লগইন করুন
এভাবে আমরা দেখছি যে, চতুর্থ শতক থেকে আলিমগণ ইমাম আবূ হানীফা রচিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’ ও কয়েকটি পুস্তিকার কথা উল্লেখ করেছেন। উপরন্তু তাঁরা বারবার বলেছেন যে, তাঁরা এগুলো সহীহ সনদের বর্ণনার মাধ্যমে গ্রহণ ও অধ্যয়ন করেছেন। কিন্তু তারপরও এগুলো নিয়ে আপত্তি বা সন্দেহের কারণ কী?
ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর শুরু থেকে মুতাযিলী শাসনের প্রেক্ষাপটে অনেক হানাফী ফকীহ মুতাযিলী মত গ্রহণ করেন বা মুতাযিলীদের সাথে মিলে মিশে চলতে থাকেন। তৃতীয় হিজরী শতক থেকে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ইরাক, ইরান ও মধ্য এশিয়ার অনেকে ফিকহী বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফার মত অনুসরণ করলেও আকীদার বিষয়ে মুতাযিলী-কাদারিয়া মত অনুসরণ করতেন। আল্লামা জারুল্লাহ যামাখশারী (৫৩৮ হি)-র কথা আমরা অনেকেই জানি। তিনি মুতাযিলী মতবাদের একজন গোঁড়া অনুসারী ও প্রচারক ছিলেন। কিন্তু ফিকহী বিষয়ে তিনি হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং হানাফী ফিকহ বিষয়ে তাঁর রচিত একাধিক গ্রন্থ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এসকল মুতাযিলী-কাদারী হানাফীগণ ইমাম আবূ হানীফাকেও মুতাযিলী-কাদারিয়া মতাবলম্বী বলে মনে করতেন বা চিত্রিত করার চেষ্টা করতেন। তাদের মতের পক্ষে অনেক বক্তব্য ও গল্প তারা ইমাম আবূ হানীফার নামে প্রচার করতেন। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলো সবই আকীদা বিষয়ক এবং মুতাযিলী-কাদারিয়া আকীদার বিরোধী। এজন্য এ গ্রন্থগুলোকে তারা বিভিন্নভাবে চোখের আড়াল রাখতে চেষ্টা করতেন। এগুলো ইমামের রচিত নয় বলে প্রচার করতেন। কখনো বা ব্যাখ্যার নামে এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বক্তব্য ঢুকিয়েছেন। যে কারণে গ্রন্থগুলোর ব্যাপক প্রচার ব্যাহত হয়েছে এবং এ বিষয়ে নানা বিতর্ক ও সন্দেহ প্রচারিত হয়েছে।
আমরা দেখেছি, ইমাম বাযদাবী এরূপ প্রচারণা খন্ডন করে বলেছেন যে, ইমাম আযম মুতাযিলী বা কাদারী ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে অষ্টম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা আব্দুল কাদির ইবন আবিল ওয়াফা কুরাশী (৬৯৬-৭৭৫ হি) বলেন:
قال الكردري: فإن قلت ليس لأبي حنيفة كتاب مصنف قلت هذا كلام المعتزلة... وغرضهم بذلك نفي أن يكون الفقه الأكبر وكتاب العالم والمتعلم له لأنه صرح فيه بأكثر قواعد أهل السنة والجماعة ودعواهم أنه كان من المعتزلة وذلك الكتاب لأبي حنيفة البخاري وهذا غلط صريح فإني رأيت بخط العلامة مولانا شمس الملة والدين الكردري البزاتقني العمادي هذين الكتابين وكتب فيهما أنهما لأبي حنيفة وقال تواطأ على ذلك جماعة كثير من المشائخ ...
কারদারী[1] বলেন: ‘‘আপনি যদি বলেন যে, ‘আবূ হানীফা কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি’, তবে আমি বলব যে, এ মু’তাযিলীদের কথা। ... তাদের উদ্দেশ্য হলো, আল-ফিকহুল আকবার এবং আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম গ্রন্থদ্বয় তাঁর রচিত নয় বলে দাবি করা। কারণ ইমাম এ দুটো গ্রন্থে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অধিকাংশ মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। মুতাযিলীরা দাবি করে যে, ইমাম আবূ হানিফা মুতাযিলী ছিলেন। তারা বলে, ‘আল-ফিকহুল আকবার’ আবূ হানীফা আল-বুখারী নামক একব্যক্তির লেখা। এ কথাটি সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি। কারণ মাওলানা শামসুল মিল্লাতি ওয়াদ্দীন কারদারী বাযাতিকনী ইমাদীর নিজের হাতে অনুলিপি করা এ দুটো গ্রন্থ আমার হস্তগত হয়েছে এবং তিনি এদুটো গ্রন্থেই লিখে রেখেছেন যে, গ্রন্থদ্বয় ইমামের রচিত। তিনি বলেছেন: বহুসংখ্যক মাশাইখ (প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ) এ বিষয়ে একমত।’’[2]
এরূপ অপপ্রচারের কারণে ইমাম আযম রচিত গ্রন্থগুলো তাঁর অনুসারীদের মধ্যেও তেমন প্রচার লাভ করে নি। ‘আল-ফিকহুল আকবার’ ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থের পান্ডুলিপিও খুবই কম পাওয়া যেত। আল্লামা আব্দুল কাদির ইবন আবিল ওয়াফা কুরাশী ইমাম আযমের রচনাবলি আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন:
وقد شرحت الفقه الأكبر وضمتنه وصاياه بحمد الله ولعلي إذا ظفرت بالعلم والمتعلم أشرحه بعون الله وتوفيقه
‘‘আল-হামদু লিল্লাহ, আমি ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থটির ব্যাখ্যা রচনা করেছি। এর মধ্যে ইমামের ওসিয়্যাতগুলোও সংযুক্ত করেছি। যদি ‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম’ গ্রন্থটির সন্ধান পাই তাহলে আশা রাখি যে, আমি আল্লাহর সাহায্যে ও তাওফীকে এ গ্রন্থটিরও ব্যাখ্যা লিখব।’’[3]
এ থেকে আমরা বুঝি যে, সপ্তম শতকেও ইমাম আযমের কোনো কোনো গ্রন্থ এতই দুষ্প্রাপ্য ছিল যে, এরূপ একজন প্রসিদ্ধ ও ব্যাপক অধ্যয়ন নির্ভর হানাফী আলিমের জন্যও এ সকল গ্রন্থ সংগ্রহ সম্ভব হয় নি।
[2] কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ ২/৪৬১।
[3] কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ ২/৪৬১।