লগইন করুন
বহু যুবকের ধারণা এই যে, ইসলাম মানেই হচ্ছে পরাধীনতার জীবন। অর্থাৎ, মুসলিমের জীবনে কোন প্রকার স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য নেই। ইসলাম শক্তি ও প্রগতির বিরোধী। এর ফলে তারা ইসলাম থেকে দূরে সরতে থাকে এবং তার নামে অবজ্ঞায় নাক সিঁটকায়। মনে করে ইসলাম এক পশ্চাদগামী ধর্ম। যে তার অবলম্বীদের হাত ধরে পশ্চাৎ ও অবনতির দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে উন্নতি, প্রগতি ও অগ্রগতির পথে বাধা দান করে।
এটি একটি নিছক সন্দেহ ও ভ্রান্ত ধারণা মাত্র এবং ইসলাম-প্রিয় যুবকদের জন্য একটি সমস্যা। এই সমস্যার সমাধানকল্পে ঐ ভ্রষ্ট যুবকদের সম্মুখে ইসলামের প্রকৃত রূপ প্রকাশ হওয়া এবং তার প্রতি আরোপিত অপবাদের আবরণমুক্ত হওয়া উচিত; যারা তাদের ভ্রান্ত ধারণা অথবা স্বল্প জ্ঞান মতে অথবা উভয় মতে ইসলামের আসল চিত্র সম্বন্ধে অজ্ঞাত। আর জানা কথা যে, পীড়া-জনিত কারণে যার মুখ তিক্ত হয়ে আছে তাকে ঐ মুখে সুমিষ্ট পানিও তেঁতো লাগবে। যেমন জলাতঙ্ক রোগের রোগী স্বচ্ছ পানিতেও কুকুর দেখে থাকে।
বাস্তব এই যে, ইসলাম মানুষকে পার্থিব জীবনের সুখ লুটতে বাধা দেয় না। মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে না। অবশ্য জীবনের সীমারেখা নির্ধারিত করে। মানুষের পায়ের বেড়ি দিয়ে পথ চলতে বাধা সৃষ্টি করে না। বরং চলার পথ নির্ধারিত, নির্দিষ্ট ও সীমিত করে। সৎপথে চলতে নির্দেশ দেয় এবং অসৎ পথে চলতে বাধা দান করে। আর এ কথা ধ্রুব সত্য যে, যে পথে সুখ উপভোগ করতে ইসলাম বাধা দেয়, সে পথে আপাতঃদৃষ্টিতে মানুষের সাময়িক সুখ থাকলেও, আসলে কিন্তু সুখ নেই অথবা সে সুখের পর দুঃখ আছে। পক্ষান্তরে ইসলামের নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত পথে আছে পরম ও চরম সুখ এবং তার পরে কোন দুঃখ নেই।
ইসলাম মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতা খর্ব করে না। ইসলাম কোন পরাধীন জীবন অতিবাহিত করতে আহ্বান করে না। অবশ্য স্বেচ্ছাচারিতায় বাধা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যপূর্ণ সুশৃঙ্খলময় জীবন গড়তে আদেশ করে। সকল প্রকার স্বাধীনতাকে সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খলাবদ্ধ করে। স্বাধীনতা যাতে স্বৈরাচারিতা ও উজ্জ্বলতায় বদলে না যায় তার বিশেষ নির্দেশনা দান করে। যাতে সীমা ও শৃঙ্খলহীন স্বাধীনতার জীবনে এক ব্যক্তির স্বাধীনতা অপর ব্যক্তির স্বাধীনতার সাথে সংঘর্ষ না বাধায়। কারণ, যে ব্যক্তি সীমাহীন সর্বপ্রকার স্বাধীনতা চাইবে, নিশ্চয় সে ব্যক্তি অন্যের স্বাধীনতা হরণ ও খর্ব করবে। যেহেতু, তাছাড়া পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ সম্ভবই নয়। পরন্তু তা লাভ করতেই হলে সমগ্র স্বাধীনতার মাঝে সংঘাত সৃষ্টি হবে এবং তারপরই সৃষ্টি হবে নানা বিঘ্ন ও বিশৃঙ্খলা।
