লগইন করুন
জাহেলী যুগে আরবের মুশরিকদেরকে শয়তান বিভিন্ন রকমের ধ্যান-ধারণা দেয়ার মাধ্যমে শির্কে লিপ্ত করেছিল। তাদেরকে যে সব ধ্যান-ধারণা দিয়েছিল তন্মধ্যে অন্যতম একটি ধারণা এমন দিয়েছিল যে, আল্লাহর ওলি ও ফেরেশ্তাদের নামে তাদের যে সব দেব-দেবী রয়েছে সেগুলো আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মাঝে মধ্যস্থতাকারী। এদের মধ্যস্থতা গ্রহণ করলে অতি সহজে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায়। আবার এদের মধ্যস্থতা পেতে হলে এদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হয়। সে জন্যে তারা এদের উদ্দেশ্যে মানত করতো। এদের কাছে অবস্থান করতো। সাহায্যের জন্য এদেরকে আহ্বান করতো। তারা যে এদের মধ্যস্থতা পাওয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এ জাতীয় উপাসনা করতো সে সম্পর্কে তারা নিজেরাই বলতো :
﴿مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ ﴾ [الزمر: ٣]
‘‘আমরা তাদের উপাসনা করছি কেবল এ জন্য যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী করে দেবে।’’[1]
মুশরিকদের এ কথার দ্বারা পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে, তারা যে সব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা করতো, তন্মধ্যে এদের ওসীলায় আল্লাহর নিকটবর্তী হতে চাওয়া তাদের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। কালের পরিক্রমায় ওলীদের ব্যাপারে শয়তান বহু মুসলিমদের অন্তরেও এ জাতীয় ধারণার জন্ম দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তাদেরকে আরো ধারণা দিয়েছে যে, তাঁদের মাধ্যমে মানুষেরা তাদের জীবনের ছোট ছোট বিষয়াদি প্রাপ্ত হয়ে থাকে। পৃথিবীর নিয়ম-শৃঙ্খলা তাঁদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়ে থাকে। আল্লাহ তাঁদের মাঝ থেকে কতিপয় ব্যক্তিকে আবদাল, আওতাদ, আবরার, গাউছ ও কুতুব... ইত্যাদি প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন।[2]
আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে গউছ খেতাব পেয়েছিলেন বলেই তাঁকে গউছুল আ‘জম বলা হয়ে থাকে। একই কারণে চট্রগ্রামের মাইজভাণ্ডারের আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারীকেও গউছুল আ‘জম বলা হয়। প্রেসিডেন্টের কাছে মন্ত্রীদের যেরূপ মর্যাদা থাকে, আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাঁদের সে রকম মর্যাদা রয়েছে। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা যেমন প্রেসিডেন্টের মাধ্যম হয়ে থাকেন, তেমনি আল্লাহর নিকট সাধারণ মানুষের সমস্যাদি উপস্থাপন করা, তাদের মনস্কামনা পূর্ণ করিয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা এবং তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়ার ক্ষেত্রে ওলিগণ হলেন আল্লাহর মাধ্যম বা ওসীলা ! [নাউযুবিল্লাহ]
মানুষের জীবনের ইহলৌকিক সমস্যা ও তা সমাধানের মাধ্যম:
মানুষের জীবনের সমস্যাদি মোট দু’ভাগে বিভক্ত :
এক, জীবন ও জীবিকার সমস্যা। দুই, পরকালীন সমস্যা। প্রতিটি মানুষই পৃথিবীতে ভাল জীবন ও জীবিকা পেতে চায় এবং প্রতিটি মু’মিন মাত্রই আখেরাতে শান্তিময় জীবন লাভ করতে চায়। পৃথিবীতে ভাল জীবন ও জীবিকা লাভের বিষয়টি মানুষের ভাগ্যের সাথে সম্পর্কিত। ভাগ্য নির্ধারণ সম্পর্কে আমরা এ বই এর প্রথম অধ্যায়ে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তাই এখানে এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছু না বলে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আল্লাহর ইনসাফ ও বিচারে যে মানুষকে যে জীবন ও জীবিকা প্রদান করা উচিত ও তার জন্য মঙ্গলজনক বলে তিনি মনে করেছেন, তাকে তিনি সে জীবন ও জীবিকা প্রদানের পরিকল্পনা পূর্ব থেকেই করে রেখেছেন। প্রতিটি মানুষের ভাগ্যে কী জীবন ও জীবিকা রয়েছে তা খতিয়ে দেখার মাধ্যম সে নিজেই।
