সকালের শুভ্র জ্যোতি তো অপেক্ষা করছিল মুসলিমদের জন্য তাদের অলক্ষ্যে। কিন্তু মুসলিম ছিল বিভোর নিদ্রায় বেহুশ। চক্ষু মুদে পড়ে ছিল এবং আজও সেই অবস্থাতেই আছে। আর “আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে।” (সূরা রা’দ ১০) পক্ষান্তরে ধনবত্তা ও পার্থিব উন্নয়ন মানুষের জন্য বাঞ্ছিত মর্যাদা নয়। তা যদি হত তাহলে আম্বিয়াগণই এ জগতে সবার চেয়ে বেশী ধনবানরূপে খ্যাত হতেন। কিন্তু পার্থিব জীবন হল ক্ষণস্থায়ী। এ পৃথিবী আমাদের আসল ঠিকানা নয়, এ ঘর-বাড়ি আমাদের আসল ঘর-বাড়ি নয়। আসল ঠিকানা ও ঘর-বাড়ি হল পরকাল। আর ইহকাল হল পরকালের ক্ষেতস্বরূপ। এই ক্ষেতে আমাদেরকে তৈরী করতে হবে আখেরাতের সুখময় জীবনের ফসল। পার্থিব সম্পদ বেশী পেলাম চাহে কম, অথবা না-ই পেলাম তাতে মুসলিমের দুঃখ হওয়া উচিত নয়। কাফেরদের বিভব ও ঐশ্বর্য দেখে নিজেকে হেয় মনে করা উচিত নয়। উচিত হল, পরকালের জীবন ধ্বংস হলে দুঃখ ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়া। কারণ, আসল ক্ষতি হল এটাই। আল্লাহ তাআলা বলেন, “বল (হে নবী!) তারাই হল আসল ক্ষতিগ্রস্ত, যারা কিয়ামতের দিন নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্তরূপে পাবে এবং পরিবারবর্গ হারাবে। আর জেনে রেখো, এটাই হল সুস্পষ্ট ক্ষতি। তাদের জন্য উপর দিক থেকে এবং নীচের দিক থেকে আগুনের মেঘমালা। থাকবে।” (সূরা যুমার ১৫- ১৬ আয়াত)
কোন এক ওস্তায তার হালকার ছাত্রদের মাঝে কিছু বই বিতরণ করলেন। কিছু বই ছিল বড় ও মোটা আকৃতির। কিছু ছিল মাঝারি এবং কিছু পাতলা আকৃতির ছোট বই। ছাত্রদের মধ্যে যারা মোটা বই পেয়েছিল তারা বড় আনন্দিত ও গর্বিত হল। যারা ছোট বই পেয়েছিল। তাদের ঐ সামান্য ক’ পাতার বই দেখে মনঃক্ষুন্ন ও দুঃখিত হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। তারা কামনা করেছিল, যদি তারাও ওদের মত মোটা ও দামী বই পেত, তাহলে তারাও ধন্য হত। কিন্তু কিছুদিন পর ওস্তায় যখন ঘোষণা করলেন যে, তিনি যে বই সকলকে বিতরণ করেছেন, সেই বই থেকেই প্রত্যেকের কাছ থেকে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এই ঘোষণা শোনার পর যারা ছোট বই পেয়েছিল তারা নিতান্ত খুশী হল। কারণ, ক’ পাতা পড়ে পরীক্ষা দেওয়া ছিল খুবই সহজ। আর যারা মোটা বই পেয়ে মনে মনে গর্বিত ছিল তারাই হল ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ, এত মোটা বই পড়ে পরীক্ষা দেওয়াটা মোটেই সহজ ছিল না। পরন্তু তাতে ফেল হওয়ার আশঙ্কাই ছিল অধিক। বলা বাহুল্য, মুসলিমের পার্থিব এ স্বল্প সম্পদ হল পরীক্ষার বস্তু। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো পরীক্ষার বস্তু এবং আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য মহাপুরস্কার আছে।” (সূরা তাগাবুন ১৫)
সুতরাং পরীক্ষার এ ধন কম পেয়ে মুসলিমের দুঃখ হওয়া উচিত নয়; বরং খুশী হওয়াই উচিত।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, “ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য, আর সৎকর্ম -যার ফল স্থায়ী- তা তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশা-আকাঙ্খার ব্যাপারেও উৎকৃষ্ট।” (সূরা কাহফ ৪৬) “কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ পরকালই হল উৎকৃষ্টতর এবং চিরস্থায়ী।” (সূরা আল ১৬-১৭)
