জাহেলী যুগে আরবের মুশরিকদেরকে শয়তান বিভিন্ন রকমের ধ্যান-ধারণা দেয়ার মাধ্যমে শির্কে লিপ্ত করেছিল। তাদেরকে যে সব ধ্যান-ধারণা দিয়েছিল তন্মধ্যে অন্যতম একটি ধারণা এমন দিয়েছিল যে, আল্লাহর ওলি ও ফেরেশ্তাদের নামে তাদের যে সব দেব-দেবী রয়েছে সেগুলো আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মাঝে মধ্যস্থতাকারী। এদের মধ্যস্থতা গ্রহণ করলে অতি সহজে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায়। আবার এদের মধ্যস্থতা পেতে হলে এদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হয়। সে জন্যে তারা এদের উদ্দেশ্যে মানত করতো। এদের কাছে অবস্থান করতো। সাহায্যের জন্য এদেরকে আহ্বান করতো। তারা যে এদের মধ্যস্থতা পাওয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এ জাতীয় উপাসনা করতো সে সম্পর্কে তারা নিজেরাই বলতো :
﴿مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ ﴾ [الزمر: ٣]
‘‘আমরা তাদের উপাসনা করছি কেবল এ জন্য যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী করে দেবে।’’[1]
মুশরিকদের এ কথার দ্বারা পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে, তারা যে সব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা করতো, তন্মধ্যে এদের ওসীলায় আল্লাহর নিকটবর্তী হতে চাওয়া তাদের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। কালের পরিক্রমায় ওলীদের ব্যাপারে শয়তান বহু মুসলিমদের অন্তরেও এ জাতীয় ধারণার জন্ম দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তাদেরকে আরো ধারণা দিয়েছে যে, তাঁদের মাধ্যমে মানুষেরা তাদের জীবনের ছোট ছোট বিষয়াদি প্রাপ্ত হয়ে থাকে। পৃথিবীর নিয়ম-শৃঙ্খলা তাঁদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়ে থাকে। আল্লাহ তাঁদের মাঝ থেকে কতিপয় ব্যক্তিকে আবদাল, আওতাদ, আবরার, গাউছ ও কুতুব... ইত্যাদি প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন।[2]
আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে গউছ খেতাব পেয়েছিলেন বলেই তাঁকে গউছুল আ‘জম বলা হয়ে থাকে। একই কারণে চট্রগ্রামের মাইজভাণ্ডারের আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারীকেও গউছুল আ‘জম বলা হয়। প্রেসিডেন্টের কাছে মন্ত্রীদের যেরূপ মর্যাদা থাকে, আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাঁদের সে রকম মর্যাদা রয়েছে। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা যেমন প্রেসিডেন্টের মাধ্যম হয়ে থাকেন, তেমনি আল্লাহর নিকট সাধারণ মানুষের সমস্যাদি উপস্থাপন করা, তাদের মনস্কামনা পূর্ণ করিয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা এবং তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়ার ক্ষেত্রে ওলিগণ হলেন আল্লাহর মাধ্যম বা ওসীলা ! [নাউযুবিল্লাহ]
মানুষের জীবনের ইহলৌকিক সমস্যা ও তা সমাধানের মাধ্যম:
মানুষের জীবনের সমস্যাদি মোট দু’ভাগে বিভক্ত :
এক, জীবন ও জীবিকার সমস্যা। দুই, পরকালীন সমস্যা। প্রতিটি মানুষই পৃথিবীতে ভাল জীবন ও জীবিকা পেতে চায় এবং প্রতিটি মু’মিন মাত্রই আখেরাতে শান্তিময় জীবন লাভ করতে চায়। পৃথিবীতে ভাল জীবন ও জীবিকা লাভের বিষয়টি মানুষের ভাগ্যের সাথে সম্পর্কিত। ভাগ্য নির্ধারণ সম্পর্কে আমরা এ বই এর প্রথম অধ্যায়ে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তাই এখানে এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছু না বলে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আল্লাহর ইনসাফ ও বিচারে যে মানুষকে যে জীবন ও জীবিকা প্রদান করা উচিত ও তার জন্য মঙ্গলজনক বলে তিনি মনে করেছেন, তাকে তিনি সে জীবন ও জীবিকা প্রদানের পরিকল্পনা পূর্ব থেকেই করে রেখেছেন। প্রতিটি মানুষের ভাগ্যে কী জীবন ও জীবিকা রয়েছে তা খতিয়ে দেখার মাধ্যম সে নিজেই।
সুস্থ জীবন ও উত্তম জীবিকা লাভ করার জন্য তাকে শরী‘আতসম্মত বৈধ উপায় ও পন্থায় প্রয়োজনীয় কর্ম করতে হবে। যে সকল কর্ম করার ক্ষেত্রে জীবিত মানুষেরা একে অন্যের স্বাভাবিকভাবে কর্ম বা দো‘আ করার মাধ্যমে সাহায্য করতে পারে, সে সকল ক্ষেত্রে অন্যের কর্ম বা দো‘আর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে নিজে ও প্রয়োজনে অন্য জীবিত মানুষের সাহায্য নিয়ে কর্ম করে কর্মের ফল প্রাপ্তির জন্য সর্বদা আল্লাহর কাছেই তাঁর দয়া কামনা করতে হবে। ধৈর্যের সাথে যাবতীয় সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। ভাগ্য পরিবর্তনে বিলম্ব হচ্ছে দেখে কোনো অবস্থাতেই ধৈর্যহারা হয়ে কোনো বিকল্প পথে ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো পীর, ফকীর ও ওলির কবরে এ জন্য কোনো আবেদন-নিবেদন করা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকতে হবে।
মনে রাখতে হবে যে, ভাগ্যে সুস্থ জীবন, সন্তান ও উত্তম জীবিকা লেখা থাকলে বৈধ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে তা আজ হোক কাল হোক, পাওয়া যাবেই। কেউ হাজার ষড়যন্ত্র করেও তা ঠেকাতে পারবে না। আর ভাগ্যে তা লেখা না থাকলে সারা দুনিয়ার জীবিত ও মৃত মানুষেরা সাহায্য ও দো‘আ করলেও তা পাইয়ে দিতে পারবে না। বৈধ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তিত হলে তা যেমন আল্লাহরই দান হয়ে থাকবে, তেমনি অবৈধ পন্থা অবলম্বনের পর তা পরিবর্তিত হলে তাও আল্লাহরই দ্বারা হয়ে থাকবে। দুয়ের মাঝে পার্থক্য এটুকু যে, যারা বৈধ পন্থা অবলম্বন করে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করে, তারাই হবে প্রকৃত মু’মিন ও আল্লাহর প্রিয়ভাজন বান্দা। আর যারা অধৈর্য হয়ে কবর ও কবরে যেয়ে রোগ মুক্তি, সন্তান দান ও উত্তম জীবিকা ইত্যাদি চাইবে, তারা হবে মুশরিক ও আল্লাহর বিরাগভাজন।
পরকালীন সমস্যা সমাধানের মাধ্যম:
এ ক্ষেত্রে শরী‘আতের একক শিক্ষা হলো : ঈমান ও সৎ ‘আমলই হচ্ছে মানুষের পরকালীন সমস্যা সমাধানের একক মাধ্যম বা ওসীলা। এ দু’টি গুণ ব্যতীত যারা অন্য কোনো উপায়ে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায় বলে মনে করে, তারা মূলত কল্পনার জগতেই বসবাস করে। মুহাজির, আনসার ও তাঁদের অনুসারী পরবর্তী মনীষীগণ এ বিষয়টি অনুধাবন করেই ঈমান ও ‘আমলে সালেহ এর ক্ষেত্রে অধিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। যার ফলেই সাহাবীদের মধ্যকার দশজন ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ দুনিয়াতে থাকতেই জান্নাতের আগাম সনদ লাভ করেছিলেন। বাকিরা সনদ লাভ না করলেও তা লাভ করার যোগ্য হয়েছিলেন। এক কথায় আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য কুরআনুল কারীমে বর্ণিত-
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱبۡتَغُوٓاْ إِلَيۡهِ ٱلۡوَسِيلَةَ﴾ [المائدة: ٣٥]
‘‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ কর’’।[3]
এ আয়াতে ওসীলা অন্বেষণের যে নির্দেশ রয়েছে, এর দ্বারা তাঁরা ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করার প্রতি নির্দেশ করার কথাই বুঝেছিলেন।
জ্ঞানী ও সৎ মানুষদের সাহচর্য গ্রহণ :ঈমান কী এবং কিভাবে ‘আমলে সালেহ করতে হয়, তা তাঁদের কারো জানা না থাকলে সে জন্য তাঁরা জ্ঞানী ও সৎ জনের সাহচর্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের শিক্ষার অনুসরণ ও অনুকরণ করে সে অনুযায়ী ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করাকেই তাঁরা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার একক ওসীলা হিসেবে গণ্য করেছিলেন। ঈমান ও ‘আমলে সালেহ না করে কেবলমাত্র সৎ মানুষদের সাহচর্য গ্রহণ করা বা তাঁদের হাতে বায়‘আত[4] করাকেই তাঁরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মূল উপায় হিসেবে নির্ধারণ করেন নি। অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁরাই ছিলেন আমাদের একমাত্র আদর্শ। তাই আমাদেরকেও তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করে আখেরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে শান্তিময় জীবন লাভের আশা করতে হবে।
>[2]. লেখকের মূল কথার উদ্ধৃতি এ বই এর প্রথম অধ্যায়ের ২৫ নং টীকায় প্রদান করা হয়েছে। দেখুন : দৈনিক ইনকিলাব, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ খ্রি., পৃ.৬।
[3]. আল-কুরআন, সূরাহ মা-ইদাহ : ৩৫।
[4]. যদিও এ ধরনের বাই‘আত গ্রহণ জঘন্য বিদ‘আত। এর অধিকার তাদের নেই। এ অধিকার শাসকদের জন্য নির্ধারিত। [সম্পাদক]
কিন্তু কালের পরিক্রমায় এক শ্রেণীর মানুষেরা তাঁদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবের সুযোগে শয়তান তাদের মাঝে ওসীলা সম্পর্কে ভুল ধারণা দিতে সক্ষম হয়। একশ্রেণীর মানুষকে এ ধারণা দিতে সক্ষম হয় যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া ও আখেরাতে মুক্তি পাওয়ার জন্য শুধুমাত্র ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করাই যথেষ্ট নয়। এ জন্য প্রয়োজন রয়েছে একজন ওলির হাতে বায়‘আত ও তাঁর ওসীলা গ্রহণ। যেমন একজন পীর বায়‘আতের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা প্রসঙ্গে উক্ত আয়াতে বর্ণিত ওসীলা শব্দের অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন :
‘‘আমরা দুনিয়াতে দেখি কোনো কাজই ওসীলা ব্যতীত হয় না, আর সে জন্যই আল্লাহ বলেছেন: (وابتغوا إليه الوسيلة) ‘‘আল্লাহ পাকের মহববত অর্জন করার জন্য অছিলা তালাশ কর।’’[1] এ আয়াতের সরল অর্থ বর্ণনা করার পর এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওসীলা অন্বেষণ করা দ্বারা যে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর উপর ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করার মাধ্যমেই তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ করতে বলেছেন, তিনি এ কথা না বলে বলেছেন : আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ‘‘একজন পীরের হাতে বায়‘আত কর।’’ ভাবটা যেন এমন যে, কোনো পীরের হাতে বায়‘আত করলেই যেন সাধারণ মানুষের জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম হয়ে গেল। একজন সাধারণ মানুষ একজন শরী‘আতী পীরের হাতে বায়‘আত করলে[2] এতে তার পক্ষে শরী‘আত সম্পর্কে জানা এবং সে অনুযায়ী ‘আমল করা সহজ হবে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু পীর সাহেব যদি নিজেকে সাধারণ মানুষের ত্রাণকর্তা ভাবতে শুরু করেন, আর মুরীদরা যদি পীর ব্যতীত মুক্তির কোনো পথ নেই বলে ভাবতে থাকে, তা হলেই তো সমস্যার সৃষ্টি হয়। অপরাধীরা যতই অপরাধ করুক না কেন, তাদের ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আল্লাহর দরজা সব সময়ই উন্মুক্ত। তাওবায়ে নাসূহা তথা খাঁটি তাওবা করলেই তিনি তাদের অপরাধ মার্জনা করেন। এ সত্যটি কুরআনের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়ে থাকলেও পীর সাহেবগণ তা বেমালুম ভুলে যান। তারা বলেন-অনেক অপরাধ করলে না কি আল্লাহ অপরাধীদেরকে কোনো পীরের ওসীলা ব্যতীত মাফ করতে চান না। যেমন উক্ত পীর সাহেব এ সম্পর্কে বলেন :
‘‘বান্দার গুনাহ যখন অধিক হয়ে যায়, তখন কোনো মাধ্যম ব্যতীত সরাসরি আল্লাহর কাছে তাওবা করলে আল্লাহ তা মাফ করতে চান না, কিন্তু যখন তার পীর এখলাসের সাথে তার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করেন, তখন তিনি তার তাওবা কবুল করেন অথবা পীরের দো‘আর বরকতে তার তাওবা কবুল হওয়ার আশা করা যায়।’’[3] পীরের হাতে বায়‘আত ও পীরের ওসীলা ব্যতীত কারো মুক্তি নেই, এ কথা প্রমাণ করার জন্য তিনি তাঁর কিতাবে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর মৃত্যুকালীন সময়ে ঘটিত ঈমান হননকারী একটি অদ্ভুত ঘটনারও উল্লেখ করেছেন।[4]
শয়তান অপর এক শ্রেণীর লোকদেরকে ওসীলা সম্পর্কে এ ধারণা দিয়েছে যে, আল্লাহর নিকবর্তী হওয়া ও আখেরাতে মুক্তির জন্য শরী‘আত পালনের খুব একটা আবশ্যকতা নেই। এ-জন্য মূলত প্রয়োজন ওলিদের সাহচর্য, তাঁদের সন্তুষ্টি ও ভালবাসা। এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ওলিদের শিক্ষার অনুসরণ ও অনুকরণ করার বদলে সে তাদেরকে তাঁদের কবর ও কবরকে কেন্দ্র করে এমন সব কর্ম করতে লিপ্ত করেছে, যার কারণে তারা তাঁদেরকে উপাস্যে এবং নিজেদেরকে তাঁদের উপাসকে পরিণত করেছে। উদাহরণস্বরূপ কোনো ওলির কবর বা কবরের খেদমত করা, সেখানে নামায আদায় করা, কবরের পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করা, ও এর চারপার্শ্বে প্রদক্ষিণ করার কথা উল্লেখ করা যায়।
এগুলো কা‘বা শরীফকে কেন্দ্র করে করলে তা আল্লাহর উপাসনা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। কিন্তু কোনো কবর বা কবর আল্লাহর উপাসনার স্থান না হওয়ায় সেখানে এ সব কাজ করলে তা সংশ্লিষ্ট কবর বা কবরবাসীর সান্নিধ্য অর্জন ও তাঁর উপাসনা হিসেবে গণ্য হবে। কেননা, কোনো উপাসনা খালিসভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হওয়ার জন্য পূর্ব শর্ত হচ্ছে তা শির্কমুক্ত স্থানে হতে হবে এবং তা এককভাবে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যেই হতে হবে, তা না হলে হাদীস অনুযায়ী তা শির্কী কর্ম হিসেবে গণ্য হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
«مَنْ عَمِلَ عَمَلاَ أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِيْ غَيْرِيْ تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ وَجَعَلْتُ الْعَمَلَ لِلَّذِيْ أَشْرَكَهُ»
‘‘যে ব্যক্তি কোনো কাজে আমার সাথে অপরকে শরীক করে নিল, আমি তাকে ও তার কাজকে ছেড়ে দেই এবং সে কাজটি তার জন্যই দিয়ে দেই, যাকে সে উক্ত কাজে শরীক করেছে।’’[5]
>[2]. সম্ভবত: লেখক ‘শরীয়তী পীর’ বলে সত্যিকার আলেমদের বুঝিয়েছেন, নতুবা পীর শব্দটি ইসলামের কোনো গ্রহণযোগ্য শব্দ নয়। শরীয়তী পীর বলতে কিছু নেই। তাছাড়া আলেমের হাতেও বাই‘আত হওয়ার অধিকার নেই; কারণ বাই‘আত শরী‘য়তের পরিভাষা, শরী‘য়ত নির্ধারিত স্থানেই তা করতে হয়। শাসক ও যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা পরিচালকের নিকট ব্যতীত আরও কারও নিকট তা হওয়া জায়েয প্রমাণিত হয় নি। [সম্পাদক]
[3]. তদেব; পৃ. ২৪।
[4]. ঘটনাটি নিম্নরূপ : একদা ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী একজন পীরের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করতে ইচ্ছা করে সে পীরের কাছে গমন করেন। পীর সাহেব বললেন : তোমার মধ্যে ইলমে মা‘রেফাত প্রবেশ করাবার কোনো স্থান নেই বিধায়, আমি তোমার বায়‘আত নিতে পারবো না। ফলে ইমাম রাযী হতাশ হয়ে ফিরে আসেন। পীর বিহীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যুর সময়ে শয়তান কুমন্ত্রণা দিতে আসলে পীর ছাড়া তাঁর কী অবস্থা হবে, এ নিয়ে তিনি খুব ভাবতে থাকলেন। অতঃপর তাঁর মৃত্যুকালীন সময়ে শয়তান এসে তাঁর নিকট আল্লাহর ব্যাপারে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে, যার ফলে ঈমান বিহীন অবস্থায়ই তাঁর মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক এমন সময় অযুরত অবস্থায় বহু দুর থেকে কশফের মাধ্যমে সে পীর সাহেব তাঁর এ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন, তখন তিনি ইমাম রাযী যে দিকে সেদিকে পানি ছিটিয়ে দিলেন এবং ইমাম রাযীকে লক্ষ্য করে বলেন: শয়তানকে বল, বিনা দলীলে আল্লাহ একজন, আল্লাহর এক হওয়ার জন্য কোন দলীলের প্রয়োজন নেই। তদেব; পৃ. ৩১-৩২। (বস্তুত: এটি একটি গাঁজাখুরি গল্প, ইমাম রাযীর জীবনে বা অন্য কারও জীবনে এটা ঘটে নি। [সম্পাদক])
[5]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; ৪/২২৮৯; ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আজীম; ২/৪৯৫।
‘ওসীলা’ (وَسِيْلَة) শব্দটি আভিধানিক দিক থেকে মাধ্যম (Media)[1] ও নৈকট্য এর অর্থ প্রকাশ করে থাকে।[2] উপরে বর্ণিত আয়াতে ‘ওসীলা’ শব্দেটিকে উভয় অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সাহাবা, তাবেঈন ও বিশিষ্ট মনীষীগণ অত্র আয়াতে এ শব্দটিকে ‘মাধ্যম’ অন্বেষণের অর্থে ব্যবহার না করে ‘নৈকট্য’ অন্বেষণের অর্থে ব্যবহার করেছেন। ফলে তাঁদের মতে এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে-‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং (ঈমান ও ‘আমলে সালেহ দ্বারা) তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ কর।’’[3] বিশিষ্ট তাবেঈ ক্বাতাদাঃ (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
«تقربوا إليه بطاعته و العمل بما يرضيه»
‘‘তাঁর আনুগত্য এবং যে-সব কাজ তাঁকে সন্তুষ্ট করে সে-সব কাজের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য ও সান্নিধ্য অন্বেষণ কর’’।[4] যদি ‘ওসীলা’ শব্দটিকে ‘মাধ্যম’ অর্থে ব্যবহার করা হয় তা হলে উক্ত আয়াতের অর্থ হবে: ‘‘তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য মাধ্যম অন্বেষণ কর’’। যদি এই অর্থ করা হয় তা হলে প্রশ্ন দাঁড়াবে, মাধ্যম বলতে এখানে কী উদ্দেশ্য করা হয়েছে? এ প্রশ্নের স্বাভাবিক জবাব হচ্ছে- ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করে এ দু’য়ের মাধ্যমে তাঁর নিকটবর্তী হতে চাও। ‘আমলে সালেহ এর মধ্যে জীবিত সৎ মানুষদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা, তাঁদের সান্নিধ্যে থাকা, নবী-রাসূল ও ওলিগণকে ভালবাসা, তাঁদের শিক্ষার অনুসরণ ও অনুকরণ করা ইত্যাদি বিষয়াদি থাকলেও মৃত বা জীবিত কোনো ওলিদের ব্যক্তিত্ব, তাঁদের মর্যাদা ও নামের মাধ্যম করে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার অর্থটি এখানে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় বা তাঁর ওফাতের পরেও তাঁর সাহাবীদের মাঝে তাঁর মর্যাদা ও নাম নিয়ে এমন ওসীলার কোনো প্রচলন ছিল না।
যে সব সহীহ হাদীস দ্বারা বাহ্যত এমন কিছু বুঝা যায়, আসলে সে সবের দ্বারা তাঁর দো‘আর ওসীলাই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। ব্যক্তি রাসূল, তাঁর নাম ও মর্যাদার ওসীলা উদ্দেশ্য করা হয় নি। এ প্রসংগে কিছু মরফু‘ ও মাওকুফ হাদীস বর্ণিত হয়েছে ঠিকই, তবে হাদীস বিশেষজ্ঞদের মতে তা দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য।[5] কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু কিছু আলেম ও পীরদের মুখে এমনকি কোনো কোন তাফসীরকারকদের কলমেও এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শয়তান এ অপ্রাসঙ্গিক অর্থটি জুড়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। যেমন মাওলানা মুফতী শফী‘ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাঁর তাফসীর গ্রন্থে এ অর্থটি জুড়ে দিয়ে লিখেছেন :
‘‘ওসীলা শব্দের আভিধানিক ব্যাখ্যা এবং ছাহাবী ও তাবেয়ীগণের তফসীর থেকে জানা গেল যে, যে বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের মাধ্যম হয়, তা-ই মানুষের জন্য আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার ওসীলা। ঈমান ও সৎ কর্ম যেমন এর অন্তর্ভুক্ত, তেমনি পয়গম্বর ও সৎ কর্মীদের সংসর্গ এবং মহববতও এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা, এগুলোও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভেরই উপায়। এ কারণেই তাঁদেরকে ওসীলা করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা জায়েয।’’ [6]
এখানে তিনি ‘‘তাঁদেরকে ওসীলা করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা জায়েয’’ এ মর্মে যে কথাটি বলেছেন এর দ্বারা তিনি যদি এ উদ্দেশ্য করে থাকেন যে, জীবিত ওলিদেরকে সাথে নিয়ে তাঁদের দো‘আর ওসীলায় দো‘আ করা জায়েয, তা হলে তাতে আপত্তির কিছু নেই। তবে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার ওসীলা হিসেবে পয়গাম্বর ও সৎ কর্মীদের সংসর্গ ও মহববতের কথা বলার পর এ কথাটি পৃথক করে বলাতে প্রমাণিত হয় যে, আসলে তিনি তাঁর এ কথার দ্বারা তা উদ্দেশ্য করেন নি। বরং মৃত নবী ও ওলিদের মর্যাদা এবং তাঁদের নামের ওসীলায় আল্লাহ তা‘আলার নিকট দো‘আ করার যে প্রচলন সমাজে রয়েছে, সে ওসীলার কথাই তিনি তাঁর এ কথার দ্বারা উদ্দেশ্য করেছেন। অথচ তা সম্পূর্ণ একটি ভ্রান্ত কথা।
যার সাথে এ আয়াতে বর্ণিত নির্দেশের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। এমন কি ওসীলা সম্পর্কে তিনি এ কথার পর যা বলেছেন তার সাথেও তাঁর এ কথার আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা, নেক মৃত মানুষের মহববত করা এক জিনিষ আর তাঁদের নামের ওসীলায় দো‘আ করা একটি ভিন্ন জিনিষ। প্রথমটি মানুষের ঈমানের পরিচায়ক, আর অপরটি শরী‘আত বহির্ভুত একটি বেদ‘আতী কর্ম। কিন্তু তা সত্ত্বেও শয়তান তাঁর মত ব্যক্তি ও অন্যান্য পীরদের মুখ ও লেখনীতে এ কথাটিকে চালিয়ে দিয়ে অজ্ঞ ও মুর্খ মুসলিমদেরকে পথভ্রষ্ট করার একটি উত্তম সুযোগ করে নিয়েছে।
কুরআনে বর্ণিত ‘ওসীলা’ শব্দের অর্থ বর্ণনার ক্ষেত্রে তারা যদি তাদের সলফগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন, তা হলে সমাজে ‘ওসীলা’ ধরা নিয়ে শয়তান এতো বিভ্রান্তি ছড়াতে পারতো না।
‘ওসীলা’ শব্দটি কুরআনে করীমের মোট দু’স্থানে বর্ণিত হয়েছে। একটির কথা উপরে বর্ণিত হয়েছে। আর অপরটি বর্ণিত হয়েছে সূরা ইসরাতে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ﴾ [الاسراء: ٥٧]
‘‘মুশরিকরা যাদেরকে (হিত সাধন বা অনিষ্ট রোধের জন্য) আহ্বান করে তারা নিজেরাই (এখন) তাদের রবের অধিক নিকটবর্তী হওয়ার ক্ষেত্রে ওসীলা অন্বেষণে প্রতিযোগিতা করে, তাঁর রহমত কামনা করে এবং তাঁর আযাবকে ভয় করে’’।[7]
এ আয়াতে বর্ণিত ‘ওসীলা’ শব্দটিকেও উপর্যুক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘ওসীলা’ শব্দের ন্যায় ওসীলার উভয় অর্থেই ব্যবহার করা যেতে পারে[8]। এ ছাড়া সহীহ হাদীসে আজানের পর পঠিত দো‘আর মধ্যেও ‘ওসীলা’ শব্দটি বর্ণিত হয়েছে। তবে সেখানে তা আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থানের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
«سَلُوا اللَّه لِيَ الْوَسِيْلَةَ فَإِنَّهَا دَرَجَةٌ فِي الْجَنَّةِ لاَ تَنْبَغِيْ إِلاَّ لِعَبْدٍ مِنْ عِبَادِ اللَّهِ فَمَنْ سَأَلَ لِيْ الْوَسِيْلَةَ حَلَّتْ لَهُ الشَّفَاعَةُ»
‘‘তোমরা আজানের পর আমার জন্য আল্লাহর নিকট ওসীলা কামনা কর। কেননা, তা এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থান যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে কেবল একজন বান্দার জন্যেই শোভা পাবে। যে আমার জন্য ওসীলা কামনা করবে তার জন্য আমার শাফা‘আত হালাল হয়ে যাবে।’’[9]
উক্ত বর্ণনার দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ‘ওসীলা’ শব্দটি কুরআন ও হাদীসে মোট দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হচ্ছে- নৈকট্য বা নৈকট্যের মাধ্যম অর্থে। আর অপরটি হচ্ছে মর্যাদাপূর্ণ স্থান এর অর্থে। আর নৈকট্যের মাধ্যম এর অর্থে এটিকে গ্রহণ করলে এর অর্থ দাঁড়ায়- ঈমান, সৎকর্ম, মৃত নবী ও নেক মানুষদের ভালবাসা, তাঁদের আদর্শ অনুসরণ, জীবিত নেক মানুষের সাহচর্য গ্রহণ, তাঁদের দো‘আ, ভালবাসা ও তাঁদের আদর্শ অনুসরণ ইত্যাদির ওসীলায় আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ করা। স্রেফ তাঁদের নাম ও মর্যাদার ওসীলায় বা তাঁদের কবরের পার্শ্বে বসে আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ ও এর ওসীলায় ইহ-পরকালীন কিছু চাওয়া নয়।
আল্লাহর নিকট কোনো জীবিত বা মৃত মানুষের মর্যাদার ওসীলায় কিছু চাওয়া যায় না :
প্রকৃতকথা হচ্ছে- একজন মানুষ অপর কোনো মানুষের নিকট থেকে তার কোনো উদ্দেশ্য সহজে হাসিল করার জন্য তৃতীয় কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তির নামের মাধ্যমে তার কাছে তা চাইতে পারে এবং দ্বিতীয় ব্যক্তিও তৃতীয় ব্যক্তির নাম শুনে তিনটি কারণে প্রথম ব্যক্তির চাহিদা ও আবদার পূর্ণ করতে পারেন। কারণগুলো হচ্ছে :
১. দ্বিতীয় ব্যক্তি তৃতীয় ব্যক্তির নাম শুনে তার মর্যাদার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তা করতে পারেন।
২. তৃতীয় ব্যক্তির সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কায় তিনি তা করে দিতে পারেন।
৩. তৃতীয় ব্যক্তির নিকট থেকে তার নিজের কোনো প্রয়োজন হাসিল করার জন্য তা করে দিতে পারেন।মানুষ মানুষের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়, একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয় বলে তাদের মাঝে এ ধরনের ওসীলা চলতে পারে। মহান আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী না হওয়ায় এবং কারো দ্বারা তিনি প্রভাবিত না হওয়ায় তাঁর কাছে কারো নাম ও মর্যাদার ওসীলায় দো‘আ করা যেতে পারে না। নবী ও ওলিদের যে মর্যাদা রয়েছে তা তাঁরই দেয়া। সুতরাং তাঁদেরকে তাঁরই দেয়া জিনিষের ওসীলায় তাঁর কাছে কিছু আবদার করা তাঁর সাথে বেআদবী করারই নামান্তর। তিনি কারো কোনো উদ্দেশ্য পূর্ণ না করলে এতে তাঁর কোনো ক্ষতিরও আশঙ্কা নেই। এমতাবস্থায় তাঁর কাছে কারো নাম, মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলায় কিছু চাওয়া আল্লাহর সাথে মানবীয় আচরণ করারই শামিল।
>[2]. ইবনুল আছীর, আন-নেহায়াতু ফী গারীবিল হাদীসি ওয়াল আছার; (বৈরুত: আল-মাকতাবাতুল ইলমিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ৫/১৮৫; ইবনে মানযূর আল-আফরীক্বী, লেসানুল আরব; ১১/৭২৪।
[3]. বিশিষ্ট তাবেঈ আবু ওয়াইল, হাসান, মুজাহিদ, ক্বাতাদাহ, ’আত্বা ও সুদ্দি এ আয়াতে বর্ণিত ‘ওসীলা’ শব্দটিকে ‘ক্বুর্বাত’ তথা নৈকট্য অর্থে ব্যবহার করেছেন। দেখুন : কুরতবী, প্রাগুক্ত; ৬/১৫৯; ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ৬/২২৫।
[4]. ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আজীম; ২/৫৩।
[5] . ইবনে তাইমিয়্যাহ, আত-তাওয়াসসুলু ওয়াল ওয়াসীলাতু; পৃ.৪৭।
[6]. মাওলানা মুফতী শফী‘, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩২৭।
[7] . আল-কুরআন, সূরা ইসরা বা বনী ইসরাঈল: ৫৭।
[8] . আমরা আগেই বলেছি যে, ওসীলা দ্বারা শুধু ‘মাধ্যম’ অর্থ নেওয়া কোনো গ্রহণযোগ্য অভিধানবিদের মত ছিল না। [সম্পাদক]
[9]. ইবনে খুযায়মাহ, মুহাম্মদ, সহীহ; সম্পাদনা : ড. মুহাম্মদ মুস্তফা আল-আ‘জমী, (বৈরুত : আল-মাকতবুল ইসলামী, সংস্করণ বিহীন, ১৯৭০ খ্রি.), ১/২১৮।
জীবিত মানুষের দো‘আর ওসীলা দু’ভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে :
এক, কোনো জীবিত মানুষের কাছে গিয়ে এ কথা বলা যেতে পারে যে, আমি অমুক সমস্যায় পতিত হয়েছি, আপনি আমার জন্য এ মুহূর্তে আল্লাহর কাছে একটু দো‘আ করুন। এ ধরনের দো‘আ কামনা করার বিষয়টি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যা আমরা একটু পরে বর্ণনা করবো।
দুই, কোনো জীবিত মানুষের নিকট গিয়ে এ মর্মে দো‘আ কামনা করা যেতে পারে যে, আপনি আমার জন্য দো‘আ করবেন। দো‘আকারী যদি অসাক্ষাতে দো‘আ করেন, তা হলে তার দো‘আ আল্লাহ তা‘আলার নিকট মঞ্জুর হওয়ার অধিক সম্ভাবনার কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। উম্মুদ দরদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«دَعْوَةُ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ لاَخِيْهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مُسْتَجَابَةٌ...»
