দুনিয়ায় চিরদিন কেউই থাকবেনা, একদিন মরতেই হবে এবং যে কোন সময়ে মরণ আসতে পারে এ কথার স্মরণ মুমিনকে পরকালের জন্য প্রস্তুতি নিতে উদ্বুদ্ধ করে, আর অস্থায়ী ধোকাবাজ ধূলির ধরাতে ও মায়াময় সংসারে উদাসীন, ভোগমত্ত ও বিভোর হতে সুদূরে রাখে। মরণের স্মরণ মুমিনকে আত্মসমীক্ষা তথা বারবার তওবা করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ করে দ্বীনদারী ও ঈমানদারীর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে।
বারা’ বিন আযেব (রাঃ) বলেন, একদা আমরা আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর সাথে ছিলাম। হঠাৎ তিনি একদল লোক দেখতে পেয়ে বললেন, “কি ব্যাপারে ওরা জমায়েত হয়েছে?” কেউ বলল, 'একজনের কবর খোড়ার জন্য জমায়েত হয়েছে। একথা শুনে আল্লাহর রসূল (ﷺ) ঘাবড়ে উঠলেন। তিনি তড়িঘড়ি সঙ্গীদের ত্যাগ করে কবরের নিকট পৌছে হাঁটু গেড়ে বসে গেলেন। তিনি কি করছেন তা দেখার জন্য আমি তাঁর সামনে খাড়া হলাম। দেখলাম, তিনি কাঁদছেন। পরিশেষে তিনি এত কাঁদলেন যে, তার চোখের পানিতে মাটি পর্যন্ত ভিজে গেল। অতঃপর তিনি আমাদের দিকে মুখ তুলে বললেন, হে আমার ভাই সকল! এমন দিনের জন্য তোমরা প্রস্তুতি নাও।” (বুখারী তারীখ, ইবনে মাজাহ ৪১৯৫, আহমাদ ৪/৩৯৪, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৭৫১ নং)।
উসমান (রাঃ) যখন কোন কবরের পাশে দাঁড়াতেন তখন এত কাঁদা কঁদতেন যে, চোখের পানিতে তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। কেউ তাকে বলল, ‘জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনাকালে আপনি তো কাঁদেন না, আর এই কবর দেখে এত কঁদছেন? উত্তরে তিনি বললেন, যেহেতু আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “পরকালের (পথের) মঞ্জিলসমুহের প্রথম মঞ্জিল হল কবর। সুতরাং যে ব্যক্তি এ মঞ্জিলে নিরাপত্তা লাভ করে তার জন্য পরবর্তী মঞ্জিলসমূহ অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে যায়। আর যদি সে এখানে নিরাপত্তা লাভ না করতে পারে তবে তার পরবর্তী মঞ্জিলগুলো আরো কঠিনতর হয়।” আর তিনি একথাও বলেছেন যে, “আমি যত দৃশ্যই দেখেছি, সে সবের চেয়ে অধিক বিভীষিকাময় হল কবর!” (সহীহ তিরমিযী ১৮৭৮, ইবনে মাজাহ ৪২৬৭ নং)
আবু দারদা , বলেন, “তিনটি বিষয় চিন্তা করে আমার হাসি আসে এবং তিনটি বিষয় মনে করে আমার কান্না আসে। যা আমাকে হাসায় তা হল; সেই ব্যক্তি যে, দুনিয়ার আকাঙ্ক্ষী অথচ মৃত্যু তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজে গাফেল ও উদাসীন অথচ সে দৃষ্টিচ্যুত ও বিস্মৃত নয়। (অথচ তার মৃত্যু। আসবে এবং হিসাব নেওয়া হবে।) আর যে, মুখভর্তি হাসে অথচ জানে না যে, সে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করল, নাকি ক্রোধান্বিত।
আর যা আমাকে কাদায় তা হল, প্রিয়তম মুহাম্মাদ (ﷺ) ও তাঁর সহচরগণের বিরহ, মৃত্যু যন্ত্রণায় সেই কঠিন ভয়াবহতার স্মরণ, আর সেই দিনে আল্লাহর সামনে খাড়া হওয়ার কথা যেদিনে মানুষের গুপ্ত যত কিছু সব প্রকাশ হয়ে পড়বে। অতঃপর জানতে পারে না যে, তার শেষ পরিণাম জান্নাত না জাহান্নাম। এক যাহেদ (সংসার-বিরাগী)কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, সবচেয়ে ফলপ্রসু ওয়ায ও উপদেশ কিসে লাভ হয়? উত্তরে তিনি বললেন, 'মৃতব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিপাতে।”
উমার বিন আব্দুল আযীয আওযায়ীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ---পর সমাচার এই যে, যে ব্যক্তি অধিক অধিক মরণকে স্মরণ করবে, সে ব্যক্তি দুনিয়ার স্বল্প উপকরণ (ধন-সম্পদ) নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে।
আত্বা বলেন, 'উমার বিন আব্দুল আযীয প্রত্যেক রাত্রে ফকীহগণকে সমবেত করতেন এবং সকলে মিলে মৃত্যু, কিয়ামত ও আখেরাতের কথা আলোচনা করে কাঁদতেন।
সালেহ মুররা বলতেন, সামান্য ক্ষণ মরণকে বিস্মৃত হলেই আমার হৃদয় মলিন হয়ে যায়।”
দাক্কাক বলেন, 'যে ব্যক্তি মরণকে স্মরণ করে সে তিনটি উপকার লাভ করে; সত্বর তওবা, স্বল্পে তুষ্টি, আর আলস্যহীন ইবাদত। পক্ষান্তরে যে মরণের কথা ভুলেই থাকে সেও তিনটি জিনিস সত্বর লাভ করে; তওবায় দীর্ঘসূত্রতা, যথেষ্ট সব কিছু পেয়েও অতৃপ্তিবোধ এবং ইবাদতে অলসতা।
মরণাপন্ন ব্যক্তিকে দর্শন করা, মৃত্যু যন্ত্রণায় তার কঠিন ভয়ানক কাতরতা লক্ষ্য করা এবং মরণের পরে মৃতব্যক্তির সেই করুণ মুখ-দৃশ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করায় হৃদয়ের সকল ভোগেচ্ছা উড়ে যায় এবং মনের সকল বাসনা ও উল্লাস উবে যায়। এর ফলে মানুষ সুগভীর নিদ্রা ত্যাগ করে চক্ষু মুছে উঠতে পারে, শরীরের জন্য অতিরিক্ত আরামকে হারাম করে। শুরু করে নেক আমল দ্বারা প্রস্তুতি নিতে এবং বৃদ্ধি করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে তার পরিশ্রম ও প্রয়াস।
হাসান বসরী (রঃ) এর ব্যাপারে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি এক রোগীকে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে দেখলেন, তার মৃত্যু আসন্ন। মৃত্যুকালীন তার ঐ যন্ত্রণা ও কঠিন কষ্ট দেখার পর যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন তাঁর দেহের রঙ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির লোকে বলল, আল্লাহ আপনাকে রহম করুক! খানা তো খেয়ে নিন। তিনি বললেন, হে আমার পরিজনবর্গ! তোমরা তোমাদের খানা খেয়ে নাও। কারণ আজ আমি এমন বিপদ সঙ্কট দর্শন করেছি, যার জন্য তা আমার নিকট পৌঁছনো পর্যন্ত একাধারে আমল করে যাব।” (আত্তাযকিরাহ কুরতুবী ১২ পৃঃ)
কথিত আছে যে, তিনি এক জানাযায় শরীক হয়ে একজন লোককে উদ্দেশ্য করে এবং কবরে রাখা লাশের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, 'দেখ, ওকে কবরে। একটু পরে প্রশ্ন করা হবে আর ও উত্তর দেবে। অতঃপর ওকে যদি দুনিয়ায় পুনরায় আসতে দেওয়া হয়, তাহলে কি ও ভালো কাজ করবে? লোকটি উত্তরে বলল, অবশ্যই করবে। তিনি বললেন, তাহলে তুমি তো এখন দুনিয়াতেই আছ, তুমি ভালো কাজ করে যাও।” মরণকে বরণ করবে না এমন কে আছে? আজ অথবা কাল সকলের জীবনের সেই বাতি নিভে যাবে। মানুষ মরণকে স্মরণে না রাখলেও মরণ কোন দিন তাকে ভুলে যাবে না। অচিরেই তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে পরপারের চির সুখ সাগরে অথবা দুঃখ পাথারে।
সুতরাং জ্ঞানী মাত্রই বিপদ স্মরণ করে তার হাত থেকে মুক্তির উপায় ও অস্ত্র সংগ্রহ করতে উঠে পড়ে লাগে। পক্ষান্তরে উদাসীন খালি হাতে থেকে বিপদের পঞ্জায় নিজেকে সঁপে দেয়।। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, সর্বসুখ-বিনাশী মৃত্যুকে তোমরা অধিকাধিক স্মরণ কর।
(তিরমিযী, নাসাঈ, হাকেম প্রমুখ। কারণ, যে ব্যক্তি কোন সঙ্কটে তা স্মরণ করবে সে ব্যক্তির জন্য সে সঙ্কট সহজ হয়ে যাবে এবং যে ব্যক্তি তা কোন সুখের সময়ে স্মরণ করবে সে ব্যক্তির জন্য সুখ তিক্ত হয়ে উঠবে।” (বাইহাকী, ইবনে হিব্বান, সহীহুল জামে ১২১০- ১২১১নং)