ে, এমন কি স্ত্রীর কামাই খেয়ে দিন কাটাতে পরম তৃপ্তি ও সুখ অনুভব করে থাকে। এক বণিক তার ছেলেকে বাণিজ্যে পাঠাল। একদা সে বন্য পথে এক ক্ষুধার্ত শিয়াল দেখতে পেয়ে তার অলস মনে ভাবল, এই মিসকীন কোত্থেকে খেতে পায়? তৎক্ষণাৎ দেখল, অনতি দুরে এক বাঘ শিকার ধরে খাচ্ছে। বাঘের ভয়ে লুকিয়ে এক স্থান হতে তাদের কীর্তিকাণ্ড লক্ষ্য করতে লাগল।

পরিশেষে সে দেখল, বাঘ যা খাওয়ার তা খেয়ে চলে গেলে ঐ শিয়াল এসে পরিত্যক্ত অবশিষ্ট অংশ খেতে শুরু করল। কুঁড়ে মনে ভাবতে লাগল, এই তো আসল বুদ্ধি! বিনা মেহনতে বেশ খাসা খাবার শিয়াল খেতে পেল। এমনি করে বিনা পরিশ্রমে আমারও তো দিন চলে যাবে। বাপের তো অনেক আছে। এত কষ্ট স্বীকার করে লাভ কি? বাস, ভাবা মাত্রই বাড়ি ফিরে এল শ্রমবিমুখ ছেলে। এসে বাঘ ও শিয়ালের বৃত্তান্ত শুনালে আব্বা তাকে বুঝিয়ে বললেন, 'তুই আসলে ভুল বুঝেছি। অনুকরণ যদি করতেই হয় তাহলে শিয়ালের কেন? বাঘের অনুকরণ কর। শিয়ালের কর্মকাণ্ড খেয়াল করলি, অথচ বাঘের কর্মটা খেয়াল করলি না? আমি আশা করব যে, তুই পরান্ন বা উচ্ছিষ্টভোজী শিয়াল না হয়ে স্বনির্ভরশীল বাঘ হবি; তুই কামাই করে খাবি। অন্য কেউ শিয়ালের মত তোর এঁটো খাক- তাতে দোষ নেই।

যুবক বন্ধু আমার জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলে তোমাকে কেউ ভালোবাসবে না, এমন কি তোমার প্রাণপ্রিয়া স্ত্রীও নয়। সংসারের দরজা দিয়ে অভাব ঢুকলে জানালা দিয়ে ভালোবাসা লুকিয়ে পালিয়ে যাবে। কাল তুমি যার কাছে রসের নাগর’ ও ‘যোগ্য স্বামী ছিলে, আজ পয়সা থেকে পকেট খালি হলে তার কাছেই অযোগ্য মিন্সে’ বলে পরিচিত হবে। শ্বশুর বাড়িতেও তোমার অযোগ্যতার চর্চা হবে। নি-কামায়ের জামাই দেখে সবাই নাক সিটকাবে। কাল তোমার ধনের জন্য যেখানে ধন্য-ধন্য নাম হচ্ছিল আজ সেখানে অন্নহারাছন্নছাড়া হয়ে তুমি ঘৃণাই হবে। কাল যারা তোমাকে আদর করে দোলা-ভাই' বলে ডাকত, আজ তারা তোমাকে ঘৃণাভরে অকর্মণ্য হওয়ার ফলে কুটে লাগা’ বা ‘অকেজো’ বলে আখ্যায়িত করবে। কাল যারা ‘আসুন-আসুন’ ‘বসুন-বসুন’ বলে আপ্যায়ন করত, আজ তারা ‘আয়’ বলেও ডাকতে চাইবে না। ঠিকই তো, যার ধান নেই, তার মান নেই। যার ভাত নেই, তার জাত নেই।' সিমেন্ট না থাকলে কি ইটে-ইটে জোড়া লাগে? আঠা না হলে কাগজে-কাগজে কোলাকুলি হয় না। তোমার অর্থ না থাকলে কে তোমাকে নিয়ে গলাগলি করবে ভাই?

একটি সত্য ঘটনা শোন৷ এক গরীব মা তার ছেলেকে বড় মেহনত করে অর্থ সংগ্রহ করে মানুষ করেছিল। বাপ মারা গেছে সে যখন কোলে ছিল তখন। ছেলে লেখাপড়া শিখে বড় ডিগ্রি

ও চাকুরী লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। মা চেয়েছিল এক দ্বীনদার যুবতীর সঙ্গে তার বিবাহ সেরে ফেলবে। কিন্তু ছেলে তার শিক্ষা অনুসারে সে কনেকে পছন্দ করেনি। নিজের পজিশন হিসাবে পছন্দ করেছিল তারই মত তথাকথিত 'আলোকপ্রাপ্তা’ এক শিক্ষিতা যুবতীকে। বিয়ের ঠিক ছ'মাস পরে এক রাত্রে সেই স্ত্রী স্বামীর নিকট কেঁদে অভিযোগ করল, আমি এ ঘরে তোমার মায়ের সঙ্গে বাস করতে পারব না। এর চাইতে বেশী সবর আর আমি করতে পারব না। তুমি ব্যবস্থা কর। তা না হলে আমি মায়ের ঘর চলে যাব।'

যেই বলা সেই ব্যবস্থা। মা’এর মত ধনকে ঘর ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যেতে বাধ্য করল তার শিক্ষিত ছেলে-বউ! অশ্রুসিক্ত নয়নে মা ঘর থেকে যেত যেতে শুধু বলেছিল, 'আল্লাহ তোকে হেদায়াত করুক বেটা! আল্লাহ তোকে সুখী করুক।'

অবশ্য কিছুদিন পর ছেলের মাথা ঠান্ডা হলে এ কাজ তার বিবেকে বিরাট ভুল বলে ধরা পড়েছিল। কিন্তু মা কোথায় আছে তা খোজা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি৷ আর স্ত্রীও তার রূপলাবণ্য, ছলাকলা ও বিভিন্ন প্রভাব-প্রতিপত্তির সাহায্যে মায়ের সে সব কথা ভুলিয়ে তাকে বেশ প্রশান্ত করে নিজ বশে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। দিন কারো সমান যায় না। একদা অসুস্থ হল স্বামী। রোগ ছিল বড় মারাত্মক। মায়ের নিকট খবর পৌছলে মায়ের মন বাছাকে না দেখে থাকতে পারেনি৷ দেখতে এসেছিল হাসপাতালে। সঙ্গে মেম সাহেবা বিবিজান ছিল। রুমের দরজা প্রবেশ করতেই সে মায়ের মুখোমুখি দাড়িয়ে কঠোর ভাষায় বলে উঠল, 'ফিরে যাও এখান থেকে। তোমার বেটা নেই। আমাদের কাছে কি চাও তুমি? আমরা তোমাকে চাই না।' অসুখের তাড়নায় ছেলের কথা বলার এবং স্ত্রীর কথার কোন প্রতিবাদ করারও ক্ষমতা ছিল।

নিরুপায় হয়েই মা লজ্জায় ও ঘৃণায় চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ফিরে গিয়েছিল। সুস্থ হলে বাড়ি ফেরার পর আবার অসুখ বেড়ে যায় স্বামীর। পুনরায় ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। লম্বা অনুপস্থিতির ফলে এবারে তার চাকুরীও চলে যায়। ঋণের বোঝা ইতিমধ্যে কোমর ভেঙ্গে ফেলেছে। বহু বন্ধু আর দেখা করতে আসে না। এখন সবাই যেন তাকে দুর বাসতে শুরু করে দিয়েছে। এক্ষণে স্ত্রীই বা কেন থাকবে? সিমেন্টে লোনা ধরলে ইটের দেওয়াল তো ভেঙ্গে পড়বেই। হঠাৎ একদিন সে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলল, আমি আর এত কষ্টে তোমার কাছে থাকতে পারব না; আমাকে তালাক দাও! এখন তোমার চাকরী নেই, কোন পজিশন নেই। আমি মায়ের ঘর চললাম!' রোগাক্লিষ্ট স্বামী যে হতবাক ও নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য সে হয়তো এই শাস্তির যোগ্যও ছিল। সুদীর্ঘ নিদ্রাঘোর থেকে যেন আজই চৈতন্যপ্রাপ্ত হল।

পরবর্তীতে একটু সুস্থ হলে মায়ের খোঁজ করল। এতদিন মা লোকের সদকাহ-যাকাত খেয়ে কালাতিপাত করছিল। মায়ের সন্ধান পেয়ে অশ্রু বিনিময়ের মাধ্যমে এক অপরকে নতুন জীবনের অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। আজ সে মায়ের মত মা’ পেয়ে বড় সুখী। (আ ইদুনা ইলাল্লাহ পুস্তিকা থেকে সংগৃহীত)

এ জন্যই লোকেরা বলে থাকে, বউ গেলে বউ পাবি রে, কিন্তু মা গেলে মা আর পাবি না।” অবশ্য মায়ের মত মা’ পাওয়া এক সৌভাগ্যের ব্যাপার।

‘এরি মাঝে কোথা হতে ভেসে এল মুক্তধারা মা আমার

সে ঝড়ের রাতে

কোলে তুলে নিল মোরে, শত শত চুমা দিল সিক্ত আঁখি-পাতে।

অবশ্য মা-বাপও যে শ্রমবিমুখ ছেলেকে বসিয়ে রেখে খাওয়াবে তা নয়। মা-বাপের যত স্নেহ-আদরের কথা বেশী ভাবা যায় শিশু অবস্থায়। কিন্তু বড় হলে তারাও ছেলের কামাই খেতে চায়। আর এটা তাদের অধিকার। সুতরাং কামাই দেখাতে না পারলে জামাই-এর যেমন কোন মান নেই শ্বশুর বাড়িতে, ঠিক তেমনই অর্থ ঢেলে দিতে না পারলে ছেলেরও। কোন স্নেহ নেই পিতামাতার কাছে। দুনিয়ার কানুনই এটা। সংসারের যত রকমের মায়াবন্ধন আছে সে সবের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হল এই টাকা। টাকা না হলে সব ফাকা। সমস্ত মায়ার বাধন ছিন্নভিন্ন হবে টাকা যদি না থাকে। এক বন্ধু আমাকে জানালেন, বাড়ির লোকে আমাকে খুব ভালোবাসে, খুব মানে।

কোন কাজ আমার পরামর্শ ছাড়া হয়ই না। বিভিন্ন মজলিসে আব্বা আমার খুব প্রশংসা করেন। কিছুদিন পর সেই বন্ধুর মুখেই শুনলাম তার বিপরীত। কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে, বন্ধুর টাকা জমা দেওয়ার বাজেট নাকি কম হয়ে গেছে তাই। আর এই অবস্থা। অধিকাংশ বন্ধুরই। কথায় বলে, 'টাকা তুমি যাচ্ছ কোথা? পিরীত যথা। আসবে কবে? বিচ্ছেদ যবে। বলা বাহুল্য, পিরীত ও বিচ্ছেদের মূল কারণ হল ঐ টাকা। সুতরাং তার উপরে যথার্থ নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে জীবনে পরাজয় ও ব্যর্থতা সুনিশ্চিত। টাকা নিয়ে বিভিন্ন আকর্ষণ ও বিকর্ষণের মাঝে সুস্থিরভাবে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখা সুপুরুষের কাজ। এমন স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে, যাতে সাপও মরে এবং লাঠিও না ভাঙ্গে। তাছাড়া প্রত্যেক অধিকারীকে স্ব-স্ব অধিকার যথাযথভাবে প্রদান করতে ইসলাম আমাদেরকে আদেশ করে। আর পরিশ্রম না করে ঘরে বসে থেকে সে সব অধিকার আদায় করা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। অতএব প্রিয় বন্ধু! প্রতিষ্ঠিত যে হতেই হবে, তা অবশ্যই বুঝতে পারছ। আশা করি যে, সামর্থ্যবান যুবক হয়ে কোনদিন তুমি তোমার বাড়া ভাতে ছাই পছন্দ করবে না এবং লাঞ্ছনাময় জীবন পেয়েও সন্তুষ্টচিত্তে তারই মাঝে আনন্দের আলো খুঁজবে না।

হ্যা, আর বিলাসপরায়ণ হতে চেষ্টা করো না। অর্থাৎ, 'ঘরে নেই ভাত, আর কেঁাচা তিন হাত করে ‘নবাব খাজা খা’ সেজে পেটে ভাত না থাকলেও মুখে পান রাখার অভ্যাস, বাজারে গেলেই চা পান, হোটেলে ভাত শক করে খাওয়ার অভ্যাস, অপ্রয়োজনীয় কাজে পয়সা অপচয় করার নেশা খবরদার রেখো না। নচেৎ বুঝতেই তো পারছ, ঠাস-ঠোসকে বিকায় ঘোড়া।

বাড়িতে বসে স্ত্রীর প্রেম-পাশে আবদ্ধ থেকে চাষ করলেই যদি দিন চলে যাবে ভাব, তাহলে মুরুব্বীদের একটি কথা অবশ্যই মনে রেখো,

খাটে খাটায় লাভের গাতি,

তার অর্ধেক মাথায় ছাতি।

আর ঘরে বসে পুছে বাত,

তার কপালে হা-ভাত।

এ সবের আগে মনে রাখবে মহানবীর মহাবাণী। তিনি বলেন, “যখন তোমরা ‘ঈনা’* ব্যবসা করবে এবং গরুর লেজ ধরে চাষ-ক্ষেত নিয়ে সন্তুষ্ট (ব্যস্ত-সমস্ত) থাকবে। আর জিহাদ ত্যাগ করে বসবে, তখন আল্লাহ তোমাদের উপর এমন লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেবেন, যা ততক্ষণ পর্যন্ত দুরীভূত করবেন না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা (যথার্থরূপে) তোমাদের দ্বীনে ফিরে এসেছ।” (আকাউদ ও ৪৬২৭ং, কইহাকী ৫/৩১৬ সিলসিলাহ সহীহহ ১১নং তিনি বলেন, “----- এক জাতি হবে যারা গরুর লেজ ধরে চাষবাস করবে এবং জিহাদে বিমুখতা প্রকাশ করবে, তারা হবে ধ্বংস।” (আবু দাউদ ৪৩০৬, মিশকাত ৫৪৩২ নং) একদা তিনি হাল-চাষের কিছু সাজ-সরঞ্জামের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, “যে জাতির ঘরে এই জিনিস প্রবেশ করবে, সেই জাতির ঘরে আল্লাহ লাঞ্ছনা প্রবিষ্ট করবেন।” (বুখারী, ত্বাবারানী, সিলসিলাহ সহীহাহ ১০ নং)

উদ্দেশ্য এই নয় যে, চাষ করা খারাপ জিনিস বা চাষ করা লাঞ্ছনার কাজ। বরং উদ্দেশ্য হল, বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদি তার চাইতে ভালো কাজ। তাছাড়া চাষবাস যেন আল্লাহর পথে সংগ্রামে বাধা না দেয়। দুনিয়ার প্রতি মনকে অধিক আকৃষ্ট না করে তোলে। আর এ কথা বাস্তব ও অনস্বীকার্য যে, এ পৃথিবীতে চাষীরাই বেশী অবহেলিত এবং সাধারণতঃ অশিক্ষিতরাই এই পেশা অবলম্বন করে থাকে।

পক্ষান্তরে মহান আল্লাহ বলেন, “বল, তোমাদের নিকট তোমাদের পিতা-মাতা, তোমাদের। সন্তান-সন্ততি, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য; যাতে তোমরা মন্দার আশঙ্কা কর এবং তোমাদের বাসস্থান; যা তোমরা ভালবাস - এ সব যদি আল্লাহ, তার রসুল এবং আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত তোমরা অপেক্ষা কর। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।” (সূরা তাওবাহ ২৪ আয়াত)

*যে ব্যবসায় বিক্রেতা ক্রেতাকে কোন জিনিস ধারে বিক্রয় করে পুনরায় বিক্রেতা নগদ ও তার চাইতে কম মল্যে এ জিনিসকেই ক্রেতার নিকট থেকে ক্রয় করে।

অভাবের তাড়নায় ও বেকারত্বের ফলে সংঘটিত দুঃখ-জ্বালা কম নয়। এ ছাড়া সংসারের ঝড়-ঝামেলাও বিভিন্নমুখী, শতরূপী। সামান্য ভুল বুঝাবুঝির দরুন যেমন দাম্পত্য-কলহ বাধে, তেমনি মনোমালিন্য ঘটে বাপ-বেটা ও শাশুড়ী-বউ-এর মাঝেও। হিংসা-জ্বালায় বিষময় হয়ে ওঠে ভাই-ভ্রাতৃত্বের সংসার। এমনিই ঘটে থাকে। না ঘটা বিরল ব্যাপার। সংসারে দুঃখকষ্ট একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। সুখ-দুঃখ নিয়েই মানুষের জীবন গড়া। যারা তা স্বীকার করতে চায় না, তারা আসলে জীবনকেই অস্বীকার করে। অবহেলিত পিতা-মাতা অথবা সন্তান, নিপীড়িতা গৃহবধু অথবা শাশুড়ী, লাঞ্ছিত ভাই অথবা অন্য কেউ -যেই হোক না কেন, জীবনের সমস্যাকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না।

সমস্যা যতই আসুক তবুও তারই মাঝে সমাধানের আলো খুঁজে নিতে চেষ্টা করতে হবে। আর তারই মাঝে সন্ধান করতে হবে। আনন্দময় জীবন। জীবনে সমস্যার সৃষ্টি না হলে হয়তো বা আমাদের জীবনে বাঁচার আনন্দ অর্ধেক নষ্ট হয়ে যেত। কারণ, যে ভোজনে টক নেই, সে ভোজনে তত তৃপ্তি নেই। যে ভ্রমণে বিপদের ঝুঁকি নেই, সে ভ্রমণে তত আনন্দের স্বাদ নেই। মানুষের জীবনেও দুঃখ, দুশ্চিন্তা, দৈন্য আছে বলেই জীবন কখনো একঘেয়ে হয়ে ওঠে না।