এ জন্যই অস্থায়ী পৃথিবীর বিলাসময় জীবনের বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করা মুসলিমের জন্য মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় ও ফরয হল তার সেই জ্ঞান শিক্ষা করা, যদ্বারা পরকালে চিরসুখ লাভ হয় এবং যা না শিখলে চিরদিন (মরণের পর) কষ্ট ভোগ করতে হয়।
যেখানে যতদিন বাস করতে হবে সেখানকার জন্য ঠিক ততদিনকার মত প্রস্তুতি ও সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ করে নেওয়া জ্ঞানীর কর্তব্য। আমার আসল দেশ ভারত। সউদী আরবে আমি ভাড়ার ফ্লাটে বাস করি। এখানে ক্ষণস্থায়ী চাকুরী করি। আজ আছি, কাল নেই। আমি যে বেতন পাই তার অর্থ দ্বারা সউদিয়ার ঐ ফ্লাটকে অধিক সুসজ্জিত করব, নাকি আমার মাতৃভূমি ও স্থায়ী ঠিকানা ভারতের বাসাকে আমরণ বাস করার জন্য সেই অর্থ ব্যয় করে সুনির্মিত করব? জ্ঞানীরা নিশ্চয়ই পরামর্শ দেবেন যে, যে বাড়িতে আপনি ক্ষণকালের জন্য আছেন, সে বাড়িকে সাজিয়ে আপনার পয়সা খরচ করবেন কেন? এখানে তো আর নাগরিকতা পাবেন না। যে দেশের আপনি নাগরিক, সে দেশেই বরং একটা সুন্দর দেখে বাসা তৈরী করে ফেলুন। সেখানে আপনি মরার পরেও আপনার ছেলেরা বাস করতে পারবে। দুনিয়া আমাদের আসল ঠিকানা নয়, পার্থিব সুখ আসল সুখ নয়, জাগতিক উন্নতি প্রকৃত
উন্নতি নয় এবং দুনিয়ার মায়ার সাগরে ডুবে যাওয়া ভালো নয় বলেই সেই ব্যক্তি অধিক সফলকাম, যে দুনিয়াদার নয়। “যে মানুষ দুনিয়াকে ভালোবাসতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার প্রতি সদয় হয়ে তাকে দুনিয়াদারী থেকে ঠিক সেইরূপ বাঁচিয়ে নেন; যেরূপ রোগী ব্যক্তিকে ক্ষতিকর পানাহার থেকে সাবধানে রাখা হয়।” (আহমদ, হাকেম, সহীহুল জামে' ১৮১৪নং)
আর সে জন্যই মুমিন বান্দার জন্য আল্লাহর রসূল সঃ এর খাস দুআ ছিল, “হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি তোমার প্রতি ঈমান এনেছে এবং আমি তোমার রসুল বলে সাক্ষ্য দিয়েছে তার জন্য তুমি তোমার সাক্ষাৎ লাভকে প্রিয় কর, তোমার তকদীর তার হক্কে সুপ্রসন্ন কর এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাস তাকে অল্প প্রদান কর। আর যে ব্যক্তি তোমার প্রতি ঈমান রাখে না। এবং আমি তোমার রসূল বলে সাক্ষ্য দেয় না, তার জন্য তোমার সাক্ষাৎ-লাভকে প্রিয় করো, তোমার তকদীরকে তার হক্কে সুপ্রসন্ন করো না এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাস তাকে বেশী। বেশী প্রদান কর।” (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে ১৩১১ নং)
সুতরাং আল্লাহর প্রিয় বান্দারা যে পার্থিব ভোগ-বিলাসপূর্ণ জীবন লাভ করবে না, তা বলাই বাহুল্য। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তারা পৃথিবীতে আমরণ দুঃখ-কষ্ট্রে বাস করবে এবং অপরের হাতে পড়ে পড়ে মার খেতে থাকবে। বরং প্রকৃত ঈমান থাকলে তার বলে মু’মিন এ পৃথিবীতে সর্বোপরি মর্যাদা লাভ করতে পারবে। কোন সময়ে অনাহার-উপবাস ও অসুখবিসুখের সম্মুখীন হলেও অল্পে তুষ্টি এবং অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের অভ্যাস তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেয় না। তাছাড়া তার এ বিশ্বাস থাকে যে, এ অভাব-অনটন ও অসুস্থতার বিনিময়ে পরকালে মহাপ্রতিদান ও চিরস্থায়ী সম্পদ ও সুখ লাভ করবে। পরকালে ইচ্ছা-সুখের বিলাস-রাজ্য পাব’ এই পরম বিশ্বাস তার মনে সান্ত্বনা ও শান্তি এনে দেয়। আর তাই সুখরূপে তার জীবনে চরম আনন্দ ও তৃপ্তি দান করে থাকে।
