নিশ্চয়ই কুরআন আল্লাহর কালাম, যা আল্লাহর নিকট থেকে কথা হিসেবে শুরু হয়েছে, তবে এর কোনো ধরণ নির্ধারণ করা যাবে না। এ কালামকে তিনি তার রাসূলের প্রতি অহী হিসাবে নাযিল করেছেন। আর ঈমানদারগণ তাকে এ ব্যাপারে সত্যবাদী বলে মেনে নিয়েছে। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, এটি সত্যিই আল্লাহর কালাম, কোনো সৃষ্টির কথার মত সৃষ্টি নয়। অতএব, যে ব্যক্তি কুরআন শুনে তাকে মানুষের কালাম বলে ধারণা করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা তার নিন্দা করেছেন, তাকে দোষারোপ করেছেন এবং তাকে জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, سَأُصْلِيهِ سَقَرَ ‘শীঘ্রই তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো’। (সূরা মুদ্দাসি্সর: ২৬) সুতরাং যে বলে إِنْ هَذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ ‘এটাতো মানুষের কথা ছাড়া আর কিছুই নয়’ আল্লাহ তা‘আলা তাকে সাকার নামক জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করেছেন। অতএব, আমরা জেনে নিলাম ও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলাম যে, এ কুরআন মানুষের সৃষ্টিকর্তার কালাম। আর তা কোনো মানুষের কথার সাথে সাদৃশ্য রাখে না।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

وَإِنَّ الْقُرْآنَ كَلَامُ اللَّهِ، مِنْهُ بَدَا بِلَا كَيْفِيَّةٍ قَوْلًا وَأَنْزَلَهُ عَلَى رَسُولِهِ وَحْيًا وَصَدَّقَهُ الْمُؤْمِنُونَ عَلَى ذَلِكَ حَقًّا وَأَيْقَنُوا أَنَّهُ كَلَامُ اللَّهِ تَعَالَى بِالْحَقِيقَةِ، لَيْسَ بِمَخْلُوقٍ كَكَلَامِ الْبَرِيَّةِ. فَمَنْ سَمِعَهُ فَزَعَمَ أَنَّهُ كَلَامُ الْبَشَرِ فَقَدْ كَفَرَ وَقَدْ ذَمَّهُ اللَّهُ وَعَابَهُ وَأَوْعَدَهُ بِسَقَرَ حَيْثُ قَالَ تَعَالَى: سَأُصْلِيهِ سَقَرَفَلَمَّا أَوْعَدَ اللَّهُ بِسَقَرَ لِمَنْ قَالَ: إِنْ هَذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ عَلِمْنَا وَأَيْقَنَّا أَنَّهُ قَوْلُ خَالِقِ الْبَشَرِ، وَلَا يُشْبِهُ قَوْلَ الْبَشَرِ

নিশ্চয়ই কুরআন আল্লাহর কালাম, যা আল্লাহর নিকট থেকে কথা হিসেবে শুরু হয়েছে, তবে এর কোনো ধরণ নির্ধারণ করা যাবে না। এ কালামকে তিনি তার রাসূলের প্রতি অহী হিসাবে নাযিল করেছেন। আর ঈমানদারগণ তাকে এ ব্যাপারে সত্যবাদী বলে মেনে নিয়েছে। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, এটি সত্যিই আল্লাহর কালাম, কোনো সৃষ্টির কথার মত সৃষ্টি নয়। অতএব, যে ব্যক্তি কুরআন শুনে তাকে মানুষের কালাম বলে ধারণা করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা তার নিন্দা করেছেন, তাকে দোষারোপ করেছেন এবং তাকে জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, سَأُصْلِيهِ سَقَرَ ‘‘শীঘ্রই তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো’’। (সূরা মুদ্দাসি্সর: ২৬) সুতরাং যে বলে إِنْ هَذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ ‘‘এটাতো মানুষের কথা ছাড়া আর কিছুই নয়’’ আল্লাহ তা‘আলা তাকে সাকার নামক জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করেছেন। অতএব, আমরা জেনে নিলাম ও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলাম যে, এ কুরআন মানুষের সৃষ্টিকর্তার কালাম। আর তা কোনো মানুষের কথার সাথে সাদৃশ্য রাখে না।

..............................................................

ব্যাখ্যা: এটি একটি মূল্যবান মূলনীতি এবং দ্বীনের একটি বিরাট মূলভিত্তি। অনেক লোক এ মাস‘আলায় পথভ্রষ্ট হয়েছে। এ ব্যাপারে ইমাম ত্বহাবী যা উল্লেখ করেছেন, তাই সঠিক। যে ব্যক্তি কুরআন-হাদীছ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, সে বুঝতে সক্ষম হবে যে, এ কথাই সত্য ও সঠিক। কোনো প্রকার সন্দেহ ও বাতিল মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যে ফিতরাত (সৃষ্টিগত স্বভাব) পরিবর্তিত হয়ে যায়নি, উহাও সাক্ষ্য প্রদান করে যে, কুরআন আল্লাহর কালাম।

আল্লাহর কালাম সম্পর্কিত মাস‘আলায় আলেমদের মতভেদ

আল্লাহর কালাম বা কথা বলা বিশেষণের মাস‘আলায় আলেমদের নয়টি মত রয়েছে।

(১) আল্লাহর কালাম বলতে এমন অর্থ উদ্দেশ্য, যা সক্রিয় সত্তা (আল্লাহ তা‘আলা) বা অন্য কারো পক্ষ হতে মানুষের অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করে। এটি নাস্তিক, বে-দ্বীন ও দার্শনিকদের মত।

(২) কুরআন আল্লাহর কালাম নয়; বরং এটি মাখলুক। আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার বাইরে একে আলাদা করে সৃষ্টি করেছেন। এটি মুতাযেলাদের মত।[1]

(৩) আল্লাহর কালাম এমন একটি অর্থ, যা আল্লাহর সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত। এটিকেই আল্লাহর আদেশ, নিষেধ ও সংবাদ বলা হয়। আরবীতে আল্লাহর এ কালামকে প্রকাশ করা হলে তাকে কুরআন বলা হয়। ইবরানী ভাষায় ব্যাখ্যা করা হলে তাকে তাওরাত বলা হয়। ইবনে কুল্লাব এবং আশআরীদের মধ্য থেকে যারা তার অনুসরণ করেছে, এটি তাদেরই মত।

(৪) কালামের অক্ষর ও শব্দ রয়েছে, যা আল্লাহ তা‘আলার সত্তার সাথে অনাদিতেই একত্রিত অবস্থায় বিদ্যমান। যুক্তিবাদীদের এক শ্রেণী এবং একদল আহলে হাদীছও এ কথা বলেছেন।

(৫) আল্লাহর কালামের অক্ষর, শব্দ ও আওয়াজ রয়েছে। তবে প্রথমে তিনি কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন না; অতঃপর তিনি নিজের সাথে তাকে মিলিয়েছেন এবং কথা বলেছেন। কার্রামিয়া সম্প্রদায় এবং অন্যরা এ কথা বলেছে।

(৬) আল্লাহর কালাম দ্বারা তার ঐ ইলম উদ্দেশ্য, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং ঐ ইচ্ছা উদ্দেশ্য, যা তার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। মু’তাবার গ্রন্থকার এ কথা বলেছেন। ফখরুদ্দীন রাযিও তার অন্যতম গ্রন্থ মাতালেবে আলীয়াতে এ মতকে সমর্থন করেছেন।

(৭) আল্লাহর কালাম এমন অর্থ বহন করে, যা আল্লাহ তা‘আলার সত্তার সাথে যুক্ত রয়েছে এবং তিনি এটি অন্যের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। আবু মানসুর আল-মাতুরীদি এ কথা বলেছেন।

(৮) আল্লাহর কালাম এমন একটি যৌগিক বিষয়, যা তার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত অনাদি অর্থ এবং তিনি অন্যের মধ্যে যে আওয়াজ সৃষ্টি করেন তার সমন্বয়ে গঠিত। এটিই আবুল মাআলী আল-জুওয়াইনী এবং তার অনুসারীদের মত।

(৯) আল্লাহ তা‘আলা অনাদি থেকেই যখন ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত। তিনি এ বিশেষণের মাধ্যমে এমন আওয়াজের সাথে কথা বলেন, যা শুনা যায়। কথা বলা বিশেষণ আল্লাহ তা‘আলার অনাদি সিফাতের মধ্যে গণ্য। যদিও নির্দিষ্ট শব্দে কথা বলা কাদীম বা অনাদি নয়।[2] আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমামদের থেকে এ কথাই বর্ণিত হয়েছে।

শাইখের উক্তি, وَإِنَّ الْقُرْآنَ كَلَامُ اللَّهِ এখানে إن এর হামযার নীচে জের দিয়ে পড়তে হবে। কারণ এ বাক্যটিকে إِنَّ اللَّهَ وَاحِدٌ لَا شَرِيكَ لَهُ বাক্যের উপর সম্পর্ক করা হয়েছে। অতঃপর শাইখ বলেছেন, وَإِنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ الْمُصْطَفَى এখানেও হামযাহর নীচে জের দিয়ে পড়া হয়েছে। উপরোক্ত তিন স্থানেই হামযাহর নীচে জের দিয়ে পড়া হয়েছে। কারণ এ সবগুলো বাক্যই কাউলের মা’মুল। অর্থাৎ কিতাবের শুরুতে তার উক্তি: نَقُولُ فِي تَوْحِيدِ اللَّهِ إِنَّ الله........ এর আওতাধীন।

অতঃপর শাইখ বলেছেন, كَلَامُ اللَّهِ، مِنْهُ بَدَا بِلَا كَيْفِيَّةٍ قَوْلًا ‘‘আল্লাহর কালাম তার নিকট থেকেই কথা হিসেবে শুরু হয়েছে, তবে এর কোনো ধরণ নির্ধারণ করা যাবে না’’। এতে মুতাযেলা এবং অন্যদের মতবাদের জবাব দেয়া হয়েছে। কেননা মুতাযেলারা মনে করে কুরআন আল্লাহ তা‘আলার নিকট থেকে আসেনি। যেমন উপরে তাদের কথা আলোচিত হয়েছে। তারা বলে থাকে, কালামকে তার দিকে কেবল সম্মানার্থেই সম্বন্ধ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে বাইতুল্লাহ, নাকাতুল্লাহ ইত্যাদি। তারা আল্লাহর কালামকে যথাস্থান থেকে সরিয়েছে। তাদের কথা সম্পূর্ণ বাতিল। কেননা আল্লাহ তা‘আলার দিকে যাকিছু সম্বন্ধ করা হয়, তা দু’প্রকার। (১) অনুভবযোগ্য ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিসসমূহ (২) অর্থ, গুণাবলী ও বিশেষণসমূহ।

অনুভবযোগ্য ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যেসব বস্তু আল্লাহ তা‘আলার দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে, তা কেবল সম্মানার্থেই তার দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে। এগুলোর সবই আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি। যেমন بَيْتِ اللَّهِ، وَنَاقَةِ اللَّهِ (আল্লাহর ঘর, আল্লাহর উটনী) ইত্যাদি। কিন্তু যেসব গুণাবলী আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে, এর বিপরীত। অর্থাৎ তা সৃষ্টি নয়। যেমন আল্লাহর ইলম, আল্লাহর কুদরত, আল্লাহর ইজ্জত, আল্লাহর বড়ত্ব, আল্লাহর অহংকার, আল্লাহর কালাম, আল্লাহর হায়াত, আল্লাহর উলু (সৃষ্টির উপর সমুন্নত হওয়া), আল্লাহর প্রতাপ ইত্যাদি। এসব কিছুই আল্লাহ তা‘আলার সিফাত। এখান থেকে কোনো কিছুই সৃষ্টি নয়।

কথা বলা পূর্ণতার অন্যতম বিশেষণ। আর এটি দ্বারা আল্লাহ তা‘আলাকে বিশেষিত না করা তার সিফাতের মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি সাব্যস্ত করার অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَاتَّخَذَ قَوْمُ مُوسَىٰ مِن بَعْدِهِ مِنْ حُلِيِّهِمْ عِجْلًا جَسَدًا لَّهُ خُوَارٌ أَلَمْ يَرَوْا أَنَّهُ لَا يُكَلِّمُهُمْ وَلَا يَهْدِيهِمْ سَبِيلًا اتَّخَذُوهُ وَكَانُوا ظَالِمِينَ

‘‘মূসার অনুপস্থিতিতে তার জাতির লোকেরা নিজেদের অলংকার দিয়ে বাছুরের মূর্তি তৈরী করলো। তার মুখ দিয়ে গরুর মত হাম্বা হাম্বা আওয়াজ বের হতো। তারা কি দেখতে পেতো না যে, ঐ বাছুর তাদের সাথে কথা বলে না আর তাদেরকে কোনো পথও দেখায় না? এরপর ও তাকে মাবুদে পরিণত করলো। বস্তুত তারা ছিল বড়ই যালেম’’। (সূরা আরাফ: ১৪৮)

সুতরাং বাছুর পূজাকারীরা কুফুরী করলেও তারা আল্লাহ সম্পর্কে মুতাযেলাদের চেয়ে অধিক জানতো। তারা মুসাকে বলেনি যে, তোমার রবও কথা বলতে পারে না। বাছুর ও বাছুর পূজাকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

أَفَلَا يَرَوْنَ أَلَّا يَرْجِعُ إِلَيْهِمْ قَوْلًا وَلَا يَمْلِكُ لَهُمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا

‘‘তারা কি দেখছিল না যে, সে তাদের কথারও জবাব দেয় না এবং তাদের উপকার ও ক্ষতি করার কোনো ক্ষমতাও রাখে না?’’ (সূরা ত্বহা: ৮৯)

এতে বুঝা গেল কথার জবাব না দিতে পারা এবং কথা বলার ক্ষমতা না রাখা এমন ত্রুটি, যা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় যে, বাছুর কখনো ইলাহ হতে পারে না।

আল্লাহ তা‘আলার কালাম নাকোচ করার ব্যাপারে তাদের সর্বোচ্চ দলীল হলো, তারা বলে থাকে, যদি বলা হয় যে, তিনি কথা বলেন, তাহলে তার জন্য মানুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করা এবং তাদের মত দেহ ধারণ করা আবশ্যক হয়।[3]

তাদের জবাবে বলা হবে যে, আমরা যখন বলবো আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য যেভাবে কথা বলা শোভনীয়, তিনি সেভাবেই কথা বলেন, তখনই তাদের এ সন্দেহ বিদূরিত হয়ে যাবে। আপনি কি দেখেন না আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَىٰ أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُم بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

‘‘সেদিন আমি এদের মুখ বন্ধ করে দিবো, এদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং এদের পা সাক্ষ্য দেবে এরা দুনিয়ায় কি উপার্জন করে এসেছে’’। (সূরা ইয়াসীন: ৬৫)

আমরা বিশ্বাস করি কিয়ামতের দিন মানুষের হাত-পা কথা বলবে। তবে আমরা জানি না কিভাবে বলবে। এমনি আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَقَالُوا لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدْتُمْ عَلَيْنَا قَالُوا أَنْطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ

‘‘তারা তাদের শরীরের চামড়াসমূহকে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা জবাব দেবে, আল্লাহই আমাদের বাকশক্তি দান করেছেন যিনি প্রতিটি বস্তুকে বাকশক্তি দান করেছেন’’। (সূরা হা-মীম সাজদাহ: ২১)

এমনি পাথরের তাসবীহ পাঠ, খাবারের কথা, তাসবীহ পাঠ, পাথরের সালাম দেয়া ইত্যাদি। এগুলোর কথা বলা ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। এগুলো মুখ, জিহবা, দাঁত, অক্ষর উচ্চারণের মাখরাজ ছাড়াই কথা বলেছে। যে শ্বাসনালী থেকে আওয়াজ বের হয়, তা ছাড়াই কথা বলেছে। তবে এগুলোর কথা বনী আদমের নিকট পরিচিত কথা ছিল না।

এ দিকে ইঙ্গিত করেই ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, مِنْهُ بَدَا بِلَا كَيْفِيَّةٍ قَوْلًا ‘‘আল্লাহর কালাম তার নিকট থেকেই কথা হিসেবে শুরু হয়ে এসেছে, তবে এর কোনো ধরণ নির্ধারণ করা যাবে না’’। অর্থাৎ তার কাছ থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। তবে আমরা জানি না, তিনি কিভাবে উহার মাধ্যমে কথা বলেছেন। قولا কথার মাধ্যমে শাইখ এ অর্থকেই শক্তিশালী করেছেন। তিনি قولا কে এমন মাসদার হিসাবে ব্যবহার করেছেন, যা প্রকৃত অর্থকেই নির্দিষ্ট করে দেয়।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী: كلم الله موسى تكليما এর মধ্যেও আল্লাহ তা‘আলার কথা বলাকে এমন মাসদারের মাধ্যমে সাব্যস্ত করেছেন, যা রূপক অর্থকে নাকোচ করে দেয়। এভাবে সত্যকে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করার পরও যারা তা থেকে দূরে থাকবে, তাদের জন্য গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

জনৈক মুতাযেলী আলেম সুপ্রসিদ্ধ সাত কারীর অন্যতম কারী আবু আমর ইবনুল আলা রহিমাহুল্লাহকে বললেন, আমি চাই, তুমি আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী:

وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسَى تَكْلِيْماً এর মধ্যে ‘আল্লাহ’ শব্দের শেষ অক্ষরে যবর দিয়ে পাঠ করবে। যাতে করে অর্থ হয় যে, মুসা আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন’’, আল্লাহ তা‘আলা নন।[4] তখন আমর বললেন, ঠিক আছে আমি তোমার চাহিদা মোতাবেক এ আয়াত পড়ে দেবো, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী কিভাবে পাঠ করবে, যেখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

وَلَمَّا جَاءَ مُوسَى لِمِيقَاتِنَا وَكَلَّمَهُ رَبُّهُ

‘‘অতঃপর মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলেন এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন’’। (সূরা আরাফ: ১৪৩)

এতে সে মুতাযেলী আলেম হতবুদ্ধি হয়ে গেল। অর্থাৎ আমর রহিমাহুল্লাহ মুতাযেলীকে দেখিয়ে দিলেন যে, وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسَى تَكْلِيْماً এর মধ্যে আল্লাহ শব্দের উপর যবর দিয়ে পাঠ করে আয়াতটি বিকৃতি করে আরবী ব্যকরণের কোনো পদ্ধতিকে দলীল হিসাবে দাড়া করা সম্ভব হলেও وَكَلَّمَهُ رَبُّهُ আয়াতাংশকে কোনোভাবেই বিকৃতি করা সম্ভব নয়। কেননা আরবী ব্যকরণে এমন কোনো নিয়ম নেই যে, وَكَلَّمَهُ رَبُّهُ এর মধ্যে ربه এর মধ্যকার ‘বা’ অক্ষরের উপর যবর দিয়ে পড়া যেতে পারে। যাতে করে এখানেও এ অর্থ হয় যে, মুসা তার রবের সাথে কথা বলেছেন, তার রব তার সাথে কথা বলেননি।

[1]. তাদের মতে কালামকে কেবল সম্মানার্থেই আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে। যেমন সম্মানার্থে বলা হয়, بيت الله, ناقة الله ইত্যাদি।

[2]. অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার কালাম একদিক থেকে কাদীম এবং অন্যদিক থেকে কাদীম নয়। তিনি অনাদি থেকেই কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত, তার কালামের কোনো শুরু ও শেষ নেই। যেমন তার সত্তার কোনো শুরু ও শেষ নেই। তিনি সর্বদাই কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত। এ দিক থেকে তার কালাম কাদীম বা অনাদি সিফাত। কিন্তু নির্দিষ্ট শব্দ ও আওয়াজের মাধ্যমে তার কথা কাদীম নয়। অর্থাৎ এটি তার ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত। যখন ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা তিনি কথা বলেন।

[3]. অর্থাৎ তাদের মতে যদি বলা হয়, আল্লাহ তা‘আলা কথা বলেন, তাহলে তার জন্য মানুষের মত জিহবা, দাঁত, ঠোঁট কণ্ঠণালী থাকা আবশ্যক হয়। শাইখ ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ তাদের এ কথার যে জবাব দিয়েছেন, তাদের প্রতিবাদের জন্য উহাই যথেষ্ট। আল্লাহ তা‘আলার সিফাতসমূহ অস্বীকার করার ক্ষেত্রে বিদ‘আতীরা একই কথা বারবার বলে থাকে। তারা এমন কিছু আকলী যুক্তি পেশ করে থাকে, যা তারা তাদের ত্রুটিযুক্ত বিবেক-বুদ্ধির উপর নির্ভর করেই তৈরী করেছে। তারা বলে থাকে, আল্লাহর জন্য এ সিফাত সাব্যস্ত করা হলে এটি আবশ্যক হয়, ওটি আবশ্যক হয়........ইত্যাদি।

এখানে ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল বিজেতা সুলতান মাহমুদ বিন সুবক্তগীনের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। তার দরবারে একদা আশায়েরা আলেম ইবনে ফাওরাক প্রবেশ করলেন। তিনি একবার সুলতানের দরবারে আলোচনা করছিলেন। সে সময় সুলতানের দরবারে একজনু সুন্নী আলেমও ছিলেন। তখন ইবনে ফাওরাককে আল্লাহ তা‘আলার উলু (সৃষ্টির উপর সমুন্নত হওয়া) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উহা অস্বীকার করলেন। তিনি সুলতানকে যুক্তি দেখিয়ে বললেন, আপনি যদি আল্লাহর জন্য উপর সাব্যস্ত করেন, তাহলে তার জন্য নীচ সাব্যস্ত করাও আবশ্যক হয়। সুলতান ইলমে কালাম এবং আকলী যুক্তি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। তিনি তার কথার স্বভাব প্রসূত ও সহজ-সরল জবাব প্রদান করতে গিয়ে বললেন, আমার উপর কিছুই আবশ্যক হয় না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি উপরে। এ ব্যাপারে আমি তাই বলবো, যা আল্লাহ তাআলা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে আমার উপর যদি আবশ্যক কিছু থাকে, তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার জন্যও উহা আবশ্যক হয়। কারণ তিনিই উহা বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলার উপর কিছু আবশ্যক করার কেউ আছে কি? কেউ কি বলতে পারবে, হে আমার রব! তুমি তোমার নিজের জন্য উপর সাব্যস্ত করেছো, সুতরাং তোমার উপর তোমার সত্তার জন্য নীচ সাব্যস্ত করাও আবশ্যক? নাউযুবিল্লাহ। সুতরাং সুলতান মাহমুদ যে ফিতরাতী জবাব দিয়েছেন আল্লাহর সিফাত নাকোচকারী বিদ‘আতীদের সকল সন্দেহের সেটিই সঠিক জবাব। সুতরাং আমরা যখন বলবো, এটি হলো আল্লাহর কথা ও তার রাসূলের কথা, তখন আমাদের এ কথার সামনে তাদের বিবেক-বুদ্ধির আবশ্যকীয় যুক্তিগুলো ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর কিছু আবশ্যক করতে চায়, তারা তা করুক। কিন্তু আমাদের উপর আল্লাহর কালাম ও রাসূলের কালামের উপর ঈমান আনয়ন করা ব্যতীত অন্য কিছুই আবশ্যক নয়।

[4]. আল্লাহ তা‘আলার কথা বলা বিশেষণকে অস্বীকার করার জন্যই মুতাযেলী আলেম এ কৌশল অবলম্বন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সুন্নী কারী ও আলেমের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার সামনে বিদ‘আতীর অপকৌশল ধরা পড়ে।
জান্নাতবাসীদের সাথে আল্লাহর কথোপকথন।

আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে এমন অনেক দলীল রয়েছে, যা প্রমাণ করে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন জান্নাতবাসী এবং অন্যান্যদের সাথে কথা বলবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, سَلَامٌ قَوْلًا مِّن رَّبٍّ رَّحِيمٍ ‘‘দয়াময় রবের পক্ষ থেকে তাদেরকে সালাম বলা হবে’’। (সূরা ইয়াসীন: ৫৮)

জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জান্নাতবাসীগণ যখন নেয়ামতের মধ্যে থাকবে, তখন তাদের জন্য একটি নূর প্রকাশিত হবে। তারা দৃষ্টি উঠাবে। দৃষ্টি উঠিয়ে তারা দেখবে যে, তাদের মহান প্রভু উপর থেকে তাদের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন। তখন তাদের প্রভু বলবেন, السلام عليكم يا أهل الجنة এটিই হলো আল্লাহ তা‘আলার উপরোক্ত বাণীর ব্যাখ্যা। এরপর তারা যতক্ষণ আল্লাহ তা‘আলার দিকে তাকিয়ে থাকবে, ততক্ষণ জান্নাতের আর কোনো নেয়ামতের দিকে তাকিয়েই দেখবে না। এমনকি আল্লাহ তা‘আলার নূর তাদের থেকে আড়াল হওয়ার পরও তার বরকত ও নূর অবশিষ্ট থাকবে’’।[1]

ইমাম ইবনে মাজাহ এবং অন্যান্য ইমামগণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। এ হাদীছে আল্লাহ তা‘আলার জন্য কথা বলা বিশেষণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। সে সঙ্গে আরো সাব্যস্ত করা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন মুমিনগণ আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে। এখান থেকে আরো জানা গেল যে, আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টির উপরে।

সুতরাং এত দলীল থাকা সত্ত্বেও কিভাবে বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলার সকল বাণী মিলে মূলতঃ একটিই। অর্থাৎ তিনি কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত এবং তার কথা তার সত্তার সাথেই প্রতিষ্ঠিত। এমনটি নয় যে, তিনি একাধিকবার একাধিক নাবী-রাসূলের সাথে কথা বলেছেন কিংবা কিয়ামতের দিন মুমিনদের সাথে কথা বলবেন। এ কথা সম্পূর্ণ ভুল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَنًا قَلِيلًا أُوْلَئِكَ لَا خَلَاقَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ وَلَا يُكَلِّمُهُمْ اللَّهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ

‘‘যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং প্রতিজ্ঞা সামান্য মূল্যে বিক্রি করে আখেরাতে তাদের কোন অংশ নেই। তাদের সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ কথা বলবেন না। তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টিতে তাকাবেন না। আর তাদেরকে গুনাহ থেকে পবিত্রও করবেন না। বস্তুত তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক আযাব’’। (সূরা আলে ইমরান: ৭৭)

সুতরাং যারা সামান্য মূল্যে আল্লাহর অঙ্গিকার বিক্রি করে, তাদের সাথে কথা না বলার মাধ্যমে তিনি তাদেরকে অপমানিত করবেন। এখানে উদ্দেশ্য হলো, তাদের সাথে এমন কথা বলবেন না, যার মাধ্যমে তাদেরকে সম্মানিত করা হবে। আয়াতের এ ব্যাখ্যাই সঠিক। কেননা অন্য আয়াতে রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামীদেরকে বলবেন,

قَالَ اخْسَئُوا فِيهَا وَلَا تُكَلِّمُونِ

‘‘তোমরা হীন অবস্থায় এখানেই পড়ে থাকো এবং আমার সাথে কথা বলো না’’। (সূরা মুমিনুন: ১০৮)

আল্লাহ তা‘আলা যদি তার মুমিন বান্দাদের সাথে কথা না বলেন, তাহলে এতে মুমিনগণ ও তার শত্রুগণ সমান হয়ে যাবে এবং তার শত্রুদের সাথে কথা বলা বর্জন করার মধ্যে কোনো ফায়দা থাকে না। ইমাম বুখারী তার ছহীহ গ্রন্থে বলেন,

باب كلام الرب تبارك وتعالى مع أهل الجنة ‘‘অধ্যায়: জান্নাতবাসীদের সাথে আল্লাহ তা‘আলার কথা বলা’’। এ অধ্যায়ে তিনি একাধিক হাদীছ বর্ণনা করেছেন। জান্নাতবাসীদের সর্বোত্তম নেয়ামত হলো আল্লাহ তা‘আলার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা এবং মুমিনদের সাথে তার কথা বলা। সুতরাং এটিকে অস্বীকার করা জান্নাতের মূল, সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম নেয়ামতকে অস্বীকার করার নামান্তর। যা ব্যতীত জান্নাতবাসীদের জীবন পরিপূর্ণ হবে না।

[1]. ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহ হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুন: শাইখের তাহকীকসহ শরহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ১৪১।
যারা কুরআনকে মাখলুক বলে তাদের জবাব:

اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ ‘‘প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ’’ এ কথার মাধ্যমে দলীল গ্রহণ করে মুতাযেলা বলেছে যে, كل شيئ এর মধ্যে যে عموم (ব্যাপকতা) রয়েছে কুরআনও তার অন্তর্ভুক্ত। তাই কুরআনও সৃষ্টি। এটি অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। মুতাযেলারা كل (প্রত্যেক) শব্দের ব্যাপকতার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার কালাম বা কুরআনকে ঢুকিয়ে দিয়ে খুবই নিকৃষ্ট কাজ করেছে।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তারা বান্দাদের কর্মসমূহ আল্লাহর সৃষ্টিসমূহের অন্তর্ভুক্ত হলেও তারা তাকে كل (প্রত্যেক) শব্দের ব্যাপকতার অন্তর্ভুক্ত মনে করে না। তারা এ ব্যাপারে বলে যে, বান্দারাই তাদের সকল কর্মের স্রষ্টা। আল্লাহ তা‘আলা এগুলো সৃষ্টি করেন না। তারা كل (প্রত্যেক) শব্দের ব্যাপকতা থেকে বান্দার আমলসমূহ বের করে দিয়ে আল্লাহর কালামকে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অথচ আল্লাহর কালাম আল্লাহর সিফাত সমূহেরই অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহ তা‘আলার কালাম ও কথা বলা বিশেষণের মাধ্যমে সবকিছু সৃষ্টি হয় এবং তার আদেশেই সবকিছু সংঘটিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

‘‘তিনি সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজী সৃষ্টি করেছেন। সবাই তার নির্দেশের আনুগত। জেনে রাখো, সৃষ্টি তারই এবং নির্দেশও তার। আল্লাহ বড়ই বরকতের অধিকারী। তিনি সমগ্র সৃষ্টির মালিক ও প্রতিপালক’’। (সূরা আরাফ: ৫৩)

এখানে আল্লাহর সৃষ্টি ও আদেশের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। আল্লাহর আদেশ যদি তার সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে অন্য একটি আদেশের মাধ্যমে তা সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক হয়। তা আবার আরেকটি আদেশ দ্বারা সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক হয়। এভাবে আবশ্যক হতেই থাকবে, যার কোনো শেষ নেই। এতে তাসালসুল বা সূচনাহীন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকা আবশ্যক হয়। আর এটি সম্পূর্ণ বাতিল। তাদের এ বাতিল কথা থেকে আবশ্যক হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার সকল সিফাতই মাখলুক। তার ইলম, কুদরত ইত্যাদি সকল সিফাতই মাখলুক। এরূপ বিশ্বাস করা সুস্পষ্ট কুফুরী।

সুতরাং اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ ‘‘প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ’’ এ কথার মাধ্যমে দলীল গ্রহণ করে যদি বলা হয় আল্লাহর ইলম একটি জিনিস, তার কুদরত একটি জিনিস এবং তার হায়াতও একটি জিনিস। এগুলো كل (প্রত্যেক) শব্দের ব্যাপকতার মধ্যে শামিল। অতএব এক সময় এগুলোর অস্তিত্ব ছিল না। পরে সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ কথার বহু উর্ধ্বে।

যে কালাম অন্যের দ্বারা প্রকাশিত হয় কিংবা তা থেকে যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের সাথে প্রতিষ্ঠিত, তা কিভাবে আল্লাহর কালাম হতে পারে? যদি তা আল্লাহরই কালাম হয়ে থাকে, তাহলে তিনি জড়বস্তুর মধ্যে যে কালাম সৃষ্টি করেছেন, তাও আল্লাহর কালাম হওয়া আবশ্যক হয়। অনুরূপ প্রাণীজগতের মধ্যে যে কালাম সৃষ্টি করেছেন, তাও আল্লাহ তা‘আলার কালাম হওয়া আবশ্যক হয়। তখন نطق এবং أنطق এর মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকে না। অথচ কিয়ামতের দিন মানুষের চামড়া বলবে,

أَنْطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ ‘‘তারা তাদের শরীরের চামড়াসমূহকে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা জবাব দেবে, আল্লাহই আমাদের বাকশক্তি দান করেছেন যিনি প্রতিটি বস্তুকে বাকশক্তি দান করেছেন’’। এখানে বলা হয়নি যে, نطق الله (আল্লাহ কথা বলেছেন)।

সুতরাং যদি বলা হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার কালাম বলতে ঐ কালাম উদ্দেশ্য, যা তিনি অন্যের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন তাহলে তার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, তিনি সৃষ্টির মধ্যে যেসব কালাম সৃষ্টি করেছেন, তা সবই আল্লাহর কালাম। চাই সেটি মিথ্যা অথবা কুফুরী কিংবা ঠাট্ট্রা-বিদ্রম্নপের কথা হোক। আল্লাহ তা‘আলা এর বহু উর্ধ্বে। সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী লোকেরা সবকিছুর কথাকেই আল্লাহর কথা মনে করে। ইবনে আরাবী বলেন,

وَكُلُّ كَلَامٍ فِي الْوُجُودِ كَلَامُهُ... سَوَاءٌ عَلَيْنَا نَثْرُهُ وَنِظَامُهُ

‘‘সৃষ্টির মধ্যে যত কালাম রয়েছে, তা সবই আল্লাহর কালাম। মানুষ গদ্য আকারে কিংবা পদ্য আকারে যা কিছু বলে, সবই আমাদের নিকট এক রকম। অর্থাৎ সবই আল্লাহর কালাম। (নাউযুবিল্লাহ)

ইবনে আরাবীর এ কথা থেকে আবশ্যক হয় যে, যে সৃষ্টি কথা বলে এবং যা বলে তার কথাই আল্লাহর কথা এবং সেই আল্লাহ। সে হিসাবে ফেরাউনের কথাও আল্লাহর কথা এবং ফেরাউন নিজেও আল্লাহ। (নাউযুবিল্লাহ)

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাফের ইবনে আরাবীর এ কথার মধ্যে গোমরাহী ছাড়া অন্য কিছু নেই। সঠিক কথা হলো কালাম দু’প্রকার। সৃষ্টির কালাম ও স্রষ্টার কালাম। সৃষ্টির সমস্ত কালাম আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে গণ্য। আর স্রষ্টার কালাম সৃষ্টি নয়; বরং তা তার সিফাত।

কাউকে যদি এমন বিশেষণে বিশেষিত করা হয়, যা অন্যের সাথে প্রতিষ্ঠিত, তাহলে চোখ ওয়ালা মানুষকে অন্ধ বলা ঠিক আছে। কেননা অন্যের মধ্যে অন্ধত্ব বিদ্যমান রয়েছে এবং অন্ধকেও চোখ ওয়ালা বলা সঠিক। কারণ অন্যের মধ্যে তো দৃষ্টিশক্তি রয়েছে। সেই সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলাকে ঐসব গুণে গুণান্বিত করাও সঠিক হবে, যা তিনি অন্যের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। যেমন বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন রং, গন্ধ, স্বাদ, লম্বা, খাটো ইত্যাদি সৃষ্টি করেছেন। এগুলো যেহেতু সৃষ্টির বিশেষণ তাই আল্লাহর মধ্যেও তা থাকা আবশ্যক। কারণ তিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন। নাউযুবিল্লাহ

অনুরূপ জবাবের মাধ্যমে ইমাম আব্দুল আযীয মক্কী মুতাযেলা ইমাম বিশর আল মুরাইসীকে মামুনের সামনে অনুষ্ঠিত বিতর্কে পরাজিত করেছেন। আব্দুল আযীয মক্কী প্রথমে শর্ত করেছিলেন যে, কুরআনের আয়াত দ্বারাই কেবল দলীল পেশ করা হবে। বিশর খলীফা মামুনকে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আমার নিকট থেকে কুরআনের দলীল পেশ করার দাবি প্রত্যাহার করা হোক। কুরআনের দলীল বাদ দিয়ে অন্যান্য দলীল দ্বারা বিতর্ক করা হোক। বিশর দৃঢ়তার সাথে আরো বলল, ইমাম আব্দুল আযীয যদি কুরআনের দলীল পেশের দাবি পরিত্যাগ না করেন, তাহলে পরাজয় স্বীকার করে এখনই কুরআনকে মাখলুক বলে স্বীকার করুক। অন্যথায় আমার রক্ত হালাল হয়ে যাবে। অতঃপর আব্দুল আযীয বললেন, আমার পক্ষে কুরআনকে মাখলুক বলা অসম্ভব এবং যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে বিতর্ক করতে অক্ষমতা প্রকাশ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং আমি তোমাকে প্রথম প্রশ্ন করবো? না কি তুমি আমাকে প্রশ্ন করবে? সে বলল, তুমি প্রথমে প্রশ্ন করো। আব্দুল আযীয বলেন, বিশর মনে করেছিল, আমি তাকে কোনো প্রশ্নই করতে পারবো না। যাই হোক আমি বললাম, এ ব্যাপারে তোমাকে অবশ্যই তিনটি কথার যে কোনো একটি কথা স্বীকার করতে হবে।

(১) তোমাকে স্বীকার করতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের মধ্যে কুরআন সৃষ্টি করেছেন (অথচ আমি মনে করি এটি আল্লাহর কালাম) অথবা

(২) তিনি এটিকে স্বনির্ভর করে সৃষ্টি করেছেন অথবা

(৩) তিনি এটিকে অন্যের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। বিশর এ কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে পাশ কেটে গেল এবং বলল, আমি বলছি, আল্লাহ তা‘আলা অন্যসব বস্তুর মতই এটি সৃষ্টি করেছেন।

এবার মামুন আব্দুল আযীযকে বললেন, তুমি এ মাস‘আলার ব্যাখ্যা করো এবং বিশরকে ছাড়ো। কারণ তার জবাব নিঃশেষ হয়ে গেছে। আব্দুল আযীয বললেন, সে যদি বলে আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের মধ্যে কালাম সৃষ্টি করেছেন, তাহলে এটি অসম্ভব। কারণ আল্লাহ তা‘আলা কোনো সৃষ্ট বস্তুর মহল বা স্থান হতে পারেন না। অর্থাৎ সৃষ্টি তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না এবং আল্লাহর সত্তার মধ্যে কোনো সৃষ্ট জিনিস নেই। আর যদি বলে আল্লাহ তা‘আলা অন্যের মধ্যে কালাম সৃষ্টি করেছেন, তাহলে বিবেক-বুদ্ধির যুক্তির দাবিতে আবশ্যক হয় যে, তিনি সৃষ্টির মধ্যে যেসব কালাম সৃষ্টি করেছেন, তা সবই তার কালাম। এটিও অসম্ভব। কেননা এ কথা যে বলবে, তার উপর এটি স্বীকার করাও আবশ্যক যে, প্রত্যেক সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা যেসব কালাম সৃষ্টি করেছেন, তা আল্লাহরই কালাম। আর যদি বলে যে, কালাম একটি স্বনির্ভর বস্তু এবং এটি নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল, তাহলে তাও অসম্ভব। কেননা কথক ছাড়া কথার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমন ইচ্ছুক ছাড়া ইচ্ছার কোনো অস্তিত্ব নেই এবং আলেম ছাড়া ইলমের কোনো অস্তিত্ব নেই। সুতরাং এমন কোনো স্বনির্ভর কালাম নেই, যা নিজে নিজেই কথা বলে। যখন উপরোক্ত সকল দিক মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, আল্লাহর কালাম সৃষ্টি, তখন জানা গেল যে, তা আল্লাহর সিফাত। আব্দুল আযীয আলমক্কী রহিমাহুল্লাহ তার কিতাব আলহায়দাতে এ বিষয়ে যা উল্লেখ করেছেন, সংক্ষিপ্তভাবে তা এখানেই শেষ হলো।

كل (প্রত্যেক) শব্দের মধ্যে যে ব্যাপকতা রয়েছে, তা প্রত্যেক স্থান অনুপাতেই মূল্যায়ন হবে এবং বিভিন্ন আলামত দ্বারা তা জানা যাবে। আপনি কি আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর প্রতি লক্ষ্য করেন নি,

تُدَمِّرُ كُلَّ شَيْءٍ بِأَمْرِ رَبِّهَا فَأَصْبَحُوا لَا يُرَىٰ إِلَّا مَسَاكِنُهُمْ كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْقَوْمَ الْمُجْرِمِينَ

‘‘বাতাস তার রবের নির্দেশে প্রতিটি বস্তুকে ধ্বংস করে ফেললো। অবশেষে তাদের এ অবস্থা দাঁড়ালো যে, তাদের বসবাসের স্থান ছাড়া সেখানে আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হতো না। এভাবেই আমি অপরাধীদের প্রতিদান দিয়ে থাকি’’। (সূরা আহকাফ: ২৫)

এখানে তাদের বাড়িঘরগুলো প্রত্যেক জিনিসের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তা كل شيئএর ব্যাপকতার আওতাভুক্ত হয়নি, যেগুলোকে বাতাস ধ্বংস করে দিয়েছিল। সাধারণত বাতাসের মাধ্যমে যা ধ্বংস করা সম্ভব এবং যা ধ্বংস করা দরকার كل شيئ দ্বারা কেবল তা ধ্বংস করা উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা‘আলা সাবার রাণী বিলকিস সম্পর্কে বলেন,

وَأُوتِيَتْ مِن كُلِّ شَيْءٍ ‘‘তাকে সবকিছুই দান করা হয়েছে’’ (সূরা নামল:২৩)। রাজাদের যা কিছু প্রয়োজন হয় এখানে كُلِّ شَيْء দ্বারা তা উদ্দেশ্য। ব্যাপকার্থ বোধক শব্দগুলো যে ব্যাপকার্থ প্রকাশ করে, কথার আলামত ও বর্ণনা প্রসঙ্গ দ্বারা উক্ত ব্যাপকতাকে সীমাবদ্ধ করা হয়ে থাকে। এখানে হুদহুদ পাখির উদ্দেশ্য হলো, রাজ্য পরিচালনার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সাবার রাণীর কাছে তা পরিপূর্ণ রূপেই ছিল এবং তার রাজত্বকে পরিপূর্ণ করার জন্য অন্য কিছুর প্রয়োজন ছিল না। এ রকম দৃষ্টান্ত আরো অনেক রয়েছে।

সুতরাং اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ ‘‘প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ’’ (সূরা রাদ:১৬) এ কথার অর্থ হলো প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তুর স্রষ্টা। আল্লাহ ছাড়া যেসব বস্তু রয়েছে, তা সবই সৃষ্টি। বান্দাদের কর্মসমূহও নিঃসন্দেহে এর মধ্যে শামিল। এ ব্যাপকতার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার সত্তা শামিল নয়। আর তার সিফাতসমূহও তার সত্তার বাহিরের আলাদা কোনো জিনিস নয়। কেননা তিনিই পূর্ণ গুণ দ্বারা বিশেষিত। এ সিফাতগুলো তার পবিত্র সত্তার সাথেই যুক্ত। সিফাতগুলো তার সত্তা থেকে আলাদা হিসাবে কল্পনা করা অসম্ভব। ইতিপূর্বে শাইখের উক্তি:

مَا زَالَ بِصِفَاتِهِ قَدِيمًا قَبْلَ خَلِقِهِ

‘‘সৃষ্টি করার বহু পূর্ব থেকেই তিনি তার অনাদি গুণাবলীসহ শ্বাশ্বত সত্তা হিসাবে বিদ্যমান রয়েছেন, -এ অংশের ব্যাখ্যা করার সময় উক্ত অর্থের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এমনকি কুরআনকে সৃষ্টি হিসাবে সাব্যস্ত করার জন্য তারা যে আয়াত দিয়ে দলীল দিয়েছে, তাই তাদের কথার বিরুদ্ধে দলীল হিসাবে পেশযোগ্য। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী:

اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ ‘‘প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ’’ যদি মাখলুক হয়, তাহলে তা কুরআন মাখলুক হওয়ার পক্ষে দলীল হতে পারে না। কুরআনকে মাখলুক বলার পক্ষে তাদের আরেকটি দলীল হলো,

إِنَّا جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

‘‘আমি এ কিতাবকে অবতীর্ণ করেছি কুরআন রূপে আরবী ভাষায়, যাতে তোমরা তা বুঝতে পারো’’। (সূরা যুখরুফ: ৩)

এভাবে দলীল গ্রহণ করা সম্পূর্ণ বাতিল। কেননা جعل শব্দটি যখন সৃষ্টি করা অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন এটি মাত্র মাফউল একটি চায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ

‘‘তিনি অন্ধকার ও আলো সৃষ্টি করেছেন’’। (সূরা আনআম: ১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ

‘‘আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম প্রত্যেকটি প্রাণীকে। এরপরও কি তারা ঈমান আনয়ন করবেনা?’’। (সূরা আম্বীয়া: ৩০) একই সূরায় এর পরের আয়াতে দু’টিতে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَجَعَلْنَا فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَن تَمِيدَ بِهِمْ وَجَعَلْنَا فِيهَا فِجَاجًا سُبُلًا لَّعَلَّهُمْ يَهْتَدُونَ وَجَعَلْنَا السَّمَاءَ سَقْفًا مَّحْفُوظًا وَهُمْ عَنْ آيَاتِهَا مُعْرِضُونَ

‘‘আর আমি পৃথিবীতে পাহাড় বসিয়ে দিয়েছি, যাতে সে তাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে এবং তার মধ্যে চওড়া পথ তৈরি করে দিয়েছি, হয়তো লোকেরা নিজেদের পথ জেনে নেবে। আর আমি আকাশকে করেছি একটি সুরক্ষিত ছাদ, কিন্তু তারা এমন যে, এ নিদর্শনাবলীর প্রতি দৃষ্টিই দেয় না’’। (সূরা আম্বীয়া: ৩১-৩২)

আর جعل শব্দটি যখন দু’টি مفعول চায় তখন উহা সৃষ্টি করা অর্থে ব্যবহৃত হয়না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَا تَنقُضُوا الْأَيْمَانَ بَعْدَ تَوْكِيدِهَا وَقَدْ جَعَلْتُمُ اللَّهَ عَلَيْكُمْ كَفِيلًا

‘‘এবং নিজেদের কসম দৃঢ় করার পর আবার তা ভেঙ্গে ফেলো না যখন তোমরা আল্লাহকে নিজের উপর সাক্ষী বানিয়ে নিয়েছো’’। (সূরা নাহাল: ৯১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَلَا تَجْعَلُوا اللَّهَ عُرْضَةً لِّأَيْمَانِكُمْ

‘‘তোমরা শপথ বাক্য উচ্চারণ করার জন্য আল্লাহর নাম ব্যবহার করো না’’। (সূরা বাকারা: ২২৪)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

الَّذِينَ جَعَلُوا الْقُرْآنَ عِضِينَ

‘‘যারা কুরআনকে খন্ডবিখন্ড করে ফেলে’’। (সূরা হিজির: ৯১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَىٰ عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَّحْسُورًا

‘‘নিজের হাত গলায় বেঁধে রেখো না এবং তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিয়ো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে যাবে’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ২৯) আল্লাহ তা‘আলা একই সূরার ৩৯ নং আয়াতে বলেন,

وَلَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ فَتُلْقَىٰ فِي جَهَنَّمَ مَلُومًا مَّدْحُورًا

‘‘আল্লাহর সাথে অন্য কোনো মাবুদ স্থির করে নিয়ো না, অন্যথায় তোমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে নিন্দিত এবং সব রকমের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত অবস্থায়’’। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَجَعَلُوا الْمَلَائِكَةَ الَّذِينَ هُمْ عِبَادُ الرَّحْمَٰنِ إِنَاثًا أَشَهِدُوا خَلْقَهُمْ سَتُكْتَبُ شَهَادَتُهُمْ وَيُسْأَلُونَ

‘‘এরা দয়াময় আল্লাহর খাস বান্দা ফেরেশতাদেরকে নারী গণ্য করেছে। এদের সৃষ্টির সময় কি তারা উপস্থিত ছিল? এদের সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করে নেয়া হবে এবং সে জন্য এদেরকে জবাবদিহি করতে হবে’’। (সূরা যুখরুফ: ১৯) অনুরূপ আয়াত আরো অনেক রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

إِنَّا جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا

‘‘আমি এ কিতাবকে অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায়, (সূরা যুখরুফ: ৩) -এর ক্ষেত্রেও একই কথা। তারা আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

نُودِيَ مِن شَاطِئِ الْوَادِ الْأَيْمَنِ فِي الْبُقْعَةِ الْمُبَارَكَةِ مِنَ الشَّجَرَةِ أَن يَا مُوسَىٰ إِنِّي أَنَا اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

‘‘পবিত্র ভূখন্ডে মূসার ডান দিকের একটি বৃক্ষ থেকে আহবান এলো, হে মূসা! আমি আল্লাহ, সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রভু’’, (সূরা কাসাস:৩০) -এ আয়াত দ্বারা দলীল পেশ করে বলে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা গাছের মধ্যে কালাম সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর মুসা আলাইহিস সালাম তা শুনেছেন। কিন্তু তারা আয়াতের শুরু ও শেষের কথাগুলো থেকে অন্ধ হয়ে গেছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা শুরুতে বলেছেন,

فَلَمَّا أَتَاهَا نُودِيَ مِن شَاطِئِ الْوَادِ الْأَيْمَنِ

‘‘মুসা আলাইহিস সালাম যখন সেখানে আসলেন তখন মুসার ডান দিকের উপত্যকার কিনারা থেকে আহবান এলো’’ (সূরা কাসাস:৩০)। দূর থেকে যে আহবান আসে তাকে কালাম বলা হয়। উপত্যকার কিনারা থেকে মুসা আলাইহিস সালাম আহবান শুনতে পেলেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فِي الْبُقْعَةِ الْمُبَارَكَةِ مِنَ الشَّجَرَةِ ‘‘পবিত্র ভূখণ্ড-র বৃক্ষ থেকে’’ (সূরা কাসাস:৩০)। অর্থাৎ পবিত্র ভূখণ্ড-র গাছের নিকট থেকে আহবান এসেছিল। যেমন বলা হয়,سمعت كلام زيد من البيت ‘‘ঘর থেকে যায়েদের কথা শুনেছি’’। অর্থাৎ ঘর থেকে কথার সূচনা হয়েছে। এমন নয় যে, ঘর কথা বলেছে। মুসা আলাইহিস সালাম গাছ থেকে যে আহবান শুনেছেন, তা যদি গাছের মধ্যে সৃষ্টি করা কথা হয়ে থাকে, তাহলে গাছই এ কথা বলেছে হিসাবে ধরে নেয়া আবশ্যক হবে যে,

يَا مُوسَىٰ إِنِّي أَنَا اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

‘‘হে মূসা! আমি আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রভু’’ (সূরা কাসাস:৩০)। সৃষ্টিজগতের প্রভু ছাড়া অন্য কারো কি এ কথা বলার অধিকার আছে যে, আমি আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টির প্রভু? এ কথা যদি আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে বের হতো, তাহলে ফেরাউনের এ কথাও সত্য হওয়া আবশ্যক হয়,

أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى ‘‘আমি তোমাদের মহান প্রভু’’ (সূরা নাযিয়াত:২৪)। কেননা তাদের মতে উভয় কথার প্রত্যেকটিই সৃষ্টি এবং তার কায়েল (বক্তা) আল্লাহ নন। তবে তারা তাদের বাতিল মূলনীতির ভিত্তিতে উভয় কথার মধ্যে পার্থক্য করেছে। মুসা যা শুনেছেন, তা আল্লাহ তা‘আলা গাছের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন এবং ফেরাউন যা বলেছে, তা সে নিজেই সৃষ্টি করেছে। সুতরাং তারা আল্লাহর কালামের বিকৃতি করেছে, তাকে পরিবর্তন করেছে এবং বিশ্বাস করেছে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য স্রষ্টা রয়েছে। বান্দাদের কাজ-কর্মের সৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করার সময় এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ। যদি বলা হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা তো বলেছেন,

إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ

‘‘এটা একজন সম্মানিত রাসূলের বাণী’’। (সূরা হাক্কাহ:৪০, সূরা তাকবীর: ১৯)

এখান থেকে বুঝা যায় যে, একজন রসূলই কুরআন তৈরী করেছে। তিনি সম্ভবত জিবরীল অথবা মুহাম্মাদ। এর জবাব হলো, রসূল শব্দটি পরিচিত হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে প্রাপ্ত রেসালাতের প্রচারক ছিলেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এ কথা বলেননি যে, এটি একজন ফেরেশতার বাণী কিংবা একজন নাবীর বাণী।

সুতরাং জানা যাচ্ছে যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা‘আলা যে রেসালাত দিয়ে পাঠিয়েছেন, তিনি তা প্রচার করেছেন। এমনটি নয় যে, তিনি নিজের পক্ষ হতে কুর‘আন তৈরী করেছেন। এক আয়াতে রসূল দ্বারা জিবরীল উদ্দেশ্য। অন্য আয়াতে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদ্দেশ্য। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং জিবরীলের দিকে রেসালাতের সম্বন্ধ করার কারণে পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, রসূলগণের দায়িত্ব ছিল কেবল পৌঁছিয়ে দেয়া। কেননা একজন ইহা তৈরী করার অর্থ হলো অন্যের দ্বারা তা তৈরী হওয়া অসম্ভব। সুতরাং যেহেতু উভয়ের দিকে রেসালাতের সম্বন্ধ করা হয়েছে, তাতে বুঝা গেল, কারো দ্বারাই তা তৈরী হয়নি। সেই সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: رسول أمين ‘‘আমানতদার রসূল’’ এটি প্রমাণ করে যে, তাকে যে কালামের তাবলীগ করার জন্য পাঠানো হয়েছে, তিনি তাতে বৃদ্ধি করেন না কিংবা তা থেকে কোনো কিছু কমান না। বরং তাকে যা দিয়ে পাঠানো হয়েছে, তিনি তাতে বিশ্বস্ত। প্রেরকের পক্ষ হতে তিনি তা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।

যারা বলে, কুরআন মানুষের কালাম, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কাফের বলেছেন। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষ। সুতরাং যারা কুরআনকে মুহাম্মাদের কালাম বলবে কিংবা এ কথা বলবে যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটি তৈরী করেছেন, সে কুফুরী করল। যারা বলবে কুরআন মানুষের কালাম অথবা জিনের কালাম কিংবা ফেরেশতার কথা তাদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ তারা সকলেই কাফের। যে কথা বলে তা তারই কালাম হয়। যে ব্যক্তি বক্তার কাছ থেকে শুনে অন্যের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়, তাকে উক্ত কালামের প্রবক্তা বলা হয় না। সুতরাং যে ব্যক্তি কাউকে যখন বলতে শুনবে,

قِفَا نَبْكِ مِنْ ذِكْرَى حَبِيبٍ وَمُنْزِلِ ‘‘হে বন্ধুদ্বয়! থামো, আমার প্রেমিক ও তার বাড়িঘরের কথা স্মরণ করে আমরা একটু কেঁদে নেই’’ তখন সে বলবে, এটি হলো ইমরুল কায়েসের কবিতা। এমনি যে ব্যক্তি কাউকে যখন বলতে শুনবে,

إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى

‘‘প্রতিটি আমল কবুল হওয়া বা না হওয়া নিয়তের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই রয়েছে যার নিয়ত সে করে’’ তখন সে বলবে, এটি নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কালাম। ঠিক তেমনি সে যখন কাউকে বলতে শুনবে,

الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

তখন বলবে এটি আল্লাহর কালাম। যখন তার জানা থাকবে, সে এ কথাই বলবে। আর যদি জানা না থাকে, তাহলে বলবে, আমি জানি না এটি কার কালাম? কেউ যদি তার কথার প্রতিবাদ করে, তাহলে সে মিথ্যুক বলে গণ্য হবে। এ জন্যই কেউ যদি অন্যকে কোনো কবিতার ছন্দ কিংবা পদ্যাংশ পাঠ করতে শুনে তখন তাকে জিজ্ঞাসা করে, এটি কার কথা? এটি কি তোমার রচিত কথা? না অন্য কারো? .... ইত্যাদি।

আল্লাহর কালামের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব এবং বিরোধীদের জবাব - ১

মোট কথা, আহলে সুন্নাতের চার মাযহাবের সকল মাযহাব এবং সালাফ ও খালাফ-পরবর্তীদের অন্যান্য আলেমের মতে, কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম; সৃষ্টি নয়। কিন্তু পরবর্তীরা এ বিষয়ে মতভেদ করেছে। কেউ বলেছে, আল্লাহর কালাম তার সাথে প্রতিষ্ঠিত মাত্র একটি কথার নাম।[1]

আওয়াজ ও অক্ষরের মাধ্যমে তা তার সত্তা থেকে বের হয় না। কেউ কেউ বলেছেন, এর অক্ষর ও আওয়াজ রয়েছে এবং আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমে কথা বলেছেন। অথচ তিনি এর পূর্বে কথা বলেননি। আবার আরেক শ্রেণীর আলেম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা অনাদি থেকেই কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত, তিনি যখন যেভাবে ইচ্ছা কথা বলেন। কেননা কথা বলা আল্লাহ তা‘আলার কাদীম বা অনাদি বিশেষণ। কোনো কোনো মুতাযেলী আলেম বলে থাকে কুরআন মাখলুক নয়। তাদের এ কথার উদ্দেশ্য হলো, এটি মিথ্যা ও বানোয়াট নয়; বরং এটি সত্য ও সঠিক। কুরআন সত্য ও সঠিক; এটি বানোয়াট নয়। নিঃসেন্দেহে মুসলিমদের ঐক্যমতে মিথ্যা ও বানোয়াট হওয়ার ধারণা বাতিল।

আহলে কিবলার লোকদের মতভেদ শুধু এ ব্যাপারে যে, এটি কি সৃষ্টি, যা আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেছেন? না এটি আল্লাহর এমন কালাম, যার মাধ্যমে তিনি কথা বলেছেন এবং এটি তার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত আছে? আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকদেরকে খালকে কুরআনের ফিতনার সময় এ প্রশ্নই করা হয়েছিল। অন্যথায় কুরআন মিথ্যা রচনা ও বানোয়াট হওয়ার অভিযোগটি সম্পূর্ণ বাতিল ছিল, তাতে কোনো মুসলিম সন্দেহ পোষণ করতে পারে না।

মুতাযেলাদের শাইখরা এবং অন্যান্য বিদআতীরা স্বীকার করেছে যে, তাওহীদ, আল্লাহর সিফাত ও তাকদীরের ব্যাপারে তারা তাদের আক্বীদাহ ও মাযহাব কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করে না। এমনকি তারা ছাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসরণকারী তাবেঈদের থেকেও গ্রহণ করেনি। তারা ধারণা করে যে, তাদের বিবেক-বুদ্ধিই তাদের পথ আলোকিত করেছে। তাদের ধারণা, তারা শরীয়াতের ইমামদের থেকেই শরীয়তের মাসআলা-মাসায়েল গ্রহণ করে থাকে।

মানুষকে যদি অবিকৃত ফিতরাত এবং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির উপর ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে তাদের মাঝে তাওহীদ, আল্লাহর সিফাত ইত্যাদি বিষয়ে কোনো মতভেদ হবে না। কিন্তু শয়তান তার নিজের ভুল-ভ্রান্তি থেকে কতিপয় মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে বনী আদমকে দ্বীনের ব্যাপারে দলে দলে বিভক্ত করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ نَزَّلَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِي الْكِتَابِ لَفِي شِقَاقٍ بَعِيدٍ

‘‘আল্লাহ যথার্থ সত্য অনুযায়ী কিতাব নাযিল করেছেন। কিন্তু যারা কিতাবের ব্যাপারে মতভেদ করেছে, তারা সত্য থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে’’। (সূরা বাকারা: ১৭৬)

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহর কথা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলা অনাদি থেকেই যখন ইচ্ছা কথা বলেন এবং আল্লাহ তা‘আলার কালাম কাদীম অনাদি শ্রেণীর সিফাতের অন্তর্ভুক্ত। ফিকহুল আকবারে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ যা বলেছেন, তা থেকেও সুস্পষ্ট এটি বুঝা যাচ্ছে। তিনি বলেন, কুরআন মুসহাফে লিখিত রয়েছে, হাফেযদের বক্ষে সংরক্ষিত আছে, মানুষের জবান দিয়ে তা পাঠ করা হচ্ছে, এটি নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিল হয়েছে, জবান দ্বারা আমাদের কুরআন পাঠ করা মাখলুক, কিন্তু কুরআন মাখলুক নয়। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে মুসা আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নাবীদের ব্যাপারে যা উল্লেখ করেছেন এবং ফেরাউন ও ইবলীস সম্পর্কে যা বর্ণনা করেছেন, তাও আল্লাহর কালাম। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে খবর দিয়েছেন। মুসা আলাইহিস সালাম এবং অন্যান্য সৃষ্টির কালামও সৃষ্টি। কুরআন আল্লাহর কালাম; সৃষ্টির কালাম নয়। মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা‘আলার কালাম শুনেছেন। আল্লাহ তা‘আলা যখন মুসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলেছেন, তখন তিনি তার সে অনাদি সিফাতের মাধ্যমে কথা বলেছেন। তার সমস্ত সিফাত সৃষ্টির সিফাতের মতো নয়। আল্লাহ তা‘আলার ইলম রয়েছে, কিন্তু তার ইলম আমাদের ইলমের মত নয়, তার ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু তার ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মত নয়, তিনি দেখেন, কিন্তু তার দেখা আমাদের দেখার মত নয়, তিনি কথা বলেন, কিন্তু তার কথা আমাদের কথার মত নয়......। ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।

ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর উক্তি: ‘‘আল্লাহ তা‘আলা যখন মুসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলেছেন, তখন তিনি তার সে অনাদি সিফাতের মাধ্যমে কথা বলেছেন’’ -এ থেকে জানা যাচ্ছে যে, মুসা আলাইহিস সালাম যখন তুর পাহাড়ে আসলেন তখন কথা বলেছেন, এমনটি নয় যে তিনি অনাদি-অবিনশ্বর সিফাতের মাধ্যমে সবসময় ইয়া মুসা ইয়া মুসা বলে ডেকেই যাচ্ছেন। কোনো বিবেকবান এ কথা বলতে পারে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

وَلَمَّا جَاءَ مُوسَى لِمِيقَاتِنَا وَكَلَّمَهُ رَبُّهُ

‘‘অতঃপর মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলেন এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন’’ (সূরা আরাফ:১৪৩) এ আয়াত থেকে এ কথাই বুঝা যায়। এতে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর সেসব অনুসারীর প্রতিবাদ রয়েছে, যারা বলে আল্লাহর মাত্র একটি, যা তার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত এবং তা শ্রবণ করার ধারণাই করা যায় না। তিনি কেবল বাতাসের মধ্যে শব্দ সৃষ্টি করেন। আবু মানসুর আল-মাতুরীদি এবং অন্যরা এ কথাই বলেছে।

ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর উক্তি: الَّذِي هُوَ مِنْ صِفَاتِهِ لَمْ يَزَلْ ‘‘যা তার সিফাতের অন্তর্ভুক্ত এবং তা অনাদি-চিরন্তন ও অবিনশ্বর’’, এতে ঐসব লোকের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন না। অতঃপর তার জন্য এ বিশেষণ তৈরী হয়েছে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তারা কোনো বাতিল কথার সাথে মিশ্রিত সত্যে অংশকে বাতিলের সাথে প্রত্যাখ্যান করে না; বরং তারা সত্যটুকু রেখে শুধু বাতিলকেই প্রত্যাখ্যান করে। সুতরাং মুতাযেলাদের যে দলীল প্রমাণ করে যে, আল্লাহর কালাম তার ইচ্ছা ও ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত, তিনি যখন ইচ্ছা কথা বলেন ও এক কথার পর অন্য কথা বলেন, তাদের এ কথা সত্য। এটি কবুল করা আবশ্যক। কিন্তু তাদের এ কথা গ্রহণযোগ্য নয় যে, তা আল্লাহর সৃষ্টি, যখন ইচ্ছা তিনি তা সৃষ্টি করেন এবং একটি কালামের পর অন্যটি সৃষ্টি করেন।

ঠিক এমনটি যারা বলেছে, আল্লাহর কালাম তার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত, এটি তার অন্যতম সিফাত এবং সত্তা ব্যতীত সিফাত কায়েম হয় না[2] তাদের কথাও সমর্থন করা আবশ্যক। সুতরাং উপরোক্ত উভয় ফির্কার কথার মধ্যে সত্যের যে অংশ রয়েছে, তা কবুল করে নেয়া আবশ্যক এবং তাদের প্রত্যেকের কথা থেকে শরীয়াত ও বিবেক-বুদ্ধির দলীল যা প্রত্যাখ্যান করে তা থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।

এখন বিরোধীরা যদি আমাদেরকে বলে, উপরোক্ত অর্থে আল্লাহ তা‘আলার জন্য কালাম সাব্যস্ত করলে তার সত্তার সাথে حوادث (সৃষ্ট বস্তু) সাব্যস্ত করা আবশ্যক হয়, তাহলে তাদের জবাবে আমরা বলবো যে, এটি একটি সংক্ষিপ্ত কথা। আল্লাহর জন্য কালাম সাব্যস্ত করলে তার সত্তার সাথে حوادث সৃষ্ট বস্তু যুক্ত হওয়া আবশ্যক হয়, তোমাদের পূর্বে মুসলিমদের কোনো ইমাম কি এ কথা বলেছে? কুরআন ও সুন্নাতের অনেক দলীল আল্লাহর জন্য কালাম সাব্যস্ত করেছে। ইমামদের উক্তি এবং বিবেক-বুদ্ধির সুস্পষ্ট দলীল তা সাব্যস্ত করে।

রসূলগণ যখন তাদের জাতির লোকদেরকে এভাবে সম্বোধন করেছেন এবং সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আহবান করেছেন, চুপিসারে কথা বলেছেন, তখন তারা নিঃসন্দেহে জাতির লোকদেরকে এটি বুঝাননি যে, এ কথাগুলো তিনি তার সত্তা থেকে আলাদা করে অন্যস্থানে সৃষ্টি করেছেন। বরং তারা বুঝিয়েছেন যে, স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই কথাগুলো বলেছেন। তার সত্তার সাথেই এ কথাগুলো প্রতিষ্ঠিত, অন্যের সাথে নয়। তিনিই তা বলেছেন।

যেমন আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তার ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদের ঘটনায় বলেন, আমি নিজেকে এত ছোট মনে করতাম যে, আমার পবিত্রতার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা এমন অহীর মাধ্যমে কথা বলবেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত তেলাওয়াত করা হবে, এমনটি ভাবতেই পারিনি।[3]

এ থেকে যা বুঝা যাচ্ছে, এর বিপরীত উদ্দেশ্য হলে তা বর্ণনা করা আবশ্যক হতো। কেননা যখন যা বর্ণনা করা আবশ্যক, তা যথা সময়ের পরে বর্ণনা করা অবৈধ। কেননা কোনো ভাষাতেই এমনটি পাওয়া যাবে না যে, বক্তা ও কথকের কথা তার সাথে প্রতিষ্ঠিত থাকে না; বরং তার কথা অন্যের সাথে প্রতিষ্ঠিত থাকে। মানুষের বিবেক-বুদ্ধিও এটি সমর্থন করে না।

তারা যদি বলে যে, সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাতেই কেবল তারা আল্লাহর জন্য কালাম সাব্যস্ত করা থেকে বিরত থাকে। সুতরাং তারা আল্লাহ তা‘আলার জন্য কতিপয় সিফাত ছাড়া অন্যান্য সিফাত সাব্যস্ত করে না।

তাদের জবাব হলো, তারা যখন বলবে আল্লাহ তা‘আলার ইলম রয়েছে, কিন্তু তার ইলম আমাদের ইলমের মত নয়, তখন আমরা বলবো, তিনি কথা বলেন, কিন্তু আমাদের কথা বলার মত নয়। সমস্ত সিফাতের ক্ষেত্রে একই কথা। এমন কোনো ক্ষমতাবানের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় কি যার সাথে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত থাকে না এবং এমন কোনো জীবন্ত প্রাণী আছে কি যার মধ্যে হায়াত থাকে না। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দু’আয় বলতেন,

«أَعُوْذُ بِكُلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ الَّتِىْ لاَ يُجَاوِزُهُنَّ بَرٌ وَلاَ فَاجِرٌ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ»

‘‘আমি আল্লাহ্ তা‘আলার ঐ সমস্ত কালেমার উসীলা দিয়ে তার মাখলুকের অনিষ্ট হতে আশ্রয় চাচ্ছি যেগুলো কোনো নেককার কিংবা বদকারের পক্ষেই অতিক্রম করা সম্ভব নয়’’।[4]

বিবেকবান কোনো মানুষের পক্ষে কি এ কথা বলা সম্ভব যে, তিনি মাখলুকের আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দু‘আয় আরো বলেছেন,

«اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذ بِرِضَاك مِنْ سَخَطك وَبِمُعَافَاتِك مِنْ عُقُوبَتك وأعوذبك منك»

‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টির উসীলায় তোমার ক্রোধ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তোমার ক্ষমা গুণের উসীলায় তোমার শাস্তি থেকে মুক্তি কামনা করছি এবং তোমার শাস্তি থেকে তোমার নিকটই আশ্রয় চাচ্ছি’’।[5] তিনি তার দু‘আয় আরো বলেছেন,

«أَعُوذُ بِعزة اللَّهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ»

‘‘আমি নিজের মধ্যে যে ব্যথা অনুভব করছি এবং অন্যান্য যেসব রোগ-ব্যাধির আশঙ্কা করছি, তার ক্ষতি থেকে আমি আল্লাহর ইজ্জত ও ক্ষমতার আশ্রয় কামনা করছি’’[6]। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন,

«وَنعُوذُ بِعَظَمَتِكَ أنْ نغْتاَلَ مِنْ تَحْتِنَا»

‘‘হে আল্লাহ! আমরা তোমার মহত্বের উসিলা দিয়ে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি নিমণ দিক থেকে মাটি ধ্বসে আমাদের আকস্মিক মৃত্যু হতে’’[7]।

এভাবে তিনি যেসব বস্তুর উসীলা দিয়েছেন, তার সবগুলোই আল্লাহর সিফাতের অন্তর্ভুক্ত। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার যেসব সিফাতের উসীলা দিয়ে দু‘আ করেছেন, যথাস্থানে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে শুধু সংক্ষিপ্তভাবে তার দিকে ইশারা করা হলো।

পরবর্তীকালের অনেক হানাফী মনে করে আল্লাহর কালাম মাত্র একটি।[8] তার কথা একাধিক্যতা, বহুত্ব, বিভক্তিকরণ হয় শুধু বাক্য ও ব্যাখ্যার মধ্যে; মূল অর্থ কেবল একটিই। কালামের এ ভাষাগুলো সৃষ্টি। এগুলো যেহেতু আল্লাহর মাত্র একটি কালামের প্রতি নির্দেশনা প্রদান করে এবং তার ব্যাখ্যা প্রদান করে, তাই এগুলোকে আল্লাহর কালাম বলা হয়েছে। তার কালামকে যখন ইবরানী ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়, তখন তাকে তাওরাত বলা হয় আর যখন আরবী ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়, তখন তাকে কুরআন বলা হয়। সুতরাং কালামের ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা ও ভাষা বিভিন্ন হয়; মূল কালাম বিভিন্ন হয় না। তারা আরো বলেছে, এ ভাষাগুলোকে কেবল রূপকার্থেই আল্লাহর কালাম হিসাবে নামকরণ করা হয়।

এটি একটি বাতিল কথা। এ কথা থেকে আবশ্যক হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا ‘‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না’’ (সূরা বনী ইসরাঈল:৩২), -এর অর্থ আর আল্লাহর বাণী: وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ ছ্বলাত কায়েম করো (সূরা বাকারা:৪৩) এর অর্থ একই।[9] আয়াতুল কুরসীর যে অর্থ আয়াত দু’টিরও সে অর্থ। সূরাতুল ইখলাসের যে অর্থ, সূরা লাহাবেরও সে একই অর্থ। তাদের কথার মধ্যে মানুষ যতই চিন্তা করবে, ততই তাদের কথার বিভ্রান্তি পরিষ্কার হবে এবং জানতে পারবে যে, তাদের কথা সালাফদের কথার পরিপন্থী এবং সত্য থেকে বহু দূরে।

আসল কথা হলো, তাওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর এবং কুরআন আল্লাহর কালাম। আল্লাহর কালাম অপরিসীম। এর কোনো শেষ নেই। তিনি যা ইচ্ছা যখন ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা কথা বলেন। সবসময়ই তিনি এ বিশেষণে বিশেষিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُل لَّوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا

‘‘হে মুহাম্মাদ! বলো, যদি আমার রবের কথা লেখার জন্য সমুদ্র কালিতে পরিণত হয় তাহলে সেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে কিন্তু আমার রবের কথা শেষ হবে না। বরং যদি এ পরিমাণ কালি আবারও আনি তাহলে তাও যথেষ্ট হবে না’’। (সূরা কাহাফ: ১০৯) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَوْ أَنَّمَا فِي الْأَرْضِ مِن شَجَرَةٍ أَقْلَامٌ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِن بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَّا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

‘‘পৃথিবীতে যত গাছ আছে তা সবই যদি কলম হয়ে যায় এবং এ সমুদ্রের সাথে যদি আরো সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয়, তবুও আল্লাহর কালাম লিখে শেষ করা যাবে না। অবশ্যই আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী’’। (সূরা লোকমান: ২৭)

মুসহাফের মধ্যে যা আছে, তা যদি হুবহু আল্লাহর কালাম না হয়ে তার কালামের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য হতো, অপবিত্র মানুষের জন্য তা স্পর্শ ও পাঠ করা হারাম হতো না। আসল কথা হলো, আল্লাহর কালাম হাফেযদের বক্ষে সংরক্ষিত রয়েছে, জবানের মাধ্যমে তা পঠিত হচ্ছে এবং মুসহাফে তা লিখিত রয়েছে। যেমন ফিকহুল আকবারে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ সুস্পষ্ট করেই বলেছেন। এ বিষয়ে তিনি যা বলেছেন, তা সবই প্রকৃত ও সত্য। কেউ যদি বলে, في المصحف كلام الله ‘‘মুসহাফের মধ্যে আল্লাহর কালাম লিখিত আছে’’, তা থেকে প্রকৃত অর্থ বুঝতে হবে, তাতে প্রকৃত পক্ষেই আল্লাহর কালাম লিখিত আছে। যদি বলা হয়, فيه خط فلان وكتابته ‘‘মুসহাফে অমুকের হাতের লিখা রয়েছে’’, এ কথাও প্রকৃত অর্থ বুঝতে হবে। আরো যদি বলা হয়, فيه مداد قد كتب به ‘‘মুসহাফের মধ্যে কালি রয়েছে। তা দ্বারা আল্লাহর কালাম লিখা হয়েছে এবং তাতে অমুক লেখকের হাতের লেখা রয়েছে। উপরোক্ত কথাগুলোর মধ্যে في হারফে জার্ থেকে যে যারফিয়াত (স্থান বা পাত্র) বুঝা যায় এবং فيه السموات والأرض ‘‘তাতে রয়েছে আসমান যমীন’’, فيه محمد وعيسى ‘‘তাতে রয়েছে মুহাম্মাদ ও ঈসা’’ অনুরূপ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত في হারফে জার্ থেকে একই যারফিয়াত (স্থান) বুঝা যায় না। অর্থাৎ কুরআনে আসমান-যমীন, পাহাড়-পর্বত, জান্নাত, জাহান্নাম, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ঈসা আলাইহিস সালাম এবং অন্যান্য সৃষ্টির আলোচনা রয়েছে। অথচ এসব বস্তুর অস্তিত্ব মুসহাফের বাইরে। ঐদিকে মুসহাফে কালি রয়েছে এবং অমুক লেখকের হাতের লেখা রয়েছে, এ কথার অর্থ হলো বাস্তবেই কুরআনে নির্দিষ্ট এক প্রকার কালি রয়েছে, যা দ্বারা তা লিখা হয়েছে। কিন্তু যখন বলা হবে فيه كلام الله ‘‘মুসহাফে আল্লাহর কালাম রয়েছে’’ তখন উপরোক্ত যারফিয়াতের অর্থ থেকে এ বাক্যের যারফিয়াতের অর্থ হবে সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ মুসহাফের মধ্যে আল্লাহর কালাম রয়েছে, এ কথা বলা হলেই আবশ্যক হয় না যে, তা আল্লাহর সৃষ্টি। যেমন মুসহাফের মধ্যে কালি রয়েছে এ কথা থেকে আমরা বুঝি যে, তাতে এমন কালি রয়েছে, যা সৃষ্টি। কিন্তু কুরআনে জান্নাত, জাহান্নাম, আসমান-যমীন ইত্যাদি রয়েছে, -এ কথা বলা হলে আবশ্যক হয় না যে, কুরআনের মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে ও বাস্তবে তা রয়েছে। বরং এ সৃষ্টিগুলো রয়েছে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে। আর কুরআনে রয়েছে কেবল এগুলোর আলোচনা। ঠিক তেমনি মুসহাফে আল্লাহর কালাম রয়েছে বলা হলেই আবশ্যক হয় না যে তাতে আল্লাহর কালাম প্রবেশ করেছে এবং তা সৃষ্টি। কেননা সৃষ্টির মধ্যে যা প্রবেশ করে তাও সৃষ্টি!!

উপরোক্ত অর্থগুলোর মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে যে ব্যক্তি অক্ষম হবে, সে পথভ্রষ্ট হবে। এমনকি সঠিক পথের সন্ধানও পাবে না। সে সঙ্গে কুরআন পাঠ করা, যা কারীর কাজ এবং পঠিত কুরআন যা আল্লাহর কালাম, এ কথা দু’টির মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কেও বুঝতে হবে। যে ব্যক্তি এটি বুঝবে না, সে গোমরাহ হবে। কোনো লোক যদি একখন্ড কাগজ দেখতে পায়, যাতে সুপ্রসিদ্ধ কোনো লেখকের হাতে লেখা রয়েছে, ألا كل شيئ ما خلا الله باطل..... ‘‘আল্লাহ ছাড়া প্রত্যেক জিনিসই বাতিল বা ধ্বংস হবে’’, তখন সে বলবে এটি প্রকৃতপক্ষে জাহেলী কবি লাবীদ বিন রাবিআর কবিতাংশ এবং প্রকৃতপক্ষেই অমুকের হাতের লিখা। كل شيئ ‘‘প্রত্যেক জিনিস’’ যা কাগজে উল্লেখ করা হয়েছে তাও প্রকৃত এবং বাস্তব, এখানে যে কালি দ্বারা কাগজে লাবীদের কথা লিখা হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষেই কালি। এ প্রকৃত ও বাস্তব বিষয়গুলোর প্রত্যেকটিই যে ভিন্ন ভিন্ন হাকীকত, তাতে কোনে সন্দেহ নেই এবং এগুলো পরস্পর মিশ্রিত হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই।

القرآن শব্দটি মূলত মাসদার বা ক্রিয়ামূল। কখনো কখনো এটি উল্লেখ করে পাঠ উদ্দেশ্য করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا

‘‘ছ্বলাত কায়েম করো সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং ফজরে কুরআন পাঠ করো। কারণ ফজরের কুরআন পাঠ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে’’ (সূরা বনী ইসরাঈল : ৭৮)।

রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, «زَيِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ» তোমরা তোমাদের আওয়াজের মাধ্যমে কুরআন পাঠকে সুন্দর করো’’[10] কখনো কখনো কুরআন উল্লেখ করে পঠিত কুরআনকে বুঝানো হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

‘‘তারপর যখন তোমরা কুরআন পড়ো তখন অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো’’ (সূরা নাহল:৯৮)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

‘‘যখন কুরআন, তোমাদের সামনে পড়া হয়, তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো এবং নীরব থাকো, হয়তো তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হবে’’। (সূরা আরাফ: ২০৪)

রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ أُنْزِلَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ»

‘‘এ কুরআন সাতটি পদ্ধতিতে নাযিল হয়েছে’’।[11]

এ রকম আরো অনেক আয়াত ও হাদীছ প্রমাণ উপরোক্ত দু’টি অর্থই বহন করে। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষেই কুরআনের অক্ষরসমূহ ও তার অর্থসমূহ আল্লাহরই কালাম এবং তা প্রকৃতপক্ষে মানুষের তৈরী কালি দিয়েই মানুষের হাতের মাধ্যমে লিখা হয়েছে। তাতে সৃষ্ট বস্তুর আলোচনাও রয়েছে। তাই বলে এটি মাখলুক বা সৃষ্টি হয়ে যায়নি। অস্তিত্বশীল বাস্তব বস্তুগুলোর একাধিক হাকীকত থাকে। সত্তাগত অস্তিত্ব, এ ও মস্তিস্কের মধ্যকার কল্পনাগত অস্তিত্ব, শব্দগত অস্তিত্ব ও লিখা সম্পর্কিত অস্তিত্ব।

উদাহরণ স্বরূপ আমরা পাহাড়ের কথা বলতে পারি। পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলা যায় যে, এটি একটি পাহাড়। আমরা যখন নির্দিষ্ট কোনো পাহাড় সম্পর্কে কল্পনা করি, তখন আমাদের মাথার মধ্যেই পাহাড়ের অস্তিত্ব থাকে অর্থাৎ পাহাড় সম্পর্কে কল্পনা ও ধারণা থাকে। এমনি যখন পাহাড় কথাটি উচ্চারণ করি, তখনো কথা বা শব্দের মাধ্যমেও পাহাড়ই বলি; গাছ বলি না। আবার যখন আমরা অক্ষর দ্বারা পাহাড় শব্দটি লিখি তখনো ইঙ্গিতের মাধ্যমে বলি, هذا جبل এটি একটি পাহাড়। পাহাড় লিখতে যে অক্ষরগুলোর প্রয়োজন হয়েছে, এখানে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে; পাহাড়ের সত্তার দিকে নয়। সুতরাং বস্তুগুলো প্রথমত জানা হয়, তারপর উল্লেখ করা হয়, তারপর লিখা হয়। মুসহাফে প্রকৃতপক্ষেই কুরআন লিখার বিষয়টি চতুর্থ স্তরের অন্তর্ভুক্ত।

[1]. এটি একটি বাতিল কথা। আল্লাহর কালাম বা কথা একটি মাত্র নয়; বরং তার অনেক কথা রয়েছে। কুরআনে রয়েছে জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনা। রয়েছে আদেশ ও নিষেধ। তিনি তার কালামের মাধ্যমে আযাবের ভয় দেখিয়েছেন এবং তার রহমতের আশা ও আশ্বাস দিয়েছেন। তার কথা যদি মাত্র একটি হয়, তাহলে আল্লাহর আযাবের আয়াত ও তার রহমতের আয়াতের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।

[2]. যেমন আলেম ছাড়া ইলমের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সাদা জিনিস থেকে সাদা রং আলাদা করে এক স্থানে রেখে এবং জিনিসটিকে অন্যস্থানে রেখে বুঝার কোনো সুযোগ নেই। দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানুষের দৃষ্টিকে একস্থানে রেখে এবং মানুষটিকে অন্য জায়গায় রেখে বুঝার যেমন কোনো উপায় নেই। সুতরাং আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রেও একই কথা। তার পবিত্র যাত থেকে সিফাতকে আলাদা করে বুঝা অকল্পনীয়।

[3]. তার ধারণা ছিল, আল্লাহ তা‘আলা তার নাবীকে স্বপ্ন বা অন্য কোনো মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে দিবেন।

[4]. ছহীহ: ইমাম আহমাদ সহীহ সনদে মারফু হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

[5]. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৪৮৬।

[6]. ছহীহ: ইবনে মাজাহ ৩৫২২, আবূ দাউদ ৩৮৯১।

[7]. ছহীহ: মুসনাদে আহমাদ, আবূ দাউদ ৫০৭৪।

[8]. এখানে লেখক হানাফীদের যে গ্রুপের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তারা ফিকহের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর অনুসরণ করলেও আকীদাহর ক্ষেত্রে তারা আশ‘আরী ও মাতুরীদি মাযহাবের অনুসারী।

[9]. কেননা তাদের মতে আল্লাহর কালাম মাত্র একটি; একাধিক নয়।

[10]. ছহীহ: আবূ দাউদ

[11]. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ৪৯৯২।
আল্লাহর কালামের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব এবং বিরোধীদের জবাব - ২

আল্লাহর কালামের ব্যাপারে কথা হলো, এর মাঝে এবং মুসহাফের মাঝে কোনো যোগসূত্র ও সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ হুবহু আল্লাহর কালাম মুসহাফে লিখা হয়েছে। কালাম অন্যান্য অস্তিত্বশীল বস্তুর মত নয়, যা প্রথমত জানা যায় বা নির্দিষ্ট একটি স্থান দখল করে অস্তিত্বশীল হয়েছে। অতঃপর জবানের মাধ্যমে উল্লেখ করা হয়, অতঃপর তা কাগজে লিখা হয়। এক কথায় মুসহাফের কাগজে কালি দিয়ে হুবহু আল্লাহর কালাম লিখা হয়েছে। এটি এমন কোনো বস্তুর মত নয়, যার নাম কাগজে লিখা হয়, কিন্তু তার অস্তিত্ব থাকে অন্য স্থানে। মোট কথা কাগজ, কলম কালি এবং জবান সৃষ্টি হলেও কাগজ ও কালির মাধ্যমে লিখিত কালাম এবং জবানের মাধ্যমে পঠিত কালাম তার সৃষ্ট বস্তুর অন্তর্ভুক্ত নয়।

পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের মধ্যে কুরআন থাকা এবং সুক্ষ্ম চামড়া বা কাগজের উপর লিখিত থাকা অথবা লাওহে মাহফুযে সংরক্ষিত থাকা কিংবা সুরক্ষিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকার মধ্যকার পার্থক্য সুস্পষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَإِنَّهُ لَفِي زُبُرِ الْأَوَّلِينَ

‘‘আর আগের লোকদের কিতাবেও এ কথা আছে’’। (সূরা শুআরা: ১৯৬)

অর্থাৎ কুরআনে যে উপদেশ রয়েছে, তার আলোচনা, গুণাগুণ এবং সংবাদ পূর্বের কিতাবসমূহেও ছিল। এমনটি নয় যে, কুরআন হুবহু পূর্বেও নাযিল হয়েছে। পূর্ববর্তী জাতির লোকদের কিতাবসমূহে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম লিখা ছিল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা কেবল মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরই কুরআন নাযিল করেছেন। তিনি ছাড়া অন্য কারো উপর এটি নাযিল করা হয়নি। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা في الزبر (লিখিত গ্রন্থসমূহে) বলেছেন; في الصحف (পুস্তিকায়) বলেননি এবং في الرق বলেননি। কেননা الزبر শব্দটি زبور এর বহুবচন। الزّبْر শব্দের অর্থ হলো লিপিবদ্ধ করা ও একত্র করা। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

وَإِنَّهُ لَفِي زُبُرِ الْأَوَّلِينَ

‘‘আর আগের লোকদের কিতাবেও এ কথা লিখা আছে’’ (সূরা শুআরা: ১৯৬) । অর্থাৎ পূর্ববর্তীদের কিতাবসমূহেও কুরআনের খবর ও গুণাগুণ লিপিবদ্ধ রয়েছে; হুবহু এ কুরআনটি লিখা নেই। الزبر শব্দ এবং তা থেকে নির্গত শব্দের মধ্যেই এমন অর্থ রয়েছে, যা উদ্দিষ্ট অর্থকে সুস্পষ্ট করে দেয়। সে সঙ্গে আরো বর্ণনা করে দেয় যে, কুরআনের বর্ণনা খুবই পরিপূর্ণ এবং সন্দেহ ও অস্পষ্টতা মুক্ত। পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেও কুরআনের আলোচনা রয়েছে, এ কথাটির অনুরূপ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيلِ

‘‘যার উল্লেখ তারা তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত অবস্থায় পায়’’। (সূরা আরাফ: ১৫৬) অর্থাৎ তার আলোচনা পায়। এটি আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

فِي رَقٍّ مَّنشُورٍ ‘‘পাতলা চামড়ার উপর উহা লিখিত আছে’’। (সূরা তূর: ৩), আল্লাহর বাণী:

فِي لَوْحٍ مَّحْفُوظٍ ‘‘উহা সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ রয়েছে’’। (সূরা বুরুজ: ২২) এবং আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

فِي كِتَابٍ مَّكْنُونٍ ‘‘এটি একটি সুরক্ষিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে’’। (সূরা ওয়াকিয়া: ৭৮) এর বিপরীত। কেননা উপরোক্ত আয়াতগুলোতে যে হরফে জার্ في রয়েছে, তাতে যে عامل এর প্রয়োজন, তা কখনো সাধারণ فعل (ক্রিয়া) হয়। যেমন كون, استقرار, حصول ইত্যাদি। অথবা উহ্য শিবহে ফেল, مكتوب শব্দটি নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ উহ্য রূপটি এমন হতে পারে, مكتوب في رق منشور, مكتوب في كتاب مكنون, مكتوب في لوح محفوظ।

كتاب শব্দটি ব্যবহার করে কখনো এর দ্বারা লিখার স্থান উদ্দেশ্য করা হয়। আবার কখনো লিখিত কালামও উদ্দেশ্য হয়। কিতাবের মধ্যে কালাম লিখা এবং কিতাবের বাইরে অস্তিত্বশীল জিনিসগুলো কিতাবের মধ্যে লিখার মধ্যে পার্থক্য করা আবশ্যক। কিতাবের বাইরে অস্তিত্বশীল জিনিসগুলো কিতাবে লিখার সময় কেবল তার আলোচনাই লিখা হয়। আর কালাম লিখলে হুবহু তাই লিখা হয় এবং তা যার কালাম তার দিকেই সম্বন্ধ করা হয়। মানুষ যতই এ অর্থটি নিয়ে চিন্তা করবে, ততই তার জন্য পার্থক্য সুস্পষ্ট হবে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সত্তা থেকে যে কালাম বের হয়, তার প্রকৃত অবস্থা হলো, তা কখনো তার থেকে সরাসরি শুনা যায়, যেমন শুনেছিলেন মুসা আলাইহিস সালাম অথবা আল্লাহ তা‘আলার বাণী প্রচারকারী থেকে শুনা যায়। শ্রবণকারী যখন তা শুনে, তখন তিনি তা জেনে নেন এবং সংরক্ষণ করেন। সুতরাং আল্লাহর কালাম শ্রবণ করা যায়, সংরক্ষণ করা যায়। শ্রোতাগণ যখন তা পাঠ করে, তখন তারই পাঠ ও তেলাওয়াত হয়। যখন সে তা লিখে তখন তারই লিখা ও অঙ্কন বলে গণ্য করা হয়। এসব ক্ষেত্রেই উহা প্রকৃত অর্থেই ব্যবহৃত হবে। এটিকে নাকোচ করা অবৈধ। কিন্তু কোনো রূপকার্থকে নাকোচ করা বৈধ। সুতরাং এ কথা বলা ঠিক হবে না যে, মুসহাফের মধ্যে যা আছে, তা আল্লাহর কালাম নয় এবং কারীগণ যা পাঠ করে, তাও আল্লাহর কালাম নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আল্লাহ তা‘আলা সূরা তাওবার ৬ নং আয়াতে বলেন,

وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّىٰ يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ

‘‘আর মুশরিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পারে, তাহলে তাকে আল্লাহর কালাম শ্রবণ করা পর্যন্ত আশ্রয় দাও’’।

এখানে আল্লাহ তা‘আলার কালাম শুনার জন্য যাকে আশ্রয় দেয়ার কথা বলা হয়েছে, সে কখনোই সরাসরি আল্লাহ তা‘আলা থেকে কালাম শুনবে না। বরং সে আল্লাহর বাণী প্রচারকারী থেকেই তা শুনবে। যারা বলে শ্রম্নত কালাম আল্লাহর সরাসরি কালাম নয়; বরং তা আল্লাহর কালামের ব্যাখ্যা, উক্ত আয়াত তাদের কথার প্রতিবাদ করছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, حَتَّىٰ يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ‘‘যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়’’। এমনটি বলা হয়নি, যাতে সে আল্লাহর কালামের ব্যাখ্যা শুনতে পায়। ভাষার ক্ষেত্রে আসল হলো এতে শব্দগুলো প্রকৃত অর্থেই ব্যবহৃত হয়।

সুতরাং যে ব্যক্তি বলবে, মুসহাফসমূহে আল্লাহর কালামের ব্যাখ্যা অথবা আল্লাহর কালামের বর্ণনা রয়েছে; তাতে আল্লাহর কালাম নেই, সে আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং উম্মতের সালাফদের ইজমার বিরোধিতা করবে। তার গোমরাহীর জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।

যারা বলে আল্লাহর কালাম মাত্র একটিই, আল্লাহর পক্ষ হতে তা শ্রবণ করার কল্পনাই করা যাবে না এবং নাযিলকৃত, শ্রম্নত, পঠিত ও লিখিত কালাম আল্লাহর কালাম নয়; বরং তা আল্লাহ তা‘আলার কালামের ব্যাখ্যা মাত্র, ইমাম ত্বহাবীর বক্তব্য তাদের কথাকে প্রত্যাখ্যান করে। কেননা তিনি বলেছেন, مِنْهُ بَدَا وَإِلَيْهِ يَعُودُ ‘‘আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতেই এর সূচনা হয়েছে এবং আল্লাহ তা‘আলার দিকেই এটি ফিরে যাবে’’।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ ছাড়াও অন্যান্য সালাফগণ একই কথা বলেছেন। তারা আরো বলেছেন, আল্লাহর নিকট থেকেই এটি এসেছে এবং তার নিকটই ফিরে যাবে। ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ এ জন্য منه بدا বলেছেন, আল্লাহর সিফাতকে বাতিলকারী মুতাযেলারা বলেছে, আল্লাহ তা‘আলা কোনো একটি মহলে বা স্থানে কালাম সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর সেই মহল থেকে কালাম বের হয়েছে। এ জন্যই সালাফগণ তাদের প্রতিবাদে বলেছেন, منه بدا অর্থাৎ তিনিই এর মাধ্যমে কথা বলেছেন। সুতরাং তার নিকট থেকে উহা এসেছে; কোনো কোনো সৃষ্টির পক্ষ হতে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

تَنزِيلُ الْكِتَابِ مِنَ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ

‘‘এ কিতাব মহা পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত’’ (সূরা যুমার: ১)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

وَلَٰكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنِّي لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ

‘‘কিন্তু আমার সে কথা পূর্ণ হয়ে গেছে, যা আমি বলেছিলাম যে, আমি জাহান্নাম জিন ও মানুষ দিয়ে ভরে দেবো’’। (সূরা সাজদাহ: ১৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

قُلْ نَزَّلَهُ رُوحُ الْقُدُسِ مِن رَّبِّكَ بِالْحَقِّ

‘‘এদেরকে বলো, একে তো রূহুল কুদুছ ঠিক ঠিকভাবে তোমার রবের পক্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে নাযিল করেছে’’। (সূরা আল নাহাল: ১০২)

আলেমদের কথা, إليه يعود ‘‘তার দিকেই কালাম ফিরে যাবে’’, এর অর্থ হলো মানুষের বক্ষসমূহ থেকে এবং মুসহাফসমূহ থেকে কুরআন উঠিয়ে নেয়া হবে। এরপর মানুষের অন্তরে কিংবা মুসহাফে কোনো আয়াতই অবশিষ্ট থাকবে না। অনেক হাদীছে এ কথা বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম ত্বহাবীর উক্তি: بلا كيفية ‘‘এর কোনো ধরণ নির্ধারণ করা যাবে না’’।[12] অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের মাধ্যমে কিভাবে কথা বলেছেন, তার ধরণ আমরা জানি না। আল্লাহ কথা বলেছেন, -এ কথা রূপকার্থেও বলা হয়নি। তিনি অহী আকারে এটি তার রাসূলের উপর নাযিল করেছেন। অর্থাৎ ফেরেশতার মাধ্যমে তার রাসূলের নিকট তা পাঠিয়েছেন। জিবরীল ফেরেশতা তা আল্লাহর নিকট থেকে শ্রবণ করেছেন এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুনেছেন জিবরীল ফেরেশতার নিকট থেকে। অতঃপর তিনি মানুষের জন্য তা পাঠ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَقُرْآنًا فَرَقْنَاهُ لِتَقْرَأَهُ عَلَى النَّاسِ عَلَىٰ مُكْثٍ وَنَزَّلْنَاهُ تَنزِيلًا

‘‘আর এ কুরআনকে আমি অল্প অল্প করে নাযিল করেছি, যাতে তুমি থেমে থেমে তা লোকদেরকে শুনিয়ে দাও এবং এটি আমি যথাযথভাবেই নাযিল করেছি’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১০৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَإِنَّهُ لَتَنزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ عَلَىٰ قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنذِرِينَ بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُّبِينٍ

‘‘এটি রববুল আলামীনের নাযিল করা কিতাব। একে নিয়ে আমানতদার রূহ অবতরণ করেছে তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হও। পরিষ্কার আরবী ভাষায়’’। (সূরা শুআরা: ১৯২-১৯৫)

এ আয়াতগুলো থেকে আল্লাহ তা‘আলার জন্য উলু তথা সৃষ্টির উপরে সমুন্নত হওয়া সাব্যস্ত হয়।[13] এ কথার উপর কেউ আপত্তি করে বলতে পারে যে, উপর থেকে কুরআন নাযিল হওয়া, বৃষ্টি নাযিল হওয়া, লোহা নাযিল করা এবং চতুষ্পদ জন্তুর আটজোড়া নর-মাদি নাযিল করার মতই।[14]

কেননা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের অনেক স্থানেই বলেছেন যে, তিনি আসমান থেকে বৃষ্টি নাযিল করেন, সূরা হাদীদের ২৫ নং আয়াতে তিনি বলেছেন,

وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ

‘‘আমি লোহা নাযিল করেছি এবং সূরা যুমারের ১০৬ নং আয়াতে বলেছেন,

وَأَنزَلَ لَكُم مِّنَ الْأَنْعَامِ ثَمَانِيَةَ أَزْوَاجٍ

‘‘তিনি তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু থেকে আটজোড়া নাযিল করেছেন’’। সুতরাং উপর থেকে কুরআন নাযিল হওয়ার অর্থ এ নয় যে আল্লাহ তা‘আলা উপরে এবং কুরআন আল্লাহর নিকট থেকে নাযিল হয়েছে।

উপরোক্ত আপত্তির জবাব হলো, কুরআন নাযিলের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, তা আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিল হয়েছে। আর উপরোক্ত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তা বলা হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা সূরা মুমিনের ২ নং আয়াতে বলেন,

تَنزِيلُ الْكِتَابِ مِنَ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ

‘‘এ কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত যিনি মহাপরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞাত’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা যুমারের ১ নং আয়াতে বলেন,

تَنزِيلُ الْكِتَابِ مِنَ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ

‘‘এ কিতাব মহা পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে’’। সূরা ফুস্সিলাতের ২ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

تَنزِيلٌ مِّنَ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

‘‘এটা পরম দয়ালু ও মেহেরবান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে’’। সূরা হামীম সাজদার ৪২ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَّا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنزِيلٌ مِّنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ

‘‘কোনো বাতিল এতে অনুপ্রবেশ করতে পারে না, অগ্র হতেও না, পশ্চাত হতেও না। এটা প্রজ্ঞাবান ও পরম প্রশংসিত আল্লাহর নিকট থেকে হয়েছে’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা দুখানের ৩-৫ নং আয়াতে বলেন,

أَمْرًا مِّنْ عِندِنَا إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ

‘‘আমি এটি এক বরকতময় রাতে নাযিল করেছি। আমি তো সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় ফায়ছালা করা হয়। আমার নির্দেশেক্রমে, আমি তো রসূল প্রেরণকারী’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা কাসাসের ৪৯ নং আয়াতে বলেন,

قُلْ فَأْتُوا بِكِتَابٍ مِّنْ عِندِ اللَّهِ هُوَ أَهْدَىٰ مِنْهُمَا أَتَّبِعْهُ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ

‘‘হে নাবী! তাদেরকে বলো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তাহলে আনো আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন একটি যা এ দু’টির চেয়ে বেশী হেদায়াতদানকারী; আমি তারই অনুসরণ করবো’’। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

وَالَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْلَمُونَ أَنَّهُ مُنَزَّلٌ مِّن رَّبِّكَ بِالْحَقِّ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ

‘‘আর যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা জানে এ কিতাবটি তোমার রবেরই পক্ষ থেকে সত্য সহকারে নাযিল হয়েছে। কাজেই তুমি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তরভুক্ত হয়োনা’’। (সূরা আনআম: ১১৪) আল্লাহ তা‘আলা সূরা নাহালের ১০২ নং আয়াতে আরো বলেন,

قُلْ نَزَّلَهُ رُوحُ الْقُدُسِ مِن رَّبِّكَ بِالْحَقّ

‘‘এদেরকে বলো, একে তো রূহুল কুদুছ সত্যসহকারে তোমার রবের পক্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে নাযিল করেছে’’। আর বৃষ্টি নাযিলের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, তা আসমান থেকে নাযিল হয়। আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফুরকানের ৪৮ নং আয়াতে বলেন,

وَأَنزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً طَهُورًا

‘‘আমি আসমান থেকে নাযিল করি পবিত্র পানি’’।

এখানে আসমান থেকে নাযিল করার অর্থ হলো উপর থেকে নাযিল করা। অন্য স্থানে বলা হয়েছে যে, বৃষ্টি নাযিল হয় মেঘ থেকে।

সূরা নাবার ১৪ নং আয়াতেও মেঘমালা থেকে বৃষ্টি নাযিল হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর লোহা ও চতুষ্পদ জন্তু নাযিল হওয়ার বিষয়টি কোনো কিছুর দিকে সম্বন্ধ না করেই উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং কুরআন নাযিল হওয়াকে কিভাবে সৃষ্ট বস্তু নাযিল হওয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে? লোহা সাধারণত পাহাড়ের খনি থেকে বের হয়। আর পাহাড় সমতল ভূমি থেকে উঁচু থাকে। বলা হয়ে থাকে যে, লোহার খনি যতই উঁচু স্থানে হয়, সেখান থেকে উৎপাদিত লোহার মানও ভাল হয়।

সুতরাং লোহা যেহেতু উপর থেকে পাওয়া যায়, তাই লোহার ক্ষেত্রে নাযিল কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। আর চতুষ্পদ জন্তু বংশানুক্রমে সৃষ্টি করা হয়। এতে নরপশুর পৃষ্ঠদেশ থেকে নির্গত পানি মাদিপশুর গর্ভাশয়ে অবতরণ করা আবশ্যক। এ জন্যই এ ক্ষেত্রে أنْزل বলা হয়েছে نزّل বলা হয়নি। কেননা উভয় শব্দের অর্থের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। إنزال অর্থ হলো একসাথে নাযিল করা। تنزيل অর্থ হলো ধীরে ধীরে ও থেমে থেমে অবতীর্ণ করা।

এখানে আরেকটি ধর্তব্য বিষয় হলো, নবজাতক শিশু বা পশুর বাচ্চারা তাদের মায়ের পেট থেকে ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করে। আরেকটি জানা কথা হলো চতুষ্পদ জন্তুর ষাঁড়গুলো প্রজনন কর্ম সম্পাদন করার সময় মাদিপশুর উপর উঠে। এ সময় পাঠা বা ষাঁড়ের পানি উপর থেকেই মাদির গর্ভাশয়ে অবতীর্ণ হয়। এমনি সে যখন বাচ্চা প্রসব করে, তখন উপর থেকে নীচের দিকেই বাচ্চাকে নিক্ষেপ করে। এর উপর ভিত্তি করেই বলা হয়েছে,

وَأَنزَلَ لَكُم مِّنَ الْأَنْعَامِ ثَمَانِيَةَ أَزْوَاجٍ

‘‘তিনি তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু থেকে আটজোড়া নাযিল করেছেন’’ (সূরা যুমার: ৬)। এখানে من হারফে জার্ দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

(১) جنس الأنعام তথা সকল প্রকার চতুষ্পদ জন্তু বর্ণনা করার উদ্দেশ্য ব্যবহৃত হয়েছে। অথবা

(২) সূচনার সীমা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

جَعَلَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَمِنَ الْأَنْعَامِ أَزْوَاجًا

‘‘যিনি তোমাদের আপন প্রজাতি থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন, অনুরূপ অন্যান্য জীব জন্তুর প্রজাতি থেকেও তাদের জোড়া বানিয়েছেন’’ (সূরা শুরা:১১), এখানেও মিন্ হারফ জার্টি উপরোক্ত দু’টি অর্থই প্রদান করার সম্ভাবনা রাখে।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, وَصَدَّقَهُ الْمُؤْمِنُونَ عَلَى ذَلِكَ حَقًّا‘‘আর ঈমানদারগণ তাকে এ ব্যাপারে সত্যবাদী বলে মেনে নিয়েছেন’’। আল্লাহ তা‘আলা প্রকৃতপক্ষেই কথা বলেছেন এবং কুরআন প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেছেন। এটিই ছাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসারী তাবেঈদের উক্তি। তারাই হলেন সালাফে সালেহীন। আর এ কথাই সত্য ও সঠিক। ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

وَأَيْقَنُوا أَنَّهُ كَلَامُ اللَّهِ تَعَالَى بِالْحَقِيقَةِ، لَيْسَ بِمَخْلُوقٍ كَكَلَامِ الْبَرِيَّةِ

তারা দৃঢ় বিশ্বাস করেছেন যে, প্রকৃতপক্ষেই কুরআন আল্লাহর কালাম, কোনো সৃষ্টির কথার মত সৃষ্টি নয়। এখানে শাইখ সুস্পষ্টভাবেই মুতাযেলা এবং অন্যদের প্রতিবাদ করেছেন। ‘প্রকৃতপক্ষেই কুরআন আল্লাহর কালাম’ এ কথার মাধ্যমে শাইখ ঐসব লোকের প্রতিবাদ করেছেন, যারা বলে আল্লাহর কালাম মাত্র একটি, তা তার সত্তার সাথেই প্রতিষ্ঠিত এবং তা শুনা যায় না। তা কেবল কালামে নাফসানী বা আত্মিক কালাম। কেননা যার নফসের সাথে কালাম প্রতিষ্ঠিত আছে, কিন্তু সে তার মাধ্যমে কথা বলেনি, তার নফসের সাথে যুক্ত কালামকে প্রকৃত কালাম বলা হয় না। তার কথাকে কালাম বলা হলে বোবাকে মুতাকাল্লিম বলা যথার্থ হবে।[15]

কেননা তার নফসের সাথেও কালাম যুক্ত আছে। যেহেতু বোবাকে মুতাকাল্লিম বলা ঠিক নয়, সে হিসাবে মুসহাফের মধ্যে বিদ্যমান কালামকে কুরআন বলা কিংবা আল্লাহর কালাম বলা ঠিক হবে না। কিন্তু বলা হবে যে, তা আল্লাহর কালামের অর্থ মাত্র; তা হুবহু আল্লাহর কালাম নয়। যেমন বোবা কারো প্রতি ইশারা করলো। ইশারার মাধ্যমে তার উদ্দেশ্য বুঝে নিয়ে সে লোকটি উহা লিখে নিল, যার প্রতি সে ইঙ্গিত করেছে। এ ব্যক্তি যা লিখেছে তা ঐ অর্থের নাম মাত্র। আশায়েরা সম্প্রদায়ের লোকেরা আল্লাহর কালামের ব্যাপারে যা বলে, তার জন্য এ দৃষ্টান্ত হুবহু প্রয়োগযোগ্য। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলাকে তাদের কেউ বোবা হিসাবে নামকরণ করে না। তবে তারা বলে জিবরীল ফেরেশতা আল্লাহর নফসের সাথে যুক্ত কালামকে বুঝে নিয়েছে। তিনি আল্লাহ তা‘আলা থেকে একটি অক্ষর বা একটি আওয়াজও শুনেনি। বরং তিনি শুধু অর্থকেই বুঝেছেন। অতঃপর তিনি নিজের ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন। সুতরাং জিবরীল ফেরেশতাই নিজস্ব ভাষায় কুরআনের শব্দমালা ও আরবী গ্রন্থনা তৈরী করেছেন। অথবা আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা ব্যতীত অন্য কোনো জিসিম যেমন বাতাস বা অন্য কিছুর মধ্যে এ কালামের অর্থটি সৃষ্টি করেছেন।

[12]. উল্লেখ্য যে, আল্লাহর কথা বলার কোনো ধরণ নেই এটা বলা হয়নি, বরং কোনো ধরণ জানা নেই বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার কথা বলার ধরণ আমাদের জানা না থাকলেও উহার একটা ধরণ তো অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু সে ধরণ আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই জানেন।

[13]. কেননা নাযিল সাধারণত উপর থেকে নীচের দিকেই হয়ে থাকে।

[14]. মুতাযেলারা বলে থাকে, বৃষ্টি নাযিল করা, লোহা নাযিল করা, চতুষ্পদ জন্তু নাযিল করার অর্থ যেমন সৃষ্টি করা, ঠিক তেমনি কুরআন নাযিল করা মানে তা সৃষ্টি করা। এটি নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের পক্ষ হতে কুরআন নাযিল করেছেন।

[15]. এটি আশায়েরা এবং অন্যদের যুক্তি।
আল্লাহর কালামের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব এবং বিরোধীদের জবাব - ৩

আর যারা বলে আল্লাহর কালাম বলতে মাত্র একটি অর্থকেই বুঝায়, তাদের জবাবে বলা হবে, তাহলে মুসা আলাইহিস সালাম কি পূর্ণ অর্থটি শুনেছেন? না কি তার আংশিক শুনেছিলেন? তারা যদি বলে তিনি সমস্ত কালাম শুনেছেন, তাহলে আসলে এ ধারণাই করল যে, তিনি আল্লাহর সমস্ত কালাম শুনেছেন! এ কথা যে ভুল, তা সুস্পষ্ট। আর যদি বলে, তিনি আংশিক কালাম শুনেছেন, তাহলে তার জন্য এটি বলা আবশ্যক হবে যে, আল্লাহর কালামের অংশ ও শ্রেণী বিন্যাস হয়। এমনি আল্লাহ তা‘আলা যার সাথে কথা বলেছেন কিংবা যার নিকট তার কালাম থেকে কিছু নাযিল করেছেন, তার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আল্লাহ তা‘আলা যখন ফেরেশতাদেরকে বললেন,

إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً

‘‘আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করবো’’ (সূরা বাকারা: ৩০) আর যখন তিনি তাদেরকে বললেন,

اسْجُدُوا لِآدَمَ

‘‘তোমরা আদমকে সিজদাহ করো’’ ইত্যাদি সব মিলে অনুরূপ কথা কি আল্লাহর সমস্ত কালাম অথবা উহা কি তার কালামের অংশ বিশেষ? তারা যদি বলে এটিই আল্লাহর সমস্ত কালাম, তাহলে এটি অহংকার ছাড়া অন্য কিছু নয়। আর যদি বলে, আংশিক শুনেছেন, তাহলে তাদের মতেও আল্লাহর কালামের আধিক্যতা, বিভিন্নতা ও বহুত্ব প্রমাণিত হয়। লোকেরা সাধারণভাবে[16] কালামের ব্যাপারে চারটি কথা বলেছে।

(১) শব্দ এবং তার অর্থ মিলেই কালাম হয়। উভয়ের একটি থেকে অন্যটিকে আলাদা করে বুঝার কোনো সুযোগ নেই। যেমন দেহ ও রূহের মিলিত রূপকেই মানুষ বলা হয়। এটিই সালাফদের কথা।

(২) শুধু শব্দকেই কালাম বলা হয়। অর্থ শব্দের অংশ নয়। বরং অর্থ হলো তাই, যা কালাম থেকে বুঝা যায়। এটি একদল মুতাযেলা এবং অন্যদের মত।

(৩) শুধু অর্থকেই কালাম বলা হয়। আর মানুষের মুখ থেকে যে শব্দ ও আওয়াজ বের হয় তাকে কালাম বলা হয় কেবল রূপকার্থে। কেননা শব্দই অর্থের প্রতি নির্দেশনা প্রদান করে। এটি ইবনে কুল্লাব এবং তার অনুসারীদের কথা।

(৪) কালাম শব্দ ও অর্থের যৌথ নাম বিশেষ। অর্থাৎ কখনো শুধু শব্দকে কালাম বলা হয়। আবার কখনো শুধু অর্থকেই কালাম বলা হয়। এটি পরবর্তী যুগের কুল্লাবিয়া সম্প্রদায়ের কতিপয় লোকের মত। কুল্লাবীয়াদের পঞ্চম আরেকটি মত রয়েছে। আবুল হাসান আশ‘আরী রহিমাহুল্লাহ থেকেও এ কথা বর্ণনা করা হয়। তা এ যে, রূপকার্থেই কেবল আল্লাহর কালামকে কালাম হিসাবে নামকরণ করা হয়। আর বনী আদমের কালাম হলো প্রকৃত কালাম। কেননা বনী আদম কথা বলার সময় যে অক্ষরগুলো উচ্চারণ করে, তা তাদের সাথেই প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং যে কথা বলে, সে ব্যতীত অন্য কারো সাথে তার কালাম প্রতিষ্ঠিত হয় না। তবে আল্লাহর কালাম এর ব্যতিক্রম। কুল্লাবীয়াদের মতে কালাম আল্লাহর সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত হয় না। সুতরাং কুরআন আল্লাহর কালাম হওয়া অসম্ভব। এ বিষয়টি যথাস্থানে আলোচনা করা হয়েছে।

যারা বলে আল্লাহর কালামের মাত্র একটি অর্থ, যা তার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত, তারা আখতালের এ কবিতা দিয়ে দলীল পেশ করেছে।

إِنَّ الْكَلَامَ لَفِي الْفُؤَادِ وَإِنَّمَا... جُعِلَ اللِّسَانُ عَلَى الْفُؤَادِ دَلِيلَا

নিশ্চয়ই প্রকৃত কালাম কেবল অন্তরেই থাকে। অন্তরের মধ্যে যে কালাম বা তার অর্থ বিদ্যমান রয়েছে জবান কেবল তাকে ব্যাখ্যা করে মাত্র। এ কবিতার দ্বারা কুরআন আল্লাহর কালাম না হওয়ার দলীল পেশ করা ভুল। কোনো দলীল গ্রহণকারী যদি বুখারী ও মুসলিমের হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ করে, তাহলে এরা বলে, এটি হলো খবরে ওয়াহেদ বা একক ব্যক্তির বর্ণনা। যদিও আলেমগণ তাকে সর্বসম্মতিক্রমে সত্যায়ন করেছেন এবং সে অনুযায়ী আমল করার জন্য তাকে কবুল করে নিয়েছেন।

সুতরাং একজন কবির কবিতা দলীল হিসাবে পেশ করে কিভাবে বলা যেতে পারে যে, প্রকৃত কালাম হলো যা অন্তরের সাথে লাগানো থাকে; জবান থেকে যে কালাম বের হয় তা প্রকৃত কালাম নয়! আরো বলা হয়েছে যে, এটি মূলতঃ আখতালের কবিতা নয়। বিদ‘আতীরা এটি তৈরী করে তার নামে চালিয়ে দিয়েছে। তার কাব্যগ্রন্থে এটি পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ বলেছেন, উপরোক্ত শব্দে কবিতাটি সঠিক নয়; বরং সঠিক রূপ হলো এ রকম, إِنَّ الْبَيَانَ لَفِي الْفُؤَادِ নিশ্চয় প্রকৃত বর্ণনা হলো, যা অন্তরে থাকে। এটিই সঠিক হওয়ার অধিক নিকটবর্তী। আর যদি ধরেও নেয়া হয় যে এটি আখতালের কবিতা, তাহলেও তার কথা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা জায়েয নেই। কেননা সে ছিল খৃষ্টান। কালামের মাস‘আলায় তারা বিভ্রান্ত হয়েছে। তারা মনে করেছে, ঈসা আলাইহিস সালাম স্বয়ং আল্লাহর কালাম। তারা বলেছে লাহুত নাসুতের সাথে মিলে একাকার হয়ে গেছে।[17]

উলুহীয়াতের কিছু অংশ মানুষের কিছু অংশের সাথে মিশে গেছে। সুতরাং যে নাসরানী স্বয়ং কালামের মাস‘আলায় গোমরা হয়েছে, কালামের সংজ্ঞা বর্ণনায় কিভাবে তার কথাকে দলীল হিসাবে পেশ করা যেতে পারে এবং আরবদের ভাষায় কালামের সর্বজন বিদিত অর্থকে পরিহার করা যেতে পারে? আরো বলা যেতে পারে যে, এ কবিতার অর্থ সঠিক নয়। কেননা এর দাবি হলো বোবাকেও মুতাকাল্লিম বলা আবশ্যক। কেননা তার অন্তরেও কালাম যুক্ত আছে। যদিও সে কথা বলেনি এবং তার থেকে কোনো কথা শুনা যায়নি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে করা হয়েছে। এখানে শুধু ইঙ্গিত করা হলো।

এখানে একটি আশ্চর্যের বিষয় হলো, যেসব নাসারা বলে লাহুত এবং নাসুত মিলে গেছে এবং ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর স্থলাভিষিক্ত হয়ে কথা বলেছেন, তাদের কথার সাথে আশায়েরাদের কথার খুব মিল রয়েছে। কেননা আশায়েরাগণ বলে থাকে যে, আল্লাহর কালাম বলতে ঐ অর্থ উদ্দেশ্য, যা তার সত্তার সাথে যুক্ত আছে এবং যা শ্রবণ করা সম্ভব নয়। আর মুসহাফের মধ্যে যে শব্দমালা রয়েছে, তা সৃষ্টি। সুতরাং সেই অনাদি-অবিনশ্বর ও চিরন্তন অর্থকে সৃজিত শব্দমালার সাথে মিলিয়ে দেয়া লাহুতকে নাসুতের সাথে মিশিয়ে দেয়ার মতই। ঈসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে খৃষ্টানরা এ কথাই বলেছে। প্রিয় পাঠক! আপনি নাসারাদের সাথে তাদের সাদৃশ্যের এ বিষয়টির প্রতি ভালো করে খেয়াল করুন। এতে আপনি দেখতে পাবেন যে, আল্লাহর সত্তার সাথে কালাম প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং কুরআনকে মাখলুক বলার ধারণা ইসলামের বাইরে থেকে এসেছে।

যারা বলে কালাম এমন অর্থের নাম, যা নফসের সাথেই প্রতিষ্ঠিত, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ তাদের কথাকে প্রত্যাখ্যান করে। তিনি বলেছেন,

إِنَّ صَلَاتَنَا هَذِهِ لَا يَصْلُحُ فِيهَا شَيْءٌ مِنْ كَلَامِ النَّاسِ

‘‘নিশ্চয়ই আমাদের এ ছলাতের মধ্যে মানুষের কথা বলার কোনো স্থান নেই’’।[18] রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

إِنَّ اللَّهَ يُحْدِثُ مِنْ أَمْرِهِ مَا يَشَاءُ، وَإِنَّ مِمَّا أَحْدَثَ أَنْ لَا تَكَلَّمُوا فِي الصَّلَاةِ

‘‘আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা আদেশ করেন, তিনি যেসব আদেশ করেছেন, তার মধ্যে এও রয়েছে যে, তোমরা ছলাতের মধ্যে কথা বলো না’’।[19]

আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে ছলাত আদায়কারী যদি ছলাতরত অবস্থায় কথা বলে, তাহলে তার ছলাত বাতিল হয়ে যাবে। তারা আরো একমত হয়েছেন যে, ছলাত অবস্থায় ছলাত আদায়কারীর অন্তরে দুনিয়াবী বিষয়াদির প্রতি যেসব চিন্তা ও কল্পনা থাকে যেমন কোনো কিছুকে সত্যায়ন করা কিংবা উহা থেকে কোনো কিছু কামনা করা, তা ছলাত বাতিল করে দেয় না। তবে জবানের মাধ্যমে ঐগুলো উচ্চারণ করলে ছলাত বাতিল হবে। সুতরাং মুসলিমদের ঐক্যমতে মনের কল্পনা-জল্পনাকে কালাম বা কথা বলা হয় না।

ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«إِنَّ اللَّهَ تَجَاوَزَ لأُمَّتِي عَمَّا حَدَّثَتْ بِهِ أَنْفُسَهَا، مَا لَمْ تَعْمَلْ بِهِ أَوْ تَكَلَّمْ»

‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা আমার উম্মতের মনের কল্পনা বা ধারণাগুলো মাফ করে দিয়েছেন। যে পর্যন্ত না সে কাজে পরিণত করবে অথবা বাক্যে ব্যবহার করবে’’।[20]

এতে সংবাদ দেয়া হয়েছে যে, মনের কল্পনাকে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দিয়েছেন। যতক্ষণ না কথা বলা হয় অথবা মনে কল্পনাকে কার্যে পরিণত করা না হয়। সুতরাং মনের কল্পনা এবং প্রকৃত কালামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তিনি আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, কথা বলা না হলে মনের কল্পনার কারণে শাস্তি দেয়া হবে না। অর্থাৎ জবানের মাধ্যমে উহা উচ্চারণ না করা হলে। এটি আলেমদের ঐক্যবদ্ধ মত। সুতরাং জানা গেল যে, আরবী ভাষায় এটিকেই কালাম বলা হয়। কেননা শরীয়াত প্রবর্তক আমাদেরকে কেবল আরবদের ভাষায় সম্বোধন করেছেন। সুনানের কিতাবসমূহে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, মুআয রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন,

«يا رسول الله! وَإِنَّا لَمُؤَاخَذُونَ بِمَا نَتَكَلَّمُ بِهِ ؟ فَقَالَ: وَهَلْ يَكُبُّ النَّاسَ فِي النَّارِ عَلَى مَنَاخِرِهِمْ إِلَّا حَصَائِدُ أَلْسِنَتِهِمْ»

‘‘ইয়া রসূলাল্লাহ! আমরা যেসব কথা বলি, তার কারণেও কি আমাদেরকে পাকড়াও করা হবে? তিনি বললেন, মানুষকে কেবল তাদের জবানের অসংযত কথা-বার্তার কারণেই নাকের উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’’।[21]

সুতরাং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, জবানের উচ্চারণের মাধ্যমে কেবল মানুষের কালাম হয়। القول এবং الكلام শব্দ দু’টি এবং তা থেকে فعل ماضي (অতীত কালের অর্থপ্রদানকারী ক্রিয়া), فعل مضارع (বর্তমান-ভবিষ্যৎকালের অর্থপ্রদানকারী ক্রিয়া) فعل أمر (আদেশ সূচক ক্রিয়া এবং اسم فاعل (কর্তাবাচক বিশেষ্য) এবং আরো যেসব শব্দ নির্গত হয়, সেগুলোকে কুরআন, সুন্নাহ এবং আরবদের পরিভাষায় তখনই কালাম বলা হবে, যখন তার শব্দ ও অর্থের সমন্বয়ে গঠিত হবে। ছাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসারীদের মধ্যে কালাম সম্পর্কে কোনো মতভেদই ছিল না। পরবর্তীকালের বিদ‘আতী আলেমদের মধ্যেই এ নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর তা ছড়িয়ে পড়েছে।

সুতরাং কথা, কালাম এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয়ে কবির কবিতা দিয়ে দলীল পেশ করার কোনো প্রয়োজন নেই। এগুলো এমন বিষয়, যেগুলো পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কালের লোকেরা তাদের কথা-বার্তায় অহরহ উচ্চারণ করে থাকে। এগুলোর অর্থ তারা জানতে পেরেছে। যেমন তারা মাথা, হাত, পা, আসমান, যমীন, পানি, পাহাড় এবং অনুরূপ ইত্যাদির অর্থ জানতে পেরেছে। সুতরাং এগুলোর নতুন এবং যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা দিতে গেলে সহজ বিষয়গুলো আরো জটিল হয়ে যাবে।

যে ব্যক্তি বলল, আল্লাহর কালামের অর্থ মাত্র একটি, তা তার পবিত্র সত্তার সাথে যুক্ত রয়েছে এবং কারীর কণ্ঠে মুসহাফে লিখিত ও সংরক্ষিত কুরআনের যে তেলাওয়াত শুনা যায়, সেটি কেবল আল্লাহর কালামের হেকায়াত মাত্র এবং এটি সৃজিত জিনিস, সে মূলতঃ কুরআনকে মাখলুকই বলল। অথচ সে এটি জানতেই পারেনি। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لاَ يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا

‘‘হে নাবী তুমি ঘোষণা করে দাও, সমস্ত মানব ও জিন যদি এ কুরআনের অনুরূপ রচনা করে আনয়নের জন্য জড়ো হয় এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনো এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না’’। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৮)

আপনি কি মনে করেন, এখানে আল্লাহ তা‘আলা সে কালামের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যা তার নফসের সাথে প্রতিষ্ঠিত আছে? না কি এমন কালামের দিকে যা মানুষ পাঠ করছে এবং যা শুনা যাচ্ছে? কোনো সন্দেহ নেই যে, এখানে এ তেলাওয়াতকৃত ও শ্রম্নত কালামের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা আল্লাহর নফসের সাথে যা প্রতিষ্ঠিত আছে, তার দিকে ইঙ্গিত করা অসম্ভব, তা নাযিলও হয়নি, তা তেলাওয়াত করা হয়নি এবং তা শুনাও যায়নি।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لاَ يَأْتُونَ بِمِثْلِه ‘‘তারা এর অনুরূপ রচনা করতে পারবে না’’। আপনি কি মনে করেন আল্লাহ তা‘আলা এ কথা বলেছেন যে, আমার নফসের মধ্যে যে কালাম আছে এবং যা তারা শুনেনি ও জানেনি তা তারা কখনো রচনা করতে পারবে না? আসল কথা হলো আল্লাহর নফসের মধ্যে যা আছে, সে পর্যন্ত পৌঁছা কোনো সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয় এবং তা জানাও কারো পক্ষে অসম্ভব।[22]

এখন তারা যদি বলে উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কেবল তার নাফ্সের মধ্যকার কালামের ব্বিরণ ও ব্যাখ্যার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যা কারীগণ লিখিত মুসহাফ থেকে তেলাওয়াত করছে এবং যা শুনা যাচ্ছে। আর তার সত্তার সাথে যে কালাম যুক্ত আছে, তার দিকে ইশারা করা সম্ভব নয়। যারা এ কথা বলল, তারা আসলে সুস্পষ্টভাবেই কুরআনকে মাখলুক বলল। শুধু তাই নয়; এ কথা বলার কারণে তারা মুতাযেলাদের চেয়ে বড় কাফের হিসাবে গণ্য হবে।[23] আল্লাহর কালামকে তার অনুরূপ ও সদৃশ শব্দ দ্বারা বর্ণনা করা করা হয়েছে, এ কথা বলার মাধ্যমে সুস্পষ্ট ঘোষণা হয়ে যায় যে, আল্লাহর সমস্ত সিফাতই কেবল হেকায়াত (বর্ণনা করা) স্বরূপ।

কুরআনের এ তেলাওয়াতগুলো যদি আল্লাহর কালামের বর্ণনা হয়ে থাকে, তাহলে তারা আল্লাহর কালামের অনুরূপ কালাম রচনা করতে পারতো। সুতরাং এর অনুরূপ একটি কুরআন রচনা করাতে তাদের দুর্বলতা কোথায়? তাদের কথা মতে আরো আবশ্যক হয় যে, আল্লাহর কালাম এমন আওয়াজ ও অক্ষরের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে, যার আদৌ কোনো আওয়াজ ও অক্ষর নেই।

আসল কথা হলো পবিত্র গ্রন্থে লিখিত এ সূরা এবং আয়াতগুলোই কুরআন। আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন,

قُلْ فَأْتُوا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِثْلِهِ مُفْتَرَيَاتٍ وَادْعُوا مَنْ اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنتُمْ صَادِقِينَ

‘‘তুমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দাও যে, তাহলে কুরআনের ন্যায় দশটি সূরা তৈরী করে আনয়ন করো এবং আল্লাহ্ ছাড়া যাকে ইচ্ছা এ কাজে সাহায্য করার জন্য ডেকে নাও। যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো’’। (সূরা হুদ: ১৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَمَا يَجْحَدُ بِآيَاتِنَا إِلاَّ الظَّالِمُونَ

‘‘বস্তুতঃ যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাদের অন্তরে এটা স্পষ্ট নিদর্শন। যালিমরা ব্যতীত কেউ আমার নিদর্শন অস্বীকার করে না’’। (সূরা আনকাবূত: ৪৯)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

فِي صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ مَّرْفُوعَةٍ مُّطَهَّرَةٍ

‘‘এটি এমনসব পুস্তকে লিখিত আছে, যা সম্মানিত, উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন ও পবিত্র’’। (সূরা আবাসা: ১৩-১৪)

যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে তার জন্য প্রত্যেকটি হরফের বিনিময়ে দশটি নেকী লিখা হবে। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«أَمَا إِنِّي لَا أَقُولُ (الم) حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ، وَلَامٌ حَرْفٌ، وَمِيمٌ حَرْفٌ»

‘‘আমি এ কথা বলছি না যে, আলিফ লাম মীম মিলে একটি হরফ। বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম আলাদা অক্ষর এবং মীম আলাদা অক্ষর’’।[24] এ কুরআন হাফেযদের অন্তরে সংরক্ষিত রয়েছে এবং তেলাওয়াত কারীদের জবানের মাধ্যমে তেলাওয়াত হচ্ছে।

শাইখ হাফিযুদ্দীন আন নাসাফী রহিমাহুল্লাহ তার (المنار) নামক কিতাবে বলেন, إِنَّ الْقُرْآنَ اسْمٌ لِلنَّظْمِ وَالْمَعْنَى ‘‘শব্দমালা ও অর্থের সমন্বয়কে কুরআন বলা হয়’’। অন্যান্য উসূলবিদগণ একই কথা বলেছেন। আর ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর ব্যাপারে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন যে ব্যক্তি ছবলাতের মধ্যে ফারসীতে কিরাআত পাঠ করবে, তার ছ্বলাত বিশুদ্ধ হবে।[25]

কিন্তু তার ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ও আবু ইউসুফের সাথে মত বিনিময়ের পর তিনি এ মত পরিবর্তন করেছেন এবং বলেছেন আরবী পড়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে ফারসীতে কিরাআত পাঠ করবে, তার ছ্বলাত হবে না।আলেমগণ বলেছেন, যে ব্যক্তি আরবী ভাষা পরিত্যাগ করে অন্য ভাষায় কুরআন পড়বে, সে এমন পাগল বলে গণ্য হবে, যার চিকিৎসা করা দরকার অথবা নাস্তিক-মুনাফিক হিসাবে গণ্য হবে, যাকে হত্যা করা আবশ্যক। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এ ভাষায় কথা বলেছেন। কুরআনের শব্দমালা ও অর্থ মিলেই চিরন্তন মুজেযার স্তরে উন্নীত হয়েছে।

[16]. চাই তা মানুষের কালাম বা কথা হোক কিংবা আল্লাহ তাআলার কালাম হোক।

[17]. অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা ও ঈসা আলাইহিস সালাম মিলে গেছে।

[18]. সহীহ: মুসলিম, নাসাঈ ১২১৮, ছহীহ আবু দাউদ, হাদীছ নং- ৮৬২, ইরওয়া ৩৯০।

[19]. হাসান সনদে ইমাম নাসাঈ এবং অন্যরা হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। দেখুন শাইখ আলবানীর তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ১৫৫।

[20]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, ইরওয়া ২০৬২

[21]. তিরমিযী। দেখুন মূল কিতাবের টিকা নং- ১৫৭।

[22]. আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদের জন্য যে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন, তা কেবল শ্রম্নত ও পঠিত কুরআনের অনুরূপ কিছু তৈরী করে আনার জন্যই। তার সত্তার মধ্যে যা আছে, তার অনুরূপ কিছু তৈরী করে আনয়ন করার চ্যালেঞ্জ করেছেন, কোনো বিবেকবান মানুষ এ কথা বলতে পারে না। সুতরাং মানুষ যে কুরআন পাঠ করছে, তাই আল্লাহর কালাম এবং এর অনুরূপ কিছু তৈরী করে আনার জন্যই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এটি যদি আল্লাহর কালামের ব্বিরণ হতো, যা কোনো সৃষ্টির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে, তাহলে অবশ্যই সে সময়ের কবি ও সাহ্যিতকরা অনুরূপ কুরআন তৈরী করে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে পারতো। তারা যেহেতু তা করতে পারেনি, তাই বুঝা গেল যে, এটিই সরাসরি আল্লাহর কালাম; তার সত্তার মধ্যে যেই কালাম রয়েছে উহার ব্যাখ্যা বা ব্বিরণ নয়।

[23]. কেননা মুতাযেলারা কুরআনকে অন্যান্য সৃষ্টির মতই একটি সৃষ্টি বলেছে। আর এরা বলে যে, আল্লাহর সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত এমন একটি সিফাত রয়েছে, যার নাম কালাম। কুরআন হচ্ছে সে কালামের ব্যাখ্যা অথবা তার হেকায়াত স্বরূপ অথবা রূপকার্থেই কুরআনকে কালাম বলা হয়েছে। উহা আল্লাহর প্রকৃত কালাম নয়। আর আশায়েরা সম্প্রদায়ের লোকেরা বলছে যে, আল্লাহর এমন সিফাতও রয়েছে, যা হুবহু বর্ণনা করা হয় এবং উহার সাদৃশ্য পেশ করা যায়। কোনো জিনিসের হেকায়াত করা কেবল উহার অনুরূপ বস্তু দ্বারাই অথবা উহার সদৃশ বস্তু দ্বারাই হয়ে থাকে। কে আছে যে, আল্লাহর কালাম বর্ণনা করবে অথবা উহার হুবহু নমুনা পেশ করবে? জিবরীলের কিংবা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিংবা অন্য কারো পক্ষে আল্লাহর কালামের হুবহু ব্বিরণ দেয়া অথবা উহার সাদৃশ্য ও নুমনা পেশ করা সম্ভব নয়। কুরআন যদি হুবহু আল্লাহর কালাম না হয়ে উহার হেকায়াত, ব্যাখ্যা কিংব উহার সদৃশ হতো তাহলে চ্যালেঞ্জ করার কোনো গুরুত্ব ছিলনা। কেননা জিবরীল ও মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর অন্যতম সৃষ্টি। আর এক সৃষ্টির দ্বারা তৈরী কোনো জিনিসের অনুরূপ জিনিস অন্য সৃষ্টির দ্বারা তৈরী করা মোটেই অসম্ভব নয়।

[24]. ইমাম তিরমিযী হাদীছটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। দেখুন তুহফাতুল আহওয়াযী, হাদীছ নং- ২৮৩৫।

[25]. ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর পুরাতন মত অনুযায়ী কেউ যদি ছবলাতে কুরআনের অনুবাদ পড়ে নেয় সে আরবীতে কুরআন পড়তে সক্ষম হলেও বা না হলেও, তার ছ্বলাত হয়ে যায়। আল্লামা আবু বকর আলজাস্সাস ইমামের এ মতের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, এ কুরআন পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোর মধ্যেও ছিল। আর এ কথা সুস্পষ্ট, সে কিতাবগুলোতে কুরআন আরবী ভাষার শব্দ সমন্বয়ে ছিল না। অন্য ভাষায় কুরআনের বিষয়বস্তু উদ্ধৃত করে দেয়া সত্ত্বেও তা কুরআনই থাকে। কুরআন হওয়াকে বাতিল করে দেয় না। (আহকামুল কুরআন, তৃতীয় খণ্ড) কিন্তু এ যুক্তির দুর্বলতা একেবারেই সুস্পষ্ট। কুরআন মজীদ বা অন্য কোন আসমানী কিতাব নাযিল হবার ধরণ এমন ছিল না যে, আল্লাহ তা‘আলা তার নাবীর অন্তরে কেবল অর্থই সঞ্চার করে দিয়েছেন। তারপর নাবী তাকে নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন। বরং প্রত্যেকটি কিতাব যে ভাষায় এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে শব্দ ও বিষয় উভয়টি সহকারেই এসেছে। পূর্ববর্তী যেসব কিতাবে কুরআনের শিক্ষা ছিল। সেগুলোর কোনটির অনুবাদকে আল্লাহর কিতাব বলা যেতে পারে না এবং তাকে আসলের স্থলাভিষিক্ত করাও সম্ভব নয়। আর কুরআন সম্পর্কে বার বার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে তার প্রতিটি শব্দ আরবী ভাষায় হুবহু নাযিল হয়েছে: ﴾ انِّا انْزَلناه قُرانًا عَرَبِيًّا ﴿ ‘‘নিশ্চিতভাবে আমি তা নাযিল করেছি আরবী ভাষায় কুরআন আকারে’’। (সূরা ইউসুফ: ২)

আল্লাহ তাআলা বলেন, (وكذالك انزلناه حكمًا عَرَبِيًّا) ‘‘আর এভাবে আমি তা নাযিল করেছি একটি নির্দেশ আরবী ভাষায়’’। (সূরা রা’দ: ৩৭) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ﴿قُرْآنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِي عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ﴾ ‘‘আরবী ভাষায় এ কুরআন বক্রতা মুক্ত করে নাযিল করেছি। যাতে তারা তাকওয়া অর্জন করতে পারে’’। (সূরা যুমার: ২৮) এখন কুরআন সম্পর্কে কেমন করে এ কথা বলা যেতে পারে যে, কোনো মানুষ অন্য ভাষায় তার যে অনুবাদ করেছে তাও কুরআনই হবে এবং তার শব্দাবলী আল্লাহর শব্দাবলীর স্থলাভিষিক্ত হবে। মনে হচ্ছে যুক্তির এ দুর্বলতাটি মহান ইমাম পরবর্তী সময়ে উপলব্ধি করে থাকতে পারেন। তাই নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় এ কথা উদ্ধৃত হয়েছে যে, এ বিষয়ে নিজের অভিমত পরিবর্তন করে তিনি ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মত গ্রহণ করে নিয়েছিলেন অর্থাৎ যে ব্যক্তি আরবী ভাষায় ক্বিরাত তথা কুরআন পড়তে সক্ষম নয় সে ততক্ষণ পর্যন্ত ছবলাতে কুরআনের অনুবাদ পড়তে পারে যতক্ষণ না সে আরবী শব্দ উচ্চারণ করার যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু যে ব্যক্তি আরবীতে কুরআন পড়তে পারে সে যদি কুরআনের অনুবাদ পড়ে তাহলে তার ছ্বলাত হবে না।
কুরআনকে যারা মাখলুক বলে, তারা কাফের

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, فَمَنْ سَمِعَهُ فَزَعَمَ أَنَّهُ كَلَامُ الْبَشَرِ فَقَدْ كَفَرَ অতএব যে ব্যক্তি কুরআন শুনে তাকে মানুষের কালাম বলে ধারণা করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। কুরআন আল্লাহর কালাম। এ কথা যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে, তার কাফের হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি যে বলল, কুরআন মুহাম্মাদের কালাম অথবা অন্য কোনো সৃষ্টির কালাম সেও কুফুরী করল। সে সৃষ্টি চাই মানুষ হোক কিংবা ফেরেশতা হোক।

আর কেউ যখন স্বীকার করলো যে, কুরআন আল্লাহর কালাম, অতঃপর সে তার তাবীল করলো এবং তার শব্দ ও অর্থের মধ্যে বিকৃত করলো, সে ঐ ব্যক্তির কিছু কুফুরী কথাকে সমর্থন করলো, যে বলেছিল إِنْ هَذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ ‘‘এটাতো মানুষের কথা বৈ আর কিছুই নয়’’। (সূরা মুদ্দাস্সির: ২৫) তারা ঐসব লোক যাদেরকে শয়তানই কেবল পদস্খলন ঘটিয়েছে।

শাইখের উক্তি: ولا نكفر أحدا من أهل القبلة بذنب ما لم يستحله আহলে কিবলার কেউ কোন গুনাহ করলেই আমরা তাকে কাফের বলি না, যতক্ষণ না সে হালাল মনে করে সেই গুনাহয় লিপ্ত হয়, এ কথার ব্যাখ্যা করার সময় এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমরা জেনে নিলাম ও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলাম যে, এ কুরআন মানুষের সৃষ্টিকর্তারই কালাম। তা কোনো মানুষের কথার সাথে সাদৃশ্য রাখে না। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার কথা সর্বোত্তম, সর্বাধিক সুস্পষ্ট এবং সর্বাধিক সত্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ حَدِيثًا

‘‘আর আল্লাহর কথার চেয়ে অধিক সত্য আর কার কথা হতে পারে?’’ (সূরা নিসা: ৮৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,

قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لاَ يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا

‘‘হে নাবী! বলো, সমস্ত মানব ও জিন যদি এ কুরআনের অনুরূপ রচনা করে আনয়নের জন্য জড়ো হয় এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনো এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না’’। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৮) আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন,

قُلْ فَأْتُوا بِسُوَةٍ مِثْلِهِ

‘‘তুমি বলে দাও যে, তোমরা কুরআনের সূরার ন্যায় একটি সূরা তৈরী করে আনয়ন করো’’। (সূরা ইউনুস: ৩৮)

তৎকালীন মক্কার কাফেররা রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কঠোর শত্রুতা পোষণ করা সত্ত্বেও কুরআনের অনুরূপ একটি সূরা রচনা করতে পারল না। অথচ তারা ছিল আরবদের মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধভাষী। এতে বুঝা গেল রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আল্লাহর পক্ষ হতে সত্য নাবী। কুরআনের শব্দমালা এবং তার গ্রন্থনা উভয়ের মধ্যেই মুজেযা রয়েছে। একটিকে বাদ দিয়ে শুধু অন্যটির মধ্যেই যে মুজেযা রয়েছে, তা নয়। আরবী ভাষায় এ কুরআন বক্রতা মুক্ত এবং সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় এটি নাযিল হয়েছে। কুরআনের অনুরূপ কোনো কালাম থাকার যে নফী বা নাকোচ এসেছে, তা কেবল কথার ধরণ, তার মাধ্যমে কথা বলা এবং গ্রন্থনা ও অর্থের দিক থেকেই; শব্দ ও অক্ষরের দিক মূল্যায়ন করে তার সদৃশ হওয়ার নফী করা হয়নি। অর্থাৎ কুরআনের মধ্যে যে শব্দমালা ও অক্ষরসমূহ রয়েছে, আরবদের কাছেও উহা রয়েছে। তারা কেবল ২৯টি অক্ষর দ্বারাই কথা বলতো। কুরআনেও এ ২৯টি অক্ষরই রয়েছে।[1]

সূরার প্রথমে উল্লেখিত হরফে মুকাত্তাআ তথা বিচ্ছিন্ন বর্ণগুলোর মাধ্যমে এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা তাদের কথা-বার্তায় যে পদ্ধতি ব্যবহার করতো এবং যে ভাষায় তারা পরস্পর সম্বোধন করতো তাতেও তারা হরফে মুকাত্তাআ ব্যবহার করতো। আপনি কি দেখেন না যে, সূরার শুরুত হরফে মুকাত্তাআ ব্যবহার করার পরই কুরআনের আলোচনা এসেছে? যেমন আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারার শুরুতে বলেন,

الم ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ ‘‘আলিফ লাম মীম। এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। এটি মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত’’ (সূরা বাকারা:১-২)। আল্লাহ তা‘আলা সূরা আল-ইমরানের শুরুতে আরো বলেন,

الم اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ نَزَّلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ

‘‘আলিফ লাম মীম। তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি চিরজীবন্ত ও সবকিছুর ধারক। তিনি তোমার উপর সত্য সহকারে এ কিতাব নাযিল করেছেন’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা আরাফের শুরুতে বলেন,

المص كِتَابٌ أُنْزِلَ إِلَيْكَ

‘‘আলিফ লাম মীম সোয়াদ। এ কিতাব তোমার উপর নাযিল করা হয়েছে’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইউনুসের শুরুতে বলেন,

الر تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْحَكِيمِ

‘‘আলিফ -লাম -রা। এগুলো এমন একটি কিতাবের আয়াত যা হিকমত ও জ্ঞানের পরিপূর্ণ’’।

এমনি অন্যান্য সূরার প্রথমে কাটা কাটা বর্ণ উল্লেখ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সতর্ক করেছেন যে, হে মক্কাবাসীগণ! রাসূলে করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের জন্য এমন বিষয় নিয়ে আসেননি, যা তোমাদের কাছে অপরিচিত। বরং তিনি তোমাদের ভাষাতেই সম্বোধন করেছেন।

কিন্তু পঁচা মতবাদের প্রবক্তারা এরূপ বিষয়কে আল্লাহ তা‘আলার কথা বলা এবং জিবরীল কর্তৃক উহা শ্রবণ করার ঘটনাকে নাকোচ করার অযুহাত বানিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ মানুষ যেহেতু বাক্য, অক্ষর ও আওয়াজের মাধ্যমে কথা বলে, তাই মানুষের কালামের সাথে আল্লাহ তা‘আলার কালামের সাদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ভয়ে তারা বলেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা অক্ষর ও আওয়াজের মাধ্যমে কথা বলেন না।

এমনি তারা আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই’’, এ কথাকে আল্লাহর সিফাতকে নাকোচ করার অযুহাত বানিয়েছে। অথচ এ আয়াতের পরের অংশই তাদের কথার প্রতিবাদ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْر ‘‘তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শূরা: ১১) এমনি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, قُلْ فَأْتُوا بِسُوَةٍ مِثْلِهِ বলো, তোমরা কুরআনের সূরার ন্যায় একটি সূরা তৈরী করে আনয়ন করো। (সূরা ইউনুস: ৩৮)

আল্লাহ তা‘আলা এটি বলেননি যে, তোমরা একটি হরফ তৈরী করে আনো কিংবা একটি শব্দ রচনা করে নিয়ে আসো। এর মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। কেননা কুরআনের হরফের মত হরফ বা শব্দ তাদের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল। কারণ ২৯টি হরফ এবং এগুলো দ্বারা গঠিত শব্দগুলোই তারা তাদের কথা-বার্তায় ব্যাবহার করতো। তারা কুরআনের শব্দগুলো দ্বারা কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বে কথা বলতো এবং এগুলোর অর্থও জানতো।

তাই কুরআনের সূরার মত একটি সূরা কিংবা দশটি আয়াত রচনা করে আনার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কুরআনের সর্বাধিক ছোট সূরার মধ্যেও তিন আয়াতের কম নেই। এ জন্যই ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রহিমাহুমাল্লাহ বলেছেন, ছবলাতে কমপক্ষে তিনটি ছোট আয়াত অথবা একটি বড় আয়াত পাঠ করতে হবে। অন্যথায় ছ্বলাত বিশুদ্ধ হবে না। কেননা এর চেয়ে কম পরিমাণের মাধ্যমে তাদেরকে অক্ষম ও অপারগ করা হয়নি। অর্থাৎ এর চেয়ে কম রচনা করার জন্য তাদের সাথে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।

[1]. আলিফ ও হামযাকে একটি ধরলে ২৮টি হয়।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৮ পর্যন্ত, সর্বমোট ৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে