লগইন করুন
কিন্তু দো‘আর সময় নবী ও ওলিদের নামের মাধ্যম ধরে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার কথা বা অনুমতি কুরআন ও হাদীসের দ্বারা সমর্থিত নয়। এর কারণ হলো, এভাবে কারো নামের কথা শুনিয়ে কিছু চাওয়া হচ্ছে মানবীয় ব্যাপার। আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার সময় এমনটি করা ঠিক নয়। কেননা, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন বলে তাঁর সাথে মানবীয় আচরণ করা প্রকারান্তরে তাঁকে মানুষের মর্যাদার দ্বারা প্রভাবিত করতে চাওয়ারই শামিল। তিনি কারো মর্যাদার দ্বারা প্রভাবিত হন না বলেই কেউ তাঁর নিকট নিজের মর্যাদার ওসীলায় আখেরাতে কারো জন্যে কোনো শাফা‘আত করতে পারবে না। যে মর্যাদার মূল্য আখেরাতে নেই সে মর্যাদার ওসীলায় দুনিয়াতে তাঁর কাছে কিছু চাওয়ারও কোনো মূল্য নেই। এছাড়া তিনি কোনো মানুষের নামের মাধ্যমে বা ওসীলায় তাঁর কাছে কিছু আবদার করতে আমাদেরকে শিক্ষাও দেন নি। বরং তিনি তাঁর নিকট তাঁর নিজের নামের ওসীলায় আমাদের অভাব ও অভিযোগের কথা তাঁর নিকট উপস্থাপন করতে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে বলেছেন :
﴿ وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ﴾ [الاعراف: ١٨٠]
‘‘আল্লাহর রয়েছে উত্তম নামাবলী, সুতরাং তোমরা তাঁকে তাঁর নামের ওসীলায় আহ্বান কর।’’[1] আল্লাহ যেখানে আমাদেরকে তাঁর নামের ওসীলায় তাঁকে আহ্বান করতে নির্দেশ করেছেন, সেখানে আমরা তাঁকে তাঁর কোনো সৃষ্টির নামের ওসীলায় তাঁর নির্দেশ ব্যতীত আহ্বান করতে পারি না। যদিও সে সৃষ্টি তাঁর নিকট তাঁর সকল সৃষ্টির মধ্যে অধিক ভালবাসার পাত্রও হতে পারেন। আমরা আল্লাহর বান্দা। তাই আমাদের জীবনের যাবতীয় প্রয়োজনের কথা কোনো সৃষ্টির মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি তাঁর কাছে জানাবো, এটাই স্বাভাবিক কথা এবং যুক্তিরও দাবী। সে জন্যেই তিনি আমাদের সকলকে সৎ ও অসৎ নির্বিশেষে কোনো নবী বা ওলির মধ্যস্থতা ছাড়াই তাঁকে আহ্বান করার নির্দেশ করে বলেছেন :
﴿ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ ﴾ [غافر: ٦٠]
‘‘তোমরা আমাকে আহ্বান কর, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’’[2] সরাসরি আল্লাহকে আহ্বান করার শিক্ষা দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে বলেন :
«إِذَا سَأَلْتَ فَاسْاَلِ اللهَ، وَ إِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِالله»
‘‘যখন তুমি কিছু চাইবে তখন তা আল্লাহর কাছেই চাইবে, আর যখন কিছু সাহায্য চাইবে তখন তা আল্লাহর কাছেই চাইবে।’’[3] এরপরও কি এ কথা বলা যায় যে, তিনি নবী ও অলিগণের নামের মাধ্যম ছাড়া পাপীদের কোনো কথা শ্রবণ করেন না বা করতে চান না বা তাঁদের নামের ওসীলা নিয়ে দো‘আ করলে তিনি দো‘আ দ্রুত কবুল করবেন, অন্যথায় বিলম্বে করবেন?
প্রকৃতপক্ষে যারা এমনটি বলে তারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে। তারা আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করে। অথচ তিনি তাঁর পাপী বান্দাদের তাওবা ও দো‘আ কবুল করে তাদের অপরাধ মার্জনা করার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। তিনি তাঁর বান্দাদেরকে এ বিষয়ের সংবাদ দেয়ার জন্য তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ মর্মে নির্দেশ করেছেন :
﴿ ۞نَبِّئۡ عِبَادِيٓ أَنِّيٓ أَنَا ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٤٩ ﴾ [الحجر: ٤٩]
‘‘তুমি আমার বান্দাদেরকে সংবাদ দাও যে, আমি হলাম অধিক ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।’’[4]
অপর স্থানে এ মর্মে আহ্বান করতে বলেছেন :
﴿ ۞قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٥٣ ﴾ [الزمر: ٥٣]
‘‘বল : হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের নফছের উপর অত্যাচার করেছো তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যেওনা, নিশ্চয় আল্লাহ যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করেন, তিনিই হলেন অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’’[5]
যারা অপরাধ করে সরাসরি তাঁকে আহ্বান করে তিনি তাদের আহ্বান শ্রবণ করেন।
এ প্রসঙ্গে বলেছেন :
﴿ وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ﴾ [البقرة: ١٨٦]
‘‘আর আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে, (তখন তাদের বল) বস্তুত আমি নিকটেই রয়েছি, আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে, তখন আমি তার আহবানে সাড়া দিয়ে তা কবুল করি...।’’[6]
যারা অন্যায় করার পর দ্রুত তাঁর নিকট ক্ষমা চায়, তিনি তাদের তাওবা কবুল করেন। এ প্রসঙ্গে বলেন :
﴿ إِنَّمَا ٱلتَّوۡبَةُ عَلَى ٱللَّهِ لِلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسُّوٓءَ بِجَهَٰلَةٖ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٖ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَتُوبُ ٱللَّهُ عَلَيۡهِمۡۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمٗا ١٧ ﴾ [النساء: ١٧]
‘‘আল্লাহ অবশ্যই তাদের তাওবা কবুল করেন যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তাওবা করে, এরাই হলো সেই সব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।’’[7]
অপরাধীরা সরাসরি আল্লাহকে আহ্বান করলে তিনি তাদের আহবানে সাড়া দেন এবং তাদের অপরাধ মার্জনা করেন, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
«يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَ تَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْأَخِيْرِ فَيَقُوْلُ : مَنْ يَدْعُوْنِيْ فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ، وَ مَنْ يَسْأَلُنِيْ فَأُعْطِيَهُ ، وَمَنْ يَسْتَغْفِرُنِيْ فَأَغْفِرَ لَهُ...»
‘‘আমাদের বরকতময়, সুমহান প্রতিপালক প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে পৃথিবী সংলগ্ন আকাশে আগমন করে বলতে থাকেন- কে আমাকে আহ্বান করবে, আমি তার আহবানে সাড়া দেব, কে আমার নিকট চাইবে, আমি তাকে দান করবো, কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’’[8]
মহান আল্লাহ কেবল সে সব লোকেরই তাওবা কবুল করেন না, যারা মৃত্যু মুখে পতিত হয়ে তাওবা করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন :
﴿ وَلَيۡسَتِ ٱلتَّوۡبَةُ لِلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسَّئَِّاتِ حَتَّىٰٓ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ ٱلۡمَوۡتُ قَالَ إِنِّي تُبۡتُ ٱلۡـَٰٔنَ وَلَا ٱلَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمۡ كُفَّارٌۚ ﴾ [النساء: ١٨]
‘‘আর সেই সব লোকদের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মাথার উপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে- আমি এখন তাওবা করছি, আরো তাওবা নেই তাদের জন্য যারা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।’’[9]আমরা দেখতে পেলাম যে, উক্ত আয়াতসমূহ ও হাদীসে কোথাও অপরাধীদের তাওবা কবুল ও গুনাহ মার্জনা করার জন্য মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির মধ্যকার কারো নাম ও মর্যাদার মাধ্যম ধরে আল্লাহ্র কাছে তাওবা করতে বলেন নি। কোনো মাধ্যমে তাঁর কাছে কথা না বললে তিনি কারো তাওবা কবুল করতে বিলম্ব করবেন, এমন কথাও বলেন নি। বরং এ সবের দ্বারা অপরাধীদের তাওবা কবুল করে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলার অধীর আগ্রহ থাকার কথাই আমরা জানতে পেলাম।
>[2]. আল-কুরআন, সূরা গাফির : ৬০।
[3]. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল কিয়ামাহ, বাব নং- ৫৯; ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৬৬৭।
[4]. আল-কুরআন, সূরা হিজর : ৪৯।
[5]. আল-কুরআন, সূরা যুমার : ৫৩।
[6]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ : ১৮৬।
[7]. আল-কুরআন, সুরা নিসা : ১৭।
[8]. বুখারী, প্রাগুক্ত; (কিতাবুয যুহদ, বাব- শেষ রাতের নামাজে দু‘আ করা), ১/২১২১; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল মুসাফিরীন, পরিচ্ছেদ : শেষ রাতে দু‘আ ও জিকির করার ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রদান, এবং দু‘আ কবুল করা), ১/৫২১।
[9]. আল-কুরআন, সূরা নিসা : ১৮।