আসুন আমরা চৌদ্দ-শত বছর পূর্বে একবার ফিরে যাই ও ইতিহাসের পাতা উল্টাই, তা পড়ে প্রতিটি পৃষ্ঠার লাইনগুলির বাস্তবতা অনুধাবন করি এবং প্রতি পৃষ্ঠায় ও লাইনে চিন্তা ফিকির করি। আর আমরা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে প্রবেশ করি। সরাসরি পর্যবেক্ষণ করি তাঁর অবস্থা ও ঘটনাবলি এবং শ্রবণ করি তাঁর বাণী। নবীর ঘরে শুধু একদিন অবস্থান করি। একদিনই আমাদের জন্য যথেষ্ট। সেখান থেকে আমরা শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করি এবং তাঁর কথা ও কর্ম দ্বারা নিজের জীবন উজ্জ্বল করি।
মানুষের শিক্ষা- দীক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে এবং তাদের পাঠ অভ্যাসও বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং তারা কিতাব, পত্র-পত্রিকা, ফিল্ম ও অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যে তড়িৎ জিয়ারত করে থাকে। অথচ তাদের সে যিয়ারতের চেয়ে শরীয়ত সম্মত আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে যিয়ারত অগ্রাধিকার প্রাপ্ত, সেখানে আমরা যা দেখব ও যা জানব তার প্রতিটি ঘটনার শিক্ষাকে স্বীয় জীবনে বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবো। আমরা এ অল্প পরিসরে তাঁর ঘরের বিশেষ বিশেষ অবস্থারই অবতারণা করব। যেগুলি আমাদের অন্তরে লালন ও আমাদের ঘরে বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য।
হেমুসলিম ভাই!
বিগত ১৪টি শতাব্দীর ইতিহাসে যে সব ঘটনা ঘটেছে ও পূর্ববর্তী জাতিসমূহ কিভাবে অতিবাহিত হয়েছে তা জেনে ও শুনেই শুধুমাত্র মজা পাব এবং তারপর থেমে যাব, এমনটি আমরা করব না।বরং আমরা রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর সীরাত পাঠ করে ও তার সুন্নাতকে জীবনে বাস্তবায়ন করে ও তার আদর্শ ও পন্থানুযায়ী চলে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদাত ও নির্দেশ পালন করব। তিনি তাঁর রাসূলের ভালবাসাকে আমাদের জন্য ওয়াজিব করে দিয়েছেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসার প্রধান প্রধান আলামত হল:তাঁর নির্দেশের অনুসরণ ও তাঁর বারণকৃত ও সাবধান কৃত বিষয় হতে বিরত থাকা, ও তার আনিত বিষয়গুলিকে বিশ্বাস করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ ওয়াজিব। তাঁর নির্দেশকে বাস্তবায়ন এবং তাঁকে অনুকরণীয় আদর্শ ও ইমাম ঘোষণা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣١ ﴾ [ال عمران: ٣١]
অর্থাৎ: বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো তবে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দিবেন, আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু[1]।আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١ ﴾ [الاحزاب : ٢١]
অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ[2]।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের অনুসরণ করার ব্যাপারে মহা গ্রন্থ আল-কুরআনে চল্লিশের অধিকবার উল্লেখ করেছেন।[3]
তাঁর রাসূলের অনুসরণ ছাড়া কোন বান্দার সুখ-শান্তি ও আখিরাতে নাজাতের কোন পথ নেই। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন:
﴿ وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ يُدۡخِلۡهُ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَاۚ وَذَٰلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ١٣ وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُۥ يُدۡخِلۡهُ نَارًا خَٰلِدٗا فِيهَا وَلَهُۥ عَذَابٞ مُّهِينٞ ١٤ ﴾ [النساء : ١٣،١٤]
অর্থাৎ: আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং তা মহা সাফল্য। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হবে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে তিনি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন, সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য লাঞ্ছণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।[4]
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর ভালবাসাকে ঈমানের প্রকৃত সাধ অর্জনের কারণ বলে উল্লেখ করে বলেন:
ثلاث من كن فيه وجد حلاوة الإيمان: أن يكون الله ورسوله أحب إليه مما سواهما... متفق عليه.
অর্থাৎ যার ভিতর তিনটি গুণ রয়েছে সে ঈমানের প্রকৃত সাধ পেয়েছে; যার নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সব চেয়ে প্রিয়।[5]
এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:
فوالذي نفسي بيده لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده ]متفق عليه[ . .
অর্থাৎ ঐ সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের মাঝে কেউ পূর্ণ ঈমানদার ততক্ষণ পর্যন্ত হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার পিতা-মাতা ও সন্তানাদি হতে অধিক প্রিয় না হবো।[6]
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছিল পবিত্র ও মন মুগ্ধকর সীরাত, অতএব তা হতে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করবো ও তার দেখানো পথেই চলবো।
[2] আল-আহযাব, আয়াত: ২১
[3] দেখুন: ইবনে তাইমিয়া রাহেমাহুল্লাহ এর মাজমুউল ফাতাওয়া ১/৪
[4] সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৩ ,১৪
[5] বুখারী, হাদিস: ১৬, ২১, মুসলিম, হাদিস: ৬৭, ৬৮
[6] বুখারী, হাদিস: ১৪ ও মুসলিম
এ ভ্রমণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘর পানে ভ্রমণ ও তার জীবন চরিতের পানে কিছু অবস্থান। তাঁর আদর্শ, আচার-আচরণ ও ব্যবহারই তো একজন মানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার সর্বশেষ বস্তু। তবে এটি তখন হবে যখন আমরা এ হতে নেকী ও সওয়াবের প্রত্যাশা করতে পারি। এ ভ্রমণ তো হল এক অপূর্ব নসিহত, উপদেশ, জীবনাদর্শ, উত্তম নমুনা এবং অনুসরণ ও অনুকরণ।
আর এ ভ্রমণ কোন দৈহিক কোন ভ্রমণ নয়, এ ভ্রমণ হল, কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের মুখনিঃসৃত বর্ণনা কেন্দ্রিক একটি ব্যতিক্রম ভ্রমণ। কেননা, শুধু তিনটি মসজিদ ব্যতীত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘর বা কবর যিয়ারত করা ইত্যাদির উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করা বৈধ নয়। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
لا تشد الرحال إلا إلى ثلاثة مساجد: المسجد الحرام، ومسجدي هذا، والمسجد الأقصى . متفق عليه.
অর্থাৎ: তিনটি মসজিদ ব্যতীত সওয়াবের প্রত্যাশায় ভ্রমণ করা বৈধ না; [আর তা হল:] মসজিদুল হারাম, আমার এ মসজিদ ও মসজিদুল আঁকশা।[1]
অতএব, আমাদের উচিৎ হল, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ পালনার্থে উল্লেখিত তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনও দিকে সওয়াবের প্রত্যাশায় ভ্রমণ করবো না। আল্লাহ তা‘আলাও বলেন:
﴿ وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ ٧ ﴾ [الحشر: ٧]
অর্থাৎ: রাসূল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক।[2]
অতএব,যে সব বিষয় আমাদের জন্য আদর্শ ও নমুনা তা ব্যতীত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিত্যক্ত চিহ্ন ও নির্দশনাবলী অন্বেষণ করব না। এ সম্পর্কে ইবনে ওজ্জাহ বলেন:
«أمر عمر بن الخطاب رضي الله عنه بقطع الشجرة التي بويع تحتها النبي - صلى الله عليه وسلم - فقطعها لأن الناس كانوا يذهبون فيصلون تحتها، فخاف عليهم الفتنة».
যে বৃক্ষের নিচে বাইয়াতে রিযওয়ান সংঘটিত হয়েছিল, ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সে বৃক্ষ কর্তন করার নির্দেশ দেন ও তা কেটে ফেলা হয়। কেননা জনগণ সে গাছের নিচে গিয়ে সালাত আদায় করত। তাই তিনি জনগণের উপর ফিতনার আশঙ্কা করেছিলেন। [3]
ইবনে তাইমিয়া রাহেমাহুল্লাহ গারে হেরা বা হেরা গুহা সম্পর্কে বলেন: নবুওয়তের প্রাক্কালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গারে হেরাতে গিয়ে ইবাদাত করতেন এবং তাতেই সর্ব প্রথম অহি অবতীর্ণ হয়। কিন্তু অহি নাযিলের পর কখনও তিনি সেখানে উঠেননি, এমনকি তিনি তার নিকটবর্তীও হননি। তিনি তো কোন দিন যাননি, বরং তার কোন সাহাবিও কোন দিন যাননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওত প্রাপ্তির পর তেরটি বছর মক্কাতেই অবস্থান করেছেন কিন্তু তিনি কখনও সেখানে যাননি এমনকি সে পাহাড়েও তিনি উঠেন নি। হিজরতের পর তিনি মক্কাতে কয়েকবার এসেছেন, যেমন হুদাইবিয়া সন্ধির ওমরার সময়, মক্কা বিজয়ের বছর এবং সেখানে তিনি প্রায় ২০দিন অবস্থান করেছেন, জিরানা ওমরার সময়ও তিনি গারে হেরাতে যাননি।[4]
এই তো আমরা নবীর শহরে উপস্থিত হবো, এই তো আমাদের সামনে দেখা যাচ্ছে এ শহরের সর্ব বৃহৎ নিদর্শন, আর তা হল ওহুদ পাহাড়। যার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«هذا جبل يحبنا ونحبه»
এ পাহাড় আমাদেরকে ভালবাসে আর আমরাও তাকে ভালবাসি।[5]
রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] ঘরে প্রবেশের পূর্বে তার ঘরের ভিত্তি ও কাঠামোর দিকে খেয়াল করি। আমরা তাঁর জীর্ণ কুটির ও সাধারণ বিছানা দেখে আশ্চর্য হবো না। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এ ধরার বিলাস ত্যাগীদের মাঝে এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি দুনিয়ার চাকচিক্য ও সম্পদের দিকে কখনও দৃষ্টিপাত করতেন না। তার নয়ন শীতল হতো নামাযের মাধ্যমে তিনি বলেন: «بل جعلت قرة عينه في الصلاة». “বরং তার নয়ন শীতল হতো নামাযের মধ্যেই[6]।”
তিনি দুনিয়া সম্পর্কে বলেন:
«مالي وللدنيا، ما مثلي ومثل الدنيا إلا كراكب سار في يوم صائف، فاستظل تحت شجرة ساعة من نهار، ثم راح وتركها».
“আমার ধন-সম্পদ ও দুনিয়া বা আমার ও দুনিয়ার উদাহরণ হল: কোন মুসাফির গরমের দিনে চলতে চলতে কোন বৃক্ষের ছায়া তলে দিনের কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো, তারপর তা ছেড়ে চলে গেল।[7]
আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরের সামনে এসে পৌঁছেছি, আমরা মদিনার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি... এই তো আমাদেরসামনে ভেসে উঠছে রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] এর স্ত্রীদের কক্ষগুলি, যা খেজুর পাতা ও মাটি দ্বারা নির্মিত, আর কিছু পরস্পর মিলিত পাথর দ্বারা, আর তার ছাদগুলি সম্পূর্ণই খেজুর পাতার ছাউনি।
হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি ওসমান বিন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতের যুগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের ঘরে প্রবেশ করে দেখতাম, ঘরের ছাদ হাত দিয়ে নাগাল পেতাম।[8]
এতো অতি সাধারণ জীর্ণ-শীর্ণ কুটির এবং ছোট ছোট কক্ষ, তবে তা ঈমান ও আল্লাহর অনুসরণ, অহি ও রিসালাত দ্বারা সজ্জিত।
[2] সূরা হাশর, আয়াত: ৭
[3] কিতাব আল-ইতিসাম লিল ইমাম সাতবী পৃ: ২৪৮
[4] মাজমুউ আল-ফাতাওয়া ২৭/২৫১।
[5] বুখারী, হাদিস: ২৮৯৩ ও মুসলিম, হাদিস: ১৩৬৫
[6] সহীহ ইবনে হাব্বান, হাদিস: ৬৩৫২ আবু দাউদ: ৩০৫৫।
[7] তিরমিযী
[8] ইবনে সায়াদ এর তাবাকাতুল কুবরা ১/৪৯৯,৫০১, এবং দেখুন: ইবনে কাসীরের সীরাতুন্নাবাবিয়্যায় ২/২৭৪
আমরা এখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরের নিকটবর্তী। অতএব, তাঁর দরজায় অনুমতি সূচক কড়া নাড়াবো। সব খেয়াল পরিত্যাগ করে সামান্যতম দৃষ্টি রাখব ওই সমস্ত সাহাবীদের বর্ণনার দিকে যারা স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছে, তাতে যেন আমরাই তাঁকে দেখছি এবং যেন তাঁর কর্ম তৎপরতা মুবারক জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠে।
আল-বারা ইবনে আজেব [রা] হতে বর্ণিত তিনি বলেন:
«كان النبي - صلى الله عليه وسلم - أحسن الناس وجهًا، وأحسنهم خلقًا، ليس بالطويل البائن، ولا بالقصير».
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোত্তম চেহারা ও সর্বোত্তম শারীরিক কাঠামোর অধিকারী ছিলেন, তিনি অতি লম্বা ছিলেন না বা খাটোও ছিলেন না।[1]
তিনি আরও বর্ণনা করেন:
«كان النبي - صلى الله عليه وسلم - مربوعًا بعيد ما بين المنكبين، له شعر يبلغ شحمة أذنيه، رأيته في حلة حمراء لم أر شيئًا قط أحسن منه».
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশস্ত কাঁধের অধিকারী ছিলেন, তাঁর চুল ছিল কানের লতি পর্যন্ত, আমি তাঁকে লাল চাদর পরিহিত অবস্থায় দেখেছি, তাঁর চেয়ে সুন্দর কোন কিছু আর কখনও দেখিনি।[2]
আবু ইসহাক আস-সুবাইয়ি বলেন:
«سأل رجل البراء بن عازب: أكان وجه رسول الله - صلى الله عليه وسلم - مثل السيف؟ قال: لا بل مثل القمر».
এক ব্যক্তি বারা বিন আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করেছিল: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা কি তলোয়ারের ন্যায় ছিল? তিনি উত্তর দিলেন, না, বরং চাঁদের ন্যায় ছিল।[3]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«ما مسست بيدي ديباجًا ولا حريرًا، ولا شيئًا ألين من كف رسول الله - صلى الله عليه وسلم -، ولا شممت رائحة أطيب من ريح رسول الله - صلى الله عليه وسلم - ».
আমি রেশম কাপড় ও অন্যান্য জিনিস ধরে দেখেছি, কিন্তু কোন জিনিস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত থেকে মোলায়েম বা নরম ছিল না, এবং রাসূলের শরীরের ঘ্রাণের চেয়ে উত্তম কোন ঘ্রাণ আমি কখনো পাইনি।[4]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম গুণাবলীর মধ্যে একটি হল লজ্জা। এমনকি এ সম্পর্কে আবু সাঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
كان - صلى الله عليه وسلم - أشد حياء من العذراء في خدرها، فإذا رأى شيئًا يكرهه عرفناه في وجهه».
অন্ত:পুরে পর্দায় থাকা বালিকার চেয়েও তিনি বেশী লজ্জা করতেন। তবে তিনি যদি কোন কিছু অপছন্দ করতেন তা আমরা তার মুখমণ্ডল থেকেই বুঝতে পারতাম।[5]
এ হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কতিপয় দৈহিক ও চারিত্রিক গুণাবলীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দৈহিক ও চারিত্রিক উভয় প্রকারের আদর্শকে পরিপূর্ণ করেছিলেন।
[2] বুখারী, হাদিস: ৩৫৫১, মুসলিম হাদিস: ২৩৩৭
[3] বুখারী, হাদিস: ৩৫৫২
[4] বুখারী, হাদিসি: ৩৫৬১ মুসলিম, হাদিস: ২৩৩০
[5] বুখারী, হাদিস: ৩৫৬২
ইতি পূর্বে আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর কতিপয় গুণাবলী অবলোকন করলাম। এবার আমরা তাঁর কথা-বার্তা সম্পর্কে অবগত হব, তিনি কি ভাবে কোন ভঙ্গিতে কথা বলতেন! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা বলার পূর্বে আমরা তার কথার কিছু বর্ণনা শুনব।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«ما كان رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يسرد سردكم هذا، ولكنه كان يتكلم بكلام بين، فصل، يحفظه من جلس إليه»
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের মত এমন তাড়াতাড়ি কথা বলতেন না, এক নাগাড়ে কথা বলে যেতেন না। বরং তিনি স্পষ্ট ও ধীর স্থিরভাবে কথা বলতেন, তার বৈঠকে যারা উপস্থিত থাকত, সবাই তার কথাগুলি মুখস্থ করে ফেলত।[1]
তাঁর কথা-বার্তা ছিল অতি সহজ ও নরম। তিনি চাইতেন যে, তাঁর কথা যেন বোধগম্য হয় এবং শ্রোতারা বুঝতে পারে। তার উম্মতের প্রতি এত খেয়াল ছিল যে, তারা কে কতটুকু বুঝতে সক্ষম সে শ্রেণী ভেদ বিবেচনা করে কথা বলতেন, শ্রোতাদের বুঝ শক্তির ব্যবধানের প্রতি লক্ষ্য করে কথা বলতেন, সবাই যাতে বুঝতে পারে তার প্রতি লক্ষ্য রেখে কথা বলতেন। একথা এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও সহনশীল।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«كان كلام رسول الله - صلى الله عليه وسلم - كلامًا فصلاً يفهمه كل من يسمعه »
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা বলার পদ্ধতি ছিল ধীর-স্থির, যারাই তার কথা শুনত সবাই তা বুঝতে পারত।[2]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিনয়, উদারতা ও প্রশস্ত হৃদয়ের প্রতি লক্ষ্য করুন, তার কথাকে বুঝার জন্য একটি কথাকে তিনি বারবার- পুনরায়- বলতেন।
আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كان رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يعيد الكلمة ثلاثًا لتعقل عنه»
কথাকে ভালভাবে বুঝার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কথাকে তিন বার করে পুনরাবৃত্তি করতেন।[3]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের সাথে নরম ও কোমল ব্যবহার করতেন এবং তারা যেন তাতে ভয় না করে সে জন্য প্রবোধ দান করতেন। কেননা অনেকেই এমন ছিল যারা তাকে ভয় করত!।
ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
أتى النبي - صلى الله عليه وسلم - رجل فكلمه فجعل يرعد فرائصه فقال له - صلى الله عليه وسلم -: «هون عليك فإني لست بملك، إنما أنا ابن امرأة تأكل القديد».
একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে তাঁর সাথে ভয়ে ভয়ে কথা বলতে লাগল, অত:পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন: তুমি ভয় করো না, কেননা আমি কোন রাজা-বাদশাহ নই। আমি তো এক মহিলার সন্তান যিনি শুকনা মাংস খেয়েছেন।[4]
[2] আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৩৯
[3] বুখারী, হাদিস: ৯৪, ৯৫, ৬২৪৪
[4] ইবন মাজাহ, হাদিস: ৩৩১২
আমাদেরকে ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে, এখন আমরা মুসলিম উম্মাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাড়ীর ভিতর অবস্থান নিয়েছি, ভাল করে সব কিছু অবলোকন করার জন্য।
এখন আমাদের সামনে সাহাবায়ে কিরাম তাঁর বাড়ীর বিছানা, আসবাব পত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র সম্পর্কে অবহিত করবেন।
আমরা সাধারণত জানি যে, কারো ঘর ও কক্ষের দিকে তাকানো বাঞ্ছনীয় নয়, তবে আদর্শ শিক্ষার জন্য এ সম্মানিত ঘরের কিছু আমরা অবলোকন করব। এ ঘর যার ভিত্তি তো বিনয় এবং মূলধন হল ঈমান, আপনি কি দেখছেন না যে, এ ঘরের দেয়ালে কোন প্রকার জীবের ছবি নেই, যা আজকের দিনে অনেক লোক লটকিয়ে থাকে। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন:
«لا تدخل الملائكة بيتًا فيه كلب ولا تصاوير»،
“যে বাড়ীতে কোন প্রকার জীবের ছবি ও কুকুর থাকে সে বাড়ীতে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না”।[1]
এবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কিছুর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন।
সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন:
أخرج إلينا أنس بن مالك قدح خشب، غليظًا مضببًا بحديد فقال: يا ثابت هذا قدح رسول الله - صلى الله عليه وسلم -. وكان - صلى الله عليه وسلم - يشرب فيه الماء والنبيذ والعسل واللبن.
“একদা আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাদের সামনে লোহার পাত দিয়ে বাঁধাই করা কাঠের তৈরি এক পাত্র নিয়ে উপস্থিত হয়ে বললেন: হে সাবেত! এ হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যবহৃত পাত্র”। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পাত্রে পানি, খেজুর সরবত, মধু ও দুধ পান করতেন[2]।
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - كان يتنفس في الشراب ثلاثًا». يعني: يتنفس خارج الإناء.
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান করার সময় পাত্রের বাইরে তিনবার শাস ফেলতেন”।[3]
ونهى عليه الصلاة والسلام «أن يتنفس في الإناء أو ينفخ فيه».
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান করার সময় পাত্রের ভিতর শাস ফেলতে ও ফু দিতে নিষেধ করেন।[4]
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে লৌহ-বর্মটি জিহাদের ময়দানে, যুদ্ধাভিযান ও অন্যান্য কঠিন মূহুর্তে ব্যবহার করতেন তা হয়তো বর্তমানে তার ঘরে নেই। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন ‘সা’ জবের বিনিময় এক ইয়াহুদীর নিকট সেটি বন্ধক রেখেছিলেন। যেমন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন:
ومات الرسول - صلى الله عليه وسلم - والدرع عند اليهودي.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মৃত্যু বরণ করেন তখন তার লৌহ-বর্মটি ইয়াহুদীর নিকট বন্দক ছিল।[5]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পরিবারকে আতঙ্কে ফেলার জন্য কখনো হঠাৎ করে ঘরে প্রবেশ করতেন না। বরং তিনি পরিবারকে পূর্বে অবহিত করেই ঘরে প্রবেশ করতেন এবং প্রবেশ করার সময় তাদের প্রতি সালাম দিতেন।[6]
উজ্জ্বল দৃষ্টি ও উদার হৃদয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদিসটি অনুধাবন করুন তিনি বলেন,
«طوبى لمن هدي إلى الإسلام، وكان عيشه كفافًا وقنع»،
“সৌভাগ্য তো ইসলামের পথে হিদায়েত প্রাপ্তদের জন্য, এমতাবস্থায় তার জীবনোপকরণও যথেষ্ট ও তুষ্টি পূর্ণ”।[7]
আরও একটি মহান হাদিসের দিকে কর্ণপাত করুন, যাতে তিনি বলেন:
«من أصبح آمنًا في سربه معافى في جسده، عنده قوت يومه، فكأنما حيزت له الدنيا بحذافيرها».
“যে ব্যক্তি স্বীয় গোত্রে নিরাপদে বসবাস করেছে, শারীরিক ভাবেও সে সুস্থ ও তার নিকট রয়েছে সে দিনটির পরিপূর্ণ খাবার, তাহলে লোকটি এমন যেন, সারা দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যও তার মুঠোই রয়েছে”।[8]
[2] তিরমিযী
[3] বুখারী, হাদিস: ৬৫৩১ মুসলিম, হাদিসি: ২০২৮
[4] তিরমিযী, হাদিস: ১৯০৭
[5] বুখারী ও মুসলিম
[6] যাদুল মা’আদ ২/৩৮১
[7] তিরমিযী, হাদিস: ২৩৪৯
[8] তিরমিযী, হাদিস: ২৩৪৬
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্মীয় সম্পর্ক অটুট রাখার ব্যাপারে কি পরিমাণ পরিপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, যা বলে শেষ করা যাবে না। এমন কি মক্কার কাফের কুরাইশরা পর্যন্ত তাঁর প্রশংসা করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং নবুয়তের পূর্বে তাঁকে মহা সত্যবাদী ও আল-আমীন উপাধিতে ভূষিত করেছিল। আর তাঁর স্ত্রী খাদীজা তাকে এ কথাগুলি বলে প্রবোধ দিয়ে বর্ণনা করেন:
«إنك لتصل الرحم وتصدق...»
“আপনি তো আত্মীয়তা অটুট রাখেন ও সর্বদায় সত্য কথা বলেন...।”
এতো সেই ব্যক্তি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি শ্রেষ্ঠ অধিকার ও সর্ব বৃহৎ দায়িত্বসমূহ পালন করেন.. তিনি তাঁর সাত বছর বয়সে ইন্তেকাল করা মাতার কবর যিয়ারত করেন। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
زار النبي - صلى الله عليه وسلم - قبر أمه، فبكى وأبكى من حوله فقال: «استأذنت ربي في أن أستغفر لها فلم يأذن لي، واستأذنته في أن أزور قبرها فأذن لي، فزوروا القبور، فإنها تذكر الموت».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাতার কবর যিয়ারত কালে কান্না করেন ও তার কান্নায় উপস্থিত সকলেই কাঁদেন। অত:পর তিনি বলেন: “আমি স্বীয় প্রভুর নিকট তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চেয়েছিলাম কিন্তু তিনি অনুমতি দেননি, পরে আমি তাঁর সমীপে তার কবর যিয়ারতের অনুমতি চাইলে তিনি আমাকে অনুমতি দেন। অতএব, হে আমার উম্মত! তোমরা কবর যিয়ারত করো, কেননা তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।”[1]
লক্ষ্য করুন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক স্বীয় আত্মীয় স্বজনদের প্রতি ভালবাসা ও সৎ পথের দাওয়াত দেয়ার আগ্রহ ও তাদের হিদায়েত প্রাপ্তি ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল কত প্রবল। আর এ পথে তিনি কত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
لما نزلت هذه الآية: ( وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ ) ، دعا رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قريشًا فاجتمعوا فعمَّ وخصَّ، وقال: «يا بني عبد شمس، يا بني كعب بن لؤي أنقذوا أنفسكم من النار، يا بني مرة بن كعب أنقذوا أنفسكم من النار، يا بني عبد مناف أنقذوا أنفسكم من النار، يا بني هاشم أنقذوا أنفسكم من النار، يا بني عبد المطلب أنقذوا أنفسكم من النار، يا فاطمة أنقذي نفسك من النار، فإني لا أملك لكم من الله شيئًا غير أن لكم رحمًا سأبلها ببلالها».
যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হল: “وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ” অর্থাৎ “আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দেরকে ভয় প্রদর্শন করুন।”[সূরা শুয়ারা: ২১৪] তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের সকল স্তরের লোকদেরকে আহ্বান করে একত্রিত করে বলেন: “হে বনী আবদে শামস, হে বনী কা’ব বিন লুয়িই তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো। হে বনী আবদে মানাফ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো। হে বনী আব্দুল মুত্তালিব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করো। হে ফাতেমা! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করো[2]।
কেননা কিয়ামত দিবসে আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের কোন উপকার করতে পারব না। তবে আমি এ ধরাতে তোমাদের সাথে আত্মীয়তা সম্পর্ক ঠিক রাখবো।
তিনি সেই প্রিয় নবী, যিনি তাঁর চাচা আবু তালিবকে দাওয়াত দিতে কোন বিরক্ত হননি ও কোন প্রকার ত্রুটি করেননি, বিভিন্ন পন্থায় তাকে একের পর এক দাওয়াত দিয়েছেন। এমনকি তিনি তার মৃত্যুর সময়ে তার নিকট এসেছেন:
«لما حضرت أبا طالب الوفاة دخل عليه النبي - صلى الله عليه وسلم - وعنده أبو جهل وعبد الله بن أبي أمية فقال: «أي عم، قل لا إله إلا الله كلمة أحاج لك بها عند الله عز وجل»، فقال أبو جهل وعبد الله بن أبي أمية: يا أبا طالب أترغب عن ملة عبد المطلب؟ قال: فلم يزالا يكلمانه حتى قال آخر شيء كلمهم به، على ملة عبد المطلب».
فقال النبي - صلى الله عليه وسلم -: «لأستغفرن لك مالم أنه عنك» فنزلت: ( مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ ) قال: ونزلت: ( إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ ) ».
“যখন আবু তালিব মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছে তখন তার নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবেশ করেন, সে মুহূর্তে তার নিকট উপস্থিত ছিল আবু জেহেল, আবুল্লাহ বিন আবি ওমাইয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হে আমার চাচা! আপনি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মাবূদ নেই’ কালেমাটি পাঠ করুন, যাতে করে কিয়ামত দিবসে আমি আল্লাহর কাছে প্রমাণ পেশ করে সুপারিশ করতে পারি। এ সময় আবু জেহেল ও আব্দুল্লাহ বিন আবি ওমাইয়া বলল: ওহে আবু তালেব! শেষ পর্যন্ত কি তুমি আব্দুল মুত্তালিব এর ধর্মকে বিসর্জন দিতে যাচ্ছ? তারা বার বার এ কথাটি আবৃত্তি করতে লাগল, অবশেষে আবু তালিব সর্ব শেষ যে কথাটি বলল: তা হল: “আমি আব্দুল মুত্তালিব এর ধর্মের উপরেই।”
অত:পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আমাকে যতক্ষণ পর্যন্ত নিষেধ না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেই থাকব। পরে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়:
﴿ مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَن يَسۡتَغۡفِرُواْ لِلۡمُشۡرِكِينَ وَلَوۡ كَانُوٓاْ أُوْلِي قُرۡبَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُمۡ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَحِيمِ ١١٣ ﴾ [التوبة: ١١٣]
অর্থাৎ: নবী ও অন্যান্য মু’মিনদের জন্য বৈধ নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে, যদিও তারা আত্মীয় হয়, একথা প্রকাশ হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী।[3]
﴿ إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ ٥٦ ﴾ [القصص: ٥٦]
অর্থাৎ: হে নবী [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম]! আপনি যাকে চাইবেন তাকেই হেদায়েত করতে পারবেন না।[4]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু তালিবের জীবদ্দশায় তাকে অনেক বার ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন এমনকি তার জীবনের শেষ মূহুর্ত গুলিতেও। অত:পর তার মৃত্যুর পর নিষেধাজ্ঞা অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার প্রতি সদ্ব্যবহার ও দয়া পরবশ হয়ে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। তারপর তিনি আল্লাহর নির্দেশ শ্রবণ ও অনুসরণের নিমিত্তে নিকটাত্মীয় মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হতে বিরত থাকেন। এ হল তাঁর উম্মতের প্রতি দয়ার চিত্রের মধ্য হতে কতিপয় মহৎ চিত্র। অত:পর পরিশেষে এ মহান দ্বীনে মিত্রতার ও কাফের-মুশরিকদের সাথে বৈরিতার চিত্রও প্রকাশিত হয়েছে যদিও তারা নিকটাত্মীয়ও হয়।
نبي أتانا بعد يأس وفترة من الرسل، والأوثان في الأرض تعبد
فأمسى سراجاً مستنيراً وهادياً يلوح كما لاح الصقيل المهند
وأنذرنا ناراً، وبشر جنة وعلمنا الإسلام فلله نحمد
আরবি কবি বলেন:
নবী-রাসূলদের আগমনের সাময়িক ধারা বিচ্ছিন্নতা উপেক্ষা ও সকল নিরাশা ভেদ করে আমাদের নিকট আগমন করেন একজন নবী যখন বিশ্বজগতে চলত ব্যাপক মূর্তি পূজা।অত:পর তিনি আলোকময় উজ্জ্বল প্রদীপ ও দিশারীতে পরিণত হন এবং তিনি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেন যেমন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল সেই বিখ্যাত হিন্দুস্তানি চকচকে তরবারি। তিনি আমাদেরকে জাহান্নাম হতে ভীতি প্রদর্শন করেন ও জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেন এবং আমাদেরকে ইসলামের বিধি-বিধান শিক্ষা দেন। সুতরাং আল্লাহরই আমরা প্রশংসা করি।
>[2] মুসলিম, হাদিস: ২০৪
[3] সূরা তাওবা, আয়াত: ১১৩
[4] সূরা কাসাস, আয়াত: ৫৬ আহমাদ, হাদিস: ২৩৬৪৭; বুখারী, হাদিস: ১৩৬০; মুসলিম, হাদিস: ২৪
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘর যেন প্রকৃতই সমস্ত আদর্শের প্রাণ কেন্দ্র। যেখান থেকে প্রকাশিত হয় উত্তম আদর্শ, পরিপূর্ণ আদব-শিষ্টাচার, মনোরম সমাজ ও স্বচ্ছ উপাদান। আর তা ছিল চার দেয়ালের অভ্যন্তর কক্ষে যা অন্যান্য মানুষের কেউ তা অবলোকন করেনি। তিনি তো তাঁর অধীনস্থ দাস, খাদেম বা স্ত্রীদের সাথে অবস্থান করতেন। তাদের সাথে উত্তম আচরণ ও অতি বিনয় মূলক ব্যবহার করতেন। যার মধ্যে থাকত না কোন কৃত্রিমতা ও সৌজন্যটা, অথচ তিনি ছিলেন সে ঘরের সরদার ও হুকুম-দাতা ও নিষেধকারী। যারা এ ঘরে অবস্থান করত সবাই তো ছিল তার অধীনস্থ ও দুর্বল। এ উম্মতের রাসূল, পথ নির্দেশক ও মহা নিদর্শনের এত মহত্ত্ব-পূর্ণ এত বড় মান-মর্যাদা ও শানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর বাসগৃহে কেমন ছিলেন কি তাঁর অবস্থা ছিল একটু চিন্তা করে দেখি আমরা!
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঘরে কি কি কাজ করতেন? তিনি উত্তর দেন:
«كان بشرًا من البشر: يفلي ثوبه ويحلب شاته، ويخدم نفسه».
তিনি তো [রক্ত, মাংস ও চামড়ার] একজন মানুষই ছিলেন, তিনি তাঁর কাপড় সেলাই করতেন, ছাগলের দুধ দহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেন।[1]
তিনিই ছিলেন বিনয়ের মূর্ত প্রতীক যার ভিতর ছিল না কোন প্রকার অহংকার, যিনি দিতেন না কাউকে দিতেন না কষ্ট। তিনি ছিলেন প্রতিটি কাজে অংশ গ্রহণকারী মহান ব্যক্তিত্ব এবং সাহায্যকারীর অগ্রনায়ক। মানব জাতির সর্ব শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এগুলি তিনি নিজে আঞ্জাম দিতেন। তিনি এই মুবারক ঘরে বাস করতেন যেখান থেকে এ দ্বীনের হিদায়েতের আলোক বর্তিকা উদ্ভাসিত হয়ে দিক-বিদিকে ছড়িয়ে আলোকিত করেছে, অথচ সে মহান ঘরে এমন খাবার পর্যন্ত জুটত না যা দিয়ে তাঁর পেট পূর্ণ হবে।
নুমান ইবনু বাশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা বর্ণনা করতঃ বলেন:
«لقد رأيت نبيكم - صلى الله عليه وسلم - وما يجد من الدقل ما يملأ بطنه».
“আমি তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমনও দেখেছি যে, তিনি নিম্ন মানের খেজুরও পেতেন না যা দ্বারা তাঁর পেট পূর্ণ হবে।”[2] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:
«إن كنا آل محمد نمكث شهرًا ما نستوقد بنار إن هو إلا التمر والماء».
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারে আমরা এক মাস ব্যাপী কোন প্রকার চুলা জ্বালাতাম না, তবে আমরা শুধু খেজুর ও পানি দ্বারাই জীবন ধারণ করতাম।[3]
এর পরেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর ইবাদাত ও তার অনুসরণ হতে কখনো বিরত হতেন না..। যখনই তিনি মসজিদ হতে আযান ধ্বনি শুনতে পেতেন সে আহ্বানের সাড়া দিয়ে, তখনই তিনি সর্ব প্রকার কাজ ছেড়ে মসজিদ পানে ছুটে যেতেন।
আসওয়াদ বিন ইয়াযিদ বলেন:
سألت عائشة رضي الله عنها، ما كان النبي - صلى الله عليه وسلم - يصنع في البيت؟ قالت: «كان يكون في مهن أهله، فإذا سمع بالأذان خرج».
“আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ীতে কি কি ধরনের কাজ করতেন? উত্তরে তিনি বলেন: “তিনি তার পরিবারের সর্ব প্রকার কাজে নিয়োজিত থাকতেন, তবে আযান শুনার সাথে সাথেই বাড়ী হতে বের হয়ে যেতেন”।[4]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ীতে ফরয সালাত আদায় করেছেন এমন কোন প্রমাণ নেই, তবে তার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে যখন রোগ অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং মসজিদে যেতে অপারগ হয়েছিলেন তখন তিনি বাড়ীতে আদায় করেছেন।
উম্মতের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এত মেহেরবানী ও দয়া থাকার পরও যারা জামাতে উপস্থিত না হয়েছে তাদের প্রতি কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, তিনি বলেন:
«لقد هممت أن آمر بالصلاة فتقام ثم آمر رجلاً أن يصلي بالناس ثم أنطلق معي برجال معهم حزم من حطب إلى قوم لا يشهدون الصلاة فأحرق عليهم بيوتهم».
“আমার ইচ্ছা হয় যে আমি কাউকে নামাযের ইমামতি করার আদেশ দেই আর আমি কাঠসহ কিছু লোককে সাথে নিয়ে ঐ সকল লোকদের বাড়ীতে যাই যারা জামাতের সাথে সালাত পড়ার জন্য উপস্থিত হয়নি। অত:পর তারাসহ তাদের বাড়ী-ঘরকে জালিয়ে দেই।[5]
এ সব তো জামাতের সাথে সালাত আদায়ের গুরুত্ব ও মহত্ত্বের প্রমাণই বহন করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«من سمع النداء فلم يجب فلا صلاة له إلا من عذر»، والعذر خوف أو مرض.
“শরয়ী ওযর ব্যতীত যে ব্যক্তি আযান শুনার পর জামাতের সাথে সালাত আদায় করল না, তার সালাত কবূল হবে না”।[6]
আর ওযর বলতে: শত্রুর ভয় অথবা রোগকে বুঝায়।
হায়রে কোথায় আজ নামাযীরা তারা তো মসজিদ ছেড়ে দিয়ে স্ত্রীকেই প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে!! কোথায় সেই রোগ বা ভয়ের ওযর!!
[2] মুসলিম, হাদিস: ২৯৭৭
[3] মুসলিম, হাদিস: ২৯৭২
[4] বুখারী, হাদিস: ৬৭৬
[5] বুখারী, হাদিস: ৬৪৪; মুসলিম, হাদিস: ৬৫১
[6] তিরমিযী, হাদিস: ২১৭
মানুষের অঙ্গ ভঙ্গি চাল-চলন ও আচার আচরণ হল তার জ্ঞানের লক্ষণ ও তার মন-মানসিকতা বুঝার চাবি কাঠি।
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর কন্যা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা সর্বাপেক্ষা বেশী জানতেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র সম্পর্কে, আর তিনিই নিখুঁত রূপে বর্ণনা দিতে পারবেন তাঁর অবস্থা সম্পর্কে। কেননা তিনি তাঁর ঘুমের অবস্থায়, জাগ্রতাবস্থায়, রোগে ও সুস্থতায়, রাগে ও সন্তুষ্ট অবস্থায় ছিলেন তাঁর নিকটতম।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:
«لم يكن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فاحشًا ولا متفحشًا، ولا صخابًا في الأسواق ولا يجزي بالسيئة السيئة ولكن يعفو ويصفح».
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো অশ্লীল বা অশ্লীলতা লালন-কারী ব্যক্তি ছিলেন না। হাট-বাজারে কখনো হৈচৈ করতেন না। আর মন্দের প্রতিদান মন্দ দ্বারা দিতেন না বরং তিনি ক্ষমা করে দিতেন।[1]
এ হল এই উম্মতের করুণা, হিদায়াত ও সততার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র, আমাদের জন্য তাঁর গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর নাতী হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
سألت أبي عن سير النبي - صلى الله عليه وسلم - في جلسائه، فقال: «كان النبي - صلى الله عليه وسلم - دائم البشر، سهل الخلق، لين الجانب، ليس بفظ غليظ ولا صخاب، ولا عياب، ولا مشاح، يتغافل عما لا يشتهي، ولا يؤيس منه راجيه، ولا يخيب فيه، قد ترك نفسه من ثلاث: الرياء، والإكثار، وما لا يعنيه، وترك الناس من ثلاث: كان لا يذم أحدًا ولا يعيبه، ولا يطلب عورته، ولا يتكلم إلا فيما رجا ثوابه، وإذا تكلم أطرق جلساؤه، كأنما على رءوسهم الطير، فإذا سكت تكلموا، لا يتنازعون عنده الحديث، من تكلم عنده أنصتوا له حتى يفرغ حديثهم عنده حديث أولهم، يضحك مما يضحكون منه، ويتعجب مما يتعجبون منه، ويصبر للغريب على الجفوة في منطقه ومسألته حتى إن كان أصحابه ليستجلبونهم، ويقول: «إذا رأيتم طالب حاجة يطلبها فأرفدوه»، ولا يقبل الثناء إلا من مكافئ، ولا يقطع على أحد حديثه حتى يجوز فيقطعه بنهي أو قيام».
আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথীদের সাথে আচরণ সম্পর্কে আমার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলাম: উত্তরে তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাস্যোজ্জল চেহারাসম্পন্ন, অমায়িক চরিত্রের অধিকারী ও বিনয়ী ছিলেন। কঠোর ছিলেন না, হৈচৈ-কারী ছিলেন না, ছিদ্রান্বেষী ও কৃপণ ছিলেন না, তাঁর নিকট আগত ব্যক্তি নিরাশ ও হতাশ হত না। তিনি নিজের মধ্য হতে তিনটি জিনিস পরিত্যাগ করেছিলেন: [১] রিয়া বা আত্মপ্রকাশ [২] অতিরঞ্জন এবং [৩] অনর্থক কার্যকলাপ। মানুষের জন্য তিনি তিনটি জিনিসকে পরিত্যাগ করেন: [১] তিনি কাউকে নিন্দা করতেন না [২] কাউকে দোষারোপও করতেন না [৩] সওয়াবের প্রত্যাশা ব্যতীত কোন কথাই বলতেন না। যখন তিনি কথা বলতেন, শ্রবণকারীরা এমনভাবে কান পেতে শুনত যেন তাদের মাথায় পাখী বসে আছে। অত:পর যখন তিনি কথা শেষ করতেন তখন তারা কথা বলত। তারা তাঁর সামনে কখনো ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি করত না। তাঁর নিকট কেউ কথা বলা আরম্ভ করলে তারা তার কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকত। তাঁর উপস্থিতিতে তাদেরই কথা বলার অধিকার থাকত যারা প্রথম কথা বলা শুরু করত। লোকেরা যাতে হাসে তিনিও তাতে হাসতেন, মানুষ যাতে আশ্চর্য হয় তিনিও তাতে আশ্চর্য হতেন এবং তিনি বলতেন: “যখন তোমরা কোন অভাবীকে তার প্রয়োজনীয় কিছু প্রার্থনা করতে দেখ তার প্রার্থনায় তাকে সাহায্য করো।” তিনি মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা পছন্দ করতেন না, কারো কথা বলার সময় তার কথার মাঝে বাধা দিতেন না, হাঁ, তবে সীমা অতিক্রম করলে তাকে হয়ত আদেশ বা নিষেধ করতেন।[2]
মুসলিম জাতির নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শগুলিকে অনুধাবন করুন! আর আপনি সেগুলিকে আঁকড়ে ধরুন এবং তা বাস্তবায়ন করায় সচেষ্ট হোন কেননা তা সর্ব প্রকার মঙ্গলের সমাহার।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ছিল যে, তিনি সাহাবীদেরকে দ্বীনের বিধান শিক্ষা দিতেন। যেমন তিনি বলেন:
«من مات وهو يدعو من دون الله ندًا دخل النار».
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে মৃত্যু বরণ করল সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে”।[3]
তিনি আরও বলেন:
: «المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده، والمهاجر من هجر ما نهى الله عنه».
“প্রকৃত মুসলিম তো সে ব্যক্তি যার হাত ও কথার অনিষ্ট হতে অন্য মুসলিম নিরাপদে থাকে, আর প্রকৃত মুহাজির তো সেই ব্যক্তি যে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নিষেধ কৃত বস্তুকে ছেড়ে দিয়েছে”।[4]
তিনি আরও বলেন:
«بشروا المشائين في الظلم إلى المساجد بالنور التام يوم القيامة».
“অন্ধকারে মসজিদে গমনকারীদেরকে কিয়ামত দিবসে পূর্ণ আলোর সুসংবাদ দান কর।[5]
তিনি আরও বলেন:
«جاهدوا المشركين بأموالكم وأنفسكم وألسنتكم».
“তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে স্বীয় জান, মাল ও কথার দ্বারা যুদ্ধ কর”। [আবু দাউদ]
তিনি আরও বলেন:
« إن العبد ليتكلم بالكلمة ما يتبين فيها يزل بها إلى النار أبعد مما بين المشرق والمغرب».
বান্দা এমনও কথা বলে, যার মাধ্যমে সে এমন কিছু প্রকাশ করে যে, তার ফলে সে জাহান্নামের এত দূরে ছিটকে পড়ে যা পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বেরও অধিক”।[6]
তিনি আরও বলেন:
«إني لم أبعث لعانًا، وإنما بعثت رحمة».
“আমি অভিশম্পাতকারী রূপে প্রেরিত হইনি বরং আমি দয়া স্বরূপ প্রেরিত হয়েছি”।[7]
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«لا تطروني كما أطرت النصارى ابن مريم».
নিশ্চয়ই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: তোমরা আমাকে মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করো না যেমন খৃষ্টানরা মরিয়ম পুত্র ঈসাকে করেছে।[8]
জুনদুব বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
سمعت النبي - صلى الله عليه وسلم - قبل أن يموت بخمس وهو يقول: «إني أبرأ إلى الله أن يكون لي منكم خليل فإن الله قد اتخذني خليلاً كما اتخذ إبراهيم خليلاً ولو كنت متخذًا من أمتي خليلاً لاتخذت أبا بكر خليلاً، ألا وإن من كان قبلكم كانوا يتخذون قبور أنبيائهم مساجد، ألا فلا تتخذوا القبور مساجد فإني أنهاكم عن ذلك».
আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পাঁচ দিন পূর্বে তাঁকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন: আমি আল্লাহর নিকট কামনা করি যে, আমার তোমাদের মধ্য হতে একজন খলিল-বন্ধু হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাকে খলিল বানিয়েছেন, যেমন ভাবে তিনি ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে খলিল বানিয়েছিলেন, আর আমি যদি কাউকে খলিল বানাতাম তবে আবু বকরকে আমার খলিল বানাতাম। ওহে আমার উম্মত! তোমাদের পূর্বের উম্মত তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিল, সাবধান হে আমার উম্মত! তোমরা কবরসমূহকে মসজিদে রূপান্তরিত করো না, আমি এ কাজ হতে তোমাদেরকে নিষেধ করছি।[9] এ হাদিসের ভিত্তিতে এটাই প্রতীয়মান হল: যে মসজিদে কবর রয়েছে সে মসজিদে সালাত বৈধ হবে না।
>[2] তিরমিযী
[3] বুখারী, হাদিস: ৪৪৯৭
[4] বুখারী, হাদিস: ১০; মুসলিম, হাদিস: ৪২
[5] তিরমিযী, হাদিস: ২২৩; ইবনু মাযাহ, হাদিস: ৭৮১
[6] বুখারী, হাদিস: ৬৪৭৭; মুসলিম, হাদিস: ২৯৮৮
[7] মুসলিম, হাদিস: ২৫৯৯
[8] বুখারী, হাদিস: ৩৪৪৫
[9] মুসলিম, হাদিস: ৫৩২
জাহেলিয়াতের যুগে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করা ছিল পিতা-মাতার জীবনের এক কাল অধ্যায়। আর এ কাল অধ্যায়ের গ্লানি পরিবার ও বংশের সবার উপর ছেয়ে যেত। পরিশেষে উক্ত সমাজের অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হল যে, লজ্জা ও গ্লানির ভয়ে জীবিত শিশু কন্যাকে কবরস্থ করতে দ্বিধাবোধ করত না। তাদেরকে এমন কদাকার নিষ্ঠুরতার সাথে কবরস্থ করা হতো যাতে না ছিল দয়ার কোন লেশ না ছিল ভালোবাসার কোন স্থান। আর এ কাজটি বিভিন্ন পন্থায় আঞ্জাম দিত। তন্মধ্যে একটি চিত্র ছিল এই যে, কারো কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত পালন করার পর, স্ত্রীকে বলত: তাকে ভাল করে সাজিয়ে দাও আমি তাকে নিয়ে তার চাচার বাড়ীতে যাব। তার পূর্বেই মরুভূমিতে গর্ত খনন করে রাখত, গর্তের নিকট গিয়ে কন্যাকে বলত: এ গর্তের দিকে তাকাও, কন্যা গর্তে নিকট যাওয়ার সাথে সাথে ধাক্কা দিয়ে তাতে ফেলে নির্দয় ও নির্মম ভাবে তার উপর মাটি চাপা দিত।
এ জাহেলী সমাজের মাঝেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মহান দ্বীন নিয়ে এসে নারীকে মা, স্ত্রী, মেয়ে, বোন ও চাচী-ফুফুর মর্যাদায় স্থান দেন। কন্যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসায় ধন্য হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাড়ীতে যখন তাঁর মেয়ে ফাতেমা প্রবেশ করত তখন তিনি তার হাত ধরে চুমা খেয়ে তার পার্শে বসাতেন এবং তিনি যখন তাঁর বাড়ীতে প্রবেশ করতেন, তিনিও তাঁর হাত ধরে চুমা খেয়ে তার স্বস্থানে বসাতেন।[1]
যখন تبت يدا أبي لهب অর্থাৎ আবু লাহাবের হস্তদ্বয় ধ্বংস হোক” আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর কুরাইশরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াতি কাজ থেকে বিরত থাকতে বলে এবং এ বলে হুমকি দেয় যে, বিরত না হলে তার মেয়েদ্বয়কে তালাক দেয়া হবে এবং তিনি তার দাওয়াতি কাজে অবিচল থাকায় তারা তাঁর কলিজার টুকরা যাদের প্রতি এত ভালবাসা ও সম্মান থাকা স্বত্বেও আবু লাহাবের দুই ছেলে উতবা ও উতায়বা কর্তৃক তাঁর দুইজন মেয়ে উম্মে কুলসুম ও রুকাইয়ার তালাককেও ধৈর্যের সাথে মেনে নিয়েছিলেন। এ দ্বীনের দাওয়াত হতে তিনি এতটুকুও সরে দাড়াননি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক তাঁর মেয়েকে অভ্যর্থনা জানানো ও হাসি মুখে তাকে বরণ করার চিত্র আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করে বলেন:
كن أزواج النبي - صلى الله عليه وسلم - عنده، فأقبلت فاطمة رضي الله عنها تمشي ما تخطيء مشيتها من مشية رسول الله - صلى الله عليه وسلم - شيئًا فلما رآها رحب بها وقال: «مرحبًا بابنتي» ثم أجلسها عن يمينه أو عن شماله.
আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীরা তাঁর নিকট বসে থাকতাম, এমন সময় ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা হেঁটে আগমন করত, তার চলন ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলার মতই। তিনি তাকে দেখা মাত্রই এই বলে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলতেন “স্বাগত আমার মেয়েকে” অত:পর তিনি তাকে তার ডানে কিংবা বামে বসাতেন।[2]
কন্যাদের দেখতে যাওয়া ও তাদের সমস্যা দূর করাও প্রমাণ করে তাদের প্রতি তার দয়া ও ভালবাসা। একদা ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমীপে কাজ করতে করতে তার হাতে ফোস্কা পড়ার অভিযোগ করে একজন খাদেমের আবেদন করতে এসে তাকে না পেয়ে, আবেদনটি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জানালেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবেশ করায় তাঁকে আবেদনটি সম্পর্কে অবহিত করলেন। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমরা শুয়ে পড়েছিলাম, এমতাবস্থায় তিনি আমাদের কাছে প্রবেশ করলেন, আমরা তাঁকে দেখে দাঁড়াতে গেলাম, তিনি বলেন: «مكانكما» তোমরা স্বীয় স্থানেই থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএসে আমাদের দুইজনের মাঝখানে বসলেন, তার পায়ের ঠাণ্ডা আমার সিনায় অনুধাবন করতে পারলাম। অত:পর তিনি বললেন:
«ألا أدلكما على ما هو خير لكما من خادم؟ إذا أويتما إلى فراشكما، أو أخذتما مضاجعكما، فكبرا أربعًا وثلاثين وسبحا ثلاثًا وثلاثين، واحمدا ثلاثًا وثلاثين فهذا خير لكما من خادم».
“আমি কি তোমাদেরকে এমন পন্থা শিখবো? যা তোমাদের জন্য একজন খাদেমের চেয়েও উত্তম হবে? আর তা হল: যখন তোমরা বিছানায় শুইতে যাবে, তখন [৩৪] বার আল্লাহু আকবার, [৩৩] বার সুবহানাল্লাহ, [৩৩] বার আল-হামদু লিল্লাহ পাঠ করবে, এগুলি পাঠ করা একজন খাদেম পাওয়া অপেক্ষা শ্রেয়।[3]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধৈর্য ধারণ ও বিপদে অধৈর্য না হওয়ার ব্যাপারে আমাদের জন্য রয়েছেউত্তম আদর্শ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় ফাতেমা ব্যতীত সকল কন্যাগণ মৃত্যু বরণ করেন এর পরেও তিনি কখনও গাল চাপড়াননি, অথবা কাপড় ছিড়েননি বা কুরআন খানী, মিসকিন খানা বা চল্লিশা করে কাউকে এ উপলক্ষে দাওয়াত খাওয়ান নি, অথবা তিনি তাযিয়া বা শোকের কোন প্রকার অনুষ্ঠান করেননি। বরং তিনি সওয়াবের প্রত্যাশায় ও আল্লাহ কর্তৃক তাকদীরকে মেনে নিয়ে ধৈর্য ধারণ করেছেন।
চিন্তিত ও বিপদে পতিত অবস্থায় চিন্তা ও বিপদ হতে রক্ষার জন্য আমাদের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসিয়তসমূহের মধ্যে তিনি যেমন বলতেন:
﴿ قَالُوٓاْ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ١٥٦ ﴾ [البقرة: ١٥٦]
“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন অর্থাৎ আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী”।[4]
”اللهم أجرني في مصيبتي، واخلف لي خيراً منها“
“আল্লাহুম্মা আজিরনী ফি মুসীবাতী ওয়াখলুফ লী খায়রাম মিনহা অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি এ বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করুন এবং এর চেয়ে উত্তম বস্তু আমাকে দান করুন।”[5]
বিপদে পঠিত দোয়ার বাক্যগুলি আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। আর তা হল:
﴿ قَالُوٓاْ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ١٥٦ ﴾ [البقرة: ١٥٦]
“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজীউন অর্থাৎ আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী”।[6]
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা কষ্টে পতিত ব্যক্তির আশ্রয় স্থল, এবং ধৈর্য ধারণকারীদের মহা সওয়াব প্রদানকারী এবং তাদেরকে তাঁর নিকট তার প্রতিদানের সুসংবাদ দিয়ে বলেন:
﴿إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجۡرَهُم بِغَيۡرِ حِسَابٖ ١٠ ﴾ [الزمر: ١٠]
অর্থাৎ ধৈর্য ধারণকারীদের প্রতিদান দেয়া হবে হিসাব ছাড়া। [সূরা যুমার, আয়াত: ১০]
[2] মুসলিম, হাদিস: ২৪৫০
[3] বুখারী, হাদিস: ৩৭০৫
[4] সূরা বাকারাহ: ১৫৬
[5] মুসলিম, হাদিস: ৯১৮
[6] সূরা বাকারাহ, আয়াত: ১৫৬
ছোট সংসারে স্ত্রী অনেক বাধ্যবাধকতার ভিতর খেজুর বৃক্ষের শাখার মত স্বামীর সাথে অতি নিকটে অবস্থান করে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
«الدنيا كلها متاع، وخير متاع الدنيا الزوجة الصالحة».
দুনিয়ার পূর্ণটাই সম্পদ [স্বরূপ] তবে দুনিয়ার সর্বোত্তম সম্পদ হল: সতী স্ত্রী”।[1]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উত্তম আচরণ ও তিনি মনোরম দাম্পত্য জীবনের অধিকারী হওয়ার প্রমাণ বহন করে, উম্মুল মু‘মেনীন আয়েশার রাদিয়াল্লাহু আনহার নামকে আদরাচ্ছলে সংক্ষিপ্ত করে আহ্বান করা এবং তাকে এমন খবর পরিবেশন করা যাতে তার হৃদয় যেন তাঁর দিকে উড়ে যায়।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:
قال رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يومًا: «يا عائش! هذا جبريل يقرئك السلام».
একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে বলেন: হে আয়েশ! [সংক্ষিপ্তাকারে] জিব্রাঈল [আলাইহিস সালাম] এই মাত্র তোমাকে সালাম দিয়ে গেল”।[2]
মুসলিম উম্মতের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিপূর্ণ চরিত্র, সর্বোত্তম আদর্শ ও সুমহান মর্যাদার অধিকারী। দাম্পত্য জীবনের সর্বোত্তম নমুনা এবং নরম প্রকৃতি স্ত্রীর প্রকৃত আবেগ, অনুভূতি ও চাহিদা সম্পর্কে সম্যক অভিহিত।
তিনি স্ত্রীদেরকে এমন অবস্থান প্রদান করেন যা প্রত্যেক নারীই পছন্দ করবে, যার ফলে স্বামীর নিকট সে তার অর্ধাঙ্গিনীতে পরিণত হতে পারে।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:
«كنت أشرب وأنا حائض، فأناوله النبي - صلى الله عليه وسلم -، فيضع فاه على موضع في فيشرب، وأتعرق العرق فيتناوله ويضع فاه على موضع في».
আমি ঋতু স্রাবের অবস্থায় কিছু পান করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিতাম, আর তিনি আমার মুখ রাখার স্থানে মুখ রেখে পান করতেন এবং আমি হাড়ের মাংস খেয়ে শেষ করলে তিনি তা গ্রহণ করে আমার মুখ লাগানোর স্থানেই মুখ লাগাতেন”।[3]
তিনি কোন ক্রমেই তেমন ছিলেন না, যা মুনাফিকরা ধারণা পোষণ করে থাকে এবং প্রাচ্যবিদরা যে সমস্ত মিথ্যা, অলীক অপবাদ ও বাতিল দাবী করে থাকে। বরং তিনি দাম্পত্য জীবনে সর্বোত্তম ও সহজ-সরল পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।
আয়েশ রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:
«إن النبي - صلى الله عليه وسلم - قبل امرأة من نسائه ثم خرج إلى الصلاة ولم يتوضأ».
নিশ্চয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কোন এক স্ত্রীকে চুমু দিয়ে অজু না করেই নামাযের জন্য মসজিদের দিকে বের হয়ে যেতেন”।[4]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর সুমহান মর্যাদা ও সসম্মান অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশ করেছেন। এই যে দেখুন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর বিন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর এক প্রশ্নের উত্তর প্রদান করত: তাকে শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন: স্ত্রীর ভালবাসা, জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ ও সম্মানিত ব্যক্তিকে কোন ক্রমেই অপমানিত করবে না।
আমর বিন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,
أنه قال لرسول الله - صلى الله عليه وسلم -: أي الناس أحب إليك؟ قال: «عائشة».
তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার নিকট কোন ব্যক্তি সব চেয়ে প্রিয়? তিনি উত্তরে বলেন: আয়েশা।[5]
যে ব্যক্তি দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে চায় সে যেন মুমিন জননী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর এ হাদিসটি ভাল করে ভেবে দেখে: তাতে রয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:
«كنت أغتسل أنا ورسول الله - صلى الله عليه وسلم - من إناء واحد».
আমি ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক পাত্র হতে পানি নিয়ে গোসল করতাম।[6]
এ মুসলিম জাতির নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কোন ঘটনা অতিবাহিত হতে দেননি যার মাধ্যমে তিনি বৈধ পন্থায় তাঁর স্ত্রীর মধ্যে আনন্দ ও মজা জাগিয়ে তোলেননি। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:
خرجت مع رسول الله - صلى الله عليه وسلم - في بعض أسفاره، وأنا جارية لم أحمل اللحم ولم أبدن، فقال للناس: «تقدموا» فتقدموا ثم قال: «تعالي حتى أسابقك» فسابقته فسبقته، فسكت عني حتى حملت اللحم، وبدنت وسمنت وخرجت معه في بعض أسفاره فقال للناس «تقدموا» ثم قال: «تعالي أسابقك» فسبقني، فجعل يضحك ويقول: «هذه بتلك».
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোন ভ্রমণে বের হলাম, সে সময় আমি অল্প বয়সী ও শারীরিক গঠনের দিক দিয়েও পাতলা ছিলাম, তখনো মোটা তাজা হইনি। তিনি সাহাবীদেরকে বললেন: তোমরা সামনের দিকে অগ্রসর হও। তারা যখন সামনের দিকে অগ্রসর হল, তখন তিনি আমাকে বললেন: “এসো আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করি, অত:পর আমি তাঁর সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলাম ও আমি তার উপর বিজয় লাভ করলাম। তিনি সে দিন আমাকে কিছুই বললেন না। যখন আমি শারীরিক দিক দিয়ে মোটা হলাম ও ভারী হলাম, ও তাঁর সাথে কোন এক সফরে বের হলাম। তিনি সাহাবীদেরকে বললেন: তোমরা সামনের দিকে অগ্রসর হও। তারা যখন সামনে অগ্রসর হল: তখন তিনি আমাকে বললেন: এসো আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করি, এবারের প্রতিযোগিতায় তিনি আমার আগে চলে গিয়ে হাসতে হাসতে বললেন: আজকের জয় সেই দিনের প্রতিশোধ”।[7]
এ ছিল সুন্দর চিত্ত বিনোদন ও স্ত্রীর ব্যাপারে অসীম গুরুত্বারোপ। সাহাবিদেরকে আগে পাঠিয়ে স্বীয় স্ত্রীর সাথে দৌড় প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করে তার হৃদয় আনন্দিত করা। তারপর পূর্বের বিনোদনের ইতিহাস টেনে আজকের বিজয়ের তুলনা করে বলেন: আজকের বিজয় পূর্বের প্রতিশোধ।
আল্লাহর এই প্রশস্ত জমিনে আজ যারা ভ্রমণ করে এবং জাতির সরদারের অবস্থার প্রতি চিন্তা-ভাবনা করে; যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আচরণের দ্বারা আনন্দিত হয়। যিনি মহা সম্মানিত নবী, বিজয়ী নেতা, কুরাইশ ও বনি হাশেম সন্তান।
কোন এক বিজয়ের দিন, তিনি বিজয়ী বেশে এক মহা সেনা অভিযানের নেতৃত্ব প্রদান করত: প্রত্যাবর্তন করছেন। এমতাবস্থায়তেও তিনি ছিলেন স্বীয় স্ত্রী মু’মিন জননীদের সাথে মুহাব্বত ও নমনীয়তার মূর্ত প্রতীক। অভিযানের নেতৃত্ব, দীর্ঘ সফর, যুদ্ধের মহা বিজয় তাঁকে ভুলিয়ে দেয়নি যে, তাঁর সাথে রয়েছে দুর্বল স্ত্রী জাতি, যাদের তাঁর সুকোমল পরশ ও আন্তরিক ফিস ফি-সানির অধিকার ও প্রয়োজন রয়েছে। যা তাদের দীর্ঘ রাস্তার কষ্ট ও সফরের ক্লান্তি দূর করবে।
ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খায়বারের যুদ্ধ শেষে ফিরছিলেন তখন সাফিয়া বিনতে হুয়াই রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বিবাহ করেন, এবার যে উটের পিঠে সাফিয়া আরোহণ করবেন তার চার দিকে ঘুরে পর্দার জন্য কাপড় লাগানোর পর তিনি উটের পার্শে বসে তাঁর হাটুকে খাড়া করে দিলেন। অত:পর সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা স্বীয় পা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাঁটুতে রেখে উঠে আরোহণ করেন।
সে আকৃষ্ট-কারী দৃশ্যটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিনয়ের বহি:প্রকাশ।
অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন বিজয়ী কমান্ডার, ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে দূত বা রাসূল, তিনি উম্মতকে শিক্ষা দিচ্ছেন যে, স্ত্রীকে সাহায্য করা, তার সাথে বিনয়ী হওয়া, তাদের কাজে সহায়তা এবং তাদেরকে সুখ ও মজা প্রদানে তাঁর সম্মান ও মর্যাদার কোন কমতি হবে না।
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতদেরকে যে সব অসীয়ত করেন তন্মধ্যে একটি হল:
«ألا واستوصوا بالنساء خيرًا».
ওহে আমার উম্মত! তোমরা নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে”।[8]
[2] বুখারী, হাদিস: ৩৭৬৮; মুসলিম, হাদিস: ৮৯৭৫
[3] মুসলিম, হাদিস: ৩০০
[4] আবু দাউদ, হাদিস: ১৭৯; আহমদ, হাদিস: ২৫৭৩২
[5] বুখারী, হাদিস: ৩৬৬২; মুসলিম, হাদিস: ২৩৮৪
[6] বুখারী, হাদিস: ২৬৩
[7] আহমাদ, হাদিস: ২৬২৭৭
[8] বুখারি, হাদিস: ৫১৮৬; মুসলিম, হাদিস: ১৪৬৮