শির্ক শব্দের আভিধানিক অর্থ :
ইবন মানযুর বলেছেন : ‘আশ-শির্কাতু’ ও ‘আশ-শারকাতু’ (الشرْكَةُ وَ الشَّرْكَةُ) সমার্থবোথক দু’টি শব্দ। যার অর্থ : দু’শরীকের সংমিশ্রণ। তিনি আরো বলেন : ‘ইশতারাকনা’ (اشْتَرَكْنا) আমরা শরীক হলাম শব্দের অর্থ : ‘তাশারাকনা’ (تَشَارَكْنَا) আমরা পরস্পর শরীক হলাম। দু’জন শরীক হলো আর পরস্পর শরীক হলো বা একে অপরের সাথে শরীক হলো কিংবা শরীক হওয়া, এ-সব শব্দের অর্থ ‘আল-মুশারিক’ (الْمُشَارِكُ) বা অংশীদার। ‘আশ-শির্কু’ (الشِّرْكُ) শরীক করাও শরীক হওয়ার মতই। এর বহু বচন হলো : ‘আশরাক’ ও ‘শুরাকা-উ’ ‘(أَشْرَاكٌ وَ شُرَكَاءٌ) অর্থাৎ : সকল শরীকান বা অংশীদার।
তিনি আরো বলেন : ‘আশ-শির্কু’ (اَلشِّرْكُ) শব্দটি ‘আল-হিস্সাতু’ (اَلْحِصَّةُ) : অংশের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : [ مَنْ أَعْتَقَ شِرْكاً لَهُ فِيْ عَبْدٍ...]’’- ‘‘যে তার কোন ক্রীতদাসের অংশকে মুক্ত করে দিল...।’’[1] বলা হয়ে থাকে ‘‘طَرِيْقٌ مُشْتَرَكٌ’’ অর্থাৎ সম্মিলিত রাস্তা, যা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সকলের সমান অধিকার রয়েছে। ‘আশরাকা বিল্লাহি’ (أِشْرَكَ بِاللهِ) সে আল্লাহর সাথে শরীক করলো, অর্থাৎ আল্লাহর রাজত্বে কাউকে তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করলো।[2] (নাউযু বিল্লাহি)
আল-মুনজিদ নামক অভিধানে বলা হয়েছে : (أَشْرَكَ فِيْ أَمْرِهِ) অর্থাৎ- তার কাজে সে (অপর কাউকে) শরীক করে নিয়েছে। (أَشْرَكَ بِاللهِ) অর্থাৎ- সে আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করেছে। আর যে তা করলো সে মুশরিক হয়ে গেল।[3]
শেখ যাকারিয়্যা আলী ইউছুফ বলেন :
‘‘কোন ক্ষেত্রে ‘শারাকতুহু’ ও আশ-রাকতুহু’ (شَرَكْتُهُ وَ أَشْرَكْتُه) তখনই বলা হয় যখন সে ক্ষেত্রে আমি কারো ‘শরীক’ (شَرِيْكٌ) অংশীদার হয়ে গেলাম, ‘শা-রাকতুহু’ (شَارَكْتُهُ)শব্দটিও শরীক এর অর্থ প্রকাশ করে।‘আশরাকতুহু’ (أَشْرَكْتُهُ) শব্দের অর্থ: আমি তাকে শরীক করে নিলাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَأَشۡرِكۡهُ فِيٓ أَمۡرِي ٣٢ ﴾ [طه: ٣٢]
(হে আল্লাহ) ‘‘তুমি হারূনকে আমার নবুওতের অংশীদার করে দাও।’’[4]
তিনি আরো বলেন: ‘শির্ক’ শব্দমূলটি সংমিশ্রণ ও একত্রিকরণের অর্থ প্রকাশ করে। কোন বস্তুর অংশ বিশেষ যখন একজনের হবে, তখন এর অবশিষ্ট অংশ হবে অপর এক বা একাধিকজনের। আল্লাহর বাণী :
﴿أَمۡ لَهُمۡ شِرۡكٞ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ﴾ [فاطر: ٤٠]
‘‘তবে কি আকাশমণ্ডলীতে তাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে’’[5] এ-আয়াতে বর্ণিত ‘শির্কুন’ শব্দের দ্বারা এ অংশীদারিত্বের অর্থই প্রকাশিত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, একজন অংশীদার তার অপর অংশীদারের সাথে সংমিশ্রণকারী এবং তার অংশ অপরের অংশের সাথে মিলিত।
