আল্লাহ তাআলার হামদ ও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদ পাঠ করে ইসলামী শরী'আর জীবনঘনিষ্ঠ একটি গ্রন্থের ভূমিকা শুরু করছি। জীবনকে শুদ্ধ-সঠিক পথে পরিচালনার জন্য, আল্লাহর রাস্তায় পথ চলার জন্য শরী'আর ইলম অর্জনের কোন বিকল্প নাই। ডাক্তার না হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হলে জীবন চলে, ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে ব্যবসায়ী হলেও চলে, ব্যবসায়ী না হয়ে কৃষক হলেও চলে। এর কোনটাই না হয়ে বেকার থাকলে কষ্টে হলেও জীবন চলে। কিন্তু ফিকহ শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন ছাড়া এ জগৎ ও পরজগৎ কোনটাই চলবে না। বরং, পরপার হবে বিভিষিকাময়।
তাই, এই শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন ফরজে আইন – সকলের জন্য, সকল নারী-পুরুষের জন্য, ছোট ও বড়দের জন্য। পরপারের যাত্রা শুভ ও সুন্দর করার জন্য। যারা তা শিখবে তারা হবে আল্লাহর কাছে সবিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত। মহানবী (স) বলেছেন, “আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে তিনি দীনের জ্ঞান দান করেন।” জীবনের পরতে পরতে পবিত্রতা, সালাত, সওম, যাকাত ও হজ্জ – এ বিষয়গুলো আষ্টেপিষ্ঠে জড়িত। এগুলো শুদ্ধ হলে জীবন শুদ্ধ, আর এতে ভুল হলে জীবন হয় ভুল, ফলে পরিণাম হয় মারাত্মক। এ জন্যই এ গ্রন্থটি প্রণয়ন এবং বিষয়গুলো একত্রে সন্নিবেশ করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই ও বাছাইয়ে রয়েছে মতানৈক্য, মতবিরোধ, ইখতিলাফ ও দ্বিমত । শুরু হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের যামানা থেকে। চলছে আজও, চলবে কিয়ামত পর্যন্ত। বাস্তবিকই, ফিকহ হলো মতবিরোধ ও মতানৈক্যের একটি শাস্ত্র । এখানে ঐকমত্যের সুযোগ খুব কমই । মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে কিছু লেখা এক ভয়ানক কাজ। বিষয়টি জীবনের সাথে ওঁতপ্রোতভাবে জড়িত বিধায় অনেকগুলো মাসআলা প্রতিদিনের আমলের সাথে জড়িত।
তাই অনেক ঝুঁকি নিয়ে গ্রন্থটিতে হাত দিলাম, যার পেছনে সময় লেগেছে অর্ধ যুগেরও বেশি। এ জন্য যেমনটি অধ্যয়ন করেছি, কুরআন, হাদীস ও ফিকহের গ্রন্থরাজি, তেমনি বাস্তবে এগুলোর আমল দেখেছি, মক্কা মুকাররমা ও মদীনা মনওয়ারার উলামায়ে কেরামের দৈনন্দিন জীবনে। রাসূল (স) বলেছেন, “মতবিরোধ করতে করতে আমার উম্মত এক সময় তিয়াত্তর ফিরকায় বিভক্ত হবে। এর মধ্যে বায়াত্তরটি ফিরকাই জাহান্নামী হবে; জান্নাতে যাবে মাত্র একটি ফিরকা। আর সে মুক্তিপ্রাপ্ত ফিরকাটি হবে তারা, যারা আমার ও আমার সাহাবীদের আমলের উপর অধিষ্ঠিত থাকবে”। মহান আল্লাহ বলেছেন, “যারা সব কথা শুনে, অতঃপর উত্তমগুলো আমল করে তারাই হলো হেদায়াতপ্রাপ্ত, আর তারাই বুদ্ধিমান।" (সূরা ৩৯; যুমার ১৮)।
ফিকহী মাসআলা গ্রহণ ও আমলের ক্ষেত্রে মাযহাবের ইমামগণের বিরাট অবদান রয়েছে । মাযহাবের সংখ্যা অনেক হলেও বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে চারটি মাযহাব। ইমামগণের সকলেরই লক্ষ্য ছিল, অধিকতর সঠিক কথা খুঁজে বের করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা; কাউকে খাটো করে দেখা নয়। মাযহাব অর্থ কোন দল বা ফিরকা নয়; মাযহাব অর্থ হলো, মতামত। আমাদের উচিত ইমামগণের মতামতগুলোকে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করা, বুঝতে চেষ্টা করা। খুঁজে খুঁজে সহজগুলো আমল না করে দলীলের বিশুদ্ধতাকে প্রাধান্য দিয়ে উত্তমটিকে গ্রহণ করা। আমার ব্যক্তিকে নিয়ে ক’টি কথা বলছি। প্রথম জীবনে স্কুল-কলেজের ছাত্র ছিলাম, অধ্যয়ন করেছি বিজ্ঞান, শিক্ষক ছিলাম গণিতের। এরই মধ্যে দীনচর্চা শুরু করলাম। বিগত তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে কুরআন-হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্র অধ্যয়ন ও পাঠদানের সাথে সম্পৃক্ত থাকার তাওফিক আল্লাহ তাআলা করে দিয়েছেন।
মহান আল্লাহর দয়ায় মক্কার উম্মুলকুরা ইউনির্ভাসিটিতে অধ্যয়ন ও কাবা শরীফের ক’জন ইমামের ছাত্র হওয়ার সুবাদে এশিয়া ও আফ্রিকা এবং আরব ও আজমের অনেক বিজ্ঞ উলামায়ে কিরামের সান্নিধ্যে উঠা-বসার সুযোগ হয়েছে । ফিকহী মাসআলা নিয়ে মতবিনিময় ও আলোচনা-পর্যালোচনায় সুযোগ হয়েছে। তাছাড়া মক্কা শরীফের উম্মুলকুরা ইউনিভার্সিটিতে প্রথমেই ফি পড়ি একজন হানাফী উস্তাযের কাছে। এরপর মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী উস্তাযগণের কাছে ফিকহ ও কুরআনহাদীস অধ্যয়ন করি । দেখেছি, তাদের উদারতা, জ্ঞানের গভীরতা এবং পাণ্ডিত্য। এ গ্রন্থে কোন দল-উপদলের প্রতি প্রভাবিত হয়ে একতরফাভাবে কোন কিছু লিখা হয়নি । যেটাকেই সত্যের অধিকতর কাছাকাছি দেখেছি সেটিকেই প্রাধান্য দিয়েছি; কারো অন্ধ সমর্থন করে নয়। কোন কোন মাসআলা কারো কারো কাছে নতুন মনে হতে পারে। কিন্তু আমি সহীহ হাদীসকে প্রাধান্য দিয়েই তা লিখেছি। কোন হাদীসকে তো আমি গোপন করতে পারি না।
কেননা, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, “যারা হাদীস গোপন করবে আল্লাহ তাআলা তাদের মুখে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেবেন।” আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে কোথাও যেন ভুল না করে ফেলি সেজন্য যতটুকু সম্ভব মেহনত করেছি । শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই ও দলীল সংযোজনে অনেক পরিশ্রম করেছি। আয়াত ও হাদীসের নাম্বারিং করেছি অধিকাংশ জায়গায়। কউমী, আলীয়া, দেওবন্দী, মক্কী ও মাদানী - মুফতী, মুহাদ্দেস, মুফাসির ও নবীন-প্রবীণ নানা স্তরের অনেক বিজ্ঞ আলেম-উলামার সাথে দেখা করেছি, মতবিনিময় করেছি। যেটি জানি না তা জানার চেষ্টা করেছি, যা বুঝি না তা বুঝার চেষ্টা করেছি, শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এরপরও আমরা কেউই ভুলের উর্ধ্বে নই ।
সকল পাঠকবর্গের কাছে বিনীত অনুরোধ যেকোন প্রকার ভুল-ত্রুটি নযরে আসলে মেহরবানী করে নিম্ন ঠিকানায় আমাকে জানাবেন, যাতে পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করে নিতে পারি । ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ সালাত এবং তা আদায়ের পূর্বশর্ত হলো পবিত্রতা অর্জন । এর সাথে সাওম, যাকাত ও হজ্জ – ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলো নিয়ে জিজ্ঞাসা ও জবাবের আকারে প্রণীত অতীব জরুরি একটি মাসায়েল গ্রন্থ এই প্রশ্নোত্তরে ফিকহুল ইবাদাত।
‘সবুজপত্র পাবলিকেশন্স’কে ধন্যবাদ, এ ধরনের একটি মৌলিক ও অত্যাবশকীয় গ্রন্থ প্রকাশে এগিয়ে আসার জন্য। বইটি সকলের কাছে সমাদৃত হোক, ঘরে ঘরে পৌছুক। আর তা নাজাতের উছিলা হোক আমাদের সবার। আমীন!
অধ্যাপক মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম মক্কী
সভাপতি: সিরাজনগর উম্মুল কুরা মাদরাসা
পো: রাধাগঞ্জ বাজার, জেলা: নরসিংদী
অধ্যাপক মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম মক্কী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদ ইউনিয়নের সিরাজনগর (নয়াচর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মরহুম মোঃ চান মিয়া ও মরহুমা সালেহা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। উপজেলার শত বছরের গৌরবোজ্জ্বল আদিয়াবাদ হাইস্কুল থেকে ১৯৭৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৭৫-৭৬ সেশনে ঢাকা কলেজে অধ্যায়ন এবং পরে ১৯৭৭ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে গ্র্যাজুয়েশন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে ফার্স্ট ক্লাশ পেয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
প্রথম জীবনে তিনি স্কুল-কলেজের ছাত্র ও গণিতের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৮১ সালে সৌদি বাদশাহ’র গৌরবময় শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে মক্কা শরীফের উম্মুলকুরা ইউনিভার্সিটিতে গমন করেন । সেখানে তিনি এরাবিক ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউট ও অনার্স কোর্সে বিভিন্ন দেশের স্কলারদের নিকট দীর্ঘ দশ বছরকাল আরবী ভাষা, নাহু-ছরফ, তাফসীরুল কুরআন, হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে সৌদি আরবের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও পবিত্র কাবা’র সম্মানিত ইমাম শাইখ ড. সালেহ বিন হুমাইদ ও কাবা’র আরেক সম্মানিত ইমাম ড. উমর আস্-সুবাইল (র) অন্যতম।
জনাব নূরুল ইসলাম দেশে ফিরে ১৯৯৬ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপনায় রত আছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগদানের জন্য তিনি ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ভারত, আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও মিশরসহ অনেক দেশ সফর করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে অদ্যাবধি টিভি চ্যানেল এটিএন বাংলার প্রভাতের দারসে হাদীস অনুষ্ঠানের তিনি একজন নিয়মিত আলোচক। তাঁর সহধর্মিণীর নাম আঁখিনূর বেগম (এমএ, ইসলামিক স্টাডিজ)। তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জনক। ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ২০টি। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
(১) কুরআন কারীমের মর্মার্থ ও শব্দার্থ (ত্রিশতম পারা), (২) বিশুদ্ধ তিলাওয়াত পদ্ধতি, (৩) বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে ওযু-গোসল, (৪) যেভাবে নামায পড়তেন রাসূলুল্লাহ (স.) (৫) প্রশ্নোত্তরে জুমুআ ও খুৎবা, (৬) প্রশ্নোত্তরে যাকাত ও সদাকাহ, (৭) প্রশ্নোত্তরে রমযান ও ঈদ, (৮) প্রশ্নোত্তরে হজ্জ ও উমরা, (৯) উমরা কিভাবে করবেন?, (১০) প্রশ্নোত্তরে কুরবানী ও আকীকা, (১১) শুধু আল্লাহর কাছে চাই (দু'আ-মুনাজাতের বই), (১২) Dua Book in Arabi Bangla English, (১৩) আকীদা ও ফিকহ (১ম থেকে ৫ম শ্রেণী), (১৪) চরিত্র গঠনের উপায়, (১৫) কবর-কিয়ামাত : জান্নাত-জাহান্নাম ।
০ কুরআন কারীম থেকে দলীল প্রদানের ক্ষেত্রে সূরার ক্রমিক নম্বর, সূরার নাম ও আয়াত নম্বর প্রদান করা হয়েছে ।
০ হাদীস থেকে উদ্ধৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে বাম পাশে মূল হাদীসগ্রন্থের নাম ও ডান পাশে হাদীস নাম্বার দেওয়া হয়েছে। আর এ নাম্বার প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন লাইব্রেরি ও প্রকাশনা সংস্থা ভিন্ন ভিন্ন নাম্বার প্রদান করায় এক প্রকাশনীর সাথে অন্য প্রকাশনীর নম্বরের মিল থাকে না। সে জন্য আমরা অনুসরণ করেছি, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘মাকতাবা শামেলা’ থেকে, যা অনুসরণ করে থাকেন আরব দেশসমূহ-সহ সারা বিশ্বের বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম ও পাঠকবৃন্দ। এ নম্বর অনুসারেই ইন্টারনেটে আপনারা এ হাদীসগুলো খুঁজে পাবেন। এ জন্য বাংলাদেশে প্রকাশিত হাদীসগ্রন্থগুলোর সাথে উক্ত নম্বরের একটু গড়মিল হতে পারে বলে আমরা দুঃখিত। তবে, তাওহীদ পাবলিকেশন্স (৯০ হাজী আবদুল্লাহ সরকার লেন, বংশাল, ঢাকা) থেকে প্রকাশিত হাদীস গ্রন্থের সাথে অত্র বইয়ের নম্বরের মিল খুঁজে পাবেন, ইনশাআল্লাহ।
০ অন্যান্য ক্ষেত্রে গ্রন্থের নাম, কোথাও খণ্ডের নাম ও পৃষ্ঠা ব্যবহার করা হয়েছে ।
মাযহাবের সংখ্যা অনেক হলেও পৃথিবীতে চারটি মাযহাব প্রসিদ্ধি লাভ করে। সংখ্যাধিক্যের হার হিসেবে ভারতবর্ষে হানাফী, আফ্রিকার দেশগুলোতে মালেকী, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে শাফেয়ী এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে হাম্বলী মাযহাব অনুসরণকারীদের সংখ্যাধিক্য রয়েছে। এর ব্যতিক্রম হিসেবে সবকটি মহাদেশ জুড়েই রয়েছে আহলে হাদীস মতাবলম্বী লোকেরা । মাযহাব পালনের ক্ষেত্রে মাযহাবের ইমামগণের কিছু মূলনীতি ও উপদেশ রয়েছে, তা আমরা অনেকেই জানি না। বিশেষ করে মতবিরোধপূর্ণ মাসআলাগুলোতে তথ্যসূত্র দুর্বল হলেও নিজ নিজ মাযহাবের রায় অন্ধভাবে মেনে চলি অনেকেই। এমন অনুসরণের অনুমতি কি আল্লাহর রাসূল (স) আমাদেরকে দিয়েছেন?
কোন বিষয়ে দুর্বল হাদীস আমল করা, অথচ একই বিষয়ে প্রাপ্ত বিশুদ্ধ হাদীসটি আমলে না আনা- এমন অদ্ভুত, অযৌক্তিক আমলের নির্দেশ কি মাযহাবের ইমামগণ আমাদেরকে দিয়েছেন? এ বিষয়ে তাঁরা আমাদেরকে কী উপদেশ দিয়েছেন, এতদসংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাণী নিম্নে তুলে ধরা হলো।
১. ইমাম আবু হানীফা (র) বলেন, “হাদীস যেটি সহীহ সেটাই আমার মাযহাব ”(রাদ্দুল মুখতার ১/১৫৪; মুকাদ্দিমাতু উমদাতুর রিয়ায়াহ- ১/১৪; হাশিয়াতু ইবনু আবেদীখ- ১/৬৩)।
২. ইমাম মালেক (র) বলেন, “আমি নিছক একজন মানুষ। ভুল করি, শুদ্ধও করি । তাই আমার মতামতকে যাচাই করে নিও। কুরআন ও সুন্নাহর সাথে যতটুকু মিলে সেটুকু গ্রহণ করো, আর গড়মিল পেলে সেটুকু বাদ দিয়ে দিও।” (ইকাযুল হিমাম, পৃষ্ঠা ১০২)
৩. ইমাম শাফেয়ী (র) বলেন, “যদি তোমরা আমার কোন কথা হাদীসের সাথে গড়মিল দেখতে পাও, তাহলে তোমরা হাদিস অনুযায়ী আমল করো, আমার নিজের উক্তিকে দেয়ালে ছুড়ে ফেল।” (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ- ১/৩৫৭)।
৪. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) বলেন, “তুমি আমার অন্ধ অনুসরণ করো না। মালেক, শাফেয়ী, আওযায়ী, সাওরী- তাঁদেরও না; বরং তাঁরা যেখান থেকে (সমাধান) নিয়েছেন তুমিও সেখান থেকেই নাও।” (ইবনুল কাইয়্যিম রচিত ‘ঈলামুল মুওয়াকেয়ীন- ২/৩০২)।
তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি রাসূল (স)-এর সহীহ হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করবে সে লোক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত।” (ইবনুল জাওযী রচিত, আল মানাকিব: ১৮২)
৫. আল্লামা ইবনে আবেদীন বলেন, “কোন মাসআলা সহীহ হাদীসের সাথে গড়মিল হলে ঐ হাদীসটিই আমল করবে । আর ঐ হাদীসই হবে তার মাযহাব। এরূপ আমল তাকে মাযহাব থেকে বের করে দেব না। হানাফী হলে সে হানাফীই থেকে যাবে।” (রাদ্দুল মুখতার- ১/১৫৪)
৬. সুনানে আবী দাউদ গ্রন্থের সংকলক মুহাদ্দিস আবু দাউদ (র) বলেন, এমন কোন লোক নেই, যার সব কথাই গ্রহণযোগ্য; কেবল রাসূলুল্লাহ (স) ছাড়া। (মাসাইলে ইমাম আহমদ: ২৭৬)
সর্বশেষে আল্লাহ তাআলার বাণীটি স্মরণ করি। তিনি বলেছেন,
“যারা (সব) কথা শুনে, অতঃপর উত্তমটি আমল করে তারাই হলো হেদায়াতপ্রাপ্ত, আর তারাই হলো বুদ্ধিমান।” (সূরা ৩৯; আয যুমার ১৮)
ইসলামের সকল বিধি-বিধানের মৌলিক নীতিমালা ও পদ্ধতিসমূহ কুরআন-সুন্নাহ’র দলীল দ্বারা সুনির্ধারিত। এতে নতুন বিধান বা পদ্ধতি আবিষ্কারের কোন সুযোগ বা অধিকার কারো নেই। ইবাদাতের ক্ষেত্রে ফরয-ওয়াজিব সম্পর্কে ভিন্ন মতের কোন অবকাশ থাকে না। তবে সুন্নাত ও মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে রাসূল (স) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই আমলের কিছু বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। ফলশ্রুতিতে হাদীসের পর্যালোচনার ভিত্তিতে মাযহাবের ইমাম ও স্কলারদের মতামত ও আমলে ছোট-খাটো বৈপরিত্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। এ ধরনের মতানৈক্য প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের মধ্যে রয়েছে, যা ঈমান-আমলের পূর্ণতার জন্য প্রতিবন্ধক নয় ।।
অনেক সময় দেখা যায় যে, জ্ঞানের ঘাটতি বা সংকীর্ণ চিন্তা-চেতনার কারণে এসব বিষয় নিয়ে অনেকে বাড়াবাড়ি করেন, যা উম্মাহর জন্য কল্যাণকর নয়। নিজের থেকে আলাদা আমল হওয়ার কারণে সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আমলকারীকেও কেউ কেউ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন বা কটাক্ষ করেন, যা কারো জন্যই সমীচীন নয়। সুন্নাহ’র প্রতি মর্যাদা ও মহব্বত সমুন্নত রাখার স্বার্থেই এ ব্যাপারে আমাদেরকে সাবধান ও সংযত হওয়া দরকার।
কখনো কখনো দলীল-প্রমাণ বিশ্লেষণের তুলনায় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত অনুকরণ ও পক্ষ অবলম্বনের কারণে কারো তৎপরতা সুন্নাহ-বিরোধীও হয়ে যেতে পারে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের সকলের উচিত মানুষকে সরাসরি কুরআন-সুন্নাহর প্রতি আহ্বান জানানো। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন যুগের ইমাম, মুজতাহিদ ও স্কলারগণ পরবর্তীদের জন্য নেয়ামত-স্বরূপ। যাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান, বিশ্লেষণ ও মতামত থেকে মুসলিম মিল্লাত চিরকাল উপকৃত হবেন ।
মুসলিম উম্মাহ’র অবিচ্ছেদ অংশ হিসেবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের অন্তর্ভুক্ত সকলের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পাস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি বজায় রাখা কর্তব্য। কারো আমলের বিপরীতে সহীহ কথা জানা থাকলে ঝগড়া-বিবাদ বা তিরষ্কার না করে দলীলপ্রমাণের ভিত্তিতে আরো সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল হয়ে দরদী মন নিয়ে সংশোধনের চেষ্টা অব্যাহত রাখার মাধ্যমেই বরকত ও কল্যাণ হাসিল করা যাবে । মহান আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ কথা জানা, বুঝা ও মানা’র তাওফীক দান করুন। আমীন!