পাঁচ জনের সংসারে ভুল বুঝাবুঝি স্বাভাবিক। হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, বিদ্বেষ প্রভৃতি উল্লংঘন করে যাওয়া জীবনের এক শুভ জয়। আপদ-বিপদ, বালা-মসীবত ইত্যাদি সন্তুষ্টচিত্তে বরণ করে নেওয়া পূর্ণ ঈমানের পরিচায়ক। এমনই তো মুমিনের জীবন। নদীতে স্রোত আছে, তাই নদী বেগবান। জীবনে দ্বন্দ্ব আছে, তাই জীবন বৈচিত্রময়। সুতরাং এই বৈচিত্রময়তাকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এমন কেউ নেই, যার জীবনে কোন সমস্যা আসেনি। এমন কেউ নেই, যে জীবনে কোন দুঃখ পায়নি। এমন কেউ নেই, যার জীবনে কোন রিক্ততা ও তিক্ততা নেই। এমন কেউ নেই, যে। জীবনভর শুধু পেয়েই গেছে এবং কখনোও কিছু হারায়নি জীবনে। পরন্তু সংসারের এক নিয়ম এই যে, কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়, কিছু লাভ করার জন্য কিছু বিসর্জন দিতে হয়।

অবশ্য মনকে এই বলে প্রবোধ দিতে হবে যে, জীবনের সব সন্ধ্যাই অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। তার মধ্যে শুভ সন্ধ্যারও পদার্পণ ঘটে। যে সন্ধ্যায় থাকে পূর্ণিমার পূর্ণশশীর মনমুগ্ধকর জ্যোৎস্নার আলো, অথবা থাকে মিলনের আকাঙ্খায় শুভ বাসরের ফুলশয্যার প্রস্তুতি, অথবা থাকে আগামী কালের ঈদ হওয়ার সুসংবাদ। তাছাড়া দুঃখ কিসের? যে ব্যক্তি তকদীরে বিশ্বাস রাখে, যার সাথের সাথী হল স্বয়ং পালনকর্তা আল্লাহ তাআলা, তার আবার দুঃখ কিসের? ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া ওয়াজেব। মানুষ নিজ ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হয় না বলেই দুঃখ পায়। আর এ জন্যই মহানবী (সা.) বলেন, “আল্লাহ তোমার ভাগ্যে যা ভাগ করে দিয়েছেন তা নিয়ে তুষ্ট থাক, তাহলে তুমিই হবে সবার চাইতে বড় ধনী।” (আহমাদ, তিরমিযী, সহীহুল জামে ১০০নং)

পরন্তু মানুষ নানা মায়াজালে আবদ্ধ হয় হয় বলেই দুঃখ পায়। যা কামনা করে তা পায় না। বলেই ব্যথা-বেদনার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে হা-হুতাশ করে থাকে। পক্ষান্তরে যদি এমন জালে আবদ্ধ না হয়ে কোন কামনার বশীভূত না হয়, তাহলে মানুষ দুঃখের মুখ দেখে না।

কারো নিকট অতিরিক্ত অধিকার, বেশী মাত্রায় ভক্তি, অধিক পরিমাণে ভালোবাসা, অতি পরিমাণে সাহায্য-সহযোগিতা, বা মানুষ যতটার উপযুক্ত তার তুলনায় বেশী পরিমাণের মান-সম্মানের আশা করলে এবং যথা সময়ে তা না পেলে তার মনে আঘাত লাগে, দুঃখ হয়; নচেৎ কিন্তু হয় না। অতএব এরূপ আশা না রাখাই হল মনের বড় সুখ।

অবশ্য সব ধরনের সমস্যা ও দুঃখের একটি মহৌষধি ও প্রতিকার হল ধৈর্য। ধৈর্য তিক্ত; কিন্তু তার পরিণাম বড় মধুর। বৃক্ষের ছাল তিক্ত হলেও তার ফল বড় মিষ্ট। ধৈর্যধারণ করা কঠিন হলেও তার শেষ পরিণতি বড় শুভ।

আবার ধৈর্য ধরা শুরুতে কঠিন হলেও ধীরে ধীরে তাতে স্থিরতা আসে এবং পরে তা সয়ে যায়। তাছাড়া অসহ্য বলে কোন কিছু নেই। সময়ে সবই সহ্য হয়ে যায়। হরিণ বাঘের শিকার ও খাদ্য হলেও বাঘ যখন কুপোকাত হয় এবং হরিণ তার গাল চাটে, তখন বাঘ তাকে বলে, অভদ্রা বর্ষাকাল, হরিণী চাটে বাঘের গাল। শোরে হরিণী তোরে কই, সময় গুণে সবই সই। অতএব ছোটর কাছ থেকে লাথি খেলেও তা ধৈর্যের মাধ্যমে সহ্য করে নিতে হয়; বিশেষ করে যখন বদলা নেওয়ার ক্ষমতা না থাকে তখন। পরন্তু বদলা নিতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও যদি ধৈর্যধারণ করে বদলা না নেয়, তবে সেটাই হল প্রকৃত ও বড় ধৈর্য। আর এ জন্যই দেখা গেছে যে, শক্তির চেয়ে ধৈর্যই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশী সফলতা আনতে পারে। মসীবত যেমনই হোক তা মসীবত। কিন্তু সব চাইতে বড় মসীবত হল মসীবতের উপর ধৈর্য রাখতে পারা। দুঃখ-কষ্ট যেমনই হোক, ধৈর্যের তরবারি দ্বারা কেটে ফেলা ছাড়া তার আর কোনই অব্যর্থ ওষুধ নেই। অতএব দুঃখী বন্ধু আমার! মসীবতে ধৈর্য ধর ও আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নামায ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য কামনা কর। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন।” (সূরা বাকারাহ ১৫৩ আয়াত)

যাবতীয় বিপদ আসে আল্লাহর তরফ হতে। তিনি বিপদ-আপদের মাধ্যমে মু'মিনকে পরীক্ষা করে থাকেন। সোনা পুড়িয়ে সোনার খাঁটিত্ব যাচাই করে থাকেন। কখনো ভয় দিয়ে, ক্ষুধা দিয়ে, কখনো বা জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে বান্দাকে পরীক্ষায় ফেলেন। এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়, যারা হা-হুতাশ বর্জন করে সমুদয় দুঃখ-কষ্টে ধৈর্যধারণ করে, তারাই পায় আল্লাহর তরফ থেকে সুসংবাদ। উত্তম বিনিময়ের সুসংবাদ, বেহেস্তের শুভসংবাদ। যাদের উপর বিপদ পতিত হলে অসন্তুষ্ট ও বিচলিত না হয়ে বলে, ‘ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিউন। আসলে তাদেরই উপরে মহান প্রতিপালকের তরফ হতে শান্তি ও করুণা বর্ষণ হয় এবং তারাই হল সুপথগামী। (সূরা বাক্বারাহ ১৫৫-১৫৭)

পক্ষান্তরে কোন কোন বিপদ আসে মানুষের কোন কৃতকর্মের ফলে। কোন অসৎ কর্মের। সত্বর সাজাস্বরূপ অকস্মাৎ বিপদ এসে মানুষকে সতর্ক করে যায়। তাকে ধ্বংস করার জন্য নয়; বরং তাকে নতুন করে গড়ার জন্য। মরিচা-পড়া লৌহ খণ্ডকে কর্মকার আগুনে দিয়ে আঙ্গার করে বারবার হাতুড়ি দ্বারা পিটিয়ে থাকে, তা নষ্ট ও নিশ্চিহ্ন করার জন্য নয়; বরং নতুনরূপে কিছু তৈরী করার জন্য। মা জোর করে অনেক সময় শাস্তি দিয়েও তিক্ত ঔষধ শিশুকে সেবন করায় ছেলের প্রতি রুষ্ট হয়ে তাকে মেরে ফেলার জন্য নয়; বরং তার প্রতি স্নেহপরবশ হয়ে তাকে বাঁচিয়ে ও সুস্থ করে তোলার জন্য তা করে থাকে। কোন পশু গায়ের বল দেখিয়ে অত্যাচার শুরু করলে তাকে খাচায় পুরে খাওয়া বন্ধ করে শাস্তি দিয়ে জব্দ করা হয়। যে পাখীকে ক্ষুধায় রাখলে কেবল গান শোনায়, সে পাখীকে খাঁচার ভিতর ক্ষুধায় রেখে তার সুমধুর গান শুনতে অবশ্যই ভালো লাগে।

পরন্তু বান্দার কোন মসীবত এলে তাতে তার পাপ ক্ষয় হয়। এমন কি পায়ে কাঁটা ঢুকলেও তাতে মুমিন বান্দার গোনাহ মাফ হয়। অথবা মসীবতে বান্দার মর্যাদা বর্ধন হয়। নেক বান্দার জন্য মসীবত হল আল্লাহর দেওয়া এক নেয়ামত। যে বান্দা আল্লাহর নিকট যত প্রিয় হয়, সে বান্দার মসীবত তত বড় হয়। যার প্রেম যত প্রগাঢ়, তার প্রেমের পরীক্ষাও ততোধিক কঠিন। সুতরাং মসীবতে কাতর হওয়া, মুষড়ে পড়া, বিচলিত বা ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত নয়। এমন হলে মসীবত সত্যই মসীবত।

একান্ত আপনজন পর হয়ে গেছে, ধোকা দিয়েছে অথবা আঘাত হেনেছে?

আগুন, ঝড়, বন্যা বা ভূমিকম্পে বাসা-বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে?

অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, ঝড় বা বন্যায় তৈরী ফসল নষ্ট হয়ে গেছে?

গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? ছেলে বা আব্বা-আম্মা কেউ মারা গেছে?

চাকুরি চলে গেছে? কারো অত্যাচারে গৃহহীন ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছ?

ব্যবসায় মোটা টাকা নোকসান গেছে? বড় অসুখে ভুগছ?

মসীবত যেমনই হোক, দুঃখ করো না, মনমারা হয়ো না, ভেঙ্গে পড়ো না, হা-হুতাশ করো, হায়-হায়’ করে হায়-পস্তানি কোন কাজে দেবে না। অতএব সে আঘাত ভুলার চেষ্টা কর, মনকে শক্ত করে আবার নতুন করে জীবন গড়ে তোল। যা হারিয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় মহান প্রভুর নিকট ধৈর্যের সাথে সাহায্য ভিক্ষা কর। আবার লেগে যাও কাজে। কারণ, দুঃখ, ব্যথা, বেদনা থেকে বাঁচতে হলে কাজের ভিতর দিয়েই বাঁচতে হবে। নিজেকে অকেজো ভেবো না। যা হারিয়েছে তা যাবার ছিল তাই গেছে -এ কথা মনে করো। যা পাওনি তা পাবার উপযুক্ত তুমি ছিলে না -এই ধরে নিও। যা চলে গেছে তা তোমার জন্য মঙ্গলময় ছিল না -এ কথাকেও নিশ্চিতের সাথে মনে স্থান দিও। “--- কিন্তু তোমরা যা পছন্দ কর না, সম্ভবতঃ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং তোমরা যা পছন্দ কর, সম্ভবতঃ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।” (সুরা বাকারাহ ২১৬) আর “এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তা অপছন্দ করছ।” (সূরা নিসা ১৯ আয়াত)

সুতরাং অতীতের ঘটনা ভুলে এবার ভবিষ্যতে মন দাও। বুক ভেঙ্গে গেছে, তবুও ভয় নেই। ভাঙ্গা বুক নিয়েই আল্লাহর উপর ভরসা করে আবার বিজয়ের আশায় খাড়া হয়ে দাঁড়াও। দুঃখ, বেদনা ও অভাবকে তোমার উন্নতির পথে বাধা মনে না করে পরীক্ষা’ বলে ধরে নিও। তোমার পুনঃ উন্নতির পথে এই অবসরে শয়তান যেন বাদ সাধতে না পারে তার খেয়াল রেখো। মনে রেখো মহানবীর মহাবাণী; তিনি বলেন, “সবল মু'মিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা প্রিয় ও ভালো। অবশ্য উভয়ের মাঝেই কল্যাণ রয়েছে। তোমার যাতে উপকার আছে তাতে তুমি যত্নবান হও।

আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর, আর অক্ষম হয়ে বসে পড়ো না। কোন মসীবত এলে এ কথা বলো না যে, '(হায়) যদি আমি এরূপ করতাম, তাহলে এরূপ হতে। (বা যদি আমি এরূপ না করতাম, তাহলে এরূপ হতো না।) বরং বলো, আল্লাহ তকদীরে লিখেছিলেন। তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন।' (আর তিনি যা করেন, তা বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন; যদিও তা সে বুঝতে পারে না।) পক্ষান্তরে। যদি-যদি না’ (বলে আক্ষেপ) করায় শয়তানের কর্মদ্বার খুলে যায়।” (আহমদ, মুসলিম, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে ৬৬৫০ নং)

সুতরাং সম্মুখের অকস্মাৎ এ মসীবত দেখে ভয় পেয়ো না। মসীবত সরে যাওয়া নিশ্চিত ব্যাপার। বিপদের যে ঘন মেঘ তোমার জীবনকে অন্ধকার করে রেখেছে তা অবশ্যই একদিন কোন হাওয়ার ঠেলায় সরে যাবে।

‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে,

হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে।

মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই দুঃখের পরেই আছে সুখ, নিশ্চয়ই কষ্ট্রের পরে আছে। স্বস্তি।” (সূরা ইনশিরাহ ৫-৬ আয়াত)। বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরিত নবী (সা.) বলেন, “ধৈর্যের সাথেই আছে বিজয়, বিপদের পাশেই আছে উদ্ধারের পথ এবং কষ্টের সাথেই আছে স্বস্তি।” (সহীহুল জামে’ ৬৮০৬ নং)

অতএব ভয় কিসের? ভয়কে জয় কর। কারণ, তুমি যেখানে একা কপালে হাত দিয়ে বসে আছ, সেখানে তুমি একা নও দয়াবান আল্লাহ যে তোমার সাথের সাথী।

আর মনে রেখো, নদীর এক কুল ভাঙ্গলে অপর কূল গড়ে। তোমার-আমার জীবনটাও সেইরূপ। জীবন যতক্ষণ আছে বিপদ ততক্ষণ থাকবেই। জীবনের সবটাই সুখময় কারো হয়। দুঃখ-কষ্ট নিয়েই মানুষের জীবন। কিন্তু দুঃখের পর সুখ আসবে এটাও ধ্রুব সত্য। দুঃখের ঘড়ি ধীরে চললেও সে সময় যে কেটে যাবে তা নিশ্চিত। যে হালে আছ, সে হালের পরিবর্তন অবশ্যই ঘটবে। ফিরে আসবে আবার নতুন জীবন, নতুন উদ্যম।

‘কোনদিনই হায় পোহাবে না যাহা এমন রাত্রি নাই। জীবনের সে আঁধার-ঘিরা রাত্রি যতই লম্বা হোক, যেমনই হোক, যত কষ্টেরই হোক, তার অন্ধকার ভেদ করে এক সময় প্রভাতের আলো উদ্ভাসিত হবেই তোমার হৃদয় আকাশে।

দুর্যোগ রাতি পোহায়ে আবার প্রভাত আসিবে ফিরে। বিপদগ্রস্ত বন্ধু আমার! নিরাশ হয়ে মুষড়ে পড়ে না। কপালে আঘাত করে লাভ নেই। মানুষের যখন সব কিছুই হারিয়ে যায়, ভবিষ্যত তখনও অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। জীবন-গাছের খাওয়া পাতা আবার সবুজ হয়ে নতুন করে গজিয়ে উঠবে। গাছ মুড়া গেলে আবার বীজ বোনো। পুনরায় চারা গজিয়ে উঠবে। যেখানে বাসনা-রথ, সেখানেই সিদ্ধির পথ। সাধ, সাধ্য আর সাধনা, তবেই সিদ্ধির বাসনা। মনের বাসনাকে হতাশার অন্ধকারে হারিয়ে দিও না। তোমার যে সাধ্য আছে, তার মাঝে সাধনা এনে তাতে সিদ্ধিলাভ কর।

তোমার সৃষ্টিকর্তা তোমার মত নিরাশ-বিহুল ভগ্ন-হৃদয়ের মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন, “যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে চলে, আল্লাহ তার উপায় বের করে দেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে র্যী দান করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা রাখে সে। ব্যক্তির জন্য তিনিই যথেষ্ট হন। আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করেন। আল্লাহ সমস্ত কিছুর জন্য নির্দিষ্ট মাত্রা স্থির করে রেখেছেন।” (সূরা ত্বালাক ২-৩) “যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।” (ঐ ৪ আয়াত)।

অতএব আল্লাহর বান্দা! ওঠ, কোমর শক্ত করে, মাথা উচু করে। যে মাটিতে পড়ে আছ, সে মাটিতেই ভর দিয়ে আবার উঠে দাঁড়াও। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করবেন না।

নিরাশ হিয়ার বন্ধু আমার। বর্তমানের এ ব্যর্থতা ও বিফলতা দেখে পিছপা হয়ো না। বিফলতা মানুষকে হতাশ ও নিরাশ করে ঠিকই, কিন্তু জেনে রেখো, যারা এ হতাশাকে। উল্লংঘন করে বিফলতাকে পরাভূত করেছে, তারাই তাকে ভিত্তি করে গড়ে তুলেছে সফলতা ও সৌভাগ্যের প্রাসাদ।

কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে,

দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?’

দুঃখ এলে পরোয়া নেই। বিরক্তি নেই। নৈরাশ্য নেই।

“যে মাটিতে পড়ে লোক ওঠে তাই ধরে

বারেক হতাশ হয়ে কে কোথায় মরে?