দুনিয়ার ভোগ-বিলাস মুমিনের কাম্য নয়। দুনিয়াদারীর ফাঁদে আটকে পড়া জ্ঞানী মুসলিমের কাজ নয়। দুনিয়া তো এক সরাইখানা। এ দুনিয়ার ভরসা কোথায়? দুনিয়া তো মেঘের ছায়া, নিদ্রিতের স্বপ্ন, বিষ-মাখা মধু, সুসজ্জিতা ও সুরভিতা বিষকন্যা। দুনিয়া হল পাপের ধরাধাম, বঞ্চনা ও অভিশাপময় শয্যাগৃহ।
পাপের পঙ্কে পুণ্য-পদ্ম, ফুলে ফুলে হেথা পাপ,
সুন্দর এই ধরা-ভরা শুধু বঞ্চনা অভিশাপ।
সে দুনিয়ার জন্য দুঃখ কিসের, যে দুনিয়ার কোন মূল্যই নেই। “আল্লাহর দৃষ্টিতে একটি মশা পরিমাণও যদি দুনিয়ার মূল্য মান থাকত তাহলে কোন কাফের দুনিয়ার এক ঢোক পানিও পান করতে পেত না।” (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ৫১৭ ৭ নং)
আখেরাতের জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবন হল সমুদ্রের পানির তুলনায় তাতে আঙ্গুল ডুবিয়ে ঐ আঙ্গুলে লেগে থাকা পানির মত সামান্য ও তুচ্ছ। (মুসলিম, মিশকাত ৫১৫৬ নং)
আল্লাহর নিকট দুনিয়া একটি কানকাটা মৃত ছাগল-ছানার চাইতেও অধিক নিকৃষ্টতর। (মুসলিম, মিশকাত ৫১৫৭ নং)
দুনিয়া মুসলিমদের জন্য কারাগার স্বরূপ। আর কাফেরদের জন্য বেহেশ্ব স্বরূপ। (মুসলিম, মিশকাত ৫ ১৫৮ নং)
দুনিয়া অভিশপ্ত। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ মিশকাত ৫১৭৬ নং) দুনিয়া একটি ছায়াদার গাছের মত। (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ৫১৮৮ নং) দুনিয়া মানুষের কর্মক্ষেত্র। আর আখেরাত হল হিসাবের স্থান। (বুখারী) মহান আল্লাহ বলেন, “পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত বৃষ্টির ন্যায়, যা আমি আকাশ হতে বর্ষণ করি। পরে তা হতে ঘন তরুলতা উদগত হয়, যা হতে মানুষ ও জীবজন্তু আহার করে থাকে। এই অবস্থায় যখন ধরণী সুবর্ণ রূপ ধারণ করে ও সুশোভিত হয় এবং তার অধিবাসীগণ মনে করে যে, এখন তারাই তার অধিকারী। কিন্তু যখন দিন অথবা রাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে এবং আমি তা এমনভাবে নির্মূল করে দিই, যেন ইতিপূর্বে তার কোন অস্তিত্বই ছিল না।” (সূরা ইউনুস ২৪ আয়াত)
“ওদের নিকট পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা কর, এই পানির ন্যায় যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি, যার দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদ্গত হয় ও পরে তা শুকিয়ে গিয়ে এমন চুর্ণ-বিচুর্ণ হয় যে, বাতাস ওকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।” (সরা কাহফ ৪৫ আয়াত)।
