ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফার রচনাবলি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
৩. ঐতিহাসিক ও জীবনীকারগণের বক্তব্য

চতুর্থ শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আবুল লাইস সামারকান্দী নাসর ইবন মুহাম্মাদ (৩৭৩ হি) ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা করেছেন।[1] উপরন্তু গ্রন্থটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে বলে ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন।[2] এতে প্রমাণ হয় যে, ইমাম আযমের ওফাতের পরের শতকেই তাঁর এ গ্রন্থটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।

৪র্থ-৫ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবন নাদীম মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (৪৩৮ হি) ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে বলেন:


وله من الكتب كتاب الفقه الأكبر، كتاب رسالته الى البتي، كتاب العالم والمتعلم رواه عنه مقاتل، كتاب الرد على القدرية


তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: (১) আল ফিকহুল আকবার, (২) উসমান আল-বাত্তীকে লেখা চিঠি, (৩) আল-আলিম ওয়াল-মুতায়াল্লিম, গ্রন্থটি মুকাতিল তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন, (৪) আর-রাদ্দ আ’লাল-কাদারিয়াহ।’’[3]

পঞ্চম হিজরী শতকের সুপ্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ও আকীদাবিদ ইমাম বাযদাবী আলী ইবন মুহাম্মাদ ইবন হুসাইন (৪০০-৪৮২ হি) বলেন:


العلم نوعان علم التوحيد والصفات وعلم الشرايع والأحكام والأصل في النوع الأول هو التمسك بالكتاب والسنة ومجانبة الهوى والبدعة ولزوم طريق السنة والجماعة الذي كان عليه الصحابة والتابعون ... وكان على ذلك سلفنا أعني أبا حنيفة وأبا يوسف ومحمد أو عامة أصحابهم رحمهم الله وقد صنف أبو حنيفة رضي الله عنه في ذلك كتاب الفقه الأكبر وذكر فيه إثبات الصفات وإثبات تقدير الخير والشر من الله وأن ذلك كله بمشيئته ... وصنف كتاب العالم والمتعلم وكتاب الرسالة... وكان في علم الأصول إماما صادقا ... ودلت المسائل المتفرقة عن أصحابنا في المبسوط وغير المبسوط على أنهم لم يميلوا إلى شيء من مذاهب الاعتزال وإلى سائر الأهواء


‘‘ইলম দু প্রকার: (১) আল্লাহর একত্ব ও বিশেষণের ইলম এবং (২) শরীয়ত ও আহকামের ইলম। প্রথম প্রকারের ইলমের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো কুরআন ও সুন্নাত সুদৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরে থাকতে হবে, যুক্তি-মর্জি নির্ভর মত ও বিদআত বর্জন করতে হবে এবং আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতের উপরে, যে মতের উপরে সাহাবীগণ ও তাবিয়ীগণ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন সে মতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। .... আমাদের পূর্ববর্তীগণ, অর্থাৎ আবূ হানীফা, আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ ও তাঁদের অধিকাংশ ছাত্রই এ মতের উপরেই ছিলেন (রাহিমাহুমুল্লাহ)। আবূ হানীফা (রহ.) এ বিষয়ে ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি বিশেষণগুলো প্রমাণ ও স্বীকার করার কথা উল্লেখ করেছেন এবং ভালমন্দ তাকদীর আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে প্রমাণ ও স্বীকার করার কথা লিখেছেন। এগুলো সবই মহান আল্লাহর ইচ্ছায়...। এবং তিনি ‘‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিাম’’ গ্রন্থ রচনা করেছেন। এবং তিনি (বাত্তীকে পাঠানো) চিঠি লিখেছেন ....। তিনি দীনের মূলনীতির (আকীদার) বিষয়ে সত্যপরায়ণ ইমাম ছিলেন।... আমাদের সাথীগণ থেকে বর্ণিত বিস্তারিত ও সংক্ষিপ্ত সকল তথ্য প্রমাণ করে যে, তাঁরা মুতাযিলী মত বা অন্য কোনো বিদআতী মতের দিকে কোনোরূপ আকৃষ্ট হন নি।’’[4]

পঞ্চম হিজরী শতকের শাফিয়ী ফকীহ আল্লামা আবুল মুযাফ্ফার তাহির ইবন মুহাম্মাদ ইসফিরাঈনী শাহফূর (৪৭১ হি) লিখেছেন:


ومن أراد أن يتحقق أن لا خلاف بين الفريقين في هذه الجملة فلينظر فيما صنفه أبو حنيفة رحمه الله في الكلام وهو كتاب العلم ... وكتاب الفقه الأكبر الذي أخبرنا به الثقة بطريق معتمد وإسناد صحيح عن نصير بن يحيى عن أبي مطيع عن أبي حنيفة وما جمعه أبو حنيفة في الوصية التي كتبها إلى أبي عمرو عثمان البتي ...


