লগইন করুন
যুবকের পথ-বিচ্যুতির কারণ এবং তার জীবনের সমস্যা একাধিক ও বিভিন্ন। যেহেতু যুবক অবস্থায় মানুষের দেহ, চিন্তাশক্তি ও জ্ঞানের অধিকতর ক্রমোন্নতি হয়ে থাকে এবং এই সময়ই তার অভ্যুদয়ের সময়। যাতে তার বিভিন্ন পরিবর্তন ও বিবর্তনের শীঘ্র প্রসার লাভ হয়। তাই এই অবস্থায় সরল পথে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য তার প্রয়োজন হয়, হৃদয়াত্মাকে দমন ও তার ছুটন্ত ঘোড়াকে বগাধীন করার জন্য বিশেষ উপকরণ এবং প্রজ্ঞাময় প্রশিক্ষণ ও পথ প্রদর্শনের।
এই অবস্থায় যুবক বিভিন্ন কারণে পথচ্যুত ও ভ্রষ্ট হয়। তবে এই ভ্রষ্টতার বিশেষ মারাত্মক কারণ সমূহের এক কারণ হল, অবসর ও বেকারী। কর্মহীনতা এক সর্বনাশী ব্যাধি; যা চিন্তাশক্তি, জ্ঞান এবং দৈহিক শক্তিকে ধ্বংস করে। যেহেতু আত্মার জন্য কোন এক প্রকারের বিচরণ বা কর্ম একান্ত জরুরী। কিন্তু তা যদি একেবারেই শূন্য হয় তাহলে চিন্তাশক্তি নিস্তেজ, বুদ্ধি স্কুল এবং আত্মার বিচরণ দুর্বল হয়ে যায়। আর তারপরই কুচিন্তা ও কুমন্ত্রণা অন্তরকে সমাচ্ছন্ন করে ফেলে। কখনো বা এই কর্মহীনতা-জনিত মানসিক পরাজয়ের কারণে মানুষের মনে নানান কবাসনা, কৃকল্পনা ও মন্দ ইচ্ছার জন্ম হয়।
এই সমস্যার সমাধানকল্পে যুবকের উচিত, নিজের জন্য উপযুক্ত কোন কাজ বেছে নিতে চেষ্টা করা, অধ্যয়ন বা অন্য কোন ব্যবসায়ের মাধ্যমে মন ও মস্তিষ্ককে ব্যাপৃত রাখা। যাতে মন্দ কামনা ও কল্পনার পথে বিশেষভাবে বাধা পড়ে। আর এই প্রচেষ্টায় সে সমাজের এক কলস্কহীন অঙ্গ হয়ে জীবন ধারণ করতে পারবে এবং নিজের ও সমাজের জন্য একজন কাজের মানুষ হওয়া অত্যাবশ্যক মনে করবে। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব, ইবনে উসাইমীন ১৬পৃঃ)
পক্ষান্তরে মুসলিমের জন্য কোন এমন এক সময় নেই যাকে ‘অবসর’ বা ‘অবকাশ’ বলা। যায়। যার হৃদয়ে ঈমান ও ইসলাম স্থান পেয়েছে, মালাকুল মওত যাকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য প্রহর গুনছেন, যার সঙ্গে আছেন দুই সম্মানিত ফিরিশ্মা -কিরামান কাতেবীন- যারা তার নেকী-বদী নোট করে যাচ্ছেন। সে ব্যক্তির কোন ফুরসত নেই, যার হৃদয়ে রয়েছে ঈমানের তাকীদ। সে জাতির কোন ফাঁকা সময় থাকতে পারেনা, যে জাতির আছে মহান লক্ষ্য। সে সমাজের জীবনের কোন সময় অবসর নামে অভিহিত হতে পারে না, যে সমাজের সমগ্র জীবনটার নামই ইবাদত। যে জাতি ও সমাজকে তাদের পরোয়ারদেগার বলেন, “আমি মানব ও দানবকে কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াত) সে। মুসলিমের জীবনে অবকাশ বলে কোন বিরতি থাকতে পারে না, যে মুসলিম আল্লাহ বা তদীয় রসুলের একটা না একটা আনুগত্যের মাঝে কালাতিপাত করে।