“তোমরা জেনে রেখো, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, আঁকজমক, পারস্পরিক গর্ববোধ ও ধন-জনে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছু নয়। এর উপমা হল বৃষ্টি, যার। দ্বারা উৎপন্ন শস্য-সম্ভার কাফের (বা কৃষক) দলকে চমৎকৃত করে, অতঃপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তা খড়-কুটায় পরিণত হয়।” (সূর হীদ ২০} “পার্থিব জীবন ছলনাময় সম্পদ ছাড়া কিছুই নয়।” (সূরা আ-লি ইমরান ১৮৫ আয়াত) “পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছু নয়, যারা সংযত হয় তাদের জন্য পরকালের আবাসই শ্রেষ্ঠতর। তোমরা কি তা বোঝ না?” (সূরা আনআম ৩২ আয়াত)।
“এই পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছুই নয়। পারলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন।” (সূরা আনকাবুত ৬৪ আয়াত) “এই পার্থিব জীবন তো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু এবং পরকাল হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস।” (সূরা মু’মিন ৩৯ আয়াত)
“যদি কেউ পার্থিব জীবন ও তার শোভা কামনা করে, তবে দুনিয়াতে আমি তাদের কর্মের পরিমিত ফল দান করি এবং দুনিয়াতে তারা কম পায় না। তাদের জন্য পরকালে দোযখের আগুন ছাড়া কিছুই নেই। আর তারা যা এখানে করে তা বিনষ্ট হবে এবং যা করছে তা অগ্রাহ্য হবে।” (সূরা হূদ ১৫-১৬)
“কেউ পার্থিব-সুখ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা সত্বর দিয়ে থাকি। পরে ওর জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি; যেখানে সে নিন্দিত ও (আল্লাহর) অনুগ্রহ থেকে দূরীকৃত অবস্থায়। প্রবেশ করবে। আর যারা মুমিন হয়ে পরলোক কামনা করে এবং তার জন্য যথাসাধ্য সাধনা। করে, তাদেরই সাধনা স্বীকৃত হবে।” (সূরা ইসরা ১৮-১৯)
বলাই বাহুল্য যে, এ কারণেই মুসলিমের কাম্য পার্থিব জীবন ও তার সৌন্দর্য নয়। ক’দিনের এ সংসার তো এক খেলাঘর। খেলা শেষ হলে এবং রেফারী’ বাঁশি বাজিয়ে দিলেই তো সব শেষ।
যে মত শিশুর দল পথের উপর,
খেলাধুলা করে তারা বানাইয়া ঘর।
হেন কালে স্নেহময়ী মাতা ডাক দিলে,
ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে যায় মাতৃকোলে।
সেই মত এই পৃথিবীর সংসার জীবন,
মহাকালের এলে ডাক র’ব না তখন।
সালামাহ আল-আহমার বলেন, একদা আমি বাদশা হারুন রশীদের নিকট গমন করলাম। তার বালাখানা ও রাজমহল দেখে আমি তাকে বললাম, আপনার মহলখানা বেশ প্রশস্ত। আপনার মৃত্যুর পরে আপনার কবরখানিও যদি প্রশস্ত হয় তবেই ভালো।
এ কথা শুনে তিনি কাঁদতে লাগলেন। অতঃপর বললেন, হে সালামাহ! আপনি আমাকে সংক্ষেপে আরো কিছু উপদেশ দিন।
আমি বললাম, হে আমীরুল মুমেনীন! যদি কোন মরুভূমিতে পৌছে পিপাসায় আপনার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, তাহলে তা দূর করার জন্য কত পরিমাণ অর্থ দিয়ে এক ঢোক পানি কিনবেন বলবেন কি? তিনি বললেন, 'আমি আমার অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে তা কিনব।”
আমি বললাম, 'অতঃপর তা কিনে পান করে তা যদি আপনার পেট থেকে বের হতে না চায়, তাহলে তা বের করার জন্য কি ব্যয় করবেন? বললেন, 'বাকী অর্ধেক রাজত্ব ব্যয় করে দিব।
আমি বললাম, 'অতএব সে দুনিয়ার উপর আল্লাহর অভিশাপ, যে দুনিয়ার মূল্য হল মাত্র এক ঢোক পানি ও এক গোড় পেশাব!’ এ কথা শুনে বাদশা হারুন রশীদ আরো জোরে কেঁদে উঠলেন। এ জগতের কোন গুরুত্ব নেই মুসলিমের কাছে। এ সংসারের কোন মায়া নেই জ্ঞানী। মানুষের হৃদয়ে। এ দুনিয়া হল ছলনাময়ী বেশ্যার ন্যায়। বেশ্যার প্রেমে যে পড়বে, সে অবশ্যই পবিত্র দাম্পত্যও হারাবে এবং অর্থও।
