সমাজচিন্তকদের সমাজের চিত্র উন্মোচন করার জন্য।
যে যুবক ও তরুণশ্রেণি দেশের ভবিষ্যত- সেই যুবকশ্রেণির চারিত্রিক অধঃপতনে রোধে করণীয় স্থির করার জন্য।
যে সমাজে আমরা বাস করছি, সেই সমাজ ব্যবস্থার অসঙ্গতি সম্পর্কে অবহিত হয়ে সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য।
গর্তে পতিত হওয়া মুমিনের কাজ নয়। সমাজ ধ্বংসের গর্তগুলো চিহ্নিত করে গর্তে পতিত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য।
ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে চলমান অঘোষিত যুদ্ধে আল্লাহর জিজ্ঞাসার জবাব দেবার সামান্য প্রয়াস হিসেবে।
বিজ্ঞানময় আবিস্কার মানবজাতিকে যেসব নিত্যসৃষ্টে বাধিত ও ব্যাকুল করেছে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে বিনোদন সংস্কার। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার হাত ধরাধরি করে সিনেমা-থিয়েটার মানুষের বিনোদন জগতকে মাতিয়ে রেখেছে উন্মাতাল আবেগপ্রবণতায়। বাস্তবজীবনে ব্যর্থ কিংবা হতাশাক্লিষ্ট দর্শক সিনেমা-থিয়েটারে খুঁজে পায় শিহরিত বিনোদন ও উত্তেজক আনন্দ। কারণ বাস্তবজীবনে যা আদৌ সম্ভব নয় তাই দেখানো হয় এসব জায়গায়। একমাত্র সিনেমা-থিয়েটার আর নাটক-নোবেলেই সম্ভব অবাস্তব কাহিনীর অবতারণা। কারণ এখানে সত্যিকারের জীবন্ত মানুষের মুখোমুখি হওয়ার দায় নেই।
এখানে দৃশ্যত নারী-পুরুষদের কোনো অসম্ভব আচরণ বা অস্বাভাবিক উক্তি করা ও কিছু করে দেখানোতে বাধা নেই। তাই বাস্তব জীবনে যা একেবারেই অসম্ভব কিংবা কল্পনাতেও যা আসে না, নাটক-সিনেমায় সেগুলো দেখে দর্শকরা ‘ওয়াও’ আর ‘এঙ্কোর এঙ্কোর’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে! দর্শকরা জানে না, সিনেমায় যে প্রণয়নিবেদন কিংবা অবিশ্বাস্য দৃশ্য প্রদর্শিত হয় অথবা ভিলেন কর্তৃক মায়ের কাছ থেকে সন্তান কেড়ে নেয়ার যে উত্তেজক দৃশ্য দেখে তারা ব্যথিত হয় তার ষোলো আনাই মিছে, ষোলো আনাই স্টেজ-ম্যানেজড্! ষোলো আনাই ফান ও ফাঁকি! কিন্তু হতভাগ্য দর্শকের এসব জানার উপায় নেই। রচিত কাব্যের বর্হিদেশে, অভিনীত নাটকের নেপথ্যে গল্পের বাস্তবতা চিরকাল থাকে লোকলোচনের অন্তরালে। তাই নাটকের যেখানে শেষ জীবনের সেখানেই শুরু!
কিন্তু তবু কথা থেকে যায়। রচিত কাব্য ও কল্পিত নাটকই কখনও কখনও মানুষের জীবনে চরম সত্য হয়ে ধরা দেয়। সেই সত্য গল্প কাহিনীর গল্পের চেয়েও নির্মম, অভিনীত নাটকের চেয়েও অবিশ্বাস্য হয়ে আত্মপ্রকাশ করে! সেই অবিশ্বাস্য একটা গল্পই আজ আপনাকে শোনাতে চাই।
প্রেক্ষাগৃহের উত্তাপ কখনও কখনও বাইরেও আঘাত হানে। শ্রুতিগর্জন করে এই জগতের বাইরের লোকদের কানেও। চেপে ধরার পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও অন্যের ঘাম নাকে প্রবিষ্ট হওয়ার মতো কানে পড়ে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত তথ্য। হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী ‘সুদের ধোঁয়া সব মানুষকে আচ্ছন্ন করা’র মতোই।
কল্পনার জগতকে কেন্দ্র করে বাস্তবজীবন রচিত হয় না। ঠিক তদ্রূপ কেউই প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত কোনো অভিনয় কিংবা অবাস্তব জীবনের মহড়া বাস্তবজীবনে প্রতিফলিত করে না কিংবা সে অনুযায়ী সংসারও পাতে না। তাই প্রযোজকরা বাস্তবজীবনকে অবলম্বন করেই অবাস্তব ঘটনার অবতারণা ঘটান। সেই অবাস্তব অবতারণায় একজন পুরুষের (নায়কের) পাশে সার্বক্ষণিক থেকে ছবিকে রঙে-ঢঙে ফুটিয়ে তুলতে একজন নায়িকার প্রয়োজন হয়।
নব্বই দশকে ‘সোহরাব-রুস্তম’ নামের একটা ছবি নাকি খুব আলোড়ন তুলেছিল। আর সেই ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চনের পাশে একজন নায়িকা ছিলেন। নাম তার বনশ্রী (মূল নাম শাহিনা আখতার)। মুক্তি-পরবর্তী ছবিটি ব্যাপক ব্যবসা সফলও হয়েছিল। অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা একটা সরল মেয়ে এই ছবির নায়িকা বনশ্রীও রাতারাতি তারকা বনে গিয়েছিলেন। তাই দামি গাড়িতে ভ্রমণ, বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেই কেটেছে বনশ্রীর সেই তারকাখ্যাতির দিনগুলো। বললে বিশ্বাস হবে! সেই তারকা নায়িকা বনশ্রী আজ ঢাকার রাজপথের ফুটপাতে হেঁটে হেঁটে এবং বাসযাত্রীদের কাছে নামাজ শিক্ষার বই বিক্রি করেই দিন যাপন করছেন!
একসময়ের বিতর্কিত প্রযোজক ফারুক ঠাকুর এই বনশ্রীকে নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন ‘সোহরাব-রুস্তম’ ছবিটি। তখন বনশ্রী ফারুক ঠাকুরের বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন বলেও গুঞ্জন ছিল। অথচ বনশ্রী ছিলেন অন্যজনের ঘরণী। তিনি শ্যামল দাস নামের এক হিন্দু স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তেন। সেই স্যার বনশ্রীর রূপে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বনশ্রীর পরিবার থেকে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে তিনি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে স্বধর্ম ত্যাগ করে তিনি বনশ্রীকে বিয়ে করতে সক্ষম হন। কিন্তু বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে মোহ কেটে যায়। যিনি তাকে বিয়ে করার জন্য গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন সেই তিনিই তাকে ছাড়ার ফন্দি করতে থাকেন।
এরপর বনশ্রী নেমেছিলেন শোবিজের কণ্টকাকীর্ণ পথে। যার মাধ্যমে সিনেমা জগতে এসেছিলেন তাকে কড়া শর্ত দিয়েছিলেন পার্শ্বনায়িকা নয়- মূল নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করবেন তিনি। শুধু তাই নয়, যেনতেন নায়কের সঙ্গে অভিনয় নয়, তখনকার যিনি হিট তার সঙ্গে অভিনয় করবেন। না জানি কী এক জাদু ছিল বনশ্রীর কথায়, আচরণে কিংবা সৌন্দর্যে। যার ফলে সিনেমা জগতের জন্য এই অবাস্তব শর্তও তৎকালীন পরিচালক ফারুক ঠাকুর সহজেই মেনে নিয়েছিলেন এবং প্রথমদিন থেকেই চেয়েছিলেন বনশ্রীকে এদেশের প্রথম সারির একজন নায়িকা বানাবার। এজন্য তিনি একেবারে অনভিজ্ঞ, অপরিচিত ও গ্রাম্য মেয়েটির জন্য ছবিতে বিনিয়োগও করেছিলেন প্রচুর। এরপর ঘটেছিল অনেক কিছু। কিন্তু যেহেতু বনশ্রী আজ ঘরে ফেরার পথে আছেন, নিজ সন্তানকে গড়ে তুলতে চাচ্ছেন একজন ভালো মানুষ হিসেবে তাই সেই অবাঞ্ছিত ইতিহাস উল্লেখ না করাই ভালো।
পত্রিকার খবর, সোহরাব-রুস্তমের পর বনশ্রী অভিনীত ‘নিষ্ঠুর দুনিয়া’ ও ‘ভাগ্যের পরিহাস’ নামের দুটি ছবির কাজও শুরু হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, ছবি ও নাটকের কল্পিত ঘটনা ও আখ্যানই কখনও কখনও মানুষের বাস্তবজীবনের আঙিনায় তীব্রবেগে আছড়ে পড়ে। বনশ্রীর বেলায়ও তাই ঘটল। ছবির সেই কল্পিত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বনশ্রীর বাস্তবজীবনে আঘাত হানল। সেই আঘাতে জর্জরিত ঘরছাড়া, অর্থহারা, সন্তানহারা বনশ্রী আজ তিন বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে হকারি করে দিনযাপন করছেন! কিছুদিন আগে খবর বেরুলো, শাহবাগে তিনি ফুল বিক্রি করছেন!
ঘটনার সারাংশ হচ্ছে, ফারুক ঠাকুর নিজ বলয়ের বাইরে কারও ছবিতে কাজ করতে দিতেন না বনশ্রীকে। এ নিয়ে বনশ্রীর মনে ক্ষোভ থাকলেও ফারুক ঠাকুরের ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলেননি। বনশ্রী থাকতেন মোহাম্মদপুরের একটি আলিশান বাড়িতে। বিলাসিতারও কোনো কমতি ছিল না। এত সুখ হয়তো তার কপালে সয়নি। একটি দুর্ঘটনা সবকিছু বদলে দেয়। গুলশান এলাকার একটি জমি নিয়ে কিছু লোকের সঙ্গে ফারুক ঠাকুরের বিরোধ ছিল। একদিন প্রতিপক্ষের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডার একপর্যায়ে ফারুক ঠাকুরের ছোঁড়া গুলিতে প্রতিপক্ষের এক লোক ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এ ঘটনার পর ফারুক ঠাকুর লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি আর প্রকাশ্যে আসেননি। একা হয়ে যায় বনশ্রী। ফারুক ঠাকুর তাকে ঢাকার নামীদামী এলাকায় একটি বাড়িও করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বনশ্রীর বাবা তাতে অনীহা প্রকাশ করায় তা আর করা হয়নি। ফলে বনশ্রীর জীবনযুদ্ধ আরো কঠিন হয়ে ওঠে।
তারপর থেকেই শুরু হয় বনশ্রীর জীবনযুদ্ধ। ফারুক ঠাকুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বনশ্রীকে নিয়ে আর কেউ ছবি বানাতে আগ্রহী হয়নি। দিন দিন তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। প্রথম স্বামী যে আবেগে স্বধর্ম ত্যাগ করে তাকে বিয়ে করেছিলেন সেই আবেগের বশবর্তী হয়ে খুব দ্রুতই বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়েছিলেন। এরপর আশ্রয় হয়ে ওঠা ফারুক ঠাকুরও খুনের ঘটনায় হারিয়ে গেলেন। ফারুকের এই ঘটনার সময়ও প্রচুর অর্থবিত্ত ছিল তার। কিন্তু সবকিছুতেই যেন পতন শুরু হয়। চতুর্দিক থেকে লোক জড়ো হতে থাকে তার টাকাগুলো মেরে দেয়ার জন্য। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যক্তি কেউ ব্যবসা করে দেয়ার নামে। কেউ অল্পদিনের জন্য ঋণ নেয়ার নামে প্রায় কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালেন্স অল্পদিনের মধ্যেই নিঃশেষ করে দেয়। বনশ্রী এরপর ধানমণ্ডিতে একটি বিউটিপার্লার করেন। সে ব্যবসাও তিনি বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারেননি।
নিজেকে টিকিয়ে রাখতে নিজের চেয়েও কমবয়সী এক ছেলের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বাড্ডার বসতিতে নতুন স্বামী নিয়ে সংসার শুরু করেন। পালছেঁড়া জীবনতরীর দুর্বল মাঝি হলেও এই স্বামী তার জীবনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন সামনের দিকে। কিন্তু একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে সেই মানুষটিও বনশ্রীকে নিঃসঙ্গ করে পরপারের যাত্রাপথে রওয়ানা হন।
বনশ্রী খুবই বিলাসী, অলংকারপ্রিয় ও সৌন্দর্যসচেতন ছিলেন। জড়োয়া গহনা এবং মোটা ও পুরু অলঙ্কার ছাড়া কখনও এফডিসি মাড়াতেন না। অভিনয়ের সময়েও শরীরে জড়ানো থাকত মূল্যবান অলঙ্কার। যে কয়জন লোকের মূল্যবান গাড়িতে সে সময়ের রাজধানীর পিচঢালা পথ প্রকম্পিত হতো, তিনি ছিলেন তাদেরই একজন। কিন্তু পর্যায়ক্রমে গাড়িও পরিবর্তন হয়েছে, গাড়িতে ওঠার উদ্দেশ্যও পরিবর্তন হয়েছে। জীবনতরীর পাল, মাস্তুল, মাঝি-মাল্লা সবই বিধ্বস্ত হয়েছে। জীবন থেকে সরে গেছে একে একে সব অবলম্বন।
সর্বশেষ যে ঝড় তার জীবনের শেষ অবলম্বন নিশ্চিহ্ন করে দেয় তার ধকল সহ্য করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রথম ঘরের অষ্টম শ্রেণির মেয়েটিকে তার পরিচিত লোকেরা হাইজাক করে। তিনি মেয়ের শূন্যতায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে যান। ছুটতে থাকেন থানায় থানায়। বিচার চান এই অমানবিক অন্যায়-অপরাধের। কিন্তু সবাই তাকে নিরাশ করে। নিবৃত করেন নিজকন্যার দাবি থেকে! এ কোন দুঃসহ সমাজে বাস করছি আমরা? একজন হতভাগা মা তার কন্যা অপহরণের বিচার নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অপরাধীকে চিহ্নিত করার পরও আইন তার সহায়তা না করে অপরাধীর সহায়তা করে!
বনশ্রী অনেক কাকুতি-মিনতি করেন হাইজাকারদের কাছে একমাত্র অবলম্বন নিজের বুকে ফিরিয়ে দেয়ার। কিন্তু হৃদয় গলে না পাষণ্ডদের। তারা তাকে বিক্রি করে দেয় খারাপ জায়গায়। বুকটা ফেটে যায় বনশ্রীর। নিজকন্যার এই পরিণতি তিনি কিছুতেই বরদাশত করতে পারেন না। একরাশ বেদনা, হতাশা ও জীবনধারনের শেষ অবলম্বন হারিয়ে তিনি রাস্তায় নামেন। পরের ঘরের মাত্র তিন বছরের শিশু সন্তান নিয়ে সিনেমার মতোই অবিশ্বাস্য ঘটনার জন্ম দিয়ে আজ ফুটপাতে বই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন বনশ্রী। জীবিকার প্রশ্নে আশ্রয় নিয়েছেন এমন এক অবলম্বন, যা মুসলিমদের হৃদয়কে আন্দোলিত করে। তিনি বাসে বাসে নামাজ শিক্ষার বই বিক্রি করতে থাকেন। অনেকে তার পরিচয় পেয়ে হতবিহ্বল হন। নামাজ শিক্ষার বইয়ের কারণে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
এভাবেই চলছে একজন খ্যাতিমান তারকার দুঃখের জীবন। যাদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন নাটক-সিনেমার রঙিন জগত তারা উল্কাবেগে তার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন, তেমন এক নায়কের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বহুদিন আগের পথ-পরিচয়ের কোনো অস্পষ্ট স্মৃতি যেমন কেউ খুব কষ্ট করে মনে করে, ঠিক তেমনি তিনি বললেন, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এই নামের একজন নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করেছিলাম! সত্যিই স্যালুকাস! এই জীবনে না আছে দায়, না আছে হৃদয়। কেবলই অভিনয়, প্রবঞ্চনা আর শঠতা। এই শঠতা দিয়েই ধ্বংস করা হচ্ছে হাজার তরুণ-যুবকের জীবন। হতভাগ্য যুবক তা বোঝে জীবনসায়াহ্নে, জীবনভেলা ভাঙাতীরে ভেড়ার পর!
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হচ্ছে, বনশ্রী এই সমাজব্যবস্থা, মানুষের সীমাহীন লৌকিকতা ও পাষণ্ডতার প্রতি তীব্র বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছেন। তথাকথিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তিনি চরম আস্থাহীন হয়ে পড়েছেন। তাই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি আমার ছেলেকে আলেম বানাবো। সারাবিশ্বের মানুষকে সে আল্লাহ তা‘আলার দিকে ডাকবে। আমি নায়ক বানাবো না। কেননা, নায়ক হলে মদ খাবে, আমাকে ভালোবাসবে না।’
এটাই কুদরতের খেলা! কিছুদিন আগে এক রাজনীতিক বাংলাদেশের আলেম-ওলামা ও মাদরাসার ছাত্র সংখ্যা কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। কী স্পর্ধা! আল্লাহ তা‘আলা যাদের মাধ্যমে কেয়ামত পর্যন্ত দীন জিন্দা রাখবেন, কুরআন-হাদীসের আলো ও নূর যাদের দ্বারা প্রজ্জ্বলিত রাখবেন তাদের সংখ্যা কমানো মানে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা? নাকি স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা! আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত হাদীসে কুদসীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
«مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالحَرْبِ»
‘যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলী বা প্রিয় কারও সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে, আমি তার বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধের ঘোষণা দেই।’ [বুখারী : ৬৫০২]
কুরআন ও কুরআনী শিক্ষার বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগ সফল হবে না ইনশাআল্লাহ। যারা এর অপপ্রয়াস চালাবে তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহর ঘোষণা :
﴿ يُرِيدُونَ أَن يُطۡفُِٔواْ نُورَ ٱللَّهِ بِأَفۡوَٰهِهِمۡ وَيَأۡبَى ٱللَّهُ إِلَّآ أَن يُتِمَّ نُورَهُۥ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡكَٰفِرُونَ ٣٢ ﴾ [التوبة: ٣٢]
‘তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায়। কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরের পূর্ণতা বিধান করবেন, যদিও কাফেররা তা অপ্রীতিকর মনে করে।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ৩২)
আরেক আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে :
﴿ يُرِيدُونَ لِيُطۡفُِٔواْ نُورَ ٱللَّهِ بِأَفۡوَٰهِهِمۡ وَٱللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡكَٰفِرُونَ ٨ ﴾ [الصف: ٨]
‘তারা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’ (সূরা আস-সফ, আয়াত : ৮)
ইহুদী-খ্রিস্টানদের সমাজে এবং একজন খ্রিস্টান রমণীকে বগলদাবা করে সংসার করা পাশ্চাত্য ভাবনার এক বাঙালীর পক্ষেই সম্ভব এরূপ ইসলামবিরোধী ঘোষণা দেয়া। কিন্তু যারা বাস্তবজীবনে ঠোকরের পর ঠোকর খেয়েছেন, তথাকথিত শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বৃত্তায়নে যাদের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে, যে শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ একজন বিপন্ন নায়িকার বুক থেকে নিজের মেয়েটিকে কেড়ে নিয়ে পতিতালয়ে বিক্রি করে দিয়েছে এবং যে শিক্ষার সার্টিফিকেটধারীদের কাছে প্রতিকার চাইতে গিয়ে উল্টো হয়রানীর শিকার হয়েছেন সেই শিক্ষার প্রতি তার জেগেছে ঘৃণা, ক্ষোভ ও মর্মপীড়া।
তাই তিনি এমন এক শিক্ষার আশ্রয় নেয়ার পরিকল্পনা করেছেন যে শিক্ষায় সরলতা, সততা, মমতা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা আছে। আছে দেশ, মানবতা ও ইসলামী ভাবনার মহত্তম চিন্তা। যে শিক্ষায় নেই প্রতারণা, ধোঁকাবাজি, অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি। নেই ধর্ষণের নূন্যতম অভিজ্ঞতা। সুতরাং সেই শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইসলামবিদ্বেষীদের বগলদাবায় বসবাস করা খিস্ট্রান রমণীর স্বামী একজন নেতা হঠাৎ উড়ে এসে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও করতে পারে। কিন্তু জীবনবাস্তবতায় যিনি সমধিক পরিচিত, তিনিই বোঝেন কোন শিক্ষার কী ফল। তাই তো পোড় খাওয়া ব্যক্তি বনশ্রী বলতে পারেন, ছেলেকে আলেম বানাবো, যাতে করে সে বিশ্বের সকলের সেবা ও খেদমত করতে পারে। মা-বাবাকে ভালোবাসে, মাদক অনাসক্তিতে থাকে।
এফডিসি নামের যে আনন্দশালা সদা মুখরিত থাকে এবং বনশ্রী ও অন্যান্য অভিনেত্রী-অভিনায়কদের জীবন ছিল মুখরিত, যেখানে নিত্য রচিত হয় হাজারও কল্পকাহিনী, যেখান থেকে পরিকল্পনা করা হয় অভিনিত অবাস্তব নাট্যের কারসাজিতে দর্শকদের অশ্র“সিক্ত করার মহড়া, সেখানে যে প্রকৃতপক্ষেই হৃদয়ঘটিত কোনো আবেগ ও সহমর্মিতা নেই তার প্রমাণ পেয়েছেন বনশ্রী নিজেই। বিপদগ্রস্ত হয়ে এফডিসির শিল্পী সমিতিতে সাহায্য চেয়ে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কোনো শিল্পী তার দিকে মুখ ফিরিয়েও তাকাননি। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি সেই গন্তব্যেই ফিরে আসার চেষ্টা করছেন, যা শতসহস্র বছর ধরে ধরার বিভিন্নপ্রান্তের সহায়-সম্বলহীনদের আশ্রয়, যাঁর দরবার কাউকে ফিরিয়ে দেয় না, যেখানে প্রত্যাবর্তনকারীকে সমাদর করা হয় পরম ক্ষমার ঐশ্বর্যে। তাইতো বনশ্রীর মুখে প্রস্ফুটিত হচ্ছে সত্য ও ঘরে ফেরার আকুলতা। আল্লাহর কাছে আত্মনিবেদনের শ্বাশত অভিপ্রায়। মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে-
‘আমি সর্বদা আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকি, ইবাদত বন্দেগি করি। ‘নামায শিক্ষা’র বই বিক্রি করি। একটা লোক আমাকে সাহায্য করেছে। এক সাংবাদিক আছে, যিনি ইয়ং বয়সে আমাকে কাভারেজ দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বাসে দেখেছেন বই বিক্রি করছি। আমাকে তিনি প্রথমে চিনেননি আমিই পরিচয় দিয়েছি। এরপর তার সহায়তায় নিউজ হয়েছে।
‘আল্লাহ তা‘আলার কাছে বলি, হে আল্লাহ তা‘আলা, তুমি সব জানো। যারা আমার বুক খালি করেছে তুমি তার বুক খালি করো। আমার ছেলে আজ কারো বাড়িতে যেতে পারে না। বস্তিতে থেকে থেকে আমি কি যেন হয়ে গেছি। দু‘আ করবেন আল্লাহ তা‘আলা যেন আমার ওপর রহমত নাযিল করেন।’ আরেকটি কথা বলুন, যে লোকটি পাঁচওয়াক্ত নামায পড়ে সে কীভাবে আমার বুক খালি করে দিলো? আসলে দেখুন ও কীসের মুসলিম। আমি মেয়েকে দশ মাস বুকে লালন করেছি। সে আমার বুক খালি করে দিল? আমি এই ছেলেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করছি।’
কাকুতির সঙ্গে আছে বিধ্বস্ত সমাজের অবাঞ্ছিত ফসল থেকে আশ্রয়। ঐশী (উচ্ছৃঙ্খল ও নেশার জীবনের প্রতিবন্ধক মনে করে যে মাবাবাকে একই সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল) তো হাল-আমলের বখে যাওয়া সমাজ সংসারের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। বনশ্রী নিজ সন্তানকে সেরকম কিছু দেখতে চান না। তাই আকুতির সঙ্গে ঝরে পড়ছে শঙ্কাও। তিনি বললেন, ‘নাকি আমার মেয়েকে ঐশী বানাচ্ছে? আমি আমার মেয়েকে দেখতে চাই। আমি আমার মেয়ের সুন্দর ও শালীন জীবনে দেখতে চাই। ঐশীর মতো দেখতে চাই না।’
হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে বনশ্রীর এই ফিরে আসাকে স্বাগত জানাই। আল্লাহ তা‘আলা তার বর্তমান ও পরকালীন জীবন সুন্দর করুন। তার ছেলেকে আলেম বানানোর যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করেছেন তা বাস্তবায়ন হোক। যেসব ইসলামবিদ্বেষী ও ইহুদী-খ্রিস্টানদের চর এদেশে ইসলাম থাক, মুসলিম থাক, ইলমে দীনের শিক্ষা থাক তা বরদাশত করতে পারে না, যারা আলেম কমানোর নামে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তারা দেখুক ইলমে দীনের মাহাত্ম্য, বড়ত্ব ও নির্মলতা। বনশ্রীর সেই হতদরিদ্র রোগা ছেলেটি এদেশের একজন মস্ত বড় আলেম হয়ে আল্লাহদ্রোহীদের মুখে চপেটাঘাত করুক আল্লাহর কাছে মনেপ্রাণে সেই কামনাই করি।
আফসোস হয় ক্ষমতাসীনদের দেখে। এরা বিদেশীদেরকে এভাবে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে, তাদের কথায় ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করা, ইসলামের বৈরিতায় তৃপ্তি পায়। যুদ্ধ ঘোষণা করে ইলমে দীনের বিরুদ্ধে। অথচ আমাদের পূর্বপরবর্তী মুসলিম শাসকগণ শুধু ইলমে দীনই নয়; যে কোনো ধরনের শিক্ষা বিস্তারের জন্য সদা তৎপর ছিলেন। খলীফা মামুন এমন সব নিত্যনতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন যা আজকের প্রেক্ষাপটে বড় অদ্ভুত ও বিস্ময়কর বলে না মেনে উপায় নেই। আর ইলমে দীনের প্রচার-প্রসারে তো ছিলেন জীবনোৎসর্গকারী।
পক্ষান্তরে বর্তমান যুগের রাজা-বাদশা ও ক্ষমতাশালীরা নিজেদের সন্তানদেরকে পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থায় পারদর্শী করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন এবং কুরআন-সুন্নাহ তথা ইসলামের মৌলিক বিদ্যা থেকে তাদের একেবারেই বঞ্চিত করেন। অতীতের কীর্তিমান শাসকগণের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা তাদের সন্তানদেরকে কুরআন-হাদীসের ইলম দান করে ধন্য হতেন এবং সন্তানদের জীবন ধন্য হয়েছে বলে মনে করতেন। বেশিদিন আগের কথা নয়। মোঘল সম্রাট আলমগীরের কথাই ধরুন। ভারত শাসন করেছেন যাঁরা, তাদের কয়জন তার মতো কৃতিত্ব ও ইতিহাসে স্মরণীয় হতে পেরেছেন?
