লগইন করুন
মোট কথা, আহলে সুন্নাতের চার মাযহাবের সকল মাযহাব এবং সালাফ ও খালাফ-পরবর্তীদের অন্যান্য আলেমের মতে, কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম; সৃষ্টি নয়। কিন্তু পরবর্তীরা এ বিষয়ে মতভেদ করেছে। কেউ বলেছে, আল্লাহর কালাম তার সাথে প্রতিষ্ঠিত মাত্র একটি কথার নাম।[1]
আওয়াজ ও অক্ষরের মাধ্যমে তা তার সত্তা থেকে বের হয় না। কেউ কেউ বলেছেন, এর অক্ষর ও আওয়াজ রয়েছে এবং আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমে কথা বলেছেন। অথচ তিনি এর পূর্বে কথা বলেননি। আবার আরেক শ্রেণীর আলেম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা অনাদি থেকেই কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত, তিনি যখন যেভাবে ইচ্ছা কথা বলেন। কেননা কথা বলা আল্লাহ তা‘আলার কাদীম বা অনাদি বিশেষণ। কোনো কোনো মুতাযেলী আলেম বলে থাকে কুরআন মাখলুক নয়। তাদের এ কথার উদ্দেশ্য হলো, এটি মিথ্যা ও বানোয়াট নয়; বরং এটি সত্য ও সঠিক। কুরআন সত্য ও সঠিক; এটি বানোয়াট নয়। নিঃসেন্দেহে মুসলিমদের ঐক্যমতে মিথ্যা ও বানোয়াট হওয়ার ধারণা বাতিল।
আহলে কিবলার লোকদের মতভেদ শুধু এ ব্যাপারে যে, এটি কি সৃষ্টি, যা আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেছেন? না এটি আল্লাহর এমন কালাম, যার মাধ্যমে তিনি কথা বলেছেন এবং এটি তার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত আছে? আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকদেরকে খালকে কুরআনের ফিতনার সময় এ প্রশ্নই করা হয়েছিল। অন্যথায় কুরআন মিথ্যা রচনা ও বানোয়াট হওয়ার অভিযোগটি সম্পূর্ণ বাতিল ছিল, তাতে কোনো মুসলিম সন্দেহ পোষণ করতে পারে না।
মুতাযেলাদের শাইখরা এবং অন্যান্য বিদআতীরা স্বীকার করেছে যে, তাওহীদ, আল্লাহর সিফাত ও তাকদীরের ব্যাপারে তারা তাদের আক্বীদাহ ও মাযহাব কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করে না। এমনকি তারা ছাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসরণকারী তাবেঈদের থেকেও গ্রহণ করেনি। তারা ধারণা করে যে, তাদের বিবেক-বুদ্ধিই তাদের পথ আলোকিত করেছে। তাদের ধারণা, তারা শরীয়াতের ইমামদের থেকেই শরীয়তের মাসআলা-মাসায়েল গ্রহণ করে থাকে।
মানুষকে যদি অবিকৃত ফিতরাত এবং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির উপর ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে তাদের মাঝে তাওহীদ, আল্লাহর সিফাত ইত্যাদি বিষয়ে কোনো মতভেদ হবে না। কিন্তু শয়তান তার নিজের ভুল-ভ্রান্তি থেকে কতিপয় মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে বনী আদমকে দ্বীনের ব্যাপারে দলে দলে বিভক্ত করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ نَزَّلَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِي الْكِتَابِ لَفِي شِقَاقٍ بَعِيدٍ
‘‘আল্লাহ যথার্থ সত্য অনুযায়ী কিতাব নাযিল করেছেন। কিন্তু যারা কিতাবের ব্যাপারে মতভেদ করেছে, তারা সত্য থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে’’। (সূরা বাকারা: ১৭৬)
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহর কথা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলা অনাদি থেকেই যখন ইচ্ছা কথা বলেন এবং আল্লাহ তা‘আলার কালাম কাদীম অনাদি শ্রেণীর সিফাতের অন্তর্ভুক্ত। ফিকহুল আকবারে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ যা বলেছেন, তা থেকেও সুস্পষ্ট এটি বুঝা যাচ্ছে। তিনি বলেন, কুরআন মুসহাফে লিখিত রয়েছে, হাফেযদের বক্ষে সংরক্ষিত আছে, মানুষের জবান দিয়ে তা পাঠ করা হচ্ছে, এটি নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিল হয়েছে, জবান দ্বারা আমাদের কুরআন পাঠ করা মাখলুক, কিন্তু কুরআন মাখলুক নয়। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে মুসা আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নাবীদের ব্যাপারে যা উল্লেখ করেছেন এবং ফেরাউন ও ইবলীস সম্পর্কে যা বর্ণনা করেছেন, তাও আল্লাহর কালাম। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে খবর দিয়েছেন। মুসা আলাইহিস সালাম এবং অন্যান্য সৃষ্টির কালামও সৃষ্টি। কুরআন আল্লাহর কালাম; সৃষ্টির কালাম নয়। মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা‘আলার কালাম শুনেছেন। আল্লাহ তা‘আলা যখন মুসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলেছেন, তখন তিনি তার সে অনাদি সিফাতের মাধ্যমে কথা বলেছেন। তার সমস্ত সিফাত সৃষ্টির সিফাতের মতো নয়। আল্লাহ তা‘আলার ইলম রয়েছে, কিন্তু তার ইলম আমাদের ইলমের মত নয়, তার ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু তার ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মত নয়, তিনি দেখেন, কিন্তু তার দেখা আমাদের দেখার মত নয়, তিনি কথা বলেন, কিন্তু তার কথা আমাদের কথার মত নয়......। ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।
ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর উক্তি: ‘‘আল্লাহ তা‘আলা যখন মুসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলেছেন, তখন তিনি তার সে অনাদি সিফাতের মাধ্যমে কথা বলেছেন’’ -এ থেকে জানা যাচ্ছে যে, মুসা আলাইহিস সালাম যখন তুর পাহাড়ে আসলেন তখন কথা বলেছেন, এমনটি নয় যে তিনি অনাদি-অবিনশ্বর সিফাতের মাধ্যমে সবসময় ইয়া মুসা ইয়া মুসা বলে ডেকেই যাচ্ছেন। কোনো বিবেকবান এ কথা বলতে পারে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وَلَمَّا جَاءَ مُوسَى لِمِيقَاتِنَا وَكَلَّمَهُ رَبُّهُ
‘‘অতঃপর মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলেন এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন’’ (সূরা আরাফ:১৪৩) এ আয়াত থেকে এ কথাই বুঝা যায়। এতে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর সেসব অনুসারীর প্রতিবাদ রয়েছে, যারা বলে আল্লাহর মাত্র একটি, যা তার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত এবং তা শ্রবণ করার ধারণাই করা যায় না। তিনি কেবল বাতাসের মধ্যে শব্দ সৃষ্টি করেন। আবু মানসুর আল-মাতুরীদি এবং অন্যরা এ কথাই বলেছে।
ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর উক্তি: الَّذِي هُوَ مِنْ صِفَاتِهِ لَمْ يَزَلْ ‘‘যা তার সিফাতের অন্তর্ভুক্ত এবং তা অনাদি-চিরন্তন ও অবিনশ্বর’’, এতে ঐসব লোকের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন না। অতঃপর তার জন্য এ বিশেষণ তৈরী হয়েছে।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তারা কোনো বাতিল কথার সাথে মিশ্রিত সত্যে অংশকে বাতিলের সাথে প্রত্যাখ্যান করে না; বরং তারা সত্যটুকু রেখে শুধু বাতিলকেই প্রত্যাখ্যান করে। সুতরাং মুতাযেলাদের যে দলীল প্রমাণ করে যে, আল্লাহর কালাম তার ইচ্ছা ও ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত, তিনি যখন ইচ্ছা কথা বলেন ও এক কথার পর অন্য কথা বলেন, তাদের এ কথা সত্য। এটি কবুল করা আবশ্যক। কিন্তু তাদের এ কথা গ্রহণযোগ্য নয় যে, তা আল্লাহর সৃষ্টি, যখন ইচ্ছা তিনি তা সৃষ্টি করেন এবং একটি কালামের পর অন্যটি সৃষ্টি করেন।
ঠিক এমনটি যারা বলেছে, আল্লাহর কালাম তার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত, এটি তার অন্যতম সিফাত এবং সত্তা ব্যতীত সিফাত কায়েম হয় না[2] তাদের কথাও সমর্থন করা আবশ্যক। সুতরাং উপরোক্ত উভয় ফির্কার কথার মধ্যে সত্যের যে অংশ রয়েছে, তা কবুল করে নেয়া আবশ্যক এবং তাদের প্রত্যেকের কথা থেকে শরীয়াত ও বিবেক-বুদ্ধির দলীল যা প্রত্যাখ্যান করে তা থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।
এখন বিরোধীরা যদি আমাদেরকে বলে, উপরোক্ত অর্থে আল্লাহ তা‘আলার জন্য কালাম সাব্যস্ত করলে তার সত্তার সাথে حوادث (সৃষ্ট বস্তু) সাব্যস্ত করা আবশ্যক হয়, তাহলে তাদের জবাবে আমরা বলবো যে, এটি একটি সংক্ষিপ্ত কথা। আল্লাহর জন্য কালাম সাব্যস্ত করলে তার সত্তার সাথে حوادث সৃষ্ট বস্তু যুক্ত হওয়া আবশ্যক হয়, তোমাদের পূর্বে মুসলিমদের কোনো ইমাম কি এ কথা বলেছে? কুরআন ও সুন্নাতের অনেক দলীল আল্লাহর জন্য কালাম সাব্যস্ত করেছে। ইমামদের উক্তি এবং বিবেক-বুদ্ধির সুস্পষ্ট দলীল তা সাব্যস্ত করে।
রসূলগণ যখন তাদের জাতির লোকদেরকে এভাবে সম্বোধন করেছেন এবং সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আহবান করেছেন, চুপিসারে কথা বলেছেন, তখন তারা নিঃসন্দেহে জাতির লোকদেরকে এটি বুঝাননি যে, এ কথাগুলো তিনি তার সত্তা থেকে আলাদা করে অন্যস্থানে সৃষ্টি করেছেন। বরং তারা বুঝিয়েছেন যে, স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই কথাগুলো বলেছেন। তার সত্তার সাথেই এ কথাগুলো প্রতিষ্ঠিত, অন্যের সাথে নয়। তিনিই তা বলেছেন।
যেমন আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তার ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদের ঘটনায় বলেন, আমি নিজেকে এত ছোট মনে করতাম যে, আমার পবিত্রতার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা এমন অহীর মাধ্যমে কথা বলবেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত তেলাওয়াত করা হবে, এমনটি ভাবতেই পারিনি।[3]
এ থেকে যা বুঝা যাচ্ছে, এর বিপরীত উদ্দেশ্য হলে তা বর্ণনা করা আবশ্যক হতো। কেননা যখন যা বর্ণনা করা আবশ্যক, তা যথা সময়ের পরে বর্ণনা করা অবৈধ। কেননা কোনো ভাষাতেই এমনটি পাওয়া যাবে না যে, বক্তা ও কথকের কথা তার সাথে প্রতিষ্ঠিত থাকে না; বরং তার কথা অন্যের সাথে প্রতিষ্ঠিত থাকে। মানুষের বিবেক-বুদ্ধিও এটি সমর্থন করে না।
তারা যদি বলে যে, সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাতেই কেবল তারা আল্লাহর জন্য কালাম সাব্যস্ত করা থেকে বিরত থাকে। সুতরাং তারা আল্লাহ তা‘আলার জন্য কতিপয় সিফাত ছাড়া অন্যান্য সিফাত সাব্যস্ত করে না।
তাদের জবাব হলো, তারা যখন বলবে আল্লাহ তা‘আলার ইলম রয়েছে, কিন্তু তার ইলম আমাদের ইলমের মত নয়, তখন আমরা বলবো, তিনি কথা বলেন, কিন্তু আমাদের কথা বলার মত নয়। সমস্ত সিফাতের ক্ষেত্রে একই কথা। এমন কোনো ক্ষমতাবানের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় কি যার সাথে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত থাকে না এবং এমন কোনো জীবন্ত প্রাণী আছে কি যার মধ্যে হায়াত থাকে না। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দু’আয় বলতেন,
«أَعُوْذُ بِكُلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ الَّتِىْ لاَ يُجَاوِزُهُنَّ بَرٌ وَلاَ فَاجِرٌ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ»
‘‘আমি আল্লাহ্ তা‘আলার ঐ সমস্ত কালেমার উসীলা দিয়ে তার মাখলুকের অনিষ্ট হতে আশ্রয় চাচ্ছি যেগুলো কোনো নেককার কিংবা বদকারের পক্ষেই অতিক্রম করা সম্ভব নয়’’।[4]
বিবেকবান কোনো মানুষের পক্ষে কি এ কথা বলা সম্ভব যে, তিনি মাখলুকের আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দু‘আয় আরো বলেছেন,
«اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذ بِرِضَاك مِنْ سَخَطك وَبِمُعَافَاتِك مِنْ عُقُوبَتك وأعوذبك منك»
‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টির উসীলায় তোমার ক্রোধ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তোমার ক্ষমা গুণের উসীলায় তোমার শাস্তি থেকে মুক্তি কামনা করছি এবং তোমার শাস্তি থেকে তোমার নিকটই আশ্রয় চাচ্ছি’’।[5] তিনি তার দু‘আয় আরো বলেছেন,
«أَعُوذُ بِعزة اللَّهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ»
‘‘আমি নিজের মধ্যে যে ব্যথা অনুভব করছি এবং অন্যান্য যেসব রোগ-ব্যাধির আশঙ্কা করছি, তার ক্ষতি থেকে আমি আল্লাহর ইজ্জত ও ক্ষমতার আশ্রয় কামনা করছি’’[6]। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন,
«وَنعُوذُ بِعَظَمَتِكَ أنْ نغْتاَلَ مِنْ تَحْتِنَا»
‘‘হে আল্লাহ! আমরা তোমার মহত্বের উসিলা দিয়ে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি নিমণ দিক থেকে মাটি ধ্বসে আমাদের আকস্মিক মৃত্যু হতে’’[7]।
এভাবে তিনি যেসব বস্তুর উসীলা দিয়েছেন, তার সবগুলোই আল্লাহর সিফাতের অন্তর্ভুক্ত। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার যেসব সিফাতের উসীলা দিয়ে দু‘আ করেছেন, যথাস্থানে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে শুধু সংক্ষিপ্তভাবে তার দিকে ইশারা করা হলো।
পরবর্তীকালের অনেক হানাফী মনে করে আল্লাহর কালাম মাত্র একটি।[8] তার কথা একাধিক্যতা, বহুত্ব, বিভক্তিকরণ হয় শুধু বাক্য ও ব্যাখ্যার মধ্যে; মূল অর্থ কেবল একটিই। কালামের এ ভাষাগুলো সৃষ্টি। এগুলো যেহেতু আল্লাহর মাত্র একটি কালামের প্রতি নির্দেশনা প্রদান করে এবং তার ব্যাখ্যা প্রদান করে, তাই এগুলোকে আল্লাহর কালাম বলা হয়েছে। তার কালামকে যখন ইবরানী ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়, তখন তাকে তাওরাত বলা হয় আর যখন আরবী ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়, তখন তাকে কুরআন বলা হয়। সুতরাং কালামের ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা ও ভাষা বিভিন্ন হয়; মূল কালাম বিভিন্ন হয় না। তারা আরো বলেছে, এ ভাষাগুলোকে কেবল রূপকার্থেই আল্লাহর কালাম হিসাবে নামকরণ করা হয়।
এটি একটি বাতিল কথা। এ কথা থেকে আবশ্যক হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا ‘‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না’’ (সূরা বনী ইসরাঈল:৩২), -এর অর্থ আর আল্লাহর বাণী: وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ ছ্বলাত কায়েম করো (সূরা বাকারা:৪৩) এর অর্থ একই।[9] আয়াতুল কুরসীর যে অর্থ আয়াত দু’টিরও সে অর্থ। সূরাতুল ইখলাসের যে অর্থ, সূরা লাহাবেরও সে একই অর্থ। তাদের কথার মধ্যে মানুষ যতই চিন্তা করবে, ততই তাদের কথার বিভ্রান্তি পরিষ্কার হবে এবং জানতে পারবে যে, তাদের কথা সালাফদের কথার পরিপন্থী এবং সত্য থেকে বহু দূরে।
আসল কথা হলো, তাওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর এবং কুরআন আল্লাহর কালাম। আল্লাহর কালাম অপরিসীম। এর কোনো শেষ নেই। তিনি যা ইচ্ছা যখন ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা কথা বলেন। সবসময়ই তিনি এ বিশেষণে বিশেষিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُل لَّوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا
‘‘হে মুহাম্মাদ! বলো, যদি আমার রবের কথা লেখার জন্য সমুদ্র কালিতে পরিণত হয় তাহলে সেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে কিন্তু আমার রবের কথা শেষ হবে না। বরং যদি এ পরিমাণ কালি আবারও আনি তাহলে তাও যথেষ্ট হবে না’’। (সূরা কাহাফ: ১০৯) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَوْ أَنَّمَا فِي الْأَرْضِ مِن شَجَرَةٍ أَقْلَامٌ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِن بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَّا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
‘‘পৃথিবীতে যত গাছ আছে তা সবই যদি কলম হয়ে যায় এবং এ সমুদ্রের সাথে যদি আরো সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয়, তবুও আল্লাহর কালাম লিখে শেষ করা যাবে না। অবশ্যই আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী’’। (সূরা লোকমান: ২৭)
মুসহাফের মধ্যে যা আছে, তা যদি হুবহু আল্লাহর কালাম না হয়ে তার কালামের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য হতো, অপবিত্র মানুষের জন্য তা স্পর্শ ও পাঠ করা হারাম হতো না। আসল কথা হলো, আল্লাহর কালাম হাফেযদের বক্ষে সংরক্ষিত রয়েছে, জবানের মাধ্যমে তা পঠিত হচ্ছে এবং মুসহাফে তা লিখিত রয়েছে। যেমন ফিকহুল আকবারে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ সুস্পষ্ট করেই বলেছেন। এ বিষয়ে তিনি যা বলেছেন, তা সবই প্রকৃত ও সত্য। কেউ যদি বলে, في المصحف كلام الله ‘‘মুসহাফের মধ্যে আল্লাহর কালাম লিখিত আছে’’, তা থেকে প্রকৃত অর্থ বুঝতে হবে, তাতে প্রকৃত পক্ষেই আল্লাহর কালাম লিখিত আছে। যদি বলা হয়, فيه خط فلان وكتابته ‘‘মুসহাফে অমুকের হাতের লিখা রয়েছে’’, এ কথাও প্রকৃত অর্থ বুঝতে হবে। আরো যদি বলা হয়, فيه مداد قد كتب به ‘‘মুসহাফের মধ্যে কালি রয়েছে। তা দ্বারা আল্লাহর কালাম লিখা হয়েছে এবং তাতে অমুক লেখকের হাতের লেখা রয়েছে। উপরোক্ত কথাগুলোর মধ্যে في হারফে জার্ থেকে যে যারফিয়াত (স্থান বা পাত্র) বুঝা যায় এবং فيه السموات والأرض ‘‘তাতে রয়েছে আসমান যমীন’’, فيه محمد وعيسى ‘‘তাতে রয়েছে মুহাম্মাদ ও ঈসা’’ অনুরূপ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত في হারফে জার্ থেকে একই যারফিয়াত (স্থান) বুঝা যায় না। অর্থাৎ কুরআনে আসমান-যমীন, পাহাড়-পর্বত, জান্নাত, জাহান্নাম, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ঈসা আলাইহিস সালাম এবং অন্যান্য সৃষ্টির আলোচনা রয়েছে। অথচ এসব বস্তুর অস্তিত্ব মুসহাফের বাইরে। ঐদিকে মুসহাফে কালি রয়েছে এবং অমুক লেখকের হাতের লেখা রয়েছে, এ কথার অর্থ হলো বাস্তবেই কুরআনে নির্দিষ্ট এক প্রকার কালি রয়েছে, যা দ্বারা তা লিখা হয়েছে। কিন্তু যখন বলা হবে فيه كلام الله ‘‘মুসহাফে আল্লাহর কালাম রয়েছে’’ তখন উপরোক্ত যারফিয়াতের অর্থ থেকে এ বাক্যের যারফিয়াতের অর্থ হবে সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ মুসহাফের মধ্যে আল্লাহর কালাম রয়েছে, এ কথা বলা হলেই আবশ্যক হয় না যে, তা আল্লাহর সৃষ্টি। যেমন মুসহাফের মধ্যে কালি রয়েছে এ কথা থেকে আমরা বুঝি যে, তাতে এমন কালি রয়েছে, যা সৃষ্টি। কিন্তু কুরআনে জান্নাত, জাহান্নাম, আসমান-যমীন ইত্যাদি রয়েছে, -এ কথা বলা হলে আবশ্যক হয় না যে, কুরআনের মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে ও বাস্তবে তা রয়েছে। বরং এ সৃষ্টিগুলো রয়েছে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে। আর কুরআনে রয়েছে কেবল এগুলোর আলোচনা। ঠিক তেমনি মুসহাফে আল্লাহর কালাম রয়েছে বলা হলেই আবশ্যক হয় না যে তাতে আল্লাহর কালাম প্রবেশ করেছে এবং তা সৃষ্টি। কেননা সৃষ্টির মধ্যে যা প্রবেশ করে তাও সৃষ্টি!!
উপরোক্ত অর্থগুলোর মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে যে ব্যক্তি অক্ষম হবে, সে পথভ্রষ্ট হবে। এমনকি সঠিক পথের সন্ধানও পাবে না। সে সঙ্গে কুরআন পাঠ করা, যা কারীর কাজ এবং পঠিত কুরআন যা আল্লাহর কালাম, এ কথা দু’টির মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কেও বুঝতে হবে। যে ব্যক্তি এটি বুঝবে না, সে গোমরাহ হবে। কোনো লোক যদি একখন্ড কাগজ দেখতে পায়, যাতে সুপ্রসিদ্ধ কোনো লেখকের হাতে লেখা রয়েছে, ألا كل شيئ ما خلا الله باطل..... ‘‘আল্লাহ ছাড়া প্রত্যেক জিনিসই বাতিল বা ধ্বংস হবে’’, তখন সে বলবে এটি প্রকৃতপক্ষে জাহেলী কবি লাবীদ বিন রাবিআর কবিতাংশ এবং প্রকৃতপক্ষেই অমুকের হাতের লিখা। كل شيئ ‘‘প্রত্যেক জিনিস’’ যা কাগজে উল্লেখ করা হয়েছে তাও প্রকৃত এবং বাস্তব, এখানে যে কালি দ্বারা কাগজে লাবীদের কথা লিখা হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষেই কালি। এ প্রকৃত ও বাস্তব বিষয়গুলোর প্রত্যেকটিই যে ভিন্ন ভিন্ন হাকীকত, তাতে কোনে সন্দেহ নেই এবং এগুলো পরস্পর মিশ্রিত হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই।
القرآن শব্দটি মূলত মাসদার বা ক্রিয়ামূল। কখনো কখনো এটি উল্লেখ করে পাঠ উদ্দেশ্য করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا
‘‘ছ্বলাত কায়েম করো সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং ফজরে কুরআন পাঠ করো। কারণ ফজরের কুরআন পাঠ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে’’ (সূরা বনী ইসরাঈল : ৭৮)।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, «زَيِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ» তোমরা তোমাদের আওয়াজের মাধ্যমে কুরআন পাঠকে সুন্দর করো’’[10] কখনো কখনো কুরআন উল্লেখ করে পঠিত কুরআনকে বুঝানো হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
‘‘তারপর যখন তোমরা কুরআন পড়ো তখন অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো’’ (সূরা নাহল:৯৮)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
‘‘যখন কুরআন, তোমাদের সামনে পড়া হয়, তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো এবং নীরব থাকো, হয়তো তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হবে’’। (সূরা আরাফ: ২০৪)
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ أُنْزِلَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ»
‘‘এ কুরআন সাতটি পদ্ধতিতে নাযিল হয়েছে’’।[11]
এ রকম আরো অনেক আয়াত ও হাদীছ প্রমাণ উপরোক্ত দু’টি অর্থই বহন করে। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষেই কুরআনের অক্ষরসমূহ ও তার অর্থসমূহ আল্লাহরই কালাম এবং তা প্রকৃতপক্ষে মানুষের তৈরী কালি দিয়েই মানুষের হাতের মাধ্যমে লিখা হয়েছে। তাতে সৃষ্ট বস্তুর আলোচনাও রয়েছে। তাই বলে এটি মাখলুক বা সৃষ্টি হয়ে যায়নি। অস্তিত্বশীল বাস্তব বস্তুগুলোর একাধিক হাকীকত থাকে। সত্তাগত অস্তিত্ব, এ ও মস্তিস্কের মধ্যকার কল্পনাগত অস্তিত্ব, শব্দগত অস্তিত্ব ও লিখা সম্পর্কিত অস্তিত্ব।
উদাহরণ স্বরূপ আমরা পাহাড়ের কথা বলতে পারি। পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলা যায় যে, এটি একটি পাহাড়। আমরা যখন নির্দিষ্ট কোনো পাহাড় সম্পর্কে কল্পনা করি, তখন আমাদের মাথার মধ্যেই পাহাড়ের অস্তিত্ব থাকে অর্থাৎ পাহাড় সম্পর্কে কল্পনা ও ধারণা থাকে। এমনি যখন পাহাড় কথাটি উচ্চারণ করি, তখনো কথা বা শব্দের মাধ্যমেও পাহাড়ই বলি; গাছ বলি না। আবার যখন আমরা অক্ষর দ্বারা পাহাড় শব্দটি লিখি তখনো ইঙ্গিতের মাধ্যমে বলি, هذا جبل এটি একটি পাহাড়। পাহাড় লিখতে যে অক্ষরগুলোর প্রয়োজন হয়েছে, এখানে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে; পাহাড়ের সত্তার দিকে নয়। সুতরাং বস্তুগুলো প্রথমত জানা হয়, তারপর উল্লেখ করা হয়, তারপর লিখা হয়। মুসহাফে প্রকৃতপক্ষেই কুরআন লিখার বিষয়টি চতুর্থ স্তরের অন্তর্ভুক্ত।
[2]. যেমন আলেম ছাড়া ইলমের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সাদা জিনিস থেকে সাদা রং আলাদা করে এক স্থানে রেখে এবং জিনিসটিকে অন্যস্থানে রেখে বুঝার কোনো সুযোগ নেই। দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানুষের দৃষ্টিকে একস্থানে রেখে এবং মানুষটিকে অন্য জায়গায় রেখে বুঝার যেমন কোনো উপায় নেই। সুতরাং আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রেও একই কথা। তার পবিত্র যাত থেকে সিফাতকে আলাদা করে বুঝা অকল্পনীয়।
[3]. তার ধারণা ছিল, আল্লাহ তা‘আলা তার নাবীকে স্বপ্ন বা অন্য কোনো মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে দিবেন।
[4]. ছহীহ: ইমাম আহমাদ সহীহ সনদে মারফু হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
[5]. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৪৮৬।
[6]. ছহীহ: ইবনে মাজাহ ৩৫২২, আবূ দাউদ ৩৮৯১।
[7]. ছহীহ: মুসনাদে আহমাদ, আবূ দাউদ ৫০৭৪।
[8]. এখানে লেখক হানাফীদের যে গ্রুপের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তারা ফিকহের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর অনুসরণ করলেও আকীদাহর ক্ষেত্রে তারা আশ‘আরী ও মাতুরীদি মাযহাবের অনুসারী।
[9]. কেননা তাদের মতে আল্লাহর কালাম মাত্র একটি; একাধিক নয়।
[10]. ছহীহ: আবূ দাউদ
[11]. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ৪৯৯২।