কুরআন ও হাদীছের আলোকে হজ্জ, উমরাহ ও মদীনা যিয়ারত নবম অধ্যায় শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ১০ টি

মহান আল্লাহ বলেন:

﴿لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيراً﴾

তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের আশা রাখে আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।[1] আল্লাহ তা’আলা আরোও বলেন:

﴿قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعاً الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ لا إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ يُحْيِـي وَيُمِيتُ فَآمِنُواْ بِاللّهِ وَرَسُولِهِ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللّهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ﴾

বল হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রসূল, সেই আল্লাহর যিনি আকাশসমূহ আর পৃথিবীর রাজত্বের মালিক, তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোন মা’বূদ নেই, তিনিই জীবিত করেন আর মৃত্যু আনেন। কাজেই তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তাঁর প্রেরিত সেই নিরক্ষর বার্তাবাহকের প্রতি যে নিজে আল্লাহর প্রতি তাঁর যাবতীয় বাণীর প্রতি বিশ্বাস করে, তোমরা তাঁর অনুসরণ কর যাতে তোমরা সঠিক পথ পেতে পার।[2]

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন:

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

বলে দাও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসকল ক্ষমা করবেন, বস্ত্ততঃ আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।[3] আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন:

فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّكَ عَلَى الْحَقِّ الْمُبِينِ

কাজেই তুমি আল্লাহর উপর নির্ভর কর, তুমি তো সুস্পষ্ট সত্যের উপর আছ।[4] আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন:

فَذَلِكُمُ اللّهُ رَبُّكُمُ الْحَقُّ فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلاَّ الضَّلاَلُ فَأَنَّى تُصْرَفُونَ

তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। প্রকৃত সত্যের পর গুমরাহী ছাড়া আর কী থাকতে পারে? তোমাদেরকে কোন্দিকে ঘুরানো হচ্ছে?[5]

যা কিছুই নাবী (সা.)-এর আদর্শ ও পদ্ধতির পরিপন্থী হবে তা বাতিল, ভ্রষ্টতা এবং উক্ত আমলকারীর মুখে তা ছুঁড়ে দেয়া হবে। যেমন নাবী (সা.) বলেছেন:

مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيهِ أمرُنا فَهُوَ رَد

যে ব্যক্তি এমন আমল করবে যার প্রতি আমাদের আদর্শ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।[6] এর অর্থ হচ্ছে যে, সেই আমল তার দিকেই ছুঁড়ে ফেলা হবে এবং তা গ্রহণ করা হবে না।

তবে কিছু মুসলিম বিভিন্ন ইবাদাতের ক্ষেত্রে কুরআন ও সহীহ হাদীস বিরোধী বহু কাজ করে। আল্লাহ তাদের হিদায়াত দান করুন এবং সুন্নাতের অনুসরণের তাওফীক প্রদান করুন। আর বিশেষ করে হাজ্জের সময় না জেনে ফাতওয়া প্রদানকারীদের সংখ্যা বেড়ে যায়। এমনকি এক শ্রেণীর মানুষ ফাতওয়া দেয়াকে খ্যাতির উদ্দেশে পেশা বানিয়ে ফেলেছে। যার কারণে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হয় এবং বহু লোকদের পথভ্রষ্ট করে। অথচ প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয যে, ফাতওয়া দেয়ার পূর্বে সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হাসিল করে নিবে। কারণ, ফাতওয়া প্রদানকারী মহান আল্লাহর পক্ষ হতে বার্তাবাহকের স্থলাভিষিক্ত। তাকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহী করতে হবে। অতএব যে কোন মুফতী ফাতওয়া দেয়ার সময় যেন নাবী (সা.)-এর সম্পর্কে মহান আল্লাহর এই বাণী স্মরণ করে নেয়:

﴿وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ۞ لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ۞ ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ۞ فَمَا مِنكُم مِّنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِينَ﴾

আর নাবী যদি কোন কথা নিজে রচনা করে আমার নামে চালিয়ে দিত, আমি অবশ্যই তার ডান হাত ধরে তাকে পাকড়াও করতাম, তারপর অবশ্যই কেটে দিতাম তার হৃৎপিণ্ডের শিরা, অতঃপর তোদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে, (আমার গোস্বা থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য) বাধা সৃষ্টি করতে পারে।[7]

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন:

﴿قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُواْ بِاللّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَاناً وَأَن تَقُولُواْ عَلَى اللّهِ مَا لاَ تَعْلَمُونَ﴾

বল, আমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, পাপ, অন্যায় অত্যাচার, আল্লাহর অংশীদার স্থির করা যে ব্যাপারে তিনি কোন প্রমাণ নাযিল করেননি, আর আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের অজ্ঞতাপ্রসূত কথাবার্তা হারাম করে দিয়েছেন।[8] আর হাজীদের অধিকাংশ ভুলগুলির কারণ হচ্ছে, না জেনে ফাতওয়া দেয়া এবং বিনা দলীলে পরস্পর অন্ধ অনুকরণ করা। তাই আমরা এখানে এমন কতিপয় আমল এবং সে ক্ষেত্রে যে সব ভুল হয়ে থকে সে সব বিষয় উল্লেখ করে ভুল-ভ্রান্তি থেকে সতর্ক করব। মহান আল্লাহর নিকট দু‘আ করি যেন তিনি আমাদেরকে সত্য কথা বলার এবং গ্রহণ করার তাওফীক প্রদান করেন এবং আমাদের মুসলিম ভাই-বোনদের ইহা দ্বারা উপকৃত করেন। নিশ্চয়ই তিনি সম্মানিত দাতা।

>
[1]. সূরা আল-আহযাব ৩৩:২১

[2]. সূরা আরাফ ৭:১৫৮

[3]. সূরা আলি-ইমরান ৩ঃ ৩১

[4]. সূরা আ-নাম্লঃ ৭৯

[5]. সূরা ইউনুসঃ ৩২

[6]. সহীহ মুসলিম ১৭১৮।

[7]. সূরাহ্ আল হা-ক্কাহঃ ৪৪-৪৭

[8]. সূরাহ্ আল-আ‘রাফঃ ৩৩

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আল্লাহর রসূল (সা.) মীক্বাত নির্ধারিত করেছেন, মদীনাবাসীদের জন্য ‘যুলহুলাইফা’ নামক স্থানকে (যার বর্তমান নাম আবয়ার আলী), শাম দেশবাসীদের জন্য ‘জুহফা’ নামক স্থানকে, নজদবাসীদের জন্য ‘কারনুল মানাযিল’ নামক স্থানকে (যার বর্তমান নাম আস্সায়লুল কাবীর) এবং ইয়ামানবাসীদের জন্য ‘ইয়ালামলাম’ নামক স্থানকে। আর তিনি একথাও বলেন: এ মীক্বাতগুলি এ এলাকবাসীদের জন্যে এবং ঐ সব লোকের জন্যে যারা অন্য এলাকা থেকে এ পথ হয়ে আগমন করবে, যদি তারা হাজ্জ বা উমরার নিয়্যাতে আসে।[1]

আয়িশা (রা.) হতে আরও বর্ণিত, তিনি বলেন যে, নাবী (সা.) ইরাক্ববাসীদের জন্যে ‘যাতু ইরক’ নামক স্থানকে মীক্বাত নির্ধারিত করেন।[2]

আরো আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) হতে বর্ণিত যে, নাবী (সা.) বলেছেন:

يُهِلُّ أَهْلُ الْمَدِينَةِ مِنْ ذِي الْحُلَيْفَةِ وَيُهِلُّ أَهْلُ الشَّأْمِ مِنْ الْجُحْفَةِ وَيُهِلُّ أَهْلُ نَجْدٍ مِنْ قَرْن

মদীনাবাসী যুলহুলায়ফা থেকে ইহরাম করবে, শামবাসী জুহফা থেকে ইহরাম করবে এবং নাজদবাসী ক্বারন হতে ইহরাম করবে।[3]

এ মীক্বাতগুলি আল্লাহর রসূল (সা.) স্বয়ং নির্ধারত করেছেন, যা আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াত। অতএব ইহা কারো জন্য বদল করা বা তাতে বাড়াবাড়ি করা, কিংবা হাজ্জ বা উমরার ইচ্ছুকদের জন্য বিনা ইহরামে তা অতিক্রম করা জায়েয নয়। কারণ, ইহা মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমানা (আইনসমূহ) লঙ্ঘন করার শামিল। আর আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:

وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ اللّهِ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

আর যারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করবে, তারাই যালিম।[4]

আর নাবী (সা.) থেকে বর্ণিত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.)-এর হাদীসে আছে যে,

يُهِلُّ أَهْلُ المَدِينَةِ مِنْ ذِي الحُلَيْفَةِ، وَيُهِلُّ أَهْلُ الشَّأْمِ مِنَ الجُحْفَةِ، وَأَهْلُ نَجْدٍ مِنْ قَرْنٍ

মদীনাবাসী যুলহুলায়ফা থেকে ইহরাম করবে, শামবাসী জুহফা থেকে ইহরাম করবে এবং নাজদবাসী ক্বার্ন হতে ইহরাম করবে।[5]

এ হাদীসের অর্থ নির্দেশসূচক। এজন্যই ইবনু উমার (রা.) বলেন, আল্লাহর রসূল (সা.) (মীক্বাতগুলি) ফরয (নির্ধারণ) করেছেন। যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

সুতরাং হাজ্জ কিংবা উমরা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি উপরোক্ত মীক্বাতগুলি বা তার বরাবর হয়ে অতিক্রম করলে সেখান হতে ইহরাম বাঁধা ওয়াজিব। স্থলপথ হয়ে আগমন করুক কিংবা সমুদ্রপথ হয়ে অথবা আকাশপথ হয়ে।

তাই কোন ব্যক্তি যদি স্থলপথে এসে সেই মীক্বাত হয়ে অতিক্রম করে তাহলে সেখানে অবতরণ করবে। আর যদি তার বরাবর দূর দিয়ে অতিক্রম করে তাহলে মীক্বাত বরাবর হলেই ইহরাম করার সময়ে যা করণীয় তা সম্পাদন করবে: যেমন গোসল করা, শরীরে সুগন্ধি ব্যবহার করা এবং পুরুষদের জন্য সিলাই বিহীন ইহরামের কাপড় পরিধান করা। তারপরে মীক্বাত থেকে প্রস্থানের আগেই ইহরামের নিয়্যাত করবে।

আর যদি কোন ব্যক্তি জলপথে হাজ্জে বা উমরার উদ্দেশ্যে আসে এবং জাহাজ মীক্বাত বরাবর থামে, তাহলে সেখানে গোসল করবে, সুগন্ধি ব্যবহার করবে এবং অবস্থানরত অবস্থায় (পুরুষরা সিলাই বিহীন ইহরামের কাপড় পরিধান করবে)। তারপরে সেখান থেকে প্রস্থানের আগেই ইহরামের নিয়্যাত করবে। তবে যদি জাহাজ মীক্বাত বরাবর না থামে, তাহলে মীক্বাত বরাবর হওয়ার পূর্বেই গোসল করবে, সুগন্ধি ব্যবহার করবে এবং অবস্থানরত অবস্থায় (পুরুষরা সিলাই বিহীন ইহরামের কাপড় পরিধান করবে)। তারপরে মীক্বাত বরাবর হওয়ার আগেই ইহরামের নিয়্যাত করবে।

আর যদি কোন ব্যক্তি হাজ্জ বা উমরার উদ্দেশ্যে আকাশপথে আসে, তাহলে বিমানে চড়ার পূর্বেই গোসল করে নিবে, সুগন্ধি ব্যবহার করবে এবং (পুরুষরা সিলাই বিহীন ইহরামের কাপড় পরিধান করবে)। তারপরে মীক্বাত বরাবর হওয়ার অপেক্ষা না করে তার কিছু পূর্বেই ইহরামের নিয়্যাত করবে। কারণ, বিমান খুব দ্রুত পথ অতিক্রম করায় মীক্বাত বরাবর হওয়ার সময় পাওয়া যাবে না; ফলে যদি মীক্বাত বরাবর হওয়ার বেশ আগেই ইহরাম করে নেয় তাতে কোন দোষ নেই।

এখানে কিছু লোকেরা যে ভুলটি করে থাকে তা হলো, তারা বিমানে চেপে মীক্বাতের উপর বা তার আশ-পাশ দিয়ে অতিক্রম করে চলে আসে, তারপর তারা জিদ্দা বিমান বন্দরে অবতরণ করে। অতঃপর সেখান থেকে ইহরাম বাঁধে। অথচ ইহা নাবী (সা.)-এর নির্দেশ পরিপন্থী কাজ এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করা।

আর আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, বসরা ও কূফা দুই শহর বিজয় হলে লোকেরা উমার (রা.)-এর নিকট এসে বলল যে, নাবী (সা.) নাজদবাসীদের জন্যে ক্বার্ন নামক স্থানকে মীক্বাত নির্ধারিত করেছেন, যা আমাদের পথ হতে উল্টো পথে। তাই যদি আমরা ক্বার্ন নামক স্থানে এসে ইহরাম করি তাহলে তা আমাদের জন্য বড় কষ্টকর হয়ে যায়। তখন খালীফা উমার (রা.) বললেন, তাহলে ‘ক্বার্নুল মানাযিল’ বরাবর তোমাদের রাস্তা খুঁজে নাও তাহলে যারা মীক্বাত হয়ে অতিক্রম করতে পারে না, আমীরুল মু’মিনীন খলীফায়ে রাশিদীন তাদের মীক্বাত বরাবর স্থানকেই মীক্বাত গণ্য করলেন।[6] আর যেমন স্থলে মীক্বাত বরাবর হওয়া তেমনি হচ্ছে আকাশ পথে মীক্বাত বরাবর হওয়া। উভয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই।

অতএব কোন মানুষ যদি এধরণের ভুল করে ফেলে, যেমন ইহরাম করার পূর্বে জিদ্দায় অবতরণ করল, তাহলে বিমান পথে যেই মীক্বাত বরাবর হয়ে অতিক্রম করেছিল সেই মীক্বাতে ফিরে গিয়ে সেখান থেকে ইহরাম করবে। আর যদি তা না করে জিদ্দা থেকে ইহরাম করে তাহলে অধিকাংশ আলিমগণের মতে তাকে মক্কায় ফিদয়া (কুরবানী) যবহ করে সমস্ত মাংসটা সেখানকার দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করে দিতে হবে। সে ব্যক্তি তা হতে কিছু খেতে পারবে না এবং কোন স্বচ্ছল ব্যক্তিকে তা থেকে উপঢৌকনও দিতে পারবে না। কারণ, ইহা কাফফারার সমতুল্য।

[1]. সহীহ বুখারী ১৫২৪।

[2]. সুনান আবূ দাউদ ১৭৩৯ ও সুনান নাসঈ ২৬৫৩।

[3]. সহীহ বুখারী ১৫২৬ ও মুসলিম১১৮১।

[4]. সূরা আল-বাক্বারা ২ঃ ২২৯

[5]. সহীহ বুখারী ১৫২৫।

[6]. সহীহ বুখারী ১৫৩১।
তাওয়াফ সংক্রান্ত কর্মগত ভুল-ভ্রান্তি

নাবী (সা.) হতে প্রমাণিত, তিনি বায়তুল্লাহর পূর্ব দক্ষিণ কোণায় অবস্থিত হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) হতে তাওয়াফ শুরু করেন। আর তিনি হিজরের (হাতীম) বাহির দিয়ে সম্পূর্ণ কা‘বা ঘরের তাওয়াফ করেন। আর তিনি মক্কায় সর্বপ্রথম পদার্পণ করে তাওয়াফের শুধুমাত্র প্রথম তিন চক্করে রামাল (পায়ের ধাপ ছোট করে দ্রুত চলা) করেন। আর তিনি (সা.) নিজ তাওয়াফে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করতেন এবং তাকে চুম্বন দিতেন।[1]

আবার কখনও তিনি নিজ হাত দ্বারা হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করতেন এবং হাতে চুম্বন দিতেন। আবার কখনও বাহনে চেপে নিজ লাঠি দ্বারা স্পর্শ করেন এবং তাতে চুম্বন দেন। আর কখনও তিনি নিজ উটের উপর সাওয়ার হয়ে তাওয়াফ করেন এবং প্রত্যেক চক্করে হাজরে আসওয়াদের দিকে হাতের ইশারা করতেন। আর নাবী (সা.) হতে ইহাও প্রমাণিত যে, তিনি রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করতেন (কিন্তু তাতে চুম্বন দিতেন না)।

আর হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের বিভিন্ন পদ্ধতি হওয়ার কারণ হচ্ছে, সুবিধা অনুযায়ী চুম্বন করা; যখন যেমনটি সুবিধাজনক হয়েছে তখন তিনি তাই করেছেন। (আল্লাহই অধিক জ্ঞানী) আর নাবী (সা.) যে হাজরে আসওয়াদকে কখনো স্পর্শ করে হাতে চুম্বন দিয়েছেন, কখনো সরাসরি পাথরেই চুম্বন দিয়েছেন এবং কখনো হাতের ইশারা করেছেন, এসমস্ত একমাত্র মহান আল্লাহর ইবাদাত ও তাঁর মহত্ত্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে। কখনো এবিশ্বাস নিয়ে নয় যে, পাথর কোন উপকার বা অপকার করতে পারে।

উমার (রা.) হতে বর্ণিত যে, তিনি হাজরে আসওয়াদে চুম্বন দিয়ে বলতেন:

إِنِّي أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لَا تَضُرُّ وَلَا تَنْفَعُ وَلَوْلَا أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ

নিশ্চয়ই আমি জানি যে, তুমি একটি পাথর, কোন ক্ষতিও করতে পার না এবং কোন উপকারও করতে পার না। তাই আমি যদি তোমাকে চুম্বন দিতে নবী (সা.)-কে না দেখতাম তাহলে কখনো আমি তোমাকে চুম্বন দিতাম না।[2]

[1]. সহীহ বুখারী ১৬০৩-১৬০৬।

[2]. সহীহ বুখারী ১৫৯৭।
কতিপয় হাজীগণের এক্ষেত্রে যে সব ভুল হয়ে থাকে:

১। হাজরে আসওয়াদের সামনে আসার পূর্বেই তাওয়াফ শুরু করা।

ইহা দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির অন্তর্ভুক্ত, যা থেকে নাবী (সা.) নিষেধ করেছেন। আর ইহা কিছু ক্ষেত্রে রমযানের এক বা দুই দিন পূর্বে সিয়াম রাখার সাদৃশ্য। নাবী (সা.) যা করতে নিষেধ করেছেন। এ সম্পর্কে কতেক হাজীর যুক্তি যে, তারা সতর্কতা মূলক ইহা করে থাকেন, তাদের একথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আসল ও লাভজনক সতর্কতা হচ্ছে শরিয়তের অনুসরণ করা এবং মহান আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা.)-এর আগে বেড়ে না যাওয়া।

২। ভীড়ের সময় কতেক হাজীদের হাতীমের মধ্য দিয়ে তাওয়াফ করা।

তা এভাবে যে, হাতীমের এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করে অপর দরজা দিয়ে বের হয়ে যায় এবং হাতীমের অবশিষ্ট অংশ তারা ডান পার্শ্বে ছেড়ে দেয়। ইহা একটি বড় ভুল; এভাবে তাওয়াফ শুদ্ধ হবে না। কারণ, এতে তারা পুরো কা‘বা ঘরের তাওয়াফ না করে তার কিছু অংশের তাওয়াফ করল।

৩। তাওয়াফের সাত চক্করেই রামাল (পায়ের ধাপ ছোট করে দ্রুত চলা) করা ভুল। সঠিক হচ্ছে শুধুমাত্র প্রথম তিন চক্করে রামাল করা।

৪। হাজরে আসওয়াদে চুম্বন দেয়ার উদ্দেশ্যে সেখানে পৌঁছাতে গিয়ে বেশী ভীড়-ভাড় করা। এমন কি কোন কোন সময় ইহা লড়াই-ঝগড়া ও গালাগালী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। যার ফলে সেখানে মারমারি ও এমন অশালীন কথা-বার্তা হয়ে যায় যা এমন সৎ কাজে, আল্লাহর সম্মানিত মসজিদে এবং তাঁর পবিত্র ঘরের ছায়ায় হওয়া সমীচিন নয়। এধরণের অন্যায়ে লিপ্ত হলে শুধু তাওয়াফ অসম্পূর্ণ থাকে না, বরং পুরো হাজ্জ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এর প্রমাণ মহান আল্লাহর বাণী:

﴿الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَّعْلُومَاتٌ فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ الْحَجَّ فَلاَ رَفَثَ وَلاَ فُسُوقَ وَلاَ جِدَالَ فِي الْحَجِّ وَمَا تَفْعَلُواْ مِنْ خَيْرٍ يَعْلَمْهُ اللّهُ﴾

হাজ্জ হয় কয়েকটি নির্দিষ্ট মাসে। অতঃপর এ মাসগুলোতে যে কেউ হাজ্জ করার মনস্থ করবে, তার জন্য হাজ্জের মধ্যে সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। আর তোমরা যে কোন সৎ কাজই কর, আল্লাহ তা জানেন।[1]

এধরণের ধাক্কা-ধাক্কি করা ইবাদাতে বিনয়ীভাব নষ্ট করে এবং মহান আল্লাহর যিকির হতে গাফিল করে দেয়, যা হচ্ছে তাওয়াফের মুখ্য উদ্দেশ্য।

৫। কতেক হাজীর ধারণা যে, হাজরে আসওয়াদ স্বয়ং উপকারী, তাই তারা তা স্পর্শ করার সময় নিজ গায়ে অথবা সঙ্গে থাকা সন্তানদের গায়ে হাত বুলায়। এসমস্ত কাজ অজ্ঞতা ও গুমরাহী। কারণ, লাভ ও ক্ষতি একমাত্র আল্লাহর পক্ষ হতে।

আর আমি পূর্বে আমীরুল মু’মিনীন উমার (সা.)-এর বাণী উল্লেখ করেছি, হে পাথর! নিশ্চয়ই আমি জানি যে, তুমি একটি পাথর, কোন ক্ষতিও করতে পার না এবং কোন উপকারও করতে পার না। তাই আমি যদি তোমাকে চুম্বন দিতে নাবী (সা.)-কে না দেখতাম তাহলে কখনো আমি তোমাকে চুম্বন দিতাম না।[2]

৬। কতেক হাজী কা’বা ঘরের চার কর্ণাই স্পর্শ করে ও চুম্বন দেয়, এমন কি অনেকে কা’বা ঘরের সমস্ত দেয়ালকে স্পর্শ করে ও চুম্বন দিয়ে থাকে এবং শরীরে হাত বুলায়। এ সমস্ত কাজ অজ্ঞতা ও গুমরাহী বৈ কিছু নয়।

কারণ রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করা এবং হাজরে আসওয়াদ চুম্বন বা স্পর্শ করা মহান আল্লাহর ইবাদাত ও তাঁর মহত্ত্ব প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। তাই নাবী (সা.) থেকে যতটুকু প্রমাণিত তাই যথেষ্ট মনে করা আবশ্যক। কারণ, নাবী (সা.) দুই রুকনে ইয়ামানী কা’বা ঘরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণ -যাতে হাজরে আসওয়াদ লাগানো রয়েছে- এবং পশ্চিম-দক্ষিণ কোণ (রুকনে ইয়ামানী) ছাড়া বায়তুল্লাহর অন্য কোন কনা স্পর্শ করেননি।

আর মুসনাদ আহমাদে তাবেঈ মুজাহিদ (রহঃ) সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি একবার মুআবিয়া (রা.)-এর সাথে তাওয়াফ করেন, তখন মুআবিয়া (রা.) কা’বা ঘরের চার কণা স্পর্শ করা শুরু করেন। তখন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন, এ দু’টি কোণ (রুকনে শামী এবং রুকনে ইরাকী) কেন স্পর্শ করলেন? অথচ আল্লাহর রসূল (সা.) তা স্পর্শ করতেন না। তখন মুআবিয়া (রা.) উত্তরে বললেন, কা’বা ঘরের কোন কিছুই ছাড়ার মতো নয়। তখন উত্তরে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন:

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ

তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।[3] তখন উত্তরে মুআবিয়া (রা.) বলেন, তুমি ঠিকই বলেছ।[4]

[1]. সূরা বাক্বারা ২ঃ ১৯৭

[2]. সহীহ বুখারী ১৫৯৭।

[3]. সূরাহ্ আল-আহযাবঃ ২১

[4]. হাসান লি গাইরিহী: মুসনাদে আহমাদ ১৮৭৭।
তাওয়াফ সংক্রান্ত বাচনিক ভুল-ভ্রান্তি

নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত যে, তিনি হাজরে আসওয়াদের সামনে আসলেই মহান আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে "আল্লাহু আকবার" পাঠ করতেন।[1]

আর রুকনে ইয়ামানী এবং হাজরে আসওয়াদের মাঝে এ দু‘আ পাঠ করতেন:

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

[রব্বানা আতিনা ফিদ্দুন ইয়া হাসানাহ, ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাহ্, ওয়াক্বিনা আযা বান্নার]

হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দাও এবং আখিরাতেও কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব হতে রক্ষা কর।[2] আর নাবী (সা.) বলেছেন:

إِنَّمَا جُعِلَ الطَّوَافُ بِالْبَيْتِ وَبِالصَّفَا وَالْمَرْوَةِ وَرَمْيُ الْجِمَارِ لِإِقَامَةِ ذِكْرِ اللَّهِ

নিশ্চয়ই বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার সাঈ এবং জামরাগুলিতে কংকর নিক্ষেপ করা আল্লাহর যিকির (স্মরণ) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে বিধি-বদ্ধ করা হয়েছে।[3]

১। এক্ষেত্রে কতেক হাজীরা যে ভুল করে থাকে তা হচ্ছে, প্রত্যেক চক্করে একটি করে বিশেষ গদ বাঁধা দু‘আ পাঠ করা। উপরোক্ত দু‘আ ছাড়া আর কোন দু‘আ পাঠ করবে না। এমন কি সেই চক্করটি যদি নির্দিষ্ট দু’আটি শেষ হবার আগে সমাপ্ত হয়ে যায় তাহলে দু‘আটির একটি শব্দ অবশিষ্ট থাকলেও তা বন্ধ করে দেয়, যাতে করে পরের চক্করে নুতন দু‘আ পাঠ করতে পারে। আর যদি চক্কর সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে বিশেষ দু‘আটি পড়া শেষ হয়ে যায় তাহলে নিরব হয়ে থাকে।

অথচ তাওয়াফ সম্পর্কে নাবী (সা.) হতে প্রত্যেক চক্করের জন্য বিশেষ কোন দু‘আ পড়ার কোন প্রমাণ নেই। তাই শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ্ (রহঃ) বলেন, তাওয়াফ সংক্রান্ত কোন বিশেষ নির্ধারিত যিকির বা দু‘আ নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত নয়। না তাঁর এ সম্পর্কে কোন নির্দেশ, না তাঁর কোন উক্তি, আর না তিনি কোন ব্যক্তিকে শিক্ষা দিয়েছেন।

বরং তিনি (সা.) তাওয়াফের সময় যে কোন শরিয়াত সম্মত দু‘আ করতেন। আর অনেক লোকেরা কা’বা ঘরের ছাদের নালার নীচে বা তাওয়াফের সময় যে বিশেষ দ’ুআ পাঠ করেন, তার কোন ভিত্তি নেই। তাই তাওয়াফকারী ইহকাল-পরকালের কল্যাণের জন্য নিজ পছন্দ মত যে কোন দু‘আ পাঠ করবে।

অনুরূপ যে কোন শরিয়াত সম্মত যিকির (যা সম্মিলিত নয় এবং অসম্পূর্ণ বাক্য দিয়ে নয়) দ্বারা মহান আল্লাহর যিকির করবে। যেমন:

তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ পাঠ করা)

তাহমীদ (আলহামদু লিল্লাহ পাঠ করা)

তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করা)

তাকবীর (আল্লাহু আকবার পাঠ করা)

অথবা কুরআন তিলাওয়াত করা।

২। আর কতেক তাওয়াফকারীদের ভুল হচ্ছে যে, তারা এ গদ বাঁধা দু‘আগুলি লিখিতভাবে হাতে নিয়ে অর্থ না বুঝেই পাঠ করে। কখনো তাতে টাইপের ভুল থাকার কারণে অর্থ সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। যার ফলে তার অজানাতেই নেক দু‘আ বদ দু‘আয় পরিণত হয়। আর আমরা এধরণের আশ্চর্যজনক দু‘আ অনেক শুনে থাকি। তাই যদি তাওয়াফকারী ব্যক্তি নিজ ইচ্ছামত অর্থ বুঝে দু‘আ করতো তাহলে তার জন্য ইহা বড় কল্যাণকর ও অধিক উপকারী হতো এবং রসূল (সা.)-এর খাঁটি অনুসারীও হতে পারত।

৩। কতেক তাওয়াফকারী আরো ভুল করে যে, তারা কোন এক মুআল্লিম ভাড়া করে, যে একদলকে তাওয়াফ করায় এবং তাদেরকে উচ্চস্বরে দু‘আ পড়াতে থাকে, তখন উক্ত দলটি সম্মিলিতভাবে চিৎকার করে তার অনুসরণ করতে থাকে, যাতে বড় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় ফলে অন্যান্য তাওয়াফকারীদের জন্য এমন কষ্টের কারণ হয়ে যায় যে তারা কি পড়ছে টেরও পাচ্ছে না। এতে তাওয়াফের খুশু ও বিনয়ীভাব বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এরকম পবিত্র ও নিরাপদ স্থানে আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট দেয়া হয়।

অথচ একদা নাবী (সা.) কিছু লোকদের একসাথে উচ্চস্বরে কুরআন পাঠ করে সলাত আদায় করতে দেখে তাদের সামনে বের হয়ে বললেন:

إِنَّ الْمُصَلِّيَ يُنَاجِي رَبَّهُ فَلْيَنْظُرْ بِمَا يُنَاجِيهِ بِهِ وَلَا يَجْهَرْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَعْضٍ بِالْقُرْآنِ

নিশ্চয়ই সলাত আদায়কারী নিজ প্রতিপালকের সঙ্গে চুপিস্বরে কথা বলে, সুতরাং সে যেন চিন্তা করে নেয় যে, কিভাবে তাঁর সাথে কথা বলছে। আর তোমাদের একে অপরের সামনে যেন উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত না করে।[4] তাই কতই না ভাল হতো যদি এ মুআল্লিম কা‘বা ঘরের নিকট লোকদেরকে নিয়ে এসে তাওয়াফের নিয়মাবলী শিখিয়ে দিত এবং তারা নিজ নিজ পছন্দমত অর্থ বুঝে দু‘আ করত। আর তাদের সঙ্গে তাওয়াফ অবস্থায় থেকে ভুল-ভ্রান্তির সংশোধন করে দিত তাহলে তারা বিনয় ও প্রশান্তির সাথে তাওয়াফ করতে পারতো এবং অন্তরে আল্লাহ পাকের ভয়-ভীতি নিয়ে একনিষ্ঠভাবে বুঝে-বুঝে নিজ ইচ্ছা মতো দু‘আ করে ধন্য হতো এবং অন্যান্য লোকেরাও তাদের পক্ষ হতে কোন রকম কষ্ট পাওয়া থেকে নিরপদ থাকত।

>
[1]. সহীহ বুখারী ১৬১৩।

[2]. হাসান: সুনানে আবূ দাউদ ১৮৯২, সূরা আল-বাক্বারা ২ঃ ২০১

[3]. হাসান: সুনানে দারিমী ১৮৯৫।

[4]. মুআত্তা ইমাম মালিক, ইমাম আবনু আব্দিলবার হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
তাওয়াফ শেষে দু‘রাকা‘আত সলাতে কতিপয় মানুষের ভুল

নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত যে, তিনি তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহীমের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিম্নোক্ত আয়াতের অংশটি পাঠ করতেন:

وَاتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى

[ওয়াত্তাখিযু মিম্ মাক্বামি ইবরাহীমা মুসাল্লা]

তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সলাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর।

অতঃপর মাকামে ইবরাহীমকে কা‘বা ঘর ও নিজের মাঝখানে রেখে দুই রাক‘আত সলাত আদায় করতেন। প্রথম রাক‘আতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা কাফিরূন এবং দ্বিতীয় রাকা‘আতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা ইখলাস পাঠ করতেন।[1]

এক্ষেত্রে কতিপয় লোকেরা যে ভুল করে তা হচ্ছে, তাদের ভুল ধারণা যে, এই দুই রাকা‘আত সলাত মাকামে ইবরাহীমের নিকটেই আদায় করতে হবে, যার ফলে তারা এখানে বড় ভীড় করে থাকে এবং বিশেষ করে হাজ্জ ও রমাদ্বানের ভীড়ের মৌসুমে তাওয়াফকারীদের কষ্ট দিয়ে থাকে এবং তাদের তাওয়াফের পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের এই ধারণা ভুল; কারণ, এই সলাত মাসজিদে হারামের যে কোন স্থানে আদায় করাই যথেষ্ট। আর মাকামে ইবরাহীম থেকে দূরে সলাত আদায় করেও তাকে নিজের ও কা‘বা ঘরের মাঝখানে রেখে সলাত আদায় করা যেতে পারে। যাতে করে নিজেকে এবং অপর কোন ব্যক্তিকে কষ্ট দেয়া থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয় এবং বিনয় ও প্রশান্তির সাথে সলাতটি সম্পাদিত হয়। তাই যদি মাসজিদে হারামের দায়িত্বশীলরা মাকামে ইবরাহীমের পিছনে নিকটবর্তী হয়ে যারা সলাত আদায় করে তাওয়াফকারীদের কষ্ট দিয়ে থাকে তাদের এধরণের কাজে বাঁধা দিত এবং তাদেরকে জানিয়ে দিত যে, তাওয়াফের পরের দুই রাকা‘আত সলাতের জন্য মাকামে ইবরাহীমের নিকটবর্তী হওয়া শর্ত নয় তাহলে বড় ভাল হত।

এক্ষেত্রে যে ভুলটি হয়ে থাকে তা হচ্ছে যে, কিছু লোকেরা মাকামে ইবরাহীমের পিছনে বিনা কারণে অধিক পরিমাণে সলাত আদায় করে, অথচ যারা তাওয়াফ সমাপ্ত করে ফেলেছে তাদের এখানে সলাত আদায়ের জায়গার প্রয়োজন।

এখানে আরো একটি ভুল হয়ে থাকে তা হচ্ছে যে, কিছু তাওয়াফকারীরা দুই রাক‘আত সলাত শেষে তাদের নেতা তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে উচ্চস্বরে সম্মিলিত দু‘আ করতে শুরু করে, ফলে সেখানকার নামাযীদের নামাযে গোলযোগ সৃষ্টি করে তাদের প্রতি অন্যায় করে থাকে। অথচ মহান আল্লাহ বলেন:

ادْعُواْ رَبَّكُمْ تَضَرُّعاً وَخُفْيَةً إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ

তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে বিনয়ের সঙ্গে এবং গোপনে আহবান কর। তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।[2]

সাফা ও মারওয়ায় আরোহণ, তার উপর দু‘আ এবং দুই সবুজ বাতির মাঝখানে দৌঁড় দেয়া ও এক্ষেত্রে কতিপয় মানুষের ভুল

নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত যে, তিনি সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হলে এই আয়াত পাঠ করতেন:

إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ

[ইন্নাস্সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআ‘ইরিল্লাহ্]

নিশ্চয়ই ‘সাফা’ এবং ‘মারওয়া’ আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম।[3]

তারপর সাফা পর্বতের উপর এমনভাবে চড়তেন যে, তিনি কা‘বা ঘর দেখতে পেতেন। অতঃপর কিবলামুখী হয়ে দুই হাত উত্তোলন করে আল্লাহর প্রশংসা করতেন এবং নিজ পছন্দমত দু‘আ করতেন। সেই সময় নিম্নোক্ত কালিমা তাওহীদ দ্বারা আল্লাহর একত্ব প্রকাশ করতেন এবং মহত্ত্ব ঘোষনা করতেন:

لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ أَنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ

[লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্‌দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহু ওয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্‌দাহু, আনজাযা ওয়া’দাহু, ওয়া নাসারা আব্দাহু, ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহ্‌দাহু]

আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা’বূদ নেই, যিনি এক ও একক, যাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, তাঁরই সমস্ত প্রশংসা, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা’বূদ নেই, তিনি নিজ প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণ করেছেন, নিজ বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি একাই সমস্ত ভ্রান্ত দলসমূহকে পরাজিত করেছেন।

নাবী (সা.) উক্ত কালিমাটি তিনবার করে পাঠ করতেন এবং তার মাঝে দু‘আ করতেন। দু‘আ করার পরে পায়ে হেঁটে নীচের দিকে নেমে আসতেন এবং দুই সবুজ বাতির মধ্যবর্তী স্থানে দৌঁড় দিতেন। অতঃপর তা অতিক্রম করে মারওয়া পর্যন্ত হেঁটে আসতেন এবং মারওয়ার উপর তাই করতেন যা তিনি সাফার উপর করেছিলেন।[4]

কতেক সাঈকারীরা এখানে যে ভুল করে তা হচ্ছে যে, তারা সাফা ও মারওয়ায় আরোহণ করলে কিবলামুখী হয়ে তিনবার তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করে এবং সলাতে হাত তোলার মত দুই হাত উত্তোলন করে ইশারা করে, তারপর নেমে হাটতে শুরু করে। অথচ ইহা নাবী (সা.) হতে বর্ণিত সুন্নাতের পরিপন্থী। তাদের উচিৎ যে, সম্ভব হলে সুন্নাত পালন করবে, আর না হলে তা ছেড়ে দেবে। কিন্তু এমন কোন বিদআতী কাজ করবে না যা নাবী (সা.) করেননি।

আরো কতেক সাঈকারী যে ভুল করে থাকে তা হচ্ছে যে, তারা সাফা ও মারওয়ার মাঝে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দৌড় দিতে থাকে। ইহা সুন্নাতের বিপরীত; কারণ, সাঈ শুধুমাত্র দুই সবুজ বাতির মধ্যবর্তী স্থানে সুন্নাত। আর বাকি স্থানে সাধারণভাবে হেঁটে সাঈ করতে হবে। এধরণের ভুলগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে কিংবা তাড়াহুড়া করে সাঈ সমাপ্ত করতে গিয়ে হয়ে থাকে। (মহান আল্লাহ যেন তাদের সুমতি দান করেন।)

আরো ভুল হচ্ছে যে, কতেক মহিলারা দুই সবুজ বাতির মধ্যবর্তী স্থানে পুরুষদের মতই দৌড় দেয়। অথচ মহিলাদের জন্য দৌড় দেয়া সুন্নাত নয় বরং তারা সাধারণভাবে হাঁটবে। এর দলীল আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.)-এর হদীস তিনি বলেন, মহিলাদের জন্য বায়তুল্লাহর রামাল এবং সাফা ও মারওয়ার মাঝে দৌঁড় নেই।

আরো ভুল হচ্ছে যে, কতেক সাঈকারী মহান আল্লাহর এই বাণী:

إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ

[ইন্নাস্সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআ‘ইরিল্লাহ্]

সাফা ও মারওয়ার উপর আসলে প্রত্যেকবার পাঠ করতে থাকে। অথচ সুন্নাত হচ্ছে যে, তা শুধুমাত্র প্রথমবার সাফায় পৌঁছালে পাঠ করবে।আরো ভুল হচ্ছে যে, কতোক সাঈকারী প্রত্যেক চক্করে গদবাঁধা নির্ধারিত একটি করে দু‘আ পাঠ করে, যার কোন ভিত্তি নেই। তাই ইহা একটি বিদ‘আত।

[1]. সহীহ: মুসলিম ১২১৮, সুনানে দারিমী ১৮৯২, নাসাঈ ২৯৫৩।

[2]. সূরাহ্ আল-আ‘রাফঃ ৫৫

[3]. সূরা বাক্বারা ২ঃ ১৫৮

[4]. সহীহ মুসলিম ১২১৮।
আরাফায় অবস্থান সংক্রান্ত ভুল-ভ্রান্তি

নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত যে, তিনি আরাফার দিবসে নামেরা নামক স্থানে সূর্য মাথার উপর থেকে ঢলা পর্যন্ত অবস্থান করেছেন। অতঃপর বাহনে চেপে উরনাহ্ নামক উপত্যকায় অবতরণ করেন এবং সেখানে যুহর ও আসর সলাত দুই দুই রাকা‘আত (কসর) জমা তাকদীম (অগ্রীম একত্রিত) করে এক আযান এবং দুই ইকামাতে আদায় করেন। তারপর বাহনে চেপে আরাফায় নিজ অবস্থানস্থলে আগমন করেন এবং তিনি একথা বলেন:

وَوَقَفْتُ هَاهُنَا وَعَرَفَةُ كُلُّهَا مَوْقِفٌ

আর আমি এখানে অবস্থান করলাম। তবে আরাফার সব জায়গায় হচ্ছে অবস্থান স্থল।[1] অতঃপর তিনি (সা.) সেখানে কিবলামুখী হয়ে দুই হাত উত্তোলন করে সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আল্লাহর যিকির ও তাঁর নিকট দু‘আ করায় ব্যস্ত থাকেন। তারপর সম্পূর্ণরূপে সূর্য ডুবে গেলে তিনি (সা.) মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান।

এক্ষেত্রে কতিপয় হাজীগণ যে ভুলগুলি করে থাকে তা হচ্ছেঃ

১। অনেক হাজীরা আরাফার সীমানার বাইরে অবতরণ করেন এবং তারা সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান না করে সেখান থেকেই মুযদালিফার উদ্দেশ্যে ফিরে আসেন। ইহা বড় মারাত্মক ভুল; যাতে হাজ্জ নষ্ট হয়ে যাবে; কারণ আরাফায় অবস্থান হচ্ছে রুকুন, যা ব্যতীত হাজ্জ শুদ্ধ হয় না। অতএব কোন ব্যক্তি যদি আরাফায় অবস্থানকালে সেখানে অবস্থান না করে তাহলে তার হাজ্জ হয় না। কারণ, নাবী (সা.) বলেছেন:

الْحَجُّ عَرَفَةُ مَنْ جَاءَ لَيْلَةَ جَمْعٍ قَبْلَ طُلُوعِ الْفَجْرِ فَقَدْ أَدْرَكَ الْحَجَّ

হাজ্জ হচ্ছে আরাফায় অবস্থানের নাম। সুতরাং যে ব্যক্তি মুযদালিফার রাত্রে ফজর হওয়ার পূর্বে (আরাফায়) এসে পৌঁছাবে সে হাজ্জ পেয়ে গেল।[2]

এই ভুলের কারণ হচ্ছে, লোকেদের পরস্পরকে দেখে প্রতারিত হওয়া। কেননা অনেক মানুষ আরাফায় পৌঁছার পূর্বেই তার সীমানা না দেখেই আরাফার বাইরেই অবস্থান করে নেয়, ফলে তারা নিজেদের হাজ্জ নষ্ট করে এবং অন্যরা ধোকা খেয়ে তাদের অন্ধ অনুকরণ করে।

তাই কতই না ভাল হতো যদি হাজ্জ বিষয়ক দায়িত্বশীলগণ বিভিন্ন ভাষায় ঘোষণা করে লোকদেরকে জানিয়ে দিতেন এবং তাঁরা যদি মুআল্লিমদেরকে নির্দেশ দিতেন, যাতে করে তারা হাজীদেরকে এধরণের কাজ থেকে সতর্ক করে। তাহলে হাজীরা জেনে শুনে সুন্দরভাবে হাজ্জ পালন করত, যাতে করে তারা দায়িত্ব মুক্ত হতে পারে।

২। তাদের আর একটি ভুল হচ্ছে যে, তারা সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বেই আরাফা থেকে বেরিয়ে পড়ে। অথচ ইহা হারাম। কারণ, ইহা নাবী (সা.)-এর আদর্শ বিরোধি কাজ; কেননা তিনি আরাফায় সূর্য সম্পূর্ণরূপে ডুবা পর্যন্ত অবস্থান করেছেন। এছাড়া আরাফা থেকে সূর্য অস্ত হওয়ার পূর্বে ফিরে আসা জাহিলী যুগের কাফিরদের প্রথা। (যার বিরোধিতা করা মুসলিমের জন্য আবশ্যক)।

৩। অনেক হাজীরা আরাফায় আরো একটি ভুল করে থাকে; তা হলো যে, তারা দু‘আ করার সময় কিবলা পিছনে, কিংবা তাদের ডানে বা বামে হলেও আরাফার পাহাড়কে (যা জাবালে রাহামাত বলে সাধারণদের নিকট পরিচিত) সামনে করে দু‘আ করে। ইহা নাবী (সা.)-এর সুন্নাত বিরোধী কাজ। কারণ, দু‘আর সুন্নাত হচ্ছে যেমন নাবী (সা.) কিবলামূখী হয়ে দু‘আ করেছেন তেমনিই করা।

[1]. হাদীসটি ইমাম আহমাদ ও সহীহ মুসলিম ১২১৮।

[2]. সহীহ: ইমাম আহমাদ ১৮৭৭৪, সুনানুল কুবরা বাইহাকী ৯৮১২, নাসাঈ ৩০১৬, তিরিমিযী ৮৮৯ ও ইবনু মাজাহ ৩০১৫।

নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত যে, তিনি কুরবানীর দিন সকাল বেলা জামরাহ আকাবায়, যা মক্কার দিকে মিনার শেষ প্রামেত্ম অবস্থিত, (যাকে বড় জামরাও বলা হয়) তাতে সাতটি পাথর মারতেন। আর প্রত্যেকটি পাথর মারার সময় তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করতেন। যেই কংকরগুলি বুঁটের দানার চেয়ে সামান্য বড় হত।

সুনানে নাসাঈতে ফাযল বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি মুযদালিফা থেকে মিনা যাওয়ার পথে নাবী (সা.)-এর বাহনের পেছনে বসেছিলেন। তিনি বলেন, নাবী (সা.) মুহস্সির নামক স্থানে (হস্তি বাহিনী ধ্বংস হওয়ার জায়গা) অবতরণ করেন এবং তিনি লোকজনকে সম্বোধন করে বলেন: তোমরা ক্ষুদ্র কংকর দ্বারা জামরায় পাথর নিক্ষেপ করবে। ফাযল (রা.) বলেন, নাবী (সা.) নিজ হাত দ্বারা ইংগিত করছিলেন যে, যেমন মানুষ হাতের আঙ্গুলে ধরে ক্ষুদ্র কংকর নিক্ষেপ করে।

আর মুসনাদে আহমাদে আব্দুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সা.) আমাকে জামরাহ আকাবায় পাথর নিক্ষেপের দিন সকালে বলেন, আমার জন্য কংকর কুড়িয়ে নিয়ে আসো। তিনি বলেন, তখন আমি তাঁর জন্য ছোট ছোট পাথর কুড়িয়ে নিয়ে এসে তাঁর হাতে দিলাম। তখন তিনি হাত উপরে করে বললেন:

إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِالْغُلُوِّ فِي الدِّينِ

তোমরা বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে থাক; কারণ, তোমাদের পূর্বের লোকেরা দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়েছে।[1]

উম্মে সুলায়মান (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নাবী (সা.)-কে কুরবানীর দিন মিনার উপত্যকা হতে জামরাহ্ আকাবাতে পাথর নিক্ষেপ করতে দেখেছি। তিনি সে সময় লোকদেরকে বলছিলেন: হে মানুষ! তোমরা পরস্পরকে খুন করিও না। আর যখন তোমরা জামরায় পাথর নিক্ষেপ করবে তখন ঠিকরের মত (ছোট) কংকর নিক্ষেপ করবে।[2]

আর ইবনু উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি মিনার নিকটবর্তী জামরাকে (ছোট জামরা) সাতটি কংকর মারতেন এবং প্রত্যেকটি কংকর নিক্ষেপের সাথে তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করতেন। তারপর সামনে এগিয়ে কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে দু‘আ করেন। অতঃপর জামরাহ উসতায় (মধ্যবর্তী জামরা) পাথর নিক্ষেপ করে বাম দিকে এগিয়ে যান এবং সেখানে কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে দু‘আ করেন। তারপর উপত্যকা হতে জাম্রা আকাবায় (বড় জামরা) পাথর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সেখানে (দু‘আর জন্য) না থেমে ফিরে আসেন। অতঃপর বলেন, এভাবেই নাবী (সা.)-কে একাজগুলি সম্পাদন করতে দেখেছি।[3]

আর ইমাম আহমাদ ও ইমাম আবূ দাউদ (রহঃ) আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, প্রিয় নাবী (সা.) বলেছেন:

إِنَّمَا جُعِلَ الطَّوَافُ بِالْبَيْتِ وَبِالصَّفَا وَالْمَرْوَةِ وَرَمْيُ الْجِمَارِ لِإِقَامَةِ ذِكْرِ اللَّهِ

নিশ্চয়ই বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার সাঈ এবং জামরাগুলিতে কংকর নিক্ষেপ করা আল্লাহর যিকির (স্মরণ) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিধি-বদ্ধ করা হয়েছে।[4]

এ ক্ষেত্রে কতিপয় হাজীগণ যে সব ভুল করে থাকে:

১। তাদের ভুল ধারণা যে, কংকরগুলি মুযদালিফা থেকেই নিতে হবে। তাই তারা দশই যিলহাজ্জর রাত্রে পাথর কুড়ায় এবং মিনার দিনগুলিতে তা সঙ্গে রাখায় নিজেকে কষ্ট দিয়ে থাকে। এমন কি দেখা যায় যে, তাদের কারো একটি পাথর যদি হারিয়ে যায় তাহলে তাতে বড়ই কষ্ট হয় এবং নিজ সঙ্গীদের সাথে মুযদলিফা থেকে কুড়ানো অতিরিক্ত পাথর থাকলে তাদের নিকট পাথর ভিক্ষা চায়। অথচ ইহা স্পষ্ট যে নাবী (সা.) থেকে এর কোন প্রমাণ নেই। বরং নাবী (সা.) বাহনে চেপে থেমে থাকা অবস্থায় আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.)-কে ঈদের দিন সকালে কংকর কুড়াতে বলেন। যাতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি জামরার নিকট থেমে থাকা অবস্থায় এই নির্দেশ দেন। কারণ, নাবী (সা.) থেকে এর কোন প্রমাণ নেই যে, তিনি মুযদালিফা থেকে রওনা হওয়ার পর জামরা পৌঁছার পূর্বে কোথাও থেমেছেন। আরো একটি যুক্তি হচ্ছে যে, পাথরের প্রয়োজন জামরাতে এসেই হয়েছে। সুতরাং নাবী (সা.) তার পূর্বে পাথর কুড়াতে বলতে পারেন না, যাতে কোন লাভ নেই, বরং মুযদালিফা থেকে অনর্থক রাস্তায় বোঝা বয়ে নিয়ে আসতে হবে।

২। অনেক হাজীদের ভ্রান্ত ধারণা যে, তারা জামরায় পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে শয়তানকে পাথর মারে। এজন্যে তারা জামরাগুলিকে শয়তান বলে আখ্যায়িত করে। তাই তাদের বলতে শুনা যায় যে, আমরা বড় শয়তানকে পাথর মেরেছি বা ছোট শয়তানকে পাথর মেরেছি কিংবা বড় জামরাকে পাথর মারলে তারা অনেকে বলে যে, আমরা শয়তানের বাপকে পাথর মেরেছি। এধরণের অনেক কথায় তারা বলে থাকে, যা হজ্জের স্থানসমূহ ও কার্যাবলী সম্পর্কে বলা সমিচীন নয়। আরো দেখবেন যে, তারা পাথর মারার সময় তাদের ভ্রান্ত ধারণায় এ জমরাসমূহকে শয়তান মনে করে বড়ই কঠোরতা, নিষ্ঠুরতা, চিৎকার ও গালাগালি করে থাকে। বরং এমনও লোক দেখেছি যে, জামরার উপর চড়ে বড়ই ক্রোধ ও আবেগের সাথে জুতো-স্যান্ডেল ও বড় বড় পাথর দ্বারা পিটাচ্ছে এবং তার উপর লোকদের মারা কংকর পড়তে আছে, তবুও তার রাগ-গোস্সা ঠান্ডাও হচ্ছে না এবং তারা এ আচরণও ছাড়ছে না। আর লোকেরা তার চারপার্শ্বে অট্ট হাঁসী হাঁসছে। মনে হচ্ছে যেন এক নাটকের দৃশ্য। এ দৃশ্য জামরায় পুল তৈরী হওয়ার এবং তার পিলার উঁচু করার পূর্বে দেখেছি। আর এসমস্ত ঘটনার কারণ হচ্ছে, তাদের বদ আকীদা যে, হাজীরা শয়তানকে পাথর মারে। অথচ ইহা এক ভিত্তিহীন কথা। আর পূর্বে জামরায় পাথর মারার তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছেন যে, তা আল্লাহর যিকির (স্মরণ) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে বিধি-বদ্ধ করা হয়েছে। এজন্যই নাবী (সা.) প্রত্যেকটি পাথর নিক্ষেপ করার সময় আল্লাহু আকবার বলতেন।

৩। অনেক হাজীরা জামরাতে বড় বড় পাথর, জুতো, স্যান্ডেল এবং লকড়ি মারে। ইহা একটি বড় ভুল, যা নাবী (সা.) তাঁর উম্মাতকে নিজ নির্দেশ ও আমল দ্বারা যে শরিয়াতী দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তার পরিপন্থী। কারণ, তিনি ছোট ছোট ঠিকরের মত কংকর দ্বারা নিজেও জামরাতে রামী করেছেন এবং নিজ উম্মাতকেও তারই নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা থেকে সতর্ক করেছেন। আর এ মারাত্মক ভুলের একমাত্র কারণ যা আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, তাদের ধারণা যে, তারা না কি শয়তানকে পাথর মারে।

৪। তাদের আর একটি ভুল হচ্ছে যে, তারা অনেকে জামরাতে যাওয়ার সময় বড় গরম মেযাজ ও নিষ্ঠুরতার সাথে এগিয়ে যায়, তাদের মধ্যে আল্লাহর ইবাদাতে কোন বিনয়ও থাকে না এবং আল্লাহর বান্দাহদের প্রতি কোন দয়ার আচরণও করে না। আর অন্যান্য হাজীদের কষ্ট দেয় এবং নানা রকমের গালিগালাজ করে। ফলে ইহা নাবী (সা.)-এর আদর্শ এবং ইসলামের আসল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে ইবাদাত না হয়ে মারপীট ও গালিগালাজের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।

তাই মুসনাদে আহমাদে কুদামা বিন আব্দুল্লাহ বিন আম্মার (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আমি নাবী (সা.)-কে কুরবানীর দিন হলুদবর্ণ উষ্ট্রীতে চেপে জামরাহ আকাবায় (বড় জামরা) পাথর মারতে দেখেছি। সেই সময় না কারো সাথে মারপীট, না কাউকে তাড়ানো আর না রাস্তা ছাড়ো রাস্তা ছাড়ো বলে কোন হৈ চৈ।[5]

৫। অনেক হাজীদের আরো একটি ভুল হচ্ছে যে, তারা তাশরীকের দিনগুলিতে (১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্জ) প্রথম ও দ্বিতীয় জামরায় কংকর নিক্ষেপের পরে সেখানে দু‘আ করে না। অথচ নাবী (সা.) এ দুই জায়গায় পাথর মারার পর কিবলামুখী হয়ে দু’হাত তুলে দীর্ঘক্ষণ দু‘আ করতেন। অনেক হাজীদের এ দু‘আর জন্য অবস্থানকে পরিত্যাগ করার কারণ হচ্ছে, সুন্নাত সম্পর্কে অজ্ঞতা অথবা তাড়াহুড়া করে দায়সাড়া ইবাদাত করা।

তাই কতই না ভাল হতো যদি হাজীগণ হাজ্জ করার পূর্বে হাজ্জের বিধি-বিধান শিখে মহান আল্লাহর ইবাদাত জ্ঞান সহকারে সম্পাদন করতো এবং তাতে নাবী (সা.)-এর সুন্নাতের বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হত। দুনিয়ার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন দেশের ভ্রমণ করে তাহলে দেখা যায় যে, সেখানে ভালভাবে পৌঁছার জন্য সেই দেশের রাস্তা-পথ সম্পর্কে খুটি-নাটি জিজ্ঞেস করে। তাহলে যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির এবং তাঁর জান্নাতের পথে চলতে চায়, তার কেমন সতর্কতা অবলম্বণ করা উচিত? তাহলে গন্তব্য স্থানে পৌঁছার উদ্দেশ্যে এপথে চলার পূর্বে সে সম্পর্কে ভালভাবে জেনে নেয়া তার জন্য কি উচিৎ নয়?

৬। আরো একটি ভুল হচ্ছে, তাদের অনেকে সাতটি পাথর এক মুষ্টিতে নিয়ে একবারেই মেরে দেয়। ইহা বড় মারাত্মক ভুল। কারণ, আলিমগণ বলেছেন যে, একসাথে একাধিক পাথর মারলে তা একটি বলে গণ্য হবে। আর মনে রাখবেন যে, নাবী (সা.)-এর সুন্নাত মুতাবেক এক একটি করে পাথর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।

৭। জামরায় কংকর মারার সময় বাড়তি কিছু দু‘আ পাঠ করা, যা নাবী (সা.) থেকে মোটেই প্রমাণিত নয়। যেমন তারা অনেকে বানোয়াট দু‘আ বলে,

‘আল্লাহুম্মা ইজ্‌আলহা রিযান লিররাহমান, ওয়া গাযাবান লিশশায়তান’

অনেকে এ বিদআতী দু‘আ পড়ে কিন্তু নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত তাকবীর ছেড়ে দেয়। অথচ বাড়তি বা ঘাটতি না করে নাবী (সা.) থেকে বর্ণিত তাকবীরেই খ্যান্ত করা আবশ্যক।

৮। আরো একটি ভুল হচ্ছে, জামরায় পাথর নিজ হাতে মারার ক্ষেত্রে অনেকের অবহেলা করা। তারা নিজে কংকর মারতে সক্ষম হলেও অপর ব্যক্তিকে উকীল বানিয়ে ভীড়ের অবস্থায় কংকর মারার কষ্ট থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চায়। অথচ ইহা মহান আল্লাহর এ বাণীর পরিপন্থী, যাতে তিনি হাজ্জ সম্পূর্ণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন:

وَأَتِمُّواْ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلّهِ

তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হাজ্জ ও উমরা সম্পূর্ণ কর।[6] তাই কষ্ট ও ক্লেশ বরদাশ্ত করে কংকর নিক্ষেপ করায় সক্ষম ব্যক্তির নিজ হাতে কংকর মারা আবশ্যক। কারণ, হাজ্জ এক প্রকারের জিহাদ, যাতে কষ্ট-ক্লেশ হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই হাজীগণ যেন আল্লাহকে ভয় করেন এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী স্বয়ং নিজেই যথাসাধ্য হজ্জের কার্যাবলী সম্পাদন করেন।

>
[1]. মুসনাদ আহমাদ ৩২৪৮ ও নাসাঈ ৩০৫৭।

[2]. মুসনাদ আহমাদ

[3]. সহীহ বুখারী ১৭৫২।

[4]. যঈফ: মুসনাদ আহমাদ ২৪৩৫১।

[5]. তিরমিযী, হাদীসটিকে তিনি হাসান ও সহীহ বলেছেন

[6]. সূরা বাক্বারা ২ঃ ১৯৬
বিদায়ী তাওয়াফ সংক্রান্ত ভুল-ভ্রান্তি

ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে প্রমাণিত, তিনি বলেন, লোকদেরকে (নাবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে) নির্দেশ দেয়া হয় যে, তাদের শেষ সাক্ষাৎ যেন বায়তুল্লাহর সাথে হয়। (বিদায় তাওয়াফ যেন হাজ্জের শেষ কাজ হয়।) তবে ঋতুবতী মহিলার জন্য ছাড় দেয়া হয়েছে। (তার প্রতি বিদায় তাওয়াফ ওয়াজিব নয়।)[1]

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, লোকেরা হাজ্জের শেষে যে যেখান থেকে ইচ্ছা রওনা হয়ে যেত। তখন নাবী (সা.) বলেন:

لَا يَنْفِرَنَّ أَحَدٌ حَتَّى يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِ بِالْبَيْتِ

তোমাদের কোন ব্যক্তি যেন বায়তুল্লাহর শেষ সাক্ষাৎ (বিদায় তাওয়াফ) না করা পর্যন্ত হাজ্জ শেষে বিদায় না হয়।[2]

আর ইমাম আবূ দাউদ (রহঃ) এভাবে বর্ণনা করেন:

لَا يَنْفِرَنَّ أَحَدٌ حَتَّى يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِ الطَّوَافَ بِالْبَيْت

তোমাদের কোন ব্যক্তি (হাজ্জ সম্পাদনকারী ব্যক্তি) যেন সর্বশেষে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ না করা পর্যন্ত বিদায় না হয়।[3]

আরো উম্মি সালামা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নাবী (সা.)-এর নিকট (হাজ্জ অবস্থায়) আমার অসুস্থতার অভিযোগ করলাম। তখন তিনি (সা.) বললেন, তুমি বাহনে সাওয়ার হয়ে পুরুষদের থেকে পৃথক হয়ে তাওয়াফ সম্পাদন কর। তাই আমি যখন তাওয়াফ করছিলাম তখন নাবী (সা.) বায়তুল্লাহর পার্শ্বে সলাতরত অবস্থায় সূরা আত্তূর পাঠ করছিলেন।[4]

আর উম্মি সালামা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি যে, আমি বিদায় তাওয়াফ করিনি। তখন নাবী (সা.) বললেন: যখন সলাতের ইকামাত হয়ে যাবে তখন তুমি নিজ উঁটের উপর চেপে পুরুষদের থেকে পৃথক হয়ে তাওয়াফ সম্পাদন করে নিও।[5]

আর আনাস বিন মালিক (রা.) হতে বর্ণিত যে, নাবী (সা.) যুহর, আসর, মাগরিব ও এশা সলাত আদায় করে মুহাস্সাব নামক স্থানে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেন। অতঃপর বাহনে চেপে বায়তুল্লাহর উদ্দেশ্যে এসে বিদায় তাওয়াফ সম্পাদন করেন।[6]

আরো আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, সাফিয়াহ্ (রা.)-এর তাওয়াফ ইফাযা সম্পাদন করার পরে মাসিক ঋতু শুরু হয়ে যায়। তখন নাবী (সা.) বলেন, তাহলে সে কি আমাদেরকে রওনা হতে বাঁধা সৃষ্টি করবে? লোকেরা বললেন, তিনি তো তাওয়াফ ইফাযা করে ফেলেছেন। তখন নাবী (সা.) বললেন, তাহলে সে যেতে পারবে।[7]

আর মুআত্তা হাদীস গ্রন্থে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) হতে বর্ণিত যে, উমার (সা.) (তাঁর খেলাফাত আমলে) বলেন, কোন ব্যক্তি (বিদায়ী) তাওয়াফ না করা পর্যন্ত যেন হাজ্জ থেকে ফিরে না আসে। কারণ, হাজ্জের শেষ কাজ হচ্ছে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা। তাতে ইয়াহয়া বিন সাঈদ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, উমার (রা.) এক ব্যক্তিকে মাররুযযাহরান নামক স্থান থেকে তার বিদায় তাওয়াফ না করে চলে আসার কারণে ফিরিয়ে দেন। অতঃপর সে ফিরে গিয়ে বিদায় করে আসে।

>
[1]. সহীহ বুখারী ১৭৫৫, সহীহ মুসলিম ১৩২৮।

[2]. সহীহ মুসলিম ১৩২৭, ইবনে মাজাহ ৩০৭০।

[3]. সহীহ: সুনানে আবূ দাউদ ২০০২।

[4]. সহীহ বুখারী ১৬৩৩, সহীহ মুসলিম ১২৭৬।

[5]. সহীহ লি গাইরিহী: নাসাঈ ২৯২৬।

[6]. সহীহ বুখারী ১৭৬৪।

[7]. সহীহ বুখারী ১৭৭১।
এ ক্ষেত্রে কতিপয় হাজীগণ যে সব ভুল করে থাকে

১। কতোক হাজী মিনা থেকে বিদায়ের দিন জামরায় পাথর মারার পূর্বেই সেখান থেকে মক্কায় চলে আসে। তারপর বিদায় তাওয়াফ করে মিনা গিয়ে জামরাতে পাথর মারে। অতঃপর সেখান থেকে নিজ দেশে চলে আসে। অথচ ইহা জায়েয নয়; কারণ, ইহা নাবী (সা.)-এর নির্দেশ বিরোধী কাজ। তিনি বলেছেন, হাজীর শেষ কাজ যেন বায়তুল্লাহর তাওয়াফ হয়। আর যে ব্যক্তি বিদায়ী তাওয়াফের পর জামরায় পাথর নিক্ষেপ করল সে তার শেষ সাক্ষাৎ (কাজ) বায়তুল্লাহর সাথে না করে জামরার সঙ্গে করল। আর নাবী (সা.) হাজ্জের সমস্ত কাজ সম্পূর্ণ করে মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় বিদায়ী তাওয়াফ করেছেন এবং তিনি একথাও বলেছেন,

خُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم

তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান গ্রহণ কর।[1]

আর উমার (রা.) থেকে বর্ণিত উপরোক্ত হাদীস স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, বায়তুল্লাহর বিদায়ী তাওয়াফই হচ্ছে হজ্জের সর্বশেষ আমল। অতএব কোন ব্যক্তি যদি বিদায়ী তাওয়াফ করার পরে জামরায় পাথর মারে তাহলে তার তাওয়াফ যথাস্থানে না হওয়ার কারণে যথেষ্ট নয়। তাই তাকে পাথর মারার পরে পুনঃরায় বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে। আর তা না করলে তার বিধান বিদায়ী তাওয়াফ পরিত্যাগকারী ব্যক্তির অনুরূপ। ওয়াজিব ছেড়ে দেয়ার কারণে তাকে দম (কুরবানী) দিতে হবে।

২। অনেক হাজীরা বিদায়ী তাওয়াফের পরেও মক্কায় বসে থাকে, তাহলে তাদের শেষ সাক্ষাৎ বায়তুল্লাহর সাথে হলো না। আর ইহা নাবী (সা.) যে নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং নিজ কর্ম দ্বারা উম্মাতের সামনে বর্ণনা করেছেন তার পরিপন্থী কাজ। আর নাবী (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন যে, হাজীর শেষ কাজ যেন বায়তুল্লাহর তাওয়াফ হয় এবং তিনি নিজেও মক্কা থেকে বের হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে বিদায়ী তাওয়াফ করেছেন। আর সাহাবীগণও অনুরূপ আমল করেছেন। তবে আলিমগণ বিদায় তাওয়াফের পরে অনিচ্ছাকৃত কোন বিশেষ কারণে মক্কায় অবস্থান করাকে জায়েয বলেছেন। যেমন, বিদায় তাওয়াফের পরে যদি সলাতের ইকামাত হয়ে যায়, তাহলে সলাত আদায় করে নিবে। কিংবা বিদায়ী তাওয়াফের পরে যদি জানাযা উপস্থিত হয়ে যায় তাহলে জানাযার সলাত আদায় করে নিবে। অথবা সফরের কোন সামান খরীদ করা বা সঙ্গীদের অপেক্ষা করা ইত্যাদি। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি বিদায়ী তাওয়াফের পরে ইচ্ছাকৃতভাবে মক্কায় অবস্থান করে তাহলে তার প্রতি পুণঃরায় বিদায়ী তাওয়াফ করা আবশ্যক হবে।

৩। অনেক হাজীরা বিদায়ী তাওয়াফের পরে কা‘বা ঘরের দিকে মুখ করে উল্টোভাবে মাসজিদে হারাম থেকে বের হয়। তারা মনে করে যে, ইহাতে কা‘বা ঘরের সম্মান প্রদর্শন করা হয়। অথচ ইহা সুন্নাত বিরোধী কাজ। বরং তা বিদআত, যা থেকে আল্লাহর রসূল (সা.) আমাদেরকে সতর্ক করতে গিয়ে বলেছেন,

كُلَّ بِدْعَة ضَلالَةٌ

প্রত্যেক বিদআত হচ্ছে ভ্রষ্টতা।[2]

আর বিদ‘আত এমন নব আবিস্কৃত আকীদা ও ইবাদাতকে বলা হয় যা রসূল (সা.) এবং তাঁর খলীফা রাশিদগণ-এর আকীদা ও আমল পরিপন্থী। তাহলে কি কা‘বা ঘর সামনে করে উল্টোভাবে ফিরা ব্যক্তি মনে করে যে, সে রসূল (সা.)-এর অপেক্ষা কা‘বা ঘরের অধিক সম্মানকারী? না কি মনে করে যে, উল্টোভাবে ফিরায় কা‘বার সম্মান প্রদর্শন করা হয় এ বিষয়টি নাবী (সা.) এবং তাঁর খুলাফা রশিদীন জানতেন না?

৪। অনেক হাজীরা বিদায়ী তাওয়াফ সমাপ্ত করে মাসজিদে হারামের দরজায় গিয়ে কা‘বা ঘরের দিকে চেয়ে দেখে এবং সেখানে দাঁড়িয়ে কা‘বা ঘর থেকে বিদায় নেয়ার মত করে দু‘আ করতে থাকে। ইহাও একটি বিদআত; যার কোন প্রমাণ নাবী (সা.) এবং তাঁর তাঁর খলীফা রাশিদগণ হতে নেই। আর যে কোন আমল দ্বারা যদি মহান আল্লাহর ইবাদাত উদ্দেশ্য করা হয় অথচ তার ইসলামী শরিয়তে কোন প্রমাণ নেই, তাহলে তা বাতিল এবং প্রত্যাখ্যাত। কারণ, নাবী (সা.) বলেছেন:

مَنْ أحْدَثَ في أمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ

যে ব্যক্তি আমাদের এবিষয়ে কোন নুতন কিছু আবিষ্কার করবে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত।[3] অর্থাৎ তা ঐ ব্যক্তির দিকে ছুঁড়ে ফেলা হবে। তা আল্লাহর নিকট কাবুল হবে না।

অতএব আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী ঈমানদার ব্যক্তির উপর আবশ্যক হলো, নিজ ইবাদাতে রসূল (সা.)-এর আদর্শের অনুসারী হবে। যাতে করে সে আল্লাহর ভালবাসা ও মার্জনা হাসিল করতে পারে। যেমনটি মহান আল্লাহ বলেছেন:

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

হে নবী! বলে দাও, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসকল ক্ষমা করবেন, বস্ত্ততঃ আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।[4]

আর নাবী (সা.)-এর অনুসরণ যেমন হবে তাঁর ইতিবাচক কর্মের ক্ষেত্রে তেমনি হবে তাঁর নেতিবাচক কর্মের ক্ষেত্রেও। তাই যদি নাবী (সা.)-এর আমলে কোন কর্মের ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও তিনি তা না করে থাকেন তাহলে ইহা প্রমাণ করে যে, ইহা পরিত্যাগ করাটাই হচ্ছে নাবী আদর্শ ও তাঁর শরিয়াত। সুতরাং তা মানুষকে যতই ভাল লাগুক না কেন মহান আল্লাহর দ্বীনে তার আবিষ্কার করা জায়েয নয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন:

وَلَوِ اتَّبَعَ الْحَقُّ أَهْوَاءهُمْ لَفَسَدَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ بَلْ أَتَيْنَاهُم بِذِكْرِهِمْ فَهُمْ عَن ذِكْرِهِم مُّعْرِضُونَ

সত্য যদি তাদের ইচ্ছা-আকাঙ্খার অনুগামী হত তাহলে আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী এবং উভয়ের মাঝে যা আছে সমস্ত কিছুই বিশৃংখল হয়ে যেত। বরং (তোমাদের কামনা-বাসনার বিপরীতে) আমি তাদেরকে দিয়েছি তাদের জন্য উপদেশবাণী। কিন্তু তারা উপদেশবাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।[5]

আর নাবী (সা.) বলেছেন:

لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ

তোমাদের কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ তার প্রবৃত্তি (মনের কামনা-বাসনা) আমার আনীত বিধানের অনুসারী না হয়ে যায়।[6] মহান আল্লাহর নিকট দু‘আ করি যেন তিনি আমাদেরকে তাঁর সহজ-সরল পথ দেখান, আমাদের সঠিক পথ দেখানোর পর হৃদয়কে বক্র না করে দেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে যেন আমাদেরকে করুণা প্রদান করেন। নিশ্চয়ই তিনি মহান দাতা।

>
[1]. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ১২৯৭।

[2]. সহীহ: সুনানে দারিমী ৯৬, ইবনে মাজাহ ৪২, সহীহ মুসলিম ৮৬৭।

[3]. সহীহ মুসলিম ১৭১৮।

[4]. সূরা আল-ইমরান ৩:৩১

[5]. সূরা মু’মিনূন ২৩:৭১

[6]. যঈফ সনদ: মিশকাতুল মাসাবিহ ১৬৭, ইমাম বাগভীর শারহুস্ সুন্নাহ
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১০ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে