হাদীসের নামে জালিয়াতি অন্যান্য কিছু বানোয়াট হাদীস ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ৮ টি

আমরা জানি যে, আখিরাতের জন্য দুনিয়াতে কর্ম করতে হবে। তবে এ অর্থে একটি ‘হাদীস’ প্রচলিত, যা ভিত্তিহীন। ‘হাদীসটিতে’ বলা হয়েছে:

اَلدُّنْيَا مَزْرَعةُ الآخِرَةِ

‘‘দুনিয়া হলো আখেরাতের শস্যক্ষেত্র।’’

কথাটির অর্থ সঠিক হলেও তা হাদীস নয়। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ সনদেও কথাটি কোথাও বর্ণিত হয় নি।[1]

[1] সাগানী, আল-মাউদূ‘আত, পৃ. ৬৪; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ২২৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১৭৪; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ১২৩; আল-মাসনূ, পৃ. ৭১; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/৪৯৫; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ১১০।
২. নেককারদের পুণ্য নিকটবর্তীদের পাপ

প্রচলিত একটি বাক্য যা সাধারণত ‘হাদীস’ বলে উল্লেখ করা হয়:

حَسَنَاتُ الأَبْرَارِ سَيِّئَاتُ الْمُقَرَّبِيْنَ

‘‘নেককার মানুষদের নেক-আমলসমূহ নিকটবর্তীগণের (আল্লাহর ওলীদের) পাপ।’’ মুহাদ্দিসগণ একমত যে বাক্যটি হাদীস নয়, বরং তৃতীয় শতকের একজন বুযুর্গ আবূ সাঈদ আল-খার্রার (২৮৬হি)-এর কথা।[1]

[1] ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুস্সাস, পৃ. ৮৪, সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ১৯৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ১১৩; আল-মাসনূ, পৃ. ৬৪; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৩১২।

‘হাদীস’ বলে প্রচলিত আরেকটি ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা:

لاَ صَلاَةَ إِلاَّ بِحُضُوْرِ الْقَلْبِ

‘‘অন্তরের উপস্থিতি (মনোযোগ) ছাড়া সালাত হবে না।’’

সালাতের মধ্যে মনোযোগের গুরুত্ব কুরআন ও বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে বুঝা যায়। তবে এ কথাটি হাদীস নয়; বরং সনদবিহীন বানোয়াট কথা।

হাদীস নামে প্রচলিত একটি বানোয়াট বাক্য:

مُوْتُوا قَبْلَ أَنْ تَمُوْتُوأ

‘‘তোমরা মৃত্যুর আগেই মৃত্যুবরণ কর।’’

ইবনু হাজার আসকালানী, সাখাবী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস একমত যে, এ কথাটি ভিত্তিহীন একটি বানোয়াট কথা।[1]

[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪৩২; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৪৬; আল-মাসনূ, পৃ. ১৬১; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৩৫; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৮৪।

আমাদের দেশের অতি প্রচলিত ও ওয়ায়িযদের প্রিয় ‘হাদীস’:

اَلْمَسْجِدُ بَيْتُ اللهِ وَالْمَدْرَسَةُ بَيْتِيْ

‘‘মাসজিদ আল্লাহর বাড়ি এবং মাদরাসা আমার বাড়ি বা আমার ঘর।’’

কথাটি হাদীসের নামে বলা একটি জঘন্য মিথ্যা ও বানোয়াট কথা, যা কোনো সহীহ, যয়ীফ বা জাল সনদেও রাসূলুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয় নি।