বিপদে পতিত, তবু ছাড়িব না হাল,

আজিকে বিফল হলে, হতে পারে কাল।

জীবনে পরাজয় আসার পর অলসভাবে বসে থাকা জ্ঞানীর কাজ নয়। যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে চেষ্টা করাই হল বুদ্ধিমানের কাজ। সবল মু’মিন সাতবার বিপদে পড়লেও আবার ওঠে। কিন্তু দুর্বল মনের অসৎ মানুষ একবার বিপদে পড়লেই আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ্য প্রকাশ করে; ফলে সে আর উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয় না।

দয়ার নবী ৪৯ বলেন, “মুমিনের উপমা হল গম গাছের মত; যে হাওয়ার চাপে কখনো নুয়ে পড়ে, আবার তখনই সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। পক্ষান্তরে মুনাফিক ও কাফেরের উপমা হল আরযা’ (Cedar) গাছের মত; যা হাওয়ার চাপের মুখেও সোজা খাড়া থাকে। কিন্তু (সামলাতে না পেরে) অবশেষে ভেঙ্গে শেষ হয়ে যায়।” (সহীহুল জামে ৫৮৪৪ নং)

পতন জীবনে আসতেই পারে। পতনকে যে ভয় করে, সে আসলে জীবনে জয়লাভ করতে পারে না। আবার পতন অনেক সময় মানুষের উপকারও করে। পতন মানুষের সফলতা আনে, প্রচ্ছন্ন সত্যকে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে, উদাসীন হৃদয়কে জাগ্রত করে তোলে। অতএব তোমার এ পতনে বড় মঙ্গল অবশ্যই আছে।

আর গরীব বা নিঃস্ব বলে দুঃখ করো না বন্ধু আমার! কারণ, আসল নিঃস্ব তো সেই, যে কিয়ামতে নিঃস্ব। তাছাড়া জেনে রেখো যে, গরীবরাই অধিকাংশ বেহেস্তে যাবে।

হ্যা, আর আত্মহত্যা করার কথা মনেও এনো না। আত্মহত্যা কেন করবে? হয়তো দুঃখের তাড়নায় এই ভাববে যে, মরণেই তোমার শান্তি আছে। মরতে পারলেই তোমার সকল দুঃখ

জ্বালা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু তার নিশ্চয়তা কোথায়? তুমি কি জান না, মরণের ওপারে তোমার জন্য কি অপেক্ষা করছে? কবরের পরীক্ষা এবং হয়তো বা আযাব ও আখেরাতের ভয়ংকর শাস্তি। তার জন্য তোমার প্রস্তুতি আছে কি? সে শাস্তি থেকে তুমি অব্যাহতি পাবে, তার নিশ্চয়তা আছে কি? যদি না থাকে তাহলে সে দুঃখ-জ্বালা যে এ দুঃখ-জ্বালা থেকে বহু গুণ তাছাড়া তুমি তো জানো যে, আত্মহত্যা মহাপাপ। মনের ধিক্কারে তুমি নিজেকে হত্যা করবে -এ অধিকার তোমার নেই। তুমি যেমন অপরকে খুন করতে পার না, তেমনিই পার

নিজেকে খুন করতে। তা তোমার নিজের জীবন হলেও সে তো সৃষ্টিকর্তারই আমানত। তাতে খেয়ানত করলে অবশ্যই অপরাধী সাব্যস্ত হবে তার নিকট। তাই তিনি মানুষকে আত্মহত্যা করতে নিষেধ করেছেন। (সূরা নিসা ২৯ আয়াত) নিষেধ করেছেন নিজেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে। (সুরা বাকারাহ ১৯৫ আয়াত)।

আর পরকালে এ কাজের শাস্তির কথা শোন। মহানবী ৪৬ বলেন, “যে ব্যক্তি কোন পাহাড় হতে নিজেকে ফেলে আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি জাহান্নামেও সর্বদা ও চিরকালের জন্য নিজেকে ফেলে অনুরূপ শাস্তিভোগ করবে। যে ব্যক্তি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি জাহান্নামেও সর্বদা চিরকালের জন্য বিষ পান করে যাতনা ভোগ করবে। আর যে ব্যক্তি কোন লৌহখন্ড (ছুরি ইত্যাদি) দ্বারা আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি জাহান্নামেও ঐ লৌহখন্ড দ্বারা সর্বদা ও চিরকালের জন্য নিজেকে আঘাত করে যাতনা ভোগ করতে থাকবে।” (বুখারী ৫৭ ৭৮, মুসলিম ১০৯নং প্রমুখ)

আল্লাহর রসূল (সা.) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি ফাসি নিয়ে আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি দোযখেও অনুরূপ ফাসি নিয়ে আযাব ভোগ করবে। আর যে ব্যক্তি বর্শা বা ছুরিকাঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি দোযখেও অনুরূপ বর্শা বা ছুরিকাঘাত দ্বারা (নিজে নিজে) আযাব ভোগ করবে।” (বুখারী ১৩৬৫নং)

অবশ্য পরকালের এ সব কথার উপর তোমার যদি বিশ্বাস না থাকে এবং এ বিশ্বাস না রেখেই তুমি আত্মহত্যা কর, তাহলে অবস্থা আরো ভয়ানক। কাফের হয়ে মারা গেলে কুফরীর শাস্তি তো তোমার অজানা নয়। তুমি মুসলিম। তোমার কর্মকাণ্ড হওয়া উচিত ইসলামের ভিত্তিতেই। কেন ক্ষতি করবে নিজের ইহ-পরকালের এবং তোমার ছেড়ে যাওয়া আব্বা-আম্মা বা ছেলে-মেয়েদের? পরিশেষে একটি কথা মনে রেখো যে, যে অবস্থাতেই থাক, হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে পড়ো । ছোট কাজ করলেও নিজেকে ছোট ও নীচ ভেবে বসো না এবং সেই সাথে নিজের চরিত্রকেও হীন করে ফেলো না। মাথা উচু করে নিজের উন্নতির কথা সর্বদা মনে রেখো। নীচ হয়ে থাকা এবং উন্নতির আশা-আকাঙ্খা না করা হীনতার পরিচয়। আল্লাহর দেওয়া রুযী পেয়ে সন্তুষ্ট থেকেই উন্নতি ও বর্কতের আশা কর। আর উন্নতির সোপান বেয়ে চড়তে হলে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে সে কথা ভুলে যেও না।

একদা এক কুকুর এসে এক সিংহকে বলল, 'হে পশুরাজ! আমি আমার নাম পরিবর্তন করতে চাই। দয়া করে আমার নামটা বদলে দিন। কারণ আমার নামটা বড় বিশ্রী ও অসভ্য।

সিংহ বলল, তুমি তো বিশ্বাসঘাতক ও নির্লজ্জ। তোমার আচরণ বড় হীন। অতএব এ নামই তোমার জন্য যথার্থ ও সার্থক।

কুকুর বলল, তাহলে আমাকে পরীক্ষা করে দেখে নিন, আমি সুন্দর নামের কাজ করতে পারি কি না। সিংহ কুকুরকে এক টুকরা গোশ্য দিয়ে বলল, 'ঠিক আছে। এটা আমার জন্য কাল পর্যন্ত তোমার কাছে যত্ন করে আমানত রেখে দাও। কাল আমি তোমার কাছ থেকে এটা নেব, আর তোমার নাম পাল্টে দিয়ে এক সুন্দর মত নাম রেখে আসব।' গোশ্য টুকরাটি নিয়ে কুকুর বাসায় ফিরল। ক্ষিদে লাগলে সে গোন্তের দিকে তাকিয়ে জিভের লাল ফেলতে শুরু করল। খাওয়ার ইচ্ছে হলেও নাম পাল্টাবার কথা মনে পড়লে ধৈর্যের সাথে সিংহের অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু যখনই তার প্রবৃত্তিতে লালসার উদ্রেক হল তখনই আর ধৈর্যের বালির বাঁধ আটকে রাখতে পারল না। অবশেষে ভালো নাম নিয়েই বা আর কি হবে? কুকর’ ও তো ভালো নাম।' -এই বলেই সে গো টুকরাটি খেয়েই ফেলল।

এরূপ উদাহরণ হল চরিত্রহীন নীচমনা মানুষদের; যারা স্বার্থের খাতিরে নিজেদের হীন আচরণ বর্জন করতে পারে না। অথবা লালসার ফলে নিজেদের প্রবৃত্তি দমন করতে পারে। এ শ্রেণীর মানুষকে অনেক সময় চা পান করতে বললে বলে, আমার জন্য চা খাওয়া নিষেধ। কারণ, আমার ডায়াবেটিস আছে। কিন্তু পরক্ষণে পাতে বড় বড় রসগোল্লা এলে তখন আর লোভ সামলাতে না পেরে বলে, 'দু-একবার মিষ্টি খেলে কিছু ক্ষতি হয় না। মোট কথা, মনকে ধরে রাখা সবল ও দৃঢ় মনোবলশালী ব্যক্তিত্বের পরিচয়। তোমাকে সেইরকম একটা শক্ত মনের মানুষ হওয়ার কথাই বলছি। উচু দরের মানুষ হতে হলে উচু দরের খেয়াল হতে হবে, উঁচু আশা ও মনোবল রাখতে হবে। যেমন উঁচু দরের মানুষ হয়ে নীচ মনের পরিচয় দেওয়াও বর্জন করতে হবে। জাতে গোয়াল হয়ে কঁজি ভক্ষণ’ স্বভাব অবশ্যই জাত মানুষের নয়।

উঁচু হিম্মতের মন হল, উচু আকাশে উড়ন্ত পাখীর মত। যে পাখী অন্যান্য পাখীর মত নীচুতে উড়তে রাজী নয়। যে পাখীর নিকট সেই বিপদ-আপদ পৌছে না যা নীচে উড়ন্ত পাখীর নিকটে পৌছে থাকে। তাই হিম্মত যত উঁচু হবে মন তত আপদমুক্ত হবে। আর হিম্মত যত নীচু হবে মনও তত আপদগ্রস্ত হবে। সুতরাং উচু হিম্মত মানুষের সফলতার শিরোনাম। পক্ষান্তরে নীচু হিম্মত তার বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার নিদর্শন।

হে মুসলিম যুবক! তুমি তোমার আচরণ, ব্যবহার, চরিত্র, শিক্ষা, অধ্যবসায়, অর্থোপার্জন ও দ্বীনদারীতে উচু হিম্মত, সংকল্পবদ্ধ মন এবং উন্নত ও উদ্যমশীল হৃদয়ের অধিকারী হও -এই কামনা করি।

যুবক এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও প্রগতি - ১

বহু যুবকের ধারণা এই যে, ইসলাম মানেই হচ্ছে পরাধীনতার জীবন। অর্থাৎ, মুসলিমের জীবনে কোন প্রকার স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য নেই। ইসলাম শক্তি ও প্রগতির বিরোধী। এর ফলে তারা ইসলাম থেকে দূরে সরতে থাকে এবং তার নামে অবজ্ঞায় নাক সিঁটকায়। মনে করে ইসলাম এক পশ্চাদগামী ধর্ম। যে তার অবলম্বীদের হাত ধরে পশ্চাৎ ও অবনতির দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে উন্নতি, প্রগতি ও অগ্রগতির পথে বাধা দান করে।

এটি একটি নিছক সন্দেহ ও ভ্রান্ত ধারণা মাত্র এবং ইসলাম-প্রিয় যুবকদের জন্য একটি সমস্যা। এই সমস্যার সমাধানকল্পে ঐ ভ্রষ্ট যুবকদের সম্মুখে ইসলামের প্রকৃত রূপ প্রকাশ হওয়া এবং তার প্রতি আরোপিত অপবাদের আবরণমুক্ত হওয়া উচিত; যারা তাদের ভ্রান্ত ধারণা অথবা স্বল্প জ্ঞান মতে অথবা উভয় মতে ইসলামের আসল চিত্র সম্বন্ধে অজ্ঞাত। আর জানা কথা যে, পীড়া-জনিত কারণে যার মুখ তিক্ত হয়ে আছে তাকে ঐ মুখে সুমিষ্ট পানিও তেঁতো লাগবে। যেমন জলাতঙ্ক রোগের রোগী স্বচ্ছ পানিতেও কুকুর দেখে থাকে।

বাস্তব এই যে, ইসলাম মানুষকে পার্থিব জীবনের সুখ লুটতে বাধা দেয় না। মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে না। অবশ্য জীবনের সীমারেখা নির্ধারিত করে। মানুষের পায়ের বেড়ি দিয়ে পথ চলতে বাধা সৃষ্টি করে না। বরং চলার পথ নির্ধারিত, নির্দিষ্ট ও সীমিত করে। সৎপথে চলতে নির্দেশ দেয় এবং অসৎ পথে চলতে বাধা দান করে। আর এ কথা ধ্রুব সত্য যে, যে পথে সুখ উপভোগ করতে ইসলাম বাধা দেয়, সে পথে আপাতঃদৃষ্টিতে মানুষের সাময়িক সুখ থাকলেও, আসলে কিন্তু সুখ নেই অথবা সে সুখের পর দুঃখ আছে। পক্ষান্তরে ইসলামের নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত পথে আছে পরম ও চরম সুখ এবং তার পরে কোন দুঃখ নেই।

ইসলাম মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতা খর্ব করে না। ইসলাম কোন পরাধীন জীবন অতিবাহিত করতে আহ্বান করে না। অবশ্য স্বেচ্ছাচারিতায় বাধা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যপূর্ণ সুশৃঙ্খলময় জীবন গড়তে আদেশ করে। সকল প্রকার স্বাধীনতাকে সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খলাবদ্ধ করে। স্বাধীনতা যাতে স্বৈরাচারিতা ও উজ্জ্বলতায় বদলে না যায় তার বিশেষ নির্দেশনা দান করে। যাতে সীমা ও শৃঙ্খলহীন স্বাধীনতার জীবনে এক ব্যক্তির স্বাধীনতা অপর ব্যক্তির স্বাধীনতার সাথে সংঘর্ষ না বাধায়। কারণ, যে ব্যক্তি সীমাহীন সর্বপ্রকার স্বাধীনতা চাইবে, নিশ্চয় সে ব্যক্তি অন্যের স্বাধীনতা হরণ ও খর্ব করবে। যেহেতু, তাছাড়া পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ সম্ভবই নয়। পরন্তু তা লাভ করতেই হলে সমগ্র স্বাধীনতার মাঝে সংঘাত সৃষ্টি হবে এবং তারপরই সৃষ্টি হবে নানা বিঘ্ন ও বিশৃঙ্খলা।

অতএব ইসলাম চায়, মানুষের জীবনকে শৃঙ্খলা ও সীমাবদ্ধ করতে। তাই তো মহান আল্লাহ দ্বীনী হুকুম-আহকামকে ‘হুদূদ’ বা সীমারেখা বলে অভিহিত করেছেন। কাজ হারাম হলে বলা হয়েছে, “এগুলি আল্লাহর সীমারেখা, সুতরাং এর ধারে-কাছে যেও না।” (সূরা বাকারাহ ১৮৭ আয়াত) আর ওয়াজেব হলে বলা হয়েছে, “এগুলি আল্লাহর সীমারেখা, অতএব তা তোমরা লংঘন করো না।” (ঐ ২২৯ আয়াত)। বলাই বাহুল্য যে, কিছু লোকের ঐ কল্পিত পরাধীনতা এবং ইসলামের নির্দেশাবলী ও সুশৃঙ্খলতা; যা প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ সৃষ্টিকর্তা তার বান্দাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন উভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে।

অতএব যুবকের মনে এ ধরনের কোন সমস্যা প্রকৃতপক্ষে কোন সমস্যাই নয়। যেহেতু শৃঙ্খলা ও নিয়মধারার অনুবর্তী হয়ে চলা এ বিশ্বের সর্বক্ষেত্রে নিত্য-ঘটিত, স্বাভাবিক ও বাঞ্ছিত ব্যাপার। মানুষও প্রকৃতিগতভাবে এই নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীনস্থ। তাই তো সে ক্ষুৎপিপাসার বশবর্তী এবং পান-ভোজনের মুখাপেক্ষী। নিয়মিত ও পরিমিত পরিমাণে উপযুক্ত গুণসম্পন্ন পানাহার করতে বাধ্য থাকে। যাতে সে নিজের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা করতে পারে। কিন্তু স্বেচ্ছামত চললে অসুস্থতা ও বিভিন্ন ব্যাধির জন্ম হয়। যেমন মানুষ সামাজিক রীতি-নিয়মের অনুবর্তী, স্বদেশী চাল-চলন, আবাস-লেবাস প্রভৃতির অনুরক্ত। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়তের ব্যাপারে পাশপোর্ট-ভিসার নিয়ম, স্বদেশী আইন-কানুন, ট্রাফিক-কানুন প্রভৃতির অনুগত। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা চালালে সমাজে ঘূণ্য হতে হয়, আইন-লংঘনের প্রতিফল ভোগ করতে হয়। পথিমধ্যে বিপদগ্রস্ত হতে হয়।

সুতরাং বিশ্ব-সংসারই নির্ধারিত সীমারেখা ও নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন। আর এর ফলেই বাঞ্ছিত মতে সকলের জীবন ও কাজকর্ম চলে। অতএব সামাজিক কল্যাণ লাভ করতে এবং বিশৃঙ্খলা ও বিঘ্ন দুর করতে সকল মানুষের জন্য মানব-রচিত সামাজিক রীতি-নীতির বাধ্য থাকা যদি জরুরী হয়, তাহলে অনুরূপভাবে উম্মাহর কল্যাণের জন্য এবং সার্বিক মঙ্গল আনয়নের জন্য সকল মানুষের পক্ষে স্রষ্টার প্রেরিত শরীয়তের বিধি-বিধান ও নিয়ম-নীতির অনুবর্তী হওয়া একান্ত জরুরী। তবে কেন ও কি ভেবে কিছু মানুষ এ শাশ্বত নিয়ম-শৃঙ্খলাকে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করে এবং তা মানুষের জন্য পরাধীনতা বলে মনে করে? নিশ্চয় তা প্রকাশ্য অপবাদ এবং ভ্রান্ত ও পাপময় ধারণা ছাড়া কিছু নয়। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব, ইবনে উসাইমীন ২০-২২পৃঃ)

