বহু যুবকের ধারণা এই যে, ইসলাম মানেই হচ্ছে পরাধীনতার জীবন। অর্থাৎ, মুসলিমের জীবনে কোন প্রকার স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য নেই। ইসলাম শক্তি ও প্রগতির বিরোধী। এর ফলে তারা ইসলাম থেকে দূরে সরতে থাকে এবং তার নামে অবজ্ঞায় নাক সিঁটকায়। মনে করে ইসলাম এক পশ্চাদগামী ধর্ম। যে তার অবলম্বীদের হাত ধরে পশ্চাৎ ও অবনতির দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে উন্নতি, প্রগতি ও অগ্রগতির পথে বাধা দান করে।
এটি একটি নিছক সন্দেহ ও ভ্রান্ত ধারণা মাত্র এবং ইসলাম-প্রিয় যুবকদের জন্য একটি সমস্যা। এই সমস্যার সমাধানকল্পে ঐ ভ্রষ্ট যুবকদের সম্মুখে ইসলামের প্রকৃত রূপ প্রকাশ হওয়া এবং তার প্রতি আরোপিত অপবাদের আবরণমুক্ত হওয়া উচিত; যারা তাদের ভ্রান্ত ধারণা অথবা স্বল্প জ্ঞান মতে অথবা উভয় মতে ইসলামের আসল চিত্র সম্বন্ধে অজ্ঞাত। আর জানা কথা যে, পীড়া-জনিত কারণে যার মুখ তিক্ত হয়ে আছে তাকে ঐ মুখে সুমিষ্ট পানিও তেঁতো লাগবে। যেমন জলাতঙ্ক রোগের রোগী স্বচ্ছ পানিতেও কুকুর দেখে থাকে।
বাস্তব এই যে, ইসলাম মানুষকে পার্থিব জীবনের সুখ লুটতে বাধা দেয় না। মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে না। অবশ্য জীবনের সীমারেখা নির্ধারিত করে। মানুষের পায়ের বেড়ি দিয়ে পথ চলতে বাধা সৃষ্টি করে না। বরং চলার পথ নির্ধারিত, নির্দিষ্ট ও সীমিত করে। সৎপথে চলতে নির্দেশ দেয় এবং অসৎ পথে চলতে বাধা দান করে। আর এ কথা ধ্রুব সত্য যে, যে পথে সুখ উপভোগ করতে ইসলাম বাধা দেয়, সে পথে আপাতঃদৃষ্টিতে মানুষের সাময়িক সুখ থাকলেও, আসলে কিন্তু সুখ নেই অথবা সে সুখের পর দুঃখ আছে। পক্ষান্তরে ইসলামের নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত পথে আছে পরম ও চরম সুখ এবং তার পরে কোন দুঃখ নেই।
ইসলাম মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতা খর্ব করে না। ইসলাম কোন পরাধীন জীবন অতিবাহিত করতে আহ্বান করে না। অবশ্য স্বেচ্ছাচারিতায় বাধা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যপূর্ণ সুশৃঙ্খলময় জীবন গড়তে আদেশ করে। সকল প্রকার স্বাধীনতাকে সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খলাবদ্ধ করে। স্বাধীনতা যাতে স্বৈরাচারিতা ও উজ্জ্বলতায় বদলে না যায় তার বিশেষ নির্দেশনা দান করে। যাতে সীমা ও শৃঙ্খলহীন স্বাধীনতার জীবনে এক ব্যক্তির স্বাধীনতা অপর ব্যক্তির স্বাধীনতার সাথে সংঘর্ষ না বাধায়। কারণ, যে ব্যক্তি সীমাহীন সর্বপ্রকার স্বাধীনতা চাইবে, নিশ্চয় সে ব্যক্তি অন্যের স্বাধীনতা হরণ ও খর্ব করবে। যেহেতু, তাছাড়া পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ সম্ভবই নয়। পরন্তু তা লাভ করতেই হলে সমগ্র স্বাধীনতার মাঝে সংঘাত সৃষ্টি হবে এবং তারপরই সৃষ্টি হবে নানা বিঘ্ন ও বিশৃঙ্খলা।
অতএব ইসলাম চায়, মানুষের জীবনকে শৃঙ্খলা ও সীমাবদ্ধ করতে। তাই তো মহান আল্লাহ দ্বীনী হুকুম-আহকামকে ‘হুদূদ’ বা সীমারেখা বলে অভিহিত করেছেন। কাজ হারাম হলে বলা হয়েছে, “এগুলি আল্লাহর সীমারেখা, সুতরাং এর ধারে-কাছে যেও না।” (সূরা বাকারাহ ১৮৭ আয়াত) আর ওয়াজেব হলে বলা হয়েছে, “এগুলি আল্লাহর সীমারেখা, অতএব তা তোমরা লংঘন করো না।” (ঐ ২২৯ আয়াত)। বলাই বাহুল্য যে, কিছু লোকের ঐ কল্পিত পরাধীনতা এবং ইসলামের নির্দেশাবলী ও সুশৃঙ্খলতা; যা প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ সৃষ্টিকর্তা তার বান্দাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন উভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে।
অতএব যুবকের মনে এ ধরনের কোন সমস্যা প্রকৃতপক্ষে কোন সমস্যাই নয়। যেহেতু শৃঙ্খলা ও নিয়মধারার অনুবর্তী হয়ে চলা এ বিশ্বের সর্বক্ষেত্রে নিত্য-ঘটিত, স্বাভাবিক ও বাঞ্ছিত ব্যাপার। মানুষও প্রকৃতিগতভাবে এই নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীনস্থ। তাই তো সে ক্ষুৎপিপাসার বশবর্তী এবং পান-ভোজনের মুখাপেক্ষী। নিয়মিত ও পরিমিত পরিমাণে উপযুক্ত গুণসম্পন্ন পানাহার করতে বাধ্য থাকে। যাতে সে নিজের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা করতে পারে। কিন্তু স্বেচ্ছামত চললে অসুস্থতা ও বিভিন্ন ব্যাধির জন্ম হয়। যেমন মানুষ সামাজিক রীতি-নিয়মের অনুবর্তী, স্বদেশী চাল-চলন, আবাস-লেবাস প্রভৃতির অনুরক্ত। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়তের ব্যাপারে পাশপোর্ট-ভিসার নিয়ম, স্বদেশী আইন-কানুন, ট্রাফিক-কানুন প্রভৃতির অনুগত। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা চালালে সমাজে ঘূণ্য হতে হয়, আইন-লংঘনের প্রতিফল ভোগ করতে হয়। পথিমধ্যে বিপদগ্রস্ত হতে হয়।
সুতরাং বিশ্ব-সংসারই নির্ধারিত সীমারেখা ও নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন। আর এর ফলেই বাঞ্ছিত মতে সকলের জীবন ও কাজকর্ম চলে। অতএব সামাজিক কল্যাণ লাভ করতে এবং বিশৃঙ্খলা ও বিঘ্ন দুর করতে সকল মানুষের জন্য মানব-রচিত সামাজিক রীতি-নীতির বাধ্য থাকা যদি জরুরী হয়, তাহলে অনুরূপভাবে উম্মাহর কল্যাণের জন্য এবং সার্বিক মঙ্গল আনয়নের জন্য সকল মানুষের পক্ষে স্রষ্টার প্রেরিত শরীয়তের বিধি-বিধান ও নিয়ম-নীতির অনুবর্তী হওয়া একান্ত জরুরী। তবে কেন ও কি ভেবে কিছু মানুষ এ শাশ্বত নিয়ম-শৃঙ্খলাকে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করে এবং তা মানুষের জন্য পরাধীনতা বলে মনে করে? নিশ্চয় তা প্রকাশ্য অপবাদ এবং ভ্রান্ত ও পাপময় ধারণা ছাড়া কিছু নয়। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব, ইবনে উসাইমীন ২০-২২পৃঃ)
এ জগতে একমাত্র পাগলেরই আছে পূর্ণ স্বাধীনতা, সেই কেবল যাচ্ছে তাই করে বেড়াতে পারে। অবশ্য সে স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক সময় গলা-ধাক্কাও খেয়ে থাকে। প্রকৃত প্রস্তাবে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা এ পৃথিবীর কারো নেই। প্রত্যেকে কোন না কোন নিয়মের পরাধীন অবশ্যই থাকে। তা না হলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। প্রত্যেক জিনিসের পশ্চাতে একটা না একটা বাধন আছে, নিয়ন্ত্রণ জোড়া আছে। নচেৎ, বিপদ অনিবার্য। আগুন, পানি, বাতাস, খাদ্য, যাই বল না কেন, সবকিছুর ব্যবহার বিধি নিয়ন্ত্রিত। ঘোড়ার লাগাম না থাকলে বা গাড়ির ব্রেক না থাকলে ঘোড়া বা গাড়ি কি ঠিক মত ঈপ্সিত পথে চলে থাকে, না কেউ চালাতে পারে? মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা-গবেষণাও অনুরূপ নিয়ন্ত্রিত। ষড়রিপুর নাকেও দড়ি দেওয়া আছে। তা না হলে পৃথিবীতে কেউ শান্তিতে বাস করতে পেত না। মানুষ। মানুষরূপে বাস করতে পারত না; বরং পশুর চাইতেও অধম হয়ে নিজ নিজ স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে আপোসে লড়ে ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব প্রত্যেক বস্তুর নিয়ন্ত্রিত দিকটাই ভালো। শৃঙ্খলিত সবকিছুই মানুষের ঈপ্সিত।
উদ্ধৃঙ্খলতা সভ্য সমাজ পছন্দ করতে পারে না। কেউ চায় না নিয়ন্ত্রণহারা পানি বা বন্যার অদম্য গতি। কেউ চায় না আগুন তার রান্নাঘর থেকে আয়ত্তের বাইরে চলে যাক।
কলেজ থেকে ফিরার পথে বেসামাল ড্রেসে চামেলী বাসায় ফিরছিল। এমন বেসামাল পোশাকে আবেদনময়ী ভঙ্গিমায় চলাতে তার স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এক দল যুবক তার সে মস্তানা চলন দেখে তার উপর হামলা করে তার রাঙা যৌবন লুটে নিল। ধর্ষিতা ও খুন হল চামেলী দুর্ধর্ষ যুবকদলের হাতে। অবশ্য যুবকদলেরও এতে স্বাধীনতা ছিল। অন্যায়ভাবে অবৈধ উপায়ে অর্থ সঞ্চয় করাতে তোমার-আমার স্বাধীনতা আছে। তেমনি ডাকাতেরও স্বাধীনতা আছে ডাকাতি করার। চোরেরও স্বাধীনতা আছে বিনা বাধায় চুরি করার। গাড়িওয়ালার স্বাধীনতা আছে, সে যেদিকে খুশী সেদিকে চালাতে পারে। যখন ইচ্ছা তখন বায়ে অথবা ডাইনে সাইড নিতে পারে। এতে কার কি বলার থাকতে পারে? স্বামীর স্বাধীনতা আছে ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ রাখার, তেমনি স্ত্রীরও স্বাধীনতা আছে বয় ফ্রেন্ড’ ব্যবহার করার। কোন কোন রাত্রি যদি স্ত্রী বাসায় বাস না করে তার সে বন্ধুর বাসায় বাস করে, তবে তাতে স্বামীর প্রতিবাদের কি আছে? আশা করি এমন স্বাধীনতাকে কোন জ্ঞানী মানুষই বিশ্বাস ও সমর্থন করবে না। যে স্বাধীনতা অপরের স্বাধীনতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, সে স্বাধীনতা হল স্বেচ্ছাচারিতা ও মহা অপরাধ। সংঘর্ষহীন বগাধীন স্বাধীনতা শান্তিকামী মনুষ্য সমাজের অভিপ্রেত বস্তু।
অতএব বাক-স্বাধীনতার অর্থ যা ইচ্ছে তাই বলা নয়, তারও নিয়ন্ত্রণ-সীমা আছে। ন্যায়অন্যায়ের মানদন্ড আছে।
ব্যক্তি-স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এতেও ন্যায়-অন্যায়, পরোপকার, অপরের লাভ-ক্ষতি ও স্বাধীনতার কথাও খেয়াল রাখা জরুরী। মতামতের স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যে যা ইচ্ছা তাই মন্তব্য করবে। বিনা দলীলে যা মন তাই মনগড়া মত প্রকাশ করবে এবং ন্যায়কে অন্যায় বা তার বিপরীত প্রমাণ করার জন্য বিষাক্ত কলম ব্যবহার করবে।
এ বিশ্ব আল্লাহর। তিনিই বিশেষ অনুগ্রহে আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আমরা তারই আজ্ঞাবহ দাস। অতএব প্রভুর কাছে দাসের স্বাধীনতা আবার কি? সকল ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ। মানুষের হাতে আর কতটুক ক্ষমতা আছে? আর পূর্ণ ক্ষমতা না থাকলে কি স্বাধীন হওয়া যায়?
পরিশেষে এ বিষয়ে একটি মূল্যবান উপদেশ শোন। একদা এক ব্যক্তি ইবরাহীম বিন আদহাম (রঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আবু ইসহাক? আমি বড় গোনাহগার। অতএব আমাকে কিছু নসীহত করুন; যাতে আমি গোনাহ থেকে বিরত হতে পারি।
আবু ইসহাক (ইবরাহীম) বললেন, 'যদি তুমি পঁাচটি উপদেশ গ্রহণ কর এবং তদনুযায়ী আমল কর, তাহলে গোনাহ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। লোকটি বলল, বলুন। ইবরাহীম বললেন, 'প্রথম এই যে, আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করলে তুমি তার রুযী খেয়ো না।' লোকটি বলল, তাহলে খাব কি? দুনিয়াতে সবকিছুই তো তারই দেওয়া রুযী! বললেন, 'ওহে আল্লাহর বান্দা! তুমি তার রুযী খাবে, অথচ তার অবাধ্যাচরণ করবে। এটা কি তোমার বিবেকে ভালো মনে হবে। বলল, 'অবশ্যই না। দ্বিতীয় কি বলুন। বললেন, 'যদি তুমি তার অবাধ্যাচরণ করতেই চাও তাহলে খবরদার তাঁর রাজত্বে বাস করো না।” বলল, এটা তো বিরাট মুশকিল। তাহলে বাস করব কোথায়? বললেন, 'ওহে আল্লাহর বান্দা! তুমি তার রুযী খাবে, তাঁর রাজত্বে বাস করবে, অথচ তার নাফরমানী করবে, এটা কি তোমার উচিত হবে?” বলল, অবশ্যই না। তৃতীয় কি বলুন। বললেন, 'তার রুযী খেয়ে তাঁর রাজত্বে বাস করেও যদি তার নাফরমানী করতে চাও, তাহলে এমন জায়গায় করো, যেখানে তিনি তোমাকে দেখতে পাবেন না।'
বলল, হে ইবরাহীম! তা কি করে সম্ভব? তিনি তো আমাদের মনের গোপন খবরও জানেন! বললেন, তাহলে তার রযী খেয়ে, তাঁর রাজত্বে বসবাস করে, তার দৃষ্টির সামনে তুমি তার অবাধ্যাচরণ করবে এবং তার জ্ঞানায়ত্তে থেকেও পাপাচরণ করবে, এতে কি তোমার লজ্জা হবে না? বলল, 'অবশ্যই। চতুর্থ কি বলুন। বললেন, 'মালাকুল মওত যখন তোমার জান কবজ করতে আসবেন, তখন তাঁকে তুমি বলো যে, (আমি স্বাধীন। আমি মরব না অথবা) আমাকে আর ক'টা দিন সময় দিন যাতে আমি খালেস তওবা করে নিয়ে ভালো কাজ করে নিতে পারি। বলল, তিনি তো আমার এ অনুরোধ মেনে নেবেন না। বললেন, 'ওহে আল্লাহর বান্দা! তাহলে তওবা করার জন্য যদি তুমি মরণকে বাধা দিতে পার, আর তুমি জান যে, মৃত্যু এসে গেলে আর ক্ষণকালও দেরী করা হবে না, তাহলে। মুক্তির আশা কিরূপে করতে পার? বলল, 'পঞ্চমটা বলুন। বললেন, কিয়ামতের দিন দোযখের প্রহরিগণ যখন তোমাকে দোযখে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসে উপস্থিত হবেন, তখন তুমি তাদের সাথে যেও না। বলল, তারা তো আমাকে ছেড়ে দেবেন না। আমার সে আবেদন তারা মানবেন না। বললেন, তাহলে নাজাতের আশা কেমন করে করতে পার? বলল, হে ইবরাহীম! যথেষ্ট, যথেষ্ট। আমি এক্ষনি আল্লাহর নিকট তওবা করছি এবং কৃতপাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
হ্যাঁ, মানুষ সর্ববিষয়ে স্বাধীন নয়। মানুষ তো দাস। মহান স্রষ্টা আল্লাহর দাস। আর এ দাসত্বে আছে তার পরম আনন্দ। এ পরাধীনতায় আছে প্রেমের সুমধুর স্বাদ। প্রেম তো পরাধীনতারই এক নাম। তদনুরূপ ইসলাম প্রগতি ও বিজ্ঞান বিরোধী নয়। বরং ইসলাম সভ্যতা, সংস্কৃতি, চিন্তা, জ্ঞান, গবেষণা, সুস্বাস্থ্য প্রভৃতি সার্বিক প্রগতি ও শক্তির প্রশস্ত ময়দান।
ইসলাম মানুষকে চিন্তা ও গবেষণা করতে আহ্বান করে। যাতে সে উপদেশ গ্রহণ করে ভালো-মন্দ নির্ণয় করতে পারে এবং নিজ জ্ঞানের পরিসর বৃদ্ধি করতে পারে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, “বল, আমি তোমাদেরকে একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি; তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু’জন করে অথবা একা একা দাড়াও, অতঃপর চিন্তা কর-------।” (কুঃ ৩৪/৪৬) “বল, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার প্রতি লক্ষ্য কর----” (কুঃ ১০/১০১)। চিন্তা ও গবেষণা করার প্রতি মানুষকে আহ্বান করেই ইসলাম ক্ষান্ত নয়। বরং যারা জ্ঞানগবেষণা ও চিন্তা করে না তাদের প্রতি আক্ষেপ ও নিন্দাবাদ করে।
মহান আল্লাহ বলেন, “তারা কি লক্ষ্য (গবেষণা) করে না আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের প্রতি এবং আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি----।” (কুঃ ৭/ ১৮৫) “ওরা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না (চিন্তা করে না) যে, আল্লাহ আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও ওদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু যথাযথভাবেই সৃষ্টি করেছেন।” (কুঃ ৩০/৮) “আমি যাকে দীর্ঘ জীবন দান করি তাকে তো জরাগ্রস্ত করে দিই, তবুও কি ওরা জ্ঞান করে না?” (কুঃ ৬/৬৮)।
ইসলামের এই চিন্তা ও জ্ঞান-গবেষণা করতে আদেশ দেওয়ার অর্থই হল, জ্ঞান ও চিন্তাশক্তির দ্বার উন্মুক্ত করা। অতএব তারা কি করে বলে যে, ইসলামে বিভিন্ন শক্তির অবক্ষয় ঘটে। তাদের মুখ-নিঃসৃত বাক্য কি উদ্ভট! তারা কেবল মিথ্যাই বলে।”
ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য তাদের ঈমান, জান, মান, জ্ঞান ও ধনের পক্ষে অহিতকর বা ক্ষতিকর নয় এমন সকল প্রকার সম্ভোগকে বৈধ করেছে। তাই সমস্ত উত্তম ও উপাদেয় খাদ্য-পানীয়কে হালাল করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা থেকে পবিত্র বস্তু আহার কর এবং আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর----” (কুঃ ২/১৭২) “---এবং তোমরা পানাহার কর, আর অপচয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।” (কুঃ ৭৭/৩১) প্রজ্ঞা ও প্রকৃতি অনুসারে সমস্ত পরিচ্ছদ ও সৌন্দর্যকে বৈধ করেছেন। তিনি বলেন, “হে আদম সন্তান দল! তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদের উপর পরিচ্ছদ অবতীর্ণ করেছি। আর তাকওয়া’ (সংযমতা)র পরিচ্ছদই সর্বোৎকৃষ্ট।” (কুঃ ৭/২৬) “বল, বান্দাদের জন্য আল্লাহর সৃষ্ট সৌন্দর্য এবং উত্তম জীবিকা কে হারাম (নিষিদ্ধ) করেছে? বল, পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে এ সমস্ত তাদের জন্য, যারা ঈমান এনেছে।” (কুঃ ৭/৩২) আর মহানবী ৪ বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। তিনি তার দেওয়া নেয়ামতের চিহ্ন বান্দার দেহে দেখা যাক, তা পছন্দ করেন।” (সহীহুল জামে ১৭৪২ নং)
বিধিসম্মত বিবাহ-বন্ধনের মাধ্যমে তিনি যৌন-সভোগও বৈধ করেছেন। তিনি বলেন, “--তবে বিবাহ কর (স্বাধীনা) নারীদের মধ্য হতে যাকে তোমাদের ভালো লাগে; দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশঙ্কা কর যে, (তাদের মধ্যে) সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে----” (কুঃ ৪/৩)।
ব্যবসা ও অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম তার অনুসারীদের অগ্রগতিকে গতিহীন করতে চায়নি। বরং তাদের জন্য সর্বপ্রকার অনুমতিপ্রাপ্ত হালাল ও ইনসাফপূর্ণ বাণিজ্য ও
অর্থোপার্জনকে বৈধ ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, “---অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে অবৈধ করেছেন।” (কঃ২/২৭৫) “তিনি তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে। দিয়েছেন, অতএব তোমরা দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার প্রদত্ত জীবনোপকরণ হতে আহার্য গ্রহণ কর, আর তারই প্রতি (সকলের) পুনরুত্থান।” (কুঃ ৬৭/১৫) “অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর----” (কুঃ ৬২/১০)। সুতরাং এর পরেও কি কিছু মানুষের এই ধারণা রাখা সঠিক যে, ইসলাম শক্তি অর্জন, প্রগতি ও উন্নয়নের পথে বাধা দেয়? (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব ২২-২৫পৃঃ)।
আজ বহু যুবকের মনে এ প্রশ্ন বারংবার উকি মারে যে, মুসলিম শ্রেষ্ঠ জাতি হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা সর্ববিষয়ে উন্নত নয় কেন? কেন পার্থিব ধন-সম্পদ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথে তারা বহু পিছিয়ে রয়েছে?
প্রথমতঃ আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, জাতির হাতে যে অর্থভান্ডার কম আছে তা নয়। আর্থিক দিক দিয়ে এ জাতি পিছিয়ে নেই। অবশ্য অর্থ যথার্থভাবে ব্যয় করার পথে এরা পিছিয়ে আছে। অর্থ যাদের হাতে আছে তারা জাতির উন্নয়নের কাজে তা যথাযথ ব্যয় করার পরিবর্তে নিজেদের বিলাস-ব্যসনে অধিক ব্যয় করেছে। বিভিন্ন স্মৃতি-বিজড়িত বিলাস-ভবন নির্মাণ করেছে, কিন্তু কোন উন্নয়নমুলক জ্ঞান-ভবন নির্মাণ করেনি। যারা করেছে তারা যথেষ্ট আকারে তা করেনি। প্রয়োজনের তুলনায় সে ব্যয় ছিল নেহাতই কম। তাছাড়া মুসলিম দুনিয়া হারিয়েছে বহু শাসকের দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে অধিক মত্ত হওয়ার ফলে। নিজেদের অবজ্ঞা ও অবহেলাবশে, গৃহযুদ্ধ ও আত্মকলহের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ার কারণে শুধু দুনিয়াই নয়; বরং অমূল্য ধন দ্বীনও হারিয়েছে। কত তাতার, কত হালাকু, কত চেঙ্গিজ এসে এ জাতির বুকে অত্যাচারের রুলার চালিয়েছে। কত শত জ্ঞান-বিজ্ঞানের অমূল্য ভান্ডার ভাসিয়ে দিয়েছে দিজলা নদীর পানিতে। জাতির অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করে দিয়ে কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে মুসলিমদের। শাসকদল অবহেলা ও ঔদাস্যের শিকার হয়ে নিজেদের রাজ্য তুলে দিয়েছে অত্যাচারী ও আগ্রাসী ঔপনিবেশিকদের হাতে। মুসলিম ধীরে-ধীরে। শিকার হয়ে পড়েছে হীনম্মন্যতার। পক্ষান্তরে সরে পড়েছে নিজ জীবন-ব্যবস্থা থেকে বহু দূরে।
অন্যান্য জাতি অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের কোন তমীজ করেনি; বরং তারা হালাল-হারাম তো চেনেই না। তারা শোষণ ও জুলুমবাজির কোন বাধাই মানেনি। বিশেষতঃ সুদী-কারবারের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করে দুনিয়া নিজেদের মনমত গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু মুসলিম তা পারেনি; আর পারেও না তা করতে।
পারে না সুদী কোন কারবার বা ব্যাংক চালাতে।
পারে না বর্তমানের অর্থনৈতিক সবচেয়ে সহজ উপায় হিসাবে ব্যাংকের সুদ নিতে।
পারে না কোন সুদী ব্যাংকে চাকুরী করতে।
পারে না কোন মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করতে।
পারে না কোন মদ্যশালা চালাতে।
পারে না কোন ফিল্ম-ইন্ডাষ্ট্রী চালাতে।
পারে না কোন সিনেমা হল চালাতে।
পারে না কোন নৃত্যশালা চালাতে।
পারে না কোন যাত্রা, থিয়েটার ও নাট্য-কোম্পানী চালাতে।
পারে না কোন গানবাদ্যের অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে।
পারে না কোন বেশ্যাখানার মালিক হতে।
পারে না কোন ফিল্ম ও গান-বাজনার যন্ত্র বা ক্যাসেট-ব্যবসা করতে।
পারে না কোন সেলুন খুলে দাড়ি উঁছতে।
পারে না ভেজাল দিয়ে কোন দ্রব্য বিক্রয় করতে।
পারে না শরীয়তে নিষিদ্ধ কোন প্রকার ব্যবসা করতে।
পরন্তু হালাল পথ বেছে নিয়ে জাগতিক উন্নয়ন সাধনের সংগ্রামও তারা করেনি। তাদের। জীবন-সংবিধানের প্রদর্শিত পথে চলতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারা ভুলে বসেছে যে, “যে কেউ দুনিয়ার কল্যাণ কামনা করবে, তার জেনে রাখা প্রয়োজন যে, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ আল্লাহরই নিকট রয়েছে।” (সূরা নিসা ১৩৪) তারা জানে না যে, “যারা মু'মিনদেরকে বর্জন করে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নেয়, তারা কি তাদের কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে? যাবতীয় সম্মান তো শুধুমাত্র আল্লাহরই।” (ঐ ১৩৯ আয়াত) “কেউ মান-সম্মান চাইলে সে জেনে রাখুক যে, সকল প্রকার সম্মান আল্লাহরই জন্য।” (সূরা ফাত্বির ৩৫) “ঈমান এনে পুরুষ বা নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করে, তাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করে থাকি এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করি।” (সূরা নাহল ৯৭ আয়াত) মান-সম্মান, উন্নয়ন-প্রগতি এবং যাবতীয় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর বিধান ছেড়ে অন্যের কাছে সম্মান ও উন্নয়ন খুঁজতে গিয়ে মুসলিম আজ যথাসর্বস্ব হারিয়ে বসেছে। হযরত উমার : বলেছেন, 'আমরা সেই জাতি, যে জাতিকে আল্লাহ ইসলাম দিয়ে সুসম্মানিত করেছেন। কিন্তু যখনই আমরা ইসলাম ছেড়ে অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্মান অন্বেষণ করব, তখনই তিনি আমাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।
সকালের শুভ্র জ্যোতি তো অপেক্ষা করছিল মুসলিমদের জন্য তাদের অলক্ষ্যে। কিন্তু মুসলিম ছিল বিভোর নিদ্রায় বেহুশ। চক্ষু মুদে পড়ে ছিল এবং আজও সেই অবস্থাতেই আছে। আর “আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে।” (সূরা রা’দ ১০) পক্ষান্তরে ধনবত্তা ও পার্থিব উন্নয়ন মানুষের জন্য বাঞ্ছিত মর্যাদা নয়। তা যদি হত তাহলে আম্বিয়াগণই এ জগতে সবার চেয়ে বেশী ধনবানরূপে খ্যাত হতেন। কিন্তু পার্থিব জীবন হল ক্ষণস্থায়ী। এ পৃথিবী আমাদের আসল ঠিকানা নয়, এ ঘর-বাড়ি আমাদের আসল ঘর-বাড়ি নয়। আসল ঠিকানা ও ঘর-বাড়ি হল পরকাল। আর ইহকাল হল পরকালের ক্ষেতস্বরূপ। এই ক্ষেতে আমাদেরকে তৈরী করতে হবে আখেরাতের সুখময় জীবনের ফসল। পার্থিব সম্পদ বেশী পেলাম চাহে কম, অথবা না-ই পেলাম তাতে মুসলিমের দুঃখ হওয়া উচিত নয়। কাফেরদের বিভব ও ঐশ্বর্য দেখে নিজেকে হেয় মনে করা উচিত নয়। উচিত হল, পরকালের জীবন ধ্বংস হলে দুঃখ ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়া। কারণ, আসল ক্ষতি হল এটাই। আল্লাহ তাআলা বলেন, “বল (হে নবী!) তারাই হল আসল ক্ষতিগ্রস্ত, যারা কিয়ামতের দিন নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্তরূপে পাবে এবং পরিবারবর্গ হারাবে। আর জেনে রেখো, এটাই হল সুস্পষ্ট ক্ষতি। তাদের জন্য উপর দিক থেকে এবং নীচের দিক থেকে আগুনের মেঘমালা। থাকবে।” (সূরা যুমার ১৫- ১৬ আয়াত)
কোন এক ওস্তায তার হালকার ছাত্রদের মাঝে কিছু বই বিতরণ করলেন। কিছু বই ছিল বড় ও মোটা আকৃতির। কিছু ছিল মাঝারি এবং কিছু পাতলা আকৃতির ছোট বই। ছাত্রদের মধ্যে যারা মোটা বই পেয়েছিল তারা বড় আনন্দিত ও গর্বিত হল। যারা ছোট বই পেয়েছিল। তাদের ঐ সামান্য ক’ পাতার বই দেখে মনঃক্ষুন্ন ও দুঃখিত হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। তারা কামনা করেছিল, যদি তারাও ওদের মত মোটা ও দামী বই পেত, তাহলে তারাও ধন্য হত। কিন্তু কিছুদিন পর ওস্তায় যখন ঘোষণা করলেন যে, তিনি যে বই সকলকে বিতরণ করেছেন, সেই বই থেকেই প্রত্যেকের কাছ থেকে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এই ঘোষণা শোনার পর যারা ছোট বই পেয়েছিল তারা নিতান্ত খুশী হল। কারণ, ক’ পাতা পড়ে পরীক্ষা দেওয়া ছিল খুবই সহজ। আর যারা মোটা বই পেয়ে মনে মনে গর্বিত ছিল তারাই হল ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ, এত মোটা বই পড়ে পরীক্ষা দেওয়াটা মোটেই সহজ ছিল না। পরন্তু তাতে ফেল হওয়ার আশঙ্কাই ছিল অধিক। বলা বাহুল্য, মুসলিমের পার্থিব এ স্বল্প সম্পদ হল পরীক্ষার বস্তু। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো পরীক্ষার বস্তু এবং আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য মহাপুরস্কার আছে।” (সূরা তাগাবুন ১৫)
সুতরাং পরীক্ষার এ ধন কম পেয়ে মুসলিমের দুঃখ হওয়া উচিত নয়; বরং খুশী হওয়াই উচিত।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, “ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য, আর সৎকর্ম -যার ফল স্থায়ী- তা তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশা-আকাঙ্খার ব্যাপারেও উৎকৃষ্ট।” (সূরা কাহফ ৪৬) “কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ পরকালই হল উৎকৃষ্টতর এবং চিরস্থায়ী।” (সূরা আল ১৬-১৭)
এ জন্যই অস্থায়ী পৃথিবীর বিলাসময় জীবনের বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করা মুসলিমের জন্য মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় ও ফরয হল তার সেই জ্ঞান শিক্ষা করা, যদ্বারা পরকালে চিরসুখ লাভ হয় এবং যা না শিখলে চিরদিন (মরণের পর) কষ্ট ভোগ করতে হয়।
যেখানে যতদিন বাস করতে হবে সেখানকার জন্য ঠিক ততদিনকার মত প্রস্তুতি ও সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ করে নেওয়া জ্ঞানীর কর্তব্য। আমার আসল দেশ ভারত। সউদী আরবে আমি ভাড়ার ফ্লাটে বাস করি। এখানে ক্ষণস্থায়ী চাকুরী করি। আজ আছি, কাল নেই। আমি যে বেতন পাই তার অর্থ দ্বারা সউদিয়ার ঐ ফ্লাটকে অধিক সুসজ্জিত করব, নাকি আমার মাতৃভূমি ও স্থায়ী ঠিকানা ভারতের বাসাকে আমরণ বাস করার জন্য সেই অর্থ ব্যয় করে সুনির্মিত করব? জ্ঞানীরা নিশ্চয়ই পরামর্শ দেবেন যে, যে বাড়িতে আপনি ক্ষণকালের জন্য আছেন, সে বাড়িকে সাজিয়ে আপনার পয়সা খরচ করবেন কেন? এখানে তো আর নাগরিকতা পাবেন না। যে দেশের আপনি নাগরিক, সে দেশেই বরং একটা সুন্দর দেখে বাসা তৈরী করে ফেলুন। সেখানে আপনি মরার পরেও আপনার ছেলেরা বাস করতে পারবে। দুনিয়া আমাদের আসল ঠিকানা নয়, পার্থিব সুখ আসল সুখ নয়, জাগতিক উন্নতি প্রকৃত
উন্নতি নয় এবং দুনিয়ার মায়ার সাগরে ডুবে যাওয়া ভালো নয় বলেই সেই ব্যক্তি অধিক সফলকাম, যে দুনিয়াদার নয়। “যে মানুষ দুনিয়াকে ভালোবাসতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার প্রতি সদয় হয়ে তাকে দুনিয়াদারী থেকে ঠিক সেইরূপ বাঁচিয়ে নেন; যেরূপ রোগী ব্যক্তিকে ক্ষতিকর পানাহার থেকে সাবধানে রাখা হয়।” (আহমদ, হাকেম, সহীহুল জামে' ১৮১৪নং)
আর সে জন্যই মুমিন বান্দার জন্য আল্লাহর রসূল সঃ এর খাস দুআ ছিল, “হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি তোমার প্রতি ঈমান এনেছে এবং আমি তোমার রসুল বলে সাক্ষ্য দিয়েছে তার জন্য তুমি তোমার সাক্ষাৎ লাভকে প্রিয় কর, তোমার তকদীর তার হক্কে সুপ্রসন্ন কর এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাস তাকে অল্প প্রদান কর। আর যে ব্যক্তি তোমার প্রতি ঈমান রাখে না। এবং আমি তোমার রসূল বলে সাক্ষ্য দেয় না, তার জন্য তোমার সাক্ষাৎ-লাভকে প্রিয় করো, তোমার তকদীরকে তার হক্কে সুপ্রসন্ন করো না এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাস তাকে বেশী। বেশী প্রদান কর।” (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে ১৩১১ নং)
সুতরাং আল্লাহর প্রিয় বান্দারা যে পার্থিব ভোগ-বিলাসপূর্ণ জীবন লাভ করবে না, তা বলাই বাহুল্য। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তারা পৃথিবীতে আমরণ দুঃখ-কষ্ট্রে বাস করবে এবং অপরের হাতে পড়ে পড়ে মার খেতে থাকবে। বরং প্রকৃত ঈমান থাকলে তার বলে মু’মিন এ পৃথিবীতে সর্বোপরি মর্যাদা লাভ করতে পারবে। কোন সময়ে অনাহার-উপবাস ও অসুখবিসুখের সম্মুখীন হলেও অল্পে তুষ্টি এবং অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের অভ্যাস তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেয় না। তাছাড়া তার এ বিশ্বাস থাকে যে, এ অভাব-অনটন ও অসুস্থতার বিনিময়ে পরকালে মহাপ্রতিদান ও চিরস্থায়ী সম্পদ ও সুখ লাভ করবে। পরকালে ইচ্ছা-সুখের বিলাস-রাজ্য পাব’ এই পরম বিশ্বাস তার মনে সান্ত্বনা ও শান্তি এনে দেয়। আর তাই সুখরূপে তার জীবনে চরম আনন্দ ও তৃপ্তি দান করে থাকে।
দুনিয়ার ভোগ-বিলাস মুমিনের কাম্য নয়। দুনিয়াদারীর ফাঁদে আটকে পড়া জ্ঞানী মুসলিমের কাজ নয়। দুনিয়া তো এক সরাইখানা। এ দুনিয়ার ভরসা কোথায়? দুনিয়া তো মেঘের ছায়া, নিদ্রিতের স্বপ্ন, বিষ-মাখা মধু, সুসজ্জিতা ও সুরভিতা বিষকন্যা। দুনিয়া হল পাপের ধরাধাম, বঞ্চনা ও অভিশাপময় শয্যাগৃহ।
পাপের পঙ্কে পুণ্য-পদ্ম, ফুলে ফুলে হেথা পাপ,
সুন্দর এই ধরা-ভরা শুধু বঞ্চনা অভিশাপ।
সে দুনিয়ার জন্য দুঃখ কিসের, যে দুনিয়ার কোন মূল্যই নেই। “আল্লাহর দৃষ্টিতে একটি মশা পরিমাণও যদি দুনিয়ার মূল্য মান থাকত তাহলে কোন কাফের দুনিয়ার এক ঢোক পানিও পান করতে পেত না।” (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ৫১৭ ৭ নং)
আখেরাতের জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবন হল সমুদ্রের পানির তুলনায় তাতে আঙ্গুল ডুবিয়ে ঐ আঙ্গুলে লেগে থাকা পানির মত সামান্য ও তুচ্ছ। (মুসলিম, মিশকাত ৫১৫৬ নং)
আল্লাহর নিকট দুনিয়া একটি কানকাটা মৃত ছাগল-ছানার চাইতেও অধিক নিকৃষ্টতর। (মুসলিম, মিশকাত ৫১৫৭ নং)
দুনিয়া মুসলিমদের জন্য কারাগার স্বরূপ। আর কাফেরদের জন্য বেহেশ্ব স্বরূপ। (মুসলিম, মিশকাত ৫ ১৫৮ নং)
দুনিয়া অভিশপ্ত। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ মিশকাত ৫১৭৬ নং) দুনিয়া একটি ছায়াদার গাছের মত। (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ৫১৮৮ নং) দুনিয়া মানুষের কর্মক্ষেত্র। আর আখেরাত হল হিসাবের স্থান। (বুখারী) মহান আল্লাহ বলেন, “পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত বৃষ্টির ন্যায়, যা আমি আকাশ হতে বর্ষণ করি। পরে তা হতে ঘন তরুলতা উদগত হয়, যা হতে মানুষ ও জীবজন্তু আহার করে থাকে। এই অবস্থায় যখন ধরণী সুবর্ণ রূপ ধারণ করে ও সুশোভিত হয় এবং তার অধিবাসীগণ মনে করে যে, এখন তারাই তার অধিকারী। কিন্তু যখন দিন অথবা রাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে এবং আমি তা এমনভাবে নির্মূল করে দিই, যেন ইতিপূর্বে তার কোন অস্তিত্বই ছিল না।” (সূরা ইউনুস ২৪ আয়াত)
“ওদের নিকট পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা কর, এই পানির ন্যায় যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি, যার দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদ্গত হয় ও পরে তা শুকিয়ে গিয়ে এমন চুর্ণ-বিচুর্ণ হয় যে, বাতাস ওকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।” (সরা কাহফ ৪৫ আয়াত)।
“তোমরা জেনে রেখো, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, আঁকজমক, পারস্পরিক গর্ববোধ ও ধন-জনে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছু নয়। এর উপমা হল বৃষ্টি, যার। দ্বারা উৎপন্ন শস্য-সম্ভার কাফের (বা কৃষক) দলকে চমৎকৃত করে, অতঃপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তা খড়-কুটায় পরিণত হয়।” (সূর হীদ ২০} “পার্থিব জীবন ছলনাময় সম্পদ ছাড়া কিছুই নয়।” (সূরা আ-লি ইমরান ১৮৫ আয়াত) “পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছু নয়, যারা সংযত হয় তাদের জন্য পরকালের আবাসই শ্রেষ্ঠতর। তোমরা কি তা বোঝ না?” (সূরা আনআম ৩২ আয়াত)।
“এই পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছুই নয়। পারলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন।” (সূরা আনকাবুত ৬৪ আয়াত) “এই পার্থিব জীবন তো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু এবং পরকাল হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস।” (সূরা মু’মিন ৩৯ আয়াত)
“যদি কেউ পার্থিব জীবন ও তার শোভা কামনা করে, তবে দুনিয়াতে আমি তাদের কর্মের পরিমিত ফল দান করি এবং দুনিয়াতে তারা কম পায় না। তাদের জন্য পরকালে দোযখের আগুন ছাড়া কিছুই নেই। আর তারা যা এখানে করে তা বিনষ্ট হবে এবং যা করছে তা অগ্রাহ্য হবে।” (সূরা হূদ ১৫-১৬)
“কেউ পার্থিব-সুখ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা সত্বর দিয়ে থাকি। পরে ওর জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি; যেখানে সে নিন্দিত ও (আল্লাহর) অনুগ্রহ থেকে দূরীকৃত অবস্থায়। প্রবেশ করবে। আর যারা মুমিন হয়ে পরলোক কামনা করে এবং তার জন্য যথাসাধ্য সাধনা। করে, তাদেরই সাধনা স্বীকৃত হবে।” (সূরা ইসরা ১৮-১৯)
বলাই বাহুল্য যে, এ কারণেই মুসলিমের কাম্য পার্থিব জীবন ও তার সৌন্দর্য নয়। ক’দিনের এ সংসার তো এক খেলাঘর। খেলা শেষ হলে এবং রেফারী’ বাঁশি বাজিয়ে দিলেই তো সব শেষ।
যে মত শিশুর দল পথের উপর,
খেলাধুলা করে তারা বানাইয়া ঘর।
হেন কালে স্নেহময়ী মাতা ডাক দিলে,
ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে যায় মাতৃকোলে।
সেই মত এই পৃথিবীর সংসার জীবন,
মহাকালের এলে ডাক র’ব না তখন।
সালামাহ আল-আহমার বলেন, একদা আমি বাদশা হারুন রশীদের নিকট গমন করলাম। তার বালাখানা ও রাজমহল দেখে আমি তাকে বললাম, আপনার মহলখানা বেশ প্রশস্ত। আপনার মৃত্যুর পরে আপনার কবরখানিও যদি প্রশস্ত হয় তবেই ভালো।
এ কথা শুনে তিনি কাঁদতে লাগলেন। অতঃপর বললেন, হে সালামাহ! আপনি আমাকে সংক্ষেপে আরো কিছু উপদেশ দিন।
আমি বললাম, হে আমীরুল মুমেনীন! যদি কোন মরুভূমিতে পৌছে পিপাসায় আপনার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, তাহলে তা দূর করার জন্য কত পরিমাণ অর্থ দিয়ে এক ঢোক পানি কিনবেন বলবেন কি? তিনি বললেন, 'আমি আমার অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে তা কিনব।”
আমি বললাম, 'অতঃপর তা কিনে পান করে তা যদি আপনার পেট থেকে বের হতে না চায়, তাহলে তা বের করার জন্য কি ব্যয় করবেন? বললেন, 'বাকী অর্ধেক রাজত্ব ব্যয় করে দিব।
আমি বললাম, 'অতএব সে দুনিয়ার উপর আল্লাহর অভিশাপ, যে দুনিয়ার মূল্য হল মাত্র এক ঢোক পানি ও এক গোড় পেশাব!’ এ কথা শুনে বাদশা হারুন রশীদ আরো জোরে কেঁদে উঠলেন। এ জগতের কোন গুরুত্ব নেই মুসলিমের কাছে। এ সংসারের কোন মায়া নেই জ্ঞানী। মানুষের হৃদয়ে। এ দুনিয়া হল ছলনাময়ী বেশ্যার ন্যায়। বেশ্যার প্রেমে যে পড়বে, সে অবশ্যই পবিত্র দাম্পত্যও হারাবে এবং অর্থও।
‘এ মায়া মরিচিকা, এ যে মোহ ভুল,
এ নহে তো সেই
যাহারে সঁপিতে পারি প্রণয়ের পারিজাত ফল।
মানুষের জীবনের দু’টি দিক আছে; একটি হল ভোগের দিক এবং অপরটি ত্যাগের। কিছু ভোগ করতে পারলে মানুষের কল্যাণ আছে। আবার কিছু ত্যাগ করলে তার মঙ্গল আছে। পরন্তু কিছু ভোগ করতে চাইলে কিছু ত্যাগ করতে হয় এবং কিছু ত্যাগ স্বীকার করলে তবেই কিছু ভোগ করতে পাওয়া যায়। কিন্তু বিপদ হয় তখনই, যখন মানুষ ত্যাজ্য বস্তুকে ভোগ্যরূপে এবং ভোগ্য বস্তুকে ত্যাজ্যরূপে গ্রহণ করে বসে। কিছু ফলের উপরের অংশ আমাদের ভক্ষণীয়, আর কিছু অন্য ফলের ভিতরের অংশ ভক্ষণীয়। অতএব ফল চেনে না। এমন লোক যদি ফল চেনে এমন লোকের পরামর্শ না নিয়ে যে অংশটা খাওয়া দরকার তা না খেয়ে অপর অংশটা খায়, তাহলে তা মুখতা বৈ কি? বলা বাহুল্য, দুনিয়া আমাদের ভোগের বস্তু নয়; বরং ত্যাগের বস্তু। আর আখেরাত হল ভোগের বস্তু। পরন্তু দুনিয়া ত্যাগ করলে তবেই আখেরাত পাওয়া যাবে। নচেৎ একই সাথে উভয়ই পাওয়া অসম্ভব।
অবশ্য দুনিয়া ত্যাজ্য' বলতে বৈরাগ্যবাদ উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল, আখেরাত চিন্তা বর্জন করে কেবল দুনিয়ার চিন্তায় মগ্ন থাকা উচিত নয়। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল আখেরাত। আর দুনিয়া হল উপলক্ষ্য মাত্র। অতএব প্রধান লক্ষ্যে পৌঁছনর উদ্দেশ্যে। উপলক্ষ্য আমাদেরকে যথাবিহিত অনুসারে ব্যবহার করতে হবে এবং উপলক্ষ্যকে লক্ষ্যে পরিণত করা মোটেই চলবে না। প্রিয় নবী ৪ঞ্জ বলেন, “যে ব্যক্তির প্রধান চিন্তা ও লক্ষ্য দুনিয়াদারী হয়, আল্লাহ সেই ব্যক্তির একক প্রচেষ্টাকে তার প্রতিকূলে বিক্ষিপ্ত করে দেন, তার দারিদ্রকে তার দুই চোখের সামনে হাজির করে দেন। আর দুনিয়ার সুখ-সামগ্রী তার ততটুকুই লাভ হয়, যতটুকু তার ভাগ্যে লিখা থাকে।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির পরম লক্ষ্য আখেরাতই হয়, আল্লাহ সে ব্যক্তির প্রচেষ্টাকে তার অনুকূলে ঐকান্তিক করে দেন, তার হৃদয়ে ধনবত্তা ভরে দেন। আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুনিয়ার সুখ-সামগ্রী তার নিকট এসে উপস্থিত হয়।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ৬৫ ১৬, সহীহুল জামে’ ৬৫১০ নং)
দুনিয়াদারদের প্রতিই হল, এ জগতে হায় সেই বেশী চায়, আছে যার ভূরিভূরি। যত পায় তত আরো পেতে চায়। চাওয়া-পাওয়ার আকাঙ্খা তাদের মেটে না। যত ভোগ পায়, তত ভোগের নেশা তাদেরকে আরো মাতাল করে তোলে।
পক্ষান্তরে পরকালকামী মুসলিম প্রয়োজন মত দুনিয়া চায়। দুনিয়াকে আখেরাতের জন্য ব্যবহার করে, আখেরাতকে দুনিয়ার জন্য নয়। সে জানে যে, দুনিয়া তার জন্য মুসাফিরখানা এবং আখেরাত হল আসল ঠিকানা। যেমন মুসাফিরখানার সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য তার কাম্য নয়, তেমনি মুসাফিরখানাকে ধ্বংস করে দেওয়াও তার কাম্য হতে পারে না। কারণ, তাকে এই দুনিয়ার ক্ষেতে বীজ বপণ করেই আখেরাতে তার ফসল তুলতে হবে। অতএব ক্ষেত সমূলে বিনাশ করা তার অধিকারভুক্তও নয়।
এ কথা কুরআন মাজীদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। “আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন তার মাধ্যমে পরলোকের কল্যাণ অনুসন্ধান কর এবং ইহলোক থেকে তুমি তোমার অংশ ভুলে যেও না।” অর্থাৎ, দুনিয়ার বৈধ সম্ভোগকে তুমি উপেক্ষা করো না। (সূরা কাসাস ৭৭ আয়াত)
“তুমি বল, আল্লাহ যে সব সুন্দর বস্তু স্বীয় বান্দাগণের জন্য সৃষ্টি করেছেন তা এবং জীবিকার মধ্য হতে পবিত্র খাদ্য-পানীয়কে কে অবৈধ করেছে? বল, এই সব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্য এবং বিশেষ করে পরকালে কেবল তাদেরই জন্য (প্রস্তুত রাখা হয়েছে)।” (সূরা আরাফ ৩২ আয়াত)
আমাদের ও অন্যান্য মানুষদের মাঝে একটি বড় পার্থক্য এই যে, আমাদের বিশ্বাস হল, আমরা নিজে নিজে সৃষ্টি হতে পারি না। আমাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। আর তিনি হলেন আমাদের একমাত্র উপাস্য মহান আল্লাহ। আমরা কেবল তারই আনুগত্য করার জন্য সৃষ্টি হয়েছি। এর বিনিময়ে তাঁর সন্তুষ্টি পাব। আমাদেরকে একদিন অবশ্যই মরতে হবে। এ পার্থিব জীবনই সব কিছুর শেষ নয়। মরণের পর পুনরায় এক সময় আবার জীবিত হতে হবে এবং আমরা এ জগতে যা কিছু করি তার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জবাবদিহি করতে হবে। তাঁর আনুগত্য করে থাকলে সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য চির-সুখময় স্থান বেহেশ্ব প্রস্তুত রেখেছেন। অন্যথা করলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভীষণ শাস্তি ও জ্বালাময় দোযখ-যন্ত্রণা।
আসলে উক্ত বিশ্বাস অধিকাংশ মানুষের মনে না থাকার ফলেই যত বিপর্যয় ও বিভ্রাট সৃষ্টি। হয়েছে। হিসাব দিতে হবে না মনে করেই অনেকে রিপুর একান্ত সেবক ও অনুগত দাস হয়ে। স্বেচ্ছাচারিতার স্বাধীন জীবন অতিবাহিত করে যাচ্ছে। ধরে নিয়েছে, দুনিয়াটাই সব কিছু। দুনিয়াটা মস্ত বড়, খাও-দাও ফুর্তি কর।' এই শ্লোগান তাদের মনে-মগজে জায়গা করে নিয়েছে। তাদের সন্দেহ ও বক্তব্য হল, “সে (মুহাম্মাদ) কি তোমাদেরকে এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তোমাদের মৃত্যু হলে এবং তোমরা মৃত্তিকা ও অস্থিতে পরিণত হলেও তোমাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে?! তোমাদেরকে যে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে তা কদাচ ঘটবে, কদাচ ঘটবে না। একমাত্র পার্থিব জীবন, আমরা মরি-বাচি এখানেই এবং আমরা পুনরুত্থিত হব না। সে তো এমন এক ব্যক্তি, যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে এবং আমরা তাকে বিশ্বাস করবার নই।” (সূরা মু'মিনুন ৩৫-৩৮ আয়াত) তাদের বুলি হল,
‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও ধারের খাতা শুন্য থাক,
দুরের আওয়াজ লাভ কি শুনে মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।”
কেউ বা বলে,
এখন যা পাই তাই নিয়ে যাই দুর অজানার কাজ কি মোর,
এমন মাটির স্বর্গ আমার কোথায় পাব এর দোসর?’
অন্য কেউ বলে থাকে,
‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহু দূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “---বল, আল্লাহই সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনেন ও পরে ওর পুনরাবর্তন ঘটান। সুতরাং তোমরা কেমন করে সত্য-বিচ্যুত হচ্ছাে? তুমি বল, তোমরা যাদেরকে (আল্লাহর) শরীক কর তাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে সত্যের পথ নির্দেশ করতে পারে? বল, আল্লাহই সত্য পথ নির্দেশ করে থাকেন। অতএব যিনি সত্যপথ নির্দেশ করেন তিনিই আনুগত্যের অধিকতর হকদার, নাকি যে তার পথ-প্রদর্শন ব্যতীত পথ পায় না সে? সুতরাং তোমাদের কি হয়েছে, কেমন তোমাদের বিচার? আসলে তাদের অধিকাংশই অনুমান ও কল্পনারই অনুসরণ করে থাকে। অথচ নিশ্চয় সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোন কাজে আসে না। তারা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে অবহিত।” {সূরা ইউনুস ৩৪-৩৬ আয়াত) কল্পনার কলে পড়ে যেমন এ শ্রেণীর লোকেরা সত্যকে প্রত্যাখান করে ঠিক তেমনিই বহু উদ্ভট অসত্য বিশ্বাস করে থাকে এরা। শুধু এরা এদের নিজ ধারণা ও চিন্তাবলে সত্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে অনেক সময় অনেক চিন্তাবিদ সত্যাশ্রয়ীদের নিকট হাস্যস্পদ হয়ে ওঠে। যেমন এক শহুরে চিন্তাবিদ পাড়া-গ্রামে এসে দেওয়ালে খুঁটে দেখে এই চিন্তাদ্বন্দ্বে পড়েছিল যে, এই দেওয়ালে গরু কিভাবে উঠে বিষ্ঠা ত্যাগ করল?!' তদনুরূপ বাদরের সাথে মানুষের আকৃতির। মিল দেখে বহু চিন্তাবিদের ধারণা হল, 'বহু কাল পূর্বে মানুষ আসলে বানর ছিল, পরে এর বিবর্তন ঘটেছে!' অর্থাৎ, তারা নাকি বাদরের জাত!!
মোট কথা, পরকালে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর জীবন-ধারা এক নয়। হতেও পারে না এক। একজন জানে যে, তাকে আমানতে দেওয়া প্রত্যেক পয়সা ও প্রত্যেক আয়-ব্যয়ের যথার্থ হিসাব লাগবে। আর একজন পরের ধনে পোদ্দারি করে এবং মনে করে যে, তাকে একটি পয়সারও হিসাব লাগবে না। তার আয়-ব্যয়ের হিসাব নেওয়ার মত কেউ নেই। এই উভয় লোকের খরচে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। পুঁজি ভেঙ্গে খেতে ভালো, ভিটেন গাঙে যেতে ভালো, যত কষ্ট বুঝতে আর উজুতে।' একজন জানে যে, সে কেবল পরের জমা করা ধন ভেঙ্গে খেয়ে যাবে, আর তাকে হিসাব বুঝাতে হবে না। নদীর ভাটার টানে তার নৌকা আপনা-আপনিই বয়ে যাবে এবং পরবর্তী কালে উঝানে আর উঠতে হবে না এমন লোক; আর যে জানে যে, তাকে তার ঐ ভেঙ্গে খাওয়া অর্থের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপ হিসাব লাগবে, প্রত্যেক কাজ ও খরচের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, জীবন-তরীকে পার্থিব ভোগ-বিলাস ও খেয়াল-খুশীর ভাটায় ভাসিয়ে দিলেও একদিন তাকে উঝান বেয়ে ফিরে যেতেই হবে। -এই উভয় মানুষের জীবন-পদ্ধতি, আহার-বিহার, চাল-চলন এক হতে পারে না। মানুষকে ভেবে দেখা উচিত যে, এ জীবনের মূল উদ্দেশ্য কি? মূল লক্ষ্য কি? কেন সে সৃষ্টি হয়েছে? তার কর্তব্যই বা কি? মূল লক্ষ্য কি কেবল রিপু ও ইন্দ্রিয়-সেবন? আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কি পার্থিব সুখ ও সফলতা? যদি তাই হয় তবে তা তো চিরস্থায়ী নয়। এ বিপুল সুখের ভরপুর আয়োজন ক’দিনের জন্য? সে সুখের স্বপ্ন নিদ্রাভঙ্গ হলেই যে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তারপর কি? মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি, আর তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না?” (সূরা মুমিনুন ১১৫ আয়াত)
“মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে?” (সূরা কিয়ামাহ ৬) না কক্ষনই না। “আমি দানব ও মানবকে তো আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াত ৫৬)
“মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করতে পারব না? বস্তুতঃ আমি ওর অঙ্গুলিগুলো পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম। তবুও যা অবশ্যম্ভাবী মানুষ তা অস্বীকার করতে চায়।” (সূরা কিয়ামাহ ৩-৫ আয়াত)
পূর্বোক্ত আলোচনার পরেও কোন যুবকের মনে আর কোন প্রশ্ন থাকা উচিত নয় যে, ধর্মহীন, লাগামছাড়া হওয়া সত্ত্বেও ওরা পার্থিব ব্যাপারে কত উন্নত জাগতিক সুখ ওদের পায়ে লুটিয়ে পড়েছে। আর আমাদের অবস্থা এমন হয়েছে যে, যে করবে ধম্ম, তার কাঁদতে যাবে জন্ম। কারণ, আমরা সে সুখ প্রতিযোগিতায় নামতে চাইনি। তাছাড়া আমাদের জন্য রয়েছে আমাদের প্রতিপালকের আশ্বাসবাণী; তিনি বলেন, “তোমাদেরকে যা কিছু দেওয়া হয়েছে, তা তো পার্থিব-জীবনের ভোগ ও শোভা এবং যা আল্লাহর নিকট আছে তা উত্তম ও স্থায়ী। তোমরা কি বুঝ না? যাকে আমি উত্তম পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি -যা সে পাবে, সে কি ঐ ব্যক্তির মত যাকে আমি পার্থিব জীবনের ভোগ-সম্পদ দিয়েছি, যাকে পরে কিয়ামতের দিন অপরাধীরূপে উপস্থিত করা হবে?” (সূরা কাসাস ৬০-৬১ আয়াত)
“বস্তুতঃ তোমাদেরকে যা কিছু দেওয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ্য; কিন্তু আল্লাহর নিকট যা আছে তা যারা ঈমান রাখে ও নিজেদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে তাদের জন্য উত্তম ও স্থায়ী।” (সূরা শুরা ৩৬ আয়াত)।
ছন্নছাড়া সে কাফেরদের সুখ-সম্ভােগ দেখে কোন মুসলিমের চোখ টাটানো উচিত নয়। সাধারণতঃ সেই জিনিসে মানুষের ঈর্ষা জন্মে, যাতে আছে উপকার ও কল্যাণ পার্থিব ভোগবিলাসে ক্ষণকালীন সুখ ছাড়া চিরকালীন কল্যাণ নেই। অতএব সে সম্পদে ঈর্ষা জন্মানো। মুসলিমের সমীচীন নয়।
মহান আল্লাহ বলেন, “আমি অবিশ্বাসীদের কতককে তাদের পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য-স্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়ে রেখেছি, তার প্রতি তুমি কখনো দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখো না। তোমার প্রতিপালকের উপজীবিকাই উৎকৃষ্টতর ও চিরস্থায়ী।(সূরা ত্বহ ১৩১ কাফেররা দুনিয়ায় সুখ ভোগ করবে। এটাই বিধির বিধান। তাদেরকে দুনিয়া দেওয়া হয়েছে। এবং হবেও। আর মুসলিমদের জন্য রয়েছে আখেরাত। দুনিয়াটাই হল কাফেরদের বেহেশু। তারপর চিরস্থায়ী আযাব। আর মুসলিমের ক্ষণকাল দুঃখ হলেও তার জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী বেহেস্তী সুখ পরকালে বেহেশ্যে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “সত্য-প্রত্যাখ্যানে মানুষ এক মতাবলম্বী হয়ে পড়বে এই আশঙ্কা থাকলে দয়াময় আল্লাহকে যারা অস্বীকার করে তাদেরকে তিনি ওদের গৃহের জন্য রৌপ্যনির্মিত সিঁড়ি দিতেন, রৌপ্যনির্মিত দরজা ও বিশ্রামের পালঙ্ক দিতেন। আর দিতেন স্বর্ণের অলঙ্কার। কিন্তু এ সব তো পার্থিব জীবনের ভোগ-সম্ভার। আর সংযমীদের জন্য তোমার প্রতিপালকের নিকট পরলোকের কল্যাণ আছে।” (সূরা যুখরুফ ৩৩-৩৫ আয়াত)।
“অতএব ওদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাকে মুগ্ধ না করে। আল্লাহ তো ওর দ্বারাই ওদেরকে পার্থিব জীবনে শাস্তি দিতে চান।” (সূরা তাওবাহ ৫৫ আয়াত)।
ওরা কতই বা উন্নত? প্রগতির নামে অধোগতির সমাজে কত যে দুর্গতি তাদের, তা বহু মানুষই জানে। তারা পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ সত্য, কিন্তু তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক সম্বন্ধে অবগত, পক্ষান্তরে ওরা পরকাল সম্বন্ধে একেবারে গাফেল।” (সূরা রূম ৭ আয়াত)
ওরা পার্থিব ঐ উন্নতি নিয়ে চাদে যেতে পারে, মঙ্গল বা অন্য কোন গ্রহে বাস করতে পারে, কিন্তু বেহেশ্যে পৌছতে পারে না নিশ্চয়। আর মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ হলেও, চাদে বা অন্য গ্রহে না যেতে পারলেও বেহেস্তে যাওয়ার পথ তার জন্য সুগম। পার্থিব ও বৈজ্ঞানিক উন্নতির পথে ইসলাম তো বাধা দেয় না; বরং যে কাজেই মানুষের কল্যাণ আছে সেই কাজেই ইসলাম মুসলিমকে অনুপ্রাণিত করে। তবুও প্রগতিশীল মানুষদের ধারণা যে, ইসলাম বিজ্ঞানের পথে বাধাস্বরূপ। যেমন কবি বলেছেন,
‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে তখনো আমরা বসে,
বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফিকা ও হাদীস চষে।
কিন্তু আমরা যদি কবিকে প্রশ্ন করি যে, আপনিও তো বসে আছেন, অথচ লোকে চাঁদে গেল, মঙ্গল গ্রহে পা রাখল?
‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে তখনো আমরা বসে,
কলম ধরিয়া কবিতা লিখেছি মনের রস ও রোষে।
তখন নিশ্চয় কবি বলবেন, 'চাদে যাওয়ার কাজ তো আমার সাধ্যে নয়। আমার সে উপায়। উপকরণ নেই। তাহলে যারা ফিকা ও হাদীস চষে বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেন তারাও নিশ্চয় বলবেন, ও কাজ আমাদের নয়। আমাদের ও কাজে সাধ্য ও উপায়-উপকরণ কিছুই নেই। এখন চাদে যদি না-ই যেতে পারি, তাহলে ধর্মও কি ছেড়ে বসতে হবে? হারামহালালের তমীজও কি বাদ দিতে হবে?’ পরন্তু মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিধানে হারামহালালের তমীজ করা হল ফরয। আর কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে চাদে যাওয়া হল বড় জোর মুস্তাহাব। চাঁদ বা মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার চেয়ে আমাদের কাছে বেহেস্তে যাওয়া অধিকতর। গুরুত্বপূর্ণ। তবুও চাদে যেতে ইসলাম মানা করেনি। তবে ইসলাম ও তার উলামা সমাজের প্রতি এ কটাক্ষ কেন?
এ কটাক্ষ করা চলে তাদের প্রতি, যাদের হাতে আছে বিভিন্ন উপায়-উপকরণ। যাদের ক্ষমতায় আছে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিজ্ঞান-মন্দির, গবেষণাগার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে লুক্কায়িত শত শত প্রতিভার প্রতিভাত ঘটানোর কাজ। সুতরাং কবির জন্য শোভনীয় ছিল। এই বলা,
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে তখনো আমরা বসে,
ভোগ-বিলাসের সিংহাসনে মত্ত থেকেছি রসে।
যাই হোক, পার্থিব জগতের চাকচিক্য নিয়ে ওরা বডড় খোশ। আর তারা মনে করে যে, ধর্মের বাঁধনে তারা আবদ্ধ নয় বলেই তাদের এই উন্নতি। নৈতিক বাধ্য-বাধকতা মানে না বলেই তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত উন্নত। কিন্তু মহান সৃষ্টিকর্তা বলেন, “যারা অবিশ্বাস করেছে তারা যেন এ ধারণা না করে যে, আমি তাদেরকে যে সুযোগ দিয়েছি, তা তাদের জন্য কল্যাণকর। তারা স্বীয় পাপ বর্ধিত করবে এই উদ্দেশ্যেই আমি তাদেরকে ঢিল দিয়ে রেখেছি। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাপ্রদ শাস্তি।” (সূরা আ-লি ইমরান ১৭৮)
যদিও তারা আজ ধর্মভীরুদেরকে ব্যঙ্গ করে ও নিজেদেরকেই চির উন্নত মনে করে তবুও প্রকৃতপ্রস্তাবে চির উন্নত হল মুসলিমরাই। চির’ শব্দের অর্থ মরণ পর্যন্তই বিস্তৃত নয়। চির’ হল অনন্তকালের জন্য মরণের পরপারেও যে জীবন, সে জীবনকেও পরিব্যাপ্ত।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “যারা অবিশ্বাস করছে, তাদের পার্থিব জীবন সুশোভিত করা হয়েছে, আর তারা বিশ্বাসী (মুসলিমদের)কে ঠাট্টা করে থাকে। অথচ যারা ধর্মভীরু তাদেরকে কিয়ামতে সমুন্নত করা হবে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবিকা দান করেন।” (সূরা বাকারাহ ২ ১২) সুতরাং অধোগতি মাকা’ সে সব প্রগতিশীল মানুষদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার কোন অর্থ থাকতে পারে কি? এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে মুমিনদেরকে নিষেধ করা হয়েছে।
একদা দুই জাহানের বাদশাহ, নবীকুল-শিরোমণি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) চাটাই-এর উপর হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলেন। তার পার্শ্বদেশে চাটাই-এর স্পষ্ট দাগ পড়ে গিয়েছিল। তার বগলে ছিল খেজুর গাছের চোকার বালিশ! তা দেখে হযরত উমার কেঁদে ফেললেন। আল্লাহর রসূল
# জিজ্ঞাসা করলেন, “হঠাৎ কেঁদে উঠলে কেন, হে উমার?” উমার বললেন, হে আল্লাহর রসুল! পারস্য ও রোম-সম্রাট কত সুখ-বিলাসে বাস করছে। আর আপনি আল্লাহর রসুল হয়েও এ অবস্থায় কালাতিপাত করছেন? আপনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করুন, যেন তিনি আপনার উম্মতকে পার্থিব সুখ-সম্পদে সমৃদ্ধ করেন। পারস্য ও রোমবাসীদেরকে আল্লাহ দুনিয়ার সুখ-সামগ্রী দান করেছেন, অথচ তারা তাঁর ইবাদত করে না!
এ কথা শুনে মহানবী ঃ হেলান ছেড়ে উঠে বসলেন এবং বললেন, “হে উমার। এ ব্যাপারে তুমি এমন কথা বল? ওরা হল এমন জাতি, যাদের সুখ-সম্পদকে এ জগতেই ত্বরান্বিত করা হয়েছে। তুমি কি চাও না যে, ওদের সুখ ইহকালে আর আমাদের সুখ পরকালে হোক?” (বুখারী ৫১৯১, মুসলিম, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে ১৩২৭ নং)। মহান আল্লাহ বলেন, “যেদিন অবিশ্বাসীদেরকে দোযখের নিকট উপস্থিত করা হবে, সেদিন ওদেরকে বলা হবে, 'তোমরা তো পার্থিব জীবনে তোমাদের সুখ-সভার ভোগ করে শেষ করেছ। সুতরাং আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া হবে। কারণ, তোমরা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিলে এবং তোমরা ছিলে সত্যদ্রোহী।” (সূরা আহক্বাফ ২০)
প্রগতিশীল যুবক বন্ধু আমার! জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে তুমি বিরাট বড় হয়ে বিরাট কিছু হতে পার, কিন্তু পরলোকে তুমি মিসকীন৷ এ জগতে তোমার ৫০০/৭০০ বিঘা জমি থাকতে পারে, হতে পার জমিদার। কিন্তু জান্নাতের মাটিতে তোমার এক-আধ কাঠা জায়গা কেনা না থাকলে নিশ্চয় তুমি নিঃস্ব। মানুষের দাসত্ব (চাকরী) করে তুমি মোটা অঙ্কের টাকা কামিয়ে বড় সুখী হতে পার। কিন্তু আল্লাহর দাসত্ব না করলে তুমি প্রকৃত ও চিরসুখী কখনোই হতে পার না। তুমি বহু কিছু হতে পার, কিন্তু প্রকৃত মুসলিম না হলে কিছুই নও। নৌকাচালক মাঝি বীজগণিতের ফরমুলা মুখস্থ না করলে, ভৌতবিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রক্রিয়া না জানলে, ভূগোলের গোল্লা না বুঝলে, ইতিহাসের ইতিবৃত্ত না জানলে তার জীবনের ১২ আনাই মিছে সত্যই, কিন্তু নৌকায় চড়ে কুলকুল-তান নদীর বুকে ঝড়ের তালে তালে যখন পানি ফুলে। ফুলে উঠে নৌকাডুবি হবে, তখন সে সময়ে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য যদি মাঝির মত সঁতার না শিখে থেকো তাহলে তুমি যত বড়ই পন্ডিত হও -তোমার জীবনের ১৬ আনাই মিছে। তোমার প্রগতির গাড়ির গতিবেগ যত বেশীই হোক না কেন, তবুও সে গাড়ি ঐ কবরডাঙ্গা পর্যন্ত চলমান। অতঃপর সে গাড়ি বদলি করতে হবে এবং তোমার গাড়ি যে অচল হয়ে থেকে যাবে, আর সেখানে যে তোমার প্রগতি অধোগতিতে পড়ে কি দুর্গতি হবে তা কি ভেবেছ?
গর্বিত বন্ধু আমার অহংকার প্রদর্শন করো না। দুনিয়া পেয়েছ বলে ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে দেখে নাক সিটকায়ো না। যে সুখ আছে, সে সুখ তোমার ক’দিনকার?
শত কামনা, শত বাসনা, শত আশার ফুলের মুকুল,
মরণ-তুফান আসিয়া নিমেষে ভাসাবে ভোগের স্নিগ্ধ দু’কুল।
মনের আশা রহিবে মনেই, ছিন্ন হইবে সকল বাঁধন,
হাটের মৎস্য হাটেই রহিবে মসলা বেঁটেও হবে না রাঁধন।
এসে গেলে সে
গাড়িপ্রস্তুত হওয়ার সময় দেবে না যেতে হবে তাড়াতাড়ি।
‘হে ভাই যুবক! ভেবে দেখ তুচ্ছ এই দুনিয়া নিয়ে, দুনিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা ও জুলুমবাজি নিয়ে, তার ধোকাবাজি ও ক্ষণস্থায়িত্ব নিয়ে। চিন্তা কর দুনিয়াদার ও সংসার-প্রেমী মানুষদের কথা; যাদেরকে দুনিয়া বিভিন্ন কষ্টে ক্লিষ্ট করেছে, পান করিয়েছে নানান তিক্ত ও বিষময় শারাব। যাদেরকে সামান্য আনন্দ দান করলেও কাদিয়েছে ও দুঃখ দিয়েছে বেশী।
ভেবে দেখ দোযখ নিয়ে, দোযখের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ও লেলিহান দাহিকাশক্তি নিয়ে। মনের গহীন কোণে একবার কল্পনা করে দেখ জাহান্নামের গভীরতা, তার কঠিন তাপ ও ভীষণ উষ্ণতা এবং আরো বিভিন্ন আযাব নিয়ে।
ভেবে দেখ, দোযখবাসীদের কথা; যাদেরকে সেখানে উপস্থিত করা হবে এবং তাদের চেহারা হবে বিকট কালো, চক্ষু হবে গাঢ় নীল, তাদের ঘাড়ে থাকবে বেড়ি ও শিকল। অতঃপর যখন তাদের সম্মুখে দোযখের দরজা খুলে দেওয়া হবে তখন সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে তাদের হৃদয় বিদগ্ধ হবে, হুঁশ হারিয়ে যাবে এবং শত আক্ষেপ ঘিরে ধরবে তাদের মন ও মগজে। ভাই যুবক! তুমি কত বছর বাচবে এ দুনিয়াতে? ৬০ বছর? ৮০, ১০০ অথবা ১০০০ বছর? তারপর কি? তারপর নিশ্চয়ই মুত্যু। তারপর হয় বেহেস্তের সুখময় বাসস্থান। নচেৎ দোযখের জ্বালাময় ঠিকানা। ভাইজান! তুমি কি দুনিয়ার এ ক'টা দিন, এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের ক’টা বছর আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্য রাখতে পারবে না? তোমার মন কি চায় না যে, কাল মরণের পর তুমি লাভ করবে চিরস্থায়ী জীবনের ইচ্ছাসুখের অনন্তকালের চির আনন্দ? (আখিল হাবীব দ্রঃ) পরিশেষে এস দুআ করি,
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