ইমাম আবূ হানীফার যুগের আলিমগণ সাধারণত প্রচলিত পরিভাষায় গ্রন্থ রচনা করতেন না, বরং তাঁরা যা বলতেন তা ছাত্ররা লিখতেন। এজন্য তাবিয়ী যুগে বা ১৫০ হিজরী সালের মধ্যে মৃত্যুবরণকারী আলিমদের লেখা বা সংকলিত পৃথক গ্রন্থাদির সংখ্যা খুবই কম। তাঁদের ছাত্রগণের লেখায় তাঁদের বক্তব্য সংকলিত। কখনো কোনো ছাত্র তাঁদের বক্তব্য একক পুস্তিকায় সংকলন করতেন। কখনো তাঁরা নিজেরাই কিছু তথ্য সংকলন করতেন। ইমাম আবূ হানীফার লেখা বলতে কখনো তাঁর নিজের সংকলন এবং কখনো তাঁর কোনো ছাত্র কর্তৃক তাঁর বক্তব্য বা তাঁর বর্ণিত হাদীস সংকলন বুঝানো হতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই তা ‘ইমাম আবূ হানীফা’-র নামে প্রচারিত হতে পারে। এ মূলনীতির ভিত্তিতে ইমাম আবূ হানীফা রচিত ও সংকলিত প্রধান গ্রন্থ ‘কিতাবুল আসার’।
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় ‘আসার’ বলতে সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের বক্তব্য বা কর্ম বুঝানো হয়। সাধারণভাবে ‘আসার’ এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় হিজরী শতকে মুহাদ্দিসগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসের সাথে সাহাবীগণের বক্তব্যও সংকলন করতেন এবং ফিকহী পদ্ধতিতে বিন্যাস করতেন। এরূপ গ্রন্থগুলো ‘মুআত্তা’, ‘মুসান্নাফ’ বা ‘কিতাবুল আসার’ নামে পরিচিত।
ইমাম আবূ হানীফা সংকলিত ‘কিতাবুল আসার’ তাঁর কয়েকজন ছাত্র বর্ণনা করেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন: যুফার ইবন হুযাইল (১৫৮ হি), আবূ ইউসুফ (১৮২ হি), মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (১৮৯ হি), হাসান ইবন যিয়াদ লুলুয়ী (২০৪ হি)। তন্মধ্যে আবূ ই্উসূফ এবং মুহাম্মাদ বর্ণিত ‘কিতাবুল আসার’ দুটো পৃথক গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত। এ গ্রন্থদুটোতে ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ ইমাম আবূ হানীফা বর্ণিত হাদীসে নববী এবং সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্য সংকলন করেছেন। উল্লেখ্য যে, উভয় গ্রন্থের অধিকাংশ ‘আসার’ বা হাদীস একই। মূলত গ্রন্থদুটো ইমাম আবূ হানীফা সংকলিত কিতাবুল আসারের পৃথক বর্ণনা মাত্র। ইমাম মালিকের মুআত্তা গ্রন্থটি যেমন বিভিন্ন ছাত্র বিভিন্ন সময়ে শ্রবণ ও বর্ণনা করার কারণে অনেকগুলো মুআত্তার সৃষ্টি হয়েছে। অনুরূপভাবে ইমাম আবূ হানীফা সংকলিত কিতাবুল আসার ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম আবূ ইউসুফ পৃথকভাবে বর্ণনা করার কারণে উভয়ের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম সৃষ্টি হয়েছে।
‘কিতাবুল আসার’ ছাড়াও ইমাম আবূ হানীফা সংকলিত হাদীসগুলো ‘মুসনাদ আবী হানীফা’ নামে বর্ণিত ও গ্রন্থায়িত। তাঁর কয়েকজন ছাত্র তাঁর মুসনাদ বর্ণনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:
(১) ইমাম আবূ হানীফার পুত্র হাম্মাদ ইবন আবূ হানীফা (১৮০ হি)
(২) মুহাম্মাদ ইবন খালিদ ওয়াহবী (২০০ হি)
(৩) আবূ আলী হাসান ইবন যিয়াদ লু’লুয়ী (২০৪ হি)
চতুর্থ হিজরী শতক থেকে ষষ্ঠ হিজরী শতক পর্যন্ত সময়ে কয়েকজন মুহাদ্দিস ইমাম আবূ হানীফার সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলো তাঁদের সনদে সংগ্রহ করে ‘মুসনাদ আবী হানীফা’ নামে সংকলন করেন। তাঁদের অন্যতম:
(১) উমার ইবনুল হাসান ইবনুল আশনানী বাগদাদী (৩৩৯ হি)
(২) আবূ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ইয়াকূব ইবনুল হারিস আল-হারিসী আল-বুখারী আল-উসতাদ (৩৪০ হি)
(৩) আবূ আহমদ আব্দুল্লাহ ইবন আদী জুরজানী (৩৬৫ হি)
(৪) আবুল কাসিম তালহা ইবন মুহাম্মাদ ইবন জা’ফার মুআদ্দিল শাহিদ বাগদাদী (৩৮০ হি)
(৫) আবুল হুসাইন মুহাম্মাদ ইবনুল মুযাফ্ফার ইবন মূসা ইবন ঈসা ইবন মুহাম্মাদ বাগদাদী (৩৭৯ হি)
(৬) আবূ নুআইম ইসপাহানী আহমদ ইবন আব্দুল্লাহ (৪৩০ হি)
(৭) আবূ বকর আহমদ ইবন মুহাম্মাদ কালায়ী কুরতুবী (৪৩২ হি)
(৮) আবূ বাকর মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল বাকী ইবন মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ আনসারী খাযরাজী (৫৩৫ হি)
(৯) আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন ইবন মুহাম্মাদ ইবন খসরু বালখী বাগদাদী (৫২৬ হি)
(১০) আবুল কাসিম আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন আবিল আওয়াম সা’দী।
তিনি মিসরের বিচারপতি ছিলেন। তাঁর মৃত্যু তারিখ জানা যায় না। তবে তিনি ইমাম নাসায়ীর (৩০৩ হি) ছাত্র ছিলেন।[1] এছাড়া তাঁর পৌত্র মিসরের বিচারপতি আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আবিল আওয়াম হিজরী ৩৪৯ সালে জন্মগ্রহণ এবং ৪১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।[2] এ হিসেবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি চতুর্থ হিজরী শতকের প্রথমার্ধে ৩৩০-৩৪০ হিজরী সালের দিকে মৃত্যুবরণ করেন।
এগুলোর মধ্যে আবূ মুহাম্মাদ হারিসী সংকলিত মুসনাদ এবং আবূ নুআইম ইসপাহানী সংকলিত মুসনাদ গ্রন্থ দুটি মুদ্রিত।
সপ্তম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম ইমাম আবুল মুআইয়িদ মুহাম্মাদ ইবন মাহমূদ খাওয়ারিযমী (৬৬৫ হি) ‘জামিউল মাসানীদ’ বা ‘মুসনাদগুলোর সংকলন’ নামক একটি গ্রন্থে ‘মুসনাদ আবী হানীফা’ নামে প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোতে বিদ্যমান হাদীসগুলো একত্রে সংকলন করেন।
[1] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৪/১২৭।
[2] গায্যী, তারাজিমুল হানাফিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ১৪৯-১৫০; কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ১০৬-১০৭; যিরকলী, আল-আ’লাম ১/২১১।
কোনো কোনো আলিম ও গবেষক দাবি করতেন যে, ইমাম আযম কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি। হিজরী ষষ্ঠ শতকে প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও দার্শনিক ইমাম ফাখরুদ্দীন রাযী (৫৪৪-৬০৬হি) তাঁর রচিত মানাকিবুশ-শাফিয়িয়্যা গ্রন্থে এ ধারণা ব্যক্ত করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর রচিত কোন গ্রন্থই বিদ্যমান নেই।[1] পক্ষান্তরে অন্যান্য অনেক আলিম তাঁর রচিত কয়েকটি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন।