এ জগতে একমাত্র পাগলেরই আছে পূর্ণ স্বাধীনতা, সেই কেবল যাচ্ছে তাই করে বেড়াতে পারে। অবশ্য সে স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক সময় গলা-ধাক্কাও খেয়ে থাকে। প্রকৃত প্রস্তাবে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা এ পৃথিবীর কারো নেই। প্রত্যেকে কোন না কোন নিয়মের পরাধীন অবশ্যই থাকে। তা না হলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। প্রত্যেক জিনিসের পশ্চাতে একটা না একটা বাধন আছে, নিয়ন্ত্রণ জোড়া আছে। নচেৎ, বিপদ অনিবার্য। আগুন, পানি, বাতাস, খাদ্য, যাই বল না কেন, সবকিছুর ব্যবহার বিধি নিয়ন্ত্রিত। ঘোড়ার লাগাম না থাকলে বা গাড়ির ব্রেক না থাকলে ঘোড়া বা গাড়ি কি ঠিক মত ঈপ্সিত পথে চলে থাকে, না কেউ চালাতে পারে? মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা-গবেষণাও অনুরূপ নিয়ন্ত্রিত। ষড়রিপুর নাকেও দড়ি দেওয়া আছে। তা না হলে পৃথিবীতে কেউ শান্তিতে বাস করতে পেত না। মানুষ। মানুষরূপে বাস করতে পারত না; বরং পশুর চাইতেও অধম হয়ে নিজ নিজ স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে আপোসে লড়ে ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব প্রত্যেক বস্তুর নিয়ন্ত্রিত দিকটাই ভালো। শৃঙ্খলিত সবকিছুই মানুষের ঈপ্সিত।

উদ্ধৃঙ্খলতা সভ্য সমাজ পছন্দ করতে পারে না। কেউ চায় না নিয়ন্ত্রণহারা পানি বা বন্যার অদম্য গতি। কেউ চায় না আগুন তার রান্নাঘর থেকে আয়ত্তের বাইরে চলে যাক।

কলেজ থেকে ফিরার পথে বেসামাল ড্রেসে চামেলী বাসায় ফিরছিল। এমন বেসামাল পোশাকে আবেদনময়ী ভঙ্গিমায় চলাতে তার স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এক দল যুবক তার সে মস্তানা চলন দেখে তার উপর হামলা করে তার রাঙা যৌবন লুটে নিল। ধর্ষিতা ও খুন হল চামেলী দুর্ধর্ষ যুবকদলের হাতে। অবশ্য যুবকদলেরও এতে স্বাধীনতা ছিল। অন্যায়ভাবে অবৈধ উপায়ে অর্থ সঞ্চয় করাতে তোমার-আমার স্বাধীনতা আছে। তেমনি ডাকাতেরও স্বাধীনতা আছে ডাকাতি করার। চোরেরও স্বাধীনতা আছে বিনা বাধায় চুরি করার। গাড়িওয়ালার স্বাধীনতা আছে, সে যেদিকে খুশী সেদিকে চালাতে পারে। যখন ইচ্ছা তখন বায়ে অথবা ডাইনে সাইড নিতে পারে। এতে কার কি বলার থাকতে পারে? স্বামীর স্বাধীনতা আছে ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ রাখার, তেমনি স্ত্রীরও স্বাধীনতা আছে বয় ফ্রেন্ড’ ব্যবহার করার। কোন কোন রাত্রি যদি স্ত্রী বাসায় বাস না করে তার সে বন্ধুর বাসায় বাস করে, তবে তাতে স্বামীর প্রতিবাদের কি আছে? আশা করি এমন স্বাধীনতাকে কোন জ্ঞানী মানুষই বিশ্বাস ও সমর্থন করবে না। যে স্বাধীনতা অপরের স্বাধীনতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, সে স্বাধীনতা হল স্বেচ্ছাচারিতা ও মহা অপরাধ। সংঘর্ষহীন বগাধীন স্বাধীনতা শান্তিকামী মনুষ্য সমাজের অভিপ্রেত বস্তু।

অতএব বাক-স্বাধীনতার অর্থ যা ইচ্ছে তাই বলা নয়, তারও নিয়ন্ত্রণ-সীমা আছে। ন্যায়অন্যায়ের মানদন্ড আছে।

ব্যক্তি-স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এতেও ন্যায়-অন্যায়, পরোপকার, অপরের লাভ-ক্ষতি ও স্বাধীনতার কথাও খেয়াল রাখা জরুরী। মতামতের স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যে যা ইচ্ছা তাই মন্তব্য করবে। বিনা দলীলে যা মন তাই মনগড়া মত প্রকাশ করবে এবং ন্যায়কে অন্যায় বা তার বিপরীত প্রমাণ করার জন্য বিষাক্ত কলম ব্যবহার করবে।

এ বিশ্ব আল্লাহর। তিনিই বিশেষ অনুগ্রহে আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আমরা তারই আজ্ঞাবহ দাস। অতএব প্রভুর কাছে দাসের স্বাধীনতা আবার কি? সকল ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ। মানুষের হাতে আর কতটুক ক্ষমতা আছে? আর পূর্ণ ক্ষমতা না থাকলে কি স্বাধীন হওয়া যায়?

পরিশেষে এ বিষয়ে একটি মূল্যবান উপদেশ শোন। একদা এক ব্যক্তি ইবরাহীম বিন আদহাম (রঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আবু ইসহাক? আমি বড় গোনাহগার। অতএব আমাকে কিছু নসীহত করুন; যাতে আমি গোনাহ থেকে বিরত হতে পারি।

আবু ইসহাক (ইবরাহীম) বললেন, 'যদি তুমি পঁাচটি উপদেশ গ্রহণ কর এবং তদনুযায়ী আমল কর, তাহলে গোনাহ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। লোকটি বলল, বলুন। ইবরাহীম বললেন, 'প্রথম এই যে, আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করলে তুমি তার রুযী খেয়ো না।' লোকটি বলল, তাহলে খাব কি? দুনিয়াতে সবকিছুই তো তারই দেওয়া রুযী! বললেন, 'ওহে আল্লাহর বান্দা! তুমি তার রুযী খাবে, অথচ তার অবাধ্যাচরণ করবে। এটা কি তোমার বিবেকে ভালো মনে হবে। বলল, 'অবশ্যই না। দ্বিতীয় কি বলুন। বললেন, 'যদি তুমি তার অবাধ্যাচরণ করতেই চাও তাহলে খবরদার তাঁর রাজত্বে বাস করো না।” বলল, এটা তো বিরাট মুশকিল। তাহলে বাস করব কোথায়? বললেন, 'ওহে আল্লাহর বান্দা! তুমি তার রুযী খাবে, তাঁর রাজত্বে বাস করবে, অথচ তার নাফরমানী করবে, এটা কি তোমার উচিত হবে?” বলল, অবশ্যই না। তৃতীয় কি বলুন। বললেন, 'তার রুযী খেয়ে তাঁর রাজত্বে বাস করেও যদি তার নাফরমানী করতে চাও, তাহলে এমন জায়গায় করো, যেখানে তিনি তোমাকে দেখতে পাবেন না।'

বলল, হে ইবরাহীম! তা কি করে সম্ভব? তিনি তো আমাদের মনের গোপন খবরও জানেন! বললেন, তাহলে তার রযী খেয়ে, তাঁর রাজত্বে বসবাস করে, তার দৃষ্টির সামনে তুমি তার অবাধ্যাচরণ করবে এবং তার জ্ঞানায়ত্তে থেকেও পাপাচরণ করবে, এতে কি তোমার লজ্জা হবে না? বলল, 'অবশ্যই। চতুর্থ কি বলুন। বললেন, 'মালাকুল মওত যখন তোমার জান কবজ করতে আসবেন, তখন তাঁকে তুমি বলো যে, (আমি স্বাধীন। আমি মরব না অথবা) আমাকে আর ক'টা দিন সময় দিন যাতে আমি খালেস তওবা করে নিয়ে ভালো কাজ করে নিতে পারি। বলল, তিনি তো আমার এ অনুরোধ মেনে নেবেন না। বললেন, 'ওহে আল্লাহর বান্দা! তাহলে তওবা করার জন্য যদি তুমি মরণকে বাধা দিতে পার, আর তুমি জান যে, মৃত্যু এসে গেলে আর ক্ষণকালও দেরী করা হবে না, তাহলে। মুক্তির আশা কিরূপে করতে পার? বলল, 'পঞ্চমটা বলুন। বললেন, কিয়ামতের দিন দোযখের প্রহরিগণ যখন তোমাকে দোযখে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসে উপস্থিত হবেন, তখন তুমি তাদের সাথে যেও না। বলল, তারা তো আমাকে ছেড়ে দেবেন না। আমার সে আবেদন তারা মানবেন না। বললেন, তাহলে নাজাতের আশা কেমন করে করতে পার? বলল, হে ইবরাহীম! যথেষ্ট, যথেষ্ট। আমি এক্ষনি আল্লাহর নিকট তওবা করছি এবং কৃতপাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

হ্যাঁ, মানুষ সর্ববিষয়ে স্বাধীন নয়। মানুষ তো দাস। মহান স্রষ্টা আল্লাহর দাস। আর এ দাসত্বে আছে তার পরম আনন্দ। এ পরাধীনতায় আছে প্রেমের সুমধুর স্বাদ। প্রেম তো পরাধীনতারই এক নাম। তদনুরূপ ইসলাম প্রগতি ও বিজ্ঞান বিরোধী নয়। বরং ইসলাম সভ্যতা, সংস্কৃতি, চিন্তা, জ্ঞান, গবেষণা, সুস্বাস্থ্য প্রভৃতি সার্বিক প্রগতি ও শক্তির প্রশস্ত ময়দান।

ইসলাম মানুষকে চিন্তা ও গবেষণা করতে আহ্বান করে। যাতে সে উপদেশ গ্রহণ করে ভালো-মন্দ নির্ণয় করতে পারে এবং নিজ জ্ঞানের পরিসর বৃদ্ধি করতে পারে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, “বল, আমি তোমাদেরকে একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি; তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু’জন করে অথবা একা একা দাড়াও, অতঃপর চিন্তা কর-------।” (কুঃ ৩৪/৪৬) “বল, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার প্রতি লক্ষ্য কর----” (কুঃ ১০/১০১)। চিন্তা ও গবেষণা করার প্রতি মানুষকে আহ্বান করেই ইসলাম ক্ষান্ত নয়। বরং যারা জ্ঞানগবেষণা ও চিন্তা করে না তাদের প্রতি আক্ষেপ ও নিন্দাবাদ করে।

মহান আল্লাহ বলেন, “তারা কি লক্ষ্য (গবেষণা) করে না আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের প্রতি এবং আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি----।” (কুঃ ৭/ ১৮৫) “ওরা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না (চিন্তা করে না) যে, আল্লাহ আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও ওদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু যথাযথভাবেই সৃষ্টি করেছেন।” (কুঃ ৩০/৮) “আমি যাকে দীর্ঘ জীবন দান করি তাকে তো জরাগ্রস্ত করে দিই, তবুও কি ওরা জ্ঞান করে না?” (কুঃ ৬/৬৮)।

ইসলামের এই চিন্তা ও জ্ঞান-গবেষণা করতে আদেশ দেওয়ার অর্থই হল, জ্ঞান ও চিন্তাশক্তির দ্বার উন্মুক্ত করা। অতএব তারা কি করে বলে যে, ইসলামে বিভিন্ন শক্তির অবক্ষয় ঘটে। তাদের মুখ-নিঃসৃত বাক্য কি উদ্ভট! তারা কেবল মিথ্যাই বলে।”

ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য তাদের ঈমান, জান, মান, জ্ঞান ও ধনের পক্ষে অহিতকর বা ক্ষতিকর নয় এমন সকল প্রকার সম্ভোগকে বৈধ করেছে। তাই সমস্ত উত্তম ও উপাদেয় খাদ্য-পানীয়কে হালাল করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা থেকে পবিত্র বস্তু আহার কর এবং আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর----” (কুঃ ২/১৭২) “---এবং তোমরা পানাহার কর, আর অপচয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।” (কুঃ ৭৭/৩১) প্রজ্ঞা ও প্রকৃতি অনুসারে সমস্ত পরিচ্ছদ ও সৌন্দর্যকে বৈধ করেছেন। তিনি বলেন, “হে আদম সন্তান দল! তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদের উপর পরিচ্ছদ অবতীর্ণ করেছি। আর তাকওয়া’ (সংযমতা)র পরিচ্ছদই সর্বোৎকৃষ্ট।” (কুঃ ৭/২৬) “বল, বান্দাদের জন্য আল্লাহর সৃষ্ট সৌন্দর্য এবং উত্তম জীবিকা কে হারাম (নিষিদ্ধ) করেছে? বল, পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে এ সমস্ত তাদের জন্য, যারা ঈমান এনেছে।” (কুঃ ৭/৩২) আর মহানবী ৪ বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। তিনি তার দেওয়া নেয়ামতের চিহ্ন বান্দার দেহে দেখা যাক, তা পছন্দ করেন।” (সহীহুল জামে ১৭৪২ নং)

বিধিসম্মত বিবাহ-বন্ধনের মাধ্যমে তিনি যৌন-সভোগও বৈধ করেছেন। তিনি বলেন, “--তবে বিবাহ কর (স্বাধীনা) নারীদের মধ্য হতে যাকে তোমাদের ভালো লাগে; দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশঙ্কা কর যে, (তাদের মধ্যে) সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে----” (কুঃ ৪/৩)।

ব্যবসা ও অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম তার অনুসারীদের অগ্রগতিকে গতিহীন করতে চায়নি। বরং তাদের জন্য সর্বপ্রকার অনুমতিপ্রাপ্ত হালাল ও ইনসাফপূর্ণ বাণিজ্য ও

অর্থোপার্জনকে বৈধ ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, “---অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে অবৈধ করেছেন।” (কঃ২/২৭৫) “তিনি তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে। দিয়েছেন, অতএব তোমরা দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার প্রদত্ত জীবনোপকরণ হতে আহার্য গ্রহণ কর, আর তারই প্রতি (সকলের) পুনরুত্থান।” (কুঃ ৬৭/১৫) “অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর----” (কুঃ ৬২/১০)। সুতরাং এর পরেও কি কিছু মানুষের এই ধারণা রাখা সঠিক যে, ইসলাম শক্তি অর্জন, প্রগতি ও উন্নয়নের পথে বাধা দেয়? (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব ২২-২৫পৃঃ)।

আজ বহু যুবকের মনে এ প্রশ্ন বারংবার উকি মারে যে, মুসলিম শ্রেষ্ঠ জাতি হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা সর্ববিষয়ে উন্নত নয় কেন? কেন পার্থিব ধন-সম্পদ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথে তারা বহু পিছিয়ে রয়েছে?

প্রথমতঃ আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, জাতির হাতে যে অর্থভান্ডার কম আছে তা নয়। আর্থিক দিক দিয়ে এ জাতি পিছিয়ে নেই। অবশ্য অর্থ যথার্থভাবে ব্যয় করার পথে এরা পিছিয়ে আছে। অর্থ যাদের হাতে আছে তারা জাতির উন্নয়নের কাজে তা যথাযথ ব্যয় করার পরিবর্তে নিজেদের বিলাস-ব্যসনে অধিক ব্যয় করেছে। বিভিন্ন স্মৃতি-বিজড়িত বিলাস-ভবন নির্মাণ করেছে, কিন্তু কোন উন্নয়নমুলক জ্ঞান-ভবন নির্মাণ করেনি। যারা করেছে তারা যথেষ্ট আকারে তা করেনি। প্রয়োজনের তুলনায় সে ব্যয় ছিল নেহাতই কম। তাছাড়া মুসলিম দুনিয়া হারিয়েছে বহু শাসকের দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে অধিক মত্ত হওয়ার ফলে। নিজেদের অবজ্ঞা ও অবহেলাবশে, গৃহযুদ্ধ ও আত্মকলহের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ার কারণে শুধু দুনিয়াই নয়; বরং অমূল্য ধন দ্বীনও হারিয়েছে। কত তাতার, কত হালাকু, কত চেঙ্গিজ এসে এ জাতির বুকে অত্যাচারের রুলার চালিয়েছে। কত শত জ্ঞান-বিজ্ঞানের অমূল্য ভান্ডার ভাসিয়ে দিয়েছে দিজলা নদীর পানিতে। জাতির অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করে দিয়ে কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে মুসলিমদের। শাসকদল অবহেলা ও ঔদাস্যের শিকার হয়ে নিজেদের রাজ্য তুলে দিয়েছে অত্যাচারী ও আগ্রাসী ঔপনিবেশিকদের হাতে। মুসলিম ধীরে-ধীরে। শিকার হয়ে পড়েছে হীনম্মন্যতার। পক্ষান্তরে সরে পড়েছে নিজ জীবন-ব্যবস্থা থেকে বহু দূরে।

অন্যান্য জাতি অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের কোন তমীজ করেনি; বরং তারা হালাল-হারাম তো চেনেই না। তারা শোষণ ও জুলুমবাজির কোন বাধাই মানেনি। বিশেষতঃ সুদী-কারবারের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করে দুনিয়া নিজেদের মনমত গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু মুসলিম তা পারেনি; আর পারেও না তা করতে।

পারে না সুদী কোন কারবার বা ব্যাংক চালাতে।

পারে না বর্তমানের অর্থনৈতিক সবচেয়ে সহজ উপায় হিসাবে ব্যাংকের সুদ নিতে।

পারে না কোন সুদী ব্যাংকে চাকুরী করতে।

পারে না কোন মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করতে।

পারে না কোন মদ্যশালা চালাতে।

পারে না কোন ফিল্ম-ইন্ডাষ্ট্রী চালাতে।

পারে না কোন সিনেমা হল চালাতে।

পারে না কোন নৃত্যশালা চালাতে।

পারে না কোন যাত্রা, থিয়েটার ও নাট্য-কোম্পানী চালাতে।

পারে না কোন গানবাদ্যের অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে।

পারে না কোন বেশ্যাখানার মালিক হতে।

পারে না কোন ফিল্ম ও গান-বাজনার যন্ত্র বা ক্যাসেট-ব্যবসা করতে।

পারে না কোন সেলুন খুলে দাড়ি উঁছতে।

পারে না ভেজাল দিয়ে কোন দ্রব্য বিক্রয় করতে।

পারে না শরীয়তে নিষিদ্ধ কোন প্রকার ব্যবসা করতে।

পরন্তু হালাল পথ বেছে নিয়ে জাগতিক উন্নয়ন সাধনের সংগ্রামও তারা করেনি। তাদের। জীবন-সংবিধানের প্রদর্শিত পথে চলতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারা ভুলে বসেছে যে, “যে কেউ দুনিয়ার কল্যাণ কামনা করবে, তার জেনে রাখা প্রয়োজন যে, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ আল্লাহরই নিকট রয়েছে।” (সূরা নিসা ১৩৪) তারা জানে না যে, “যারা মু'মিনদেরকে বর্জন করে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নেয়, তারা কি তাদের কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে? যাবতীয় সম্মান তো শুধুমাত্র আল্লাহরই।” (ঐ ১৩৯ আয়াত) “কেউ মান-সম্মান চাইলে সে জেনে রাখুক যে, সকল প্রকার সম্মান আল্লাহরই জন্য।” (সূরা ফাত্বির ৩৫) “ঈমান এনে পুরুষ বা নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করে, তাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করে থাকি এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করি।” (সূরা নাহল ৯৭ আয়াত) মান-সম্মান, উন্নয়ন-প্রগতি এবং যাবতীয় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর বিধান ছেড়ে অন্যের কাছে সম্মান ও উন্নয়ন খুঁজতে গিয়ে মুসলিম আজ যথাসর্বস্ব হারিয়ে বসেছে। হযরত উমার : বলেছেন, 'আমরা সেই জাতি, যে জাতিকে আল্লাহ ইসলাম দিয়ে সুসম্মানিত করেছেন। কিন্তু যখনই আমরা ইসলাম ছেড়ে অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্মান অন্বেষণ করব, তখনই তিনি আমাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।

যুবক এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও প্রগতি - ২

সকালের শুভ্র জ্যোতি তো অপেক্ষা করছিল মুসলিমদের জন্য তাদের অলক্ষ্যে। কিন্তু মুসলিম ছিল বিভোর নিদ্রায় বেহুশ। চক্ষু মুদে পড়ে ছিল এবং আজও সেই অবস্থাতেই আছে। আর “আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে।” (সূরা রা’দ ১০) পক্ষান্তরে ধনবত্তা ও পার্থিব উন্নয়ন মানুষের জন্য বাঞ্ছিত মর্যাদা নয়। তা যদি হত তাহলে আম্বিয়াগণই এ জগতে সবার চেয়ে বেশী ধনবানরূপে খ্যাত হতেন। কিন্তু পার্থিব জীবন হল ক্ষণস্থায়ী। এ পৃথিবী আমাদের আসল ঠিকানা নয়, এ ঘর-বাড়ি আমাদের আসল ঘর-বাড়ি নয়। আসল ঠিকানা ও ঘর-বাড়ি হল পরকাল। আর ইহকাল হল পরকালের ক্ষেতস্বরূপ। এই ক্ষেতে আমাদেরকে তৈরী করতে হবে আখেরাতের সুখময় জীবনের ফসল। পার্থিব সম্পদ বেশী পেলাম চাহে কম, অথবা না-ই পেলাম তাতে মুসলিমের দুঃখ হওয়া উচিত নয়। কাফেরদের বিভব ও ঐশ্বর্য দেখে নিজেকে হেয় মনে করা উচিত নয়। উচিত হল, পরকালের জীবন ধ্বংস হলে দুঃখ ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়া। কারণ, আসল ক্ষতি হল এটাই। আল্লাহ তাআলা বলেন, “বল (হে নবী!) তারাই হল আসল ক্ষতিগ্রস্ত, যারা কিয়ামতের দিন নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্তরূপে পাবে এবং পরিবারবর্গ হারাবে। আর জেনে রেখো, এটাই হল সুস্পষ্ট ক্ষতি। তাদের জন্য উপর দিক থেকে এবং নীচের দিক থেকে আগুনের মেঘমালা। থাকবে।” (সূরা যুমার ১৫- ১৬ আয়াত)

কোন এক ওস্তায তার হালকার ছাত্রদের মাঝে কিছু বই বিতরণ করলেন। কিছু বই ছিল বড় ও মোটা আকৃতির। কিছু ছিল মাঝারি এবং কিছু পাতলা আকৃতির ছোট বই। ছাত্রদের মধ্যে যারা মোটা বই পেয়েছিল তারা বড় আনন্দিত ও গর্বিত হল। যারা ছোট বই পেয়েছিল। তাদের ঐ সামান্য ক’ পাতার বই দেখে মনঃক্ষুন্ন ও দুঃখিত হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। তারা কামনা করেছিল, যদি তারাও ওদের মত মোটা ও দামী বই পেত, তাহলে তারাও ধন্য হত। কিন্তু কিছুদিন পর ওস্তায় যখন ঘোষণা করলেন যে, তিনি যে বই সকলকে বিতরণ করেছেন, সেই বই থেকেই প্রত্যেকের কাছ থেকে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এই ঘোষণা শোনার পর যারা ছোট বই পেয়েছিল তারা নিতান্ত খুশী হল। কারণ, ক’ পাতা পড়ে পরীক্ষা দেওয়া ছিল খুবই সহজ। আর যারা মোটা বই পেয়ে মনে মনে গর্বিত ছিল তারাই হল ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ, এত মোটা বই পড়ে পরীক্ষা দেওয়াটা মোটেই সহজ ছিল না। পরন্তু তাতে ফেল হওয়ার আশঙ্কাই ছিল অধিক। বলা বাহুল্য, মুসলিমের পার্থিব এ স্বল্প সম্পদ হল পরীক্ষার বস্তু। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো পরীক্ষার বস্তু এবং আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য মহাপুরস্কার আছে।” (সূরা তাগাবুন ১৫)

সুতরাং পরীক্ষার এ ধন কম পেয়ে মুসলিমের দুঃখ হওয়া উচিত নয়; বরং খুশী হওয়াই উচিত।

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, “ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য, আর সৎকর্ম -যার ফল স্থায়ী- তা তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশা-আকাঙ্খার ব্যাপারেও উৎকৃষ্ট।” (সূরা কাহফ ৪৬) “কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ পরকালই হল উৎকৃষ্টতর এবং চিরস্থায়ী।” (সূরা আল ১৬-১৭)

এ জন্যই অস্থায়ী পৃথিবীর বিলাসময় জীবনের বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করা মুসলিমের জন্য মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় ও ফরয হল তার সেই জ্ঞান শিক্ষা করা, যদ্বারা পরকালে চিরসুখ লাভ হয় এবং যা না শিখলে চিরদিন (মরণের পর) কষ্ট ভোগ করতে হয়।

যেখানে যতদিন বাস করতে হবে সেখানকার জন্য ঠিক ততদিনকার মত প্রস্তুতি ও সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ করে নেওয়া জ্ঞানীর কর্তব্য। আমার আসল দেশ ভারত। সউদী আরবে আমি ভাড়ার ফ্লাটে বাস করি। এখানে ক্ষণস্থায়ী চাকুরী করি। আজ আছি, কাল নেই। আমি যে বেতন পাই তার অর্থ দ্বারা সউদিয়ার ঐ ফ্লাটকে অধিক সুসজ্জিত করব, নাকি আমার মাতৃভূমি ও স্থায়ী ঠিকানা ভারতের বাসাকে আমরণ বাস করার জন্য সেই অর্থ ব্যয় করে সুনির্মিত করব? জ্ঞানীরা নিশ্চয়ই পরামর্শ দেবেন যে, যে বাড়িতে আপনি ক্ষণকালের জন্য আছেন, সে বাড়িকে সাজিয়ে আপনার পয়সা খরচ করবেন কেন? এখানে তো আর নাগরিকতা পাবেন না। যে দেশের আপনি নাগরিক, সে দেশেই বরং একটা সুন্দর দেখে বাসা তৈরী করে ফেলুন। সেখানে আপনি মরার পরেও আপনার ছেলেরা বাস করতে পারবে। দুনিয়া আমাদের আসল ঠিকানা নয়, পার্থিব সুখ আসল সুখ নয়, জাগতিক উন্নতি প্রকৃত

উন্নতি নয় এবং দুনিয়ার মায়ার সাগরে ডুবে যাওয়া ভালো নয় বলেই সেই ব্যক্তি অধিক সফলকাম, যে দুনিয়াদার নয়। “যে মানুষ দুনিয়াকে ভালোবাসতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার প্রতি সদয় হয়ে তাকে দুনিয়াদারী থেকে ঠিক সেইরূপ বাঁচিয়ে নেন; যেরূপ রোগী ব্যক্তিকে ক্ষতিকর পানাহার থেকে সাবধানে রাখা হয়।” (আহমদ, হাকেম, সহীহুল জামে' ১৮১৪নং)

আর সে জন্যই মুমিন বান্দার জন্য আল্লাহর রসূল সঃ এর খাস দুআ ছিল, “হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি তোমার প্রতি ঈমান এনেছে এবং আমি তোমার রসুল বলে সাক্ষ্য দিয়েছে তার জন্য তুমি তোমার সাক্ষাৎ লাভকে প্রিয় কর, তোমার তকদীর তার হক্কে সুপ্রসন্ন কর এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাস তাকে অল্প প্রদান কর। আর যে ব্যক্তি তোমার প্রতি ঈমান রাখে না। এবং আমি তোমার রসূল বলে সাক্ষ্য দেয় না, তার জন্য তোমার সাক্ষাৎ-লাভকে প্রিয় করো, তোমার তকদীরকে তার হক্কে সুপ্রসন্ন করো না এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাস তাকে বেশী। বেশী প্রদান কর।” (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে ১৩১১ নং)

সুতরাং আল্লাহর প্রিয় বান্দারা যে পার্থিব ভোগ-বিলাসপূর্ণ জীবন লাভ করবে না, তা বলাই বাহুল্য। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তারা পৃথিবীতে আমরণ দুঃখ-কষ্ট্রে বাস করবে এবং অপরের হাতে পড়ে পড়ে মার খেতে থাকবে। বরং প্রকৃত ঈমান থাকলে তার বলে মু’মিন এ পৃথিবীতে সর্বোপরি মর্যাদা লাভ করতে পারবে। কোন সময়ে অনাহার-উপবাস ও অসুখবিসুখের সম্মুখীন হলেও অল্পে তুষ্টি এবং অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের অভ্যাস তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেয় না। তাছাড়া তার এ বিশ্বাস থাকে যে, এ অভাব-অনটন ও অসুস্থতার বিনিময়ে পরকালে মহাপ্রতিদান ও চিরস্থায়ী সম্পদ ও সুখ লাভ করবে। পরকালে ইচ্ছা-সুখের বিলাস-রাজ্য পাব’ এই পরম বিশ্বাস তার মনে সান্ত্বনা ও শান্তি এনে দেয়। আর তাই সুখরূপে তার জীবনে চরম আনন্দ ও তৃপ্তি দান করে থাকে।

দুনিয়ার ভোগ-বিলাস মুমিনের কাম্য নয়। দুনিয়াদারীর ফাঁদে আটকে পড়া জ্ঞানী মুসলিমের কাজ নয়। দুনিয়া তো এক সরাইখানা। এ দুনিয়ার ভরসা কোথায়? দুনিয়া তো মেঘের ছায়া, নিদ্রিতের স্বপ্ন, বিষ-মাখা মধু, সুসজ্জিতা ও সুরভিতা বিষকন্যা। দুনিয়া হল পাপের ধরাধাম, বঞ্চনা ও অভিশাপময় শয্যাগৃহ।

পাপের পঙ্কে পুণ্য-পদ্ম, ফুলে ফুলে হেথা পাপ,

সুন্দর এই ধরা-ভরা শুধু বঞ্চনা অভিশাপ।

সে দুনিয়ার জন্য দুঃখ কিসের, যে দুনিয়ার কোন মূল্যই নেই। “আল্লাহর দৃষ্টিতে একটি মশা পরিমাণও যদি দুনিয়ার মূল্য মান থাকত তাহলে কোন কাফের দুনিয়ার এক ঢোক পানিও পান করতে পেত না।” (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ৫১৭ ৭ নং)

আখেরাতের জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবন হল সমুদ্রের পানির তুলনায় তাতে আঙ্গুল ডুবিয়ে ঐ আঙ্গুলে লেগে থাকা পানির মত সামান্য ও তুচ্ছ। (মুসলিম, মিশকাত ৫১৫৬ নং)

আল্লাহর নিকট দুনিয়া একটি কানকাটা মৃত ছাগল-ছানার চাইতেও অধিক নিকৃষ্টতর। (মুসলিম, মিশকাত ৫১৫৭ নং)

দুনিয়া মুসলিমদের জন্য কারাগার স্বরূপ। আর কাফেরদের জন্য বেহেশ্ব স্বরূপ। (মুসলিম, মিশকাত ৫ ১৫৮ নং)

দুনিয়া অভিশপ্ত। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ মিশকাত ৫১৭৬ নং) দুনিয়া একটি ছায়াদার গাছের মত। (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ৫১৮৮ নং) দুনিয়া মানুষের কর্মক্ষেত্র। আর আখেরাত হল হিসাবের স্থান। (বুখারী) মহান আল্লাহ বলেন, “পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত বৃষ্টির ন্যায়, যা আমি আকাশ হতে বর্ষণ করি। পরে তা হতে ঘন তরুলতা উদগত হয়, যা হতে মানুষ ও জীবজন্তু আহার করে থাকে। এই অবস্থায় যখন ধরণী সুবর্ণ রূপ ধারণ করে ও সুশোভিত হয় এবং তার অধিবাসীগণ মনে করে যে, এখন তারাই তার অধিকারী। কিন্তু যখন দিন অথবা রাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে এবং আমি তা এমনভাবে নির্মূল করে দিই, যেন ইতিপূর্বে তার কোন অস্তিত্বই ছিল না।” (সূরা ইউনুস ২৪ আয়াত)

“ওদের নিকট পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা কর, এই পানির ন্যায় যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি, যার দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদ্গত হয় ও পরে তা শুকিয়ে গিয়ে এমন চুর্ণ-বিচুর্ণ হয় যে, বাতাস ওকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।” (সরা কাহফ ৪৫ আয়াত)।

“তোমরা জেনে রেখো, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, আঁকজমক, পারস্পরিক গর্ববোধ ও ধন-জনে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছু নয়। এর উপমা হল বৃষ্টি, যার। দ্বারা উৎপন্ন শস্য-সম্ভার কাফের (বা কৃষক) দলকে চমৎকৃত করে, অতঃপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তা খড়-কুটায় পরিণত হয়।” (সূর হীদ ২০} “পার্থিব জীবন ছলনাময় সম্পদ ছাড়া কিছুই নয়।” (সূরা আ-লি ইমরান ১৮৫ আয়াত) “পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছু নয়, যারা সংযত হয় তাদের জন্য পরকালের আবাসই শ্রেষ্ঠতর। তোমরা কি তা বোঝ না?” (সূরা আনআম ৩২ আয়াত)।

“এই পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছুই নয়। পারলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন।” (সূরা আনকাবুত ৬৪ আয়াত) “এই পার্থিব জীবন তো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু এবং পরকাল হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস।” (সূরা মু’মিন ৩৯ আয়াত)

“যদি কেউ পার্থিব জীবন ও তার শোভা কামনা করে, তবে দুনিয়াতে আমি তাদের কর্মের পরিমিত ফল দান করি এবং দুনিয়াতে তারা কম পায় না। তাদের জন্য পরকালে দোযখের আগুন ছাড়া কিছুই নেই। আর তারা যা এখানে করে তা বিনষ্ট হবে এবং যা করছে তা অগ্রাহ্য হবে।” (সূরা হূদ ১৫-১৬)

“কেউ পার্থিব-সুখ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা সত্বর দিয়ে থাকি। পরে ওর জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি; যেখানে সে নিন্দিত ও (আল্লাহর) অনুগ্রহ থেকে দূরীকৃত অবস্থায়। প্রবেশ করবে। আর যারা মুমিন হয়ে পরলোক কামনা করে এবং তার জন্য যথাসাধ্য সাধনা। করে, তাদেরই সাধনা স্বীকৃত হবে।” (সূরা ইসরা ১৮-১৯)

বলাই বাহুল্য যে, এ কারণেই মুসলিমের কাম্য পার্থিব জীবন ও তার সৌন্দর্য নয়। ক’দিনের এ সংসার তো এক খেলাঘর। খেলা শেষ হলে এবং রেফারী’ বাঁশি বাজিয়ে দিলেই তো সব শেষ।

যে মত শিশুর দল পথের উপর,

খেলাধুলা করে তারা বানাইয়া ঘর।

হেন কালে স্নেহময়ী মাতা ডাক দিলে,

ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে যায় মাতৃকোলে।

সেই মত এই পৃথিবীর সংসার জীবন,

মহাকালের এলে ডাক র’ব না তখন।

সালামাহ আল-আহমার বলেন, একদা আমি বাদশা হারুন রশীদের নিকট গমন করলাম। তার বালাখানা ও রাজমহল দেখে আমি তাকে বললাম, আপনার মহলখানা বেশ প্রশস্ত। আপনার মৃত্যুর পরে আপনার কবরখানিও যদি প্রশস্ত হয় তবেই ভালো।

এ কথা শুনে তিনি কাঁদতে লাগলেন। অতঃপর বললেন, হে সালামাহ! আপনি আমাকে সংক্ষেপে আরো কিছু উপদেশ দিন।

আমি বললাম, হে আমীরুল মুমেনীন! যদি কোন মরুভূমিতে পৌছে পিপাসায় আপনার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, তাহলে তা দূর করার জন্য কত পরিমাণ অর্থ দিয়ে এক ঢোক পানি কিনবেন বলবেন কি? তিনি বললেন, 'আমি আমার অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে তা কিনব।”