‘‘একজন মুসলিম ভাইয়ের জন্য তার অসাক্ষাতে মুসলিম ব্যক্তির দো‘আ মকবূল হয়ে থাকে।’’[1]তবে এ ধরনের দো‘আ কামনা যে শুধু সাধারণ লোকেরাই কেবল সৎ লোকজনের নিকটেই চাইবে তা নয়, বরং একজন মর্যাদাবান ব্যক্তিও তাঁর চেয়ে কম মর্যাদাবান ব্যক্তির নিকটে তা চাইতে পারেন। এমন দো‘আ চাওয়ার প্রচলন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই প্রমাণিত। একদা ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘উমরা পালন উপলক্ষে মক্কায় যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অনুমতি চাইলে তিনি তাঁকে অনুমতি দানপূর্বক বলেন : ‘‘ভাই! (সফরের অবস্থায় যখন তুমি দো‘আ করবে তখন) তোমার নেক দো‘আ থেকে আমাদের ভুলে যেও না।’’[2] এটি হচ্ছে জীবিত মানুষের দো‘আর ওসীলা গ্রহণের একটি সঠিক পদ্ধতি। এতে প্রমাণিত হয় যে, একজন সাধারণ মানুষ যেমন একজন ওলি ও পীর সাহেবের নিকট দো‘আ কামনা করতে পারে, তেমনি একজন পীর সাহেবও একজন সাধারণ মানুষের নিকট দো‘আ চাইতে পারেন। কোনো পীর সাহেব যে মানুষের জন্য দো‘আ করার এজেন্সী নিয়ে বসে থাকবেন বিষয়টি এমন নয়।
>[2] . আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; সালাত অধ্যায়, বাবুদ দু‘আ; ২/১৬৯; হাদীসটি ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহ থেকে বর্ণিত। কুরতুবী, প্রাগুক্ত; ১২/৩২১। (তবে হাদীসটির সনদ দুর্বল, [সম্পাদক])
কিন্তু দো‘আর সময় নবী ও ওলিদের নামের মাধ্যম ধরে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার কথা বা অনুমতি কুরআন ও হাদীসের দ্বারা সমর্থিত নয়। এর কারণ হলো, এভাবে কারো নামের কথা শুনিয়ে কিছু চাওয়া হচ্ছে মানবীয় ব্যাপার। আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার সময় এমনটি করা ঠিক নয়। কেননা, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন বলে তাঁর সাথে মানবীয় আচরণ করা প্রকারান্তরে তাঁকে মানুষের মর্যাদার দ্বারা প্রভাবিত করতে চাওয়ারই শামিল। তিনি কারো মর্যাদার দ্বারা প্রভাবিত হন না বলেই কেউ তাঁর নিকট নিজের মর্যাদার ওসীলায় আখেরাতে কারো জন্যে কোনো শাফা‘আত করতে পারবে না। যে মর্যাদার মূল্য আখেরাতে নেই সে মর্যাদার ওসীলায় দুনিয়াতে তাঁর কাছে কিছু চাওয়ারও কোনো মূল্য নেই। এছাড়া তিনি কোনো মানুষের নামের মাধ্যমে বা ওসীলায় তাঁর কাছে কিছু আবদার করতে আমাদেরকে শিক্ষাও দেন নি। বরং তিনি তাঁর নিকট তাঁর নিজের নামের ওসীলায় আমাদের অভাব ও অভিযোগের কথা তাঁর নিকট উপস্থাপন করতে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে বলেছেন :
﴿ وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ﴾ [الاعراف: ١٨٠]
‘‘আল্লাহর রয়েছে উত্তম নামাবলী, সুতরাং তোমরা তাঁকে তাঁর নামের ওসীলায় আহ্বান কর।’’[1] আল্লাহ যেখানে আমাদেরকে তাঁর নামের ওসীলায় তাঁকে আহ্বান করতে নির্দেশ করেছেন, সেখানে আমরা তাঁকে তাঁর কোনো সৃষ্টির নামের ওসীলায় তাঁর নির্দেশ ব্যতীত আহ্বান করতে পারি না। যদিও সে সৃষ্টি তাঁর নিকট তাঁর সকল সৃষ্টির মধ্যে অধিক ভালবাসার পাত্রও হতে পারেন। আমরা আল্লাহর বান্দা। তাই আমাদের জীবনের যাবতীয় প্রয়োজনের কথা কোনো সৃষ্টির মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি তাঁর কাছে জানাবো, এটাই স্বাভাবিক কথা এবং যুক্তিরও দাবী। সে জন্যেই তিনি আমাদের সকলকে সৎ ও অসৎ নির্বিশেষে কোনো নবী বা ওলির মধ্যস্থতা ছাড়াই তাঁকে আহ্বান করার নির্দেশ করে বলেছেন :
﴿ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ ﴾ [غافر: ٦٠]
‘‘তোমরা আমাকে আহ্বান কর, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’’[2] সরাসরি আল্লাহকে আহ্বান করার শিক্ষা দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে বলেন :
«إِذَا سَأَلْتَ فَاسْاَلِ اللهَ، وَ إِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِالله»
‘‘যখন তুমি কিছু চাইবে তখন তা আল্লাহর কাছেই চাইবে, আর যখন কিছু সাহায্য চাইবে তখন তা আল্লাহর কাছেই চাইবে।’’[3] এরপরও কি এ কথা বলা যায় যে, তিনি নবী ও অলিগণের নামের মাধ্যম ছাড়া পাপীদের কোনো কথা শ্রবণ করেন না বা করতে চান না বা তাঁদের নামের ওসীলা নিয়ে দো‘আ করলে তিনি দো‘আ দ্রুত কবুল করবেন, অন্যথায় বিলম্বে করবেন?
প্রকৃতপক্ষে যারা এমনটি বলে তারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে। তারা আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করে। অথচ তিনি তাঁর পাপী বান্দাদের তাওবা ও দো‘আ কবুল করে তাদের অপরাধ মার্জনা করার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। তিনি তাঁর বান্দাদেরকে এ বিষয়ের সংবাদ দেয়ার জন্য তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ মর্মে নির্দেশ করেছেন :
﴿ ۞نَبِّئۡ عِبَادِيٓ أَنِّيٓ أَنَا ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٤٩ ﴾ [الحجر: ٤٩]
‘‘তুমি আমার বান্দাদেরকে সংবাদ দাও যে, আমি হলাম অধিক ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।’’[4]
অপর স্থানে এ মর্মে আহ্বান করতে বলেছেন :
﴿ ۞قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٥٣ ﴾ [الزمر: ٥٣]
‘‘বল : হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের নফছের উপর অত্যাচার করেছো তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যেওনা, নিশ্চয় আল্লাহ যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করেন, তিনিই হলেন অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’’[5]
যারা অপরাধ করে সরাসরি তাঁকে আহ্বান করে তিনি তাদের আহ্বান শ্রবণ করেন।
এ প্রসঙ্গে বলেছেন :
﴿ وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ﴾ [البقرة: ١٨٦]
‘‘আর আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে, (তখন তাদের বল) বস্তুত আমি নিকটেই রয়েছি, আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে, তখন আমি তার আহবানে সাড়া দিয়ে তা কবুল করি...।’’[6]
যারা অন্যায় করার পর দ্রুত তাঁর নিকট ক্ষমা চায়, তিনি তাদের তাওবা কবুল করেন। এ প্রসঙ্গে বলেন :
﴿ إِنَّمَا ٱلتَّوۡبَةُ عَلَى ٱللَّهِ لِلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسُّوٓءَ بِجَهَٰلَةٖ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٖ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَتُوبُ ٱللَّهُ عَلَيۡهِمۡۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمٗا ١٧ ﴾ [النساء: ١٧]
‘‘আল্লাহ অবশ্যই তাদের তাওবা কবুল করেন যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তাওবা করে, এরাই হলো সেই সব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।’’[7]
অপরাধীরা সরাসরি আল্লাহকে আহ্বান করলে তিনি তাদের আহবানে সাড়া দেন এবং তাদের অপরাধ মার্জনা করেন, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
«يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَ تَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْأَخِيْرِ فَيَقُوْلُ : مَنْ يَدْعُوْنِيْ فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ، وَ مَنْ يَسْأَلُنِيْ فَأُعْطِيَهُ ، وَمَنْ يَسْتَغْفِرُنِيْ فَأَغْفِرَ لَهُ...»
‘‘আমাদের বরকতময়, সুমহান প্রতিপালক প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে পৃথিবী সংলগ্ন আকাশে আগমন করে বলতে থাকেন- কে আমাকে আহ্বান করবে, আমি তার আহবানে সাড়া দেব, কে আমার নিকট চাইবে, আমি তাকে দান করবো, কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’’[8]
মহান আল্লাহ কেবল সে সব লোকেরই তাওবা কবুল করেন না, যারা মৃত্যু মুখে পতিত হয়ে তাওবা করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন :
﴿ وَلَيۡسَتِ ٱلتَّوۡبَةُ لِلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسَّئَِّاتِ حَتَّىٰٓ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ ٱلۡمَوۡتُ قَالَ إِنِّي تُبۡتُ ٱلۡـَٰٔنَ وَلَا ٱلَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمۡ كُفَّارٌۚ ﴾ [النساء: ١٨]
‘‘আর সেই সব লোকদের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মাথার উপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে- আমি এখন তাওবা করছি, আরো তাওবা নেই তাদের জন্য যারা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।’’[9]আমরা দেখতে পেলাম যে, উক্ত আয়াতসমূহ ও হাদীসে কোথাও অপরাধীদের তাওবা কবুল ও গুনাহ মার্জনা করার জন্য মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির মধ্যকার কারো নাম ও মর্যাদার মাধ্যম ধরে আল্লাহ্র কাছে তাওবা করতে বলেন নি। কোনো মাধ্যমে তাঁর কাছে কথা না বললে তিনি কারো তাওবা কবুল করতে বিলম্ব করবেন, এমন কথাও বলেন নি। বরং এ সবের দ্বারা অপরাধীদের তাওবা কবুল করে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলার অধীর আগ্রহ থাকার কথাই আমরা জানতে পেলাম।
>[2]. আল-কুরআন, সূরা গাফির : ৬০।
[3]. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল কিয়ামাহ, বাব নং- ৫৯; ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৬৬৭।
[4]. আল-কুরআন, সূরা হিজর : ৪৯।
[5]. আল-কুরআন, সূরা যুমার : ৫৩।
[6]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ : ১৮৬।
[7]. আল-কুরআন, সুরা নিসা : ১৭।
[8]. বুখারী, প্রাগুক্ত; (কিতাবুয যুহদ, বাব- শেষ রাতের নামাজে দু‘আ করা), ১/২১২১; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল মুসাফিরীন, পরিচ্ছেদ : শেষ রাতে দু‘আ ও জিকির করার ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রদান, এবং দু‘আ কবুল করা), ১/৫২১।
[9]. আল-কুরআন, সূরা নিসা : ১৮।
এখন শুধু প্রয়োজন হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার নিকট বান্দার অনুতাপ ও অনুনয়-বিনয় প্রকাশ করার। আল্লাহ তা‘আলার নিকট বান্দা সার্বক্ষণিকই তার অনুতাপ প্রকাশ করতে পারে। তবে এ জন্য সম্ভাব্য কিছু সময় ও মুহূর্তও রয়েছে। সম্ভাব্য সময় যেমন- সেহরীর সময়, জুমু‘আর দিন, রমাযান মাস ও ‘আরাফার দিন। আর সম্ভাব্য মুহূর্ত যেমন- নামাযে সেজদা রত অবস্থায়, আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়, নামাযের শেষে একাকী বসে ও বৃষ্টি বর্ষণের সময়ে।[1] বান্দা যদি দো‘আ কবুলের এ সব সম্ভাব্য সময় ও মুহূর্ত অন্বেষণ করে আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার কৃত অপরাধের জন্য অনুতাপ করে এবং পুনরায় অপরাধ না করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তাঁর কাছে প্রার্থনা করে, তা হলে তিনি তাকে অবশ্যই ক্ষমা করবেন।
