মানহাজ (আল-আজবিবাতুল মুফীদাহ) শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান ১২০ টি
মানহাজ (আল-আজবিবাতুল মুফীদাহ) শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান ১২০ টি

সকল প্রশংসা আল্লাহর। আমরা তার প্রশংসা করছি। তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি। তার নিকটই ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আমাদের আত্মিক অনিষ্ট ও কর্মসমূহের অমঙ্গল থেকে আশ্রয় কামনা করছি। আল্লাহ তা‘আলা যাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন, কেউ তাকে বিপথগামী করতে পারে না। আর আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন, কেউই তাকে সঠিকপথ প্রদর্শন করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ‘ইলাহ’ নেই। তিনি একক। তার কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বান্দা ও রসূল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,


{ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلا تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ }

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যথাযথ ভয়। আর তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না (সূরা আলে ইমরান ৩:১০২)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,


{ يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالاً كَثِيراً وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيباً }

হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো। যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক আত্মা থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে (জনম বিস্তারের মাধ্যমে) ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের নিকট চাও। আর ভয় করো রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়তার ব্যাপারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক রূপে রয়েছেন (সূরা আন নিসা ৪:১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

{ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلاً سَدِيداً - يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزاً عَظِيماً }

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। এবং তোমরা সঠিক কথা বল। (তাহলে) তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজগুলোকে শুদ্ধ করে দেবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই এক মহা সাফল্য অর্জন করলো (সূরা আল আহযাব ৩৩:৭০-৭১)।
পরকথা হলো, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। যিনি প্রত্যেক রসূলের মৃত্যুর পর এমন কিছু আলিম তৈরি করেছেন; যারা মানুষদেরকে পথভ্রষ্টতা বর্জন করে হিদায়াতের পথে আহবান করেন। যারা তাদের (স্ব স্ব উম্মাতের পক্ষ থেকে) প্রদত্ত কষ্টে ধৈর্য ধারণ করেন, যারা কুরআন দ্বারা মৃতকে তথা ইসলাম থেকে বিমুখ ব্যক্তিদেরকে পুনরুজ্জীবিত করেন, যারা অন্ধদেরকে আল্লাহর আলো দ্বারা দৃষ্টিবান করেন। তারা কতই না শয়তান কর্তৃক আক্রান্ত ব্যক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করলেন, কতই না বিপথগামী বিভ্রান্তকে সুপথের দিশা দিলেন! জনসাধারণের সাথে তাদের আচরণ কতই না সুন্দর ছিল! কিন্তু তাদের সাথে জনসাধারণের আচরণ ছিল কতই না খারাপ! তারা আল্লাহর কিতাব কুরআনুল কারীমকে বাড়াবাড়িকারীদের বাড়াবাড়ি, পরিবর্তনকারীদের পরিবর্তন ও অপব্যাখ্যা কারীদের অপব্যাখ্যা থেকে মুক্ত করেন।
আমরা আশা করি যে, আমাদের সম্মানিত শায়েখ সলিহ ইবনে ফাওযান ইবনে আব্দুল্লাহ আল ফাওযান হাফিযাহুল্লাহও (আল্লাহ তাকে হিফাযত করুন) তাদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।


বর্তমান যুগে বিভিন্ন ঈমান বিধ্বংসী মতবাদ ঢেউয়ের মতো পরস্পর আছড়ে পড়ছে। বিদআত, ফিতনা ও গোমরাহির প্রতি আহবানকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে সন্দেহ-সংশয়বাদীদের সংখ্যা, প্রকাশ পাচ্ছে এমন কিছু বই ও পত্রিকা-যেগুলো সুন্নাহর আবরণে শিক্ষার্থীদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে। আর সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তাদের ধোঁকার ব্যাপকতা সম্পর্কে কিই বা বলব!
এমতাবস্থায় সম্মানিত শায়েখ ছাত্রদেরকে সুন্নাহর আলোকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা পেশ করেছেন। সুন্নাহর বিভিন্ন ব্যাখ্যাকে সুস্পষ্ট করেছেন। সংশয় নিরসন করেছেন। আর সালাফে সালেহীনের কর্মপদ্ধতির সাথে দ্বিমত পোষণকারী বিভিন্ন বিধ্বংসী পথের আহবায়ক ও কুরআন-সুন্নাহ বিদ্বেষীদের মতামতকে ১৪১৩ হিজরীতে তায়েফ শহরের গ্রীষ্মকালীন বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রে দরস, বক্তৃতা ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বিশুদ্ধ দলীল প্রমাণ ও সুস্পষ্ট বর্ণনা দ্বারা খণ্ডন করেছেন।


আমি প্রথমে সেগুলোর রেকর্ড ধারণ করেছি। অতঃপর কিছু ভাইয়ের সাহায্যে সেগুলোকে বিন্যস্ত করেছি। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। এরপর আয়াত-হাদীছ সমূহের তথ্যসূত্র ও প্রয়োজনীয় স্থানে টীকা-টিপ্পনি সংযোজন করেছি।
আল্লাহর কিতাব ও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর দলীল ভিত্তিক ও সালাফে সালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শারঈ জ্ঞান প্রচার-প্রসার করে সুন্নাহর খিদমত করার জন্যই এ কিতাব প্রকাশে আগ্রহী হয়েছি।


সংকলন শেষ করার পর সম্মানিত শায়েখ সলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান (আল্লাহ তাকে হিফাযতে রাখুন এবং আমাদেরকে তার ইলম দ্বারা উপকৃত করুন) এ সমীপে পেশ করেছি। তিনি দেখেছেন ও কিছু সংযোজন-বিয়োজন করেছেন। এরপর এর উপকারিতা যেন ব্যাপকতা লাভ করে সেজন্য তিনি আমাকে লিখিত অনুমতি প্রদান করেছেন। সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য, যিনি তাওফীক দান করেছেন।
আল্লাহর সাহায্যে, এই ছিল সালাফদের দাওয়াত প্রচারে আগ্রহী এ অধমের  প্রচেষ্টা। ইচ্ছের পেছনে মূল শক্তির যোগান দিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা। আল্লাহ তা‘আলা নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার পরিবার-পরিজন ও সাথীবর্গের উপর শান্তি বর্ষণ করুন।


আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থী বান্দা
আবূ ফুরাইহান জামাল ইবনে ফুরাইহান আল হুমায়লী আল হারিসী
সোমবার, ৬ই রবিউল আওয়াল ১৪১৪ হি.।
তায়েফ।

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তার প্রশংসা করি। তার সাহায্য কামনা করি। তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। এবং আমাদের আত্মিক অনিষ্ট ও কর্মসমূহের অমঙ্গল হতে আশ্রয় কামনা করি। আল্লাহ তা‘আলা যাকে সঠিক পথের দিশা দেন কেউ তাকে বিপথগামী করতে পারে না। আর আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন কেউই তাকে সঠিকপথ প্রদর্শন করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই। তিনি একক। তার কোনো শরীক নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বান্দা ও রসূল।

অতঃপর- গবেষকগণ মুসলিমদের অবস্থা নিয়ে অত্যন্ত আশ্চর্যবোধ করেন যে, মূর্খ, প্রতারিত-প্রতারক, পথভ্রষ্ট, প্রবৃত্তি পূজারী, আত্মপ্রকাশকারী, জ্ঞানী দাবিদার এবং আমলকারী আলিম, হিদায়াতপ্রাপ্ত অনুসারী, সুপথের অনুসন্ধানকারী, সুন্নাতের সাহায্যকারী, যাদের মাঝে কতই না মতপার্থক্য ও দলাদলি বিদ্যমান। এ ব্যাপারে সত্যবাদী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যথার্থই সত্য বলেছেন। তিনি বলেন,

مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيَرَى اخْتِلاَفاً كَثِيْراً..

তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ঐ সময় বেঁচে থাকবে সে অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে।[1]

কিন্তু এ বোকামি ও পরস্পর মারামারি থেকে উত্তরণের উপায় কী?

নিঃসন্দেহে আল্লাহর কিতাব ও তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ আঁকড়ে ধরাই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ مِنْ بَعْدِيْ

তোমাদের উপর আমার সুন্নাহ ও আমার পরে সুপথপ্রাপ্ত খলীফাদের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা অত্যাবশ্যক।[2]

 

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,

تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمِا كِتِابَ اللهِ وَسُنَّتِيْ

তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে গেলাম। যতদিন তোমরা সে দুটোকে আঁকড়ে ধরে থাকবে ততদিন বিপথগামী হবে না। তা হচ্ছে- আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং আমার সুন্নাহ (হাদীছ)।[3]

যখনই অধিকাংশ মানুষ এ দুটোকে গুরুত্ব দেয়া ও আঁকড়ে ধরা ছেড়ে দিয়ে প্রবৃত্তি ও যুক্তিকে ওহীর উপর প্রাধান্য দিয়েছে এবং আবেগের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে; তখুনি প্রবৃত্তি তাদেরকে নীচে নামিয়ে দিয়েছে। তাদের পা পিছলে গিয়েছে। ফলে তারা ফিতনায় পতিত হয়েছে। আর এ রশিদ্বয় তথা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহকে ধারণকারীগণ -যারা মাড়ির দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে তারাই সালাফে সালেহীনের পদ্ধতির উপর সুপথপ্রাপ্ত। তারাই হলেন ‘আল ফিরকা আন নাজিয়াহ’ (মুক্তিপ্রাপ্ত দল), ‘আত ত্বয়িফাহ আল মানসূরাহ’ (সাহায্যপ্রাপ্ত দল) এবং ‘আল জামাত’। যদিও তারা ছাগলের রাখালই হোক না কেন।

তাদের ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِّنْ أُمَّتِيْ عَلىَ الْحَقِّ ظَاهِرِيْنَ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ وَلَا مَنْ خَالَفَهُمْ.

আমার উম্মাহর একটি দল হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে তাদের থেকে যারা বিচ্ছিন্ন থাকবে এবং যারা বিরোধিতা করবে তারা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না।[4]

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মতপার্থক্য বিষয়ক হাদীছে বলেন,

ستفترق أمتي على ثلاث وسبعين فرقة كلها في النار إلا واحدة

‘অচিরেই আমার উম্মাহ ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। একটা দল ব্যতিরেকে তাদের  সকল দলই জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।[5]

قلنا من هي قال : ( الجماعة )، وقال : من كان على مثل ما أنا عليه اليوم وأصحابي

(ছাহাবায়ে কিরাম বলেন) আমরা বললাম, সে দল কোনটি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, (সে দলটি হলো) আল জামাত। তিনি আরো বললেন, আমি এবং আমার ছাহাবীরা যার উপর প্রতিষ্ঠিত আছি এর উপর যারা প্রতিষ্ঠিত থাকবে।[6]

সুতরাং সকল মুসলিমের উপর বিশেষত যুবকদের উপর -যারা পরকালীন মুক্তিকামনা করে, আর দুনিয়াতে সুখে থাকতে চায়- তাদের জন্য ওয়াজিব হলো ফিতনার স্থানসমূহ থেকে সতর্ক থাকা, নিরাপদ দূরতেব অবস্থান করা, যাতে তারা ফিতনায় নিমজ্জিত না হয়। যদি তা না করে তবে তারা ফিতনায় নিমজ্জিত হবে।

আর পথভ্রষ্ট দাঈদের থেকে পূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে। যারা সুন্নাহর লিবাস পরিধান করে, সুন্নাহর নামে কথা বলে। অথচ তারা সুন্নাহ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। কেননা হয় তারা শত্রুদের স্বার্থে কাজ করে নতুবা সুন্নাহর মর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ।

আর আমাদের ধারণা দ্বিতীয় বিষয়টিই তথা তাদের সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আলিমদের নিকট থেকে সরাসরি জ্ঞানার্জন করেনি। আর এটাই যখন তাদের অবস্থা তখন কীভাবে তাদেরকে অনুসরণ করা যাবে? কীভাবেই বা তাদের উপর নির্ভর করা যাবে? আমরা কীভাবেই বা তাদের থেকে ইলম, ফাতওয়া ও দিক নির্দেশনা গ্রহণ করতে পারি? দুর্বলের দ্বারা শুধু দুর্বলতাই বৃদ্ধি পায়।

কুরআন-সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণ ছাড়া সঠিক পথের উপর অটল থাকা সম্ভব নয়। আর তা অর্জিত হয় ইলম অন্বেষণ, আলিমদের সংস্পর্শে থাকা, সঠিক পথের দিক-নির্দেশক পূর্ববর্তী আলিমদের বই-পুস্তক অধ্যয়ন, আর তাদের উপকারী ইলম অর্জনে প্রচেষ্টা চালানো, গ্রহণযোগ্য আলিমগণের মত গ্রহণ করা, অপ্রয়োজনীয় বিষয়াবলী বর্জন করা, প্রবৃত্তিপূজারী ও বিদাতীদের কথা ও মত থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে।

কেননা প্রবৃত্তিপূজারীরা উম্মাহর জন্য বিপজ্জনক। তারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আহলে বাইতের নাম উল্লেখ পূর্বক আলোচনা করে। আর এই সুন্দর আলোচনা দ্বারা মূর্খ লোকদের প্রতারিত করে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। ঐ সকল প্রবৃত্তিপূজারীদের উদাহরণ হলো মধুর নামে গাছের তিক্ত রস পরিবেশনকারীর মতো, যা সে কখনো কখনো প্রাণনাশক বিষকে প্রতিষেধক হিসাবে পান করায়।

তুমি তাদের ব্যাপারে (সতর্কতামূলক) লক্ষ্য রাখবে। যদিও তুমি পানির সাগরে জনম গ্রহণ করোনি। কিন্তু তুমি প্রবৃত্তির সাগরে জনম গ্রহণ করেছ যা পানির সাগরের থেকেও অধিক গভীর ও অধিক বিশৃঙখল, অধিক গর্জনকারী ও কূল কিনারাহীন।