আমি বললাম, 'অতঃপর তা কিনে পান করে তা যদি আপনার পেট থেকে বের হতে না চায়, তাহলে তা বের করার জন্য কি ব্যয় করবেন? বললেন, 'বাকী অর্ধেক রাজত্ব ব্যয় করে দিব।

আমি বললাম, 'অতএব সে দুনিয়ার উপর আল্লাহর অভিশাপ, যে দুনিয়ার মূল্য হল মাত্র এক ঢোক পানি ও এক গোড় পেশাব!’ এ কথা শুনে বাদশা হারুন রশীদ আরো জোরে কেঁদে উঠলেন। এ জগতের কোন গুরুত্ব নেই মুসলিমের কাছে। এ সংসারের কোন মায়া নেই জ্ঞানী। মানুষের হৃদয়ে। এ দুনিয়া হল ছলনাময়ী বেশ্যার ন্যায়। বেশ্যার প্রেমে যে পড়বে, সে অবশ্যই পবিত্র দাম্পত্যও হারাবে এবং অর্থও।

‘এ মায়া মরিচিকা, এ যে মোহ ভুল,

এ নহে তো সেই

যাহারে সঁপিতে পারি প্রণয়ের পারিজাত ফল।

মানুষের জীবনের দু’টি দিক আছে; একটি হল ভোগের দিক এবং অপরটি ত্যাগের। কিছু ভোগ করতে পারলে মানুষের কল্যাণ আছে। আবার কিছু ত্যাগ করলে তার মঙ্গল আছে। পরন্তু কিছু ভোগ করতে চাইলে কিছু ত্যাগ করতে হয় এবং কিছু ত্যাগ স্বীকার করলে তবেই কিছু ভোগ করতে পাওয়া যায়। কিন্তু বিপদ হয় তখনই, যখন মানুষ ত্যাজ্য বস্তুকে ভোগ্যরূপে এবং ভোগ্য বস্তুকে ত্যাজ্যরূপে গ্রহণ করে বসে। কিছু ফলের উপরের অংশ আমাদের ভক্ষণীয়, আর কিছু অন্য ফলের ভিতরের অংশ ভক্ষণীয়। অতএব ফল চেনে না। এমন লোক যদি ফল চেনে এমন লোকের পরামর্শ না নিয়ে যে অংশটা খাওয়া দরকার তা না খেয়ে অপর অংশটা খায়, তাহলে তা মুখতা বৈ কি? বলা বাহুল্য, দুনিয়া আমাদের ভোগের বস্তু নয়; বরং ত্যাগের বস্তু। আর আখেরাত হল ভোগের বস্তু। পরন্তু দুনিয়া ত্যাগ করলে তবেই আখেরাত পাওয়া যাবে। নচেৎ একই সাথে উভয়ই পাওয়া অসম্ভব।

অবশ্য দুনিয়া ত্যাজ্য' বলতে বৈরাগ্যবাদ উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল, আখেরাত চিন্তা বর্জন করে কেবল দুনিয়ার চিন্তায় মগ্ন থাকা উচিত নয়। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল আখেরাত। আর দুনিয়া হল উপলক্ষ্য মাত্র। অতএব প্রধান লক্ষ্যে পৌঁছনর উদ্দেশ্যে। উপলক্ষ্য আমাদেরকে যথাবিহিত অনুসারে ব্যবহার করতে হবে এবং উপলক্ষ্যকে লক্ষ্যে পরিণত করা মোটেই চলবে না। প্রিয় নবী ৪ঞ্জ বলেন, “যে ব্যক্তির প্রধান চিন্তা ও লক্ষ্য দুনিয়াদারী হয়, আল্লাহ সেই ব্যক্তির একক প্রচেষ্টাকে তার প্রতিকূলে বিক্ষিপ্ত করে দেন, তার দারিদ্রকে তার দুই চোখের সামনে হাজির করে দেন। আর দুনিয়ার সুখ-সামগ্রী তার ততটুকুই লাভ হয়, যতটুকু তার ভাগ্যে লিখা থাকে।

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির পরম লক্ষ্য আখেরাতই হয়, আল্লাহ সে ব্যক্তির প্রচেষ্টাকে তার অনুকূলে ঐকান্তিক করে দেন, তার হৃদয়ে ধনবত্তা ভরে দেন। আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুনিয়ার সুখ-সামগ্রী তার নিকট এসে উপস্থিত হয়।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ৬৫ ১৬, সহীহুল জামে’ ৬৫১০ নং)

দুনিয়াদারদের প্রতিই হল, এ জগতে হায় সেই বেশী চায়, আছে যার ভূরিভূরি। যত পায় তত আরো পেতে চায়। চাওয়া-পাওয়ার আকাঙ্খা তাদের মেটে না। যত ভোগ পায়, তত ভোগের নেশা তাদেরকে আরো মাতাল করে তোলে।

পক্ষান্তরে পরকালকামী মুসলিম প্রয়োজন মত দুনিয়া চায়। দুনিয়াকে আখেরাতের জন্য ব্যবহার করে, আখেরাতকে দুনিয়ার জন্য নয়। সে জানে যে, দুনিয়া তার জন্য মুসাফিরখানা এবং আখেরাত হল আসল ঠিকানা। যেমন মুসাফিরখানার সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য তার কাম্য নয়, তেমনি মুসাফিরখানাকে ধ্বংস করে দেওয়াও তার কাম্য হতে পারে না। কারণ, তাকে এই দুনিয়ার ক্ষেতে বীজ বপণ করেই আখেরাতে তার ফসল তুলতে হবে। অতএব ক্ষেত সমূলে বিনাশ করা তার অধিকারভুক্তও নয়।

এ কথা কুরআন মাজীদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। “আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন তার মাধ্যমে পরলোকের কল্যাণ অনুসন্ধান কর এবং ইহলোক থেকে তুমি তোমার অংশ ভুলে যেও না।” অর্থাৎ, দুনিয়ার বৈধ সম্ভোগকে তুমি উপেক্ষা করো না। (সূরা কাসাস ৭৭ আয়াত)

“তুমি বল, আল্লাহ যে সব সুন্দর বস্তু স্বীয় বান্দাগণের জন্য সৃষ্টি করেছেন তা এবং জীবিকার মধ্য হতে পবিত্র খাদ্য-পানীয়কে কে অবৈধ করেছে? বল, এই সব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্য এবং বিশেষ করে পরকালে কেবল তাদেরই জন্য (প্রস্তুত রাখা হয়েছে)।” (সূরা আরাফ ৩২ আয়াত)

আমাদের ও অন্যান্য মানুষদের মাঝে একটি বড় পার্থক্য এই যে, আমাদের বিশ্বাস হল, আমরা নিজে নিজে সৃষ্টি হতে পারি না। আমাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। আর তিনি হলেন আমাদের একমাত্র উপাস্য মহান আল্লাহ। আমরা কেবল তারই আনুগত্য করার জন্য সৃষ্টি হয়েছি। এর বিনিময়ে তাঁর সন্তুষ্টি পাব। আমাদেরকে একদিন অবশ্যই মরতে হবে। এ পার্থিব জীবনই সব কিছুর শেষ নয়। মরণের পর পুনরায় এক সময় আবার জীবিত হতে হবে এবং আমরা এ জগতে যা কিছু করি তার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জবাবদিহি করতে হবে। তাঁর আনুগত্য করে থাকলে সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য চির-সুখময় স্থান বেহেশ্ব প্রস্তুত রেখেছেন। অন্যথা করলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভীষণ শাস্তি ও জ্বালাময় দোযখ-যন্ত্রণা।

আসলে উক্ত বিশ্বাস অধিকাংশ মানুষের মনে না থাকার ফলেই যত বিপর্যয় ও বিভ্রাট সৃষ্টি। হয়েছে। হিসাব দিতে হবে না মনে করেই অনেকে রিপুর একান্ত সেবক ও অনুগত দাস হয়ে। স্বেচ্ছাচারিতার স্বাধীন জীবন অতিবাহিত করে যাচ্ছে। ধরে নিয়েছে, দুনিয়াটাই সব কিছু। দুনিয়াটা মস্ত বড়, খাও-দাও ফুর্তি কর।' এই শ্লোগান তাদের মনে-মগজে জায়গা করে নিয়েছে। তাদের সন্দেহ ও বক্তব্য হল, “সে (মুহাম্মাদ) কি তোমাদেরকে এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তোমাদের মৃত্যু হলে এবং তোমরা মৃত্তিকা ও অস্থিতে পরিণত হলেও তোমাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে?! তোমাদেরকে যে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে তা কদাচ ঘটবে, কদাচ ঘটবে না। একমাত্র পার্থিব জীবন, আমরা মরি-বাচি এখানেই এবং আমরা পুনরুত্থিত হব না। সে তো এমন এক ব্যক্তি, যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে এবং আমরা তাকে বিশ্বাস করবার নই।” (সূরা মু'মিনুন ৩৫-৩৮ আয়াত) তাদের বুলি হল,

‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও ধারের খাতা শুন্য থাক,

দুরের আওয়াজ লাভ কি শুনে মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।”

কেউ বা বলে,

এখন যা পাই তাই নিয়ে যাই দুর অজানার কাজ কি মোর,

এমন মাটির স্বর্গ আমার কোথায় পাব এর দোসর?’

অন্য কেউ বলে থাকে,

‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহু দূর?

মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর।

যুবক এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও প্রগতি - ৩

আল্লাহ তাআলা বলেন, “---বল, আল্লাহই সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনেন ও পরে ওর পুনরাবর্তন ঘটান। সুতরাং তোমরা কেমন করে সত্য-বিচ্যুত হচ্ছাে? তুমি বল, তোমরা যাদেরকে (আল্লাহর) শরীক কর তাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে সত্যের পথ নির্দেশ করতে পারে? বল, আল্লাহই সত্য পথ নির্দেশ করে থাকেন। অতএব যিনি সত্যপথ নির্দেশ করেন তিনিই আনুগত্যের অধিকতর হকদার, নাকি যে তার পথ-প্রদর্শন ব্যতীত পথ পায় না সে? সুতরাং তোমাদের কি হয়েছে, কেমন তোমাদের বিচার? আসলে তাদের অধিকাংশই অনুমান ও কল্পনারই অনুসরণ করে থাকে। অথচ নিশ্চয় সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোন কাজে আসে না। তারা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে অবহিত।” {সূরা ইউনুস ৩৪-৩৬ আয়াত) কল্পনার কলে পড়ে যেমন এ শ্রেণীর লোকেরা সত্যকে প্রত্যাখান করে ঠিক তেমনিই বহু উদ্ভট অসত্য বিশ্বাস করে থাকে এরা। শুধু এরা এদের নিজ ধারণা ও চিন্তাবলে সত্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে অনেক সময় অনেক চিন্তাবিদ সত্যাশ্রয়ীদের নিকট হাস্যস্পদ হয়ে ওঠে। যেমন এক শহুরে চিন্তাবিদ পাড়া-গ্রামে এসে দেওয়ালে খুঁটে দেখে এই চিন্তাদ্বন্দ্বে পড়েছিল যে, এই দেওয়ালে গরু কিভাবে উঠে বিষ্ঠা ত্যাগ করল?!' তদনুরূপ বাদরের সাথে মানুষের আকৃতির। মিল দেখে বহু চিন্তাবিদের ধারণা হল, 'বহু কাল পূর্বে মানুষ আসলে বানর ছিল, পরে এর বিবর্তন ঘটেছে!' অর্থাৎ, তারা নাকি বাদরের জাত!!

মোট কথা, পরকালে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর জীবন-ধারা এক নয়। হতেও পারে না এক। একজন জানে যে, তাকে আমানতে দেওয়া প্রত্যেক পয়সা ও প্রত্যেক আয়-ব্যয়ের যথার্থ হিসাব লাগবে। আর একজন পরের ধনে পোদ্দারি করে এবং মনে করে যে, তাকে একটি পয়সারও হিসাব লাগবে না। তার আয়-ব্যয়ের হিসাব নেওয়ার মত কেউ নেই। এই উভয় লোকের খরচে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। পুঁজি ভেঙ্গে খেতে ভালো, ভিটেন গাঙে যেতে ভালো, যত কষ্ট বুঝতে আর উজুতে।' একজন জানে যে, সে কেবল পরের জমা করা ধন ভেঙ্গে খেয়ে যাবে, আর তাকে হিসাব বুঝাতে হবে না। নদীর ভাটার টানে তার নৌকা আপনা-আপনিই বয়ে যাবে এবং পরবর্তী কালে উঝানে আর উঠতে হবে না এমন লোক; আর যে জানে যে, তাকে তার ঐ ভেঙ্গে খাওয়া অর্থের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপ হিসাব লাগবে, প্রত্যেক কাজ ও খরচের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, জীবন-তরীকে পার্থিব ভোগ-বিলাস ও খেয়াল-খুশীর ভাটায় ভাসিয়ে দিলেও একদিন তাকে উঝান বেয়ে ফিরে যেতেই হবে। -এই উভয় মানুষের জীবন-পদ্ধতি, আহার-বিহার, চাল-চলন এক হতে পারে না। মানুষকে ভেবে দেখা উচিত যে, এ জীবনের মূল উদ্দেশ্য কি? মূল লক্ষ্য কি? কেন সে সৃষ্টি হয়েছে? তার কর্তব্যই বা কি? মূল লক্ষ্য কি কেবল রিপু ও ইন্দ্রিয়-সেবন? আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কি পার্থিব সুখ ও সফলতা? যদি তাই হয় তবে তা তো চিরস্থায়ী নয়। এ বিপুল সুখের ভরপুর আয়োজন ক’দিনের জন্য? সে সুখের স্বপ্ন নিদ্রাভঙ্গ হলেই যে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তারপর কি? মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি, আর তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না?” (সূরা মুমিনুন ১১৫ আয়াত)

“মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে?” (সূরা কিয়ামাহ ৬) না কক্ষনই না। “আমি দানব ও মানবকে তো আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াত ৫৬)

“মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করতে পারব না? বস্তুতঃ আমি ওর অঙ্গুলিগুলো পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম। তবুও যা অবশ্যম্ভাবী মানুষ তা অস্বীকার করতে চায়।” (সূরা কিয়ামাহ ৩-৫ আয়াত)

পূর্বোক্ত আলোচনার পরেও কোন যুবকের মনে আর কোন প্রশ্ন থাকা উচিত নয় যে, ধর্মহীন, লাগামছাড়া হওয়া সত্ত্বেও ওরা পার্থিব ব্যাপারে কত উন্নত জাগতিক সুখ ওদের পায়ে লুটিয়ে পড়েছে। আর আমাদের অবস্থা এমন হয়েছে যে, যে করবে ধম্ম, তার কাঁদতে যাবে জন্ম। কারণ, আমরা সে সুখ প্রতিযোগিতায় নামতে চাইনি। তাছাড়া আমাদের জন্য রয়েছে আমাদের প্রতিপালকের আশ্বাসবাণী; তিনি বলেন, “তোমাদেরকে যা কিছু দেওয়া হয়েছে, তা তো পার্থিব-জীবনের ভোগ ও শোভা এবং যা আল্লাহর নিকট আছে তা উত্তম ও স্থায়ী। তোমরা কি বুঝ না? যাকে আমি উত্তম পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি -যা সে পাবে, সে কি ঐ ব্যক্তির মত যাকে আমি পার্থিব জীবনের ভোগ-সম্পদ দিয়েছি, যাকে পরে কিয়ামতের দিন অপরাধীরূপে উপস্থিত করা হবে?” (সূরা কাসাস ৬০-৬১ আয়াত)

“বস্তুতঃ তোমাদেরকে যা কিছু দেওয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ্য; কিন্তু আল্লাহর নিকট যা আছে তা যারা ঈমান রাখে ও নিজেদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে তাদের জন্য উত্তম ও স্থায়ী।” (সূরা শুরা ৩৬ আয়াত)।

ছন্নছাড়া সে কাফেরদের সুখ-সম্ভােগ দেখে কোন মুসলিমের চোখ টাটানো উচিত নয়। সাধারণতঃ সেই জিনিসে মানুষের ঈর্ষা জন্মে, যাতে আছে উপকার ও কল্যাণ পার্থিব ভোগবিলাসে ক্ষণকালীন সুখ ছাড়া চিরকালীন কল্যাণ নেই। অতএব সে সম্পদে ঈর্ষা জন্মানো। মুসলিমের সমীচীন নয়।

মহান আল্লাহ বলেন, “আমি অবিশ্বাসীদের কতককে তাদের পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য-স্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়ে রেখেছি, তার প্রতি তুমি কখনো দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখো না। তোমার প্রতিপালকের উপজীবিকাই উৎকৃষ্টতর ও চিরস্থায়ী।(সূরা ত্বহ ১৩১ কাফেররা দুনিয়ায় সুখ ভোগ করবে। এটাই বিধির বিধান। তাদেরকে দুনিয়া দেওয়া হয়েছে। এবং হবেও। আর মুসলিমদের জন্য রয়েছে আখেরাত। দুনিয়াটাই হল কাফেরদের বেহেশু। তারপর চিরস্থায়ী আযাব। আর মুসলিমের ক্ষণকাল দুঃখ হলেও তার জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী বেহেস্তী সুখ পরকালে বেহেশ্যে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “সত্য-প্রত্যাখ্যানে মানুষ এক মতাবলম্বী হয়ে পড়বে এই আশঙ্কা থাকলে দয়াময় আল্লাহকে যারা অস্বীকার করে তাদেরকে তিনি ওদের গৃহের জন্য রৌপ্যনির্মিত সিঁড়ি দিতেন, রৌপ্যনির্মিত দরজা ও বিশ্রামের পালঙ্ক দিতেন। আর দিতেন স্বর্ণের অলঙ্কার। কিন্তু এ সব তো পার্থিব জীবনের ভোগ-সম্ভার। আর সংযমীদের জন্য তোমার প্রতিপালকের নিকট পরলোকের কল্যাণ আছে।” (সূরা যুখরুফ ৩৩-৩৫ আয়াত)।

“অতএব ওদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাকে মুগ্ধ না করে। আল্লাহ তো ওর দ্বারাই ওদেরকে পার্থিব জীবনে শাস্তি দিতে চান।” (সূরা তাওবাহ ৫৫ আয়াত)।

ওরা কতই বা উন্নত? প্রগতির নামে অধোগতির সমাজে কত যে দুর্গতি তাদের, তা বহু মানুষই জানে। তারা পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ সত্য, কিন্তু তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক সম্বন্ধে অবগত, পক্ষান্তরে ওরা পরকাল সম্বন্ধে একেবারে গাফেল।” (সূরা রূম ৭ আয়াত)

ওরা পার্থিব ঐ উন্নতি নিয়ে চাদে যেতে পারে, মঙ্গল বা অন্য কোন গ্রহে বাস করতে পারে, কিন্তু বেহেশ্যে পৌছতে পারে না নিশ্চয়। আর মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ হলেও, চাদে বা অন্য গ্রহে না যেতে পারলেও বেহেস্তে যাওয়ার পথ তার জন্য সুগম। পার্থিব ও বৈজ্ঞানিক উন্নতির পথে ইসলাম তো বাধা দেয় না; বরং যে কাজেই মানুষের কল্যাণ আছে সেই কাজেই ইসলাম মুসলিমকে অনুপ্রাণিত করে। তবুও প্রগতিশীল মানুষদের ধারণা যে, ইসলাম বিজ্ঞানের পথে বাধাস্বরূপ। যেমন কবি বলেছেন,

‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে তখনো আমরা বসে,

বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফিকা ও হাদীস চষে।

কিন্তু আমরা যদি কবিকে প্রশ্ন করি যে, আপনিও তো বসে আছেন, অথচ লোকে চাঁদে গেল, মঙ্গল গ্রহে পা রাখল?

‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে তখনো আমরা বসে,

কলম ধরিয়া কবিতা লিখেছি মনের রস ও রোষে।

তখন নিশ্চয় কবি বলবেন, 'চাদে যাওয়ার কাজ তো আমার সাধ্যে নয়। আমার সে উপায়। উপকরণ নেই। তাহলে যারা ফিকা ও হাদীস চষে বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেন তারাও নিশ্চয় বলবেন, ও কাজ আমাদের নয়। আমাদের ও কাজে সাধ্য ও উপায়-উপকরণ কিছুই নেই। এখন চাদে যদি না-ই যেতে পারি, তাহলে ধর্মও কি ছেড়ে বসতে হবে? হারামহালালের তমীজও কি বাদ দিতে হবে?’ পরন্তু মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিধানে হারামহালালের তমীজ করা হল ফরয। আর কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে চাদে যাওয়া হল বড় জোর মুস্তাহাব। চাঁদ বা মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার চেয়ে আমাদের কাছে বেহেস্তে যাওয়া অধিকতর। গুরুত্বপূর্ণ। তবুও চাদে যেতে ইসলাম মানা করেনি। তবে ইসলাম ও তার উলামা সমাজের প্রতি এ কটাক্ষ কেন?

এ কটাক্ষ করা চলে তাদের প্রতি, যাদের হাতে আছে বিভিন্ন উপায়-উপকরণ। যাদের ক্ষমতায় আছে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিজ্ঞান-মন্দির, গবেষণাগার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে লুক্কায়িত শত শত প্রতিভার প্রতিভাত ঘটানোর কাজ। সুতরাং কবির জন্য শোভনীয় ছিল। এই বলা,

বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে তখনো আমরা বসে,

ভোগ-বিলাসের সিংহাসনে মত্ত থেকেছি রসে।

যাই হোক, পার্থিব জগতের চাকচিক্য নিয়ে ওরা বডড় খোশ। আর তারা মনে করে যে, ধর্মের বাঁধনে তারা আবদ্ধ নয় বলেই তাদের এই উন্নতি। নৈতিক বাধ্য-বাধকতা মানে না বলেই তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত উন্নত। কিন্তু মহান সৃষ্টিকর্তা বলেন, “যারা অবিশ্বাস করেছে তারা যেন এ ধারণা না করে যে, আমি তাদেরকে যে সুযোগ দিয়েছি, তা তাদের জন্য কল্যাণকর। তারা স্বীয় পাপ বর্ধিত করবে এই উদ্দেশ্যেই আমি তাদেরকে ঢিল দিয়ে রেখেছি। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাপ্রদ শাস্তি।” (সূরা আ-লি ইমরান ১৭৮)

যদিও তারা আজ ধর্মভীরুদেরকে ব্যঙ্গ করে ও নিজেদেরকেই চির উন্নত মনে করে তবুও প্রকৃতপ্রস্তাবে চির উন্নত হল মুসলিমরাই। চির’ শব্দের অর্থ মরণ পর্যন্তই বিস্তৃত নয়। চির’ হল অনন্তকালের জন্য মরণের পরপারেও যে জীবন, সে জীবনকেও পরিব্যাপ্ত।

আল্লাহ তাআলা বলেন, “যারা অবিশ্বাস করছে, তাদের পার্থিব জীবন সুশোভিত করা হয়েছে, আর তারা বিশ্বাসী (মুসলিমদের)কে ঠাট্টা করে থাকে। অথচ যারা ধর্মভীরু তাদেরকে কিয়ামতে সমুন্নত করা হবে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবিকা দান করেন।” (সূরা বাকারাহ ২ ১২) সুতরাং অধোগতি মাকা’ সে সব প্রগতিশীল মানুষদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার কোন অর্থ থাকতে পারে কি? এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে মুমিনদেরকে নিষেধ করা হয়েছে।

একদা দুই জাহানের বাদশাহ, নবীকুল-শিরোমণি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) চাটাই-এর উপর হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলেন। তার পার্শ্বদেশে চাটাই-এর স্পষ্ট দাগ পড়ে গিয়েছিল। তার বগলে ছিল খেজুর গাছের চোকার বালিশ! তা দেখে হযরত উমার কেঁদে ফেললেন। আল্লাহর রসূল

# জিজ্ঞাসা করলেন, “হঠাৎ কেঁদে উঠলে কেন, হে উমার?” উমার বললেন, হে আল্লাহর রসুল! পারস্য ও রোম-সম্রাট কত সুখ-বিলাসে বাস করছে। আর আপনি আল্লাহর রসুল হয়েও এ অবস্থায় কালাতিপাত করছেন? আপনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করুন, যেন তিনি আপনার উম্মতকে পার্থিব সুখ-সম্পদে সমৃদ্ধ করেন। পারস্য ও রোমবাসীদেরকে আল্লাহ দুনিয়ার সুখ-সামগ্রী দান করেছেন, অথচ তারা তাঁর ইবাদত করে না!

এ কথা শুনে মহানবী ঃ হেলান ছেড়ে উঠে বসলেন এবং বললেন, “হে উমার। এ ব্যাপারে তুমি এমন কথা বল? ওরা হল এমন জাতি, যাদের সুখ-সম্পদকে এ জগতেই ত্বরান্বিত করা হয়েছে। তুমি কি চাও না যে, ওদের সুখ ইহকালে আর আমাদের সুখ পরকালে হোক?” (বুখারী ৫১৯১, মুসলিম, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে ১৩২৭ নং)। মহান আল্লাহ বলেন, “যেদিন অবিশ্বাসীদেরকে দোযখের নিকট উপস্থিত করা হবে, সেদিন ওদেরকে বলা হবে, 'তোমরা তো পার্থিব জীবনে তোমাদের সুখ-সভার ভোগ করে শেষ করেছ। সুতরাং আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া হবে। কারণ, তোমরা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিলে এবং তোমরা ছিলে সত্যদ্রোহী।” (সূরা আহক্বাফ ২০)

প্রগতিশীল যুবক বন্ধু আমার! জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে তুমি বিরাট বড় হয়ে বিরাট কিছু হতে পার, কিন্তু পরলোকে তুমি মিসকীন৷ এ জগতে তোমার ৫০০/৭০০ বিঘা জমি থাকতে পারে, হতে পার জমিদার। কিন্তু জান্নাতের মাটিতে তোমার এক-আধ কাঠা জায়গা কেনা না থাকলে নিশ্চয় তুমি নিঃস্ব। মানুষের দাসত্ব (চাকরী) করে তুমি মোটা অঙ্কের টাকা কামিয়ে বড় সুখী হতে পার। কিন্তু আল্লাহর দাসত্ব না করলে তুমি প্রকৃত ও চিরসুখী কখনোই হতে পার না। তুমি বহু কিছু হতে পার, কিন্তু প্রকৃত মুসলিম না হলে কিছুই নও। নৌকাচালক মাঝি বীজগণিতের ফরমুলা মুখস্থ না করলে, ভৌতবিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রক্রিয়া না জানলে, ভূগোলের গোল্লা না বুঝলে, ইতিহাসের ইতিবৃত্ত না জানলে তার জীবনের ১২ আনাই মিছে সত্যই, কিন্তু নৌকায় চড়ে কুলকুল-তান নদীর বুকে ঝড়ের তালে তালে যখন পানি ফুলে। ফুলে উঠে নৌকাডুবি হবে, তখন সে সময়ে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য যদি মাঝির মত সঁতার না শিখে থেকো তাহলে তুমি যত বড়ই পন্ডিত হও -তোমার জীবনের ১৬ আনাই মিছে। তোমার প্রগতির গাড়ির গতিবেগ যত বেশীই হোক না কেন, তবুও সে গাড়ি ঐ কবরডাঙ্গা পর্যন্ত চলমান। অতঃপর সে গাড়ি বদলি করতে হবে এবং তোমার গাড়ি যে অচল হয়ে থেকে যাবে, আর সেখানে যে তোমার প্রগতি অধোগতিতে পড়ে কি দুর্গতি হবে তা কি ভেবেছ?

গর্বিত বন্ধু আমার অহংকার প্রদর্শন করো না। দুনিয়া পেয়েছ বলে ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে দেখে নাক সিটকায়ো না। যে সুখ আছে, সে সুখ তোমার ক’দিনকার?

শত কামনা, শত বাসনা, শত আশার ফুলের মুকুল,

মরণ-তুফান আসিয়া নিমেষে ভাসাবে ভোগের স্নিগ্ধ দু’কুল।

মনের আশা রহিবে মনেই, ছিন্ন হইবে সকল বাঁধন,

হাটের মৎস্য হাটেই রহিবে মসলা বেঁটেও হবে না রাঁধন।

এসে গেলে সে

গাড়িপ্রস্তুত হওয়ার সময় দেবে না যেতে হবে তাড়াতাড়ি।

‘হে ভাই যুবক! ভেবে দেখ তুচ্ছ এই দুনিয়া নিয়ে, দুনিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা ও জুলুমবাজি নিয়ে, তার ধোকাবাজি ও ক্ষণস্থায়িত্ব নিয়ে। চিন্তা কর দুনিয়াদার ও সংসার-প্রেমী মানুষদের কথা; যাদেরকে দুনিয়া বিভিন্ন কষ্টে ক্লিষ্ট করেছে, পান করিয়েছে নানান তিক্ত ও বিষময় শারাব। যাদেরকে সামান্য আনন্দ দান করলেও কাদিয়েছে ও দুঃখ দিয়েছে বেশী।

ভেবে দেখ দোযখ নিয়ে, দোযখের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ও লেলিহান দাহিকাশক্তি নিয়ে। মনের গহীন কোণে একবার কল্পনা করে দেখ জাহান্নামের গভীরতা, তার কঠিন তাপ ও ভীষণ উষ্ণতা এবং আরো বিভিন্ন আযাব নিয়ে।

ভেবে দেখ, দোযখবাসীদের কথা; যাদেরকে সেখানে উপস্থিত করা হবে এবং তাদের চেহারা হবে বিকট কালো, চক্ষু হবে গাঢ় নীল, তাদের ঘাড়ে থাকবে বেড়ি ও শিকল। অতঃপর যখন তাদের সম্মুখে দোযখের দরজা খুলে দেওয়া হবে তখন সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে তাদের হৃদয় বিদগ্ধ হবে, হুঁশ হারিয়ে যাবে এবং শত আক্ষেপ ঘিরে ধরবে তাদের মন ও মগজে। ভাই যুবক! তুমি কত বছর বাচবে এ দুনিয়াতে? ৬০ বছর? ৮০, ১০০ অথবা ১০০০ বছর? তারপর কি? তারপর নিশ্চয়ই মুত্যু। তারপর হয় বেহেস্তের সুখময় বাসস্থান। নচেৎ দোযখের জ্বালাময় ঠিকানা। ভাইজান! তুমি কি দুনিয়ার এ ক'টা দিন, এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের ক’টা বছর আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্য রাখতে পারবে না? তোমার মন কি চায় না যে, কাল মরণের পর তুমি লাভ করবে চিরস্থায়ী জীবনের ইচ্ছাসুখের অনন্তকালের চির আনন্দ? (আখিল হাবীব দ্রঃ) পরিশেষে এস দুআ করি,

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

পরিবেশের এমন একটি প্রভাব-ক্ষমতা আছে যার ফলে ভালো মানুষ খারাপ হয়, আবার। খারাপ মানুষ ভালোও হয়ে থাকে। বহু যুবকই এমন আছে, যাদের মন ভালো, ভালো হওয়ার ইচ্ছাও রাখে, কিন্তু পরিবেশের চাপে খারাপ হয়ে যায়। এ জগতে যেহেতু মন্দলোকের সংখ্যাই বেশি, তাই মন্দের প্রভাব আগে ও বেশি পড়ে যুবকের উপর। আর এ মন্দ পরিবেশে প্রভাবান্বিত তারাই বেশি হয়, যাদের মন দুর্বল, ঈমান দুর্বল, দুর্বল দ্বীনী জ্ঞান। সত্যকে মানতে গিয়ে ঠাট্টা-উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, কটাক্ষ-টিপ্পনী, লোকহাস্য প্রভৃতির শিকার হয়ে অনেকে সত্য ত্যাগ করে বসে। দ্বীন ও দুনিয়ার নানান সমস্যা নিয়ে মানুষের মাঝে যে মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব-কলহ আছে তার কুচক্রে পড়ে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। পরিবেশগত বিভিন্নমুখী স্রোতের মুখে নিজের স্বাতন্ত্র্য ও ঈমানকেও বাচিয়ে রাখতে পারে না অনেকে।

ভোগ-বিলাসের প্রবণতা এমন বেড়ে উঠছে যে, সেই বিলাসবহুল দ্বীনহীন পরিবেশে একজন মানুষকে মুসলিম’-রূপে বেঁচে থাকতে প্রয়োজন হল অগাধ ধৈর্যের। “যত (মন্দ) বছর বা যত দিন অতিবাহিত হবে তার তুলনায় আগামী বছর ও দিন হবে আরো মন্দতর।” (আহমদ, বুখারী, ইবনে মাজাহ সহীহুল জামে” ৭৫৭৬ নং)

“এমন দিন আগামীতে আসছে যে, ধৈর্যের সাথে দ্বীন বাচিয়ে রাখতে ঠিক ততটা কষ্টকর মনে হবে, যতটা কষ্টকর মনে হয় হাতের মুঠোয় আগুনের আঙ্গার রাখা।” (তিরমিযী, সহীহুল জামে’ ৮০০২নং) “আগুনের আঙ্গার হাতের মুঠোয় ধরে রাখতে যেমন কঠিন ও কষ্টের কাজ ঠিক তেমনি উম্মতের মতবিরোধ ও কলহের সময় মহানবীর সুন্নাহ (তরীকা) অনুসারে জীবন-যাপন করা কঠিন ও কষ্টের কাজ বলে মনে হবে।” (সহীহুল জামে ৬৬ ৭৬ নং)

এমন পরিবেশে ধৈর্য ধরা সহজ নয়। যেমন সহজ নয় হাতের মুঠোয় আগুন ধরে রাখা। শত বাধা-বিঘ্ন ও আপদ-বিপদ উপেক্ষা করেও যারা দ্বীন ও ঈমান বাঁচিয়ে রাখবে এবং এমন ঘোলাটে নোংরা পরিবেশের আবর্জনায় নিজেদের দ্বীনদারীকে মলিন হতে দেবে না। তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার। এমন লোক হবে তারা, যারা প্রত্যেকে ৫০ জন শহীদ সাহাবীর সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে ২২৩৪ নং)

পরিবেশ ইত্যাদির কারণে মুমিনের ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। তাই প্রিয় নবী ৪৪ বলেন, “তোমাদের দেহের ভিতরে ঈমান ঠিক সেইরূপ পুরাতন হয়ে যায়, যেরূপ পুরাতন হয়ে যায় নতুন কাপড়। সুতরাং তোমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর, যাতে তিনি তোমাদের হৃদয়ে ঈমানকে (ঝালিয়ে) নতুন করে দেন।” (ত্বাবারানী, হাকেম, সহীহুল জামে ১৫৯০ নং)

পরিবেশের এমন এক শক্তি আছে, যার ফলে মানুষের চরিত্র, ব্যবহার, পরিধান, পানাহার প্রভৃতির মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার লাভ করে থাকে। পরিবেশ-দোষেই সত্য মিথ্যারূপে এবং মিথ্যা সত্যরূপে, সভ্যতা অসভ্যতারূপে এবং অসভ্যতা সভ্যতারূপে, সুন্নাত বিদআতরূপে এবং বিদআত সুন্নাতরূপে পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। একই পোশাক

কোন পরিবেশে পরিধান করলে লোকে তা দেখে হাসে। আবার ঐ পোশাকই অন্য এক পরিবেশে পরিধান না করলে লোকে তা না দেখতে পেয়ে আশ্চর্যবোধ, কটাক্ষ ও ব্যঙ্গ করে। তাছাড়া ভালোর তুলনায় নোংরা পরিবেশেরই প্রভাব-ক্ষমতা অধিক।পরশমণির সংস্পর্শে লোহা সোনা হওয়ার কথা শোনা যায় ঠিকই, কিন্তু তার বাস্তবরূপ বিরল। পক্ষান্তরে একটা পঁচা আলুর চারিপাশে বহু আলুকে পঁচ ধরতে অনেকেই দেখে থাকে।

