ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَالرُّؤْيَةُ حَقٌّ لِأَهْلِ الْجَنَّةِ بِغَيْرِ إِحَاطَةٍ وَلَا كَيْفِيَّةٍ كَمَا نَطَقَ بِهِ كِتَابُ رَبِّنَا ﴿وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ﴾ وَتَفْسِيرُهُ عَلَى مَا أَرَادَ اللَّهُ تَعَالَى وَعَلِمَهُ وَكُلُّ مَا جَاءَ فِي ذَلِكَ مِنَ الْحَدِيثِ الصَّحِيحِ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَهُوَ كَمَا قَالَ، وَمَعْنَاهُ عَلَى مَا أَرَادَ، لَا نَدْخُلُ فِي ذَلِكَ مُتَأَوِّلِينَ بِآرَائِنَا وَلَا مُتَوَهِّمِينَ بِأَهْوَائِنَا فَإِنَّهُ مَا سَلِمَ فِي دِينِهِ إِلَّا مَنْ سَلَّمَ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَلِرَسُولِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَرَدَّ عِلْمَ مَا اشْتَبَهَ عَلَيْهِ إِلَى عَالِمِهِ
আর জান্নাতীদের জন্য আল্লাহকে দেখার বিষয়টি সত্য। তবে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে নয়, তার পদ্ধতিও আমাদের অজানা। যেমনটি আমাদের রবের কিতাব ঘোষণা করেছে, وُجُوه يَوۡمَئِذٍ نَّاضِرَةٌ إِلَىٰ رَبِّهَا نَاظِرَةٌ ‘‘সেদিন অনেক মুখম-ল আনন্দোজ্জল হবে, সেগুলো তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে’’। (সূরা আল-কিয়ামাহ: ২২) এ দেখার ব্যাখ্যা হলো, একমাত্র আল্লাহ যেভাবে ইচ্ছা করেন এবং যেভাবে তিনি জানেন সেভাবেই এটি অর্জিত হবে এবং এ সম্পর্কে যা কিছু ছহীহ হাদীছে রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত হয়েছে, তা যেভাবে তিনি বলেছেন সেভাবেই গৃহীত হবে এবং তিনি যা উদ্দেশ্য করেছেন সেটিই ধর্তব্য হবে। এতে আমরা আমাদের নিজস্ব মতের উপর নির্ভর করে কোনো অপব্যাখ্যা করবো না এবং আমাদের প্রবৃত্তির প্ররোচনায় তাড়িত হয়ে কোনো অযাচিত ধারণার বশবর্তী হবো না। কারণ কোনো ব্যক্তি কেবল তখনই তার দ্বীনকে ভ্রষ্টতা ও বক্রতা থেকে নিরাপদ রাখতে পারে, যখন সে মহান আল্লাহ এবং তার রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পন করবে এবং সংশয়ের ব্যাপারসমূহকে আল্লাহর দিকেই ফিরিয়ে দিবে।
.................................................................
ব্যাখ্যা: আখেরাতে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখার মাস‘আলায় জাহমিয়া, মুতাযেলা এবং তাদের অনুসারী খারেজী ও শিয়াদের ইমামীয়া সম্প্রদায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিরোধিতা করেছে। কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীলের মাধ্যমে তাদের কথা বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত। ছাহাবী, তাবেঈ, ইসলামের সুপ্রসিদ্ধ ইমামগণ, আহলে হাদীছ এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের কালাম শাস্ত্রবিদগণও পরকালে মুমিনদের জন্য আল্লাহর দিদার সাব্যস্ত করেছেন।
এটি দ্বীনের মূলনীতি সম্পর্কিত একটি বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ মাস‘আলা। এটি অর্জনের জন্যই মুমিনগণ সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন এবং প্রতিযোগিতায় মাশগুল থাকেন। যাদেরকে কিয়ামতের দিন তাদের রবের সান্নিধ্য থেকে দূরে রাখা হবে এবং তার দরজা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে, তারাই এ নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে। মুমিনগণ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবেন। এর দলীল হিসাবে ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ সূরা কিয়ামাহএর ২২ ও ২৩ নং আয়াতের দলীল পেশ করেছেন। এটিই এ বিষয়ে সর্বাধিক সুস্পষ্ট দলীল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ
সেদিন অনেক মুখমণ্ডল আনন্দোজ্জল হবে, সেগুলো তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে।
কিন্তু যারা তাবীলের নাম দিয়ে এ আয়াতের তাহরীফ বা বিকৃতি করার পথকেই বেছে নিয়েছে, তাদের জন্য আল্লাহর সাক্ষাৎ সম্পর্কিত এ আয়াতটির তাবীল-অপব্যাখ্যা করার চেয়ে পুনরুত্থান, জান্নাত, জাহান্নাম এবং হিসাব সম্পর্কিত আয়াতগুলোর তাবীল করা অধিক সহজ। বাতিলপন্থীরা কুরআনের আয়াতগুলোর যথাযথ অর্থ পরিবর্তন করতে চাইলে সে ঐ পথেই অগ্রসর হয়, যে পথে অগ্রসর হয় এ আয়াতগুলোর তাবীলকারীগণ।
তাবীলই দ্বীন ও দুনিয়াকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইহুদী-খৃষ্টানরা এভাবেই তাওরাত ও ইঞ্জিলের আয়াতগুলো পাল্টিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাদের অনুরূপ করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু বাতিলপন্থীরা তাদের পথেই চলেছে। ভ্রান্ত তাবীল ইসলাম ও মুসলিমদের উপর সীমাহীন মসীবত টেনে এনেছে। ভ্রান্ত তাবীলের কারণেই উছমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিহত হয়েছে। জঙ্গে জামালা ও জঙ্গে সিফ্ফীনও সংঘটিত হয়েছে তাবীলের কারণেই। হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিহত হয়েছেন এ তাবীলের কারণেই। মদীনাতে হার্আর ঘটনার দিন যা কিছু ঘটেছিল, তাও তাবীলের কারণে। খারেজী, মুতাযেলা এবং রাফেযী সম্প্রদায়ের উৎপত্তিও হয়েছে তাবীল থেকেই। ভ্রান্ত তাবীলের কারণেই উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হয়েছে।
উপরোক্ত আয়াতে النظر বা তাকানোকে চেহারার দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে। চেহারাই হলো দৃষ্টির স্থান। সেই সঙ্গে إلى হরফে জার্ এর মাধ্যমে النظر কে মুতাআদ্দী করা হলে এর দ্বারা চোখের দেখা ছাড়া অন্য কিছু বুঝানো হয় না। সুতরাং النظر এখানে প্রকৃতপক্ষে চোখের দেখা অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে এমন কোনো আলামত নেই যা প্রমাণ করে যে, প্রকৃত অর্থের বিপরীত অর্থ উদ্দেশ্য। সুতরাং সুস্পষ্টভাবেই জানা গেল, আল্লাহ তা‘আলা এখানে চেহারার মধ্যকার চোখের দেখা উদ্দেশ্য করেছেন। আর চেহারাগুলো আল্লাহ তা‘আলার দিকেই তাকিয়ে থাকবে।
النظر শব্দটি সরাসরি কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে মুতাআদ্দী হওয়ার দিক থেকে কয়েকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি যদি নিজে নিজেই মুতাআদ্দী হয়, তাহলে এর অর্থ হয় অপেক্ষা করা। কিয়ামতের দিন মুনাফেক পুরুষ ও মুনাফেক নারীরা মুমিনদেরকে বলবে,
انظُرُونَا نَقْتَبِسْ مِن نُّورِكُمْ
‘‘আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা করো যাতে তোমাদের নূর থেকে আমরা কিছু উপকৃত হতে পারি’’। (সূরা হাদীদ: ১৩)
في হরফে জারের মাধ্যমে মুতাআদ্দী হলে তার অর্থ হয়, চিন্তা-গবেষণা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَوَلَمْ يَنظُرُوا فِي مَلَكُوتِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا خَلَقَ اللَّهُ مِن شَيْءٍ
‘‘তারা কি কখনো আকাশ ও পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তা করেনি এবং আল্লাহর সৃষ্ট কোন জিনিসের দিকে চোখ মেলে তাকায়নি?’’ (সূরা আরাফ: ১৮৫) আর যদি إلى হারফে জারের মাধ্যমে মুতাআদ্দী হয়, তাহলে অর্থ হয় চোখ দিয়ে দেখা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
انظُرُوا إِلَىٰ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَيَنْعِهِ إِنَّ فِي ذَٰلِكُمْ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
‘‘গাছ যখন ফলবান হয় তখন এর ফল ধরা ও ফল পাকার অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দাও। এসব জিনিসের মধ্যে ঈমানদারদের জন্য নিদর্শন রয়েছে’’। (সূরা আন‘আম ৬:৯৯)
সুতরাং চোখের স্থান চেহারার দিকে যখন النظر কে সম্বন্ধ করা হবে, তখন তার দ্বারা চোখের দেখা উদ্দেশ্য হবে না কেন?