অতএব ইসলাম চায়, মানুষের জীবনকে শৃঙ্খলা ও সীমাবদ্ধ করতে। তাই তো মহান আল্লাহ দ্বীনী হুকুম-আহকামকে ‘হুদূদ’ বা সীমারেখা বলে অভিহিত করেছেন। কাজ হারাম হলে বলা হয়েছে, “এগুলি আল্লাহর সীমারেখা, সুতরাং এর ধারে-কাছে যেও না।” (সূরা বাকারাহ ১৮৭ আয়াত) আর ওয়াজেব হলে বলা হয়েছে, “এগুলি আল্লাহর সীমারেখা, অতএব তা তোমরা লংঘন করো না।” (ঐ ২২৯ আয়াত)। বলাই বাহুল্য যে, কিছু লোকের ঐ কল্পিত পরাধীনতা এবং ইসলামের নির্দেশাবলী ও সুশৃঙ্খলতা; যা প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ সৃষ্টিকর্তা তার বান্দাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন উভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে।
অতএব যুবকের মনে এ ধরনের কোন সমস্যা প্রকৃতপক্ষে কোন সমস্যাই নয়। যেহেতু শৃঙ্খলা ও নিয়মধারার অনুবর্তী হয়ে চলা এ বিশ্বের সর্বক্ষেত্রে নিত্য-ঘটিত, স্বাভাবিক ও বাঞ্ছিত ব্যাপার। মানুষও প্রকৃতিগতভাবে এই নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীনস্থ। তাই তো সে ক্ষুৎপিপাসার বশবর্তী এবং পান-ভোজনের মুখাপেক্ষী। নিয়মিত ও পরিমিত পরিমাণে উপযুক্ত গুণসম্পন্ন পানাহার করতে বাধ্য থাকে। যাতে সে নিজের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা করতে পারে। কিন্তু স্বেচ্ছামত চললে অসুস্থতা ও বিভিন্ন ব্যাধির জন্ম হয়। যেমন মানুষ সামাজিক রীতি-নিয়মের অনুবর্তী, স্বদেশী চাল-চলন, আবাস-লেবাস প্রভৃতির অনুরক্ত। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়তের ব্যাপারে পাশপোর্ট-ভিসার নিয়ম, স্বদেশী আইন-কানুন, ট্রাফিক-কানুন প্রভৃতির অনুগত। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা চালালে সমাজে ঘূণ্য হতে হয়, আইন-লংঘনের প্রতিফল ভোগ করতে হয়। পথিমধ্যে বিপদগ্রস্ত হতে হয়।
সুতরাং বিশ্ব-সংসারই নির্ধারিত সীমারেখা ও নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন। আর এর ফলেই বাঞ্ছিত মতে সকলের জীবন ও কাজকর্ম চলে। অতএব সামাজিক কল্যাণ লাভ করতে এবং বিশৃঙ্খলা ও বিঘ্ন দুর করতে সকল মানুষের জন্য মানব-রচিত সামাজিক রীতি-নীতির বাধ্য থাকা যদি জরুরী হয়, তাহলে অনুরূপভাবে উম্মাহর কল্যাণের জন্য এবং সার্বিক মঙ্গল আনয়নের জন্য সকল মানুষের পক্ষে স্রষ্টার প্রেরিত শরীয়তের বিধি-বিধান ও নিয়ম-নীতির অনুবর্তী হওয়া একান্ত জরুরী। তবে কেন ও কি ভেবে কিছু মানুষ এ শাশ্বত নিয়ম-শৃঙ্খলাকে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করে এবং তা মানুষের জন্য পরাধীনতা বলে মনে করে? নিশ্চয় তা প্রকাশ্য অপবাদ এবং ভ্রান্ত ও পাপময় ধারণা ছাড়া কিছু নয়। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব, ইবনে উসাইমীন ২০-২২পৃঃ)
এ জগতে একমাত্র পাগলেরই আছে পূর্ণ স্বাধীনতা, সেই কেবল যাচ্ছে তাই করে বেড়াতে পারে। অবশ্য সে স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক সময় গলা-ধাক্কাও খেয়ে থাকে। প্রকৃত প্রস্তাবে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা এ পৃথিবীর কারো নেই। প্রত্যেকে কোন না কোন নিয়মের পরাধীন অবশ্যই থাকে। তা না হলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। প্রত্যেক জিনিসের পশ্চাতে একটা না একটা বাধন আছে, নিয়ন্ত্রণ জোড়া আছে। নচেৎ, বিপদ অনিবার্য। আগুন, পানি, বাতাস, খাদ্য, যাই বল না কেন, সবকিছুর ব্যবহার বিধি নিয়ন্ত্রিত। ঘোড়ার লাগাম না থাকলে বা গাড়ির ব্রেক না থাকলে ঘোড়া বা গাড়ি কি ঠিক মত ঈপ্সিত পথে চলে থাকে, না কেউ চালাতে পারে? মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা-গবেষণাও অনুরূপ নিয়ন্ত্রিত। ষড়রিপুর নাকেও দড়ি দেওয়া আছে। তা না হলে পৃথিবীতে কেউ শান্তিতে বাস করতে পেত না। মানুষ। মানুষরূপে বাস করতে পারত না; বরং পশুর চাইতেও অধম হয়ে নিজ নিজ স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে আপোসে লড়ে ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব প্রত্যেক বস্তুর নিয়ন্ত্রিত দিকটাই ভালো। শৃঙ্খলিত সবকিছুই মানুষের ঈপ্সিত।
উদ্ধৃঙ্খলতা সভ্য সমাজ পছন্দ করতে পারে না। কেউ চায় না নিয়ন্ত্রণহারা পানি বা বন্যার অদম্য গতি। কেউ চায় না আগুন তার রান্নাঘর থেকে আয়ত্তের বাইরে চলে যাক।
কলেজ থেকে ফিরার পথে বেসামাল ড্রেসে চামেলী বাসায় ফিরছিল। এমন বেসামাল পোশাকে আবেদনময়ী ভঙ্গিমায় চলাতে তার স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এক দল যুবক তার সে মস্তানা চলন দেখে তার উপর হামলা করে তার রাঙা যৌবন লুটে নিল। ধর্ষিতা ও খুন হল চামেলী দুর্ধর্ষ যুবকদলের হাতে। অবশ্য যুবকদলেরও এতে স্বাধীনতা ছিল। অন্যায়ভাবে অবৈধ উপায়ে অর্থ সঞ্চয় করাতে তোমার-আমার স্বাধীনতা আছে। তেমনি ডাকাতেরও স্বাধীনতা আছে ডাকাতি করার। চোরেরও স্বাধীনতা আছে বিনা বাধায় চুরি করার। গাড়িওয়ালার স্বাধীনতা আছে, সে যেদিকে খুশী সেদিকে চালাতে পারে। যখন ইচ্ছা তখন বায়ে অথবা ডাইনে সাইড নিতে পারে। এতে কার কি বলার থাকতে পারে? স্বামীর স্বাধীনতা আছে ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ রাখার, তেমনি স্ত্রীরও স্বাধীনতা আছে বয় ফ্রেন্ড’ ব্যবহার করার। কোন কোন রাত্রি যদি স্ত্রী বাসায় বাস না করে তার সে বন্ধুর বাসায় বাস করে, তবে তাতে স্বামীর প্রতিবাদের কি আছে? আশা করি এমন স্বাধীনতাকে কোন জ্ঞানী মানুষই বিশ্বাস ও সমর্থন করবে না। যে স্বাধীনতা অপরের স্বাধীনতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, সে স্বাধীনতা হল স্বেচ্ছাচারিতা ও মহা অপরাধ। সংঘর্ষহীন বগাধীন স্বাধীনতা শান্তিকামী মনুষ্য সমাজের অভিপ্রেত বস্তু।
অতএব বাক-স্বাধীনতার অর্থ যা ইচ্ছে তাই বলা নয়, তারও নিয়ন্ত্রণ-সীমা আছে। ন্যায়অন্যায়ের মানদন্ড আছে।
ব্যক্তি-স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এতেও ন্যায়-অন্যায়, পরোপকার, অপরের লাভ-ক্ষতি ও স্বাধীনতার কথাও খেয়াল রাখা জরুরী। মতামতের স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যে যা ইচ্ছা তাই মন্তব্য করবে। বিনা দলীলে যা মন তাই মনগড়া মত প্রকাশ করবে এবং ন্যায়কে অন্যায় বা তার বিপরীত প্রমাণ করার জন্য বিষাক্ত কলম ব্যবহার করবে।
এ বিশ্ব আল্লাহর। তিনিই বিশেষ অনুগ্রহে আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আমরা তারই আজ্ঞাবহ দাস। অতএব প্রভুর কাছে দাসের স্বাধীনতা আবার কি? সকল ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ। মানুষের হাতে আর কতটুক ক্ষমতা আছে? আর পূর্ণ ক্ষমতা না থাকলে কি স্বাধীন হওয়া যায়?
পরিশেষে এ বিষয়ে একটি মূল্যবান উপদেশ শোন। একদা এক ব্যক্তি ইবরাহীম বিন আদহাম (রঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আবু ইসহাক? আমি বড় গোনাহগার। অতএব আমাকে কিছু নসীহত করুন; যাতে আমি গোনাহ থেকে বিরত হতে পারি।
আবু ইসহাক (ইবরাহীম) বললেন, 'যদি তুমি পঁাচটি উপদেশ গ্রহণ কর এবং তদনুযায়ী আমল কর, তাহলে গোনাহ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। লোকটি বলল, বলুন। ইবরাহীম বললেন, 'প্রথম এই যে, আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করলে তুমি তার রুযী খেয়ো না।' লোকটি বলল, তাহলে খাব কি? দুনিয়াতে সবকিছুই তো তারই দেওয়া রুযী! বললেন, 'ওহে আল্লাহর বান্দা! তুমি তার রুযী খাবে, অথচ তার অবাধ্যাচরণ করবে। এটা কি তোমার বিবেকে ভালো মনে হবে। বলল, 'অবশ্যই না। দ্বিতীয় কি বলুন। বললেন, 'যদি তুমি তার অবাধ্যাচরণ করতেই চাও তাহলে খবরদার তাঁর রাজত্বে বাস করো না।” বলল, এটা তো বিরাট মুশকিল। তাহলে বাস করব কোথায়? বললেন, 'ওহে আল্লাহর বান্দা! তুমি তার রুযী খাবে, তাঁর রাজত্বে বাস করবে, অথচ তার নাফরমানী করবে, এটা কি তোমার উচিত হবে?” বলল, অবশ্যই না। তৃতীয় কি বলুন। বললেন, 'তার রুযী খেয়ে তাঁর রাজত্বে বাস করেও যদি তার নাফরমানী করতে চাও, তাহলে এমন জায়গায় করো, যেখানে তিনি তোমাকে দেখতে পাবেন না।'
বলল, হে ইবরাহীম! তা কি করে সম্ভব? তিনি তো আমাদের মনের গোপন খবরও জানেন! বললেন, তাহলে তার রযী খেয়ে, তাঁর রাজত্বে বসবাস করে, তার দৃষ্টির সামনে তুমি তার অবাধ্যাচরণ করবে এবং তার জ্ঞানায়ত্তে থেকেও পাপাচরণ করবে, এতে কি তোমার লজ্জা হবে না? বলল, 'অবশ্যই। চতুর্থ কি বলুন। বললেন, 'মালাকুল মওত যখন তোমার জান কবজ করতে আসবেন, তখন তাঁকে তুমি বলো যে, (আমি স্বাধীন। আমি মরব না অথবা) আমাকে আর ক'টা দিন সময় দিন যাতে আমি খালেস তওবা করে নিয়ে ভালো কাজ করে নিতে পারি। বলল, তিনি তো আমার এ অনুরোধ মেনে নেবেন না। বললেন, 'ওহে আল্লাহর বান্দা! তাহলে তওবা করার জন্য যদি তুমি মরণকে বাধা দিতে পার, আর তুমি জান যে, মৃত্যু এসে গেলে আর ক্ষণকালও দেরী করা হবে না, তাহলে। মুক্তির আশা কিরূপে করতে পার? বলল, 'পঞ্চমটা বলুন। বললেন, কিয়ামতের দিন দোযখের প্রহরিগণ যখন তোমাকে দোযখে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসে উপস্থিত হবেন, তখন তুমি তাদের সাথে যেও না। বলল, তারা তো আমাকে ছেড়ে দেবেন না। আমার সে আবেদন তারা মানবেন না। বললেন, তাহলে নাজাতের আশা কেমন করে করতে পার? বলল, হে ইবরাহীম! যথেষ্ট, যথেষ্ট। আমি এক্ষনি আল্লাহর নিকট তওবা করছি এবং কৃতপাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
হ্যাঁ, মানুষ সর্ববিষয়ে স্বাধীন নয়। মানুষ তো দাস। মহান স্রষ্টা আল্লাহর দাস। আর এ দাসত্বে আছে তার পরম আনন্দ। এ পরাধীনতায় আছে প্রেমের সুমধুর স্বাদ। প্রেম তো পরাধীনতারই এক নাম। তদনুরূপ ইসলাম প্রগতি ও বিজ্ঞান বিরোধী নয়। বরং ইসলাম সভ্যতা, সংস্কৃতি, চিন্তা, জ্ঞান, গবেষণা, সুস্বাস্থ্য প্রভৃতি সার্বিক প্রগতি ও শক্তির প্রশস্ত ময়দান।
ইসলাম মানুষকে চিন্তা ও গবেষণা করতে আহ্বান করে। যাতে সে উপদেশ গ্রহণ করে ভালো-মন্দ নির্ণয় করতে পারে এবং নিজ জ্ঞানের পরিসর বৃদ্ধি করতে পারে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, “বল, আমি তোমাদেরকে একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি; তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু’জন করে অথবা একা একা দাড়াও, অতঃপর চিন্তা কর-------।” (কুঃ ৩৪/৪৬) “বল, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার প্রতি লক্ষ্য কর----” (কুঃ ১০/১০১)। চিন্তা ও গবেষণা করার প্রতি মানুষকে আহ্বান করেই ইসলাম ক্ষান্ত নয়। বরং যারা জ্ঞানগবেষণা ও চিন্তা করে না তাদের প্রতি আক্ষেপ ও নিন্দাবাদ করে।
মহান আল্লাহ বলেন, “তারা কি লক্ষ্য (গবেষণা) করে না আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের প্রতি এবং আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি----।” (কুঃ ৭/ ১৮৫) “ওরা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না (চিন্তা করে না) যে, আল্লাহ আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও ওদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু যথাযথভাবেই সৃষ্টি করেছেন।” (কুঃ ৩০/৮) “আমি যাকে দীর্ঘ জীবন দান করি তাকে তো জরাগ্রস্ত করে দিই, তবুও কি ওরা জ্ঞান করে না?” (কুঃ ৬/৬৮)।
ইসলামের এই চিন্তা ও জ্ঞান-গবেষণা করতে আদেশ দেওয়ার অর্থই হল, জ্ঞান ও চিন্তাশক্তির দ্বার উন্মুক্ত করা। অতএব তারা কি করে বলে যে, ইসলামে বিভিন্ন শক্তির অবক্ষয় ঘটে। তাদের মুখ-নিঃসৃত বাক্য কি উদ্ভট! তারা কেবল মিথ্যাই বলে।”
ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য তাদের ঈমান, জান, মান, জ্ঞান ও ধনের পক্ষে অহিতকর বা ক্ষতিকর নয় এমন সকল প্রকার সম্ভোগকে বৈধ করেছে। তাই সমস্ত উত্তম ও উপাদেয় খাদ্য-পানীয়কে হালাল করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা থেকে পবিত্র বস্তু আহার কর এবং আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর----” (কুঃ ২/১৭২) “---এবং তোমরা পানাহার কর, আর অপচয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।” (কুঃ ৭৭/৩১) প্রজ্ঞা ও প্রকৃতি অনুসারে সমস্ত পরিচ্ছদ ও সৌন্দর্যকে বৈধ করেছেন। তিনি বলেন, “হে আদম সন্তান দল! তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদের উপর পরিচ্ছদ অবতীর্ণ করেছি। আর তাকওয়া’ (সংযমতা)র পরিচ্ছদই সর্বোৎকৃষ্ট।” (কুঃ ৭/২৬) “বল, বান্দাদের জন্য আল্লাহর সৃষ্ট সৌন্দর্য এবং উত্তম জীবিকা কে হারাম (নিষিদ্ধ) করেছে? বল, পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে এ সমস্ত তাদের জন্য, যারা ঈমান এনেছে।” (কুঃ ৭/৩২) আর মহানবী ৪ বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। তিনি তার দেওয়া নেয়ামতের চিহ্ন বান্দার দেহে দেখা যাক, তা পছন্দ করেন।” (সহীহুল জামে ১৭৪২ নং)
বিধিসম্মত বিবাহ-বন্ধনের মাধ্যমে তিনি যৌন-সভোগও বৈধ করেছেন। তিনি বলেন, “--তবে বিবাহ কর (স্বাধীনা) নারীদের মধ্য হতে যাকে তোমাদের ভালো লাগে; দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশঙ্কা কর যে, (তাদের মধ্যে) সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে----” (কুঃ ৪/৩)।
ব্যবসা ও অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম তার অনুসারীদের অগ্রগতিকে গতিহীন করতে চায়নি। বরং তাদের জন্য সর্বপ্রকার অনুমতিপ্রাপ্ত হালাল ও ইনসাফপূর্ণ বাণিজ্য ও
অর্থোপার্জনকে বৈধ ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, “---অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে অবৈধ করেছেন।” (কঃ২/২৭৫) “তিনি তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে। দিয়েছেন, অতএব তোমরা দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার প্রদত্ত জীবনোপকরণ হতে আহার্য গ্রহণ কর, আর তারই প্রতি (সকলের) পুনরুত্থান।” (কুঃ ৬৭/১৫) “অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর----” (কুঃ ৬২/১০)। সুতরাং এর পরেও কি কিছু মানুষের এই ধারণা রাখা সঠিক যে, ইসলাম শক্তি অর্জন, প্রগতি ও উন্নয়নের পথে বাধা দেয়? (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব ২২-২৫পৃঃ)।
আজ বহু যুবকের মনে এ প্রশ্ন বারংবার উকি মারে যে, মুসলিম শ্রেষ্ঠ জাতি হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা সর্ববিষয়ে উন্নত নয় কেন? কেন পার্থিব ধন-সম্পদ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথে তারা বহু পিছিয়ে রয়েছে?
প্রথমতঃ আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, জাতির হাতে যে অর্থভান্ডার কম আছে তা নয়। আর্থিক দিক দিয়ে এ জাতি পিছিয়ে নেই। অবশ্য অর্থ যথার্থভাবে ব্যয় করার পথে এরা পিছিয়ে আছে। অর্থ যাদের হাতে আছে তারা জাতির উন্নয়নের কাজে তা যথাযথ ব্যয় করার পরিবর্তে নিজেদের বিলাস-ব্যসনে অধিক ব্যয় করেছে। বিভিন্ন স্মৃতি-বিজড়িত বিলাস-ভবন নির্মাণ করেছে, কিন্তু কোন উন্নয়নমুলক জ্ঞান-ভবন নির্মাণ করেনি। যারা করেছে তারা যথেষ্ট আকারে তা করেনি। প্রয়োজনের তুলনায় সে ব্যয় ছিল নেহাতই কম। তাছাড়া মুসলিম দুনিয়া হারিয়েছে বহু শাসকের দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে অধিক মত্ত হওয়ার ফলে। নিজেদের অবজ্ঞা ও অবহেলাবশে, গৃহযুদ্ধ ও আত্মকলহের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ার কারণে শুধু দুনিয়াই নয়; বরং অমূল্য ধন দ্বীনও হারিয়েছে। কত তাতার, কত হালাকু, কত চেঙ্গিজ এসে এ জাতির বুকে অত্যাচারের রুলার চালিয়েছে। কত শত জ্ঞান-বিজ্ঞানের অমূল্য ভান্ডার ভাসিয়ে দিয়েছে দিজলা নদীর পানিতে। জাতির অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করে দিয়ে কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে মুসলিমদের। শাসকদল অবহেলা ও ঔদাস্যের শিকার হয়ে নিজেদের রাজ্য তুলে দিয়েছে অত্যাচারী ও আগ্রাসী ঔপনিবেশিকদের হাতে। মুসলিম ধীরে-ধীরে। শিকার হয়ে পড়েছে হীনম্মন্যতার। পক্ষান্তরে সরে পড়েছে নিজ জীবন-ব্যবস্থা থেকে বহু দূরে।
অন্যান্য জাতি অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের কোন তমীজ করেনি; বরং তারা হালাল-হারাম তো চেনেই না। তারা শোষণ ও জুলুমবাজির কোন বাধাই মানেনি। বিশেষতঃ সুদী-কারবারের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করে দুনিয়া নিজেদের মনমত গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু মুসলিম তা পারেনি; আর পারেও না তা করতে।
পারে না সুদী কোন কারবার বা ব্যাংক চালাতে।
পারে না বর্তমানের অর্থনৈতিক সবচেয়ে সহজ উপায় হিসাবে ব্যাংকের সুদ নিতে।
পারে না কোন সুদী ব্যাংকে চাকুরী করতে।
পারে না কোন মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করতে।
পারে না কোন মদ্যশালা চালাতে।
পারে না কোন ফিল্ম-ইন্ডাষ্ট্রী চালাতে।
পারে না কোন সিনেমা হল চালাতে।
পারে না কোন নৃত্যশালা চালাতে।
পারে না কোন যাত্রা, থিয়েটার ও নাট্য-কোম্পানী চালাতে।
পারে না কোন গানবাদ্যের অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে।
পারে না কোন বেশ্যাখানার মালিক হতে।
পারে না কোন ফিল্ম ও গান-বাজনার যন্ত্র বা ক্যাসেট-ব্যবসা করতে।
পারে না কোন সেলুন খুলে দাড়ি উঁছতে।
পারে না ভেজাল দিয়ে কোন দ্রব্য বিক্রয় করতে।
পারে না শরীয়তে নিষিদ্ধ কোন প্রকার ব্যবসা করতে।
পরন্তু হালাল পথ বেছে নিয়ে জাগতিক উন্নয়ন সাধনের সংগ্রামও তারা করেনি। তাদের। জীবন-সংবিধানের প্রদর্শিত পথে চলতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারা ভুলে বসেছে যে, “যে কেউ দুনিয়ার কল্যাণ কামনা করবে, তার জেনে রাখা প্রয়োজন যে, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ আল্লাহরই নিকট রয়েছে।” (সূরা নিসা ১৩৪) তারা জানে না যে, “যারা মু'মিনদেরকে বর্জন করে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নেয়, তারা কি তাদের কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে? যাবতীয় সম্মান তো শুধুমাত্র আল্লাহরই।” (ঐ ১৩৯ আয়াত) “কেউ মান-সম্মান চাইলে সে জেনে রাখুক যে, সকল প্রকার সম্মান আল্লাহরই জন্য।” (সূরা ফাত্বির ৩৫) “ঈমান এনে পুরুষ বা নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করে, তাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করে থাকি এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করি।” (সূরা নাহল ৯৭ আয়াত) মান-সম্মান, উন্নয়ন-প্রগতি এবং যাবতীয় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর বিধান ছেড়ে অন্যের কাছে সম্মান ও উন্নয়ন খুঁজতে গিয়ে মুসলিম আজ যথাসর্বস্ব হারিয়ে বসেছে। হযরত উমার : বলেছেন, 'আমরা সেই জাতি, যে জাতিকে আল্লাহ ইসলাম দিয়ে সুসম্মানিত করেছেন। কিন্তু যখনই আমরা ইসলাম ছেড়ে অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্মান অন্বেষণ করব, তখনই তিনি আমাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।