যার চিন্তা, গবেষণা, পানাহার, নিদ্রা, জাগরণ, ভ্রমণ, বিচরণ, যাওয়া, আসা, প্রভৃতি সবকিছুই ইবাদত। নিয়ত বিশুদ্ধ হলে এবং আনুগত্যের সততা প্রমাণিত হলে মুসলিমের জীবন-মরণ সবটাই ইবাদতে পরিণত হয়। “বল, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সেই মহান আল্লাহ রব্বল আলামীনের জন্য।” (সূরা আনআম ১৬২ আয়াত)। সে বান্দার জীবনে আর খালি সময় কোথায়, যার প্রভু ঘোষণা করেছেন, “অতএব যখন অবসর পাও, তখন পরিশ্রম কর এবং তোমার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ কর।” (সুরা ইনশিরাহ ৭-৮ আয়াত) সে জাতি অবসর আর কোত্থেকে পেতে পারে, যার সারা জীবনটাই হল জিহাদে পরিবেষ্টিত। এই জীবন-সংগ্রামে বিরতি কোথায়? আর বিরতি ও বিশ্রাম নিলে শত্রু (শয়তান ও ধর্মদ্রোহীর) হাত থেকে নিস্তার কোথায়?
সে জাতির আর বিরতির সময় কোথায়, যে জাতি লম্বা সফরে পথ হেঁটে চলেছে? চলেছে। অবিরামভাবে বেহেস্তের পথে, তার সেই প্রথম ও আসল ঠিকানা এবং প্রিয় চিরস্থায়ী আবাসস্থলের দিকে। প্রেমের পরিধি যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, প্রেমের পাত্র যত বেশীই হোক না কেন, আসল ও প্রকৃত প্রেমের টান থাকে সেই প্রথম প্রেমিকের প্রতি। তুলনায় তার তুল্য পরবর্তীকালের আর কেউ অধিক প্রিয় হতে পারে না। মানুষ যত দেশেই যাক, যেখানেই বাস করুক এবং যত সুখেই থাকুক না কেন, তবুও মনের টান থাকে তার সেই প্রথম দেশ, পরিবেশ ও মাতৃভূমির প্রতি মানুষের প্রথম দেশ ও বাসস্থান হল জান্নাত। তাকে ফিরে যেতে হবে তার আপন দেশে।
কিন্তু বিদেশে বের হয়ে সে ডাকাত শয়তানের দলবলের হাতে বন্দী, অথবা তাদের কাছে লুণ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা পদে পদে। তাই তো সন্দেহ হয় যে, সে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে। স্বদেশে ফিরে যেতে পারবে কি না? এমন আশঙ্কাময় পথে বিরতির সময় কোথায়? প্রিয় নবী ৪ বলেন, “যে ব্যক্তি গভীর রাত্রিকে ভয় করে, সে ব্যক্তি যেন সন্ধ্যা রাত্রি থেকেই সফর শুরু করে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যা রাত্রি থেকেই চলতে লাগে সে গন্তব্যস্থলে পৌছে যায়। সাবধান! আল্লাহর পণ্য বড় আক্রা। শোনো! আল্লাহর পণ্য হল জান্নাত।” (সহীহ তিরমিযী ১৯৯৩নং)
সে জাতির জীবনে অবসর কোথায়, যে জাতির জান-মালকে মহান আল্লাহ বেহেস্তের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন? স্বর্ণ-রৌপ্য, মনিমুক্তা, হীরে-কাঞ্চন যাই বলি না কেন, সময়ের তুল্য কোন অন্য মূল্যবান ধাতুর মূল্য নেই। সময়ের সে মূল্য মানুষ সেদিন অনুভব করবে, যেদিন হবে তার জীবনের শেষ দিন। যেদিন সে নিরস্ত ও ক্ষান্ত হয়ে সময় অপচয় করার ভুল বুঝতে পারবে আর বলবে, “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরো কিছু দিনের জন্য অবকাশ দিলে আমি দানখয়রাত করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্গত হতাম। কিন্তু নির্ধারিত কাল উপস্থিত হলে আল্লাহ কাউকে কোন অবকাশ দেন না।” (সূরা মুনাফিকূন ১০-১১ আয়াত) তখন হবে শত আফশোষ; যখন আফশোষ কোন কাজে দেবে না।