‘বাদশা আলমগীর,
কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলবী দিল্লির’
হৃদয়কাড়া কবিতার এ অংশই প্রমাণ করে বিখ্যাত মোঘল সম্রাট পুত্রের জন্য কী ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি নিজেও অত্যন্ত ইলম-অনুরাগী ছিলেন। বিশ্বখ্যাত ফাতাওয়ার গ্রন্থ ‘ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী’ তারই তত্ত্বাবধানে সংকলিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। আগের যুগের সব খলীফা ও আমীর-উমারা এরূপই ইলমের প্রতি সীমাহীন অনুরাগী ছিলেন। যেমন বিখ্যাত শাসক আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান তার পুত্রকে উপদেশ প্রদান করে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! ইলম শিক্ষা করো। কেননা যদি নেতা হও তবে সবার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবে। যদি মধ্যম ধরনের লোক হও তবে নেতার আসন লাভ করতে পারবে। আর যদি সাধারণ প্রজা হও তবে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করতে পারবে।’
এরপর তিনি কবিতা আবৃত্তি করে বলেন,
ومن لم يذق مر التعلم ساعة تجرع ذل الجهل طول حياته
ومن فاته التعليم وقت شبابه فكبر عليه أربعا لوفاته
وذات الفتى والله بالعلم والتقى إذا لم يكونا لا اعتبار لذاته
‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের কিঞ্চিত তিক্ততা বরদাশত করে না, সে দিনের পর দিন মূর্খতার লাঞ্ছনা গিলতে বাধ্য হয়। যৌবনে যার ইলম শিক্ষা করার সুযোগ হয়নি তার ওপর (জানাযার) চার তাকবীর পাঠ করো। কেননা সে তো মৃত! আল্লাহ তা‘আলার শপথ! যুবকের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব তার ইলম ও তাকওয়ার কারণে। আর যদি এই দুটি বস্তু না থাকে তবে তার কোনো মূল্যই নেই।’
কোথায় ইতিহাসের একজন নামকরা প্রতাপশালী শাসক খলীফা মারওয়ান আর কোথাকার কোন নচ্ছান দুদিনের নেতা! যারা কীর্তিমান, যারা মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধার জায়গা করতে চান তারা কখনও জ্ঞান ও ইলমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন না। ইলমের সঙ্গে যুদ্ধ! সে তো তারাই পারে যারা মানুষের হৃদয়ে আবর্জনার মতো ঘৃণা হয়ে ভাসমান থাকতে চায়।
বনশ্রীর জীবনের গল্পটা শেষ করি কবির ‘কাব্যগল্প’ দিয়ে-
একুল ভাঙে ওকুল গড়ে এই তো নদীর খেলা
সকাল বেলার আমীর রে ভাই ফকির সন্ধ্যা বেলা
রে ভাই এই তো বিধির খেলা....
তসলিমা নাসরিন। বাংলাদেশের এক বিপথগামী লেখিকার প্রতিচ্ছবি। নামটা শুনলে যে কারো চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক অশ্লীল রিপুতাড়িত উগ্র নারীর অবয়ব। শুধু নিজের শরীর ও জীবন-যৌবনকেই তিনি পানির দরে পুরুষজাতির সামনে উপস্থাপন করেননি, বরং অন্য নারীদেরকেও তিনি এই পথে আহ্বান করেছেন। নগ্নতার ইন্ধন যুগিয়ে তিনি শুধু নিজেকেই ধ্বংস করেননি, বরং ধ্বংস করেছেন একটি সমাজকে, নিজের পরিবারকে এবং দেশের বৃহৎ লেখক গোষ্ঠীকে। বাংলাদেশের বহু নামকরা লেখককে তিনি যৌবনের বড়শি দিয়ে শিকার করেছেন খুব সহজেই। আবার তাদের এসব ‘কীর্তি’র কথা প্রকাশও করেছেন নির্দ্বিধায়। ফলে তসলিমা এখন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে তাওহীদপ্রেমী জনতার আন্দোলনের প্রয়োজন হবে না, তার এই অভিসারসঙ্গী এলিট শ্রেণীরাই আন্দোলন করে তাকে প্রতিহত করবে!
তসলিমার কোনো বই সাহিত্যের মানে উত্তীর্ণ নয়। কেউ তা সাহিত্যের বিচারে মূল্যায়নও করে না। তিনি নিজেও নিজেকে সাহিত্যসম্পন্ন বলে মনে করেন না। বাবা তাকে একজন ডাক্তার বানিয়েছিলেন। তার কাজ ছিল অসুস্থ মানুষের দেহে ইনজেকশনের সূঁই ফুটিয়ে সুস্থ করে তোলা। কিন্তু তিনি সেই পথ ছেড়ে আনাড়ি হাতে কলম নিয়ে তা দিয়ে সুস্থ মানুষের দেহে সম্ভ্রমহানীর হুল ফোটাচ্ছেন। সাহিত্যমানের জন্য নয়; মানুষ তার বই পড়ে অসুস্থ সুখ লাভের উদ্দেশ্যে। এরা হলো গ্রামগঞ্জের বাজারী হকারদের মতো; যারা রোগের চটকদার বিবরণে শ্রোতা সংগ্রহ করে মুহূর্তেই বিরাট মজমা জমিয়ে তোলে। কিন্তু কিছু বোকা শ্রোতা ছাড়া অধিকাংশ লোক তাদের কথা ও দাওয়া কোনোটাই গ্রহণ করে না।
সুতরাং তসলিমার লেখা এধরনের অশ্লীলতা সম্বলিত কোনো বই পড়ার গরজবোধ করিনি কখনও। তবে ঢাকার ফুটপাত থেকে পুরান বই কেনার অভ্যাস আছে আমার। এসব দোকান থেকে জীবনে অনেক মূল্যবান বই দেখা ও কেনার সুযোগ হয়েছে। তাই ওদিকে গেলে পুরান বইয়ের বাজারে একটু উঁকি না দিলে স্বস্তি পাই না। একবার বাংলাবাজার থেকে আসতে এভাবে উঁকি দিলাম ফুটপাতের একটি পুরান বইয়ের দোকানে। সাদা মলাটে বাঁধানো একটি বইয়ে দৃষ্টি আটকে গেল। ‘আমি তসলিমার মামা বলছি’ শিরোনামের বইটি কিনতে বিলম্ব করলাম না। একটা মেয়ে কেন এত বেপরোয়া, উচ্ছৃখল এবং অস্বাভাবিক পথে হাঁটা শুরু করল তা জানার কৌতূহল বইটি কিনতে আমাকে উৎসাহিত করল। বইয়ের লেখক তসলিমার মামা লেখক নন এমনকি উচ্চ শিক্ষিতও নন বলে ভূমিকা পাঠ করে বুঝা গেলো। নিতান্তই ভাগ্নির কলমের খোঁচায় জর্জরিত হয়ে অপারগ হয়ে কলম ধরেছেন তিনি। তসলিমা তার গোটা পরিবারকে দেশবাসীর সামনে কত নির্মম ব্যভিচারী পরিবার হিসেবে উপস্থাপন করেছেন তা ফুটে উঠেছে তসলিমার মামার কাঁচা হাতের লেখা এই বইয়ে।
তসলিমা নিজেও তার এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, তিনি তার পরিবারকে অত্যন্ত নির্মমভাবে ‘জবাই’ করেছেন। তার জবাইয়ের নির্মমতা কত ভয়াবহ হতে পারে তা ওই বইটি পড়েও কিছু আঁচ-অনুমান করা যায়।
তিনি অত্যন্ত নোংরা ভাষায় মা, বাবা, চাচা, মামা, ভাইবোন এবং নিকট ও দূর সম্পর্কের প্রায় সব আত্মীয়-স্বজনকে অত্যন্ত কামুক পশুসম চরিত্রের মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এসব কথা লেখার সময় তসলিমার মস্তিষ্ক সুস্থ ছিল কিনা, কখনও কখনও সন্দেহ হয়। যিনি নিজের জীবনকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বহুপুরুষের ভোগের সামগ্রী ভাবতে পছন্দ করেন, একে একে স্বামী ছেড়ে বহুগামিতায় বিকৃত সুখ ও অর্থবিত্ত খোঁজেন, আল্লাহ-রাসূলের বিরুদ্ধে অকপটে কুৎসা রটনা করেন, কুরআন-হাদীস ও ইসলাম-মুসলমানের বিরুদ্ধে চরম বিষোদগার করেন, জীবনের পড়ন্তবেলায় সেই তসলিমা কেমন আছেন তা মাঝে মাঝে জানার কৌতূহল হয়। বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক ফরহাদ মজহার তার এক লেখায় ইউরোপিয়ান এক জরিপের ফলাফল উল্লেখ করেছেন। জরিপটা ছিল নাস্তিকদের বিষয়ে। জরিপে উল্লেখ করা হয়, অধিকাংশ নাস্তিক জীবনের পড়ন্ত কিংবা মাঝবেলায় আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার এবং আড়ালে-আবডালে তাঁকে মান্য করতে তৎপর হয়ে ওঠে।’
জরিপের এই ফলাফল পরম বাস্তব তথ্য। একজন মানুষ কতকাল আর প্রবৃত্তির পূজা করে বাঁচতে পারে? এক আল্লাহয়, এক স্রষ্টায়, এক মালিকের বিশ্বাস ও ইবাদতে যে তৃপ্তি, নির্ভরতা ও দায়মুক্তির নিশ্চয়তা বহু আল্লাহয় তার কল্পনাই করা যায় না। স্বয়ং আল্লাহ কুরআনে একথার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। তাই সঙ্গত কারণেই জীবনের পড়ন্ত কিংবা মাঝবেলায় এসে অনেক নাস্তিক বেকারার হয়ে যায়, খোঁজে ফেরে প্রকৃত আল্লাহকে। ভ্রষ্টবিহঙ্গের মতো। যে উদগ্রীব হয়ে খোঁজে তার নীড়। আসলে খেঁড়পাতের সবুজাভ স্পন্দন কতদিনই বা থাকে? একসময় স্পন্দন শেষ হয় এবং বৃক্ষ থেকেই তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তাই জীবনের এই উন্মাদনা থাকে না চিরদিন। আল্লাহর গোলামীতে নিজেকে সঁপে দিতেই হয় কোনো না কোনো সময়ে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰٓ إِلَى ٱلسَّمَآءِ وَهِيَ دُخَانٞ فَقَالَ لَهَا وَلِلۡأَرۡضِ ٱئۡتِيَا طَوۡعًا أَوۡ كَرۡهٗا قَالَتَآ أَتَيۡنَا طَآئِعِينَ ١١ ﴾ [فصلت: ١١]
‘অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করলেন, যা ছিল ধুম্রপুঞ্জবিশেষ। অনন্তর তিনি তাকে এবং পৃথিবীকে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে আসো ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা আসলাম অনুগত হয়ে।’ (সূরা ফুসসিলাত, আয়াত : ১১)
বিরাট এক ভূমিকা পেশ করে ফেললাম। কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য তসলিমার একটি সাক্ষাৎকার। জীবনে কতবার, কতভাবে আল্লাহ-রাসূলের বিরুদ্ধে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কিন্তু কিছুদিন আগে ‘পার্বত্য নিউজ’ নামে একটা পত্রিকায় তার দেয়া সাক্ষাৎকারে আছে নীড়ে ফেরার আকুলতা, অতীত জীবনের পাপমোচনের দায়বদ্ধতা। সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম এমন-
‘মাঝেমধ্যে মনে হয় সব ছেড়ে নামাজ-রোজা করি, তওবা করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করি।’
বিভিন্ন সময়ে ইসলামের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে যাযাবরি জীবনযাপন করা তসলিমার এখন বিশাল পৃথিবীর কোথাও জায়গা হচ্ছে না। হবেই বা কী করে? জমিন যে আল্লাহ তা‘আলার!
﴿ يُولِجُ ٱلَّيۡلَ فِي ٱلنَّهَارِ وَيُولِجُ ٱلنَّهَارَ فِي ٱلَّيۡلِ وَسَخَّرَ ٱلشَّمۡسَ وَٱلۡقَمَرَۖ كُلّٞ يَجۡرِي لِأَجَلٖ مُّسَمّٗىۚ ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمۡ لَهُ ٱلۡمُلۡكُۚ وَٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ مَا يَمۡلِكُونَ مِن قِطۡمِيرٍ ١٣ ﴾ [فاطر: ١٣]
‘তিনি রাত্রিকে দিবসে প্রবিষ্ট করেন এবং দিবসকে রাত্রিতে প্রবিষ্ট করেন। তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে কাজে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকটি আবর্তন করে এক নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত। ইনি আল্লাহ; তোমাদের পালনকর্তা, সাম্রাজ্য তাঁরই। তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা তুচ্ছ খেজুর আঁটিরও অধিকারী নয়।’ (সূরা ফাতির, আয়াত : ১৩)
তাই পৃথিবীর কোনো জমিনই নাস্তিক ও আল্লাহদ্রোহীর ভার বহন পছন্দ করে না। ফলে জীবনের পড়ন্ত বেলায় এখন তিনি হতাশ। কমে গেছে সেই তারুণ্যময় উচ্ছৃঙ্খল লেখালেখি। ‘সবকিছুর একটা শেষ আছে’ সেই সত্য এখন তার অনুভবে স্পষ্ট। ভুল, হতাশা ও হতাশা থেকে নতুন উপলব্ধি, শঙ্কা-দোদুল্যমানতার মধ্যে দিন কাটছে তার। নিজেই ভাবছেন, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয় সব ছেড়ে নামাজ-রোজা করি, তওবা করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করি।’ কম্যুনিস্টরাও তো এক সময় বদলে যায়। পার্বত্য নিউজে দেওয়া তার ওই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে এধরনের অকল্পনীয় কিছু তথ্য। একজন স্বঘোষিত নাস্তিকের এ বাস্তবজীবনের অনুভূতি প্রকাশ করতে সাক্ষাৎকারটির কিছু অংশ তুলে ধরা যাক। তবে পাঠকের পূর্ণ অনুমানের জন্য কাটছাঁট না করে সাক্ষাৎকারের ওই পূর্ণ অংশ উপস্থাপন করা হলো।
[আলোচিত এই সাক্ষাৎকারের কথায় পরিষ্কার, এখন তিনি হতাশ, চোখের নিচে কালি পড়েছে, চামড়ায় বয়সের ছাপ, শরীরের মধ্যে নানারকম ব্যথা-বেদনা তো আছেই। একাকিত্ব তাকে আরও পঙ্গু করে দিচ্ছে। এমন অবস্থায় বিদেশের কোথাও থিতু হতেও পারছেন না। দেশে ফেরাও তার জন্য দিন দিন কঠিন হয়ে গেছে। যে প্রতিবাদী ঈমানদার জনতার ভয়ে দেশ ছেড়েছিলেন, সে ভয় এখনও তাকে তাড়িয়ে ফিরছে। তিনি বলেছেন, লন্ডন থেকে দিন কয়েকের জন্য গিয়েছিলাম ভারতে। আর কাকতালীয়ভাবেই দেখা গেলো এই বিতর্কিতা লেখিকা ডা. তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে। তিন দিনের নানা বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হলো। এ বিষয়গুলো তুলে ধরতেই আজকের এই প্রয়াস। সাক্ষাৎগ্রহীতার ভাষ্য]
‘প্রশ্ন : আপনার কাছে একটা প্রশ্ন। এই যে লেখালেখি করলেন, এর মূল উদ্দেশ্য কী ছিল, দেহের স্বাধীনতা না চিন্তার স্বাধীনতা?
তসলিমা নাসরীন : প্রশ্নটি আপেক্ষিক। আসলে আমিতো পেশায় ছিলাম চিকিৎসক। আমার বাবা চেয়েছিলেন তার মতো মানে অধ্যাপক ডা. রজব আলীর মতো আমিও একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক হই। শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনে আমি অনুভব করি, নারীরা আমাদের সমাজে ক্রীতদাসীর মতো। পুরুষরা তাদের ভোগ্যপণ্যের মতো ব্যবহার করে। এ কারণেই বিষয়গুলো নিয়ে প্রথমে লেখালেখির কথা ভাবি।
প্রশ্ন : আমার প্রশ্নের জবাব হলো না। কী স্বাধীনতার দাবিতে আপনার এ লড়াই?
তসলিমা : আমি প্রথমত নারীর জরায়ুর স্বাধীনতার দাবি তুলি। একজন পুরুষ যখন চাইবে, তখনই তার মনোস্কামনা পূর্ণ করতে ছুটে যেতে হবে। এটা তো হতে পারে না। অথচ তখন ছুটে না গেলে জীবনের সব পুণ্য নাকি শেষ হয়ে যাবে। চিন্তার স্বাধীনতা না থাকলে ভালো লেখক হওয়া যায় না। দেহের স্বাধীনতার বিষয়টা গৌণ। তবে একেবারে ফেলনা নয়। পুরুষই একচেটিয়া মজা লুটবে, নারী শুধু ভোগবাদীদের কাছে পুতুলের মতো হয়ে থাকবে, এটা মেনে নিতে পারিনি।
প্রশ্ন : আপনি পরিকল্পিতভাবে নিজেকে আলোচিত ও অপরিহার্য করে তোলেন। আজ বাংলা সাহিত্যে বা বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে আপনি তো চরমভাবে অবহেলিত।
তসলিমা : আমি একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছি। সত্য কথা সাহিত্যে এলে তা অনেকের জন্য কষ্টদায়ক হয়। আমি আমার বহু স্বামী ও ভোগ্য পুরুষদের নামধাম প্রকাশ করে দেওয়ায় অনেক বন্ধু আমাকে এড়িয়ে চলেন। বাংলা সাহিত্যের অনেক দামি দামি পুরুষও চান না যে আমি দেশে ফিরি। এক সময় আমার বিপক্ষে ছিল কট্টর মৌলবাদীরা। এখন প্রগতিশীল অনেক সাহিত্যিকও বিপক্ষে। কারণ এদের নষ্ট মুখোশ আমি খুলে দিয়েছি।
প্রশ্ন : আপনি চিকিৎসক থাকলেই ভালো করতেন। মিডিয়াতে কেন এলেন? সাহিত্যেই বা কেন ঢুকলেন?
তসলিমা : আমি নারীর অধিকার নিয়ে ভেবেছি। কিন্তু এখন মনে হয় আমি মানবিকভাবে আশ্রয়হীন। আর এ কারণেই আমি অন্য স্রোতে সুখ খুঁজেছি। পরিবার হারালাম, স্বামী সন্তান হলো না, ঘর-সংসার হলো না। তখন দৈহিক সম্পর্কে নেশাগ্রস্ত না থেকে আর কোনো পথ খোলা ছিলো না।
প্রশ্ন : এখন আপনি কী চান?
তসলিমা : অনেক কিছু। আমার হারিয়ে যাওয়া জীবন, যৌবন, ভোগ-উপভোগ, স্বামী-সন্তান, পরিবার-পরিজন। কিন্তু দিতে পারবেন কি? আজ আমি নিজ দেশের কাউকে দেখলে কুণ্ঠিত ও লজ্জিত হই। খ্যাতি, অর্থ, পুরস্কার সবই আছে, তবুও মনে হয় আমি ভীষণ পরাজিত। দিনে হইচই করে কাটাই, রাত হলে একাকিত্ব পেয়ে বসে। আগের মতো পুরুষদের নিয়ে রাতকে উপভোগ করার মতো দেহ-মন কোনোটাই নেই।
প্রশ্ন : পুরনো বন্ধুরা যোগাযোগ রাখেনি? এখন কেমন পুরুষ বন্ধু আছে?
