সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তার প্রশংসা করি। তার সাহায্য কামনা করি। তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। এবং আমাদের আত্মিক অনিষ্ট ও কর্মসমূহের অমঙ্গল হতে আশ্রয় কামনা করি। আল্লাহ তা‘আলা যাকে সঠিক পথের দিশা দেন কেউ তাকে বিপথগামী করতে পারে না। আর আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন কেউই তাকে সঠিকপথ প্রদর্শন করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই। তিনি একক। তার কোনো শরীক নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বান্দা ও রসূল।
অতঃপর- গবেষকগণ মুসলিমদের অবস্থা নিয়ে অত্যন্ত আশ্চর্যবোধ করেন যে, মূর্খ, প্রতারিত-প্রতারক, পথভ্রষ্ট, প্রবৃত্তি পূজারী, আত্মপ্রকাশকারী, জ্ঞানী দাবিদার এবং আমলকারী আলিম, হিদায়াতপ্রাপ্ত অনুসারী, সুপথের অনুসন্ধানকারী, সুন্নাতের সাহায্যকারী, যাদের মাঝে কতই না মতপার্থক্য ও দলাদলি বিদ্যমান। এ ব্যাপারে সত্যবাদী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যথার্থই সত্য বলেছেন। তিনি বলেন,
مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيَرَى اخْتِلاَفاً كَثِيْراً..
তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ঐ সময় বেঁচে থাকবে সে অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে।[1]
কিন্তু এ বোকামি ও পরস্পর মারামারি থেকে উত্তরণের উপায় কী?
নিঃসন্দেহে আল্লাহর কিতাব ও তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ আঁকড়ে ধরাই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ مِنْ بَعْدِيْ
তোমাদের উপর আমার সুন্নাহ ও আমার পরে সুপথপ্রাপ্ত খলীফাদের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা অত্যাবশ্যক।[2]
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمِا كِتِابَ اللهِ وَسُنَّتِيْ
তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে গেলাম। যতদিন তোমরা সে দুটোকে আঁকড়ে ধরে থাকবে ততদিন বিপথগামী হবে না। তা হচ্ছে- আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং আমার সুন্নাহ (হাদীছ)।[3]
যখনই অধিকাংশ মানুষ এ দুটোকে গুরুত্ব দেয়া ও আঁকড়ে ধরা ছেড়ে দিয়ে প্রবৃত্তি ও যুক্তিকে ওহীর উপর প্রাধান্য দিয়েছে এবং আবেগের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে; তখুনি প্রবৃত্তি তাদেরকে নীচে নামিয়ে দিয়েছে। তাদের পা পিছলে গিয়েছে। ফলে তারা ফিতনায় পতিত হয়েছে। আর এ রশিদ্বয় তথা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহকে ধারণকারীগণ -যারা মাড়ির দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে তারাই সালাফে সালেহীনের পদ্ধতির উপর সুপথপ্রাপ্ত। তারাই হলেন ‘আল ফিরকা আন নাজিয়াহ’ (মুক্তিপ্রাপ্ত দল), ‘আত ত্বয়িফাহ আল মানসূরাহ’ (সাহায্যপ্রাপ্ত দল) এবং ‘আল জামাত’। যদিও তারা ছাগলের রাখালই হোক না কেন।
তাদের ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِّنْ أُمَّتِيْ عَلىَ الْحَقِّ ظَاهِرِيْنَ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ وَلَا مَنْ خَالَفَهُمْ.
আমার উম্মাহর একটি দল হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে তাদের থেকে যারা বিচ্ছিন্ন থাকবে এবং যারা বিরোধিতা করবে তারা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না।[4]
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মতপার্থক্য বিষয়ক হাদীছে বলেন,
ستفترق أمتي على ثلاث وسبعين فرقة كلها في النار إلا واحدة
‘অচিরেই আমার উম্মাহ ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। একটা দল ব্যতিরেকে তাদের সকল দলই জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।[5]
قلنا من هي قال : ( الجماعة )، وقال : من كان على مثل ما أنا عليه اليوم وأصحابي
(ছাহাবায়ে কিরাম বলেন) আমরা বললাম, সে দল কোনটি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, (সে দলটি হলো) আল জামাত। তিনি আরো বললেন, আমি এবং আমার ছাহাবীরা যার উপর প্রতিষ্ঠিত আছি এর উপর যারা প্রতিষ্ঠিত থাকবে।[6]
সুতরাং সকল মুসলিমের উপর বিশেষত যুবকদের উপর -যারা পরকালীন মুক্তিকামনা করে, আর দুনিয়াতে সুখে থাকতে চায়- তাদের জন্য ওয়াজিব হলো ফিতনার স্থানসমূহ থেকে সতর্ক থাকা, নিরাপদ দূরতেব অবস্থান করা, যাতে তারা ফিতনায় নিমজ্জিত না হয়। যদি তা না করে তবে তারা ফিতনায় নিমজ্জিত হবে।
আর পথভ্রষ্ট দাঈদের থেকে পূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে। যারা সুন্নাহর লিবাস পরিধান করে, সুন্নাহর নামে কথা বলে। অথচ তারা সুন্নাহ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। কেননা হয় তারা শত্রুদের স্বার্থে কাজ করে নতুবা সুন্নাহর মর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ।
আর আমাদের ধারণা দ্বিতীয় বিষয়টিই তথা তাদের সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আলিমদের নিকট থেকে সরাসরি জ্ঞানার্জন করেনি। আর এটাই যখন তাদের অবস্থা তখন কীভাবে তাদেরকে অনুসরণ করা যাবে? কীভাবেই বা তাদের উপর নির্ভর করা যাবে? আমরা কীভাবেই বা তাদের থেকে ইলম, ফাতওয়া ও দিক নির্দেশনা গ্রহণ করতে পারি? দুর্বলের দ্বারা শুধু দুর্বলতাই বৃদ্ধি পায়।
কুরআন-সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণ ছাড়া সঠিক পথের উপর অটল থাকা সম্ভব নয়। আর তা অর্জিত হয় ইলম অন্বেষণ, আলিমদের সংস্পর্শে থাকা, সঠিক পথের দিক-নির্দেশক পূর্ববর্তী আলিমদের বই-পুস্তক অধ্যয়ন, আর তাদের উপকারী ইলম অর্জনে প্রচেষ্টা চালানো, গ্রহণযোগ্য আলিমগণের মত গ্রহণ করা, অপ্রয়োজনীয় বিষয়াবলী বর্জন করা, প্রবৃত্তিপূজারী ও বিদাতীদের কথা ও মত থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে।
কেননা প্রবৃত্তিপূজারীরা উম্মাহর জন্য বিপজ্জনক। তারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আহলে বাইতের নাম উল্লেখ পূর্বক আলোচনা করে। আর এই সুন্দর আলোচনা দ্বারা মূর্খ লোকদের প্রতারিত করে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। ঐ সকল প্রবৃত্তিপূজারীদের উদাহরণ হলো মধুর নামে গাছের তিক্ত রস পরিবেশনকারীর মতো, যা সে কখনো কখনো প্রাণনাশক বিষকে প্রতিষেধক হিসাবে পান করায়।
তুমি তাদের ব্যাপারে (সতর্কতামূলক) লক্ষ্য রাখবে। যদিও তুমি পানির সাগরে জনম গ্রহণ করোনি। কিন্তু তুমি প্রবৃত্তির সাগরে জনম গ্রহণ করেছ যা পানির সাগরের থেকেও অধিক গভীর ও অধিক বিশৃঙখল, অধিক গর্জনকারী ও কূল কিনারাহীন।
তোমার এই বিভ্রান্তিপূর্ণ পথ অতিক্রম করার একমাত্র বাহন হলো সুন্নাহর অনুসরণ করা। সুন্নাতের অনুসরণরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা প্রত্যেক মুসলিমের নিকট মর্যাদা ও সম্মানের বিষয়। আমাদের একাকিত্ব, ভাইদের ইমিত্মকাল, সাহায্য কম হওয়া, বিদআত প্রকাশ পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আল্লাহর নিকটই অভিযোগ পেশ করবো। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আলিমদের মৃত্যুতে এবং বিদআত প্রকাশিত হওয়ায় এ উম্মাহ কতই না মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়েছে! তবে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথায় আমাদের জন্য সান্তবনা রয়েছে।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لا تزال طائفة من أمتي على الحق ظاهرين
আমার উম্মাহর একটি দল হকের উপর সর্বদাই প্রতিষ্ঠিত থাকবে।[7]
পর সমাচার হলো,
এটা ‘আল আজউইবাতুল মুফীদাহ আন আসইলাতিল মানাহিজিল জাদীদাহ’ নামক গ্রন্থের নতুন মোড়কে সজ্জিত তৃতীয় সংস্করণ। যা ১ম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার দীর্ঘদিন পর প্রকাশ পেল। ইতোমধ্যে অনেক নিত্য নতুন ঘটনা ঘটেছে। অনেকেরই পদস্খলন ঘটেছে। অনেকেরই চিন্তা-চেতনা পরিবর্তিত হয়েছে। সুতরাং এমতাবস্থায় উল্লেখিত ঘটনার ব্যাপারে অভিজ্ঞ আলিমদের মত ও তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে জানা শরীরের জন্য খাবার ও পানীয় গ্রহণের চেয়েও বেশি প্রয়োজন। কেননা শারীরিক রোগ আর অন্তরের রোগ সমান নয়। অন্তরে রোগ প্রবেশ করলে যদি তা বের করে ফেলার মতো কেউ না থাকে তাহলে তা ব্যক্তির দুনিয়া এবং আখিরাত সবই নষ্ট করে দেয়।
আল্লাহর নিকট দু‘আ করি তিনি যেন আমাদেরকে সত্য সঠিক পথ প্রদান করেন। আর আমাদের শায়েখকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করেন। দরূদ ও শান্তিধারা বর্ষিত হোক আমাদের নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার পরিবার ও ছাহাবীগণের উপর।
আবূ ফুরাইহান জামাল ইবনে ফুরাইহান আল হুমায়লী আল হারিসী
১৩ ই শাবান, ১৪২৩ হি., শনিবার ফজরের পর।
[2]. সহীহ: সুনানে আবু দাউদ হা/৪৬০৭।
[3]. সহীহ: মুস্তাদরাক হাকীম হা/৩১৯, সুনানুল ক্বুবরা বাইহাকী হা/২০১২৪, সহীহ জামি হা/৩২৩২, ২৯৩৭।
[4]. সহীহ: মুসলিম হা/১৯২০
[5]. হাকিম ০১/১২৯
[6]. হাসান: তিরমিযি হা/২৬৪১
[7]. সহীহ: সুনানে তিরমিযী হা/২২২৯