সুপ্রিয় পাঠক, কেউ যদি আপনার কাছে আপনার মৃত পিতামহ বা পূর্বপুরুষের কোনো লিখিত দলিল উপস্থিত করে বলেন যে, আপনার বাড়ি বা জমি তিনি বিক্রয় বা দান করে গিয়েছেন তবে আপনি কি দলিলের বিশুদ্ধতা যাচাই ও নিশ্চয়তা ছাড়া বাড়ি বা জমি তাকে ছেড়ে দেবেন? যদি তিনি আপনার বাড়ি বা জমি দখলের জন্য আদালতে তার দলিল জমা দিয়ে মামলা করেন তবে আপনি কি বিচারককে দলিলটার বিশুদ্ধতা বিষয়ে নিশ্চিত হতে অনুরোধ করবেন না? যদি বিচারক আপনার পিতামহের নামের দলিল দেখেই তা মেনে নিয়ে রায় দেন তবে আপনি কি আপিল করবেন না?
আপনার প্রতিপক্ষ প্রচার মাধ্যম বা জাগতিক প্রভাব খাটিয়ে যদি এরূপ জাল দলিল আদালতে বা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং আপনাকেই পরের জমি দখলকারী বলে চিত্রিত করেন তবে আপনি কি নিজেকে অপরাধী বলে বিশ্বাস করে নেবেন? প্রচারণা, প্রতারণা বা জাগতিক প্রভাব খাটিয়ে হাজার হাজার মানুষকে প্রভাবিত করতে পারা কি কোনো দলিলের বিশুদ্ধতার প্রমাণ? জাগতিক কোনো দলিল যদি এরূপ অনুসন্ধান, তদন্ত ও নিশ্চয়তা ছাড়া কেউ গ্রহণ করেন বা তার ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড, সম্পত্তি হস্তান্তর ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নেন তবে আপনি তাকে কী বলবেন?
ধর্মগ্রন্থের বিষয়ে আরো অনেক বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ জাগতিক দলিলের জালিয়াতি বা ভুলের কারণে টাকা, সম্পত্তি বা দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন নষ্ট হয়। আর ধর্মীয় দলিলের জালিয়াতি বা ভুলের কারণে অনন্ত জীবন নষ্ট হয়।
একটা গ্রন্থ কোনো নবী বা ধর্মপ্রবর্তকের নামে প্রচারিত হলেই তাকে মেনে নেওয়া যায় না। গ্রন্থটা তাঁর লেখা কিনা এবং তাঁর থেকে বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত সূত্রে বর্ণিত কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। এছাড়া তিনি এটাকে ঐশী প্রেরণায় লেখা বই বা ধর্মগ্রন্থ হিসেবে দাবি ও প্রচার করেছেন কিনা সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে হবে। এজন্য বাইবেলীয় পুস্তকগুলোর বিষয়ে আমাদের দুটো বিষয় নিশ্চিত হতে হবে: (ক) পুস্তকগুলো যাদের নামে প্রচারিত আদৌ সেগুলো তাঁদের লেখা কিনা এবং (খ) তাঁরা এগুলোকে ওহী-নির্ভর পুস্তক হিসেবে দাবি করেছেন কিনা। আমরা দেখব যে, বাইবেলের পুস্তকগুলোর ক্ষেত্রে এ দুটো বিষয় প্রমাণ করা অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান।
শুধু ধারণা বা অনুমানের উপর নির্ভর করে কোনো গ্রন্থকে কোনো নবীর লেখা বা কোনো ওহী বা প্রেরণা (Inspiration)-প্রাপ্ত ব্যক্তির বলে দাবি করলে বা প্রচার করলেই তা সে ব্যক্তির লেখা গ্রন্থ বলে প্রমাণিত বা স্বীকৃত হতে পারে না।
ইতোপূর্বে নতুন ও পুরাতন নিয়মের অতিরিক্ত পুস্তকগুলোর আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, এরূপ অনেক গ্রন্থই অনেক নবী বা শিষ্যের নামে প্রচারিত, যেগুলো ইহুদি খ্রিষ্টানরাও সে সকল নবীর গ্রন্থ বলে স্বীকার করেন না। মোশি, ইয্রা, যিশাইয়, যিরমিয়, শলোমন, মথি, লূক, মার্ক, যোহন, পিতর, যাকোব প্রমুখের নামে অনেক পুস্তক বাইবেলের অংশ হিসেবে লিখিত ও প্রচলিত হয়েছে এবং অসংখ্য ইহুদি ও খ্রিষ্টান যেগুলোকে ঐশী পুস্তক হিসেবে বিশ্বাস ও গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সেগুলোকে এ সকল নবীর লেখা পুস্তক বলে স্বীকার করেন না। ইহুদি- খ্রিষ্টানরা এগুলোকে জাল (Pseudepigrapha) বলে গণ্য করেন।
