উপরের বাক্যটি ইমাম আবূ হানীফার লেখা হোক বা না হোক প্রসঙ্গটি ইসলামী আকীদার সাথে জড়িত। পরবর্তী অনুচ্ছেদে আবূ তালিবের ওফাত প্রসঙ্গে আমরা দেখব যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকেই শীয়াগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ও তাঁর চাচা আবূ তালিবকে মুমিন হিসেবে বিশ্বাস করাকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন। মূলধারার তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনেক প্রসিদ্ধ ইমাম উল্লেখ করেছেন যে, তাঁরা কাফির-মুশরিক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। কারণ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিভিন্ন হাদীস এরূপই প্রমাণ করে। আনাস (রা) বলেন:
إنَّ رَجُلا قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيْنَ أَبِي قَالَ فِي النَّارِ فَلَمَّا قَفَّى دَعَاهُ فَقَالَ إِنَّ أَبِي وَأَبَاكَ فِي النَّارِ
‘‘এক ব্যক্তি বলে: হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতা কোথায়? তিনি বলেন: জাহান্নামে। লোকটি যখন চলে যাচ্ছিল তখন তিনি তাকে ডেকে বললেন: নিশ্চয়ই আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে।’’[1]
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন:
زَارَ النَّبِيُّ ﷺ قَبْرَ أُمِّهِ (يَوْمَ الْفَتْحِ) فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ حَوْلَهُ (فَمَا رُئِيَ بَاكِيًا أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ الْيَوْمِ) فَقَالَ اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي فِي أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِي وَاسْتَأْذَنْتُهُ فِي أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأُذِنَ لِي فَزُورُوا الْقُبُورَ فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ
(মক্কা বিজয়ের সময়) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর মাতার কবর যিয়ারত করেন। তখন তিনি এমনভাবে ক্রন্দন করেন যে তাঁর সাথীগণও ক্রন্দন করতে থাকেন (তাঁকে এত বেশি ক্রন্দন করতে আর কখনো দেখা যায় নি)। তিনি বলেন: আমি আমার রবের নিকট আমার মায়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার অনুমতি চাইলাম, কিন্তু আমাকে অনুমতি দেয়া হলো না। তারপর আমি তার কবর যিয়ারতের অনুমতি চাইলাম। তখন আমাকে অনুমতি দেয়া হলো। তোমরা কবর যিয়ারত করবে; কারণ তা মৃত্যুর কথা স্মরণ করায়।[2]
ইমাম ইবন মাজাহ মুহাম্মাদ ইবন ইয়াযীদ কাযবীনী (২৭৩ হি), ইমাম নাসায়ী আহমদ ইবন শুআইব (৩০৩ হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এ হাদীসকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাতার মুশরিক হওয়ার প্রমাণ ও মুশরিকের কবর যিয়ারতের বৈধতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন। এ হাদীস প্রসঙ্গে ইবন মাজাহ বলেন: ‘‘(باب ما جاء في زيارة قبور المشركين) মুশরিকদের কবর যিয়ারত বিষয়ে বর্ণিত হাদীসের অনুচ্ছেদ’’[3] এবং নাসায়ী বলেন: (باب زيارة قبر المشرك) ‘‘মুশরিকের কবর যিয়ারতের অনুচ্ছেদ’’।[4] তৃতীয়-চতুর্থ শতক পর্যন্ত অনেকেই বিষয়টিকে স্বতঃসিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন:
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلاَ تُسْأَلُ عَنْ أَصْحَابِ الْجَحِيمِ
‘‘নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আপনি জাহান্নামীদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবেন না।’’[5]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম তাবারী (৩১০ হি) তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবন কা’ব কুরাযী থেকে উদ্ধৃত করেন, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
ليت شعري ما فعل أبواي؟ فنزلت
‘‘আমার পিতামাতার কি অবস্থা তা যদি আমি জানতে পারতাম!’- তখন এ আয়াতটি নাযিল করা হয়।’’
এরপর ইমাম তাবারী বলেন:
فإن ظن ظان أن الخبر الذي روي عن محمد بن كعب صحيح ، فإن في استحالة الشك من الرسول عليه السلام - في أن أهل الشرك من أهل الجحيم ، وأن أبويه كانا منهم، ما يدفع صحة ما قاله محمد بن كعب، إن كان الخبر عنه صحيحا.
‘‘যদি কোনো ধারণাকারী ধারণা করেন যে, মুহাম্মাদ ইবন কা’ব থেকে বর্ণিত এ হাদীসটি সহীহ তবে তার এ ধারণা সঠিক হবে না। কারণ মুশরিকগণ যে জাহান্নামী এবং তাঁর পিতামাতা যে তাদের অন্তর্ভুক্ত এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো সন্দেহ থাকা-ই অসম্ভব বিষয়। আর এটিই প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদ ইবন কাব যে কথা বলেছেন তা সঠিক নয়; যদিও তিনি এ কথা বলেছেন বলে প্রমাণিত হয়।[6]
ইমাম ফাখরুদ্দীন রাযী (৬০৬ হি) এ মত সমর্থন করে বলেন:
هذه الرواية بعيدة لأنه ﷺ كان عالماً بكفرهم، وكان عالماً بأن الكافر معذب، فمع هذا العلم كيف يمكن أن يقول : ليت شعري ما فعل أبواي.
‘‘এ বর্ণনাটি অগ্রহণযোগ্য। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের কাফির হওয়ার বিষয় জানতেন এবং কাফিররা যে শাস্তি পাবে তাও জানতেন। কাজেই এরূপ জ্ঞান থাকার পরেও কিভাবে তিনি বলবেন: আমার পিতামাতা কিরূপ আছেন তা যদি জানতাম!?’’[7]
এ মতের বিপরীতে বিগত কয়েক শতাব্দী যাবৎ অনেক আলিম মত প্রকাশ করছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন। ইবনু শাহীন উমার ইবনু আহমদ (৩৮৫ হি), খতীব বাগদাদী (৪৬৩ হি), ইবনু আসাকির (৫৭১হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা সকলেই একই সনদে হাদীসটি সংকলন করেছেন। আয়েশা (রা)-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসটিতে বলা হয়েছে যে, বিদায় হজ্জের সময়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেদনার্ত ছিলেন। একসময় তিনি আনন্দিত চিত্তে আয়েশার (রা) নিকট আগমন করেন। তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন:
ذَهَبْتُ لِقَبْرِ أُمِّي آمِنَةَ فَسَأَلْت اللهَ رَبِّي أَنْ يُحْيِيَهَا فَأَحْيَاهَا فَآمَنَتْ بِي أَوْ قَالَ فَآمَنَتْ وَرَدَّهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ
‘‘আমি আমার আম্মা আমেনার কবরের নিকট গমন করি এবং আল্লাহর কাছে দুআ করি তাঁকে জীবিত করতে। তখন আল্লাহ তাঁকে জীবিত করেন, তিনি আমার উপর ঈমান আনয়ন করেন, অতঃপর আল্লাহ তাঁকে ফিরিয়ে নেন।’’ কোনো কোনো বর্ণনায় পিতামাতার কথা বলা হয়েছে।
নবম-দশম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও শাফিয়ী ফকীহ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১ হি) ও অন্যান্য আলিম এ হাদীসের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেন বলে মত প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য যে, ইবনুল জাওযী, মোল্লা আলী কারী, শাওকানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে নিশ্চিত করেছেন। ইবনু কাসীর বলেন: হাদীসটি মুনকার ও অত্যন্ত দুর্বল এবং হাদীসের রাবীগণ দুর্বল ও অজ্ঞাতপরিচয়। ইবনু আসাকিরও একই কথা বলেছেন। ইমাম সুয়ূতী উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি নিশ্চিতরূপেই দুর্বল। তিনি বলেন, মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি দুর্বল, কেউ কেউ একে জাল বলেছেন। তবে একে জাল না বলে দুর্বল বলা উচিত। ইমাম সুয়ূতীর মতে ফযীলত বা মর্যাদার বিষয় যেহেতু ঈমান-আকীদা ও হালাল-হারাম-এর সাথে সংশিস্নষ্ট নয়, এজন্য ফযীলত বিষয়ে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়। আর এ মূলনীতির ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার ফযীলতে এ দুর্বল হাদীসটি গ্রহণ করা যায়।[8]
এর বিপরীতে কোনো কোনো আলিম বলেছেন যে, আমল বা কর্মের ফযীলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করার পক্ষে অনেক আলিম মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তির ফযীলত বা মর্যাদার বিষয় যেহেতু বিশ্বাস বা আকীদার বিষয় সেহেতু এ বিষয়ে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায় না। অনেক আলিম বলেন, হাদীসটি জাল না হলেও এরূপ দুর্বল হাদীস বুখারী-মুসলিম সংকলিত সহীহ হাদীসের বিপরীতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বোপরি কুরআন ও হাদীসে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, আযাব বা মৃত্যুর আগমনের পর ঈমান বা তাওবা অর্থহীন।[9] আল্লাহ তাঁর হাবীবের পিতামাতাকে ক্ষমা করতে চাইলে তাঁর দুআর মাধ্যমেই করতে পারেন; মৃত্যুর মাধ্যমে আখিরাত প্রত্যক্ষ করার পরে ঈমান গ্রহণ এক্ষেত্রে অর্থহীন।[10]
অন্য হাদীসে আলী (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
خَرَجْتُ مِنْ نِكَاحٍ، وَلَمْ أَخْرُجْ مِنْ سِفَاحٍ مِنْ لَدُنْ آدَمَ إِلَى أَنْ وَلَدَتْنِي أَبِي وَأُمِّي ، لَمْ يُصِبْنِي مِنْ سِفَاحِ الْجَاهِلِيَّةِ شَيْءٌ.
‘‘আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আমার পিতামাতা আমাকে জন্ম দেওয়া পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে আমার জন্ম, কোনো অবৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে আমার জন্ম হয় নি। জাহিলী যুগের কোনো অবৈধতা- অশ্লীলতা আমাকে স্পর্শ করে নি।’’[11]
কেউ কেউ এ অর্থের হাদীস দ্বারা দাবি করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ও পূর্বপুরুষগণ কেউ কাফির ছিলেন না। ইমাম বাইহাকী ও অন্যান্য আলিম বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। বাইহাকী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ও পিতামহের জাহান্নামী হওয়ার অর্থে অনেকগুলো হাদীস উদ্ধৃত করেন। এরপর তিনি বলেন:
وكيف لا يكون أبواه وجده بهذه الصفة في الآخرة؟ وكانوا يعبدون الوثن حتى ماتوا، ولم يدينوا دين عيسى ابن مريم عليه السلام. وأمرهم لا يقدح في نسب رسول الله ﷺ؛ لأن أنكحة الكفار صحيحة، ألا تراهم يسلمون مع زوجاتهم فلا يلزمهم تجديد العقد، ولا مفارقتهن إذا كان مثله يجوز في الإسلام.
‘‘তাঁর পিতা, মাতা ও পিতামহ মৃত্যু পর্যন্ত মূর্তিপূজা করেছেন এবং তাঁরা ঈসা (আঃ)-এর দীনও গ্রহণ করেন নি, কাজেই তাঁরা আখিরাতে জাহান্নামী হবেন না কেন? এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশের পবিত্রতার পরিপন্থী নয়; কারণ কাফিরদের বিবাহ বিশুদ্ধ। এজন্য তো কাফিরগণ যখন তাদের স্ত্রীদের সাথে একত্রে ইসলাম গ্রহণ করেন তখন নতুন করে বিবাহ পড়ানোর দরকার হয় না এবং স্ত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ারও কোনো বিধান নেই, যদি এরূপ বিবাহ ইসলামে বৈধ থাকে।’’[12]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার বিষয়ে তৃতীয় একটি মত বিদ্যমান। এ মতানুসারে তাঁর পিতামাতা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেও নবী-বিহীন যুগে মৃত্যুর কারণে তাঁরা শাস্তিযোগ্য নন। নিম্নের আয়াতগুলো তা প্রমাণ করে:
وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُولا
‘‘রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি শাস্তি প্রদান করি না।’’[13]
رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ
‘‘রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও ভয়প্রদর্শনকারী হিসেবে; যেন রাসূলগণের পরে মানুষের জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ অবশিষ্ট না থাকে।’’[14]
وَلَوْ أَنَّا أَهْلَكْنَاهُمْ بِعَذَابٍ مِنْ قَبْلِهِ لَقَالُوا رَبَّنَا لَوْلَا أَرْسَلْتَ إِلَيْنَا رَسُولًا فَنَتَّبِعَ آَيَاتِكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَذِلَّ وَنَخْزَى
‘‘যদি আমি তাদেরকে ইতোপূর্বে শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করতাম তবে তারা বলত, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের কাছে একজন রাসূল পাঠালেন না কেন? পাঠালে আমরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হওয়ার আগে আপনার নিদর্শন মেনে চলতাম।’’’[15]
এ সকল আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ‘‘ফাতরাত’’ বা রাসূল-বিহীন যুগে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, এরূপ মানুষদেরকে কিয়ামাতে পরীক্ষা করে মুক্তি দেওয়া হবে। এজন্য অনেক আলিম মত প্রকাশ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেও শাস্তির অন্তর্ভুক্ত হবেন না।
এ মতটি অত্যন্ত জোরালো। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার কুফরের উপর মৃত্যু হওয়ার বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সুনিশ্চিত। মৃত্যুর পরে পুনর্জীবিত হয়ে ঈমান গ্রহণের হাদীসটি সনদগতভাবে অত্যন্ত দুর্বল। উপরন্তু অর্থের দিক থেকে মৃত্যুর পরে ঈমান আনার বিষয়টি কুরআন-হাদীসের সামগ্রিক নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক। পক্ষান্তরে ‘ফাতরাতে’ বা ‘রাসূল-বিহীন’ যুগে মৃত্যুর কারণে আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে উপরে উল্লেখিত ‘‘আমার ও তোমার পিতা জাহান্নামে’’ হাদীসটি এ মতের সাথে সাংঘর্ষিক।
সপ্তম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম নববী (৬৭৬ হি) ‘আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে’- হাদীসটিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণের নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে বলেন:
فِيهِ أَنَّ مَنْ مَاتَ عَلَى الْكُفْر فَهُوَ فِي النَّار، وَلا تَنْفَعهُ قَرَابَة الْمُقَرَّبِينَ، وَفِيهِ أَنَّ مَنْ مَاتَ فِي الْفَتْرَة عَلَى مَا كَانَتْ عَلَيْهِ الْعَرَب مِنْ عِبَادَة الأَوْثَان فَهُوَ مِنْ أَهْل النَّار، وَلَيْسَ هَذَا مُؤَاخَذَة قَبْل بُلُوغ الدَّعْوَة، فَإِنَّ هَؤُلاءِ كَانَتْ قَدْ بَلَغَتْهُمْ دَعْوَة إِبْرَاهِيم وَغَيْره مِنْ الأَنْبِيَاء
‘‘এ হাদীসে নির্দেশনা রয়েছে, যে ব্যক্তি কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামী। আল্লাহর প্রিয়ভাজনদের আত্মীয়তা তার কোনো উপকার করবে না। এ হাদীসে আরো নির্দেশনা রয়েছে, আরবের মানুষগণ যেরূপ মুর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল সেরূপ কর্মের মধ্যে থেকে যে ব্যক্তি রাসূল-বিহীন ‘ফাতরাতের’ সময়ে মৃত্যুবরণ করেছে সে ব্যক্তিও জাহান্নামী। এরূপ ব্যক্তিদের জাহান্নামে যাওয়ার অর্থ এ নয় যে, তাদেরকে দীনের দাওয়াত পৌঁছানোর পূর্বেই শাস্তি দেওয়া হলো। কারণ, এদের কাছে ইবরাহীম (আঃ) ও অন্যান্য নবীর দাওয়াত পৌঁছেছিল।’’[16]
আল্লামা খলীল আহমদ সাহারানপূরী (১৩৪৬ হি) বলেন:
قَدْ بَالَغَ السُّيُوْطِيُّ فِيْ إِثْبَاتِ إِيْمَانِ أَبَوَيْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ. قَالَ الْقَارِي: الجمهور عَلَى أَنَّ وَالِدَيْهِ ﷺ مَاتَا كَافِرَيْنِ. وَهَذَا الْحَدِيْثُ أَصَحُّ مَا رُوِيَ فِيْ حَقِّهِمَا... فَعَلَى تَقْدِيْرِ صِحَّتِهِ لاَ يَصْلُحُ أَنْ يَكُوْنَ مُعَارِضاً لِحَدِيْثِ مُسْلِمٍ مَعَ أَنَّ الْحُفَّاظَ طَعَنُوْا فِيْهِ وَمَنَعُوْا جَوَازَهُ بِأَنَّ إِيْمَانَ الْيَأْسِ غَيْرُ مَقْبُوْلٍ إِجْمَاعاً كَمَا يَدُلُّ عَلَيْهِ الْكِتَابُ وَالسُّنَّةُ وَبِأَنَّ الإِيْمَانَ الْمَطْلُوْبَ مِنَ الْمُكَلَّفِ إِنَّمَا هُوَ الإِيْمَانُ الْغَيْبِيُّ... وَهَذَا الْحَدِيْثُ الصَّحِيْحُ صَرِيْحٌ أَيْضاً فِيْ رَدِّ مَا تَشَبَّثَ بِهِ بَعْضُهُمْ بِأَنَّهُمَا كَانَا مِنْ أَهْلِ الْفَتْرَةِ وَلاَ عَذَابَ عَلَيْهِمْ
‘‘সুয়ূতী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতা-মাতার ঈমানের বিষয়টি প্রমাণে অতি-চেষ্টা করেছেন। মোল্লা আলী ক্বারী বলেছেন: অধিকাংশ আলিম একমত যে, তাঁরা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এ ব্যাপারে এ হাদিসটি সবচেয়ে বিশুদ্ধ দলিল। ... (পুনর্জীবিত করার) হাদিসটি সহীহ বলে মেনে নিলেও মুসলিম শরীফের (আমার ও তোমার পিতা জাহান্নামে) হাদীসটির বিপরীতে দাঁড় করানো যায় না। সর্বোপরি প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ (পুনরুজ্জীবিত করার) এ হাদিসটির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে আপত্তি করেছেন। তাঁরা এ ঘটনার সম্ভাবনাও অস্বীকার করেছেন। কারণ মুসলিম উম্মাহর ইজমা যে, নৈরাশ্যের পরে ঈমান- অর্থাৎ মৃত্যুর আগমনের পরে ঈমান- গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন ও হাদীসে তা সুস্পষ্ট বলা হয়েছে। এছাড়া ঈমান তো গাইবী বিষয়ের উপরই হয়ে থাকে। মৃত্যুর পরে তো সব গাইবী বিষয় প্রত্যক্ষ হয়ে যায়; এরপর তো আর ঈমান বিল-গাইব থাকে না। ... (আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে) হাদিসটি সুষ্পষ্টভাবে তাদের বক্তব্যও প্রত্যাখ্যান করে যারা দাবী করে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতা ‘‘ফাতরাত’’ বা রাসূল-বিহীন যুগে থাকার কারণে তাদের শাস্তি হবে না।’’[17]
এভাবে ইমাম নববী ও অন্যান্য আলিম এ হাদীসের উপর নির্ভর করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার ফাতরাত’-বাসী হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তাঁরা দাবি করেছেন যে, আরবের মুশরিকগণ ‘‘রাসূল-বিহীন’’ ছিলেন না; বরং ইবরাহীম (আঃ)-এর দাওয়াত তাদের নিকট পৌঁছেছিল। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা এই যে, ইবরাহীম (আঃ)-এর বিশুদ্ধ দাওয়াত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগের অনেক আগেই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। কাজেই তাঁর নুবুওয়াতের অব্যবহিত পূর্বের যুগের মানুষদেরকে রাসূল-বিহীন বলে গণ্য করাই কুরআন, সুন্নাহ, ইতিহাস ও যুক্তির দিক থেকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
তবে আলোচ্য হাদীসটি বাহ্যত এ মতটির সাথে সাংঘর্ষিক। এ হাদীসটির অর্থ হতে পারে যে ‘‘আমার ও তোমার পিতা রাসূল-বিহীন যুগের অধিবাসীদের পরীক্ষা পর্যন্ত জাহান্নামী হওয়ার বিধানের মধ্যে’’- এ অর্থের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতাকে রাসূল-বিহীন যুগের অধিবাসী হিসেবে আখিরাতের আযাব-মুক্ত বলে গণ্য করার মতটিই অগ্রগণ্য বলে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহই ভাল জানেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতামাতার বিষয়ে চতুর্থ মত হলো এ বিষয়ে মত প্রকাশ থেকে বিরত থাকা। সঠিক জ্ঞান তো মহান আল্লাহরই নিকটে।
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৭১ (জানাইয, বাবু ইসতিজানিন নাবিয়্যি.. ফি যিয়ারাতি)।
[3] ইবন মাজাহ, কিতাবুল জানায়িয, বাব মা জাআ ফী যিয়ারাতি কুবূরির মুশরিকীন ১/৫০১।
[4] নাসায়ী, কিতাবুল জানায়িয, বাব যিয়ারত কাবরিল মুশরিক ৪/৯০-৯১।
[5] সূরা (২) বাকারা: ১১৯ আয়াত।
[6] তাবারী, তাফসীর ২/৫৫৮-৫৬০।
[7] ফখরুদ্দীন রাযী, মাফাতীহুল গাইব ৪/২৮।
[8] সুয়ূতী, আল-হাবী লিল-ফাতাওয়া ২/২১৮।
[9] সূরা নিসা: ১৭-১৮ আয়াত; সূরা গাফির (মুমিন): ৮৫ আয়াত।
[10] বিস্তারিত দেখুন: সুহাইলী, আর-রাওযুল উনুফ /২৯৬; ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূআত ১/২৮৪; ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ৪/৩০৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী আল-মাসনূআ ১/২৪৫; আল-হাবী লিল-ফাতওয়া ২/২১৮; ৩/৩৪৩; কুরতুবী, আত-তাযকিরা ফী আহওয়ালিল আখিরাহ ১/১২; মোল্লা আলী কারী, আদিল্লাতু মু’তাকাদি আবী হানীফা, ৮৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ আল-মাজমুআ ১/৩২২।
[11] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৭/১৯০; আলবানী, সহীহুল জামি ১/৬১৩, নং ৩২২৫।
[12] বাইহাকী, দালাইলুন নুবুওয়াত ১/১১২, ১১৯-১২২।
[13] সূরা (১৭) ইসরা (বনী ইসরাঈল): ১৫ আয়াত।
[14] সূরা (৪) নিসা: ১৬৫ আয়াত।
[15] সূরা (২০) তাহা: ১৩৪ আয়াত। পুনশ্চ: সূরা (২৮) কাসাস: ৪৭ আয়াত।
[16] নববী, শারহু সাহীহ মুসলিম ৩/৭৯।
[17] সাহারানপুরী, বজলুল মাজহূদ ৫/২১৪ ।