তখনই মানুষ সময়ের মূল্য বুঝতে পারবে, যখন “অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে অধোবদন হয়ে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা দেখলাম ও শুনলাম। এখন তুমি আমাদেরকে পুনরায় (পৃথিবীতে পাঠিয়ে দাও, আমরা এবারে সৎকাজ করব, আমার এখন দৃঢ় বিশ্বাসী।” (সূরা সাজদাহ ১২ আয়াত) কিন্তু তখনকার সে বিশ্বাস কোন কাজে দেবে না।
অলস লোকেদের জন্য দিন বড় ভারি জিনিস। রাত্রি এলে খুশীতে এমন লোকেদের মন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটি বছর অতিবাহিত হলে ‘জন্মদিন পালনের আনন্দে মাতোয়ারা হয় বহু বুড়োবুড়িও। অথচ হয়তো তারা ভুলে বসে যে, জীবনের আকাশ হতে তাদের একটি তারা খসে পড়ল। এবং মৃত্যুর দিকে একদিন বা এক বছরের পথ তারা আরো অগ্রসর হল! আর এই ভুলের কারণেই তারা দিন বা বছর শেষে দুঃখ প্রকাশ করে সচেতন না হয়ে আনন্দের সুনিদ্রায় সুষুপ্ত থাকে। পক্ষান্তরে সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। হৃদযন্ত্রের ঘড়ি ধকধক করে বাজতে আছে। যে ঘড়ি মানুষকে সতর্ক করে যেন সর্বদা বলছে, 'ওহে মানুষ! তোমার জীবন তো মাত্র কয়েক মিনিট ও সেকেন্ডের সমষ্টির নাম। সুতরাং সাবধান হও। সে জীবনের কি কোন অবসর থাকতে পারে, যে জীবন সূর্যালোকের নীচে বরফের মত গলে গলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে অথবা আগুনের নীচে মোমবাতির মত দ্রবীভূত হয়ে লয়প্রাপ্ত হচ্ছে।
সুতরাং মুমিনের জন্য অবসর’ হল এক বড় সম্পদ। এ অবসর সময়ের ব্যাপারে উদাসীন হওয়া অথবা এর যথার্থ কদর না করা তার পক্ষে মহাভুল। প্রিয় নবী ও বলেন, “দু'টি নেয়ামত এমন আছে; যার ব্যাপারে বহু মানুষ ধোকার মধ্যে রয়েছে। আর সে দু’টি নেয়ামত হল সুস্থতা ও অবসর।” (বুখারী ৬৪১২, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) অতএব এমন নেয়ামতের ব্যাপারে ভুল করার খেসারত তাকে দিতে হবে। কারণ, “কিয়ামতের দিন কোন বান্দার পদযুগল ততক্ষণ পর্যন্ত সরবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে তার আয়ু প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হবে। যে, সে তা কিসে ক্ষয় করেছে?----” (তিরমিযী, সিলসিলাহ সহীহাহ ৯৪৬নং)
আর এ জন্যই প্রিয় নবী (সা.) উম্মতকে সতর্ক করে বলেন, “পাঁচটি বস্তুকে পাঁচটির পূর্বে গনীমত জেনে মূল্যায়ন করো; বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবনকে, অসুস্থতার পূর্বে তোমার। সুস্থতাকে, দারিদ্রের পূর্বে তোমার ধনবত্তাকে, ব্যস্ততার পুর্বে তোমার অবসরকে এবং মরণের পূর্বে তোমার জীবনকে।” (হাকেম ৪/৩০৬, আহমদ, সহীহুল জামে ১০৭ ৭নং)
উমার বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেন, 'দিবারাত্র তোমার মাঝে নিজ কাজ করে যাচ্ছে। সুতরাং তুমিও তার মাঝে কাজ করে যাও।
সময় নষ্ট করা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যারা, তারাই তো প্রকৃত জ্ঞানী। যে ছাত্র পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হতে চায়, সে কোনদিন সময় নিয়ে অবহেলা করে । হীরের টুকরা কুড়াতে সে যত আলস্য প্রদর্শন করবে ক্ষতি হবে তার তত বেশী। বেকারত্ব ও কর্মবিমুখতা যুবকের জন্য ঔদাস্য সৃষ্টি করে। আর তা যুবতীর জন্য এমন ক্ষতিকর যে, তার মনের গোপনে যৌনানুভুতি সঞ্চারিত করে তোলে।
উমার (রাঃ) বলেন, কোন কোন মানুষকে দেখে আমি বড় পছন্দ করি। অতঃপর খোজ নেওয়ার পর যখন জানতে পারি যে, ওর কোন কাজ-ধান্দা নেই, তখন সে আমার। চোখে ছোট হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, 'আমি তোমাদের কাউকে বেকাররূপে দেখতে অপছন্দ করি; যে ব্যক্তি কোন দুনিয়ার কাজ করে, আর না-ই কোন আখেরাতের কাজ। একথা বড় সত্য যে, যে ব্যক্তি তার জীবনের একটি দিনকে ক্ষয় করে দেয় অথচ সে তার মধ্যে কারো একটি অধিকার প্রদান করতে পারে না, অথবা কোন কর্তব্য পালন করে না, অথবা কোন একটা গৌরব অর্জন করে না, অথবা কোন প্রকার প্রশংসা লাভ করতে পারে না, অথবা কোন কল্যাণ সাধন করতে পারে না, অথবা কোন জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয় না, তাহলে সে ব্যক্তি নিশ্চয়ই সেদিনকার মত নিজের জন্য বড় যালেম প্রতিপন্ন হয়।
জাতি বড় উপকৃত ও লাভবান হত, যদি তার মধ্যে বিভিন্নমুখী উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড উদ্ভব করে জাতির মানুষের খালি ও অবসর সময়কে সুষ্ঠুরূপে কাজে লাগাতে এবং কেবল সৎ ও বৈধ কাজে নিয়ন্ত্রিত রাখতে পারত। কিন্তু হায়! তার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন অবসর-বিনোদন কেন্দ্র, মাধ্যম ও যন্ত্র। ফলে যারা ডুবছিল তাদেরকে আরো ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে অধঃপতনের অতল তলে। যারা ছোট কাজ পেয়ে সামান্য মজুরী উপার্জন করে কিছু খেয়ে কিছু সঞ্চয় করছিল তারাও তাদের অবসর-বিনোদনের জন্য, বরং অনেক সময় কাজ ছেড়ে দিয়ে চিত্তবিনোদনের জন্য সেই উপার্জিত অর্থটুকু এবং সেই সাথে অপর্যাপ্ত সময়ও ব্যয় করে ফেলেছে ঐ সব কেন্দ্রে ও যন্ত্রে। যার ফলশ্রুতিতে বহু মানুষ তাদের দ্বীন হারিয়েছে এবং দুনিয়াও। যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নত যুগে মানুষের শারীরিক পরিশ্রম কম হয়ে গেছে। অবসর ও আরামআয়েশের সময় বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে ক্ষিধেও লাগে কম। কিন্তু খাবার সময় হলেই খেতে হয়। ক্ষুধা না লাগলেও উদরপুর্তি করতে হয়। এতে না খাওয়ায় রুচি থাকে, আর না হজম ঠিকমত হয়। এ জন্য অধিকাংশ লোকের পেট খারাপ হয় এবং বিভিন্ন পেটের রোগও দেখা দেয় এরই কারণে।