আমরা দেখেছি যে, বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন অর্থোডক্স বাইবেলে কমবেশি সাতাশিটা পুস্তক বিদ্যমান, যেগুলোর একুশটাকে প্রটেস্ট্যানটরা জাল গণ্য করেন এবং চৌদ্দটাকে ক্যাথলিকরা জাল মনে করেন। অথচ এগুলোর অনেক পুস্তক বাইবেলের ‘প্রাচীনতম’ পাণ্ডুলিপির মধ্যে বিদ্যমান। এ ছাড়াও শুধু নতুন নিয়মের দেড় শতাধিক পুস্তকের নাম আমরা দেখেছি যেগুলো যীশু, মেরি, প্রেরিতগণ, শিষ্য বা প্রসিদ্ধ ধর্মগুরুদের লেখা বলে প্রচারিত ছিল এবং প্রথম শতাব্দীগুলোর খ্রিষ্টানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে সকল খ্রিষ্টান সম্প্রদায় একমত যে, এগুলো সবই বানোয়াট, সন্দেহজনক বা জাল (Pseudepigrapha/ Apocrypha)।
সুপ্রিয় পাঠক সহজেই বুঝতে পারছেন, এমতাবস্থায় কোনো একটা গ্রন্থকে কোনো একজন নবী বা শিষ্যের নামে প্রচার করলেই গ্রন্থটাকে সে নবী বা শিষ্যের লেখা বা সংকলিত গ্রন্থ বলে মেনে নেওয়া যৌক্তিক নয়।
সাধারণভাবে প্রাচীন কোনো পুস্তকের প্রামাণ্যতা (Authoritativeness/ authenticity) নিশ্চিত করতে প্রাচীন পাণ্ডুলিপির উপর নির্ভর করা হয়। প্রথমেই দেখা হয়, যার নামে গ্রন্থটা প্রচারিত তিনি আদৌ গ্রন্থটা লেখেছেন কিনা? গ্রন্থের কোথাও গ্রন্থকারের নাম বা পরিচয় লেখা আছে কিনা? এবং তার স্বহস্তে লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যাচ্ছে কিনা। না হলে পরবর্তী কোনো অনুলিপিকার যদি উল্লেখ করেন যে, তিনি লেখকের স্বহস্তে লেখা পাণ্ডুলিপি থেকে গ্রন্থটা অনুলিপি করেছেন তবে তা সঠিক বলেই গণ্য করা হয়। যদি একাধিক পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় এবং পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে পার্থক্য না থাকে তবে তা গ্রন্থটার প্রামাণ্যতা নিশ্চিত করে।
যদি লেখকের লেখা বা তা থেকে অনুলিপি করা কোনো পাণ্ডুলিপি না পাওয়া যায় তবে প্রাচীনতম অনুলিপি অনুসন্ধান করা হয়। প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাওয়া না গেলে গবেষকরা সাধারণত গ্রন্থটার প্রামাণ্যতায় সন্দেহ পোষণ করেন এবং অভ্যন্তরীণ ও পারিপার্শ্বিক প্রমাণাদির ভিত্তিতে গ্রন্থটার লেখক, সময়কাল ইত্যাদি নির্ধারণের চেষ্টা করেন। আমরা এ অধ্যায়ে আধুনিক গবেষণার আলোকে বাইবেলের পাণ্ডুলিপি এবং বাইবেলের লেখকদের পরিচয় আলোচনা করব।
বাইবেলের পুস্তকগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা এই যে, এগুলোর প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। পুস্তকগুলো যাদের লেখা তাদের স্বহস্তে লেখা পাণ্ডুলিপি তো দূরের কথা তাদের কয়েক শতাব্দী পরে লেখা পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায় না। পুরাতন বা নতুন নিয়মের প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপিগুলো ইহুদি-খ্রিষ্টান ধর্মগুরু ও গবেষকদের দাবি অনুসারে ৪র্থ শতাব্দী বা তার পরে লেখা।
খ্রিষ্টান গবেষকরা অনেক সময় প্রাচীন গল্প, উপন্যাস বা সাহিত্য কর্মের সাথে ধর্মগ্রন্থের তুলনা করে বলেন যে, প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যিক হোমার (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী) রচিত ইলিয়ড, ওডেসিস ইত্যাদি গ্রন্থ এবং প্রাচীন গ্রিক ট্রাজেডিয়ান ইউরিপিডিস (খৃস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী) রচিত গ্রন্থগুলোর ক্ষেত্রে লেখকদের কয়েক শতাব্দী পরের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় এবং পাণ্ডুলিপির সংখ্যাও কম। সে তুলনায় নতুন নিয়মের পাণ্ডুলিপির সংখ্যা বেশি এবং লেখকদের এবং পাণ্ডুলিপির মধ্যে সময়ের ব্যবধান মাত্র কয়েক শত বছর।
ইতিহাস বা সাহিত্য কর্মের সাথে ধর্মগ্রন্থের তুলনা এবং হোমার (Homer) বা ইউরিপিডিস (Euripides)-এর সাথে যীশু খ্রিষ্টের তুলনা একেবারেই বেমানান ও অগ্রহণযোগ্য। পাঠক, নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
প্রথমত: প্রথম দুজন অনেক প্রাচীন, পক্ষান্তরে যীশু খ্রিষ্ট অনেক পরের মানুষ। তার যুগে গ্রন্থ লেখা ও সংরক্ষণের প্রচলন ব্যাপকতর ছিল।
দ্বিতীয়ত: হোমার, ইউরিপিডিস বা অন্যান্য সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিকের হাজার হাজার অনুসারী ছিলেন না যারা তাদের পুস্তকগুলো নিয়মিত অধ্যয়ন করতেন। পক্ষান্তরে যীশু খ্রিষ্টের হাজার হাজার অনুসারী ছিলেন। প্রথম শতাব্দীগুলোতে ইঞ্জিল বলে কোনো পুস্তকের প্রচলন থাকলে স্বভাবতই তার অনেক পাণ্ডুলিপি পাওয়া যেত।
তৃতীয়ত: ইতিহাস বা সাহিত্যের সাথে ধর্মগ্রন্থের তুলনা চলে না। ধর্মগ্রন্থের একটা শব্দের হেরফেরের কারণে বিশ্বাসীদের মধ্যে দলাদলি, হানাহানি ও রক্তারক্তি হয়। ধর্মগ্রন্থের একটা শব্দের হেরফেরে লক্ষ লক্ষ মানুষ বিভ্রান্তি ও ঈশ্বর-বিমুখতায় লিপ্ত হয়ে পার্থিব জীবনের পাশাপাশি পারলৌকিক অনন্ত জীবন হারায়। কাজেই যে ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক বিশুদ্ধতা নিশ্চিত নয় তাকে ঐতিহাসিক বা সাহিত্যিক কর্ম হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না।
চতুর্থত: হোমার, ইউরিপিডাস ও অন্যান্য প্রাচীন লেখকদের গ্রন্থাবলির বিদ্যমান পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে পার্থক্য ও ভিন্নতা খুবই কম। এর বিপরীতে বাইবেলের পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যকার ভিন্নতা ও বৈপরীত্য অনেক বেশি।[1]
আমরা দেখেছি, প্রথম শতাব্দীতে ‘নতুন নিয়ম’ নামে কিছুই ছিল না। দ্বিতীয় শতাব্দীতে ইঞ্জিল নামে ও শিষ্যদের পত্র নামে অনেক পুস্তক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ শতাব্দীর কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় শতাব্দীর কোনো কোনো ধর্মগুরুর বক্তব্য থেকে ধর্মীয় পুস্তকের মধ্যে বিকৃতির প্রবল ধারার কথা জানা যায়।
সেন্ট ডায়োনিসিয়াস (St. Dionysius) খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ খ্রিষ্টান ধর্মগুরু ও প্রচারক। তিনি করিন্থের বিশপ ছিলেন। তাঁর মৃত্যু তারিখ জানা যায় না। তবে ক্যাথলিক এনসাইক্লোপিডিয়া উল্লেখ করেছে যে, তিনি ১৭০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে করিন্থের বিশপ ছিলেন।[1] ধর্মগ্রন্থের পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে বিকৃতি দ্বিতীয় শতাব্দীতেও কত ব্যাপক ছিল তা তাঁর লেখা থেকে জানা যায়। ডায়োনিসিয়াস বিভিন্ন চার্চে অনেকগুলো যাজকীয় পত্র (epistles) লেখেছিলেন।[2] নিজের লেখা পত্রের মধ্যে নিজের জীবদ্দশাতেই ব্যাপক বিকৃতি দেখে তিনি মন্তব্য করেন:
“As the brethren desired me to write epistles, I wrote. And these epistles the apostles of the devil have filled with tares, cutting out some things and adding others. For them a woe is reserved. It is, therefore, not to be wondered at if some have attempted to adulterate the Lord's writings also, since they have formed designs even against writings which are of less account.”
‘‘ভাতৃগণের ইচ্ছা অনুসারে আমি অনেকগুলো পত্র লেখেছিলাম। আর শয়তানের অনুসারীরা নোংরা বিষয় দিয়ে এ সকল পত্র ভরে দিয়েছে। কিছু বিষয় তারা বাদ দিয়েছে এবং কিছু বিষয় তারা সংযোজন করেছে। তাদের জন্য দুঃখই পাওনা। কাজেই, এতে কোনো অবাক হওয়ার কারণ নেই যে, কেউ কেউ আমাদের প্রভুর লেখনিগুলোকে বিকৃত করার চেষ্টা করবে। কারণ, তারা সেগুলোর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকাদি এভাবে বিকৃত করার পরিকল্পনা করেছে।’’[3]
আমরা জানি যে, ডায়োনিসিয়াসের পত্রগুলো ধর্মগুরুদের এবং চার্চগুলোর মধ্যেই প্রচারিত ছিল। ধর্মগুরু বা ধার্মিক মানুষেরাই এগুলো পাঠ ও অনুলিপি করতেন এবং বিকৃতিও তারাই করেছিলেন। প্রথম শতাব্দীগুলোর ধার্মিক খ্রিষ্টানরা প্রত্যেকে যা বুঝতেন সেটাকেই সঠিক বিশ্বাস ও পবিত্র আত্মার প্রেরণা বলে গণ্য করতেন। এজন্য ধর্মগ্রন্থের যে কথাগুলো তাদের কাছে অসম্পূর্ণ বা সঠিক বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে হত তাৎক্ষণিক তারা তা পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজনের মাধ্যমে ‘ঠিক’ করে দিতেন। এজন্যই এত দ্রম্নত ডায়োনিসিয়াসের পত্রগুলোও বিকৃত হয়ে যায়।
ডায়োনিসিয়াসের পত্রগুলোর ধর্মীয় গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত কম ছিল। সেগুলোর সংশোধনে যদি সে যুগের ধর্মগুরু বা ধার্মিক মানুষেরা এত তৎপর হন তবে এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ যীশুর বিবরণ সম্বলিত তথ্যগুলোর অপূর্ণতা, অস্পষ্টতা বা বিভ্রান্তি পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজনের মাধ্যমে সংশোধন করতে তাদের অধিক তৎপর হওয়াই স্বাভাবিক। এছাড়া ডায়োনিসিয়াসের পত্রগুলো তাঁর জীবদ্দশায় অল্প পরিসরেই প্রচারিত হয়েছিল এবং অল্প সংখ্যক ধার্মিক মানুষের হাতে পড়েছিল। পক্ষান্তরে যীশুর নামে প্রচারিত তথ্যগুলো স্বভাবতই আরো অনেক বেশি প্রচারিত ছিল, বেশি মানুষের হাতে পড়েছে এবং বিকৃতি, পরিবর্তন বা সংশোধনও অনেক বেশি পরিমাণে হয়েছে। এজন্য আমরা দেখব যে, বাইবেলের পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে বৈপরীত্য ও ভিন্নতার পরিমাণ বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান শব্দের সংখ্যার চেয়েও বেশি!
[2] Eusebius, The Ecclesiastical History, page 158, 475.
[3] Eusebius, The Ecclesiastical History, page 160.
তৃতীয় শতাব্দীতে বাইবেলের পাণ্ডুলিপিগুলোতে পরিবর্তন ও বিকৃতির প্রবলতা বিষয়ে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু ওরিগন (মৃ ২৫৪ খ্রি.)-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। সর্বপ্রথম যারা প্রচলিত ইঞ্জিলগুলোর উল্লেখ করেছিলেন ওরিগন (origen) তাদের অন্যতম। তিনি মথির ইঞ্জিলের এক ব্যাখ্যা রচনা করেন, যা মথির টীকা (Commentary on Mattew) নামে ইংরেজিত অনূদিত। এ গ্রন্থে তিনি লেখেছেন:
“The differences among the manuscripts have become great, either through the negligence of some copyist or through the perverse audacity of others; they either neglect ot check over what they have transcribed, or, in the process of checking, the make additions or deletions as the please.”
‘‘পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে বৈপরীত্য খুবই ব্যাপক হয়ে গিয়েছে। এর কারণ কতিপয় অনুলিপিকারের অবহেলা অথবা অন্য অনেকের বিপথগামী ধৃষ্টতা। কী জিনিস তারা লেখছে বা প্রতিলিপি করছে তা তারা যাচাই করতে অবহেলা করেছে, অথবা তা যাচাই-এর নামে তারা যা ইচ্ছা সংযোজন বা বিয়োজন করেছে।’’[1]
খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের দাবি অনুসারে ইঞ্জিলগুলো প্রথম শতকের শেষভাগে বা দ্বিতীয় শতকের শুরুতে লেখা। আর এক শতাব্দী পার না হতেই এগুলোর মধ্যে বিকৃতির অনুপ্রবেশ ছিল এত ব্যাপক। এ সকল ইঞ্জিলের লেখকরা পবিত্র আত্মার প্রেরণা প্রাপ্ত ছিলেন কিনা তা জানা না গেলেও এগুলোর অনুলিপিকাররা যে পবিত্র আত্মার সহায়তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন তা প্রাচীন ধর্মগুরুরা অকপটে স্বীকার করেন। কারো অবহেলা আর কারো ইচ্ছাকৃত ধৃষ্টতার মাধ্যমে গ্রন্থগুলো বিকৃত হয়েছে।
ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে হিব্রু বাইবেল বা খ্রিষ্টান পুরাতন নিয়মের পুস্তকগুলো মূসা (আ.) থেকে মালাখি পর্যন্ত নবীগণ কর্তৃক রচিত। এ সকল নবীর সময়কাল নিয়ে অনেক মতভেদ বিদ্যমান। তবে সাধারণ ভাবে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সাল থেকে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের মধ্যে পুস্তকগুলো লিখিত বলে ধর্মগুরুরা দাবি করেন। পক্ষান্তরে আধুনিক গবেষকরা বলেন যে, বর্তমানে বিদ্যমান এ সকল পুস্তক কোনোটাই সংশিস্নষ্ট নবীর লেখা নয়। বরং তাঁদের অনেক পরে এগুলো সংকলিত ও তাঁদের নামে প্রচারিত।[1] সর্বাবস্থায় এগুলোর সংকলন চূড়ান্ত হয়েছে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যে। কিন্তু পরবর্তী প্রায় ৭ শত বছরের কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। সংকলিত হিব্রু বাইবেলের প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় ৯/১০ খ্রিষ্টীয় শতক থেকে।[2]
১৯৪৫ সালের দিকে জর্ডানের কুমরান প্রান্তরে কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, যেগুলো ‘কুমরান পাণ্ডুলিপি’ বা ‘মৃত সাগরের পাণ্ডুলিপি’ (Dead Sea Scrolls) নামে প্রসিদ্ধ। এগুলোর মধ্যে হিব্রু বাইবেলের অনেক গ্রন্থের আংশিক বা সামান্য কিছু পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে। ইহুদি-খ্রিষ্টান গবেষকরা দাবি করেন যে, এগুলো খ্রিষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দী থেকে খ্রিষ্ট পরবর্তী ২ শতাব্দীর মধ্যে লেখা। তবে এ সকল আংশিক, খণ্ডতে ও সামান্য কয়েক পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিগুলোর সাথে প্রচলিত হিব্রু বাইবেলের অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। আমরা ইতোপূর্বে একটা নমুনা উল্লেখ করেছি।
ইহুদি-খ্রিষ্টানদের দাবি অনুসারে পুরাতন নিয়মের গ্রিক সংস্করণ বা সেপ্টুআজিন্ট লেখা হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে। অথচ এর প্রাচীনতন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় ৪র্থ খ্রিষ্টীয় শতাব্দী থেকে। অর্থাৎ ৭০০ বছর পুস্তক-সংকলনটা লক্ষ লক্ষ ইহুদি-খ্রিস্টানের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং হাজার হাজার সিনাগগ ও চার্চে পঠিত হত বলে দাবি করা হল, অথচ ৭০০ বছরের মধ্যে লেখা একটা প্রাচীন পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায় না। সর্বোপরি এ বাইবেলের বক্তব্য ও বইয়ের সংখ্যা হিব্রু বাইবেল থেকে অনেক ভিন্ন। ইহুদি ও প্রটেস্ট্যানটরা ‘সেপ্টুআজিন্ট’ মানেন না। আর ৪র্থ শতাব্দী থেকে পাওয়া সেপ্টুআজিন্টের পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য ও বৈপরীত্য বিদ্যমান।
এভাবে আমরা দেখছি যে, মূল লেখকদের বা তাদের শিষ্যদের লেখা পাণ্ডুলিপি তো অনেক দূরের কথা, তাদের পরে প্রায় দেড় হাজার বছর পর্যন্ত লেখা কোনো প্রাচীন হিব্রু পাণ্ডুলিপি ইহুদি বা খ্রিষ্টানদের সংগ্রহে নেই। এ প্রসঙ্গে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার বক্তব্য:
The earliest printed editions of the Hebrew Bible derive from the last quarter of the 15th century and the first quarter of the 16th century. The oldest Masoretic codices stem from the end of the 9th century and the beginning of the 10th. A comparison of the two shows that no textual developments took place during the intervening 600 years. .... This situation, however, was a relatively late development; there is much evidence for the existence of a period when more than one Hebrew text-form of a given book was current. In fact, both the variety of witnesses and the degree of textual divergence between them increase in proportion to their antiquity.
‘‘খৃস্টীয় ১৫ শতকের শেষে ও ১৬ শতকের শুরুতে হিব্রু বাইবেলের প্রাচীনতম মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আর হিব্রু বাইবেলের লিখিত পাণ্ডুলিপি খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দী থেকে পাওয়া যায়। মুদ্রিত কপি ও ৯ম শতাব্দীর প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপির মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায় যে, ৬০০ বছরে বইগুলোর বক্তব্যে পরিবর্তন হয়নি। ... কিন্তু এটা অনেক পরের অবস্থা। অনেক প্রমাণ বিদ্যমান যে, এক সময় বাইবেলের একই পুস্তকের একাধিক হিব্রু ভাষ্য প্রচলিত ছিল। প্রকৃত বাস্তবতা হল, সাক্ষ্যের বৈপরীত্য এবং বক্তব্যের দূরত্ব গ্রন্থগুলোর বয়সের বা প্রাচীনত্বের সাথে তাল রেখে বৃদ্ধি পেয়েছে।’’[3]
হিব্রু বাইবেলের প্রাচীনতম পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি দুটো: Aleppo Codex ও Leningrad Codex। প্রথমটা দশম শতাব্দীতে লেখা এবং দ্বিতীয়টা একাদশ শতাব্দীতে লেখা। এ পাণ্ডুলিপি দুটোর পুস্তক বিন্যাসের সাথে বর্তমান ইহুদি বাইবেল বা তানাখণ্ডএর পুস্তক বিন্যাসের পার্থক্য রয়েছে। এ দুটো পাণ্ডুলিপিতে বংশাবলি পুস্তকটা তৃতীয় অংশের শুরুতে। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যমান মুদ্রিত তানাখণ্ডএ বংশাবলি পুস্তকটা তৃতীয় অংশের শেষ পুস্তক। আগ্রহী পাঠক ইন্টারনেটে এ দুটো পাণ্ডুলিপির নাম লেখে অনুসন্ধান করলে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
[2] উইকিপিডিয়া: Aleppo Codex, Leningrad Codex and other incomplete MSS
[3] "biblical literature/Textual criticism: manuscript problems "Encyclopædia Britannica. Encyclopædia Britannica 2009 Ultimate Reference Suite. Chicago; Encyclopædia Britannica, 2009.
নতুন নিয়মের অবস্থা পুরাতন নিয়মের চেয়ে মোটেও ভাল নয়। নতুন নিয়মের কোনো পুস্তকের লেখকের স্বহস্তে লেখা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। এমনকি প্রথম প্রায় দেড় শত বছরের মধ্যে লেখা একটা পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায় না। দু-একটা পুস্তকের অল্প কয়েক পৃষ্ঠার প্রাচীন পাণ্ডুলিপির ভগ্নাংশ বা খণ্ডতে টুকরো (fragment) পাওয়া গেছে, যেগুলোকে খ্রিষ্টান গবেষকরা দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের বলে দাবি করেন, যদিও কয়েক পৃষ্ঠার এ খণ্ডতে পাণ্ডুলিপির বয়স নির্ধারণের বিষয়টা পুরোপুরিই অনুমান নির্ভর হওয়ার কারণে গবেষকরা একমত হতে পারেন না।[1]
নতুন নিয়মের হাজার হাজার পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান। কিন্তু সবই পরবর্তী সময়ের। নতুন ও পুরাতন নিয়মের সমন্বিত বাইবেলের প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপির বয়স খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের দাবি অনুসারেই ৪র্থ শতাব্দী। অর্থাৎ যীশু ও তাঁর শিষ্যদের থেকে পরবর্তী প্রায় ৪০০ বছরের মধ্যে লেখা ‘নতুন নিয়মের’ বা ‘বাইবেলের’ কোনো পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না।[2] নতুন নিয়মের পাণ্ডুলিপি প্রসঙ্গে উইকিপিডিয়ায় বলা আছে:
“The vast majority of these manuscripts date after the 10th century. Although there are more manuscripts that preserve the New Testament than there are for any other ancient writing, the exact form of the text preserved in these later, numerous manuscripts may not be identical to the form of the text as it existed in antiquity. Textual scholar Bart Ehrman writes: "It is true, of course, that the New Testament is abundantly attested in the manuscripts produced through the ages, but most of these manuscripts are many centuries removed from the originals, and none of them perfectly accurate. They all contain mistakes - altogether many thousands of mistakes. It is not an easy task to reconstruct the original words of the New Testament.”
‘‘এ সকল পাণ্ডুলিপির অধিকাংশই দশম শতাব্দীর পরের। অন্য যে কোনো প্রাচীন পুস্তকের তুলনায় নতুন নিয়মের অনেক বেশি পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে, তবে পরবর্তীকালে লেখা এ সকল অগণিত পাণ্ডুলিপির মধ্যে যে বক্তব্য সংরক্ষিত হয়েছে তা মূল প্রাচীন বক্তব্যের সাথে এক নয় বলেই প্রতীয়মান। বাইবেলের গবেষক বার্ট ইহরম্যান লেখেছেন: এ কথা সত্য যে, যুগে যুগে লেখা অগণিত পাণ্ডুলিপির মধ্যে নতুন নিয়ম লিপিবদ্ধ। কিন্তু এ সকল পাণ্ডুলিপির অধিকাংশই মূল থেকে কয়েক শতাব্দী পরের এবং এগুলোর মধ্যে একটাও পুরোপুরি বিশুদ্ধ নয়। সকল পাণ্ডুলিপির মধ্যেই ভুল রয়েছে এবং সব মিলিয়ে হাজার হাজার ভুল। নতুন নিয়মের মূল বক্তব্য পুনরুদ্ধার করা মোটেও সহজ কাজ নয়।’’[3]
এরপর মূলপাঠ বিষয়ক সমালোচনা (Textual Criticism) প্রসঙ্গে উইকিপিডিয়া লেখেছে: “None of the original documents of the New Testament is extant and the existing copies differ from one another. ...” ‘‘নতুন নিয়মের মূল পাণ্ডুলিপিগুলোর কিছুই বিদ্যমান নেই এবং বর্তমানে বিদ্যমান কপিগুলো একটা থেকে অন্যটা ভিন্ন।... ’’[4]
প্রসিদ্ধ আমেরিকান গবেষক লেখিকা ডরোথি মারডক (Dorothy M. Murdock) যিনি ‘আচারিয়া এস (Acharya S) ছদ্মনাম বা কলম নামে বেশি প্রসিদ্ধ। বাইবেল, যীশু খ্রিষ্ট ও প্রাচীন ধর্ম বিষয়ে তার গবেষণা ও গ্রন্থাবলি সুপরিচিত যদিও তার গ্রন্থাবলির পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক আছে। তিনি truthbeknown.com নামে একটা ওয়েবসাইট পরিচালনা করেন। এই ওয়েবসাইটে তার Sons of God: Krishna, Buddha and Christ Unveiled বইয়ের ‘ঐতিহাসিক যীশু?’ (The Historical Jesus?) প্রবন্ধে লেখেছেন:
“It would be impossible to date the appearance of the gospels based on the extant manuscripts, since the autographs or originals were destroyed long ago, an act that would appear to be the epitome of blasphemy, were these texts truly the precious testimonials by the Lord's very disciples themselves. Although a miniscule bit of papyrus (Rylands P52) dating to the middle of the second century has been identified speculatively as part of "John's Gospel" (18:31-33), the oldest fragments conclusively demonstrated as coming from the canonical gospels date to the 3rd century. The two verses of "John's Gospel," comprising only about 60 words, could easily be part of another, non-canonical gospel, of which there were numerous in the first centuries of the Christian era.”
‘‘বর্তমানে বিদ্যমান পাণ্ডুলিপিগুলোর উপর নির্ভর করে ইঞ্জিলগুলোর আবির্ভাব বা রচনাকাল নির্ণয় করা অসম্ভব। কারণ, লেখকের স্বহস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি বা মূল পাণ্ডুলিপিগুলো সবই অনেক আগে বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। যদি যীশুর শিষ্যদের নিকট এ পু্স্তকগুলো সত্যই মূল্যবান কিছু বলে গণ্য হয়ে থাকত তবে এগুলো বিনষ্ট হওয়া ধর্মদ্রোহিতা বলে বিবেচিত হত। দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ের বলে গণ্য ছোট্ট একটুকরা প্যাপিরাস পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে। এ টুকরাটাকে আনুমানিকভাবে যোহনের ইঞ্জিলের (১৮/৩১-৩৩ শ্লোক) বলে ধারণা করা হয়। এ টুকরোটা বাদে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত স্বীকৃত ইঞ্জিলগুলোর পাণ্ডুলিপির খণ্ডতে টুকরোগুলো তৃতীয় শতাব্দীর। দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের যে টুকরোটাকে যোহনের ইঞ্জিলের অংশ বলে দাবি করা হয় তাতে ৬০টা শব্দ বিদ্যমান। এ শব্দগুলো সহজেই অন্য একটা ইঞ্জিলের শ্লোকের সাথে মিলে যায়, যে ইঞ্জিলটা খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীগুলোতে বহুল প্রচলিত ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে জাল ও বাতিল বলে গণ্য হয়েছে।’’[5]
[2] উইকিপিডিয়া, Biblical manuscript, New Testament manuscripts.
[3] উইকিপিডিয়া, Biblical manuscript, New Testament manuscripts.
[4] উইকিপিডিয়া, Biblical manuscript, New Testament manuscripts, Textual Criticism.
[5] http://www.truthbeknown.com/historicaljc.htm
আমরা দেখেছি যে, হিব্রু ভাষায় রচিত পুরাতন নিয়মের প্রাচীনতম পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি ১০ম খ্রিষ্টীয় শতকের। পক্ষান্তরে গ্রিক ভাষায় রচিত নতুন ও পুরাতন নিয়মের পাণ্ডুলিপি অপেক্ষাকৃত অনেক প্রাচীন। নিম্নে আমরা বাইবেল গবেষকদের বর্ণনা অনুসারে বাইবেলের ‘প্রাচীনতম’ পাণ্ডুলিপিগুলোর বিবরণ প্রদান করছি। উল্লেখ্য যে, পাণ্ডুলিপিগুলো কার লেখা ও কবে লেখা তা পাণ্ডুলিপির কোথাও উল্লেখ নেই। হাতের লেখার পদ্ধতি, কাগজের ধরন ইত্যাদি বিবেচনা করে পাণ্ডুলিপির বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা এখানে খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের দাবি অনুসারে প্রাচীনতম বয়স উল্লেখ করব। তবে অনেক গবেষকের মতে এ সকল পাণ্ডুলিপি আরো অনেক পরে লেখা।
খ্রিষ্টান ধর্মগুরু ও পণ্ডিতদের মতে বাইবেলের বর্তমানে বিদ্যমান প্রাচীনতম গ্রিক পাণ্ডুলিপিগুলোর অন্যতম ভ্যাটিকানের পাণ্ডুলিপি। তাদের ধারণায় চতুর্থ খ্রিষ্টীয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে পাণ্ডুলিপিটা লেখা। বর্তমানে বিদ্যমান পাণ্ডুলিপিটা পূর্ণাঙ্গ নয়। এতে বিদ্যমান বাইবেলীয় পুস্তকগুলোর ক্রম বিন্যাস বর্তমানে প্রচলিত বিন্যাস থেকে ভিন্ন। এছাড়া আলেকজান্দ্রীয় পাণ্ডুলিপির বিন্যাস থেকেও ভিন্ন। পুরাতন নিয়মের এপক্রিপা বা সন্দেহজনক পুস্তকগুলোর কয়েকটা এ পাণ্ডুলিপিতে বিদ্যমান। নতুন নিয়মের পুস্তকগুলোর মধ্য থেকে ২ তীমথিয়, তীত, ফিলীমন এবং প্রকাশিত বাক্য পুস্তকগুলো নেই। সম্ভবত নতুন নিয়মের এপক্রিপা বা সন্দেহজনক পুস্তকগুলোর কয়েকটা মূল পাণ্ডুলিপিতে ছিল, পরে তা ছিড়ে ফেলা হয়েছে। বাহ্যত ‘প্রকাশিত বাক্য’ পুস্তকটা এ পাণ্ডুলিপিতে মোটেও ছিল না। এ পাণ্ডুলিপির মধ্যে বিদ্যমান পুস্তকগুলোর পাঠ বর্তমানে প্রচলিত বাইবেল থেকে কিছু ভিন্ন। বর্তমানে বিদ্যমান অনেক বাক্যাংশ, বাক্যমালা ও শ্লোক এ পাণ্ডুলিপিতে বিদ্যমান পুস্তকগুলোতে নেই।[1]
খ্রিষ্টান ধর্মগুরু ও পণ্ডিতদের মতে কডেক্স সিনাটিকাস বা সিনাই বাইবেল (Sinai Bible) গ্রিক বাইবেলের প্রাচীনতম একটা পাণ্ডুলিপি। ভ্যাটিকান পাণ্ডুলিপির সমসাময়িক বা তার পরপরই এটা লেখা বলে তারা ধারণা করেন। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পাণ্ডুলিপিটা লেখা হয় বলে তারা দাবি করেন।
এ পাণ্ডুলিপির মধ্যে ৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণকারী প্রসিদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মগুরু ইউসিবিয়াসের (Eusebius of Caesarea) বাইবলেীয় পদ্ধতি অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। ফলে গবেষকরা নিশ্চিত যে পাণ্ডুলিপিটা ৩২৫/৩৩০ খ্রিষ্টাব্দের পরে লিখিত। অনেকেই মনে করেন পাণ্ডুলিপিটা ৩৬০ খ্রিষ্টাব্দে লিখিত। তারা মনে করেন যে, এ পাণ্ডুলিপিতে পুরাতন ও নতুন নিয়ম পূর্ণাঙ্গ লেখা ছিল। তবে বর্তমানে বিদ্যমান পাণ্ডুলিপির মধ্যে পুরাতন নিয়মের প্রায় অর্ধেক রয়েছে। নতুন নিয়ম পুর্ণাঙ্গই বিদ্যমান। এ পাণ্ডুলিপিতে নতুন নিয়মের পুস্তক সংখ্যা ২৯। প্রচলিত ২৭টা পুস্তকের সাথে অতিরিক্ত দুটো পুস্তক এতে বিদ্যমান: (১) বার্নাবাসের পত্র (Epistle of Barnabas) এবং (২) হারমাসের রাখাল (The Shepherd of Hermas)।
পুস্তকসংখ্যার এ পার্থক্য ছাড়াও এ পাণ্ডুলিপির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে: (১) বাইবেলীয় পুস্তকগুলোর ক্রমবিন্যাস প্রচলিত বিন্যাস থেকে ভিন্ন, (২) নতুন নিয়মের অনেক পুস্তকের অনেক শ্লোক (verses) ও বাক্যাংশ (phrases) এ পাণ্ডুলিপিতে বাদ দেওয়া হয়েছে, (৩) বেশ কিছু শ্লোক পরবর্তী সংশোধনকারীরা বাদ দিয়েছেন এবং (৪) অনেক পুস্তকের অনেকগুলো শ্লোক এ পাণ্ডুলিপিতে ভিন্নরূপে লেখা।[1]