ইমাম আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিত (রাহিমাহুল্লাহু) বলেন:
وَاللهُ تَعَالَي يَهْدِيْ مَنْ يَشَاءُ فَضْلاً مِنْهُ، وَيُضِلُّ مَنْ يَشَاءُ عَدْلاً مِنْهُ وَإِضْلاَلُهُ خُذْلاَنُهُ وَتَفْسِيْرُ الْخُذْلاَنِ أَنْ لاَ يُوَفِّقَ الْعَبْدَ عَلَي مَا يَرْضَاهُ عَنْهُ وَهُوَ عَدْلٌ مِنْهُ. وَكَذَا عُقُوْبَةُ الْمَخْذُوْلِ عَلَى الْمَعْصِيَةِ. وَلاَ يَجُوْزُ أَنْ نَقُوْلُ: إِنَّ الشَّيْطَانَ يَسْلُبُ الإِيْمَانَ مِنَ الْعَبْدِ الْمُؤْمِنِ قَهْراً وَجَبْراً. وَلَكِنْ نَقُوْلُ: الْعَبْدُ يَدَعُ الإِيْمَانَ فَإِذَا تَرَكَهُ فَحِيْنَئِذٍ يَسْلُبُهُ مِنْهُ الشَّيْطَانُ.
وَسُؤَالُ مُنْكَرٍ وَنَكِيْرٍ حَقٌّ كَائِنٌ فِيْ الْقَبْرِ، وَإِعَادَةُ الرُّوْحِ إِلَى جَسَدِ الْعَبْدِ فِيْ قَبْرِهِ حَقٌّ، وَضَغْطَةُ الْقَبْرِ وَعَذَابُهُ حَقٌّ كَائِنٌ لِلْكُفَّارِ كُلِّهِمْ أَجْمَعِيْنَ وَلِبَعْضِ عُصَاةِ الْمُؤْمِنِيْنَ.
وَكُلُّ شَيْءٍ ذَكَرَهُ الْعُلَمَاءُ بِالْفَارِسِيِّةِ مِنْ صِفَاتِ اللهِ تَعَالَى عَزَّ اسْمُهُ فَجَائِزٌ الْقَوْلُ بِهِ سِوَى الْيَدِ بِالْفَارِسِيَّةِ وَيَجُوْزُ أَنْ يُقَالَ "بُرُوئِ خُدَاي" عَزَّ وَجَّلَّ بِلاَ تَشْبِيْهٍ وَلاَ كَيْفِيَّةٍ. وَلَيْسَ قُرْبُ اللهِ تَعَالَى وَلاَ بُعْدُهُ مِنْ طَرِيْقِ طُوْلِ الْمَسَافَةِ وَقِصَرِهَا، وَلَكِنْ (وَلاَ) عَلَى مَعْنَى الْكَرَامَةِ وَالْهَوَانِ، وَالْمُطِيْعُ قَرِيْبٌ مِنْهُ بِلاَ كَيْفٍ، وَالْعَاصِىْ بَعِيْدٌ مِنْهُ بِلاَ كَيْفٍ. وَالْقُرْبُ وَالْبُعْدُ وَالإِقْبَالُ يَقَعُ عَلَى الْمُنَاجِىْ وَكَذَالِكَ جَوَارُهُ فِىْ الْجَنَّةِ، وَالْوُقُوْفُ بَيْنَ يَدَيْهِ بِلاَ كَيْفِيَّةٍ.
وَالْقُرْآنُ مُنَزَّلٌ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ ﷺ وَهُوَ فِىْ الْمُصْحَفِ مَكْتُوْبٌ، وَآَيَاتُ الْقُرْآَنِ فِىْ مَعْنَى الْكَلاَمِ كُلُّهَا مُسْتَوِيَةٌ فِىْ الْفَضِيْلَةِ وَالْعَظَمَةِ، إِلاَّ أَنَّ لِبَعْضِهَا فَضِيْلَةَ الذِّكْرِ وَفَضِيْلَةَ الْمَذْكُوْرِ، مِثْلُ آَيَةِ الْكُرْسِىِّ؛ لأَنَّ الْمَذْكُوْرَ فِيْهَا جَلاَلُ اللهِ تَعَالَى وَعَظَمَتُهُ وَصِفَاتُهُ، فَاجْتَمَعَتْ فِيْهَا فَضِيْلَتَانِ: فَضِيْلَةُ الذِّكْرِ وَفَضِيْلَةُ الْمَذْكُوْرِ، وَلِبَعْضِهَا فَضِيْلَةُ الذِّكْرِ فَحَسْبٌ مِثْلُ قِصَّةِ الْكُفَّارِ، وَلَيْسَ لِلْمَذْكُوْرِ فِيْهَا فَضْلٌ وَهُمُ الْكُفَّارُ. وَكَذَالِكَ الأَسْمَاءُ وَالصِّفَاتُ كُلُّهَا مُسْتَوِيَةٌ فِىْ الْعَظَمَةِ وَالْفَضْلِ لاَ تَفَاوُتَ بَيْنَهَا.
وَوَالِدَا رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ تَعَالَي عَلَيْهِ وَآَلِهِ وَسَلَّمَ مَاتَا عَلَى الْكُفْرِ (وَفِيْ نُسْخَةٍ زِيْدَ) وَرَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلَيْهِ وَآَلِهِ وَسَلَّمَ مَاتَ عَلَى الاِيْمَانِ وَأَبُوْ طَالِبٍ عَمُّهُ ﷺ وَأَبُوْ عَلِيٍّ مَاتَ كَافِراً.
وَقَاسِمٌ وَطَاهِرٌ وَإِبْرَاهِيْمُ كَانُوْا بَنِىْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، وَفَاطِمَةُ وَرُقَيَّةُ وَزَيْنَبُ وَأُمُّ كُلْثُوْمٍ كُنَّ جَمِيْعاً بَنَاتِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ. وَرَضِيَ عَنْهُنَّ
وَإِذَا أَشْكَلَ عَلَى الإِنْسَانِ شَيْءٌ مِنْ دَقَائِقِ عِلْمِ التَّوْحِيْدِ، فَإِنَّهُ يَنْبَغِىْ لَهُ أَنْ يَعْتَقِدَ فِىْ الْحَالِ مَا هُوَ الصَّوَابُ عِنْدَ اللهِ تَعَالَى إِلَى أَنْ يَجِدَ عَالِماً فَيَسْأَلُهُ، وَلاَ يَسَعُهُ تَأْخِيْرُ الطَّلَبِ، وَلاَ يُعْذَرُ بِالْوَقْفِ فِيْهِ، وَيَكْفُرُ إِنْ وَقَفَ.
وَخَبَرُ الْمِعْرَاجِ حَقٌّ. مَنْ رَدَّهُ فَهُوَ ضَالٌّ مُبْتَدِعٌ . وَخُرُوْجُ الدَّجَّالِ وَيَأْجُوْجَ وَمَأْجُوْجَ وَطُلُوْعُ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنُزُوْلُ عِيْسَى عَلَيْهِ السَّلاَمُ مِنَ السَّمَاءِ وَسَائِرُ عَلاَمَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ عَلَى مَا وَرَدَتْ بِهِ الأَخْبَارُ الصَّحِيْحَةُ حَقٌّ كَائِنٌ وَاللهُ تَعَالَى يَهْدِيْ مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيْمٍ
বঙ্গানুবাদ:
আল্লাহ তা‘আলা দয়া করে যাকে ইচ্ছা সুপথ প্রদর্শন করেন। আর তিনি ন্যায়পরায়ণতা পূর্বক যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন। বিভ্রান্ত করার অর্থ সাহায্য পরিত্যাগ করা। সাহায্য পরিত্যাগের ব্যাখ্যা এই যে, মহান আল্লাহ সে বান্দাকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক প্রদান করেন না। বিষয়টি তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ। অনুরূপভাবে যে পাপীকে তিনি পাপ ও অবাধ্যতার কারণে পরিত্যাগ করেছেন তার পাপের কারণে শাস্তি প্রদানও তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ।
আমাদের জন্য এ কথা বলা বৈধ নয় যে, শয়তান জবরদস্তি করে বা জোর করে মুমিন বান্দার ঈমান কেড়ে নেয়। বরং আমরা বলি: বান্দা তার ঈমান পরিত্যাগ করে, তখন শয়তান তা তার থেকে ছিনিয়ে নেয়।
মুনকার ও নাকীরের প্রশ্ন সত্য, যা কবরের মধ্যে হবে। কবরের মধ্যে বান্দার রূহকে দেহে ফিরিয়ে দেওয়া সত্য। কবরের চাপ এবং কবরের আযাব সত্য, কাফিররা সকলেই এ শাস্তি ভোগ করবে এবং কোনো কোনো পাপী মুমিনও তা ভোগ করবে।
মহান আল্লাহর- মহিমান্বিত হোক তাঁর নাম- বিশেষণসমূহের বিষয়ে আলিমগণ ফার্সী ভাষায় যা কিছু উল্লেখ করেছেন তা সবই বলা বৈধ, কেবলমাত্র ফার্সী ভাষায় ইয়াদ বা হাত বলা বাদে। ফার্সীতে ‘বরোয়ে খোদা’ -আয্যা ও জাল্লা- অর্থাৎ মহান আল্লাহর চেহারার ওসীলায়- এ কথা বলা যাবে, কোনোরূপ তুলনা ছাড়া এবং কোনোরূপ স্বরূপ সন্ধান ও প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়া। আল্লাহর নৈকট্য এবং তাঁর দূরত্ব কোনো স্থানের দূরত্ব বা স্থানের নৈকট্য নয়। কিন্তু এর অর্থ সম্মান বা অসম্মান। (মোল্লা আলী কারীর বর্ণনা: সম্মান বা অসম্মানের অর্থেও নয়।) অনুগত বান্দা কোনো স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়াই আল্লাহর নিকটবর্তী। অবাধ্য বান্দা কোনো স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়াই আল্লাহ থেকে দূরবর্তী। নৈকট্য, দূরত্ব, নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি প্রার্থনাকারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনুরূপভাবে জান্নাতে মহান আল্লাহর প্রতিবেশিত্ব বা নৈকট্য এবং মহান আল্লাহর সম্মুখে অবস্থান সবই স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়া।
কুরআন কারীম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ এবং তা মুসহাফের মধ্যে লিপিবদ্ধ। আল্লাহর কালাম হিসেবে সকল আয়াত মর্যাদা ও মহত্ত্বের দিক থেকে সমান। তবে কোনো কোনো আয়াতের দ্বিবিধ মর্যাদা রয়েছে: যিক্র-এর মর্যাদা এবং যিক্র-কৃতের মর্যাদা। যেমন আয়াতুল কুরসী। এর মধ্যে মহান আল্লাহর মহত্ত্ব, মর্যাদা ও বিশেষণ আলোচিত হয়েছে, এজন্য এর মধ্যে দ্বিবিধ মর্যাদা একত্রিত হয়েছে: যিক্র বা স্মরণের মর্যাদা এবং স্মরণকৃতের মর্যাদা। আর কোনো কোনো আয়াতের কেবল যিক্র-এর ফযীলত রয়েছে, যেমন কাফিরদের কাহিনী, এতে যাদেরকে উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ কাফিরদের কোনো মর্যাদা নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহর নামসমূহ এবং বিশেষণসমূহ সবই সমমর্যাদার, এগুলোর মধ্যে মর্যাদাগত কোনো তারতম্য নেই।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কুফুরের উপর মৃত্যুবরণ করেন। (কোনো কোনো পান্ডুলিপিতে অতিরিক্ত রয়েছে: এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেন।) তাঁর চাচা এবং আলী (রা)-এর পিতা আবু তালিব কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। কাসিম, তাহির ও ইবরাহীম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পুত্র ছিলেন। ফাতিমা, রুকাইয়া, যাইনাব ও উম্মু কুলসূম তাঁরা সকলেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কন্যা ছিলেন। আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হোন।
যদি কোনো মানুষের কাছে ‘ইলমুত তাওহীদ’-এর বা আকীদার খুঁটিনাটি বিষয়ের সুক্ষ্ম তথ্য অস্পষ্ট হয়ে পড়ে তবে তার দায়িত্ব এই যে, তৎক্ষণাৎ এ বিষয়ে আল্লাহর নিকট যা সঠিক তাই আমার বিশ্বাস-এরূপ বিশ্বাস পোষণ করবে। এরপর যথাশীঘ্র সম্ভব কোনো আলিমকে জিজ্ঞাসা করে সঠিক তথ্য জেনে নিবে। সঠিক তথ্য জানার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দেরি করা তার জন্য বৈধ নয়। এরূপ বিষয়ে ‘দাঁড়িয়ে থাকা’ বা ‘বিরত থাকা’, অর্থাৎ ‘জানিও না এবং জানবও না বলে থেমে থাকা’, বা ‘কিছুই জানি না কাজেই কিছুই বিশ্বাস করব না’ এরূপ কথা বলা তার জন্য কোনো ওযর বলে গৃহীত হবে না। কেউ যদি এরূপ দাঁড়িয়ে থাকে বা বিরত থাকে তবে তা কুফরী বলে গণ্য হবে।
মি’রাজের সংবাদ সত্য। যে তা প্রত্যাখ্যান করে সে বিদ‘আতী ও বিভ্রান্ত।
দাজ্জালের বহির্গমন, ইয়াজূজ ও মাজূজের বহির্গমন, অস্তগমনের স্থান থেকে সূর্যের উদয় হওয়া, আকাশ থেকে ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ এবং কিয়ামাতের অন্যান্য সকল পূর্বাভাস, যেভাবে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই সত্য এবং ঘটবেই। মহান আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।
উপরের বক্তব্যে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) প্রথমে হেদায়াত ও গোমরাহি বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন:
‘‘আল্লাহ তা‘আলা দয়া করে যাকে ইচ্ছা সুপথ প্রদর্শন করেন। আর তিনি ন্যায়পরায়ণতা পূর্বক যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন। বিভ্রান্ত করার অর্থ সাহায্য পরিত্যাগ করা। সাহায্য পরিত্যাগের ব্যাখ্যা এই যে, মহান আল্লাহ সে বান্দাকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক প্রদান করেন না। বিষয়টি তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ। অনুরূপভাবে যে পাপীকে তিনি পাপ ও অবাধ্যতার কারণে পরিত্যাগ করেছেন তার পাপের কারণে শাস্তি প্রদানও তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ। আমাদের জন্য এ কথা বলা বৈধ নয় যে, শয়তান জবরদস্তি করে বা জোর করে মুমিন বান্দার ঈমান কেড়ে নেয়। বরং আমরা বলি: বান্দা তার ঈমান পরিত্যাগ করে, তখন শয়তান তা তার থেকে ছিনিয়ে নেয়।’’
মহান আল্লাহ কুরআনে বারবার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন বা পথভ্রষ্ট করেন। এ বিষয়ক কয়েকটি আয়াত আমরা প্রথম পরিচ্ছেদে তাকদীর প্রসঙ্গে দেখেছি। এ অর্থে আরো কয়েকটি আয়াত:
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللَّهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
‘‘আর আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়; অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখান। আর তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’’[1]
فَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يَهدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلإِسْلامِ وَمَنْ يُرِدْ أَنْ يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ كَذَلِكَ يَجْعَلُ اللَّهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ
‘‘আল্লাহ যাকে হেদায়াত করতে চান তার বক্ষ ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করতে চান তার বক্ষকে সংকীর্ণ-সংকুচিত করে দেন; যেন সে আকাশে-ঊর্ধ্বে আরোহণ করছে। এভাবেই আল্লাহ অকল্যাণ দেন তাদের উপর যারা ঈমান আনে না।’’[2]
পাশাপাশি কুরআনে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঈমান আনয়ন বা সত্য গ্রহণ মানুষের নিজের ইচ্ছাধীন কর্ম। মহান আল্লাহ বলেন:
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ
‘‘আর বল, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সত্য; কাজেই যে ইচ্ছা করে সে ঈমান গ্রহণ করুক এবং যে ইচ্ছা করে সে কুফরী করুক।’’[3]
অন্য আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
إِنَّ هَذِهِ تَذْكِرَةٌ فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ سَبِيلا
‘‘নিশ্চয় এ এক উপদেশ; অতএব যে চায় সে তার রবের দিকে পথ গ্রহণ করুক।’’[4]
উপরের সকল আয়াতের সমন্বিত অর্থ ইমাম আবু হানীফা এখানে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কথার সারমর্ম হলো, মানুষকে আল্লাহ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছা ব্যবহার করে কি করবে তিনি তা জানেন। তিনি ইচ্ছা করলে তার ইচ্ছা ও কর্মে বাধা দিতে পারেন বা তার ইচ্ছাকে প্রভাবিত করতে পারেন। তিনি তাঁর কোনো বান্দার ইচ্ছা বা কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অতিরিক্ত তাওফীক কল্যাণের সহায়তা প্রদান করেন। আর এ অর্থেই তিনি বলেছেন: ‘‘যাকে ইচ্ছা করেন তাকে তিনি হেদায়াত করেন।’’ তার হেদায়াত অর্থ তাঁর তাওফীক, যা তাঁর পক্ষ থেকে অতিরিক্ত করুণা। পক্ষান্তরে যার ইচ্ছা ও কর্মে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন তাকে এরূপ তাওফীক বা মঙ্গলের সহায়তা প্রদান থেকে তিনি বিরত থাকেন; বরং তাকে তার স্বাধীন ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেন। তখন সে স্বাধীন ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে বিপথগামী হয়। এ অর্থেই তিনি বলেছেন: ‘‘যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে পথভ্রষ্ট করেন।’’ কাউকে তার ইচ্ছা ও কর্মের কারণে অতিরিক্ত করুণা ও তাওফীক প্রদান থেকে বিরত থাকা ইনসাফের ব্যতিক্রম নয়। এরূপ ব্যক্তির ইচ্ছা ও কর্মের জন্য তাকে শাস্তি দেওয়াও ইনসাফের ব্যতিক্রম নয়।
[2] সূরা ৬ আনআম: ১২৫ আয়াত।
[3] সূরা (১৮) কাহাফ: ২৯ আয়াত।
[4] সূরা (৭২) মুযাম্মিল: ১৯ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৭৪) মুদ্দাস্সির: ৫৫-৫৬ আয়াত; সূরা (৭৬) দাহর (ইনসান): ২৯ আয়াত; সূরা (৭৮) নাবা: ৩৯ আয়াত; সূরা (৮০) আবাসা: ১১-১২ আয়াত।
এরপর ইমাম আযম কবর বিষয়ক আকীদার কয়েকটি দিক উল্লেখ করে বলেছেন: মুনকার ও নাকীরের প্রশ্ন সত্য, যা কবরের মধ্যে হবে। কবরের মধ্যে বান্দার রূহকে দেহে ফিরিয়ে দেওয়া সত্য। কবরের চাপ এবং কবরের আযাব সত্য, কাফিররা সকলেই এ শাস্তি ভোগ করবে এবং কোনো কোনো পাপী মুমিনও তা ভোগ করবে।’’
কুরআন ও হাদীসের আলোকে মৃত্যুর পরে কিয়ামাতের আগে মধ্যবর্তী সময়ের অবস্থা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। মহান আল্লাহ বলেন:
يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الآَخِرَةِ وَيُضِلُّ اللَّهُ الظَّالِمِينَ وَيَفْعَلُ اللَّهُ مَا يَشَاءُ
‘‘যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আল্লাহ শাশ্বত বাণীতে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন ইহজীবনে এবং পরজীবনে এবং যারা জালিম আল্লাহ তাদেরকে বিভ্রান্তিতে রাখবেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।’’[1]
এ থেকে জানা যায় যে, ইহজীবনের ন্যায় পরজীবনেও শাশ্বত বাণীর উপর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে। বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে পরকালীন জীবনের শুরুতে কবরে ‘মুনকার-নাকীর’ নামক মালাকদ্বয়ের প্রশ্নের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠা প্রমাণিত হবে।
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
وَلَوْ تَرَى إِذِ الظَّالِمُونَ فِي غَمَرَاتِ الْمَوْتِ وَالْمَلائِكَةُ بَاسِطُو أَيْدِيهِمْ أَخْرِجُوا أَنْفُسَكُمُ الْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ الْهُونِ بِمَا كُنْتُمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ غَيْرَ الْحَقِّ وَكُنْتُمْ عَنْ آَيَاتِهِ تَسْتَكْبِرُونَ
‘‘যদি তুমি দেখতে, যখন জালিমগণ মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকবে এবং মালাকগণ হাত বাড়িয়ে বলবে: ‘তোমাদের প্রাণ বের কর, তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে অন্যায় বলতে ও তাঁর নিদর্শন সম্বন্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে, সে জন্য আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি প্রদান করা হবে।’’[2]
এ আয়াত থেকে মৃত্যুকালীন শাস্তি এবং মৃত্যুর পরেই- সেদিনেই- যে শাস্তি প্রদান করা হবে তার বিষয়ে জানা যায়। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
وَحَاقَ بِآَلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آَلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ
‘‘কঠিন শাস্তি পরিবেষ্টন করল ফিরাউনের গোষ্ঠীকে। সকাল সন্ধ্যায় তাদের উপস্থিত করা হয় আগুনের সামনে এবং যেদিন কিয়ামাত ঘটবে সেদিন (বলা হবে:) ফিরাউনের গোষ্ঠীকে প্রবেশ করাও কঠিন শাস্তির মধ্যে।’’[3]
এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, কিয়ামাতের পূর্বেও কাফিরগণকে শাস্তি প্রদান করা হবে এবং সকাল-সন্ধ্যায় আগুনের সামনে তাদের উপস্থিত করা হবে।
কিয়ামাত দিবসের বর্ণনা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:
يَوْمَ لا يُغْنِي عَنْهُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا وَلا هُمْ يُنْصَرُونَ وَإِنَّ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا عَذَابًا دُونَ ذَلِكَ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لا يَعْلَمُونَ
‘‘যে দিন তাদের ষড়যন্ত্র তাদের কোনো কাজে লাগবে না এবং তাদেরকে সাহায্যও করা হবে না। আর যালিমগণের জন্য রয়েছে এর পূর্বের বা নিম্নের শাস্তি; কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।’’[4]
এ আয়াতও কিয়ামাতের পূর্বের শাস্তির কথা প্রমাণ করে। পাশাপাশি অসংখ্য হাদীসে মৃত্যুর সময়ের, মৃত্যুর পরের এ সকল শাস্তি, পুরস্কার ইত্যাদির বিষয়ে জানানো হয়েছে। এ সকল হাদীস থেকে জানা যায় যে, মৃতব্যক্তিকে কবরে রাখার পরে তার ‘রূহ’ তাকে ফেরত দেওয়া হবে এবং তাকে ‘মুনকার ও নাকীর’ নামক ফিরিশতাগণ প্রশ্ন করবেন তার প্রতিপালক, তার দীন ও তার নবী সম্পর্কে। মুমিন ব্যক্তি এ সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবেন। মুনাফিক বা কাফির এ সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম হবে। পাপী ও অবিশ্বাসীদেরকে কবরে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি ভোগ করতে হবে, তন্মধ্যে রয়েছে ‘কবরের চাপ’। কবরের মাটি চারিদিক থেকে কবরস্থ ব্যক্তিকে চাপ দেওয়ার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করবে। পক্ষান্তরে নেককার মুমিনগণ কবরে অবস্থানকালে শান্তি ও নিয়ামত ভোগ করবেন।
সাধারণভাবে এ অবস্থাকে ‘কবরের’ অবস্থা বলা হয়। তবে ‘কবর’ বলতে মৃত্যু ও কিয়ামাতের মধ্যবর্তী অবস্থাকেই বুঝানো হয়। কোনো ব্যক্তি কোনো কারণে কবরস্থ না হলেও সে এ সকল শাস্তি বা পুরস্কার লাভ করে। কুরআনে বলা হয়েছে:
حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ.
‘‘যখন তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন সে বলে, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে পুনরায় প্রেরণ কর; যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি যা আমি পূর্বে করি নি। না, এ হওয়ার নয়। এ তো তার একটি উক্তি মাত্র। তাদের সম্মুখে ‘বারযাখ’ (প্রতিবন্ধক বা পৃথকীকরণ সময়কাল) থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।’’[5]
ইমাম আবূ হানীফা এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস সংক্ষেপে এখানে ব্যাখ্যা করেছেন।
কবর আযাব প্রসঙ্গে তিনি ‘আল-ফিকহুল আবসাত’-এ বলেন:
من قال لا أعرف عذاب القبر فهو من الجهمية الهالكة لأنه أنكر قوله تعالى: "سَنُعَذِّبُهُمْ مَرَّتَيْنِ"، "ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَى عَذَابٍ عَظِيمٍ"، يعني عذاب القبر وقوله تعالى: "وَإِنَّ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا عَذَابًا دُونَ ذَلِك"، يعني في القبر
‘‘যদি কেউ বলে: আমি কবরের আযাব জানি না তবে সে ধ্বংসগ্রস্ত জাহমীদের দলভুক্ত। কারণ, সে কুরআনের বক্তব্য অস্বীকার করেছে। আল্লাহ বলেন: ‘‘অচীরেই আমি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করব দু’বার’’ ‘‘এরপর তাদেরকে কঠিন আযাবের দিকে নেওয়া হবে’’- অর্থাৎ কবরের আযাব। আল্লাহ আরো বলেছেন: ‘‘আর যালিমগণের জন্য রয়েছে এর পূর্বের শাস্তি...’’[6], অর্থাৎ কবরের শাস্তি।’’[7]
[2] সূরা (৬) আন‘আম: ৯৩ আয়াত।
[3] সূরা (৪০) গাফির/মুমিন: ৪৫-৪৬ আয়াত।
[4] সুরা (৫২) তূর: ৪৬-৪৭ আয়াত।
[5] সূরা (২৩) মুমিনুন: ৯৯-১০০ আয়াত।
[6] সূরা (৯) তাওবা: ১০১ আয়াত এবং সূরা (৫২) তূর: ৪৭ আয়াত।
[7] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত (আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম-সহ), পৃষ্ঠা ৫২।
এরপর ইমাম আযম বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহর- মহিমান্বিত হোক তাঁর নাম- বিশেষণসমূহের বিষয়ে আলিমগণ ফার্সী ভাষায় যা কিছু উল্লেখ করেছেন তা সবই বলা বৈধ, কেবলমাত্র ফার্সী ভাষায় ইয়াদ বা হাত বলা বাদে। ফার্সীতে ‘বরোয়ে খোদা’ -আয্যা ও জাল্লা- অর্থাৎ মহান আল্লাহর চেহারার ওসীলায়- এ কথা বলা যাবে, কোনোরূপ তুলনা ছাড়া এবং কোনোরূপ স্বরূপ সন্ধান ও প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়া।’’
আমরা জেনেছি যে, আল্লাহর বিশেষণসমূহ তুলনা ও স্বরূপ ব্যতিরেকে বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি। এখানে ইমাম আবূ হানীফা আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় এ সকল বিশেষণের অনুবাদ করার মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। অন্য ভাষায় আরবী বিশেষণটির যে আভিধানিক প্রতিশব্দ রয়েছে তা ব্যবহার করা হবে এবং তুলনা ও স্বরূপ সন্ধান ছাড়া তা বিশ্বাস করতে হবে। যেমন ওয়াজহুল্লাহ (وجه الله) অর্থ ‘রোয়ে খোদা’: ‘আল্লাহর চেহারা’ বা ‘মুখমণ্ডল’ বলা হবে। মুমিন প্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস করেন যে, ‘চেহারা’ বা ‘মুখমণ্ডল’ মহান আল্লাহর একটি বিশেষণ, এর স্বরূপ আমরা জানি না এবং তা কোনো সৃষ্টির কোনো বিশেষণের সাথে তুলনীয় নয়। অন্যান্য সকল বিশেষণই এরূপ। যেমন আইন অর্থ চক্ষু, কাদাম অর্থ পদ, গাযাব অর্থ ক্রোধ, রিদা অর্থ সন্তুষ্টি, ইসতিওয়া অর্থ অধিষ্ঠান, নুযূল অর্থ অবতরণ ইত্যাদি। তবে ইয়াদ বা হাত শব্দটির ফার্সী প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে ইমাম আযম আপত্তি করেছেন। মোল্লা আলী কারী বলেন: এ নিষেধের কারণ স্পষ্ট নয়। তবে সালফ সালিহীন সকলেই একমত যে, ইয়াদ (হস্ত) বিশেষণটি ব্যাখ্যাবিহীনভাবে গ্রহণ করতে হবে।[1]