বস্ত্তত ‘মাদরাসা’ শব্দটিরই কোনো ব্যবহারই ইসলামের প্রথম দু শতাব্দীতে ছিল না। এর অর্থ এ নয় যে, ‘‘মাদরাসা’’ ব্যবস্থা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের যুগে ছিল না। ‘‘আকীদা’’, ‘‘তাসাউফ’’ ইত্যাদি পরিভাষা কুরআন-হাদীসে তো নেই, উপরন্তু সাহাবীগণের যুগেও ছিল না। প্রথম দু শতাব্দীর পরে এ সব পরিভাষার উদ্ভব। কুরআন-হাদীসে ঈমানের বিষয় বলা হয়েছে। পরবর্তী যুগে এ বিষয়ক আলোচনাকে ‘‘আকীদা’’ নাম দেয়া হয়েছে। কুরআন-হাদীসে তাযকিয়ায়ে নাফসের নির্দেশ রয়েছে, পরবর্তী যুগে ‘‘তাসাউফ’’ পরিভাষার উদ্ভব। কুরআন-হাদীসে ইলম শিক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীগণের যুগে মসজিদে বা নির্ধারিত ঘরে পাঠগ্রহণ ও প্রদানের রীতি ছিল। তবে পাঠদানকেন্দ্রকে ‘‘মাদরাসা’’ নামকরণের প্রচলন সে যুগে ছিল না।

নবজাতকের কানে আযান দেওয়া সুন্নাত। আবু রাফি (রা) বলেন:

رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ أَذَّنَ فِي أُذُنِ الْحَسَنِ بْنِ عَلِيٍّ حِينَ وَلَدَتْهُ فَاطِمَةُ بِالصَّلاةِ

‘‘আমি দেখলাম, ফাতেমা (রা) যখন হাসানকে জন্ম দিলেন তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ হাসানের কানে নামাযের আযানের মত আযান দিলেন।’’[1]

তবে বাম কানে একামত দেওয়ার বর্ণনাটি জাল পর্যায়ের। হাদীসটি নিম্নরূপ:

مَنْ وُلِدَ لَهُ وَلَدٌ فَأَذَّنَ في أُذُنِهِ الْيُمْنَى وَأَقَامَ في أُذُنِهِ الْيُسْرَى لَمْ تَضُرَّهُ أُمُّ الصِّبْيَانِ

‘‘যদি কারো সন্তান জন্মগ্রহণ করে এবং সে তার ডান কানে আযান এবং বাম কানে ইকামত দেয় তবে ‘উম্মুস সিবইয়ান’ (জিন) তার ক্ষতি করবে না।’’

হাদীসটি আবূ ইয়ালা মাউসিলী, ইবনুস সুন্নী প্রমুখ মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবনুল আলা রাযী থেকে মারওয়ান ইবন সালিম থেকে তালহা ইবন উবাইদুল্লাহ উকাইলী থেকে ইমাম হুসাইন ইবন আলী (রা) থেকে রাসূলুল্লাহ থেকে হাদীসটি সংকলন করেছেন। আর ইয়াহইয়া ইবনুল আলা এবং তার উসতাদ মারওয়ান ইবন সালিম উভয়ই জালিয়াত ছিলেন।[2]

[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৯৭; আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/৩২৮; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/১৯৭। তিরমিযী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন ও আলবানী হাসান বলেছেন।

[2] আবূ ইয়ালা, আল-মুসনাদ ১২/১৫০; ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াওম (শামিলা ৩.৫) ৩/১৯৮; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান ৬/৩৯০; ইবন আদী, কামিল ৭/২৬৫৬; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৪/৩৯৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৫৯; আলবানী, যায়ীফাহ ১/৪৯১।

প্রচলিত একটি পত্রিকা[1] থেকে জানা যায়, আমাদের দেশের কোনো কোনো এলাকায় ধুমপানের বিরুদ্ধে দুটি বানোয়াট হাদীস প্রচার করা হয়:

مَنْ شَرِبَ الدُّخَانَ فَكَأَنَّمَا شَرِبَ دَمَ الأَنْبِيَاءِ

‘‘যে ব্যক্তি ধুমপান করল সে যেন নবীগণের রক্ত পান করল।’’

مَنْ شَرِبَ الدُّخَانَ فَكَأَنَّمَا زَنَى بِأُمِّهِ فِيْ الْكَعْبَةِ

‘‘যে ব্যক্তি ধুমপান করল, সে যেন কাবাঘরের মধ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করল।’’

