নামাজ জামাআত সহকারে আদায় করা ওয়াজেব। বিধায় বিনা ওজরে জামাআত ত্যাগ করা কাবীরাহ্ গুনাহ। মহান আল্লাহ বলেন,
(وَأَقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوْا مَعَ الرَّاكِعِيْنَ)
অর্থাৎ, তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকূকারিগণের সাথে রুকূ কর। (কুরআন মাজীদ ২/৪৩)
বরং জামাআতে নামায না পড়লে নামায কবুল নাও হতে পারে। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আযান শোনে অথচ (মসজিদে জামাআতে) উপস্থিত হয় না, সে ব্যক্তির কোন ওজর ছাড়া (ঘরে নামায পড়লেও তার) নামাযই হয় না।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৪৫, সহিহ তারগিব ৪২২নং)
“যে ব্যক্তি মুআযযিনের (আযান) শোনে এবং কোন ওজর (ভয় অথবা অসুখ) তাকে জামাআতে উপস্থিত হতে বাধা না দেয়, তাহলে যে নামায সে পড়ে সে নামায কবুল হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫১নং)
“যে কোন গ্রাম বা মরু-অঞ্চলে তিনজন লোক বাস করলে এবং সেখানে (জামাআতে) নামায কায়েম না করা হলে শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে ফেলে। সুতরাং তোমরা জামাআতবদ্ধ হও। অন্যথা ছাগ পালের মধ্য হতে নেকড়ে সেই ছাগলটিকে ধরে খায়, যে (পাল থেকে) দূরে দূরে থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৫১১, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৪৫, সহিহ তারগিব ৪২২নং)
যারা নামাযের জামাআতে মসজিদে হাজির হয় না, মহানবী (ﷺ) তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “মুনাফিকদের পক্ষে সবচেয়ে ভারী নামায হল এশা ও ফজরের নামায। ঐ দুই নামাযের কি মাহাত্ম আছে, তা যদি তারা জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও অবশ্যই তাতে উপস্থিত হত। আমার ইচ্ছা ছিল যে, কাউকে নামাযের ইকামত দিতে আদেশ দিই, অতঃপর একজনকে নামায পড়তেও হুকুম করি, অতঃপর এমন একদল লোক সঙ্গে করে নিই; যাদের সাথে থাকবে কাঠের বোঝা। তাদের নিয়ে এমন সম্প্রদায়ের নিকট যাই, যারা নামাযে হাজির হয় না। অতঃপর তাদেরকে ঘরে রেখেই তাদের ঘরবাড়িকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিই।” (বুখারী ৬৫৭, মুসলিম, সহীহ ৬৫১নং)
হযরত উসামা বিন যায়দ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “লোকেরা জামাআত ত্যাগ করা হতে অবশ্য অবশ্যই বিরত হোক, নচেৎ আমি অবশ্যই তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেব।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, সহিহ তারগিব ৪৩০নং)
কোন অন্ধ মানুষকেও মহানবী (ﷺ) জামাআতে অনুপস্থিত থেকে ঘরে নামায পড়ার অনুমতি দেননি। অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূম (রাঃ) মহানবী (ﷺ)-এর দরবারে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! মসজিদে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার মত আমার উপযুক্ত মানুষ নেই। তাছাড়া মদ্বীনায় প্রচুর হিংস্র প্রাণী (সাপ-বিছা-নেকড়ে প্রভৃতি) রয়েছে। (মসজিদের পথে অন্ধ মানুষের ভয় হয়)। সুতরাং আমার জন্য ঘরে নামায পড়ার অনুমতি হবে কি?’ আল্লাহর নবী (ﷺ) তাঁর ওজর শুনে তাঁকে ঘরে নামায পড়ার অনুমতি দিলেন। তিনি চলে যেতে লাগলে মহানবী (ﷺ) তাঁকে ডেকে বললেন, “কিন্তু তুমি কি আযান ‘হাইয়্যা আলাস স্বালাহ্,হাইয়্যা আলাল ফালাহ্’ শুনতে পাও।” তিনি উত্তরে বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ মহানবী (ﷺ) বললেন, “তাহলে তুমি (মসজিদে) উপস্থিত হও, তোমার জন্য কোন অনুমতি পাচ্ছি না।” (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫৫২, ৫৫৩নং)
যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদলের সম্মুখেও জামাআত মাফ নয়। মহান আল্লাহ বিধিবদ্ধ করলেন স্বালাতে খওফ। (কুরআন মাজীদ ৪/১০২) জামাআত সহকারে নামায একান্ত বাঞ্জিত ও জরুরী কর্তব্য না হলে ঐ ভীষণ সময়ে মরণের মুখে তিনি তা মাফ করতেন।
তদনুরুপ জামাআত বাঞ্জিত বলেই প্রয়োজনে নামায জমা করে পড়া বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। মসজিদের পথে শত্রুর ভয় হলে, প্রচুর ঠান্ডা বা বৃষ্টি হলে অথবা সফরে থাকলে যোহ্র-আসর এবং মাগরেব-এশাকে জমা করে পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে জামাআতের ফযীলত লাভ করার জন্যই।
জামাআত ত্যাগ করা মুমিনের গুণ নয়; বরং তা মুনাফিকের গুণ। মহান আল্লাহ এদের গুণ বর্ণনা করে বলেন,
(উوَلاَ يَأْتُوْنَ الصَّلاَةَ إِلاَّ وَهُمْ كُسَالَى وَلاَ يُنْفِقُوْنَ إِلاَّ وَهُمْ كَارِهُوْنَ)
অর্থাৎ, ---ওরা (মুনাফেকরা) নামাযে শৈথিল্যর সাথে হাজির হয় এবং অনিচ্ছাকৃত ভাবেই দান করে থাকে। (কুরআন মাজীদ ৯/৫৪)
বিশেষ করে এশা ও ফজরের নামায মুনাফেকের জন্য অধিক ভারী। আর একথা পূর্বে এক হাদীসে আলোচিত হয়েছে।
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমরা যখন কোন লোককে ফজরের নামাযে অনুপস্থিত দেখতাম, তখন তার প্রতি কু ধারণা করতাম।’ (ত্বাবরানি, ইবনে আবী শাইবা, বাযয়ীফ, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ২/৪০)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাল আল্লাহর সাথে মুসলিম হয়ে সাক্ষাৎ করতে আনন্দবোধ করে তার উচিৎ, যেখানে আহবান করা হয় সেখানে (অর্থাৎ মসজিদে) ঐ নামাযগুলির হিফাযত করা। অবশ্যই আল্লাহ তাআলা তোমাদের নবীর জন্য বহু হেদায়াতের পথ ও আদর্শ বিধিবদ্ধ করেছেন এবং ঐ (নামায)গুলি হেদায়াতের পথ ও আদর্শর অন্তর্ভুক্ত। যদি তোমরা তোমাদের স্বগৃহে নামায পড়ে নাও; যেমন এই পশ্চাদগামী তার স্বগৃহে নামায পড়ে থাকে, তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শ ও তরীকা বর্জন করে ফেলবে। আর যদি তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শ ও তরীকা বর্জন করে ফেল, তাহলে তোমরা ভ্রষ্ট হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে পবিত্রতা অর্জন (ওযু) করে এই মসজিদসমূহের কোন মসজিদের প্রতি (যেতে) প্রবৃত্ত হয়, আল্লাহ তার প্রত্যেক পদক্ষেপের পরিবর্তে একটি করে নেকী লিপিবদ্ধ করেন, এর দ্বারায় তাকে এক মর্যাদায় উন্নীত করেন ও এর দ্বারায় তার একটি পাপ হরাস করেন। আমরা দেখেছি যে, বিদিত কপটতার কপট (মুনাফিক) ছাড়া নামায থেকে কেউ পশ্চাতে থাকত না। আর মানুষকে দুটি লোকের কাঁধে ভর করে হাঁটিয়ে এনে কাতারে খাড়া করা হত।’ (মুসলিম, সহীহ ৬৫৪নং)
