লগইন করুন
মানসিকতার পরিবর্তন ও বিবর্তন মানবজাতির সবচেয়ে কাছের ঘটনা। যুগের কোনো অধ্যায় ও কোনোকালেই বিবর্তন চিন্তা মানুষের সঙ্গ ছাড়েনি। তাই সময় যত গড়িয়েছে মানুষের চিন্তা ও ভাবনায় নতুন নতুন অধ্যায় যোগ হয়েছে। নতুন নতুন এই ভাবনা কোনো কোনো সময় বিশ্ববাসীকে করেছে বাধিত আর কখনো করেছে বিব্রত। বিশেষত অষ্টাদশ শতকের ইউরোপের শিল্পবিপ্লব অর্থপূজারী বিশ্বের ভাবনায় প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। এই বিপ্লব মানুষের অন্তরে শুধু অর্থলিপ্সা এবং অর্থপিপাসার অনুপ্রবেশ ঘটায়নি, বরং গোটা সত্তা এবং লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় অর্থক্ষুধার নিষিদ্ধবৃক্ষ রোপণ করেছে।
ফলে অর্থক্ষুধার এই নিষিদ্ধবৃক্ষ মানুষকে মানবিক ও নৈতিকতার বেহেশত থেকে অনেক দূরে ছিটকে দিয়েছে। ফলে নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষের একেকটা অন্তর অর্থলিপ্সার হাবিয়া দোযখে পরিণত হয়েছে; যে দোযখে নিত্য গুঞ্জরিত হয় ‘হাল মিম মাজিদ’ এর সুর। এই সুর স্রোতের মতো বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে শিল্পের কাঁচামালের খোঁজে। আর অতি দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, শিল্পসভ্যতার এই যুগে চতুর বণিকসমাজের দৃষ্টিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় কাঁচামাল ছিল নারীসমাজ। তাই শিল্পে নারীর ব্যবহার ছিল চরম প্রতারণামূলক ও নারীসত্তার জন্য প্রলয়ংকরী সিদ্ধান্ত।
তবে বণিকরা জানত, নারীসমাজকে এই পথে টেনে আনা দুঃসহ নয়, দুর্লভও নয়। অর্থ ও খ্যাতির একটু জাল বিছানোর প্রয়োজন মাত্র। বণিকদের সেই জাল বিছানোর ধারা শেষ হয়নি এবং নির্দিষ্ট কোনো অবয়বেও তা সীমাবদ্ধ থাকেনি। দিন দিন তারা নিত্যনতুন আবেষ্টনে সামান্য কিছু পয়সায় নারীদেরকে ব্যবসার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ব্যবসার প্রয়োজনেই তারা নারীদেরকে কখনও নগ্ন করছে কখনও অর্ধনগ্ন করছে এবং কখনও ‘মা’, ‘বোন’, ‘কন্যা-জায়া’র আসনে বসিয়ে অধিকার (?) দেয়ার নামে গলা ফাটাচ্ছে। পুকুরচুরি আর ধোঁকাবাজি কাকে বলে!
খুবই বেদনায়ক ব্যাপার হচ্ছে, নারীরা প্রতারকদের ফাঁদকে ভেবেছে মরুদ্যান। মরীচিকাকে ভেবেছে জীবনতৃষ্ণার অবারিত সুপেয় বারি। তাই অর্থতৃষ্ণা নিবারিত করতে কখন যে চোরাবালিতে ফেঁসে গেছে তা টেরও পায়নি এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথও খোঁজার চেষ্টা করেনি। তাই ধ্বংসের অতল গহ্বরে ডুবতে থাকা এই নারীসমাজ কোথায় তাদের সম্মান, কারা তাদের হিতাকাঙ্ক্ষী তা ভাবেওনি, ভাবার প্রয়োজনও মনে করেনি। ফলে এমন কর্মে তারা গৌরববোধ করছে এবং এমন প্রক্রিয়ায় সম্মানিত হতে চাচ্ছে যা কৌতুক বৈ কিছু নয়।
এবার আসি মূল ঘটনায়। ওই শিল্পবিপ্লবের পথ ধরেই আবির্ভাব ঘটেছে মিডিয়ার। মিডিয়াকে লালন করে বণিকশ্রেণি এবং বণিকশ্রেণিকে বাঁচিয়ে রাখে মিডিয়া। আর এই নারীবিধ্বংসী মিডিয়ার প্রধান খোরাক হচ্ছে নারী। মিডিয়ায় প্রচারিত কেশতেলে নারীর উপস্থিতি না হয় যৌক্তিক। কিন্তু পুরুষের গোঁফ কাটার ব্লেড-রেজারের বিজ্ঞাপনে নারী ব্যবহারের যৌক্তিকতা কতটুকু? মিডিয়া কোনো জবাবদিহিতার ধার ধারে না, তাদের চাই সর্বক্ষেত্রে নারী দেহের কমনীয় ও উত্তেজক উপস্থিতি, যা পুরুষকে আকৃষ্ট করবে সর্বোতভাবে ও সর্বব্যাপী।
