আকাশ-সংস্কৃতি কি আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে? নৈতিকতাভিত্তিক যে চরিত্র গঠনের আবেদন আমরা জানাই, যে আন্দোলন করি, যে অনুশীলন আমরা সাধ্যমত করছি, এই চরিত্রের সঙ্গে আকাশ সংস্কৃতি কি সাংঘর্ষিক, না সহযোগী?
আকাশ-সংস্কৃতি কী? আকাশের তো কোনো সংস্কৃতি পয়দা হয় না। তবে হ্যাঁ আকাশ পথে সব সংস্কৃতির বেসাতি চলে, আমদানি-রপ্তানি হয়, ক্রয়-বিক্রয় হয় তাই টোটাল সওদাকে আমরা বলতে পারি আকশ-সংস্কৃতি। আপনি আমি এটাকে সংস্কৃতি বলি আর নাই বলি, বাজারে এটাই সংস্কৃতি নামে পরিচিত। আকাশ থেকে এ পর্যন্ত একটি তারকাও খসে পড়েনি, তবুও সিনেমা জগতে, ফুটবল জগতে, ক্রিকেট জগতে, এমনকি পরীক্ষার ফলাফল সিটে হাজার হাজার তারকার ভীড়। এসবের কোন কোনটির পেছনেও আকাশ-সংস্কৃতির ভূমিকা রয়েছে।
আকাশ-সংস্কৃতির কারবারটা জানতে হলে কি আকাশ ঘুরে আসতে হয়? আসলে আকাশের ঠিকানা আমরা জানি না, বিজ্ঞানীরাও জানে না। তবে আকাশের ঠিকানা জানা না জানার প্রশ্ন পরের কথা, দুনিয়া থেকে যদি আখেরাতের সওদা আহরণ করা যায়, তাহলে জমিনে বাস করে আকাশের খবর কেন জানা যাবে না? আকাশের আলোচনায় আসার আগে দুনিয়ার কিছু খবরাখবর আমাদের জানা দরকার। আকাশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগে আমাদের নিয়ত ও আত্মপরিচয় কী সে সম্পর্কে কিছু বলার ও জানার আছে। আল্লাহ আমাদের কেন দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তা জানা থাকা দরকার। এসব না জানলে, মনোবল সেভাবে গড়তে না পারলে এবং আকাশ শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করার ঈমানী হিম্মত নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করতে না পারলে আকাশ সংস্কৃতির ভাইরাসরা আমাদের চারদিকে ঘিরে ফেলবে। এখনই ঘেরাও এর মধ্যে আছি। এজন্য দুনিয়াতে আমাদের আগমন ও জীবনযাপন আর প্রস্থান সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। নিজেকে চিনলে, নিজেকে জানলে আল্লাহকে চেনা যায়, জানা যায়। এবং তখন যে কোনো যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া যায়।
আমরা দুনিয়াতে বাস করি। এই দুনিয়াতে আমাদের প্রেরণ কি স্রষ্টার নিছক খেয়ালমাত্র? আল্লাহ বলেন,
﴿ أَفَحَسِبۡتُمۡ أَنَّمَا خَلَقۡنَٰكُمۡ عَبَثٗا وَأَنَّكُمۡ إِلَيۡنَا لَا تُرۡجَعُونَ ١١٥ ﴾ [المؤمنون: ١١٥]
‘তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে কেবল অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে না?’ (সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত : ১১৫)
না তা নয়। খেলাচ্ছলে বা নিছক খেয়ালে আল্লাহ কিছুই করেন না। যদিও একক ক্ষমতা শুধু তারই আছে, হও বললেই হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّمَآ أَمۡرُهُۥٓ إِذَآ أَرَادَ شَيًۡٔا أَن يَقُولَ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ٨٢ ﴾ [يس: ٨٢]
‘তাঁর ব্যাপার শুধু এই যে, কোন কিছুকে তিনি যদি ‘হও’ বলতে চান, তখনই তা হয়ে যায়।’ (সূরা ইয়াসীন, আয়াত : ৮২)
এমন শক্তিধর সর্বশক্তিমান যিনি, তাঁর তো খলীফা প্রেরণের প্রয়োজন নেই। তবুও তিনি মানবজাতিকে তার খলীফা হিসেবে প্রেরণ করেছেন মানবজাতির মধ্যে জবাবদিহিতা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦]
‘আর আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদাত করবে।’ (সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত : ৫৬)