সুস্থ জীবন ও উত্তম জীবিকা লাভ করার জন্য তাকে শরী‘আতসম্মত বৈধ উপায় ও পন্থায় প্রয়োজনীয় কর্ম করতে হবে। যে সকল কর্ম করার ক্ষেত্রে জীবিত মানুষেরা একে অন্যের স্বাভাবিকভাবে কর্ম বা দো‘আ করার মাধ্যমে সাহায্য করতে পারে, সে সকল ক্ষেত্রে অন্যের কর্ম বা দো‘আর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে নিজে ও প্রয়োজনে অন্য জীবিত মানুষের সাহায্য নিয়ে কর্ম করে কর্মের ফল প্রাপ্তির জন্য সর্বদা আল্লাহর কাছেই তাঁর দয়া কামনা করতে হবে। ধৈর্যের সাথে যাবতীয় সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। ভাগ্য পরিবর্তনে বিলম্ব হচ্ছে দেখে কোনো অবস্থাতেই ধৈর্যহারা হয়ে কোনো বিকল্প পথে ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো পীর, ফকীর ও ওলির কবরে এ জন্য কোনো আবেদন-নিবেদন করা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকতে হবে।
মনে রাখতে হবে যে, ভাগ্যে সুস্থ জীবন, সন্তান ও উত্তম জীবিকা লেখা থাকলে বৈধ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে তা আজ হোক কাল হোক, পাওয়া যাবেই। কেউ হাজার ষড়যন্ত্র করেও তা ঠেকাতে পারবে না। আর ভাগ্যে তা লেখা না থাকলে সারা দুনিয়ার জীবিত ও মৃত মানুষেরা সাহায্য ও দো‘আ করলেও তা পাইয়ে দিতে পারবে না। বৈধ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তিত হলে তা যেমন আল্লাহরই দান হয়ে থাকবে, তেমনি অবৈধ পন্থা অবলম্বনের পর তা পরিবর্তিত হলে তাও আল্লাহরই দ্বারা হয়ে থাকবে। দুয়ের মাঝে পার্থক্য এটুকু যে, যারা বৈধ পন্থা অবলম্বন করে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করে, তারাই হবে প্রকৃত মু’মিন ও আল্লাহর প্রিয়ভাজন বান্দা। আর যারা অধৈর্য হয়ে কবর ও কবরে যেয়ে রোগ মুক্তি, সন্তান দান ও উত্তম জীবিকা ইত্যাদি চাইবে, তারা হবে মুশরিক ও আল্লাহর বিরাগভাজন।
পরকালীন সমস্যা সমাধানের মাধ্যম:
এ ক্ষেত্রে শরী‘আতের একক শিক্ষা হলো : ঈমান ও সৎ ‘আমলই হচ্ছে মানুষের পরকালীন সমস্যা সমাধানের একক মাধ্যম বা ওসীলা। এ দু’টি গুণ ব্যতীত যারা অন্য কোনো উপায়ে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায় বলে মনে করে, তারা মূলত কল্পনার জগতেই বসবাস করে। মুহাজির, আনসার ও তাঁদের অনুসারী পরবর্তী মনীষীগণ এ বিষয়টি অনুধাবন করেই ঈমান ও ‘আমলে সালেহ এর ক্ষেত্রে অধিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। যার ফলেই সাহাবীদের মধ্যকার দশজন ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ দুনিয়াতে থাকতেই জান্নাতের আগাম সনদ লাভ করেছিলেন। বাকিরা সনদ লাভ না করলেও তা লাভ করার যোগ্য হয়েছিলেন। এক কথায় আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য কুরআনুল কারীমে বর্ণিত-
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱبۡتَغُوٓاْ إِلَيۡهِ ٱلۡوَسِيلَةَ﴾ [المائدة: ٣٥]
‘‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ কর’’।[3]
এ আয়াতে ওসীলা অন্বেষণের যে নির্দেশ রয়েছে, এর দ্বারা তাঁরা ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করার প্রতি নির্দেশ করার কথাই বুঝেছিলেন।
জ্ঞানী ও সৎ মানুষদের সাহচর্য গ্রহণ :ঈমান কী এবং কিভাবে ‘আমলে সালেহ করতে হয়, তা তাঁদের কারো জানা না থাকলে সে জন্য তাঁরা জ্ঞানী ও সৎ জনের সাহচর্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের শিক্ষার অনুসরণ ও অনুকরণ করে সে অনুযায়ী ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করাকেই তাঁরা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার একক ওসীলা হিসেবে গণ্য করেছিলেন। ঈমান ও ‘আমলে সালেহ না করে কেবলমাত্র সৎ মানুষদের সাহচর্য গ্রহণ করা বা তাঁদের হাতে বায়‘আত[4] করাকেই তাঁরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মূল উপায় হিসেবে নির্ধারণ করেন নি। অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁরাই ছিলেন আমাদের একমাত্র আদর্শ। তাই আমাদেরকেও তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করে আখেরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে শান্তিময় জীবন লাভের আশা করতে হবে।
>[2]. লেখকের মূল কথার উদ্ধৃতি এ বই এর প্রথম অধ্যায়ের ২৫ নং টীকায় প্রদান করা হয়েছে। দেখুন : দৈনিক ইনকিলাব, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ খ্রি., পৃ.৬।
[3]. আল-কুরআন, সূরাহ মা-ইদাহ : ৩৫।
[4]. যদিও এ ধরনের বাই‘আত গ্রহণ জঘন্য বিদ‘আত। এর অধিকার তাদের নেই। এ অধিকার শাসকদের জন্য নির্ধারিত। [সম্পাদক]