উল্লেখ্য যে, প্রাচীন যুগের অন্যান্য প্রসিদ্ধ আলিমগণের ন্যায় ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর নামেও অনেক জাল গল্প, কাহিনী, মত, বক্তব্য ও গ্রন্থ পরবর্তী যুগে প্রচারিত হয়েছে। বিশেষত ইমাম আবূ হানীফার পক্ষে ও বিপক্ষে বাড়াবাড়ি ও জালিয়াতির প্রবণতা ছিল খুবই বেশি, যার নমুনা আমরা দেখেছি। এক্ষেত্রে সত্য ও মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য আলিমগণ কয়েকটি বিষয় বিচার করেছেন: (১) জীবনীকারদের বক্তব্য, (২) সনদ যাচাই ও (৩) গ্রন্থের বিষয় ও ভাষা বিচার করা।
কোনো মনীষী কোনো গ্রন্থ রচনা করেছেন কিনা সে বিষয়ে জানতে তাঁর সমসাময়িক বা নিকটবর্তী লেখকদের বক্তব্য দেখতে হয়। তাঁর সমসাময়িক বা কাছাকাছি যুগের গবেষক বা জীবনীকারগণ যদি তাঁর রচিত কোনো গ্রন্থের উল্লেখ করেন তবে জানা যায় যে, উক্ত লেখকের নামে উক্ত গ্রন্থটি তাঁর মৃত্যুর আগে বা পরেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।
মুসলিম উম্মাহর অনন্য বৈশিষ্ট্য সনদ সংরক্ষণ। শুধু হাদীসের ক্ষেত্রেই নয়, লিখিত গ্রন্থগুলোর ক্ষেত্রেও তাঁরা সনদ সংরক্ষণ করেছেন। তাবিয়ীদের যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী শতশত বৎসর যাবৎ যত গ্রন্থ রচিত হয়েছে সকল গ্রন্থের পান্ডুলিপির শুরুতে পাঠক দেখবেন যে, গ্রন্থটির লেখক থেকে শুরু করে পান্ডুলিপির মালিক বা বর্ণনাকারী পর্যন্ত সনদ উক্ত পান্ডুলিপির উপর লেখা রয়েছে। এ সকল সনদ অধ্যয়ন করে খুব সহজেই গ্রন্থটি প্রকৃতই উক্ত আলিমের লেখা কিনা তা নিশ্চিত করা যায়।
যে গ্রন্থের পান্ডুলিপির কোনো নির্ভরযোগ্য সনদ নেই বা তার কোনো প্রাচীন পান্ডুলিপি নেই এবং পূর্ববর্তী লেখকগণ যে গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেন নি তা জাল বলে বুঝা যায়।
চতুর্থ শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আবুল লাইস সামারকান্দী নাসর ইবন মুহাম্মাদ (৩৭৩ হি) ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা করেছেন।[1] উপরন্তু গ্রন্থটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে বলে ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন।[2] এতে প্রমাণ হয় যে, ইমাম আযমের ওফাতের পরের শতকেই তাঁর এ গ্রন্থটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।
৪র্থ-৫ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবন নাদীম মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (৪৩৮ হি) ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে বলেন:
وله من الكتب كتاب الفقه الأكبر، كتاب رسالته الى البتي، كتاب العالم والمتعلم رواه عنه مقاتل، كتاب الرد على القدرية
তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: (১) আল ফিকহুল আকবার, (২) উসমান আল-বাত্তীকে লেখা চিঠি, (৩) আল-আলিম ওয়াল-মুতায়াল্লিম, গ্রন্থটি মুকাতিল তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন, (৪) আর-রাদ্দ আ’লাল-কাদারিয়াহ।’’[3]
পঞ্চম হিজরী শতকের সুপ্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ও আকীদাবিদ ইমাম বাযদাবী আলী ইবন মুহাম্মাদ ইবন হুসাইন (৪০০-৪৮২ হি) বলেন:
العلم نوعان علم التوحيد والصفات وعلم الشرايع والأحكام والأصل في النوع الأول هو التمسك بالكتاب والسنة ومجانبة الهوى والبدعة ولزوم طريق السنة والجماعة الذي كان عليه الصحابة والتابعون ... وكان على ذلك سلفنا أعني أبا حنيفة وأبا يوسف ومحمد أو عامة أصحابهم رحمهم الله وقد صنف أبو حنيفة رضي الله عنه في ذلك كتاب الفقه الأكبر وذكر فيه إثبات الصفات وإثبات تقدير الخير والشر من الله وأن ذلك كله بمشيئته ... وصنف كتاب العالم والمتعلم وكتاب الرسالة... وكان في علم الأصول إماما صادقا ... ودلت المسائل المتفرقة عن أصحابنا في المبسوط وغير المبسوط على أنهم لم يميلوا إلى شيء من مذاهب الاعتزال وإلى سائر الأهواء
‘‘ইলম দু প্রকার: (১) আল্লাহর একত্ব ও বিশেষণের ইলম এবং (২) শরীয়ত ও আহকামের ইলম। প্রথম প্রকারের ইলমের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো কুরআন ও সুন্নাত সুদৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরে থাকতে হবে, যুক্তি-মর্জি নির্ভর মত ও বিদআত বর্জন করতে হবে এবং আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতের উপরে, যে মতের উপরে সাহাবীগণ ও তাবিয়ীগণ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন সে মতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। .... আমাদের পূর্ববর্তীগণ, অর্থাৎ আবূ হানীফা, আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ ও তাঁদের অধিকাংশ ছাত্রই এ মতের উপরেই ছিলেন (রাহিমাহুমুল্লাহ)। আবূ হানীফা (রহ.) এ বিষয়ে ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি বিশেষণগুলো প্রমাণ ও স্বীকার করার কথা উল্লেখ করেছেন এবং ভালমন্দ তাকদীর আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে প্রমাণ ও স্বীকার করার কথা লিখেছেন। এগুলো সবই মহান আল্লাহর ইচ্ছায়...। এবং তিনি ‘‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিাম’’ গ্রন্থ রচনা করেছেন। এবং তিনি (বাত্তীকে পাঠানো) চিঠি লিখেছেন ....। তিনি দীনের মূলনীতির (আকীদার) বিষয়ে সত্যপরায়ণ ইমাম ছিলেন।... আমাদের সাথীগণ থেকে বর্ণিত বিস্তারিত ও সংক্ষিপ্ত সকল তথ্য প্রমাণ করে যে, তাঁরা মুতাযিলী মত বা অন্য কোনো বিদআতী মতের দিকে কোনোরূপ আকৃষ্ট হন নি।’’[4]
পঞ্চম হিজরী শতকের শাফিয়ী ফকীহ আল্লামা আবুল মুযাফ্ফার তাহির ইবন মুহাম্মাদ ইসফিরাঈনী শাহফূর (৪৭১ হি) লিখেছেন:
ومن أراد أن يتحقق أن لا خلاف بين الفريقين في هذه الجملة فلينظر فيما صنفه أبو حنيفة رحمه الله في الكلام وهو كتاب العلم ... وكتاب الفقه الأكبر الذي أخبرنا به الثقة بطريق معتمد وإسناد صحيح عن نصير بن يحيى عن أبي مطيع عن أبي حنيفة وما جمعه أبو حنيفة في الوصية التي كتبها إلى أبي عمرو عثمان البتي ...