এ প্রকারের জঘন্য নোংরা ও ফালতু কথা কেউ হাদীস হিসেবে বলতে পারে বলে বিশ্বাস করা কষ্ট। সর্বাবস্থায় এগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট কথা।

[1] আঞ্জুমানে আহমাদিয়া রাহমানিয়া সুন্নিয়া, চট্টগ্রাম, মাসিক তরজুমান, ২৫ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, মে-জুন ২০০৫, পৃ. ৫৭।
৮. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ধুমপানের নির্দেশ দিলেন!

‘ইমামুস সুফিয়্যাহ’ বা সূফীগণের ইমাম নামে খ্যাত গত শতকের সুপ্রসিদ্ধ আলিম, সূফী ও বিচারক ইউসূফ ইবন ইসমাঈল নাবহানী (১২৬৫-১৩৫০ হি/১৮৪৯-১৯৩২খৃ) রচিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘‘জাওয়াহিরুল বিহার ফী ফাদায়িলিন নাবিয়্যিল মুখতার’’। এ গ্রন্থে তিনি প্রসিদ্ধ সূফী আলিম আব্দুল গনী নাবলুসী (১০৫০-১১৪৩ হি/ ১৬৪১-১৭৩১) থেকে উদ্ধৃত করেছেন:

جاء إلى مجلسنا السيد عبد القادر أفندي على عادته، وكان يقرأ علينا في مختصر صحيح البخاري في أواخره فقرأ الحديث الذي أخرجه البخاري عن أبي هريرة عن النبي ﷺ قال: "من رآني في المنام فسيراني في اليقظة ولا يتمثل الشيطان بي" ... ثم جرت معه مذاكرة في شرب الدخان فأخبرنا عن الشيخ أحمد بن منصور العقربي عن شيخنا الشريف أحمد بن عبد العزيز المغربي أنه كان يجتمع بالنبي ﷺ مراراً عدة ، وأنه مرض مرضاً شديداً فسأل النبي ﷺ عن شرب الدخان فسكت النبي ﷺ ولم يرد له الجواب، ثم أمره باستعماله.

‘‘আব্দুল কাদির আফিন্দি তাঁর অভ্যাসমত আমাদের মাজলিসে আসলেন। তিনি মুখতাসার সহীহ বুখারীর শেষভাগ আমাদের কাছে পড়তেন। এদিন তিনি বুখারী সংকলিত আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসটি পড়লেন, যাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখবে সে অচিরেই আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে; শয়তান আমার রূপ গ্রহণ করতে পারে না।... এরপর তাঁর সাথে ধুমপান বিষয়ে আলোচনা হয়। তিনি বলেন, শাইখ আহমাদ ইবন মানসূর আকরাবী আমাদের শাইখ আহমাদ ইবন আব্দুল আযীয মাগরিবী থেকে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি অনেক বার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে একত্রিত হয়েছেন। একবার তিনি কঠিনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ধুমপান সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ উত্তর না দিয়ে নীরব থাকেন। এরপর তিনি তাকে ধুমপান করতে নির্দেশ দেন।’’[1]

সম্মানিত পাঠক, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে জালিয়াতির একটি বড় পথ স্বপ্ন। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত দুটো বিষয়ের ভুল ব্যাখ্যা করে অগণিত মিথ্যা এ পথ দিয়ে দীনের মধ্যে প্রবেশ করছে। সহীহ বিষয় দুটো নিম্নরূপ:

(ক) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে স্বপ্নে দেখলে প্রকৃতই তাঁকে দেখা হয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘‘যে স্বপ্নে আমাকে দেখল, সে প্রকৃতই আমাকে দেখল, কারণ শয়তান আমার রূপ পরিগ্রহণ করতে পারে না।’’[2]

