কুরআন ও সুন্নাহর তরীকা বাদ দিয়ে দ্বীনের মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার অন্য কোনো তরীকা আছে কি? রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার ছাহাবীদের ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে কিভাবেই আল্লাহর কিতাবের ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? অথচ কুরআন ছাহাবীদের ভাষাতেই নাযিল হয়েছে। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَالَ فِي الْقُرْآنِ بِرَأْيِهِ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ»
‘‘যে ব্যক্তি নিজের মত দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা করলো, সে নিজের ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিল’’।[7] অন্য বর্ণনায় এসেছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَالَ فِي الْقُرْآنِ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ»
‘‘যে ব্যক্তি ইলম ছাড়াই কুরআনের তাফসীর করলো, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়’’।[8]
আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী, وَفَاكِهَةً وَأَبًّا ‘‘নানা জাতের ফল ও ঘাস’’। (সূরা আবাসা: ৩১) অর্থাৎ তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘আবব’ কাকে বলা হয়? জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে না জেনে কথা বললে, কোন্ আকাশ আমাকে ছায়া দিবে? কোন্ যমীন আমাকে আশ্রয় দিবে?
আল্লাহ তা‘আলার দিদারকে সূর্য ও চন্দ্র দেখার সাথে তুলনা করার অর্থ এ নয় যে, চন্দ্র ও সূর্যকে আল্লাহর সাথে সাদৃশ্য প্রদান করা হয়েছে। বরং এখানে মেঘহীন আকাশে দিনের বেলা সূর্য ও রাতে পূর্ণিমার উজ্জ্বল চন্দ্র দেখার সাথে আল্লাহ তা‘আলার দিদারের তুলনা করা হয়েছে। মেঘহীন আকাশে সূর্য দেখতে এবং পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখতে যেমন কোনো অসুবিধা হয় না, ঠিক তেমনি আল্লাহকে দেখতে কোনো অসুবিধা হবে না। এক দৃশ্যের সাথে অন্য দৃশ্যের সাথে তুলনা করা হয়নি। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাকে চন্দ্র-সূর্যের সাথে তুলনা করা হয়নি। কারণ আল্লাহ তা‘আলার কোনো তুলনা নেই। এখান থেকে সৃষ্টির উপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়ার দলীল পাওয়া যায়। সাএা সামনি ও মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া দৃষ্টিপাত করার ধারণা অসম্ভব। আর যারা বলে, আল্লাহকে দেখা যাবে, তবে কোনো দিকে নয়, সে যেন তার জ্ঞান-বুদ্ধিকে সংশোধন করে নেয়। সে সম্ভবত নিজের জ্ঞানকেই বড় মনে করেছে এবং আত্ম অহমিকায় লিপ্ত। অথবা তার বিবেক-বুদ্ধি ও বোধশক্তির মধ্যে সমস্যা রয়েছে। আর যে ব্যক্তি বলবে, আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা যাবে, তবে দর্শক আল্লাহকে সামনেও দেখবে না, পিছনেও না, ডানেও না, বামেও না, উপরেও না এবং নীচেও না, প্রত্যেক সুস্থ স্বভাব-প্রকৃতি ও বুঝশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিই তার এ কথার প্রতিবাদ করবে।
এ জন্যই মুতাযেলারা আশায়েরা সম্প্রদায়ের লোকদেরকে বলেছে, তোমরা যেহেতু আল্লাহর সত্তাগত সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করেছো, তাই তোমাদের উপর আল্লাহর দিদারকেও অস্বীকার করা আবশ্যক। কেননা মুখোমুখী হওয়া ব্যতীত ও দিক সাব্যস্ত করা ছাড়া তো দেখা সম্ভব নয়।
প্রকৃত কথা হলো আমাদের দৃষ্টিশক্তি দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখতে অক্ষম বলেই আমরা দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখিনি। এ জন্য নয় যে, আল্লাহকে দেখা অসম্ভব। এ সূর্যের প্রখর আলোর দিকে যখন কেউ দৃষ্টি দেয়, তখন তার দৃষ্টি দুর্বল ও নত হয়ে যায়। সূর্য দেখা অসম্ভব, এ কারণে নয়; বরং দর্শকের দুর্বলতার কারণে। আল্লাহ তা‘আলা যখন আখেরাতে বনী আদমকে শক্তিশালী ও পূর্ণ করে সৃষ্টি করবেন, তখন তারা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে সক্ষম হবে। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা যখন তুর পাহাড়ের উপর জ্যোতি প্রকাশ করলেন, তখন তার নূর তুর পাহাড়কে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল এবং মূসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে মূসা বললেন,
خَرَّ مُوسَى صَعِقًا فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ سُبْحَانَكَ تُبْتُ إِلَيْكَ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُؤْمِنِينَ
মূসা বেহুশ হয়ে পড়ে গেল। অতঃপর যখন তার হুস আসল তখন সে বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান, আমি আপনার নিকট তাওবা করলাম এবং আমি মুমিনদের মধ্যে প্রথম।’ (সূরা আরাফ: ১৪৩)
একটি হাদীছে কুদুসীতে এসেছে, মুসা আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহর দর্শন প্রার্থনা করলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
يا موسى لن ترانى انه لن يرانى حى الا مات ولا يابس الاتدهده
হে মুসা! তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। জীবিত কোনো প্রাণী আমাকে দেখা মাত্রই মারা যাবে এবং কোনো শুকনো বস্তুর উপর আমার জ্যোতি পড়লেই তাতে প্রকম্পন সৃষ্টি হবে।
সুতরাং মানুষ ফেরেশতাদেরকেও তাদের আসল আকৃতিতে দেখতে অক্ষম। তবে আল্লাহ যাকে শক্তিশালী করেছেন, তিনিই কেবল তাদেরকে তাদের আসল আকৃতিতে দেখার ক্ষমতা রাখেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শক্তিশালী করার কারণেই তিনি জিবরীল আলাইহিস সালামকে তার আসল আকৃতিতে দু’বার দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَقَالُوا لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْهِ مَلَكٌ وَلَوْ أَنزَلْنَا مَلَكًا لَّقُضِيَ الْأَمْرُ ثُمَّ لَا يُنظَرُونَ
‘‘তারা বলে, এ নাবীর কাছে ফেরেশতা পাঠানো হয় না কেন? যদি ফেরেশতা পাঠাতাম, তাহলে এতদিনে ফায়সালা হয়ে যেতো, তখন তাদেরকে অবকাশ দেয়া হতো না’’। (সূরা আনআম: ৮)
অনেক সালাফ বলেছেন, ফেরেশতাদেরকে তাদের আসল আকৃতিতে দেখা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি যদি তাদের জন্য ফেরেশতা অবতীর্ণ করতাম, তাহলে মানুষের আকৃতিতেই অবতীর্ণ করতাম। এতে তারা সন্দেহে পড়ে যেতো। তারা বলতো, তিনি কি মানুষ? না ফেরেশতা? আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে যেসব নেয়ামত দান করেছেন, তার মধ্যে এও রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল পাঠিয়েছেন।
মুতাযেলারা আশায়েরা সম্প্রদায়কে আল্লাহর দিদার অস্বীকারে বাধ্য করতে চাচ্ছে এ কারণে যে, তারা এবং মুতাযেলারা এ মাস‘আলায় একমত যে, আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরে নন, বাইরেও নন, ডানেও নন, বামেও নন, সামনেও নন, পিছনেও নন উপরেও নন এবং নীচেও নন।[9]
যে ব্যক্তি এমন কিছুর অস্থিত্বে বিশ্বাস করবে, যা দেখা যায়, কিন্তু কোনো দিকে নয়, বিবেকবান লোকের মতে তার কথা ঐ ব্যক্তির কথার মতই, যে স্বনির্ভর এমন বস্তুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করলো, যা দেখা যায় না এবং তা কোনো দিকেও নয়।
আল্লাহ তা‘আলা কোনো দিকে নয়, -এ অযুহাত দেখিয়ে যারা আল্লাহর দিদারকে অস্বীকার করে, তাদেরকে বলা হবে, তুমি কি ‘দিক’ দ্বারা কোনো অস্বিত্বশীল জিনিস বুঝাতে চাচ্ছো? না কি অস্তিত্বহীন কোনো বস্তু বুঝাতে চাচ্ছো? তারা যদি অস্তিত্বশীল কোনো জিনিস বুঝাতে চায়, তাহলে উহ্য ব্বিরণটি হবে এমন: كُلُّ مَا لَيْسَ فِي شَيْءٍ مَوْجُود لَا يُرَى ‘‘যে জিনিস অন্য জিনিসের মধ্যে প্রবিষ্ট নয়, তা দেখা যায় না’’। এ ভূমিকাটি সঠিক নয়। কোনো কিছু দেখার জন্য তাকে অস্থিত্বশীল অন্য কোনো জিনিসের মধ্যে ঢুকিয়েই দেখতে হবে, তা জরুরী নয়। কারণ এর পক্ষে কোনো দলীল নেই। বরং তা সম্পূর্ণ বাতিল। কেননা সৃষ্টিজগতের ছাদ দেখা সম্ভব। আর সৃষ্টিজগৎ অন্য সৃষ্টিজগতের মধ্যে প্রবিষ্টও নয়। অর্থাৎ সৃষ্টিজগতের ছাদকে অন্য সৃষ্টির মধ্যে না ঢুকিয়ে সরাসরি দেখা সম্ভব।
আর যদি বলা হয় দিক একটি অস্তিত্বহীন বিষয়, আর এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অভিমত। তারা বলেছেন, দিক একটি আপেক্ষিক বিষয়; এটি স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর কোনো সৃষ্টি নয়। অর্থাৎ অন্যের দিকে সম্বন্ধ করা ব্যতীত দিক শব্দটি কোনো অর্থ প্রদান করে না। পীপড়া যখন হাটে তখন সে অন্যান্য কীট-পতঙ্গের তুলনায় নীচেই থাকে। পীপড়া এবং অন্যান্য পোকা-মাকড়ের চেয়ে আমরা উপরে।
এখানে আরেকটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, শুধু ডান, শুধু বাম, কিংবা শুধু উপর বললে কিছুই বুঝা যাবে না। যতক্ষণ না আপনি উল্লেখ করেবেন যে, যায়েদের ডান, করীমের বাম, গাছের উপর, ছাদের নীচ ইত্যাদি। সুতরাং দিক বলতে কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্বশীল জিনিস নেই। ডান বলতে কোনো জিনিস নেই, বাম বলতে কিছুই নেই, উপর বলতে কোন সৃষ্টি নেই এবং নীচ বলতেও কিছুই নেই। এ সবগুলো আপেক্ষিক ও তুলনামূলক বিষয়। সুতরাং এটি অমুকের ডান দিকে, ঐটি অমুকের বাম দিকে, এটি আমার উপরে এবং এটি তার নীচে। দিক শব্দটি সাধারণত এভাবেই ব্যবহার হয়।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টির উপরে এবং সকল সৃষ্টির উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সমুন্নত হওয়া সুসাব্যস্ত। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদের এটি সাব্যস্ত করা থেকে আবশ্যক হয় না যে, আল্লাহ তা‘আলা অস্তিত্বশীল কোনো পরিমন্ডলে সীমাবদ্ধ হয়ে আছেন, যাকে দিক বলা হয়। তবে এ কথা সঠিক যে তিনি সকল মাখলুক থেকে উপরের দিকে। অথচ দিক এমন কোনো অনুভবযোগ্য স্বতন্ত্র অস্তিত্বশীল বাস্তব জিনিস নয়, যেখান থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাকে দেখা যাবে।
মুতাযেলাদের কথা হলো, যদি বলা হয় মুমিনগণ আল্লাহ তা‘আলাকে দেখবে তাহলে তার জন্য দিক সাব্যস্ত করা আবশ্যক হয়। তাদের এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। কেননা দিক একটি আপেক্ষিক বিষয়। আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা যাবে এবং তাকে দেখা সম্ভব। শরীয়তের দলীল ও বিবেক-বুদ্ধির দলীলের মাধ্যমে এটি সাব্যস্ত হয়েছে। জান্নাতীদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা যেসব নেয়ামত তৈরী করে রেখেছেন, তার মধ্যে এটিই সর্বোত্তম নেয়ামত। কোনো মাখলুক যখন অন্য কোনো জিনিস দেখে, সে অবশ্যই কোনো না কোনো দিকেই দেখে। আল্লাহ তা‘আলাকে কিয়ামতের দিন মুমিনগণ কোন্ দিকে দেখবে? সহজ কথা হলো, আল্লাহর কাছে দুআ করার সময় যে দিকে হাত উঠানো হয়, সেদিকেই তাকে দেখা যাবে। অর্থাৎ উপরে দেখা যাবে। জান্নাতের অধিবাসী মুমিনগণ উপরের দিকে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখবে। তবে তিনি কোনো দিক দ্বারা পরিবেষ্টিত ও সীমাবদ্ধ হওয়ার বহু উর্ধ্বে। উপরে আমরা বলেছি, দিক বলতে স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর কোনো সৃষ্টি নেই। সুতরাং যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির উপরে সমুন্নত হলে তিনি কোনো একটি দিক ও সীমার মধ্যে সীমায়িত হয়ে যান, তাদের কথা বাতিল। জাহমিয়া, মুতাযেলা, আশায়েরা ও মাতুরিদী আক্বীদাহর অনুসারীরা তাদের মস্তিস্ক প্রসূত কল্পনা থেকেই এহেন কথা বলে থাকে।
আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত থেকে যারা দ্বীনের মূলনীতি সম্পর্কিত জ্ঞান আহরণ করে না, তারা কিভাবে দ্বীনের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে কথা বলে?! তারা কেবল অমুক অমুকের কাছ থেকেই জ্ঞান অর্জন করে থাকে। তারা কুরআনকে জ্ঞান অর্জনের উৎস মনে করলেও রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ থেকে তারা উহা ব্যাখ্যা গ্রহণ করে না এবং তাতে দৃষ্টিও প্রদান করে না। এমনকি মুহাদ্দিছদের দ্বারা চয়নকৃত নির্ভরযোগ্য রাবীদের মাধ্যমে ছাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসরণকারী তাবেঈদের থেকে যে বর্ণনা এসেছে, তারা তাতেও দৃষ্টি দেয় না। আর যাদের মাধ্যমে কুরআন বর্ণনা করা হয়েছে, তারা শুধু কুরআনের শব্দ বর্ণনা করেনি; বরং তারা শব্দ ও অর্থ উভয়ই বর্ণনা করেছেন। শিশুরা যেমনভাবে শিখে তারা সেভাবে কুরআন শিখতেন না। বরং তারা অর্থসহ কুরআন শিখতেন। যে ব্যক্তি ছাহাবীদের পথ বাদ দিয়ে অন্য পথ অবলম্বন করবে, সে কুরআনের তাফসীর করতে গিয়ে শুধু নিজের এগড়া কথাই বলবে। যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে জ্ঞান অর্জন না করেই নিজের এগড়া কথা বলবে এবং তাকে দ্বীনের অংশ মনে করবে, তার কথা সঠিক হলেও সে গুনাহগার হবে। আর যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে জ্ঞান অর্জন করবে, তার কথা ভুল হলেও সে নেকী পাবে। তবে এ ব্যক্তির কথা যদি সঠিক হয়, তাহলে তার নেকী বহুগুণ বৃদ্ধি করা হবে।
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, وَالرُّؤْيَةُ حَقٌّ لِأَهْلِ الْجَنَّةِ ‘‘আর জান্নাতীদের জন্য আল্লাহকে দেখার বিষয়টি সত্য। এখানে বিশেষভাবে মুমিনদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, কেবল মুমিনরাই আল্লাহ তা‘আলাকে দেখবে। অন্যরা দেখবে না। কোনো সন্দেহ নেই যে, জান্নাতবাসীগণ তাদের প্রভুকে জান্নাতে দেখবে। ঠিক তেমনি জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্বে তারা হাশরের ময়দানেও আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে। ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ছহীহ সূত্রে এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর মধ্যে উক্ত কথার প্রমাণ মিলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُ سَلَامٌ
‘‘যেদিন তারা তার সাথে সাক্ষাত করবে, তাদের অভ্যর্থনা হবে সালামের মাধ্যমে’’। (সূরা আহযাব: ৪৪)
হাশরের ময়দানের সকলেই আল্লাহ তা‘আলাকে দেখবে কি না, এ ব্যাপারে তিনটি অভিমত রয়েছে।
(১) হাশরের ময়দানে অবস্থানকারীদের মধ্যে শুধু মুমিনরাই আল্লাহ তা‘আলাকে দেখবে।
(২) মুমিন-কাফের সকলেই দেখবে। অতঃপর কাফেরদের সামনে পর্দা পড়ে যাবে। এরপর তারা আর আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে না।
(৩) কাফেররা ব্যতীত মুমিন ও মুনাফিকরা দেখতে পাবে। এমনি হাশরের মাঠের সকলের সাথেই আল্লাহ তা‘আলা কথা বলবেন কি না, সে ব্যাপারেও মতভেদ রয়েছে।
উম্মতে মুহাম্মাদীর সকল লোকই এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে, দুনিয়াতে স্বীয় চোখ দিয়ে কেউ আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে না। আমাদের নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলাকে দেখেছেন কিনা সে ব্যাপারেই কেবল আলেমগণ মতভেদ করেছেন। তাদের কেউ বলেছেন, তিনি স্বীয় চোখ দিয়ে আল্লাহকে দেখেননি। আবার কেউ বলেছেন, তিনি দেখেছেন। কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ তার কিতাব আশ্ শিফার মধ্যে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলাকে দেখেছেন কি না এ ব্যাপারে ছাহাবী এবং তাদের পরবর্তী যামানার আলেমদের মতভেদ বর্ণনা করেছেন। আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রভুকে কপালের চোখ দিয়ে দেখার কথাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছেন। মাসরুক যখন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি তার প্রভুকে দেখেছেন? আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তখন বললেন, তোমার কথা শুনে আমার শরীরের পশম খাড়া হয়ে গেছে। অতঃপর তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তোমাকে বলবে, মুহাম্মাদ তার প্রভুকে দেখেছে, সে মিথ্যুক। অতঃপর কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ বলেন, এক দল লোক আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার অনুরূপ কথা বলেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকেই এ কথা প্রসিদ্ধ রয়েছে। তবে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে দুই ধরণের কথা এসেছে। একদল মুহাদ্দিছ, ফকীহ এবং মুতাকাল্লিম মিরাজের রাতে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আল্লাহর দিদার হওয়ার কথা অস্বীকার করেছে। তারা আরো বলেছেন যে, দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখা অসম্ভব।
ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রভুকে কপালের চোখ দিয়ে দেখেছেন।[10] তবে আতা রহিমাহুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রভুকে অন্তরের চোখ দিয়ে দেখেছেন। অতঃপর কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ এ বিষয়ে আরো অনেক মতামত ও উপকারী বিষয় বর্ণনা করেছেন।
অতঃপর কাযী ইয়ায রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমাদের নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য তার প্রভুর দিদার আবশ্যক হওয়া এবং এ কথা বলা যে, তিনি তাকে নিজ চোখে দেখেছেন, এ ব্যাপারে কোনো অকাট্য দলীল নেই। সূরা নাজমের আয়াত দু’টিই হলো এ মতের মূলভিত্তি। কিন্তু আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যায় রয়েছে আলেমদের অনেক মতভেদ। তবে আয়াত দু’টির মাধ্যমে বুঝা যায় যে, আল্লাহকে দেখা সম্ভব।
সুতরাং কাযী ইয়ায রাহিমাহুল্লাহু এ ব্যাপারে যা বলেছেন, তাই সত্য ও সঠিক। দুনিয়াতেও আল্লাহকে দেখা সম্ভব।[11] কেননা দুনিয়াতে যদি আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা সম্ভব না হতো, তাহলে মুসা আলাইহিস সালাম কখনই আল্লাহকে দেখার আবদার করতেন না।[12] তবে এমন কোনো দলীল পাওয়া যায় না যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রবকে কপালের চোখ দিয়ে দেখেছেন। বরং ছহীহ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রভুকে দেখেননি। ছহীহ মুসলিমে আবু যার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম,
«هَلْ رَأَيْتَ رَبَّكَ قَالَ نُورٌ أَنَّى أَرَاهُ»
‘‘আপনি কি আপনার প্রভুকে দেখেছেন? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর নূর দেখেছি। তাকে দেখবো কিভাবে?[13] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি একটি নূর দেখেছি’’।
ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ আবু মুসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণনা করেন যে,
قَامَ فِينَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِخَمْسِ كَلِمَاتٍ فَقَالَ إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَنَامُ وَلَا يَنْبَغِي لَهُ أَنْ يَنَامَ يَخْفِضُ الْقِسْطَ وَيَرْفَعُهُ يُرْفَعُ إِلَيْهِ عَمَلُ اللَّيْلِ قَبْلَ عَمَلِ النَّهَارِ وَعَمَلُ النَّهَارِ قَبْلَ عَمَلِ اللَّيْلِ حِجَابُهُ النُّورُ لَوْ كَشَفَهُ لَأَحْرَقَتْ سُبُحَاتُ وَجْهِهِ مَا انْتَهَى إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ
‘‘একদা নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে পাঁচটি কথা বললেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা নিদ্রা যান না। নিদ্রা যাওয়া তার জন্য সমিচীন নয়। তিনি ন্যায় দন্ডের পাল্লা নামান এবং উঠান। দিবসের আমলের পূর্বেই তার নিকট রাতের আমলসমূহ উঠানো হয় এবং রাতের আমলের পূর্বেই দিনের আমল উঠানো হয়। তার পর্দা হচ্ছে নূর। তিনি যদি তা উন্মুক্ত করেন তার চোখের দৃষ্টি যতদূর যাবে ততদূর পর্যন্ত সকল মাখলুক তার চেহারার আলোতে জ্বলে যাবে’’।[14]
সুতরাং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু যার্কে উদ্দেশ্য করে যেখানে বলেছেন, আমি নূর দেখেছি, তার অর্থ হলো তিনি নূরের পর্দা দেখেছেন। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী, نُورٌ أَنَّى أَرَاهُ ‘‘আমি আল্লাহর নূর দেখেছি, তাকে দেখবো কিভাবে? অর্থাৎ যে নূরটি পর্দা স্বরূপ ছিল, আল্লাহ তা‘আলার দিদার থেকে তাই আমাকে বাধা প্রদান করেছে। আরো খোলাসা করে এভাবে বলা যেতে পারে যে, আমি আল্লাহ তা‘আলাকে কিভাবে দেখতে পাবো? আমার মাঝে এবং তার মাঝে একটি নূরের পর্দার অন্তরায় ছিল। এটিই আমাকে আল্লাহর দিদার থেকে বাধা প্রদান করেছে। এ কথা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিরাজের রাতে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখেননি। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
ইমাম উছমান সাঈদ আদ দারামী রহিমাহুল্লাহ এ বিষয়ে ছাহাবীদের ইজমা হওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রবকে দেখেছেন, এ কথা সাব্যস্ত করার চেয়ে জিবরীলকে দেখা সাব্যস্ত করার প্রতি আমাদের প্রয়োজন বেশী। যদি আল্লাহ তা‘আলাকে দেখার বিষয়টি আরো মহান ও বৃহত্তম। কিন্তু মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত সাব্যস্ত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা আবশ্যক নয়।
[8]. ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করার পর বলেছেন, হাসান সহীহ। তবে শাইখ আলবানী উহাকে যঈফ বলেছেন, দেখুন পূর্বোক্ত তথ্যসূত্র, টিকা নং- ১৬৬।
[9]. অর্থাৎ মুতাযেলারা আশায়েরাদেরকে বলতে চাচ্ছে যে, হে আশায়েরাগণ! তোমরাও যেহেতু আমাদের মতই সৃষ্টির উপর আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করে থাকো, তাই আমাদের ন্যায় আল্লাহর সাক্ষাৎকেও অস্বীকার করো। কারণ সৃষ্টির উপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়া এবং তাকে দেখা, -এ দু’টি মাসআলা একই সূত্রে গাঁথা। যারা বিশ্বাস করে আল্লাহকে দেখা যাবে, মুমিনগণ আল্লাহকে দেখবে, তাদের উপর এটি বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, আল্লাহ তা‘আলা উপরে বা উপরের দিকে রয়েছেন। উপর থেকেই তিনি মুমিনদেরকে জান্নাতে তার চেহারা মোবারকের দিদার প্রদান করবেন। যা দেখে মুমিনগণ পরিতৃপ্ত হবে। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তোমার দিদার থেকে মাহরুম করোনা। আমীন।
[10]. যঈফ, ইবনে খুযাইমাহ
[11]. আলেমগণ এ মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখা সম্ভব। তবে কেও দেখেনি। আল্লামা ড. সালেহ ফাওয়ান বলেন, দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখা সম্ভব। তবে কেউ তাকে দেখার ক্ষমতা রাখে না।
[12]. কেননা কোনো নাবীর জন্যই আল্লাহ তা‘আলার কাছে অসম্ভব বস্তু চাওয়া জায়েয নেই। আর নাবীগণ ভালো করেই জানতেন, আল্লাহ তাআলার কাছে অসম্ভব বস্তু চাওয়া অবৈধ।
[13]. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ১৭৮।
[14]. ছহীহ মুসলিম ১৭৯।