তিনি যদি তাঁর অবাধ্য অহংকারী শয়তানের দো‘আ কবুল করে তার আহবানে সাড়া দিয়ে তাকে অপকর্ম করার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত আয়ু দিতে পারেন,[2] তা হলে সাধারণ অপরাধীরা তাঁর কাছে বিনয়ের সাথে সরাসরি কিছু চাইলে তিনি তাদের দো‘আ কবুল না করার কোনো কারণ থাকতে পারেনা। প্রকৃত কথা হচ্ছে- যারা তাঁর আনুগত্যকে স্থায়ীভাবে না হোক অন্তত সাময়িকভাবে হলেও স্বীকার করে নিয়ে তাঁকে একনিষ্ঠভাবে বিনয়ের সাথে আহ্বান করে, তিনি তাদের আহবানেও সাড়া দেন। এ ক্ষেত্রে আহ্বানকারী কোনো মুশরিক না মুনাফিক না ফাসিক না মু’মিন, এ সবের প্রতি তিনি আদৌ কোনো লক্ষ্য করেন না। আর এ কারণেই মুশরিকরা যখন সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে তাঁকে একনিষ্ঠভাবে আহ্বান করতো তখন তিনি তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিতেন।
যেমন আল্লাহ বলেন :
﴿ فَإِذَا رَكِبُواْ فِي ٱلۡفُلۡكِ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ فَلَمَّا نَجَّىٰهُمۡ إِلَى ٱلۡبَرِّ إِذَا هُمۡ يُشۡرِكُونَ ٦٥ ﴾ [العنكبوت: ٦٥]
‘‘যখন মুশরিকরা (সমুদ্রে) নৌকা বা জাহাজে আরোহণ করে (ঝড়ের কবলে পড়ে, তখন তারা) তাদের সকল আনুগত্যকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ট করে তাঁকে আহ্বান করে। অতঃপর তিনি যখন তাদেরকে স্থলে এনে উদ্ধার করে দিতেন, তখনই তারা (তাঁর সাথে) শরীক করতে থাকে।’’[3] মুশরিকরা যদি তাদের শির্কী ধ্যান-ধারণা পরিহার না করেও কোনো মধ্যস্থতা ছাড়াই একনিষ্ঠভাবে সরাসরি আল্লাহকে আহ্বান করার ফলে তিনি তাদেরকে ঝড়ের কবল থেকে উদ্ধার করতে পারেন, তা হলে আমাদের ডাক না শুনার তো কোনো কারণ থাকতে পারে না। অতএব যারা মৃত নবী ও ওলিদেরকে আল্লাহ ও সাধারণ মানুষদের মাঝে মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করেন এবং তাঁদের নামের মাধ্যমে দো‘আ করলে আল্লাহ সে দো‘আ দ্রুত শ্রবণ করেন বলে মনে করেন, তারা আসলে আল্লার প্রতি মিথ্যারোপ করেন। তাদের জানা আবশ্যক যে, কোনো ওলি তো দূরের কথা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও যদি কারো ব্যাপারে আল্লাহর কাছে কোনো সুপারিশ করেন, তা হলে তাঁর সে সুপারিশ গ্রহণ করা আল্লাহ তা‘আলার উপর জরুরী হয়ে যায় না। যেমন তিনি মুনাফিকদের সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর জানাযার নামায পড়ে তার মাগফিরাতের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁর সুপারিশ গ্রহণ করাতো দূরের কথা, তিনি তাঁকে এ ধরনের কর্মের পুনরাবৃত্তি করার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছিলেন :
﴿إِن تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ سَبۡعِينَ مَرَّةٗ فَلَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَهُمۡۚ ﴾ [التوبة: ٨٠]
‘‘যদি তুমি তাদের (মুনাফিকদের) জন্য সত্তর বারও ক্ষমা ভিক্ষা কর, তবুও আল্লাহ কস্মিনকালেও তাদেরকে ক্ষমা করবেন না।’’[4]
অপর আয়াতে এদের জানাযা পড়তে নিষেধ করে দিয়ে বলেন :
﴿ وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٖ مِّنۡهُم مَّاتَ أَبَدٗا وَلَا تَقُمۡ عَلَىٰ قَبۡرِهِۦٓ﴾ [التوبة: ٨٤]
‘‘এদের কেউ মরলে তুমি তাদের জানাযার নামায পড়বে না, তার কবরের পাশেও দাঁড়াবে না।’’[5]
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, কেউ কিছু চাইলে তা নবী বা ওলিদের মধ্যমে আল্লাহর নিকট চেয়েছে কি না, মূলত সেটা দেখার কোনো বিষয় নয়। বরং আসল দেখার বিষয় হচ্ছে যার সমস্যা তার মানসিক অবস্থা কী। দো‘আকারীর মানসিক অবস্থা ঠিক হলে এবং এখলাসের সাথে সে নিজেই সরাসরি আল্লাহর কাছে চাইলে তিনি শুধু মু’মিন কেন মুশরিকেরও দো‘আ শুনেন এবং তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। এটাই হচ্ছে আল্লাহর সুন্নাত বা নিয়ম।উক্ত আলোচনার দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হলো যে, দো‘আ করার সময় কোনো সৃষ্টির নামের বা তাঁর মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলা গ্রহণের জন্য আল্লাহ আমাদেরকে কোনো শিক্ষা দান করেন নি বা তাঁর সাধারণ বান্দাদের সমস্যাদি তাঁর নিকট উপস্থাপনের জন্য তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যকার কাউকে তাঁর ও তাঁর বান্দাদের মধ্যে ওসীলা হওয়ার জন্যেও মনোনীত করেন নি। বরং এটি কোনো কোন পীরদের মনগড়া বক্তব্য বৈ আর কিছুই নয়। এ বিষয়টি অবগতির পর এবার আমাদেরকে যে বিষয়টি জানতে হবে তা হলো : আল্লাহ তা‘আলার নিকট কিছু চাইতে হলে তা কীভাবে চাইতে হবে?
>[2]. শয়তান অপমানিত হয়ে বিতাড়িত হওয়ার প্রাক্কালে এই ব’লে দু‘আ করেছিল :
﴿ قَالَ أَنظِرۡنِيٓ إِلَىٰ يَوۡمِ يُبۡعَثُونَ ١٤ قَالَ إِنَّكَ مِنَ ٱلۡمُنظَرِينَ ١٥ ﴾ [الاعراف: ١٤، ١٥]
‘‘প্রভু! আমাকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দান করুন, আল্লাহ বলেন : তোমাকে অবকাশ দান করা হলো।” আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ : ১৪ ও ১৫।
[3]. আল-কুরআন, সূরা ‘আনকাবূত : ৬৫।
[4]. আল-কুরআন, সূরা তাওবাহ : ৮০।
[5]. আল-কুরআন, সূরা তাওবাহ : ৮৪।
আল্লাহর নিকট কিছু চাইতে হলে তা মোট দু’ভাবে চাওয়া যেতে পারে :
এক. কোনো কিছুর মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট কিছু চাওয়া যেতে পারে। কোনো প্রয়োজনকে সামনে রেখে এ কথা বলা যেতে পারে যে, হে আল্লাহ আমার অমুক প্রয়োজনটি পূর্ণ করে দিন। আমার অসুখ হয়েছে তা দ্রুত নিবারণ করে দিন...ইত্যাদি।
দুই. কোনো কিছুর ওসীলা বা মাধ্যম করে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া। কুরআন ও সহীহ হাদীস অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, আল্লাহর কাছে মোট ছয় পন্থায় ওসীলা করে কিছু চাওয়া যেতে পারে:
প্রথম পন্থা : আল্লাহ তা‘আলার সুন্দর নামাবলী ও সুমহান গুণাবলীর ওসীলায় দো‘আ করা :
আল্লাহ তা‘আলার জানা বা অজানা পবিত্র ও উত্তম নামাবলীর মাধ্যমে তাঁর কাছে কিছু আবেদন করা। নিজের প্রয়োজনের কথা বলার পূর্বে মুখে তাঁর নাম নেয়া । যেমন এ কথা বলা :
«يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ»
‘‘হে চিরঞ্জীব হে সবকিছুর ধারক! আমি তোমার রহমতের অসীলায় উদ্ধার কামনা করছি[1]।’’
এ পন্থা যে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশিত পন্থা তা আমরা ইতোপূর্বে অবগত হয়েছি। এটি ওসীলার সর্বোত্তম পন্থা হওয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকহারে এ পন্থা অবলম্বন করেই দো‘আ করতেন। হাদীসের গ্রন্থসমূহের দো‘আর অধ্যায় খুললেই এর জলন্ত প্রমাণ পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় পন্থা : আল্লাহর তাওহীদ ও ঈমানের রূকনসমূহের প্রতি ঈমান আনয়নের ওসীলায় দো‘আ করা :
নিম্নে বর্ণিত আয়াত দু’টি দ্বারা এ জাতীয় ওসীলার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইউনুস (আলাইহিস সালাম) কে যখন সমুদ্রের মাছ ভক্ষণ করেছিল, তখন তিনি সে বিপদ থেকে দ্রুত মুক্তি লাভের জন্য আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের ওসীলায় দো‘আ করে বলেছিলেন :
﴿فَنَادَىٰ فِي ٱلظُّلُمَٰتِ أَن لَّآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنتَ سُبۡحَٰنَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ﴾ [الانبياء: ٨٧]
‘‘অন্ধকারের মধ্যে তিনি এই বলে আহ্বান করেন যে, (হে আল্লাহ) তুমি ব্যতীত কোনো সঠিক ইপাস্য নেই, আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি, নিশ্চয় আমি যালিমদের অন্তর্গত হয়ে গেছি।’’[2]
আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনয়নের ওসীলায় দো‘আ করা প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে :
﴿ رَّبَّنَآ إِنَّنَا سَمِعۡنَا مُنَادِيٗا يُنَادِي لِلۡإِيمَٰنِ أَنۡ ءَامِنُواْ بِرَبِّكُمۡ فََٔامَنَّاۚ رَبَّنَا فَٱغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرۡ عَنَّا سَئَِّاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ ٱلۡأَبۡرَارِ ١٩٣ ﴾ [ال عمران: ١٩٣]
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা একজন আহ্বানকারীকে ঈমানের প্রতি এ মর্মে আহ্বান করতে শুনেছি যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনয়ন কর, ফলে আমরা ঈমান আনয়ন করেছি, হে আমাদের প্রতিপালক! অতএব, (তোমার প্রতি ঈমান আনয়নের ওসীলায়) তুমি আমাদের অপরাধসমূহ মার্জনা কর, আমাদের অপকর্মসমূহ দূর করে দাও এবং আমাদেরকে নেক মানুষদের সাথে মৃত্যু দাও।’’[3]
ঈমানের রুকসমূহের প্রতি ঈমান আনয়নের ওসীলায় দো‘আ করা প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে :
﴿ رَبَّنَآ ءَامَنَّا بِمَآ أَنزَلۡتَ وَٱتَّبَعۡنَا ٱلرَّسُولَ فَٱكۡتُبۡنَا مَعَ ٱلشَّٰهِدِينَ ٥٣ ﴾ [ال عمران: ٥٣]
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি যা কিছু অবতীর্ণ করেছ আমরা তাতে ঈমান এনেছি এবং রাসূলের অনুসরণ করেছি, অতএব, তুমি আমাদেরকে সাক্ষ্যদানকারীদের মধ্যে লিখে নাও।’’[4]
অত্র আয়াতে আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঈমান এবং রাসূলের অনুসরণ এ দু’টি বিষয়কে ওসীলা করে সাক্ষ্যদানকারীদের মধ্যে লিখে নেয়ার কথা আল্লাহর কাছে চাওয়া হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ দু’টি বিষয়ের মত ঈমানের আরো যে সব রুকন রয়েছে সেগুলোর প্রতি ঈমান আনয়নের ওসীলায়ও দো‘আ করা যেতে পারে।
তৃতীয় পন্থা : আল্লাহর নিকট বিপদ ও দুঃখের কথা বলে নিজের অপারগতা ও দুর্বলতা প্রকাশের ওসীলায় দো‘আ করা :
যেমন আইউব (আলাইহিস সালাম) তাঁর অসুখের কথা বলে নিজের অপারগতা ও অসহায়ত্বের বিষয়টি আল্লাহর কাছে তুলে ধরে তাঁর দয়া কামনা করে বলেছিলেন :
﴿ أَنِّي مَسَّنِيَ ٱلضُّرُّ وَأَنتَ أَرۡحَمُ ٱلرَّٰحِمِينَ ﴾ [الانبياء: ٨٣]
‘‘প্রভু! আমাকে অকল্যাণ পেয়ে বসেছে, তুমি হলে অধিক দয়াবান।’’
চতুর্থ পন্থা : নিজের অপরাধ স্বীকার করার ওসীলায় দো‘আ করা :
যেমন আদম ও হাওয়া (‘আ.) শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে গম খাওয়ার পর যখন বুঝতে পারলেন যে, তারা অপরাধ করে ফেলেছেন, তখন তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করার ওসীলায় আল্লাহর কাছে তা মার্জনার জন্য দো‘আ করে বলেছিলেন :
﴿رَبَّنَا ظَلَمۡنَآ أَنفُسَنَا وَإِن لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَتَرۡحَمۡنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ﴾ [الاعراف: ٢٣]
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নিজেদের উপর অত্যাচার করেছি, তুমি যদি ক্ষমা ও দয়া না কর, তা হলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’’[5]
পঞ্চম পন্থা : কোনো সৎকর্মের ওসীলায় দো‘আ করা:
সৎ কর্ম বিভিন্ন রকমের হতে পারে। তন্মধ্যে উত্তম দু’টি ‘আমল হচ্ছে নামায ও বিপদে ধৈর্য ধারণ করা। তাই মহান আল্লাহ এ দু’টির ওসীলায় দো‘আ করার প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেছেন :
﴿ وَٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ ﴾ [البقرة: ٤٥]
‘‘তোমরা ধৈর্য ধারণ এবং নামাযের ওসীলায় আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা কর’’।[6] এ আয়াতের মর্মানুযায়ী প্রমাণিত হয় যে, ফরয ও নফল নামাযান্তে একাকী বসে নামাযের ওসীলায় আল্লাহর কাছে কিছু প্রাপ্তির জন্য দো‘আ করা যেতে পারে।
এছাড়াও সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, বনী ইসরাঈলের তিন ব্যক্তি একদা রাত যাপনের জন্য একটি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। রাতে পাহাড়ের চূড়া থেকে একটি পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেলে তারা পরস্পরকে বললো :
«إِنَّهُ لاَ يُنْجِيكُمْ مِنْ هَذِهِ الصَّخْرَةِ إِلَّا أَنْ تَدْعُوا اللَّهَ بِصَالِحِ أَعْمَالِكُمْ»
‘‘তোমাদের সৎ ‘আমলের ওসীলায় আল্লাহকে আহ্বান না করা ব্যতীত এ পাথর থেকে তোমাদের মুক্তির কোনো উপায় নেই...।’’[7] এরপর তাদের একজন তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করার ওসীলায় দো‘আ করলো, আরেকজন আল্লাহর ভয়ে ব্যভিচার করা থেকে বিরত থাকার ওসীলায় দো‘আ করলো, তৃতীয়জন মজুরকে তার প্রাপ্যসহ আরো অধিক সম্পদ দেয়ার ওসীলায় আল্লাহ তা‘আলাকে আহ্বান করার পর আল্লাহ তাদেরকে সে বিপদ থেকে মুক্ত করেছিলেন।[8]
এতে প্রমাণিত হয় যে, শরী‘আত কর্তৃক নির্দেশিত যাবতীয় করণীয় ও বর্জনীয় কর্ম করে এর ওসীলায় ইহ-পরকালীন কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করা যেতে পারে।
ষষ্ঠ পন্থা : জীবিত মানুষের দো‘আর ওসীলায় আল্লাহর নিকট কিছু কামনা করা :
জীবিত মানুষের দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করেও আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া যেতে পারে। এ ওসীলা আবার দু’ভাবে হতে পারে :
এক. নিজের এবং নিজের সন্তানাদি ও পরিবারের ইহ-পরকালীন কল্যাণের জন্য কোনো মানুষের নিকট গিয়ে তাকে এ কথা বলা যেতে পারে যে, আমাদের জন্য একটু দো‘আ করুন বা আমাদের জন্য দো‘আ করবেন[9]। দো‘আকারী ব্যক্তি তাৎক্ষণিক আমাদের জন্য দো‘আ করতে পারেন। ইচ্ছা করলে পরবর্তী সময়ে আমাদের অনুপস্থিতিতেও তা করতে পারেন। তবে অনুপস্থিত অবস্থার দো‘আই সবচেয়ে উত্তম। কেননা, তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে বলে ইতোপূর্বে বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে।
নবজাত শিশু ও রোগীদেরকে কারো কাছে নিয়ে যেয়ে তার নিকট তাদের জন্য দো‘আ কামনা করাও এ জাতীয় ওসীলারই অন্তর্ভুক্ত। এ জাতীয় কর্ম রাসূলের সাহাবীদের মাঝে প্রচলিত ছিল। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সন্তানদের নিয়ে আসা হতো, তিনি (দো‘আ পাঠ করে তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে ঝাড়ফুঁক করে) তাদের উপর বরকত দিতেন এবং খুরমা চিবিয়ে তাদের মুখের তালুতে লাগিয়ে দিতেন।’’[10]
দুই. কারো নিকট নিজের কল্যাণের জন্য দো‘আ চাওয়া এবং তিনি তাৎক্ষণিক দো‘আ করলে নিজেও সে দো‘আয় শরীক হয়ে আল্লাহর কাছে নিজের জন্য দো‘আকারীর দো‘আ কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহুম্মা আ-মীন বলা। অথবা তার দো‘আর সাথে শরীক না হয়ে পরবর্তী কোনো সময়ে নিজে নিজের জন্য দো‘আ করার সময় তাঁর দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করে এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ! অমুক ব্যক্তি আমার জন্য যে দো‘আ করেছেন, তাঁর সে দো‘আ এর ওসীলা করে বলছি- আমার ব্যাপারে তাঁর দো‘আ কবুল করুন। এ জাতীয় ওসীলা করার বৈধতা নিম্নে বর্ণিত হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয়:
প্রথম হাদীস
‘উছমান ইবনে হানীফ (রহ.) থেকে বর্ণিত। একজন অন্ধ মানুষ এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললো :
«أُدْعُ اللهَ أَنْ يُعافِيْنِيْ . فَقَالَ لَهُ:"إِنْ شِئْتَ دَعَوْتُ لَكَ ، وَ إِنْ شِئْتَ صَبَرْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ". فقال:اُدْعُ. "فَأَمَرَهُ أَنْ يَتَوَضَّأَ ، فَيُحْسِنَ وُضُوْءَهُ ، فَيُصَلِّيْ رَكْعَتَيْنِ ، وَ يَدْعُوْ بِهَذَا الدُّعَاءِ : اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ وَ أَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ نَبِيَّ الرَّحْمَةِ يَا مُحَمَّدُ إِنِّيْ تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّيْ فِيْ حَاجَتِيْ هَذِهِ فَتَقَضِيْ لِيْ ، اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ". و في رواية "وَ شَفِّعْنِيْ فِيْهِ. قال الراوي : فَبَرِأَ الرَّجُلُ»
‘‘হে রাসূল! আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন তিনি যেন আমার চক্ষু ফিরিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন : তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য দো‘আ করবো, আর তুমি চাইলে ধৈর্য ধারণ করতে পারো, তা হলে তোমার জন্য তা মঙ্গল হবে। লোকটি বললো: দো‘আ করুন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উত্তমভাবে ওয়াযু করে দু’রাক‘আত নামায আদায় করে নিম্নোক্ত দো‘আর মাধ্যমে দো‘আ করতে বললেন:হে আল্লাহ ! আমি তোমার কাছে সওয়াল করছি এবং তোমার রহমতের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (এর দো‘আ)-এর ওসীলায় তোমার দিকে মুখ ফিরালাম, হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমি তোমার (দো‘আ এর) ওসীলায় আমার এই প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তোমার রবের প্রতি মুখ ফিরালাম, অতএব আমার এই প্রয়োজন পূর্ণ করুন। হে আল্লাহ! আমার ব্যাপারে তুমি তাঁর দো‘আকে কবুল কর’’। অপর বর্ণনায় রয়েছে : আমার সে ব্যাপারে আমার দো‘আ কবুল কর।’’ এ হাদীসের বর্ণনাকারী বলেন : লোকটি এভাবে দো‘আ করার পর সে সুস্থ হয়ে যায়।’’[11]
এ হাদীসে বর্ণিত লোকটির দো‘আর জন্য আবেদন করা অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে তার জন্য দো‘আ করা বা না করার ব্যাপারে এখতিয়ার দেয়া, পরিশেষে রাসূলের পক্ষ থেকে তাকে উক্ত দো‘আ শিখিয়ে দেয়ার দ্বারা এ জাতীয় ওসীলার বৈধতা প্রমাণিত হয়।
দ্বিতীয় হাদীস
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে যখন অনাবৃষ্টিজনিত কারণে তাঁরা অভাবে পতিত হতেন তখন তারা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর দো‘আর ওসীলায় বৃষ্টি চাইতেন এবং ‘উমার তাঁর দো‘আয় বলতেন :
«اللَّهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا فَتَسْقِيْنَا، وَ إِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا ، قَالَ : فَيَسْقَوْنَ»
‘‘হে আল্লাহ! আমরা আমাদের নবীর মাধ্যমে আপনার নিকট বৃষ্টির জন্য দো‘আ চাইতাম, ফলে তুমি আমাদের বৃষ্টি দিতে, আমরা (এখন) আমাদের নবীর চাচার (দো‘আর) মাধ্যমে আপনার নিকট বৃষ্টি কামনা করছি.অতএব, আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করুন। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : এ ভাবে দো‘আ করার পর তাঁদের বৃষ্টি দান করা হতো।’’[12] এ হাদীস দ্বারাও অন্যের দো‘আর ওসীলায় দো‘আ করার বৈধতা প্রমাণিত হয়।
>[2]. আল-কুরআন, সূরা : আম্বিয়া : ৮৭।
[3]. আল-কুরআন, সূরা : আলে ইমরা্ন : ১৯৩।
[4]. আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান : ৫৩।
[5]. আল-কুরআন, সূরা : আ‘রাফ : ২৩।
[6]. আল-কুরআন, সূরা : বাক্বারাহ : ৪৫।
[7]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল ইজারাহ, বাব নং- ১২ ; ৩/৭৯৩; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুয যিক্র, বাব : ক্বিস্যাতু আসহাবিল গারিস সালাসাতি, হাদীস নং- ১০০; ৪/২০৯৯।
[8]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুয যিকির ওয়াদ দু’আ, বাব: তিন গুহাবাসীর ঘটনা...); ৪/২০৯৯।
[9]. যদিও কারও কাছে দো‘আ চেয়ে বেড়ানো কুরআন ও রাসূলের সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় নি; কারণ এতে দু’টি সমস্যা রয়েছে, এক. বান্দা তার রব থেকে দূরে সরে যেতে পারে। দুই. শুধু শুধু কারও কাছে ছেয়ে বেড়ানোর মাধ্যমে নিজেকে হেয় করছে এবং অন্যের প্রতি মুখাপেক্ষী হচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সুতরাং বান্দা নিজেই এ কাজটি নিজের জন্য করা উচিত। যদি অন্যের কাছে দো‘আ চায়, তখন তার উদ্দেশ্যে থাকতে হবে যে যার কাছে দো‘আ চেয়েছি সে ব্যক্তি নিজেও আমার জন্য দো‘আ করা দ্বারা উপকৃত হতে পারে; কারণ, যে কেউ কারও জন্য তার অনুপস্থিতিতে দো‘আ করে ফেরেশতা বলতে থাকে, “তোমার জন্যও অনুরূপ হোক”। সুতরাং এর মাধ্যমে দো‘আপ্রার্থী ও দো‘আকারী উভয়েই সমভাবে উপকৃত হতে পারে। তাই কারও কাছে দো‘আ চাওয়ার সময় উভয়ে উপকৃত হওয়ার এ নিয়ত থাকা আবশ্যক, নিছক নিজের জন্য কারও কাছে যাচ্ঞা করে বেড়ানো ইসলামের মূল শিক্ষার বিরোধী। এ বিষয়টি আরও জানার জন্য শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ লিখিত, ‘আল-ওয়াসেতা-বাইনাল হাক্কি ওয়াল খালক’ বা স্রষ্টাকে পেতে মাধ্যম গ্রহণ গ্রন্থটি (কামিয়াব প্রকাশনী কর্তৃক আমার দ্বারা অনুবাদ ও সম্পাদিত) দেখা যেতে পারে। [সম্পাদক]
[10]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুত ত্বাহারত, পরিচ্ছদ : দুগ্ধপানকারী শিশুদের বরকত দানের হুকুম); ১/২৩৭।
[11]. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; ৪/৫৬৯; আব্দুর রহমান আল-মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; ৪/২৮১-২৮২।
[12]. বুখারী, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল ইস্তেসকা, পরিচ্ছদ : অনাবৃষ্টির সময় জনগণ কর্তৃক ইমামকে বৃষ্টি জন্য দু‘আ করতে বলা); ১/২/৭৫।
কেউ কেউ এ হাদীস দু’টি দ্বারা নবী ও ওলিদের জাতসত্তা, তাঁদের নাম, অধিকার ও মর্যাদার ওসীলায় দো‘আ করাকে জায়েয বলে দলীল দিয়ে থাকেন এবং এর ভিত্তিতেই তারা নবী, রাসূল, তথাকথিত গাউছ, কুতুব ও খাজেগানদের নাম ও মর্যাদার ওসীলায় দো‘আ করেন। রাসূল এর হুরমতের ওসীলায় দো‘আ করে বলেন :
"سهل يا إلهي كل صعب بحرمة سيد الأبرار"
‘‘হে আল্লাহ সৈয়্যিদুল আবরার এর হুরমতের ওসীলায় যাবতীয় কঠিন সমস্যাদি সহজ করে দিন।’’
অনেক সময় নামাযান্তে বা কোনো অনুষ্ঠান শেষে যৌথভাবে দো‘আ করার সময় বলে থাকেন: হে আল্লাহ সমস্ত নবী-রাসূল, সাহাবা, তাবেঈন, আইম্মায়ে কেরাম, গউছ, কুতুব ও খাজেগানদের ওসীলায় আমাদের অপরাধ মার্জনা করুন, ইহকাল-আখেরাতে কল্যাণ দান করুন এবং অকল্যাণ দূর করুন...ইত্যাদি।
তারা এ জাতীয় ওসীলা বৈধ বলে প্রমাণ করার জন্য বলেন: প্রথম হাদীস দ্বারা বাহ্যত প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যক্তিকে তাঁর নাম ও মর্যাদার ওসীলায় দো‘আ করতে শিখিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যক্তির জন্য তাৎক্ষণিক কোনো দো‘আ করেছেন বলেও এ হাদীসের বর্ণনায় কোনো প্রমাণ নেই। তাদের মতে এতে বুঝা যায় যে, তিনি তাঁর নামের ওসীলায়ই তাকে দো‘আ করতে শিখিয়েছেন। আর দ্বিতীয় হাদীসেও আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার দো‘আর ওসীলার কথা বর্ণিত না হওয়ায় তাদের মতে এ-হাদীসের দ্বারাও নবী ও ওলিদের নাম, জাত ও মর্যাদার ওসীলায় দো‘আ করার বৈধতা প্রমাণিত হয়। তবে নিম্নে বর্ণিত বিষয়াদির প্রতি লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে যে, বাহ্যত উভয় হাদীস দ্বারা উক্ত সন্দেহের সম্ভাবনা প্রমাণিত হলেও আসলে প্রথম হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে ব্যক্তিকে তাঁর নামের ওসীলায় দো‘আ করতে বলেন নি। দ্বিতীয় হাদীসেও ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার জাত বা তাঁর মর্যাদার ওসীলায় দো‘আ করেন নি। বরং উভয় হাদীস দ্বারাই তাঁদের দো‘আর ওসীলা গ্রহণের কথাই প্রমাণিত হয়। লক্ষ্যণীয় বিষয়সমূহ নিম্নরূপ :
(ক) প্রথম হাদীসে যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দো‘আ করার কোনো বর্ণনা নেই, তবে এ না থাকাটি তাঁর দো‘আ না করার বিষয়টিকে অকাট্যভাবে প্রমাণ করে না। কারণ, এ হাদীসের প্রথম ও শেষাংশের দিকে লক্ষ্য করলে তাঁর সে ব্যক্তির জন্য দো‘আ করার কথাই প্রমাণিত হয়। কেননা, সেতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দো‘আ করতে বলেছে এবং তিনিও তাকে দো‘আ করা বা ধৈর্য ধারণ করার কথা বলেছেন এবং তাকে যে দো‘আ শিক্ষা দিয়েছেন তাতে তাকে এই বলতে বলেছেন : (اللهم فشفعه في) ‘‘হে আল্লাহ! আমার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শাফা‘আত তথা তাঁর দো‘আ কবুল কর’’। এ সবের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে ব্যক্তির জন্য দো‘আ করেছিলেন। তবে বর্ণনাকারী তা বর্ণনা করাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন নি। কারণ, তার দৃষ্টিতে সে ব্যক্তির জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দো‘আ করার বিষয়টি বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তার দৃষ্টিতে যা বলার প্রয়োজন, তিনি সেটুকুই বলেছেন।
(খ) এ হাদীস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, সে ব্যক্তি দো‘আ করতে বললে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দো‘আ করার ওয়াদা দিয়েছেন। সে যখন দো‘আ করার বিষয়টি বেছে নিয়েছে, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য অবশ্যই দো‘আ করে থাকবেন। নতুবা এতে ওয়াদা খিলাফী হওয়া জরুরী হয়ে পড়বে, যা রাসূলের ব্যাপারে কল্পনা করা যায় না।
(গ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে যে দো‘আ শিখিয়েছেন তাতে বর্ণিত(اللهم فشفعه في) বাক্যটির অর্থ হচ্ছে- ‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দো‘আ কবুল কর’’। এ কথাটি প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দো‘আ করেছিলেন। নতুবা সে ব্যক্তির দো‘আর মধ্যে তাকে এ কথা বলতে শিখানোর কোনো অর্থ থাকে না।
(ঘ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম, জাত ও মর্যাদার ওসীলা করে দো‘আ করা বৈধ হলে সে ব্যক্তির পক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে দো‘আ চাওয়ার কোনো প্রয়োজন হতো না। তার নিজের বাড়ীতে বসেইতো সে তা করে নিতে পারতো। কিন্তু তা না করে যখন রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে এসে তাঁর দো‘আ কামনা করেছে, তখন এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ হাদীস দ্বারা রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম, জাত ও মর্যাদার ওসীলা গ্রহণ করার দলীল গ্রহণ করা যায় না।
(ঙ) রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শেখানো এ-দো‘আর উদ্দেশ্য যদি তাঁর নাম, জাত ও মর্যাদার ওসীলা গ্রহণই হয়ে থাকে এবং এ অন্ধ ব্যক্তির চক্ষু ফিরে পাওয়ার পিছনে মূল রহস্য যদি রাসূলের জাতসত্তার ওসীলায় এ-দো‘আর মাধ্যমে দু’আ করাই হয়ে থাকে, তা হলেতো অন্যান্য অন্ধরাও এ-দো‘আ পাঠ করে তাদের চক্ষু ফিরে পেতেন। কিন্তু বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এতে প্রমাণিত হয় যে, সে ব্যক্তির চক্ষু ফিরে পাওয়ার পিছনে মূল রহস্য হচ্ছে তার জন্য রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দো‘আ। তাঁর জাতের বা এ শিখানো দো‘আ এর ওসীলা নয়।
(চ) বিশিষ্ট মনীষীগণ এ হাদীসকে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মু‘জিযা হিসেবে গণ্য করেছেন। রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দো‘আর ওসীলায় এ অন্ধ ব্যক্তির চক্ষু ফিরে পাওয়ার কারণেই তাঁরা এটাকে তাঁর নবুওয়াতের প্রমাণকারী বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন।[1]
উক্ত এ সব বিষয়াদির প্রতি লক্ষ্য করলে এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, হাদীসে বর্ণিত (أتوجه إليك بنبيك و توجهت بك إلى ربي) এ দু’টি বাক্যের অর্থ হবে (أتوجه إليك بدعاء نبيك و توجهت بدعائك إلى ربي), অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তোমার নবীর দো‘আর ওসীলায় তোমার দিকে মুখ ফিরালাম এবং তোমার দো‘আর ওসীলায় আমার রবের দিকে মুখ ফিরালাম। (أتوجه إليك بنبيك) এ বাক্যের দ্বারা কোনো অবস্থাতেই ‘তোমার নবীর নাম, জাত ও মর্যাদার ওসীলায় তোমার দিকে মুখ ফিরালাম’ এ অর্থ গ্রহণ করা সঠিক নয়।
(ছ) দ্বিতীয় হাদীস দ্বারা বাহ্যত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার নাম, জাত ও মর্যাদার ওসীলা গ্রহণ করে দো‘আ করার বৈধতার যে সম্ভাবনা প্রমাণিত হয় তাও এ হাদীসের অন্যান্য বর্ণনার প্রতি লক্ষ্য করলে দূর হয়ে যায়। প্রখ্যাত হাদীসবিদ ইসমা‘ঈলী, যিনি ইমাম বুখারী (রহ.) থেকে তাঁর সহীহ গ্রন্থ বর্ণনা করেছেন, তাঁর বর্ণনায় এ হাদীসে রয়েছে :
«كَانُوْا إِذَا قَحَطُوْا عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ اسْتَسْقَوْا بِهِ ، فَيَسْتَسْقِيْ لَهُمْ ، فَيَسْقَوْن ، فَلَمَّا كَانَ فِيْ إِمَارَةِ عُمَرَ َ...»الحديث
তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে অনাবৃষ্টিতে পতিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে বৃষ্টির জন্য দো‘আ চাইতেন, তখন তিনি তাদের জন্য বৃষ্টি চেয়ে দো‘আ করতেন, ফলে বৃষ্টি হতো। অতঃপর যখন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের সময় হয়...।’’[2] (এ হাদীসের বাকী অংশটুকু উপরের হাদীসের অনুরূপ, তাই এখানে এর পুনরাবৃত্তি করা হলো না)। এ হাদীসে বর্ণিত (فيستسقي لهم) এ কথার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা দো‘আর করার সময় স্রেফ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম ব্যবহার করে বৃষ্টি চাইতেন না, বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের জন্য বৃষ্টি কামনা করে আল্লাহর নিকট দো‘আ করতেন এবং তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দো‘আকেই ওসীলা হিসেবে গণ্য করতেন। যেমন অপর এক ঘটনা দ্বারাও এ কথার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,
«أَصَابَ النَّاسُ سِنَةً عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَبَيْنَمَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَخْطُبُ قَائِمًا فِيْ يَوْمِ الجُمُعَةِ فَقَامَ أَعْرَابِيٌّ فَاسْتَقْبَلَ رَسُوْلَ الله صلى الله عليه وسلم قَائِمًا فَقَالَ يَا رَسُوْلَ الله! هَلَكَ المَالُ وَ جَاعَ الْعِيَالُ ، فَادْعُ الله لَنَا ، فَرَفَعَ يَدَيْهِ ، و في رواية : فَمَدَّ يَدَيْهِ و دَعَا»
‘‘রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে একদা লোকজন অভাবে পতিত হয়। একদিন রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- জুমু‘আর দিনে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন, এমন সময় এক গ্রাম্য ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো: হে আল্লাহর রাসূল ! সম্পদ সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পরিবার পরিজন অনাহারে পতিত হয়ে গেছে, আপনি আমাদের জন্য দো‘আ করুন। ফলে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-দো‘আর জন্য তাঁর দু’হাত উঠালেন[3]। অপর বর্ণনায় রয়েছে: ফলে তিনি দু’হাত প্রলম্বিত করে উঠালেন এবং দো‘আ করলেন’’।[4] ইসমা‘ঈলী এবং আনাস (রা. থেকে বর্ণিত হাদীস দু’টি দ্বারা পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে, সাহাবীদের বৃষ্টির জন্য দো‘আ কামনা করা মূলত রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দো‘আর ওসীলায় ছিল, স্রেফ তাঁর নাম ও মর্যাদার ওসীলায় ছিল না।
(জ) এ-সময় আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা কী কথা বলে দো‘আ করেছিলেন তা উপস্থাপন করলেও রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দো‘আ করার বিষয়টি আমাদের কাছে আরো পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি এ বলে দো‘আ করেছিলেন :
«اللَّهُمَّ إِنَّه لَمْ يَنْزِلْ بَلاَءٌ إِلاَّ بِذَنْبٍ ولَمْ يُكْشَفْ إِلاَّ بِتُوْبَةٍ ، وَقَدْ تَوَجَّهَ الْقَوْمُ بِيْ إِلَيْكَ لَمَكَانِيْ مِنْ نَبِيِّكَ، وَ هٰذِهِ أَيْدِيْنَا إِلَيْكَ بِالذُّنُوْبِ وَنَوَاصِيْنَا إِلَيْكَ بِالتَّوْبَةِ ، فَاسْقِنَا...»
‘‘হে আল্লাহ! নিশ্চয় অপরাধ সংঘটিত না হলে কোনো বিপদ অবতীর্ণ হয়না, আর তাওবা ব্যতীত তা দূর করা হয়না, আমি তোমার নবীর নিকটজন হওয়ার কারণে জনগণ আমার (দো‘আর) মাধ্যমে আপনার দিকে মুখ করেছে, আমরা আমাদের গুনাহমাখা হাতগুলো আপনার দিকে প্রসারিত করেছি এবং তাওবার সাথে আমাদের ললাটগুলো আপনার সমীপে অবনত করেছি, কাজেই আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করুন...।’’[5]
এ হাদীস দ্বারা যেমন এ কথাটি প্রমাণিত হয় যে, ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু মূলত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করেই দো‘আ করেছিলেন, তেমনি আরো প্রমাণিত হয় যে, তাঁদের দ্বারা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করার বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবিত থাকাকালীন সময়ে তাঁর দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করার মতই ছিল। কাজেই এ হাদীস দ্বারাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ওলিদের নাম, জাত ও মর্যাদার ওসীলা গ্রহণ জায়েয হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা যায় না।
(ঝ) এ হাদীস থেকে এ জাতীয় অর্থ গ্রহণের কোনই সম্ভাবনা নেই; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম, জাত ও মর্যাদার ওসীলা গ্রহণ করে দো‘আ করা জায়েয হলে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর মর্যাদার ওসীলায় দো‘আ না করে সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম ও মর্যাদার ওয়াসীলায়ই দো‘আ করতেন। কিন্তু তা না করে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সামনে রেখে বৃষ্টির জন্য উক্ত ধরনের দো‘আ করার দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় নিজেই দো‘আ করতেন বলে তাঁরা তাঁর দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করতেন। তাঁর অবর্তমানে তাঁরা তাঁর জীবিত চাচা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করেছিলেন।
(ঞ) কারো নামের ওসীলা গ্রহণ করে দো‘আ করা জায়েয হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবার চেয়ে মর্যাদাবান হওয়ায় তাঁরা অনাবৃষ্টির সময় তাঁর নাম নিয়েই বৃষ্টি চাইতেন। কিন্তু তা না করে রাসূলের চেয়ে কম মর্যাদার অধিকারী আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর ওসীলা গ্রহণ করাতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা মূলত তাঁর নামের ওসীলায় দো‘আ কামনা করেন নি, বরং তাঁর দো‘আর ওসীলায়ই বৃষ্টি কামনা করেছিলেন।
(ট) আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা একাধিকবার আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মাধ্যমে অনাবৃষ্টির সময় দো‘আ করেছিলেন। কারো মর্যাদার ওসীলা গ্রহণ করে দো‘আ করা জায়েয হলে তাঁরা বার বার তাঁর মাধ্যমে দো‘আ না করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামের ওসীলায় দো‘আ করতেন। কিন্তু তাঁরা তা না করাতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম, মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলা গ্রহণ করে দো‘আ করা জায়েয নয়।
(ঠ) ‘আমরা আমাদের নবীর চাচার মাধ্যমে তোমার কাছে ওসীলা করছি’ এ কথা বলার উদ্দেশ্য যদি আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নাম ও তাঁর মর্যাদার ওসীলা গ্রহণ হয়ে থাকে, তা হলে তাঁরাতো নিজ নিজ ঘরে বসেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর মর্যাদার ওসীলা গ্রহণ করে দো‘আ করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তাঁরা তাঁর নিকটে আসাতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁর দো‘আর ওসীলা গ্রহণের জন্যেই তাঁরা তাঁর নিকট এসেছিলেন। তাঁর মর্যাদার ওসীলা গ্রহণের জন্যে নয়।উপরে বর্ণিত এ সব বিষয়াদির প্রতি লক্ষ্য করলে এ কথাটি স্বতঃই প্রমাণিত হয় যে, এ উভয় হাদীস থেকে কোনো অবস্থাতেই নবী বা অলিগণের নাম, মর্যাদা ও জাতের ওসীলা গ্রহণ করে দো‘আ করার বৈধতা প্রমাণ করা যায় না।
[2]. ইবন হাজার, ফতহুল বারী; ২/২৯৯।
[3]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জমাআঃ, বাব : জুমু‘আর দিনের খুতবায় বৃষ্টির জন্য দু‘আ করা); ২/২/৪৭।
[4]. তদেব।
[5]. ইবনে হাজার, ফতহুল বারী; ৩/১৫০।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা ওলিগণ কে আল্লাহ তা‘আলা যে মর্যাদা দিয়েছেন তা তাঁদের প্রতি আল্লাহর একটি করুণা বিশেষ। তাঁদেরকে এ মর্যাদা প্রদানের অর্থ এটা নয় যে, এ মর্যাদার দিক লক্ষ্য করে আল্লাহ তাঁদেরকে কোনো প্রকার বিপদ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন না। আমাদের নবীর জীবনে তাঁর শত্রুদের পক্ষ থেকে অসংখ্য বিপদ এসেছে। বিভিন্ন সময় তিনি অসুস্থও হয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-নিজের মর্যাদার ওসীলায় স্বয়ং নিজেকে ভাগ্য বিড়ম্বনার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন নি। এমতাবস্থায় অন্যরা তাঁর মর্যাদার ওসীলায় কী করে রক্ষা পেতে পারে? বস্তুত তাঁর এ মর্যাদার ওসীলায় কেউ এ দুনিয়ায় যেমন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে না, তেমনি আখেরাতেও পারবে না।
ইহ-পরকালীন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন যথার্থ ঈমান ও সঠিক কর্মের। বিপদ যাতে না আসে সে জন্য সর্বাগ্রে আল্লাহর নিকট বিপদ থেকে আশ্রয় চাইতে হবে। যেসব কারণে বিপদ আসে তা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। সকাল ও সন্ধায় দো‘আ-কালাম পাঠ করে শরীরে ঝাড়ফুঁক দিতে হবে। এর পরেও যদি বিপদ এসে যায় তা হলে তা দূরীকরণের জন্য ওসীলার বৈধ পন্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে আল্লাহর ইচ্ছা ও দয়া হলে তিনি বিপদ দূর করে দেবেন। বিপদ দূর করার জন্য রাসূল বা অলিগণের নামের ওসীলায় আল্লাহর কাছে দো‘আ করা বিপদ দূরীকরণের কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা নয়। সেজন্য সলফে সালেহীনদের মাঝে এ-জাতীয় ওসীলা গ্রহণের কোনো প্রচলন লক্ষ্য করা যায় না।
কারো মর্যাদার ওসীলায় যেমন কেউ ইহকালীন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে না, তেমনি কেউ কারো মার্যাদার খাতিরে পরকালীন বিপদ থেকেও রক্ষা পেতে পারে না। যদি কেউ পারতো তা হলে সর্বাগ্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটাত্মীয়রাই তা পারতেন। কিন্তু দেখা যায় রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এ-জাতীয় সম্ভাবনার কথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন। তাঁর কোনো নিকটাত্মীয়দের মনে যাতে এ-জাতীয় ধারণার উদ্রেক না হয়, সে-জন্য তিনি তাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি বনী হাশিম ও বনী মুত্তালিব এমনকি তাঁর কলিজার টুকরা মা ফাতেমাকেও ডেকে বলে দিয়েছিলেন:
«لاَ أُغْنِيْ عَنْكُمْ مِنَ اللهِ شَيْئًا»
‘‘আমি আল্লাহর শাস্তির হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করতে পারবো না’’।[1] আল্লাহর কাছে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অফুরন্ত মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও তিনি যদি তাঁর মর্যাদার ওসীলায় তাঁর নিকটাত্মীয়দেরকে পরকালীন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারেন, তাঁর আত্মীয়রা যদি আখেরাতে তাঁর মর্যাদার দ্বারা কোনো উপকার পেতে না পারে, তা হলে এ-জগতে আর কে থাকতে পারেন যিনি তাঁর নিজের মর্যাদার ওসীলায় তাঁর নিকটাত্মীয় ও ভক্তদেরকে পরকালীন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন ?!প্রকৃতকথা হচ্ছে-পরকালীন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপযুক্ত উপায় হচ্ছে-রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণে সঠিক ঈমান ও বিশুদ্ধ ‘আমল দ্বারা নিজের জীবনকে পরিশুদ্ধ করা। যারাই এ যোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হবে, তারাই হয় বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে, না হয় হালকা হিসেব হবে, প্রয়োজনে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আত লাভে ধন্য হবে। এর বাইরে প্রারম্ভে কোনো পীর বা ওলির ওসীলায় কারো পার পাবার কোনই উপায় নেই। কিন্তু সাধারণ জনমনে ওলিদের ব্যাপারে এ-জাতীয় ধারণার জন্ম হওয়ার ফলেই তারা ওলিদের কবরে নানারকম উপাসনা করার মাধ্যমে তাঁদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে চেষ্টা করে।
এ-উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য তাদের কেউবা কবরের খেদমত করে, কেউবা সেখানে মানত করে। কেউবা সেখানে যেয়ে বসে থেকে ধ্যানে মগ্ন হয়ে মুরাক্বাবা ও মুশাহাদা করে। কেউবা কবরের পার্শ্বে নামায পড়ে। কেউবা সেখানে অনুনয় বিনয় করে দো‘আ করে। কেউবা সেজদাবনত হয় ইত্যাদি...। আর এ-সব কর্মের মাধ্যমে তারা কবরস্থ ওলির দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর দয়া ও কৃপা অর্জন করতে চায় এবং তাঁদের দয়ার ওসীলায় আখেরাতে পরিত্রাণ পেয়ে আল্লাহর নিকটতম হতে চায়। তবে এ-জাতীয় কর্মকারীদের জানা আবশ্যক যে, তারা যে ধারণার ভিত্তিতে মাযার ও কবরে এ-সব কর্ম করেন, আরবের মুশরিকরাও ঠিক এ ধারণার ভিত্তিতেই তাদের ওলিদের মূর্তিকে কেন্দ্র করে এ-সব করতো। যার প্রমাণ এ পরিচ্ছেদের প্রারম্ভেই প্রদান করা হয়েছে।
>