মিডিয়ায় নারী ব্যবহারের এই ব্যাপকতা পুরুষকে প্রবলভাবে টানতে থাকে এবং নারী হয়ে ওঠে মিডিয়ার ব্যাপকতার প্রধান হাতিয়ার। এই ধারা উত্তেজক হতে হতে এমন একপর্যায়ে পৌঁছে, যখন নারীদেহের নগ্ন উপস্থিতিই হয়ে ওঠে পত্রিকা বা সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার মূল উপাদেয় এবং বিশ্বে এমন অনেক মিডিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে যার প্রচ্ছদে মাখানো হয় উলঙ্গ নারীদেহ। প্লেবয় নামের একটা ম্যাগাজিন কামনাবিলাস পুরুষের পছন্দের তালিকার শীর্ষের একটি ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনটির প্রতি সংখ্যায় বিশ্বের কোনো না কোনো নারীর নগ্ন ছবি ছাপা হয়।
পত্রিকায় প্রকাশ; বৃটিশ এক শিল্পপতির কন্যা তামারা নাম্নী এমনি এক যুবতী পুরুষদের প্রিয় ‘প্লেবয়’-র প্রচ্ছদে নগ্ন ছবি স্যুট করতে পেরে বেশ উচ্ছসিত। বৃটিশ শিল্পপতি বার্নি এক্লেস্টনের মেয়ে তামারা। মেয়ের নগ্ন ছবি স্যুটের ব্যাপারে বেশ উচ্ছসিত পিতা বার্নিও! তামারা বলেন, সম্পূর্ণ নগ্ন হতে প্রথম পর্যায়ে একটু বিব্রতবোধ হলেও পরে আর কোনো সমস্যা হয়নি। প্রথমদিন বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম। তবে তৃতীয় দিন আমি এতোটাই স্বাভাবিক যেমনটি এখন দেখছেন।’
তামারা আরো বলেন, ‘শরীর নিয়ে আমি অনেক বেশি গর্ববোধ করি। এটিকে আমি উদযাপন করতে চাই। আমার মা এটি দেখে খুব খুশি হয়েছে এবং আমার বোনও একই কাজ করতে আগ্রহী। তবে আমার বাবা এটি দেখেছে কিনা আমি জানি না। আমার ধারণা উনি এ সম্পর্কে জানেন।’
এ সম্পর্কে তামারা আরো বলেন, ‘আমার এ সৌন্দর্য সম্পর্কে আমি খুবই আনন্দিত। একজন নারী হিসেবে নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করছি। আমার ছবি নিশ্চয় বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণভাবে আপনাদের ভালো লাগবে বলে আশা করছি।’
পত্রিকা জগতের পুরুষদের প্রিয় প্লেবয় ম্যাগাজিন। প্রায় ৬০ বছর ধরে বিশ্বের সুন্দর নারীদের এর বিভিন্ন পৃষ্ঠায় স্থান দিয়ে আসছে বলে জানান তামারা। মে মাসের মূল প্রচ্ছদে নিজেকে দেখে তামারা সম্মানিতবোধ করছেন বলে জানান।’
পাঠক! এই রিপোর্টটি পাঠ করে মন্তব্য করার কিছু আছে? তাই বলছিলাম, চতুর বণিকরা শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে সম্মানিত নারীকে ব্যবহার করার প্রচেষ্টায় শতভাগ নয়, হাজারভাগ সফল হয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। নারীদেরকে শুধু তাদের সুবিধামাফিক স্থানে ব্যবহারই করা যাবে না; তাদের অনুভূতিও নিঃশেষ করা যাবে স্বয়ং বণিকরাও এতটুকু কল্পনা কখনও করেনি। কিন্তু কল্পনার সব প্রাচীর ভেদ করে নারী আজ সীমালঙ্ঘনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এরপর সীমালঙ্ঘন করার মতো কোনো জায়গাই রাখেনি! অন্যথায় একজন নারী তার নগ্নদেহ প্রকাশ করে উচ্ছ্বসিত হয় কী করে? নারী জন্মের আনন্দ কি তবে নগ্ন-প্রকাশে সন্নিহিত? তামারা তার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বলতে কী বোঝাতে চেয়েছে? একজন নারী নগ্ন হওয়ার পর তার অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বলতে কীইবা বাকি থাকে? আজ কি তবে বিবসনা নারীই আধুনিক বিশ্বের আদর্শ? যদি তাই না হবে তবে তামারার আরেক বোন কেন বোনের অনুসরণ করে নিজেই এভাবে পোজ দেয়ার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে? আর মা-বাবাই যুবতী কন্যার এমন নগ্নদেহ দেখে পুলকিত হন কী করে?
কন্যার কীর্তিতে পিতার উচ্ছসিত হওয়া যৌক্তিক। কিন্তু পত্রিকাওয়ালারা তো তামারাকে শো করেছে বিশ্বের কোটি যুবকের লোলুপ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। কোনো আবিষ্কার, পরীক্ষার বিস্ময়কর ফলাফল বা এজাতীয় কোনো কীর্তির কারণে নয়। বরং সৃষ্টিগত কারণেই একজন পুরুষ বিবসনা নারীদেহে প্রলুদ্ধ হবে, এই উদ্দেশ্যে তারা এই ছবিটা ছেপেছে। সুতরাং বিবসনা যুবতীর প্রলুদ্ধ করা নগ্ন ছবিতে লোলুপ যুবকদের সঙ্গে বাবাও উচ্ছসিত হবেন কেন?
মুদ্রার অপর পিঠ
তবে মুদ্রার অপর পিঠ থাকার মতো সব ঘটনার পশ্চাতেই ঘটনা থাকে। এক নারী নগ্ন পোজে জীবনের স্বার্থকতা খুঁজছেন তো অপরজন করছেন এর বিরুদ্ধে লড়াই! সচেতন করছেন যুবকদেরকে, নগ্নতার নিন্দা করছেন স্বয়ং নগ্নরাই।
এক সময়ে আকর্ষণীয় ফিগার নিয়ে নজর কাড়া পোজ দিতে জুড়ি ছিল না রোমোলা গারাইয়ের। ব্রিটিশ এই টেলিভিশন নাট্যশিল্পী দু’বার গোল্ডেন গ্লোব এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এসকোয়ার থেকে শুরু করে নামকরা সব সাময়িকীতে তার ছবি ছাপা হলে ভক্তকূলের বুকে ঝড় উঠত। সেই রোমোলা গারাইয় এখন লড়াই শুরু করেছেন পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে। তার মতে ছেলেদের সাময়িকীতে মডেলদের নগ্ন পোজ অবশ্যই সামাজিক সমস্যা তৈরি করছে।
এক দশক আগেও তিনি এধরনের পোজ দিয়েছেন, সে বিষয়টি মনে করিয়ে দিলে রোমোলা গারাই স্বীকার করেন অবশ্যই সেগুলো সামাজিক সমস্যার অংশবিশেষ। কিন্তু এখন তার নতুন লড়াই হচ্ছে টেসকোর পক্ষে পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রচারিভিযান চালানো। নগ্নতা বা এধরনের উদ্যোগ যা সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে তার বিরুদ্ধে এখন রোমোলা।
৩১ বছরের এই নাট্যঅভিনেত্রী বলেন, এখন সময় এসেছে নগ্নতা যেভাবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার। তিনি জু এন্ড নাটস’ এর মতো সাময়িকী বন্ধের দাবি জানান, যেখানে ছেলেদের জন্যে মেয়েদের নগ্ন পোজ দিয়ে ছবি ছাপা হয়। পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে রোমোলা গারাইয়া বলেন, টিনএজ থেকে শুরু করে শিশুরা যেভাবে পর্নোগ্রাফির ছোবলে পড়ছে তা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। কচি মনে এধরনের প্রকাশনা পরবর্তীতে তাদের অপরাধপ্রবণ হতে উস্কে দেয়।
তিনি বলেন, কোনো নারীর অধিকার নেই অন্যের সমস্যা সৃষ্টির জন্য নিজেকে নগ্ন হয়ে ছবি তোলার। তিনি বলেন, তবে মিডিয়া সবসময় নারীর আকর্ষণীয় ফিগারের কাছে দুর্বল বলে অনেকের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এই তো জীবনের বাস্তবতা। মোটা চোখে যা সুন্দর, বাস্তবতার চোখে তাই কুৎসিত, অসত্য। বস্তুত এভাবেই মানুষের জয়-পরাজয়ের হিসেব হয়। যারা জীবনকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে না মেপে গোটা জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন এবং গোটা সমাজকে সুন্দর করে দেখতে চান তারা সত্যের পথ খুঁজে পান। এমনকি ভুল করার পরও তাদের সৎপথে ফিরে আসতে সমস্যা হয় না। এক্ষেতে রোমোলো অন্তত সমাজব্যবস্থা ধ্বংসের ক্ষেত্রে নগ্নতা ও নারীদেহের স্বাধীনতা কত ভয়ংকর তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং নিজের দেহে হলেই যে তা যেনতেনভাবে প্রকাশ করতে হবে এবং প্রকাশ করতে গিয়ে সমাজের হাজার মানুষের জীবন ধ্বংস করবে, পরিবেশকে অশান্ত করে তুলবে সেই অধিকার কারো নেই। ধন্যবাদ রোমোলোকে!