ইসলাম জামাআতবদ্ধ জীবন পছন্দ করে; অপছন্দ করে বিচ্ছিন্নতাকে। কারণ, শান্তি ও শ£খলা রয়েছে জামাআতে। আর নামায একটি বিশাল ইবাদত। (শিশু, ঋতুমতী মহিলা ও পাগল ছাড়া) নামায পড়তেও হয় সমাজের সকল শ্রেণীর সভ্যকে। তাই সমষ্টিগতভাবে এই ইবাদতের জন্যও একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম-নীতির প্রয়োজন ছিল। বিধিবদ্ধ হল জামাআত।
পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হয় ইসরা’ ও মি’রাজের রাত্রে। ঠিক তার পরের দিন যোহরের সময় জিবরীল (আঃ) প্রিয় নবী (ﷺ)-কে নিয়ে জামাআত সহকারে প্রথম নামায পড়েন। অনুরুপভাবে মুসলিমরাও মহানবী (ﷺ)-এর পশ্চাতে দাঁড়িয়ে তাঁর অনুসরণ করেন। আর জিবরীলের ইমামতির পর মহানবী (ﷺ) মক্কা মুকার্রামায় কোন কোন সাহাবীকে নিয়ে কখনো কখনো জামাআত সহকারে নামায আদায় করেছেন। কিন্তু মদ্বীনায় হিজরত করার পর জামাআত একটি বাঞ্জিত নিয়ম ও ইসলামী প্রতীকরুপে গুরুত্ব পেল। আর সকল নামাযীকে জামাআতবদ্ধ ও জমায়েত করার জন্য বিধিবদ্ধ হল আযান।
ইসলামী শরীয়তের একটি মাহাত্ম এই যে, তার বিভিন্ন ইবাদতে জামাআত ও ইজতিমা বিধিবদ্ধ রয়েছে। যা আসলে এক একটি সম্মেলন। যে সম্মেলনে মুসলিম নিয়মিতভাবে জমায়েত হয়। তাতে তারা এক অপরের অবস্থা জানতে পারে। একে অন্যকে উপদেশ দিতে পারে। কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সলা-পরামর্শ করতে পারে। উপস্থিত সমস্যfর সঠিক সমাধান অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে পরস্পর সহ্যোগিতা করতে পারে। এক সাথে বসে পরস্পর মত-বিনিময় করতে পারে।
জামাআতে উপস্থিত হয়ে অজ্ঞ ব্যক্তি ইসলামী জ্ঞান লাভ করতে পারে। দরিদ্র সাহায্য পেতে পারে। ঐক্যের মহামিলন দেখে মুসলিমের হৃদয় নরম হয়ে থাকে। প্রকাশ পায় ইসলামী শান-শওকত, সমতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা।
জামাআতে ভেঙ্গে চুরমার হয় বর্ণ-বৈষম্যের সকল প্রাচীর। একাকার হয় সকল জাত-পাত। আমীর-গরীব, আতরাফ-আশরাফ, বাদশা-ফকীরের কোন ভেদাভেদ নেই এখানে। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের মহান আদর্শর অভিব্যক্তি ঘটে এই জামাআতে।
সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, সুশৃঙ্খলতা এই জামাআতের মহান বৈশিষ্ট্য । সভ্য জাতির আদর্শ শিক্ষা লাভ হয় এই পুন: পুন: ইজতিমায়।
জামাআতে উপস্থিত হয়ে একে অপরের দেখাদেখি আল্লাহর ইবাদতের জন্য প্রতিযোগিতামূলক মন-মানসিকতা সৃষ্টি হয় মুসলিমের।
জামাআতের এই মহা মিলনক্ষেত্রে ইসলামী সম্প্রীতির যে সুন্দর ও সুষ্ঠ পরিবেশ পরিলক্ষিত হয়, তাতে সামাজিক জীবনের চলার পথে নিজেকে একাকী ও অসহায় বোধ হয় না। মনে জাগে খুশী, প্রাণে জাগে উৎফুল্লুতা, ইবাদতে আসে মনোযোগ, উৎসাহ্, উদ্দীপনা ও স্ফূর্তি।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। শান্তি মুসলিমের কাম্য। অপর ভায়ের সাথে সাক্ষাৎ হলে উভয় মুসলিম এক অপরের জন্য শান্তি কামনা করে দুআ দিয়ে থাকে। ‘আস-সালামু আলাইকুম, অআলাইকুমুস সালাম’ বলার মাধ্যমে আল্লাহর তরফ থেকে এবং উভয়ের হৃদয়-মনেও শান্তি লাভ হয় এই জামাআতে হাজির হলে।
নামাজ জামাআত সহকারে আদায় করা ওয়াজেব। বিধায় বিনা ওজরে জামাআত ত্যাগ করা কাবীরাহ্ গুনাহ। মহান আল্লাহ বলেন,
(وَأَقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوْا مَعَ الرَّاكِعِيْنَ)
অর্থাৎ, তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকূকারিগণের সাথে রুকূ কর। (কুরআন মাজীদ ২/৪৩)
বরং জামাআতে নামায না পড়লে নামায কবুল নাও হতে পারে। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আযান শোনে অথচ (মসজিদে জামাআতে) উপস্থিত হয় না, সে ব্যক্তির কোন ওজর ছাড়া (ঘরে নামায পড়লেও তার) নামাযই হয় না।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৪৫, সহিহ তারগিব ৪২২নং)
“যে ব্যক্তি মুআযযিনের (আযান) শোনে এবং কোন ওজর (ভয় অথবা অসুখ) তাকে জামাআতে উপস্থিত হতে বাধা না দেয়, তাহলে যে নামায সে পড়ে সে নামায কবুল হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫১নং)
“যে কোন গ্রাম বা মরু-অঞ্চলে তিনজন লোক বাস করলে এবং সেখানে (জামাআতে) নামায কায়েম না করা হলে শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে ফেলে। সুতরাং তোমরা জামাআতবদ্ধ হও। অন্যথা ছাগ পালের মধ্য হতে নেকড়ে সেই ছাগলটিকে ধরে খায়, যে (পাল থেকে) দূরে দূরে থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৫১১, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৪৫, সহিহ তারগিব ৪২২নং)
যারা নামাযের জামাআতে মসজিদে হাজির হয় না, মহানবী (ﷺ) তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “মুনাফিকদের পক্ষে সবচেয়ে ভারী নামায হল এশা ও ফজরের নামায। ঐ দুই নামাযের কি মাহাত্ম আছে, তা যদি তারা জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও অবশ্যই তাতে উপস্থিত হত। আমার ইচ্ছা ছিল যে, কাউকে নামাযের ইকামত দিতে আদেশ দিই, অতঃপর একজনকে নামায পড়তেও হুকুম করি, অতঃপর এমন একদল লোক সঙ্গে করে নিই; যাদের সাথে থাকবে কাঠের বোঝা। তাদের নিয়ে এমন সম্প্রদায়ের নিকট যাই, যারা নামাযে হাজির হয় না। অতঃপর তাদেরকে ঘরে রেখেই তাদের ঘরবাড়িকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিই।” (বুখারী ৬৫৭, মুসলিম, সহীহ ৬৫১নং)
হযরত উসামা বিন যায়দ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “লোকেরা জামাআত ত্যাগ করা হতে অবশ্য অবশ্যই বিরত হোক, নচেৎ আমি অবশ্যই তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেব।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, সহিহ তারগিব ৪৩০নং)
কোন অন্ধ মানুষকেও মহানবী (ﷺ) জামাআতে অনুপস্থিত থেকে ঘরে নামায পড়ার অনুমতি দেননি। অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূম (রাঃ) মহানবী (ﷺ)-এর দরবারে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! মসজিদে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার মত আমার উপযুক্ত মানুষ নেই। তাছাড়া মদ্বীনায় প্রচুর হিংস্র প্রাণী (সাপ-বিছা-নেকড়ে প্রভৃতি) রয়েছে। (মসজিদের পথে অন্ধ মানুষের ভয় হয়)। সুতরাং আমার জন্য ঘরে নামায পড়ার অনুমতি হবে কি?’ আল্লাহর নবী (ﷺ) তাঁর ওজর শুনে তাঁকে ঘরে নামায পড়ার অনুমতি দিলেন। তিনি চলে যেতে লাগলে মহানবী (ﷺ) তাঁকে ডেকে বললেন, “কিন্তু তুমি কি আযান ‘হাইয়্যা আলাস স্বালাহ্,হাইয়্যা আলাল ফালাহ্’ শুনতে পাও।” তিনি উত্তরে বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ মহানবী (ﷺ) বললেন, “তাহলে তুমি (মসজিদে) উপস্থিত হও, তোমার জন্য কোন অনুমতি পাচ্ছি না।” (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫৫২, ৫৫৩নং)
যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদলের সম্মুখেও জামাআত মাফ নয়। মহান আল্লাহ বিধিবদ্ধ করলেন স্বালাতে খওফ। (কুরআন মাজীদ ৪/১০২) জামাআত সহকারে নামায একান্ত বাঞ্জিত ও জরুরী কর্তব্য না হলে ঐ ভীষণ সময়ে মরণের মুখে তিনি তা মাফ করতেন।
তদনুরুপ জামাআত বাঞ্জিত বলেই প্রয়োজনে নামায জমা করে পড়া বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। মসজিদের পথে শত্রুর ভয় হলে, প্রচুর ঠান্ডা বা বৃষ্টি হলে অথবা সফরে থাকলে যোহ্র-আসর এবং মাগরেব-এশাকে জমা করে পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে জামাআতের ফযীলত লাভ করার জন্যই।
জামাআত ত্যাগ করা মুমিনের গুণ নয়; বরং তা মুনাফিকের গুণ। মহান আল্লাহ এদের গুণ বর্ণনা করে বলেন,
(উوَلاَ يَأْتُوْنَ الصَّلاَةَ إِلاَّ وَهُمْ كُسَالَى وَلاَ يُنْفِقُوْنَ إِلاَّ وَهُمْ كَارِهُوْنَ)
অর্থাৎ, ---ওরা (মুনাফেকরা) নামাযে শৈথিল্যর সাথে হাজির হয় এবং অনিচ্ছাকৃত ভাবেই দান করে থাকে। (কুরআন মাজীদ ৯/৫৪)
বিশেষ করে এশা ও ফজরের নামায মুনাফেকের জন্য অধিক ভারী। আর একথা পূর্বে এক হাদীসে আলোচিত হয়েছে।
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমরা যখন কোন লোককে ফজরের নামাযে অনুপস্থিত দেখতাম, তখন তার প্রতি কু ধারণা করতাম।’ (ত্বাবরানি, ইবনে আবী শাইবা, বাযয়ীফ, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ২/৪০)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাল আল্লাহর সাথে মুসলিম হয়ে সাক্ষাৎ করতে আনন্দবোধ করে তার উচিৎ, যেখানে আহবান করা হয় সেখানে (অর্থাৎ মসজিদে) ঐ নামাযগুলির হিফাযত করা। অবশ্যই আল্লাহ তাআলা তোমাদের নবীর জন্য বহু হেদায়াতের পথ ও আদর্শ বিধিবদ্ধ করেছেন এবং ঐ (নামায)গুলি হেদায়াতের পথ ও আদর্শর অন্তর্ভুক্ত। যদি তোমরা তোমাদের স্বগৃহে নামায পড়ে নাও; যেমন এই পশ্চাদগামী তার স্বগৃহে নামায পড়ে থাকে, তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শ ও তরীকা বর্জন করে ফেলবে। আর যদি তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শ ও তরীকা বর্জন করে ফেল, তাহলে তোমরা ভ্রষ্ট হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে পবিত্রতা অর্জন (ওযু) করে এই মসজিদসমূহের কোন মসজিদের প্রতি (যেতে) প্রবৃত্ত হয়, আল্লাহ তার প্রত্যেক পদক্ষেপের পরিবর্তে একটি করে নেকী লিপিবদ্ধ করেন, এর দ্বারায় তাকে এক মর্যাদায় উন্নীত করেন ও এর দ্বারায় তার একটি পাপ হরাস করেন। আমরা দেখেছি যে, বিদিত কপটতার কপট (মুনাফিক) ছাড়া নামায থেকে কেউ পশ্চাতে থাকত না। আর মানুষকে দুটি লোকের কাঁধে ভর করে হাঁটিয়ে এনে কাতারে খাড়া করা হত।’ (মুসলিম, সহীহ ৬৫৪নং)
হযরত ওসমান বিন আফফান (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তির মসজিদে থাকা অবস্থায় আযান হয়, অতঃপর বিনা কোন প্রয়োজনে বের হয়ে যায় এবং ফিরে আসার ইচ্ছা না রাখে, সে ব্যক্তি মুনাফিক।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, সহিহ তারগিব১৫৭নং)
যারা আহবানকারী মুআযযেনের আযানে সাড়া দিয়ে জামাআতে উপস্থিত হয় না, কিয়ামতে তাদের বিশেষ অবস্থা ও শাস্তি রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
(يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَّيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ فَلاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ، خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ، وَقَدْ كَانُوْا يُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ وَهُمْ سَالِمُوْنَ)
অর্থাৎ, যেদিন পদনালী উন্মুক্ত করা হবে এবং ওদেরকে সিজদা করার জন্য আহবান করা হবে, কিন্তু ওরা তা করতে সক্ষম হবে না। হীনতাগ্রস্ত হয়ে ওরা ওদের দৃষ্টি অবনত করবে। অথচ যখন ওরা সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল, তখন তো ওদেরকে সিজদা করতে আহবান করা হয়েছিল। (কুরআন মাজীদ ৬৮/৪২-৪৩) (বুখারী ৪৯১৯ নং)
এমন কি মসজিদে জামাআতে উপস্থিত থেকে মুআযযিনের আযান শুনেও যে মসজিদ থেকে বের হয়ে যায়, সে আল্লাহর নবীর অবাধ্য ও নাফরমান রুপে পরিগণিত হয়। একদা মসজিদে আযান হলে এক ব্যক্তি সেখান থেকে উঠে চলে যেতে লাগল। সে মসজিদ থেকে বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আবূ হুরাইরা (রাঃ) তার দিকে নিনিGমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। পরিশেষে তিনি বললেন, ‘আসলে এ ব্যক্তি তো আবূল কাসেম (ﷺ)-এর নাফরমানী করল।’ (মুসলিম, সহীহ ৬৫৫নং) আর এ কথা বিদিত যে, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে, সে আসলে স্পষ্টরুপে ভ্রষ্ট হয়ে যায়।” (কুরআন মাজীদ ৩৩/৩৬)
অবশ্য যদি কেউতার জরুরী কাজে; যেমন, প্রস্রাব-পায়খানা বা ওযূ করতে মসজিদের বাইরে যায়, তাহলে তা নাফরমানীর আওতাভুক্ত নয়। (মাজমূউফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১২/২০০)
আল্লাহর নবী (ﷺ)-এর সাহাবাগণও ফরয নামাযের জন্য জামাআতে উপস্থিত হওয়াকে ওয়াজেব মনে করতেন।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে, বিদিত কপটতার কপট (মুনাফিক) ছাড়া (জামাআতে) নামায থেকে কেউ পশ্চাতে থাকত না।’ (মুসলিম ৬৫৪নং)
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ, আবূ মূসা আশআরী, আলী বিন আবী তালেব, আবূ হুরাইরা, আয়েশা ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আযান শোনে অথচ (মসজিদে জামাআতে) উপস্থিত হয় না, সে ব্যক্তির কোন ওজর ছাড়া (ঘরে নামায পড়লেও তার) নামাযই হয় না।’ (তিরমিযী, সুনান ২১৭নং, যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম )
ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, যে ব্যক্তি রোযা রাখে, তাহাজ্জুদ পড়ে; কিন্তু জামাআত ও জুমআয় হাজির হয় না। উত্তরে তিনি বললেন, ‘এ অবস্থায় মারা গেলে সে জাহান্নামবাসী হবে!’ (তিরমিযী, সুনান ২১৮নং, এটির সনদ দুর্বল)
আত্বা বিন আবী রাবাহ্ (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টি কোন শহর বা গ্রামবাসীর জন্য এ অনুমতি নেই যে, সে আযান শোনার পর জামাআতে নামায ত্যাগ করে।’
হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন, ‘কারো আম্মা যদি তাকে মায়া করে এশার নামায জামাআতে পড়তে বারণ করে, তাহলে সে তার ঐ বারণ শুনবে না।’ (বুখারী)
আওযায়ী (রহঃ) বলেন, ‘জুমুআহ ও জামাআত ত্যাগ করার ব্যাপারে পিতার আনুগত্য নেই, চাহে সে আযান শুনতে পাক, আর না-ই পাক।’
অবশ্য জেনে রাখা ভাল যে, যে ব্যক্তি জামাআত ছাড়াই নামায পড়ে, তার নামায শুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জামাআত ত্যাগ করার জন্য সে (কাবীরা) গুনাহগার হয়। তবে তার ঐ নামায কবুল হওয়া ও না হওয়ার ব্যাপার তো আল্লাহর কাছে। (মারা: ১৭২পৃ:)
জামাআতের আসল মর্যাদা ছিল সলফে সালেহীনের কাছে। তাঁরা জামাআতের এত গুরুত্ব দিতেন যে, তা ছুটে গেলে অথবা নষ্ট হয়ে গেলে কেউ কেউ কেঁদে ফেলতেন। একে অপরকে দেখা করে সান্তনা দিতেন।
সাঈদ বিন আব্দুল আযীয জামাআত ছুটে গেলে কাঁদতেন।
হাতেম আল-আসাম্ম বলেন, ‘একদা আমার এক নামাযের জামাআত ছুটে গেল। এর জন্য আবূ ইসহাক বুখারী আমাকে দেখা করতে এলেন। অথচ আমার কোন ছেলে মারা গেলে দশহাজারেরও বেশী লোক আমাকে দেখা করতে আসত। কেন না, মানুষের নিকট দুনিয়ার মসীবতের তুলনায় দ্বীনের মসীবত নেহাতই হাল্কা।’
নামাযের জামাআত কোনক্রমেই তাঁদের নিকট কোন পার্থিব জিনিসের সমতুল্য ছিল না; যে তুচ্ছ জিনিসের পশ্চাতে আমরা অনেক ক্ষেত্রে লালসার নিরলস প্রচেষ্টা নিয়ে অপেক্ষমাণ থাকি। যার জন্য কখনো বা নামায যথা সময়ে পড়তে পারি না। কেউবা তারই জন্য মূলেই নামায ত্যাগ করে বসে। ব্যবসা-বানিজ্য, কাজ-কারবার, খেলাধূলা, সরগরম মজলিসে আজেবাজে গল্প, রাজনৈতিক পরিকল্পনা, সংবাদ ও সমীক্ষা প্রভৃতি নামাযের জামাআত; কখনো বা নামায নষ্ট করে ফেলে বর্তমান যুগের বহু সংখ্যক মানুষের!
একদা মাইমূন বিন মিহ্রান মসজিদে এলেন। দেখলেন, নামায শেষ হয়ে গেলে নামাযীরা মসজিদ থেকে ফিরে গেছে। এ দেখে তিনি বললেন, ‘ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিঊন! অবশ্যই আমার নিকট এই জামাআতের মর্যাদা ইরাকের রাজত্ব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’
ইউনুস বিন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমার কি হল যে, মুরগী নষ্ট হলে আমি তার জন্য দু:খিত হ্ব, অথচ নামায (জামাআত) নষ্ট হলে তার জন্য দু:খিত হ্ব না?’
সলফে সালেহীন অধীর আগ্রহে অপেক্ষার পর আযান শুনলে মসজিদে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করতেন। যাতে ইমামের সাথে তাকবীরে তাহ্রীমা ছুটে না যায়, তার বিশেষ খেয়াল রাখতেন।
সাঈদ বিন মুসাইয়েব বলেন, ‘পঞ্চাশ বছর ধরে আমার নামাযের প্রথম তাকবীর ছুটেনি! আর পঞ্চা শ বছর ধরে নামাযে কোন মানুষের পিঠ দেখিনি।’ অর্থাৎ, পঞ্চাশ বছর যাবৎ তিনি প্রথম কাতারেই নামায পড়েছেন!
অকী’ বিন জার্রাহ্ বলেন, ‘প্রায় সত্তর বছর ধরে আ’মাশের প্রথম তাকবীর ছুটে নি!’
ইবনে সামাআহ্ বলেন, ‘যে দিন আমার আম্মা মারা যান, সে দিন ছাড়া চল্লিশ বছর ধরে আমার প্রথম তাকবীর ছুটে নি!’ (ফাযায়িলু অষামারাতুস স্বা লাতি মাআল জামাআহ্ ৬পৃ:)
ইবরাহীম নাখয়ী বলেন, ‘যখন কোন মানুষকে দেখবে, সে প্রথম তাকবীরের ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করছে, তখন তুমি তার ব্যাপারে হাত ধুয়ে নাও।’
আব্দুল আযীয বিন মারওয়ান আদব শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর ছেলে উমারকে মদ্বীনায় পাঠালেন। আর তার দেখাশোনা করার জন্য সালেহ্ বিন কায়সানকে চিঠি লিখলেন। তিনি তাকে নামায পড়তে বাধ্য করতেন। একদিন সে এক নামাযে পিছে থেকে গেলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে তোমাকে আটকে রেখেছিল?’ উমার বলল, ‘আমার দাসী আমার চুল আঁচড়াচ্ছিল।’ তিনি বললেন, ‘ব্যাপার এত দূর গড়িয়ে গেল যে, তোমার চুল আঁচড়ানো তোমার নামাযকে প্রভাবান্বিত করে ফেলল?’ এরপর সে কথা জানিয়ে তিনি তার আব্বা (আব্দুল আযীয)কে চিঠি লিখলেন। তা জেনে আব্দুল আযীয একটি দূত পাঠালেন এবং কোন কথা বলার আগেই সে দূত উমারের মাথা নেড়া করে দিল! (সিয়ারু আ’লামুন নুবালা’, ইমাম যাহাবী ৫/১১৬)
যে ব্যক্তি মসজিদে জামাআত সহকারে নামায পড়তে আসত না তাকে মক্কার আমীর আত্তাব বিন উসাইদ উমাবী (রাঃ) তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার ধমকি দিতেন। (গায়াতুল মারাম, ইযযুদ্দ্বীনহাশেমী ১/১৮-১৯)
হযরত আলী (রাঃ) প্রত্যহ্ রাস্তায় পার হওয়ার সময় ‘আস-স্বালাত, আস-স্বালাত’ বলে লোকেদেরকে ফজরের নামাযের জন্য জাগাতেন। (তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ৬৫০পৃ:) যেমন আজও সঊদী আরবে আযান হলেই নির্দিষ্ট অফিসের নিযুক্ত লোক ঐ একই কথা বলে নামাযের জন্য দোকান-পাট বন্ধ করতে তাকীদ করে থাকে। তাতে মুসলিমরা সাথে সাথে দোকান বন্ধ করে মসজিদে যায়। আর মুনাফিক ও কাফেররা যায় নিজ নিজ বাসায়। আর নামাযের সময়টুকু বন্ধ থাকে সমস্ত দোকান-পাট।
বলাই বাহুল্য যে, তাঁদের ও আমাদের মাঝে পার্থক্য রয়েছে বিরাট। তাঁদের নিকট নামাযের গুরুত্ব আমাদের তুলনায় অনেক বেশী। তাঁদের ছিল আগ্রহ্, আশা ও অধিক সওয়াব লাভের বাসনা। পক্ষান্তরে আমাদের মাঝে আছে পার্থিব প্রেম ও দুনিয়া লাভের কামনা। তাই আমরা নামাযের উপর দুনিয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি, আমাদের নিকট গুরুত্ব পায় পার্থিব ভোগ-বিলাস ও তার জন্য কর্ম-ব্যস্ততা।
অবশ্য এ কথা বলা অত্যুক্তি নয় যে, আমাদের জামাআতে হাজির হয়ে নামায না পড়া আমাদের দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক। আমাদের হৃদয়ে আল্লাহর সে তা’যীমনেই, আল্লাহর প্রতি সে প্রেম, ভক্তি ও ভয় নেই, তাঁর আদেশ ও অধিকার পালনে সে আগ্রহ্ ও উৎসাহ্ নেই, তাই আমরা এমন শৈথিল্য প্রদর্শন করতে লজ্জাও করি না।
ওয়াজেব হওয়ার সাথে সাথে জামাআতের বিভিন্নমুখী কল্যাণ ও মাহাত্ম রয়েছে; যা জেনে জ্ঞানী নামাযীকে জামাআতে উপস্থিত হয়ে নামায আদায় করতে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হওয়া উচিৎ।
জামাআতে হাজির হয়ে যারা আল্লাহর ঘর মসজিদ আবাদ রাখে, তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত; মহান আল্লাহ তাদের প্রশংসা করে বলেন,
(إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللهِ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلاَةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلاَّ اللهَ، فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَّكُوْنُوْا مِنَ الْمُهْتَدِيْنَ)
অর্থাৎ, আসলে তারাই আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করে না। আর আশা করা যায়, তারাই হল হেদায়াত-প্রাপ্ত। (কুরআন মাজীদ ৯/১৮)
জামাআতে উপস্থিতি দোযখ ও মুনাফেকী থেকে মুক্তি দেয়; মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে ৪০ দিন জামাআতে নামায আদায় করবে এবং তাতে তাহ্রীমার তকবীরও পাবে, (সেই ব্যক্তির জন্য দুটি মুক্তি লিখা হবে; দোযখ থেকে মুক্তি এবং মুনাফেকী থেকে মুক্তি।” (তিরমিযী, সুনান, সহিহ তারগিব ৪০৪নং)
জামাআতে উপস্থিত নামাযীদেরকে নিয়ে মহান আল্লাহ তাঁর ফিরিশ্তাসভায় গর্ব করেন। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। এই যে তোমাদের পালনকর্তা আসমানের দরজাসমূহের একটি দরজা খুলে তাঁর ফিরিশ্তামন্ডলীর কাছে তোমাদেরকে নিয়ে গর্ব করছেন; বলছেন, ‘তোমরা আমার বান্দাদের প্রতি লক্ষ্য কর, তারা এক ফরয (নামায) আদায় করেছে এবং অন্য এক ফরয আদায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৮০১নং)
মহান আল্লাহ জামাআতের নামায দেখে মুগ্ধ হন। মহানবী (ﷺ) বলেন, “জামাআতের নামাযে আল্লাহ মুগ্ধ হন।” (আহমাদ, মুসনাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৬৫২নং)
জামাআতে উপস্থিত হয়ে নামায আদায় করলে একাকীর তুলনায় ২৫ থেকে ২৭ গুণ সওয়াব বেশী পাওয়া যায়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “পুরুষের জামাআত সহকারে নামাযের মান একাকী নামাযের মান অপেক্ষা ২৭ গুণ অধিক।” (বুখারী, মুসলিম, প্রমুখ জামে ৩৮২০নং)
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “একাকীর নামায অপেক্ষা জামাআতের নামায সাতাশ গুণ উত্তম।” (বুখারী ৬৪৫নং, মুসলিম ৬৫০নং)
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “পুরুষের স্বগৃহে বা তার ব্যবসাক্ষেত্রে নামায পড়ার চেয়ে (মসজিদে) জামাআতে শামিল হয়ে নামায পড়ার সওয়াব পঁচিশ গুণ বেশি। কেননা, যে যখন সুন্দরভাবে ওযু করে কেবল মাত্র নামায পড়ার উদ্দেশ্যেই মসজিদের পথে বের হয় তখন চলামাত্র প্রত্যেক পদক্ষেপের বিনিময়ে তাকে এক-একটি মর্যাদায় উন্নীত করা হয় এবং তার এক-একটি গুনাহ মোচন করা হয়। অতঃপর নামায আদায় সম্পন্ন করে যতক্ষণ সে নামাযের স্থানে বসে থাকে ততক্ষণ ফিরিশ্তাবর্গ তার জন্য দুআ করতে থাকে; ‘হে আল্লাহ ওর প্রতি করুণা বর্ষণ কর। হে আল্লাহ! ওকে ক্ষমা কর। আর সে ব্যক্তি যতক্ষণ নামাযের অপেক্ষা করে, ততক্ষণ যেন নামাযের অবস্থাতেই থাকে।” (বুখারী ৬৪৭নং, মুসলিম ৬৪৯নং, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নামাযের জন্য পরিপূর্ণরুপে ওযু করে কোন ফরয নামায পড়ার উদ্দেশ্যে যায় এবং তা লোকেদের সাথে অর্থাৎ জামাআত সহকারে অথবা মসজিদে পড়ে, আল্লাহ তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেন।” (মুসলিম, সহীহ ২৩২নং)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি পরিপূর্ণরুপে ওযু করে কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে (মসজিদে) যায়, অতঃপর তা ইমামের সাথে আদায় করে সে ব্যক্তির পাপরাশি মাফ হয়ে যায়।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ তারগীব ৪০১নং)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি স্বগৃহ্ থেকে ওযূ করে কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হয়, তার সওয়াব হল ইহ্রাম বাঁধা হাজীর মত।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫৮নং)
“যে ব্যক্তি জামাআতে কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে (মসজিদে) যায়, সে ব্যক্তির সওয়াব হয় একটি হজ্জ করার মত এবং যে ব্যক্তি কোন নফল (চাশতের) নামায পড়ার জন্য পায়ে হেঁটে (মসজিদে) যায়, তার সওয়াব হয় নফল উমরাহ্ করার মত।” (আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, ত্বাব, জামে ৬৫৫৬নং)
বলা বাহুল্য, যে ব্যক্তি স্বগৃহে ওযূ করে ফরয নামায আদায় করার জন্য প্রত্যহ্ ৫ বার মসজিদে যায় এবং সে তাতে ঐ বিশাল সওয়াবের আশা রাখে, সে ব্যক্তি প্রত্যেক দিন ৫টি করে; অর্থাৎ বছরে প্রায় ১৮০০টি হজ্জ করার সওয়াব লাভ করে! আর ৬০ বছরের জীবনে প্রায় ১ লক্ষ ৮ হাজার বার হজ্জ করা হয় একজন মসজিদ-ভক্ত নামাযীর! অতএব অনায়াসে সে ৬০ বছরেই যেন ১০৮০০০ বছরের জীবন লাভ করে থাকে। বরং এত বছর বাঁচলেও সে হয়তো প্রত্যেক বছর হজ্জ করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু জামাআতের ঐ নামায তাকে এত দীর্ঘ জীবন দান করে থাকে।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “এই নামাযের জামাআতে অনুপস্থিত ব্যক্তি যদি জানত যে, তাতে উপস্থিত ব্যক্তির জন্য কত সওয়াব নিহিত রয়েছে তাহলে অবশ্যই সে হাতে-পায়ে হামাগুড়ি দিয়েও হাজির হত। (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম,সহিহ তারগিব ৪০৩নং)
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “আমি তোমাদেরকে কি সেই কথা বলে দেব না; যার দরুন আল্লাহ গুনাহসমূহকে মোচন করে দেন এবং মর্যাদা আরো উন্নত করেন?” সকলে বলল, ‘অবশ্যই, হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, “কষ্টের সময় পরিপূর্ণ ওযু করা, মসজিদের দিকে অধিকাধিক পদক্ষেপ করা (চলা), আর এক নামাযের পর আগামী নামাযের অপেক্ষা করা। উপরন্তু এগুলোই হল প্রতিরক্ষা-বাহিনীর কাজের ন্যায়, এগুলোই হল প্রতিরক্ষা-বাহিনীর কাজের ন্যায়, এগুলোই হল প্রতিরক্ষা-বাহিনীর কাজের ন্যায়।” (মালেক, মুঅত্তা, মুসলিম, সহীহ ২৫১নং, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, অনুরুপ অর্থে।)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “আজ রাত্রে আমার কাছে আমার প্রতিপালকের এক দূত এসে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি জানেন কি, নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশ্তামন্ডলী কি নিয়ে মতভেদ করছেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, (তাঁরা মতভেদ করছেন) পাপ মোচন, মর্যাদা বর্ধন, জামাআতে শামিল হওয়ার জন্য পদক্ষেপ, প্রচন্ড ঠান্ডার সময় পরিপূর্ণরুপে ওযূ এবং নামাযের অপেক্ষা নিয়ে। যে ব্যক্তি উক্ত কর্মসমূহ সম্পাদন করতে যত্নবানহবে, সে ব্যক্তির জীবন হবে কল্যাণময় এবং মরণ হবে কল্যাণময়। আর সে তার পাপ থেকে পবিত্র হয়ে সেই দিনকার মত নিষ্পাপ হবে, যেদিন তার মা তাকে ভূমিষ্ঠ করেছিল।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান ৩২৩৩নং)
এ ব্যাপারে আরো মাহাত্ম ‘মসজিদে যাওয়ার মাহাত্ম’ শিরোনামে দ্রষ্টব্য।
জামাআতে লোক যত বেশী হবে তত বেশী সওয়াব লাভ হবে নামাযীদের। মহানবী (ﷺ) বলেন, “---এক ব্যক্তির কোন অন্য ব্যক্তির সাথে জামাআত করে পড়া নামায একাকী পড়া নামায অপেক্ষা অধিকতর উত্তম। অনুরুপ অন্য দুই ব্যক্তির সাথে জামাআত করে পড়া নামায এক ব্যক্তির সাথে জামাআত করে পড়া নামায অপেক্ষা অধিকতর উত্তম। এইভাবে জামাআতের লোক সংখ্যা যত অধিক হবে ততই আল্লাহ আয্যা অজাল্লার নিকট অধিক প্রিয়।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ৪০৬নং)
তিনি বলেন, “১ জনের ইমামতিতে ২ জনের নামায আল্লাহর নিকট একাকী ৪ জনের নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর, ১ জনের ইমামতিতে ৪ জনের নামায আল্লাহর নিকট একাকী ৮ জনের নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর এবং ১ জনের ইমামতিতে ৮ জনের নামায আল্লাহর নিকট একাকী ১০০ জনের নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর।” (বায়হাকী, বাযয়ীফ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, জামে ৩৮৩৬নং)
বিশেষ করে ফজর ও এশার নামায জামাআতে পড়ার পৃথক মাহাত্ম রয়েছে।
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “লোকে যদি আযান ও প্রথম কাতারের মাহাত্ম জানত অতঃপর তা লাভের জন্য লটারি করা ছাড়া কোন অন্য উপায় না পেত তাহলে লটারিই করত। আর তারা যদি (নামাযের জন্য মসজিদের প্রতি) সকাল-সকাল আসার মাহাত্ম জানত, তাহলে অবশ্যই তার জন্য প্রতিযোগিতা করত। আর যদি এশা ও ফজরের নামাযের মাহাত্ম তারা জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে চলেও তারা উভয় নামাযে উপস্থিত হত।” (বুখারী ৬১৫নং,মুসলিম, সহীহ ৪৩৭নং)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি এশার নামায জামাআতের সঙ্গে পড়ল, সে যেন অর্ধরাত্রি (নফল) নামায পড়ল। আর যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতের সাথে পড়ল, সে যেন পুরো রাত্রিই নামায পড়ল।” (মালেক, মুঅত্তা, মুসলিম, সহীহ ৬৫৬নং, আবূদাঊদ, সুনান)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের জামাআতের নামায একাকী নামাযের তুলনায় ২৫ গুণ অধিক মর্যাদা রাখে। আর রাত্রি ও দিনের ফিরিশ্তা ফজরের নামাযে একত্রিত হন।”
উক্ত হাদীস বর্ণনার পর আবূ হুরাইরা বলেন, ‘তোমাদের ইচ্ছা হলে তোমরা পড়ে নাও :
(إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُوْداً)
অর্থাৎ, নিশ্চয় ফজরের নামাযে ফিরিশ্তা হাযির হয়। (কুরআন মাজীদ ১৭/৭৮) (বুখারী ৬৪৮, নাসাঈ, সুনান, জামে ২৯৭৪নং)
নবী (ﷺ) বলেন, “(ফজরের সময়) যে ব্যক্তি (স্বগৃহে) ওযু করে। অতঃপর মসজিদে এসে ফজরের (ফরয) নামাযের পূর্বে দুই রাকআত নামায পড়ে। অতঃপর বসে (অপেক্ষা ক’রে) ফজরের নামায (জামাআতে) পড়ে, সেই ব্যক্তির সেদিনকার নামায নেক লোকদের নামায রুপে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর তার নাম পরম করুণাময় (আল্লাহর) প্রতিনিধিদলের তালিকাভুক্ত হয়।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৪১৩নং)
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের নামায (জামাআতে) পড়ে, সে ব্যক্তি (সন্ধ্যা পর্যন্ত) আল্লাহর দায়িত্বে থাকে।” (মুসলিম, সহীহ ৬৫৭, তিরমিযী, সুনান, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, জামে ৬৩৪৩নং)
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতে পড়ে, অতঃপর সূর্যোদয় অবধি বসে আল্লাহর যিক্র করে তারপর দুই রাকআত নামায পড়ে, সেই ব্যক্তির একটি হজ্জ ও উমরার সওয়াব লাভ হয়।” বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বললেন, “পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ।” অর্থাৎ কোন অসম্পূর্ণ হজ্জ-উমরার সওয়াব নয় বরং পূর্ণ হজ্জ-উমরার সওয়াব। (তিরমিযী, সুনান, সহিহ তারগিব ৪৬১নং)
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “ইসমাঈলের বংশধরের চারটি মানুষকে দাসত্বমুক্ত করা অপেক্ষা ফজরের নামাযের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত যিক্রকারী দলের সাথে বসাটা আমার নিকট অধিক প্রিয়। অনুরুপ চারটি জীবন দাসমুক্ত করার চেয়ে আসরের নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যিক্রকারী সম্প্রদায়ের সাথে বসাটা আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, সহিহ তারগিব ৪৬২নং)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ফজরের নামায জামাআতে পড়ার জন্য কয়েকটি জিনিস জরুরী:
- আল্লাহর আযাবের ভয় এবং তার সওয়াবের লোভ মনের মাঝে স্থান দিতে হবে।
- অবৈধ কাজে তো নয়ই; বরং বৈধ কাজেও বেশী রাত না জেগে আগে আগে ঘুমাতে হবে।
- জামাআত ধরার পাক্কা এরাদা হতে হবে।
- ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় এমন অসীলা ব্যবহার করতে হবে; যেমন এলার্ম ঘড়ি, কোন সুহৃদ সাথী ইত্যাদি।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, দুনিয়ার কাজের জন্য ফজরের আগেও উঠতে মানুষ অসুবিধা বোধ করে না, অথচ যত অসুবিধা বোধ করে আল্লাহর কাজে যথা সময়ে জাগতে। সুতরাং এমন মানুষের এমন অবহেলা তার ঈমানী দুর্বলতার পরিচয় নয় কি?
এখানে প্রসঙ্গত: ফজরের নামায যথা সময়ে না পড়ার যে বিধান, সে সম্পর্কিত একটি ফতোয়া উল্লেখ করা সমীচীন বলে মনে করি।
প্রত্যেক মুসলিমের জন্য প্রত্যেক নামায তার যথাসময়ে মসজিদে জামাআত সহকারে আদায় করা ওয়াজেব। আর প্রত্যেক সেই বিষয় থেকে দূরে থাকা জরুরী, যে বিষয় তাকে কোন নামায তার নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা থেকে বাধা দিতে পারে। বিশেষ করে ফজরের নামাযের জন্য বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিৎ, যাতে ঘুমিয়ে থেকে জামাআত ছুটে না যায় বা তার সময় পার না হয়ে যায়। পক্ষান্তরে ফজরের নামাযকে কোন মুসলিমের জন্য ভারী মনে করা উচিৎ নয়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “মুনাফিকের জন্য সবচেয়ে বেশী ভারী নামায হল, এশা ও ফজরের নামায। ঐ উভয় নামাযে কি রাখা আছে তা যদি ওরা জানতো তাহলে হাঁটু গেড়ে হলেও তার জামাআতে এসে উপস্থিত হত।” (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
সুতরাং এমন সব উপায় ও অসীলা অবলম্বন করা উচিৎ, যাতে যথা সময়ে উঠে ফজরের নামায জামাআত সহকারে পড়া সহ্জ হয়। যেমন সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়া, বেশী রাত না জাগা, কাউকে জাগিয়ে দিতে অনুরোধ করা, এলার্ম ঘড়ি ব্যবহার করা, ইত্যাদি।
এত বেশী রাত জেগে কুরআন তেলাওয়াত বা কোন ইলমী আলোচনা করাও বৈধ নয়, যার ফলে ফজরের নামায ছুটে যাওয়ার ভয় থাকে। সুতরাং টিভি-ভিসিআর দেখে, তাস খেলে অথবা অন্য কোন অবৈধ কারণে রাত জেগে ফজরের নামায নষ্ট করা যে কত বড় পাপের কাজ -তা অনুমেয়। পক্ষান্তরে যদি ইচ্ছা করে কেউফজরের আযান শুনেও না ওঠে, অথবা তাকে জাগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও না ওঠে, পরন্তু যে জাগিয়ে দেয় তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়, অথবা ইচ্ছা করেই ঘড়িতে এলার্ম ফজরের সময় না দিয়ে সূর্য উদয় হওয়ার পর ঠিক তার ডিউটির সময়ে দেয়, তাহলে এমন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট থেকে শাস্তির উপযুক্ত এবং শাসন কর্তৃপক্ষের নিকটেও শাস্তিযোগ্য।
আর ইচ্ছাকৃতভাবে বিনা ওযরে ফজরের নামায সূর্য ওঠার পর আদায় করলেও যথাসময়ে নামায ত্যাগ করার জন্য (বহু উলামার ফতোয়া মতে) সে কাফের হয়ে যাবে। কারণ, মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমাদের ও তাদের (কাফেরদের) মাঝে চুক্তি হল নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করবে সে কাফের হয়ে যাবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান) আর মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন, “নামাযীদের জন্য রয়েছে ‘ওয়াইল’ দোযখ; যে নামাযীরা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন।” (সূরা মাঊন) অর্থাৎ, যারা নামায যথাসময়ে আদায় করে না। (দ্র: ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৫২, ৩৬৫)
অতএব গাফলতি ছাড়cন এবং যে কোন প্রকারে ফজর ও অন্যান্য নামায যথাসময়ে আদায় করুন। আল্লাহ আমাদেরকে খাঁটি মুসলমান করুন এবং আমাদের নামায কবুল করে নিন। আমীন।
- জায়গার গুরুত্ব হিসাবে জামাআতের সওয়াব কম-বেশী হয়ে থাকে; যেমন মাসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী, বায়তুল মাকদেস, মসজিদে কুবা প্রভৃতি।
- অমসজিদের তুলনায় মসজিদের জামাআতে সওয়াব বেশী। অবশ্য জনহীন মরুভূমীতে রুকূ-সিজদাহ ইত্যাদি পরিপূর্ণরুপে করলে তার সওয়াব ৫০ গুণ বেশী। আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, জামাআতে পড়া নামায পঁচিশটি নামাযের সমতুল্য। আর যদি কেউ সেই নামায কোন জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে এবং তার রুকু ও সিজদা পূর্ণরুপে আদায় করে, তবে ঐ নামায পঞ্চাশটি নামাযের সমমানে পৌঁছায়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৬০, সহিহ তারগিব ৪০৭নং)
- বাসা থেকে মসজিদ যত দূরে হবে, পদক্ষেপ হিসাবে জামাআতের সওয়াব তত বেশী হবে। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫৬নং)
- জামাআতের লোকসংখ্যা যত বেশী হবে, তার সওয়াবও তত বেশী হবে।
- তাকবীরে তাহ্রীমা সহ্ পূর্ণ নামাযের জামাআতের সওয়াব কিছু অংশ বাদ যাওয়া নামাযের জামাআতের সওয়াব অপেক্ষা বেশী।
- নামায অনুযায়ীও জামাআতের সওয়াব কম-বেশী হয়ে থাকে। যেমন, ফজরের জামাআত এশার তুলনায় এবং এশার জামাআত অন্যান্য ওয়াক্তের জামাআতের তুলনায় সওয়াবে অধিক বেশী।
স্বাধীন জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম পুরুষের জন্য সুস্থতা-অসুস্থতা, ঘরে-সফরে, বিপদে-নিরাপদে সর্বাবস্থায় যথাসাধ্য জামাআতে শামিল হয়ে নামায আদায় করা ওয়াজেব।
অবশ্য জামাআত কেবল ফরয নামাযের জন্য ওয়াজেব। এ ছাড়া (মুআক্কাদাহ ও গায়র মুআক্কাদাহ) সুন্নত এবং নফল নামাযের জন্য; যেমন সুনানে রাওয়াতেব, বিত্র, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ, তাহিয়্যাতুল উযূ, তাহিয়্যাতুত ত্বাওয়াফ, স্বালাতুত তাসবীহ্ (?) স্বালাতুত তাওবাহ্, ইশরাক, চাশত, আওয়াবীন প্রভৃতি নামাযের জন্য জামাআত বিধিবদ্ধ নয়।
পক্ষান্তরে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের নামায, ঈদ, ইস্তিস্কা ও তারাবীহ্র নামাযের জন্য জামাআত সুন্নত। যেমন কাযা ও তাহাজ্জুদের নামাযেও জামাআত চলে। আর এ সব কথা যথাস্থানে আলোচিত হবে ইন শাআল্লাহ।
আবার সাধারণ অতিরিক্ত নফল নামায জামাআত করে পড়া যায়। দলীল স্বরুপ দেখুন, বুখারী ১১৮৬ ও মুসলিম ৫৬৮নংহাদীস।
(ঈদের নামায ছাড়া অন্য নামাযের জন্য) মহিলাদের মসজিদের জামাআতে শামিল হওয়ার চাইতে স্বগৃহে; বরং গৃহের মধ্যে সবচেয়ে বেশী অন্দর মহলে নামায পড়াই হল উত্তম। মহানবী (ﷺ) বলেন, “মহিলাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মসজিদ তার গৃহের ভিতরের কক্ষ।” (আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২০৯, বায়হাকী, জামে ৩৩২৭নং)
তিনি বলেন, “মহিলা স্বগৃহে থেকে তার রবের অধিক নিকটবর্তী থাকে।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৩৩৯, ৩৪১নং)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, “মহিলা তার ঘরে থেকে রবের ইবাদত করার মত ইবাদত আর অন্য কোথাও করতে পারে না।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৩৪২নং)
তিনি মহিলাদেরকে সম্বোধন করে বলেন, “তোমাদের খাস কক্ষের নামায সাধারণ কক্ষে নামায অপেক্ষা উত্তম, তোমাদের সাধারণ কক্ষের নামায বাড়ির ভিতরে কোন জায়গায় নামায অপেক্ষা উত্তম এবং তোমাদের বাড়ির ভিতরের নামায মসজিদে জামাআতে নামায অপেক্ষা উত্তম।” (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, বায়হাকী, জামে ৩৮৪৪নং)
উল্লেখ্য যে, সাহাবিয়া উম্মে হুমাইদ উক্ত হাদীস শোনার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাঁর বাড়ির সব চাইতে অধিক অন্দর ও অন্ধকার কামরাতে নামায পড়েছেন।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “মহিলা হল গোপনীয় জিনিস। বাইরে বের হলে শয়তান তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখতে থাকে।” (ত্বাবারানী, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, সহিহ তারগিব ৩৩৯, ৩৪১, ৩৪২নং)
এ তো ইবলীস জিনের কথা। পক্ষান্তরে বর্তমান যুগের দ্বীনহীন যুবকদল; যারা মহিলার জন্য হাজার শয়তান অপেক্ষা বেশী ক্ষতিকর, তাদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে গোপনে থাকা নারীর একান্ত কর্তব্য।
তবে যদি সে একান্ত মসজিদের জামাআতে শরীক হয়ে নামায পড়তে চায়, তাহলে তাতে অনুমতি আছে। অবশ্য এর জন্য কয়েকটি শর্ত আছে:
- মসজিদের পথে যেন (লম্পটদের) কোন অশুভ ফিতনার আশঙ্কা না থাকে।
- মহিলা যেন সাদাসিধাভাবে পর্দার সাথে আসে। অর্থাৎ, সেজেগুজে প্রসাধন-সেন্ট লাগিয়ে না আসে। (নামাযীর লেবাস দ্রষ্টব্য।)
- এতে যেন তার স্বামীর অনুমতি থাকে।
স্বামীর জন্যও উচিৎ, যদি তার স্ত্রী মসজিদে যেতে অনুমতি চায়, তাহলে তাকে বাধা না দেওয়া। সাহাবাদের মহিলাগণ মসজিদে গিয়ে জামাআতে নামায আদায় করতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘মুমিন মহিলারা আল্লাহর রসূল (ﷺ)-এর সাথে ফজরের নামায পড়ার জন্য দেহে চাদর জড়িয়ে হাযির হত। অতঃপর নামায শেষ হলে তারা নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেত, আবছা অন্ধকারে তাদেরকে কেউ চিনতে পারত না।’ (বুখারী ৫৭৮,মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৪২৩, তিরমিযী, সুনান ১৫৩, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৬৬৯নং)
পরন্তু এতে মসজিদের দরস ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করার উপকারিতাও রয়েছে।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “যদি তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের কাছে রাত্রে মসজিদে আসার অনুমতি চায়, তাহলে তোমরা তাদেরকে অনুমতি দিয়ে দাও।” (বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান)
“আল্লাহর বা¦দীদেরকে মসজিদে আসতে বারণ করো না, যদিও তাদের ঘরই তাদের জন্য ভালো।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৫৬৭,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৭৪৫৮নং)
“আল্লাহর বা¦দীদেরকে মসজিদে আসতে বারণ করো না, তবে তারা যেন খোশবূ ব্যবহার না করে সাদাসিধা ভাবে আসে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, জামে ৭৪৫৭নং)
একদা আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বললেন, আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “তোমাদের মহিলারা যদি মসজিদে যেতে অনুমতি চায়, তাহলে তাদেরকে বাধা দিও না।” এ হাদীস শোনার পর তাঁর ছেলে বিলাল বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমরা ওদেরকে বাধা দেব।’ এ কথা শুনে আব্দুল্লাহ তার মুখোমুখি হয়ে এমন গালি দিলেন, যেমনটি আর কোনদিন শোনা যায়নি। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমি তোকে আল্লাহর রসূল (ﷺ) থেকে খবর দিচ্ছি। আর তুই বলিস, ‘আল্লাহর কসম! আমরা ওদেরকে বাধা দেব।’ (মুসলিম, সহীহ ৪৪২নং)
অবশ্য সত্যপক্ষে ফিতনা, নজরবাজি বা নষ্টি ফষ্টির আশঙ্কা থাকলে অথবা মহিলা সেজেগুজে বেপর্দায় কিংবা সেন্ট ব্যবহার করে যেতে চাইলে অভিভাবক বা স্বামী তাকে অনুমতি দেবে না।
অনুরুপভাবে যে মহিলারা জামাআতে হাযির হবে, তাদের জন্য জরুরী এই যে, তারা পুরুষদের ইমামের সালাম ফেরা মাত্র উঠে বাড়ি রওনা দেবে। যাতে পুরুষদের সাথে মসজিদের দরজায় বা পথে কোন প্রকার দেখা-সাক্ষাৎ না হয়। হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ)-এর যুগে মহিলারা যখন ফরয নামাযের সালাম ফিরত, তখন তারা উঠে চলে যেত। আর রসূল (ﷺ) এবং তাঁর সাথে অন্যান্য নামাযীরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেন। অতঃপর আল্লাহর রসূল উঠে গেলে পুরুষরা উঠে যেত।’ (বুখারী ৮৬৬, ৮৭০নং)
অবশ্য মহিলাদের পর্দাযুক্ত পৃথক মুসাল্লা ও পৃথক দরজা হলে সালাম ফেরা মাত্র সত্বর উঠে যাওয়া জরুরী নয়। (আনিঃ ১/২৮৭)
প্রকাশ যে, মহিলা সঙ্গে তার ছোট শিশুকেও মসজিদে আনতে পারে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যাতে মসজিদের কোন জিনিস, কুরআন, পবিত্রতা আদি নষ্ট এবং নামাযীদের কোন প্রকার ডিষ্টার্ব না করে।
মসজিদের বর্ণনায় মসজিদে যাওয়ার কিছু আদব আলোচিত হয়েছে। জামাআতের প্রাসঙ্গিকতায় এখানে আরো কিছু কথা উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি।
জামাআতে হাযির হওয়ার জন্য বাসা থেকে ওযূ করে বিনয়ের সাথে বের হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ, বাসা থেকে ওযূ করে নামাযে যাওয়ার কথা একাধিক হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে।
এ সময়ে সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লেবাস পরিধান করা কর্তব্য। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর আদেশ রয়েছে। (কুরআন মাজীদ ৭/৩১)
সর্বশরীর থেকে সর্বপ্রকার দুর্গন্ধ দূর করে নেওয়া জরুরী। লেবাসের, মুখের, ঘামের, কাঁচা পিঁয়াজ ও রসুন তথা বিড়ি-সিগারেটের দুর্গন্ধ দূর করে নেওয়া আবশ্যিক। যাতে সে গন্ধে ফিরিশ্তা ও পাশের নামাযী কষ্ট না পান এবং ঐ গন্ধ-ওয়ালার প্রতি নামাযীদের মনে মনে ঘৃণার উদ্রেক না হয়।
চলার পথে দুইহাতের আঙ্গুলসমূহের মাঝে খাজাখাজি করা নিষিদ্ধ। কারণ, নামাযের জন্য চলাও নামায পড়ার মতই গুরুত্ব রাখে। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৬২নং)
চলার সময় নামাযী যেন এদিক-ওদিক না তাকায়, হৈ-হাল্লা না করে, নামাযের কিছু অংশ ছুটে গেলেও যেন না দৌড়ে। বরং ভদ্রতা ও গম্ভীরতার সাথে তাড়াহুড়ো না করে ধীরে-সুস্থে শান্তভাবে জামাআতে শামিল হয়।
চলার পথে আল্লাহর যিক্র মনে রাখা কর্তব্য। (মসজিদে যাওয়ার আদব দ্রষ্টব্য)
উল্লেখ্য যে, মসজিদে প্রবেশ করার সময় (জুমআর খুতবার আযান ছাড়া অন্য) আযান হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আযানের উত্তর দিয়ে দরুদ-দুআ পড়ে তারপর তাহিয়্যাতুল মাসজিদ অথবা অন্য সুন্নত পড়বে নামাযী।
ইমাম ছাড়া কম পক্ষে একটি নামাযী হলে জামাআত গঠিত হবে; চাহে সে নামাযী জ্ঞানসম্পন্ন শিশু হোক অথবা মহিলা।
মহানবী (ﷺ) ইবনে আব্বাসকে নিয়ে জামাআত করে (তাহাজ্জুদ) নামায পড়েছেন। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আসু:) তিনি সফরে উদ্যত দুইজন লোককে বলেছিলেন, “নামাযের সময় উপস্থিত হলে তোমাদের একজন আযান দেবে এবং তোমাদের মধ্যে যে বড় সে ইমামতি করবে।” (বুখারী ৬৩০নং, মুসলিম, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান)
নামাযের এক রাকআত ইমামের সাথে পেলে জামাআতের পূর্ণ ফযীলত পাওয়া যায়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইমামের সাথে এক রাকআত নামায পেয়ে গেল, সে নামায পেয়ে গেল।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৪১২নং)
তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি জুমুআহ অথবা অন্য নামাযের এক রাকআত পেয়ে গেল, সে নামায পেয়ে গেল।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান ১১২৩নং)
অবশ্য ইমামের সালাম ফিরার আগে তাকবীরে তাহ্রীমা দিয়ে নামাযের যেটুকু অংশ পাওয়া যায় সেটুকুকে ভিত্তি করে জামাআতে শামিল হওয়া যায়। যেহেতু মহানবী (ﷺ) বলেন, “নামাযের ইকামত হয়ে গেলে তোমরা দৌড়ে এস না। বরং তোমরা স্বাভাবিকভাবে চলে এস। আর তোমাদের মাঝে যেন স্থিরতা থাকে। অতঃপর যেটুকু নামায পাও তা পড়ে নাও এবং যা ছুটে যায় তা পুরা করে নাও।” (মুসলিম, সহীহ ৬০২)
উল্লেখ্য যে, জামাআত করার মত লোক থাকলেও শেষ রাকআতে রুকূর পর বা শেষ তাশাহ্হুদে জামাআতে শামিল না হয়ে ইমামের সালাম ফিরার পর দ্বিতীয় জামাআত করা উত্তম নয়। উত্তম হল, ইমামের সালাম ফিরার আগে পর্যন্ত জামাআতে শামিল হওয়া। (ফাতাওয়া মুহিম্মাহ্ তাতাআল্লাকু বিস-স্বালাহ্, ইবনে বায ৭৬পৃ:)
কেউ কেউ বলেন, সঙ্গে জামাআত করার মত লোক থাকলে এবং ইমাম শেষ তাশাহ্হুদে থাকলে জামাআতে শামিল না হয়ে তাদের সালাম ফিরার পর নতুনভাবে জামাআত করে নামায পড়া উত্তম। কেননা, মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইমামের সাথে এক রাকআত নামায পেয়ে গেল, সে নামায পেয়ে গেল।” আর তার মানেই হল যে এক রাকআত পেল না বরং সিজদাহ বা তাশাহহুদ পেল, সে নামায পেল না। অতএব নতুন করে জামাআত করলে প্রথম থেকে জামাআত পাওয়া যাবে এবং পূর্ণ নামাযও পাওয়া যাবে। আর এটাই হবে উত্তম। (ফাতাওয়া তাতাআল্লাকু বিজামাআতিল মাসজিদ ৫০পৃ:) অতএব আল্লাহই ভালো জানেন।
মসজিদের জামাআত ছুটে গেলে বা জামাআত শেষ হওয়ার পর মসজিদে এলে যদি অন্য লোক থাকে তাহলে তাদের সাথে মিলে একজন ইমাম হয়ে জামাআত করে নামায পড়বে।
যদি আর কোন লোকের উপস্থিতির আশা না থাকে, তাহলে অন্য মসজিদে জামাআত না হওয়ার ধারণা পাকা হলে সেখানে গিয়ে জামাআতে নামায পড়বে।
তা না হলে মসজিদে একাকী নামায পড়ার চাইতে বাড়িতে ফিরে গিয়ে নিজের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে জামাআত করে নামায পড়া উত্তম। মহানবী (ﷺ) এরুপ করেছেন বলে প্রমাণ আছে। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ১৫৫পৃ:, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ৫৬পৃ:) অবশ্য বাড়িতে জামাআত করার মত লোক না থাকলে ফরয নামায বাড়ির চেয়ে মসজিদে পড়াই উত্তম। কারণ, নামাযের উদ্দেশ্যে মসজিদে যাওয়ার পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে এবং ফরয নামায মসজিদে পড়ার আদেশ আছে।