(খ) মুমিনের স্বপ্ন নুবুওয়াতের ৪৬ ভাগের বা ৭০ ভাগের এক ভাগ। আনাস (রা), উবাদা ইবনুস সামিত, আবূ হুরাইরা (রা) প্রমুখ সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হাদীদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

رُؤْيَا الْمُؤْمِنِ جُزْءٌ مِنْ سِتَّةٍ وَأَرْبَعِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ

‘‘মুমিনের স্বপ্ন নুবুওয়াতের ৪৬ অংশের এক অংশ।’’[3]

অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:

الرُّؤْيَا الصَّالِحَةُ جُزْءٌ مِنْ سَبْعِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ

‘‘নেক স্বপ্ন নুবুওয়াতের ৭০ ভাগের এক ভাগ।’’[4]

এ দুটি সহীহ বিষয়কেই ভুল ব্যাখ্যা করে বিকৃত করা হয়েছে:

(ক) অন্য কাউকে দেখাকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে দেখা বলে দাবি করা।

মুসলিম উম্মাহ একমত যে, শয়তান রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আকৃতি গ্রহণ করতে পারে না। কাজেই কেউ যদি রাসূলুল্লাহ ﷺ- কে তাঁর প্রকৃত আকৃতিতে স্বপ্নে দেখে তাহলে সুনিশ্চিতভাবেই সে তাঁকে দেখেছে। তবে স্বপ্নে যদি কারো সম্পর্কে বলা হয় যে, ইনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ); কিন্তু পৃথিবীতে তাঁর যে আকৃতির কথা হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সে আকৃতির সাথে উক্ত ব্যক্তির আকৃতির শতভাগ মিল না হয় তাহলে কি তাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলে মনে করতে হবে? অনেকে এরূপ দাবি করেন। তাঁরা দাবি করেন, শয়তান যেমন তাঁর রূপ পরিগ্রহণ করতে পারে না, তেমনি সে অন্য রূপে এসে নিজেকে মুহাম্মাদ (ﷺ) বলে দাবি করতে পারে না।

এ দাবির পক্ষে হাদীসের কোনো প্রমাণ নেই। হাদীসে বলা হয়েছে, শয়তান তাঁর রূপ গ্রহণ করতে পারে না; কিন্তু অন্য রূপে এসে নিজেকে নবী বলে দাবি করতে পারে না বলে কোথাও বলা হয় নি। উপরন্তু মানুষ শয়তান যেমন জাল হাদীস বানাতে পারে, তেমনি জিন শয়তানও স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে জালিয়াতি করতে পারে। বাস্তবে আমরা দেখি যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে জালিয়াতির একটি বড় পথ স্বপ্নে অন্য আকৃতির কাউকে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলে বিশ্বাস করা। সাহাবী-তাবিয়ীগণ এ বিষয়ে কঠোর ছিলেন। কেউ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে স্বপ্নে দেখেছে বলে দাবি করলে তাঁরা তাকে স্বপ্নে দেখা মানুষটির আকৃতির বর্ণনা করতে বলতেন। স্বপ্নে দেখা মানুষটির আকৃতি হুবহু রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রকৃত আকৃতির সাথে মিললেই তাঁরা স্বপ্নকে সত্য বলে গ্রহণ করতেন। সাহাবী ইবনু আববাস (রা), প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ও স্বপ্ন-বিশারদ মুহাম্মাদ ইবনু সিরীনও (১১০হি) ও অন্যান্যরা এ মত পোষণ করতেন।[5]

(খ) ৪৬ বা ৭০ ভাগের একভাগকে শতভাগ নুবুওয়াত মনে করা।

এটি বিভ্রান্তির দ্বিতীয় দরজা। স্বপ্নে যদি প্রকৃতই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কে দেখা যায় এবং তিনি স্বপ্নে কুরআন বা হাদীসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু বলেন তবে তা কখনোই প্রকৃত অর্থে গ্রহণ করা যাবে না। স্বপ্নে যা-ই দেখা হোক না কেন শরীয়তে তার কোনো মূল্য নেই। শরীয়তের ভিত্তি শতভাগ নুবুওয়াত দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের উপর, অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাতের উপর। প্রয়োজনে কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে ইজতিহাদ করতে হবে। কিন্তু স্বপ্ন, কাশফ, ইলহাম, ইলকা ইত্যাদি মুমিনের ব্যক্তিগত অনুভূতি। কুরআন ও সুন্নাতের আলোকে বিচার করে তা গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে।

ইসলামের প্রথম যুগগুলোতে স্বপ্ন-কাশফ ইত্যাদিকে ব্যক্তিগত অনুভূতির পর্যায়েই রাখা হয়েছে। কোনো হাদীস বা ফিকহী মাসআলার বিশুদ্ধতা যাচাইয়ে কখনোই স্বপ্ন, কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির কোনোরূপ গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। স্বপ্ন, কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির আলোকে কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যা করা বা স্বপ্ন-কাশফকে দীন বা শরীয়তের সাথে সংযুক্ত করাই উম্মাতের অধঃপতন এবং ইসলামের বিকৃতির অন্যতম পথ। গোলাম আহমদ কাদিয়ানির মত অসংখ্য ভন্ড স্বপ্ন, কাশফ, ইলহাম ইত্যাদিতে তাদের মহা আধিপত্য প্রচার করছে। আর সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করছে। আমাদের হুজুরের সাথে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের (ﷺ) বিশেষ সম্পর্ক। তিনি আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের কাছ থেকে না জেনে বা না শুনে কিছুই বলেন না। কাজেই তাঁর মতই একমাত্র সহীহ মত!!!

আর এজন্যই এখন বহু প্রকারের ইসলামের জন্ম হয়েছে। কেউ স্বপ্নে ধুমপানের নির্দেশ পেয়ে ধুমপান করাকে আহলুস সুন্নাহ হওয়ার শর্ত বানিয়েছেন। কেউ স্বপ্নে ধুমপানের নিষেধাজ্ঞা পেয়ে ধুমপান করাকে মহাপাপ বলে গণ্য করছেন। এভাবে দীন, শরীয়ত, হালাল, হারাম, হক, বাতিল ইত্যাদির মূল মাপকাঠি হয়ে গিয়েছে স্বপ্ন, কাশফ ইত্যাদি।

আলিমগণ তাদের ওয়াজ, তারবিয়াত ইত্যাদির ক্ষেত্রে মূলত স্বপ্ন-কাশফ ও হেকায়াত-কাহিনীর উপর নির্ভর করেন। প্রত্যেকেই নিজের মুরববী বা মতের সঠিকত্ব প্রমাণ করতে স্বপ্নের দলীল পেশ করেন। কেউ বলছেন,& আমাদের বুজুর্গগণ স্বপ্নে (বা জাগ্রত অবস্থায়!!) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হয়ে কিয়াম করতে দেখেছেন। কেউ বলছেন আমাদের বুজুর্গগণ রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে স্বপ্নে নির্দেশ পেয়ে এ কাজ করেছেন। একে অপরের মত খন্ডন করলেও স্বপ্ন-কাশফ ও গল্প নির্ভরতার বিষয়ে সকলেই একমত। ইসলামের প্রথম যুগগুলোর অতিক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই স্বপ্ন-নির্ভর গল্প-কাহিনীর প্রচলন হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে তা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়েছে।

এ কারণেই গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মত অগণিত ভন্ড প্রতারকগণ সমাজের মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পায়। সকল আলিমই যেহেতু স্বপ্ন, কাশফ ও কারামতের গল্প বলেন সেহেতু সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বেশি। কুরআন-হাদীসের কথা বলে সাধারণ মুসলিম সমাজকে যতটুকু প্রভাবিত করা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবিত করা যায় স্বপ্ন, কাশফ, কারামত ইত্যাদির গল্প দিয়ে।