‘‘(আকীদা বিষয়ে) হানাফী-শাফিয়ী মতভেদ না থাকার বিষয়টি যদি কেউ নিশ্চিত হতে চায় তবে সে যেন আবূ হানীফা (রাহ) রচিত ইলমুল কালাম বিষয়ক গ্রন্থ অধ্যয়ন করে। তা হলো ‘কিতাবুল ইলম’ (কিতাবুল আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম)। এবং ‘আল-ফিকহুল আকবার’ নামক গ্রন্থও অধ্যয়ন করুক, যে গ্রন্থটি আমাকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য সূত্রে ও সহীহ সনদে নাসীর ইবন ইয়াহইয়া থেকে আবূ মুতী থেকে আবূ হানীফা থেকে বর্ণনা করে শুনিয়েছেন। এছাড়া আবূ হানীফা আবূ আমর উসমান আল-বাত্তীকে (১৪৩হি) পাঠানো পত্রে যা লিখেছেন তাও অধ্যয়ন করুক।’’[5]

শাইখুল ইসলাম তাকিউদ্দীন ইবন তাইমিয়া (৬৬১-৭২৮ হি) বলেন:


فإن أبا حنيفة ... كلامه في الرد على القدرية معروف في الفقه الأكبر وقد بسط الحجج في الرد عليهم بما لم يبسطه على غيرهم في هذا الكتاب


‘‘কাদারিয়া মতের বিরুদ্ধে ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থে আবূ হানীফার বক্তব্য সুপরিচিত। এ গ্রন্থে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যত বিস্তারিত আলোচনা করেছেন অন্য কোনো ফিরকার বিরুদ্ধে তত আলোচনা করেন নি।’’[6]

প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম ইবন জামাআহ (৩৩হি) বলেন:


فإن أبا حنيفة له كتاب في الرد على القدرية سماه الفقه الأكبر


‘‘আবূ হানীফা কাদারিয়া মতবাদ খন্ডনে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম দিয়েছিলেন: ‘আল-ফিকহুল আকবার’।’’[7]

এভাবে আমরা দেখলাম যে, হিজরী ৪র্থ শতক থেকে আলিমগণ ইমাম আবূ হানীফা রচিত তিনটি বা চারটি পুস্তিকার কথা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগগুলোতে কয়েকজন আলিম ইমাম আবূ হানীফার লেখা আরো কয়েকটি পুস্তিকার কথা উল্লেখ করেছেন। অষ্টম হিজরী শতকে আল্লামা আব্দুল কাদির ইবন আবিল ওয়াফা (৭৭৫ হি) ইমাম আযমের রচনাবলি প্রসঙ্গে বলেন:


ومن تصانيفه وصاياه لأصحابه


‘‘তাঁর গ্রন্থাদির মধ্যে রয়েছে ‘তাঁর সাথীদের জন্য তাঁর ওসিয়্যাত’।[8]

এ শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ বাবরতী (৭৮৬ হি) ‘‘শারহু ওয়াসিয়্যাতিল ইমাম আবী হানীফাহ’ নামে এ পুস্তিকাটির ব্যাখ্যা লিখেন।[9] কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন যে, এ পুস্তিকাটি তাঁর পুত্র হাম্মাদ-এর রচিত।[10]

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আহমদ ইবন হাসান আল-বায়াদী (১০৯৮ হি), মুহাম্মাদ মুরতাদা যাবীদী (১২০৫ হি), আল্লামা মুহাম্মাদ যাহিদ কাওসারী (১৩৭১/১৯৫২) ও অন্যান্য আলিম ইমাম আযমের রচনাবলির মধ্যে ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ নামক গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন।[11]

ত্রয়োদশ হিজরী শতকে (ঊনবিংশ খৃস্টীয় শতকে) তুরস্ক ও ভারতে ইমাম আবূ হানীফার নামে ‘‘আল-কাসীদাহ আন-নুমানিয়্যাহ’ বা ‘আল-কাসীদাহ আল-কাফিয়্যাহ’ নামে আরেকটি কাব্য-পুস্তিকা প্রকাশ পায়। তুরস্ক ও ভারতে কোনো কোনো আলিম এর অনুবাদও করেন। এদের মধ্যে প্রাচীনতম যাকে জানা যায় তিনি তুরস্কের শাইখ ইবরাহীম খালীল ইবন আহমদ রূমী হানাফী (১২৭০ হি/১৮৫৪খৃ)।[12] বিগত শতকে ‘‘আল-মাকসূদ ফিস সারফ’’ নামে আরবী শব্দতত্ত্ব বিষয়ক একটি পুস্তিকা ইমাম আযমের লিখিত বলে প্রচারিত হয়েছে।

[1] আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম-এর ভূমিকায় আল্লামা যাহিদ কাওসারীর আলোচনা, পৃ ৪।

[2] আবূ মানসূর মাতুরিদী (আবুল্লাইস সামারকান্দী), শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ২।

[3] ইবন নাদীম, আল-ফিহরিস্ত, পৃ. ২৮৫।

[4] বাযদাবী, উসূলুল বাযদাবী ১/৩-৪।

[5] শাহফূর আবুল মুযাফ্ফার ইসফিরাঈনী, আত-তাবসীর ফিদ্দীন. পৃ ১৮৪।

[6] ইবন তাইমিয়া, মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ ৩/৮৩।

[7] ইবন জামাআহ, ঈদাহুদ দালীল, পৃ. ২২।

[8] কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ (শামিলা: মীর কুতুবখানা, করাচী) ২/৪৬১।

[9] যিরকলী, আল-আলাম ৭/৪২।

[10] ইলইয়াস সারকীস, মু’জামুল মাতবূআত ১/৩০৩।

[11] আল-বায়াদী, ইশারাতুল মারাম, পৃ. ২৮; যাবীদী, ইতহাফিস সাদাতিল মুত্তাকীন ২/১৪; ড. খুমাইয়িস, উসূলুদ্দীন ইনদাই ইমাম আবী হানীফাহ, পৃ. ১১৯।

[12] ইসমাঈল পাশা, ঈদাহুল মাকনূন ২/১৪; কাহ্হালাহ, মু’জামুল মুআল্লিফীন ১/৩০।