অন্য দিকে কাজ না থাকলে বসে থাকতে হয়। বসলে শুতে ইচ্ছে করে। আর রাত্রে সকালসকাল শুলেও তো আর ঘুম আসে না। কারণ দিনে কোন মেহনতের কাজ না করে থাকলে শরীর ক্লান্ত হয়ে চটপট ঘুম আসবে কোত্থেকে? ফলে অনেকেই কয়েক ঘন্টা ধরে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে ছটফট করে। রাত পার হয়ে যাবে এই ভয় মনে থাকলে ঘুম আসতে আরো দেরী হয়। রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে যেমন একটার পর একটা নক্ষত্র ফুটতে থাকে, তেমনি ঘুম না আসা লোকের মনের আকাশে একটার পর একটা চিন্তার তারা ফুটে উঠতে থাকে। দিনের বেলায় তাকে কথায় কে আঘাত দিয়েছে তার চিন্তা, কে তার কথা মানেনি তার অপমান চিন্তা, সংসারের কোন খরচ চিন্তা, কারো ধোকাবাজির চিন্তা, প্রেম। থাকলে প্রেম ও তার সাফল্য বা অসাফল্যের চিন্তা, স্বামী বা স্ত্রী বিদেশে থাকলে সে অন্যের প্রেমে পড়ছে কি না তার চিন্তা, নানা প্রকার সুমধুর যৌনচিন্তা, আরো কত রকম অশুভ চিন্তা, কুচিন্তা ও দুশ্চিন্তা তার মনের দুয়ারে এসে ভিড় জমায়।
আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যাদের কাজ নেই অথবা থাকলেও কম এবং অবসর বেশী, তাদেরকেই মানসিক রোগ অধিক আক্রমণ করে থাকে। আর সে জন্যই যারা যত বিলাসী তারা তত মনের রোগে অধিক পীড়িত। পক্ষান্তরে যারা খেটে খাওয়া পরিশ্রমী মানুষ, যারা সারাদিন কল-কারখানা অথবা ক্ষেতখামারে মেহনত করে তাদেরকে ক্ষুধা লাগে বেশী। তাদের খাবারে সে রকম স্বাদ ও উল্লেখ্য ‘ভ্যারাইটিজ’ না থাকার ফলে স্বল্প আহার করে। আর পেট খালি রেখে খেলে অসুখ-বালা। কম হয়। মামুলী ধরনের খাবার হওয়ার ফলে তাদের হজম ও পরিপাকের কোন ক্ষতি হয়। অতঃপর বিছানায় আসার আগেই তন্দ্রায় তাদের চোখ দুটি ঢুলুঢুলু করে। আর বিছানায় যেতেই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে মৃতপ্রায় হয়ে পরম তৃপ্তি সহকারে রাত্রি যাপন করে। অতএব মুসলিম যুবকের উচিত, নিজেকে কর্মমুক্ত না করা। প্রকারান্তরে কর্মবিমুখ ও শ্রমকাতর হওয়া তো মোটেই উচিত নয়।
সংসারের কাজ না থাকলে সমাজের কাজ তো আছে, তা না থাকলে কোন প্রতিবেশীর কাজ অবশ্যই থাকবে। বসে থাকার চেয়ে বেগাড় যাওয়া তো অনেক ভালো। লোকেও বলে, ‘বেকারের চেয়ে বেগাড় ভালো। মানুষের উপকার করা নিশ্চয় মানবিক কাজ। তা ছাড়া তাও এক প্রকার ইবাদত। মুসলিম ভায়ের সাহায্য করলে, আল্লাহ সাহায্যকারীকে সাহায্য করে থাকেন। আর কোন প্রকার সাংসারিক কাজ না পাওয়া গেলে আখেরাতের কাজ তো আছেই। একটা ইসলামী বই নিয়ে বসা, তসবীহ ও দুআ-দরূদ পাঠ করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, তফসীর ও হাদীস বুঝে পড়া ইত্যাদি বহু কাজ আছে; যা বুঝে করতে পারলে অবসর পাওয়া তো দূরের কথা, হাতে সময়ই পাওয়া যাবে না। আল্লাহর প্রতি ঈমান ও জিহাদের পরবর্তী পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ আমল হল, সব চাইতে ভালো ও দামী ক্রীতদাস মুক্ত করা। কেউ যদি তা না পারে তবে তার জন্য উত্তম কাজ হল, কোন কারিগরের সহযোগিতা করা অথবা যে কারিগর নয় তার কাজ করে দেওয়া। (মুসলিম ৮৪নং)।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, কারিগরকে সহযোগিতা করা যদি উত্তম কাজ হয় তাহলে নিজে কারিগর হওয়াটা কত বড় উত্তম কাজ হতে পারে! ছুতোর, কামার, কুমোর, তাঁতী, ঘরামী প্রভৃতি কারিগরের কারিগরি কাজ কোন জাতের সহিত সম্পৃক্ত ও নির্দিষ্ট নয়। এর প্রত্যেকটাই মুসলিমের গর্বের কাজ। নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মেহনতের বাহুবলে যারা অর্থোপার্জন করে দ্বীন ও দুনিয়া করে তাদের তা নিয়ে গর্ব হওয়া উচিত। তা ছাড়া শুধু কারিগরি কাজই নয়, বরং কাজ যত ছোটই হোক না কেন, তা করতে লেগে যাওয়া উচিত এবং তার সঙ্গে ঐ কাজের মাধ্যমে বড় কিছু করার বা উত্তম। আরো কিছু হওয়ার আশা ও প্রচেষ্টা রাখা অবশ্যই উচিত। ঐ সময় ছোট কাজ করব না’ বলে বা আভিজাত্যে বাধে বলে কোন অনিশ্চিতের আশায় কোন নিশ্চিত কিছুকে ত্যাগ করে বেকারত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে কুঁড়ের জীবন অতিবাহিত করা পুরুষের জন্য একটা বড় মানসিক পরাজয়। পথ ও উপায় বৈধ হলে হালাল রুজী কামিয়ে খাওয়ার মাঝে পুরুষের পৌরুষ লুকিয়ে আছে। অতএব অপেক্ষা কিসের? বড়র আগে ছোটতেই লেগে যাও।
অতঃপর বড় কিছু পাওয়া গেলে তো ভালোই; নচেৎ ছোট থেকেই বড় হওয়ার চেষ্টা কর। নিষ্কর্মা থেকে মা-বাপের ঘাড়ে বোঝা হয়ে বসে থেকো না। সোনার স্বপ্ন দেখে মুক্তার সময় নষ্ট করার চাইতে বাস্তবে কর্মক্ষেত্রে উঠে-পড়ে লেগে গিয়ে সোনার খনি আবিষ্কার করাটাই হল জীবনের মহাজয়।
শোন, আল্লাহর রসূল সঃ কি বলেন; তিনি বলেন, “স্বহস্তে উপার্জন করে যে খায়, তার চেয়ে উত্তম খাদ্য অন্য কেউ ভক্ষণ করে না। আল্লাহর নবী দাউদ (আঃ) স্বহস্তে উপার্জিত খাদ্য ভক্ষণ করতেন।” (বুখারী ২০৭২ নং) “তোমরা যে খাদ্য ভক্ষণ কর তার মধ্যে সব চাইতে উত্তম খাদ্য হল, তোমাদের নিজের হাতে কামাই করা খাদ্য।” (তিরমিযী, নাসাঈ, বাইহাকী সহীহুল জামে' ১৫৬৬ নং) নিরুপায়ে এই শ্রেণীর কাজ করতে যদি তোমার আভিজাত্যে বাধে তাহলে জেনে রেখো যে, সৃষ্টির সেরা মানুষ আম্বিয়াগণও ঐ শ্রেণীর ছোট কাজ করেছেন। প্রত্যেক নবীই ছাগল চড়িয়েছেন। (বুখারী ৩৪০৬নং, মুসলিম) কেউ ছিলেন ছুতোর, কেউ বা কামার। সুতরাং তোমার আভিজাত্য যে আসলে জাতের আভিজাত্য নয়; বরং স্বভাবের কুঁড়েমি ও আলসেমি তা বলাই বাহুল্য।