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এরপর বলেছেন: ‘‘আল্লাহর নৈকট্য এবং তাঁর দূরত্ব কোনো স্থানের দূরত্ব বা স্থানের নৈকট্য নয়। সম্মান বা অসম্মানের অর্থেও নয়। অনুগত বান্দা কোনো স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়াই আল্লাহর নিকটবর্তী। অবাধ্য বান্দা কোনো স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়াই আল্লাহ থেকে দূরবর্তী। নৈকট্য, দূরত্ব, নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি প্রার্থনাকারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনুরূপভাবে জান্নাতে মহান আল্লাহর প্রতিবেশিত্ব বা নৈকট্য এবং মহান আল্লাহর সম্মুখে অবস্থান সবই স্বরূপ সন্ধান বা প্রকৃতি নির্ধারণ ছাড়া।’’
মহান আল্লাহ বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বান্দার নিকটবর্তী, তিনি তার গলার ধমনী হতেও বেশি নিকটবর্তী, তিনি তার সাথে, তিনি নেককার বান্দাগণের নিকটবর্তী বা সাথে... ইত্যাদি। এগুলি সবই আল্লাহর সিফাত বা বিশেষণ। জাহমী ও মুতাযিলীগণ কখনো এ সকল বিশেষণের নানারূপ ব্যাখ্যা করেছে। কখনো এগুলির ভিত্তিতে মহান আল্লাহর আরশের উপর অধিষ্টিত হওয়ার বিশেষণ অস্বীকার করেছে। তাদের ধারণায় আল্লাহর নৈকট্য ও আরশের উপর অধিষ্ঠিত থাকার মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে। আসল বৈপরীত্য তাদের ধারণা ও চেতনায়; তারা মহান আল্লাহকে সৃষ্টির মত চিন্তা করে কল্পনা করেছে যে, তিনি একই সময়ে আরশে সমাসীন ও বান্দার নিকট হতে পারেন না। তারা ভাবতে পারে নি বা চায় নি যে, তিনি এরূপ মানবীয় সীমবদ্ধতার অনেক ঊর্ধ্বে। ইমাম আযম উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল বিশেষণকেও একইভাবে কোনোরূপ তুলনা এবং স্বরূপসন্ধান ছাড়াই সরল অর্থে বিশ্বাস করতে হবে।
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এরপর কুরআনের আয়াতসমূহের মর্যাদার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘‘কুরআন কারীম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ এবং তা মুসহাফের মধ্যে লিপিবদ্ধ। আল্লাহর কালাম হিসেবে সকল আয়াত মর্যাদা ও মহত্ত্বের দিক থেকে সমান। তবে কোনো কোনো আয়াতের দ্বিবিধ মর্যাদা রয়েছে: যিক্র-এর মর্যাদা এবং যিক্র-কৃতের মর্যাদা। যেমন আয়াতুল কুরসী। এর মধ্যে মহান আল্লাহর মহত্ত্ব, মর্যাদা ও বিশেষণ আলোচিত হয়েছে, এজন্য এর মধ্যে দ্বিবিধ মর্যাদা একত্রিত হয়েছে: যিক্র বা স্মরণের মর্যাদা এবং স্মরণকৃতের মর্যাদা। আর কোনো কোনো আয়াতের কেবল যিক্র-এর ফযীলত রয়েছে, যেমন কাফিরদের কাহিনী, এতে যাদেরকে উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ কাফিরদের কোনো মর্যাদা নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহর নামসমূহ এবং বিশেষণসমূহ সবই সমমর্যাদার, এগুলির মধ্যে মর্যাদাগত কোনো তারতম্য নেই।’’
কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতের কিছু ফযীলত বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে অনেক তথাকথিত ‘‘ধার্মিক’’ মানুষ অনেক জাল ও মিথ্যা কথাও ফযীলতের নামে প্রচার করেছেন।[1] এ সকল বর্ণনা ফযীলত বিষয়ে এক প্রকারের বাড়াবাড়ির জন্ম দেয়। ফযীলতের আয়াত ও সূরাগুলোর বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপের কারণে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত, অধ্যয়ন ও অনুধাবনের সুন্নাহ নির্দেশিত ইবাদতে অবহেলা ও ত্রম্নটি হয়।
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এ বিষয়ক মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহর কালাম হিসেবে সকল আয়াতের মর্যাদা সমান। কুরআনের মর্যাদা ও ফযীলতের মূল বিষয় এটিই। কাজেই মুমিনকে এ দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পাশাপাশি কিছু আয়াতের অর্থগত বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। সহীহ হাদীসে প্রমাণিত বিশেষ ফযীলতগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এরূপ অর্থগত মর্যাদার কথা তাতে বলা হয়েছে। আর এরূপ অর্থগত ফযীলত লাভ করতে অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা এবং পঠিত আয়াতে মহান আল্লাহর যে মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা অনুভব করা প্রয়োজন। কাজেই এ বিষয়ে সহীহ সুন্নাতের নির্দেশনার মধ্যে অবস্থান জরুরী।
এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আত্মীয়-স্বজন বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন:
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কুফুরের উপর মৃত্যুবরণ করেন। (কোনো কোনো পান্ডুলিপিতে অতিরিক্ত রয়েছে: এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেন।) তাঁর চাচা এবং আলী (রা)-এর পিতা আবু তালিব কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। কাসিম, তাহির ও ইবরাহীম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পুত্র ছিলেন। ফাতিমা, রুকাইয়া, যাইনাব ও উম্মু কুলসূম তাঁরা সকলেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কন্যা ছিলেন। আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হোন।’’
আমরা ইমাম আযমের এ কথাগুলো পর্যালোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
৬. ১. ১. কী বলেছিলেন ইমাম আবূ হানীফা?
এ পরিচ্ছেদে ইমাম আযম আবূ হানীফা (রাহ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা, চাচা ও সন্তানদের বিষয় উল্লেখ করেছেন। প্রথম অনুচ্ছেদে তিনটি বাক্য বিদ্যমান। তিনটি বাক্যই মৃত্যু প্রসঙ্গে। প্রথম বাক্যে তাঁর পিতামাতার মৃত্যু, দ্বিতীয় বাক্যে তাঁর মৃত্যু ও তৃতীয় বাক্যে তাঁর চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর অবস্থা উল্লেখ করা হয়েছে। তৃতীয় বাক্যটি সকল পান্ডুলিপিতে বিদ্যমান। প্রথম ও দ্বিতীয় বাক্যটি ‘‘আল-ফিকহুল আকবারের’’ কোনো কোনো পান্ডুলিপিতে বিদ্যমান ও অন্যান্য পান্ডুলিপিতে অবিদ্যমান।
‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ গ্রন্থের প্রসিদ্ধতম ব্যাখ্যা দশম-একাদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি/১৬০৬ খৃ) প্রণীত ‘‘শারহুল ফিকহিল আকবার’’। এ গ্রন্থের কোনো পান্ডুলিপিতে বাক্যদুটি বিদ্যমান এবং কোনো কোনোটিতে শুধু তৃতীয় বাক্যটি বিদ্যমান। থানবী প্রকাশনী, দেওবন্দ, ভারত থেকে প্রকাশিত ‘শারহুল ফিকহিল আকবার’ এ বাক্যগুলো এভাবেই বিদ্যমান। শাইখ মারওয়ান মুহাম্মাদ আশ-শা‘আর (الشيخ مروان محمد الشعار)-এর সম্পাদনায় লেবাননের দারুন নাফাইস কর্তৃক প্রকাশিত ‘‘শারহুল ফিকহিল আকবার’’ গ্রন্থেও বাক্যগুলো বিদ্যমান। কিন্তু দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ বৈরুত, লেবানন প্রকাশিত ‘শারহু ফিকহিল আকবার’ পুস্তকে (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন) বাক্যটি নেই। অনুরূপভাবে কাদীমী কুতুবখানা, আরামবাগ, করাচি, পাকিস্তান হতে প্রকাশিত মোল্লা আলী ক্বারীর শারহুল ফিকহিল আকবারেও বাক্যটি নেই।
আল-ফিকহুল আকবারের পান্ডুলিপিগুলো প্রসিদ্ধ হানাফী আলিমগণ সংরক্ষণ ও অনুলিপি করেছেন। এখানে দুটি সম্ভাবনা বিদ্যমান: (ক) ইমাম আযম বাক্যগুলো লিখেছিলেন, কিন্তু পরবর্তী যুগের কোনো কোনো লিপিকার হানাফী আলিম বাক্যগুলো অশোভনীয় হওয়ায় তা ফেলে দিয়েছেন। (খ) বাক্যগুলো তিনি লিখেন নি, পরবর্তী যুগের কোনো লিপিকার হানাফী আলিম অতিরিক্ত বাক্যগুলো সংযোজন করেছেন।
প্রথম সম্ভাবনাই স্বাভাবিক। পরবর্তী যুগে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার বিষয়ে এ বাক্য সংযোজন করার কোনো প্রয়োজনীয়তা হানাফী আলিমদের ছিল বলে প্রতীয়মান হয় না। কিন্তু এ বাক্যদুটোকে পরবর্তী যুগের অনেক হানাফী আলিমই অশোভনীয় বলে গণ্য করেছেন। কাজেই অপ্রাসঙ্গিক বা অশোভনীয় হিসেবে তা ফেলে দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। আমরা দেখব যে, মোল্লা আলী কারীর ব্যাখ্যার মধ্যে এ বিষয়ক আলোচনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাঁর ব্যাখ্যা গ্রন্থের সাথে মুদ্রিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’-এর কোনো কোনো মুদ্রণে এ বাক্যটি নেই। অর্থাৎ মুদ্রণ বা অনুলিপির সময় ইমাম আযমের বক্তব্য থেকে কথাটি ফেলে দেওয়া হয়েছে, যদিও ব্যাখ্যার মধ্যে তা বিদ্যমান। আমরা পরবর্তী আলোচনা থেকে দেখব যে, ইসলামের প্রথম তিন-চার শতাব্দীতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলিমগণ যা বলেছেন পরবর্তী আলিমগণ সেগুলো সেভাবে বলা অশোভনীয় বলেই মনে করেছেন।
কোনো কোনো আলিম মত প্রকাশ করেছেন যে, হয়ত বক্তব্যটি নিম্নরূপ ছিল (والدا رسول الله صلى الله عليه وسلم ما ماتا على الكفر) ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কুফরের উপর মৃত্যুবরণ করেন নি’’। পান্ডুলিপিকারের ভুলে (ما) শব্দটি পড়ে যাওয়ায় অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে গিয়েছে। এটি একটি দূরবর্তী সম্ভাবনা। কারণ এক্ষেত্রে ‘কুফরের উপর মৃত্যুবরণ করেন নি’ না বলে ‘ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন’ বলাই ছিল স্বাভাবিক।
উল্লেখ্য যে, মোল্লা আলী কারী এ বিষয়ে পৃথক একটি পুস্তক রচনা করেন। পুস্তকটির নাম (أدلة معتقد أبي حنيفة الأعظم في أبوي الرسول عليه السلام) অর্থাৎ ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার বিষয়ে ইমাম আযম আবূ হানীফার আকীদার পক্ষে দলীলসমূহ’’। এ গ্রন্থের শুরুতে তিনি বলেন:
"قَدْ قَالَ الإِمَامُ الأَعْظَمُ وَالْهُمَامُ الأَقْدَمُ فِيْ كِتَابِهِ الْمُعْتَبَرِ الْمُعَبَّرِ بِـ(الْفِقْهِ الأَكْبَرِ) مَا نَصُّهُ: "وَوَالِدَا رَسُوْلِ اللهِ مَاتَا عَلَى الْكُفْرِ". فَقَالَ شَارِحُهُ: هَذَا رَدٌّ عَلَى مَنْ قَالَ بِأَنَّ وَالِدَيْ رَسُوْلِ اللهِ مَاتَا عَلَى الإِيْمَانِ، وَعَلَى مَنْ قَال مَاتَا عَلَى الْكُفْرِ ثُمَّ (دَعَا) رَسُوْلُ اللهِ اللهَ لَهُمَا فَأَحْيَاهُمَا اللهُ وَأَسْلَمَا ثُمَّ مَاتَا عَلَى الإِيْمَانِ. فَأَقُوْلُ وَبِحَوْلِهِ أَصُوْلُ: إِنَّ هَذَا الْكَلاَمَ مِنْ حَضْرَةِ الإِمَامِ لاَ يُتَصَوَّرُ فِيْ هَذَا الْمَقَامِ لِتَحْصِيْلِ الْمَرَامِ إِلاَّ أَنْ يَكُوْنَ قَطْعِيَّ الدِّرَايَةِ لاَ ظَنِّيَّ الرِّوَايَةِ لأَنَّهُ فِيْ بَابِ الاِعْتِقَادِ لاَ يُعْمَلُ بِالظَّنِّيَّاتِ وَلاَ يُكْتَفَى بِالآحَادِ مِنَ الأَحَادِيْثِ الْوَاهِيَاتِ وَالرِّوَايَاتِ الْوَهْمِيَّاتِ إِذْ مِنَ الْمُقَرَّرِ وَالْمُحَرَّرِ فِيْ الأَصْلِ الْمُعْتَبَرِ أَنَّهُ لَيْسَ لأَحَدٍ مِنْ أَفْرَادِ الْبَشَرِ أَنْ يَحْكُمَ عَلَى أَحَدٍ بِأَنَّهُ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ وَلاَ بِأَنَّهُ مِنْ أَهْلِ الْعُقُوْبَةِ إِلاَّ بِنَقْلٍ ثَبْتٍ بِنَصٍّ مِنَ الْكِتَابِ أَوْ تَوَاتُرٍ مِنَ السُّنَّةِ أَوْ إِجْمَاعِ عُلَمَاءِ الأُّمَّةِ بِالإِيْمَانِ الْمَقْرُوْنِ بِالْوَفَاةِ أَوْ بِالْكُفْرِ الْمُنْضَمِّ إِلَى آخِرِ الْحَيَاةِ. فَإِذَا عَرَفْتَ ذَلِكَ فَنَسْتَدِلُّ عَلَى مَرَامِ الإِمَامِ بِحَسْبِ مَا اطَّلَعْنَا عَلَيْهِ فِيْ هَذَا الْمَقَامِ بِالْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَاتِّفَاقِ أَئِمَّةِ الأَنَامِ".
‘‘ইমাম আযম তাঁর ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ নামক নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে বলেছেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কুফুরের উপর মৃত্যুবরণ করেন।’’ ব্যাখ্যাকার বলেন: এ কথার দ্বারা তিনি দুটি মত খন্ডন করেছেন: যারা বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের মত এবং যারা বলেন যে, তাঁরা কুফরের উপর মৃত্যু বরণ করেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করেন, তখন আল্লাহ তাদের দুজনকে পুনর্জীবিত করেন এবং তাঁরা দুজন ইসলাম গ্রহণ করে ইসলাম-সহ মৃত্যুবরণ করেন- তাদের মত তিনি খন্ডন করেছেন। এ বিষয়ে আমি আল্লাহর সাহায্য ও তাওফীকে বলি যে, এ বিষয়ে হযরত ইমাম আযমের বক্তব্য বুঝতে হলে কোনো যন্নী বা ‘‘ধারণা’’ প্রদানকারী প্রমাণের উপর নির্ভর করা যাবে না; বরং কাতয়ী বা সুনিশ্চিত বিশ্বাস প্রদানকারী প্রমাণের উপর নির্ভর করতে হবে। কারণ বিষয়টি আকীদা বা বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট, যে বিষয়ে ‘‘যন্নী’’ বা ধারণাজ্ঞাপক প্রমাণের উপর নির্ভর করা যায় না। আর এ বিষয়ে দুর্বল-অনির্ভরযোগ্য দু-চারটি হাদীস বা কাল্পনিক বর্ণনা যথেষ্ট নয়। কারণ নির্ভরযোগ্য মূলনীতিতে একথা নির্ধারণ ও নিশ্চিত করা হয়েছে যে, কোনো মানুষের জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে জান্নাতী বা শাস্তিপ্রাপ্ত (জাহান্নামী) বলে নিশ্চিত করা বৈধ নয়। কেবলমাত্র যদি কুরআন কারীমের সুস্পষ্ট বক্তব্য, মুতাওয়াতির হাদীস বা উম্মাতের আলিমগণের ইজমা দ্বারা যদি সুনিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে, উক্ত ব্যক্তি ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন, অথবা জীবনের শেষ মুহূর্তে কাফির থেকে কুফরসহ মৃত্যুবরণ করেছেন, তাহলেই কেবল তাকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলে নিশ্চিত করা যায়। উপরের বিষয়টি বুঝার পরে আমি আমার জ্ঞান অনুসারে কুরআন হাদীস ও উম্মাতের ইমামগণের ইজমার আলোকে ইমাম আযমের বক্তব্য প্রমাণ করব।’’[1]
শারহুল ফিকহিল আকবার গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মোল্লা আলী কারী বলেন:
هَذَا رَدٌّ عَلَى مَنْ قَالَ أَنَّهُمَا مَاتَا عَلَى الإِيْمَانِ أَوْ مَاتَا عَلَى الْكُفْرِ ثُمَّ أَحْيَاهُمُ اللهُ تَعَالَى فَمَاتَا فِيْ مَقَامِ الإِيْمَانِ. وَقَدْ أَفْرَدْتُ لِهَذِهِ الْمَسْأَلَةِ رِسَالَةً مُسْتَقِلَّةً وَدَفَعْتُ مَا ذَكَرَهُ السُّيُوْطِيُّ فِيْ رَسَائِلِهِ الثَّلاَثَةِ، فِيْ تَقْوِيَةِ هَذِهِ الْمَقَالَةِ بِالأَدِلَّةِ الْجَامِعَةِ الْمُجْتَمِعَةِ مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَالْقِيَاسِ وَإِجْمَاعِ الأُمَّةِ. وَمِنْ غَرِيْبِ مَا وَقَعَ فِيْ هَذِهِ الْقَضِيَّةِ إِنْكَارُ بَعْضِ الْجَهَلَةِ مِنَ الْحَنَفِيَّةِ عَلَى مَا فِيْ بَسْطِ هَذَا الْكَلاَمِ بَلْ أَشَارَ إِلَى أَنَّهُ غَيْرُ لاَئِقٍ بِمَقَامِ الإِمَامِ الأَعْظَمِ. وَهَذَا بِعَيْنِهِ كَمَا قَالَ الضَّالُّ جَهْمُ بْنُ صَفْوَانَ: وَدِدْتُ أَنْ أَحُكَّ مِنَ الْمُصْحَفِ قَوْلَهُ تَعَالَى: ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ ... وَقَوْلِ الرَّافِضِيِّ الأَكْبَرِ إِنَّهُ بَرِيْءٌ مِنَ الْمُصْحَفِ الَّذِيْ فِيْهِ نَعْتُ الصِّدِّيْقِ الأَكْبَرِ.