ইবনে মারদুওয়াই স্বীয় সনদের আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ ‘‘সেদিন অনেক মুখণ্ডল আনন্দোজ্জ্বল হবে’’। উজ্জ্বলতা ও সৌন্দর্যের কারণে চকচক করবে। সেগুলো তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে’’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ ‘‘সেগুলো তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে’’। অর্থাৎ فِي وَجْهِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ তারা আল্লাহ তা‘আলার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকবে।[1]
হাসান বসরী রহিমাহুল্লাহ বলেন, তারা তাদের রবের দিকে তাকাবে। এতে করে তাদের রবের নূরে তাদের চেহারাও উজ্জ্বল হবে।
আবু সালেহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে﴿إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ﴾ ‘‘সেগুলো তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে’’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, তারা তাদের রবের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকবে।
ইকরিমা আয়াত দু’টির ব্যাখ্যায় বলেন, সেদিন নেয়ামত পেয়ে অনেক চেহারা উজ্জ্বল হবে এবং তারা তাদের রবের দিকে যথাযথভাবেই তাকিয়ে থাকবে।
ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকেও অনুরূপ ব্যাখ্যা এসেছে। এটিই আহলে সুন্নাত এবং মুফাসসিরে কেরামদের অভিমত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَهُم مَّا يَشَاءُونَ فِيهَا وَلَدَيْنَا مَزِيدٌ ‘‘সেখানে তাদের জন্য যা চাইবে তাই থাকবে। আর আমার কাছে আরো কিছু অতিরিক্ত জিনিসও থাকবে’’ (সূরা ক্বফ: ৩৫)
ইমাম তাবারী বলেন, আলী ইবনে আবু তালেব এবং আনাস বিন মালেক এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এখানে অতিরিক্ত জিনিস বলতে আল্লাহ তা‘আলার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, للَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ ‘‘যারা সৎকর্ম সম্পাদন করেছে, তাদের জন্য রয়েছে উত্তম বস্তু এবং আরো অতিরিক্ত জিনিস’’। (সূরা ইউনুস: ২৬) এখানে হুসনা বলতে জান্নাত উদ্দেশ্য এবং যিয়াদাহ বলতে আল্লাহ তা‘আলার সম্মানিত চেহারার দিকে তাকানো উদ্দেশ্য। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং পরবর্তীতে তার ছাহাবীগণ থেকে এ ব্যাখ্যাই এসেছে।
যেমন ছহীহ মুসলিম সুহাইব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করলেন,
للَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ
‘‘যারা সৎকর্ম সম্পাদন করেছে, তাদের জন্য রয়েছে উত্তম বস্তু এবং আরো অতিরিক্ত জিনিস’’ (সূরা ইউনুস: ২৬)। অতঃপর বললেন, জান্নাতবাসীগণ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং জাহান্নামীগণ যখন জাহান্নামে প্রবেশ করবে, তখন একজন ঘোষক এ বলে ঘোষণা করবে, হে জান্নাতবাসীগণ! তোমাদের সাথে আল্লাহ তা‘আলার একটি ওয়াদা রয়েছে। তিনি তা পূরণ করতে চাচ্ছেন। জান্নাতবাসীগণ বলবেন, তা কী? আল্লাহ তা‘আলা কি আমাদের মীযানের পাল্লা ভাড়ি করেননি? আমাদের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল করেননি? আমাদেরকে কি জান্নাতে প্রবেশ করাননি এবং জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ দেননি? অতঃপর পর্দা উঠানো হবে। তারা তখন আল্লাহর দিকে তাকাবে। আল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকার চেয়ে অধিক প্রিয় তাদেরকে আর কিছুই দেয়া হবে না। এটিই হলো কুরআনে তাদের জন্য ওয়াদাকৃত অতিরিক্ত জিনিস। ইমাম মুসলিম ছাড়াও অন্যরা বিভিন্ন সনদে ও বিভিন্ন শব্দে এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। এ হাদীছগুলোতে যে الزيادة শব্দটি এসেছে, তার অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা। ছাহাবীগণ এ ব্যাখ্যাই করেছেন। ইমাম ইবনে জারীর একদল ছাহাবী থেকে এ ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হুযায়ফা, আবু মুসা আশআরী এবং ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
كَلَّا إِنَّهُمْ عَن رَّبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّمَحْجُوبُونَ
‘‘কখনো নয়, নিশ্চিয়ই সেদিন তাদের রবের দর্শন থেকে বঞ্চিত রাখা হবে’’। (সূরা মুতাফফিফীন: ১৫)
এ আয়াত দ্বারা ইমাম শাফেঈ এবং অন্যরা দলীল গ্রহণ করেছেন যে, কাফেরদেরকে যেহেতু আল্লাহর সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত রাখার কথা বলা হয়েছে, তাই বুঝা গেল যে, তা কেবল মুমিনদের জন্য সাব্যস্ত। ইমাম ইবনে জারীর তাবারী ইমাম শাফেঈর ছাত্র মুযানী থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আবু আব্দুল্লাহ আলহাকেম বলেন, আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন আসাম, তিনি বলেন, আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন রুবাই ইবনে সুলায়মান, তিনি বলেন, আমি মুহাম্মাদ বিন ইদরীস শাফেঈর কাছে উপস্থিত ছিলাম, তখন মিশরের গ্রামাঞ্চল থেকে তার নিকট একটি পত্র আসল। তাতে ইমামকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী
كَلَّا إِنَّهُمْ عَن رَّبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّمَحْجُوبُونَ
‘‘কখনো নয়, নিশ্চিয়ই সেদিন তাদের রবের দর্শন থেকে বঞ্চিত রাখা হবে’’ (সূরা মুতাফফিফীন: ১৫) সম্পর্কে আপনি কী বলেন? জবাবে তিনি বললেন, তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তা‘আলা তার দিদার হতে তাদেরকে বঞ্চিত করার মধ্যে দলীল পাওয়া যায় যে, তার অলীগণ সন্তুষ্ট অবস্থায় তাকে দেখতে পাবেন।
মুতাযেলা এবং আল্লাহর দিদার অস্বীকারকারী অন্যান্য সম্প্রদায় দলীল হিসাবে আল্লাহর বাণী: لَنْ تَرَانِي ‘‘তুমি আমাকে কখনই দেখতে পাবে না’’ (সূরা আরাফ : ১৪৩)- এবং আল্লাহর বাণী, لَّا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ ‘‘দৃষ্টিশক্তি তাকে আয়ত্ত করতে পারে না। কিন্তু তিনি দৃষ্টিকে আয়ত্ত করে নেন’’ (সূরা আন‘আম : ১০৩)-এ আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছে। অথচ আয়াত দু’টি তাদের কথার পক্ষের দলীল নয়; বরং তাদের কথার বিপক্ষের দলীল।
প্রথম আয়াত দ্বারা একাধিক পদ্ধতিতেই আল্লাহর দিদার সাব্যস্ত করা যায়।
(১) আল্লাহর সম্মানিত রসূল মুসা কালীমুল্লাহ সম্পর্কে এ ধারণা করা অসম্ভব যে, তিনি আল্লাহর কাছে এমন জিনিস প্রার্থনা করবেন, যা তার জন্য অবৈধ। কেননা তিনি ছিলেন আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে সে যামানার সর্বাধিক জ্ঞানী। মুতাযেলাদের নিকট এ ধরনের প্রশ্ন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
(২) আল্লাহ তা‘আলা তার সাক্ষাৎ প্রার্থনার ক্ষেত্রে মুসা আলাইহিস সালামের প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু নূহ আলাইহিস সাল্লাম যখন আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার পুত্রের মুক্তির-নাজাতের ব্যাপারে প্রার্থনা করলেন, তখন তিনি নূহ আলাইহিস সালামের প্রতিবাদ করেছেন এবং বলেছেন,
إِنِّي أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ
‘‘আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, নিজেকে অজ্ঞদের মতো বানিয়ে ফেলো না’’। (সূরা হুদ: ৪৬)
(৩) আল্লাহ বলেছেন, لَنْ تَرَانِي ‘‘তুমি আমাকে কখনই দেখতে পাবে না’’। তিনি এ কথা বলেননি যে, আমাকে দেখা সম্ভব নয় অথবা এটি বলেননি যে, আমাকে দেখা বৈধ নয় কিংবা বলেননি যে, আমাকে দেখা যায় না। উভয় প্রকার জবাবের মধ্যে পার্থক্য অতি সুস্পষ্ট। আপনি কি লক্ষ্য করেন না, কারো জামার আস্তিনে পাথর থাকলে কেউ যদি তাকে খাবার মনে করে এবং বলে আমাকে তা থেকে খাবার দাও, তখন সঠিক জবাব হলো এগুলো খাওয়া যায় না। কিন্তু যদি সেগুলো আসলেই খাদ্য-দ্রব্য হয়ে থাকে তাহলে এ কথা বলা জায়েয আছে যে, إنك لن تأكله ‘‘তুমি তা খেতে পারবে না’’। এতে প্রমাণ মিলে যে, আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা যাবে। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে মুসার শক্তি তার দিদার বরদাশত করতে সক্ষম নয়। কেননা দুনিয়ার জীবনে মানুষের শক্তি কম থাকার কারণে আল্লাহর দিদার বরদাশত করতে অক্ষম।[1]
(৪) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَٰكِنِ انظُرْ إِلَى الْجَبَلِ فَإِنِ اسْتَقَرَّ مَكَانَهُ فَسَوْفَ تَرَانِي فَلَمَّا تَجَلَّىٰ رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكًّا وَخَرَّ مُوسَىٰ صَعِقًا
‘‘তবে পাহাড়ের দিকে তাকাও। পাহাড়টি যদি নিজের জায়গায় স্থির থাকতে পারে তাহলে অবশ্যই তুমি আমাকে দেখতে পাবে। তার রব যখন পাহাড়ে জ্যোতি প্রকাশ করলেন তখন তা তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল এবং মূসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। (সূরা আরাফ: ১৪৩)
আল্লাহ তা‘আলা মুসাকে জানিয়ে দিলেন যে, পাহাড় অত্যন্ত মজবুত ও শক্ত হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়াতে আল্লাহর জ্যোতি বরদাশত করতে পারে না। তাহলে যে মানুষকে অত্যন্ত দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে সে ইহ জগতে আল্লাহর দিদার বরদাশত করবে কিভাবে?
(৫) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পাহাড়কে ঠিক রাখতে সক্ষম। তার জন্য এটি মোটেই অসম্ভব নয়। আল্লাহর দিদারকে পাহাড় স্থির থাকার সাথে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, পাহাড় যদি স্বীয় স্থানে স্থির থাকে, তাহলে তুমি অবশ্যই আমাকে দেখতে পাবে।
আল্লাহকে দেখা যদি অসম্ভব হতো, তাহলে আল্লাহর কথাটি এরূপ হতো, إِنِ اسْتَقَرَّ الْجَبَلُ فَسَوْفَ آكُلُ وَأَشْرَبُ وَأَنَامُ ‘‘অর্থাৎ পাহাড় স্থির থাকে, তাহলে অচিরেই আমি খাবো, পান করবো এবং ঘুমাবো। সুতরাং আমার জন্য যেমন খাওয়া, পান করা ও ঘুমানো সম্ভব নয়, তাই পাহাড় স্থির থাকাও অসম্ভব। এক কথায় পাহাড় স্থির থাকা সম্ভব এবং আল্লাহ তা‘আলাকে দেখাও সম্ভব। মুতাযেলাদের মতে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা বৈধ হওয়া তার জন্য পানাহার গ্রহণকরা বৈধ হওয়ার মতই।