এক যুগ ছিল যখন রেডিও কেনাও পাপ মনে করা হত। কিন্তু আজ আর তা হয় না। পূর্বে টিভিকে অধিকাংশ মুসলিম খারাপ মনে করতেন। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিমই টিভি তো দূরের কথা ডিসকেও খারাপ মনে করেন না। আর এ স্বাভাবিকতা আসে পরিবেশের গুণেই। পরিবেশের চাপেই কাল যা পাপ মনে করা হত, আজ তাকে বৈধ বা পুণ্য কাজ অথবা এক ফ্যাশনরূপে পরিগণিত হতে দেখা যায়।

কোন মুসলিম যদি রমযানের রোযার দিনে কিছু খায় তাহলে তা দেখে অনেকে তাকে মুসলিম নয় বলে ধারণা করবে। কিন্তু ঐ ব্যক্তিকেই নামায ত্যাগ করতে দেখে তারা কোন কিছু মনে করে না। অথচ নামাযের মর্যাদা রোযার চাইতে বহুগুণ উর্ধে। কিন্তু পরিবেশে বেনামাযী ও ‘আটকী-খাটকী-তিনশো ষাটকী’ নামাযীর সংখ্যা বেশী ও স্বাভাবিক হওয়ার ফলে তা আর বড় পাপ বা আশ্চর্যের বিষয় বলে মনে করা হয় না।

কোন মসজিদের ইমামকে যদি লোকে সোনার আংটি বা অন্য কিছু পরে থাকতে দেখে অথবা বিড়ি-সিগারেট পান করতে দেখে তাহলে সকলের চোখ ডাগর হবে। পক্ষান্তরে তাকে গীবত করতে দেখলে অথবা শিকী তাবীয লিখে ব্যবসা করতে দেখলে লোকের কোন ক্ষেপ দেখা যায় না। অথচ শেষােক্ত কর্মদ্বয়ের পাপ অধিকতর বড়। কারণ, পরিবেশ এমন সৃষ্টি হয়ে থাকে যে, মানুষ সেই হিসাবেই ভালো-মন্দ ও স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক বিচার করে থাকে। অথচ একজন মুসলিমের জন্য এ দৃষ্টিভঙ্গি ও মাপকাঠি হওয়া উচিত নয়। মুসলিমের সর্বকর্ম ও সকল ভালো-মন্দ বিচারের মানদন্ড হল ইসলাম, আল্লাহর বিধান। কারণ, মানুষ পরিবেশ সৃষ্টি করে। আর মানুষের জ্ঞান-বিবেক সীমিত ও বিভিন্নমুখী। একই বস্তু সকলের কাছে ভালো না-ও হতে পারে। সুতরাং ইসলামকে পরিবেশের ছাঁচে না ঢেলে, বরং পরিবেশকেই ইসলামের ছাঁচে ঢেলে গড়ে তোলা মুসলিমের কর্তব্য।

পরন্তু ইসলামী পরিবেশে মিশে যেতে হবে দুধে চিনি ঘুলে যাওয়ার মত। পক্ষান্তরে অনৈসলামী পরিবেশে মিশতে হলে মিশতে হবে চানাচুরে বাদাম মিশার মত; বড় সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে, যেন নিজস্ব সত্তা, স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বিলীন ও একাকার হয়ে বা হারিয়ে না যায়।

যদি বল, মাছ ধরব, অথচ গায়ে কাদাও লাগাব না তা কি করে সম্ভব? তাহলে বলা যায় যে, যে মাছ ধরতে গিয়ে তোমার গায়ে কাদা লাগবে এবং তোমার সৌন্দর্য কাদাতে মলিন হয়ে যাবে, সে মাছ ধরতে তুমি যাবে না। মাছ খাওয়ার দরকার একান্তই পড়ে থাকলে ছিপ দিয়েও তো ধরতে পার। হিকমত অবলম্বন করে চললে চলার পথ অতি সহজ।

পরিবেশ মানুষকে অতি সহজে তার দাসে পরিণত করে ফেলে। অস্বাভাবিককে স্বাভাবিক ও পাপকে সাধারণ কর্মে পরিবর্তিত করে। কারণ, প্রত্যেক জিনিসের কসরতই মানুষকে

অভ্যস্ত করে তোলে এবং সেখান থেকে দেখাদেখি শুরু হয় পরিবেশের সৃষ্টি। আর যে মানুষ ঐ পরিবেশে বাস করে সে বুঝতেও পারে না যে, সে যা করছে তা অস্বাভাবিক বা পাপ কাজ। যেমন চামড়ার গুদামে কর্মরত কর্মচারীর জন্য গুদামের ভিতরে অবস্থান করতে কোন কষ্ট হয় না। দুর্গন্ধ নাকে নিতে নিতে অভ্যাসে পরিণত হলে তা সাধারণ গন্ধে পরিবর্তিত হয় তার। কাছে। অথচ বাইরে থেকে অন্য কোন মানুষ সেখানে প্রবেশ করলে আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে। আরবীতে একটি প্রবাদ আছে, অর্থাৎ, দেহের কোন। জায়গা (যেমন শিশুদের জন্য মায়ের স্তনবৃন্ত) অধিকরূপে চোষণ করা হয় তখন প্রথম প্রথম তা খুব বেশী অনুভুত হলেও পরের দিকে আর কোন অনুভুতি অবশিষ্ট থাকে না। কারণ, তখন তা অভ্যাস ও স্বাভাবিকতায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, পরিবেশের এই অবস্থা হওয়ার ফলে পরিবেশ-দূষণ থেকে বাচা বড় কষ্টকর। আমাদের পরিবেশের এমন নোংরা ও ঘোলাটে অবস্থা যে, সে পরিস্থিতিতে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা বড় দুষ্কর। মাছ ধরার ইচ্ছা না থাকলেও গায়ে যে কাদা লাগবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? কারণ, তোমাকেও তো ঐ পুকুর ধারেই বাস করতে হবে।

‘পশ্চিমে ঝড় ঐ যে আসে পুবে অন্ধকার।

মহাকালের বাজছে প্রলয়-ভেরী,

বসুন্ধরার কাপন বড় ভাঙ্গছে তোরণদ্বার

তুফান আসার নাইকো বেশী দেরী।

ধুলোয় নয়ন আঁধার হল, আকাশ ডাকে গুরু

মাথা গোজার নাইকো কোথাও ঠাই,

কাল-নাগেরি শতেক ফণায় বক্ষ-দুরুদুরু

পালিয়ে যাওয়ার পথ তো জানা নাই।

এমন সংকটাপন্ন পরিবেশে মুসলিম দোটানায় দোদুল্যমান। কাদামাখা পা ধোয়ার চেষ্টা করলেও পা ধুয়ে রাখার স্থান কোথায়? কারণ, সব জায়গাই তো কাদাময়। ধুয়ে পা যদি কাদাতেই রাখতে হয় তাহলে ধোয়ার মুল্যই বা কি থাকে? শুকনো জায়গায় বা পাথরে সরে গিয়ে পা ধুলে অবশ্য ফলপ্রসূ হয়। কিন্তু ‘টকের ভয়ে দেশ ছেড়ে তেঁতুল-তলায় বাসা’ হলে তো আর এক মুশকিল।

সুতরাং এহেন পরিবেশে নিজেকে বাঁচাতে হলে কত যে সাধ, সাধ্য ও সাধনার প্রয়োজন তা বলাই বাহুল্য। চোরকাটা ভরা মাঠে চলতে যেমন কাপড় বাঁচিয়ে চলতে হয়, পিচ্ছিল্য কাদাময় পথে যেমন পা টিপে টিপে চলতে হয়, মাইন-পাতা পথে যেমন গাড়ি সাবধানে চালাতে হয়, ঠিক তেমনি ভাবেই মুসলিমকে সতর্কতার সাথে, পা টিপে, হুঁশিয়ার হয়ে, অতি সন্তর্পণে জীবনের গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে।

বৃষ্টি নামলে যেমন ছাতা দিয়ে আড়াল করে নিজেকে ভিজা থেকে বাঁচানো যায়, ঝড় বা শিলাবৃষ্টির সময় যেমন একটি মজবুত আশ্রয়-স্থলের প্রয়োজন হয়, বন্যা এলে যেমন কোন উঁচু ঘর বা স্থান দরকার হয়, তেমনিই অপসংস্কৃতির বিভিন্ন অশ্লীলতা থেকে বাঁচতে বিভিন্ন উপায়-অসীলার দরকার মুসলিমের।

আমাদের সামনে যে বড় ঝড় আসছে তা হল কুফরী ও ধর্মহীনতার ঝড়। পশ্চিম থেকে যে ঝড়ের লাল মেঘ দেখা দিয়েছে, তা হল জরায়ু-স্বাধীনতা ও যৌনবাদের ঝড়। সর্বগ্রাসী চরিত্ৰবিনাশী যে তুফান আমাদেরকে ধ্বংস করতে এবং যৌন-উন্মাদনার যে বন্যা প্রবল তান্ডবের সাথে নৃত্য করতে করতে আমাদেরকে গ্রাস করতে আসছে, তার কবল হতে রক্ষার জন্য আমাদের প্রয়োজন হল নুহের কি শুীর। আর সে কিশী হল শরীয়ত ও তার নীতিনৈতিকতা। যদি তাতে কেউ না চড়ে তবে ডুবে ও ভেসে যাবে ঐ পাপাচারের বন্যায় প্লাবিত হবে তার যথাসর্বস্ব। আর যদি কেউ নুহের ছেলে কিনআনের মত বলে যে, আমি কিন্তীতে

চড়ে কোন উচু পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেব’ তবুও সে রেহাই পাবে না। কারণ, এ তুফান হল ‘আকাশ-তুলতুল’, হিমালয় পর্বতও এ প্লাবনের নিচে হাবুডুবু খাবে। হে যুবক বন্ধু। কিন্তু তুমি পরিবেশ নোংরার ওজুহাতে নোংরায় গা ভাসিয়ে দিও না। তোমার অভিযোগ, দেশে ইসলামী শাসন কায়েম না হলে পরিবেশ ভালো হবে না। অবশ্য তোমার কথা নিশ্চয়ই ঠিক। পরন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ কথাও ঠিক যে, পরিবেশ ভালো না করতে পারলে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। কারণ, পরিবেশের অধিকাংশ লোক এ আসমানী শাশ্বত শাসনকে মেনে নিতে না চাইলে তুমি কার জোরে কার উপরে তা জারী করবে? হে ভাই যুবক! তুমি তো এক রাজা। তোমার রাজত্বে তোমার এমন সার্বভৌমত্ব আছে যে, ঐ রাজ্যের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বাইরের কারো জন্য বৈধ নয়। তুমি পার তোমার রাজ্যকে সোনা দিয়ে মুড়তে। তোমার ঐ রাজ্য থেকে অবিচার, অনাচার, অন্যায়, অত্যাচার, অরাজকতা ও বিভিন্ন দুর্নীতি দূরীভূত করে শান্তিময় ইলাহী শাসন পরিপূর্ণরূপে কায়েম করতে তোমাকে কেউ বাধা প্রদান করতে পারে না।

তুমি পারবে নির্ভয়ে ঘুসবাজি, চাঁদাবাজি, মস্তানি, গুন্ডামি, ভন্ডামি প্রভৃতি অন্যায়ের দ্বার রুদ্ধ করতে। আর এ কাজে তোমার ভোট যাওয়ার ভয় থাকবে না এবং গদি হাত ছাড়া হওয়ারও আশঙ্কা থাকবে না। তুমি যদি তোমার গৃহরাজ্যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পার, তাহলে দেখবে, দেশের রাজাও তার রাজ্যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হচ্ছে। নচেৎ অন্ততঃপক্ষে তোমার রাজ্যকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিতে অবশ্যই আগ্রহী হচ্ছে। কারণ, এতটুকু না করলে তার গদি যে উল্টে গিয়ে নদীতে ভেসে যাবে। হ্যা, তুমি তোমার পরিবার ও গৃহরাজ্যের রাজা। সংসারের সকল ব্যক্তির দায়িত্ব আছে তোমার উপরে। মহানবী সঃ বলেন, “সতর্ক হও! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্বশীলতা প্রসঙ্গে কাল কিয়ামতে কৈফিয়ত দিতে হবে। পুরুষ হল তার সংসারের সকল ব্যক্তির জন্য দায়িত্বশীল। তাকে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে কিয়ামতে জবাবদিহি করতে হবে।---” (আহমাদ, বখারী মুসলিম আবুদাউদ, তিরমিযী সহীহুল জামে’ ৪৫৬৯ নং) সুতরাং পথে-ঘাটে ক্ষিপ্ত কুকুরদের ‘ঘেউ-ঘেউ ভেকানি যদি বন্ধ না-ও করতে পার, তাহলে এতটুকু নিশ্চয়ই পারবে যে, সেই কুকুরদলকে তুমি তোমার গৃহাঙ্গনে প্রবেশ না করতে দিয়ে তোমার পরিবেশকে অন্ততঃ শান্ত রাখবে।

বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষার জন্য যেমন তোমার শিশুদেরকে ভ্যাকসিন বা টিকা দিয়ে থাক, ঠিক তেমনিই এমন বিষাক্ত পরিবেশের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য তাদেরকে প্রতিষেধক ঈমানী ও তরবিয়তী টিকা পূর্ব থেকেই দিয়ে রেখো।

হ্যাঁ, আর অপরের দোহাই দিয়ে এ কথা বলো না যে, কে আর মেনে চলছে?’ অর্থাৎ, সবাই যখন নোংরা, তখন আমিই বা ভালো কেন থাকি? লোকে মানে না, তাই আমিও মেনে চলি না। কিন্তু ভেবে দেখ, তুমি মানবে তোমার সৃষ্টিকর্তাকে, তোমার নিজের ভালাইর জন্য। তুমি কোন মানুষকে ভয় করে, কোন মানুষের খাতিরে ভালো হয়ে চলবে না -এটাই হবে তোমার নিজস্ব স্বকীয়তা ও সবলতার পরিচয়। দুনিয়ার সমস্ত লোক দোযখে গেলে তুমিও কি দোযখে যাবে? দুনিয়ার মানুষ অধিকাংশই কাফের বলে তুমিও কি (নাউযু বিল্লাহ) কুফরী করবে? তুমি কি চাও না মুক্তি? চাও না বেহেশ্‌ত?

হ্যা, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের সামনে এমন যুগ আসছে, যে যুগে আমাদেরকে অপসংস্কৃতির দুর্নিবার তুফানের সম্মুখীন হতে হবে। প্রগতিশীল অবাধ যৌনচারিতার বন্যায় ভেসে যাবে আমাদের নীতি নৈতিকতা। ভেঙ্গে যাবে সকল প্রকার সচ্চরিত্রতার বাঁধ। কিয়ামতের নিদর্শনসমূহের মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, ব্যভিচার ব্যাপক আকারে প্রকাশ পাবে, মহিলার সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশী হবে। একটি মাত্র পুরুষ পঞ্চাশ জন মহিলার দেখাশোনা করবে। (বুখারী মুসলিম, মিফাত ৫৪৩৭ নং বাদ্যযন্ত্র ব্যাপক আকারে দৃষ্ট ও ব্যবহৃত হবে, ব্যাপক আকারে প্রকাশ পাবে নর্তকীদলের মক্ষীরাণীরা। যেমন মদ্যপানকে হালাল মনে করা হবে। {সহীহুল জামে’ ৩৬৬৫ নং) অযোগ্য লোক নেতৃত্ব পাবে। (বুখারী ৬৪৯৬ নং)।

আর এ কথাও প্রায় সকলের বিদিত যে, তেমন উদ্ধৃঙ্খল পরিবেশ পাশ্চাত্যে শুরু হয়ে গেছে বহু দিন আগে থেকেই। যে পরিবেশে ব্যভিচার কোন নোংরা বা মন্দ কাজ নয়; বরং আইন-সম্মত বৈধ কাজ। অবৈধ যৌন-সম্পর্ক ও ফেসানী নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই তাদের। যত মাথা-ব্যথা হল, কুমারী ও কিশোরীদের গর্ভধারণ নিয়ে। সেখানে যৌনতা কোন গোপনীয় বিষয় নয়। সেখানে স্কুলে যৌনতা শিক্ষা দেওয়া হয়। কিশোরীদেরকে ব্যভিচার ও হারাম যৌন-সম্পর্কে জড়িত না হতে উপদেশ দেওয়া হয় না; বরং উপদেশ দেওয়া হয়, যাতে তারা এ সম্পর্কে গর্ভবতী না হয়ে পড়ে। তাই তো কোন চৌদ্দ বছরের মেয়ে যদি যৌনমিলন না করে থাকে, তাহলে তাকে নিয়ে তার সখী ও সহপাঠিনীরা ব্যঙ্গ করে। আমাদের দেশে যেমন পনের-বিশ বছরের কোন তরুণ কলকাতা না দেখে থাকলে বন্ধুরা বলে, এখনো কলকাতা দেখিসনি? তুই এখনো মায়ের পেটে আছি রে!’ অনুরূপ ঐ সব দেশে তের-চৌদ্দ। বছরের কিশোরীকে নিয়ে তার সখীরা আশ্চর্য হয়ে ও ঠাট্টা করে বলে, 'এখনো এ মজা। চাখিসনি? তুই এখনো মায়ের পেটে আছি রে। এর ফলে দুই দিনের ভিতরে সেই কুমারীও অকুমারী হয়ে যায়! এর ছোঁয়া আমাদের পরিবেশে যে লাগেনি তা নয়। বর্তমানে দিল্লী, বোম্বাই, কলকাতা, ঢাকা সহ বড় বড় শহরের পার্কগুলিতে এ যৌন-পরিবেশ বেশ পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন সমুদ্রসৈকতে পরিদৃষ্ট হয় সেই পাশ্চাত্য অসভ্যতার অকপট পূর্ণ অনুকরণ!

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪৬ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 পরের পাতা »