‘‘এ কথা দ্বারা তাদের মত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে যারা বলেন যে, তাঁরা উভয়ে ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছিলেন, অথবা কুফর অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন, পরে আল্লাহ তাঁদেরকে জীবিত করেন এবং তাঁরা ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেন। এ বিষয়ে আমি পৃথক একটি পুস্তিকা রচনা করেছি। তাতে আমি সুয়ূতীর তিনটি পুস্তিকার বক্তব্য খন্ডন করেছি। এ পুস্তিকায় আমি কুরআন, হাদীস, কিয়াস ও ইজমার বক্তব্য দিয়ে ইমাম আযমের এ মত জোরদার করেছি। এ সম্পর্কিত একটি মজার বিষয় হলো, কিছু অজ্ঞ হানাফী এ বিষয়ক আলোচনা আপত্তিকর বলে মনে করেন। বরং তারা বলে, এ ধরনের কথা বলা ইমাম আযমের মর্যাদার পরিপন্থী। তাদের এ কথা অবিকল (জাহমী মতের প্রতিষ্ঠাতা) বিভ্রান্ত জাহম ইবনু সাফওয়ানের কথার মত। সে বলত: ‘‘আমার মনে চায় আল্লাহর বাণী ‘অতপর তিনি আরশে সমাসীন হলেন’ কথাটি আমি কুরআনের পৃষ্ঠা থেকে মুছে ফেলে দিই।’’ অনুরূপভাবে তাদের কথা অবিকল সেই শ্রেষ্ঠ শীয়া-রাফিযীর কথার মত, যে বলে: যে কুরআনের মধ্যে সিদ্দীকে আকবারের প্রশংসা বিদ্যমান সে কুরআনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’’ (অর্থাৎ জাহম যেমন মুর্খতা বশত বলত যে, ‘আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন’ কথাটি আল্লাহর মর্যাদার পরিপন্থী এবং শীয়া-প্রবর যেমন মনে করেছে যে সিদ্দীকে আকবারের প্রশংসা কুরআনের মর্যাদার পরিপন্থী, তেমনি এ অজ্ঞ হানাফী ভেবেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা বিষয়ক আবূ হানীফার বক্তব্যটি তাঁর মর্যাদার পরিপন্থী।)[2]
মোল্লা আলী কারীর এ বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম আবূ হানীফার বক্তব্যের মধ্যে এ বাক্যটির বিদ্যমান থাকার বিষয়ে তিনি সুনিশ্চিত ছিলেন এবং তার ব্যাখ্যা গ্রন্থের মধ্যেও বাক্যটি বিদ্যমান ছিল। সম্ভবত পরবর্তী কোনো কোনো প্রকাশক বাক্যটির বিষয়ে বিতর্কের কারণে বা বাক্যটি ইমাম আযমের মর্যাদার পরিপন্থী বলে মনে করে তা উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছেন। মহান আল্লাহই ভাল জানেন।
[2] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার ১৩১ পৃ. (মাকতাবায়ে থানবী)
উপরের বাক্যটি ইমাম আবূ হানীফার লেখা হোক বা না হোক প্রসঙ্গটি ইসলামী আকীদার সাথে জড়িত। পরবর্তী অনুচ্ছেদে আবূ তালিবের ওফাত প্রসঙ্গে আমরা দেখব যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকেই শীয়াগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ও তাঁর চাচা আবূ তালিবকে মুমিন হিসেবে বিশ্বাস করাকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন। মূলধারার তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনেক প্রসিদ্ধ ইমাম উল্লেখ করেছেন যে, তাঁরা কাফির-মুশরিক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। কারণ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিভিন্ন হাদীস এরূপই প্রমাণ করে। আনাস (রা) বলেন:
إنَّ رَجُلا قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيْنَ أَبِي قَالَ فِي النَّارِ فَلَمَّا قَفَّى دَعَاهُ فَقَالَ إِنَّ أَبِي وَأَبَاكَ فِي النَّارِ
‘‘এক ব্যক্তি বলে: হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতা কোথায়? তিনি বলেন: জাহান্নামে। লোকটি যখন চলে যাচ্ছিল তখন তিনি তাকে ডেকে বললেন: নিশ্চয়ই আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে।’’[1]
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন:
زَارَ النَّبِيُّ ﷺ قَبْرَ أُمِّهِ (يَوْمَ الْفَتْحِ) فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ حَوْلَهُ (فَمَا رُئِيَ بَاكِيًا أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ الْيَوْمِ) فَقَالَ اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي فِي أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِي وَاسْتَأْذَنْتُهُ فِي أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأُذِنَ لِي فَزُورُوا الْقُبُورَ فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ
(মক্কা বিজয়ের সময়) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর মাতার কবর যিয়ারত করেন। তখন তিনি এমনভাবে ক্রন্দন করেন যে তাঁর সাথীগণও ক্রন্দন করতে থাকেন (তাঁকে এত বেশি ক্রন্দন করতে আর কখনো দেখা যায় নি)। তিনি বলেন: আমি আমার রবের নিকট আমার মায়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার অনুমতি চাইলাম, কিন্তু আমাকে অনুমতি দেয়া হলো না। তারপর আমি তার কবর যিয়ারতের অনুমতি চাইলাম। তখন আমাকে অনুমতি দেয়া হলো। তোমরা কবর যিয়ারত করবে; কারণ তা মৃত্যুর কথা স্মরণ করায়।[2]
ইমাম ইবন মাজাহ মুহাম্মাদ ইবন ইয়াযীদ কাযবীনী (২৭৩ হি), ইমাম নাসায়ী আহমদ ইবন শুআইব (৩০৩ হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এ হাদীসকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাতার মুশরিক হওয়ার প্রমাণ ও মুশরিকের কবর যিয়ারতের বৈধতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন। এ হাদীস প্রসঙ্গে ইবন মাজাহ বলেন: ‘‘(باب ما جاء في زيارة قبور المشركين) মুশরিকদের কবর যিয়ারত বিষয়ে বর্ণিত হাদীসের অনুচ্ছেদ’’[3] এবং নাসায়ী বলেন: (باب زيارة قبر المشرك) ‘‘মুশরিকের কবর যিয়ারতের অনুচ্ছেদ’’।[4] তৃতীয়-চতুর্থ শতক পর্যন্ত অনেকেই বিষয়টিকে স্বতঃসিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন:
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلاَ تُسْأَلُ عَنْ أَصْحَابِ الْجَحِيمِ
‘‘নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আপনি জাহান্নামীদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবেন না।’’[5]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম তাবারী (৩১০ হি) তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবন কা’ব কুরাযী থেকে উদ্ধৃত করেন, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
ليت شعري ما فعل أبواي؟ فنزلت
‘‘আমার পিতামাতার কি অবস্থা তা যদি আমি জানতে পারতাম!’- তখন এ আয়াতটি নাযিল করা হয়।’’
এরপর ইমাম তাবারী বলেন:
فإن ظن ظان أن الخبر الذي روي عن محمد بن كعب صحيح ، فإن في استحالة الشك من الرسول عليه السلام - في أن أهل الشرك من أهل الجحيم ، وأن أبويه كانا منهم، ما يدفع صحة ما قاله محمد بن كعب، إن كان الخبر عنه صحيحا.
‘‘যদি কোনো ধারণাকারী ধারণা করেন যে, মুহাম্মাদ ইবন কা’ব থেকে বর্ণিত এ হাদীসটি সহীহ তবে তার এ ধারণা সঠিক হবে না। কারণ মুশরিকগণ যে জাহান্নামী এবং তাঁর পিতামাতা যে তাদের অন্তর্ভুক্ত এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো সন্দেহ থাকা-ই অসম্ভব বিষয়। আর এটিই প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদ ইবন কাব যে কথা বলেছেন তা সঠিক নয়; যদিও তিনি এ কথা বলেছেন বলে প্রমাণিত হয়।[6]
ইমাম ফাখরুদ্দীন রাযী (৬০৬ হি) এ মত সমর্থন করে বলেন:
هذه الرواية بعيدة لأنه ﷺ كان عالماً بكفرهم، وكان عالماً بأن الكافر معذب، فمع هذا العلم كيف يمكن أن يقول : ليت شعري ما فعل أبواي.
‘‘এ বর্ণনাটি অগ্রহণযোগ্য। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের কাফির হওয়ার বিষয় জানতেন এবং কাফিররা যে শাস্তি পাবে তাও জানতেন। কাজেই এরূপ জ্ঞান থাকার পরেও কিভাবে তিনি বলবেন: আমার পিতামাতা কিরূপ আছেন তা যদি জানতাম!?’’[7]
এ মতের বিপরীতে বিগত কয়েক শতাব্দী যাবৎ অনেক আলিম মত প্রকাশ করছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন। ইবনু শাহীন উমার ইবনু আহমদ (৩৮৫ হি), খতীব বাগদাদী (৪৬৩ হি), ইবনু আসাকির (৫৭১হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা সকলেই একই সনদে হাদীসটি সংকলন করেছেন। আয়েশা (রা)-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসটিতে বলা হয়েছে যে, বিদায় হজ্জের সময়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেদনার্ত ছিলেন। একসময় তিনি আনন্দিত চিত্তে আয়েশার (রা) নিকট আগমন করেন। তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন:
ذَهَبْتُ لِقَبْرِ أُمِّي آمِنَةَ فَسَأَلْت اللهَ رَبِّي أَنْ يُحْيِيَهَا فَأَحْيَاهَا فَآمَنَتْ بِي أَوْ قَالَ فَآمَنَتْ وَرَدَّهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ
‘‘আমি আমার আম্মা আমেনার কবরের নিকট গমন করি এবং আল্লাহর কাছে দুআ করি তাঁকে জীবিত করতে। তখন আল্লাহ তাঁকে জীবিত করেন, তিনি আমার উপর ঈমান আনয়ন করেন, অতঃপর আল্লাহ তাঁকে ফিরিয়ে নেন।’’ কোনো কোনো বর্ণনায় পিতামাতার কথা বলা হয়েছে।
নবম-দশম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও শাফিয়ী ফকীহ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১ হি) ও অন্যান্য আলিম এ হাদীসের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেন বলে মত প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য যে, ইবনুল জাওযী, মোল্লা আলী কারী, শাওকানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে নিশ্চিত করেছেন। ইবনু কাসীর বলেন: হাদীসটি মুনকার ও অত্যন্ত দুর্বল এবং হাদীসের রাবীগণ দুর্বল ও অজ্ঞাতপরিচয়। ইবনু আসাকিরও একই কথা বলেছেন। ইমাম সুয়ূতী উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি নিশ্চিতরূপেই দুর্বল। তিনি বলেন, মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি দুর্বল, কেউ কেউ একে জাল বলেছেন। তবে একে জাল না বলে দুর্বল বলা উচিত। ইমাম সুয়ূতীর মতে ফযীলত বা মর্যাদার বিষয় যেহেতু ঈমান-আকীদা ও হালাল-হারাম-এর সাথে সংশিস্নষ্ট নয়, এজন্য ফযীলত বিষয়ে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়। আর এ মূলনীতির ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার ফযীলতে এ দুর্বল হাদীসটি গ্রহণ করা যায়।[8]
এর বিপরীতে কোনো কোনো আলিম বলেছেন যে, আমল বা কর্মের ফযীলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করার পক্ষে অনেক আলিম মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তির ফযীলত বা মর্যাদার বিষয় যেহেতু বিশ্বাস বা আকীদার বিষয় সেহেতু এ বিষয়ে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায় না। অনেক আলিম বলেন, হাদীসটি জাল না হলেও এরূপ দুর্বল হাদীস বুখারী-মুসলিম সংকলিত সহীহ হাদীসের বিপরীতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বোপরি কুরআন ও হাদীসে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, আযাব বা মৃত্যুর আগমনের পর ঈমান বা তাওবা অর্থহীন।[9] আল্লাহ তাঁর হাবীবের পিতামাতাকে ক্ষমা করতে চাইলে তাঁর দুআর মাধ্যমেই করতে পারেন; মৃত্যুর মাধ্যমে আখিরাত প্রত্যক্ষ করার পরে ঈমান গ্রহণ এক্ষেত্রে অর্থহীন।[10]
অন্য হাদীসে আলী (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
خَرَجْتُ مِنْ نِكَاحٍ، وَلَمْ أَخْرُجْ مِنْ سِفَاحٍ مِنْ لَدُنْ آدَمَ إِلَى أَنْ وَلَدَتْنِي أَبِي وَأُمِّي ، لَمْ يُصِبْنِي مِنْ سِفَاحِ الْجَاهِلِيَّةِ شَيْءٌ.
‘‘আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আমার পিতামাতা আমাকে জন্ম দেওয়া পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে আমার জন্ম, কোনো অবৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে আমার জন্ম হয় নি। জাহিলী যুগের কোনো অবৈধতা- অশ্লীলতা আমাকে স্পর্শ করে নি।’’[11]
কেউ কেউ এ অর্থের হাদীস দ্বারা দাবি করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ও পূর্বপুরুষগণ কেউ কাফির ছিলেন না। ইমাম বাইহাকী ও অন্যান্য আলিম বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। বাইহাকী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ও পিতামহের জাহান্নামী হওয়ার অর্থে অনেকগুলো হাদীস উদ্ধৃত করেন। এরপর তিনি বলেন:
وكيف لا يكون أبواه وجده بهذه الصفة في الآخرة؟ وكانوا يعبدون الوثن حتى ماتوا، ولم يدينوا دين عيسى ابن مريم عليه السلام. وأمرهم لا يقدح في نسب رسول الله ﷺ؛ لأن أنكحة الكفار صحيحة، ألا تراهم يسلمون مع زوجاتهم فلا يلزمهم تجديد العقد، ولا مفارقتهن إذا كان مثله يجوز في الإسلام.
‘‘তাঁর পিতা, মাতা ও পিতামহ মৃত্যু পর্যন্ত মূর্তিপূজা করেছেন এবং তাঁরা ঈসা (আঃ)-এর দীনও গ্রহণ করেন নি, কাজেই তাঁরা আখিরাতে জাহান্নামী হবেন না কেন? এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশের পবিত্রতার পরিপন্থী নয়; কারণ কাফিরদের বিবাহ বিশুদ্ধ। এজন্য তো কাফিরগণ যখন তাদের স্ত্রীদের সাথে একত্রে ইসলাম গ্রহণ করেন তখন নতুন করে বিবাহ পড়ানোর দরকার হয় না এবং স্ত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ারও কোনো বিধান নেই, যদি এরূপ বিবাহ ইসলামে বৈধ থাকে।’’[12]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার বিষয়ে তৃতীয় একটি মত বিদ্যমান। এ মতানুসারে তাঁর পিতামাতা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেও নবী-বিহীন যুগে মৃত্যুর কারণে তাঁরা শাস্তিযোগ্য নন। নিম্নের আয়াতগুলো তা প্রমাণ করে:
وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُولا
‘‘রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি শাস্তি প্রদান করি না।’’[13]
رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ
‘‘রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও ভয়প্রদর্শনকারী হিসেবে; যেন রাসূলগণের পরে মানুষের জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ অবশিষ্ট না থাকে।’’[14]
وَلَوْ أَنَّا أَهْلَكْنَاهُمْ بِعَذَابٍ مِنْ قَبْلِهِ لَقَالُوا رَبَّنَا لَوْلَا أَرْسَلْتَ إِلَيْنَا رَسُولًا فَنَتَّبِعَ آَيَاتِكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَذِلَّ وَنَخْزَى
‘‘যদি আমি তাদেরকে ইতোপূর্বে শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করতাম তবে তারা বলত, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের কাছে একজন রাসূল পাঠালেন না কেন? পাঠালে আমরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হওয়ার আগে আপনার নিদর্শন মেনে চলতাম।’’’[15]
এ সকল আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ‘‘ফাতরাত’’ বা রাসূল-বিহীন যুগে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, এরূপ মানুষদেরকে কিয়ামাতে পরীক্ষা করে মুক্তি দেওয়া হবে। এজন্য অনেক আলিম মত প্রকাশ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেও শাস্তির অন্তর্ভুক্ত হবেন না।
এ মতটি অত্যন্ত জোরালো। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার কুফরের উপর মৃত্যু হওয়ার বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সুনিশ্চিত। মৃত্যুর পরে পুনর্জীবিত হয়ে ঈমান গ্রহণের হাদীসটি সনদগতভাবে অত্যন্ত দুর্বল। উপরন্তু অর্থের দিক থেকে মৃত্যুর পরে ঈমান আনার বিষয়টি কুরআন-হাদীসের সামগ্রিক নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক। পক্ষান্তরে ‘ফাতরাতে’ বা ‘রাসূল-বিহীন’ যুগে মৃত্যুর কারণে আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে উপরে উল্লেখিত ‘‘আমার ও তোমার পিতা জাহান্নামে’’ হাদীসটি এ মতের সাথে সাংঘর্ষিক।
সপ্তম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম নববী (৬৭৬ হি) ‘আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে’- হাদীসটিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণের নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে বলেন:
فِيهِ أَنَّ مَنْ مَاتَ عَلَى الْكُفْر فَهُوَ فِي النَّار، وَلا تَنْفَعهُ قَرَابَة الْمُقَرَّبِينَ، وَفِيهِ أَنَّ مَنْ مَاتَ فِي الْفَتْرَة عَلَى مَا كَانَتْ عَلَيْهِ الْعَرَب مِنْ عِبَادَة الأَوْثَان فَهُوَ مِنْ أَهْل النَّار، وَلَيْسَ هَذَا مُؤَاخَذَة قَبْل بُلُوغ الدَّعْوَة، فَإِنَّ هَؤُلاءِ كَانَتْ قَدْ بَلَغَتْهُمْ دَعْوَة إِبْرَاهِيم وَغَيْره مِنْ الأَنْبِيَاء
‘‘এ হাদীসে নির্দেশনা রয়েছে, যে ব্যক্তি কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামী। আল্লাহর প্রিয়ভাজনদের আত্মীয়তা তার কোনো উপকার করবে না। এ হাদীসে আরো নির্দেশনা রয়েছে, আরবের মানুষগণ যেরূপ মুর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল সেরূপ কর্মের মধ্যে থেকে যে ব্যক্তি রাসূল-বিহীন ‘ফাতরাতের’ সময়ে মৃত্যুবরণ করেছে সে ব্যক্তিও জাহান্নামী। এরূপ ব্যক্তিদের জাহান্নামে যাওয়ার অর্থ এ নয় যে, তাদেরকে দীনের দাওয়াত পৌঁছানোর পূর্বেই শাস্তি দেওয়া হলো। কারণ, এদের কাছে ইবরাহীম (আঃ) ও অন্যান্য নবীর দাওয়াত পৌঁছেছিল।’’[16]
আল্লামা খলীল আহমদ সাহারানপূরী (১৩৪৬ হি) বলেন:
قَدْ بَالَغَ السُّيُوْطِيُّ فِيْ إِثْبَاتِ إِيْمَانِ أَبَوَيْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ. قَالَ الْقَارِي: الجمهور عَلَى أَنَّ وَالِدَيْهِ ﷺ مَاتَا كَافِرَيْنِ. وَهَذَا الْحَدِيْثُ أَصَحُّ مَا رُوِيَ فِيْ حَقِّهِمَا... فَعَلَى تَقْدِيْرِ صِحَّتِهِ لاَ يَصْلُحُ أَنْ يَكُوْنَ مُعَارِضاً لِحَدِيْثِ مُسْلِمٍ مَعَ أَنَّ الْحُفَّاظَ طَعَنُوْا فِيْهِ وَمَنَعُوْا جَوَازَهُ بِأَنَّ إِيْمَانَ الْيَأْسِ غَيْرُ مَقْبُوْلٍ إِجْمَاعاً كَمَا يَدُلُّ عَلَيْهِ الْكِتَابُ وَالسُّنَّةُ وَبِأَنَّ الإِيْمَانَ الْمَطْلُوْبَ مِنَ الْمُكَلَّفِ إِنَّمَا هُوَ الإِيْمَانُ الْغَيْبِيُّ... وَهَذَا الْحَدِيْثُ الصَّحِيْحُ صَرِيْحٌ أَيْضاً فِيْ رَدِّ مَا تَشَبَّثَ بِهِ بَعْضُهُمْ بِأَنَّهُمَا كَانَا مِنْ أَهْلِ الْفَتْرَةِ وَلاَ عَذَابَ عَلَيْهِمْ
‘‘সুয়ূতী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতা-মাতার ঈমানের বিষয়টি প্রমাণে অতি-চেষ্টা করেছেন। মোল্লা আলী ক্বারী বলেছেন: অধিকাংশ আলিম একমত যে, তাঁরা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এ ব্যাপারে এ হাদিসটি সবচেয়ে বিশুদ্ধ দলিল। ... (পুনর্জীবিত করার) হাদিসটি সহীহ বলে মেনে নিলেও মুসলিম শরীফের (আমার ও তোমার পিতা জাহান্নামে) হাদীসটির বিপরীতে দাঁড় করানো যায় না। সর্বোপরি প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ (পুনরুজ্জীবিত করার) এ হাদিসটির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে আপত্তি করেছেন। তাঁরা এ ঘটনার সম্ভাবনাও অস্বীকার করেছেন। কারণ মুসলিম উম্মাহর ইজমা যে, নৈরাশ্যের পরে ঈমান- অর্থাৎ মৃত্যুর আগমনের পরে ঈমান- গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন ও হাদীসে তা সুস্পষ্ট বলা হয়েছে। এছাড়া ঈমান তো গাইবী বিষয়ের উপরই হয়ে থাকে। মৃত্যুর পরে তো সব গাইবী বিষয় প্রত্যক্ষ হয়ে যায়; এরপর তো আর ঈমান বিল-গাইব থাকে না। ... (আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে) হাদিসটি সুষ্পষ্টভাবে তাদের বক্তব্যও প্রত্যাখ্যান করে যারা দাবী করে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ‘‘ফাতরাত’’ বা রাসূল-বিহীন যুগে থাকার কারণে তাদের শাস্তি হবে না।’’[17]
এভাবে ইমাম নববী ও অন্যান্য আলিম এ হাদীসের উপর নির্ভর করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার ফাতরাত’-বাসী হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তাঁরা দাবি করেছেন যে, আরবের মুশরিকগণ ‘‘রাসূল-বিহীন’’ ছিলেন না; বরং ইবরাহীম (আঃ)-এর দাওয়াত তাদের নিকট পৌঁছেছিল। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা এই যে, ইবরাহীম (আঃ)-এর বিশুদ্ধ দাওয়াত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগের অনেক আগেই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। কাজেই তাঁর নুবুওয়াতের অব্যবহিত পূর্বের যুগের মানুষদেরকে রাসূল-বিহীন বলে গণ্য করাই কুরআন, সুন্নাহ, ইতিহাস ও যুক্তির দিক থেকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
তবে আলোচ্য হাদীসটি বাহ্যত এ মতটির সাথে সাংঘর্ষিক। এ হাদীসটির অর্থ হতে পারে যে ‘‘আমার ও তোমার পিতা রাসূল-বিহীন যুগের অধিবাসীদের পরীক্ষা পর্যন্ত জাহান্নামী হওয়ার বিধানের মধ্যে’’- এ অর্থের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতাকে রাসূল-বিহীন যুগের অধিবাসী হিসেবে আখিরাতের আযাব-মুক্ত বলে গণ্য করার মতটিই অগ্রগণ্য বলে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহই ভাল জানেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার বিষয়ে চতুর্থ মত হলো এ বিষয়ে মত প্রকাশ থেকে বিরত থাকা। সঠিক জ্ঞান তো মহান আল্লাহরই নিকটে।
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৭১ (জানাইয, বাবু ইসতিজানিন নাবিয়্যি.. ফি যিয়ারাতি)।
[3] ইবন মাজাহ, কিতাবুল জানায়িয, বাব মা জাআ ফী যিয়ারাতি কুবূরির মুশরিকীন ১/৫০১।
[4] নাসায়ী, কিতাবুল জানায়িয, বাব যিয়ারত কাবরিল মুশরিক ৪/৯০-৯১।
[5] সূরা (২) বাকারা: ১১৯ আয়াত।
[6] তাবারী, তাফসীর ২/৫৫৮-৫৬০।
[7] ফখরুদ্দীন রাযী, মাফাতীহুল গাইব ৪/২৮।
[8] সুয়ূতী, আল-হাবী লিল-ফাতাওয়া ২/২১৮।
[9] সূরা নিসা: ১৭-১৮ আয়াত; সূরা গাফির (মুমিন): ৮৫ আয়াত।
[10] বিস্তারিত দেখুন: সুহাইলী, আর-রাওযুল উনুফ /২৯৬; ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূআত ১/২৮৪; ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ৪/৩০৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী আল-মাসনূআ ১/২৪৫; আল-হাবী লিল-ফাতওয়া ২/২১৮; ৩/৩৪৩; কুরতুবী, আত-তাযকিরা ফী আহওয়ালিল আখিরাহ ১/১২; মোল্লা আলী কারী, আদিল্লাতু মু’তাকাদি আবী হানীফা, ৮৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ আল-মাজমুআ ১/৩২২।
[11] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৭/১৯০; আলবানী, সহীহুল জামি ১/৬১৩, নং ৩২২৫।
[12] বাইহাকী, দালাইলুন নুবুওয়াত ১/১১২, ১১৯-১২২।
[13] সূরা (১৭) ইসরা (বনী ইসরাঈল): ১৫ আয়াত।
[14] সূরা (৪) নিসা: ১৬৫ আয়াত।
[15] সূরা (২০) তাহা: ১৩৪ আয়াত। পুনশ্চ: সূরা (২৮) কাসাস: ৪৭ আয়াত।
[16] নববী, শারহু সাহীহ মুসলিম ৩/৭৯।
[17] সাহারানপুরী, বজলুল মাজহূদ ৫/২১৪ ।
আমরা দেখেছি, কোনো কোনো পান্ডুলিপির ভাষ্য অনুসারে ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন: ‘‘ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেন।’’
এ বিষয়টি সন্দেহাতীত মহাসত্য এবং এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ বা মতভেদ নেই। কাজেই বিষয়টি আকীদা বিষয়ক গ্রন্থে উল্লেখের আবশ্যকতা কী? এ বিষয়ে মোল্লা আলী কারী বলেন: ‘‘এ বাক্যটি ব্যাখ্যাকারের মূল পান্ডুলিপিতে নেই। এ বিষয়টি এত সুস্পষ্ট যে এর কোনো ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুমহান মর্যাদার প্রেক্ষাপটে এ কথা উল্লেখের কোনো প্রয়োজনও নেই। যদি ধরে নেওয়া হয় যে কথাটি মূলতই ইমাম আযম লিখেছেন, তবে এ কথার অর্থ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং অন্যান্য নবী-রাসূল নুবুওয়াতের মর্যাদার কারণে ‘মাসূম’ এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কুফর থেকে সংরক্ষিত। কাজেই তাঁদের বিষয়ে আমাদের আকীদা পোষণ করতে হবে যে, তাঁরা ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্যান্য আউলিয়া, উলামা বা আল্লাহর প্রিয়পাত্রদের কারো বিষয়ে এরূপ নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না যে, তারা ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের থেকে যদি অলৌকিক কারামতাদি প্রকাশিত হয়, তাদের পরিপূর্ণ কামালাত ও বেলায়াত প্রমাণিত হয় বা সকল প্রকারের নেক আমলে তাদের লিপ্ত থাকা নিশ্চিত জানা যায়, তবুও তাদের কারো বিষয়ে এরূপ নিশ্চিত হওয়া যায় না।...।’’[1]