তসলিমা : এক সময় অনেক ব্যক্তিত্ববানদের পেছনে আমি ঘুরেছি। ব্যক্তিত্বহীনরা আমার পেছনে পেছনে ঘুরেছে। আজকাল আর সুখের পায়রাদের দেখি না। মনে হয় নিজেই নিজেকে নষ্ট করেছি। পরিচিত হয়েছি নষ্ট নারী, নষ্টা চরিত্রের মেয়ে হিসেবে। লেখালেখি করে তাই এসব পুরুষদের ওপর আমার রাগ, ঘৃণা ও অবহেলা প্রকাশ করেছি। চরিত্রহীনতার রাণী হিসেবে প্রকাশিত হলাম, অথচ এই রাণীর কোনো রাজাও নেই, প্রজাও নেই। এ জন্য আজ হতাশায় নিমজ্জিত আমি।
প্রশ্ন : ধর্ম-কর্ম করেন?
তসলিমা : মাঝেমধ্যে মনে হয় সব ছেড়ে নামাজ-রোজা করি, তওবা করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করি। কম্যুনিস্টরাও তো এক সময় বদলে যায়। আমার জন্ম ১২ই রবিউল আউয়াল, মহানবীর জন্মদিনে। নানী বলেছিলেন, আমার নাতনী হবে পরহেজগার। সেই আমি হলাম বহু পুরুষভোগ্যা একজন ধর্মকর্মহীন নারী। বলা তো যায় না, মানুষ আর কতদিন বাঁচে। আমার মা ছিলেন পীরের মুরীদ। আমিও হয়ত একদিন বদলে যাবো।
প্রশ্ন : বিয়ে-টিয়ে করবার ইচ্ছে আছে কি?
তসলিমা : এখন বিয়ে করে কী করবো? পুরুষটিই বা আমার মধ্যে কী পাবে? সবই পড়ন্ত বেলায়। যে বিয়ে করবে, সে যদি আমার মধ্যে কিছু না চায়, সন্তান না চায়, এমন মানব পেলে একজন সঙ্গী করার কথা ভাবতেও পারি।
প্রশ্ন : আপনি কি একেবারে ফুরিয়ে গেছেন?
তসলিমা : না, তা ঠিক নয়। তবে পুরুষতো শত বছরেও নারীকে সন্তান দেয়। মেয়েরা তা পারে না। আমি এখনও ফুরিয়ে যায়নি। তবে নতুন বা আনকোরাতো নয়। পুরুষদেরও বয়স বাড়লে আগ্রহ বেড়ে যায়। এতটা মেটানো তো আর এই বয়সে সম্ভব হবে না।
প্রশ্ন : বয়স বাড়লে পুরুষের চাহিদা বাড়ে এটা কীভাবে বুঝলেন?
তসলিমা : কত বুড়ো, মাঝবয়সী ও প্রবীণ বন্ধুদের নিয়ে মেতেছি, এটা আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি।
প্রশ্ন : রাত যখন বিশ্বকে গ্রাস করে, আপনার ঘুম আসছে না তখন আপনার বেশি করে কী মনে পড়ে?
তসলিমা : খুব বেশি মনে পড়ে আমার প্রথম প্রেম, প্রথম স্বামী, প্রয়াত কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। অনেক কাঁদি তার জন্য। পেয়েও হারালাম তাকে। রাগ হয়েছিল বিয়ের রাতেই। (অশ্লীল হওয়ায় পরের অংশ বাদ)
প্রশ্ন : অন্য স্বামীদের কথা মনে পড়ে না?
তসলিমা : তারা এমন উল্লেখযোগ্য কেউ নন। তাদের মুরোদ আমি দেখেছি। তার চেয়ে বহু বন্ধুর মধ্যে আমি দেখেছি কেমন উন্মত্ত তেজ। ওদের স্মৃতি মনে পড়ে মাঝে মধ্যে।
প্রশ্ন : দেশে ফিরবেন না?
তসলিমা : দেশই আমাকে ফিরতে দেবে না। আর কোথায় যাবো? বাবা-মা-ভাই-বোন সবাইকে আমি লেখাতে জবাই করে দিয়েছি। আসলে নেশাগ্রস্তই ছিলাম, অনেক কিছু বুঝিনি। আজ আত্মীয়-স্বজনও আমাকে ঘৃণা করে। মরার পর লাশ নিয়ে চিন্তা থাকে, আমার নেই। যে কোনো পরীক্ষাগারে দেহটা ঝুলবে। ছাত্রদের কাজে লাগবে।’
এই হলো ধর্ম, সমাজ ও নির্মল সংস্কৃতির বিপরীত মেরুর প্রবক্তা রুচিহীন নাস্তিক মহিলা। যৌন স্বাধীনতা দাবি করে বিতাড়িত হয়েছে দেশ থেকে, মাতৃভূমি থেকে এবং নারীত্বের কাতার থেকে। পেয়েছে কেবল বিধর্মীদের এঁটে কয়েক মুঠো ভাত। কিন্তু এখন তাও বাসি হয়ে গেছে। তাই আকুলতা বাড়ছে ফিরে আসার, আপন নীড়ে ঠিকানা করে নেওয়ার। সব বিহঙ্গই সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফেরে। মানুষের জীবনেও সন্ধ্যাবেলা আছে। জীবন সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময় থাকে মানববিহঙ্গের ঘরে ফেরার। জানি না তসলিমার সেই সুযোগ হবে কিনা? আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি ঘরে ফিরুন। ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েই কবরের পথ ধরুন। তাকে দেখে শিখুক তার ভাবগুরু ও ভাবশিষ্য অসংখ্য ধর্মদ্রোহী ও ইসলামবিদ্বেষী নারী-পুরুষ।
ইতিহাসের আইয়ামে জাহেলিয়া তথা জাহেলী যুগকে গালমন্দ করি। অসভ্য, বর্বরতার দৃষ্টান্ত দিতে এই যুগের নাকি তুলনা নেই! নির্মমতা, পাশবিকতা ও অশ্লীলতার দরজা-জানালা খুলে ওই যুগের লোকেরা নাকি সভ্যতার দিগম্বর প্রাণীতে পরিণত হয়েছিল! পক্ষান্তরে আমরা জাহেলিয়াতের সেই কলঙ্কজনক অধ্যায় দূরে ঠেলে রকেট গতিতে সভ্যতার স্বর্ণশিখর ও মানবিকতার মঙ্গলগ্রহে পৌঁছে গেছি! কিন্তু বাস্তবতা আসলে কী? আমরা কি সত্যিকার অর্থেই জাহেলিয়াতের আখ্যান থেকে পলায়ন করছি, না জাহেলিয়াতের নগ্ন-ময়দানে ততোধিক দিগম্বর সাজে নৃত্য করছি?
জাহেলী যুগে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনা আজ আমাদের তথাকথিত সভ্য ও বিজ্ঞানময় সমাজদেহে আছড়ে পড়ে পাশবিকতা ও অশ্লীলতায় ক্ষুদ্রতার দোষে অভিযুক্ত হয়ে ছিটকে পড়ছে! সে সময়ের জাহেলীপনা ছিল মন্থর, উটের শ্লথ গতির। কিন্তু আজ যে অশ্লীলতা ও পাশবিকতার ছড়াছড়ি তা জাহেলিয়াতের সকল জাহেলী ও দস্যিপনাকে ছাড়িয়ে যেতে বাধ্য। উদাহরণস্বরূপ জাহেলীযুগের বিখ্যাত কবি ইমরুল কায়সের কথাই ধরুন। তিনি এক কবিতায় তার নারী সম্ভোগের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন বেশ নগ্ন ও অশালীনভাবে সেকথা অস্বীকার করার জো নেই। তিনি লিখেছেন- আমি প্রেমিকার এক ডালিম খাই আর অপরটি চোষে তার শিশুবাচ্চা....
নিঃসন্দেহে এটি অশ্লীল সাহিত্যের দৃষ্টান্ত। বস্তুবাদী অধিকাংশ কবির যা মজ্জাগত স্বভাব। তাদের কবিতা নাকি নারীদেহের উপস্থিতি ছাড়া বাঙময় হয় না! একারণেই বলতে গেলে প্রত্যেক কবির কবিতায় নগ্নভাবে প্রকাশ পায় নারীদেহের কথা, কবিতার পরতে পরতে ভেসে ওঠে পরনারীর উত্তেজক নিলাজ অঙ্গের কথা। তাই একজন স্বভাবজাত ও জাহেলী সভ্যতার প্রভাবমিশ্রিত সমাজে বসবাসরত কবি থেকে এধরনের অশ্লীলতা প্রকাশ পাওয়া খুব অস্বাভাবিক বলে ধরা যায় না। কিন্তু আজ লেখক, কবি ও সভ্যতার দাবিদারদের থেকে যেসব কাব্য-কবিতা ও আত্মকথা প্রকাশ পাচ্ছে তা কোনো সভ্যতার যুগ হিসেবে তো নয়ই; জাহেলী যুগের লোকেরাও কল্পনা করতে পারবে না। এসব ঘটনাকে জাহেলী কাজ বললে আমার ধারণা জাহেলী যুগের লোকেরাও অপমানবোধ করবে। সব লোককেই কি পাগল বলা যায়, এতে পাগলের অবমাননা হয় না! বস্তুত আমরা জাহেলী যুগ পেরিয়ে গেছি চরিত্র আর নৈতিকতার প্রশ্নে। দেশ-বিদেশের দুটি ঘটনা পেশ করি।
এক. ইংল্যান্ড ফুটবল দলের এক সময়ের কোচ ভেন গেরান। জীবনসায়াহ্নে এসে তিনি তার আত্মজীবনী প্রকাশ করে বিশ্বজুড়ে ঝড় তুলেছেন। আলোচনার সুনামি বিশ্বমানচিত্রের সর্বত্র আছড়ে পড়ছে। বেশি আছড়ে পড়ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশে। এদেশের একজন বেশ নামকরা যুবতী তার শয্যাশায়ী হয়েছেন এবং একজন মুসলিম যুবতী কীভাবে একটা বিধর্মী বুড়ো ষাঁড়ের নিকৃষ্ট গল্পের উপাদান হলেন তা পাঠ করে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। সেই সঙ্গে অবাক হই এই সভ্য সমাজের কথা ভেবে, যে সমাজের একজন বৃদ্ধ অকপটে বলতে পারেন তার অবৈধ সম্পর্কের কথা? পুরো রিপোর্ট দেখুন :
এক রাতের ঘটনা। ভেন গোরান এরিকসনের বাসায় বাংলাদেশের মেয়ে মারিয়া আলম (ছদ্মনাম)। তারা একসঙ্গে এক টেবিলে বসে রাতের খাবার খেলেন। এরিকসনের বাসায় কোনো পরিচারিকা ছিল না। তাই এরিকসন নিজেই টেবিল পরিষ্কার করলেন। এরপর তিনি টেবিলের ডিশ, প্লেট ধুয়ে ফেললেন। এসব যখন শেষ হলো তখন তিনি মারিয়া আলমকে নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলেন। পৌঁছে গেলেন তার বেডরুমে। সেখানে কাটে তাদের রাত। এ ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে ইংল্যান্ড ফুটবল দলের সাবেক ম্যানেজার ভেন গোরান এরিকসনের আত্মজীবনী ‘ভেন : মাই স্টোরি’তে।
বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর বৃটেনসহ পশ্চিমা দুনিয়ায় ব্যাপক সাড়া পড়ে গেছে। শুধু মারিয়া আলম নন, অনেক মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এরিকসনের। তাদের সবার কথাই এ বইয়ে তুলে ধরেছেন তিনি। আর তা নিয়ে বিশেষ করে বৃটিশ মিডিয়া তোলপাড়। তারা বিভিন্ন প্রতিবেদনে ফিরে যাচ্ছেন পেছনের দিনগুলোতে। তখন এরিকসনের সঙ্গে মারিয়ার সম্পর্ক প্রকাশিত হয়ে পড়ে তারপর তাদের সম্পর্ক আস্তে আস্তে ভেঙে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে মারিয়া প্রকাশক ম্যাক্স ক্লিফোর্ডের কাছে তার কাহিনী ৫ লাখ পাউন্ডে বিক্রি করে দেন বলে খবর বেরিয়েছিল।
সেখানেই মারিয়া বলেছেন, ওই রাতের খাবার খাওয়ার পর এরিকসন আমাকে নিয়ে তার বেডরুমে প্রবেশ করেন। প্রথম দিন বা সেখানে কীভাবে তারা উদ্দাম সম্পর্কে মিলিত হন তার বিস্তারিত বর্ণনাও দেন। এরিকসন তাই লিখেছেন, ম্যাক্স ক্লিফোর্ডকে মারিয়া যে কাহিনী বলেছে তাতে রয়েছে আমাদের ওই রাতের শারীরিক সম্পর্কের গ্রাফিক্স বর্ণনা কিংবা বলা যায় সেন্সরবিহীন উন্মুক্ত কাহিনীর বর্ণনা। প্রথম ডেটিংয়েই তারা উদ্দাম শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
মারিয়া বলেছেন, ফুটবল এসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী মার্ক পালিওর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তৃপ্তির ছিল না। তবে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল অল্প সময়ের জন্য। অন্যদিকে এরিকসনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল একেবারেই অন্য স্বাদের। তিনি দৈহিক লীলায় ঝানু ওস্তাদ। তার সঙ্গে যে সম্পর্ক হয়েছিল তা ছিল অদ্ভুত। আবেগে ভরা। এক পর্যায়ে মারিয়া জেনে যান, ন্যান্সি ডেলওলিও নামে একজন ইতালিয়ান বান্ধবী আছেন। ভালোবাসার টানে তখন থেকে ৬ বছর আগে স্বামীকে ফেলে এরিকসনের কাছে চলে এসেছেন। ন্যান্সি সম্পর্কে একদিন মারিয়া জানতে চান। জবাবে এরিকসন বলেন তাদের সে সম্পর্ক এখন মৃত। এরিকসন বলেন, ন্যান্সির প্রতি শারীরিক আকর্ষণ অনেক দিন আগেই আমার উঠে গেছে।
এরিকসন স্বীকার করেছেন, তিনি ন্যান্সির কথা গোপন করেছিলেন। মারিয়াকে জানতে দেননি। ন্যান্সি ও এরিকসন একই বাড়িতে বসবাস করলেও তাদের বিয়ে হয় নি তখনও। কিন্তু ন্যান্সিকে ফাঁকি দিয়ে তিনি মারিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এরিকসন লিখেছেন, আমি ন্যান্সিকে ঠকাচ্ছি। এতে আমার কোনো অনুশোচনা ছিল না। আসলে ন্যান্সি নয়, ভীষণ ভালোবেসেছিলাম (বাঙালী মেয়ে) মারিয়াকেই। ন্যান্সিকে কীভাবে তার স্বামীর কাছ থেকে ছিনতাই করেছিলেন এরিকসন সে সম্পর্কে লিখেছেন,
১৯৯৭ সালের শরৎকাল। আমি ইতালিয়ান একটি স্পাতে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। তখন আমার সঙ্গী এক নারী। তিনি সবে সুইডেন থেকে আমাকে দেখতে এসেছেন। সহসা আমাদের টেবিলের দিকে এক নারী ও এক পুরুষকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। মহিলাটি ছিলেন শ্যামলা। তবে অনেক সুন্দরী। অন্য যেসব লোক সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই ওই নারীকে দেখতে লাগলেন। তারা বিস্ময়ে বললেন, ওয়াও! তার সঙ্গের পুরুষটি নিজেকে পরিচয় দিলেন গিয়ানকারলো হিসেবে। তিনি রোমা ফুটবল দলের ফ্যান বলে পরিচয় দিলেন। এই দলটির এক সময় ম্যানেজার ছিলাম আমি। পরে রোমার প্রতিপক্ষ দলের ম্যানেজার হই। অল্প সময়ের মধ্যে তাকে দেখে অতি শান্ত মানুষ মনে হলো। কিন্তু আমি তো তার সঙ্গী নারীর দিক থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না।
তিনি গিয়ানকারলোর স্ত্রী ন্যান্সি ডেলওলিও। তখন তার চেহারা, অভিব্যক্তি এমন ছিল যে, তার দিকে চোখ না দিয়ে পারা যায় না। আমরা কিছু সময় বসে গল্প করলাম। এর পরের দিন ওই দম্পতির সঙ্গে আমার আবার দেখা। এবার একটি সুইমিং পুলে। ন্যান্সি আমাকে তাদের রোমের বাসায় নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানালেন। আমি তা গ্রহণ করলাম। বললাম, তাহলে তো চমৎকার হয়। তার স্বামী গিয়ানকারলো একজন আইনজীবী। তিনি রোমের বিলাসবহুল এক বাসায় বসে আইনী কাজ করেন। এতে তিনি সফল। তার স্ত্রী ন্যান্সিও একজন আইনজীবী। কিন্তু তিনি তেমন আইনচর্চা করেন না।
আমরা যখন নৈশভোজের টেবিলে তখন আমার পাশের চেয়ারে বসলেন ন্যান্সি। আমাকে এরপর একের পর এক অনেক দিন নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানাতে লাগলেন। প্রতিবারই আমার চেয়ারের পাশে বসেন তিনি। ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি। এদিন আমার বয়স ৫০ হলো। বেলা ব্লু নামে একটি রেস্তরাঁ ও নাইটক্লাবে একটি পার্টি দিয়ে তা উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম। সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হলো ৬০ জনকে। তাদের মধ্যে ছিলেন ন্যান্সি এবং তার স্বামী গিয়ানকারলো।
এরিকসন আরও লিখেছেন, তখনও আমি সিঙ্গেল। এর আগেই আমার ইতালিয়ান সুন্দরী গ্রেজিলা মানসিনেলির সঙ্গে প্রেম জমে ওঠে। তখন আমি জেনোয়াতে একটি দলের ম্যানেজার। গ্রোজলার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে আমার বিয়ে ভেঙে যায়। রোমের ওই জন্মদিনের পার্টি শেষে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে আমি কিছু পানীয় পান করতে গেলাম। তখন আমার সঙ্গে আমার সাবেক স্ত্রী অংকি। এসব বন্ধুর মধ্যে ছিল সে-ও। এক পর্যায়ে কথায় কথায় উঠে আসে ন্যান্সি প্রসঙ্গ। ন্যান্সি শুধু আমাকেই চমকে দেয় নি, সে সবাইকে যেন মোহময় করে ফেলেছিল। আমার স্ত্রী অংকি বললো, এরই মধ্যে যদি এরিকসনের বিছানায় ন্যান্সি না গিয়ে থাকে তাহলে খুব শিগগিরই যাবে। তাদের সম্পর্ক এ পর্যন্ত গড়াবে। আসলেই তার পূর্বাভাস সত্যি হয়েছিল।
পাঠক! আপনি চিন্তা করুন, কত খোলামেলাভাবে একজন বৃদ্ধ তার অনাচার ব্যক্তি জীবনের কথা অকপটে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। আরও লজ্জা ও বেদনার বিষয় হচ্ছে, একজন বাঙালী মুসলিম নারী কীভাবে তার কামনার শিকার হয়ে সেই নোংরা কাজে গৌরব ও শিহরণের অনুভূতি প্রকাশ করছেন!
তসলিমার সাক্ষাতকারটিই কথাই চিন্তা করুন। জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়ে হয়ত কিছুটা অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন। কিন্তু তবু থেমে নেই তার অনুভূতির অশ্লীলতা। কত গড় গড় করে বলে দিলেন নিজের বহুগামতার কথা, কত পুরুষের সঙ্গে শুয়েছেন, কার সঙ্গে কীভাবে মিলিত হয়েছেন তা দ্ব্যর্থ ও ভাবলেশহীন বাক্যে তুলে ধরেছেন! আজ আধুনিক সভ্যতায় এই যে একজন নারী তার পতিতাবৃত্তির কেচ্ছা প্রচার করছেন প্রবল বিক্রমে তা কি জাহেলী যুগের মানুষ কল্পনা করতে পারত? এসবের বিবেচনায় ইমরুল কায়েস ও তৎকালীন লেখক-কবিদের ‘অশ্লীল’ কাব্য-কবিতা ও তাদের ব্যক্তি-জীবনের প্রকাশ আজকের তুলনায় অনেক শালীন, মার্জিত ও অভদ্রতার ক্ষমাযোগ্য সীমানায় আবদ্ধ।
খারাপ মানুষ সব যুগেই থাকে এবং আগেও ছিল। সুতরাং যুগের বিচার হয় না, বিচার হয় যুগের বাসিন্দার, যারা নগ্নতা, অশ্লীলতা এবং অশ্লীলতার বিকাশ ও প্রকাশকে সাধারণ বিষয়ে পরিণত করেছে। নিঃসন্দেহে সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিমাত্রই একমত হতে বাধ্য যে, আমরা জাহেলিয়াতকে নিজেদের সামনে রাখতে দিইনি, প্রবল প্রতিযোগিতা ও তীব্র লড়াই করে অনেক দূরে ফেলে এসেছি! এখন সময় সামনে এগোবার, অশ্লীলতা, নোংরামী, পাপাচারে পৃথিবীর সব জাতি, শ্রেণি এবং পশু-প্রাণীকেও হার মানাবার!!!
‘আলফু লাইলা ও লায়লা’ (One Thousand and One Nights একহাজার এক রজনী) বা বিকৃত বাংলার ‘আলিফ লায়লা’ গ্রন্থে ‘জাহশিয়ারী’ এক হাজার একটি গল্প লেখার ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু মাঝপথে ৪৮০টি গল্প লিখেই সে ইচ্ছার চাদর ভাজ করে রাখতে হয়েছিল। হাজার রজনীর গল্প ফুরিয়ে যায় কিন্তু ফুরায় না আমাদের নারী-লাঞ্ছনার কাহিনী। বন্ধ হয় না জাহিলী সভ্যতার পুনরাবৃত্তি। তাই জাহেলিয়াতের সব স্তর অতিক্রম করা আরো কিছু গল্প শুনুন। বিচার করুন নিজ বিবেচনাবোধে এবং নির্ধারণ করুন এই সমাজের নারী-ভাগ্য। আল্লাহর বাণী দিয়েই এ পর্বে ইতি টানা যাক :
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ ٱلۡفَٰحِشَةُ فِي ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ١٩ ﴾ [النور: ١٩]
‘যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহাকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।’ (সূরা আন-নূর, আয়াত : ১৯)
বাবা-মায়েরা বাধ্য করছেন!
﴿ وَلَا تُكۡرِهُواْ فَتَيَٰتِكُمۡ عَلَى ٱلۡبِغَآءِ إِنۡ أَرَدۡنَ تَحَصُّنٗا لِّتَبۡتَغُواْ عَرَضَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۚ وَمَن يُكۡرِههُّنَّ فَإِنَّ ٱللَّهَ مِنۢ بَعۡدِ إِكۡرَٰهِهِنَّ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣٣ ﴾ [النور: ٣٣]
‘তোমাদের দাসীরা সতীত্ব রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের কামনায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য করো না। আর যারা তাদেরকে বাধ্য করবে, নিশ্চয় তাদেরকে বাধ্য করার পর আল্লাহ তাদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সূরা আন-নূর, আয়াত : ৩৩)
আলোচ্য আয়াতে জাহেলী যুগের কতিপয় মুনাফেক সুবিধাবাদি লোকের স্বভাবের আলোচনা স্থান পেয়েছে। এরা নারীদের সতীত্ব বিক্রি করে নিজেদের আখের গোছাতো এবং সমাজকে করত কলুষিত। এই নারী-ব্যবসায়ীদের অন্যতম হোতা ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল। সে অন্য ধর্মাবলম্বী নারী তো বটেই, মুআজা নাম্নী এক মুসলিম দাসীকেও ব্যভিচারে বাধ্য করে অর্থোপার্জন করত। মুফাসসিরগণ লিখেছেন, মুনাফিক আব্দুল্লাহর মোট ছয়জন দাসী ছিল। মুআজা, মুসায়কা, উমায়মা, আমরাহ, আরওয়া এবং কুতায়লা। একদিন এদের একজন এক দিরহাম উপার্জন করে নিয়ে এলো এবং অপরজন আনল সামান্য কিছু অর্থ। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবায় তাকে আবার ওই কাজে লিপ্ত হয়ে সমপরিমাণ দিনার নিয়ে আসার আদেশ করল। কিন্তু ওই দাসী প্রতিবাদ করে বলল, অসম্ভব! আমাদের কাছে ইসলাম এসেছে এবং ইসলাম এই জঘন্য কাজকে হারাম ঘোষণা করেছে। সুতরাং আমার দ্বারা এটা আর সম্ভব নয়।’
ইবনে জারির রহিমাহুল্লাহ আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন,
كُنَّ نِسَاءً مَعْلُومَاتٍ فَكَانَ الرَّجُلُ مِنْ فُقَرَاءِ الْمُسْلِمِينَ يَتَزَوَّجُ الْمَرْأَةَ مِنْهُنَّ لِتُنْفِقَ عَلَيْهِ، فَنَهَاهُمُ اللَّهُ عَنْ ذَلِكَ
‘এরা ছিল নির্দিষ্ট কিছু নারী। কতিপয় গরীব মুসলিম এদের বিয়ে করতে লাগলেন, যাতে এরা (নিজেদের) উপার্জন স্বামীদের পেছনে ব্যয় করে। আয়াতে আল্লাহ তাদের এহেন অভিসন্ধি থেকে নিষেধ করে দেন।’ [তাবারী, জামেউল বায়ান : ১৭/১৫০]
প্রাচীনত্বের সূত্র ধরেই নারীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সাধারণ পণ্যের মতোই এই অবলা নারীকে ব্যবসার পণ্য বানাতে অনেকেই সেজেছে মহাজন। এই মহাজনদের অর্থল্পিসায় পুড়ে ছাড়খার হচ্ছে নারীত্বের মর্যাদা, ভূলণ্ঠিত হচ্ছে নারীর সবচেয়ে সর্বদামী ‘সতীত্ব’। সভ্যতার লগি-বৈঠা ঠেলে আধুনিকতার যে মহাতরী আমরা তথাকথিত সভ্যতার নদীবন্দরে ভিড়িয়েছি, তার রং-রূপ যে কত কদর্য তা কল্পনাও করা মুশকিল।
‘অশ্লীলতার অভিযোগে চলচ্চিত্র জগতের বেশ ক‘জন অভিনেত্রী অভিযুক্ত। অভিযোগ রয়েছে আয়ের কোনো পথ না থাকায় মায়েরাই জোর করে মেয়েদের এ পথে ঠেলে দিচ্ছেন। নায়িকা ময়ূরীর মা সেতু ইসলাম বলেন, আমার মেয়ে অশ্লীল নায়িকা নয়। সে কখনও অশ্লীল চরিত্রে অভিনয় করেনি। নির্মাতারা ডামি ব্যবহার করে আমার মেয়ের সর্বনাশ করেছে।’
তিনি বলেন, আমার মেয়ের নামের সঙ্গে অশ্লীল বিশেষণ শুনতে কষ্ট লাগে। ওর আসল নাম মুনমুন আক্তার লিজা। ১৯৯৭ সালে চলচ্ছিত্র নির্মাতা মালেক আফসারী আমাকে বললেন, আপনার মেয়েকে চলচ্চিত্রে নিতে চাই। আমি বললাম অভিনয় তো আমি করি। আমার মেয়েকে চলচ্চিত্রে কাজ করানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই। তিনি জোর দিয়ে বললেন, রোজী আফসারী অপেক্ষা করছেন। ওকে নিয়ে চলেন। সে তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। বারো বছর সাত মাস বয়স। আমি আবারো বললাম, আমার মেয়ে এখনও ছোটো। তাকে চলচ্চিত্রে দেব না। শেষ পর্যন্ত জোর করে রোজী ভাবীর কাছে নিয়ে গেলো আমাদের। রোজী ভাবী ওকে দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন, আমাদের ঘরে এত সুন্দর মেয়ে থাকতে বাইরে নায়িকা খুঁজছি কেন? তাদের জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলাম।
আফসারী ভাই আমার হাতে ৫০ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে ছবিতে নাম লেখান। নাম মৃত্যুর মুখে। তারপর সে নিয়মিত ছবি করে যেতে লাগল। বেশ সুনামও অর্জন করল। এক সময় শুনলাম সে নাকি অশ্লীল ছবি করছে। বিষয়টি তার মুখ থেকেই শুনতে চাইলাম। ও বলল, নির্মাতা বলেছে, গল্পের প্রয়োজনে শর্ট ড্রেস পরতে হবে। কিন্তু ছবিতে যেভাবে খোলামেলা দেখানো হয়েছে ওরকম শট দেইনি। পরে জানতে পারলাম, প্রযোজক-পরিচালক অন্য মেয়ে দিয়ে খোলামেলা শট নিয়ে তাতে ময়ূরীর মুখ লাগিয়ে চালিয়ে দিয়েছে!
ময়ূরীর মা আরো বলেন, বিশ্ব আধুনিক হয়েছে। সবকিছু উন্মুক্ত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের নায়িকারা গল্পের প্রয়োজনে পাতলা বা ছোট কাপড় না পরলে তাকে নিয়ে নির্মাতারা কাজ করবেন কেন? তিনি বলেন, দর্শক সাটেলাইট চ্যানেল, ডিভিডি, সিডি কিংবা প্রেক্ষাগৃহে বিদেশি ছবি এবং নীল ছবি অহরহ দেখছে। তাহলে এদেশের নায়িকাদের দেখতে অভ্যস্ত নয় কেন? তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের চোখ পাল্টেছে কিন্তু মন পাল্টায়নি।
সেতু ইসলামের প্রথম কথাগুলো ভালোই ছিল। তিনি হয়ত নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে অসমীচীন মনে করে মেয়েকে এই নষ্টপথে না দেয়ার প্রতিজ্ঞা করে সঠিক পথেই এগুচ্ছিলেন। কিন্তু অপরের পীড়াপীড়ি আর নিজের মনের কোণে লুকিয়ে থাকা অস্পষ্ট ইচ্ছার কাছে হার মেনেছেন এবং পঞ্চাশ হাজার নগদ টাকায় প্রলুব্ধ হয়ে মেয়েকে চির অকল্যাণের পথে নামিয়েছেন। শুধু কি তাই! নিজ মেয়ে ও এদেশের অন্য মুসলিম নারীদেরও তিনি প্রলুব্ধ করছেন সংক্ষিপ্ত বসন-ভূষণে নিজেদেরকে উপস্থাপিত করতে। আক্ষেপ করছেন এই সমাজ কেন পশ্চিমাদের অনুকরণে এখনও অশ্লীলতার সরোবরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে না! অশ্লীলতার অন্য যাবতীয় উপকরণ অনুসরণ করে প্রেক্ষাগৃহগুলোতেও নগ্নতার বিস্তৃতি ঘটছে না সেজন্য!
এই ভুলোপথের মায়েরা কি বোঝেন না, এদেশের তরুণ প্রজন্মই কেবল প্রেক্ষাগৃহগুলোকে ভীড় জমায় না; অনেক শিশুরাও ভীড় করে এখানে? সুতরাং এমনিতেই এই শিশুগুলো চোখ খোলার আগেই বদদীনী রপ্ত করছে। শিখছে অশ্লীলতা। এর মধ্যে যদি নগ্নতার মহড়া চলে এবং পশ্চিমাদের অনুসরণে এদেশের মুসলিম নারীদেরকে বিবসনা উপস্থাপনা করা হয় তবে এদেশের মুসলিমসত্তাই শুধু হুমকির মুখে পড়বে তাই নয়; দেশের ভবিষ্যতও অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে। কেননা অশ্লীলতায় নিমগ্ন একটা জাতি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না কিংবা বেশি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
সেতু ইসলামের এই কথাগুলো বুকের ভেতর কেমন শক্তভাবে বিঁধে। একজন মুসলিম নারীর নিজকন্যাদের ব্যাপারে এই মন্তব্য তা ভাবতেই কষ্ট হয়। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলকেও যেন তিনি ছাড়িয়ে গেছেন। উবাই তো পরকন্যাদের এই পথে নামিয়ে পয়সা কামাতেন, কিন্তু এই মায়েরা যে নিজকন্যাকে এই পথে নামিয়েছেন!
এবার সভ্যতার তীর তরীটা ভারতভূমে নিয়ে যাই। ভারতভূমির নৈতিক অবক্ষয় বর্তমানে পৃথিবীর সব ইতিহাস ও অবক্ষয়কে ছাড়িয়ে গেছে। এরা চলিচ্চত্র ও হিন্দুস্তানী ললনাদের উদ্বাহু নৃত্যকৌশলে বিশ্ববাজার দখল করতে গিয়ে নিজেদের লজ্জার বাঁধন একেবারেই ঢিলে করে দিয়েছে। তাই ঘটছে জঘন্য সব ঘটনা, ইতিহাসের কালি যার বিভৎসরূপ নিরূপণ করতে ব্যর্থ। এই বিভৎসতা ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের অস্তিমজ্জায়।
বিশ্বের যুবসম্প্রদায়কে ভ্রষ্ট করতে গিয়ে ভ্রষ্টতার মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে এদেশের প্রায় প্রতিটি নাগরিক। এদেশের চরিত্র ও নিষ্কলুষতা বলতে এখন আর তেমন কিছু বাকি নেই। কিছুদিন আগে খবর বেরুলো, ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরালা রাজ্যে নিজের ১৭ বছর বয়সী মেয়েকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে বাবার বিরুদ্ধে! এমনকি অর্থের বিনিময়ে দুই শতাধিক পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে তার বাবা তাকে বাধ্য করেছে বলে অভিযোগ করেছে ওই মেয়ে নিজেই। গণমাধ্যমের কাছে নিজেই চরিত্রের এই অগ্নি পরীক্ষা দিয়েছে মেয়েটি। এমনকি তার বাবা কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ারও অভিযোগ করেছে সে। এছাড়া তাকে না খাইয়ে রাখা হতো এবং অন্যান্য পুরুষদের সঙ্গে পাপকাজ করতে বাধ্য করা হতো বলে মেয়েটি জানায়।
মেয়েটি তার সঙ্গে যারা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে বলে নাম প্রকাশ করেছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে ঠিকাদার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পুলিশ সদস্যও রয়েছে। একটি স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলকে মেয়েটি বলে, ‘বাসায় মায়ের অনুপস্থিতিতে প্রথমে আমার বাবা আমাকে লাঞ্ছিত করে!’
এরপর আমি চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাবো এ কথা বলে তিনি আমাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন।’ ওই মেয়ে জানায়, যখন তার মা বিষয়টি বুঝতে পারে, তখন তাকে চুপ থাকার জন্য তার বাবা পরিবারের সব সদস্যকে হত্যার হুমকি দেয়। এই মেয়েটি দুই শতাধিক পুরুষ কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে। যেটা আপনার বিবেককে দংশিত ও স্তব্ধ করে দেবে।
এই হলো সভ্য যুগের বাবা! বেচারা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এরচেয়ে ঢের বেশি ভালো ছিল। সে নিজের মেয়েকে নোংরামীতে নামায়নি কিংবা নিজের মেয়ের সঙ্গে...
এশিয়া মহাদেশ জুড়ে দাদাগিরির দাম্ভিকতা ও সাম্রাজ্যবাদীতার মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা ভারত একটা জলজ্যান্ত ধর্ষণের খোঁয়াড়ে পরিণত হয়েছে। যার কারণে এখানে পিতৃত্ব পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে ঘটছে এধরনের আরো ভয়াবহ ঘটনা। পৃথিবীতে একজন সন্তানের সবচেয়ে বড় আশ্রয় আর কী হতে পারে? এই প্রশ্ন করা হলে উত্তর খোঁজার জন্য খুব বেশি সময় নিতে হতো না আগে। এক মুহূর্তের ব্যবধানেই উত্তর আসতো পিতা-মাতা। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই এই বিশ্বাস প্রবহমান ছিল। কিন্তু ভারতের নানান ঘটনা আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই বিশ্বাসের ভিত্তিকে খুবই নড়বড়ে করে দিয়েছে।
কারণ এই আশ্রয় ভয়ঙ্কর কদর্য মনোবৃত্তির তাড়নার দাবানলে ভেঙ্গে পড়ে তা এখন বিস্ময়, অবিশ্বাস, হতাশা আর ঘৃণার স্থানে পরিণত হয়েছে। যে পিতা সন্তানের প্রথম ও শেষ আশ্রয়, যে পিতা সন্তানকে আগলে রাখেন সব অশুভ পরিণতি থেকে, সেই পিতা নামধারী কতক পাষণ্ডই ধর্ষণ করে চলেছে তার কিশোরী কন্যাকে, অতঃপর হত্যাও!
এধরনের আরেকটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে ভারতের মুম্বাইয়ের শহরতলীতে। উত্তর প্রদেশে থেকে আসা ১৭ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে তারই পিতা ও পিতার এক বন্ধু। গ্রেফারের পর দুই পাষণ্ডই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, উত্তর প্রদেশের গাজিপুরের নিজ গ্রাম থেকে বিয়ের উদ্দেশে ছেলেবন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে মুম্বাই চলে আসে কিশোরীটি। এখানে এসে বন্ধুর সঙ্গে যে বাসায় কিশোরীটি বসবাস করছিল সেখানে এক বন্ধুসহ তার বাবা এসে উপস্থিত হয়। বুঝিয়ে-শুনিয়ে মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান তিনি।
কিন্তু মেয়েটি রাজি না হওয়ায় তার বাবা জোর করে কন্যাটিকে কাছের একটি জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে বন্ধুসহ নিজ কন্যাকে ধর্ষণ করে পাষণ্ড পিতা। আর এ ঘটনার পরপরই মেয়েটি ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে।
দেশ-বিদেশের সব ঘটনার নির্মমতা ছাড়িয়ে গেছে খোদ আমাদের দেশের একটি ঘটনা। ঘটনাটি হচ্ছে; ডাক্তার বানানোর কথা বলে অন্তু নামের আপন ছোট বোনকে দিয়ে পতিতাবৃত্তি করিয়েছে তারই বড় বোন মাফিয়া। এমনই তথ্য বেরিয়ে আসে একুশে টেলিভিশনের একটি অনুসন্ধানি রিপোর্টে। বার বছর বয়সী অন্তু জানিয়েছে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই দীর্ঘদিন ধরে তাকে এমন জঘণ্য কাজ করিয়ে যাচ্ছে তার বড় বোন মাফিয়া। ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর মালিবাগে। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। একুশে টেলিভিশনের ৭ নভেম্বর ২০১৩ ইং প্রচারিত সংবাদ প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ :
বড় হয়ে ডাক্তার হবে, মানুষের সেবা করবে, পরিবারের অভাব ঘোচাবে, এমন হাজারো স্বপ্ন নিয়ে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় বড় বোনের কাছে এসেছিলো অন্তু। কিন্তু আসার পর থেকে তাকে দিয়ে জোরপূর্বক শরীর-ব্যবসা করাতে থাকে তারই আপন বড় বোন। গোপনীয়ভাবে এমন তথ্য জানার পর একুশে টেলিভিশন ওই বাসায় উপস্থিত হলে অন্তুর বড়বোন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। কিন্তু একপর্যায়ে মাফিয়া তার অপকর্মের কথা অকপটে স্বীকার করে। সে জানায়, তার ছোটবোনের পড়ালেখার খরচ জোটাতে এ লাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ও।
এদিকে অন্তুর মা জানিয়েছে, তার বড় মেয়ে পড়ালেখার কথা বলেই অন্তুকে ঢাকায় নিয়ে গেছে। কিন্তু এরপর কি হয়েছে তা সে জানে না। নিজের মেয়ের কাছেই যখন মেয়ের নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে সে এখন কার কাছে যাবে এটাই এখন পরিবারটির জিজ্ঞাসা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী রক্সি ফাতেমা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, ‘মানুষ মনে করে তার নিরাপত্তার সর্বশেষ আশ্রয় হলো নিজের পরিবার। কিন্তু নিজ পরিবারেরই কেউ যখন তাকে এরকম জঘন্য অপকর্মের দিকে ঠেলে দেয়, তখন মানুষের নিরাপত্তার স্থান কোথায়?’
সায়মা আক্তার একজন গৃহিনী। তিনি জানান, ‘বড় বোনরা সাধারণত মায়ের মতোই হয়ে থাকে। সেই বোন যখন বোনকে বেশ্যাবৃত্তিতে বাধ্য করে, তাহলে সেটাকে মানবতার বিপর্যয়ই বলা চলে।’
এভাবেই কন্যা বাবার কাছে, ছোটো বোন বড় বোনের কাছে, মেয়ে মায়ের কাছে অপরিচিত ও অনিরাপদ হয়ে উঠছে। এসব ঘটনায় বারবার একটা প্রশ্ন নাড়া দিচ্ছে, যে সমাজের পিতা তার কন্যার, বড়বোন তার ছোটোবোনের এবং মা তার মেয়ের ইজ্জত দিতে পারে না, আব্রু রক্ষার জামিন হতে পারে না সেই সমাজে অন্যরা কেন দেবে নারীর দাম, নারীর মর্যাদা? নারীর জন্য একই সঙ্গে করুণা ও আক্ষেপ যে, তারা তাদের সতীত্ব-সম্ভ্রমের ব্যাপারে সবদিক থেকেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে।
মায়ের উৎসাহে স্কুল পড়ুয়া মেয়ে এখন অন্তঃসত্ত্বা!
পাঠকগণ প্রশ্ন করতে পারেন, আলোচ্য গ্রন্থে বিধর্মীদের আলোচনা স্থান দেয়ার যৌক্তিকতা কী? এর বিজ্ঞোচিত যৌক্তিক কারণ পেশ করতে পারব না। তবে এতটুকু তো সত্য যে, এরাও সমাজেরও একটি অংশ, বরং বলা যায় এরাই পরিবর্তিত বিশ্বের নিয়ন্ত্রক। আর বিশ্ব ইতিহাসের অলিখিত সংবিধান হচ্ছে, নিয়ন্ত্রিতরা নিয়ন্ত্রকদের অনুগামী ও অনুসারী হয়। নির্মল হাওয়া খাওয়ার জন্য যিনি ঘরের দখিনা জানালা খোলা রাখেন, তিনিই আবার নর্দমার দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত বাতাস থেকে বাঁচতে উত্তরের জানালা বন্ধ করে রাখেন। কিন্তু যে শুধু উত্তরের নোংরা বাতাসের খবরই রাখেন তিনি যেমন নির্মল বায়ু থেকে বঞ্চিত হন, তেমনিভাবে যে শুধু দখিনা নির্মল বায়ুর সন্ধান রাখেন তিনি উত্তরের নোংরা হাওয়ায় আক্রান্ত হন। সুতরাং বুদ্ধিমান তিনিই, যিনি ভালোকে ভালো জেনে তা গ্রহণ করেন এবং মন্দকে মন্দ জেনে তা বর্জন করেন।
তাই আমাদের হৃদয় জানালা দিয়ে যেন কেবলই ভালো ও অনুসরণীয় বস্তুটাই প্রবেশ করে, মন্দ ও নোংরা বস্তুটা প্রবেশ না করে সেজন্য আমাদের সচেতন হওয়া চাই। বিশ্বসমাজ ব্যবস্থার কোনটা নির্মল ও সেবনযোগ্য বায়ু এবং কোনটা বর্জনযোগ্য তা জানা থাকা একান্ত অপরিহার্য। এই ভাবনা থেকেই বিশ্বের নানাপ্রান্তে ঘটমান এসব ঘটনা উল্লেখ করে আমরা নিজেদেরকে সতর্ক করতে চাই এবং আমরা যাদের অনুসরণ করছি তারা প্রকৃতপক্ষেই অনুসরণযোগ্য কিনা সেটা বিবেচনার জন্যই এসব ঘটনা পাঠকদের বিবেকের কাঠগড়ায় পেশ করা হয়।
বস্তুতঃ এদের কালচার, সভ্যতা ও মনুষ্যত্ববোধ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকলে ভ্রান্তপথে পা বাড়াবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। শঙ্কা আছে বিবেকের আদালতের ভ্রান্ত ফয়সালা দেয়ার। ভয় আছে ভুল পথে চলার এবং অন্যকে চালাবার। ভূমিকা বড় করে বলে ফেললাম। এবার আগের কথায় ফিরে আসি...
সন্তানের মা হতে যাচ্ছে সয়া কিভেনি নামে এক স্কুল পড়ুয়া মেয়ে। তাকে নিয়ে সমাজের অন্য অভিভাবকরা নাক কুঁচকালেও তার মা জেনিস কিভেনির আনন্দের শেষ নেই। তিনিই মেয়েকে এতটুকু পথ নিয়ে আসতে উৎসাহ দিয়েছেন। মেয়েকে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিকিনি পরা ছবি তোলার উৎসাহ দিয়েছেন। তা ছাপা হয়েছে একটি ম্যাগাজিনে। আর তারপর সয়া কিভেনিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা। মাত্র ৭ বছর বয়স থেকে তাকে ডিসকো পার্টিতে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আর এখন সয়া কিভেনির বয়ফ্রেন্ড জ্যাককে মেয়ের সঙ্গে রাত কাটানোর অবাধ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন। সয়াদের বাড়িতেই রাতে থাকে এখন জ্যাক। এরই ফল হিসেবে সয়া কিভেনি এখন ১২ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা। এ নিয়ে অনেকজন অনেক কথা বলছেন। তাতে কান দিচ্ছেন না সয়া কিভেনির মা জেনিস। এ খবর দিয়েছে অনলাইন দ্য সান। এতে বলা হয়, সয়া কিভেনির অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর জানতে পেরে তার মা জেনিসের আর গর্ব ধরছে না। তিনি আহ্লাদে একেবারে গদগদ।
আর তাই বলছেন, আমাদের তিন বেডরুমের বাসাটি এখন লোকসংখ্যার তুলনায় একেবারে ছোট হয়ে গেছে। একই বাড়িতে থাকে আমার মেয়ে কোকো ও রিজি, ছেলে ট্যারোট, সয়ার বয়ফ্রেন্ড জ্যাক এবং আমার এক মেয়ের শিশু সন্তান। আমার আশা, সয়ার সন্তান যখন আসবে তখন কাউন্সিল আমাদেরকে ৪ বা ৫ বেডরুমের একটি বাসা দেবে। আমরা এরই মধ্যে সবকিছু গোছগাছ শুরু করেছি। সয়া গর্ভপাতে বিশ্বাসী নয়। সে যে মা হচ্ছে এটা শতভাগ নিশ্চিত। আমার বিশ্বাস সে চমৎকার একজন মা হবে। সে নিজের সন্তানদের শিখাবে আমার মতো শৃঙ্খলাবোধ! ওদিকে সন্তান ধারণ করতে পেরে সয়া কিভেনিও কম উৎফুল্ল নয়। সে বলেছে, প্রথমে আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। তবে এখন আমি খুব উপভোগ করছি বিষয়টা!
ওই রিপোর্টে বলা হয়, সয়া কিভেনির মা জেনিস তার মেয়ের স্বপ্ন পূরণে দিয়েছেন পূর্ণাঙ্গ সহায়তা। তাকে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করিয়েছেন। পরিণত বয়স না হলেও তাকে পাঠানো হয়েছে শরীর চর্চার কেন্দ্রে। ওদিকে সয়া কিভেনির যেসব বিকিনি পরা ছবি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এক অভিভাবক বলেছেন, আমাদের মনে হয় তার মায়ের এভাবে মেয়েকে ছেড়ে দেয়া ঠিক হয়নি। তিনি কি কিশোরী মেয়ে শিকারীদের নাম শোনেননি? জেনিস এক স্কুলের সাবেক সেক্রেটারি। এখন অবসরভাতা পান। তিনি সয়া কিভেনিকে ক্লিভল্যান্ডের থর্নাবিতে মাত্র ৭ বছর বয়সে ডিসকোতে যেতে দিতেন। তাকে মেকাপ করাতেন। পরাতেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোশাক। শরীরের উপরের অংশের অনেকটাই থাকতো অনাবৃত। জেনিস বলেন, সয়া এখনও মাত্র কিশোরী। অনেকটা অপরিণত। কিন্তু যখন সে তার বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে যায় তখন তার ওপর আমার শতভাগ আস্থা আছে। তার ১২ বা ১৩ বছর বয়সে সে একটা ১৮ বছরের কম বয়সীদের ডিসকোতে গিয়েছিল।
জেনিস স্বীকার করেছে, সে সয়া কিভেনির বয়ফ্রেন্ড জ্যাককে তার বাসায় রাতে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। তবে সয়া ও সে আলাদা আলাদা বেডরুমে থাকতো এবং ওই সময়ে সয়া ব্যবহার করতো পিল। সয়া এখন ১২ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা। এই সময়ে তিনি তাদের আলাদাই রাখতে চান। তিনি বলেন, লোকজন মনে করতে পারে আমি ঘোড়ার আগে গাড়ি চালিয়ে আইন লঙ্ঘন করছি। কিন্তু আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি জানুয়ারিতে সয়ার বয়স ১৬ বছর পূর্ণ হবে। এর আগে তাকে ও জ্যাককে আমার বাসায় এক বেডরুমে থাকতে দেব না।
আমি শুরু করেছিলাম কুরআনের একটি আয়াত দিয়ে। যে আয়াতে মানুষের নৈতিক অধপতনের চূড়ান্ত অবস্থা উল্লেখ করা হয়েছে। আমি কয়েকটি তাফসীর ও হাদীসের কিতাবের উদ্বৃতি সেই সময়ের করুণ অবস্থা ও নৈতিক ভঙ্গুরতার চিত্র তুলে ধরেছি। আশা করি বিচক্ষণ পাঠক এ দুই সময়কার পার্থক্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। জাহেলিয়াতের ওই ঘোরতর অমানিশাতেও কিন্তু কোনো পিতা তার কন্যাকে ব্যভিচারে বাধ্য করেছে বলে কোনো ঘটনা আমরা জানি না। কিংবা ব্যভিচারের ফসল অবৈধ সন্তানে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো কোনো ইতিহাসও সংরক্ষিত নেই। সয়া কিভেনির অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর জানতে পেরে তার মা জেনিসের আর গর্ব ধরছে না। সে আহ্লাদে একেবারে গদগদ। উদ্বেলিত আনন্দের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে সে বলেছে, ‘আমরা এরই মধ্যে সবকিছু গোছগাছ শুরু করেছি। সয়া গর্ভপাতে বিশ্বাসী নয়। সে যে মা হচ্ছে এটা শতভাগ নিশ্চিত। আমার বিশ্বাস সে চমৎকার একজন মা হবে। সে নিজের সন্তানদের শিখাবে আমার মতো শৃঙ্খলাবোধ!’
ওদিকে সন্তান ধারণ করতে পেরে সয়া কিভেনিও কম উৎফুল্ল নয়। সে বলেছে, ‘প্রথমে আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। তবে এখন আমি খুব উপভোগ করছি বিষয়টা!’ একটা অবৈধ সম্পর্কের অবৈধ সন্তানকে গ্রহণ করতে যে সমাজ এত উদ্বেলিত থাকে সেই সমাজে বৈধতার কোনো মূল্য আছে কি? যে সমাজে ব্যভিচার ঘৃণিত তো নয়ই, বরং উপভোগের বস্তু সেই সমাজকে মনুষ্যত্বের কাতারে রাখার চেষ্টা নিজেদের সততাকে চরমভাবে লঙ্ঘিত করার নামান্তর। মানুষ আজ এতটুকু পারে? আসলে বিজ্ঞানের যুগে এসে সবকিছুর হিসাব-নিকাষ বদলে গেছে। বিজ্ঞান যেমন মানুষকে হাজার রকমের থমকে দেয়া বিস্ময় বস্তু উপহার দিয়েছে তেমনিভাবে মানুষও বিজ্ঞানের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে ঘটাচ্ছে অদ্ভুত ও বিস্ময়কর নানান ঘটনা। এসব ঘটনায় কেঁদে উঠছে মানবতার শুদ্ধপ্রাণ, নির্মলতা হারাচ্ছে সভ্যতার তাজা ফুল। পক্ষান্তরে অট্টহাসিতে মেতে উঠছে বর্বরতা, অসভ্যতার ভূতুড়ে দাঁত। কিন্তু এসবের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠছে যে বিষয় সেটা হচ্ছে, আমরা মানবতার নির্মল ফুলের নির্জীবতায় বিষণ্ন হচ্ছি না; অসভ্যতার ভূতুড়ে হাসিতে ফেটে পড়ছি! এ হাসি সভ্যতার উপহার! বিজ্ঞানের দান!! উৎকর্ষের সুফল!!!
আকাশ-সংস্কৃতি কি আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে? নৈতিকতাভিত্তিক যে চরিত্র গঠনের আবেদন আমরা জানাই, যে আন্দোলন করি, যে অনুশীলন আমরা সাধ্যমত করছি, এই চরিত্রের সঙ্গে আকাশ সংস্কৃতি কি সাংঘর্ষিক, না সহযোগী?
আকাশ-সংস্কৃতি কী? আকাশের তো কোনো সংস্কৃতি পয়দা হয় না। তবে হ্যাঁ আকাশ পথে সব সংস্কৃতির বেসাতি চলে, আমদানি-রপ্তানি হয়, ক্রয়-বিক্রয় হয় তাই টোটাল সওদাকে আমরা বলতে পারি আকশ-সংস্কৃতি। আপনি আমি এটাকে সংস্কৃতি বলি আর নাই বলি, বাজারে এটাই সংস্কৃতি নামে পরিচিত। আকাশ থেকে এ পর্যন্ত একটি তারকাও খসে পড়েনি, তবুও সিনেমা জগতে, ফুটবল জগতে, ক্রিকেট জগতে, এমনকি পরীক্ষার ফলাফল সিটে হাজার হাজার তারকার ভীড়। এসবের কোন কোনটির পেছনেও আকাশ-সংস্কৃতির ভূমিকা রয়েছে।
আকাশ-সংস্কৃতির কারবারটা জানতে হলে কি আকাশ ঘুরে আসতে হয়? আসলে আকাশের ঠিকানা আমরা জানি না, বিজ্ঞানীরাও জানে না। তবে আকাশের ঠিকানা জানা না জানার প্রশ্ন পরের কথা, দুনিয়া থেকে যদি আখেরাতের সওদা আহরণ করা যায়, তাহলে জমিনে বাস করে আকাশের খবর কেন জানা যাবে না? আকাশের আলোচনায় আসার আগে দুনিয়ার কিছু খবরাখবর আমাদের জানা দরকার। আকাশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগে আমাদের নিয়ত ও আত্মপরিচয় কী সে সম্পর্কে কিছু বলার ও জানার আছে। আল্লাহ আমাদের কেন দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তা জানা থাকা দরকার। এসব না জানলে, মনোবল সেভাবে গড়তে না পারলে এবং আকাশ শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করার ঈমানী হিম্মত নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করতে না পারলে আকাশ সংস্কৃতির ভাইরাসরা আমাদের চারদিকে ঘিরে ফেলবে। এখনই ঘেরাও এর মধ্যে আছি। এজন্য দুনিয়াতে আমাদের আগমন ও জীবনযাপন আর প্রস্থান সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। নিজেকে চিনলে, নিজেকে জানলে আল্লাহকে চেনা যায়, জানা যায়। এবং তখন যে কোনো যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া যায়।
আমরা দুনিয়াতে বাস করি। এই দুনিয়াতে আমাদের প্রেরণ কি স্রষ্টার নিছক খেয়ালমাত্র? আল্লাহ বলেন,
﴿ أَفَحَسِبۡتُمۡ أَنَّمَا خَلَقۡنَٰكُمۡ عَبَثٗا وَأَنَّكُمۡ إِلَيۡنَا لَا تُرۡجَعُونَ ١١٥ ﴾ [المؤمنون: ١١٥]
‘তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে কেবল অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে না?’ (সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত : ১১৫)
না তা নয়। খেলাচ্ছলে বা নিছক খেয়ালে আল্লাহ কিছুই করেন না। যদিও একক ক্ষমতা শুধু তারই আছে, হও বললেই হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّمَآ أَمۡرُهُۥٓ إِذَآ أَرَادَ شَيًۡٔا أَن يَقُولَ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ٨٢ ﴾ [يس: ٨٢]
‘তাঁর ব্যাপার শুধু এই যে, কোন কিছুকে তিনি যদি ‘হও’ বলতে চান, তখনই তা হয়ে যায়।’ (সূরা ইয়াসীন, আয়াত : ৮২)
এমন শক্তিধর সর্বশক্তিমান যিনি, তাঁর তো খলীফা প্রেরণের প্রয়োজন নেই। তবুও তিনি মানবজাতিকে তার খলীফা হিসেবে প্রেরণ করেছেন মানবজাতির মধ্যে জবাবদিহিতা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦]
‘আর আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদাত করবে।’ (সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত : ৫৬)
ইবাদত কী? ইবাদত হচ্ছে, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে তার দেয়া জীবন বিধান অনুয়ায়ী জীবনযাপন করা। কিভাবে জীবনযাপন করতে হবে এজন্য কওমের কাছে প্রতি জনপদে নবী-রাসূল এসেছেন। অনেকে তার আদেশ নিষেধ শুনেছে আবার অনেকে শুনেনি। প্রেরিত গাইডকে নির্যাতিত করেছে, গাইড বুকও ধ্বংস করেছে। তাই তাদের এখন নৈতিক কোনো বোধই নেই। যা ছিল তা অবক্ষয়ে অবক্ষয়ে শেষ গেছে।
যে নৈতিকবোধ তারা নানাভাবে প্রদর্শন করে নিজেদের নীতিবান বলে বিশ্ববাসীর কাছে জাহির করছে, তা কৃত্রিম, নিজেদের মনগড়া নৈতিকতা। তারা-কাপড় পরিধান করেও থাকে দিগম্বর। সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড় পরিধান করে বটে, সুন্দর সুন্দর সংলাপে শ্রোতাকে তারা মুগ্ধও করে। কারণ নৈতিকতার কুদরতী সীমানা আর মানুষের তৈরি সীমানার মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। কুদরতী হুকুমের কোনো তোয়াক্কা তারা করেনি। ফলে শয়তানের সঙ্গে মিতালী করে এমন এক নৈতিকতা সৃষ্টি করে রেখেছে, যা অনৈতিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। নানা দিকে অবক্ষয়ের ঢল ও ধস। এমন এক পর্যায়ে অবক্ষয়ের সর্বশেষ স্তরে এবং সময়ের এই সন্ধিক্ষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর মূল মিশন কী ছিল লক্ষ্যহীন ঠিকানাবিহীন এবং বিগত নবী-রাসূলদের শিক্ষা ও আদর্শ ভুলে যাওয়া মানবজাতির বংশধরদের বিস্মৃত সবক-পাঠ স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং সর্বক্ষেত্রে জাহিলিয়াতের যে অবক্ষয় নেমেছিল তা প্রতিহত করে চরিত্রবান জাতি হিসেবে গড়ে তোলা। আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗاۚ وَإِن مِّنۡ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٞ ٢٤ ﴾ [فاطر: ٢٤]
‘আমি তোমাকে সত্যসহ পাঠিয়েছি সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে; আর এমন কোন জাতি নেই যার কাছে সতর্ককারী আসেনি।’ (সূরা ফাতির, আয়াত : ২৪)
সংস্কৃতি একটি জাতিকে প্রভাবিত করার অতুলনীয় মাধ্যম। তবে তার ব্যবহার হওয়া চাই যথার্থ। কেননা ব্যক্তি ও সত্তার প্রভাবে সংস্কৃতির ক্রিয়া ও প্রভাব ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে বাধ্য। সুতরাং বলা যায় নাস্তিক, মুরতাদ আর সেক্যুলারিস্টদের ‘মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর অবক্ষয়ের’ সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার সঙ্গে তাওহীদে বিশ্বাসীদের সংজ্ঞা ব্যাখ্যার মিল নেই।
কোন পথে চললে কোন ঠিকানায় আমাকে পৌঁছাবে, কোন পথের বাঁকে বাঁকে এবং মোড়ে মোড়ে কে কে আছে এবং কেন আছে তাও জানা হয়ে গেছে। অতএব নাস্তিকের নৈতিকতা ও সংস্কৃতি আমার জন্য অনৈতিকতা ও অপসংস্কৃতি হওয়ারই স্বাভাবিক ও সঙ্গত।
‘আকাশ সংস্কৃতি’ খুব লম্বা চওড়া বিষয় নয়, তবে এর আগে অথৈ আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে লড়াইয়ের আগে জেনে নিতে হবে আমরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত কি না, আমরা যে অস্ত্র নিয়ে লড়াই করবো তা লড়াই উপযোগী কিনা? আর এ লড়াইয়ের ব্যাপারে আমাদের ধ্যান-ধারণা পরিষ্কার কিনা। ধারণাটা পরিষ্কার করা হয় না বলে আমাদের অনেক আবেগী লোক জোশ ও জেদের বশবর্তী হয়ে পাল্টা কিছু করতে চান এবং কিছু কিছু করেও দেখেছেন। না ওকুল পেয়েছে না একুল পেয়েছেন। ওরা ফ্যাশন শো করে, আমরাও করে দেখি না আমাদের মতো করে! করে দেখা গেল বাজার পাওয়া গেল না!
মহিলাদের রূপ প্রদর্শনই যখন ইসলামে নিষিদ্ধ, তখন ফ্যাশন দেশটায় কীভাবে বাজার পায়? নিতান্ত সাংঘর্ষিক। ফ্যাশন শো ইসলাম বিলাসিতা মনে করে, তাও আবার নারীর ফ্যাশন, মানে পুরুষকে প্রদর্শন? এভাবে উদাহরণ দিলে অনেক দেয়া যায়। মিসরে একবার জামাল আব্দুন নাসেরের সময় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নামে নৃত্য (নাউযুবিল্লাহ) বানানো যায় কিনা- এমন এক কসরত শুরু হয়েছিল, কিন্তু শুরুতেই এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ। সন্ত্রাসের পাল্টা সন্ত্রাস, বোমাবাজির পরিবর্তে বোমাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ আর খুনের বদলা ছিনতাই অপহরণ আর খুন, গালির বদলে গালি, ইসলাম তা কখনও সমর্থন করে না।
তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য ন্যায়ের অস্ত্র বহুমুখী ব্যবহারের এস্তেমাল ইসলাম সমর্থন করে। এতটুকুই শুধু বলা যায়, এর অধিক বলার অবকাশ এখানে নেই। ওরা ক্রুসেডের ডাক দিলেও আমরা জিহাদের ডাক দিতে পারছি না নানাবিধ কারণে। কৃষ্টি-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অপরিচ্ছন্ন ধারণা, অস্পষ্টতা আর ভুল বোঝাবুঝি প্রচুর। ওদের এই আছে, হরেক রকম সংস্কৃতির উপকরণ আছে, তাদের মুকাবিলায় আমাদের কিছু থাকা দরকার। কিন্তু তাই বলে সবকিছুর জবাব একই ভাষায় দিতে হবে? ওদের সমাজে পিতৃপরিচয়হীন সন্তান কিলবিল করছে, লাখ লাখ সমকামীদের উৎপাদন চাই? আমরাও কি তবে সেই কালচারের পৃষ্ঠপোষকতা করব? অন্যের বাবা দেখতে যত সুন্দর হোক তাকে আমি বাবা বলি না, সাফ বিভাজন। আমার সংস্কৃতি আমার বটে। কিন্তু আমার ঈমানের বলয়ের বিপরীত বলয়ের সংস্কৃতি কখনোই আমার হতে পারে না। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওই বাণীই আজ বাস্তবে পরিণত হতে দেখছি। আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ، وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ سَلَكُوا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوهُ»، قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ: اليَهُودَ، وَالنَّصَارَى قَالَ: «فَمَنْ»
‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুসারী হবে। হাত হাত ও বিঘত বিঘত তথা হুবহু এবং অবিকলভাবে।এমনকি তারা যদিকোনোগুইসাপের গর্তেঢুকে পড়ে তাহলে তোমরাও তাতে ঢুকে পড়বে। আমরা (সাহাবায়ে কেরাম) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল!তারাকি ইহুদী ও খ্রিস্টন? তিনি বললেন,তারানয় তো আর কারা? [বুখারী : ৩৪৫৬; মুসলিম : ২৬৬৯]
যে বিজাতির অনুসরণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ»
‘যে কোনো জাতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হবে সে তাদের গোত্রভুক্ত বলেই গণ্য হবে।’ [আবূ দাউদ, সুনান : ৪০৩১]
আমার কৃষ্টি বা কালচার বা সংস্কৃতির কী বুঝে তারা, এতে যাদের ঈমান ও বিশ্বাস নেই? ড. মরিস বুকাইলী বাদশাহ ফয়সালকে জানিয়েছিলেন আমি ইতিবাচক নিয়তেই বলছি, ইসলামের ওপর গবেষণা করবো। স্বল্পভাষী বাদশাহ ফয়সাল স্মিত হাসি দিয়ে বলেছিলেন খুব ভালো, তাই যদি করতে চান তাহলে আগে পবিত্র কুরআনকে কুরআনের ভাষায় পাঠ করতে শিখুন অর্থ বুঝুন আরবি ভাষা শিখুন। মুরিস বুকাইলি সে উপদেশ মতো পবিত্র কুরআন স্টাডি করেছিলেন এবং ইসলাম বুঝেছিলেন। এরই ফলে তিনি অমর কয়েকটি গ্রন্থ বিশ্ববাসীকে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুতরাং আমার বলয়ের সংস্কৃতিও আমাকে লালন করতে হবে এবং অন্যকেও পারলে এই সংস্কৃতির বলয়ে আনতে হবে। কিন্তু আমি কখনই অন্যের সংস্কৃতি আমদানি করে নিজের ঘর নষ্ট করতে চাই না।
আসল কথা হলো, নিজেদের পরিচয়ের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। তাহলে আকাশ-সংস্কৃতির কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ তা বাছাই করা যাবে। আপনার আমার কাছে যদি ঈমানের চালনী না থাকে, ঈমানের নজর না থাকে, ঈমানের মনটা না থাকে তাহলে আকাশ-সংস্কৃতির ভালোমন্দ কিছুই পরখ করা যাবে না। যে দেহে রোগ প্রতিরোধ শক্তি প্রবল সে দেহে সহজে কোনো রোগ-জীবাণু প্রবেশ করতে পারে না। আকাশ-সংস্কৃতির যত ভয়ঙ্কর ভাইরাস আছে, এসব সংস্কৃতির অনিষ্টকারিতার প্রতিরোধে আমাদের সংস্কৃতি অক্ষম, যদি নিজস্ব সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে সে চেষ্টা সাধনা না থাকে। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, কালচার আর সংস্কৃতি এক নয়, যা কালচার তা সংস্কৃতি নাও হতে পারে। হাঁটার কালচার একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানের এক, কিন্তু দু’জনের প্রার্থনা ও ইবাদতের কালচার ও সংস্কৃতি এক নয়।
এক কথায় মুসলিমরা সব কালচারকে তাদের ঈমানী সংস্কারের কষ্টিপাথরে বাছাই করে যা গ্রহণ করে তা মুসলসমানদের সংস্কৃতি। সকল ধর্ম যেমন এক নয়, সকল ধর্মাবলম্বীদের সংস্কৃতিও এক নয়। প্রত্যেক ধর্মাম্বলবীদের কাছে সংস্কৃতি নির্ণয়ের কষ্টিপাথরও নেই। আর নেই বলেই যা চকমক করে ঝকমক করে, তাকেই সংস্কৃতির সোনা বলে। যেমন আশ্চর্য কিছু দেখলেই পূজোয় লেগে যায়, গাছ, বাঁশ, সাপ, পাথর, সূর্যকে এমনকি বট গাছকেও অলৌকিকতায় মণ্ডিত করে পূজো করে।
বর্তমানে আকাশ-সংস্কৃতির বড্ড জোর। বিশ্বের প্রত্যেক দেশ এই সংস্কৃতির হাওয়ায় ভাসছে। তরুণরা আবেগে থরথর করে কাঁপছে। আকাশ-সংস্কৃতির সওদা সিডি ও ক্যাসেট আকারে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দোকানে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। এসব সওদার মূল্য অতি কম কিন্তু মুগ্ধ করার, সম্মোহিত করার আছর থাকে বেশি। ঘরে ঘরে টিভি ও অন্যান্য যন্ত্র প্রবেশ করছে। পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন চ্যানেলের নাম প্র্রোগ্রাম রোজ ছাপা হয়। দিনরাতের প্রতিটি মুহূর্তে চিত্তকে বিনোদিত করার ব্যবস্থা আছে। বিনোদনের কি আইটেম আপনার চাই? হাতের কাছে রিমোট কন্ট্রোল মেশিন আছে। বোতাম টিপতে থাকুন একটার পর একটা। পশ্চিমাদের বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে সংস্কৃতি নামের বিভিন্ন অপসংস্কৃতি তৈরি করে বিশ্বময় রপ্তানি করছে, কেউ কেউ আমদানিও করছেন। যত অশ্লীলতা আছে, কুৎসিতদের জন্য কুৎসিত বিনোদন আছে সবই সরবরাহ করছে সিডিতে বন্দি করেও। ভারত ও পশ্চিমাদের ফ্যাক্টরিগুলোতে আকাশ সংস্কৃতি বিভিন্ন আইটেম তৈরি করে।
গত শতাব্দীর আশির দশকে বিভিন্ন কারণে লাতিন আমেরিকার প্রত্যেক দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল, কিন্তু তাদের কাছে সংস্কৃতি যাচাই বাছাইয়ের যন্ত্র না থাকায় এক পর্যায়ে উত্তেজনা থেমে যায়। ঠান্ডা হয়ে যায়, এখন লাতিন আমেরিকা খুশির বন্যায় সাঁতার কাটছে। আমাদের দেশেও যখন পশ্চিমা অপসংস্কৃতির এ বন্যার গলিজ পানি ঢুকতে থাকে তখন দেখা গেল শহর বন্দরের প্রত্যেক অলিগলিতে ভিডিও ক্লাব ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে। বেশকিছু দিন ধরে পাকড়াও চললো তারপর কি যেন একটা সমঝোতা হয়ে গেল। কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই, দেশের যুবসমাজ ও কিশোর কিশোরীরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে, কিছু একটা করা দরকার। আপত্তিকর পরিবেশনায় বদঅভ্যস্ত চ্যানেলগুলো বন্ধের পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ভারতের আকাশ বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর জন্য বন্ধ অথচ ভারতীয় চ্যানেলের একটি নাটকও কখন সম্প্রচার করা হবে তা বাংলাদেশে সময়সহ প্রচারিত হয়।
আকাশ সংস্কৃতি আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটাচ্ছে কীভাবে ব্যাখ্যার বোধ হয় কোনো প্রয়োজন নেই। নগ্নতা নগ্নতা ছাড়া তো তাদের কাছে কিছুই নেই। এই দুয়ের প্রমাণ যে যতো ঘটাচ্ছে সে ততো বেশি আকাশের বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে। অপসংস্কৃতির প্লাবনের মধ্যেও কোনো কোনো মুসলিম দেশ সেন্সর করে আকাশের এ সওদা প্রত্যাখ্যান করার সাহস দেখিয়েছে। কারণ প্রত্যেক দেশের কাছে এই আর্ন্তজাতিক নেটওয়ার্কের লোকাল কন্ট্রোলিং ব্যবস্থা আছে। যা আপত্তিকর বলে মনে করা হবে তা প্রদর্শন না করার হুকুম শক্তভাবে দেয়া যায়। ইরান ও সউদী আরব পারছে। আমরা কেন পারবো না?
নগ্নতা বিরুদ্ধে একটা ঘৃণাবোধ সৃষ্টির জাতীয় আন্দোলন অপরিহার্য। তরুণ সমাজের মধ্যে এই জাগরণ যদি আসে তাহলে আন্দোলন সফল হয়। নৈতিকতাবোধ শক্তি, শিক্ষা ও অনুশীলন ছাড়া এই ভাইরাস বন্ধ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এই ভাইরাস প্রতিরোধে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সেটা হলো এই অপসংস্কৃতির কেউ মনে প্রাণে পছন্দ করে না। আল্লাহর রাসূলের না পছন্দের আর পছন্দের দিকটি যত বেশি প্রচারে আসবে শিক্ষায় আসবে আমলে অনুশীলনে আসবে এই আসমানী বালা-মুসিবত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা হবে, নতুবা পরিত্রাণ নেই। হ্যা, আশার কথা, খুব দুর্বল হলেও বিপরীত একটা স্রোত একটা হাওয়া সৃষ্টির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আশা শুধু এই আমাদের ঈমানের তেজই আমাদের হেফাজত করতে পারে।
বর্তমানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে স্যাটেলাইট তথা ইলেকট্রনিক মিডিয়া আজকের আধুনিক সভ্যতার যুগে অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার দাবিদার। তবে এটা নির্ভর করে মূলত প্রত্যেক দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সুষ্ঠু দর্শন তথা সাচ্চা জাতীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে মিডিয়ার সদ্ব্যবহারের ওপর। আজ এই মিডিয়ার বদৌলতে পৃথিবীর পরিধি এখন ক্ষুদ্র হয়ে এসেছে। এটা জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নয়নের একটি প্রধান হাতিয়ার স্বরূপ।
তবে একথা সত্য যে এই ইতিবাচক দিকগুলো তখন উদ্ভাসিত হয়, যখন কিনা মিডিয়াগুলো মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে অপসংস্কৃতির প্রচার ঘটলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নেতিবাচক দিকটা উদ্ভাসিত হতে থাকবে এবং মানুষও সেই সঙ্গে তার নৈতিক আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতির গৌরবোজ্জ্বল অহংকারকে ধূলোয় মিশিয়ে অপসংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরবে। ফলে দেখা যাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কারণে একটি জাতির ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা ধ্বংস হয়ে গেছে। ভারত ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্লাবন আমাদের এদেশে যেভাবে আকাশ সংস্কৃতির নামে প্লাবিত হচ্ছে, তাতে আমাদের দেশের জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হচ্ছে অবহেলিত। ধরছে বিলুপ্তির পথ। যার ফলে এদেশের জীবনাদর্শ তথা সামাজিক জীবনের মৌলিক ধ্যান-ধারণা ও মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে বারবার ব্যাহত।
ভারত উপমহাদেশ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসক কর্তৃক শাসনের ফলে ঔপনিবেশিক আদর্শ ও নীতিরীতি এদেশের মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে এবং তারা এদেশের সংগ্রামী মানুষের শোষণ ও শাসনের জন্য কৌশল পরিবর্তন করে স্বাধীনতার নাম দিয়ে শাসনের নামে শোষণ করতে থাকে। ফলে দিনে দিনে ইংরেজ সংস্কৃতি এদেশের মানুষের মনে শেকড় তৈরি করতে সক্ষম হয়। উপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী এদেশ ত্যাগ করলেও দিনে দিনে এদেশের শাসন ও শোষণের মূল হাতিয়ার রূপে এখন বিদ্যমান স্যাটেলাইট, ফেসবুক এর মাধ্যমে অশ্লীল নৃত্যসহ নীল ছবি প্রচার করায় এদেশের মানুষ যেমন অপসংস্কৃতির বেড়িবাঁধে বন্দি তেমনি ঐসব চ্যানেল ইন্টারনেটের প্রতিনিধিরা হচ্ছে বিজয়ী।
তারা এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে গিয়েও এদেশকে ধ্বংস করার সূক্ষ্ম মাধ্যম বেছে নিয়েছে। যা শাসন ও শোষণের চেয়েও হাজার গুণ বিষাক্ত। এরা অপসংস্কৃতি দিয়ে এসব দারিদ্র্য দেশগুলোর জাতীয় মূল্যবোধ ধ্বংস করতে সর্বদা সচেষ্ট। এ জন্যেই তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মি. জন ফস্টার ডালেস সর্বপ্রথম সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিষ্ঠানিকভাবে রূপদান করেন। তিনি তার বক্তব্যে পরোক্ষে প্রতিপাদ্য ছিলো ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দাও।’ বিশ্বে যখন আমেরিকা সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করাকে একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন জাতিকে ধ্বংস করতে সংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
বর্তমান বিশ্বে যে পরিস্থিতি চলছে তার মূলে রয়েছে বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নয়নের অপপ্রয়োগ এবং অপব্যবহার। বিশ্বে এখন সামরিক আগ্রাসনের তুলনায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো যেমন সহজ তেমনি অধিকতর কার্যকর। আর এই অপসংস্কৃতির আগ্রাসন চালানো হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বে, বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে। আরো ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে, পশ্চিমা ও হিন্দুস্তানী যৌথ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিফলিত হওয়ার বিচারে বাংলাদেশ একটি উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হতে চলেছে। মূলত ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসীরা এদেশে বেশ কিছু সেবাদাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। দিন দিন ব্যাপকভাবে সেবাদাস সৃষ্টি করতে সচেষ্ট রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে রয়েছে তাঁবেদার রাজনীতিক এবং একশ্রেণির ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক-কলামিস্ট। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য মূলত দায়ী এদেশের সুষ্ঠু মতাদর্শগত জাতীয় চরিত্রসম্পন্ন রাজনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পশচাদপদ দিক।
আকাশ সংস্কৃতি সম্পর্কে বড্ড দীর্ঘ একটা বয়ান দিয়ে ফেললাম। এবার মূল আলোচনায় ফেরা যাক। আকাশ সংস্কৃতির ছোবল থেকে ভারতের অক্টোপাস বাঁধন আমরা ছাড়তেই পারছি না। প্রতিবেশি দেশ বলে কথা! এদের উৎকট আকাশ সংস্কৃতির বিধ্বংসী ঢেউ আমাদের মানচিত্রের ভূখণ্ড ধসিয়ে দিচ্ছে। ছোটো হয়ে আসছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও মুসলিম সভ্যতার পরিধি। কুখ্যাত হিন্দুসংস্কৃতি আমাদের মুসলিম তরুণ ও যুব সম্প্রদায়ের মাথা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। ওদের কৃষ্টি-কালচার আমাদের জন্য রীতিমতো উদ্বেগ ও হতাশাজনক। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে এবং প্রবলভাবেই তা বাড়ছে। প্রতিবেশি এই বৃহৎ দেশটি কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর লাশ ঝুলিয়ে রেখে শুধু আমাদের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ও মানচিত্রের মর্যাদাই ক্ষুণ্ন করছে না, আকাশ সংস্কৃতির নগ্ন আগ্রাসনের মাধ্যমে আমাদের তরুণ ও উঠতি প্রজন্মের চিন্তার স্বাধীনতা ও পবিত্রতাও চরমভাবে ক্ষুণ্ন ও ছিনতাই করে চলেছে।
দেশ স্বাধীন হলো এদেশের মানুষের ভেজা রক্তের নজরানায়, কিন্তু ভারত নিয়ে গেলো পরাজিত ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের অত্যাধুনিক সব অস্ত্র, যার বৈধ মালিক ছিল একমাত্র মূলত বাংলাদেশ। সেই যে নেয়ার ধারাবাহিকতা শুরু হলো আজও থামল না সেই আগ্রাসন। বরং দিন দিন বাড়ছেই ভারতের ক্ষুধা ও পিপাসা। এই পিপাসায় মরুভূমি হচ্ছে বাংলাদেশ। পিপাসার্ত ভারত ফারাক্কায় বাঁধ দিলো, তিস্তার পানি চুষে নিলো, টিপাইমুখে বাঁধ দিলো, ফেনি নদীর পানি নিলো। আর সর্বশেষ হরণ করে নিচ্ছে এদেশের তরুণ প্রজন্মের মেধা ও চিন্তার স্বাধীনতা। ফলে আজ অধিকাংশ তরুণ-তরুণী ভারতীয় নগ্ন সংস্কৃতির প্রভাবে ভারতপ্রীতি নিয়ে বড় হচ্ছে এবং মনের অদৃশ্য কোণে কোনো না কোনোভাবে লালন করছে ভারতপ্রেম। একটি দেশের চূড়ান্ত সর্বনাশের জন্য এরচেয়ে বড় আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয় আর কী হতে পারে?
এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মাথা ব্যথার কারণ নয়, সারাবিশ্বের জন্যই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ। সারাবিশ্বকেই আজ ভারতীয় ললনারা তাদের উদ্বাহু নৃত্যের নোংরা ছলনায় হতবিহ্বল করে চলেছে। তারা ক্রমশ দুর্বল হতে চলেছে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি। আর প্রতিবেশি দেশ হিসেবে এর বিষাক্ত ছোবল সর্বাগ্রে পড়ছে আমাদের মুসলিম যুবসমাজের ওপর। এতে যুবসমাজের মধ্যে দেশপ্রেম, নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ভাবগাম্ভীর্য ব্যাহত হচ্ছে এবং আরো উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খলভাবে এই কাজটা করা হচ্ছে। ভারতের কিছু মুসলিম অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন, যাদেরকে ব্যবহার করে অত্যন্ত সুকৌশলে ভারতীয়রা মুসলিম প্রতিবেশি দেশগুলোতে আকাশ সংস্কৃতির মরণছোবল বিস্তার করছে।
বড্ড দুঃখ লাগে মুসলিম পরিচয় নিয়ে শাহরুখ খান সেদেশের ব্রাহ্মণ কন্যা গৌরীকে হিন্দু রীতি মোতাবেক সিঁদুর দিয়ে বিয়ে করেছেন! এটা তার ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলে কথা ছিল না। কিন্তু আকাশ সংস্কৃতির হাওয়ায় তা আমাদের সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এবং বিষবাষ্পের মতো তা মুসলিম সমাজকে বিষাক্ত করছে। এই শাহরুখ কয়েকদিন আগে তার মেয়েকে প্রেমিক খুঁজে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন! সেই সঙ্গে কেমন প্রেমিক বেছে নিতে হবে সে ছবকও মেয়েকে দিয়েছেন তিনি। তিনি মেয়ে সুহানাকে বলেছেন, যদি তুমি কারো সঙ্গে ডেটিং দিতে সিদ্ধান্ত নাও তাহলে এমন ব্যক্তিকে বেছে নিও যে আমার মতো। শাহরুখ খান টুইটারে এক পোস্টে লিখেছেন, ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমি একজন চমৎকার মানুষ। আমি যথেষ্ট শালীন, ভালোবাসাময়, শিক্ষিত ও যত্নবান। আমি আমার মেয়েকে বলবো যে, যদি তার কোনো বয়ফ্রেন্ড খুঁজে নেয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে আমার ক্ষোভকে এড়িয়ে তাকে এমন একজনকে বেছে নিতে হবে যে হবে আমার মতো।’
নিজকন্যাকে এই জঘন্য পরামর্শ দিয়ে শাহরুখ খান কতটুকু অপরাধ করেছেন, সেটা হয়ত তার কন্যার ভবিষ্যত ও ইতিহাস নিরূপণ করবে। কিন্তু এর সঙ্গে তিনি যে অপরাধটি করেছেন তা এক কথায় ক্ষমার অযোগ্য। তিনি নিজ মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর তাবত মেয়েদেরও অনুরূপ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি আমি এ কথা আমার মেয়েকে বলতে পারি তাহলে এ কথা সব মেয়েকে বলতে পারি।’
সুতরাং এটা যে আকাশ সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে অন্যদের মধ্যেও এই অশালীনতা ও জঘন্য অনাচার বিস্তারের প্রয়াস তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারতীয় আকাশ সংস্কৃতি এভাবেই গিলে খাচ্ছে আমাদের তরুণ-যুবকদের মাথা, মেধা, মননশীলতা ও ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা। এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তরুণ সমাজকে সচেতন ও সতর্ক করতে না পারলে দেশ থেকে শুধু ইসলামী আদর্শই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই নয়; দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বও ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত হয়ে পড়বে।
তবে আমরা আশাবাদী একারণে যে, দেশে এখনও অনেক সচেতন, আত্মমর্যাদা ও ইসলামী ভাবনাবোধসম্পন্ন তরুণ-যুবক আছেন। বিষয়টি বুঝা যায় ওই সংবাদের ওপর পাঠকদের মন্তব্য পাঠ করেই।
আমি আশাবাদী এভাবে বহু তরুণ-তরুণী ও যুবসম্প্রদায় ইসলামী আদর্শ ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে ভারতসহ বিশ্বের সকল আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্রমে রুখে দাঁড়াবে। কারণ, তারুণ্যের রক্তে উচ্ছৃঙ্খলার জোর যত বেশি, প্রতিরোধ, দেশপ্রেম ও স্বকীয়তাবোধের উষ্ণতা তারচেয়েও বেশি। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষ সর্বদাই নিজস্ব স্বাধীনতা-স্বকীয়তা রক্ষায় সিদ্ধহস্ত।
ইন্ডিয়ারই ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০) বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র সম্পর্কে “বাঙ্গালার ইতিহাস” বইটিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের মাটি নরম কিন্তু জায়গা কঠিন এখানে মানুষ অপেক্ষা মাটির প্রভাব অধিক।... এই স্বাতন্ত্র্যলোলুপ প্রাচ্য সমাজকে পুনঃপুনঃ আর্যাবর্তের আদিসমাজের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে টানিয়া আনিবার আয়োজনের ত্রুটি হয় নাই; কিন্তু মাটির গুণে সে আয়োজন পুনঃপুনঃ ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। যাহারা এ দেশের জনসাধারণ, তাহারা যেমন স্বতন্ত্র, সেইরূপ স্বতন্ত্রই রহিয়া গিয়াছে; বরং যাহারা তাহাদিগকে পরতন্ত্র করিয়া আর্যাচারী করিবার আয়োজনে ব্যাপৃত হইয়াছিলেন, তাহারাও নানা বিষয়ে আদিসমাজের বিধিব্যবস্থা পরিবর্তিত করিয়া, স্বতন্ত্র হইয়া উঠিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।... শাস্ত্রবচন যখন সমুদ্র-যাত্রার প্রবল প্রতিবাদ-প্রচারে সম্পূর্ণ অবসরশূন্য, তখন বাঙালি সমুদ্রপথে নানা দিকে দ্বীপোপদ্বীপে বাণিজ্যের বিজয়-বৈজয়ন্তীহস্তে প্রধাবিত।... বাঙালির আচার ব্যবহার ও শিক্ষাদীক্ষা লোকতত্ত্বের সকল স্তরেই স্বাতন্ত্রের ছায়ামূর্তি অঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছে। বাঙালিকে জানিতে হইলে, গ্রন্থকীট হইলেই, সকল তত্ত্ব জানিয়া চরিতার্থ হইবার সম্ভাবনা নাই। বাঙালিকে জানিতে হইলে, গ্রন্থ ছাড়িয়া, লোকতত্ত্বের মূল তথ্যের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হইতে হইবে।.... বঙ্গভূমি আর্যাবর্ত ও বঙ্গসমাজ আর্যসমাজ হইলেও, তাহা স্বতন্ত্র দেশ ও স্বতন্ত্র সমাজরূপে আর্যাবর্তের ও আর্যসমাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নাই।...
বহুসংখ্যক অনার্যের মধ্যে অল্পসংখ্যক আর্যবীরের পক্ষে জ্ঞানবলে, কৌশলবলে যন্ত্রবলে বা সুপরিচালিত বাহুবলে বিজয়রাজ্য সংস্থাপিত করা সম্ভব হইলেও বিজিত সমাজের ভাষা ও আচার ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে পরাভূত ও পরিবর্তিত করা সম্ভব হইতে পারে না। বরং সেরূপ ক্ষেত্রে বিজেতার পক্ষে আপন ভাষা ও আচার ব্যবহারের পূর্বতন বিশুদ্ধি রক্ষা করাই অসম্ভব হইয়া পড়ে। যে পরিমাণে নবরাজ্য সুগঠিত করিবার জন্য ভাষা ও লোক-ব্যবহারের পরিবর্তন সাধিত করিবার প্রয়োজন উপস্থিত হয়, সেই পরিমাণে পরিবর্তনের স্রোত প্রবাহিত হয়। বাঙ্গালীর লোক-ব্যবহার এই সকল পরিবর্তনের প্রভাবে ধীরে ধীরে গঠিত হইয়া উঠিয়াছে। তাহার আরম্ভ কোন্ পুরাতন যুগে, তাহার সীমানির্দেশের সম্ভাবনা নাই। আর্যাবর্তের আর্যসমাজের কেন্দ্রস্থলে তাহার মূল প্রস্রবণ নিহিত হইলেও, বাঙ্গালার সমতল ক্ষেত্রে তাহার সহিত নানা নদ-নদী সলিলসম্ভার মিলিত হইয়া তাহাকে কূলপ্লাবিনী প্রবল বন্যার ন্যায় শক্তিশালী করিয়া তুলিয়াছে।...
বঙ্গভাষা স্বতন্ত্র ভাষা। তাহার গঠন প্রণালীতে স্বাতন্ত্র্যের অভাব নাই। বাঙ্গালীর আচার ব্যবহারেও এইরূপ কত স্বাতন্ত্র লক্ষিত হয়। তাহার শিল্পের স্বাতন্ত্র সর্বত্র সুপরিচিত।...
বাঙ্গালীর আধুনিক ইতিহাসেও স্বাতন্ত্র্যের অভাব নাই। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ যে পথে গিয়াছে, বাঙ্গালী সকল বিষয়ে, সকল সময়ে সে পথ অবলম্বন করিতে সম্মত হয় নাই। আধুনিক ইতিহাসে বাঙ্গালী ভীরু এবং কাপুরুষ বলিয়া তিরস্কৃত হইলেও বাঙ্গালি স্বাতন্ত্রপ্রিয়-স্বাধীনতার উপাসক-অপরাজিত পৃথক জাতি। বাঙ্গালী কখন বৌদ্ধ হইয়াছে, কখন হিন্দু হইয়াছে, কখন হিন্দু মুসলিম বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে; কিন্তু কদাচ দীর্ঘকাল পরাধীন থাকতে সম্মত হয় নাই। পাঠান মোঘল কেহই বাঙ্গালীকে সম্পূর্ণরূপে জয় করিতে পারেন নাই; ইংরেজেরাও বাঙ্গালীকে রণক্ষেত্রে পরাভূত করিয়া, শাসনভার গ্রহণ করেন নাই। ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থান অস্ত্রবলে পরাভূত- বাঙ্গালা দেশ অস্ত্র বলে পরাভূত হয় নাই।’
সুতরাং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যে বাঙ্গালী মানুষ কখনও সার্বভৌমত্বেও পরাধীনতা মানেনি সেই বাঙ্গালী মুসলিম কারো সাংস্কৃতিক পরাধীনতাও মানবে না। অবশ্য এর জন্য চাই ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা ও অদম্য সাহস।
মানসিকতার পরিবর্তন ও বিবর্তন মানবজাতির সবচেয়ে কাছের ঘটনা। যুগের কোনো অধ্যায় ও কোনোকালেই বিবর্তন চিন্তা মানুষের সঙ্গ ছাড়েনি। তাই সময় যত গড়িয়েছে মানুষের চিন্তা ও ভাবনায় নতুন নতুন অধ্যায় যোগ হয়েছে। নতুন নতুন এই ভাবনা কোনো কোনো সময় বিশ্ববাসীকে করেছে বাধিত আর কখনো করেছে বিব্রত। বিশেষত অষ্টাদশ শতকের ইউরোপের শিল্পবিপ্লব অর্থপূজারী বিশ্বের ভাবনায় প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। এই বিপ্লব মানুষের অন্তরে শুধু অর্থলিপ্সা এবং অর্থপিপাসার অনুপ্রবেশ ঘটায়নি, বরং গোটা সত্তা এবং লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় অর্থক্ষুধার নিষিদ্ধবৃক্ষ রোপণ করেছে।
ফলে অর্থক্ষুধার এই নিষিদ্ধবৃক্ষ মানুষকে মানবিক ও নৈতিকতার বেহেশত থেকে অনেক দূরে ছিটকে দিয়েছে। ফলে নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষের একেকটা অন্তর অর্থলিপ্সার হাবিয়া দোযখে পরিণত হয়েছে; যে দোযখে নিত্য গুঞ্জরিত হয় ‘হাল মিম মাজিদ’ এর সুর। এই সুর স্রোতের মতো বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে শিল্পের কাঁচামালের খোঁজে। আর অতি দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, শিল্পসভ্যতার এই যুগে চতুর বণিকসমাজের দৃষ্টিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় কাঁচামাল ছিল নারীসমাজ। তাই শিল্পে নারীর ব্যবহার ছিল চরম প্রতারণামূলক ও নারীসত্তার জন্য প্রলয়ংকরী সিদ্ধান্ত।
তবে বণিকরা জানত, নারীসমাজকে এই পথে টেনে আনা দুঃসহ নয়, দুর্লভও নয়। অর্থ ও খ্যাতির একটু জাল বিছানোর প্রয়োজন মাত্র। বণিকদের সেই জাল বিছানোর ধারা শেষ হয়নি এবং নির্দিষ্ট কোনো অবয়বেও তা সীমাবদ্ধ থাকেনি। দিন দিন তারা নিত্যনতুন আবেষ্টনে সামান্য কিছু পয়সায় নারীদেরকে ব্যবসার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ব্যবসার প্রয়োজনেই তারা নারীদেরকে কখনও নগ্ন করছে কখনও অর্ধনগ্ন করছে এবং কখনও ‘মা’, ‘বোন’, ‘কন্যা-জায়া’র আসনে বসিয়ে অধিকার (?) দেয়ার নামে গলা ফাটাচ্ছে। পুকুরচুরি আর ধোঁকাবাজি কাকে বলে!
খুবই বেদনায়ক ব্যাপার হচ্ছে, নারীরা প্রতারকদের ফাঁদকে ভেবেছে মরুদ্যান। মরীচিকাকে ভেবেছে জীবনতৃষ্ণার অবারিত সুপেয় বারি। তাই অর্থতৃষ্ণা নিবারিত করতে কখন যে চোরাবালিতে ফেঁসে গেছে তা টেরও পায়নি এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথও খোঁজার চেষ্টা করেনি। তাই ধ্বংসের অতল গহ্বরে ডুবতে থাকা এই নারীসমাজ কোথায় তাদের সম্মান, কারা তাদের হিতাকাঙ্ক্ষী তা ভাবেওনি, ভাবার প্রয়োজনও মনে করেনি। ফলে এমন কর্মে তারা গৌরববোধ করছে এবং এমন প্রক্রিয়ায় সম্মানিত হতে চাচ্ছে যা কৌতুক বৈ কিছু নয়।
এবার আসি মূল ঘটনায়। ওই শিল্পবিপ্লবের পথ ধরেই আবির্ভাব ঘটেছে মিডিয়ার। মিডিয়াকে লালন করে বণিকশ্রেণি এবং বণিকশ্রেণিকে বাঁচিয়ে রাখে মিডিয়া। আর এই নারীবিধ্বংসী মিডিয়ার প্রধান খোরাক হচ্ছে নারী। মিডিয়ায় প্রচারিত কেশতেলে নারীর উপস্থিতি না হয় যৌক্তিক। কিন্তু পুরুষের গোঁফ কাটার ব্লেড-রেজারের বিজ্ঞাপনে নারী ব্যবহারের যৌক্তিকতা কতটুকু? মিডিয়া কোনো জবাবদিহিতার ধার ধারে না, তাদের চাই সর্বক্ষেত্রে নারী দেহের কমনীয় ও উত্তেজক উপস্থিতি, যা পুরুষকে আকৃষ্ট করবে সর্বোতভাবে ও সর্বব্যাপী।
মিডিয়ায় নারী ব্যবহারের এই ব্যাপকতা পুরুষকে প্রবলভাবে টানতে থাকে এবং নারী হয়ে ওঠে মিডিয়ার ব্যাপকতার প্রধান হাতিয়ার। এই ধারা উত্তেজক হতে হতে এমন একপর্যায়ে পৌঁছে, যখন নারীদেহের নগ্ন উপস্থিতিই হয়ে ওঠে পত্রিকা বা সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার মূল উপাদেয় এবং বিশ্বে এমন অনেক মিডিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে যার প্রচ্ছদে মাখানো হয় উলঙ্গ নারীদেহ। প্লেবয় নামের একটা ম্যাগাজিন কামনাবিলাস পুরুষের পছন্দের তালিকার শীর্ষের একটি ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনটির প্রতি সংখ্যায় বিশ্বের কোনো না কোনো নারীর নগ্ন ছবি ছাপা হয়।
পত্রিকায় প্রকাশ; বৃটিশ এক শিল্পপতির কন্যা তামারা নাম্নী এমনি এক যুবতী পুরুষদের প্রিয় ‘প্লেবয়’-র প্রচ্ছদে নগ্ন ছবি স্যুট করতে পেরে বেশ উচ্ছসিত। বৃটিশ শিল্পপতি বার্নি এক্লেস্টনের মেয়ে তামারা। মেয়ের নগ্ন ছবি স্যুটের ব্যাপারে বেশ উচ্ছসিত পিতা বার্নিও! তামারা বলেন, সম্পূর্ণ নগ্ন হতে প্রথম পর্যায়ে একটু বিব্রতবোধ হলেও পরে আর কোনো সমস্যা হয়নি। প্রথমদিন বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম। তবে তৃতীয় দিন আমি এতোটাই স্বাভাবিক যেমনটি এখন দেখছেন।’
তামারা আরো বলেন, ‘শরীর নিয়ে আমি অনেক বেশি গর্ববোধ করি। এটিকে আমি উদযাপন করতে চাই। আমার মা এটি দেখে খুব খুশি হয়েছে এবং আমার বোনও একই কাজ করতে আগ্রহী। তবে আমার বাবা এটি দেখেছে কিনা আমি জানি না। আমার ধারণা উনি এ সম্পর্কে জানেন।’
এ সম্পর্কে তামারা আরো বলেন, ‘আমার এ সৌন্দর্য সম্পর্কে আমি খুবই আনন্দিত। একজন নারী হিসেবে নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করছি। আমার ছবি নিশ্চয় বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণভাবে আপনাদের ভালো লাগবে বলে আশা করছি।’
পত্রিকা জগতের পুরুষদের প্রিয় প্লেবয় ম্যাগাজিন। প্রায় ৬০ বছর ধরে বিশ্বের সুন্দর নারীদের এর বিভিন্ন পৃষ্ঠায় স্থান দিয়ে আসছে বলে জানান তামারা। মে মাসের মূল প্রচ্ছদে নিজেকে দেখে তামারা সম্মানিতবোধ করছেন বলে জানান।’
পাঠক! এই রিপোর্টটি পাঠ করে মন্তব্য করার কিছু আছে? তাই বলছিলাম, চতুর বণিকরা শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে সম্মানিত নারীকে ব্যবহার করার প্রচেষ্টায় শতভাগ নয়, হাজারভাগ সফল হয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। নারীদেরকে শুধু তাদের সুবিধামাফিক স্থানে ব্যবহারই করা যাবে না; তাদের অনুভূতিও নিঃশেষ করা যাবে স্বয়ং বণিকরাও এতটুকু কল্পনা কখনও করেনি। কিন্তু কল্পনার সব প্রাচীর ভেদ করে নারী আজ সীমালঙ্ঘনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এরপর সীমালঙ্ঘন করার মতো কোনো জায়গাই রাখেনি! অন্যথায় একজন নারী তার নগ্নদেহ প্রকাশ করে উচ্ছ্বসিত হয় কী করে? নারী জন্মের আনন্দ কি তবে নগ্ন-প্রকাশে সন্নিহিত? তামারা তার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বলতে কী বোঝাতে চেয়েছে? একজন নারী নগ্ন হওয়ার পর তার অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বলতে কীইবা বাকি থাকে? আজ কি তবে বিবসনা নারীই আধুনিক বিশ্বের আদর্শ? যদি তাই না হবে তবে তামারার আরেক বোন কেন বোনের অনুসরণ করে নিজেই এভাবে পোজ দেয়ার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে? আর মা-বাবাই যুবতী কন্যার এমন নগ্নদেহ দেখে পুলকিত হন কী করে?
কন্যার কীর্তিতে পিতার উচ্ছসিত হওয়া যৌক্তিক। কিন্তু পত্রিকাওয়ালারা তো তামারাকে শো করেছে বিশ্বের কোটি যুবকের লোলুপ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। কোনো আবিষ্কার, পরীক্ষার বিস্ময়কর ফলাফল বা এজাতীয় কোনো কীর্তির কারণে নয়। বরং সৃষ্টিগত কারণেই একজন পুরুষ বিবসনা নারীদেহে প্রলুদ্ধ হবে, এই উদ্দেশ্যে তারা এই ছবিটা ছেপেছে। সুতরাং বিবসনা যুবতীর প্রলুদ্ধ করা নগ্ন ছবিতে লোলুপ যুবকদের সঙ্গে বাবাও উচ্ছসিত হবেন কেন?
মুদ্রার অপর পিঠ
তবে মুদ্রার অপর পিঠ থাকার মতো সব ঘটনার পশ্চাতেই ঘটনা থাকে। এক নারী নগ্ন পোজে জীবনের স্বার্থকতা খুঁজছেন তো অপরজন করছেন এর বিরুদ্ধে লড়াই! সচেতন করছেন যুবকদেরকে, নগ্নতার নিন্দা করছেন স্বয়ং নগ্নরাই।
এক সময়ে আকর্ষণীয় ফিগার নিয়ে নজর কাড়া পোজ দিতে জুড়ি ছিল না রোমোলা গারাইয়ের। ব্রিটিশ এই টেলিভিশন নাট্যশিল্পী দু’বার গোল্ডেন গ্লোব এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এসকোয়ার থেকে শুরু করে নামকরা সব সাময়িকীতে তার ছবি ছাপা হলে ভক্তকূলের বুকে ঝড় উঠত। সেই রোমোলা গারাইয় এখন লড়াই শুরু করেছেন পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে। তার মতে ছেলেদের সাময়িকীতে মডেলদের নগ্ন পোজ অবশ্যই সামাজিক সমস্যা তৈরি করছে।
এক দশক আগেও তিনি এধরনের পোজ দিয়েছেন, সে বিষয়টি মনে করিয়ে দিলে রোমোলা গারাই স্বীকার করেন অবশ্যই সেগুলো সামাজিক সমস্যার অংশবিশেষ। কিন্তু এখন তার নতুন লড়াই হচ্ছে টেসকোর পক্ষে পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রচারিভিযান চালানো। নগ্নতা বা এধরনের উদ্যোগ যা সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে তার বিরুদ্ধে এখন রোমোলা।
৩১ বছরের এই নাট্যঅভিনেত্রী বলেন, এখন সময় এসেছে নগ্নতা যেভাবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার। তিনি জু এন্ড নাটস’ এর মতো সাময়িকী বন্ধের দাবি জানান, যেখানে ছেলেদের জন্যে মেয়েদের নগ্ন পোজ দিয়ে ছবি ছাপা হয়। পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে রোমোলা গারাইয়া বলেন, টিনএজ থেকে শুরু করে শিশুরা যেভাবে পর্নোগ্রাফির ছোবলে পড়ছে তা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। কচি মনে এধরনের প্রকাশনা পরবর্তীতে তাদের অপরাধপ্রবণ হতে উস্কে দেয়।
তিনি বলেন, কোনো নারীর অধিকার নেই অন্যের সমস্যা সৃষ্টির জন্য নিজেকে নগ্ন হয়ে ছবি তোলার। তিনি বলেন, তবে মিডিয়া সবসময় নারীর আকর্ষণীয় ফিগারের কাছে দুর্বল বলে অনেকের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এই তো জীবনের বাস্তবতা। মোটা চোখে যা সুন্দর, বাস্তবতার চোখে তাই কুৎসিত, অসত্য। বস্তুত এভাবেই মানুষের জয়-পরাজয়ের হিসেব হয়। যারা জীবনকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে না মেপে গোটা জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন এবং গোটা সমাজকে সুন্দর করে দেখতে চান তারা সত্যের পথ খুঁজে পান। এমনকি ভুল করার পরও তাদের সৎপথে ফিরে আসতে সমস্যা হয় না। এক্ষেতে রোমোলো অন্তত সমাজব্যবস্থা ধ্বংসের ক্ষেত্রে নগ্নতা ও নারীদেহের স্বাধীনতা কত ভয়ংকর তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং নিজের দেহে হলেই যে তা যেনতেনভাবে প্রকাশ করতে হবে এবং প্রকাশ করতে গিয়ে সমাজের হাজার মানুষের জীবন ধ্বংস করবে, পরিবেশকে অশান্ত করে তুলবে সেই অধিকার কারো নেই। ধন্যবাদ রোমোলোকে!
ইসলামে ভিক্ষার মাধ্যমে উপার্জন এবং অপরের গলগ্রহ হওয়ার কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। ইসলাম মূলতই আত্মমর্যাদার ধর্ম। তাই ইসলাম তার অনুসারী কাউকে একেবারে লাচার হওয়া ছাড়া কারো কাছে হাত পেতে নিজের আত্মমর্যাদাবোধ বিসর্জন দেয়ার অনুমতি প্রদান করে না। বরং সর্বাবস্থায় নিজ হাতের উপার্জনকে উৎসাহিত করে এবং মর্যাদা প্রদান করে। তাই জীবিকার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে হালালপন্থা অবলম্বন করা এবং হারাম, সন্দেহজনক ও লজ্জাজনকপন্থা থেকে দূরে রাখা প্রতিটি মুমিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র দায়িত্ব। হাদীসে মানুষের গলগ্রহ না হয়ে বরং হালাল উপার্জনকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আবার কোনো কোনো হাদীসে ব্যবসা এবং হাতের কামাইকে সর্বোত্তম উপার্জন আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন-
«أفضلُ الكَسْبِ بَيْعٌ مَبْرُورٌ وَعَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِهِ»
‘মানুষের সর্বোত্তম উপার্জন হলো বৈধ ব্যবসা এবং হাতের কাজের উপার্জন।’ [ছহীহুল জামে‘ : ১১২৬, সহীহ]
শেষ যুগে হারামের ছড়াছড়ি এবং হালাল উপার্জনের ঘাটতি দেখা দেবে বলে হাদীসে ইরশাদ হয়েছে। এই প্রচেষ্টা নবীদেরই পবিত্র আখলাকের অন্যতম অংশ। যেমন, হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
«أُمِرَتِ الرُّسُلُ أنْ لا تَأْكُلَ إلاَّ طَيِّباً ولا تَعْمَلَ إلاَّ صالِحاً»
‘রাসূলগণকে একমাত্র হালাল ভক্ষণ এবং একমাত্র নেক কাজের আদেশ করা হয়েছে।’ [ছহীহুল জামে‘ : ১৩৬৭, হাসান]
আল্লাহ তা‘আলা অলস লোক পছন্দ করেন না। বস্তুত হালাল উপার্জনে সাধারণ পেশা অবলম্বন করা আদৌ দোষের বিষয় নয়। স্বয়ং নবী-রাসূলগণও সাধারণ পেশা অবলম্বন করতে লজ্জাবোধ করতেন না। আল্লাহর নবী মুসা ‘আলাইহিস সালাম কায়িক শ্রম করেছেন। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও শারীরিক পরিশ্রম করে উপার্জন করেছেন। তাই হালাল রুজির স্বল্পতায় বিচলিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
«نَفَثَ رُوحُ الْقُدُسِ فِي رَوْعِي أَنَّ نفْسًا لَنْ تَخْرُجَ مِنَ الدُّنْيَا حَتَّى تَسْتَكْمِلَ أَجَلَهَا، وَتَسْتَوْعِبَ رِزْقَهَا، فَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ، وَلَا يَحْمِلَنَّكُمِ اسْتِبْطَاءُ الرِّزْقِ أَنْ تَطْلُبُوهُ بِمَعْصِيَةِ اللهِ، فَإِنَّ اللهَ لَا يُنَالُ مَا عِنْدَهُ إِلَّا بِطَاعَتِهِ»
‘পবিত্র প্রাণ (জিবরীল ফেরেশতা) আমার অন্তরে ফুঁকে দিয়েছেন যে, কোনো ব্যক্তি তার নির্দিষ্ট রিজিক পূর্ণ না করে মৃত্যুবরণ করবে না। সুতরাং তোমরা রিজিক অন্বেষণে সুন্দরপন্থা অবলম্বন করো। আর রিজিকপ্রাপ্তির বিলম্ব যেন তোমাদের কাউকে অবৈধপন্থা অবলম্বন করতে উৎসাহিত না করে। কেননা আল্লাহ তা‘আলার কাছে যা আছে তা তার আনুগত্য ছাড়া হাসিল হয় না।’ [জামে ছগীর : ২২৭৩, শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, বিস্তারিত দেখুন, সহীহুল জামি‘ আস-সাহীহ ওয়া যিয়াদাতুহু : ১/৪১৯]
অবৈধ বা সন্দেহজনকপন্থা পরিহার করে হালাল রুজির পন্থা অবলম্বন করাই একজন আলেমের বড় শান। হাদীছে এ ধরনের সাহসী লোকদের প্রশংসা করা হয়েছে। আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«التَّاجِرُ الْجَبَانُ مَحْرُومٌ وَالتَّاجِرُ الْجَسُورُ مَرْزُوقٌ»
‘ভীরু ব্যবসায়ী বঞ্চিত এবং সাহসী ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয়।’ [জামে ছগীর : ৩৩৯৫, হাসান]
দীনী দায়িত্বগুলো পালনের পাশাপাশি যদি বৈধ কোনো ব্যবসার সুযোগ এসে যায়, তবে তা হাতছাড়া করা ঠিক নয়। অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাও অপছন্দ করেন। অন্যের কাছে হাত পাতার চেয়ে নিজে যে কোনো হালাল পন্থায় উপার্জন করা উচিত। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: «الْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلَى، وَالْيَدُ الْعُلْيَا الْمُنْفِقَةُ، وَالسُّفْلَى السَّائِلَةُ»
‘ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, উচু হাত নিচু হাত থেকে উত্তম। খরচকারী হাত হলো উচু হাত আর নিচু হাত হলো প্রার্থনাকারী হাত।’ [মুসলিম : ১০৩৩]
ভিক্ষাবৃত্তির নিন্দা সম্পর্কে অনেকগুলো হাদীস উল্লেখ করলাম। সাধারণত মানুষ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির চাহিদা না মেটাতে পেরেই ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। তবে জীবনধারনের এসব মৌলিক কারণেও ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত হওয়া নিন্দনীয়, ঘৃণিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিস্টিনা এনড্রিউ নামের এক ভিক্ষুক ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন ভয়ঙ্কর এক উদ্দেশ্যে। নিজের স্তনের আকার বৃদ্ধির জন্য টাকা যোগার করতেই তিনি এখন জনে জনে ভিক্ষা চেয়ে বেড়াচ্ছেন ফ্লোরিডার রাস্তায়!
জানা যায়, ফ্লোরিডার এক ব্যস্ত রাস্তায় ভিক্ষারত ওই নারী ভিক্ষুক একটি প্ল্যাকার্ডে নিজের উদ্দেশ্যের কথা লিখে সবার কাছে অর্থ সাহায্য কামনা করছেন। তার প্ল্যাকার্ডে লেখা- ‘NO HOMELESS NEED BOOBS’ ‘আমার খাদ্য কিংবা আশ্রয়ের প্রয়োজন নেই। ‘শারিরীক সৌন্দর্য’ বৃদ্ধি করতে অর্থ প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে ক্রিস্টিনা জানান, ফ্লোরিডার পেনসাকোলা রোডের কোণায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করে তিনি কিছু অর্থ জমিয়েছেন। ক্রিস্টিনা বলেন, ‘আমি শুধু চাই আমার বুক যেন উন্নত হয়। কারণ আমার যা আছে তাতে আমি খুশি নই। আর যেহেতু আমার টাকা নেই তাই এটাই ভালো পন্থা। মানুষ গৃহহীন চিহ্ন লাগিয়ে ভিক্ষা করে। আমি তা নই বরং তাদের চেয়ে সৎ। কারণ আমি সত্যি কথা বলছি।’
বিশ্বটা আজ কামনা-বাসনার জ্যান্ত খোঁয়াড়ে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞান, আধুনিকতা, উৎকর্ষ ও মানবিক ভাবনার এমন সমৃদ্ধ সমাজেও আমরা কেন যেন বিজ্ঞানময়, মানবিক ও শালীনতাবোধের সীমানায় অটল থাকতে পারছি না। যান্ত্রিক উৎকর্ষ মানবজীবনে যত দ্রুতগতিতে প্রবেশ করেছে তার চেয়ে তীব্র গতিতে মানবজীবন থেকে পালিয়ে যাচ্ছে মনুষ্যত্ব, শালীনতাবোধ ও চক্ষুলজ্জা। উৎকর্ষসিক্ত এই যান্ত্রিক জীবনযাত্রায় মানবতা ও মনুষ্যত্ব যেন অন্তসারশূন্য এক রঙিন প্রচ্ছদমাত্র। যেকোনো মূল্যে নিজের প্রবৃত্তি লালন ও বাসনাকে উচ্চমার্গে নিয়ে যাবার দুর্বার ইচ্ছা আজ মনুষ্যত্ব ও শালীনতাবোধের শেষ নিশানাটুকুও মিটিয়ে দিচ্ছে।
তাই কথিত আধুনিকসভ্যতায় যাপিত আমাদের এই জীবন ও মনুষ্যত্ব আজ শৃঙ্খলিত, বাক্যহীন, স্তব্ধ, বিমূঢ় এক ছায়াশক্তি। বিবেকবোধ ও শালীনতা আজ অধুনালুপ্ত। পৃথিবীটা যেন নির্জলজ্জার অগ্নিগোলকে পরিণত হচ্ছে, পরিণত হচ্ছে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার রিপুর খোঁয়াড়ে। বলা যায় এই অনৈতিক ভাবনা স্পর্শ করেছে বিশ্বের অধিকাংশ নাগরিককে। বলতে গেলে প্রায় সব ধরনের প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা আবর্তিত হচ্ছে অর্থ ও দেহকে কেন্দ্র করে। ফলে গড়ে উঠছে লালসা ও রিপুকেন্দ্রিক মানসিকতা। এরফলে প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে মনুষ্যত্বের সব্জ-শাদাব বাগিচা, ফুলেলবাগান। সমাজ ব্যবস্থায় যদি শালীনতাবোধ না থাকে তাহলে সেই সমাজ কত দিন টিকতে পারবে সেটা পরের কথা, সেই সমাজের চেহারা কতটা বিবর্ণ, কুৎসিত এবং কদাকর হতে পারে সেটাই আগে বিবেচনা করা দরকার।
এই বিবেচনাকর্মে আমরা রীতিমতো গলদঘর্ম! আমেরিকা-ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো বিশ্ববাজারে শুধু মোড়লগিরি করেই বেড়ায় না; নিজেদেরকে পরম সভ্য বলেও দাবি করে। কিন্তু আজ অবধি ওরা তাদের কথিত সভ্যতার সংজ্ঞা দেয়নি, ভালো মানুষগিরির ব্যাখ্যাও দেয়নি। কিন্তু আমরা তাদের সভ্যতার যেসব নিদর্শন প্রতিনিয় প্রত্যক্ষ করি তা আমাদেরকে সভ্যতার সংজ্ঞা কিংবা সভ্যতার দাবিদারদের প্রতি তীব্র ঘৃণার উদ্রেক করে। কারণ, ইউরোপ-আমেরিকায় এমন সব ঘটনা সংঘটিত হতে দেখি যা কোনো সভ্য সমাজে তো দূরের কথা জংলি সমাজেও সম্ভব নয়।
একজন নারী কতটা নির্লজ্জ হলে প্রকাশ্যে রাজপথে ব্যানার টাঙিয়ে বক্ষবৃদ্ধির জন্য ভিক্ষা করতে পারে সেটা কল্পনা করা যায়? এরূপ একজন নারী যেদেশের নাগরিকত্বের প্রতিনিধিত্ব করে সেই দেশকে কীভাবে সভ্য দেশ বলা যায়? কিন্তু এটাই বাস্তব, টাকার জোরে, ক্ষমতার বলে আজ শুধু অন্যদেরকে দাবিয়েই রাখা হচ্ছে না; সভ্যতার টিকিট ক্রয় এবং তা ফেরিও করা হচ্ছে! ফলে এরা কখনও এসব অশ্লীল, গর্হিত ও শালীনতাবর্জিত কাজে বাঁধ সাধবে না। এই বাঁধ না সাধার আরো কারণ আছে- বাণিজ্য। এরা বাণিজ্যিক কারণেই নারীকে অশ্লীলতার প্রশিক্ষণ দেয় এবং অশালীন কাজে লিপ্ত হতে দেখে বাণিজ্যিক ফায়েদার হিসেব করে।
আমরা জ্ঞানী-দার্শনিক ও হাকিমদের হেকমত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা কেবল কর্ণের বিনোদন হিসেবে শ্রবণ করি কিংবা অতি রসিক হলে কেউ কেউ বাণীগুলো বাঁধিয়ে ঘরেরও সৌন্দর্য বর্ধন করি। কিন্তু কথাগুলো দিয়ে আমরা মন সাজাই না কিংবা মনটাকে ঘরের মতো সুন্দর করার জন্য বাঁধাই করি না। লং ফেলো নামের একজন মনস্তাত্ত্বিক দার্শনিক ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘একজন মহিলা সুন্দর হওয়ার চেয়ে চরিত্রবান হওয়া বেশি প্রয়োজন।’
লং ফেলো যদি আজ জীবিত থাকতেন তবে লজ্জায় হয়ত তার এই কথাটা উঠিয়ে নিতেন। যে সমাজের একজন নারী তার ‘শরীর’ উন্নত করতে প্রকাশ্যে ব্যানার-ফেস্টুন টাঙিয়ে ভিক্ষা করতে পারে, সেই সমাজে আর যাই হোক এধরনের নীতিবাক্য মানায় না!
‘ইফ এনি ওয়ান ওয়ান্ট টু সেক্স দ্যান ইউ ক্যান কল টু মি পার আওয়ার ফাইভ থাউজেন্ড ওয়ানলি। ডোন্ট মিট টু আউট সাইট।’
ফেসবুকের পাতায় আকর্ষণীয় একটি টু কোয়ার্টার ছবির সঙ্গে এই বাক্য সম্বলিত পোস্ট দিয়েছে একটা মেয়ে। বিষয়টি কৌতূহলের। তাই প্রকৃত রহস্য ও ঘটনা জানার জন্য কল দেন জনৈক সাংবাদিক। ফোন গ্রহণ করে মেয়েটি বলে, নাম্বারটি কোথায় পেয়েছেন? কী নাম লেখা হয়েছে ওখানে? লোপা। কবে আসতে চান? কোথায় আসতে হবে? মিরপুর ১১ ইস্টার্ন হাউজিংয়ে। আমার বাসায়। অন্তত দুই ঘন্টা আগে ফোন দিতে হবে। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাশ তো ভাইয়া! কোথায় পড়ছেন? জবাবে মেয়েটি একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলল। এরপর বলল, এত কথার দরকার নেই, কবে আসতে চান বলুন? এখন তো মাসের মাঝামাঝি। বেতন পাওয়ার পর আসব- বলে লাইন কেটে দেন সাংবাদিক।
সাংবাদিক আরো জানান এরপর ট্যাগ সাইটে মেয়েটির নাম ও বয়স উল্লেখ করে ওয়েব পেজটিতে সার্চ দিলে লোপার ছবি ও ভিই প্রোফাইল আসে। অনুসন্ধান করে দেখা যায় লোপা নামে যে ছবি দেখানো হয়েছে তা আসলে দক্ষিণ ভারতের একজন নায়িকার ছবি। এরপর ফোন দেয়া হলে সে নিশ্চিত হয়ে নেয় এবং লোকেশন বাতলে দেয়। আর বলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ওখানে নেমে সোজা দোতালায় চলে আসবেন। বাম দরজায় করাঘাত করবেন। নতুবা মিস দেবেন।
সাজকানন বিউটি পার্লারের কাছে দুই মিনিট অপেক্ষা করতে বলা হয়। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার পর মেয়েটি ওই সাংবাদিককে ঘরে বসতে দেয়। খাতার ওপর লেখা তসলিমা। তসলিমা বলে নেটে লোপা লিখেছি, ছবিটিও আমার নয়। ভারতীয় এক মডেলের। সাংবাদিক জানতে চান, এক ঘণ্টার হিসাব হবে কখন থেকে? এইতো কথা বলা শুরু থেকে! এই এক ঘণ্টায় যতবার ইচ্ছা ততবার....পারবেন।
নেটে আহ্বান জানানোর চিন্তা মাথায় কীভাবে আসল? সাংবাদিক তা জানতে চাইলে মেয়েটি বলল, আগেই বলেছি ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি। প্রচুর অর্থের করকার। বিবিএর থার্ড সেমিস্টারে পড়ছি। সামনে আরও ৯ সেমিস্টার বাকি। পুরো কোর্সে আমার খরচ হবে সাড়ে তিনলাখ টাকা। মানিকগঞ্জের একটি ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারমিডিয়েট দিয়েই বন্ধুর হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে আসি। কয়েক মাস পর স্বামী উধাও হয়ে যায়। বাবা আর্মি অফিসার তিনি তা মেনে নেননি। আর্থিক অবস্থা ভালো হলেও তার ঘরে আর ফিরে যাইনি। ছেলেবেলার এক বন্ধুর কাছে ত্রিশ হাজার টাকা চাইলে সে বলে আমি টাকা দেবো কিন্তু তুই কী দিবি? ভালোই তো। পৃথিবী হচ্ছে গিভ এন্ড টেকের জায়গা। কিছুটা আঁচ করতে পেরে তাকে বলি কী চাও? সে বলে এক রাত কাটাতে চাই।
নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করে সিদ্ধান্ত নিই। আমার মনে তখন নতুন করে পড়াশোনা করার আনন্দ! রাত কেটে যায়। স্বামী উধাও হয়ে যাওয়ার পর ওই রাতটি অনেক আনন্দে কেটে যায়। বন্ধু আমাকে সারারাত মাতিয়ে রাখে। তখন মিরপুরের এক বাসায় সাবলেট থাকতাম। পরেরদিন ভাবতে ভাবতেই কেটে যায়। ভাবি, আমিও কি তবে আর দশটা মেয়ের মতো প্রফেশনাল হওয়ার পথে পা বাড়ালাম? এপথে তো আমার নিয়মিত হাঁটাচলা করা সম্ভব নয়। পড়াশোনা আছে! নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তাছাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাবার সামনেও দাঁড়াতে হবে। পড়াশোনা শেষ করে কোচিং করেও মাসে লাখ টাকা কামাই করছি। আমি ভালো আছি।
সাধারণ মেয়ের মতো এ হোটেল ও হোটেল করলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে না। আগে থেকেই সাইবার ক্যাফে যাওয়া আসা ছিল। অনেকের ফেসবুকে একাউন্ট থাকায় সিদ্ধান্ত নিই কোনো অফ ট্যাকের কোনো সাইটে একাউন্ট খুলব। ডিজিটাল সেক্স বলে রেটটা একটু বেশি রাখি। এতে সুবিধা অনেক। কোথাও যেতে হয় না। একদিনে অনেক পুরুষকে সঙ্গ দিতে হয়ে না। এক ঘণ্টায় একজন পরপুরুষ সাধারণত দুইবারের বেশি মিলিত হতে পারে না। ফলে আমি সেক্সটা এনজয় করতে পারি। অনেক গল্প শোনালাম। আর না। এবার আমার টাকাটা দিন। সে অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করে। আমি বলি ছবির সঙ্গে আপনার মিল নেই। ওসবের দরকার নেই।’ [হাসান শাফেয়ী ও কাজী সোহাগের রিপোর্ট, মানবজমিন ও অবাক বাংলাদেশ এর সৌজন্যে]
পাঠক! আশা করি পত্রিকার রিপোর্টটি পড়ে যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছেন। হয়ত এই ভেবে আহত হচ্ছেন, পশ্চিমা সভ্যতার জীবন বিধ্বংসী সুনামী কত নিপুণ মর্মান্তিকতায় আমাদের এই মুসলিম রাষ্ট্রটিকে জেঁকে ধরেছে। যে শিক্ষার আলোর আশায় দারিদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে সেই শিক্ষাই সাগরের ধ্বংসের উন্মাতাল ঝড়ে পালছেঁড়া তরীর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে!
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। দেয়ালে, বইয়ের পাতায়, ছেলেসন্তানদের পড়াশোনায় আগ্রহী করতে মা বাবাদের কথায়, বড়দের উপদেশ বাণীতে এবং পাঠ্যপুস্তকগুলোর শেষ পৃষ্ঠাসমূহে খুব যত্ন করে কথাগুলো লেখা থাকে। কথাটা সত্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হলে সর্বাগ্রে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন ও বিপ্লব আনতে হয়। একটি বৈপ্লবিক শিক্ষাব্যবস্থা ওই দেশকে বিশ্বমানচিত্রে বিশেষ স্থান ও মর্যাদা দখল করতে বিপুল ভূমিকা রাখে। এর সর্বশেষ প্রমাণ ইরান। বিশ্বমানচিত্রে ইরান আজ বিশেষ জায়গা দখল করে নিয়েছে। বিশ্বের একমাত্র জারজ রাষ্ট্র ইসরাঈল অনেক হম্বিতম্বি করলেও তারা জানে ইরান আজ যে অবস্থানে পৌঁছেছে তাতে তারা ইসরাঈলকে মানচিত্র থেকে মুছে দিতে সক্ষম।
ইরানের মতো একটা দেশের এই অবস্থানে পৌঁছা সহজ হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল শিক্ষাবিপ্লব। এই বিপ্লবসাধন করতে গিয়ে তাদেরকে অনেক কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে। পাঁচবছর পর্যন্ত সকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ-ইউনিভার্সিটি বন্ধ রেখে দেশের স্বার্থকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রণয়ন করে তবেই শিক্ষার দ্বার খুলে দেয়া হয়েছে। এর ফলাফলও তারা আজ হাতেনাতে পাচ্ছে। শিক্ষাবিপ্লবের ফলে তারা এমন কীর্তিবান ও সক্ষম নাগরিক তৈরি করতে পারছে যারা আমেরিকার রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন বিমান শুধু অবতরণ করাতেই সক্ষম হয়নি, অনুরূপ ড্রোন তারা নিজেরাও তৈরি করে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছে।
আমি ইরানের ধর্মীয় আদর্শের পক্ষে কথা বলছি না। জাতি ও দেশের কল্যাণ সাধনা-নিমিত্তে প্রণয়ন করা একটি শিক্ষাব্যবস্থা দেশকে কত উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে শুধু সে কথাটা বলতে চাচ্ছি। যদি সে ভাবনার আলোকে বলি তবে বলতে হবে, আমাদের দেশেও শিক্ষায় বিপ্লব আনতে হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তো চল্লিশ বছরের বেশি গত হলো, এর আগের শিক্ষা ছিল পাকিস্তান শাসনাধীন। তারও আগের শিক্ষা ছিলো বৃটিশ নিয়ন্ত্রিত। ফলে দীর্ঘদিন আমরা শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লবের যুগান্তকারী ছোঁয়া থেকে বঞ্ছিত হচ্ছি। তাই সামর্থ্যে সীমাবদ্ধ এই ক্ষুদ্র দেশটিতে শিক্ষাবিপ্লবের তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছে স্রোতের গতিতে অনৈতিকতা, বেলেল্লাপনা।
সুতরাং আদর্শ ও দেশের সেবার মানসে একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুনধারার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি হয়ে উঠেছে। যে শিক্ষার গোড়ায় থাকবে ইসলাম, দেশ ও মানবপ্রেম। থাকবে হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য রক্ষার দীপ্ত প্রতিজ্ঞা। আজ কেন শিক্ষালয় হয়ে উঠবে নাস্তিকদের আস্তানা? ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য হাজার বছর ধরে হাজার আলেম-উলামা, মুজাহিদীন-শহীদান ও ইসলামপ্রেমীর কুরবানীর নযরানায় প্রতিষ্ঠিত দেশটিতে চর্চা হবে ইসলামবিরোধীতা? কেন শিক্ষালয়গুলো অনৈতিক নগ্নাচারের চর্চা হবে? কেন একজন নারীকে দেহের বদলায় শিক্ষা করতে হবে? কেন এই পরিবেশ সৃষ্টি হলো? কারা শিক্ষাঙ্গনকে অশালীন জিন্দেগির কালিমায় কলঙ্কিত করল? আজ উচ্চশিক্ষার জন্য একজন নারীকে কেন ফেসবুকে দেহ বিক্রির অফার করতে হবে?
শিক্ষাবিহীন একজন মানুষ দেশ ও সমাজের বিরাট বোঝা, একথা সত্য। কিন্তু এরচেয়েও বড় সত্য হচ্ছে একজন চরিত্রবান নারী এই ধরনের চরিত্রওয়ালা শিক্ষিত নারীর চেয়ে হাজারগুণ ভালো। শিক্ষা না থাকলেও চরিত্র দিয়ে এরা দেশের কল্যাণে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু যার শিক্ষা খরচ অর্জিত হয়েছে দেহদানের বদলায় সেই শিক্ষা দেশের কোন খাতে ব্যয়িত হবে? ওই নারী তার জীবনবোধের কোন গল্পের দায়ে দেশ ও মানুষের সেবা করবেন? তার মধ্যে তখন কাজ করবে ঘৃণা, জিঘাংসা ও প্রতিশোধস্পৃহা। যে বাবা তাকে শিক্ষা খরচ থেকে বঞ্ছিত করেছে, যে স্বামী তাকে অসহায় করে ফেলে চলে গেছে, যে পুরুষরা শুধু টাকার জোরে তাকে ব্যবহার করে গেছে হয়ত একে একে এদের সবার বিরুদ্ধে ক্ষোভ, ক্রোধ ও জিঘাংসা জন্ম নেবে। যে সমাজ-সংসারের হাজারজনের বিরুদ্ধে জন্ম নিবে জিঘাংসা ও প্রতিশোধস্পৃহা সেই সমাজকে তিনি কীইবা উপহার দেবেন?
এখানে আরেকটি বিষয় খুবই লক্ষণীয়। ইসলাম আসার পূর্বে ব্যভিচারের মাধ্যমে অর্থ কামানোর রেওয়াজ ছিল। কিন্তু সেটা আজকের মতো এত ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল না। ব্যভিচারসংক্রান্ত পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করতে গিয়ে হাদীসগ্রন্থগুলো থেকে তৎকালীন পতিতাবৃত্তির কিছু ধারণা লাভ করা যায়। আয়াতটি হলো :
﴿ ٱلزَّانِي لَا يَنكِحُ إِلَّا زَانِيَةً أَوۡ مُشۡرِكَةٗ وَٱلزَّانِيَةُ لَا يَنكِحُهَآ إِلَّا زَانٍ أَوۡ مُشۡرِكٞۚ وَحُرِّمَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٣ ﴾ [النور: ٣]
‘ব্যভিচারী কেবল ব্যভিচারিণী অথবা মুশরিক নারীকে ছাড়া বিয়ে করবে না এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক ছাড়া বিয়ে করবে না। আর মুমিনদের উপর এটা হারাম করা হয়েছে।’ (সূরা আন-নূর, আয়াত : ৩)
আয়াতটি নাযিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হাদীসের বিভিন্নগ্রন্থে অনেক বর্ণনা সংকলিত হয়েছে। যেমন :
عَنْ سُفْيَانَ الثَّوْرِيِّ، قَالَ: سَمِعْتُ سَعِيدَ بْنَ جُبَيْرٍ يَقُولُ: «كُنَّ بَغَايَا بِمَكَّةَ قَبْلَ الْإِسْلَامِ، فَكَانَ رِجَالٌ يَتَزَوَّجُونَهُنَّ فَيُنْفِقْنَ عَلَيْهِمْ مَا أَصَبْنَ، فَلَمَّا جَاءَ الْإِسْلَامُ تَزَوَّجَهُنَّ رِجَالٌ مِنْ أَهْلِ الْإِسْلَامِ، فَحَرَّمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَلِكَ عَلَيْهِمْ»
সুফিয়ান ছাওরী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি সাঈদ ইবন জুবাইরকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘মক্কায় ইসলাম আগমনের পূর্বে কয়েকজন (নয়জন) ব্যভিচারী ছিল (তারা বাড়ির সামনে লাল পতাকা টাঙিয়ে রাখত যাতে খদ্দেররা সহজে তাদের কাছে আসতে পারে)। কিছু লোক তাদেরকে বিয়ে করেছিল এবং তারা তাদের অর্জিত অর্থের কিছু ওই স্বামীদের পেছনে খরচ করত। ইসলাম আগমনের পর মুসলিমদের কেউ কেউ তাদেরকে বিয়ে করতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিয়ে করাকে হারাম বলে ঘোষণা করেন।’ [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা : ১৬৯৩২]
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
أَنَّهَا نَزَلَتْ فِي بَغَايَا مُعْلِنَاتٍ كُنَّ فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَكُنَّ زَوَانِيَ مُشْرِكَاتٍ، فَحَرَّمَ اللَّهُ نِكَاحَهُنَّ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ.
‘আয়াতটি নাযিল হয়েছে জাহেলী যুগের প্রকাশ্যে ব্যভিচারিণীদের সম্পর্কে। এরা ছিল কিছু ব্যভিচারী মুশরিক মহিলা। আল্লাহ মুমিনদের জন্য এসব মহিলাকে বিয়ে করা হারাম ঘোষণা করেছেন। [সিয়ূতী, আদ-দুররুল মানছূর : ৬/১২৯]
তাফসীর ও হাদীসশাস্ত্রের বক্তব্যানুযায়ী ওই মহিলারা কেবল এলাকাকেন্দ্রিক পাপাচারে লিপ্ত হতো এবং তাদের দ্বারা সমাজের খুব কম সংখ্যক মানুষই খারাপ পথে পা বাড়াতো। উল্লেখিত আয়াতের তাফসীরে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর বর্ণনা থেকে তেমনি প্রতীয়মান হয়। তিনি বলেন,
إِنَّمَا كُنَّ نِسَاءً بَغَايًا مُتَعَالِنَاتٍ يَجْعَلْنَ عَلَى أَبْوَابِهِنَّ رَايَاتٍ يَأْتِيهِنَّ النَّاسُ يُعْرَفْنَ بِذَلِكَ
‘জাহেলী যুগে প্রকাশ্যে ব্যভিচারী কিছু নারী ছিল। তারা তাদের দরজার সামনে পতাকা ঝুলিয়ে রাখত, যাতে খারাপ লোকেরা বুঝতে পেরে তাদের কাছে আসতে পারে।’ [প্রাগুক্ত : ৬/১২৯]
কিন্তু জাহেলিয়াতের সীমাবদ্ধতার জাল ছিন্নভিন্ন করে মানুষ এগিয়ে গেছে অনেক দূরে- চাঁদে, মঙ্গলগ্রহে, সাত সমুদ্রের নিচে আর ফেসবুকে প্রস্তাব দিয়ে ব্যভিচারি নারী পৃথিবীর সব নষ্ট পুরুষের কাছে! আনাকরা (মক্কার নয় ব্যভিচারিণীর একজন) জাহেলিয়াতের মূর্খতার সীমাবদ্ধতায় যা করতে পারেনি, আধুনিকতার রণসজ্জিত লোপারা আজ তা নির্বিঘ্নে করতে পারছে!
তবে এখনও কি সময় আসেনি আল্লাহর এই দান বিজ্ঞান ও প্রচার মাধ্যমকে প্রবৃত্তির কাজে ব্যবহার না করে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করার? আজ দাবি উঠছে সবাইকে এক সঙ্গে শোধরাবার। রাজনৈতিক, আত্মকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে এই নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে।
অনৈতিকতা আশ্রিত এই শিক্ষার বোঝা বহন করা সমাজের পক্ষে অসাধ্য হয়ে উঠছে। তাই এই বোঝা কমাতে হবে, শিক্ষার হার বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চরিত্র ভালো করার দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, শিক্ষার গুরুত্বের পাশাপাশি শিক্ষালাভের গুরুত্বও বয়ান করা হয়। এপর্যন্ত এসে অনেক মানুষ সত্য থেকে সরে যায়। প্রচলিত এই শিক্ষাব্যবস্থা নিছক ভবিষ্যত উপার্জনের মাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও তারা ‘মনুষ্যত্বের জন্য শিক্ষা’ বলে গলাবাজি করে। অথচ এই কপটতা যদি না থাকত, শিক্ষাকে যদি সত্যিই মনুষ্যত্বের মাধ্যম বানাতো তবে সমাজের চিত্র আজ এত কদর্য থাকত না।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, সমাজের ভয়াবহ পাপ, অন্যায়, দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ, যেনা-ব্যভিচার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘শিক্ষিত’ লোকদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। একজন অশিক্ষিত রিক্সাওয়ালা না মেটানোর সুযোগ নিয়ে হয়ত পাঁচটাকা ভাড়া বেশি হাঁকান আর তাতেই আমরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি। এই ‘মহা অন্যায়ের’ প্রতিবাদে তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করি। কিন্তু বাংলাদেশ ও বিদেশ থেকে পড়ে আসা একজন ডাক্তার যখন টাকা খেয়ে সদ্য ধর্ষিতার মেডিকেল টেস্টকে ভুয়া বলে সার্টিফিকেট দেন কিংবা একজন সচিব যখন নতুন মসজিদে বিদ্যুৎ সংযোগের ফাইল ঘুষের টাকার লোভে আটকে দেন, একজন এমপি যখন নিঃস্ব, অসহায় বৃদ্ধার বয়স্কভাতা কার্ডে ভাগ বসান তখন আমরা তা নিরবে হজম করি! এর কারণ কি একমাত্র এই যে, রিকশাওয়ালার ওই পাঁচ টাকার অনৈতিক দাবির জন্য বিনিয়োগ করতে হয়নি আর এদের অনৈতিকতার দাবিতে বিশাল বিনিয়োগ করা হয়েছে?
জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাই বুঝি মানুষকে এমন নির্দয়, নিষ্ঠুর করে তোলে? আসলে একই সঙ্গে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সমাজ ও পাঠকের স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে, শিক্ষাকে প্রকৃত অর্থেই মনুষ্যত্ব বিকাশের উৎস মনে করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে নৈতিকতা ও ধর্মীয় জ্ঞানকে গুরুত্ব দিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। আনতে হবে শিক্ষাখাতে কার্যকর বিপ্লব।
তা না করলে এই শিক্ষা মানবজাতির সমাধান তো দেবেই না, উল্টো এই শিক্ষাই পুরোজাতির গলার কাঁটা হয়ে আবির্ভূত হবে। শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি মহৎ না হয়, শিক্ষাব্যবস্থা যদি নিছক জাগতিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে গড়া হয়, তবে সেই শিক্ষা কী পরিমাণ অনৈতিকতার জন্ম দেয় তা আজ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি লোপার এই গল্প পড়ে। আল্লাহর একটি বাণী উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি ইরশাদ করেছেন,
﴿ وَلَقَدۡ ذَرَأۡنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلۡجِنِّ وَٱلۡإِنسِۖ لَهُمۡ قُلُوبٞ لَّا يَفۡقَهُونَ بِهَا وَلَهُمۡ أَعۡيُنٞ لَّا يُبۡصِرُونَ بِهَا وَلَهُمۡ ءَاذَانٞ لَّا يَسۡمَعُونَ بِهَآۚ أُوْلَٰٓئِكَ كَٱلۡأَنۡعَٰمِ بَلۡ هُمۡ أَضَلُّۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡغَٰفِلُونَ ١٧٩ ﴾ [الاعراف: ١٧٩]
‘আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হল গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ।’ (সূরা আল-‘আরাফ, আয়াত : ১৭৯)