হাদীস বলার ক্ষেত্রে দেশের আলিমগণ সহীহ-যয়ীফ আলোচনা করেন না এবং হাদীস-গ্রন্থের রেফারেন্স দেওয়ার গুরুত্ব কেউই বলেন না। বরং এগুলো বললে তাঁরা আপত্তি করেন। এজন্য সাধারণ মুসলিমগণ এ বিষয়ে মোটেও সচেতন নন। ফলে প্রতারক ও ভন্ডগণ যা খুশি হাদীস বলে চালিয়ে দেন।

প্রিয় পাঠক, অনেকেই সমাজের অবক্ষয়, শিরক-কুফর, ভন্ডদের প্রসার ইত্যাদি দেখে কষ্ট পান এবং এগুলো পরিবর্তন ও সংস্কার করতে আগ্রহী হন। তবে কার্যকর সংস্কারের জন্য নিম্নের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়:

প্রথমত: আমাদের শিক্ষা, তারবিয়াত, তাসাউফ, ফিকহ, ওয়াজ, আলোচনা, ফযীলত, দাওয়াত ইত্যাদি সকল কর্মকান্ড একান্তই কুরআন, হাদীস ও সাহাবীগণের জীবন কেন্দ্রিক হতে হবে। স্বপ্ন, কাশফ, হেকায়াত, পরবর্তী যুগের বুজুর্গগণের নামে প্রচারিত গল্প, কারামত ইত্যাদি যথাসম্ভব পরিহার করা উচিত। কয়েকটি কারণে তা করা উচিত:

(১) এতে রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীগণের মহববত আমাদের হৃদয়ে গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকবে।

(২) হাদীসে নাবাবী ও হাদীসে সাহাবার অন্তত সনদ পাওয়া যায় এবং সহীহ বা জাল যাচাই করা সম্ভব। পক্ষান্তরে পরবর্তী বুজুর্গগণের নামে প্রচলিত গল্প, উক্তি, কারামত ইত্যাদির তেমন কোনো সনদ পাওয়া যায় না এবং এ ময়দানে জালিয়াতদের কারসাজিও খুব বেশি।

(৩) রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পরে সাহাবীগণকে কুরআন-হাদীসে উম্মাতের অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী বুজুর্গগণের বিষয়ে তা বলা হয় নি। বরং তাঁরা তাদের বুজুর্গির পাশাপাশি ইজতিহাদ বা অসতর্কতা বশত বিভিন্ন খেলাফে সুন্নাত কাজ করেছেন। তাঁদের সকল বিষয় অনুকরণীয় নয়। তাঁদের কেউ সামা কাওয়ালী করেছেন, কেউ খেলাফে সুন্নাতভাবে নির্জনবাস করেছেন। কেউ খেলাফে সুন্নাত কথা বিভিন্ন হালতে বলেছেন। এগুলোর সত্য-মিথ্যা বা জালিয়াতি নির্ণয় যেমন সম্ভব নয়, তেমনি এগুলোর আলোচনা ক্ষতি ছাড়া কোনো উপকার বয়ে আনে না। ভন্ড-প্রতারকগণ মূলত এ সকল গল্প-কাহিনীর অপব্যবহার করেই মুমিনদের ঈমান বিনষ্ট করে।

[1] নাবহানী, জাওয়াহিরুল বিহার (বৈরুত, ১৩২৭ হি) ৪/১০০।

[2] বুখারী ৬/২৫৬৭ (ভারতীয় ২/১০৩৬); মুসলিম ৪/১৭৭৫, (ভারতীয় ২/২৪২)।

[3] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৬৩; মুসলিম আস-সহীহ ৪/১৭৭৩-১৭৭৪ নং ২২৬৩, ২২৬৪।

[4] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৭৫, নং২২৬৫।

[5] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৬৭; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১২/৩৮৩-৩৮৪।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৮ পর্যন্ত, সর্বমোট ৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে