إن الحمد لله نحمده ونستعينه ، ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضلل فلا هادي له ، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له وأشهد أن محمدا عبده ورسوله صلى الله عليه وعلى آله وأصحابه وسلم تسليما كثيرا
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلا تَمُوتُنَّ إِلا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا
ইসলাম যাদের জীবন, কুরআন ও সুন্নাহর আলো-বাতাসে যাদের প্রাণ সজীব তারা নিশ্চয়ই চায় যে, তাদের ঐ ইহকালের শেষজীবন সমাপ্ত এবং পারলৌকিক মধ্যজগতের শুভজীবন আরম্ভ হোক সেই সৌরভময় আলোবাতাসের মনোরম পরিবেশের মাধ্যমেই। তাইতো সলফগণ তাঁর পরিজনবর্গকে সুন্নাহ ভিত্তিক জানাযাকার্য সমাধা করতে অসিয়ত করতেন। সা’দ বিন আবী অক্কাস (রাঃ) তাঁর মৃত্যুশয্যায় বলেন, 'আমার জন্য বগলী কবর খনন করো এবং কাঁচা ইট থাকিয়ে দিও। যেমন রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্য করা হয়েছিল।' (মুসলিম ৬০৬ক, নাসাঈ ১৯৮০ক, বাইহাকী) আবু মূসা (রাঃ) তার শেষ শয্যায় বলেন, 'যখন তোমরা আমার জানাযা নিয়ে যাবে তখন শীঘ্রতার সাথে চলো। (আগর কাষ্ঠ জ্বালাবার পাত্র) ধুনুচি নিয়ে। আমার অনুগমন করো না, কবরের ভিতর আমার লাশ ও মাটির মাঝে কোন বস্তুর অন্তরাল রেখো না, আমার কবরের উপর (গৃহাদি) নির্মাণ করো না। আর আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রাখছি যে, আমি প্রত্যেক (মসীবত ও শোকের সময়) কেশ মুন্ডনকারিণী, উচ্ছরোলে বিলাপকারিণী এবং বস্ত্র বিদীর্ণকারিণী হতে সম্পর্কহীন। লোকেরা বলল, আপনি এ ব্যাপারে কিছু শুনেছেন কি?' তিনি বললেন, হ্যাঁ, রসূল (ﷺ) এর নিকট শুনেছি।” (মুসনাদে আহমাদ ১৮৭২৬ক, বাইহাকী ৩/৩৯৫)
হুযাইফাহ (রাঃ) বলেন, আমি মারা গেলে কাউকে খবর দিও না। কারণ, আমি আশঙ্কা করছি যে, তা মৃত্যু সংবাদ ঘোষণার পর্যায়ভুক্ত হবে। আর আমি রসূল (ﷺ)-কে মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা নিষেধ করতে শুনেছি। (তিরমিযী ৯০৭ক, ইবনে মাজাহ ১৪৬৫ক, আহমাদ ২২৩৫৮, সহীহ তিরমিযী ৭৮৬নং)
আমর বিন আল-আস (রাঃ) তার অসিয়তে বলেন, 'আমি মারা গেলে যেন আমার জানাযার সাথে কোন মাতমকারিণী এবং কোন প্রকারের আগুন না থাকে।' (মুসলিম, আহমাদ)
আবু হুরাইরা (রাঃ) তার অন্তিম বিদায়ের সময় বলেন, 'আমার কবরের উপর যেন তাবু স্থাপন করো না এবং ধুনুচি (বা আগুন) সহ আমার অনুগমন করো।” (মুসনাদে আহমাদ)।
সুতরাং অনুরূপ অসিয়ত তাদের অনুসারীদেরও করা উচিত। যাতে তাদের জানাযার কাজ সহীহ সুন্নাহ ভিত্তিক সম্পন্ন হয় এবং কোন প্রকারের কুসংস্কার ও বিদআত যেন এই কাজে স্থান না পায়।
এই পুস্তিকা লিখে আমি নিজের জন্য এবং সকল মুসলিম ভাইদের জন্য, সকল মুসলিম ভাইদের উদ্দেশ্যে সেই অসিয়ত করারই প্রয়াস পেয়েছি। আর আশা করছি যে, পাঠক মাত্রই এই অসিয়ত পালনে কার্পণ্য ও কুণ্ঠাবোধ করবেন না।
আল হামদুলিল্লাহ! মানুষ এখন বড় সচেতন। ধর্মীয় চেতনা এবং সঠিক ও সত্য জানার একান্ত অনুপ্রেরণা প্রায় সকলের মনে। তাইতো বিনা হাওয়ালার বই-পুস্তক পড়তে ও মানতে চান না। কিন্তু ফেঁসে যান সেখানেই, যেখানে গলদ, অচল, দুর্বল প্রভৃতি হাওয়ালা মানতে বাধ্য হন। কারণ এসব চেনার ক্ষমতা সকলের নেই। সুতরাং ব্যক্তিত্বের উপর বিশ্বাস ও ভরসা রাখতেই হচ্ছে।
আরব জাহানের সত্যানুসন্ধিৎসা সকলের মনে। গবেষণা কেন্দ্রও সেখানে আধুনিক পদ্ধতিতে দ্বীনী রিসার্চ বহু সত্যের সন্ধান দেয়, বহু রহস্য উদঘাটন করে এবং সংস্কারের নামে বহু কুসংস্কারের পর্দা উম্মোচন করে। দুটি পরস্পর-বিরোধী হাদীসের কোনটি মান্য, পরস্পর-বিরোধী ইমাম ও উলামাদের কোন কথাটি বলিষ্ঠ, যুক্তিযুক্ত ও আমলযোগ্য ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক অভিমত প্রদান করে। যেহেতু ইসলামী শরীয়তে বিশেষ করে আহকামে বহু মতানৈক্য সেই সাহাবা দের যামানা থেকেই চলে আসছে। এর মধ্যে কোনটি রহিত, কোনটি নির্দিষ্ট বা বিশিষ্ট, কোটি রূপক, কোন্ হাদীসটি জাল বা দুর্বল, একজন দুর্বল ও অপরজন সবল বললে ন্যায় ও যুক্তির মানদন্ডে কার কথাটি বলিষ্ঠ ইত্যাদি বিবেচনা করে নতুন নতুন গ্রন্থাদি প্রণয়ন করা হচ্ছে। যা ঘাড় পেতে মেনে নিতে সাধারণ মুসলমানদের আর কোন দ্বিধা থাকতে পারে না। এবং যশ ও পদ-লোভ ছাড়া আর কোন বাধা থাকতে পারে না। সত্যের উত্তাপ পাওয়ার পরও আর কারো অন্ধানুকরণে ‘ফ্রোজেন’ থাকা সাজে না।
এই সংস্কারকে আমরা সাদর স্বাগত জানাই এবং মনে করি যে, এই সংস্কার সাধনেই রয়েছে মুক্তি, অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি। আল্লাহর গযব ও আযাব থেকে মুক্তি।
আমাদের জ্ঞান সীমিত হলেও জেনে পৌছে দেওয়ার দায়িত্বভার মস্তক উপরে। যা হাল্কা করা অনিবার্য কর্তব্য। তাই তো আমাদের এই পদক্ষেপ। বহু কিছু নতুন লাগলেও তা না জানার কারণে নতুন, অনেক কিছু অবান্তর লাগলেও সেটাই নতুন গবেষণায় সত্য ও বাস্তব।
এ কথা মেনে নেওয়ার জন্যই উদারচিত্ত ও উন্মুক্ত মনের সুধীজনদের নিকট আমাদের পুনঃপুনঃ আবেদন। তাই ছোট-খাট বিতর্কিত বিষয়ে ইজতিহাদী (বুঝার ফের নিয়ে) বিতর্ক থেকে গেলেও তা মুক্ত মনে গ্রহণ করা অথবা তাকে বিরাট আকার দান করে সে প্রসঙ্গে মূল্যবান সময় ব্যয় না করাই সকলের কর্তব্য। অত্র পুস্তিকা সেই সত্যানুসন্ধানী মনীষীদের মেহনতেরই সুপক্ক ফল, যা আমি তাদের পুস্তক বাগিচা হতে চয়ন করে আমার এই পুস্তিকা ডালিতে সংগ্রহ করেছি। এতে যে সমস্ত হাদীসের হাওয়ালা দেওয়া হয়েছে তার সবগুলিই সহীহ। যয়ীফ হলে তা ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাঁদের হাদীসলব্ধ জ্ঞান ও মতামতের স্থানে তাদের পুস্তকের হাওয়ালা দেওয়া হয়েছে। প্রায় সকল স্থানেই হাওয়ালায় খন্ড-পৃষ্ঠা ও হাদীস-নং ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য শুরুর দিকে অধিকাংশ হাদীসের হাওয়ালায় কম্পিউটারে ব্যবহৃত নম্বরের অর্থে (ক) ব্যবহার করা হয়েছে। সময়ের অভাবেই এই আধুনিক যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
অত্র পুস্তিকা দ্বারা জরাজীর্ণ সমাজে মৃত্যু ও জানাযা বিষয়ক কর্মাকর্মে নব জাগরণ ও সংস্কার এলে শ্রম সার্থক হবে। আল্লাহর নিকট আশা রাখি যে, তিনি যেন এই পুস্তিকার উদ্যোক্তা (শ্রদ্ধেয় ভাই মাষ্টার সিরাজুল হক সাহেব), প্রকাশক এবং আমার মেহনতকে কিয়ামতে নেকীর পাল্লায় রাখেন এবং এর। দ্বারা মুসলিম সমাজকে সম্যক উপকৃত করেন।
বিনীত - আব্দুল হামীদ ফাইযী
আল-মাজমাআহ
সউদী আরব
৭/৯/১৯৯৬
মৃত্যু এ জাগতিক সংসারে এক অবধারিত, অনিবার্য ও ধ্রুব সত্য। 'জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথায় ভবে?’ জীবন-মৃত্যুর সৃষ্টিকর্তার নিজস্ব ঘোষণাঃ
كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ * وَيَبْقَىٰ وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ
“ভূপৃষ্ঠে যা কিছু আছে সবই নশ্বর, অবিনশ্বর কেবল তোমার প্রতিপালকের চেহারা (সত্তা), যিনি মহিমাময় মহানুভব।” (কুঃ ৫৫/২৬-২৭) “আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সমস্ত কিছুই ধ্বংসশীল, বিধান তো তাঁরই এবং তাঁরই দিকে তোমরা প্রত্যানীত হবে।” (কুঃ ২৮/৮৮) “জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে, আর কিয়ামতের দিন তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় দেওয়া হবে। সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দুরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সেই সফলকাম, আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়। (কুঃ ৩/১৮৫) “জীব মাত্রই মরণশীল; অতঃপর তোমরা আমারই নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে।” (কুঃ ২৯/৫৭) “বল ‘মৃত্যুর ফিরিশ্যা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অবশেষে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যানীত হবে।” (কুঃ ৩২/১১) মৃত্যু যন্ত্রণা সত্যসত্যই আসবে, এ তো সেই বস্তু যা হতে তোমরা অব্যাহতি চেয়ে আসছ।” (কুঃ ৫০/১৯) “বল, তোমরা যে মৃত্যু হতে পলায়ন করতে চাও, তোমাদেরকে সে মৃত্যুর সম্মুখীন হতেই হবে। অতঃপর তোমাদেরকে অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতার নিকট প্রত্যাবর্তিত করা হবে। তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন যা তোমরা করতে।” (কুঃ ৬২/৮)।
এইভাবে কুরআন মাজীদে বিভিন্ন ভাবভঙ্গিমায় ১৬৪ স্থানে মরণের কথা আলোচিত হয়েছে। সেই সর্বগ্রাসী তিক্তময় সন্ধিক্ষণ। যার আগমনে সন্তান। অনাথ হয়, স্ত্রী বিধবা হয়, পিতামাতা হয় নয়নমণি-হারা এবং বিগলিত হয়। সহস্র অশ্রুধারা। কি সে বিষাদ ও বিরহের মুহূর্ত! যা হতে মানুষ একেবারে উদাসীন ও বিস্মৃত। মহান আল্লাহ বলেন,
أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ * حَتَّىٰ زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ * كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ
“প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে; যতক্ষণ না তোমরা কবরের সম্মুখীন হয়েছে। না, এ সঙ্গত নয়। তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে----- ” (কুঃ ১০২/১-২)
অতএব “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং মুসলিম না হওয়া পর্যন্ত তোমরা অবশ্যই মৃত্যু বরণ করো না।” (কুঃ ৪/৭৮)
হ্যাঁ, আর এ কথাও জেনে রেখো যে, “তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই। এমন কি সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করলেও। ” (কুঃ ৪/৭8) সুতরাং মরণের করাল কবল হতে এবং হিসাবের হাত হতে বাঁচার কোন। উপায়ন্তর নেই। এর জন্য রইল কাল জয়ী চ্যালেঞ্জ, “যদি তোমরা সত্যবাদী। হও তবে তোমরা নিজেদেরকে মৃত্যু হতে রক্ষা কর।” (কুঃ ৩/১৬৮) প্রিয় রসূল (ﷺ) বলেন, “সকল প্রকার সুখ আনন্দ ও সুখহরণ মৃত্যুকে তোমরা অধিকাধিক স্মরণ কর।” (তিরমিযী, নাসাঈ)
“দুনিয়ার সাথে আমার কি সাথ? তাঁর শপথ যার হস্তে আমার প্রাণ আছে! আমার ও দুনিয়ার উপমা তো একজন পথিকের (ও বৃক্ষের) ন্যায়, যে, রৌদ্রতপ্ত দিবসে পথ চলতে একটি বৃক্ষের নিচে ক্ষণেক তার ছায়া গ্রহণ করে। অতঃপর তা ত্যাগ করে প্রস্থান করে।” (আহমাদ, হাকেম)
“যেখানেই তুমি থাক হে মানব যত হও সাবধান,
মৃত্যু তোমাকে ধরে নেবে ঠিক পাবে না পরিত্রাণ।
মিছে ছলনায় বাঁধলি যে ঘর সে তো নয় তোর কভু।
হায়রে অবোধ আজো কি নিজেরে চিনিতে পারিলি তবু?”
দুনিয়ায় চিরদিন কেউই থাকবেনা, একদিন মরতেই হবে এবং যে কোন সময়ে মরণ আসতে পারে এ কথার স্মরণ মুমিনকে পরকালের জন্য প্রস্তুতি নিতে উদ্বুদ্ধ করে, আর অস্থায়ী ধোকাবাজ ধূলির ধরাতে ও মায়াময় সংসারে উদাসীন, ভোগমত্ত ও বিভোর হতে সুদূরে রাখে। মরণের স্মরণ মুমিনকে আত্মসমীক্ষা তথা বারবার তওবা করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ করে দ্বীনদারী ও ঈমানদারীর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে।
বারা’ বিন আযেব (রাঃ) বলেন, একদা আমরা আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর সাথে ছিলাম। হঠাৎ তিনি একদল লোক দেখতে পেয়ে বললেন, “কি ব্যাপারে ওরা জমায়েত হয়েছে?” কেউ বলল, 'একজনের কবর খোড়ার জন্য জমায়েত হয়েছে। একথা শুনে আল্লাহর রসূল (ﷺ) ঘাবড়ে উঠলেন। তিনি তড়িঘড়ি সঙ্গীদের ত্যাগ করে কবরের নিকট পৌছে হাঁটু গেড়ে বসে গেলেন। তিনি কি করছেন তা দেখার জন্য আমি তাঁর সামনে খাড়া হলাম। দেখলাম, তিনি কাঁদছেন। পরিশেষে তিনি এত কাঁদলেন যে, তার চোখের পানিতে মাটি পর্যন্ত ভিজে গেল। অতঃপর তিনি আমাদের দিকে মুখ তুলে বললেন, হে আমার ভাই সকল! এমন দিনের জন্য তোমরা প্রস্তুতি নাও।” (বুখারী তারীখ, ইবনে মাজাহ ৪১৯৫, আহমাদ ৪/৩৯৪, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৭৫১ নং)।
উসমান (রাঃ) যখন কোন কবরের পাশে দাঁড়াতেন তখন এত কাঁদা কঁদতেন যে, চোখের পানিতে তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। কেউ তাকে বলল, ‘জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনাকালে আপনি তো কাঁদেন না, আর এই কবর দেখে এত কঁদছেন? উত্তরে তিনি বললেন, যেহেতু আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “পরকালের (পথের) মঞ্জিলসমুহের প্রথম মঞ্জিল হল কবর। সুতরাং যে ব্যক্তি এ মঞ্জিলে নিরাপত্তা লাভ করে তার জন্য পরবর্তী মঞ্জিলসমূহ অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে যায়। আর যদি সে এখানে নিরাপত্তা লাভ না করতে পারে তবে তার পরবর্তী মঞ্জিলগুলো আরো কঠিনতর হয়।” আর তিনি একথাও বলেছেন যে, “আমি যত দৃশ্যই দেখেছি, সে সবের চেয়ে অধিক বিভীষিকাময় হল কবর!” (সহীহ তিরমিযী ১৮৭৮, ইবনে মাজাহ ৪২৬৭ নং)
আবু দারদা , বলেন, “তিনটি বিষয় চিন্তা করে আমার হাসি আসে এবং তিনটি বিষয় মনে করে আমার কান্না আসে। যা আমাকে হাসায় তা হল; সেই ব্যক্তি যে, দুনিয়ার আকাঙ্ক্ষী অথচ মৃত্যু তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজে গাফেল ও উদাসীন অথচ সে দৃষ্টিচ্যুত ও বিস্মৃত নয়। (অথচ তার মৃত্যু। আসবে এবং হিসাব নেওয়া হবে।) আর যে, মুখভর্তি হাসে অথচ জানে না যে, সে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করল, নাকি ক্রোধান্বিত।
আর যা আমাকে কাদায় তা হল, প্রিয়তম মুহাম্মাদ (ﷺ) ও তাঁর সহচরগণের বিরহ, মৃত্যু যন্ত্রণায় সেই কঠিন ভয়াবহতার স্মরণ, আর সেই দিনে আল্লাহর সামনে খাড়া হওয়ার কথা যেদিনে মানুষের গুপ্ত যত কিছু সব প্রকাশ হয়ে পড়বে। অতঃপর জানতে পারে না যে, তার শেষ পরিণাম জান্নাত না জাহান্নাম। এক যাহেদ (সংসার-বিরাগী)কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, সবচেয়ে ফলপ্রসু ওয়ায ও উপদেশ কিসে লাভ হয়? উত্তরে তিনি বললেন, 'মৃতব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিপাতে।”
উমার বিন আব্দুল আযীয আওযায়ীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ---পর সমাচার এই যে, যে ব্যক্তি অধিক অধিক মরণকে স্মরণ করবে, সে ব্যক্তি দুনিয়ার স্বল্প উপকরণ (ধন-সম্পদ) নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে।
আত্বা বলেন, 'উমার বিন আব্দুল আযীয প্রত্যেক রাত্রে ফকীহগণকে সমবেত করতেন এবং সকলে মিলে মৃত্যু, কিয়ামত ও আখেরাতের কথা আলোচনা করে কাঁদতেন।
সালেহ মুররা বলতেন, সামান্য ক্ষণ মরণকে বিস্মৃত হলেই আমার হৃদয় মলিন হয়ে যায়।”
দাক্কাক বলেন, 'যে ব্যক্তি মরণকে স্মরণ করে সে তিনটি উপকার লাভ করে; সত্বর তওবা, স্বল্পে তুষ্টি, আর আলস্যহীন ইবাদত। পক্ষান্তরে যে মরণের কথা ভুলেই থাকে সেও তিনটি জিনিস সত্বর লাভ করে; তওবায় দীর্ঘসূত্রতা, যথেষ্ট সব কিছু পেয়েও অতৃপ্তিবোধ এবং ইবাদতে অলসতা।
মরণাপন্ন ব্যক্তিকে দর্শন করা, মৃত্যু যন্ত্রণায় তার কঠিন ভয়ানক কাতরতা লক্ষ্য করা এবং মরণের পরে মৃতব্যক্তির সেই করুণ মুখ-দৃশ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করায় হৃদয়ের সকল ভোগেচ্ছা উড়ে যায় এবং মনের সকল বাসনা ও উল্লাস উবে যায়। এর ফলে মানুষ সুগভীর নিদ্রা ত্যাগ করে চক্ষু মুছে উঠতে পারে, শরীরের জন্য অতিরিক্ত আরামকে হারাম করে। শুরু করে নেক আমল দ্বারা প্রস্তুতি নিতে এবং বৃদ্ধি করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে তার পরিশ্রম ও প্রয়াস।
হাসান বসরী (রঃ) এর ব্যাপারে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি এক রোগীকে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে দেখলেন, তার মৃত্যু আসন্ন। মৃত্যুকালীন তার ঐ যন্ত্রণা ও কঠিন কষ্ট দেখার পর যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন তাঁর দেহের রঙ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির লোকে বলল, আল্লাহ আপনাকে রহম করুক! খানা তো খেয়ে নিন। তিনি বললেন, হে আমার পরিজনবর্গ! তোমরা তোমাদের খানা খেয়ে নাও। কারণ আজ আমি এমন বিপদ সঙ্কট দর্শন করেছি, যার জন্য তা আমার নিকট পৌঁছনো পর্যন্ত একাধারে আমল করে যাব।” (আত্তাযকিরাহ কুরতুবী ১২ পৃঃ)
কথিত আছে যে, তিনি এক জানাযায় শরীক হয়ে একজন লোককে উদ্দেশ্য করে এবং কবরে রাখা লাশের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, 'দেখ, ওকে কবরে। একটু পরে প্রশ্ন করা হবে আর ও উত্তর দেবে। অতঃপর ওকে যদি দুনিয়ায় পুনরায় আসতে দেওয়া হয়, তাহলে কি ও ভালো কাজ করবে? লোকটি উত্তরে বলল, অবশ্যই করবে। তিনি বললেন, তাহলে তুমি তো এখন দুনিয়াতেই আছ, তুমি ভালো কাজ করে যাও।” মরণকে বরণ করবে না এমন কে আছে? আজ অথবা কাল সকলের জীবনের সেই বাতি নিভে যাবে। মানুষ মরণকে স্মরণে না রাখলেও মরণ কোন দিন তাকে ভুলে যাবে না। অচিরেই তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে পরপারের চির সুখ সাগরে অথবা দুঃখ পাথারে।
সুতরাং জ্ঞানী মাত্রই বিপদ স্মরণ করে তার হাত থেকে মুক্তির উপায় ও অস্ত্র সংগ্রহ করতে উঠে পড়ে লাগে। পক্ষান্তরে উদাসীন খালি হাতে থেকে বিপদের পঞ্জায় নিজেকে সঁপে দেয়।। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, সর্বসুখ-বিনাশী মৃত্যুকে তোমরা অধিকাধিক স্মরণ কর।
(তিরমিযী, নাসাঈ, হাকেম প্রমুখ। কারণ, যে ব্যক্তি কোন সঙ্কটে তা স্মরণ করবে সে ব্যক্তির জন্য সে সঙ্কট সহজ হয়ে যাবে এবং যে ব্যক্তি তা কোন সুখের সময়ে স্মরণ করবে সে ব্যক্তির জন্য সুখ তিক্ত হয়ে উঠবে।” (বাইহাকী, ইবনে হিব্বান, সহীহুল জামে ১২১০- ১২১১নং)
“পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়
মরণ এক দিন মুছে দেবে সকল রঙ্গিন পরিচয়।
মিছে এই মানুষের বন্ধন।
মিছে মায়া স্নেহ প্রীতি ক্রন্দন।
মিছে এই জীবনের রঙধনু শত রঙ
মিছে এই দু’দিনের অভিনয়।
পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়।
মিছে এই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
মিছে গান কবিতার ছন্দ
মিছে এই অভিনয় নাটকের মঞ্চে
মিছে এই জয় আর পরাজয়।
পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়,
মরণ এক দিন মুছে দেবে সকল রঙ্গিন পরিচয়।।”
**********
“ভেবে দেখ ওরে মন!
এ সংসার এক পান্থশালা,
একদল আসে হায়
অন্যদল চলে যায়
স্বার্থপূর্ণ এ জীবন
দু’দিনের খেলা।”
কেউ ব্যাধিগ্রস্ত ও অসুস্থ থাকলে প্রত্যেক মুসলিমের উচিত তাকে দেখা করতে যাওয়া এবং বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা, সাহস ও ধৈর্যধারণে উৎসাহ দেওয়া। এটা প্রত্যেক মুসলিমের অপরের নিকট হতে প্রাপ্য অধিকার, যা পালন করলে অজস্র পুণ্য লাভ হয়ে থাকে। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “একজন মুসলিমের অপর মুসলিমের উপর পাঁচটি অধিকার রয়েছে; সালামের জওয়াব দেওয়া, রোগীকে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞাসাবাদ করা, জানাযায় অংশগ্রহণ করা, দাওয়াত কবুল করা এবং হাঁচির জওয়াবে (আলহামদু লিল্লাহ বলা শুনলে) য়্যারহামুকাল্লাহ’ বলা।” (বুখারী ১২৮০নং, মুসলিম ২ ১৬২নং)
“মুসলিম যখন তার কোন মুসলিম (রোগী) ভাইকে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যায় তখন তার নিকট ফিরে না আসা পর্যন্ত জান্নাতের বাগানে অবস্থান। করে।” (মুসলিম ২৫৬৮নং)।
কোন মুসলিম সকালে কোন মুসলিম (রোগীকে) সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৭০ হাজার ফিরি তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। আর সন্ধ্যা বেলায় সাক্ষাৎ করলে সকাল পর্যন্ত ৭০ হাজার ফিরিশতা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং জান্নাতে তার জন্য এক বাগান রচনা করা হয়।” (তিরমিযী, ১৮৩নং, সহীহ ইবনে মাজাহ ১১৮৩নং)
যেমন রোগীর উচিত, আল্লাহর নির্ধারিত তকদীরে সন্তুষ্ট থাকা, নিজের ভাগ্যের মসীবতে ধৈর্য রাখা এবং আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখা যে, আল্লাহর রহমত ও করুণা অসীম, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন ইত্যাদি। কারণ আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেন, “আল্লাহ তাআলার প্রতি সুধারণা রাখা ছাড়া অন্য অবস্থায় তোমাদের কেউ যেন মৃত্যুবরণ না করে।” (মুসলিম ২৮৭৭, ইবনে মাজাহ ৪ ১৬৭ নং)
তবে আল্লাহর ক্ষমা ও রহমতের আশা করার সাথে সাথে স্বকৃত পাপের শাস্তির আশঙ্কা ও ভয় তার মনে অবশ্যই থাকবে। আনাস (রাঃ) বলেন, “একদা নবী (ﷺ) একজন মরণাপন্ন যুবকের নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে বললেন, “কেমন লাগছে তোমাকে?” যুবকটি বলল, আল্লাহর কসম; হে আল্লাহর রসূল! আমি আল্লাহর (রহমতের) আশাধারী। তবে স্বকৃত পাপের ব্যাপারেও ভয় হচ্ছে।
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বললেন, “এহেন অবস্থায় যে বান্দারই হৃদয়ে আল্লাহর রহমতের আশা ও আযাবের ভয় পাশাপাশি থাকে, সে বান্দাকেই আল্লাহ তার আকাঙ্খিত বস্ত্র প্রদান করে থাকেন। আর যা সে ভয় করে তা হতে তাকে নিরাপত্তা দান করেন।” (তিরমিযী ৯৯৪ ইবনে মাজাহ ৪২৬১, সহীহ তিরমিযী ৭৯৫ নং)
রোগ ও পীড়া যত বেশীই যন্ত্রণাদায়ক হোক না কেন তবুও মৃত্যুকামনা করা রোগীর কোনক্রমেই উচিত নয়। কেননা, উম্মুল ফাযল (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূলের চাচা পীড়িত হলে তিনি তাঁর নিকট এলেন। আব্বাস মৃত্যুকামনা প্রকাশ করলে আল্লাহর রসূল (ﷺ) তাঁকে বললেন, “হে চাচাজান! মৃত্যু কামনা করেন না। কারণ, আপনি নেক লোক হলে এবং হায়াত বেশী পেলে বেশী-বেশী নেকী করে নিতে পারবেন; যা আপনার জন্য মঙ্গলময়। আর গোনাহগার হলে এবং বেশী হায়াত পেলে আপনি গোনাহ থেকে তওবা করার সুযোগ পাবেন, সুতরাং তাও আপনার জন্য মঙ্গলময়। অতএব মৃত্যুকামনা করেন না। ” (হাকেম ১/৩৩৯, আহকামুল জানায়েয, আলবানী ৪ পৃঃ)।
তাই রোগীর উচিত, অধিকাধিক তওবা-ইস্তিগফার করা এবং অনুশোচনার সাথে আল্লাহ-অভিমুখী হওয়া। রোগযন্ত্রণায় ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহর নির্ধারিত তকদীর নিয়ে রাজী থেকে এ কথা বিশ্বাসে রাখা যে, রোগজনিত পীড়া ভোগান্তির প্রতিদান সে অবশ্যই লাভ করবে। আর উচিত, যথাসম্ভব শেষ সুযোগে নেক কাজ করতে বেশী প্রয়াসী হওয়া। কিন্তু যদি একান্তই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গার উপক্রম হয় এবং মরণ চাইতেই হয়, তাহলে এই দুআ বলে চাওয়া উচিত,
اللهم أحيني ما كانت الحياة خيرًا لي، وتوفني إذا كانت الوفاة خيرًا لي
উচ্চারণঃ- আল্লাহুম্মা আহয়িনী মা কা-নাতিল হায়াত খাইরাল লী অতাওয়াফ্ফানী ইযা কা-নাতিল অফা-তু খাইরাল লী।
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! যতক্ষণ বেঁচে থাকা আমার জন্য কল্যাণকর ততক্ষণ। আমাকে জীবিত রাখ। আর যদি মৃত্যু আমার জন্য কল্যাণকর হয় তবে আমাকে মরণ দাও। (বুখারী ৫৬৭১, মুসলিম ২৬৮০ নং)
উল্লেখ্য যে, পীড়ার তাড়না বা মানসিক যন্ত্রণার চাপে আত্মহত্যা করা মহাপাপ। আত্মঘাতীর জন্য রয়েছে মহাশাস্তির ঘোষণা যে যে ভাবে আত্মহত্যা করবে তাবে ঠিক সেই ভাবেই জাহান্নামে কষ্ট ও শাস্তি ভোগ করতে হবে। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি পাহাড়ের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুনে সর্বদা চিরকাল ধরে অনুরূপ ঝাঁপ দিতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুনে সর্বদা চিরকাল ধরে হাতে বিষ নিয়ে পান করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি ছুরি দ্বারা আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুনে সর্বদা চিরকালের জন্য হাতে ছুরি নিয়ে নিজ পেটে আঘাত করতে থাকবে। (বুখারী ৫৭৭৮নং)
মৃত্যুর সময় যখন নিকটবর্তী হয়, তখন বহু মানুষ বুঝতে পারে যে, এবার তার আর সময় নেই। সুতরাং জ্ঞানী ও সৎ সেই ব্যক্তি, যে তা বুঝতে না পারলেও মরণের জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। সর্বদা ধ্যানে-মনে রাখে ইবনে উমার (রাঃ) এর এই কথা, সন্ধ্যা হলে তুমি আর সকাল হওয়ার ভরসা করো না এবং সকাল হলে আর সন্ধ্যার ভরসা করো না--- ” (বুখারী, মিশকাত ১৬০৪ নং) বরং পরপারের সেই পরম সুখ ও অনাবিল শান্তির আশায় ও লোভে পথের উৎকৃষ্ট পাথেয় সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত হয়। কারণ, মরণের পর ঈমান ও আমল ছাড়া আর কিছু উপকারে আসতে পারে না। পিয়ারা নবী (ﷺ) বলেন, “তিনটি জিনিস মরণ-পথের পথিকের অনুগমন করে; তার পরিজন, আমল এবং ধন-সম্পদ। কিন্তু দুটি জিনিস (মধ্যপথ হতে) ফিরে আসে এবং অবশিষ্ট একটি তার সঙ্গ দেয়; তার পরিজন ও ধন-সম্পদ ফিরে আসে এবং তার আমল (কৃতকর্ম) তার সাথী হয়।” (বুখারী ৬৫১৪, মুসলিম ২৯৬০নং)
মরণের প্রস্তুতি স্বরূপ কারো কাছে ঋণী থাকলে সম্ভব হলে পরিশোধ করে দেবে। কারো অধিকার ছিনিয়ে থাকলে, কারো হক আত্মসাৎ করে থাকলে অথবা কারো প্রতি কোন অন্যায় ও অত্যাচার করে থাকলে তার অধিকার ফিরিয়ে দেবে এবং তার নিকট ক্ষমা চেয়ে নেবে। নচেৎ সেদিন ভীষণ পস্তানি হবে যেদিন এর পরিবর্তে তার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগকারী ব্যক্তিকে তার নেকী থেকে প্রাপ্য হক প্রদান করা হবে। আর নেকী নিঃশেষ হলে বা না থাকলে তাদের গোনাহ নিয়ে এই ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়া হবে। রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “সেদিন আসার পূর্বে পূর্বে কারো উপর যদি তার কোন ভায়ের দেহ, সম্ভ্রম বা সম্পদের অধিকার ও যুলুম থেকে থাকে, তবে তা সে। যেন তা আদায় করে প্রতিশোধ দিয়ে দেয় যেদিন দীনার বা দিরহাম (টাকা-পয়সার মাধ্যমে মুক্তিপণ) গ্রহণ করা হবে না। বরং তার (ঐ অত্যাচারীর) কোন নেক আমল থাকলে তা ছিনিয়ে নিয়ে তার প্রতিবাদী (অত্যাচারিত ব্যক্তি)কে প্রদান করা হবে। আর যদি তার কোন নেক আমল না থাকে, তাহলে তার প্রতিবাদীর গোনাহ নিয়ে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে।” (বুখারী ২৪৪৯নং, মুসনাদে আহমাদ ২/৫০৬, বাইহাকী ৩/৩৬৯)
কোন অসুবিধার কারণে কারো প্রাপ্য হক পরিশোধ করতে অক্ষম হলে রোগী তার ওয়ারেসীনদের অসিয়ত করে যাবে, যেন তারা তার মৃত্যুর পর তা আদায় করে দেয়। জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, “উহুদ যুদ্ধের সময় উপস্থিত হলে রাত্রিকালে আমার আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, 'আমার মনে হচ্ছে যে, নবী (ﷺ) এর সাহাবাবর্গের মধ্যে যারা খুন হবেন তাদের মধ্যে আমি প্রথম। আল্লাহর রসূল (ﷺ) ছাড়া আমার সবচেয়ে প্রিয়তম জিনিস আমি তোমাকেই ছেড়ে যাব। আমার কিছু ঋণ আছে, তা তুমি পরিশোধ করে দিও। আর ভাইদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। অতঃপর সকাল হলে দেখলাম, তিনিই প্রথমে খুন হয়েছেন।” (বুখারী ১৩৫ ১নং)।
প্রয়ােজনীয় অসিয়ত যতশীঘ্র সম্ভব প্রস্তুত করা বা লিখে দেওয়া কর্তব্য। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “কোন মুসলিমের জন্য সমীচীন নয় যে, তার অসিয়ত করার কিছু থাকলে তা লিখে মাথার নিকট প্রস্তুত না রেখে সে দুটি রাত্রিও অতিবাহিত করে।” ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, “আমি যখন থেকে নবী (ﷺ)-এর নিকট উক্ত কথা শুনেছি, তখন থেকে আমার নিকট অসিয়ত প্রস্তুত না রেখে একটি রাত্রি যাপন করিনি। (বুখারী ২৭৩৮, মুসলিম ১৬২৭নং)
যে সকল নিকটাত্মীয় রোগীর মীরাস থেকে বঞ্চিত (যেমন অন্য ছেলের) বর্তমানে মৃত ছেলের ছেলেরা তাদের নামে (উইল) করা ওয়াজেব। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন,
كُتِبَ عَلَيْكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ إِن تَرَكَ خَيْرًا الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ بِالْمَعْرُوفِ ۖ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ
অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে যখন কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় এবং সে যদি ধনসম্পত্তি রেখে যায়, তবে পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য ন্যায় সঙ্গত অসিয়ত করার বিধান তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। মুত্তাকীদের পক্ষে তা অবশ্য পালনীয়। (সুরা বাকারাহ ১৮০ আয়াত)
কিন্তু মীরাসের আয়াতে যথানির্ধারিত ভাগ পিতা-মাতা এবং অন্যান্য ওয়ারেস আত্মীয়দেরকে প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং এ বিধান কেবল তাদের জন্য বহাল আছে যারা মীরাস থেকে বঞ্চিত। (তফসীরে সা’দী ৬৮ পৃঃ)