(৬) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلَمَّا تَجَلَّىٰ رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكًّا ‘‘তার রব যখন পাহাড়ে জ্যোতি প্রকাশ করলেন তখন তা তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল’’ (সূরা আরাফ :১৪৩)।
পাহাড়ের জন্য যখন আল্লাহর নূর ছাড়া বৈধ হলো, অথচ পাহাড় হলো জড়বস্তু, তার কোনো শাস্তি বা পুরস্কার নেই, তখন সম্মানের ঘর জান্নাতে তার রসূল ও অলীদের জন্য কিভাবে তা অসম্ভব হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এখানে মুসাকে জানিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, ইহ জগতে পাহাড় যেহেতু আল্লাহর দিদারের জন্য টিকে থাকতে পারেনি, তাই মানুষ পাহাড়ের চেয়ে অধিক দুর্বল বিধায় তার পক্ষে টিকে থাকা মোটেও সম্ভব নয়।
(৭) আল্লাহ তা‘আলা মুসার সাথে কথা বলেছেন, তাকে ডাক দিয়েছেন এবং চুপিসারে বাক্যালাপ করেছেন। যার জন্য বিনা মাধ্যমে কথা বলা জায়েয এবং যার সম্বোধন অন্যকে শুনানো বৈধ তাকে দেখা আরো উত্তমভাবেই বৈধ হবে। এ জন্যই আল্লাহর কথা বলা বিশেষণকে অস্বীকার না করলে, তার দিদার অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আর তারা উভয়টিকেই অস্বীকার করেছে।
তারা দাবি করে থাকে যে, لن تراني এর মধ্যকার لن অব্যয়টি تأبيد النفي অর্থাৎ চিরস্থায়ী নাকোচ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, আখেরাতেও আল্লাহর দিদারকে নফী বা নাকোচ করা হয়েছে। তাদের এ কথা সম্পূর্ণ ভুল। কেননা যদি ধরেও নেয়া হয় যে, لن অব্যয়টি চিরস্থায়ী নফী বা নাকোচ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, তথাপিও যেহেতু এটি দ্বারা আখেরাতে আল্লাহর দিদারের নফী বা নাকোচ বুঝা যায় না, তাহলে তাবীদসহ নফী না করা হলে তো আরো উত্তমভাবেই চিরস্থায়ী নফী করা হবে না।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারার ৯৫ নং আয়াতে বলেন, وَلَن يَتَمَنَّوْهُ أَبَدًا ‘‘তারা কখনোই মৃত্যু কামনা করবে না’’। অথচ জাহান্নামীরা যে আখেরাতে মৃত্যু কামনা করবে, আল্লাহ তা‘আলা তা উল্লেখ করে বলেন,
وَنَادَوْا يَا مَالِكُ لِيَقْضِ عَلَيْنَا رَبُّكَ قَالَ إِنَّكُم مَّاكِثُونَ
‘‘তারা চিৎকার করে বলবে হে মালেক! তোমার রব যেন আমাদেরকে একেবারে ধ্বংস করে দেন। তিনি জবাবে বলবেন, তোমাদের এভাবেই থাকতে হবে’’। (সূরা যুখরুফ: ৭৭)
সুতরাং لن যদি চিরস্থায়ী নফী অর্থে ব্যবহৃত হতো, তাহলে তার পরে এমন ফেল বা ক্রিয়া আসতো না, যা দ্বারা ব্যতিক্রম বুঝা যায়। অথচ কুরআনে لَنْ দ্বারা চিরস্থায়ী নফীর ব্যতিক্রম অর্থও বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইউসুফের ৮০ নং আয়াতে বলেন,
فَلَنْ أَبْرَحَ الْأَرْضَ حَتَّىٰ يَأْذَنَ لِي أَبِي
‘‘আমি তো এখান থেকে কখনোই যাবো না যে পর্যন্ত না আমার বাপ আমাকে অনুমতি দেন’’। এতে প্রমাণিত হলো যে, لن দ্বারা চিরস্থায়ী নাকচ করা হয় না। নাহুশাস্ত্রের অন্যতম ইমাম ইবনে মালেক রহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَمَنْ رَأَى النَّفْيَ بِلَنْ مُؤَبَّدًا ... فَقَوْلُهُ ارْدُدْ وَسِوَاهُ فَاعْضُدَا
‘‘যে ব্যক্তি মনে করবে, لن দ্বারা চিরস্থায়ী নফী করা হয়, তার কথা প্রত্যাখ্যান করো এবং তার কথার বিপরীত অর্থকেই শক্তিশালী করো’’। আল্লাহর বাণী:
لَّا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ
‘‘দৃষ্টিশক্তি তাকে আয়ত্ত করতে পারে না। কিন্তু তিনি দৃষ্টিকে আয়ত্ত করে নেন’’ (সূরা আনআম:১০৩)
এ আয়াত দ্বারাও অতি সুক্ষ্ণ ও সুন্দরভাবে আল্লাহর দিদার সাব্যস্ত হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলার প্রংশসা প্রসঙ্গে উপরোক্ত কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটি জানা কথা যে, প্রংশসা কেবল উত্তম গুণাবলী সাব্যস্ত করার মাধ্যমে হয়ে থাকে। কারো মধ্যে কোনো নিকৃষ্ট স্বভাব না থাকা তার পূর্ণতা বুঝায় না। সুতরাং কোনো সিফাত নাকোচ করার মাধ্যমে প্রশংসা হয় না।[2]
আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা হয়ে থাকে এমন নাকচ করার মাধ্যমে, যাতে উত্তম গুণাবলীও সাব্যস্ত হয়। যেমন তন্দ্রা ও নিদ্রা নফী করার মাধ্যমে সাব্যস্ত করা হয়েছে। কেননা তা নাকচ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ চিরন্তনতা ও অবিনশ্বরতা সাব্যস্ত হয়। আর তার থেকে মৃত্যু নফী বা নাকোচ করার মাধ্যমে তার পরিপূর্ণ হায়াত বা জীবন সাব্যস্ত হয়। ক্লান্তি-ক্লেশ দূর করার মাধ্যমে তার জন্য পূর্ণ ক্ষমতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা থেকে শরীক, সঙ্গিনী, সন্তান ও সাহায্যকারী নাকোচ করার মাধ্যমে তার জন্য পরিপূর্ণ রুবুবীয়াত, উলুহীয়াত ও পরাক্রমশালীতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। তার থেকে পানাহার নফী করার মাধ্যমে তার জন্য পরিপূর্ণ অমূখাপেক্ষীতা ও ধনাঢ্যতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। বিনা অনুমতিতে কেউ তার নিকট সুপারিশ করতে পারবে না, -এ কথা বলার মাধ্যমে তার পরিপূর্ণ তাওহীদ এবং সৃষ্টি থেকে তার পরিপূর্ণ অমূখাপেক্ষীতা বুঝানো হয়েছে। তার থেকে যুলুম নফী করার মাধ্যমে তার জন্য পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার সাব্যস্ত করা হয়েছে, ভুলে যাওয়া, গাফেল হওয়া ইত্যাদি নাকোচ করার মাধ্যমে তার জন্য পরিপূর্ণ ইলম ও সকল জিনিসকে জ্ঞানের মাধ্যমে পরিবেষ্টন করে রাখার বিষয়টি সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তার সদৃশ নাকোচ করার মাধ্যমে তার সত্তা ও সিফাতের কামালিয়াত সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ জন্যই শুধু এমন নাকোচের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা নিজের প্রশংসা করেননি, যা পূর্ণতার গুণাবলীকে আবশ্যক করে না। কেননা অস্তিত্বহীন সিফাতের মাধ্যমে কোনো জিনিসকে বিশেষিত করা যায়না।
সুতরাং যার অস্তিত্ব পরিপূর্ণ তাকে কিভাবে অস্তিত্বহীন বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত করা যেতে পারে? অস্তিত্বহীন বিশেষণ কেবল অস্তিত্বহীন জিনিসের জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে। বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্বই নেই। কোনো কামেল বা পূর্ণ জিনিসকে এমন বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত করা যাবে না, যাতে করে তা এবং অস্তিত্বহীন জিনিস একই রকম হয়ে যায়।
আসল অর্থ হলো, আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা যাবে, তবে তাকে পরিপূর্ণ রূপে আয়ত্ত ও বেষ্টন করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
لَّا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ ‘‘দৃষ্টিশক্তি তাকে আয়ত্ত করতে পারে না’’ (সূরা আনআম:১০৩), এটি আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ বড়ত্বের প্রমাণ। তিনি সবকিছু থেকে বড় ও মহান। তার পরিপূর্ণ বড়ত্বের কারণেই কেউ তাকে পূর্ণরূপে আয়ত্ত করতে পারে না। কেননা الإدراك অর্থ হলো কোনো জিনিসকে সকল দিক থেকে পূর্ণরূপে আয়ত্ত ও পরিবেষ্টন করা। এটি শুধু দেখা নয়; বরং তার চেয়েও বেশী অর্থ বহন করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَلَمَّا تَرَاءَى الْجَمْعَانِ قَالَ أَصْحَابُ مُوسَىٰ إِنَّا لَمُدْرَكُونَ قَالَ كَلَّا إِنَّ مَعِيَ رَبِّي سَيَهْدِينِ
‘‘দু’দল যখন পরস্পরকে দেখতে পেলো তখন মূসার সাথীরা চিৎকার করে উঠলো, আমরা তো পাকড়াও হয়ে গেলাম। মূসা বললেন, কখনো না, আমার সাথে আছেন আমার রব, তিনি নিশ্চয়ই আমাকে পথ দেখাবেন’’। (সূরা শুআরা: ৬২)।
এখানে মুসা আলাইহিস সালাম দেখা নাকোচ করেননি। পরিপূর্ণরূপে তাদেরকে আক্রমণ, ঘেরাও এবং পাকড়াওকে নফী বা নাকোচ করেছেন। দেখা ও বেষ্টন করা উভয়টিই একসঙ্গে অর্জিত হয়। পরিবেষ্টন করা ব্যতীতও দেখা সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা যাবে, কিন্তু পরিবেষ্টন করা অসম্ভব। যেমন আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় অর্জন করা সম্ভব, কিন্তু ইলমের মাধ্যমে তাকে পরিবেষ্টন করা সম্ভব নয়। ছাহাবী এবং ইমামগণ আয়াত থেকে এ অর্থই বুঝেছেন। যেমন তাদের কথাগুলো এ আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর সৃষ্টি এ সূর্যকে মানুষ দেখে, কিন্তু এটি যে অবস্থায় রয়েছে হুবহু সে অবস্থায় দর্শকের পক্ষে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার ছাহাবীদের থেকে আল্লাহর দিদার সম্পর্কিত হাদীছগুলো মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। ছহীহ, মুসনাদ এবং সুনান গ্রন্থকারগণ এ হাদীছগুলো বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
أَنَّ ناسا قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ نَرَى رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَلْ تُضَارُّونَ فِي الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ قَالُوا لَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ فَهَلْ تُضَارُّونَ فِي الشَّمْسِ لَيْسَ دُونَهَا سَحَابٌ قَالُوا لَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ فَإِنَّكُمْ تَرَوْنَهُ كَذَلِكَ
‘‘একদল লোক বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমরা কি কিয়ামতের দিন আমাদের প্রভুকে দেখতে পাবো? নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, পূর্ণিমার রাত্রিতে চন্দ্রকে দেখতে কি তোমাদের কোন অসুবিধা হয়? তারা বলল, না কোন অসুবিধা হয় না। তিনি আবার বললেন, আকাশে মেঘ না থাকলে সূর্য দেখতে তোমাদের কোন অসুবিধা হয় কি? তারা বলল, না কোন অসুবিধা হয় না। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা কিয়ামতের দিন এরকম পরিষ্কারভাবেই আল্লাহকে দেখতে পাবে’’।[3] হাদীছটি ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ মর্মে আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছটিও ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে। জারীর বিন আব্দুল্লাহ আলবাজালী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছটিও অনুরূপ। তিনি বলেন,
«كُنَّا جُلُوسًا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فنَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةَ اأربع عشرة فَقَالَ أَمَا إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ عيانا كَمَا تَرَوْنَ هَذَا لَا تُضَامُّونَ فِي رُؤْيَتِهِ»
‘‘একদা পুর্ণিমার রাত্রিতে আমরা রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে বসা ছিলাম। তিনি পূর্ণিমার রাতে চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আমাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা অচিরেই স্বচক্ষে তোমাদের রবকে দেখতে পাবে। যেমন কোনো রকম অসুবিধা ছাড়াই এ চন্দ্রটিকে দেখতে পাচ্ছ’’।[4] ইতিপূর্বে সুহাইবের হাদীছটিও অতিক্রান্ত হয়েছে। ইমাম মুসলিম এবং অন্যান্য ইমামগণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
আবু মুসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«جَنَّتَانِ مِنْ فِضَّةٍ آنِيَتُهُمَا وَمَا فِيهِمَا، وَجَنَّتَانِ مِنْ ذَهَبٍ آنِيَتُهُمَا وَمَا فِيهِمَا، وَمَا بَيْنَ الْقَوْمِ وَبَيْنَ أَنْ يَنْظُرُوا إِلَى رَبِّهِمْ إِلاَّ رِدَاءُ الْكِبْرِ عَلَى وَجْهِهِ فِي جَنَّةِ عَدْنٍ»
‘‘দু’টি জান্নাত হবে রৌপ্যের তৈরী। তার সমস্ত থালা-বাসন এবং অন্যান্য বস্তুও হবে রৌপ্যের। আর দু’টি জান্নাত হবে স্বর্ণের। তার সমস্ত থালা-বাসন এবং অন্যান্য বস্তু হবে স্বর্ণের। জান্নাতে আদনের মধ্যে তাদের এবং তাদের প্রভুর মাঝে গৌরব ও অহঙ্কারের একটি চাদর ব্যতীত অন্য কোন ব্যবধান থাকবে না, যা আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র চেহারার উপর থাকবে।[5] ইমাম বুখারী ও মুসলিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
আদী বিন হাতিমের হাদীছে এসেছে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«وَلَيَلْقَيَنَّ اللَّهَ أَحَدُكُمْ يَوْمَ يَلْقَاهُ، وَلَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُ حِجَابٌ وَلَا تَرْجُمَانٌ يُتَرْجِمُ لَهُ، فَلَيَقُولَنَّ: أَلَمْ أَبْعَثْ إِلَيْكَ رَسُولًا فَيُبَلِّغَكَ؟ فَيَقُولُ: بَلَى يَا رَبِّ، فَيَقُولُ: أَلَمْ أُعْطِكَ مَالًا وَأُفْضِلْ عَلَيْكَ؟ فَيَقُولُ، بَلَى يَا رَبِّ»
‘‘কিয়ামতের দিন তোমাদের কেউ যখন আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন আল্লাহর মাঝে এবং তার মাঝে কোনো পর্দা থাকবেনা এবং বান্দার কথা আল্লাহকে অনুবাদ করে বুঝানোর জন্য কোনো দোভাষীরও প্রয়োজন পড়বেনা। আল্লাহ তা‘আলা তখন বলবেন, আমি কি তোমার কাছে রসূল পাঠাইনি, যিনি তোমার কাছে আমার দ্বীন পৌঁছিয়ে দিয়েছেন? বান্দা তখন বলবে, হ্যাঁ, হে আমার রব! আল্লাহ তা‘আলা আবারো বলবেন, আমি কি তোমাকে সম্পদ দান করিনি এবং তোমার উপর অনুগ্রহ করিনি? বান্দা বলবে, হ্যাঁ, হে আমার রব! ইমাম বুখারী (৩৫৯৫) তার ছহীতে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
প্রায় ত্রিশজন ছাহাবী আল্লাহর দিদার সম্পর্কিত হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। যে ব্যক্তি ভালোভাবে হাদীছগুলো বুঝতে সক্ষম হবে, সে জোর দিয়েই বলবে যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উহা বলেছেন।[6] আমি যদি কিতাবটি সংক্ষিপ্ত আকারে লিখার ইচ্ছা না করতাম, তাহলে এ ব্যাপারে সকল হাদীছই উল্লেখ করতাম।
যে ব্যক্তি হাদীছগুলো সম্পর্কে অবগত হতে চায়, সে যেন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছগুলো পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়। কেননা সেখানে আল্লাহর দিদার সাব্যস্ত হওয়ার সাথে সাথে আরো সাব্যস্ত হয় যে, তিনি যখন ইচ্ছা, যার সাথে ইচ্ছা কথা বলবেন। আর আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে বিচার-ফায়ছালা করার জন্য আগমন করবেন। একই সঙ্গে হাদীছগুলো প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা রয়েছেন সকল সৃষ্টির উপরে। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন এমন আওয়াজের মাধ্যমে সৃষ্টিকে ডাক দিবেন, যা নিকটের ও দূরের সকলেই শ্রবণ করবে, তিনি সৃষ্টির সামনে প্রকাশিত হবেন এবং তিনি হাসবেন। এমনি আরো যেসব সিফাত রয়েছে, যা জাহমিয়াদের জন্য বজ্রপাতের মত।
[2]. অর্থাৎ আপনি যদি কারো প্রশংসা করতে গিয়ে তার থেকে নিকৃষ্ট স্বভাবগুলো নাকোচ করতে থাকেন এবং বলতে থাকেন, আপনি চোর নন, ডাকাত নন, মিথ্যাবাদী নন, কৃপণ নন....তাহলে কখনোই সে আপনার উপর সন্তুষ্ট হবে না; বরং আপনার উপর ক্রোধান্বিত হবে ও প্রতিবাদ করবে। প্রশংসা কেবল সুকুমার বৃত্তিগুলো বর্ণনা করার মাধ্যমেই হতে পারে। তবে যে নাকোচের সাথে ইছবাত-সাব্যস্তও অন্তর্ভুক্ত থাকে, তার কথা ভিন্ন।
[3]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, ছহীহ বুখারী ৪৮৫১, ছহীহ মুসলিম ১৮২।
[4]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, ছহীহ বুখারী ৮০৬, ছহীহ মুসলিম ৬৩৩।
[5]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, ছহীহ বুখারী ৪৮৭৮, ছহীহ মুসলিম ১৮০।
[6]. মুমিনগণ আল্লাহকে দেখবে, এ মর্মে আলেমদের ইজমা সংঘটিত হয়েছে।
কুরআন ও সুন্নাহর তরীকা বাদ দিয়ে দ্বীনের মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার অন্য কোনো তরীকা আছে কি? রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার ছাহাবীদের ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে কিভাবেই আল্লাহর কিতাবের ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? অথচ কুরআন ছাহাবীদের ভাষাতেই নাযিল হয়েছে। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَالَ فِي الْقُرْآنِ بِرَأْيِهِ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ»
‘‘যে ব্যক্তি নিজের মত দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা করলো, সে নিজের ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিল’’।[7] অন্য বর্ণনায় এসেছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَالَ فِي الْقُرْآنِ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ»
‘‘যে ব্যক্তি ইলম ছাড়াই কুরআনের তাফসীর করলো, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়’’।[8]
আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী, وَفَاكِهَةً وَأَبًّا ‘‘নানা জাতের ফল ও ঘাস’’। (সূরা আবাসা: ৩১) অর্থাৎ তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘আবব’ কাকে বলা হয়? জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে না জেনে কথা বললে, কোন্ আকাশ আমাকে ছায়া দিবে? কোন্ যমীন আমাকে আশ্রয় দিবে?
আল্লাহ তা‘আলার দিদারকে সূর্য ও চন্দ্র দেখার সাথে তুলনা করার অর্থ এ নয় যে, চন্দ্র ও সূর্যকে আল্লাহর সাথে সাদৃশ্য প্রদান করা হয়েছে। বরং এখানে মেঘহীন আকাশে দিনের বেলা সূর্য ও রাতে পূর্ণিমার উজ্জ্বল চন্দ্র দেখার সাথে আল্লাহ তা‘আলার দিদারের তুলনা করা হয়েছে। মেঘহীন আকাশে সূর্য দেখতে এবং পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখতে যেমন কোনো অসুবিধা হয় না, ঠিক তেমনি আল্লাহকে দেখতে কোনো অসুবিধা হবে না। এক দৃশ্যের সাথে অন্য দৃশ্যের সাথে তুলনা করা হয়নি। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাকে চন্দ্র-সূর্যের সাথে তুলনা করা হয়নি। কারণ আল্লাহ তা‘আলার কোনো তুলনা নেই। এখান থেকে সৃষ্টির উপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়ার দলীল পাওয়া যায়। সাএা সামনি ও মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া দৃষ্টিপাত করার ধারণা অসম্ভব। আর যারা বলে, আল্লাহকে দেখা যাবে, তবে কোনো দিকে নয়, সে যেন তার জ্ঞান-বুদ্ধিকে সংশোধন করে নেয়। সে সম্ভবত নিজের জ্ঞানকেই বড় মনে করেছে এবং আত্ম অহমিকায় লিপ্ত। অথবা তার বিবেক-বুদ্ধি ও বোধশক্তির মধ্যে সমস্যা রয়েছে। আর যে ব্যক্তি বলবে, আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা যাবে, তবে দর্শক আল্লাহকে সামনেও দেখবে না, পিছনেও না, ডানেও না, বামেও না, উপরেও না এবং নীচেও না, প্রত্যেক সুস্থ স্বভাব-প্রকৃতি ও বুঝশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিই তার এ কথার প্রতিবাদ করবে।
এ জন্যই মুতাযেলারা আশায়েরা সম্প্রদায়ের লোকদেরকে বলেছে, তোমরা যেহেতু আল্লাহর সত্তাগত সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করেছো, তাই তোমাদের উপর আল্লাহর দিদারকেও অস্বীকার করা আবশ্যক। কেননা মুখোমুখী হওয়া ব্যতীত ও দিক সাব্যস্ত করা ছাড়া তো দেখা সম্ভব নয়।
প্রকৃত কথা হলো আমাদের দৃষ্টিশক্তি দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখতে অক্ষম বলেই আমরা দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখিনি। এ জন্য নয় যে, আল্লাহকে দেখা অসম্ভব। এ সূর্যের প্রখর আলোর দিকে যখন কেউ দৃষ্টি দেয়, তখন তার দৃষ্টি দুর্বল ও নত হয়ে যায়। সূর্য দেখা অসম্ভব, এ কারণে নয়; বরং দর্শকের দুর্বলতার কারণে। আল্লাহ তা‘আলা যখন আখেরাতে বনী আদমকে শক্তিশালী ও পূর্ণ করে সৃষ্টি করবেন, তখন তারা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে সক্ষম হবে। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা যখন তুর পাহাড়ের উপর জ্যোতি প্রকাশ করলেন, তখন তার নূর তুর পাহাড়কে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল এবং মূসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে মূসা বললেন,
خَرَّ مُوسَى صَعِقًا فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ سُبْحَانَكَ تُبْتُ إِلَيْكَ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُؤْمِنِينَ
মূসা বেহুশ হয়ে পড়ে গেল। অতঃপর যখন তার হুস আসল তখন সে বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান, আমি আপনার নিকট তাওবা করলাম এবং আমি মুমিনদের মধ্যে প্রথম।’ (সূরা আরাফ: ১৪৩)
একটি হাদীছে কুদুসীতে এসেছে, মুসা আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহর দর্শন প্রার্থনা করলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
يا موسى لن ترانى انه لن يرانى حى الا مات ولا يابس الاتدهده
হে মুসা! তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। জীবিত কোনো প্রাণী আমাকে দেখা মাত্রই মারা যাবে এবং কোনো শুকনো বস্তুর উপর আমার জ্যোতি পড়লেই তাতে প্রকম্পন সৃষ্টি হবে।
সুতরাং মানুষ ফেরেশতাদেরকেও তাদের আসল আকৃতিতে দেখতে অক্ষম। তবে আল্লাহ যাকে শক্তিশালী করেছেন, তিনিই কেবল তাদেরকে তাদের আসল আকৃতিতে দেখার ক্ষমতা রাখেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শক্তিশালী করার কারণেই তিনি জিবরীল আলাইহিস সালামকে তার আসল আকৃতিতে দু’বার দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَقَالُوا لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْهِ مَلَكٌ وَلَوْ أَنزَلْنَا مَلَكًا لَّقُضِيَ الْأَمْرُ ثُمَّ لَا يُنظَرُونَ
‘‘তারা বলে, এ নাবীর কাছে ফেরেশতা পাঠানো হয় না কেন? যদি ফেরেশতা পাঠাতাম, তাহলে এতদিনে ফায়সালা হয়ে যেতো, তখন তাদেরকে অবকাশ দেয়া হতো না’’। (সূরা আনআম: ৮)
অনেক সালাফ বলেছেন, ফেরেশতাদেরকে তাদের আসল আকৃতিতে দেখা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি যদি তাদের জন্য ফেরেশতা অবতীর্ণ করতাম, তাহলে মানুষের আকৃতিতেই অবতীর্ণ করতাম। এতে তারা সন্দেহে পড়ে যেতো। তারা বলতো, তিনি কি মানুষ? না ফেরেশতা? আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে যেসব নেয়ামত দান করেছেন, তার মধ্যে এও রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল পাঠিয়েছেন।
মুতাযেলারা আশায়েরা সম্প্রদায়কে আল্লাহর দিদার অস্বীকারে বাধ্য করতে চাচ্ছে এ কারণে যে, তারা এবং মুতাযেলারা এ মাস‘আলায় একমত যে, আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরে নন, বাইরেও নন, ডানেও নন, বামেও নন, সামনেও নন, পিছনেও নন উপরেও নন এবং নীচেও নন।[9]
যে ব্যক্তি এমন কিছুর অস্থিত্বে বিশ্বাস করবে, যা দেখা যায়, কিন্তু কোনো দিকে নয়, বিবেকবান লোকের মতে তার কথা ঐ ব্যক্তির কথার মতই, যে স্বনির্ভর এমন বস্তুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করলো, যা দেখা যায় না এবং তা কোনো দিকেও নয়।
আল্লাহ তা‘আলা কোনো দিকে নয়, -এ অযুহাত দেখিয়ে যারা আল্লাহর দিদারকে অস্বীকার করে, তাদেরকে বলা হবে, তুমি কি ‘দিক’ দ্বারা কোনো অস্বিত্বশীল জিনিস বুঝাতে চাচ্ছো? না কি অস্তিত্বহীন কোনো বস্তু বুঝাতে চাচ্ছো? তারা যদি অস্তিত্বশীল কোনো জিনিস বুঝাতে চায়, তাহলে উহ্য ব্বিরণটি হবে এমন: كُلُّ مَا لَيْسَ فِي شَيْءٍ مَوْجُود لَا يُرَى ‘‘যে জিনিস অন্য জিনিসের মধ্যে প্রবিষ্ট নয়, তা দেখা যায় না’’। এ ভূমিকাটি সঠিক নয়। কোনো কিছু দেখার জন্য তাকে অস্থিত্বশীল অন্য কোনো জিনিসের মধ্যে ঢুকিয়েই দেখতে হবে, তা জরুরী নয়। কারণ এর পক্ষে কোনো দলীল নেই। বরং তা সম্পূর্ণ বাতিল। কেননা সৃষ্টিজগতের ছাদ দেখা সম্ভব। আর সৃষ্টিজগৎ অন্য সৃষ্টিজগতের মধ্যে প্রবিষ্টও নয়। অর্থাৎ সৃষ্টিজগতের ছাদকে অন্য সৃষ্টির মধ্যে না ঢুকিয়ে সরাসরি দেখা সম্ভব।
আর যদি বলা হয় দিক একটি অস্তিত্বহীন বিষয়, আর এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অভিমত। তারা বলেছেন, দিক একটি আপেক্ষিক বিষয়; এটি স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর কোনো সৃষ্টি নয়। অর্থাৎ অন্যের দিকে সম্বন্ধ করা ব্যতীত দিক শব্দটি কোনো অর্থ প্রদান করে না। পীপড়া যখন হাটে তখন সে অন্যান্য কীট-পতঙ্গের তুলনায় নীচেই থাকে। পীপড়া এবং অন্যান্য পোকা-মাকড়ের চেয়ে আমরা উপরে।
এখানে আরেকটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, শুধু ডান, শুধু বাম, কিংবা শুধু উপর বললে কিছুই বুঝা যাবে না। যতক্ষণ না আপনি উল্লেখ করেবেন যে, যায়েদের ডান, করীমের বাম, গাছের উপর, ছাদের নীচ ইত্যাদি। সুতরাং দিক বলতে কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্বশীল জিনিস নেই। ডান বলতে কোনো জিনিস নেই, বাম বলতে কিছুই নেই, উপর বলতে কোন সৃষ্টি নেই এবং নীচ বলতেও কিছুই নেই। এ সবগুলো আপেক্ষিক ও তুলনামূলক বিষয়। সুতরাং এটি অমুকের ডান দিকে, ঐটি অমুকের বাম দিকে, এটি আমার উপরে এবং এটি তার নীচে। দিক শব্দটি সাধারণত এভাবেই ব্যবহার হয়।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টির উপরে এবং সকল সৃষ্টির উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সমুন্নত হওয়া সুসাব্যস্ত। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদের এটি সাব্যস্ত করা থেকে আবশ্যক হয় না যে, আল্লাহ তা‘আলা অস্তিত্বশীল কোনো পরিমন্ডলে সীমাবদ্ধ হয়ে আছেন, যাকে দিক বলা হয়। তবে এ কথা সঠিক যে তিনি সকল মাখলুক থেকে উপরের দিকে। অথচ দিক এমন কোনো অনুভবযোগ্য স্বতন্ত্র অস্তিত্বশীল বাস্তব জিনিস নয়, যেখান থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাকে দেখা যাবে।
মুতাযেলাদের কথা হলো, যদি বলা হয় মুমিনগণ আল্লাহ তা‘আলাকে দেখবে তাহলে তার জন্য দিক সাব্যস্ত করা আবশ্যক হয়। তাদের এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। কেননা দিক একটি আপেক্ষিক বিষয়। আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা যাবে এবং তাকে দেখা সম্ভব। শরীয়তের দলীল ও বিবেক-বুদ্ধির দলীলের মাধ্যমে এটি সাব্যস্ত হয়েছে। জান্নাতীদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা যেসব নেয়ামত তৈরী করে রেখেছেন, তার মধ্যে এটিই সর্বোত্তম নেয়ামত। কোনো মাখলুক যখন অন্য কোনো জিনিস দেখে, সে অবশ্যই কোনো না কোনো দিকেই দেখে। আল্লাহ তা‘আলাকে কিয়ামতের দিন মুমিনগণ কোন্ দিকে দেখবে? সহজ কথা হলো, আল্লাহর কাছে দুআ করার সময় যে দিকে হাত উঠানো হয়, সেদিকেই তাকে দেখা যাবে। অর্থাৎ উপরে দেখা যাবে। জান্নাতের অধিবাসী মুমিনগণ উপরের দিকে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখবে। তবে তিনি কোনো দিক দ্বারা পরিবেষ্টিত ও সীমাবদ্ধ হওয়ার বহু উর্ধ্বে। উপরে আমরা বলেছি, দিক বলতে স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর কোনো সৃষ্টি নেই। সুতরাং যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির উপরে সমুন্নত হলে তিনি কোনো একটি দিক ও সীমার মধ্যে সীমায়িত হয়ে যান, তাদের কথা বাতিল। জাহমিয়া, মুতাযেলা, আশায়েরা ও মাতুরিদী আক্বীদাহর অনুসারীরা তাদের মস্তিস্ক প্রসূত কল্পনা থেকেই এহেন কথা বলে থাকে।
আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত থেকে যারা দ্বীনের মূলনীতি সম্পর্কিত জ্ঞান আহরণ করে না, তারা কিভাবে দ্বীনের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে কথা বলে?! তারা কেবল অমুক অমুকের কাছ থেকেই জ্ঞান অর্জন করে থাকে। তারা কুরআনকে জ্ঞান অর্জনের উৎস মনে করলেও রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ থেকে তারা উহা ব্যাখ্যা গ্রহণ করে না এবং তাতে দৃষ্টিও প্রদান করে না। এমনকি মুহাদ্দিছদের দ্বারা চয়নকৃত নির্ভরযোগ্য রাবীদের মাধ্যমে ছাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসরণকারী তাবেঈদের থেকে যে বর্ণনা এসেছে, তারা তাতেও দৃষ্টি দেয় না। আর যাদের মাধ্যমে কুরআন বর্ণনা করা হয়েছে, তারা শুধু কুরআনের শব্দ বর্ণনা করেনি; বরং তারা শব্দ ও অর্থ উভয়ই বর্ণনা করেছেন। শিশুরা যেমনভাবে শিখে তারা সেভাবে কুরআন শিখতেন না। বরং তারা অর্থসহ কুরআন শিখতেন। যে ব্যক্তি ছাহাবীদের পথ বাদ দিয়ে অন্য পথ অবলম্বন করবে, সে কুরআনের তাফসীর করতে গিয়ে শুধু নিজের এগড়া কথাই বলবে। যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে জ্ঞান অর্জন না করেই নিজের এগড়া কথা বলবে এবং তাকে দ্বীনের অংশ মনে করবে, তার কথা সঠিক হলেও সে গুনাহগার হবে। আর যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে জ্ঞান অর্জন করবে, তার কথা ভুল হলেও সে নেকী পাবে। তবে এ ব্যক্তির কথা যদি সঠিক হয়, তাহলে তার নেকী বহুগুণ বৃদ্ধি করা হবে।
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, وَالرُّؤْيَةُ حَقٌّ لِأَهْلِ الْجَنَّةِ ‘‘আর জান্নাতীদের জন্য আল্লাহকে দেখার বিষয়টি সত্য। এখানে বিশেষভাবে মুমিনদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, কেবল মুমিনরাই আল্লাহ তা‘আলাকে দেখবে। অন্যরা দেখবে না। কোনো সন্দেহ নেই যে, জান্নাতবাসীগণ তাদের প্রভুকে জান্নাতে দেখবে। ঠিক তেমনি জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্বে তারা হাশরের ময়দানেও আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে। ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ছহীহ সূত্রে এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর মধ্যে উক্ত কথার প্রমাণ মিলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُ سَلَامٌ
‘‘যেদিন তারা তার সাথে সাক্ষাত করবে, তাদের অভ্যর্থনা হবে সালামের মাধ্যমে’’। (সূরা আহযাব: ৪৪)
হাশরের ময়দানের সকলেই আল্লাহ তা‘আলাকে দেখবে কি না, এ ব্যাপারে তিনটি অভিমত রয়েছে।
(১) হাশরের ময়দানে অবস্থানকারীদের মধ্যে শুধু মুমিনরাই আল্লাহ তা‘আলাকে দেখবে।
(২) মুমিন-কাফের সকলেই দেখবে। অতঃপর কাফেরদের সামনে পর্দা পড়ে যাবে। এরপর তারা আর আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে না।
(৩) কাফেররা ব্যতীত মুমিন ও মুনাফিকরা দেখতে পাবে। এমনি হাশরের মাঠের সকলের সাথেই আল্লাহ তা‘আলা কথা বলবেন কি না, সে ব্যাপারেও মতভেদ রয়েছে।
উম্মতে মুহাম্মাদীর সকল লোকই এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে, দুনিয়াতে স্বীয় চোখ দিয়ে কেউ আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে না। আমাদের নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলাকে দেখেছেন কিনা সে ব্যাপারেই কেবল আলেমগণ মতভেদ করেছেন। তাদের কেউ বলেছেন, তিনি স্বীয় চোখ দিয়ে আল্লাহকে দেখেননি। আবার কেউ বলেছেন, তিনি দেখেছেন। কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ তার কিতাব আশ্ শিফার মধ্যে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলাকে দেখেছেন কি না এ ব্যাপারে ছাহাবী এবং তাদের পরবর্তী যামানার আলেমদের মতভেদ বর্ণনা করেছেন। আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রভুকে কপালের চোখ দিয়ে দেখার কথাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছেন। মাসরুক যখন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি তার প্রভুকে দেখেছেন? আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তখন বললেন, তোমার কথা শুনে আমার শরীরের পশম খাড়া হয়ে গেছে। অতঃপর তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তোমাকে বলবে, মুহাম্মাদ তার প্রভুকে দেখেছে, সে মিথ্যুক। অতঃপর কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ বলেন, এক দল লোক আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার অনুরূপ কথা বলেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকেই এ কথা প্রসিদ্ধ রয়েছে। তবে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে দুই ধরণের কথা এসেছে। একদল মুহাদ্দিছ, ফকীহ এবং মুতাকাল্লিম মিরাজের রাতে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আল্লাহর দিদার হওয়ার কথা অস্বীকার করেছে। তারা আরো বলেছেন যে, দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখা অসম্ভব।
ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রভুকে কপালের চোখ দিয়ে দেখেছেন।[10] তবে আতা রহিমাহুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রভুকে অন্তরের চোখ দিয়ে দেখেছেন। অতঃপর কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ এ বিষয়ে আরো অনেক মতামত ও উপকারী বিষয় বর্ণনা করেছেন।
অতঃপর কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমাদের নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য তার প্রভুর দিদার আবশ্যক হওয়া এবং এ কথা বলা যে, তিনি তাকে নিজ চোখে দেখেছেন, এ ব্যাপারে কোনো অকাট্য দলীল নেই। সূরা নাজমের আয়াত দু’টিই হলো এ মতের মূলভিত্তি। কিন্তু আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যায় রয়েছে আলেমদের অনেক মতভেদ। তবে আয়াত দু’টির মাধ্যমে বুঝা যায় যে, আল্লাহকে দেখা সম্ভব।
সুতরাং কাযী ইয়ায রাহিমাহুল্লাহু এ ব্যাপারে যা বলেছেন, তাই সত্য ও সঠিক। দুনিয়াতেও আল্লাহকে দেখা সম্ভব।[11] কেননা দুনিয়াতে যদি আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা সম্ভব না হতো, তাহলে মুসা আলাইহিস সালাম কখনই আল্লাহকে দেখার আবদার করতেন না।[12] তবে এমন কোনো দলীল পাওয়া যায় না যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রবকে কপালের চোখ দিয়ে দেখেছেন। বরং ছহীহ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রভুকে দেখেননি। ছহীহ মুসলিমে আবু যার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম,
«هَلْ رَأَيْتَ رَبَّكَ قَالَ نُورٌ أَنَّى أَرَاهُ»
‘‘আপনি কি আপনার প্রভুকে দেখেছেন? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর নূর দেখেছি। তাকে দেখবো কিভাবে?[13] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি একটি নূর দেখেছি’’।
ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ আবু মুসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণনা করেন যে,
قَامَ فِينَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِخَمْسِ كَلِمَاتٍ فَقَالَ إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَنَامُ وَلَا يَنْبَغِي لَهُ أَنْ يَنَامَ يَخْفِضُ الْقِسْطَ وَيَرْفَعُهُ يُرْفَعُ إِلَيْهِ عَمَلُ اللَّيْلِ قَبْلَ عَمَلِ النَّهَارِ وَعَمَلُ النَّهَارِ قَبْلَ عَمَلِ اللَّيْلِ حِجَابُهُ النُّورُ لَوْ كَشَفَهُ لَأَحْرَقَتْ سُبُحَاتُ وَجْهِهِ مَا انْتَهَى إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ
‘‘একদা নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে পাঁচটি কথা বললেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা নিদ্রা যান না। নিদ্রা যাওয়া তার জন্য সমিচীন নয়। তিনি ন্যায় দন্ডের পাল্লা নামান এবং উঠান। দিবসের আমলের পূর্বেই তার নিকট রাতের আমলসমূহ উঠানো হয় এবং রাতের আমলের পূর্বেই দিনের আমল উঠানো হয়। তার পর্দা হচ্ছে নূর। তিনি যদি তা উন্মুক্ত করেন তার চোখের দৃষ্টি যতদূর যাবে ততদূর পর্যন্ত সকল মাখলুক তার চেহারার আলোতে জ্বলে যাবে’’।[14]
সুতরাং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু যার্কে উদ্দেশ্য করে যেখানে বলেছেন, আমি নূর দেখেছি, তার অর্থ হলো তিনি নূরের পর্দা দেখেছেন। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী, نُورٌ أَنَّى أَرَاهُ ‘‘আমি আল্লাহর নূর দেখেছি, তাকে দেখবো কিভাবে? অর্থাৎ যে নূরটি পর্দা স্বরূপ ছিল, আল্লাহ তা‘আলার দিদার থেকে তাই আমাকে বাধা প্রদান করেছে। আরো খোলাসা করে এভাবে বলা যেতে পারে যে, আমি আল্লাহ তা‘আলাকে কিভাবে দেখতে পাবো? আমার মাঝে এবং তার মাঝে একটি নূরের পর্দার অন্তরায় ছিল। এটিই আমাকে আল্লাহর দিদার থেকে বাধা প্রদান করেছে। এ কথা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিরাজের রাতে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখেননি। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
ইমাম উছমান সাঈদ আদ দারামী রহিমাহুল্লাহ এ বিষয়ে ছাহাবীদের ইজমা হওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রবকে দেখেছেন, এ কথা সাব্যস্ত করার চেয়ে জিবরীলকে দেখা সাব্যস্ত করার প্রতি আমাদের প্রয়োজন বেশী। যদি আল্লাহ তা‘আলাকে দেখার বিষয়টি আরো মহান ও বৃহত্তম। কিন্তু মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত সাব্যস্ত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা আবশ্যক নয়।
[8]. ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করার পর বলেছেন, হাসান সহীহ। তবে শাইখ আলবানী উহাকে যঈফ বলেছেন, দেখুন পূর্বোক্ত তথ্যসূত্র, টিকা নং- ১৬৬।
[9]. অর্থাৎ মুতাযেলারা আশায়েরাদেরকে বলতে চাচ্ছে যে, হে আশায়েরাগণ! তোমরাও যেহেতু আমাদের মতই সৃষ্টির উপর আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করে থাকো, তাই আমাদের ন্যায় আল্লাহর সাক্ষাৎকেও অস্বীকার করো। কারণ সৃষ্টির উপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়া এবং তাকে দেখা, -এ দু’টি মাসআলা একই সূত্রে গাঁথা। যারা বিশ্বাস করে আল্লাহকে দেখা যাবে, মুমিনগণ আল্লাহকে দেখবে, তাদের উপর এটি বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, আল্লাহ তা‘আলা উপরে বা উপরের দিকে রয়েছেন। উপর থেকেই তিনি মুমিনদেরকে জান্নাতে তার চেহারা মোবারকের দিদার প্রদান করবেন। যা দেখে মুমিনগণ পরিতৃপ্ত হবে। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তোমার দিদার থেকে মাহরুম করোনা। আমীন।
[10]. যঈফ, ইবনে খুযাইমাহ
[11]. আলেমগণ এ মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখা সম্ভব। তবে কেও দেখেনি। আল্লামা ড. সালেহ ফাওয়ান বলেন, দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখা সম্ভব। তবে কেউ তাকে দেখার ক্ষমতা রাখে না।
[12]. কেননা কোনো নাবীর জন্যই আল্লাহ তা‘আলার কাছে অসম্ভব বস্তু চাওয়া জায়েয নেই। আর নাবীগণ ভালো করেই জানতেন, আল্লাহ তাআলার কাছে অসম্ভব বস্তু চাওয়া অবৈধ।
[13]. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ১৭৮।
[14]. ছহীহ মুসলিম ১৭৯।
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহর উক্তি: بِغَيْرِ إِحَاطَةٍ وَلَا كَيْفِيَّةٍ ‘‘অর্থাৎ আমরা মুমিনদের জন্য আল্লাহর দিদার সাব্যস্ত করি, তবে তাকে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে নয়। আমরা সেই দিদারের কোনো ধরণও সাব্যস্ত করি না। আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ বড়ত্ব এবং তার নূরের উজ্জ্বলতার কারণে কোনো সৃষ্টির পক্ষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাকে পরিপূর্ণরূপে আয়ত্ত করা এবং তার প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করা অসম্ভব। সুতরাং দৃষ্টিসমূহ তাকে পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি ও আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব, কিন্তু জ্ঞানের মাধ্যমে তাকে পূর্ণরূপে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لَّا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ
‘‘দৃষ্টিশক্তি তাকে আয়ত্ত করতে পারে না। কিন্তু তিনি দৃষ্টিকে আয়ত্ত করে নেন’’ (সূরা আনআম: ১০৩)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا
‘‘তারা জ্ঞান দ্বারা তাকে আয়ত্ত করতে পারে না’’। (সূরা ত্বহা: ১১০) আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ
‘‘সেদিন বহু মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে’’। (সূরা আল কিয়ামাহ ৭৫:২২-২৩) এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলাকে মুমিনগণ দেখবে বলে যে কথা বলা হয়েছে, তার ব্যাপারে ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহর উক্তি: وَتَفْسِيرُهُ عَلَى مَا أَرَادَ اللَّهُ تَعَالَى وَعَلِمَهُ ‘‘আল্লাহ তা‘আলাকে দেখার ব্যাখ্যা হলো, একমাত্র আল্লাহ যেভাবে ইচ্ছা করেন এবং যেভাবে তিনি জানেন সেভাবেই এটি অর্জিত হবে।
এ সম্পর্কে যা কিছু ছহীহ হাদীছে রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত হয়েছে, তা যেভাবে তিনি বলেছেন সেভাবেই গৃহীত হবে এবং তিনি যা উদ্দেশ্য করেছেন সেটিই ধর্তব্য হবে। তিনি আরো বলেন, এতে আমরা আমাদের মতের উপর নির্ভর করে কোনো অপব্যাখ্যা করবো না এবং আমাদের প্রবৃত্তির প্ররোচনায় নিপতিত হয়ে কোনো অযাচিত ধারণার বশবর্তী হবো না।
আল্লাহ তা‘আলাকে দেখার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীছের বক্তব্যগুলোকে মুতাযেলারা যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে, আমরা সেগুলোকে ঐভাবে ব্যাখ্যা করবো না। কেননা তাদের ব্যাখ্যায় আল্লাহর কালাম ও রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর আসল অর্থ পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। কুরআনের আয়াতের যে ব্যাখ্যা সুন্নাতের অনুরূপ হয়, তাই হলো সঠিক ব্যাখ্যা। আর যে ব্যাখ্যা সুন্নাতের বিপরীত হয়, তা বাতিল ব্যাখ্যা।
বর্ণনা প্রসঙ্গ যে ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে না এবং যার পক্ষে কোনো আলামতও থাকে না, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাণীর মাধ্যমে উহা উদ্দেশ্য করেননি। কুরআন ও হাদীছের বক্তব্য থেকে যদি প্রকাশ্য অর্থ উদ্দেশ্য না হয়ে অন্য কোনো অর্থ উদ্দেশ্য হতো, তাহলে অবশ্যই বাক্যের সাথে এমন কিছু আলামত যুক্ত হতো, যা প্রমাণ করতো যে এখানে সুস্পষ্ট অর্থের বিপরীত অর্থ উদ্দেশ্য। যাতে করে শ্রোতাগণ সন্দেহ ও ভুলের মধ্যে নিপতিত না হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট করেই তার কালাম নাযিল করেছেন। এতে রয়েছে মানুষের জন্য হেদায়াত। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি বাহ্যিক অর্থের বিপরীত অর্থ উদ্দেশ্য করে থাকেন এবং সেই অর্থটি বুঝানোর জন্য এমন কোনো ইঙ্গিত না করে থাকেন, যা বাহ্যিক অর্থ ব্যতীত অন্য অর্থ প্রত্যেক লোকের বোধশক্তির মধ্যে প্রবেশ করে, তাহলে কুরআনকে সুস্পষ্ট বর্ণনা হিসাবে নাম দেয়া ঠিক হতো না। এবং এটি মানুষের জন্য হেদায়াতও হতোনা। সুতরাং বক্তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংবাদ দেয়াকে তাবীল বলা হয়। এতে নতুন করে কিছু তৈরী হয় না।
এ স্থানে অনেকেই ভুল করে থাকে। বক্তার বক্তব্যের উদ্দেশ্য বুঝানোর নাএ তাবীল। যখন বলা হয়, এ শব্দটির অর্থ হলো এটি, তখন এর দ্বারা বক্তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে খবর দেয়া হয়। খবরটি যদি বাস্তব অবস্থার সাথে না মিলে, তাহলে বক্তার উপর মিথ্যা আরোপ করা হয়ে যায়। বক্তা তার বক্তৃতার মাধ্যমে কী উদ্দেশ্য করেছেন, তা বুঝার পদ্ধতি একাধিক।
(১) অনেক সময় বক্তা নিজেই তার বক্তৃতার উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট করে বলে দেয়।
(২) বক্তা তার উদ্দেশ্য বুঝাতে এমন শব্দ ব্যবহার করেন, যা উক্ত অর্থের জন্যই গঠন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বক্তা যদি তার বক্তব্যের মধ্যে এমন কোনো আলামত উল্লেখ না করেন, যাতে বুঝা যাবে যে, তিনি প্রকৃত অর্থ উদ্দেশ্য করেননি, তখন যে অর্থের জন্য শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে, তা দ্বারা তাই বুঝাবে। সুতরাং বক্তা যখন তার কালামের আসল অর্থ উদ্দেশ্য করবেন, যে অর্থের জন্য কালামটি গঠন করা হয়েছে তাই বুঝাবেন এবং সেই সঙ্গে বাক্যটি আসল অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার পক্ষে আলামতও থাকবে, তখন অন্য কালামকে অর্থে ব্যবহার করার কোনো সুযোগই থাকে না।
আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী: وَكَلَّمَ اللَّهَ مُوسَى تَكْلِيْماً ‘‘আল্লাহ তা‘আলা মুসার সাথে সুস্পষ্ট কথা বলেছেন’’ (সূরা আন নিসা:১৬৩)। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ عيانا كَمَا تَرَوْنَ الشمس في الظهيرة ليس دونها سحاب»
‘‘নিশ্চয় তোমরা অচিরেই স্বচক্ষে তোমাদের রবকে দেখতে পাবে। যেমন মেঘহীন আকাশে দুপুর বেলা কোনো রকম অসুবিধা ছাড়াই সূর্য দেখতে পাও’’।[15]
এ রকম সুস্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে শ্রোতা বক্তার উদ্দেশ্য সহজেই বুঝতে পারে। আর বক্তা যখন তার কথার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংবাদ দিতে গিয়ে এমন শব্দ ব্যবহার করবে, যাকে ঐ অর্থের জন্যই গঠন করা হয়েছে এবং সেই সঙ্গে তার কথার মধ্যে উক্ত অর্থটি উদ্দেশ্য হওয়ার কারণও পাওয়া যাবে, তখন বক্তা তার কথার মধ্যে সত্যবাদী হবে। আর যখন কোনো বক্তব্যের এমন তাবীল করা হবে, যা বক্তব্য থেকে বুঝা যায় না এবং বক্তব্যের সাথে উক্ত তাবীলের পক্ষে কোনো আলামতও থাকে না, তখন যদি বলা হয় এ তাবীল হলো বক্তার উদ্দেশ্য, তাহলে এটি বক্তার উপর মিথ্যাচারের পর্যায়ে পড়বে। এটি হবে এগড়া ব্যাখ্যা এবং প্রবৃত্তির ধারণা মাত্র।
প্রকৃত বিষয় হলো, যারা বলে আমরা এ আয়াতকে এ অর্থে ব্যাখ্যা করবো অথবা এর মাধ্যমে তাবীল করবো, তাদের কথার মাধ্যমে আসলে শব্দকে তার অর্থ থেকে পরিবর্তন করা হয় মাত্র। কেননা কুরআন-হাদীছের বাণী দ্বারা যখন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দলীল পেশ করা হয়, তখন যদি সে উহাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা না রাখে, তাহলে শব্দটির অর্থ পরিবর্তন করে ফেলে এবং বলে, আমরা এটিকে বাহ্যিক অর্থের বিপরীত অর্থে ব্যাখ্যা করবো।
আর যদি বলে আয়াতের আরেকটি অর্থ রয়েছে, আপনারা উহা উল্লেখ করেননি, তাহলে শব্দটি প্রকৃত ও বাহ্যিক অর্থে ব্যবহার করা অসম্ভব এবং তাকে বাতিল করাও সম্ভব নয়। সুতরাং শব্দটি যেহেতু কুরআন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে এবং তার বাহ্যিক অর্থ যেহেতু উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব নয়, তাই বলবো যে, এখানে রূপক অর্থ উদ্দেশ্য। রূপক অর্থে গ্রহণ করবো, যদিও তাকে প্রথমত রূপক অর্থে গঠন করা হয়নি।
তাদের জবাবে বলা হবে, বক্তার কথার অর্থ সম্পর্কে এ খবর দেয়া যে, তিনি তার কথার মাধ্যমে এ অর্থ উদ্দেশ্য করেছেন, এ সংবাদটি সত্য এবং মিথ্যা উভয়ই হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। যেমনটি ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। আর এটি অসম্ভব যে, বক্তার কথার বিপরীত অর্থ উদ্দেশ্য হবে, অথচ তিনি শ্রোতাদের জন্য ঐ অর্থ বর্ণনা করবেন না। বরং বক্তার কথার মাধ্যএে জানা যায় যে, তিনি তার কথার দ্বারা প্রকৃত অর্থই উদ্দেশ্য করেছেন। তবে বক্তার কথার অর্থ কখনো কখনো তার বাহ্যিক অর্থের বিপরীত হয়ে থাকে। আমরা এটি অস্বীকার করি না। বক্তা যখন শ্রোতার নিকট আসল উদ্দেশ্য গোপন রাখতে চায়, তখন সে তার কথার বাহ্যিক অর্থের বিপরীত অর্থ উদ্দেশ্য করে থাকতে পারে। তবে বক্তা যখন কোনো বিষয়কে সুস্পষ্ট করে বুঝাতে চাইবে এবং তার উদ্দেশ্য অন্যদেরকে বুঝাতে চাইবে, তখন সে তার কথার বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থের বিপরীত উদ্দেশ্য করবে, এটি অগ্রহণযোগ্য। এটি কিভাবে সম্ভব হতে পারে? অথচ বক্তা তার বক্তব্যের মধ্যে এমন কিছু উল্লেখ করে, যা রূপক অর্থের ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত করে দেয়। সেই সঙ্গে সে তার কথাকে একাধিকবার পুনরাবৃত্তি করে এবং তার কথাকে সুস্পষ্ট করার জন্য বহু উদাহরণ ও উপমাও পেশ করে থাকে।
অতঃপর ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, কোনো ব্যক্তি কেবল তখনই তার দ্বীনকে ভ্রষ্টতা ও বক্রতা থেকে নিরাপদ রাখতে পারে, যখন আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পন করবে এবং সংশয়ের ব্যাপার সমূহকে আল্লাহর দিকেই ফিরিয়ে দিবে। অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর দলীলগুলো মাথা পেতে মেনে নিতে হবে। তাতে কোনো প্রকার সন্দেহ পোষণ করা যাবে না এবং সেগুলোর বাতিল ব্যাখ্যাও করা যাবে না। এমনকি কারো এ কথার মাধ্যমেও শরীয়তের কুরআন-সুন্নাহর দলীলের বিরোধিতা করা যাবে না যে, বোধশক্তি তো এ দলীলের বিরোধী এবং বোধশক্তির দলীলই হলো আসল দলীল। এ কথাও বলা যাবে না যে, শরীয়াতের দলীল বুঝশক্তির দলীলের বিরোধী হলে বুঝশক্তির দলীলকেই প্রাধান্য দিতে হবে। এটি কখনোই হতে পারে না। অর্থাৎ শরীয়তের দলীল ও বোধশক্তির দলীল কখনো পারস্পরিক সাংঘর্ষিক হতে পারে না। তবে কখনো কখনো এ রকম সন্দেহ হয়ে থাকে। যেসব ক্ষেত্রে শরীয়তের ছহীহ দলীল ও বোধশক্তির দলীল পরস্পর সাংঘর্ষিক মনে হয়, সেখানে যারা বুঝশক্তির দলীলকে জ্ঞাত বিষয় বলে দাবি করে, তাদের কথা ঠিক নয়; বরং প্রকৃতপক্ষে তা জ্ঞাত নয়; বরং অজ্ঞাত। যে ব্যক্তি গভীর দৃষ্টি দিবে তার কাছে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে।
আর যে হাদীছ ছহীহ নয়, তা বোধশক্তির দলীলের বিরোধি হওয়ার উপযোগী নয়। সুতরাং বিশুদ্ধ বর্ণনা এবং পরিশুদ্ধ বিবেক-বুদ্ধি কখনো পরস্পর বিরোধী হয় না। যে ব্যক্তি বুঝশক্তির দলীলের মাধ্যমে শরীয়তের দলীলের বিরোধিতা করবে, তাকে বলা হবে, তোমার কথাকেই বিবেক-বুদ্ধির দলীল প্রত্যাখ্যান করে। তাকে বলা হবে, বোধশক্তির দলীল শরীয়তের দলীলের বিরোধী হলে শরীয়তের দলীলকে বিবেক-বুদ্ধির দলীলের উপর প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা পরস্পর বিরোধী উভয় দলীলের মাধ্যমে সাব্যস্ত বিষয়কে একসাথে মেনে নেয়া হলে পরস্পর অসংগতিপূর্ণ দু’টি জিনিসকে এক সাথে একত্রিত করা আবশ্যক হয় এবং উভয় প্রকার দলীলকে পরিত্যাগ করলে পরস্পর বিপরীতমুখী দু’ই বস্তুর অস্তিত্ব অস্বীকার করা আবশ্যক হয়। তাই বিবেক-বুদ্ধির দাবিকে শরীয়তের দলীলের উপর প্রাধান্য দেয়া অসম্ভব। কেননা বিবেক-বুদ্ধির দলীল কুরআন-সুন্নাহর দলীল সত্য হওয়ার সাক্ষ্য দেয় এবং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সংবাদ প্রদান করেছেন, তা কবুল করে নেয়াকে আবশ্যক করে। সুতরাং আমরা যদি শরীয়তের এ দলীলকে বাতিল করে দেই, তাহলে বিবেক-বুদ্ধির দলীলকেও বাতিল করে দেয়া আবশ্যক হবে। আর বিবেক-বুদ্ধির দলীল যদি বাতিল হয়, তাহলে তা শরীয়তের দলীলের বিরোধী হওয়ার উপযোগী হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কেননা যে জিনিস নিজেই দলীল হওয়ার উপযুক্ত নয়, সে অন্যান্য দলীলের বিরোধী হওয়ার যোগ্যতাও রাখে না। সুতরাং ফলাফল এ দাড়ালো যে, বিবেক-বুদ্ধি ও মস্তিস্কের চিন্তা প্রসূত দলীলকে কুরআন-সুন্নাহর দলীলের উপর প্রাধান্য না দেয়া আবশ্যক। তাই একে প্রাধান্য দেয়া অবৈধ। এটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট বিষয়।
বিবেক-বুদ্ধির দলীল প্রমাণ করে যে, কুরআন-সুন্নাহর দলীল সত্য, বিশুদ্ধ এবং তার সংবাদ বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। সুতরাং শরীয়তের যে দলীলকে বিবেক-বুদ্ধি সমর্থন করেছে, তা বাতিল হওয়ার কারণে যদি দলীল দ্বারা সাব্যস্ত বস্তুও বাতিল হয়, তাহলে আবশ্যক হয় যে, মানুষের বুঝশক্তি বিশুদ্ধ ও নির্ভুল কোনো দলীল নয়। আর বুঝশক্তি যদি বিশুদ্ধ কোনো দলীল না হয়, তাহলে তাকে শরীয়তের দলীলের উপর প্রাধান্য দেয়া তো দূরের কথা, কখনোই তার অনুসরণ করা জায়েয নয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বিবেক-বুদ্ধির দলীলকে কুরআন-সুন্নাহর দলীলের উপর প্রাধান্য দেয়া হলে বুঝশক্তির দলীলই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।
প্রত্যেক মুসলিমের উপর আবশ্যক হলো, সে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের সামনে নিজেকে সোপর্দ করবে, তার আদেশের সামনে নত হবে এবং তার সংবাদকে সত্য বলে মেনে নিবে। আমাদের জন্য কোনো অবস্থাতেই বৈধ নয় যে, ভ্রান্ত কল্পনার মাধ্যমে আমরা তার বিরোধীতা করবো। ভ্রান্ত কল্পনাকে বিবেক-বুদ্ধির দলীল নাম দিয়ে তাকে শরীয়তের দলীলের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো বৈধ নয়। সন্দেহের বশবতী হয়ে কুরআন-সুন্নাহর দলীলের ব্যাখ্যা করা আমাদের জন্য বৈধ নয় কিংবা কুরআন-সুন্নাহর দলীলের উপর মানুষের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া এবং মানুষের মস্তিস্ক প্রসূত মতবাদকে শরীয়তের অকাট্য দলীলের উপর অগ্রাধিকার দেয়া আমাদের জন্য মোটেই সমিচীন নয়। সুতরাং একমাত্র রসূলকেই ফায়ছালাকারী হিসাবে মানবো এবং একমাত্র তার সুন্নাতের সামনেই নিজেদেরকে সোপর্দ করবো ও তার সামনে নত হবো। মোটকথা আমরা একমাত্র রাসূলের সুন্নাতকে ঠিক সেভাবেই অনুসরণ করবো যেভাবে আমরা একমাত্র রসূল প্রেরণকারীর ইবাদত করে থাকি, তার জন্য নত হই, বিনীত হই, তার দিকেই ফিরে যাই এবং তার উপরই ভরসা করি।
সুতরাং দু’টি তাওহীদ বাস্তবায়ন করা জরুরী। এ দু’টি তাওহীদ বাস্তবায়ন করা ব্যতীত কোনো বান্দা আল্লাহর আযাব থেকে রেহাই পাবে না। রসূল প্রেরণ কারীর তাওহীদ এবং প্রেরিত রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণের তাওহীদ। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং একমাত্র রাসূলের সুন্নাতের আনুগত্য ও অনুসরণ করা। আমরা রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত ব্যতীত অন্য কারো সুন্নাতের ফায়ছালা গ্রহণ করবো না এবং তার হুকুম ব্যতীত অন্য কারো হুকুম নিয়ে সন্তুষ্ট হবো না। সেই সঙ্গে তার আদেশ বাস্তবায়ন করা এবং তার খবরকে সত্যায়ন করার ক্ষেত্রে আমরা কোনো শাইখের কথা, কোনো ইমামের মতামত, মাযহাবের অনুসারীর সমর্থন, কোনো ফির্কার ইমাম এবং মর্যাদাবান ব্যক্তির সিদ্বামেত্মর অপেক্ষা করবো না। কিছু কিছু মানুষ রয়েছে, যারা তাদের শাইখ ও ইমামের অনুমতি ছাড়া রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাকে বাস্তবায়ন করে না এবং তার খবরকেও সত্যায়ন করে না। আর কোনো হাদীছ বা আয়াতের ব্যাপারে ইমামের কথা পাওয়া না গেলে তারা বলে, আমরা যেহেতু ইমামের অনুসরণ করি, আর ইমামদের কাছে এ হাদীছটি যেহেতু অবশ্যই পৌঁছে থাকবে, তাই তারা যা বলেছেন, আমার কথাও তাই। তারা কুরআন ও সুন্নাহর দলীলকে ইমামদের উপর সোপর্দ করে দেয় এবং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশকে বাস্তবায়ন ও তার হাদীছকে সত্যায়ন করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর এমনটি করা অসম্ভব হলে কুরআন-হাদীছের বক্তব্যকে তারা পরিবর্তন করে ফেলে। তারা এ পরিবর্তনকে তাবীল বা ব্যাখ্যা এবং অন্য অর্থে প্রয়োগ করে বলে নাম দিয়ে থাকে। তারা বলে থাকে আমরা এ আয়াত বা হাদীছের ব্যাখ্যা করছি এবং এ অর্থে ব্যবহার করছি।
আসল কথা হলো কোনো বান্দা তার রবের সাথে এ অবস্থায় সাক্ষাৎ করার চেয়ে শির্ক ব্যতীত অন্যান্য সকল গুনাসহ সাক্ষাৎ করা অনেক ভালো। বান্দার অবস্থা এমন হওয়া উচিত, যখন তার কাছে রাসূলের কোনো ছহীহ হাদীছ পৌঁছাবে, তখন নিজেকে এরূপ ভাববে যে, সে স্বয়ং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকেই হাদীছটি শুনেছে। তার জন্য কি এটি বৈধ হবে যে, রাসূলের হাদীছ তার কাছে আসবে আর সে তা কবুল করে নেয়ার আগে কারো কথা, মত বা মাজহাবের বক্তব্য আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? বরং তার উপর আবশ্যক হলো, সে রাসূলের হাদীছ বাস্তবায়ন করবে। অন্য কারো কথার প্রতি দৃষ্টি দিবে না। অন্য কারো কথার সাথে রাসূলের কথা সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে সে রাসূলের কথাকে বাতিল মনে করবেনা। বরং মানুষের যে মতামত হাদীছের বিরোধী হবে, সে ক্ষেত্রে মানুষের মতামতকেই বাতিল করবে। কিয়াসের মাধ্যমে কুরআন-হাদীছের দলীলের বিরোধিতা করবে না। যেমন কোনো কোনো মাজহাবের লোকেরা মুসার্রাতের হাদীছকে কিয়াসের বিরোধী হওয়ার কারণে বর্জন করে থাকে। মুসার্রাতের হাদীছটি হলো, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দিয়েছেন, কেউ যদি এমন উটনী, গাভী, কিংবা বকরী খরীদ করে, বেশী দামে বিক্রি করার জন্য যার স্তনে দুধ আটকানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ক্রেতা যদি দুধ কম পায়, তাহলে তার অধিকার রয়েছে যে, সে ইচ্ছা করলে উক্ত পশুটি ফেরত দিতে পারবে। ফেরত দেয়ার সময় পশুটির সাথে একসা পরিমাণ খেজুর দিয়ে দিবে। এ হাদীছটি ছহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কিয়াসের অনুসারীরা বলেছে, এ হাদীছটি মেনে নেয়া কঠিন। কেননা এটি কিয়াসের বিরোধী। তাই তারা এ হাদীছকে প্রত্যাখ্যান বা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। ফিক্হের কিতাবসমূহে তাহারাত অধ্যায় থেকে শুরু করে লেন-দেনের অধ্যায় পর্যন্ত এ ধরণের উদাহরণ আরো অনেক রয়েছে।
হাদীছের সাথে মানুষের কিয়াসসমূহ যখন সাংঘর্ষিক হবে তখন কিয়াস বাদ দিয়ে হাদীছ কবুল করে নেয়া আবশ্যক। আমাদের উচিত শরীয়তের দলীলকে স্বীয় স্থান থেকে মস্তিস্ক প্রসূত এমন কল্পনার কারণে সরিয়ে না দেয়া, যাকে তার উদ্ভাবকগণ বোধশক্তি দ্বারা জ্ঞাত দলীল হিসাবে সাব্যস্ত করেছে। প্রকৃতপক্ষে তা জ্ঞাত বিষয় তো নয়ই; বরং তা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একটি বিষয় এবং সত্য থেকে বহু দূরে। মোটকথা, কোনো ইমামের কথা না আসা পর্যন্ত রাসূলের কথাকে কবুল করে নেয়া থেকে বিরত থাকা যাবে না। সে যে-ই হোক না কেন।
ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমাদের কাছে আনাস বিন ইয়ায বর্ণনা করেছেন, তিনি বর্ণনা করেছেন আবু হাযেম থেকে, আর তিনি বর্ণনা করেছেন আমর বিন শুআইব থেকে, আমর বিন শুআইব বর্ণনা করেছেন, তার পিতা থেকে, তার পিতা বর্ণনা করেছেন, তার দাদা থেকে। তার দাদা বলেন, একদা আমি এবং আমার ভাই এমন একটি উত্তম মজলিসে বসলাম, যা আমার দৃষ্টিতে লাল উট পাওয়ার চেয়ে উত্তম। আমি এবং আমার ভাই সেখানে গমণ করলাম। তখন দেখলাম একদল বিজ্ঞ ছাহাবী রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো একটি ঘরের দরজায় বসে রয়েছেন। আমরা তাদেরকে ডিঙ্গিয়ে সামনে যাওয়া অপছন্দ করলাম। তাই একটু দূরেই বসে পড়লাম। তখন তারা কুরআনের একটি আয়াত নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করার এক পর্যায়ে তাদের আওয়াজ উঁচু হলো। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন রাগান্বিত অবস্থায় তাদের নিকট আসলেন। তার চেহারা তখন ক্রোধে লাল হয়ে গিয়েছিল। তিনি তাদের প্রতি মাটি নিক্ষেপ করছিলেন এবং বলছিলেন, হে লোক সকল থামো! এ কারণেই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা ধ্বংস হয়েছে। তারা তাদের নাবীর সাথে মতভেদ করার কারণে এবং কিতাবের এক অংশকে অন্য অংশের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করার কারণে ধ্বংস হয়েছে। কুরআন এ জন্য নাযিল হয়নি যে, তার এক অংশ অন্য অংশকে মিথ্যায়ন করবে। বরং এ জন্য নাযিল হয়েছে যে, তার এক অংশ অন্য অংশকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিবে। কুরআনের যে অংশ তোমরা বুঝ, সে অনুযায়ী আমল করো এবং তার যে অংশ তোমাদের অজানা থাকে, তা আলেমদের নিকট পেশ করো।[16]
আল্লাহ তা‘আলা তার নামে বিনা ইলমে কথা বলা হারাম করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالإثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنزلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ
‘‘তুমি বলে দাও, আমার প্রতিপালক কেবল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন এবং হারাম করেছেন গুনাহ্, অন্যায় বাড়াবাড়ি, আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, যার কোনো দলীল-প্রমাণ তিনি অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা বলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন, যা তোমরা জানো না’’। (সূরা আল ‘আরাফ: ৩৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا
‘‘এমন কোনো জিনিসের পেছনে লেগে যেয়ো না যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চিয়ই চোখ, কান ও দিল সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ৩৬)
সুতরাং বান্দার উপর আবশ্যক হলো, আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী-রসূলদেরকে যাসহ প্রেরণ করেছেন, এবং তিনি যেসব কিতাব নাযিল করেছেন সে কেবল ঐ বিষয়কেই সত্য বলে স্বীকৃতি দিবে ও বিশ্বাস করবে। কেবল তার অনুসরণ করাই তার জন্য আবশ্যক। সে সত্যায়ন করবে যে, তা সত্য ও সঠিক। তা ছাড়া মানুষের যত কথা আছে, তাকে তার সামনে পেশ করবে। মানুষের যে কথা আল্লাহর পক্ষ হতে আগত অহীর সাথে মিলবে, তাও সত্য। আর যা তার সাথে মিলবে না, তা বাতিল বলে গণ্য হবে। আর যেসব কথা সম্পর্কে জানা যাবে না যে, তা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হাদীছের সাথে মিলেছে কি না, সে ক্ষেত্রে চুপ থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ কথা খুব সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে বক্তার কথা বুঝা না গেলে কিংবা কথাটি বুঝা গেলেও রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি কথাটিকে সত্যায়ন করেছেন? না কি তিনি তাকে বাতিল করেছেন? তা অজ্ঞাত থাকার কারণেই তা কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্যের বিরোধী কি না, তা বুঝা সম্ভব হয়ে উঠে না। আকীদার ক্ষেত্রে এরূপ সংক্ষিপ্ত কিংবা অস্পষ্ট কথাকে সমর্থন কিংবা বর্জন না করে নিরব থাকা বাঞ্চনীয়। বিনা ইলমে কথা বলা অন্যায়। যে কথার পক্ষে কুরআন ও হাদীছের দলীল আছে, সেটিই প্রকৃত ইলম। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সত্যবাণী নিয়ে এসেছেন, তাই আমাদের জন্য উপকারী।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্যদের কথার মধ্যেও ইলম রয়েছে। তবে তা দ্বীনি বিষয়ের ইলম নয়; বরং তা পার্থিব জীবনের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াদির ইলম। যেমন ডাক্তারী বিদ্যা, হিসাব বিজ্ঞান এবং কৃষি বিজ্ঞান ইত্যাদি। কিন্তু আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞান এবং দ্বীনি বিষয়াদির ব্যাপারে কথা হলো তা কেবল রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেই গ্রহণ করতে হবে।
[16]. ছহীহ: শারহুস সুন্নাহ ১২১।