বর্তমানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে স্যাটেলাইট তথা ইলেকট্রনিক মিডিয়া আজকের আধুনিক সভ্যতার যুগে অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার দাবিদার। তবে এটা নির্ভর করে মূলত প্রত্যেক দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সুষ্ঠু দর্শন তথা সাচ্চা জাতীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে মিডিয়ার সদ্ব্যবহারের ওপর। আজ এই মিডিয়ার বদৌলতে পৃথিবীর পরিধি এখন ক্ষুদ্র হয়ে এসেছে। এটা জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নয়নের একটি প্রধান হাতিয়ার স্বরূপ।
তবে একথা সত্য যে এই ইতিবাচক দিকগুলো তখন উদ্ভাসিত হয়, যখন কিনা মিডিয়াগুলো মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে অপসংস্কৃতির প্রচার ঘটলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নেতিবাচক দিকটা উদ্ভাসিত হতে থাকবে এবং মানুষও সেই সঙ্গে তার নৈতিক আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতির গৌরবোজ্জ্বল অহংকারকে ধূলোয় মিশিয়ে অপসংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরবে। ফলে দেখা যাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কারণে একটি জাতির ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা ধ্বংস হয়ে গেছে। ভারত ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্লাবন আমাদের এদেশে যেভাবে আকাশ সংস্কৃতির নামে প্লাবিত হচ্ছে, তাতে আমাদের দেশের জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হচ্ছে অবহেলিত। ধরছে বিলুপ্তির পথ। যার ফলে এদেশের জীবনাদর্শ তথা সামাজিক জীবনের মৌলিক ধ্যান-ধারণা ও মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে বারবার ব্যাহত।
ভারত উপমহাদেশ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসক কর্তৃক শাসনের ফলে ঔপনিবেশিক আদর্শ ও নীতিরীতি এদেশের মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে এবং তারা এদেশের সংগ্রামী মানুষের শোষণ ও শাসনের জন্য কৌশল পরিবর্তন করে স্বাধীনতার নাম দিয়ে শাসনের নামে শোষণ করতে থাকে। ফলে দিনে দিনে ইংরেজ সংস্কৃতি এদেশের মানুষের মনে শেকড় তৈরি করতে সক্ষম হয়। উপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী এদেশ ত্যাগ করলেও দিনে দিনে এদেশের শাসন ও শোষণের মূল হাতিয়ার রূপে এখন বিদ্যমান স্যাটেলাইট, ফেসবুক এর মাধ্যমে অশ্লীল নৃত্যসহ নীল ছবি প্রচার করায় এদেশের মানুষ যেমন অপসংস্কৃতির বেড়িবাঁধে বন্দি তেমনি ঐসব চ্যানেল ইন্টারনেটের প্রতিনিধিরা হচ্ছে বিজয়ী।
তারা এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে গিয়েও এদেশকে ধ্বংস করার সূক্ষ্ম মাধ্যম বেছে নিয়েছে। যা শাসন ও শোষণের চেয়েও হাজার গুণ বিষাক্ত। এরা অপসংস্কৃতি দিয়ে এসব দারিদ্র্য দেশগুলোর জাতীয় মূল্যবোধ ধ্বংস করতে সর্বদা সচেষ্ট। এ জন্যেই তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মি. জন ফস্টার ডালেস সর্বপ্রথম সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিষ্ঠানিকভাবে রূপদান করেন। তিনি তার বক্তব্যে পরোক্ষে প্রতিপাদ্য ছিলো ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দাও।’ বিশ্বে যখন আমেরিকা সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করাকে একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন জাতিকে ধ্বংস করতে সংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
বর্তমান বিশ্বে যে পরিস্থিতি চলছে তার মূলে রয়েছে বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নয়নের অপপ্রয়োগ এবং অপব্যবহার। বিশ্বে এখন সামরিক আগ্রাসনের তুলনায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো যেমন সহজ তেমনি অধিকতর কার্যকর। আর এই অপসংস্কৃতির আগ্রাসন চালানো হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বে, বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে। আরো ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে, পশ্চিমা ও হিন্দুস্তানী যৌথ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিফলিত হওয়ার বিচারে বাংলাদেশ একটি উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হতে চলেছে। মূলত ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসীরা এদেশে বেশ কিছু সেবাদাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। দিন দিন ব্যাপকভাবে সেবাদাস সৃষ্টি করতে সচেষ্ট রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে রয়েছে তাঁবেদার রাজনীতিক এবং একশ্রেণির ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক-কলামিস্ট। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য মূলত দায়ী এদেশের সুষ্ঠু মতাদর্শগত জাতীয় চরিত্রসম্পন্ন রাজনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পশচাদপদ দিক।
আকাশ সংস্কৃতি সম্পর্কে বড্ড দীর্ঘ একটা বয়ান দিয়ে ফেললাম। এবার মূল আলোচনায় ফেরা যাক। আকাশ সংস্কৃতির ছোবল থেকে ভারতের অক্টোপাস বাঁধন আমরা ছাড়তেই পারছি না। প্রতিবেশি দেশ বলে কথা! এদের উৎকট আকাশ সংস্কৃতির বিধ্বংসী ঢেউ আমাদের মানচিত্রের ভূখণ্ড ধসিয়ে দিচ্ছে। ছোটো হয়ে আসছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও মুসলিম সভ্যতার পরিধি। কুখ্যাত হিন্দুসংস্কৃতি আমাদের মুসলিম তরুণ ও যুব সম্প্রদায়ের মাথা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। ওদের কৃষ্টি-কালচার আমাদের জন্য রীতিমতো উদ্বেগ ও হতাশাজনক। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে এবং প্রবলভাবেই তা বাড়ছে। প্রতিবেশি এই বৃহৎ দেশটি কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর লাশ ঝুলিয়ে রেখে শুধু আমাদের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ও মানচিত্রের মর্যাদাই ক্ষুণ্ন করছে না, আকাশ সংস্কৃতির নগ্ন আগ্রাসনের মাধ্যমে আমাদের তরুণ ও উঠতি প্রজন্মের চিন্তার স্বাধীনতা ও পবিত্রতাও চরমভাবে ক্ষুণ্ন ও ছিনতাই করে চলেছে।
দেশ স্বাধীন হলো এদেশের মানুষের ভেজা রক্তের নজরানায়, কিন্তু ভারত নিয়ে গেলো পরাজিত ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের অত্যাধুনিক সব অস্ত্র, যার বৈধ মালিক ছিল একমাত্র মূলত বাংলাদেশ। সেই যে নেয়ার ধারাবাহিকতা শুরু হলো আজও থামল না সেই আগ্রাসন। বরং দিন দিন বাড়ছেই ভারতের ক্ষুধা ও পিপাসা। এই পিপাসায় মরুভূমি হচ্ছে বাংলাদেশ। পিপাসার্ত ভারত ফারাক্কায় বাঁধ দিলো, তিস্তার পানি চুষে নিলো, টিপাইমুখে বাঁধ দিলো, ফেনি নদীর পানি নিলো। আর সর্বশেষ হরণ করে নিচ্ছে এদেশের তরুণ প্রজন্মের মেধা ও চিন্তার স্বাধীনতা। ফলে আজ অধিকাংশ তরুণ-তরুণী ভারতীয় নগ্ন সংস্কৃতির প্রভাবে ভারতপ্রীতি নিয়ে বড় হচ্ছে এবং মনের অদৃশ্য কোণে কোনো না কোনোভাবে লালন করছে ভারতপ্রেম। একটি দেশের চূড়ান্ত সর্বনাশের জন্য এরচেয়ে বড় আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয় আর কী হতে পারে?
এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মাথা ব্যথার কারণ নয়, সারাবিশ্বের জন্যই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ। সারাবিশ্বকেই আজ ভারতীয় ললনারা তাদের উদ্বাহু নৃত্যের নোংরা ছলনায় হতবিহ্বল করে চলেছে। তারা ক্রমশ দুর্বল হতে চলেছে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি। আর প্রতিবেশি দেশ হিসেবে এর বিষাক্ত ছোবল সর্বাগ্রে পড়ছে আমাদের মুসলিম যুবসমাজের ওপর। এতে যুবসমাজের মধ্যে দেশপ্রেম, নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ভাবগাম্ভীর্য ব্যাহত হচ্ছে এবং আরো উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খলভাবে এই কাজটা করা হচ্ছে। ভারতের কিছু মুসলিম অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন, যাদেরকে ব্যবহার করে অত্যন্ত সুকৌশলে ভারতীয়রা মুসলিম প্রতিবেশি দেশগুলোতে আকাশ সংস্কৃতির মরণছোবল বিস্তার করছে।
বড্ড দুঃখ লাগে মুসলিম পরিচয় নিয়ে শাহরুখ খান সেদেশের ব্রাহ্মণ কন্যা গৌরীকে হিন্দু রীতি মোতাবেক সিঁদুর দিয়ে বিয়ে করেছেন! এটা তার ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলে কথা ছিল না। কিন্তু আকাশ সংস্কৃতির হাওয়ায় তা আমাদের সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এবং বিষবাষ্পের মতো তা মুসলিম সমাজকে বিষাক্ত করছে। এই শাহরুখ কয়েকদিন আগে তার মেয়েকে প্রেমিক খুঁজে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন! সেই সঙ্গে কেমন প্রেমিক বেছে নিতে হবে সে ছবকও মেয়েকে দিয়েছেন তিনি। তিনি মেয়ে সুহানাকে বলেছেন, যদি তুমি কারো সঙ্গে ডেটিং দিতে সিদ্ধান্ত নাও তাহলে এমন ব্যক্তিকে বেছে নিও যে আমার মতো। শাহরুখ খান টুইটারে এক পোস্টে লিখেছেন, ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমি একজন চমৎকার মানুষ। আমি যথেষ্ট শালীন, ভালোবাসাময়, শিক্ষিত ও যত্নবান। আমি আমার মেয়েকে বলবো যে, যদি তার কোনো বয়ফ্রেন্ড খুঁজে নেয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে আমার ক্ষোভকে এড়িয়ে তাকে এমন একজনকে বেছে নিতে হবে যে হবে আমার মতো।’
নিজকন্যাকে এই জঘন্য পরামর্শ দিয়ে শাহরুখ খান কতটুকু অপরাধ করেছেন, সেটা হয়ত তার কন্যার ভবিষ্যত ও ইতিহাস নিরূপণ করবে। কিন্তু এর সঙ্গে তিনি যে অপরাধটি করেছেন তা এক কথায় ক্ষমার অযোগ্য। তিনি নিজ মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর তাবত মেয়েদেরও অনুরূপ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি আমি এ কথা আমার মেয়েকে বলতে পারি তাহলে এ কথা সব মেয়েকে বলতে পারি।’
সুতরাং এটা যে আকাশ সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে অন্যদের মধ্যেও এই অশালীনতা ও জঘন্য অনাচার বিস্তারের প্রয়াস তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারতীয় আকাশ সংস্কৃতি এভাবেই গিলে খাচ্ছে আমাদের তরুণ-যুবকদের মাথা, মেধা, মননশীলতা ও ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা। এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তরুণ সমাজকে সচেতন ও সতর্ক করতে না পারলে দেশ থেকে শুধু ইসলামী আদর্শই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই নয়; দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বও ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত হয়ে পড়বে।
তবে আমরা আশাবাদী একারণে যে, দেশে এখনও অনেক সচেতন, আত্মমর্যাদা ও ইসলামী ভাবনাবোধসম্পন্ন তরুণ-যুবক আছেন। বিষয়টি বুঝা যায় ওই সংবাদের ওপর পাঠকদের মন্তব্য পাঠ করেই।
আমি আশাবাদী এভাবে বহু তরুণ-তরুণী ও যুবসম্প্রদায় ইসলামী আদর্শ ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে ভারতসহ বিশ্বের সকল আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্রমে রুখে দাঁড়াবে। কারণ, তারুণ্যের রক্তে উচ্ছৃঙ্খলার জোর যত বেশি, প্রতিরোধ, দেশপ্রেম ও স্বকীয়তাবোধের উষ্ণতা তারচেয়েও বেশি। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষ সর্বদাই নিজস্ব স্বাধীনতা-স্বকীয়তা রক্ষায় সিদ্ধহস্ত।
ইন্ডিয়ারই ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০) বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র সম্পর্কে “বাঙ্গালার ইতিহাস” বইটিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের মাটি নরম কিন্তু জায়গা কঠিন এখানে মানুষ অপেক্ষা মাটির প্রভাব অধিক।... এই স্বাতন্ত্র্যলোলুপ প্রাচ্য সমাজকে পুনঃপুনঃ আর্যাবর্তের আদিসমাজের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে টানিয়া আনিবার আয়োজনের ত্রুটি হয় নাই; কিন্তু মাটির গুণে সে আয়োজন পুনঃপুনঃ ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। যাহারা এ দেশের জনসাধারণ, তাহারা যেমন স্বতন্ত্র, সেইরূপ স্বতন্ত্রই রহিয়া গিয়াছে; বরং যাহারা তাহাদিগকে পরতন্ত্র করিয়া আর্যাচারী করিবার আয়োজনে ব্যাপৃত হইয়াছিলেন, তাহারাও নানা বিষয়ে আদিসমাজের বিধিব্যবস্থা পরিবর্তিত করিয়া, স্বতন্ত্র হইয়া উঠিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।... শাস্ত্রবচন যখন সমুদ্র-যাত্রার প্রবল প্রতিবাদ-প্রচারে সম্পূর্ণ অবসরশূন্য, তখন বাঙালি সমুদ্রপথে নানা দিকে দ্বীপোপদ্বীপে বাণিজ্যের বিজয়-বৈজয়ন্তীহস্তে প্রধাবিত।... বাঙালির আচার ব্যবহার ও শিক্ষাদীক্ষা লোকতত্ত্বের সকল স্তরেই স্বাতন্ত্রের ছায়ামূর্তি অঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছে। বাঙালিকে জানিতে হইলে, গ্রন্থকীট হইলেই, সকল তত্ত্ব জানিয়া চরিতার্থ হইবার সম্ভাবনা নাই। বাঙালিকে জানিতে হইলে, গ্রন্থ ছাড়িয়া, লোকতত্ত্বের মূল তথ্যের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হইতে হইবে।.... বঙ্গভূমি আর্যাবর্ত ও বঙ্গসমাজ আর্যসমাজ হইলেও, তাহা স্বতন্ত্র দেশ ও স্বতন্ত্র সমাজরূপে আর্যাবর্তের ও আর্যসমাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নাই।...
বহুসংখ্যক অনার্যের মধ্যে অল্পসংখ্যক আর্যবীরের পক্ষে জ্ঞানবলে, কৌশলবলে যন্ত্রবলে বা সুপরিচালিত বাহুবলে বিজয়রাজ্য সংস্থাপিত করা সম্ভব হইলেও বিজিত সমাজের ভাষা ও আচার ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে পরাভূত ও পরিবর্তিত করা সম্ভব হইতে পারে না। বরং সেরূপ ক্ষেত্রে বিজেতার পক্ষে আপন ভাষা ও আচার ব্যবহারের পূর্বতন বিশুদ্ধি রক্ষা করাই অসম্ভব হইয়া পড়ে। যে পরিমাণে নবরাজ্য সুগঠিত করিবার জন্য ভাষা ও লোক-ব্যবহারের পরিবর্তন সাধিত করিবার প্রয়োজন উপস্থিত হয়, সেই পরিমাণে পরিবর্তনের স্রোত প্রবাহিত হয়। বাঙ্গালীর লোক-ব্যবহার এই সকল পরিবর্তনের প্রভাবে ধীরে ধীরে গঠিত হইয়া উঠিয়াছে। তাহার আরম্ভ কোন্ পুরাতন যুগে, তাহার সীমানির্দেশের সম্ভাবনা নাই। আর্যাবর্তের আর্যসমাজের কেন্দ্রস্থলে তাহার মূল প্রস্রবণ নিহিত হইলেও, বাঙ্গালার সমতল ক্ষেত্রে তাহার সহিত নানা নদ-নদী সলিলসম্ভার মিলিত হইয়া তাহাকে কূলপ্লাবিনী প্রবল বন্যার ন্যায় শক্তিশালী করিয়া তুলিয়াছে।...
বঙ্গভাষা স্বতন্ত্র ভাষা। তাহার গঠন প্রণালীতে স্বাতন্ত্র্যের অভাব নাই। বাঙ্গালীর আচার ব্যবহারেও এইরূপ কত স্বাতন্ত্র লক্ষিত হয়। তাহার শিল্পের স্বাতন্ত্র সর্বত্র সুপরিচিত।...
বাঙ্গালীর আধুনিক ইতিহাসেও স্বাতন্ত্র্যের অভাব নাই। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ যে পথে গিয়াছে, বাঙ্গালী সকল বিষয়ে, সকল সময়ে সে পথ অবলম্বন করিতে সম্মত হয় নাই। আধুনিক ইতিহাসে বাঙ্গালী ভীরু এবং কাপুরুষ বলিয়া তিরস্কৃত হইলেও বাঙ্গালি স্বাতন্ত্রপ্রিয়-স্বাধীনতার উপাসক-অপরাজিত পৃথক জাতি। বাঙ্গালী কখন বৌদ্ধ হইয়াছে, কখন হিন্দু হইয়াছে, কখন হিন্দু মুসলিম বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে; কিন্তু কদাচ দীর্ঘকাল পরাধীন থাকতে সম্মত হয় নাই। পাঠান মোঘল কেহই বাঙ্গালীকে সম্পূর্ণরূপে জয় করিতে পারেন নাই; ইংরেজেরাও বাঙ্গালীকে রণক্ষেত্রে পরাভূত করিয়া, শাসনভার গ্রহণ করেন নাই। ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থান অস্ত্রবলে পরাভূত- বাঙ্গালা দেশ অস্ত্র বলে পরাভূত হয় নাই।’
সুতরাং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যে বাঙ্গালী মানুষ কখনও সার্বভৌমত্বেও পরাধীনতা মানেনি সেই বাঙ্গালী মুসলিম কারো সাংস্কৃতিক পরাধীনতাও মানবে না। অবশ্য এর জন্য চাই ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা ও অদম্য সাহস।