তৌরাতের প্রথম পুস্তক আদিপুস্তক (পয়দায়েশ) ৩৬/৩১: ‘‘বনি-ইসরাইলদের উপরে কোন বাদশাহ রাজত্ব করার আগে এঁরা ইদোম দেশের বাদশাহ ছিলেন।’’ এরপর পরবর্তী শ্লোকগুলোতে বনি-ইসরাইলদের প্রথম রাজা তালূত (শৌল)-এর রাজত্ব লাভের পূর্ব পর্যন্ত ইদোমের রাজাদের নাম-পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে।
ইহুদি-খ্রিষ্টান সকল বাইবেল বিশেষজ্ঞ একমত যে, এ কথাগুলো মোশি বা মূসা (আ.)-এর শতশত বছর পরে তৌরাতের মধ্যে সংযোজিত। ‘বনি-ইসরাইলদের উপরে কোনো বাদশাহ প্রথম রাজত্ব করেন’ মোশির প্রায় সাড়ে তিন শত বছর পর।
মোশির মৃত্যুর পরে দীর্ঘ প্রায় তিন শতাব্দী যাবৎ বনি-ইসরাইল বা ইসরাইল-সন্তানদের মধ্যে কোনো রাজা বা রাজত্ব ছিল না। নবী (ভাববাদী) বা বিচারকরা (কাজীরা) তাদেরকে পরিচালনা করতেন। সর্বশেষ বিচারকর্তা শামুয়েল নবীর সময়ে ইসরাইলীয়রা তাঁর নিকট একজন রাজা নিয়োগের জন্য আবেদন করেন। তখন কীশের পুত্র শৌল (তালুত) নামক এক ব্যক্তি রাজা মনোনীত হন। আনুমানিক খ্রি. পূ. ১০১৫/১০০০ অব্দে আমালিকা সম্প্রদায়ের রাজা জালুত (Golieth)-কে পরাজিত করে তালুত প্রথম ইসরাইলীয় রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন ও প্রথম ইসরাইলীয় রাজা বলে গণ্য হন। তাহলে মোশির লিখিত বলে কথিত ‘তৌরাতের’ প্রথম পুস্তকে তাঁর মৃত্যুর প্রায় সাড়ে তিন শত বছর পরের ঘটনাবলি লেখা হচ্ছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, পুরাতন নিয়মের আরেকটা পুস্তক ‘বংশাবলি’ বা খান্দাননামা (১ম ও ২য় খণ্ড)। এ দু’ খণ্ড পুস্তক খ্রিষ্টান বাইবেলে ১৩ ও ১৪ নং পুস্তক। আর ইহুদি বাইবেলে এদের অবস্থান একদম শেষে: ৩৮ ও ৩৯ নং। উইকিপিডিয়ার ‘Authorship of the Bible’ প্রবন্ধের ভাষ্যমতে এ পুস্তকটা মোশির প্রায় এক হাজার বছর পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে অজ্ঞাতনামা লেখক কর্তৃক রচিত।[1]
মজার বিষয় হল, আদিপুস্তক ৩৬/৩১-৩৯ শ্লোকগুলো অবিকল ১ বংশাবলির ১ম অধ্যায়ের ৪৩-৫০ শ্লোক। আমরা দেখলাম যে, বংশাবলি (খান্দাননামা) পুস্তকটা তালুতের মৃত্যুর প্রায় ছয় শত বছর পরে রচিত; কাজেই এ পুস্তকের মধ্যে এ বিষয় আলোচিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তালুতের সাড়ে তিন শত বছর পূর্বে মোশির লেখা তৌরাতের প্রথম পুস্তকের মধ্যে এ কথা কিভাবে লেখা হল? এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, তৌরাত নামে প্রচলিত পুস্তকও মোশির বা মূসা (আ.)-এর হাজার বছর পরের অজ্ঞাতনামা লেখকদের সংকলন।
তৌরাতের দ্বিতীয় পুস্তক হিজরত/ যাত্রাপুস্তকের ১৬/৩৫ শ্লোক: ‘‘বনি-ইসরাইলরা চল্লিশ বছর, যে পর্যন্ত বসতি-এলাকায় উপস্থিত না হল, সেই পর্যন্ত সেই মান্না ভোজন করলো; সেই দেশের (the land of Canaan কেরি: কনান দেশের) সীমাতে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত তারা মান্না খেতো।’’ (মো.-১৩)
এ কথাটা মোশির লেখা নয়। কারণ তাঁর জীবদ্দশায় মান্না ভোজন বন্ধ হয়নি এবং তাঁর জীবদ্দশায় বনি-ইসরাইলরা বসতি-এলাকা বা কেনান দেশের সীমায় উপস্থিতও হয়নি।
তৌরাতের ৪র্থ পুস্তক শুমারী/ গণনাপুস্তক ২১/১৪ (মো.-১৩): ‘‘এজন্য মাবুদের যুদ্ধ-বিবরণী কিতাবে উক্ত আছে: শূফাতে বাহেব, আর অর্ণোনের সমস্ত উপত্যকা।’’
পাঠক দেখছেন যে, এখানে গণনাপুস্তক বা শুমারী কিতাবের লেখক পূর্ববর্তী একটা ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রদান করছেন। ধর্মগ্রন্থটার ইংরেজি নাম (the book of the wars of the LORD)। বাংলায় কেরি: ‘সদাপ্রভুর যুদ্ধপুস্তক’, পবিত্র বাইবেল-২০০০: ‘সদাপ্রভুর যুদ্ধ নামে বই’, কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: ‘মাবুদের যুদ্ধ নামে বই’ এবং কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩: ‘মাবুদের যুদ্ধ-বিবরণী কিতাব’।
সুপ্রিয় পাঠক, আপনি আশা করি নিশ্চিত হচ্ছেন যে, এ কথাটা কখনোই মূসা (আ.)-এর কথা হতে পারে না। উপরন্তু এ কথাটা প্রমাণ করে যে, মূসা (আ.) ‘শুমারী’ বা ‘গণনাপুস্তক’ নামক এ বইটার লেখক নন। কারণ, ইহুদি-খ্রিষ্টানরা একমত যে, মূসা (আ.)-এর পূর্বে কোনো কিতাব তাদের মধ্যে নাযিল হয়নি এবং মূসা কোনো কিতাব দেখে তৌরাত লেখেননি। অথচ গণনাপুস্তকের লেখক এখানে ‘মাবুদের যুদ্ধ-বিবরণী’ নামক অন্য একটা কিতাব থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। এ পুস্তকটা কে লেখেছিলেন? কোন্ যুগে? কোথায়? কোনো কিছুই জানা যায় না।
তৌরাতের পঞ্চম পুস্তক দ্বিতীয় বিবরণ ৩/১৪ (মো.-১৩): ‘‘মানশার (মনঃশির) সন্তান যায়ীর (Jair the son of Manasseh) গশূরীয়দের ও মাখাথীয়দের সীমা পর্যন্ত অর্গোবের সমস্ত অঞ্চল নিয়ে তাদের নাম অনুসারে বাশন দেশের সেসব স্থানের নাম হবোৎ-যায়ীর রাখল; আজও (অদ্য পর্যন্ত (unto this day) সেই নাম প্রচলিত আছে।’’
বাইবেল বিশেষজ্ঞরা একমত যে, এ কথাগুলো সংযোজিত। ‘অদ্য পর্যন্ত’ কথাটা যিনি লেখেছেন তিনি অবশ্যই যায়ীরের যুগের অনেক পরের মানুষ। অনেক পরের মানুষেরা ছাড়া কেউ এ প্রকারের শব্দাবলি ব্যবহার করে না।
এছাড়া ‘মানশার সন্তান যায়ীর’ কথাটা ভুল। যায়ীরের পিতার নাম ‘সগূব’: ‘‘সগুবের পুত্র যায়ীর, গিলিয়দ দেশে তাঁহার তেইশটি নগর ছিল।’’ (১ বংশাবলি ২/২২)
যায়ীর নামক এ ব্যক্তি মোশির পরের প্রজন্মের মানুষ ছিলেন। ইয়াকুব বা যাকোবের পুত্র লেবি, তার পুত্র কহাৎ, তাঁর পুত্র ইমরান, তাঁর পুত্র মোশি। আর যাকোবের অন্য পুত্র এহুদা, তাঁর পুত্র পেরস, তাঁর পুত্র হিষ্রোণ, তাঁর পুত্র সগূব, তাঁর পুত্র যায়ীর। (১ বংশাবলি/ খান্দাননামা ২/১-২৩ ও ৬/১-৩)
এভাবে আমরা দেখছি যে, সগূব ছিলেন মোশির প্রজন্মের এবং সগূবের পুত্র যায়ীর মোশির পরের প্রজন্মের মানুষ। কাজেই একথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে, এ বক্তব্যটার পুরোটাই অনেক পরের সংযোজন। সংযোজনকারী যায়ীরের নাম ও তাঁর মালিকানাধীন গ্রামগুলোর নামের বিষয়ে জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে কথাটা লেখেছেন। এজন্য তিনি যায়ীরের পিতার নামও ঠিকমত লেখতে পারেননি।
এরূপ সংযোজনের আরো নমুনা দেখুন: আদিপুস্তক ১৯/৩৭; ১৯/৩৮; ২৬/৩৩; ৩২/৩২; ৩৫/২০; ৪৭/২৬; ৪৮/১৫; যাত্রাপুস্তক ১০/৬; গণনা পুস্তক ২২/৩০; দ্বিতীয় বিবরণ: ২/২২, ৩/১৪, ১০/৮, ১১/৪, ২৯/৪, ৩৪/৬; যিহোশূয় ৫/৯, ৮/২৮ ও ২৯, ১০/২৭, ১৩/১৩, ১৪/১, ১৫/৬৩, ১৬/১০।
দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪/৫-১০ (মো.-১৩): ‘‘তখন মাবুদের গোলাম মূসা মাবুদের কথা অনুসারে সেই স্থানে মোয়াব দেশে ইন্তেকাল করলেন। আর মাবুদ মোয়াব দেশে বৈৎ-পিয়োরের সম্মুখস্থ উপত্যকাতে তাঁকে কবর দিলেন; কিন্তু তাঁর কবরস্থান কোথায় আজও কেউ জানে না (but no man knoweth of his sepulchre unto this day)। মৃত্যুর সময় মূসার বয়স একশত বিশ বছর হয়েছিল। তাঁর চোখ ক্ষীণ হয়নি ও তাঁর তেজও হ্রাস পায়নি। পরে বনি-ইসরাইল মূসার জন্য মোয়াবের উপত্যকায় ত্রিশ দিন কান্নাকাটি করলো; এভাবে মূসার শোক-প্রকাশের দিন সম্পূর্ণ হল। মূসার মত কোন নবী আর বনী-ইসরাইলের মধ্যে উৎপন্ন হয়নি...।’’
সকল বাইবেল বিশেষজ্ঞ একমত যে এ সকল কথা মোশির লেখা তৌরাতের কথা হতে পারে না। নিঃসন্দেহে এ কথাগুলো মোশির মৃত্যুর অনেক বছর পরে লেখা, যখন ইহুদিরা তাদের এ প্রিয় ভাববাদীর কবরটা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন।
যিহোশূয় বা ইউসা পুস্তকের ২৪ অধ্যায়ের ২৯-৩৩ শ্লোক নিম্নরূপ: ‘‘এসব ঘটনার পর নূনের পুত্র, মাবুদের গোলাম ইউসা একশত দশ বছর বয়সে ইন্তেকাল করলেন। পরে লোকেরা গাশ পর্বতের উত্তরে পর্বতময় আফরাহীম প্রদেশস্থ তিন্নৎ-সেরহে তাঁর অধিকারের অঞ্চলে তাঁকে দাফন করলো। ইউসার সমস্ত জীবনকালে এবং যে প্রাচীনবর্গরা ইউসার ইন্তেকালের পরে জীবিত ছিলেন ও ইসরাইলের জন্য মাবুদের কৃত সমস্ত কাজের কথা জানতেন, তাঁদেরও সমস্ত জীবনকালে বনি-ইসরাইল মাবুদের সেবা করলো। ...পরে হারুনের পুত্র ইলিয়াসর ইন্তেকাল করলেন; আর লোকেরা তাঁকে তাঁর পুত্র পীনহসের পাহাড়ে দাফন করলো...।’’ (মো.-১৩)
সকল বাইবেল বিশেষজ্ঞ একমত যে, এ শ্লোকগুলো ইউসার মৃত্যুর অনেক পরে তাঁর পুস্তকের মধ্যে সংযোজিত। তবে কে সংযোজন করেছেন তা কেউই জানেন না।
আমরা আগেই বলেছি, এরূপ বিকৃতি বাইবেলের মধ্যে অগণিত। আধুনিক অনেক খ্রিষ্টান বিশেষজ্ঞ এগুলোকে বাইবেলের অপ্রামাণ্যতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। এগুলো দিয়ে তাঁরা দাবি করেন যে, বাইবেল কোনো অভ্রান্ত ধর্মগ্রন্থ নয়; বরং মানবীয় বা মানব রচিত ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক পুস্তক।
এর বিপরীতে বাইবেল বিশেষজ্ঞ ধর্মগুরুরা এ সকল বিকৃতি স্বীকার করার পাশাপাশি দাবি করেন যে, এ সকল বিকৃতি সত্ত্বেও বাইবেল অভ্রান্ত ধর্মগ্রন্থ। এ সকল বিকৃতি বাইবেলের প্রামাণ্যতা নষ্ট করে না। যেখানে বিকৃতি অস্বীকার করার উপায় নেই সেখানে তারা বিকৃতি স্বীকার করেন এবং এর জন্য বিভিন্ন অযুহাত পেশ করেন।
যে বিকৃতিগুলোর অর্থ গ্রহণযোগ্য সেক্ষেত্রে তারা বলেন, সম্ভবত কোনো অজ্ঞাত পরিচয় নবী এ সংযোজন করেছেন। আর যেক্ষেত্রে সংযোজন, বিয়োজন বা পরিবর্তনের ফলে অগ্রহণযোগ্য অর্থ জন্ম নিয়েছে সেখানে তারা বলেন, সম্ভবত কোনো লিপিকারের ভুলে এরূপ ঘটেছে, অথবা কোনো ধর্মত্যাগী ইহুদি রাজা এটা ঘটিয়েছেন। কোনো ক্ষেত্রেই অনুমান ছাড়া আর কিছুই বলার উপায় নেই।
তাদের এ সকল ওযরখাহি আমাদেরকে মোল্লা দোপেয়াজি ও বাদশাহ আকবরের মধ্যকার সংলাপ মনে করিয়ে দেয়। বাদশাহ বললেন, এদেশে মোট কাকের সংখ্যা কত? মোল্লা দোপেয়াজী একটা কাল্পনিক সংখ্যা বললেন: এত লক্ষ... এত হাজার এত... । আপনার সন্দেহ হলে গুণে দেখুন। যদি বেশি হয় তাহলে বুঝতে হবে বাইরের কোনো কাক এদেশে বেড়াতে এসেছে। আর যদি কম হয় তাহলে বুঝতে হবে এদেশের কোনো কাক বাইরে বেড়াতে গিয়েছে। বাইবেল বিকৃতির অজুহাতে বলা এ সকল আনুমানিক সম্ভাবনার সাথে মোল্লা দোপেয়াজির কথার কি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়?
এছাড়া একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, কোনো লিপিকারের ইচ্ছায় বা ভুলে বা কোনো ধর্মত্যাগীর ইচ্ছায় বা চেষ্টায় একটা দুটো পাণ্ডুলিপির মধ্যে বিকৃতি ঘটানো যায়। কিন্তু সকল পাণ্ডুলিপি ও অনুলিপির মধ্যে বিকৃতি ঢুকল কিভাবে? এ বিষয়টা কি প্রমাণ করে না যে, এ সকল পুস্তক লেখা হয়েছে অনেক পরে এবং এগুলো দু-একটার বেশি পাণ্ডুলিপি অতীত কালে ছিল না যেগুলোকে সহজেই বিকৃত করা যেত?
সাধারণ বিকৃতি যেহেতু অগণিত, সেহেতু এ জাতীয় বিকৃতিগুলো বেশি আলোচনা করে পাঠকদের ধৈর্যচ্যূতি ঘটাতে চাচ্ছি না। ধর্মীয় উদ্দেশ্য প্রণোদিত দুটো বিশেষ শ্রেণির বিকৃতি আমরা এখানে আলোচনা করব: (১) পুরাতন নিয়ম থেকে উদ্ধৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে নতুন নিয়মের লেখকদের বিকৃতি এবং (২) পরবর্তী কালের খ্রিষ্টানগণ কর্তৃক নতুন নিয়মের পাঠের বিকৃতি।
আমরা দেখেছি যে, নতুন নিয়মের লেখকরা পুরাতন নিয়ম বুঝাতে কয়েকটা পরিভাষা ব্যবহার করতেন: (১) ‘লিখিত আছে’ বা ‘ভাববাদীগণ/ নবীগণ কর্তৃক লিখিত আছে’ (written, written by the prophets), (২) ‘শাস্ত্র’ বা পাক কিতাব (scripture) (৩) ‘ব্যবস্থা ও ভাববাদিগণ’ বা ‘তৌরাত ও নবীগণ’ (the law and the prophets)।
বাইবেল বিশেষজ্ঞরা বলেন, নতুন নিয়মের পুস্তকগুলোর লেখকরা তাঁদের ধর্মমত প্রমাণের জন্য ‘লিখিত আছে’, ‘শাস্ত্র’ বা ‘পাক কিতাবে’ আছে ইত্যাদি বলে পুরাতন নিয়মের পুস্তকগুলোর অনেক বক্তব্য বিকৃতরূপে উদ্ধৃত করেছেন। এ জাতীয় বিকৃতির মধ্যে রয়েছে গ্রন্থের নামের পরিবর্তন, বক্তব্যের পরিবর্তন, অর্থ পরিবর্তন এবং অপ্রাসঙ্গিক ব্যবহার। আমরা এখানে এ জাতীয় কিছু বিকৃতি উল্লেখ করছি।
যোহন বাপ্তাইজক বিষয়ে মথি লেখেছেন: ‘‘ইনি সেই ব্যক্তি যাঁর বিষয়ে লেখা আছে: ‘দেখ, আমি আপন দূতকে তোমার সম্মুখে প্রেরণ করি; সে তোমার আগে তোমার পথ প্রস্তুত করবে।’’ (মথি ১১/১০)। লূকও একই কথা লেখেছেন (লূক ৭/২৭)
মার্ক লেখেছেন: ‘‘যিশাইয় ভাববাদীর গ্রন্থে যেমন লেখা আছে: ‘‘দেখ, আমি আপন দূতকে তোমার অগ্রে প্রেরণ করি; সে তোমার অগ্রে তোমার পথ প্রস্তুত করিবে।’’ এটা কেরির অনুবাদ। কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩ নিম্নরূপ: ‘‘ইশাইয়া নবীর কিতাবে যেমন লেখা আছে, ‘দেখ, আমি আমার সংবাদদাতাকে তোমার আগে প্রেরণ করবো; সে তোমার পথ প্রস্তুত করবে।’’ (মার্ক ১/২)
বাইবেল বিশেষজ্ঞরা একমত যে, এ বক্তব্যটা মালাখির পুস্তকের তৃতীয় অধ্যায়ের ১ম শ্লোক থেকে উদ্ধৃত। মালাখির শ্লোকটা নিম্নরূপ: ‘‘দেখ, আমি আমার দূতকে প্রেরণ করবো, সে আমার আগে পথ প্রস্তুত করবে।’’ (মো.-১৩)
আমরা দেখছি যে, মূল পাঠ ও উদ্ধৃত পাঠের মধ্যে বহুবিধ বৈপরীত্য রয়েছে:
প্রথমত: প্রথম বাক্যে ‘আমি আপন দূতকে তোমার সম্মুখে প্রেরণ করি’ এ কথাটার মধ্যে ‘তোমার সম্মুখে’ বাক্যাংশ মালাখিতে নেই, ইঞ্জিল লেখকরা বাড়িয়েছেন।
দ্বিতীয়ত: মালাখির বক্তব্যে দ্বিতীয় বাক্যে বলা হয়েছে: ‘আমার আগে’; অথচ তিন সুসমাচার লেখকই মধ্যম পুরুষের সর্বনাম দিয়ে লেখেছেন ‘তোমার আগে’।
তৃতীয়ত: বাইবেল গবেষকরা একমত যে এ বক্তব্যটা মালাখি থেকে উদ্ধৃত। কিন্তু মার্ক লেখেছেন যে, বক্তব্যটা যিশাইয়/ ইশাইয়া নবীর গ্রন্থে বিদ্যমান।
আমাদেরকে দু’টা সম্ভাবনার একটা মানতে হবে। যিশাইয়র পুস্তকে বাক্যগুলো ছিল, কিন্তু পরে বিকৃতির মাধ্যমে তা মুছে দেওয়া হয়েছে। অথবা মার্কের লেখক ভুল করে মালাখির বক্তব্যকে যিশাইয়র বক্তব্য বলে চালিয়ে দিয়েছেন।
জাগতিক যে কোনো গবেষণায় তথ্যসূত্র প্রদানে এরূপ ভুল করলে এবং উদ্ধৃতির মধ্যে সংযোজন, বিয়োজন বা পরিবর্তন করলে গবেষক নিন্দিত হবেন এবং তিনি প্রাপ্য নম্বর বা ডিগ্রি থেকে বঞ্চিত হবেন। কিন্তু পবিত্র আত্মা কি এরূপ ভুল করতে পারেন? আর যে ‘পবিত্র আত্মা’ এরূপ ভুল করেন তার প্রেরণায় রচিত কোনো গ্রন্থের উপর কি নির্ভর করা যায়?
বৈথলেহেমের মর্যাদা বর্ণনায় মথি বলেন: ‘‘কেননা নবীর মধ্য দিয়ে এই কথা লেখা হয়েছে, ‘আর তুমি, হে এহুদা দেশের বেথেলহেম, তুমি এহুদার শাসনকর্তদের মধ্যে কোন মতে ক্ষুদ্রতম নও।’’ (মথি ২/৫-৬, মো.-১৩)
মথি মীখা বা মিকাহ (Micah) নবীকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু মীখার বক্তব্য মথির উদ্ধৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত। মীখা ৫/২ নিম্নরূপ: ‘‘আর তুমি, হে বেথেলহেম-ইফ্রাথা, তুমি এহুদার হাজার হাজার লোকদের মধ্যে মুদ্রা বলে অগণিতা।’’ (মো.-১৩)
এখানে মথি কথাটাকে সম্পূর্ণ বিকৃত করে ‘হাঁ’ কে ‘না’ বানিয়েছেন।
১ করিন্থীয় ২ অধ্যায়ের ৯ শ্লোকটা নিম্নরূপ: ‘‘কিন্তু, যেমন লেখা আছে, ‘চোখ যা দেখেনি, কান যা শোনেনি এবং মানুষের হৃদয়াকাশে যা ওঠেনি, যারা তাঁকে মহববত করে, আল্লাহ তাদের জন্য তা প্রস্তুত করে রেখেছেন।’’ (মো.-১৩)
বাইবেলের ভাষ্যকাররা বলেন, এ উদ্ধৃতিটা যিশাইয়র/ ইশাইয়ার ৬৪ অধ্যায়ের ৪ শ্লোক থেকে নেওয়া হয়েছে। শ্লোকটা নিম্নরূপ: ‘‘কারণ পুরাকাল থেকে লোক শোনেনি, কানে অনুভব করেনি, চোখে দেখেনি যে, তোমা ভিন্ন আর কোন আল্লাহ আছেন, যিনি তাঁর অপেক্ষাকারীর পক্ষে কাজ করে থাকেন।’’
লক্ষ্য করুন, উভয় বক্তব্যের মধ্যে কত বড় পার্থক্য! নিঃসন্দেহে উভয় স্থানের একটা স্থানে বিকৃতি ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে বাইবেল ব্যাখ্যাকার আদম ক্লার্ক বলেন, এ জটিল সমস্যার বিষয়ে আমি কি বলব তা ভেবে পাচ্ছি না। তবে আমি পাঠকের সামনে দুটো সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করছি। প্রথম সম্ভাবনা, এ স্থানে ইহুদিরা মূল হিব্রু বাইবেলে ও গ্রিক অনুবাদে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করেছে। দ্বিতীয় সম্ভাবনা পৌল এখানে যিশাইয়র পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করেননি, বরং তিনি এ বাক্যটা উদ্ধৃত করেছেন একটা বা দুটো জাল পুস্তক থেকে। যিশাইয়র উর্ধ্বারোহণ (The Ascension of Isaiah) ও এলিয়র নিকট প্রকাশিত বাক্য (The Revelation of Eli'jah) নামক দুটো জাল ও বানোয়াট পুস্তকে পৌলের উদ্ধৃত এ বক্তব্যটা হুবহু পাওয়া যায়। কেউ কেউ মনে করেন যে, প্রেরিত পৌল উক্ত জাল ও বানোয়াট পুস্তক থেকে এ বক্তব্যটা উদ্ধৃত করেছেন। সম্ভবত মানুষদের জন্য প্রথম সম্ভাবনাটা মেনে নেওয়া সহজ হবে না। তবে আমি এখানে গুরুত্বের সাথে পাঠকদেরকে স্মরণ করাতে চাই যে, দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাকে জীরোম ধর্মত্যাগ ও অবিশ্বাসের চেয়েও ভয়ঙ্কর বলে গণ্য করেছেন।[1]