অতএব যুবক বন্ধু! সংকোচ ও দ্বৈধের সকল জড়তা কাটিয়ে উঠে কাজ শুরু করে দাও। তোমার শিক্ষা ও কোয়ালিফিকেশন’ অনুযায়ী কিছু একটা কর। বেকার বসে থেকে সময় নষ্ট করো না। অলসদের আখড়ায়, তাসের আডড়ায় এবং ভুয়া ফুটানিবাজদের বৈঠকে থেকে নিজেকে শ্রম-বিমুখ কুঁড়ে করে তুলো না। কাজ করে খাও। কাজে গর্ব আছে, আনন্দ আছে। পরিশ্রম কর, পরিশ্রমে সুখ আছে। পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসুতি। যোগ্যতা ও ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও চাকরী না পাওয়া গেলে লোকেরা তাকে ‘বেকার’ বলে।
কিন্তু তুমি নিজেকে ‘বেকার’ বলে পরিচিত করো না। নাই বা হল চাকুরী। হালাল ব্যবসায় নেমে পড়। যতটুকু পুঁজি যোগাড় করতে পার ঠিক তত বড়ই ব্যবসা আল্লাহর নাম নিয়ে খুলে বস। ধীরে ধীরে বড় হও। ছোট্ট দোকানের মাধ্যমেই উন্নতি করতে শিখ। তারই মাঝে দয়াময় আল্লাহর কাছে বর্কত চাও। আর তুমি তো জানই যে, চলে যদি মনোহারী, কি করবে জমিদারী? তবে হ্যা, ব্যবসা চালাবার মত ব্যবহার শিখো, বৈধ কৌশল ও উপায় অবলম্বন করো। তাহলেই দেখবে, অন্যান্যের মত তুমিও চায়ের দোকান খুলে এঁটো কাপ ধুতে ধুতে অথবা সবজী ব্যবসা করতে করতে কখন বিল্ডিং বানিয়ে ফেলেছ।
ব্যবসার মাধ্যমেও তুমি হালাল রুজী উপার্জন করতে পার। এ বিষয়ে প্রিয় রসূল (সা.) বলেছেন, “সর্বাপেক্ষা উত্তম উপার্জন হল সৎ ব্যবসা এবং নিজের হাতের মেহনত।” (আহমদ, সহীহুল জামে ১১২৬নং) সুতরাং চাকুরীর পয়সা থেকেও উত্তম রজী হল, ব্যবসা ও শ্রম দ্বারা উপার্জিত রুজী।
অবশ্য ব্যবসা করলে হালালী পথে করো। ব্যবসায় কোন সময় মিথ্যা বলো না, কথায় কথায় কসম খেয়ো না, নচেৎ লাভের বর্কত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সৎপথে লাভ কম মনে হলেও তাতেই বৰ্কত আছে। হারাম উপার্জনে বর্কত নেই। তাতে ‘নাই-নাই, খাই-খাই, চাই-চাই’ মিটে না। দুআ কবুল হয় না। ভেজাল দিয়ে, ধোকা দিয়ে, দুনম্বরী করে, কালোবাজারী করে, দাড়ি মেরে প্রচুর লাভ করে বিল্ডিং ঠোকা যায় ঠিকই; কিন্তু সেই বিল্ডিং-এ সুখের পায়রা বাসা। বাঁধে না। আর কথায় তো আছে যে, ফাকি দিলে ফাঁকে পড়ে, মারা পয়সা যায় ডাক্তার ঘরে।
সুতরাং 'হঠাৎ বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন ও শক ত্যাগ করা হারামী পথে কোটিপতি না হতে চেয়ে হালালী পথে তুমি তোমার প্রয়োজনীয় রুজী সন্ধান কর। আমাদের প্রিয় নবী বলেন, “রজী সন্ধানের ব্যাপারে জলদিবাজি করো না। পৃথিবীতে কোন বান্দাই তার ভাগ্যে নির্ধারিত সর্বশেষ রুজী অর্জন না করা পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। অতএব আল্লাহকে ভয় কর এবং রুজী সন্ধানে মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন কর। হালাল উপায় গ্রহণ কর এবং হারাম উপায় বর্জন কর।” (হাকেম, বাইহাকী, সহীহুল জামে ৭৩২৩ নং)
তিনি আরো বলেন, “মৃত্যু বান্দাকে যত খুঁজে বেড়ায় তার চাইতে বেশী খুঁজে বেড়ায় তার রুজী।” (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে' ১৬৩০ নং) সুতরাং প্রত্যেক ঘরে তার দরজা দিয়েই প্রবেশ করা হল জ্ঞানী মানুষের কাজ। আর হালাল পথ ও উপায় অবলম্বন করা অবশ্যই মুসলিমের গুণ। নচেৎ একথারও সাক্ষ্য বিদ্যমান রয়েছে যে, “ব্যবসাদার লোকরাই ফাজের (ফাসেক, সত্যত্যাগী ও মিথ্যাবাদী) হয়ে থাকে।” (আহমদ, হাকেম, ত্বাবারানী, সহীহুল জামে ১৫৯৪ নং) আর এ জন্যই লোকেরা বলে, 'মিথ্যা না বললে কি ব্যবসা চলে নাকি? তবে এ শ্রেণীর ব্যবসায়ী হল তারা, যারা সাঝে বড়লোক হতে চায়।
মুসলিমের কিন্তু এ ধরনের অতিলোভী হওয়া উচিত নয়। পরন্তু হারাম উপায়ে কামাই করে যারা ফুলে-ফেঁপে মোটা হয়েছে তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে চোখ টাটানো বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়াও সমীচীন নয়। সুতরাং তুমি সন্তুষ্টচিত্তে চেষ্টা বজায় রাখ, ফল পরোয়ারদেগারের হাতে। আর এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) এর কয়েকটি উপদেশ শোনোঃ তিনি বলেন, “আল্লাহ তাআলা বান্দাকে যা দান করেছেন তার মাধ্যমে তাকে পরীক্ষা করে থাকেন। সুতরাং সে যদি আল্লাহর ভাগ করে দেওয়া ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হয়, তাহলে তিনি তার। ঐ দানে বর্কত (প্রাচুর্য) প্রদান করেন এবং (তার রুযী) আরো প্রশস্ত করে দেন। পক্ষান্তরে সে যদি তা নিয়ে তুষ্ট না হয়, তাহলে তার রুযীতে বৰ্কত বিলীন হয়ে যায় এবং লিখিত রুযী ছাড়া বাড়তি কিছু বৃদ্ধি করা হয় না।” (আহমদ, সহীহুল জামে ১৮৬৯ নং)
“সে ব্যক্তি সফলকাম ও কৃতার্থ হয়েছে, যে ইসলামের হেদায়াত (আলো) পেয়েছে, প্রয়োজন মোতাবেক স্বচ্ছল রুযী পেয়েছে এবং তাতে সে সন্তুষ্টও আছে।” (তাবারানী হায়ে সহীহুল জামে ১১৩৮ নং)
“তোমাদের থেকে যারা নিয়ে তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর এবং তোমাদের থেকে যারা উর্ধে তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করো না। তাহলে হবে এই যে, তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামতকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছজ্ঞান করবে না।” (আহমদ, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে' ১৫০৭ নং)