ইবাদত কী? ইবাদত হচ্ছে, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে তার দেয়া জীবন বিধান অনুয়ায়ী জীবনযাপন করা। কিভাবে জীবনযাপন করতে হবে এজন্য কওমের কাছে প্রতি জনপদে নবী-রাসূল এসেছেন। অনেকে তার আদেশ নিষেধ শুনেছে আবার অনেকে শুনেনি। প্রেরিত গাইডকে নির্যাতিত করেছে, গাইড বুকও ধ্বংস করেছে। তাই তাদের এখন নৈতিক কোনো বোধই নেই। যা ছিল তা অবক্ষয়ে অবক্ষয়ে শেষ গেছে।
যে নৈতিকবোধ তারা নানাভাবে প্রদর্শন করে নিজেদের নীতিবান বলে বিশ্ববাসীর কাছে জাহির করছে, তা কৃত্রিম, নিজেদের মনগড়া নৈতিকতা। তারা-কাপড় পরিধান করেও থাকে দিগম্বর। সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড় পরিধান করে বটে, সুন্দর সুন্দর সংলাপে শ্রোতাকে তারা মুগ্ধও করে। কারণ নৈতিকতার কুদরতী সীমানা আর মানুষের তৈরি সীমানার মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। কুদরতী হুকুমের কোনো তোয়াক্কা তারা করেনি। ফলে শয়তানের সঙ্গে মিতালী করে এমন এক নৈতিকতা সৃষ্টি করে রেখেছে, যা অনৈতিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। নানা দিকে অবক্ষয়ের ঢল ও ধস। এমন এক পর্যায়ে অবক্ষয়ের সর্বশেষ স্তরে এবং সময়ের এই সন্ধিক্ষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর মূল মিশন কী ছিল লক্ষ্যহীন ঠিকানাবিহীন এবং বিগত নবী-রাসূলদের শিক্ষা ও আদর্শ ভুলে যাওয়া মানবজাতির বংশধরদের বিস্মৃত সবক-পাঠ স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং সর্বক্ষেত্রে জাহিলিয়াতের যে অবক্ষয় নেমেছিল তা প্রতিহত করে চরিত্রবান জাতি হিসেবে গড়ে তোলা। আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗاۚ وَإِن مِّنۡ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٞ ٢٤ ﴾ [فاطر: ٢٤]
‘আমি তোমাকে সত্যসহ পাঠিয়েছি সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে; আর এমন কোন জাতি নেই যার কাছে সতর্ককারী আসেনি।’ (সূরা ফাতির, আয়াত : ২৪)
সংস্কৃতি একটি জাতিকে প্রভাবিত করার অতুলনীয় মাধ্যম। তবে তার ব্যবহার হওয়া চাই যথার্থ। কেননা ব্যক্তি ও সত্তার প্রভাবে সংস্কৃতির ক্রিয়া ও প্রভাব ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে বাধ্য। সুতরাং বলা যায় নাস্তিক, মুরতাদ আর সেক্যুলারিস্টদের ‘মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর অবক্ষয়ের’ সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার সঙ্গে তাওহীদে বিশ্বাসীদের সংজ্ঞা ব্যাখ্যার মিল নেই।
কোন পথে চললে কোন ঠিকানায় আমাকে পৌঁছাবে, কোন পথের বাঁকে বাঁকে এবং মোড়ে মোড়ে কে কে আছে এবং কেন আছে তাও জানা হয়ে গেছে। অতএব নাস্তিকের নৈতিকতা ও সংস্কৃতি আমার জন্য অনৈতিকতা ও অপসংস্কৃতি হওয়ারই স্বাভাবিক ও সঙ্গত।
‘আকাশ সংস্কৃতি’ খুব লম্বা চওড়া বিষয় নয়, তবে এর আগে অথৈ আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে লড়াইয়ের আগে জেনে নিতে হবে আমরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত কি না, আমরা যে অস্ত্র নিয়ে লড়াই করবো তা লড়াই উপযোগী কিনা? আর এ লড়াইয়ের ব্যাপারে আমাদের ধ্যান-ধারণা পরিষ্কার কিনা। ধারণাটা পরিষ্কার করা হয় না বলে আমাদের অনেক আবেগী লোক জোশ ও জেদের বশবর্তী হয়ে পাল্টা কিছু করতে চান এবং কিছু কিছু করেও দেখেছেন। না ওকুল পেয়েছে না একুল পেয়েছেন। ওরা ফ্যাশন শো করে, আমরাও করে দেখি না আমাদের মতো করে! করে দেখা গেল বাজার পাওয়া গেল না!
মহিলাদের রূপ প্রদর্শনই যখন ইসলামে নিষিদ্ধ, তখন ফ্যাশন দেশটায় কীভাবে বাজার পায়? নিতান্ত সাংঘর্ষিক। ফ্যাশন শো ইসলাম বিলাসিতা মনে করে, তাও আবার নারীর ফ্যাশন, মানে পুরুষকে প্রদর্শন? এভাবে উদাহরণ দিলে অনেক দেয়া যায়। মিসরে একবার জামাল আব্দুন নাসেরের সময় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নামে নৃত্য (নাউযুবিল্লাহ) বানানো যায় কিনা- এমন এক কসরত শুরু হয়েছিল, কিন্তু শুরুতেই এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ। সন্ত্রাসের পাল্টা সন্ত্রাস, বোমাবাজির পরিবর্তে বোমাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ আর খুনের বদলা ছিনতাই অপহরণ আর খুন, গালির বদলে গালি, ইসলাম তা কখনও সমর্থন করে না।
তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য ন্যায়ের অস্ত্র বহুমুখী ব্যবহারের এস্তেমাল ইসলাম সমর্থন করে। এতটুকুই শুধু বলা যায়, এর অধিক বলার অবকাশ এখানে নেই। ওরা ক্রুসেডের ডাক দিলেও আমরা জিহাদের ডাক দিতে পারছি না নানাবিধ কারণে। কৃষ্টি-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অপরিচ্ছন্ন ধারণা, অস্পষ্টতা আর ভুল বোঝাবুঝি প্রচুর। ওদের এই আছে, হরেক রকম সংস্কৃতির উপকরণ আছে, তাদের মুকাবিলায় আমাদের কিছু থাকা দরকার। কিন্তু তাই বলে সবকিছুর জবাব একই ভাষায় দিতে হবে? ওদের সমাজে পিতৃপরিচয়হীন সন্তান কিলবিল করছে, লাখ লাখ সমকামীদের উৎপাদন চাই? আমরাও কি তবে সেই কালচারের পৃষ্ঠপোষকতা করব? অন্যের বাবা দেখতে যত সুন্দর হোক তাকে আমি বাবা বলি না, সাফ বিভাজন। আমার সংস্কৃতি আমার বটে। কিন্তু আমার ঈমানের বলয়ের বিপরীত বলয়ের সংস্কৃতি কখনোই আমার হতে পারে না। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওই বাণীই আজ বাস্তবে পরিণত হতে দেখছি। আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ، وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ سَلَكُوا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوهُ»، قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ: اليَهُودَ، وَالنَّصَارَى قَالَ: «فَمَنْ»
‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুসারী হবে। হাত হাত ও বিঘত বিঘত তথা হুবহু এবং অবিকলভাবে।এমনকি তারা যদিকোনোগুইসাপের গর্তেঢুকে পড়ে তাহলে তোমরাও তাতে ঢুকে পড়বে। আমরা (সাহাবায়ে কেরাম) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল!তারাকি ইহুদী ও খ্রিস্টন? তিনি বললেন,তারানয় তো আর কারা? [বুখারী : ৩৪৫৬; মুসলিম : ২৬৬৯]
যে বিজাতির অনুসরণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ»
‘যে কোনো জাতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হবে সে তাদের গোত্রভুক্ত বলেই গণ্য হবে।’ [আবূ দাউদ, সুনান : ৪০৩১]
আমার কৃষ্টি বা কালচার বা সংস্কৃতির কী বুঝে তারা, এতে যাদের ঈমান ও বিশ্বাস নেই? ড. মরিস বুকাইলী বাদশাহ ফয়সালকে জানিয়েছিলেন আমি ইতিবাচক নিয়তেই বলছি, ইসলামের ওপর গবেষণা করবো। স্বল্পভাষী বাদশাহ ফয়সাল স্মিত হাসি দিয়ে বলেছিলেন খুব ভালো, তাই যদি করতে চান তাহলে আগে পবিত্র কুরআনকে কুরআনের ভাষায় পাঠ করতে শিখুন অর্থ বুঝুন আরবি ভাষা শিখুন। মুরিস বুকাইলি সে উপদেশ মতো পবিত্র কুরআন স্টাডি করেছিলেন এবং ইসলাম বুঝেছিলেন। এরই ফলে তিনি অমর কয়েকটি গ্রন্থ বিশ্ববাসীকে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুতরাং আমার বলয়ের সংস্কৃতিও আমাকে লালন করতে হবে এবং অন্যকেও পারলে এই সংস্কৃতির বলয়ে আনতে হবে। কিন্তু আমি কখনই অন্যের সংস্কৃতি আমদানি করে নিজের ঘর নষ্ট করতে চাই না।
আসল কথা হলো, নিজেদের পরিচয়ের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। তাহলে আকাশ-সংস্কৃতির কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ তা বাছাই করা যাবে। আপনার আমার কাছে যদি ঈমানের চালনী না থাকে, ঈমানের নজর না থাকে, ঈমানের মনটা না থাকে তাহলে আকাশ-সংস্কৃতির ভালোমন্দ কিছুই পরখ করা যাবে না। যে দেহে রোগ প্রতিরোধ শক্তি প্রবল সে দেহে সহজে কোনো রোগ-জীবাণু প্রবেশ করতে পারে না। আকাশ-সংস্কৃতির যত ভয়ঙ্কর ভাইরাস আছে, এসব সংস্কৃতির অনিষ্টকারিতার প্রতিরোধে আমাদের সংস্কৃতি অক্ষম, যদি নিজস্ব সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে সে চেষ্টা সাধনা না থাকে। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, কালচার আর সংস্কৃতি এক নয়, যা কালচার তা সংস্কৃতি নাও হতে পারে। হাঁটার কালচার একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানের এক, কিন্তু দু’জনের প্রার্থনা ও ইবাদতের কালচার ও সংস্কৃতি এক নয়।
এক কথায় মুসলিমরা সব কালচারকে তাদের ঈমানী সংস্কারের কষ্টিপাথরে বাছাই করে যা গ্রহণ করে তা মুসলসমানদের সংস্কৃতি। সকল ধর্ম যেমন এক নয়, সকল ধর্মাবলম্বীদের সংস্কৃতিও এক নয়। প্রত্যেক ধর্মাম্বলবীদের কাছে সংস্কৃতি নির্ণয়ের কষ্টিপাথরও নেই। আর নেই বলেই যা চকমক করে ঝকমক করে, তাকেই সংস্কৃতির সোনা বলে। যেমন আশ্চর্য কিছু দেখলেই পূজোয় লেগে যায়, গাছ, বাঁশ, সাপ, পাথর, সূর্যকে এমনকি বট গাছকেও অলৌকিকতায় মণ্ডিত করে পূজো করে।
বর্তমানে আকাশ-সংস্কৃতির বড্ড জোর। বিশ্বের প্রত্যেক দেশ এই সংস্কৃতির হাওয়ায় ভাসছে। তরুণরা আবেগে থরথর করে কাঁপছে। আকাশ-সংস্কৃতির সওদা সিডি ও ক্যাসেট আকারে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দোকানে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। এসব সওদার মূল্য অতি কম কিন্তু মুগ্ধ করার, সম্মোহিত করার আছর থাকে বেশি। ঘরে ঘরে টিভি ও অন্যান্য যন্ত্র প্রবেশ করছে। পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন চ্যানেলের নাম প্র্রোগ্রাম রোজ ছাপা হয়। দিনরাতের প্রতিটি মুহূর্তে চিত্তকে বিনোদিত করার ব্যবস্থা আছে। বিনোদনের কি আইটেম আপনার চাই? হাতের কাছে রিমোট কন্ট্রোল মেশিন আছে। বোতাম টিপতে থাকুন একটার পর একটা। পশ্চিমাদের বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে সংস্কৃতি নামের বিভিন্ন অপসংস্কৃতি তৈরি করে বিশ্বময় রপ্তানি করছে, কেউ কেউ আমদানিও করছেন। যত অশ্লীলতা আছে, কুৎসিতদের জন্য কুৎসিত বিনোদন আছে সবই সরবরাহ করছে সিডিতে বন্দি করেও। ভারত ও পশ্চিমাদের ফ্যাক্টরিগুলোতে আকাশ সংস্কৃতি বিভিন্ন আইটেম তৈরি করে।
গত শতাব্দীর আশির দশকে বিভিন্ন কারণে লাতিন আমেরিকার প্রত্যেক দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল, কিন্তু তাদের কাছে সংস্কৃতি যাচাই বাছাইয়ের যন্ত্র না থাকায় এক পর্যায়ে উত্তেজনা থেমে যায়। ঠান্ডা হয়ে যায়, এখন লাতিন আমেরিকা খুশির বন্যায় সাঁতার কাটছে। আমাদের দেশেও যখন পশ্চিমা অপসংস্কৃতির এ বন্যার গলিজ পানি ঢুকতে থাকে তখন দেখা গেল শহর বন্দরের প্রত্যেক অলিগলিতে ভিডিও ক্লাব ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে। বেশকিছু দিন ধরে পাকড়াও চললো তারপর কি যেন একটা সমঝোতা হয়ে গেল। কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই, দেশের যুবসমাজ ও কিশোর কিশোরীরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে, কিছু একটা করা দরকার। আপত্তিকর পরিবেশনায় বদঅভ্যস্ত চ্যানেলগুলো বন্ধের পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ভারতের আকাশ বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর জন্য বন্ধ অথচ ভারতীয় চ্যানেলের একটি নাটকও কখন সম্প্রচার করা হবে তা বাংলাদেশে সময়সহ প্রচারিত হয়।
আকাশ সংস্কৃতি আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটাচ্ছে কীভাবে ব্যাখ্যার বোধ হয় কোনো প্রয়োজন নেই। নগ্নতা নগ্নতা ছাড়া তো তাদের কাছে কিছুই নেই। এই দুয়ের প্রমাণ যে যতো ঘটাচ্ছে সে ততো বেশি আকাশের বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে। অপসংস্কৃতির প্লাবনের মধ্যেও কোনো কোনো মুসলিম দেশ সেন্সর করে আকাশের এ সওদা প্রত্যাখ্যান করার সাহস দেখিয়েছে। কারণ প্রত্যেক দেশের কাছে এই আর্ন্তজাতিক নেটওয়ার্কের লোকাল কন্ট্রোলিং ব্যবস্থা আছে। যা আপত্তিকর বলে মনে করা হবে তা প্রদর্শন না করার হুকুম শক্তভাবে দেয়া যায়। ইরান ও সউদী আরব পারছে। আমরা কেন পারবো না?
নগ্নতা বিরুদ্ধে একটা ঘৃণাবোধ সৃষ্টির জাতীয় আন্দোলন অপরিহার্য। তরুণ সমাজের মধ্যে এই জাগরণ যদি আসে তাহলে আন্দোলন সফল হয়। নৈতিকতাবোধ শক্তি, শিক্ষা ও অনুশীলন ছাড়া এই ভাইরাস বন্ধ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এই ভাইরাস প্রতিরোধে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সেটা হলো এই অপসংস্কৃতির কেউ মনে প্রাণে পছন্দ করে না। আল্লাহর রাসূলের না পছন্দের আর পছন্দের দিকটি যত বেশি প্রচারে আসবে শিক্ষায় আসবে আমলে অনুশীলনে আসবে এই আসমানী বালা-মুসিবত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা হবে, নতুবা পরিত্রাণ নেই। হ্যা, আশার কথা, খুব দুর্বল হলেও বিপরীত একটা স্রোত একটা হাওয়া সৃষ্টির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আশা শুধু এই আমাদের ঈমানের তেজই আমাদের হেফাজত করতে পারে।
বর্তমানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে স্যাটেলাইট তথা ইলেকট্রনিক মিডিয়া আজকের আধুনিক সভ্যতার যুগে অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার দাবিদার। তবে এটা নির্ভর করে মূলত প্রত্যেক দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সুষ্ঠু দর্শন তথা সাচ্চা জাতীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে মিডিয়ার সদ্ব্যবহারের ওপর। আজ এই মিডিয়ার বদৌলতে পৃথিবীর পরিধি এখন ক্ষুদ্র হয়ে এসেছে। এটা জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নয়নের একটি প্রধান হাতিয়ার স্বরূপ।
তবে একথা সত্য যে এই ইতিবাচক দিকগুলো তখন উদ্ভাসিত হয়, যখন কিনা মিডিয়াগুলো মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে অপসংস্কৃতির প্রচার ঘটলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নেতিবাচক দিকটা উদ্ভাসিত হতে থাকবে এবং মানুষও সেই সঙ্গে তার নৈতিক আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতির গৌরবোজ্জ্বল অহংকারকে ধূলোয় মিশিয়ে অপসংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরবে। ফলে দেখা যাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কারণে একটি জাতির ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা ধ্বংস হয়ে গেছে। ভারত ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্লাবন আমাদের এদেশে যেভাবে আকাশ সংস্কৃতির নামে প্লাবিত হচ্ছে, তাতে আমাদের দেশের জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হচ্ছে অবহেলিত। ধরছে বিলুপ্তির পথ। যার ফলে এদেশের জীবনাদর্শ তথা সামাজিক জীবনের মৌলিক ধ্যান-ধারণা ও মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে বারবার ব্যাহত।
ভারত উপমহাদেশ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসক কর্তৃক শাসনের ফলে ঔপনিবেশিক আদর্শ ও নীতিরীতি এদেশের মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে এবং তারা এদেশের সংগ্রামী মানুষের শোষণ ও শাসনের জন্য কৌশল পরিবর্তন করে স্বাধীনতার নাম দিয়ে শাসনের নামে শোষণ করতে থাকে। ফলে দিনে দিনে ইংরেজ সংস্কৃতি এদেশের মানুষের মনে শেকড় তৈরি করতে সক্ষম হয়। উপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী এদেশ ত্যাগ করলেও দিনে দিনে এদেশের শাসন ও শোষণের মূল হাতিয়ার রূপে এখন বিদ্যমান স্যাটেলাইট, ফেসবুক এর মাধ্যমে অশ্লীল নৃত্যসহ নীল ছবি প্রচার করায় এদেশের মানুষ যেমন অপসংস্কৃতির বেড়িবাঁধে বন্দি তেমনি ঐসব চ্যানেল ইন্টারনেটের প্রতিনিধিরা হচ্ছে বিজয়ী।
তারা এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে গিয়েও এদেশকে ধ্বংস করার সূক্ষ্ম মাধ্যম বেছে নিয়েছে। যা শাসন ও শোষণের চেয়েও হাজার গুণ বিষাক্ত। এরা অপসংস্কৃতি দিয়ে এসব দারিদ্র্য দেশগুলোর জাতীয় মূল্যবোধ ধ্বংস করতে সর্বদা সচেষ্ট। এ জন্যেই তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মি. জন ফস্টার ডালেস সর্বপ্রথম সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিষ্ঠানিকভাবে রূপদান করেন। তিনি তার বক্তব্যে পরোক্ষে প্রতিপাদ্য ছিলো ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দাও।’ বিশ্বে যখন আমেরিকা সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করাকে একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন জাতিকে ধ্বংস করতে সংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
বর্তমান বিশ্বে যে পরিস্থিতি চলছে তার মূলে রয়েছে বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নয়নের অপপ্রয়োগ এবং অপব্যবহার। বিশ্বে এখন সামরিক আগ্রাসনের তুলনায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো যেমন সহজ তেমনি অধিকতর কার্যকর। আর এই অপসংস্কৃতির আগ্রাসন চালানো হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বে, বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে। আরো ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে, পশ্চিমা ও হিন্দুস্তানী যৌথ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিফলিত হওয়ার বিচারে বাংলাদেশ একটি উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হতে চলেছে। মূলত ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসীরা এদেশে বেশ কিছু সেবাদাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। দিন দিন ব্যাপকভাবে সেবাদাস সৃষ্টি করতে সচেষ্ট রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে রয়েছে তাঁবেদার রাজনীতিক এবং একশ্রেণির ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক-কলামিস্ট। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য মূলত দায়ী এদেশের সুষ্ঠু মতাদর্শগত জাতীয় চরিত্রসম্পন্ন রাজনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পশচাদপদ দিক।
আকাশ সংস্কৃতি সম্পর্কে বড্ড দীর্ঘ একটা বয়ান দিয়ে ফেললাম। এবার মূল আলোচনায় ফেরা যাক। আকাশ সংস্কৃতির ছোবল থেকে ভারতের অক্টোপাস বাঁধন আমরা ছাড়তেই পারছি না। প্রতিবেশি দেশ বলে কথা! এদের উৎকট আকাশ সংস্কৃতির বিধ্বংসী ঢেউ আমাদের মানচিত্রের ভূখণ্ড ধসিয়ে দিচ্ছে। ছোটো হয়ে আসছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও মুসলিম সভ্যতার পরিধি। কুখ্যাত হিন্দুসংস্কৃতি আমাদের মুসলিম তরুণ ও যুব সম্প্রদায়ের মাথা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। ওদের কৃষ্টি-কালচার আমাদের জন্য রীতিমতো উদ্বেগ ও হতাশাজনক। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে এবং প্রবলভাবেই তা বাড়ছে। প্রতিবেশি এই বৃহৎ দেশটি কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর লাশ ঝুলিয়ে রেখে শুধু আমাদের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ও মানচিত্রের মর্যাদাই ক্ষুণ্ন করছে না, আকাশ সংস্কৃতির নগ্ন আগ্রাসনের মাধ্যমে আমাদের তরুণ ও উঠতি প্রজন্মের চিন্তার স্বাধীনতা ও পবিত্রতাও চরমভাবে ক্ষুণ্ন ও ছিনতাই করে চলেছে।
দেশ স্বাধীন হলো এদেশের মানুষের ভেজা রক্তের নজরানায়, কিন্তু ভারত নিয়ে গেলো পরাজিত ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের অত্যাধুনিক সব অস্ত্র, যার বৈধ মালিক ছিল একমাত্র মূলত বাংলাদেশ। সেই যে নেয়ার ধারাবাহিকতা শুরু হলো আজও থামল না সেই আগ্রাসন। বরং দিন দিন বাড়ছেই ভারতের ক্ষুধা ও পিপাসা। এই পিপাসায় মরুভূমি হচ্ছে বাংলাদেশ। পিপাসার্ত ভারত ফারাক্কায় বাঁধ দিলো, তিস্তার পানি চুষে নিলো, টিপাইমুখে বাঁধ দিলো, ফেনি নদীর পানি নিলো। আর সর্বশেষ হরণ করে নিচ্ছে এদেশের তরুণ প্রজন্মের মেধা ও চিন্তার স্বাধীনতা। ফলে আজ অধিকাংশ তরুণ-তরুণী ভারতীয় নগ্ন সংস্কৃতির প্রভাবে ভারতপ্রীতি নিয়ে বড় হচ্ছে এবং মনের অদৃশ্য কোণে কোনো না কোনোভাবে লালন করছে ভারতপ্রেম। একটি দেশের চূড়ান্ত সর্বনাশের জন্য এরচেয়ে বড় আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয় আর কী হতে পারে?
এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মাথা ব্যথার কারণ নয়, সারাবিশ্বের জন্যই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ। সারাবিশ্বকেই আজ ভারতীয় ললনারা তাদের উদ্বাহু নৃত্যের নোংরা ছলনায় হতবিহ্বল করে চলেছে। তারা ক্রমশ দুর্বল হতে চলেছে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি। আর প্রতিবেশি দেশ হিসেবে এর বিষাক্ত ছোবল সর্বাগ্রে পড়ছে আমাদের মুসলিম যুবসমাজের ওপর। এতে যুবসমাজের মধ্যে দেশপ্রেম, নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ভাবগাম্ভীর্য ব্যাহত হচ্ছে এবং আরো উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খলভাবে এই কাজটা করা হচ্ছে। ভারতের কিছু মুসলিম অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন, যাদেরকে ব্যবহার করে অত্যন্ত সুকৌশলে ভারতীয়রা মুসলিম প্রতিবেশি দেশগুলোতে আকাশ সংস্কৃতির মরণছোবল বিস্তার করছে।
বড্ড দুঃখ লাগে মুসলিম পরিচয় নিয়ে শাহরুখ খান সেদেশের ব্রাহ্মণ কন্যা গৌরীকে হিন্দু রীতি মোতাবেক সিঁদুর দিয়ে বিয়ে করেছেন! এটা তার ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলে কথা ছিল না। কিন্তু আকাশ সংস্কৃতির হাওয়ায় তা আমাদের সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এবং বিষবাষ্পের মতো তা মুসলিম সমাজকে বিষাক্ত করছে। এই শাহরুখ কয়েকদিন আগে তার মেয়েকে প্রেমিক খুঁজে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন! সেই সঙ্গে কেমন প্রেমিক বেছে নিতে হবে সে ছবকও মেয়েকে দিয়েছেন তিনি। তিনি মেয়ে সুহানাকে বলেছেন, যদি তুমি কারো সঙ্গে ডেটিং দিতে সিদ্ধান্ত নাও তাহলে এমন ব্যক্তিকে বেছে নিও যে আমার মতো। শাহরুখ খান টুইটারে এক পোস্টে লিখেছেন, ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমি একজন চমৎকার মানুষ। আমি যথেষ্ট শালীন, ভালোবাসাময়, শিক্ষিত ও যত্নবান। আমি আমার মেয়েকে বলবো যে, যদি তার কোনো বয়ফ্রেন্ড খুঁজে নেয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে আমার ক্ষোভকে এড়িয়ে তাকে এমন একজনকে বেছে নিতে হবে যে হবে আমার মতো।’
নিজকন্যাকে এই জঘন্য পরামর্শ দিয়ে শাহরুখ খান কতটুকু অপরাধ করেছেন, সেটা হয়ত তার কন্যার ভবিষ্যত ও ইতিহাস নিরূপণ করবে। কিন্তু এর সঙ্গে তিনি যে অপরাধটি করেছেন তা এক কথায় ক্ষমার অযোগ্য। তিনি নিজ মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর তাবত মেয়েদেরও অনুরূপ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি আমি এ কথা আমার মেয়েকে বলতে পারি তাহলে এ কথা সব মেয়েকে বলতে পারি।’
সুতরাং এটা যে আকাশ সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে অন্যদের মধ্যেও এই অশালীনতা ও জঘন্য অনাচার বিস্তারের প্রয়াস তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারতীয় আকাশ সংস্কৃতি এভাবেই গিলে খাচ্ছে আমাদের তরুণ-যুবকদের মাথা, মেধা, মননশীলতা ও ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা। এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তরুণ সমাজকে সচেতন ও সতর্ক করতে না পারলে দেশ থেকে শুধু ইসলামী আদর্শই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই নয়; দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বও ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত হয়ে পড়বে।
তবে আমরা আশাবাদী একারণে যে, দেশে এখনও অনেক সচেতন, আত্মমর্যাদা ও ইসলামী ভাবনাবোধসম্পন্ন তরুণ-যুবক আছেন। বিষয়টি বুঝা যায় ওই সংবাদের ওপর পাঠকদের মন্তব্য পাঠ করেই।
আমি আশাবাদী এভাবে বহু তরুণ-তরুণী ও যুবসম্প্রদায় ইসলামী আদর্শ ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে ভারতসহ বিশ্বের সকল আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্রমে রুখে দাঁড়াবে। কারণ, তারুণ্যের রক্তে উচ্ছৃঙ্খলার জোর যত বেশি, প্রতিরোধ, দেশপ্রেম ও স্বকীয়তাবোধের উষ্ণতা তারচেয়েও বেশি। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষ সর্বদাই নিজস্ব স্বাধীনতা-স্বকীয়তা রক্ষায় সিদ্ধহস্ত।
ইন্ডিয়ারই ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০) বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র সম্পর্কে “বাঙ্গালার ইতিহাস” বইটিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের মাটি নরম কিন্তু জায়গা কঠিন এখানে মানুষ অপেক্ষা মাটির প্রভাব অধিক।... এই স্বাতন্ত্র্যলোলুপ প্রাচ্য সমাজকে পুনঃপুনঃ আর্যাবর্তের আদিসমাজের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে টানিয়া আনিবার আয়োজনের ত্রুটি হয় নাই; কিন্তু মাটির গুণে সে আয়োজন পুনঃপুনঃ ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। যাহারা এ দেশের জনসাধারণ, তাহারা যেমন স্বতন্ত্র, সেইরূপ স্বতন্ত্রই রহিয়া গিয়াছে; বরং যাহারা তাহাদিগকে পরতন্ত্র করিয়া আর্যাচারী করিবার আয়োজনে ব্যাপৃত হইয়াছিলেন, তাহারাও নানা বিষয়ে আদিসমাজের বিধিব্যবস্থা পরিবর্তিত করিয়া, স্বতন্ত্র হইয়া উঠিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।... শাস্ত্রবচন যখন সমুদ্র-যাত্রার প্রবল প্রতিবাদ-প্রচারে সম্পূর্ণ অবসরশূন্য, তখন বাঙালি সমুদ্রপথে নানা দিকে দ্বীপোপদ্বীপে বাণিজ্যের বিজয়-বৈজয়ন্তীহস্তে প্রধাবিত।... বাঙালির আচার ব্যবহার ও শিক্ষাদীক্ষা লোকতত্ত্বের সকল স্তরেই স্বাতন্ত্রের ছায়ামূর্তি অঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছে। বাঙালিকে জানিতে হইলে, গ্রন্থকীট হইলেই, সকল তত্ত্ব জানিয়া চরিতার্থ হইবার সম্ভাবনা নাই। বাঙালিকে জানিতে হইলে, গ্রন্থ ছাড়িয়া, লোকতত্ত্বের মূল তথ্যের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হইতে হইবে।.... বঙ্গভূমি আর্যাবর্ত ও বঙ্গসমাজ আর্যসমাজ হইলেও, তাহা স্বতন্ত্র দেশ ও স্বতন্ত্র সমাজরূপে আর্যাবর্তের ও আর্যসমাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নাই।...
বহুসংখ্যক অনার্যের মধ্যে অল্পসংখ্যক আর্যবীরের পক্ষে জ্ঞানবলে, কৌশলবলে যন্ত্রবলে বা সুপরিচালিত বাহুবলে বিজয়রাজ্য সংস্থাপিত করা সম্ভব হইলেও বিজিত সমাজের ভাষা ও আচার ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে পরাভূত ও পরিবর্তিত করা সম্ভব হইতে পারে না। বরং সেরূপ ক্ষেত্রে বিজেতার পক্ষে আপন ভাষা ও আচার ব্যবহারের পূর্বতন বিশুদ্ধি রক্ষা করাই অসম্ভব হইয়া পড়ে। যে পরিমাণে নবরাজ্য সুগঠিত করিবার জন্য ভাষা ও লোক-ব্যবহারের পরিবর্তন সাধিত করিবার প্রয়োজন উপস্থিত হয়, সেই পরিমাণে পরিবর্তনের স্রোত প্রবাহিত হয়। বাঙ্গালীর লোক-ব্যবহার এই সকল পরিবর্তনের প্রভাবে ধীরে ধীরে গঠিত হইয়া উঠিয়াছে। তাহার আরম্ভ কোন্ পুরাতন যুগে, তাহার সীমানির্দেশের সম্ভাবনা নাই। আর্যাবর্তের আর্যসমাজের কেন্দ্রস্থলে তাহার মূল প্রস্রবণ নিহিত হইলেও, বাঙ্গালার সমতল ক্ষেত্রে তাহার সহিত নানা নদ-নদী সলিলসম্ভার মিলিত হইয়া তাহাকে কূলপ্লাবিনী প্রবল বন্যার ন্যায় শক্তিশালী করিয়া তুলিয়াছে।...
বঙ্গভাষা স্বতন্ত্র ভাষা। তাহার গঠন প্রণালীতে স্বাতন্ত্র্যের অভাব নাই। বাঙ্গালীর আচার ব্যবহারেও এইরূপ কত স্বাতন্ত্র লক্ষিত হয়। তাহার শিল্পের স্বাতন্ত্র সর্বত্র সুপরিচিত।...
বাঙ্গালীর আধুনিক ইতিহাসেও স্বাতন্ত্র্যের অভাব নাই। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ যে পথে গিয়াছে, বাঙ্গালী সকল বিষয়ে, সকল সময়ে সে পথ অবলম্বন করিতে সম্মত হয় নাই। আধুনিক ইতিহাসে বাঙ্গালী ভীরু এবং কাপুরুষ বলিয়া তিরস্কৃত হইলেও বাঙ্গালি স্বাতন্ত্রপ্রিয়-স্বাধীনতার উপাসক-অপরাজিত পৃথক জাতি। বাঙ্গালী কখন বৌদ্ধ হইয়াছে, কখন হিন্দু হইয়াছে, কখন হিন্দু মুসলিম বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে; কিন্তু কদাচ দীর্ঘকাল পরাধীন থাকতে সম্মত হয় নাই। পাঠান মোঘল কেহই বাঙ্গালীকে সম্পূর্ণরূপে জয় করিতে পারেন নাই; ইংরেজেরাও বাঙ্গালীকে রণক্ষেত্রে পরাভূত করিয়া, শাসনভার গ্রহণ করেন নাই। ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থান অস্ত্রবলে পরাভূত- বাঙ্গালা দেশ অস্ত্র বলে পরাভূত হয় নাই।’
সুতরাং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যে বাঙ্গালী মানুষ কখনও সার্বভৌমত্বেও পরাধীনতা মানেনি সেই বাঙ্গালী মুসলিম কারো সাংস্কৃতিক পরাধীনতাও মানবে না। অবশ্য এর জন্য চাই ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা ও অদম্য সাহস।