জাহেলিয়াতের যুগে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করা ছিল পিতা-মাতার জীবনের এক কাল অধ্যায়। আর এ কাল অধ্যায়ের গ্লানি পরিবার ও বংশের সবার উপর ছেয়ে যেত। পরিশেষে উক্ত সমাজের অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হল যে, লজ্জা ও গ্লানির ভয়ে জীবিত শিশু কন্যাকে কবরস্থ করতে দ্বিধাবোধ করত না। তাদেরকে এমন কদাকার নিষ্ঠুরতার সাথে কবরস্থ করা হতো যাতে না ছিল দয়ার কোন লেশ না ছিল ভালোবাসার কোন স্থান। আর এ কাজটি বিভিন্ন পন্থায় আঞ্জাম দিত। তন্মধ্যে একটি চিত্র ছিল এই যে, কারো কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত পালন করার পর, স্ত্রীকে বলত: তাকে ভাল করে সাজিয়ে দাও আমি তাকে নিয়ে তার চাচার বাড়ীতে যাব। তার পূর্বেই মরুভূমিতে গর্ত খনন করে রাখত, গর্তের নিকট গিয়ে কন্যাকে বলত: এ গর্তের দিকে তাকাও, কন্যা গর্তে নিকট যাওয়ার সাথে সাথে ধাক্কা দিয়ে তাতে ফেলে নির্দয় ও নির্মম ভাবে তার উপর মাটি চাপা দিত।
এ জাহেলী সমাজের মাঝেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মহান দ্বীন নিয়ে এসে নারীকে মা, স্ত্রী, মেয়ে, বোন ও চাচী-ফুফুর মর্যাদায় স্থান দেন। কন্যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসায় ধন্য হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাড়ীতে যখন তাঁর মেয়ে ফাতেমা প্রবেশ করত তখন তিনি তার হাত ধরে চুমা খেয়ে তার পার্শে বসাতেন এবং তিনি যখন তাঁর বাড়ীতে প্রবেশ করতেন, তিনিও তাঁর হাত ধরে চুমা খেয়ে তার স্বস্থানে বসাতেন।[1]
যখন تبت يدا أبي لهب অর্থাৎ আবু লাহাবের হস্তদ্বয় ধ্বংস হোক” আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর কুরাইশরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াতি কাজ থেকে বিরত থাকতে বলে এবং এ বলে হুমকি দেয় যে, বিরত না হলে তার মেয়েদ্বয়কে তালাক দেয়া হবে এবং তিনি তার দাওয়াতি কাজে অবিচল থাকায় তারা তাঁর কলিজার টুকরা যাদের প্রতি এত ভালবাসা ও সম্মান থাকা স্বত্বেও আবু লাহাবের দুই ছেলে উতবা ও উতায়বা কর্তৃক তাঁর দুইজন মেয়ে উম্মে কুলসুম ও রুকাইয়ার তালাককেও ধৈর্যের সাথে মেনে নিয়েছিলেন। এ দ্বীনের দাওয়াত হতে তিনি এতটুকুও সরে দাড়াননি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক তাঁর মেয়েকে অভ্যর্থনা জানানো ও হাসি মুখে তাকে বরণ করার চিত্র আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করে বলেন:
كن أزواج النبي - صلى الله عليه وسلم - عنده، فأقبلت فاطمة رضي الله عنها تمشي ما تخطيء مشيتها من مشية رسول الله - صلى الله عليه وسلم - شيئًا فلما رآها رحب بها وقال: «مرحبًا بابنتي» ثم أجلسها عن يمينه أو عن شماله.
আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীরা তাঁর নিকট বসে থাকতাম, এমন সময় ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা হেঁটে আগমন করত, তার চলন ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলার মতই। তিনি তাকে দেখা মাত্রই এই বলে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলতেন “স্বাগত আমার মেয়েকে” অত:পর তিনি তাকে তার ডানে কিংবা বামে বসাতেন।[2]
কন্যাদের দেখতে যাওয়া ও তাদের সমস্যা দূর করাও প্রমাণ করে তাদের প্রতি তার দয়া ও ভালবাসা। একদা ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমীপে কাজ করতে করতে তার হাতে ফোস্কা পড়ার অভিযোগ করে একজন খাদেমের আবেদন করতে এসে তাকে না পেয়ে, আবেদনটি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জানালেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবেশ করায় তাঁকে আবেদনটি সম্পর্কে অবহিত করলেন। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমরা শুয়ে পড়েছিলাম, এমতাবস্থায় তিনি আমাদের কাছে প্রবেশ করলেন, আমরা তাঁকে দেখে দাঁড়াতে গেলাম, তিনি বলেন: «مكانكما» তোমরা স্বীয় স্থানেই থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএসে আমাদের দুইজনের মাঝখানে বসলেন, তার পায়ের ঠাণ্ডা আমার সিনায় অনুধাবন করতে পারলাম। অত:পর তিনি বললেন:
«ألا أدلكما على ما هو خير لكما من خادم؟ إذا أويتما إلى فراشكما، أو أخذتما مضاجعكما، فكبرا أربعًا وثلاثين وسبحا ثلاثًا وثلاثين، واحمدا ثلاثًا وثلاثين فهذا خير لكما من خادم».
“আমি কি তোমাদেরকে এমন পন্থা শিখবো? যা তোমাদের জন্য একজন খাদেমের চেয়েও উত্তম হবে? আর তা হল: যখন তোমরা বিছানায় শুইতে যাবে, তখন [৩৪] বার আল্লাহু আকবার, [৩৩] বার সুবহানাল্লাহ, [৩৩] বার আল-হামদু লিল্লাহ পাঠ করবে, এগুলি পাঠ করা একজন খাদেম পাওয়া অপেক্ষা শ্রেয়।[3]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধৈর্য ধারণ ও বিপদে অধৈর্য না হওয়ার ব্যাপারে আমাদের জন্য রয়েছেউত্তম আদর্শ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় ফাতেমা ব্যতীত সকল কন্যাগণ মৃত্যু বরণ করেন এর পরেও তিনি কখনও গাল চাপড়াননি, অথবা কাপড় ছিড়েননি বা কুরআন খানী, মিসকিন খানা বা চল্লিশা করে কাউকে এ উপলক্ষে দাওয়াত খাওয়ান নি, অথবা তিনি তাযিয়া বা শোকের কোন প্রকার অনুষ্ঠান করেননি। বরং তিনি সওয়াবের প্রত্যাশায় ও আল্লাহ কর্তৃক তাকদীরকে মেনে নিয়ে ধৈর্য ধারণ করেছেন।
চিন্তিত ও বিপদে পতিত অবস্থায় চিন্তা ও বিপদ হতে রক্ষার জন্য আমাদের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসিয়তসমূহের মধ্যে তিনি যেমন বলতেন:
﴿ قَالُوٓاْ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ١٥٦ ﴾ [البقرة: ١٥٦]
“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন অর্থাৎ আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী”।[4]
”اللهم أجرني في مصيبتي، واخلف لي خيراً منها“
“আল্লাহুম্মা আজিরনী ফি মুসীবাতী ওয়াখলুফ লী খায়রাম মিনহা অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি এ বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করুন এবং এর চেয়ে উত্তম বস্তু আমাকে দান করুন।”[5]
বিপদে পঠিত দোয়ার বাক্যগুলি আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। আর তা হল:
﴿ قَالُوٓاْ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ١٥٦ ﴾ [البقرة: ١٥٦]
“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজীউন অর্থাৎ আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী”।[6]
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা কষ্টে পতিত ব্যক্তির আশ্রয় স্থল, এবং ধৈর্য ধারণকারীদের মহা সওয়াব প্রদানকারী এবং তাদেরকে তাঁর নিকট তার প্রতিদানের সুসংবাদ দিয়ে বলেন:
﴿إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجۡرَهُم بِغَيۡرِ حِسَابٖ ١٠ ﴾ [الزمر: ١٠]
অর্থাৎ ধৈর্য ধারণকারীদের প্রতিদান দেয়া হবে হিসাব ছাড়া। [সূরা যুমার, আয়াত: ১০]
[2] মুসলিম, হাদিস: ২৪৫০
[3] বুখারী, হাদিস: ৩৭০৫
[4] সূরা বাকারাহ: ১৫৬
[5] মুসলিম, হাদিস: ৯১৮
[6] সূরা বাকারাহ, আয়াত: ১৫৬