তোমার এই বিভ্রান্তিপূর্ণ পথ অতিক্রম করার একমাত্র বাহন হলো সুন্নাহর অনুসরণ করা। সুন্নাতের অনুসরণরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা প্রত্যেক মুসলিমের নিকট মর্যাদা ও সম্মানের বিষয়। আমাদের একাকিত্ব, ভাইদের ইমিত্মকাল, সাহায্য কম হওয়া, বিদআত প্রকাশ পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আল্লাহর নিকটই অভিযোগ পেশ করবো। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আলিমদের মৃত্যুতে এবং বিদআত প্রকাশিত হওয়ায় এ উম্মাহ কতই না মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়েছে! তবে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথায় আমাদের জন্য সান্তবনা রয়েছে।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لا تزال طائفة من أمتي على الحق ظاهرين

আমার উম্মাহর একটি দল হকের উপর সর্বদাই প্রতিষ্ঠিত থাকবে।[7]

পর সমাচার হলো,

এটা ‘আল আজউইবাতুল মুফীদাহ আন আসইলাতিল মানাহিজিল জাদীদাহ’ নামক গ্রন্থের নতুন মোড়কে সজ্জিত তৃতীয় সংস্করণ। যা ১ম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার দীর্ঘদিন পর প্রকাশ পেল। ইতোমধ্যে অনেক নিত্য নতুন ঘটনা ঘটেছে। অনেকেরই পদস্খলন ঘটেছে। অনেকেরই চিন্তা-চেতনা পরিবর্তিত হয়েছে। সুতরাং এমতাবস্থায় উল্লেখিত ঘটনার ব্যাপারে অভিজ্ঞ আলিমদের মত ও তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে জানা শরীরের জন্য খাবার ও পানীয় গ্রহণের চেয়েও বেশি প্রয়োজন। কেননা শারীরিক রোগ আর অন্তরের রোগ সমান নয়। অন্তরে রোগ প্রবেশ করলে যদি তা বের করে ফেলার মতো কেউ না থাকে তাহলে তা ব্যক্তির দুনিয়া এবং আখিরাত সবই নষ্ট করে দেয়।

আল্লাহর নিকট দু‘আ করি তিনি যেন আমাদেরকে সত্য সঠিক পথ প্রদান করেন। আর আমাদের শায়েখকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করেন। দরূদ ও শান্তিধারা বর্ষিত হোক আমাদের নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার পরিবার ও ছাহাবীগণের উপর।


আবূ ফুরাইহান জামাল ইবনে ফুরাইহান আল হুমায়লী আল হারিসী

১৩ ই শাবান, ১৪২৩ হি., শনিবার ফজরের পর।

[1]. সহীহ: সুনানে ইবনে মাজাহ হা/৪৩, সুনানুল কুবরা বাইহাকী হা/২০৩৩৮, মুসনাদে আহমাদ।

[2]. সহীহ: সুনানে আবু দাউদ হা/৪৬০৭।

[3]. সহীহ: মুস্তাদরাক হাকীম হা/৩১৯, সুনানুল ক্বুবরা বাইহাকী হা/২০১২৪, সহীহ জামি হা/৩২৩২, ২৯৩৭।

[4]. সহীহ: মুসলিম হা/১৯২০

[5]. হাকিম ০১/১২৯

[6]. হাসান: তিরমিযি হা/২৬৪১

[7]. সহীহ: সুনানে তিরমিযী হা/২২২৯
এই পুস্তিকার ৩য় সংস্করণ প্রকাশের ব্যাপারে শায়খের অনুমতি

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। অতঃপর আমি শায়েখ জামাল ইবনে ফুরাইহান আল হারিসীকে ‘আল আজউইবাতুল মুফীদাহ আন আসইলাতিল মানাহিজিল জাদীদাহ’ বইটি পুনঃমুদ্রণের অনুমতি প্রদান করলাম। এ বইটি মূলতঃ বিভিন্ন শ্রেণিতে ছাত্রদের প্রশ্নের সমাধানে আমার প্রদেয় জবাবের সংকলন।
আমি তার অপূর্ব সংযোজন ও টীকা টিপ্পনীসহ পুনঃপ্রকাশের অনুমতি প্রদান করেছি।
আল্লাহ তা‘আলা সবাইকে সত্য জেনে তদনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। আল্লাহর রহমত ও শান্তিধারা বর্ষিত হোক আমাদের নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার পরিবারবর্গ ও ছাহাবীগণের উপর।

ড. সলিহ ইবনে ফাওযান ইবনে আব্দুল্লাহ আল ফাওযান
২৩ জিলহজব ১৪২৩ হিজরী

শায়েখ ড. সলিহ ইবনে ফাওযান ইবনে আব্দুল্লাহ আল ফাওযান হাফিযাহুল্লাহ আল কাসীম অঞ্চলের বুরায়দাহ শহরের নিকটবর্তী শামাসীয়ার অধিবাসী। তিনি ১লা রজব ১৩৫৪ হিজরী মোতাবেক ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালেই তার পিতা ইনতিকাল করেন। অতঃপর তিনি ইয়াতীম অবস্থায় স্বীয় পরিবারে প্রতিপালিত হন। শহরের মাসজিদের ইমামের নিকট তিনি কুরআনুল কারীম, কিরাআতের মূলনীতি এবং লেখা শিখেন।

১৩৬৯ হিজরীতে শামাসীয়ায় সরকারী মাদরাসা চালু করা হলে তিনি সেখানে ভর্তি হন। অতঃপর ১৩৭১ হিজরী সালে বুরায়দা শহরস্থ ফয়সালিয়া ইবতেদায়ী মাদরাসা হতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর ১৩৭৩ হিজরী সালে বুরায়দায় ইসলামিক ইন্সটিটিউট খোলা হলে তিনি সেখানে ভর্তি হন। ১৩৭৩ হিজরী সালে এখান থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে রিয়াদ শহরস্থ কুল্লিয়া শারঈয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৩৮১ হিজরী সালে শিক্ষা সমাপনী ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর তিনি একই প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামী ফিকহের উপর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন এবং একই বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন

শারঈয়াহ কলেজে ভর্তি হওয়ার পূর্বে ১৩৭২ হিজরীতে ইবতেদায়ী মাদরাসায় শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। শারঈয়া কলেজ থেকে ডিগ্রি অর্জন করার পর তিনি রিয়াদস্থ ইসলামিক ইন্সটিটিউটে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পরে তাকে শারঈয়াহ কলেজের শিক্ষক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। অতঃপর তাকে ইসলামী আক্বীদা বিভাগের উচ্চতর শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে তাকে বিচার বিষয়ক উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। অতঃপর তাকে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের মেয়াদ শেষে পুনরায় শিক্ষকতা পেশায় ফিরে আসেন।

পরে তাকে ইসলামী গবেষণা ও ফতোয়া বিভাগের স্থায়ী কমিটির সদস্য নিয়োগ করা হয়। তিনি আরো যেসব সরকারী দায়িত্ব পালন করেন, তার মধ্যে هَيْئَةُ كِبَارِ الْعُلَمَاءِ এর সদস্য। মক্কা মুকার্রামায় অবস্থিত রাবেতার পরিচালনাধীন ইসলামী ফিকহ একাডেমির সদস্য, ইসলামী গবেষণা ও ফাতওয়া বিভাগের স্থায়ী কমিটির সদস্য। হাজ্জ মওসুমে দাঈদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সদস্য।

রিয়াদ শহরের মালায এলাকার আমীর মুতইব ইবনে আব্দুল আযীয আল-সউদ জামে মাসজিদের ইমাম, খতীব ও শিক্ষক।

তিনি সৌদি আরব রেডিওতে نُوْرٌ عَلَى الدَّرْب নামক প্রোগ্রামে শ্রোতাদের প্রশ্নের নিয়মিত উত্তর প্রদান করেন। এ ছাড়াও তিনি পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, গবেষণা, অধ্যয়ন, পুস্তিকা রচনা, ফতোয়া প্রদান করাসহ বিভিন্নভাবে ইলম চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। এগুলো একত্র করে কতিপয় পুস্তকও রচনা করা হয়েছে। তিনি মাস্টার্স ও ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনার্থী অনেক ছাত্রের গবেষণা কর্মে তত্ত্বাবধান করেন।

শায়েখের উস্তাদবৃন্দ

শায়েখ হাফিযাহুল্লাহ অনেক আলিম ও বিচারকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। তন্মধ্যে-

(১) শায়েখ আব্দুল্লাহ ইবনে বায (রহ.) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইবনে বায (রহ.) শায়েখকে বিশেষ সম্মান করতেন। পুনঃনিরীক্ষণের জন্য তার নিকট কিতাবাদী প্রেরণ করতেন।

(২) আব্দুল্লাহ ইবনে হুমাইদ (রহ.) বুরায়দস্থ আল মা‘হাদুল ইলমীতে অধ্যয়ন রত অবস্থায় নিয়মিত তার ক্লাসে উপস্থিত হতেন।

(৩) শায়েখ মুহাম্মাদ আল আমীন আশ-শানকীতী (রহ.)।

(৪) শায়েখ আব্দুর রায্যাক আফীফী (রহ.)।

(৫) শায়েখ হামূদ ইবনে সুলাইমান আত-তালাল হাফিযাহুল্লাহ। যিনি তার গ্রামের মসজিদের ইমাম ছিলেন। তিনি ক্বাছিম অঞ্চলের দ্বারিয়্যাহ শহরে বিচারক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন।

(৬) ইবরাহীম ইবনে দ্বাইফুল্লাহ আল-ইউসুফ শামাসিয়াহর মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন।

তার গ্রন্থসমূহ

০১. আত-তাহক্বীক্বাত আল-মারদ্বিয়াহ ফিল মাবাহিছ আল-ফারদ্বিয়াহ ফিল মাওয়ারিছ (এটি তার মাস্টার্সের থিসিস)।

০২. আহকামুল আত‘ইমাহ ফিশ-শারীআহ আল-ইসলামিয়াহ (এটি তার পি এইচ ডি থিসিস)।

০৩. শারহুল আকীদা আল-ওয়াসিত্বীয়াহ।[1]

০৪. আল-বায়ান ফিমা আখত্বআ ফিহি বা‘দ্বুল কুত্তাব (২ খণ্ড)।

০৫. মাজমু‘ মুহাদ্বারাত ফিল আকীদা ওয়া আদ-দাওয়াহ (৪ খণ্ড)।

০৬. আল-খুত্বাব আল-মিমবারিয়্যাহ ফিল মুনাসাবাত আল আছরিয়াহ (৬খণ্ড)।

০৭. মিন আ‘লাম আল-মুজাদ্দিদীন ফিল ইসলাম।

০৮. মাবাহিছু ফিক্বহিয়াহ ফি মাওয়াদ্বি‘ মুখতালিফাহ।

০৯. মাজমু‘ ফাতাওয়া ফিল আকীদা ওয়াল ফিক্বহ (৫ খণ্ড)।

১০. নাকবদু কিতাব আল-হালালি ওয়াল হারামি ফিল ইসলাম, ইউসুফ আল-ক্বারযাবীর মত খণ্ডন।

১১. আল-মুলাখ্খাস ফী শারহি কিতাব আত-তাওহিদ লিশ-শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব।

১২. ইআ‘নাহ আল মুসতাফীদ শারহু কিতাব আত-তাওহীদ (২ খণ্ড)।

১৩. আত-তা‘ক্বীব আলা মা যাকারাহু আল-খত্বীব ফী হাক্কি আশ-শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব।

১৪. আল-মুলাখখাস আল ফিক্বহ (২ খণ্ড)।

১৫. ইতহাফু আহলিল ঈমান বিদুরূসি শাহরি রামাদ্বান।

১৬. আদ্ব-দ্বিয়া উল লামিউ মাআল আহাদিছ আল কুদসিয়াহ আল-জাওয়ামি।

১৭. বায়ানু মা ইয়াফআলু আল হাজ্জু ওয়াল মু’তামির।

১৮. কিতাবু আক্বীদাতিত তাওহীদ (মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্য-তালিকাভুক্ত)।

১৯. মাজাল্লাতুত দাওয়া হতে প্রকাশিত ফাতাওয়া ও প্রবন্ধ সমগ্র।

২০. দুরূসুম মিনাল কুরআনিল কারীম।

২১. আল-আজউইবাতুল মুফীদাহ আন আসইলাতিল মানাহিজিল জাদীদাহ (যা আমাদের সামনে রয়েছে)।

এছাড়াও তার আরো গ্রন্থ রয়েছে, যা প্রকাশিতব্য।

যুবকদেরকে বাতিল মানহাজসমূহ থেকে সতর্ক করা ও সহীহ মানহাজের প্রতি দিক-নির্দেশনা প্রদানের ক্ষেত্রে তার বিশাল অবদান বিদ্যমান। তার মাধ্যমে বিদাতী ও পথভ্রষ্টরা পরাভূত হয়েছে এবং অনেক মানুষ হিদায়াত পেয়েছে। আল্লাহ তাকে আমাদের ও সকল মুসলিমের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। তার আমলসমূহ একনিষ্ঠ আমল হিসাবে কবুল করে কিয়ামাতের দিন ছাওয়াবের পাল্লায় যোগ করুন।

দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার পরিবার ও সকল সাথীবর্গের উপর।


জামাল ইবনে ফুরাইহান আল-হারিসী
শায়খের একজন ছাত্র
আল আজউইবাতুল মুফিদাহ আন আসইলাতিল মানাহিজিল জাদীদাহ
আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি।

[1]. মাকতাবাতুস সুন্নাহ কর্তৃক প্রকাশিত।
প্রশ্ন-১ : গ্রীষ্মকালীন কেন্দ্রসমূহে অংশগ্রহণকারী ভাইদের প্রতি আপনার উপদেশ কী? যখন শায়খ ও আলিমগণের ক্লাস এবং গ্রীষ্মকালীন কেন্দ্রের কোর্সের সময় পরস্পর বিরোধী হয়, তখন তারা কি ক্লাসে অংশগ্রহণ করবে নাকি কেন্দ্রসমূহে অবস্থান করবে? যুবকদের মাঝে এ বিষয় নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা হওয়ায় বিষয়টি সবিস্তারে জানাবেন

উত্তর : (গ্রীষ্মকালীন কেন্দ্রসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো) ছাত্রদেরকে জ্ঞান ও সংস্কৃতি শিক্ষা দেয়া। সুতরাং আমার মতে কেন্দ্রসমূহের পরিচালকগণ সময়কে এমনভাবে ভাগ করে নিবেন যাতে কেন্দ্রের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিদেরকে দারস ও বক্তৃতা প্রদানের জন্যে মাসজিদে নিয়ে যাওয়া যায়। কেননা দারস ও আলোচনায় অংশগ্রহণ কেন্দ্রের অন্যতম একটি কাজ। আর এর জন্য কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার চেয়ে মাসজিদে উপস্থিত হওয়া উত্তম। কেননা ইলমি (জ্ঞানসংক্রান্ত) আলোচনা শ্রবণ করার জন্য কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার চেয়ে আল্লাহর ঘরে উপস্থিত হওয়াই শ্রেয়।[1]

মোটকথা : কেন্দ্রসমূহের পরিচালকদের জন্য করণীয় হলো, তারা এমনভাবে কর্মসূচি নির্ধারণ করবেন, যাতে মাসজিদে আলোচনার/বক্তৃতার জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখবেন এবং লক্ষ্য রাখবেন যেন বক্তৃতা ও প্রোগ্রাম পরস্পর বিরোধী না হয়। কেন্দ্রসমূহের উদ্দেশ্য এমনটাই হতে হবে। যেমনটা আমরা উল্লেখ করেছি।

[1]. ইসলামের প্রাথমিক যুগে মাসজিদই ছিল জ্ঞানের উৎস এবং আলিমগণের জ্ঞান পিপাসা মিটানোর ঝরণা স্বরূপ। মাসজিদ থেকেই অনেক সুবিজ্ঞ বিদ্বান পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন। অনেক হাদীছ বিশারদ হাদীছ ও উলুমুল হাদীছে, ফিক্বাহবিদগণ ফিক্বাহ ও উসূলুল ফিকহে, তাফসিরবিদগণ তাফসীর ও উসূলুল তাফসির, ভাষাবিদগণ ইলমুন নাহু ও কলা শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন। আবার কেউ কেউ মাসজিদের আলোচনা সভা থেকেই উল্লেখিত সকল বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন। সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, জ্ঞানের জন্য গমন করতে হয়, জ্ঞান কারো নিকট আসে না। সুতরাং কেউ যেন উত্তমকে অনুত্তমের বিনিময়ে পরিবর্তন না করে।

প্রশ্ন-২ : গ্রীষ্মকালীন কেন্দ্রসমূহে অভিনয় ও সংগীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়; এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

উত্তর : ছাত্রদের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলিকে কেন্দ্রসমূহের পরিচালকদের কর্মসূচি থেকে বাদ দেয়া আবশ্যক। তাদেরকে কুরআন, সুন্নাহ/হাদীছ, ফিক্বহ এবং আরবী ভাষা শিক্ষা দিবেন। তাদের সময় ও মনোযোগ এগুলোর প্রতি নিবিষ্ট রাখবেন। এমনিভাবে দুনিয়াবী প্রয়োজনীয় বিদ্যাসমূহ যেমন গণিত, বিভিন্ন ব্যবহারিক যোগ্যতা শিক্ষা দিবেন। আর তারা যে সকল কাজকে বিনোদনমূলক কাজ বলে অভিহিত করে বস্ত্ততঃ সেগুলোকে তালিকায় রাখার কোন প্রয়োজন নেই।[1] কেননা এর দ্বারা কিছু সময় বিনা উপকারে কেটে যায়। বরং কখনো কখনো তাদেরকে এমন মত্ত রাখে যে তারা মূল উদ্দেশ্যই ভুলে যায়। বিভিন্ন মিডিয়ায় যে সকল অভিনয় ও সংগীত শেখানো ও প্রচার করা  হয় তা খেল তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।

[1]. শায়খ সলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান (রহ.) তার ‘আল-খুতাবুল মিমবারিয়্যাহ’ (১৪১১ হিজরিতে প্রকাশিত) নামক গ্রন্থের ৩নং খণ্ড-র ১৮৪ ও ১৮৫ নং পৃষ্ঠায় বলেন, ‘‘জ্ঞাতব্য : বর্তমানে অনেক দীনদার যুবকদের মাঝেও যৌথসংগীত বাজানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা এ সংগীতগুলোকে ইসলামী সংগীত বলে থাকে। বস্ততঃ এ সংগীতগুলোও গানের অন্তর্ভুক্ত। কখনো কখনো এগুলো ফিতনা সৃষ্টি করে। আওয়াজ সম্পন্ন হয়ে থাকে। ক্যাসেটের দোকানে কুরআনুল কারীম ও দ্বীনী বক্তৃতার ক্যাসেটের সাথে বিক্রি করা হয়। এসকল সংগীতকে ইসলামী সংগীত বলা মারাত্মক ভুল। কেননা ইসলামী শরী‘আ হতে কোন সংগীতকে দীন হিসাবে নির্ধারণ করা হয়নি। বরং আল্লাহর যিকর, কুরআন তিলাওয়াত এবং কল্যাণকর ইলম অর্জন করা ইত্যাদিকে দীন হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে

সংগীত : সংগীত হলো বিদাতী সুফীদের ধর্ম; যারা দীনকে খেল-তামাশা মনে করে।

সংগীতকে দীনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করা খ্রিষ্টানদের সাথে সাদৃশ্য অর্জন করার নামান্তর। তারা সুরেলা কণ্ঠে যৌথ গান গাওয়াকে ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করেছে। সুতরাং এসকল সংগীত থেকে সতর্ক থাকা অত্যাবশ্যক। সংগীতের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে যে সকল ফিতনা-ফাসাদ, হট্টগোল-বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে তা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য এর কেনাবেচা, বিনিময় ও উৎপাদন নিষিদ্ধ করতে হবে।

সংগীত প্রচলনকারীরা দলিল হিসাবে বলে যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটও তো কবিতা পাঠ করা হতো। তিনি নিজে শ্রবণ করতেন এবং সম্মতি প্রদান করতেন।

উত্তর: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আবৃতিকৃত সংগীতগুলো গানের মত যৌথ স্বরে আবৃতি করা হতো না এবং সেগুলোকে ইসলামে সংগীতও বলা হতো না। বরং সেগুলো ছিল বিজ্ঞবচন, প্রবাদ, বীরত্ব ও মর্যাদার গুণাবলী বর্ণনা সম্পন্ন। ছাহাবীগণ এর অর্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে একাকি আবৃতি করতেন।

কিছু কিছু কবিতা ক্লান্তিকর কাজ যেমন নির্মাণ কাজ, রাতে সফর সম্পাদনের সময় আবৃতি করতেন। সুতরাং এর দ্বারা বুঝা যায় যে, বিশেষ কিছু সময়ে এধরণের কবিতা আবৃতি করা বৈধ; তবে তা শিক্ষা ও দাওয়ার বিষয় হতে পারে না। অথচ এটাই বর্তমানের নির্মম বাস্তবতা। এমনকি ইসলামি/দ্বীনী গান/সংগীত নাম দিয়ে ছাত্রদেরকে শিখানো হয়।

এটা দীনের মধ্যে বিদআত বা নতুন আবিষ্কারের অন্তর্ভুক্ত। এটা বিদাতী সুফীদের কাজ; যারা সংগীতকে ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করেছে।

সুতরাং এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এসকল ক্যাসেট বিক্রয় নিষিদ্ধ করতে হবে। যদি অংকুরেই একে দূর না করা হয় তাহলে এর ক্ষতি ব্যাপক আকার ধারণ করবে। ক্ষতি অল্প অল্প করেই শুরু হয় পরবর্তীতে সর্বগ্রাসী রূপ নেয়।

শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সলিহ আল উসায়মিন (রহ.) কে সংগীত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে,

‘‘প্রশ্ন : পুরুষের জন্য কী ইসলামী সংগীত আবৃতি করা বৈধ? আবৃতির সাথে সাথে কি দাফ বাজানো যাবে? ঈদ এবং আনন্দ অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য সময় কি আবৃতি করা বৈধ?

উত্তর : ইসলামী সংগীত আবৃতি করা একটি বিদআত; যা সুফীরা আবিষ্কার করেছে। এজন্য এর থেকে বিরত থেকে কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়োগ করা উচিত। জিহাদের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য সংগীত ব্যবহার করা বৈধ। তবে এর সাথে দফ যোগ করলে বৈধতা অবশিষ্ট থাকবে না। মুহাম্মাদ ইবনে সলিহ আল উসাইমিন (রহ.) ফাতওয়া, সংকলক, আশরাফ আব্দুল মাকছুদ ১/১৩৪-১৩৫, ২য় প্রকাশ, ১৪১২ হিজরী, মাকতাবা দারু আলামিল কুতুব।

প্রশ্ন-০৩ : ফিকহুল ওয়াক্বে‘ (فقه الواقع)[1] দ্বারা কী উদ্দেশ্য? এর সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ জানতে চাই। কারণ তার শারঈ অর্থ গ্রহণ না করে আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করা হয়।

উত্তর : তারা বলে, সুস্পষ্ট বিষয়কে বিশ্লেষণ করা কঠিন। উদ্দিষ্ট ও প্রত্যাশিত ফিক্বহ হলো: যা কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে রচিত। আর ভাষাগত ফিক্বহ একটি বৈধ বিষয়; যা মানুষের নিকট থেকে প্রাপ্ত। ভাষাশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করা হলো: শব্দের অর্থ, রূপান্তর, শব্দমূল ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানা, এটাই ভাষাগত ফিক্বহ নামে পরিচিত। যেমন সাআ‘লাবীর গ্রন্থ ‘ফিক্বহুল লুগাহ’ ইত্যাদি। এটি একটি ভাষা শিক্ষার পরিপূরক বিষয়। আর যদি সাধারণভাবে বলা হয় যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

{ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ }

তারা যেন দীনের সুক্ষ জ্ঞান অর্জন করে। সূরা আত তাওবা ৯: ১২২

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

( من يرد الله به خيرًا يفقهه في الدين )

আল্লাহ যার কল্যাণ কামনা করেন তাকে দীনের সুক্ষজ্ঞান দান করেন।[2]


আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

{ فَمَالِ هَؤُلاءِ الْقَوْمِ لا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ حَدِيثا }

এই কওমের কী হলো, তারা কোন কথা বুঝতে চায় না! সূরা আন নিসা ৪:৭৮

{وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لا يَفْقَهُونَ}

কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না। সূরা মুনাফিকুন ৬৩:০৭

এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: শারঈ হুকুম আহকাম জানার মাধ্যমে দীনের পাণ্ডিত্য অর্জন করা। আর এটা অর্জন করাই কাম্য। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য এই ফিক্বহ অর্জনের জন্য মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।

কিন্তু তাদের নিকট  فقه الواقع দ্বারা فقه اللغة উদ্দেশ্য নয়। বরং তাদের নিকট এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক কাজকর্মে লিপ্ত হওয়া, রাজনীতিকে জটিল করে তোলা, সময় এবং মনোযোগ রাজনীতির দিকেই নিবন্ধ রাখা, রাজনীতির জন্যই ব্যয় করা।

তারা হুকুম-আহকামগত ফিক্বাহকে ঘৃণাভরে অবজ্ঞা করে বলে যে তা হলো শাখা-প্রশাখাগত ফিক্বহ, হায়েজ-নিফাসের ফিক্বহ।[3]

[1]. এ পরিভাষাটির দু’টি প্রয়োগ আছে: (১) ফতওয়া জিজ্ঞেসকারীর বাস্তব অবস্থা, তার এলাকার অবস্থা সম্পর্কে জানা। ফতওয়া দেওয়ার আগে এ বিষয়ে জ্ঞান থাকা দরকার। এ প্রয়োগিক অর্থে শব্দটির ব্যবহার ঠিক আছে। (২) দুনিয়ার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানা এবং তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা। শত্রুদের বইপুস্তক-পত্রিকা পড়া এবং বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা খতিয়ে দেখা। এ অর্থে শব্দটি নিয়ে শিথিলতা প্রদর্শন ও সীমালঙ্ঘন দু’টোই ঘটে।

[2]. সহীহ বুখারী হা/৭১, মুসলিম হা/১০৩৭

[3]. একথা স্পষ্ট যে ফিক্বাহর অনেকগুলো প্রকার রয়েছে।

ক. ফিকহ অর্থ হলো: কুরআন, সুন্নাহ বুঝা ও শারী‘আতের মাসআলা ইসতিমবাত (উদ্ভাবন করা)।

খ. পবিত্র কুরআন এবং সুন্নাহর ভাষা, আরবীর ‘ফিকহুল লুগাহ আল-আরাবিয়্যাহ’ (আরবী ভাষার বিধি বিধান); যেমন নাহু, ছরফ, বালাগাত, ইশতিক্বাক (রূপান্তর) ও দালালাত (প্রমাণাদি) সম্পর্কে জানা।

গ. বিচার ও নব উদ্ভাবিত বিষয় সম্পর্কিত ফিকহ:

তারা যাকে ফিকহুল ওয়াকি‘ বা বাস্তব ফিকবাহ বলে এর দ্বারা তারা বুঝায় লোকজনকে রাজনৈতিক কাজে লিপ্ত করা, শাসকদের সমালোচনা করা, ফিতনা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা, বিশৃংখলা সৃষ্টি করা। তারা মানুষকে ধোঁকা দেয়ার নিমিত্তেই মূলতঃ এ নাম বলে থাকে।

এ ফিকহুল ওয়াকি‘এর অনুসারীদের থেকে নতুন কোন মতবাদ নয় বরং এদের পূর্বসূরী ও ইমাম সাইয়্যিদ কুতুব ফিকহুল ওয়াকি‘ এর ব্যাপারে যিলালিল কুরআনের ০৪ নং খণ্ড-র ২০০৬ নং পৃষ্ঠায় সূরা ইউসূফের আয়াত,  اجْعَلْنِي عَلَى خَزَائِنِ الأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌব্যাখ্যায় বলেছেন। এ আয়াত সম্পর্কে আলোচনা করার পর তিনি বলেছেন ‘‘ফিকহে ইসলামী গড়ে উঠেছে মুসলিম সমাজে। সমাজের আন্দোলন ও ইসলামী জীবন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে। আল ফিকহুল ওয়াকি‘ বা বাস্তব ফিক্বাহ ফিকহুল আওরাক বা কাগুজে ফিক্বাহ এর মাঝে মূলনীতিগতভাবে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। আন্দোলনের ফিক্বাহই প্রকৃত ফিকবাহ যার ব্যাপারে আয়াত ও আহকাম অবতীর্ণ হয়েছে।

প্রশ্ন-৪ : বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নানা ধরনের ইসলামী জামাত বা দলের নাম শুনতে পাই। এসব নামের ভিত্তি কী? তারা যদি কোন বিদআত না করে তাহলে তাদের সাথে অংশগ্রহণ করা কি বৈধ হবে?

উত্তর : আমরা কীভাবে কাজ করব তার দিক-নির্দেশনা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বলে দিয়েছেন। যে সকল কাজকর্ম দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করা যায় তার সবই তিনি বর্ণনা করেছেন, কিছুই বাকি রাখেননি। এমনিভাবে যে সকল কাজকর্ম আল্লাহ ও বান্দার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে তাও সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।[1] এ মাসআলাটিও কিন্তু সেরকমই একটি বিষয়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

فإنه من يعش منكم فسيرى اختلافاً كثيرًا

(আমার পরে) তোমাদের যে কেউ বেঁচে থাকবে সে অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে।[2]

এরূপ দলাদলি শুরু হলে সমাধান কী হবে? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين من بعدي، تمسَّكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ، وإياكم ومحدثات الأمور؛ فإن كل محدثة بدعة، وكل بدعة ضلالة

‘‘সুতরাং তোমাদের কর্তব্য হবে আমার এবং আমার পরবর্তী হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাদের সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা, তোমরা তাকে মাড়ির দাঁত দ্বারা কামড়িয়ে ধরবে। আর তোমরা সকল প্রকার নব্য কাজ থেকে নিরাপদ দূরতেব অবস্থান করবে; কেননা প্রত্যেক নতুন কাজই বিদআ’ত; প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী’’।[3]

সুতরাং এসকল জামাতের[4] মধ্যে যে জামাতই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ছাহাবায়ে কিরাম বিশেষত খুলাফায়ে রাশিদীনের ও ফযীলাত প্রাপ্ত যুগের মানহাজের (পথ ও পদ্ধতির) উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে আমরা তাদের সাথেই সম্পৃক্ত থাকব, তাদের সাথে কাজ করব।

আর যে দলই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ-নির্দেশনার বিরোধিতা করবে আমরা তাদের থেকে দূরে থাকব, যদিও তাদের নাম ইসলামী জামাত বা দল হয়। নাম কোনো ধর্তব্য ব্যাপার নয়। বাস্তবতাই মূল ধর্তব্যের বিষয়। অনেক সময় বড় বড় নাম থাকলেও দেখা যায় তা অন্তঃসারশূন্য, বাতিল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

افترقت اليهود على إحدى وسبعين فرقة، وافترقت النصارى على اثنتين وسبعين فرقة، وستفترق هذه الأمة على ثلاث وسبعين فرقة، كلها في النار إلا واحدة )) قلنا : من هي يا رسول ؟، قال : (( من كان على مثل ما أنا عليه اليوم وأصحابي ))

ইয়াহূদীরা ৭১ দলে এবং খ্রিষ্টানেরা ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল অচিরেই এই উম্মাহ ৭৩ দলে বিভক্ত  হবে। তাদের প্রত্যেক দলই জাহান্নামে যাবে; মাত্র একটি দল ছাড়া। আমরা (ছাহাবীগণ) বললাম হে আল্লাহর রসূল, সে দল কোনটি? তিনি বললেন: বর্তমানে আমি এবং আমার ছাহাবীগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত আছি এ মতের উপর যারা প্রতিষ্ঠিত থাকবে।[5]

চলার পথ সুস্পষ্ট; যে জামাতের মাঝে এই বৈশিষ্ট্য থাকবে আমরা তাদের সাথে থাকব। যারাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ছাহাবায়ে কিরামের মানহাজের উপর থাকবে তারাই প্রকৃত ইসলামী জামাত।

আর যারা এই মানহাজের (কর্মপদ্ধতির) বিরোধিতা করে অন্য পথে চলবে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং আমরাও তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমরা সে পথের সাথে সম্পৃক্ত হব না। সে পথও আমাদের সাথে সম্পৃক্ত হবে না। তাদেরকে জামাত বলা হবে না। বরং তাদেরকে অন্যতম একটি ভ্রষ্ট ফিরক্বা বলা হবে। কেননা জামাত একমাত্র হকের উপরই প্রতিষ্ঠিত থাকে। যার উপর মানুষ একত্রিত হয়। আর ভ্রষ্টতা তো শুধু বিচ্ছিন্নই গড়ে, ঐক্য গড়ে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ

আর যদি তারা বিমুখ হয় তাহলে তারা রয়েছে কেবল বিরোধিতায় (সূরা আল বাক্বারা ২/১৩৭)।


[1]. এখানে শায়খ হাফিযাহুল্লাহ একটি সহীহ হাদীছের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘যে সকল কাজ তোমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয় তার প্রত্যেকটিরই নির্দেশনা প্রদান করেছি’’। আব্দুর রাযযাক, মুছান্নাফ খ.১১ পৃ১২৫, বায়হাকী, মা‘রিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার খ.০১ পৃ ২০

[2]. আল মু‘জামুল কাবীর লিত ত্ববরানী  খ.১৮, পৃ.২৪৮, হা/৬২৩, মুসতাদরাক লিল হাকিম খ.০১, পৃ. ১৭৪, হা/৩২৯।

[3]. সকল সূত্রে সহীহ, আবু দাউদ হা/৪৬০৭ তিরমিযী হা/২৬৭৬, ইবনু মাজাহ (মুকাদ্দামা-৩৪), আলবানী, ইরওয়া হা/২৪৫৫।

[4]. কুরআন-সুন্নাহ এবং সালাফে সালেহীনের মানহাজের বিরোধী এসকল দলকে ফিরকা বলাই উত্তম। এটাই ওদের শারঈ নাম। যেমনটি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরাক সম্পর্কিত হাদীছে এ নামই বলেছেন। আর হাদীছে ইঙ্গিতকৃত জামাত হলো একমাত্র মুসলিমদের জামাত। আল্লাহই মহাজ্ঞানী।

[5]. হাসান: তিরমিযী হা/২৬৪১, হাকিম ১/১২৯, ইবনে মাজাহ হা/৩৯৯২, সুনানে আবূ দাউদ হা/৪৫৯৭।

প্রশ্ন-৫ : কে তুলনামূলক বেশি কষ্টদায়ক আযাবপ্রাপ্ত হবে: সাধারণ পাপী নাকি বিদাতী?

উত্তর : বিদাতীরা বেশি কষ্টদায়ক আযাবের শিকার হবে। কেননা বিদআত অবাধ্যতা থেকেও মারাত্মক। শয়তানের নিকট অন্যান্য পাপের চেয়ে বিদআত বেশি প্রিয়। কেননা অবাধ্যচারী ব্যক্তি তাওবাহ করে পক্ষান্তরে বিদাতীরা খুবই কম তাওবাহ করে।[1]

তার কারণ হলো বিদাতী মনে করে, সে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে পাপাচারী জানে যে, সে একজন পাপাচারী, গুনাহগার। আর বিদাতী মনে করে সে একজন আনুগত্যকারী বান্দা, ইবাদতেই রত। আর এভাবেই বিদআত পাপাচার/অবাধ্যতা থেকে অধিকতর ক্ষতিকর হয়ে যায়। বিদআত অন্যান্য পাপাচার থেকে মারাত্মক হওয়ার কারণে সালাফগণ বিদাতীদের সাথে উঠাবসা করা থেকে বারণ করেন।[2]

তাদের অনিষ্ট বড়ই মারাত্মক, যারাই তাদের সাথে চলাফেরা করে তারা তাদের প্রত্যেককেই প্রভাবিত করে। নিঃসন্দেহে অন্যান্য পাপাচার থেকে বিদআত বেশি খারাপ। বিদাতীর অনিষ্ট পাপাচারীর অনিষ্ট থেকে বেশি মারাত্মক।[3]

এ জন্য সালাফগণ বলেন, সুন্নাহর ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা বিদআতের আলোকে ইজতিহাদ (গবেষণা) করা থেকে উত্তম।[4]


[1]. ইমাম সুফইয়ান আছ্ ছাওরী (রহ.) বলেন, শয়তানের নিকট অবাধ্যতা বা পাপাচার থেকে বিদআত বেশি প্রিয়। কেননা পাপকাজ থেকে তাওবাহ করা হয়ে থাকে পক্ষান্তরে বিদআত থেকে তাওবাহ করা হয় না। মুসনাদে ইব্ন আল-জা‘দ ১৮৮৫, মাজমু‘ ফাতওয়া ১১/৪৭২ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, إن الله احتجز التوبة عن صاحب كل بدعة ‘‘আল্লাহ তা‘আলা তাওবাহকে বিদাতীদের থেকে দূরে রাখেন।’’ আছ সহীহাহ হা/১৬২০

[2]. আবুল হাসান আল বাসরী (রহ.) বলেন, তুমি কোন বিদাতীর সাথে বসো না। তার সাথে বসলে সে তোমার অন্তরকে অসুস্থ বানিয়ে দেবে। (আল-ই‘তিসাম ০১ /১৭২, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া  পৃ. ৫৪।

আল্লামা শাতিবী (রহ.) বলেন, ‘‘একমাত্র নাজাতপ্রাপ্ত দল হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত বিদাতীদের সাথে বৈরি আচরণ করতে, তাদেরকে তাড়িয়ে দিতে এবং কেউ তাদের চলে গেলে তাকে হত্যা করা বা অন্য কোনো শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে আদিষ্ট। আলিমগণ তাদের সাথে চলাফেরা ও ওঠাবসা করতে নিষেধ করেছেন।’’

আল্লাহ তা‘আলা সালাফদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন তারা প্রত্যেক বিদাতীকেই প্রতিহত করেছেন এবং তার থেকে উম্মাহকে সতর্ক করেছেন।

[3]. শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমীয়া (রহ.) বিদাতীদের অনিষ্ট বিষয়ে বলেন, যদি কেউ তাদের মুক্বাবিলা না করত তাহলে দীন ধ্বংস হয়ে যেত। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদলের আক্রমণ থেকে তাদের আক্রমণ মারাত্মক। কেননা তারা বিজয়ী হলে শুধু আনুগত্যই করে নিতে পারে; মন-মানসিকতা এবং দীন ধ্বংস করতে পারে না। পক্ষান্তরে বিদাতীরা প্রথমেই মন-মানসিকতা নষ্ট করে দেয়। মাজমূ‘ ফাতওয়া ২৮/২৩২।

তিনি আরো বলেন, সুন্নাহ ও ইজমা‘ দ্বারা প্রমাণিত যে প্রবৃত্তিপূজারী পাপী থেকে বিদাতী বেশি মারাত্মক। মাজমু‘ ফাতওয়া ২০/১০৩।

[4]. ইবনে মাসউদ রযিআল্লাহু আনহুর কওল, দেখুন আল-লালকাঈ পৃ.১১৪, আল-ইবানাহ পৃ. ১৬১ আস-সুন্নাহ লি ইবনি নাছর পৃ. ৩০।

প্রশ্ন-৬ : বিভিন্ন দলের সাথে যারা সম্পৃক্ত হয় তারাও কি বিদাতী বলে গণ্য হবে?

উত্তর : এটা জামাতের উপর নির্ভরশীল। যদি জামাতগুলিতে কুরআন সুন্নাহ বিরোধী বিষয় থাকে তাহলে সম্পৃক্ত ব্যক্তি বা সদস্যও বিদাতী বলে গণ্য হবে।[1]


[1]. শায়খ বাকর ইবনে আবু যায়দ হুকমুল ইনতিমা ইলাল ফিরাকি ওয়াল আহযাবি ওয়াল জামা‘আতিল ইসলামিয়্যাহ পৃ. ৯৬-৯৭ বলেছেন, ‘উম্মাহর কারো জন্য একমাত্র আমাদের নাবী ও রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তিকে দাঁড় করিয়ে তার দিকে আহবান করা, তার ভিত্তিতে ভালোবাসা ও শত্রুতা পোষণ করা বৈধ নয়। যদি কেউ রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তিকে একাজে দাঁড় করাবে সে বিদাতী ও বিভ্রান্ত বলে পরিগণিত হবে।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমীয়া (রহ.) বলেন, ‘উম্মাহর কারো জন্য একমাত্র আমাদের নাবী ও রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তিকে মানদন্ড দাঁড় করানো, তার পথে আহবান করা, তার ভিত্তিতে ভালোবাসা ও শত্রুতা পোষণ করা বৈধ নয়। কুরআন সুন্নাহ ও ইজমা’ ছেড়ে তাদের কোন কথাকে মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে ভালোবাসা ও শত্রুতা পোষণ করা বৈধ নয়। বরং এমনটি করা বিদাতীদের কাজ, যারা নিজেদের জন্য কোন ব্যক্তি বা কথাকে দাঁড় করিয়ে তার ভিত্তিতে উম্মতের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে। এর ভিত্তিতে বন্ধুত্ব স্থাপন করে বা শত্রুতা পোষণ করে।

শায়খ বাকর হাফিযাহুল্লাহ শায়খুল ইসলাম (রহ.) র মত উল্লেখের পর বলেন, বর্তমানে অধিকাংশ ইসলামী দল ও সংগঠনের অবস্থা এমনই; তারা তাদের কিছু ব্যক্তিকে নেতা হিসাবে দাঁড় করায়, এরপর তাদের বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব করে এবং তাদের শত্রুদের সাথে শত্রুতা করে এবং কুরআন সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা ব্যতিরেকে তাদের প্রত্যেক ফাতওয়া-নির্দেশনার আনুগত্য করে। এমনকি তাদের ফাতওয়া-নির্দেশনার ব্যাপারে দলীল প্রমাণ ও জিজ্ঞাসা করে না।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১২০ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 9 10 11 12 পরের পাতা »