হযরত ওসমান বিন আফফান (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তির মসজিদে থাকা অবস্থায় আযান হয়, অতঃপর বিনা কোন প্রয়োজনে বের হয়ে যায় এবং ফিরে আসার ইচ্ছা না রাখে, সে ব্যক্তি মুনাফিক।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, সহিহ তারগিব১৫৭নং)
যারা আহবানকারী মুআযযেনের আযানে সাড়া দিয়ে জামাআতে উপস্থিত হয় না, কিয়ামতে তাদের বিশেষ অবস্থা ও শাস্তি রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
(يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَّيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ فَلاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ، خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ، وَقَدْ كَانُوْا يُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ وَهُمْ سَالِمُوْنَ)
অর্থাৎ, যেদিন পদনালী উন্মুক্ত করা হবে এবং ওদেরকে সিজদা করার জন্য আহবান করা হবে, কিন্তু ওরা তা করতে সক্ষম হবে না। হীনতাগ্রস্ত হয়ে ওরা ওদের দৃষ্টি অবনত করবে। অথচ যখন ওরা সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল, তখন তো ওদেরকে সিজদা করতে আহবান করা হয়েছিল। (কুরআন মাজীদ ৬৮/৪২-৪৩) (বুখারী ৪৯১৯ নং)
এমন কি মসজিদে জামাআতে উপস্থিত থেকে মুআযযিনের আযান শুনেও যে মসজিদ থেকে বের হয়ে যায়, সে আল্লাহর নবীর অবাধ্য ও নাফরমান রুপে পরিগণিত হয়। একদা মসজিদে আযান হলে এক ব্যক্তি সেখান থেকে উঠে চলে যেতে লাগল। সে মসজিদ থেকে বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আবূ হুরাইরা (রাঃ) তার দিকে নিনিGমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। পরিশেষে তিনি বললেন, ‘আসলে এ ব্যক্তি তো আবূল কাসেম (ﷺ)-এর নাফরমানী করল।’ (মুসলিম, সহীহ ৬৫৫নং) আর এ কথা বিদিত যে, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে, সে আসলে স্পষ্টরুপে ভ্রষ্ট হয়ে যায়।” (কুরআন মাজীদ ৩৩/৩৬)
অবশ্য যদি কেউতার জরুরী কাজে; যেমন, প্রস্রাব-পায়খানা বা ওযূ করতে মসজিদের বাইরে যায়, তাহলে তা নাফরমানীর আওতাভুক্ত নয়। (মাজমূউফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১২/২০০)
আল্লাহর নবী (ﷺ)-এর সাহাবাগণও ফরয নামাযের জন্য জামাআতে উপস্থিত হওয়াকে ওয়াজেব মনে করতেন।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে, বিদিত কপটতার কপট (মুনাফিক) ছাড়া (জামাআতে) নামায থেকে কেউ পশ্চাতে থাকত না।’ (মুসলিম ৬৫৪নং)
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ, আবূ মূসা আশআরী, আলী বিন আবী তালেব, আবূ হুরাইরা, আয়েশা ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আযান শোনে অথচ (মসজিদে জামাআতে) উপস্থিত হয় না, সে ব্যক্তির কোন ওজর ছাড়া (ঘরে নামায পড়লেও তার) নামাযই হয় না।’ (তিরমিযী, সুনান ২১৭নং, যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম )
ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, যে ব্যক্তি রোযা রাখে, তাহাজ্জুদ পড়ে; কিন্তু জামাআত ও জুমআয় হাজির হয় না। উত্তরে তিনি বললেন, ‘এ অবস্থায় মারা গেলে সে জাহান্নামবাসী হবে!’ (তিরমিযী, সুনান ২১৮নং, এটির সনদ দুর্বল)
আত্বা বিন আবী রাবাহ্ (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টি কোন শহর বা গ্রামবাসীর জন্য এ অনুমতি নেই যে, সে আযান শোনার পর জামাআতে নামায ত্যাগ করে।’
হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন, ‘কারো আম্মা যদি তাকে মায়া করে এশার নামায জামাআতে পড়তে বারণ করে, তাহলে সে তার ঐ বারণ শুনবে না।’ (বুখারী)
আওযায়ী (রহঃ) বলেন, ‘জুমুআহ ও জামাআত ত্যাগ করার ব্যাপারে পিতার আনুগত্য নেই, চাহে সে আযান শুনতে পাক, আর না-ই পাক।’
অবশ্য জেনে রাখা ভাল যে, যে ব্যক্তি জামাআত ছাড়াই নামায পড়ে, তার নামায শুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জামাআত ত্যাগ করার জন্য সে (কাবীরা) গুনাহগার হয়। তবে তার ঐ নামায কবুল হওয়া ও না হওয়ার ব্যাপার তো আল্লাহর কাছে। (মারা: ১৭২পৃ:)
জামাআতের আসল মর্যাদা ছিল সলফে সালেহীনের কাছে। তাঁরা জামাআতের এত গুরুত্ব দিতেন যে, তা ছুটে গেলে অথবা নষ্ট হয়ে গেলে কেউ কেউ কেঁদে ফেলতেন। একে অপরকে দেখা করে সান্তনা দিতেন।
সাঈদ বিন আব্দুল আযীয জামাআত ছুটে গেলে কাঁদতেন।
হাতেম আল-আসাম্ম বলেন, ‘একদা আমার এক নামাযের জামাআত ছুটে গেল। এর জন্য আবূ ইসহাক বুখারী আমাকে দেখা করতে এলেন। অথচ আমার কোন ছেলে মারা গেলে দশহাজারেরও বেশী লোক আমাকে দেখা করতে আসত। কেন না, মানুষের নিকট দুনিয়ার মসীবতের তুলনায় দ্বীনের মসীবত নেহাতই হাল্কা।’
নামাযের জামাআত কোনক্রমেই তাঁদের নিকট কোন পার্থিব জিনিসের সমতুল্য ছিল না; যে তুচ্ছ জিনিসের পশ্চাতে আমরা অনেক ক্ষেত্রে লালসার নিরলস প্রচেষ্টা নিয়ে অপেক্ষমাণ থাকি। যার জন্য কখনো বা নামায যথা সময়ে পড়তে পারি না। কেউবা তারই জন্য মূলেই নামায ত্যাগ করে বসে। ব্যবসা-বানিজ্য, কাজ-কারবার, খেলাধূলা, সরগরম মজলিসে আজেবাজে গল্প, রাজনৈতিক পরিকল্পনা, সংবাদ ও সমীক্ষা প্রভৃতি নামাযের জামাআত; কখনো বা নামায নষ্ট করে ফেলে বর্তমান যুগের বহু সংখ্যক মানুষের!
একদা মাইমূন বিন মিহ্রান মসজিদে এলেন। দেখলেন, নামায শেষ হয়ে গেলে নামাযীরা মসজিদ থেকে ফিরে গেছে। এ দেখে তিনি বললেন, ‘ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিঊন! অবশ্যই আমার নিকট এই জামাআতের মর্যাদা ইরাকের রাজত্ব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’
ইউনুস বিন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমার কি হল যে, মুরগী নষ্ট হলে আমি তার জন্য দু:খিত হ্ব, অথচ নামায (জামাআত) নষ্ট হলে তার জন্য দু:খিত হ্ব না?’
সলফে সালেহীন অধীর আগ্রহে অপেক্ষার পর আযান শুনলে মসজিদে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করতেন। যাতে ইমামের সাথে তাকবীরে তাহ্রীমা ছুটে না যায়, তার বিশেষ খেয়াল রাখতেন।
সাঈদ বিন মুসাইয়েব বলেন, ‘পঞ্চাশ বছর ধরে আমার নামাযের প্রথম তাকবীর ছুটেনি! আর পঞ্চা শ বছর ধরে নামাযে কোন মানুষের পিঠ দেখিনি।’ অর্থাৎ, পঞ্চাশ বছর যাবৎ তিনি প্রথম কাতারেই নামায পড়েছেন!
অকী’ বিন জার্রাহ্ বলেন, ‘প্রায় সত্তর বছর ধরে আ’মাশের প্রথম তাকবীর ছুটে নি!’
ইবনে সামাআহ্ বলেন, ‘যে দিন আমার আম্মা মারা যান, সে দিন ছাড়া চল্লিশ বছর ধরে আমার প্রথম তাকবীর ছুটে নি!’ (ফাযায়িলু অষামারাতুস স্বা লাতি মাআল জামাআহ্ ৬পৃ:)
ইবরাহীম নাখয়ী বলেন, ‘যখন কোন মানুষকে দেখবে, সে প্রথম তাকবীরের ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করছে, তখন তুমি তার ব্যাপারে হাত ধুয়ে নাও।’
আব্দুল আযীয বিন মারওয়ান আদব শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর ছেলে উমারকে মদ্বীনায় পাঠালেন। আর তার দেখাশোনা করার জন্য সালেহ্ বিন কায়সানকে চিঠি লিখলেন। তিনি তাকে নামায পড়তে বাধ্য করতেন। একদিন সে এক নামাযে পিছে থেকে গেলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে তোমাকে আটকে রেখেছিল?’ উমার বলল, ‘আমার দাসী আমার চুল আঁচড়াচ্ছিল।’ তিনি বললেন, ‘ব্যাপার এত দূর গড়িয়ে গেল যে, তোমার চুল আঁচড়ানো তোমার নামাযকে প্রভাবান্বিত করে ফেলল?’ এরপর সে কথা জানিয়ে তিনি তার আব্বা (আব্দুল আযীয)কে চিঠি লিখলেন। তা জেনে আব্দুল আযীয একটি দূত পাঠালেন এবং কোন কথা বলার আগেই সে দূত উমারের মাথা নেড়া করে দিল! (সিয়ারু আ’লামুন নুবালা’, ইমাম যাহাবী ৫/১১৬)
যে ব্যক্তি মসজিদে জামাআত সহকারে নামায পড়তে আসত না তাকে মক্কার আমীর আত্তাব বিন উসাইদ উমাবী (রাঃ) তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার ধমকি দিতেন। (গায়াতুল মারাম, ইযযুদ্দ্বীনহাশেমী ১/১৮-১৯)
হযরত আলী (রাঃ) প্রত্যহ্ রাস্তায় পার হওয়ার সময় ‘আস-স্বালাত, আস-স্বালাত’ বলে লোকেদেরকে ফজরের নামাযের জন্য জাগাতেন। (তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ৬৫০পৃ:) যেমন আজও সঊদী আরবে আযান হলেই নির্দিষ্ট অফিসের নিযুক্ত লোক ঐ একই কথা বলে নামাযের জন্য দোকান-পাট বন্ধ করতে তাকীদ করে থাকে। তাতে মুসলিমরা সাথে সাথে দোকান বন্ধ করে মসজিদে যায়। আর মুনাফিক ও কাফেররা যায় নিজ নিজ বাসায়। আর নামাযের সময়টুকু বন্ধ থাকে সমস্ত দোকান-পাট।
বলাই বাহুল্য যে, তাঁদের ও আমাদের মাঝে পার্থক্য রয়েছে বিরাট। তাঁদের নিকট নামাযের গুরুত্ব আমাদের তুলনায় অনেক বেশী। তাঁদের ছিল আগ্রহ্, আশা ও অধিক সওয়াব লাভের বাসনা। পক্ষান্তরে আমাদের মাঝে আছে পার্থিব প্রেম ও দুনিয়া লাভের কামনা। তাই আমরা নামাযের উপর দুনিয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি, আমাদের নিকট গুরুত্ব পায় পার্থিব ভোগ-বিলাস ও তার জন্য কর্ম-ব্যস্ততা।
অবশ্য এ কথা বলা অত্যুক্তি নয় যে, আমাদের জামাআতে হাজির হয়ে নামায না পড়া আমাদের দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক। আমাদের হৃদয়ে আল্লাহর সে তা’যীমনেই, আল্লাহর প্রতি সে প্রেম, ভক্তি ও ভয় নেই, তাঁর আদেশ ও অধিকার পালনে সে আগ্রহ্ ও উৎসাহ্ নেই, তাই আমরা এমন শৈথিল্য প্রদর্শন করতে লজ্জাও করি না।