‘‘(আকীদা বিষয়ে) হানাফী-শাফিয়ী মতভেদ না থাকার বিষয়টি যদি কেউ নিশ্চিত হতে চায় তবে সে যেন আবূ হানীফা (রাহ) রচিত ইলমুল কালাম বিষয়ক গ্রন্থ অধ্যয়ন করে। তা হলো ‘কিতাবুল ইলম’ (কিতাবুল আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম)। এবং ‘আল-ফিকহুল আকবার’ নামক গ্রন্থও অধ্যয়ন করুক, যে গ্রন্থটি আমাকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য সূত্রে ও সহীহ সনদে নাসীর ইবন ইয়াহইয়া থেকে আবূ মুতী থেকে আবূ হানীফা থেকে বর্ণনা করে শুনিয়েছেন। এছাড়া আবূ হানীফা আবূ আমর উসমান আল-বাত্তীকে (১৪৩হি) পাঠানো পত্রে যা লিখেছেন তাও অধ্যয়ন করুক।’’[5]
শাইখুল ইসলাম তাকিউদ্দীন ইবন তাইমিয়া (৬৬১-৭২৮ হি) বলেন:
فإن أبا حنيفة ... كلامه في الرد على القدرية معروف في الفقه الأكبر وقد بسط الحجج في الرد عليهم بما لم يبسطه على غيرهم في هذا الكتاب
‘‘কাদারিয়া মতের বিরুদ্ধে ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থে আবূ হানীফার বক্তব্য সুপরিচিত। এ গ্রন্থে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যত বিস্তারিত আলোচনা করেছেন অন্য কোনো ফিরকার বিরুদ্ধে তত আলোচনা করেন নি।’’[6]
প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম ইবন জামাআহ (৩৩হি) বলেন:
فإن أبا حنيفة له كتاب في الرد على القدرية سماه الفقه الأكبر
‘‘আবূ হানীফা কাদারিয়া মতবাদ খন্ডনে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম দিয়েছিলেন: ‘আল-ফিকহুল আকবার’।’’[7]
এভাবে আমরা দেখলাম যে, হিজরী ৪র্থ শতক থেকে আলিমগণ ইমাম আবূ হানীফা রচিত তিনটি বা চারটি পুস্তিকার কথা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগগুলোতে কয়েকজন আলিম ইমাম আবূ হানীফার লেখা আরো কয়েকটি পুস্তিকার কথা উল্লেখ করেছেন। অষ্টম হিজরী শতকে আল্লামা আব্দুল কাদির ইবন আবিল ওয়াফা (৭৭৫ হি) ইমাম আযমের রচনাবলি প্রসঙ্গে বলেন:
ومن تصانيفه وصاياه لأصحابه
‘‘তাঁর গ্রন্থাদির মধ্যে রয়েছে ‘তাঁর সাথীদের জন্য তাঁর ওসিয়্যাত’।[8]
এ শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ বাবরতী (৭৮৬ হি) ‘‘শারহু ওয়াসিয়্যাতিল ইমাম আবী হানীফাহ’ নামে এ পুস্তিকাটির ব্যাখ্যা লিখেন।[9] কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন যে, এ পুস্তিকাটি তাঁর পুত্র হাম্মাদ-এর রচিত।[10]
প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আহমদ ইবন হাসান আল-বায়াদী (১০৯৮ হি), মুহাম্মাদ মুরতাদা যাবীদী (১২০৫ হি), আল্লামা মুহাম্মাদ যাহিদ কাওসারী (১৩৭১/১৯৫২) ও অন্যান্য আলিম ইমাম আযমের রচনাবলির মধ্যে ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ নামক গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন।[11]
ত্রয়োদশ হিজরী শতকে (ঊনবিংশ খৃস্টীয় শতকে) তুরস্ক ও ভারতে ইমাম আবূ হানীফার নামে ‘‘আল-কাসীদাহ আন-নুমানিয়্যাহ’ বা ‘আল-কাসীদাহ আল-কাফিয়্যাহ’ নামে আরেকটি কাব্য-পুস্তিকা প্রকাশ পায়। তুরস্ক ও ভারতে কোনো কোনো আলিম এর অনুবাদও করেন। এদের মধ্যে প্রাচীনতম যাকে জানা যায় তিনি তুরস্কের শাইখ ইবরাহীম খালীল ইবন আহমদ রূমী হানাফী (১২৭০ হি/১৮৫৪খৃ)।[12] বিগত শতকে ‘‘আল-মাকসূদ ফিস সারফ’’ নামে আরবী শব্দতত্ত্ব বিষয়ক একটি পুস্তিকা ইমাম আযমের লিখিত বলে প্রচারিত হয়েছে।
[2] আবূ মানসূর মাতুরিদী (আবুল্লাইস সামারকান্দী), শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ২।
[3] ইবন নাদীম, আল-ফিহরিস্ত, পৃ. ২৮৫।
[4] বাযদাবী, উসূলুল বাযদাবী ১/৩-৪।
[5] শাহফূর আবুল মুযাফ্ফার ইসফিরাঈনী, আত-তাবসীর ফিদ্দীন. পৃ ১৮৪।
[6] ইবন তাইমিয়া, মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ ৩/৮৩।
[7] ইবন জামাআহ, ঈদাহুদ দালীল, পৃ. ২২।
[8] কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ (শামিলা: মীর কুতুবখানা, করাচী) ২/৪৬১।
[9] যিরকলী, আল-আলাম ৭/৪২।
[10] ইলইয়াস সারকীস, মু’জামুল মাতবূআত ১/৩০৩।
[11] আল-বায়াদী, ইশারাতুল মারাম, পৃ. ২৮; যাবীদী, ইতহাফিস সাদাতিল মুত্তাকীন ২/১৪; ড. খুমাইয়িস, উসূলুদ্দীন ইনদাই ইমাম আবী হানীফাহ, পৃ. ১১৯।
[12] ইসমাঈল পাশা, ঈদাহুল মাকনূন ২/১৪; কাহ্হালাহ, মু’জামুল মুআল্লিফীন ১/৩০।
এভাবে আমরা দেখছি যে, চতুর্থ শতক থেকে আলিমগণ ইমাম আবূ হানীফা রচিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’ ও কয়েকটি পুস্তিকার কথা উল্লেখ করেছেন। উপরন্তু তাঁরা বারবার বলেছেন যে, তাঁরা এগুলো সহীহ সনদের বর্ণনার মাধ্যমে গ্রহণ ও অধ্যয়ন করেছেন। কিন্তু তারপরও এগুলো নিয়ে আপত্তি বা সন্দেহের কারণ কী?
ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর শুরু থেকে মুতাযিলী শাসনের প্রেক্ষাপটে অনেক হানাফী ফকীহ মুতাযিলী মত গ্রহণ করেন বা মুতাযিলীদের সাথে মিলে মিশে চলতে থাকেন। তৃতীয় হিজরী শতক থেকে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ইরাক, ইরান ও মধ্য এশিয়ার অনেকে ফিকহী বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফার মত অনুসরণ করলেও আকীদার বিষয়ে মুতাযিলী-কাদারিয়া মত অনুসরণ করতেন। আল্লামা জারুল্লাহ যামাখশারী (৫৩৮ হি)-র কথা আমরা অনেকেই জানি। তিনি মুতাযিলী মতবাদের একজন গোঁড়া অনুসারী ও প্রচারক ছিলেন। কিন্তু ফিকহী বিষয়ে তিনি হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং হানাফী ফিকহ বিষয়ে তাঁর রচিত একাধিক গ্রন্থ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এসকল মুতাযিলী-কাদারী হানাফীগণ ইমাম আবূ হানীফাকেও মুতাযিলী-কাদারিয়া মতাবলম্বী বলে মনে করতেন বা চিত্রিত করার চেষ্টা করতেন। তাদের মতের পক্ষে অনেক বক্তব্য ও গল্প তারা ইমাম আবূ হানীফার নামে প্রচার করতেন। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলো সবই আকীদা বিষয়ক এবং মুতাযিলী-কাদারিয়া আকীদার বিরোধী। এজন্য এ গ্রন্থগুলোকে তারা বিভিন্নভাবে চোখের আড়াল রাখতে চেষ্টা করতেন। এগুলো ইমামের রচিত নয় বলে প্রচার করতেন। কখনো বা ব্যাখ্যার নামে এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বক্তব্য ঢুকিয়েছেন। যে কারণে গ্রন্থগুলোর ব্যাপক প্রচার ব্যাহত হয়েছে এবং এ বিষয়ে নানা বিতর্ক ও সন্দেহ প্রচারিত হয়েছে।
আমরা দেখেছি, ইমাম বাযদাবী এরূপ প্রচারণা খন্ডন করে বলেছেন যে, ইমাম আযম মুতাযিলী বা কাদারী ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে অষ্টম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা আব্দুল কাদির ইবন আবিল ওয়াফা কুরাশী (৬৯৬-৭৭৫ হি) বলেন:
قال الكردري: فإن قلت ليس لأبي حنيفة كتاب مصنف قلت هذا كلام المعتزلة... وغرضهم بذلك نفي أن يكون الفقه الأكبر وكتاب العالم والمتعلم له لأنه صرح فيه بأكثر قواعد أهل السنة والجماعة ودعواهم أنه كان من المعتزلة وذلك الكتاب لأبي حنيفة البخاري وهذا غلط صريح فإني رأيت بخط العلامة مولانا شمس الملة والدين الكردري البزاتقني العمادي هذين الكتابين وكتب فيهما أنهما لأبي حنيفة وقال تواطأ على ذلك جماعة كثير من المشائخ ...
কারদারী[1] বলেন: ‘‘আপনি যদি বলেন যে, ‘আবূ হানীফা কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি’, তবে আমি বলব যে, এ মু’তাযিলীদের কথা। ... তাদের উদ্দেশ্য হলো, আল-ফিকহুল আকবার এবং আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম গ্রন্থদ্বয় তাঁর রচিত নয় বলে দাবি করা। কারণ ইমাম এ দুটো গ্রন্থে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অধিকাংশ মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। মুতাযিলীরা দাবি করে যে, ইমাম আবূ হানিফা মুতাযিলী ছিলেন। তারা বলে, ‘আল-ফিকহুল আকবার’ আবূ হানীফা আল-বুখারী নামক একব্যক্তির লেখা। এ কথাটি সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি। কারণ মাওলানা শামসুল মিল্লাতি ওয়াদ্দীন কারদারী বাযাতিকনী ইমাদীর নিজের হাতে অনুলিপি করা এ দুটো গ্রন্থ আমার হস্তগত হয়েছে এবং তিনি এদুটো গ্রন্থেই লিখে রেখেছেন যে, গ্রন্থদ্বয় ইমামের রচিত। তিনি বলেছেন: বহুসংখ্যক মাশাইখ (প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ) এ বিষয়ে একমত।’’[2]
এরূপ অপপ্রচারের কারণে ইমাম আযম রচিত গ্রন্থগুলো তাঁর অনুসারীদের মধ্যেও তেমন প্রচার লাভ করে নি। ‘আল-ফিকহুল আকবার’ ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থের পান্ডুলিপিও খুবই কম পাওয়া যেত। আল্লামা আব্দুল কাদির ইবন আবিল ওয়াফা কুরাশী ইমাম আযমের রচনাবলি আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন:
وقد شرحت الفقه الأكبر وضمتنه وصاياه بحمد الله ولعلي إذا ظفرت بالعلم والمتعلم أشرحه بعون الله وتوفيقه
‘‘আল-হামদু লিল্লাহ, আমি ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থটির ব্যাখ্যা রচনা করেছি। এর মধ্যে ইমামের ওসিয়্যাতগুলোও সংযুক্ত করেছি। যদি ‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম’ গ্রন্থটির সন্ধান পাই তাহলে আশা রাখি যে, আমি আল্লাহর সাহায্যে ও তাওফীকে এ গ্রন্থটিরও ব্যাখ্যা লিখব।’’[3]
এ থেকে আমরা বুঝি যে, সপ্তম শতকেও ইমাম আযমের কোনো কোনো গ্রন্থ এতই দুষ্প্রাপ্য ছিল যে, এরূপ একজন প্রসিদ্ধ ও ব্যাপক অধ্যয়ন নির্ভর হানাফী আলিমের জন্যও এ সকল গ্রন্থ সংগ্রহ সম্ভব হয় নি।
[2] কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ ২/৪৬১।
[3] কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ ২/৪৬১।
আমরা দেখলাম যে, উপরের ৭টি পুস্তিকা ইমাম আবূ হানীফার রচিত বলে প্রচারিত। এগুলোর মধ্যে সর্বশেষ পুস্তিকা দুটোর কোনো সনদ পাওয়া যায় না। পূর্ববর্তী কোনো গবেষক, ঐতিহাসিক বা জীবনীকারও এগুলোর কোনোরূপ উল্লেখ করেন নি। এগুলোর প্রাচীন কোনো পান্ডুলিপিও পাওয়া যায় না। এজন্য এ পুস্তিকাদ্বয় বিগত কয়েক শতকের মধ্যে কেউ রচনা করে ইমাম আযমের নামে জালিয়াতি করে প্রচার করেছেন বলে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়। এছাড়া পুস্তিকা দুটোর বিষয়বস্ত্ত, ভাষা ও পরিভাষাও জালিয়াতি নিশ্চিত করে।[1] অবশিষ্ট ৫টি পুস্তিকার সনদ আমরা এখানে উল্লেখ করছি।
(১) আল-ফিকহুল আকবার (শ্রেষ্ঠ ফিকহ)
মদীনা মুনাওয়ারার সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন গ্রন্থাগার ও প্রাচীন পান্ডুলিপির সংরক্ষণাগার ‘শাইখুল ইসলাম আরিফ হিকমাত-এর লাইব্রেরি’তে বিদ্যমান এ গ্রন্থটির প্রাচীন পান্ডুলিপির (নং ২৩৪) সনদ নিম্নরূপ: পুস্তিকাটি শুনেছেন ও বর্ণনা করেছেন প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ নাসীর ইবন ইয়াহইয়া বালখী (২৬৮ হি) প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ মুহাম্মাদ ইবন মুকাতিল রাযী (২৪৮ হি) থেকে, তিনি প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হানাফী ফকীহ ইসাম ইবন ইউসূফ বালখী (২১৫ হি) থেকে, তিনি ইমাম আবূ হানীফার পুত্র প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম হাম্মাদ ইবন আবী হানীফা (১৭৬ হি) থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে।[2]
(২) আল-ফিকহুল আবসাত (বিস্তারিত ফিকহ)
এ গ্রন্থটি মূলত ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাষ্য। গ্রন্থটির সংকলক ইমাম আবূ হানীফার ছাত্র ইমাম আবূ মুতী বালখী হাকাম ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুসলিম খুরাসানী (১৯৯ হি)। তিনি ইমাম আবূ হানীফাকে আকীদা বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করেন। এ সকল প্রশ্ন ও উত্তরের সংকলন এ গ্রন্থটি। অনেকেই এ পুস্তিকাটিকে ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ নামে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী অনুচ্ছেদে আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করব।
ইমাম আবূ মুতী বালখী অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ফকীহ ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন বিচারক বা কাযীর দায়িত্ব পালন করেন। ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধে তিনি আপোষহীন ছিলেন। ইমাম যাহাবী ও ইবন হাজার উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর ইলমের প্রশস্ততা এবং তাঁর অতুলনীয় দীনদারীর কারণে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক তাঁকে অত্যন্ত সম্মান ও ভক্তি করতেন। তবে তিনি মুতাযিলী ও মুরজিয়া মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং হাদীস বর্ণনায় দুর্বল ছিলেন বলে ইমাম আহমদ, বুখারী, আবূ দাউদ, আবূ হাতিম রাযী, নাসাঈ, ইবন হিব্বান, ইবন আদী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহই ভাল জানেন।[3]
মিসরের প্রাচীন রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগার ‘‘দারুল কুতুব’’-এ বিদ্যমান এ গ্রন্থের পান্ডুলিপির (নং ২১৫-৬৪) সনদ নিম্নরূপ। গ্রন্থটি বর্ণনা করেছেন হানাফী ফিকহের সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ বাদাইউস সানাই-এর প্রণেতা শাইখ আবূ বকর আলাউদ্দীন কাসানী (৫৮৭হি), তিনি তাঁর শ্বশুর সুপ্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আলাউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবন আহমদ সামারকান্দী থেকে, তিনি আবুল মুয়ীন মাইমূন ইবন মুহাম্মাদ নাসাফী (৫০৮ হি) থেকে, তিনি প্রসিদ্ধ ওয়ায়িয ও মুহাদ্দিস আবূ আব্দুল্লাহ হুসাইন ইবন আলী ফাদল (৪৮৪ হি) থেকে, তিনি আবূ মালিক নুসরান ইবন নাসর খাতালী থেকে, তিনি আবুল হাসান আলী ইবন আহমদ ফারিস থেকে, তিনি নাসীর ইবন ইয়াহইয়া (২৬৮ হি) থেকে, তিনি আবূ মুতী বালখী থেকে, তিনি ইমাম আবূ হানীফা থেকে।[4]
(৩) আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম (জ্ঞানী ও শিক্ষার্থী)
এ গ্রন্থের বিষয়বস্ত্ত প্রশ্ন ও উত্তর। এ গ্রন্থে ইমাম আবূ মুকাতিল হাফস ইবন সালম সামারকান্দী (২০৮ হি) তাঁর উস্তাদ ইমাম আবূ হানীফাকে আকীদা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন করেছেন এবং তিনি এ সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আবূ মুকাতিল নিজের ভাষায় এ সকল প্রশ্ন ও উত্তর সংকলন করেছেন।
এভাবে আমরা দেখছি যে, গ্রন্থটি ইমাম আবূ হানীফার রচনা নয়, বরং আবূ মুকাতিলের রচনা, যাতে তিনি ইমাম আবূ হানীফার মতামত সংকলন করেছেন, যেমন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান শাইবানী তাঁর আল-মাবসূত গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফার মতামত প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে সংকলন করেছেন। তবে যেহেতু এ গ্রন্থে শুধু তাঁর মত ও কথাই সংকলিত এজন্য গ্রন্থটি তাঁর রচিত বলে উল্লেখ করেছেন অনেক আলিম। অন্যান্য আলিম উল্লেখ করেছেন যে, এ গ্রন্থটির রচয়িতা ইমাম আবূ মুকাতিল।[5]
এ গ্রন্থের সংকলক আবূ মুকাতিল অত্যন্ত প্রসিদ্ধ আবিদ, যাহিদ ও দরবেশ ছিলেন। তবে হাদীস, ফিকহ ও ইলমের বর্ণনায় মুহাদ্দিসগণ তাঁকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। অধিকাংশ আবিদ ও যাহিদই অতিরিক্ত ইবাদতের কারণে ইলমী বিষয়ে তত মনোযোগ ও সতর্কতা রাখতে পারতেন না। ওকী ইবনুল জার্রাহ, আব্দুর রাহমান ইবন মাহদী, কুতাইবা ইবন সাঈদ, জূযজানী, হাকিম নাইসাপূরী, আবূ নুআইম ইসপাহানী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাঁকে বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। আবূ ইয়ালা আল-খালীলী তাঁকে সত্যপরায়ণ বলে উল্লেখ করেছেন।[6] ইমাম আবূ হানীফার অন্য ছাত্র প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক বলেন:
خذوا عن أبي مقاتل عبادته وحسبكم
‘‘তোমরা আবূ মুকাতিল থেকে তাঁর ইবাদত-বন্দেগি গ্রহণ করবে এবং তা-ই তোমাদের জন্য যথেষ্ট।’’[7]
এ প্রসঙ্গে ইমাম তিরমিযী বলেন:
أَخْبَرَنِى مُوسَى بْنُ حِزَامٍ قَالَ سَمِعْتُ صَالِحَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ يَقُولُ كُنَّا عِنْدَ أَبِى مُقَاتِلٍ السَّمَرْقَنْدِىِّ فَجَعَلَ يَرْوِى عَنْ عَوْنِ بْنِ أَبِى شَدَّادٍ الأَحَادِيثَ الطِّوَالَ الَّتِى كَانَ يَرْوِى فِى وَصِيَّةِ لُقْمَانَ وَقَتْلِ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ وَمَا أَشْبَهَ هَذِهِ الأَحَادِيثَ فَقَالَ لَهُ ابْنُ أَخِى أَبِى مُقَاتِلٍ يَا عَمِّ لاَ تَقُلْ حَدَّثَنَا عَوْنٌ فَإِنَّكَ لَمْ تَسْمَعْ هَذِهِ الأَشْيَاءَ. قَالَ يَا بُنَىَّ هُوَ كَلاَمٌ حَسَنٌ. وَقَدْ تَكَلَّمَ بَعْضُ أَهْلِ الْحَدِيثِ فِى قَوْمٍ مِنْ جِلَّةِ أَهْلِ الْعِلْمِ وَضَعَّفُوهُمْ مِنْ قِبَلِ حِفْظِهِمْ وَوَثَّقَهُمْ آخَرُونَ مِنَ الأَئِمَّةِ بِجَلاَلَتِهِمْ وَصِدْقِهِمْ وَإِنْ كَانُوا قَدْ وَهِمُوا فِى بَعْضِ مَا رَوَوْا
‘‘আমাদেরকে মূসা ইবন হিযাম (২৫০ হি) বলেছেন, আমি সালিহ ইবন আব্দুল্লাহ (২৩১ হি)-কে বলতে শুনেছি, আমরা আবূ মুকাতিল সামারকান্দীর নিকট ছিলাম। তিনি আওন ইবন আবী শাদ্দাদ থেকে বড় বড় হাদীস বর্ণনা করছিলেন, যে সকল হাদীসে লুকমান হাকীমের ওসীয়ত, সাঈদ ইবন জুবাইরের নিহত হওয়ার ঘটনা ও অনুরূপ বিষয়াদি ছিল। তখন আবূ মুকাতিলের ভাতিজা বলেন: চাচা, আপনি বলেন না যে, আওন আমাদেরকে এ হাদীস বলেছেন; কারণ আপনি তো এ সকল হাদীস তাঁর থেকে শুনেন নি। তখন আবূ মুকাতিল বলেন: বেটা, ‘এ কথাগুলিতো সুন্দর!’ তিরমিযী বলেন, অনেক সুপ্রসিদ্ধ মহান আলিমের বিষয়ে অনেক মুহাদ্দিস আপত্তি প্রকাশ করেছেন এবং তাঁদেরকে দুর্বল বলেছেন তাঁদের স্মৃতিশক্তি ও হাদীস নির্ভুল মুখস্থ রাখার দুর্বলতার কারণে। আবার অনেকে তাঁদেরকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন তাঁদের মর্যাদা ও সত্যবাদিতার কারণে, যদিও তাঁরা তাঁদের বর্ণিত কিছু হাদীসে অসাবধানতা জনিত ভুলভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছেন।’’[8]
ইমাম তিরমিযী সংকলিত এ ঘটনার সনদ সহীহ। এ থেকে আমরা জানতে পারি যে, ইমাম আবূ মুকাতিল বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত অসতর্ক ছিলেন। অন্যান্য অনেক দরবেশের মতই মনে করতেন, কথা যদি ভাল হয় তবে তা কোনো ভাল মানুষের নামে বললে দোষ নেই!! পাশাপাশি ইমাম তিরমিযীর বক্তব্য থেকে বুঝতে পারি যে, ইবন মুকাতিল অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ও মর্যাদাসম্পন্ন আলিম ছিলেন, যারা তাঁর বিষয়ে আপত্তি করেছেন তাঁরা শুধু নির্ভুল বর্ণনায় তাঁর দুর্বলতার কারণেই তা করেছেন। আবার যারা তাঁকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন তারাও তাঁর এ দুর্বলতার বিষয়ে সচেতন। তবে তাঁর মর্যাদা ও মূল সত্যপরায়ণতার কারণে তাঁকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন।
বিভিন্ন পান্ডুলিপিতে গ্রন্থটির একাধিক সনদ পাওয়া যায়। মিসরের দারুল কুতুবে বিদ্যমান পান্ডুলিপির (নং ৩৪১৪৭) সনদ নিম্নরূপ: পুস্তিকাটি বর্ণনা করেছেন শাইখ আবুল হাসান আলী ইবন খলীল দিমাশকী (৬৫১ হি), তিনি আবুল হাসান বুরহানুদ্দীন আলী ইবনুল হাসান বালখী (৫৪৮ হি) থেকে, তিনি আবুল মুয়ীন মাইমূন ইবন মুহাম্মাদ নাসাফী (৫০৮ হি) থেকে, তিনি তাঁর পিতা মুহাম্মাদ নাসাফী থেকে, তিনি আব্দুল কারীম ইবন মূসা বাযদাবী নাসাফী (৩৯০ হি) থেকে, তিনি (মাতুরিদী মতের প্রতিষ্ঠাতা) ইমাম আবূ মানসূর মাতুরীদী (৩৩৩ হি) থেকে, তিনি আবূ বকর আহমদ ইবন ইসহাক জূযজানী থেকে, তিনি ইমাম আবূ ইউসূফের ছাত্র প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ আবূ সুলাইমান মূসা ইবন সুলাইমান জূযজানী থেকে এবং প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবন মুকাতিল রাযী (২৪৮ হি) থেকে, তারা উভয়ে আবূ মূতী হাকাম ইবন আব্দুল্লাহ বালখী (১৯৯ হি) ও আবূ ইসমাহ ইসাম ইবন ইউসুফ বালখী (২১৫ হি) থেকে তাঁরা উভয়ে আবূ মুকাতিল সামারকান্দী থেকে, ইমাম আবূ হানীফা থেকে।[9]
(৪) আর-রিসালাহ বা উসমান বাত্তীকে লেখা পত্র
ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক বসরার সুপ্রসিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী, মুহাদ্দিস, কিয়াসপন্থী ফকীহ ও বিচারক ছিলেন আবূ আমর উসমান ইবন মুসলিম আল-বাত্তী (১৪৩ হি)। তিনি মূলত কূফার অধিবাসী ছিলেন, পরে বসরায় বসবাস করেন। বাত্তী শুনেন যে, ইমাম আবূ হানীফা মুরজিয়া মতবাদ গ্রহণ করেছেন। তিনি এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ইমাম আবূ হানীফাকে পত্র লিখেন। এ পত্রের উত্তরে ইমাম আবূ হানীফা তাঁর মত ব্যাখ্যা করে ও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ খন্ডন করে এ পত্রটি তাকে লিখে পাঠান।
মদীনা মুনাওয়ারার ‘‘আরিফ হিকমাত লাইব্রেরি’’-তে সংরক্ষিত এ পুস্তিকার পান্ডুলিপির (নং ২৩৪) সনদ নিম্নরূপ: পত্রটি বর্ণনা করেছেন হুসামুদ্দীন হুসাইন ইবন আলী সিগনাকী (৭১০ হি), তিনি হাফিযুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন নাসর বুখারী (৬৯৩ হি) থেকে, তিনি শামসুল আয়িম্মাহ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুস সাত্তার কারদারী (৬৪২ হি) থেকে, তিনি (হেদায়ার প্রণেতা) আল্লামা বুরহানুদ্দীন আলী ইবন আবী বাকর মারগীনানী (৫৯৩ হি) থেকে, তিনি যিয়াউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন ইয়ারসূখী (৫৪৫ হি) থেকে, তিনি আলাউদ্দীন আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবন আহমদ সামারকান্দী (৫৩৯ হি) থেকে, তিনি আবুল মুয়ীন মাইমূন ইবন মুহাম্মাদ নাসাফী (৫০৮ হি) থেকে, তিনি আবূ যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবন মুতরিফ বালখী থেকে, তিনি আবূ সালিহ মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন সামারকান্দী থেকে, তিনি আবূ সাঈদ সা’দান ইবন মুহাম্মাদ ইবন বাকর বুসতী থেকে, তিনি আবুল হাসান আলী ইবন আহমদ ফারিস থেকে, তিনি নাসীর ইবন ইয়াহইয়া (২৬৮ হি) থেকে, তিনি মুহাম্মাদ ইবন সামাআহ তামীমী (২৩৩ হি) থেকে তিনি ইমাম আবূ ইউসূফ (১৮২ হি) থেকে, তিনি ইমাম আবূ হানীফা থেকে।’’[10]
(৫) ওসিয়্যাহ
এ পুস্তিকাটিতে ঈমান-আকীদা বিষয়ে ইমাম আযমের কিছু ‘ওসিয়ত’ সংকলিত। মদীনা মুনাওয়ারার ‘‘শাইখুল ইসলাম আরিফ হিকমাত লাইব্রেরি’’-তে সংরক্ষিত এ পুস্তিকার পান্ডুলিপির (নং ২৩৪) সনদ নিম্নরূপ:
ওসিয়্যাতটি বর্ণনা করেছেন হুসামুদ্দীন হুসাইন ইবন আলী সিগনাকী (৭১০ হি), তিনি হাফিযুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন নাসর বুখারী (৬৯৩ হি), তিনি শামসুল আয়িম্মাহ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুস সাত্তার কারদারী (৬৪২ হি) থেকে, তিনি হেদায়ার প্রণেতা আল্লামা বুরহানুদ্দীন আলী ইবন আবী বাকর মারগীনানী (৫৯৩ হি) থেকে, তিনি যিয়াউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন নূসূখী (৫৪৫ হি) থেকে, তিনি আলাউদ্দীন আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবন আহমদ সামারকান্দী (৫৩৯ হি), তিনি আবুল মুয়ীন মাইমূন ইবন মুহাম্মাদ নাসাফী (৫০৮ হি) থেকে, তিনি ইমাম আবূ তাহির মুহাম্মাদ ইবনুল মাহদী হুসাইনী থেকে, তিনি ইসহাক ইবন মানসূর আল-মিসইয়ারী থেকে, তিনি আহমদ ইবন আলী সুলাইমানী থেকে তিনি হাতিম ইবন আকীল জাওহারী থেকে, তিনি আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবন সামাআহ তামীমী (২৩৩ হি) থেকে, তিনি ইমাম আবূ ইউসূফ ইয়াকূব ইবন ইবরাহীম (১৮২ হি) থেকে, তিনি ইমাম আবূ হানীফা থেকে।’’[11]
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখছি যে, ইমাম আবূ হানীফা রচিত তিনটি পুস্তকের কথা তৃতীয়-চতুর্থ শতক থেকেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। পরবর্তীকালে আরো কয়েকটি পুস্তিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ গ্রন্থটির কথা অনেক প্রাচীন আলিম উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থটির সনদ বিদ্যমান এবং বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে গ্রন্থটির অনেক প্রাচীন পান্ডুলিপি বিদ্যমান।
৬. আল-ফিকহুল আকবার ও আবসাত
আমরা দেখছি যে, ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থটির দুটি ভাষ্য বিদ্যমান: একটি তাঁর পুত্র হাম্মাদের সূত্রে বর্ণিত এবং অন্যটি তাঁর ছাত্র আবূ মুতী বালখীর সূত্রে বর্ণিত এবং ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ নামে প্রসিদ্ধ। পুস্তিকা দুটির সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:
(১) আল-ফিকহুল আবসাত পুস্তিকাটি আকারে আল-ফিকহুল আকবার-এর প্রায় তিনগুণ। আল্লামা মুহাম্মাদ যাহিদ কাওসারীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘আল-ফিকহুল আবসাত’-এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৮ এবং ‘আল-ফিকহুল আকবারের’ পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬।
(২) আল-ফিকহুল আবসাতে মূলত দুটি বিষয় অতি বিশদ ও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে: (১) ঈমানের পরিচয়, সংজ্ঞা, ঈমান ও আমালের সম্পর্ক, খারিজী-মুরজিয়া প্রান্তিকতা, তাকফির বা মুমিনকে কাফির বলা এবং (২) তাকদীর প্রসঙ্গ। এর মধ্যে আকীদার আরো কিছু বিষয়, যেমন: সাহাবীগণের ভালবাসা, জালিম সরকারের আনুগত্য, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, উম্মাতের বিভক্তি, বিদআত, মহান আল্লাহর আরশে অধিষ্ঠান ও ঊর্ধ্বত্ব, মহান আল্লাহর বিশেষণ ইত্যাদি বিষয় প্রসঙ্গত উল্লেখ করা হয়েছে। এর বিপরীতে আল-ফিকহুল আকবারে উপরের বিষয়গুলো ছাড়াও তাওহীদ, শিরক, আরকানুল ঈমান, নবীগণের নিষ্পাপত্ব, পাপীর ইমামত্ব, নেক আমল কবুলের শর্ত ও বিনষ্টের কারণাদি, মুজিযা-কারামত, মিরাজ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- আত্মীয়-স্বজন, কবরের অবস্থা, কিয়ামতের আলামত, আখিরাতে আল্লাহর দর্শন, শাফাআত, মীযান, হাউয ইত্যাদি আরো অনেক বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। ফিকহুল আবসাতের মূল বিষয়দুটো তুলনামূলক সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে এবং মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
(৩) ‘আল-ফিকহুল আকবার’-এ আকীদার বিষয়গুলো সংক্ষেপে সহজবোধ্য ভাষায় আলোচনা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে ‘আল-ফিকহুল আবসাত’-এ ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে কথোপকথনের মাধ্যমে দীর্ঘ ও জটিল যুক্তিতর্ক পেশ করা হয়েছে।
এভাবে আমরা দেখছি যে, পুস্তিকা দুটোর বিষয়বস্ত্ত মূলত এক। এখন প্রশ্ন হলো কোন্টি মূল ‘ফিকহুল আকবার’? কোনো কোনো গবেষক মত প্রকাশ করেছেন যে, ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ গ্রন্থটিই মূল ‘আল-ফিকহুল আকবার’। তাঁদের যুক্তি নিম্নরূপ:
(ক) চতুর্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ইমাম আবুল লাইস সামারকান্দী নাসর ইবন মুহাম্মাদ (৩৭৩ হি) ‘আল-ফিকহুল আকবার’ বলতে আবূ মুতীর সূত্রে বর্ণিত পুস্তিকাটি বুঝিয়েছেন এবং পুস্তিকাটির ব্যাখ্যা রচনা করেন।[12]
(খ) আমরা দেখেছি পঞ্চম হিজরী শতকে আল্লামা আবুল মুযাফ্ফার শাহফূর (৪৭১ হি) উল্লেখ করেছেন যে, আল-ফিকহুল আকবার গ্রন্থটি আবূ মুতীর সূত্রে বর্ণিত। অষ্টম শতকে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া (৭২৮ হি) ও অন্যান্য আলিম ‘আল-ফিকহুল আকবার’ বলতে আবূ মুতীর সূত্রে বর্ণিত পুস্তিকাটিই বুঝিয়েছেন।[13]
আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, ‘আল-ফিকহুল আকবার’ নামে প্রসিদ্ধ পুস্তিকাটিও পূর্ববর্তীদের নিকট প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:
(ক) ইমাম তাহাবী (২৩৮-৩২১ হি) রচিত ‘আকীদাহ তাহাবিয়্যাহ’ পুস্তিকার বিষয়বস্ত্ত, বক্তব্য ও উপস্থাপনার সাথে ইমাম হাম্মাদের সূত্রে বর্ণিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’ নামে প্রসিদ্ধ গ্রন্থটির অনেক মিল রয়েছে। ইমাম তাহাবী উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদ্বয়ের আকীদা বর্ণনায় তিনি পুস্তিকাটি রচনা করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা রচিত আকীদা বিষয়ক পুস্তিকাগুলোর মধ্য থেকে হাম্মাদ বর্ণিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’-এর সাথেই তাহাবীর পুস্তিকাটির বিষয় ও উপস্থাপনার সর্বোচ্চ মিল রয়েছে। এছাড়া ইমাম তাহাবী আকীদা বিষয়ক এমন কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন যা ইমাম হাম্মাদ বর্ণিত পুস্তিকা ছাড়া ইমাম আযমের অন্য কোনো পুস্তিকায় নেই। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম তাহাবী এ গ্রন্থটির উপর নির্ভর করেছিলেন।