তবে উক্ত অসিয়ত যেন রোগীর এক তৃতীয়াংশ জমি সম্পদ থেকে হয়। কারণ, এক তৃতীয়াংশের অধিক মালে অসিয়ত করা বৈধ নয়। বরং তার চাইতে আরো কম হলে সেটাই উত্তম। সা’দ বিন আবী অক্কাস (রাঃ) বলেন, আমি বিদায়ী হজ্জের সফরে নবী (ﷺ) এর সাথে ছিলাম। সেখানে এমন ব্যাধিগ্রস্ত হলাম যাতে আমি নিজেকে মৃত্যুর নিকটবর্তী মনে করলাম। আল্লাহর রসূল (ﷺ) আমাকে দেখা করতে এলে আমি তাকে বললাম, 'হে আল্লাহর রসূল! আমার ধন-মাল তো অনেক বেশী। আর একটি কন্যা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি কি আমার দুই তৃতীয়াংশ মাল অসিয়ত করতে পারি?' তিনি বললেন, “না।” আমি বললাম, তবে অর্ধেক মাল?’ বললেন, “না।” তাহলে এক তৃতীয়াংশ?' তিনি বললেন, “হ্যাঁ এক তৃতীয়াংশ করতে পার। তবে এক তৃতীয়াংশও বেশী। হে সা’দ! তুমি তোমার ওয়ারেসীনদেরকে লোকদের নিকট হাত পেতে খাবে এমন দরিদ্র অবস্থায় ছেড়ে যাওয়ার চেয়ে তাদেরকে ধনীরূপে ছেড়ে যাওয়া অনেক ভালো।” (বুখারী ১২৯৫, মুসলিম ১৬২৮নং প্রমুখ)
অসিয়ত করার ব্যাপারে দুইজন দ্বীনদার মুসলিমকে সাক্ষী মানা জরুরী। সেরূপ কোন মানুষ না পেলে ২জন বিশ্বস্ত অমুসলিম ব্যক্তিকেও সাক্ষী রেখে নিতে হবে। যাতে সন্দেহ ও মতবিরোধের সময় তাদের সাক্ষ্য দ্বারা নিশ্চয়তা লাভ সম্ভব হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا شَهَادَةُ بَيْنِكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ حِينَ الْوَصِيَّةِ اثْنَانِ ذَوَا عَدْلٍ مِّنكُمْ أَوْ آخَرَانِ مِنْ غَيْرِكُمْ إِنْ أَنتُمْ ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ فَأَصَابَتْكُم مُّصِيبَةُ الْمَوْتِ ۚ تَحْبِسُونَهُمَا مِن بَعْدِ الصَّلَاةِ فَيُقْسِمَانِ بِاللَّهِ إِنِ ارْتَبْتُمْ لَا نَشْتَرِي بِهِ ثَمَنًا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَىٰ ۙ وَلَا نَكْتُمُ شَهَادَةَ اللَّهِ إِنَّا إِذًا لَّمِنَ الْآثِمِينَ * فَإِنْ عُثِرَ عَلَىٰ أَنَّهُمَا اسْتَحَقَّا إِثْمًا فَآخَرَانِ يَقُومَانِ مَقَامَهُمَا مِنَ الَّذِينَ اسْتَحَقَّ عَلَيْهِمُ الْأَوْلَيَانِ فَيُقْسِمَانِ بِاللَّهِ لَشَهَادَتُنَا أَحَقُّ مِن شَهَادَتِهِمَا وَمَا اعْتَدَيْنَا إِنَّا إِذًا لَّمِنَ الظَّالِمِينَ
অর্থাৎ, হে ইমানদারগণ! তোমাদের কারো যখন মৃত্যুসময় উপস্থিত হয় তখন অসিয়ত করার সময় তোমাদের মধ্যে হতে দুজন ন্যায়পরায়ণ লোককে সাক্ষী রাখবে। তোমরা সফরে থাকলে এবং তোমাদের মৃত্যুরূপ বিপদ উপস্থিত হলে তোমাদের ছাড়া অন্য লোকদের (অমুসলিমদের) মধ্য হতে দুজন সাক্ষী মনোনীত করবে। তোমাদের সন্দেহ হলে নামাযের পর তাদেরকে অপেক্ষমাণ রাখবে। অতঃপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে, আমরা ওর বিনিময়ে কোন মূল্য গ্রহণ করব না - যদি সে আত্মীয়ও হয় এবং আমরা আল্লাহর সাক্ষ্য গোপন করব না, করলে আমরা নিশ্চয় পাপীদের অন্তর্ভুক্ত হব। তবে যদি এ প্রকাশ পায় যে, তারা দুজন অপরাধে লিপ্ত হয়েছে তবে যাদের স্বার্থহানি ঘটেছে তাদের মধ্য হতে নিকটতম দুজন তাদের স্থলবর্তী হবে এবং আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে, আমাদের সাক্ষ্য অবশ্যই তাদের হতে। অধিকতর সত্য এবং আমরা সীমালংঘন করি নি, করলে অবশ্যই আমরা যালেমদের দলভুক্ত হব।” (সূরা মায়েদাহঃ ১০৬-১০৭ আয়াত)
সতর্কতার বিষয় যে, যারা ওয়ারেস হবে তাদের নামে যেমন, পিতা-মাতা পুত্র বা কন্যা অথবা বিবির নামে অসিয়ত করা (জমি-জায়গা লিখা) এবং কোন ওয়ারিস (যেমন, বিবাহিত কন্যা বা স্ত্রী)কে মীরাস থেকে বঞ্চিত করা বৈধ নয়। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক হকদারকে তার প্রাপ্য হক প্রদান করেছেন। সুতরাং কোন ওয়ারেসের জন্য অসিয়ত বৈধ নয়।” (আবু দাউদ ২৮৭০, তিরমিযী, ২১২০, সহীহ আবু দাউদ ২৮৯৪নং প্রমুখ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لِّلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ ۚ نَصِيبًا مَّفْرُوضًا
অর্থাৎ, মাতা-পিতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং মাতা-পিতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তাতে তা অল্পই হোক অথবা বেশীই হোক। প্রত্যেকের জন্য এক নির্ধারিত অংশ রয়েছে। (সুরা নিসা ৭ আয়াত)
আল্লাহ তাআলা মীরাসের আয়াতের শেষ অংশে বলেন,
مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصَىٰ بِهَا أَوْ دَيْنٍ غَيْرَ مُضَارٍّ ۚ وَصِيَّةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَلِيمٌ
অর্থাৎ, --- এ ছাড়া যা অসিয়ত করে তা দেওয়া এবং ঋণ পরিশোধের পর যদি এ কারো জন্য হানিকর না হয়। এ হল আল্লাহ নির্দেশ, বস্তুতঃ আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল। (সুরা নিসা ১২ আয়াত)।
সুতরাং কোন ওয়ারেসের জন্য অসিয়ত করা অন্যায় করলেও এমন ইনসাফহীন অসিয়ত বতিলরূপে পরিগণিত হয়। কারণ, নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ (দ্বীনের) ব্যাপারে নতুন কিছু উদ্ভাবন করে, ওর অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী ২৭৯৭, মুসলিম ১৭ ১৮নং, প্রমুখ।
যেহেতু বর্তমান যুগে দ্বীনে বিশেষ করে জানাযায় বহু ভেজাল অনুপ্রবেশ করে বহু বিদআত রচিত হয়ে সুন্নাহর আকার ধারণ করেছে, সেহেতু মরণাপন্ন ব্যক্তির এ অসিয়ত করাও উচিত এবং ওয়াজেব যে, তার কাফন-দাফন ইত্যাদি শেষক্রিয়া যেন সুন্নাহর পদ্ধতি অনুযায়ী হয় এবং এ বিষয়ে কোন প্রকারে বিদআতকে প্রশ্রয় না দেওয়া হয়। এমনি অসিয়ত বহু সলফ তাঁদের ওয়ারেসীনদেরকে করে গেছেন---যেমন ভূমিকায় কিছু উল্লিখিত হয়েছে। তাছাড়া আল্লাহ তাআলার সেই বাণী ও নির্দেশের উপরেও আমল হয়, যাতে তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারপরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যার নিয়ন্ত্রণভার অর্পিত আছে নির্মমহৃদয়, কঠোর-স্বভাব ফিরিশ্তাগণের উপর; যারা আল্লাহ যা আদেশ করেন তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদিষ্ট হয়। তাই করে। (সুরা তাহরীম ৬ আয়াত)
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম,
আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, অসসালা-তু অসসালামু আলা রাসূলিহিল কারীম। আমি------আল্লাহ তার রসূল ও পরকালে বিশ্বাস রেখে সজ্ঞান ও সুস্থ মস্তিষ্কে আমার ওয়ারেসীনদেরকে সেই অসিয়ত করে যাচ্ছি; যা ইব্রাহীম ও ও ইয়াকুব (আঃ) তাদের পুত্রগণকে করেছিলেন, “হে পুত্রগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দ্বীন (ইসলাম)কে মনোনীত করেছেন। সুতরাং আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হয়ে তোমরা কখনও মৃত্যুবরণ করো না।” (সুরা বাক্বারাহ ১৩২ আয়াত) আর যা রসূল (ﷺ) তাঁর উম্মতকে করেছিলেন, “তোমরা নামাযে যত্নবান হও।”
অতঃপর তারা যেন সদা আল্লাহর ভয় রাখে, আপোসে সমিলে ও সদ্ভাবে বসবাস করে, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করে এবং সেই কাজ করে, যাতে আমার ও তাদের সকলের জন্য ইহ-পরকালে কল্যাণকর।
আমার মৃত্যুর পর আমার শোকে যেন কেউ মাতম করে কান্না না করে। জানাযার ব্যাপারে সকল বিদআত থেকে দুরে থাকে এবং সুন্নতী তরীকায় আমার শেষক্রিয়া সম্পাদন করে। আমি শরীয়তের পরিপন্থী প্রত্যেক কর্ম ও কথা থেকে সম্পর্কহীন। আমার সম্পত্তি বা টাকার এত পরিমাণ অমুক মসজিদ, মাদ্রাসা বা ব্যক্তিকে উইল করে যাচ্ছি। এই আমার অসিয়ত। “সুতরাং যে এ (অসিয়ত) শোনার পর তাতে কোন রকম পরিবর্তন সাধন করবে, তবে তার পাপ তাদের উপরেই বর্তাবে যারা তাতে পরিবর্তন করবে।” (সুরা বাকারাহ ১৮১ আয়াত) আর আল্লাহর নিকট সকলের জন্য সৎকর্মের তওফীক এবং শুভমরণ কামনা করি। অস্বাল্লাল্লাহু আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ, অআলা আ-লিহি অসাহবিহী আজমাঈন।
ইতি-
তারীখঃ ----------- (স্বাক্ষর) ---------
সাক্ষীঃ (১) -------- সাক্ষী (2) --------
প্রস্তুতিস্বরূপ রোগী তার নখ কেটে, বগল ও নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করে রাখবে। মরণ আসন্ন বুঝে খুবাইব (রাঃ) এরূপ করেছিলেন। (বুখারী ৩৯৮৯, আবুদাউদ ২৬৬০নং)
রোগী তার মরণের সময় একান্ত নিকটবর্তী বুঝতে পারলে আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর অনুকরণে নিম্নের দুআ করবে।
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي وَارْحَمْنِي وَأَلْحِقْنِي بِالرَّفِيقِالأَعْلَى
উচ্চারণ, আল্লা-হুম্মাগফিরলী অরহামনী অআলহিক্বনী বিররাফীক্বীল আ’লা।
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর, দয়া কর এবং সুমহান বন্ধুর সাথে। মিলিত কর। (বুখারী ৪০৮৬ক, মুসলিম ৪৪৭ ৪ছু তিরমী ৩৪ ৮ক, ইবনে মাজাহ ১৬০৮ ক)
“জীবন বলিছে মাটির মায়ায় আবার আসিব ফিরে,
বলিছে মরণ নিয়ে যাব তোরে মরণ-সাগর তীরে।”
মুমূষু ব্যক্তির প্রাণ ওষ্ঠাগত-প্রায় হওয়া বুঝলে সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের যা করা উচিত তা হল নিম্নরূপঃ
১। কলেমা “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ স্মরণ করিয়ে দেওয়া। পিয়ারা নবী (ﷺ) বলেন, তোমরা তোমাদের মরণাপন্ন ব্যক্তিকে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ স্মরণ করিয়ে দাও।” (তিরমিযী ৯৭৬, নাসাঈ ১৮২৬, ইবন মাজাহ ১৪৪৪ প্রমুখ।)
“যে ব্যক্তির মৃত্যুর সময় সর্বশেষ কথা “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ হবে সে একদিন জান্নাত প্রবেশ করবে - যদিও সে তার পূর্বে কিছু আযাব ভোগ। করবে।” (মাওয়ারিদুয যামআন ৭১৯নং, ইরওয়াউল গালীল ৬৭৯নং)
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই’ একথা জানা অবস্থায় মারা যায় সে জান্নাত প্রবেশ করবে।” (মুসলিম ৩৮ক, আহমাদ ৪৩৪ক)।
অতএব এই শেষ মুহূর্তে যদি সে এই কলেমা উচ্চারণ করে ও হৃদয়ে এর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় রেখে মরণের হাতে আত্মসমর্পণ করতে পারে তাহলে সে শুরু থেকে না হলেও কোন এক সময়ে জান্নাতে প্রবেশ করে সেখানে চিরস্থায়ী হবে। তালকীনের অর্থ কেবল মরণাপন্ন ব্যক্তির সামনে কলেমা পাঠ করে শোনানোই নয় বরং ঐ কলেমা পাঠের আদেশও তাকে করা যায়। (আহকামুল জানায়েয আলবানী ১০পুঃ)।
আনাস (রাঃ) বলেন, একদা আল্লাহর রসূল (ﷺ) আনসারদের এক (মরণাপন্ন) ব্যক্তিকে দেখা করতে গিয়ে বললেন, “হে মামা! লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বল।” লোকটি বলল, মামা নাকি চাচা?” তিনি বললেন, “বরং মামা।” অতঃপর লোকটি বলল, “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলা কি আমার জন্য কল্যাণকর?’ নবী (ﷺ) বললেন, “অবশ্যই।” (আহমাদ ১২৮৫নং)
অনুরূপ আদেশ করেছিলেন তাঁর চাচা আবু তালেবকেও; বলেছিলেন, “হে চাচা! আপনি “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলুন---।” (বুখারী ১৩৬০, মুসলিম, নাসাঈ, আহমদ ৫/৪৩৩)
অবশ্য কলেমা বলার জন্য বারবার আদেশ করা উচিত নয়। কারণ সেই কঠিন মৃত্যু যন্ত্রণার সময় বিরক্ত হয়ে তা বলতে অস্বীকার করতে পারে অথবা বিরক্ত হয়ে কোন অসমীচীন কথাও বলে ফেলতে পারে। সুতরাং কলেমার প্রতি বিরক্তিভাব প্রকাশ পেলে মৃতের শেষ পরিণাম অশুভ হয়ে যাবে। অতএব নম্রতার সাথে ধীরে ধীরে তাকে কলেমা উচ্চারণ করাতে চেষ্টা করতে হবে। এর পরেও যদি সে না বলে, তাহলে তার ব্যাপার আল্লাহর হাতে। আল্লাহর নিকট আমরা শুভ পরিণাম প্রার্থনা করি। আমীন।
মরণাপন্ন ব্যক্তি কলেমা পাঠ করে নিলে তার নিকট উপস্থিত সকল ব্যক্তিবর্গের উচিত, আর কিছু না বলে চুপ থাকা এবং তার সাথে অন্য কথা না বলা; যাতে তার সর্বশেষ কথা ঐ কলেমাই হয়। নচেৎ তারপর কথা বললে পুনরায় কলেমার তালকীন করা কর্তব্য। (সাবউনা সুআলান ফী আহকামিল জানাইয ইবনে উষাইমীন ৪ পৃঃ)
এ স্থলে কতকগুলো বিষয় জেনে রাখা জরুরীঃ
১। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ’ বলে অথবা আহলে বায়ত বা অন্য কোন বুযুর্গ ও অলীর নাম স্মরণ ও স্বীকার করানো বিদআত। (আহকামুল জানাই অবিদাউহা, বিদআত নং ৩)।
২। মুমুর জন্য দুআ করা; আল্লাহ! ওকে ক্ষমা করে দাও। আল্লাহ! ওর মরণকষ্ট আসান করে দাও --- ইত্যাদি।
৩। কোন প্রকারের মন্দ কথা বা অন্যায় মন্তব্য না করা। কারণ, নবী (ﷺ) বলেন, যখন তোমরা কোন রোগী বা মরণাপন্ন ব্যক্তির নিকট উপস্থিত থাকবে, তখন ভালো কথাই বলো। কেননা, তোমরা যা বলবে তার উপর ফিরিস্তাবর্গ ‘আমীন-আমীন’ বলবেন।” (মুসলিম ১৫২৭ক, তিরমিযী ৮৯৯ক, প্রমুখ) সুতরাং এ মুহূর্তে দুআ ও বন্দুআ উভয়ই কবুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তাই এই সময় মুর্খ লোক ও বাজে মেয়েদের বাজে মন্তব্য এবং অহেতুক কলকলানি থেকে ঐ পরিবেশকে মুক্ত ও শান্ত রাখা উচিত। যাতে মুমূর্ষ ব্যক্তি কলেমা শুনতে, বুঝতে ও বলতে পারে এবং দুআময় পরিবেশে তার জীবনাবসান ঘটে। ওয়ারেসীনদের উচিত, এ কাজে মুমুর্ষকে সর্বতোভাবে সহায়তা করা এবং মীরাস নিয়ে এই মুহূর্তে তার সামনে আপোসে বচসা না করা।
এই সময় মরণাপন্ন ব্যক্তির নিকট সুরা ইয়াসীন বা অন্যান্য সুরা পড়ার কথা শুদ্ধ হাদীসে নেই। সুতরাং এখন হতে সেই দাফন ও কবর যিয়ারত পর্যন্ত (নামাযে ছাড়া) কোন স্থানেই কুরআনের কোন আয়াত পড়া বিহিত নয়। অবশ্য মরণের সময় মরণােন্মুখ ব্যক্তি কুরআন তেলাঅত শুনতে চাইলে সে কথা ভিন্ন।
অন্যথা মৃতব্যক্তির শিয়রে কুরআন রাখা, পার্শ্বে বসে লোয়ানোর আগে পর্যন্ত অবিরাম কুরআন পড়া, (কোন দুর্গন্ধ না থাকলেও) ধূপধুনো দেওয়া, সারারাত্রি ব্যাপী বাতি জ্বালিয়ে রাখা, অপবিত্র (ঋতুমতী) কাউকে লাশের পাশ ঘেঁষতে না দেওয়া ইত্যাদি বিদআত। (আহকামুল জানাইয ২৪৪ পৃঃ)।
তদনুরূপ মরণাপন্ন ব্যক্তিকে কেবলামুখ করা প্রসঙ্গে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। বরং সাঈদ বিন মুসাইয়িব এ কাজকে মকরূহ মনে করেছেন। যুরআহ বিন আব্দুর রহমান সাজুর রহমান সাঈদ বিন মুসাইয়িবের মৃত্যু রোগের সময় তার নিকট উপস্থিত ছিলেন। আর ছিলেন আবু সালামাহ বিন আব্দুর রহমানও। এক সময় সাঈদ জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলে আবু সালামাহ তাঁর বিছানাটাকে কেবলামুখ করতে আদেশ করলেন। জ্ঞান ফিরে পেলে তিনি বললেন, 'তোমরা আমার বিছানা ঘুরিয়ে দিয়েছ?!’ সকলে বলল, হ্যাঁ। একথা শুনে তিনি আবু সালামার প্রতি তাকিয়ে বললেন, 'আমার মনে হয় তোমার জ্ঞানে এ কাজ হয়েছে? আবু সালামাহ বললেন, 'আমিই ওদেরকে আদেশ করলাম। এরপর সাঈদ তার বিছানাকে পূর্বাবস্থায় ঘুরিয়ে দিতে আদেশ করলেন। (ইবনে আবী শাইবাহ ৪/৭৬)।
মুমুর্ষ ব্যক্তির মাধ্যমে কোন মৃতব্যক্তিকে সালাম পৌছানো বিদআত এ ব্যাপারে যে সলফের আমল বর্ণিত করা হয় তা সহীহ নয়। (যয়ীফ ইবনে মাজাহ ৩১০নং, মিশকাত ১৬৩৩নং)
ইসলাম পেশ করলে এই শেষ মুহূর্তে মুসলিম হয়ে যেতে পারে এই আশায়। কোন কাফেরের মরণদশা দেখতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম পেশ করা উত্তম কাজ। আনাস (রাঃ) বলেন, একজন ইহুদী কিশোর নবী (ﷺ) এর খিদমত করত। সে পীড়িত হলে মহানবী (ﷺ) তাকে দেখা করতে এলেন এবং তার শিথানে বসে বললেন, “ইসলাম গ্রহণ কর (তুমি মুসলিম হয়ে যাও)।” তার এই কথা শুনে সে তার পিতার দিকে (তার মত জানতে) দৃষ্টিপাত করল। তার পিতা তার নিকটেই বসে ছিল। সে বলল, আবুল কাসেম (ﷺ)-এর কথা তুমি মেনে নাও। ফলে কিশোরটি মুসলমান হয়ে গেল। অতঃপর নবী (ﷺ) এই বলতে বলতে বের হয়ে গেলেন, “সেই আল্লাহর সকল প্রশংসা যিনি ওকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে নিলেন। তারপর কিশোরটি মারা গেলে তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা তোমাদের এক সাথীর উপর (জানাযার নামায পড়।” (বুখারী ১২৬৮ক)।
এখানে লক্ষণীয় যে, কোন কাফের শেষ মুহূর্তে ঈমান আনলে তার জানাযা আদি পড়া হবে।
“জীবনের দীপ নিভে আসে যবে ঢেউ জাগে দেহ তীরে,
ওপারে দাঁড়ায়ে ডাকে ‘মহাকাল’ আয় মোর কোলে ফিরে।”
মরণােন্মুখ ব্যক্তি মালাকুল মাওত (মওতের ফিরিশ্তা) দেখতে পায়। লোক ভালো হলে তাকে সুশ্রী চেহারায় দেখে থাকে। আর তার সাথে দেখে রহমতের আরো কয়েকজন শুভ্র চেহারা বিশিষ্ট ফিরিশ্তাকে যাদের সঙ্গে থাকে জান্নাতের কাফন এবং সুগন্ধি। পক্ষান্তরে লোক মন্দ হলে মালাকুল মউতকে কুশ্রী চেহারায় দেখতে পায়। আর তার সাথে কালো চেহারা বিশিষ্ট কয়েকজন আযাবের ফিরিশ্তাও দেখে থাকে, যাদের সাথে থাকে জাহান্নামের কাফন ও দুর্গন্ধ। এই সময় মুমূর্ষূর সমস্ত শক্তি চূর্ণ হয়ে যায়। বিকল হয়ে যায় সকল প্রকার প্রতিরোধক্ষমতা। অনায়াসে নিজেকে সঁপে দিতে চায় মরণের হাতে। আর শুরু হয় তার বিভিন্ন প্রকার মৃত্যু যন্ত্রণা।
মৃত্যুর স্বাদ এত তিক্ত ও জ্বালাময়; যার উদাহরণ একাধিকঃ
ক- উত্তপ্ত সিককাবাবের সিককে সিক্ত তুলোর মধ্যে ভরে পুনরায় টেনে। নিলে তুলোর ভিতরে যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়, তাই হয় মরণ-পারের পথিকের ভিতরে।
খ- জীবন্ত একটি পাখি উত্তপ্ত তাওয়ায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর যখন সে মারাও যায় না যাতে আরাম পেয়ে যায় এবং নিস্তারও পায় না যাতে সে উড়ে পালায়। ঠিক এমনি ভীষণ পরিস্থিতি হয় কণ্ঠাগত-প্রাণ মানুষের।
গ- একটি জীবন্ত ছাগের দেহ হতে একজন কসাই যখন তার ভোঁতা ছুরিকা দ্বারা চর্ম পৃথক করে, তখন ছাগের যে বিভীষিকাময় পরিণতি হয়, ঠিক তেমনি হবে মরণাপন্ন ব্যক্তির। তরবারির আঘাত, করাত দ্বারা ফাড়ার ব্যথা, কাইচি দ্বারা মাংস কাটার যন্ত্রণা অপেক্ষাও মৃত্যু যন্ত্রণা অনেক বেশী কঠিন ও মর্মান্তিক। (আল-বিজাযাহ)
মা আয়েশা (রাঃ) নবী (ﷺ) এর মৃত্যু সময়কালীন কষ্ট বর্ণনা করে বলেন, তার হাতের কাছে একটি পানির পাত্র রাখা ছিল। তাতে হাত ডুবিয়ে তিনি বারবার মুখ মুছতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ অবশ্যই মৃত্যুর রয়েছে কঠিন যন্ত্রণা।” অতঃপর তিনি তাঁর হাত উপর দিকে তুলে বললেন, “হে আল্লাহ! আমাকে পরম বন্ধুর সাথে (মিলিত কর।” অতঃপর তাঁর রূহ কবয হলে তাঁর হাত লুটিয়ে পড়ল। (বুখারী ৬৫১০নং)।
সুতরাং যদি এই অবস্থা সৃষ্টির সেরা মানুষ মহানবী (ﷺ) এর হয়, তাহলে আরো অন্যান্যের যে কী হাল হতে পারে, তা বলাই বাহুল্য।
যে সকল লক্ষণ দেখে জান কবজ হওয়া বুঝা যায় তা নিম্নরূপঃ
১। দম গেলে মৃতের চক্ষু ঘূর্ণায়মান হয়ে পরে স্থির হয়ে যাবে। উম্মে সালামাহ (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) আবু সালামার নিকট এলেন; তখন তার চক্ষু স্থির হয়ে গিয়েছিল। তিনি তার চক্ষু বন্ধ করে বললেন, “রূহ কবয হয়ে গেলে চক্ষু তার দিকে চেয়ে থাকে।” (মুসলিম ১৫২৮, ইবনে মাজাহ ১৪৪৪ক)
২। বাম অথবা ডান দিকে নাক বেঁকে যাবে।
৩। -নিম্নের চিবুক ঢিলে হয়ে যাবে।
৪। হৃৎস্পন্দন থেমে যাবে।
৫। সারা শরীর শীতল হয়ে যাবে।
৬। ঠ্যাং-এ ঠ্যাং জরিয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “কখনও না যখন প্রাণ কণ্ঠাগত হবে এবং বলা হবে, কে ঝাড়বে? আর সে মনে করবে যে, বিদায়ের সময় এসে গেছে। এবং ঠ্যাং ঠ্যাং-এর সাথে জড়িত হয়ে যাবে---।” (সুরা কিয়ামাহ ২৬-২৯ আয়াত)।
এই তো সেই শেষ নির্ধারিত সময় যার কোন প্রকার অন্যথা হবে না।
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ ۖ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً ۖ وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ
অর্থাৎ, আর প্রত্যেক জাতির এক নির্দিষ্ট সময় আছে। যখন তাদের সে সময় এসে উপস্থিত হবে তখন তারা মুহূর্তকাল ও বিলম্ব অথবা ত্বরা করতে পারতে। (সুরা আ'রাফ ৩৪ আয়াত)
“আমার গর্ব-গৌরব যত সব হল অবসান,
হে চির সত্য! তোমারেই আজি করি যে আত্মদান।
লৌহ কঠোর এই বাহু মোর তরবারি ক্ষুরধার,
বন্ধু আজিকে শক্তি যোগাতে কেহ নাই হেথা আর!”
রূহ কবয হয়ে গেলে উপস্থিত ব্যক্তিদের উচিতঃ
১। তার চক্ষুদ্বয় খোলা থাকলে বন্ধ করে দেওয়া এবং তার জন্য পুনঃপুনঃ দুআ করা। যেমন, আল্লাহ! তুমি ওকে ক্ষমা কর, সৎপথপ্রাপ্ত লোকেদের দলভুক্ত কর এবং ওকে মাফ করে দাও প্রভু! ওর মত (ভালো লোক) ওর। বংশে পুনঃ দান কর। আমাদেরকে এবং ওকে মাফ করে দাও প্রভু! ওর কবরকে প্রশস্ত করো এবং তা আলোময় করে দিও---।” ইত্যাদি।।
উম্মে সালামাহ (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) আবু সালামার নিকট উপস্থিত হলেন। তখন তার চক্ষু (মৃত্যুর পর) খোলা ছিল। তিনি তা বন্ধ করে দিলেন এবং বললেন, “রূহ কবয হয়ে গেলে চোখ তার দিকে তাকিয়ে থাকে।” নবী (ﷺ)বললেন, “তোমরা নিজেদের উপর বদুআ করো না বরং মঙ্গলের দুআ কর। কারণ, তোমরা যা বল তার উপর ফিরিশ্তাবর্গ ‘আমীন-আমীন’ (কবুল কর) বলে থাকেন।”
অতঃপর তিনি বললেন, “হে আল্লাহ! তুমি আবু সালামাহকে ক্ষমা করে। দাও। ওর মর্যাদা উন্নীত করে ওকে হেদায়াতপ্রাপ্তদের দলভুক্ত করে দাও। ওর অবশিষ্ট পরিজনের মধ্যে ওর পরবর্তী প্রদান কর। আমাদেরকে এবং ওকে মাফ করে দাও হে সারা জাহানের প্রভু! ওর জন্য ও কবরকে প্রশস্ত ও আলোকিত করে দাও।” (মুসলিম ১৫২৮ক, ইবনে মাজাহ ১৪৪৪ক, আহমাদ ৬/২৯৭, বাইহাকী ৩/৩৩৪)
২। মুখগহ্বার খোলা থাকলে বন্ধ করে দেবে। প্রয়ােজনে দুই চিবুক চেপে কিছু বেঁধে দেবে। হাত-পা হিলিয়ে ঢিলা করে দেবে। অনিবার্য কারণে দাফনে দেরী হবে আশঙ্কা করলে লাশ ফ্রিজে রাখার ব্যবস্থা করবে।
৩। একটি চাদর বা কাঁথা দ্বারা তার সর্বশরীর ঢেকে দেবে। মা আয়েশা বলেন, “আল্লাহর রসূল (ﷺ) যখন ইন্তেকাল করলেন তখন তাঁকে চেককাটা ইয়ামানী চাদর দ্বারা ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।” (বুখারী ৫৩৬৭ক, আবু দাউদ ২৭ ১৩ক, প্রমুখ)
তবে মৃতব্যক্তি হজ্জ করতে গিয়ে ইহরাম বাঁধা অবস্থায় মারা গেলে তার চেহারা ও মাথা ঢাকা চলবে না। কারণ, আব্বাস (রাঃ) বলেন, “আরাফাতে অবস্থান-কালে এক ব্যক্তি তার সওয়ারী থেকে পড়ে তার ঘাড় ভেঙ্গে মারা গেলে নবী (ﷺ) বললেন, “কুলের পাতা-মিশ্রিত পানি দ্বারা ওর গোসল দাও, (যে দুই ইহরামের কাপড় ও পরে আছে সে) দুই কাপড়েই ওকে কাফনিয়ে দাও, কোন খোশবু ওর দেহে লাগাবে না। আর ওর মাথা ও চেহারা ঢাকবে না। কেননা, কিয়ামতের দিন ও তালবিয়াহ পড়া অবস্থায় পুনরুত্থিত হবে।” (বুখারী ১৭ ১৯ক, মুসলিম ২০৯২ক, প্রমুখ)
৪। অতিসত্বর তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করবে এবং এতে মোটেই বিলম্ব করবে না। কারণ, নবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা জানাযার কার্য শীঘ্র সমাধা কর।” (বুখারী ১২৩১ক, মুসলিম, ১৫৬ ক, প্রমুখ)
৫। যে শহর বা গ্রামে মৃত্যু ঘটেছে সেই শহর বা গ্রামেই লাশ দাফন করবে। অন্য কোন স্থানে বহন করে সেখানে দাফন করা বিহিত নয়। কারণ, এ কাজ উক্ত শীঘ্রতার আদেশের পরিপন্থী। পরন্তু জাবের বলেন, উহুদের যুদ্ধের দিন মুসলিমদের লাশ বাকী’তে দাফন করার জন্য বহন করা শুরু হলে রসূলুল্লাহর তরফ থেকে এক আহ্বানকারী আহ্বান করে বলল, আল্লাহর রসূল (ﷺ) তোমাদেরকে তোমাদের লাশসমূহকে তাদের মৃত্যুস্থলে দাফন করতে আদেশ করেছেন। আমার আম্মাজান তখন আমার আব্বাজান ও মামাজানকে একটি সেচক উটের পিঠে পাশাপাশি রেখে বাকীতে দাফন করার উদ্দেশ্যে বহন করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাদেরকেও (ঐ আদেশানুসারে) ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।' (আবু দাউদ ১৭৪২ ক, তিরমিযী ১৬৩১ক, ইবনে মাজাহ ১৫০৫ক, আহমাদ ১৩৬৫৩ ক, মাওয়ারেদু্য যামআন ১৯৬ নং, বাইহাকী ৪/৫৭)
আয়েশা (রাঃ) এর এক ভাই ওয়াদিউল হাবাশাতে মারা গেলে এবং সেখান হতে তার লাশ বহন করা হলে তিনি বলেছিলেন, যার শোক আমাকে সন্তপ্ত করেছে তা এই যে, আমার ইচ্ছা ছিল আমার ভাই-এর দাফন তার মৃত্যুস্থলেই হোক।” (বাইহাকী, আহকামুল জানায়্যে ১৪পৃঃ)
কোন মর্যাদাপূর্ণ (বা তথাকথিত শরীফ) স্থানে দাফন করার অসিয়ত মৃতব্যক্তি করে থাকলেও তা মানা উচিত নয়। কারণ, এমন অসিয়ত বাতিল। (আযকার, নওবী, আহকামুল জানায়েয ১৪ পৃঃ, টীকা) আর সেখানে দাফন করলে মৃতের কোন ইষ্টলাভ হবে মনে করাও যুক্তিযুক্ত নয়।
পক্ষান্তরে লাশের কোন প্রকার ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে; যেমন সেথায় দাফন করলে তার কবর বা লাশের উপর অত্যাচার হতে পারে, কোন বিবাদ, হঠকারিতা বা কুপ্রবৃত্তিবশে কেউ লাশের মর্যাদাহানি ঘটাতে পারে এমন ভয় হলে নিরাপদ স্থানে বহন করে দাফন করা ওয়াজেব। তদনুরূপ কেউ বিদেশে মারা গেলে তার আত্মীয়-পরিজনের দর্শন আশা পূরণ করার জন্য এবং যিয়ারত সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে স্বদেশে বহন করে দাফন করাও প্রয়ােজনে বৈধ। (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১০/৬২)।
৬। সত্বর তার বকেয়া ঋণ পরিশোধ করবে। এতে মৃত্যের ত্যক্ত সমস্ত সম্পদ লেগে গেলেও ঋণশোধে ওয়ারেসীনদের দ্বিধা করা উচিত নয়। ঋণ পরিশোধের মত অর্থ না থাকলে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য তার তরফ থেকে সে ঋণ শোধ করা। তা না হলে বায়তুল মাল বা মুসলিমদের বিশেষ ফান্ড হতে ঋণ পরিশোধ করা হবে। অবশ্য এতে যদি কোন আত্মীয় বা অন্য কোন মুসলিম সাহায্য করে ঋণ পরিশোধ করে দেয় তাও উত্তম ও বৈধ।
সা’দ বিন আত্বঅল (রাঃ) বলেন, তার ভাই মাত্র ৩ শত দিরহাম রেখে মারা যান। আর ছেড়ে যান সন্তান-সন্ততিও। আমার ইচ্ছা ছিল ও দিরহামগুলো আমি তার পরিবারবর্গের উপর খরচ করব। কিন্তু নবী (ﷺ) আমাকে বললেন, “তোমার ভাই তো ঋণ-জালে আবদ্ধ। সুতরাং তুমি গিয়ে (আগে) তার ঋণ শোধ কর।” অতএব আমি গিয়ে তার ঋণ শোধ করে এলাম এবং নবী (ﷺ)-কে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি তার সমস্ত ঋণ শোধ করে দিয়েছি। তবে একটি মহিলা দুই দীনার পাওয়ার কথা দাবী করছে, কিন্তু তার কোন সবুত নেই। তিনি বললেন, “ওকেও দিয়ে দাও। কারণ ও সঠিক বলছে।” (ইবনে মাজাহ ২৪২৪ ক, আহমাদ ১৬৯৩ ক)
রসূল (ﷺ) বলেছিলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত হয় অতঃপর তা পরিশোধে অপারগ হয়ে পরিশোধ না করেই মারা যায়, সে ব্যক্তির অভিভাবক আমিই।” (আহমাদ ২৩৩১৬ ক, সহীহ ইবনে মাজাহ ১৯৭৩নং, এ ব্যাপারে আরো অন্যান্য হাদীসও রয়েছে। দেখুন আহকামুল জানায়েয আলামা আলবানী)
মোট কথা, ঋণ পরিশোধ হওয়া পর্যন্ত মৃত ব্যক্তি জান্নাত প্রবেশে প্রতিবন্ধী থাকবে। অতএব কর্তব্য হল, মাইয়েতের ত্যক্ত সম্পত্তি ও অর্থ থেকে প্রথমে তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা, অতঃপর তার ঋণ পরিশোধ, অতঃপর অসিয়ত পালন, এবং সবশেষে বাকী সম্পত্তি ও অর্থ ওয়ারেসীনদের মাঝে ভাগবন্টন করা হবে।
আত্মীয়-স্বজন বা উপস্থিত ব্যক্তিরা মাইয়্যেতের চেহারা খুলে দেখতে ও তাকে চুম্বন দিতে পারে। চাপা-কান্না কাঁদতে এবং তিন দিন পর্যন্ত শোক পালন করতে পারে (অবশ্য স্ত্রী হলে মৃত স্বামীর জন্য ৪ মাস ১০দিন শোক পালন। করবে।)
এ ব্যাপারে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যার কিছু নিম্নরূপ:
সাহাবী জাবের (রাঃ) বলেন, 'যখন আমার পিতা (আব্দুল্লাহ) ইন্তিকাল করলেন, তখন আমি তার চেহারা থেকে কাপড় সরিয়ে কাঁদতে লাগলাম। এ দেখে সকলে আমাকে নিষেধ করল। কিন্তু নবী (ﷺ) আমাকে নিষেধ করেন নি। অতঃপর নবী (ﷺ) এর আদেশক্রমে তার জানাযা উঠানো হল। এতে আমার ফুফু ফাতেমা কাঁদতে শুরু করলেন। নবী (ﷺ) তাঁকে বললেন, “কাঁদ অথবা না কাঁদ, ওর লাশ উঠানো পর্যন্ত ফিরিশ্তাবর্গ নিজেদের পক্ষ দ্বারা ওকে ছায়া করে রেখেছিল।” (বুখারী ১১৬৭ ক, মুসলিম ৪৫১৭ ক প্রমুখ)।
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, 'আবু বকর (রাঃ) তার বাসা সুন্হ থেকে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে এলেন। ঘোড়া থেকে নেমে মসজিদে প্রবেশ করলেন। অতঃপর নবী (ﷺ) এর নিকট গেলেন। তিনি তখন চেককাটা ইয়ামানী চাদরে ঢাকা ছিলেন। আব্বা (আবু বকর) তাঁর চেহারার কাপড় খুলে দিয়ে ঝুঁকে পড়ে তার দুই চক্ষের মাঝে চুম্বন করলেন এবং কাঁদতে লাগলেন। অতঃপর বললেন, 'আমার মা ও বাপ আপনার জন্য কুরবান হোক, হে আল্লাহর নবী! আল্লাহ আপনার মধ্যে দুটি মরণ একত্রিত করবেন না। এখন যে মরণ আপনার উপর অবধার্য ছিল তা আপনি বরণ করে নিয়েছেন।
অন্য এক বর্ণনাতে তিনি বললেন, 'আপনি সেই মৃত্যু বরণ করে নিয়েছেন যার পর আর কোন মৃত্যু নেই।” (বুখারী ১২ ৪২নং, নাসাঈ ১৮ ১৮ক, প্রমুখ)।
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, 'উষমান বিন মাযউন মারা গেলে নবী (ﷺ) তাঁকে দেখতে গেলেন। তিনি তার চেহারার কাপড় খুলে ঝুঁকে তাকে চুম্বন করলেন। অতঃপর তিনি এমন কাঁদলেন যাতে দেখলাম, তার চোখের পানি তার গাল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে । (তিরমী ৯১০ক, আবু দাউদ ২৭৫০ ক, সহীহ ইবনে মাজাহ ১৪৫৬নং)।
এ ছাড়া জাফর মারা গেলে মহানবী (ﷺ) তার পরিজনের নিকট ৩ দিন না এসে শোক প্রকাশে ঢিল দিলেন। অতঃপর তাদের নিকট এসে বললেন, আজকের পর থেকে তোমরা আমার ভায়ের জন্য কাঁদবে না। (আবু দাউদ ৩৬৬০ক, নাসাঈ ৫১৩২ক, আহমাদ ১৬৫৯ক)
নবী করীম (ﷺ) এর শিশুপুত্র ইবরাহীম মারা গেলে তার চক্ষু থেকে অশ্রু বইতে লাগল। আব্দুর রহমান বিন আউফ বললেন, আপনিও কাঁদছেন হে আল্লাহ্র রাসূল?! তিনি বললেন, এটি হল মমতার ফল, চক্ষু অশ্রু বিসর্জন করে, অন্তর সন্তপ্ত হয়, আল্লাহ যাতে সন্তুষ্ট তা ছাড়া আমরা অন্য কথা বলি না। আর তোমার যাওয়াতে আমার বড় দুঃখ হে ইবরাহীম! (বুখারী, মুসলিম, বায়হাকী ৪/৬৯ প্রমুখ)।
চললে পথিক আপনার জনে ভাসায়ে নয়ন তীরে
খেলা শেষ হল ধীরে চল ঐ মরণ সাগর তীরে।