‘এ মায়া মরিচিকা, এ যে মোহ ভুল,
এ নহে তো সেই
যাহারে সঁপিতে পারি প্রণয়ের পারিজাত ফল।
মানুষের জীবনের দু’টি দিক আছে; একটি হল ভোগের দিক এবং অপরটি ত্যাগের। কিছু ভোগ করতে পারলে মানুষের কল্যাণ আছে। আবার কিছু ত্যাগ করলে তার মঙ্গল আছে। পরন্তু কিছু ভোগ করতে চাইলে কিছু ত্যাগ করতে হয় এবং কিছু ত্যাগ স্বীকার করলে তবেই কিছু ভোগ করতে পাওয়া যায়। কিন্তু বিপদ হয় তখনই, যখন মানুষ ত্যাজ্য বস্তুকে ভোগ্যরূপে এবং ভোগ্য বস্তুকে ত্যাজ্যরূপে গ্রহণ করে বসে। কিছু ফলের উপরের অংশ আমাদের ভক্ষণীয়, আর কিছু অন্য ফলের ভিতরের অংশ ভক্ষণীয়। অতএব ফল চেনে না। এমন লোক যদি ফল চেনে এমন লোকের পরামর্শ না নিয়ে যে অংশটা খাওয়া দরকার তা না খেয়ে অপর অংশটা খায়, তাহলে তা মুখতা বৈ কি? বলা বাহুল্য, দুনিয়া আমাদের ভোগের বস্তু নয়; বরং ত্যাগের বস্তু। আর আখেরাত হল ভোগের বস্তু। পরন্তু দুনিয়া ত্যাগ করলে তবেই আখেরাত পাওয়া যাবে। নচেৎ একই সাথে উভয়ই পাওয়া অসম্ভব।
অবশ্য দুনিয়া ত্যাজ্য' বলতে বৈরাগ্যবাদ উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল, আখেরাত চিন্তা বর্জন করে কেবল দুনিয়ার চিন্তায় মগ্ন থাকা উচিত নয়। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল আখেরাত। আর দুনিয়া হল উপলক্ষ্য মাত্র। অতএব প্রধান লক্ষ্যে পৌঁছনর উদ্দেশ্যে। উপলক্ষ্য আমাদেরকে যথাবিহিত অনুসারে ব্যবহার করতে হবে এবং উপলক্ষ্যকে লক্ষ্যে পরিণত করা মোটেই চলবে না। প্রিয় নবী ৪ঞ্জ বলেন, “যে ব্যক্তির প্রধান চিন্তা ও লক্ষ্য দুনিয়াদারী হয়, আল্লাহ সেই ব্যক্তির একক প্রচেষ্টাকে তার প্রতিকূলে বিক্ষিপ্ত করে দেন, তার দারিদ্রকে তার দুই চোখের সামনে হাজির করে দেন। আর দুনিয়ার সুখ-সামগ্রী তার ততটুকুই লাভ হয়, যতটুকু তার ভাগ্যে লিখা থাকে।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির পরম লক্ষ্য আখেরাতই হয়, আল্লাহ সে ব্যক্তির প্রচেষ্টাকে তার অনুকূলে ঐকান্তিক করে দেন, তার হৃদয়ে ধনবত্তা ভরে দেন। আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুনিয়ার সুখ-সামগ্রী তার নিকট এসে উপস্থিত হয়।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ৬৫ ১৬, সহীহুল জামে’ ৬৫১০ নং)
দুনিয়াদারদের প্রতিই হল, এ জগতে হায় সেই বেশী চায়, আছে যার ভূরিভূরি। যত পায় তত আরো পেতে চায়। চাওয়া-পাওয়ার আকাঙ্খা তাদের মেটে না। যত ভোগ পায়, তত ভোগের নেশা তাদেরকে আরো মাতাল করে তোলে।
পক্ষান্তরে পরকালকামী মুসলিম প্রয়োজন মত দুনিয়া চায়। দুনিয়াকে আখেরাতের জন্য ব্যবহার করে, আখেরাতকে দুনিয়ার জন্য নয়। সে জানে যে, দুনিয়া তার জন্য মুসাফিরখানা এবং আখেরাত হল আসল ঠিকানা। যেমন মুসাফিরখানার সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য তার কাম্য নয়, তেমনি মুসাফিরখানাকে ধ্বংস করে দেওয়াও তার কাম্য হতে পারে না। কারণ, তাকে এই দুনিয়ার ক্ষেতে বীজ বপণ করেই আখেরাতে তার ফসল তুলতে হবে। অতএব ক্ষেত সমূলে বিনাশ করা তার অধিকারভুক্তও নয়।
এ কথা কুরআন মাজীদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। “আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন তার মাধ্যমে পরলোকের কল্যাণ অনুসন্ধান কর এবং ইহলোক থেকে তুমি তোমার অংশ ভুলে যেও না।” অর্থাৎ, দুনিয়ার বৈধ সম্ভোগকে তুমি উপেক্ষা করো না। (সূরা কাসাস ৭৭ আয়াত)
“তুমি বল, আল্লাহ যে সব সুন্দর বস্তু স্বীয় বান্দাগণের জন্য সৃষ্টি করেছেন তা এবং জীবিকার মধ্য হতে পবিত্র খাদ্য-পানীয়কে কে অবৈধ করেছে? বল, এই সব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্য এবং বিশেষ করে পরকালে কেবল তাদেরই জন্য (প্রস্তুত রাখা হয়েছে)।” (সূরা আরাফ ৩২ আয়াত)
আমাদের ও অন্যান্য মানুষদের মাঝে একটি বড় পার্থক্য এই যে, আমাদের বিশ্বাস হল, আমরা নিজে নিজে সৃষ্টি হতে পারি না। আমাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। আর তিনি হলেন আমাদের একমাত্র উপাস্য মহান আল্লাহ। আমরা কেবল তারই আনুগত্য করার জন্য সৃষ্টি হয়েছি। এর বিনিময়ে তাঁর সন্তুষ্টি পাব। আমাদেরকে একদিন অবশ্যই মরতে হবে। এ পার্থিব জীবনই সব কিছুর শেষ নয়। মরণের পর পুনরায় এক সময় আবার জীবিত হতে হবে এবং আমরা এ জগতে যা কিছু করি তার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জবাবদিহি করতে হবে। তাঁর আনুগত্য করে থাকলে সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য চির-সুখময় স্থান বেহেশ্ব প্রস্তুত রেখেছেন। অন্যথা করলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভীষণ শাস্তি ও জ্বালাময় দোযখ-যন্ত্রণা।
আসলে উক্ত বিশ্বাস অধিকাংশ মানুষের মনে না থাকার ফলেই যত বিপর্যয় ও বিভ্রাট সৃষ্টি। হয়েছে। হিসাব দিতে হবে না মনে করেই অনেকে রিপুর একান্ত সেবক ও অনুগত দাস হয়ে। স্বেচ্ছাচারিতার স্বাধীন জীবন অতিবাহিত করে যাচ্ছে। ধরে নিয়েছে, দুনিয়াটাই সব কিছু। দুনিয়াটা মস্ত বড়, খাও-দাও ফুর্তি কর।' এই শ্লোগান তাদের মনে-মগজে জায়গা করে নিয়েছে। তাদের সন্দেহ ও বক্তব্য হল, “সে (মুহাম্মাদ) কি তোমাদেরকে এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তোমাদের মৃত্যু হলে এবং তোমরা মৃত্তিকা ও অস্থিতে পরিণত হলেও তোমাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে?! তোমাদেরকে যে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে তা কদাচ ঘটবে, কদাচ ঘটবে না। একমাত্র পার্থিব জীবন, আমরা মরি-বাচি এখানেই এবং আমরা পুনরুত্থিত হব না। সে তো এমন এক ব্যক্তি, যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে এবং আমরা তাকে বিশ্বাস করবার নই।” (সূরা মু'মিনুন ৩৫-৩৮ আয়াত) তাদের বুলি হল,
‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও ধারের খাতা শুন্য থাক,
দুরের আওয়াজ লাভ কি শুনে মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।”
কেউ বা বলে,
এখন যা পাই তাই নিয়ে যাই দুর অজানার কাজ কি মোর,
এমন মাটির স্বর্গ আমার কোথায় পাব এর দোসর?’
অন্য কেউ বলে থাকে,
‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহু দূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর।