উসূলে ফিক্বহ (ফিক্বহের মূলনীতি) শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ৪৬ টি
উসূলে ফিক্বহ (ফিক্বহের মূলনীতি) শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ৪৬ টি

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তার প্রশংসা করি। তার কাছে সাহায্য চাই। তার কাছে ক্ষমা চাই। তার নিকটে তাওবা করি।[1] আমরা আশ্রয় চাই আল্লাহর কাছে আমাদের আত্নার অনিষ্ট[2] থেকে এবং আমাদের মন্দ কর্ম[3] থেকে। আল্লাহ যাকে হেদায়েত দেন, তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন, তাকে কেউ হেদায়েত দিতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তার কোন শরীক নেই। আমি আরোও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বান্দা ও রসূল। আল্লাহ রহমত করুন তার উপর, তার পরিবার-পরিজনের[4] উপর, তার ছাহাবীদের উপর এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত যারা ন্যায় সঙ্গতভাবে তাদের অনুসরণ করবে[5] তাদের উপর। তিনি তাদের উপর অবিরত শান্তির ধারা বর্ষণ করুন।

অতঃপর এটি ফিকহ বা প্রায়োগিক শাস্ত্রের মূলনীতি বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত পুস্তিকা। ‘মা‘হাদুল ইলমিয়্যাহ’[6] এর মাধ্যমিক স্তরের তৃতীয় বর্ষের উপযোগী করে এটি আমি লিপিবদ্ধ করেছি। এবং নাম দিয়েছি-

الأصول من علم الأصول (ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি )

আল্লাহর কাছে কামনা করছি, তিনি যেন আমাদের কর্মগুলোকে তাঁর জন্যই একনিষ্ঠ করেন, তার বান্দাদের জন্য উপকারী করেন। নিশ্চয়ই তিনি সন্নিকটে, প্রার্থনা মঞ্জুরকারী।

লেখক: শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে ছ্বলিহ আল উছাইমীন।

[1]. তাওবা হলো: পাপ থেকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা। এটা দু’প্রকার । যথা: التوبة المطلقة এবং التوبة المقيدة।

التوبة المطلقة হলো নির্দিষ্ট কোন পাপের নয়, বরং সাধারণভাবে সব ধরণের পাপের জন্য যে তাওবা করা হয়।

التوبة المقيدة হলো: ঐ তাওবা যা নির্দিষ্ট পাপের জন্য করা হয়।

[2]. এখানে আত্মার অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। কেননা, নিশ্চয় আত্মার অনিষ্টতা রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন , إن النفس لأمارة بالسوء ... নিশ্চয় আত্মা মন্দ কর্মের নির্দেশ দেয় ... (সুরা ইউসুফ ‘১২:৫৩)।

৩.অন্তরের অনিষ্টতা সব সময় দু’টি জিনিসের উপর আবর্তিত হয়।

(ক). পাপ কাজের দিকে ধাবিত করা। (খ). সৎ কর্ম থেকে বিরত রাখা।


[4]. এখানে آل অর্থ: তার নিকটাত্মীয়ের মাঝে যারা মু’মিন এবং মু’মিন নয়, তারা آل কিনা এ ব্যাপারে মতানৈক্য আছে।جلاء الأفهام পৃ: ৩২৩, القول البديع পৃ: ৮৮।

[5]. ছাহাবীদের অনুসরণ করার দিক দিয়ে মানুষ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত।

(ক). যারা তাদের অনুসরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

(খ). যারা তাদের যথাযথভাবে অনুসরণ করেন।

(গ). যারা তাদের ত্রম্নটিপূর্ণভাবে অনুসরণ করেন।

আমরা সাধারণত দ্বিতীয় শ্রেণী মানুষের জন্য দু’আ করি। প্রথম শ্রেণীর মানুষ দু‘আর মোটেও উপযুক্ত নয়। আর তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ তাদের অনুসরণের মাত্রা অনুযায়ী দু’আর অন্তর্ভুক্ত হবেন।

[6]. উক্ত প্রতিষ্ঠানে লেখক শিক্ষকতা করেছেন।

সংজ্ঞা: أصول الفقه কথাটি দু’দিক থেকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। প্রথমত: শব্দ দু’টি এককভাবে। অর্থাৎ أصول এবং الفقه এর শাব্দিক পরিচিতি।

الأصول শব্দটি أصل এর বহুবচন। আর أصل বলা হয়, যার উপর অন্য কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়। এখান থেকেই দেওয়ালের মূল ভিত্তিকে أصل الجدار বলা হয়। আরো বলা হয়, أصل الشجرة বা বৃক্ষমূল, যা থেকে ডাল-পালা বিস্তার লাভ করে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,

أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أصلهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ

অর্থ: ‘‘তুমি কি লক্ষ্য কর না আল্লাহ কিভাবে উপমা দিয়ে থাকেন ? উত্তম বাক্যের তুলনা উৎকৃষ্ট বৃক্ষ যার মূল সুদৃঢ় ও যার শাখা-প্রশাখা ঊর্ধ্বে বিস্তৃত (সূরা ইবরাহীম ১৪:২৪)।’’

الفقه এর আভিধানিক অর্থ: বুঝা, অনুধাবন করা। এ অর্থেই আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,

وَأحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِّسَانِيْ يَفْقَهُوْا قَوْلِي

‘‘আমার জিহবার জড়তা দূর করে দিন। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে (সূরা ত্বা-হা ২০:২৭)।’’

পারিভাষিক অর্থ:

مَعْرِفَةُ الْأَحْكَامِ الشَّرْعِيَّةِ الْعَمَلِيَّةِ بِأَدِلَتِهَا التَّفْصِيْلِيَّةِ

‘‘ফিক্বহ হলো বিস্তারিত দলীল-প্রমাণাদীর মাধ্যমে শরীয়াতের কর্মগত বিধি-বিধানগুলো জানা।’’

সুতরাং আমাদের কথা: معرفة (জানা) এ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো নিশ্চিত জানা, প্রবল ধারণার ভিত্তিতে জানা। কেননা, ফিক্বহী বিধি-বিধানগুলো জানা কোন সময় নিশ্চিতভাবে হয়, আবার কোন সময় প্রবল ধারণামূলক হয়। যেমনটা ফিক্বহের অনেক মাসআ’লার ক্ষেত্রে দেখা যায়।

আমাদের কথা: الأحكام الشرعية (শারঈ আহকাম) এ কথা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো শরীয়াত থেকে প্রাপ্ত বিধি-বিধান। যেমন: ওয়াজিব, হারাম ইত্যাদি।

সুতরাং এর দ্বারা জ্ঞান ভিত্তিক বিধি-বিধান বিলুপ্ত হয়েছে। যেমন: এটা জানা যে, ‘‘পূর্ণ আংশিক অপেক্ষা বৃহত্তর।’’ এবং অভ্যাসগত বা প্রাকৃতিক বিধি-বিধানও বের হয়ে গিয়েছে। যেমন: শীতের রাতে যখন আবহাওয়া পরিস্কার থাকে, তখন শিশির পড়ার বিষয়টি জানা।

العَمَلية (কর্মগত) এ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্যে হলো যা আক্বীদার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন বিষয়। যেমন: ছ্বলাত, যাকাত ইত্যাদি।

সুতরাং এর দ্বারা আক্বিদার সাথে সংশ্লিষ্ট বিলুপ্ত হয়েছে। যেমন: আল্লাহর একত্ববাদ, তার নামসমূহ, গুণাবলী প্রভৃতি সম্পর্কে জানা। সুতরাং এগুলিকে পারিভাষিক ক্ষেত্রে ফিক্বহ হিসাবে অভিহিত করা হবে না।[1]

بأدلتها التفصيلية (শারঈ বিস্তারিত দলীল) এ অংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ফিক্বহের বিস্তারিত মাসআ’লাসমূহের সাথে যুক্ত ফিক্বহের দলীলসমূহ।

সুতরাং এর দ্বারা أصول الفقه বের হয়ে গিয়েছে। কেননা, أصول الفقه এর ক্ষেত্রে ফিক্বহের সংক্ষিপ্ত দলীলসমূহ আলোচিত হয়।

দ্বিতীয়ত: একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের নাম হওয়ার দিক দিয়ে উসূলে ফিক্বহের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়। সুতরাং এর সংজ্ঞা হলো:

عِلْمٌ يَبْحَثُ عَنْ أَدِلَّةِ الْفِقْهِ الْإِجْمَالِيَّةِ وَكَيْفِيَّةِ الْإِسْتِفَادِ مِنْهَا وَحَالِ الْمُسْتَفِيْدِ

“উসূলে ফিক্বহ এমন জ্ঞান বা বিদ্যা, যা ফিক্বহের সংক্ষিপ্ত দলীল, তা থেকে উপকৃত হওয়ার পদ্ধতি ও উপকার লাভকারী তথা মুজতাহিদ ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করে।”

আমাদের কথা: الإجمالية (সংক্ষিপ্ত দলীল) এ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো القواعد العامة বা সাধারণ/ব্যাপক নিয়ম-নীতি। যেমন: উসূলবিদদের কথা ‘নির্দেশ’ ওয়াজিব হওয়ার ফায়দা দেয়। ‘নিষেধ’ হারাম হওয়ার ফায়দা দেয়। ‘শুদ্ধতা’ বাস্তবায়নের দাবি করে।[2]

এর দ্বারা বিস্তারিত দলীল-প্রমাণ বের হয়ে গিয়েছে। অতএব, বিস্তারিত দলীল-প্রমাণের আলোচনা উসূলে ফিক্বহে উল্লেখিত হবে না। তবে শুধুমাত্র নিয়ম-নীতির উদাহরণ হিসাবে এ নিয়ে আলোচনা হবে।

আমাদের কথা: وكيفية الإستفاد منها (তা থেকে উপকৃত হওয়ার পদ্ধতি) এ কথা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো শব্দের মর্মার্থ ও তার বিধি-বিধান তথা عموم(ব্যাপক অর্থ প্রদান করা) خصوص (নির্দিষ্ট হওয়া) إطلاق (শর্তহীন হওয়া)تقييد (শর্তযুক্ত হওয়া) ناسخ (রহিতকারী) منسوخ (রহিত) ইত্যাদি অধ্যয়নের মাধ্যমে দলীলসমূহ থেকে শারঈ বিধি-বিধান কিভাবে পাওয়া যায়, তা অবগত হওয়া। নিশ্চয় এটি জানার মাধ্যমেই ফিক্বহের দলীলসমূহ থেকে তার বিধি-বিধান পাওয়া যাবে।

আমাদের কথা: وحال المستفيد (উপকার লাভকারীর অবস্থা) এ কথা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো উপকার লাভকারী ব্যক্তির অবস্থা জানা। আর উপকার লাভকারী ব্যক্তি হলেন মুজতাহিদ। তাকে مستفيد নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেহেতু তিনি ইজতেহাদের স্তরে পৌঁছার কারণে নিজেই দলীলসমূহ থেকে বিধি-বিধানগুলো লাভ করেন। সুতরাং মুজতাহিদের পরিচয়, ইজতেহাদের শর্ত, হুকুম ইত্যাদি বিষয় উসূলে ফিক্বহে আলোচনা করা হয়।

উসূলে ফিক্বহের উপকারিতা:


উসূলে ফিক্বহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন একটি এলেম যা প্রচুর উপকারী। এর উপকারিতা হলো এমন সক্ষমতা ও যোগ্যতা অর্জন করা, যার দ্বারা দলীলসমূহ থেকে শারঈ বিধি-বিধান নিরাপদে বের করা যায়।

সর্বপ্রথম এ ইলম একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে গ্রন্থবদ্ধ করেন ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদরীস আশ শাফে’ঈ ((রহঃ))।[3]অতঃপর অনেক আলিম এ ব্যাপারে তার অনুসরণ করেন এবং গদ্য-পদ্য, সংক্ষিপ্ত-বিস্তারিত বিভিন্ন ধরণের কিতাব রচনা করেন। আর এভাবেই ‘উসূলে ফিক্বহ’ অনন্য বৈশিষ্ট্য ও অবকাঠামোর অধিকারী একটি স্বতন্ত্র বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

[1]. অনেক ঊসূলবিদ ফিক্বহ এর সংজ্ঞায় الْعَمَلِيَّةِ (কর্মগত) শব্দের স্থলে الفرعية (শাখাগত) শব্দ বলেছেন। সুতরাং তাদের নিকট ফিক্বহ এর সংজ্ঞা হলো,

مَعْرِفَةُ الْأَحْكَامِ الشَّرْعِيَّةِ الفرعية بِأَدِلَتِهَا التَّفْصِيْلِيَّةِ

‘‘ফিক্বহ হলো বিস্তারিত দলীল-প্রমাণাদীর মাধ্যমে শরীয়াতের শাখাগত বিধি-বিধানগুলো জানা।’’

সম্মানিত লেখক এখানে ফিক্বহের সংজ্ঞায় শাখাগত বিধান না বলে কর্মগত বিধান বলেছেন। কারণ শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) শরীয়াতের বিধি-বিধানকে মৌলিক ও শাখাগত এভাবে ভাগ করাকে নাকচ করেছেন। তিনি বলেন, এভাবে ভাগ করা বিদআ’ত। আল্লাহ ও তার রসূলের কথায় এর কোন ভিত্তি নেই। কারণ এতে ছ্বলাতকে শাখাগত বিষয় হিসাবে অভিহিত করা হয়। অথচ এটি দীনের চুড়ান্ত পর্যায়ের মৌলিক বিষয়! সুতরাং এ বিভাজন কে নিয়ে আসলো ?! বস্ত্তত এ বিভাজন নিয়ে এসেছে মু’তাজিলা, জাহমিয়া ও অন্যন্য বিদআ’তী দলের লোকেরা। (মাজমূঊল ফাতাওয়া ১৯/২০৭-২১০)

[2]. এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাল্লাহ।

[3]. উসূলে ফিক্বহ বিষয়ে প্রথম কে কিতাব রচনা করেছেন, এ ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ফখরুদ্দিন রাযী, ইবনে খালদুন, বদরুদ্দিন যুরকাশী, জুআইনী, আল্লামা সুবকী, ইবনু খাল্লিকান সহ অধিকাংশ বিদ্বানের মতানুসারে এ বিষয়ে প্রথম কিতাব রচনা করেছেন ইমাম শাফেয়ী (রহ.)। তাঁর কিতাবের নাম ‘আর রিসালাহ’। (আল ইবহাজ ফী শরহিল মিনহাজ, আত তামহীদ ফী তাখরীজিল উসূল আলাল ফুরু‘ প্রভৃতি।) কিছু হানাফী আলেম দাবী করেন যে, ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) প্রথম এ বিষয়ে কিতাব লিখেছেন। আবার কেউ বলেন, আবু ইউসুফ, মুহাম্মদ প্রথম কিতাব লিখেছেন। কিছু শীআ দাবী করে যে, তাদের ইমাম মুহাম্মদ বাকের আলী বিন যাইনুল আবেদীন প্রথম কিতাব লিখেছেন। কিন্তু এ সব দাবীর পক্ষে তেমন কোন দলীল প্রমাণ নেই। এবং এদের কোন কিতাবের সন্ধানও পাওয়া যায় না। এ জন্য কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, যদি ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানরাও দাবী করে যে, তারাই এ বিষয়ে প্রথম কিতাব লিখেছে, তবুও তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

الأحكام শব্দটি حكم এর বহুবচন। এর আভিধানিক অর্থ ফায়ছালা করা।

পারিভাষিক অর্থ:

ما اقتضاه خطاب الشرع المتعلق بأفعال المكلفين من طلب أو تخيير أو وضع

‘‘মুকাল্লাফ (যাদের উপর শরীয়াতের বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়) এমন ব্যক্তির কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট শরীয়াতের খেতাব (কুরআন ও হাদীছ) যে তলব (কোন কাজ করা অথবা না করার দাবী), তাখয়ীর (কোন কাজ করা বা না করার জন্য ঐচ্ছিকতা প্রদান) অথবা প্রতীকী বিধান যা কিছু দাবী করে, তাকে আহকাম বলে।’’

خطاب الشرع (শরীয়াতের খেতাব বা সম্বোধন) এ কথা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কুরআন ও সুন্নাহ।[1]

المتعلق بأفعال المكلفين (মুকাল্লাফ ব্যক্তির কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট) এ অংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যা তাদের আমলের সাথে সংশ্লিষ্ট; সেটা কথা হোক অথবা কর্ম, করণীয় হোক অথবা বর্জনীয় হোক। সুতরাং উক্ত বক্তব্য দ্বারা আক্বীদা সংশ্লিষ্ট বিষয় বের হয়ে গেছে। অতএব, এ পরিভাষা অনুসারে আক্বীদা সংশ্লিষ্ট বিষয়কে ‘হুকুম’ হিসাবে অভিহিত করা হবে না।

আমাদের বক্তব্য: المكلفين(শরীয়তের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি) যাদের বৈশিষ্ট্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া এ কথা দ্বারা তারাই উদ্দেশ্য। সুতরাং এটি শিশু ও পাগলকে অন্তর্ভুক্ত করবে না।

আমাদের বক্তব্য: من طلب(কোন তলব) এ কথা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আদেশ ও নিষেধ। চাই তা আবশ্যকতার ভিত্তিতে হোক অথবা উত্তমতার ভিত্তিতে হোক।[2]

আমাদের বক্তব্য: أو تخيير (ঐচ্ছিকতা) এ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মুবাহ বা বৈধ বিষয়।[3]

আমাদের বক্তব্য: أو وضع (প্রতীকী বিধান) এ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো শুদ্ধ, অশুদ্ধ প্রভৃতি বিষয় যেগুলিকে শরীয়ত প্রণেতা কোন কাজ বাস্তবায়ন করা অথবা বাতিল করে দেয়ার বিশেষণ ও প্রতীক হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।

[1]. যেহেতু কুরআন ও হাদীছের মাধ্যমেই শরীয়ত প্রণেতা আমাদেরকে বিভিন্ন কর্মের নির্দেশনা প্রদান করার জন্য সম্বোধন করেন, এ জন্য কুরআন ও হাদীছকে খেতাব বা সম্বোধনের মাধ্যম হিসাবে অভিহিত করা হয়।

উল্লেখ্য যে, ইজমা ও ক্বিয়াসকে খেতাব বলা হয় না। কেননা, এগুলির মাধ্যমে শরীয়ত প্রণেতা আমাদেরকে সম্বোধন করেন না। এগুলি মূলতঃ কুরআন-সুন্নাহ উৎসারিত প্রশাখাগত দলীল।

[2]. তলব অর্থ চাওয়া, দাবী করা প্রভৃতি। উসূলে ফিক্বহ শাস্ত্রে তলব বলতে শারঈ আদেশ ও নিষেধ বুঝায়। অর্থাৎ কোন কাজ করা বা না করার দাবীকেই তলব বলে।

[3]. শরীয়ত প্রণেতা কর্তৃক কোন কাজ করা বা না করার ঐচ্ছিকতা প্রদানকে তাখয়ীর বলে। যেমন: সফরে ছিয়াম পালন করা।
শারঈ আহকাম বা বিধি-বিধানের প্রকারভেদ (أقسام الأحكام الشرعية)

শারঈ আহকাম দু’ভাগে বিভক্ত:

(ক) الأحكام التكليفية - দায়িত্বমূলক বিধি-বিধান

(খ) الأحكام الوضعية - প্রতীকী বিধি-বিধান।

(ক) الأحكام التكليفية - দায়িত্বমূলক বিধি-বিধান পাঁচ প্রকার:

১. ওয়াজিব (অবশ্য পালনীয় বিধান)।

২. মানদুব (পালন বাঞ্চনীয়)।

৩. হারাম (পালন করা নিষিদ্ধ)

৪. মাকরূহ (পালন নিন্দনীয়)

৫. মোবাহ (পালন বৈধ)[1]

১. ওয়াজিব (অবশ্য পালনীয় বিধান): ওয়াজিবের আভিধানিক অর্থ বিচ্যুত, পতিত, আবশ্যকীয়।

পারিভাষিক অর্থ:

ما أمر به الشارع على وجه الإلزام

‘‘শরীয়ত প্রণেতা আবশ্যকতার ভিত্তিতে যা পালনের আদেশ করেন, তাকে ওয়াজিব বলে।’’ যেমন: পাঁচ ওয়াক্ত ছ্বলাত।

আমাদের বক্তব্য: ما أمر به الشارع (শরীয়ত প্রণেতা যা আদেশ করেন) এ শব্দ দ্বারা হারাম, মাকরূহ ও মোবাহ বিষয় বিলুপ্ত হয়েছে।[2]

আমাদের বক্তব্য: على وجه الإلزام (আবশ্যকতার ভিত্তিতে পালনের) এ শব্দ দ্বারা ওয়াজিব মানদুব বিলুপ্ত হয়েছে।[3] ওয়াজিব কর্ম আনুগত্যের ভিত্তিতে পালনকারী ছাওয়াব প্রাপ্ত হবে এবং বর্জনকারী হবে শাস্তির যোগ্য। এটিকে ফরজ, ফারিজা, হাতমুন, লাযেম প্রভৃতিতে অভিহিত করা হয়।[4]

২. মানদুব (পালন বাঞ্চনীয়)। আভিধানিকভাবে মানদুব অর্থ আহুত, কাঙ্খিত, বাঞ্চনীয়। পারিভাষিক অর্থ:

ما أمر به الشارع لا على وجه الإلزام

‘সাধারণভাবে শরীয়ত প্রণেতা যে সব বিষয়ে আদেশ করেন যা আবশ্যকতার ভিত্তিতে পালন বুঝায় না তাকে মানদুব বলে।’ যেমন: নিয়মিত প্রত্যেহ পালনীয় সুন্নাত সমূহ।

আমাদের বক্তব্য: ما أمر به الشارع (শরীয়ত প্রণেতা যা আদেশ করেন) এ কথা দ্বারা হারাম, মাকরূহ ও মোবাহ বিষয় মানদুব থেকে বিলুপ্ত হয়েছে।

আমাদের বক্তব্য: لا على وجه الإلزام (আবশ্যকতার ভিত্তিতে পালন নয়) এ কথা দ্বারা ওয়াজিব বের হয়ে গেছে।

মানদুব কর্ম আনুগত্যের ভিত্তিতে পালনের জন্য কর্তা ছাওয়াবের অধিকারী হবে। তবে পরিত্যাগকারীকে শাস্তি দেয়া হবে না। একে সুন্নাত, মাসনূন, মুস্তাহাব, নফল প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়।

৩. হারাম (পালন করা নিষিদ্ধ)।

হারাম শব্দের আভিধানিক অর্থ বারণকৃত, নিষিদ্ধ।

পারিভাষিক অর্থ:

ما نهى عنه الشارع على وجه الإلزام بالترك

‘‘আবশ্যকতার ভিত্তিতে পালন ছেড়ে দেয়ার জন্য শরীয়ত প্রণেতা যা নিষেধ করেন, তাকে হারাম বলে।’’ যেমন: পিতা-মাতার অবাধ্য আচরণ।

আমাদের বক্তব্য: ما نهى عنه الشارع (শরীয়ত প্রণেতা যা নিষেধ করেন) এ কথা দ্বারা ওয়াজিব, মানদুব ও মোবাহ বের হয়ে গেছে।

হারাম কাজ আনুগত্যের ভিত্তিতে বর্জনকারী ছাওয়াব পাবে এবং তা পালনকারী শাস্তির যোগ্য বিবেচিত হবে। এটাকে মাহযুর (পরিত্যক্ত, নিষিদ্ধ) ও মামনূ‘ (নিষিদ্ধ) বলা হয়।

৪. মাকরূহ (পালন নিন্দনীয়)।

মাকরূহ শব্দের আভিধানিক অর্থ: ঘৃণিত, নিন্দনীয়, অপছন্দনীয়। পরিভাষায়:

ما نهى عنه الشارع لا على وجه الإلزام بالترك

‘‘শরীয়ত প্রণেতা যা সাধারণভাবে কোন কিছু করতে নিষেধ করেন, আবশ্যিক ভাবে ছেড়ে দেয়ার জন্য নয়, তাকে মাকরূহ বলে।’’ যেমন: বাম হাত দ্বারা লেন-দেন করা।

আমাদের বক্তব্য: ما نهى عنه الشارع(শরীয়ত প্রণেতা যা নিষেধ করেন) এ কথা দ্বারা ওয়াজিব, মানদুব ও মোবাহ বিলুপ্ত হয়েছে।

আমাদের বক্তব্য: (আবশ্যিক ভাবে ছেড়ে দেয়ার জন্য নয়) এ কথা দ্বারা হারাম বের হয়ে গেছে। মাকরূহ কাজ আনুগত্যের ভিত্তিতে বর্জনকারী ছাওয়াব পাবে এবং তা পালনকারীকে শাস্তি দেয়া হবে না।

৫. মোবাহ (পালন করা বৈধ)। মোবাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ ঘোষিত, অনুমোদিত। পারিভাষিক অর্থ:

ما لا يتعلق به أمر ولا نهي لذاته

‘যে কর্মের সত্ত্বার সাথে কোন আদেশ বা নিষেধ সংশ্লিষ্ট থাকে না, তাকে মোবাহ বলে।’ যেমন: রমাদ্বনের রাতে খাবার খাওয়া।

আমাদের বক্তব্য: ما لا يتعلق به أمر(যার সাথে কোন আদেশ সংশ্লিষ্ট থাকে না) এ কথা দ্বারা ওয়াজিব ও মানদুব বের হয়ে গেছে।

ولا نهي (এবং নিষেধ ও নয়) এ শব্দ দ্বারা হারাম ও মাকরূহ বের হয়ে গেছে।

لذاته (সত্ত্বার সাথে) এ শব্দ দ্বারা বের হয়ে গেছে ঐ সব বিষয়, যেগুলির সাথে ‘আদেশ’ যুক্ত হয়েছে, কোন আদিষ্ট বিষয়ের মাধ্যম হওয়ার কারণে অথবা যেগুলির সাথে ‘নিষেধ’ যুক্ত হয়েছে, কোন নিষিদ্ধ কাজের মাধ্যম হওয়ার কারণে। কেননা, এগুলি কোন আদিষ্ট বা নিষিদ্ধ বিষয় যারই মাধ্যম হবে, তার হুকুমই এদের হুকুম হিসাবে গণ্য হবে।[5] এটি বিষয়টিকে তার মৌলিক বৈধতা থেকে বের করে দিবে না।[6]

মোবাহ বিষয় যতক্ষণ পর্যন্ত বৈধতার বিশেষণের উপর বিদ্যমান থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার উপর কোন ছাওয়াব বা শাস্তি কোন কিছুই ধার্য হবে না। এটিকে হালাল বা জায়েয হিসাবে অভিহিত করা হয়।

(খ) الأحكام الوضعية প্রতীকী বিধি-বিধান।

প্রতীকী বিধি-বিধান এর পারিভাষিক অর্থ:

ما وضعه الشارع من أمارات لثبوت أو انتفاء أو نفوذ أو إلغاء

‘‘যাকে শরীয়ত প্রণেতা কোন কিছু সাব্যস্ত হওয়া বা না হওয়া অথবা কোন কিছু বাস্তবায়িত হওয়া বা না হওয়ার প্রতীক নির্ধারণ করেছেন, তাকে প্রতীকী বিধি-বিধান বলে।’’ এর অন্যতম হলো- ছ্বহীহ-শুদ্ধ হওয়া, ফাসেদ-নষ্ট হওয়া।[7]

১। ছহীহ (শুদ্ধ)

ছহীহ এর আভিধানিক অর্থ: রোগ থেকে মুক্ত বা নিরাপদ।

পারিভাষিক অর্থ:

‘‘যার কর্মের ফল ধার্য হয়, চাই সে কর্ম কোন ইবাদত হোক অথবা লেন-দেন বা চুক্তিমূলক হোক।’’

ইবাদতের ক্ষেত্রে ছহীহ হলো, যে কর্মের দ্বারা ব্যক্তি দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যায় এবং দাবী পূরণ হয়।[8]

লেন-দেন বা চুক্তির ক্ষেত্রে ছহীহ হলো যে কর্ম তার ফলাফলের অস্তিত্ব ধার্য করে। যেমন: ক্রয়-বিক্রয় কর্মের উপর ফলাফল হিসাবে বিক্রেতার জন্য পণ্যের মালিকানা ধার্য হওয়া। কোন কর্মই শর্ত পূরণ ও প্রতিবন্ধকতা দুর করা ছাড়া ছহীহ গণ্য হয় না।[9]

ইবাদতের ক্ষেত্রে এর উদাহরণ হলো: ছ্বালাতের সমস্ত ওয়াজিব, রুকন ও শর্ত পূরণ করে, যথা সময়ে তা আদায় করা।

লেন-দেন বা চুক্তির ক্ষেত্রে ছহীহ এর উদাহরণ হলো ক্রয়-বিক্রয়ের স্বীকৃত সমুদয় শর্ত পূরণ করে, প্রতিবন্ধকতা দুর করে ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা।

যদি কোন কর্মের মধ্যে কোন শর্ত না পাওয়া যায় অথবা কোন প্রতিবন্ধকতা পাওয়া যায়, তবে কর্মটি ছহীহ হিসাবে গণ্য হবে না। ইবাদতের ক্ষেত্রে শর্ত না পাওয়ার উদাহরণ হলো ওযু ছাড়াই ছ্বলাত আদায় করা।[10] লেন-দেন বা চুক্তির ক্ষেত্রে শর্ত না পাওয়ার উদাহরণ হলো এমন জিনিস বিক্রয় করা, যার সে মালিক নয়।[11]

ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকার উদাহরণ হলো নিষিদ্ধ সময়ে সাধারণ নফল ছ্বলাত আদায় করা। লেন-দেন বা চুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকার উদাহরণ হলো জুম‘আর দ্বিতীয় আজানের পর জুম‘আ ফরয এমন ব্যক্তির অনুমোদিত পন্থায় ক্রয়-বিক্রয় করা (এ সময় বৈধ নয়)।[12]

২. ফাসেদ -নষ্ট হওয়া:

ফাসেদ এর আভিধানিক অর্থ: ক্ষতিগ্রস্থ ও নষ্ট হয়ে যাওয়া। পারিভাষিক অর্থ:

ما لا تترتب آثار فعله عليه عبادة كان أم عقدا

‘‘যার কর্মের ফল তার উপর বর্তায় না, চাই সেটা ইবাদত হোক অথবা লেন- দেন হোক।’’

সুতরাং ইবাদতের ক্ষেত্রে ফাসেদ হলো যে কর্ম দ্বারা দায়িত্ব মুক্ত হয় না এবং আদেশ বা নিষেধের দাবীও পূরণ হয় না। যেমন: সময়ের পূর্বেই ছ্বলাত আদায় করা। লেন-দেনের ক্ষেত্রে ফাসেদ হলো যার কর্মের ফল তার উপর বর্তায় না। যেমন: অজ্ঞাত বস্ত্ত বিক্রয় করা।[13] ইবাদত, লেন-দেন ও শর্তের ক্ষেত্রে প্রতিটি ফাসেদ জিনিসই হারাম। কেননা, এটি আল্লাহর সীমা লঙ্ঘনের পর্যায়ভূক্ত এবং তার আয়াতকে উপহাসের বস্ত্ত হিসাবে গ্রহণ করার শামিল। উপরন্তু আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব লোকের কর্মকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যারা এমন সব শর্ত আরোপ করে, যা আল্লাহর কিতাবে নেই।[14]

ফাসেদ ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য:

দু’টি ক্ষেত্র ব্যতিত ফাসেদ ও বাতিল একই অর্থে ব্যবহৃত হয়।

প্রথম ক্ষেত্র: হাজীদের ইহরামের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে উসূলবিদগণ উভয়ের মাঝে পার্থক্য করেছেন এভাবে যে, ফাসেদ হলো ঐ হজ্জ যাতে মুহরিম ব্যক্তি প্রথম হালাল (১০ ই যিলহজ্জ কুরবানী, মাথা মুন্ডন প্রভৃতি বিষয় পালন করে হালাল হয়ে যাওয়া) এর পূর্বে স্ত্রী মিলন করে।[15] আর বাতিল বলা হয় যার কারণে ব্যক্তি দীন ইসলাম হতে বেরিয়ে (মুরতাদ) হয়ে যায়।[16]

দ্বিতীয় ক্ষেত্র: বিবাহ। এক্ষেত্রে উসূলবিদগণ উভয়ের মাঝে পার্থক্য করেছেন এভাবে যে, ঐ বিবাহকে ফাসেদ বলা হয়, যার ফাসেদ হওয়ার ব্যাপারে বিদ্বানগণ মতানৈক্য করেছেন। যেমন: মেয়ের অবিভাবক ছাড়া বিবাহ করা।[17]

পক্ষান্তরে ঐ বিবাহকে বাতিল বলা হয়, যার বাতিল হওয়ার ব্যাপারে বিদ্বানগণ সবাই একমত। যেমন: ইদ্দত পালনকারী মহিলার বিবাহ করা।[18]

[1]. শরীয়ত প্রণেতা আমাদেরকে যে সব কর্ম আবশ্যকতার ভিত্তিতে পালন করতে বলেন সেটি ওয়াজিব, যা উত্তমতা বা ঐচ্ছিকতার ভিত্তিতে বলেন, সেটি মানদুব বিবেচিত হয়। অপরদিকে যে সব কর্ম আবশ্যকতার ভিত্তিতে পালন করতে নিষেধ করেন সেটি হারাম, যা সাধারণ ভাবে নিষেধ করেন, সেটি মাকরূহ বিবেচিত হয়। আর যে সব কর্মের সাথে কোন আদেশ-নিষেধ থাকে না, তাকে বলা হয় মোবাহ ।

[2]. ما أمر به الشارع (শরীয়ত প্রণেতা যা আদেশ করেন) এ কথা দ্বারা হারাম, মাকরূহ ও মোবাহ বিষয় বের হয়ে গেছে। হারাম ও মাকরূহ বিলুপ্ত হওয়ার কারণ হলো হারাম ও মাকরূহ এর ক্ষেত্রে আদেশ করা হয় না। বরং নিষেধ করা হয়। মোবাহ বের হয়ে যাওয়ার কারণ হলো, এতে কোন আদেশ থাকে না।

[3]. মানদুব বিলুপ্ত হওয়ার কারণ হলো, এখানে আদেশ থাকলেও আবশ্যিকভাবে পালনের আদেশ থাকে না।

[4]. অধিকাংশ বিদ্বানের মতে, ওয়াজিব ও ফরজ একই বিষয়। কিন্তু হানাফীদের নিকট ফরজ হলো যা অকাট্ট দলীলের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়। যেমন: কুরআন বা মুতাওয়াতির হাদীছের মাধ্যমে সাব্যস্ত আবশ্যক পালনীয় কর্ম। পক্ষান্তরে দলীলে যন্নী বা প্রবল ধারণা ভিত্তিক দলীল অর্থাৎ খবরে ওয়াহেদ এর মাধ্যমে সাব্যস্ত হলে, তা ওয়াজিব গণ্য হবে। অনুরূপভাবে দলীলে ক্বাতঈ বা অকাট্ট দলীলের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা সাব্যস্ত হলে হারাম আর দালীলে যন্নীর মাধ্যমে সাব্যস্ত হলে নিষেধাজ্ঞা মাকরূহ গণ্য হবে।

[5]. কোন মোবাহ কর্ম ওয়াজিব কর্মের মাধ্যম হওয়ার কারণে ওয়াজিব হওয়ার উদাহরণ হলো ছ্বলাত আদায়ের জন্য ওযু করা ফরয। পানি ক্রয় মোবাহ। কিন্তু কোথায় যদি পানি ক্রয় করা ছাড়া ওযুর পানি না পাওয়া যায়, এবং কাছে টাকাও থাকে, তাহলে সেই সময় পানি ক্রয় করা ফরজ হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে কোন মোবাহ কাজ হারাম কাজের মাধ্যম হলে, মোবাহ কাজটিও হারাম গণ্য হবে।

[6]. অর্থাৎ বিষয়টি মৌলিক ভাবে বৈধই থেকে যাবে। যদিও সেটি কোন কোন ক্ষেত্রে আদিষ্ট বিষয়ের মাধ্যম হওয়ার কারণে আদিষ্ট অথবা নিষিদ্ধ কাজের মাধ্যম হওয়ার কারণে নিষিদ্ধ বিবেচিত হয়।

[7]. সাবাব বা কারণ, শর্ত, প্রতিবন্ধকতা প্রভৃতিও প্রতীকী বিধি-বিধানের অন্তর্ভূক্ত।

[8]. যখন কোন ব্যক্তির পালিত ফরজ ইবাদত ছহীহ হয়, তখন ঐ ব্যক্তি ফরজিয়্যাতের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং তার উপর থেকে কর্মটি পালনের দাবী পূরণ হয়।

[9] . الشرط এর আভিধানিক অর্থ: আলামত, প্রতীক প্রভৃতি।

পারিভাষিক অর্থ:

الشرط: ما يلزم من عدمه العدم ولا يلزم من وجوده الوجود.

‘‘অর্থাৎ শর্ত বলা হয়, যার অবিদ্যমানতা শর্তযুক্ত জিনিসের অবিদ্যমানতাকে আবশ্যক করে। তবে তার বিদ্যমানতা শর্তযুক্ত জিনিসের বিদ্যমানতাকে অবধারিত করে না।’’ যেমন; ছ্বালাতের জন্য ওযু করা শর্ত। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি ওযু ছাড়াই ছ্বলাত আদায় করে, তাহলে তার ছ্বলাত ছহীহ হবে না। কিন্তু ওযু করলেই যে ছ্বলাত পাওয়া যাবে, এমন নয়। কারণ অনেকেই ওযু করার পরও ছ্বলাত আদায় নাও করতে পারেন।

السبب অর্থ: কারণ বা উপকরণ। পারিভাষিক অর্থ:

السبب: ما يلزم من عدمه العدم ويلزم من وجوده الوجود.

‘‘অর্থাৎ যার বিদ্যমানতা উপকরণকৃত অর্থাৎ যার সে উপকরণ, সেটির বিদ্যমানতাকে আবশ্যক করে এবং তার অবিদ্যমানতা উপকরণকৃত জিনিসটির অবিদ্যমানতাকে অবধারিত করে।’’

المانع এর আভিধানিক অর্থ: বাধাদানকারী, প্রতিবন্ধক। পারিভাষিক অর্থ:

المانع: ما يلزم من وجوده العدم ولا يلزم من عدمه الوجود.

‘‘অর্থাৎ যার বিদ্যমানতা সংশ্লিষ্ট জিনিসের অবিদ্যমানতাকে আবশ্যক করে। তবে তার অবিদ্যমানতা সংশ্লিষ্ট জিনিসের বিদ্যমানতাকে অবধারিত করে না।’’ অর্থাৎ المانع ও الشرط সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী।

[10]. যেহেতু ছ্বলাত আদায় করার জন্য শর্ত হলো ওযু করা।

[11]. যেহেতু বিক্রয় ছহীহ হওয়ার জন্য শর্ত হলো বিক্রয় যোগ্য পণ্যের মালিক হওয়া।

[12]. সুরা জুম‘আ ৯ নং আয়াতে জুম‘আর আজানের পর ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করা হয়েছে।

[13]. যে কোন জিনিস ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত হলো বিক্রয় যোগ্য পণ্য জ্ঞাত বিষয় হতে হবে। সুতরাং অজ্ঞাত বস্ত্ত ক্রয়-বিক্রয় করলে, উক্ত ক্রয়-বিক্রয় ফাসেদ গণ্য হবে।

[14]. ছহীহ বুখারী হা/ ২১৫৫, মুসলিম হা/ ১৫০৪।

[15]. মুহরিম ব্যক্তি প্রথম হালাল অর্থাৎ ১০ ই যিলহজ্জ কুরবানী, মাথা মুন্ডন প্রভৃতি সম্পন্ন করে হালাল হয়ে যাওয়ার পূর্বে স্ত্রী মিলন করলে তার হজ্জ ফাসেদ গণ্য হবে। অতঃপর সে অন্যান্য হাজীদের মতই হজ্জের বাকী কাজ চালিয়ে যাবেন। তবে তাকে এ হজ্জের ক্বাযা আদায় করতে হবে।

[16]. মুহরিম ব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় মুরতাদ হয়ে গেলে তার হজ্জ বাতিল গণ্য হবে। কাজেই সে ব্যক্তি পরক্ষণেই তাওবা করে মুসলিম হয়ে গেলে, তার জন্য জায়েয নেই হজ্জের বাকী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। বরং তার জন্য আবশ্যক হলো পরবর্তীতে হজ্জ পুনরায় আদায় করা।

[17]. কোন মেয়ে তার অভিভাবক ছাড়া বিবাহ করলে অধিকাংশ ইমামদের মতে, উক্ত বিবাহ ফাসেদ বলে গণ্য হবে। তবে হানাফী মাযহাব মতে, মেয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক জ্ঞানবান হলে, অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিবাহ করতে পারবে।

[18]. ইদ্দত বা শোক পালনকারী মহিলার ইদ্দতের সময় সীমা পূর্ণ না করা পর্যন্ত বিবাহ করা সর্ব সম্মতিক্রমে হারাম। দ্র: সুরা বাক্বারা/২৩৫।

ইলম এর সংজ্ঞা:

العلم : إدراك الشيئ على ما هو عليه إدراكا جازما

‘‘অর্থাৎ কোন জিনিসকে তার মূল স্বরূপের উপর দৃঢ়ভাবে জানা।’’ যেমন: এটা জানা যে, ‘আংশিক অপেক্ষা বৃহত্তর পূর্ণ’ ইবাদতের ক্ষেত্রে নিয়ত করা শর্ত প্রভৃতি।

আমাদের বক্তব্য: إدراك الشي (কোন জিনিস সম্পর্কে জানা) এ শব্দ দ্বারা কোন জিনিস সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে না জানা ইলম বিলুপ্ত হয়েছে। এটাকে جهل بسيط বা সম্পূর্ণ অজ্ঞতা বলা হয়। যেমন: কাউকে জিজ্ঞেস করা হলো যে, বদর যুদ্ধ কখন সংঘটিত হয়েছিল? আর সে জবাবে বলে, আমি জানি না।

আমাদের বক্তব্য: على ما هو عليه (তার মূল স্বরূপের উপর জানা) এ অংশ দ্বারা ইলম থেকে বের হয়ে গেছে এমন জিনিস যা তার মূল স্বরূপ থেকে ভিন্ন ভাবে জানা যায়। এটাকে جهل مركب বা মিশ্র অজ্ঞতা বলা হয়। যেমন: কাউকে জিজ্ঞেস করা হলো যে, বদর যুদ্ধ কখন সংঘটিত হয়েছিল? আর সে জবাবে বলে, হিজরী তৃতীয় সালে![1]

আমাদের বক্তব্য: إدراكا جازما (দৃঢ়ভাবে জানা) এ কথা দ্বারা দৃঢ়ভাবে না জানা বিষয় বিলুপ্ত হয়েছে। এটা এভাবে যে, ব্যক্তি বিষয়টি যেভাবে জেনেছে তা দৃঢ় নয়। তাছাড়া অন্য দিকটিও সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সুতরাং এভাবে জানাকে ইলম হিসাবে অভিহিত করা হবে না।

অতঃপর সম্ভাব্য দু’টি জিনিসের মাঝে একটি যদি তার নিকট অগ্রগণ্য বলে প্রতিভাত হয়, তাকে ظن বা প্রবল ধারণা প্রসূত জ্ঞান বলে। আর যার উপর অগ্রাধিকার দেয়া হলো তাকে وهم বা সংশয় বলে। পক্ষান্তরে যদি তার নিকটে উভয় জিনিসটি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে তাকে شك বা সন্দেহ বলে।

উক্ত আলোচনায় এটা স্পষ্ট হলো যে, কোন কিছু জানার সাথে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কযুক্ত:

  • العلم - এটি হলো কোন বিষয়কে তার মূল স্বরূপের উপর দৃঢ়ভাবে জানা।[2]
  • جهل البسيط -বা সম্পূর্ণ অজ্ঞতা হলো, কোন বিষয়কে সম্পূর্ণরূপে না জানা।
  • جهل مركب- মিশ্র অজ্ঞতা, এটা হলো কোন জিনিসকে তার মূল স্বরূপ থেকে ভিন্ন ভাবে জানা।
  • ظن -প্রবল ধারণা প্রসূত জ্ঞান হলো কোন বিষয়কে জানা, সাথে তার বিপরীত অগ্রগণ্য বিষয়টিও সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকা।
  • وهم-সংশয় হলো কোন বিষয়কে জানা, সাথে তার বিপরীত অগ্রগণ্য জিনিসটি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকা।
  • شك বা সন্দেহ হলো, কোন জিনিসকে জানা, সাথে তার বিপরীত সমপর্যায়ের জিনিসটি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকা।
[1]. মিশ্র অজ্ঞতা হলো প্রথমত: সে জানে না কখন বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত: সে যে বিষয়টি জানে না- এটাও সে বুঝতে পারে না!

[2] . অর্থাৎ কোন জিনিসকে দৃঢ়তার সাথে সঠিক ভাবে জানা।

ইলম দু’প্রকার। যথা:

العلم الضروري - বাধ্যগত ইলম
العلم النظري - চিন্তা-গবেষণা নির্ভর ইলম

১. العلم الضروري -বাধ্যগত ইলম: যেখানে জ্ঞাত বিষয়ের ‘জানা’ বাধ্যগত হয়।[1] এটি এমন ভাবে হয় যে, দলীল, চিন্তা-গবেষণা ছাড়াই যা মানুষ জানতে বাধ্য হয়। যেমন: কোন কিছুর পূর্ণতা আংশিক অপেক্ষা বৃহত্তর, আগুন গরম, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রসূল প্রভৃতি জানা।[2]

২. العلم النظري -চিন্তা-গবেষণা নির্ভর ইলম: যে ইলম অর্জনে দলীল-প্রমাণ ও চিন্তা-গবেষণার প্রয়োজন হয়, তাকে العلم النظري বা চিন্তা-গবেষণা মূলক ইলম বলে। যেমন: এটা জানা যে, ছ্বালাতের ক্ষেত্রে নিয়ত ফরজ।

[1]. অর্থাৎ যা মানুষ বাধ্যগতভাবে জানে।

[2]. এ ধরণের ইলম জ্ঞানী, সাধারণ মানুষ সবাই জানতে পারে। এ ধরণের ইলম কেউ অস্বীকার করলে সে কাফির হয়ে যাবে। যেমন: আল্লাহর একত্ববাদ, ছ্বালাতের ফরজিয়্যাত, সুদ, মদ, যেনা প্রভৃতি হারাম হওয়া ইত্যাদি।

আভিধানিকভাবে الكلام এর অর্থ হলো: অর্থবোধক উচ্চারিত শব্দ।[1]

পারিভাষিক অর্থ: الكلام এর অর্থ হলো:

اللفظ المفيد

‘‘অর্থাৎ উপকারী বাক্যকে কালাম বা বাক্য বলা হয়।’’[2] যেমন: আল্লাহ আমাদের রব বা প্রতিপালক, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নবী।

নূন্যতম যার দ্বারা বাক্য গঠিত হয় তা হলো, দু’টি ইসম বা বিশেষ্য দ্বারা অথবা একটি ইসম ও একটি ফে‘ল দ্বারা। প্রথমটির উদাহরণ হলো محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রসূল)। দ্বিতীয়টির উদাহরণ হলো استقام محمد (মুহাম্মদ সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে)।

الكلام এর একবচন হলো كلمة। পরিভাষায় كلمة বলা হয়-

اللفظ الموضوع لمعنى مفرد وهي إما اسم أو فعل أو حرف

‘‘অর্থাৎ একক অর্থের জন্য গঠিত শব্দকেই كلمة বলা হয়।’’ এটি ইসম, ফেল বা হরফ হতে পারে। সুতরাং كلمة বা শব্দ তিন প্রকার। যথা: ক. إسم বা বিশেষ্য খ. فعل বা ক্রিয়া গ. حرف বা অব্যয়।

ক. إسم বা বিশেষ্য:

‘যে শব্দ কোন সময় উল্লেখ না করেই নিজেই নিজের অর্থ প্রকাশ করতে পারে, তাকে ইসম বলে।’ إسم তিন প্রকার:

প্রথম প্রকার: যা عموم বা ব্যাপকতার উপকারীতা দেয়।[3] যেমন: الأسماء الموصولة

দ্বিতীয় প্রকার: যা اطلاقবা শর্তহীনতার উপকারীতা দেয়। যেমন: হ্যাঁ বাচকের প্রেক্ষাপটে অনির্দিষ্ট ইসমের ব্যবহার।[4]

তৃতীয় প্রকার: যা خصوص বা নির্দিষ্টতার ফায়দা দেয়। যেমন: নির্দিষ্ট নাম সমূহ।[5]

খ. فعل বা ক্রিয়া

‘যে শব্দ নিজের অর্থ নিজেই প্রকাশ করে এবং তার শব্দরূপের মাধ্যমে তিন কালের কোন এক কালকে নির্দেশ করে, তাকে ফে‘ল বা ক্রিয়া বলে।’[6] এটি হয়তো বা ماضي বা অতিত কালের অর্থ প্রদান করবে। যেমন: فهم -সে বুঝেছে, অথবা مضارعবা বর্তমান/ভবিষ্যত কালের অর্থ প্রদান করবে। যেমন: يفهم সে বুঝতেছে বা বুঝবে, অথবা أمرবা নির্দেশের অর্থ প্রদান করবে। যেমন: افهم -তুমি অনুধাবন করো। সকল প্রকার ফে‘ল মুতলাক বা শর্তহীনতার ফায়দা দেয়। সুতরাং এতেعموم বা ব্যাপকতা নেই।[7]


গ. حرف বা অব্যয়

যা অন্যে পদের সাথে মিলিত হয়ে নিজের অর্থ প্রকাশ করে, তাকে হরফ বা অব্যয় বলে। হরফ বা অব্যয়ের অন্তর্ভূক্ত পদ নিম্নে তুলে ধরা হলো:

الواو এটি عاطفة (সংযোজক অব্যয়) হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি হুকুমের মধ্যে معطوف عليه ও معطوف কে শরীক হওয়ার ফায়দা দেয়। এটি দলীল ছাড়া তারতীব দ্বারা ধারাবাহিকতার দাবী করে না আবার তা নাকচও করে না।[8]


الفاء -পদটি عاطفة (সংযোজক অব্যয়) হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এবং হুকুমের মধ্যে معطوف عليه ও معطوف কে পর্যায়ক্রমে শরীক হওয়ার ফায়দা দেয়।[9] এটি سببية (কারণ বর্ণনা করা) অর্থে ব্যবহৃত হয়।


اللام الجارة-যের প্রদানকারী লাম। এর বেশ কিছু অর্থ রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো কারণ বর্ণনা করা, মালিকানা বুঝানো, বৈধতা বুঝানো প্রভৃতি।


على الجارة-যের প্রদানকারী على পদটির বেশ কিছু অর্থ রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো এ অব্যয় পদটি ওয়াজিব হওয়ার ফায়দা দেয়।

[1]. আরবি ভাষায় বলা হয়-ما يتلفظ به الإنسان অর্থাৎ মানুষ যা উচ্চারণ করে। সুতরাং লফয এর মধ্যে পাঁচটি জিনিস অন্তর্ভুক্ত। তা হলো ১. ইসম বা বিশেষ্য ২. ফে‘ল বা ক্রিয়া ৩. হরফ বা অব্যয় ৪. মুরাক্বাবে গাইরে মুফীদ বা অপরিপূর্ণ যৌগিক শব্দ ৫. মুরাক্বাবে মুফীদ বা বাক্য।

[2]. اللفظ المفيد দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, মুরাক্বাবে মুফীদ বা বাক্য। সুতরাং বোবা লোকের ইশারা, লেখা প্রভৃতি দ্বারা ভাব বোঝা গেলেও, তা কালাম বা বাক্য নয়। যেহেতু এগুলি উচ্চারিত হয় না। অনুরূপ ভাবে যায়েদ, খালেদ প্রভৃতিও কালাম নয়, যেহেতু এগুলি দ্বারা পরিপূর্ণ ভাব প্রকাশ পায় না।

[3]. আম অর্থ ব্যাপক। এটি شمول عمومي বা ব্যাপক ভাবে তার সকল একককে বুঝায়। যেমন: الإنسان দ্বারা ব্যাপক ভাবে সব মানুষকে বুঝায়। যে কোন একজনকে বুঝায় না।

[4]. মুতলাক বা শর্তহীন। এটি কোন রূপ শর্ত ছাড়াই অনির্দিষ্ট ভাবে যে কোন একজনকে নির্দেশ করে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে না। যেমন: যদি বলা হয়: في الدار رجل (ঘরে একজন লোক রয়েছে।) এর দ্বারা অনির্দিষ্ট ভাবে যে কোন একজন উদ্দেশ্য।

[5]. আম, খাস, মুতলাক, মুকাইয়াদ প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সামনে অচিরেই আসছে ইনশাআল্লাহ।

[6]. শব্দরূপ দ্বারা বিভিন্ন কাল প্রকাশ করে। যেমন: فهم - সে বুঝেছে, يفهم সে বুঝতেছে বা বুঝবে, افهم -তুমি বুঝো প্রভৃতি। তাই যে সব শব্দ রূপের পরিবর্তনের মাধ্যমে কাল না বুঝিয়ে মূল ধাতুর মাধ্যমে কাল নির্দেশ করে, সেগুলি ফে‘ল হিসাবে গণ্য হবে না। যেমন: نهار- দিন, ليلة রাত প্রভৃতি।

[7]. যেমন: যদি বলা হয় صام يوم الإثنين- তিনি সোমবারে ছিয়াম রেখেছেন। এর দ্বারা যে কোন এক সোমবারে ছিয়াম রাখা বুঝায় সব সোমবারে ছিয়াম রাখা বুঝায় না। তবে ব্যাপক অর্থবোধক কোন শব্দ যদি ফে‘লের সাথে যুক্ত হয়, তখন ফে‘ল ব্যাপকতার উপকারীতা দিবে। যেমন: كان النبي صلى الله عليه وسلم يصوم يوم الإثنين. অর্থ: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবারে ছিয়াম রাখতেন। এখানে ব্যাপকভাবে সব সোমবার উদ্দেশ্য। যে কোন এক সোমবার উদ্দেশ্য নয়। কেননা, كان শব্দটি অধিকাংশ সময় চলমান এর ফায়দা দেয়।

[8]. ভিন্ন দলীল থাকলেও و পদটি তারতীবের ফায়দা দেয়। এর দলীল হলো আল্লাহ বলেন, إن الصفا والمروة من شعائر الله. -‘নিশ্চয় ছাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনের অন্যতম (সূরা বাক্বারা ২:১৫৭)। অত্র আয়াতটি ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে তারতীব বা ধারাবাহিকতা ঠিক রেখে সাঈ করাকে আবশ্যক করে না। কিন্তু হাদীছে আছে- إبدأ بما بدأ الله به -অর্থাৎ আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন, তোমরাও তা দিয়ে শুরু করো। সুতরাং অত্র হাদীছের ভিত্তিতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আবশ্যক।

[9]. ف পদটি ধারাবাহিকতা ও পর্যায়ক্রমের ফায়দা দেয়। যেমন: আল্লাহর বাণী:

الم تر أن الله ينزل من السماء ماء فتصبح الأرض مخضرة . - ‘‘তুমি কি লক্ষ্য করনি, নিশ্চয় আল্লাহ তাআ‘লা আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন। ফলে জমিন সবুজ হয়ে যায় (সুরা হাজ্জ ২২:৬৩) ।’’

সত্য বা মিথ্যার দ্বারা গুণান্বিত হওয়া বা না হওয়ার দিক দিয়ে বাক্য দু’প্রকার। যথা:

(১) خبر -বর্ণনামূলক বাক্য।

(২) إنشاء -অনুজ্ঞামূলক বাক্য।

(১) خبر-বর্ণনামূলক বাক্য।

ما يمكن أن يوصف بالصدق أو الكذب لذاته

অর্থ: যে বাক্যকে সত্ত্বাগত ভাবে সত্য বা মিথ্যার দ্বারা গুণান্বিত করা যায়, তাকে خبر (বর্ণনামূলক বাক্য) বলা হয়।

আমাদের বক্তব্য: ما يمكن أن يوصف بالصدق أو الكذب (যাকে সত্য বা মিথ্যার দ্বারা গুণান্বিত করা যায়) এ অংশ দ্বারা إنشاء (অনুজ্ঞামূলক বাক্য) বের হয়ে গেছে। কারণ এটাকে সত্য বা মিথ্যার দ্বারা গুণান্বিত করা সম্ভব নয়। কেননা, এর মর্মার্থ তার সম্পর্কে কোন সংবাদ নয় যে, যেখানে বলা যেতে পারে, ‘সে সত্য বলেছে’ অথবা ‘সে মিথ্যা বলেছে’।

আমাদের বক্তব্য: لذاته (সত্ত্বাগত ভাবে) এ শব্দ এর দ্বারা বের হয়ে গেছে এমন বর্ণনামূলক বাক্য, যাকে সংবাদ দাতার বিবেচনায় সত্য বা মিথ্যার সম্ভাবনা রাখে না। সুতরাং সংবাদ দাতার বিবেচনায় خبر (বর্ণনামূলক বাক্য) তিন প্রকার: যথা:

প্রথম: যাকে মিথ্যার দ্বারা গুণান্বিত করা সম্ভব নয়। যেমন: আল্লাহর বর্ণনা ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রমাণিত হাদীছ।

দ্বিতীয়: যাকে সত্য দ্বারা গুণান্বিত করা সম্ভব নয়। যেমন: শারঈ বা জ্ঞানগত ভাবে অসম্ভব জিনিস সম্পর্কে খবর দেয়া। প্রথমটির (শারঈভাবে অসম্ভব) উদাহরণ হলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে নবুওয়াত দাবি করার সংবাদ দেয়া।[1]

দ্বিতীয়টির (জ্ঞানগত ভাবে অসম্ভব) উদাহরণ হলো পারস্পরিক বিপরীতধর্মী দু’টি জিনিস একীভূত হওয়ার খবর দেয়া। যেমন: একই সময়ে একই চোখ স্থির ও নড়া-চড়া করার খবর দেয়া।[2]

তৃতীয়ত: যাকে সত্য এবং মিথ্যার দ্বারা গুণান্বিত করা সম্ভব নয়। হয়তো সমতার ভিত্তিতে অথবা একটিকে অপরটির উপর অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। যেমন: কোন অনুপস্থিত ব্যক্তির আগমন সম্পর্কে কোন ব্যক্তির খবর দেয়া প্রভৃতি।[3]

(২) إنشاء -অনুজ্ঞামূলক বাক্য

ما لا يمكن أن يوصف بالصدق أو الكذب

‘যাকে সত্য অথবা মিথ্যার দ্বারা গুণান্বিত করা সম্ভব নয়, তাকে إنشاء বা অনুজ্ঞামূলক বাক্য বলে।’ إنشاء বা অনুজ্ঞামূলক বাক্যের অন্তর্ভূক্ত হলো أمر (নির্দেশ), نهي (নির্দেশ) প্রভৃতি। যেমন: আল্লাহর বাণী:

واعبدوا الله ولا تشركوا به شيئا

‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না (সূরা আ ন-নিসা ৪:৩৬)।’[4]

একই বাক্য দু’দিক বিবেচনা করে একই সাথে বর্ণনামূলক ও অনুজ্ঞামূলক হতে পারে। যেমন: লেন-দেন বা চুক্তির ক্ষেত্রে উচ্চারণযোগ্য ছীগাহ বা শব্দরূপ। যেমন: بعت - আমি বিক্রয় করলাম, قبلت - আমি গ্রহণ করলাম। উপরোক্ত বাক্য গুলি চুক্তিকারীর মনে যা রয়েছে- তার উপর প্রমাণ করার দিক দিয়ে خبر বা বর্ণনামূলক আবার এ বাক্য গুলির উপর ভিত্তি করে চুক্তি ধার্য হওয়ার দিক দিয়ে এটি إنشاء বা অনুজ্ঞামূলক বাক্য।[5]

কোন কোন সময় বাক্য خبر এর আকৃতিতে আসে কিন্তু উদ্দেশ্য নেয়া হয় إنشاء আবার এর বিপরীতও হয়। অর্থাৎ বাক্য ব্যবহৃত হয় إنشاء এর আকৃতিতে কিন্তু উদ্দেশ্য নেয়া হয় خبر বা বিধেয় হিসাবে।

প্রথমটির (খবর দ্বারা ইনশা উদ্দেশ্য) এর উদাহরণ হলো আল্লাহর বাণী:

والمطلقات يتربصن بأنفسهن ثلاثة قروء

‘‘ তালাকপ্রাপ্তা নারীরা তিন পবিত্রতার সময়কাল অপেক্ষা করবে (সূরা আল-বাক্বারা ২:২২৮)।’’[6]

আয়াতে يتربصن (তারা অপেক্ষা করবে) এ শব্দটি خبر হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো أمر (আদেশ)।

এর ফায়দা হলো আদিষ্ট কাজটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে এমন ভাবে গুরুত্বারোপ করা যেন কাজটি আদিষ্ট ব্যক্তির বিশেষণের ন্যায় এটি তার সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছে।[7]

বিপরীতটির (অনুজ্ঞা মূলক বাক্য দ্বারা বর্ণনা মূলক বাক্য উদ্দেশ্য) উদাহরণ হলো আল্লাহর বাণী:

وقال الذين كفروا للذين آمنوا اتبعوا سبيلنا ولنحمل خطيكم

‘‘যারা কুফরী করেছে, তারা ঈমানদার লোকদের বলে, ‘তোমরা আমাদের পথ অনুসরণ করো, (এতে পাপ হলে) আমরা তোমাদের পাপের ভার বহন করবো’(সূরা আল-আনকাবূত ২৯:১২)।’’

আয়াতে ولنحمل শব্দটি أمر এর আকৃতিতে আসলেও এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো خبر অর্থাৎ আমরা বহন করবো।[8] এর ফায়দা হলো যার সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হয়, সেটিকে আবশ্যক-অবধারিত জিনিসের স্থলে নিয়ে আসা।


ব্যবহারিক দিক থেকে كلام বা বাক্য দু’প্রকার।

الحقيقة বা প্রকৃত অর্থবোধক।
المجاز বা রূপক অর্থবোধক।[9]

الحقيقة প্রকৃত অর্থবোধক শব্দের পরিচয়:

فالحقيقة هي اللفظ المستعمل فيما وضع له

অর্থাৎ শব্দকে যে অর্থের জন্য গঠন করা হয়েছে ঐ অর্থে তা ব্যবহৃত হওয়াকে হাক্বীকত বলে।

আমাদের কথা: ‘المستعمل (ব্যবহৃত অর্থবোধক শব্দ)’ কথাটির দ্বারা مهمل তথা অর্থহীন শব্দ বাদ হয়েছে। তাই এ ধরণের শব্দকে হাক্বীকত বা মাজায কোনটিই গণ্য করা হবে না। فيما وضع له (যে অর্থের জন্য গঠন করা হয়েছে) এ অংশ দ্বারা মাজায বা রূপক অর্থবোধক শব্দ বাদ পড়েছে।

হাক্বীকত তিন প্রকার। যথা:-

১. اللغوي বা আভিধানিক হাক্বীকত (আভিধানিক প্রকৃত অর্থ)।

২. الشرعي শারঈ হাক্বীকত (শরী‘আতগত প্রকৃত অর্থ)।

৩. العرفية বা পারিভাষিক হাক্বীকত (পরিভাষাগত প্রকৃত অর্থ)।


اللغوي বা আভিধানিক হাক্বীকত এর পরিচয়

هي اللفظ المستعمل فيما وضع له في اللغة

অর্থাৎ অভিধানে শব্দ যে অর্থের জন্য গঠন করা হয়েছে ঐ অর্থে শব্দ ব্যবহৃত হওয়াকে اللغوي বা আভিধানিক হাক্বীকত বলে।

আমাদের কথা: ‘في اللغة (অভিধানে)’ সংজ্ঞার এ অংশের দ্বারা শারঈ ও পারিভাষিক হাক্বীকত বিলুপ্ত হয়েছে। الصلاة শব্দটি আভিধানিক হাক্বীকতের উদাহরণ। এ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দু‘আ করা। অভিধানবিদদের বক্তব্য অনুযায়ী শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হবে।

الشرعي শারঈ হাক্বীকত

هي اللفظ المستعمل ففيما وضع له في الشرع

শারঈ শব্দকে যে অর্থের জন্য গঠন করা হয়েছে ঐ অর্থে তা ব্যবহৃত হওয়াকে শারঈ হাক্বীকত বলে। উক্ত সংজ্ঞায় في الشرع অংশ দ্বারা আভিধানিক ও পারিভাষিক হাক্বীকত বিলুপ্ত হয়েছে। الصلاة শব্দের শারঈ প্রকৃত অর্থ হচ্ছে,

هي الأقوال والأفعال المعلومة المفتتحة بالتكبير المختتمة بالتسليم

অর্থাৎ ছ্বলাত হচ্ছে নির্দিষ্ট কথা ও কর্ম যা আরম্ভ করা হয় তাকবির তথা আল্লাহু আকবার পাঠের মাধ্যমে আর শেষ হয় সালাম ফিরিয়ে। সুতরাং শরী‘আত প্রণেতার উদ্দেশ্যে অনুযায়ী শব্দটিকে উক্ত অর্থেই ব্যবহার করতে হবে।[10]


العرفية বা পারিভাষিক হাক্বীকত

هي اللفظ المستعمل ففيما وضع له في العرف

অর্থাৎ পরিভাষায় শব্দকে যে অর্থের জন্য গঠন করা হয়েছে ঐ অর্থে শব্দ ব্যবহৃত হওয়াকে পারিভাষিক হাক্বীকত বলে।

সংজ্ঞায় ‘في العرف’ (পরিভাষায়) এ অংশ দ্বারা শারঈ ও আভিধানিক হাক্বীকত বিলুপ্ত হয়েছে। পারিভাষিক হাক্বীকতের উদাহরণ হচ্ছে الدابة বা চতুষ্পদ প্রাণী। পরিভাষায় এ শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো চার পা বিশিষ্ট প্রাণী। সুতরাং পরিভাষাবিদদের উদ্দেশ্যে অনুযায়ী শব্দটি উক্ত অর্থেই ব্যবহৃত হবে।

হাক্বীকতের এ তিন প্রকার জেনে রাখার উপকারীতা হচ্ছে, ব্যবহৃত হওয়ার স্থান ভেদে হাক্বীকি অর্থের উপর শব্দ প্রয়োগ করা। তাই অভিধানবিদদের উদ্দেশ্যে অনুযায়ী হাক্বীকতে লুগাবি বা আভিধানিক প্রকৃত অর্থে এবং শরী‘আতগত ব্যবহারের ক্ষেত্রে হাক্বীকতে শারঈ তথা শরী‘আতগত প্রকৃত অর্থের উপরই শব্দ প্রয়োগ হবে।


(২) المجاز মাজায বা রূপক অর্থ:

المجاز هو اللفظ المستعمل في غير ما وضع له

অর্থাৎ শব্দকে যে অর্থের জন্য গঠন করা হয়েছে ঐ অর্থ ছাড়া অন্য কোন অর্থে ব্যবহৃত হওয়াকে মাজায বলা হয়। যেমন: বীরপুরুষ বুঝাতে أسد (সিংহ) শব্দের ব্যবহার। এখানে ‘ المستعمل(ব্যবহারিক অর্থবোধক)’ এ অংশ দ্বারা مهمل তথা অর্থহীন শব্দ বাদ পড়েছে। তাই অর্থহীন শব্দকে হাক্বীকত বা মাজায কোন কিছুই বলা হবে না।

আমাদের কথা: في غير ما وضع له (যে অর্থের জন্য শব্দ গঠন করা হয়েছে ঐ অর্থ ছাড়া) এ অংশ দ্বারা হাক্বীকত বিলুপ্ত হয়েছে। হাক্বীকি-প্রকৃত অর্থ গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমন সঠিক প্রমাণ ব্যতীরেকে মাজায বা রূপক অর্থে শব্দ প্রয়োগের বৈধতা নেই। এ দলীল-প্রমাণ ইলমুল বায়ান এর পরিভাষায় ‘القرينة বা ইঙ্গিত’ নামে পরিচিত।

মাজায-রূপক অর্থে শব্দ ব্যবহার যথার্থ হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে প্রকৃত ও রূপক অর্থের মাঝে যোগসূত্র বা বন্ধন বিদ্যমান থাকা। যাতে প্রকৃত অর্থকে রূপক অর্থ দ্বারা প্রকাশ করা যথাযথ হয়। এ বন্ধনকে ইলমুল বায়ান এর পরিভাষায় علاقة (সম্পর্ক) বলা হয়। এ সম্পর্ক হতে পারে مشابهة (পরস্পরিক সাদৃশ্য) বা অন্য কিছু। আর সম্পর্কে পারস্পারিক সাদৃশ্যতা বিদ্যমান থাকলে তাকে مجاز استعارة বলে। যেমন: রূপক অর্থে বীর পুরুষ বুঝাতে أسد (সিংহ) শব্দ ব্যবহৃত হয়। আর علاقة (সম্পর্ক) পারস্পারিক সাদৃশ্য ব্যতীত অন্য কিছু হলে তাকে مجاز مرسل বলে। আর কোন কিছুর দিকে মাজায-রূপক অর্থকে إسناد সম্বন্ধযুক্ত করা হলে তাকে مجاز عقلي বলা হয়। مجاز مرسل এর উদাহরণ: رعينا المطر (আমরা ঘাস চড়িয়েছি)। এর হাক্বীকি-প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আমরা বৃষ্টি চড়িয়েছি। এখানে المطر (বৃষ্টি) শব্দটি العشب (ঘাস) এর রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই শব্দটি মাজায অর্থেই গণ্য।

مجاز عقلي এর উদাহণ: أنبت المطر العشب(বৃষ্টি ঘাস উৎপন্ন করেছে)। এ বাক্যের প্রতিটি শব্দ হাক্বীকি-প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ঘাস উৎপন্ন হওয়ার সম্বন্ধ বৃষ্টির দিকে করা হয়েছে রূপক অর্থে। এখানে প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলাই ঘাস উৎপন্নকারী। তাই المطر শব্দটি সম্বন্ধের দিক থেকে মাজায-রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। مجاز مرسل এর আরো অন্তর্ভূক্ত বিষয় হলো তা বৃদ্ধি পাওয়া ও বিলুপ্ত করণের মাধ্যমে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হওয়া। উছুলবিদগণ নিম্নোক্ত আয়াত পেশ করতঃ শব্দ বৃদ্ধির উদাহরণ দিয়েছেন।

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ

কোন কিছুই তার অনুরূপ নয় (সূরা শুরা ৪২:১১)।

তারা বলেন, এখানে كَ কাফ বর্ণটি অতিরিক্ত। যা আল্লাহর সাদৃশ্যতা নাকোচ করার বিষয়টি গুরুত্বারোপ করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

শব্দ বিলুপ্তির উদাহরণ: আল্লাহর বাণী: وسئل القرية অর্থ: জিজ্ঞেস করুন ঐ জনপদকে (সূরা ইউসূফ ১২:৮২)। বাক্যেটি মূলে ছিল واسأل أهل القرية। অর্থাৎ জনপদের অধিবাসীদের জিজ্ঞেস করুন।

উক্ত আয়াতাংশ হতে أهل(অধিবাসী) শব্দটিকে রূপকভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। মাজাযের আরো অনেক প্রকার রয়েছে যা ইলমুল বায়ানে আলোচনা করা হয়েছে। উছুলে ফিক্বহের হাক্বীকত ও মাজায সম্পর্কে মাত্র একটি দিক আলোচনা করা হলো। কেননা, শব্দের প্রকৃত অথবা রূপক উভয় অর্থ ও হুকুম সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। আল্লাহ তা‘আলাই এসম্পর্কে অধিক অবগত।

সতর্কীকরণঃ
কুরআন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কালাম বা বাক্যের হাক্বীকত-প্রকৃত ও মাজায-রূপক অর্থের বিভাজন পরবর্তী অধিকাংশ আলিমের নিকট প্রসিদ্ধ বিষয়। তবে বিদ্বানদের কতিপয় বলেছেন, কুরআনে কোন মাজায-রূপক অর্থ নেই। আরো কতিপয় বলেছেন, কুরআনসহ অন্য কোথাও মাজায-রূপক অর্থ বলতে কিছুই নেই। আবূ ইসহাক্ব আল-ইসফারাইনী, পরবর্তীদের মাঝে আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ আল-আমীন শানক্বীতি এ মন্তব্য করেন। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ ও তার ছাত্র ইবনুল ক্বাইয়ূম বর্ণনা করেন যে, এ বিভাজন গুরুত্বপূর্ণ তিন যুগের পরে আবিস্কৃত পরিভাষা। তিনি এ কথাটি শক্তিশালী দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে সমর্থন করেছেন। কেউ তা অবগত হলে তার নিকট সুস্পষ্ট হবে যে, এটিই সঠিক মত।

[1]. যেহেতু কুরআনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নাবী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। দেখুন, সুরা আহযাব/৪০।
[2]. অর্থাৎ কোন বস্ত্ত একই সময়ে নড়া চড়া করা আবার স্থির থাকা মানবীয় জ্ঞান বিচারে অযৌক্তিক বিষয়।
[3]. যেমন: সততার গুণে গুণান্বিত ব্যক্তির সংবাদকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সত্য বলে জানবো আবার মিথ্যাবাদী হিসাবে পরিচিত ব্যক্তির সংবাদকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মিথ্যা বলে জানবো। আর সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে কিছুই জানা যায় না, তার সংবাদ সত্য ও মিথ্যার ক্ষেত্রে সমসম্ভাবনা থাকবে।


[5]. যেহেতু বাক্যগুলি বক্তার মনে যা আছে তার খবর দিচ্ছে, সে হিসাবে এটি বর্ণনামূলক। আবার এটি অনুজ্ঞামূলকও বটে, যেহেতু এর বক্তাকে সত্যবাদী বা মিথ্যাবাদী হিসাবে অভিহিত করা সম্ভব নয়।
[6]. আয়াতটির অর্থ হয়, তালাকপ্রাপ্তা নারীরা যেন তিন পবিত্রতার সময়কাল অপেক্ষা করে।
[7]. خبر মূলতঃ ছিফাত বা বিশেষণ। যেমন: زيد قائم - যায়েদ দন্ডায়মান। এখানে দন্ডায়মান হলো যায়েদ সম্পর্কে খবর যা তার একটি বিশেষণ বুঝাচ্ছে। সুতরাং তালাকপ্রাপ্তা নারীদের ব্যাপারে যখন ইদ্দত পালন করার খবর দেয়া হয়, সেটি যেন তাদেরই একটি ছিফাত বা বৈশিষ্ট যা পালনের দাবীকে গুরুত্বারোপ করে।
[8]. অথচ আমর হিসেবে অর্থ হওয়ার কথা ছিল এরকম: ‘আমরা যেন বহন করি।’
[9]. শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ তিনটি যুগ অর্থাৎ ছাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ যুগে কালামের এ বিভাজন প্রচলিত ছিল না। অথচ আরবী ভাষা সম্পর্কে পরবর্তীদের চেয়ে তারাই বেশি অবগত ছিলেন। ইমাম শাফেঈ, আহমাদ, আবূ হানীফা, আওযাঈ, দাউদ রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ বিদ্বান ও তাদের শিষ্যদের লেখনীতে এর প্রমাণ মিলে। যারা মনে করে যে, প্রসিদ্ধ মুজতাহিদ আলিম এবং অন্যান্য সালাফ ইমামগণ এ বিভাজন করেছেন, তাদের এ ধারণা সালাফ ইমামগণের বক্তব্যের ব্যাপারে অজ্ঞতা হিসাবে বিবেচিত হবে। যা মূলত মু‘তাযিলা ও তাদের অনুসারীদের বক্তব্যে থেকে জানা যায়। আর তাফসীর, হাদীছ, ফিক্বহ, অভিধান এবং নাহু কোন বিষয়েই তাদের ভূমিকা বা অবদান নেই। আর ভাষা ও নাহু শাস্ত্রবিদ খলীল, সিবওয়াইহ, কাসাঈ, র্ফারা এবং তাদের মতো ভাষা ও ব্যাকরণবিদগণের মধ্যে অন্যরাও এ বিভাজনের সাথে পরিচিত ছিলেন না। দ্র: মাজমু‘আ আল-ফাতাওয়া ২০/৪০০-৪০৫ পৃ। আল্লামা ইবনুল কাইয়ূম (রহঃ) এ বিভাজন বাতিল হওয়ার ৫০ টি দিক উল্লেখ করেছেন। দেখুন, مختصر الصواعق المرسلة ২৭১ পৃ:। এ প্রসঙ্গে গ্রন্থকার শাইখ ছালিহ আল-উছাইমিন (রহঃ) বলেন,

على كل حال نحن وضعنا في هذا الكتاب الحقيقة والمجاز وهو ففي تأليفنا لكن إنما وضعناه قبل أن يتبين لنا الصحة او يتبين لنا بيانا واضحا انه لا مجاز.

এ কিতাবে আমরা হাক্বীকত ও মাজায সম্পর্কে আলোচনা করেছি। যা আমাদের রচনার অন্তর্ভূক্ত। মূলতঃ সঠিক বিষয়টি আমাদের নিকট স্পষ্ট হওয়া অথবা মাজায বলতে কিছুই নেই এটার সুস্পষ্ট বর্ণনার আগেই আমরা তা লিপিবদ্ধ করেছি।

দেখুন, শারহুল উছুল মিন ইলমিল উছুল ১১৯ পৃ:।

[10]. অর্থাৎ কুরআন ও হাদীছে যখন ছ্বলাত শব্দ আসবে, তখন এর দ্বারা শারঈ ছ্বলাতই উদ্দেশ্য নেয়া হবে। যদি এ অর্থ উদ্দেশ্য নিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে। যেমন: জানাযার ছ্বলাত, ইসতিস্কার ছ্বলাত প্রভৃতি।

الأمر আমর এর সংজ্ঞা:

الأمر قول يتضمن طلب الفعل على سبيل الاستعلاء

নির্দেশ দাতা নিজেকে উর্দ্ধতন মনে করে কোন কাজ সম্পন্ন করার দাবীকে অন্তর্ভূক্ত করে এমন বক্তব্যই হচ্ছে الأمر (নির্দেশ)।

সংজ্ঞা বিশ্লেষণ:

আমাদের ভাষ্য: قول(বক্তব্য) শব্দটির মাধ্যমে ইশারা-ইঙ্গিত সূচক শব্দ বিলুপ্ত হয়েছে। তাই ইশারা দ্বারা কোন নির্দেশ করা হলেও তা أمر হিসাবে গণ্য হবে না। আর طلب الفعل (কোন কাজ সম্পন্ন করার দাবী) এ অংশ দ্বারা نهي নিষেধ সূচক শব্দ বিলুপ্ত হয়েছে। কেননা, نهي নিষেধ সূচক শব্দের মাধ্যমে কাজ না করা দাবী পেশ করা হয়। আর الفعل (কোন কাজ সম্পন্ন করা) এ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্যে হলো কাজটির অস্তিত্ব প্রদান করা। তাই ‘আদিষ্ট কথা’ এর অন্তর্ভূক্ত হবে। সংজ্ঞায় على سبيل الاستعلاء (নিজেকে উর্দ্ধতন মনে করে) এ অংশটুকুর মাধ্যমে التماس (সহপাঠী ও সমবয়সীদের পারস্পারিক চাওয়া), দু‘আ প্রভৃতি অর্থ যা أمر (নির্দেশ সূচক) শব্দে ‘ইঙ্গিত সূচক’ শব্দের মাধ্যমে পাওয়া যায় তা أمر হতে বিলুপ্ত হয়েছে।[1]

[1]. বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠীদের কাছে কোন জিনিস চাওয়া। যেমন: আমাকে একটি কলম দাও। দু‘আর সময় চাওয়া। যেমন: হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করো। যেহেতু এসব শব্দ ব্যবহার করতঃ বক্তা নিজেকে উর্দ্ধতন মনে করে না। তাই এসব আমরের ছীগায় চাওয়া অর্থ থাকলেও তা আমর হিসাবে গণ্য হবে না।

আমরের শব্দরূপ চারটি। যেমন:

১.فعل الأمر বা নির্দেশ জ্ঞাপক ক্রিয়া। যেমন: আল্লাহর বাণী:

اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ

অর্থাৎ তুমি তিলাওয়াত করো কিতাব হতে যা তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে (সূরা আল-আনকাবূত ২৯:৪৫)।

(ক্রিয়ার অর্থ জ্ঞাপক ইসম বা বিশেষ্য)।

২. اسم فعل الأمر যেমন: حي على الصلاة (ছ্বালাতের জন্য আসো।)

৩. المصدر النائب عن فعل الأمر (নির্দেশ জ্ঞাপক ক্রিয়া পদের স্থলাভিষিক্ত মাছদার বা ক্রিয়ামূল)। যেমন:

فَإِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَاب

যখন তোমরা কাফিরদের সাথে যুদ্ধে মোকাবিলা করো তখন তাদের ঘাড়ে আঘাত করো (সূরা মুহাম্মাদ:৪৭:৪)।

৪. المضارع المقرون بلام الأمر (নির্দেশ জ্ঞাপক লাম যুক্ত ফেলে মুদ্বারে-ভবিষ্যৎকালীন ক্রিয়া)। যেমন: لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ

যেন তোমরা আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান আনো (সূরা আল-মুজাদালাহ ৫৮:৪)।

কোন কোন সময় আমরের ছীগাহ ছাড়াও طلب الفعل বা ক্রিয়া সম্পন্ন করার দাবি পাওয়া যায়। যেমন: কোন কাজকে এরূপ বিশেষিত করা যে, এটা ফরয অথবা ওয়াজীব অথবা মানদূব অথবা তা আনুগত্য মূলক কাজ অথবা কোন কাজের কর্তাকে প্রশংসা করা অথবা কাজ বর্জনকারীকে নিন্দা করা অথবা কোন কাজের ছাওয়াব ধার্য হওয়া অথবা কোন কাজ পরিত্যাগকরীর শাস্তি ধার্য হওয়া।[1]

ما تقتضيه صيغة الأمر নির্দেশ জ্ঞাপক ছীগাহ-শব্দের চাহিদা: সাধারণত নির্দেশ জ্ঞাপক ছীগাহ আদিষ্ট বিষয় ওয়াজিব হওয়া এবং তা তৎক্ষণাৎ পালিত হওয়ার চাহিদা প্রকাশ করে। আমর এর ছীগাহ ওয়াজিব হওয়ার দলীল: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

যারা তার আদেশের বিরূদ্ধাচারণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে (সূরা আন-নূর ২৪ : ৬৩)।

অত্র আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণের কারণ হলো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশের বিরূদ্ধাচারণকারীদের সতর্ক করে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, তারা ফিতনায় নিপতিত হবে। আর ফিতনা হলো সত্যপথ হতে বিচ্যুত হওয়া। অথবা তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে। কেবল ওয়াজিব বর্জনের কারণে এরূপ হুশিয়ারী দেয়া হয়। তাই প্রমাণিত হয় যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ পালন ওয়াজিবের চাহিদা প্রকাশ করে।

أمر নির্দেশ জ্ঞাপক ক্রিয়া তৎক্ষণাৎ পালনের চাহিদা প্রকাশ করে এ প্রসঙ্গে দলীল হলো, আল্লাহর বাণী:

فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ

তোমরা সৎকাজে প্রতিযোগিতা মূলক এগিয়ে যাও (সূরা আল-বাক্বারা ২:১৪৮)।

শারঈ নির্দেশিত সকল বিষয় কল্যাণকর। তাই কল্যাণের কাজে প্রতিযোগিতা করার নির্দেশ তাৎক্ষণিকভাবে পালন করা ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত হয়। এ ব্যাপারে আরো দলীল হলো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ার দিন কুরবানীর পশু যবেহ করা ও মাথা মুন্ডন করার জন্য ছাহাবীদেরকে নির্দেশ দেন। কিন্তু তা পালনে ছাহাবীদের বিলম্ব করাকে তিনি অছন্দ করেন। এ কারণে যে কষ্ট তিনি পেয়েছিলেন তা উম্মে সালমার নিকট ব্যক্ত করেন। তাই বুঝা যায়, তাৎক্ষণিক আদেশ পালন অধিক সতর্কতা ও দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য অধিকতর সহায়ক। তা ছাড়া বিলম্বে নির্দেশ পালনে অনেক সমস্যা রয়েছে। (উদাহরণ স্বরূপ তাৎক্ষণিক নিদের্শ পালন না করায়) অনেক ওয়াজিব বিষয় একত্রিত হয়, ফলে একপর্যায়ে তা পালনে ব্যক্তি অÿমতা প্রকাশ করে। আমর কোন কোন ক্ষেত্রে ভিন্ন দলীলের দাবির প্রেক্ষিতে ওয়াজিব ও তৎক্ষণাৎ পালনের চাহিদা থেকে অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। তন্মধ্যে অন্যতম হলো:

الندب أمر (পালন করা বাঞ্ছনীয়) এমন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন আল্লাহর বাণী:

وَأَشْهِدُوا إِذَا تَبَايَعْتُمْ

তোমরা ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সাক্ষী রাখো (সূরা আল-বাক্বারা ২:২৮২)।

পাস্পারিক ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সাক্ষী রাখার নির্দেশটি মানদূবের জন্য প্রযোজ্য। (ওয়াজিবের জন্য নয়)। দলীল হলো:

أن النبي صلّى الله عليه وسلّم اشترى فرساً من أعرابي ولم يشهد

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বেদূইন ব্যক্তির নিকট থেকে একটি ঘোড়া ক্রয় করেন। কিন্তু কোন সাক্ষী রাখেননি।[2]

২. الإطاحة বৈধতা অর্থে ব্যবহৃত হওয়া। কোন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার পর أمر ব্যবহৃত হলে অধিকাংশ সময় তা পালন করা বৈধ অথবা কোন বিষয় নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি হলেأمر এ অর্থে ওয়াজিব হয়। নিষেধাজ্ঞার পর أمر ব্যবহৃত হওয়ার উদাহরণ: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوا

যখন তোমরা ইহরাম থেকে হালাল হবে তখন শিকার করো (সূরা আল-মায়িদা ৫:২)।

এখানে প্রাণী শিকার করার নির্দেশটি বৈধতা ঘোষণা করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা, এ নির্দেশ আল্লাহর বাণীতে প্রাপ্ত নিষেধাজ্ঞার পর এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنْتُمْ حُرُمٌ

ইহরাম অবস্থায় শিকার করা হালাল মনে করো না (সূরা আল-মায়িদা ৫:১)।

নিষিদ্ধ হওয়ার সংশয়ের পর أمرব্যবহৃত হওয়ার উদাহরণ হলো, বিদায় হজের সময় ইদের দিন পালনীয় কিছু কর্ম আগে-পরে পালন করা সম্পর্কে যারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রশ্ন করেছিল তাদের জবাবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

افعل ولا حرج

পালন করো কোন সমস্যা নেই।[3]

৩. التهديد ধমক অর্থে। যেমন আল্লাহর বাণীঃ

اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

তোমরা যা ইচ্ছা করো, নিশ্চয় তিনি দেখেন তোমরা যা করো (সূরা হা-মীম সাজদাহ ৪১:৪০)।

তিনি আরো বলেন,

إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَار

আমি জালিমদের জন্য অগ্নি প্রস্ত্তত রেখেছি (সূরা আল-কাহাফ ১৮:২৯)।

উক্ত নির্দেশের পর শাস্তি প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ করার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, নির্দেশটি ধমক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তৎক্ষণাৎ পালন করা অর্থ ব্যতীরেকে বিলম্বে পালন করা অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার উদাহরণ: রমাদ্বানের ক্বাযা ছিয়াম পালন করা আদিষ্ট বিষয়। কিন্ত দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে বুঝা যায়, তা তাৎক্ষণিক পালন করা আবশ্যক নয় বরং বিলম্বে পালনীয়। যেমন: আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

عن عائشة رضي الله عنها قالت: كان يكون عليّ الصوم من رمضان فما أستطيع أن أقضيه إلا في شعبان، وذلك لمكان رسول الله صلّى الله عليه وسلّم

আমার রমাদ্বান মাসের ছিয়াম অবশিষ্ট থেকে যেতো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খিদমাতে ব্যস্ত থাকার কারণে শা‘বান মাস ছাড়া অন্য সময়ে আমি তা আদায় করার সুযোগ পেতাম না।[4]

যদি নির্দেশটি বিলম্বে পালন করা হারাম হতো, তাহলে আয়িশা (রা.) কে তা পালন করার উপর বহাল থাকতে দেয়া হতো না।

ما لا يتم المأمور إلا به

যা ছাড়া নির্দেশিত কাজ সম্পন্ন হয় না।

নির্দেশিত কাজ সম্পন্ন করার বিষয়টি কোন জিনিসের উপর নির্ভর করলে তখন ঐ জিনিসটিও নির্দেশিত হিসাবে গণ্য হয়। তাই নির্দেশিত বিষয়টি ওয়াজীব হলে ঐ জিনিসটিও ওয়াজীব হয়ে যায়, কাজটি মানদূব (বাঞ্ছনীয়) হলে ঐ জিনিসও মানদূব (বাঞ্ছনীয়) হয়ে যায়।

ওয়াজীবের উদাহরণ: গোপ্তাঙ্গ ঢেকে রাখা ওয়াজীব। যেহেতু গোপ্তাঙ্গ ঢেকে রাখা কাপড় ক্রয় করার উপর নির্ভর করে তাই কাপড় ক্রয় করা ওয়াজীব হয়ে যায়।

মানদূবের উদাহরণ: জু‘আর দিন সুগন্ধি ব্যবহার করা মানদূব (বাঞ্ছনীয়)। যেহেতু সুগন্ধি দেয়া তা ক্রয় করার উপর নির্ভর করে তাই সুগন্ধি-প্রসাধনি ক্রয় করা মানদূব (বাঞ্ছনীয়) হিসাবে গণ্য। এ নিয়মটি একটি ব্যাপক মূলনীতির অন্তর্গত। আর তা হলো,

الوسائل لها أحكام المقاصد، فوسائل المأمورات مأمور بها، ووسائل المنهيات منهي عنها

কোন বিষয়ে উদ্দেশ্যে এর হুকুম ‘উপকরণের’ হুকুম হিসাবে গণ্য হবে। তাই আদিষ্ট বিষয়ের উপকরণ আদিষ্ট বলেই গণ্য এবং নিষিদ্ধ বিষয়ের উপকরণ নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।

[1]. কোন বিষয়কে ফরয হিসাবে বিশেষিত করার উদাহরণ হলো: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী:

فأعلمهم أن الله قد فرض عليهم خمس صلوات في كل يوم وليلة

তুমি তাদেরকে জানিয়ে দিবে যে, আল্লাহ তাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত ছ্বলাত ফরয করেছেন।

ছহীহ বুখারী হা/১৩৩২, ছহীহ মুসলিম হা/১৯। ওয়াজীব এর উদাহরণ:

غسل الجمعة واجب على كل محتلم

জুমু‘আর দিন গোসল করা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির উপর ওয়াজীব। ছহীহ বুখারী হা/ ৮২০, ছহীহ মুসলিম হা/৮৪৬।

কোন কর্ম আনুগত্য হিসাবে বিশেষিত করার উদাহরণ: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী:

من أطاع أميري فقد أطاعني

যে কেউ আমার আমীরের আনুগত্য করলো, সে যেন আমারই আনুগত্য করলো। আবূ দাউদ হা/ ২৫৫৪।

কোন কর্মের কর্তাকে প্রশংসা করার উদাহরণ: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী:

نعم الرجل عبد الله لو كان يقوم من الليل

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ কতই না উত্তম লোক! যদি সে রাতে তাহাজ্জুদের ছ্বলাত আদায় করতো। বায়হাক্বী হা/১১২।

কোন কাজ বর্জন করার কারণে নিন্দা করার উদাহরণ হলো:

من ترك الرمي بعدما علمه رغبة عنه، فإنها نعمة كفرها

তীর নিক্ষেপ শিক্ষা করার পর যে অজ্ঞতা বশতঃ তা ছেড়ে দিলো, সে মূলত একটি নি‘আমতের সাথে কুফরী করলো। জামে ছহীহ লি-সুনান হা/৬১৪২ ।

কোন কর্মের উপর ছাওয়াব ধার্য হওয়ার উদাহরণ হলো:

من صلى علي صلاة صلى الله عليه بت عشرا

যে আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তার উপর দশবার দয়া করেন।

ছহীহ মুসলিম হা/৩৮৪, আবূ দাউদ ৫২৩।

কোন কাজ বর্জন করার কারণে শাস্তি ধার্য হওয়ার উদাহরণ: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

من ترك ثلاث جمع تهاونا طبع الله على قلبه

যে কেউ অবহেলা করে পরপর তিন জুমু‘আ ছেড়ে দিবে আল্লাহ তার অন্তরে মহর মেরে দিবেন।

আবূ দাউদ হা/১০৫২, নাসাঈ হা/১৩৫৯।

সুতরাং দেখা যায়, আমরের চার ছীগাহ ও আনুষঙ্গিকসহ মোট ১২ ভাবে আমর হতে পারে।

[2].আবূ দাউদ হা/৩৬০৭, নাসাঈ হা/৬২৪৩।

[3]. বুখারী হা/৮৩, মুসলিম হা/১৩০৬।

[4]. ছহীহ বুখারী ১৯৫০, ছহীহ মুসলিম ১১৪৬।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪৬ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 পরের পাতা »