(খ) আমরা দেখেছি যে, ইমাম বাযদাবী (৪০০-৪৮২ হি) বলেছেন, ইমাম আবূ হানীফা তাঁর আল-ফিকহুল আকবার গ্রন্থে ‘মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো প্রমাণ করেছেন’। এতে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি হাম্মাদ ইবন আবী হানীফার সূত্রে বর্ণিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’ নামে প্রসিদ্ধ পুস্তিকাটিই বুঝাচ্ছেন। এ পুস্তিকাতেই ইমাম আযম বিশেষণ প্রসঙ্গ ও তাকদীর প্রসঙ্গ সমান গুরুত্ব দিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পক্ষান্তরে আল-ফিকহুল আবসাত পুস্তিকায় তাকদীর ও ঈমান প্রসঙ্গ অতি বিশদভাবে আলোচনা করলেও বিশেষণ বিষয়ে অতি-সংক্ষেপ কিছু কথা বলেছেন।
(গ) অষ্টম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ও আকীদাবিদ ইবন আবিল ইজ্জ হানাফী (৭৯২ হি) ‘‘শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ’’ গ্রন্থে বিভিন্ন স্থানে ‘ইমাম আবূ হানীফা রচিত আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। এ উদ্ধৃতিগুলো হাম্মাদের সূত্রে বর্ণিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থে হুবহু বিদ্যমান।[14]
(ঘ) দশম-একাদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ শাইখ আহমদ ইবন মুহাম্মাদ মাগনীসাবী (১০০০ হি) এবং মোল্লা আলী ইবন সুলতান কারী হানাফী (১০১৪ হি) হাম্মাদ-এর সূত্রে বর্ণিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা রচনা করেছেন। গ্রন্থদুটো মুদ্রিত।
(ঙ) আমরা দেখছি যে, গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপিগুলোর সনদ বিদ্যমান। বিষয়বস্ত্তর দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখি যে, ইমাম আবূ হানীফা রচিত আকীদা বিষয়ক অন্য চারটি পুস্তিকার সকল বিষয় এ পুস্তিকায় সন্নিবেশিত। এজন্য সনদ ও মতনের দিক থেকে পুস্তিকাটি ইমাম আবূ হানীফা রচিত বলে জানা যায়।
বাহ্যত প্রতীয়মান হয় যে, দুটো পুস্তিকা-ই ‘আল-ফিকহুল আকবার’। পুস্তিকাদুটো একই গ্রন্থের দুটি ভাষ্য (version)। আমরা দেখেছি, সে সময়ের প্রসিদ্ধ আলিমগণ তাঁদের সংকলিত বিষয়গুলো বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদেরকে পড়ে শুনাতেন বা লেখাতেন। এতে বিষয়বস্ত্ত এবং বিন্যাসের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম হতো। এজন্য ইমাম মালিকের ‘মুআত্তা’-র কয়েক ডজন ভাষ্য এবং ইমাম আবূ হানীফার ‘কিতাবুল আসার’-এর কয়েকটি ভাষ্যের ন্যায় ‘আল-ফিকহুল আকবার’-এরও দুটি ভাষ্য রয়েছে।
ইমাম হাম্মাদের সূত্রে বর্ণিত ও ‘আল-ফিকহুল আকবার’ নামে পরিচিত গ্রন্থটিতে সহজ সরল ভাষায় আকীদার মূল বিষয়গুলি সংকলিত। বাহ্যত তা ইমামের নিজের লেখা বা তাঁর মুখের বক্তব্যের সংকলন। আর দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে ইমাম আবূ মুতী ইমাম আবূ হানীফার মত ও বক্তব্য নিজের পদ্ধতিতে সংকলন করেন। অর্থাৎ দ্বিতীয় গ্রন্থটির লেখক ও সংকলক ইমাম আবূ মুতী, তবে এর বিষয়বস্ত্ত ইমাম আবূ হানীফার বক্তব্য। সম্ভবত এজন্য ইমাম যাহাবী, আব্দুল হাই লাখনবী প্রমুখ আলিম ইমাম আবূ মুতী বালখীকেই ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের রচয়িতা বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা আল-ফিকহুল আকবারের দ্বিতীয় ভাষ্য বা ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ বুঝিয়েছেন।[15]
উপরে আমরা আল-ফিকহুল আকবারের কয়েকজন ব্যাখ্যাকারের নাম উল্লেখ করেছি। আরো অনেকেই পুস্তিকাটির ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:
(১) আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ বাবরতী (৭৮৬ হি)[16]
(২) শাইখ ইলইয়াস ইবন ইবরাহীম সীনূবী তুর্কী (৮৯১ হি)[17]
(৩) মুহাম্মাদ ইবন বাহাউদ্দীন যাদাহ রাহমাবী (৯৫২ হি)[18]
(৪) শাইখ মুহিউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবন লুৎফুল্লাহ বীরামী (৯৫৬ হি)[19]
(৫) শাইখ নূরুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ শারওয়ানী (১০৬৫ হি)[20]
বিগত কয়েক শতকে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক আলিম গ্রন্থটির ব্যাখ্যা রচনা করেছেন।
[2] ড. খুমাইয়িস, উসূলুদ্দীন ইনদাল ইমাম আবী হানীফাহ, পৃ. ১১৭-১১৮।
[3] ইবন মায়ীন, আত-তারীখ ৪/৩৫৬; নাসাঈ, আদ-দুআফা ওয়াল মাতরূকীন, পৃ. ২৫৯; ইবন হিব্বান, আল-মাজরূহীন ১/২৫০; ইবন আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তাদীল ৩/১২২; ইবন আদী, আল-কামিল ২/৬৩১; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৫৭৪; ইবন হাজার, লিসানুল মীযান ২/৩৩৪; কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ ২/২৬৫-২৬৬।
[4] মুহাম্মাদ যাহিদ কাওসারী, আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ৬; ড. খুমাইয়িস, উসূলুদ্দীন, পৃ. ১২০-১২২।
[5] ইবন হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ২/৩২৩।
[6] হাকিম, আল-মাদখাল ইলাস সহীহ, পৃ. ১৩০-১৩১; নাসাঈ, আদ-দুআফা, পৃ. ৫৭; ইবন হিব্বান, আল-মাজরূহীন ১/২৫৬; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৫৫৭-৫৫৮; ইবন হাজার, লিসানুল মীযান ২/৩২২-৩২৩; খালীলী, আল-ইরশাদ ৩/৯৭৫।
[7] ইবন হিব্বান, আল-মাজরূহীন ১/২৫৬।
[8] তিরমিযী, আস-সুনান (শামিলা: মুকান্নায) ১৪/১৪৯; আল-ইলালুস সাগীব, পৃষ্ঠা ৭৩৯-৭৪০।
[9] মুহাম্মাদ যাহিদ কাওসারী, আল-আলিম ওয়াল মুতাআলিস্নম গ্রন্থের ভূমিকা, পৃষ্ঠা ৪-৫।
[10] ড. খুমাইয়িস, উসূলুদ্দীন, পৃ. ১৩৫-১৩৮।
[11] ড. খুমাইয়িস, উসূলুদ্দীন, পৃ. ১৩৮-১৪০।
[12] আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম-এর ভূমিকায় আল্লামা যাহিদ কাওসারীর আলোচনা, পৃ ৪।
[13] ইবন তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া ৫/৪৬, ৪৭, ১৪০, ১৮৩।
[14] ইবন আবিল ইজ্জ, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১১৭, ১৭৬-১৭৭, ২১৯।
[15] যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ১৩/১৫৮; আল-ইবার ১/২৫৭-২৫৮; লাখনবী, আল-ফাওয়াইদুল বাহিয়্যাহ, পৃ. ৬৮।
[16] যিরকলী, আল-আলাম ৭/৪২।
[17] যিরকলী, আল-আ’লাম ২/৮।
[18] যিরকলী, আল-আ’লাম ৬/৬০; কাহ্হালাহ, মু’জামুল মুআল্লিফীন ৯/১২০।
[19] ইসমাঈল পাশা, ঈদাহুল মাকনূন ২/২৫০।
[20] যিরকলী, আল-আ’লাম ৮/৫৩।