তিনি আরো বলেন : কোনো বস্তুতে একাধিক শরীক হলে সে বস্তুতে তাদের প্রত্যেকের অংশ সমান হওয়াটি অত্যাবশ্যক নয়, তাদের একের অংশ অপরের অংশের চেয়ে অধিক হওয়ার পথেও তা কোন অন্তরায় সৃষ্টি করে না, যেমন মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর রেসালতের ক্ষেত্রে স্বীয় ভাই হারূন আলাইহিস সালামকে তাঁর সাথে শরীক করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট আবেদন করলে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ قَالَ قَدۡ أُوتِيتَ سُؤۡلَكَ يَٰمُوسَىٰ ٣٦ ﴾ [طه: ٣٦]
‘‘হে মূসা! তোমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা হলো।’’[6]
এ কথা বলে আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালাম-এর কামনা পূর্ণ করে থাকলেও রেসালতের ক্ষেত্রে হারূন আলাইহিস সালাম-কে সমান অংশীদার করে দেন নি; বরং সে ক্ষেত্রে হারূন আলাইহিস সালাম-এর অংশ মূসা আলাইহিস সালাম-এর অংশের চেয়ে কম ছিল।[7]উপর্যুক্ত বর্ণনার আলোকে আমাদের নিকট এ-কথা প্রমাণিত হচ্ছে যে, ‘শির্ক’ শব্দমূলটি মূলগতভাবেই মিশ্রণ ও মিলনের অর্থ প্রকাশ করে থাকে এবং এ মৌলিক অর্থটি এর সকল রূপান্তরিত শব্দের মধ্যে নিহিত থাকে। আর দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যকার অংশীদারিত্ব যেমন ইন্দ্রিয় অনুভূত বস্তুসমূহের মধ্যে হতে পারে[8], তেমনি তা কোন অর্থগত বা গুণগত[9] বস্তুতেও হতে পারে।
[2]. ইবন মানযুর, লেছানুল ‘আরব; শব্দমূল : الشِّرْكُ, (কুম:নাশরু আদাবিল হাওযাঃ সংস্করণ বিহীন, ১৮০৫হি.), ১০/৪৪৮-৪৫০।
[3]. অধ্যাপক আনতুয়ান না‘মাঃ ও গং, আল-মুনজিদ; (বৈরুতঃ দারুল মাশরিক, সংস্করণ ২১, ১৯৭২ খ্রি.), পৃ.৩৮৪।
[4] . আল-কুরআন, সূরা ত্বাহা : ৩২।
[5] . আল-কুরআন, সূরা আহকাফ : ৪।
[6] . আল-কুরআন, সূরা ত্বাহা : ৩৬।
[7]. যাকারিয়্যা আলী ইউছুফ, আল-ঈমান ওয়া আ-ছারুহু ওয়া আশশির্কু ওয়া মাযাহিরুহু; (কায়রো : মাকতাবাতুস সালাম আল- আলমিয়্যা : ২য় সংস্করণ, তারিখ বিহীন), পৃ. ৭৮।
[8]. যেমন দুই বা ততোধিক ব্যক্তির কোনো বাড়ী, জমি বা গাড়ীতে সমঅংশে বা বেশ-কমে অংশীদার হওয়া।
[9]. যেমন মানুষ এবং ঘোড়া প্রাণী হওয়ার ক্ষেত্রে সমানভাবে অংশীদার এবং দু’টি ঘোড়া বাদামী বা লাল বর্ণের হওয়ার ক্ষেত্রে সমানভাবে শরীক হতে পারে।
ড. ইব্রাহীম আল-বুরাইকান শির্ক-এর পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন :
‘শির্ক’-এর দু’টি অর্থ রয়েছে :
এক. সাধারণ অর্থ, আর তা হচ্ছে- গায়রুল্লাহকে আল্লাহর বৈশিষ্ট্যের সমকক্ষ করা। সমকক্ষ বলতে এখানে মুক্ত শরীকানা বুঝানো হয়ে থাকে, শরীকানায় আল্লাহর অংশ গায়রুল্লাহের অংশের সমান হতে পারে অথবা আল্লাহর অংশ গায়রুল্লাহের অংশের চেয়ে অধিকও হতে পারে। তিনি আরো বলেন :
শির্কের উপর্যুক্ত সাধারণ অর্থের ভিত্তিতে শির্ক তিন প্রকার :
এক. আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শির্ক। এর সংজ্ঞা হচ্ছে- আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে সমকক্ষ করা অথবা কোনো বৈশিষ্ট্যকে তিনি ব্যতীত অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা। যেমন সৃষ্টি, জীবিকা, জীবন ও মৃত্যু ইত্যাদির সম্পর্ক অন্যের সাথে করা।
দুই. আল্লাহর উলূহিয়্যাতে শির্ক। এর সংজ্ঞা হচ্ছে- আল্লাহর উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে কাউকে সমকক্ষ করা। যেমন : সালাত, সাওম, পশু উৎসর্গকরণ ও মানত ইত্যাদি অন্য কারো উদ্দেশ্যে করা।
তৃতীয়. আল্লাহ তা‘আলার নামাবলী ও গুণাবলীতে শির্ক। এর সংজ্ঞা হচ্ছে- আল্লাহর নামাবলী ও গুণাবলীতে কোনো সৃষ্টিকে তাঁর সমকক্ষ করা।
শির্কের দ্বিতীয় অর্থ :
“আল্লাহর পাশাপাশি গায়রুল্লাহকে উপাস্য ও মান্যবর হিসেবে গ্রহণ করা। কুরআন, সুন্নাহ ও অগ্রবর্তী মনীষীগণের কথায় শির্ক শব্দটি যখন সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন এর দ্বারা শির্কের দ্বিতীয় অর্থই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।’’[1]
আক্বীদার বিভিন্ন কিতাবাদিতে শির্ক-এর যে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, তা অনেকটা ড. ইব্রাহীম বুরাইকান কর্তৃক বর্ণিত উপর্যুক্ত সংজ্ঞারই অনুরূপ। উপর্যুক্ত এ সংজ্ঞার দ্বারা যদিও শির্ক’র পারিভাষিক অর্থ অনুধাবন করা যাচ্ছে, তবে আমরা যদি আরো পরিষ্কারভাবে এর সংজ্ঞা জানতে চাই, তা হলে শির্ককে তাওহীদ-এর সংজ্ঞার বিপরীতে দাঁড় করালে তা জানা যেতে পারে। কেননা, শির্ক শব্দটি তাওহীদ শব্দের অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। আর প্রবাদে রয়েছে ‘প্রত্যেক বস্তুকে তার বিপরীতধর্মী বস্তু দিয়ে পরিচয় করা যায়।’ তাই নিম্নে প্রথমে তাওহীদ-এর পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রদান করা হলো এবং পরবর্তীতে এর সংজ্ঞা থেকেই শির্ক-এর সংজ্ঞা নিরূপণ করা হলো।
তাওহীদ শব্দের পারিভাষিক অর্থ :
‘তাওহীদ’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লামা জুরজানী বলেন: ‘‘তাওহীদ হলো: অন্তরে যা কিছুর কল্পনা বা ধারণা হয়, সে সব থেকে আল্লাহ তা‘আলার জাতসত্তাকে মুক্ত করা। তাওহীদ তিনটি বিষয়ের সমষ্টি : মহান আল্লাহকে রব হিসেবে জানা, তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান করা এবং তাত্থেকে সকল শরীকদের অস্বীকার করা।’’[2]
আল্লামা জাযাইরী বলেন : তাওহীদ হলো : ‘‘মহান আল্লাহ তা‘আলার যাত, তাঁর গুণাবলী ও কর্মসমূহে কারো সমকক্ষ থাকা বা সে সকল ক্ষেত্রে তাঁর কোন সাদৃশ্য হওয়া এবং তাঁর রুবুবিয়্যাত ও উপাসনায় কারো অংশীদারিত্ব থাকা অস্বীকার করাকে তাওহীদ বলা হয়।’’[3]
তাওহীদের উপর্যুক্ত দু’টি সংজ্ঞাই অনেকটা সংক্ষিপ্ত হওয়াতে নিম্নে এর অপর একটি বিস্তারিত সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :
শেখ আব্দুল আযীয বলেন : ‘‘শর‘য়ী পরিভাষায় তাওহীদ হলো : বান্দা এ-কথা স্বীকার করবে যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা হলেন সেই রব যিনি সকল সৃষ্টির জীবিকা প্রদান ও তাদের পরিচালনার কাজ এককভাবেই করে থাকেন, তিনি সকল সৃষ্টির উপাস্য, যাবতীয় উপাসনা ও আনুগত্য এককভাবে তাঁর জন্যেই নিবেদিত। আরো মনে করা যে, তিনি এককভাবে বড়ত্ব, মহত্ব ও সৌন্দর্যের যাবতীয় গুণাবলীর সার্বিক পূর্ণতায় অধিষ্ঠিত।’’[4]
‘শির্ক’ যখন ‘তাওহীদ’ এর বিপরীত তখন শেখ ‘আব্দুল ‘আযীয কর্তৃক উপরে তাওহীদের যে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, সে হিসেবে এর বিপরীতে ‘শির্ক’ এর পারিভাষিক সংজ্ঞা নিম্নরূপ দাঁড়ায় :
‘‘মহান আল্লাহকে সকল সৃষ্টির জীবন-জীবিকা দানকারী, তাদের ভাগ্যের ভাল-মন্দ ও সমগ্র জগত পবিচালনাকারী একক রব হিসেবে মনে না করা। বরং এক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টির ছোট বা বড় কোনো বস্তু যেমন গ্রহ, নক্ষত্র, বা অলি ও দরবেশ নামের কোনো নেক মানুষকে এর কোনো কিছুর পূর্ণ বা আংশিক মালিক কিংবা শরীক, অথবা তা পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্যকারী বলে মনে করা। আল্লাহর সমীপে তাঁর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত কারো জন্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা অপর কোনো অলির শাফা‘আত উপকারী হয়ে থাকে বলে বিশ্বাস করা। উপর্যুক্ত রকমের ধারণার বশবর্তী হয়ে আল্লাহর একক উপাসনা ও আনুগত্য করার পরিবর্তে তাঁদের ওসীলা ও সুপারিশে উত্তম জীবন, জীবিকা ও সৌভাগ্য লাভ করার জন্য তাঁদের উপাসনা ও আনুগত্য করা। আল্লাহর জ্ঞান, তাঁর বড়ত্ব, মহত্ব ও সৌন্দর্যের যাবতীয় গুণাবলীর ক্ষেত্রে সৃষ্টি জগতের কাউকে তাঁর সমকক্ষ করা।’’
অন্য কথায় ‘‘এমন সব বিশ্বাস, কাজ, কথা ও অভ্যাসকে শির্ক বলা হয় যার দ্বারা বাহ্যত মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত ও গুণাবলীতে অপর কারো অংশীদারিত্ব বা সমকক্ষতা প্রতীয়মান হয়।’’
অপর কথায় বলা যায় : ‘‘গায়রুল্লাহকে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত ও গুণাবলীর বৈশিষ্ট্যে গায়রুল্লাহকে সমকক্ষ করাকে শির্ক বলা হয়।’’ শির্কের এ সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দু’টি কুরআনুল কারীম থেকে প্রমাণ করা যায়।
মহান আল্লাহ বলেন :
﴿ قَالُواْ وَهُمۡ فِيهَا يَخۡتَصِمُونَ ٩٦ تَٱللَّهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ٩٧ إِذۡ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٨ ﴾ [الشعراء: ٩٦، ٩٨]
‘‘তারা (মুশরিকরা তাদের উপাস্য দেব-দেবীদের সাথে) জাহান্নামে কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়ে বলবে: আল্লাহর কসম! আমরা তথায় (পৃথিবীতে) প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্ব-পালনকর্তার সমতুল্য গণ্য করতাম।’’[5]
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুশরিকরা তাদের পাথর ও কাঠ ইত্যাদির মূর্তিসমূহকে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে সমকক্ষ বানিয়ে নেয়ার কারণেই বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে মুশরিক হয়েছিল।শির্ক যখন আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত ও গুণাবলীর বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত, তখন সর্বাগ্রে আমাদেরকে এ তিনটি বিষয়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে হবে কেননা; এতে আমাদের নিকট শির্কের সম্ভাব্য ক্ষেত্রসমূহ পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
[2]. আল-জুরজানী, শরীফ আলী ইবন মুহাম্মদ, কিতাবুত তা‘রীফাত; (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ.৬৭।
[3].আল-জাযাইরী, আবু বকর জাবির, ‘আক্বীদাতুল মু‘মিন; (জেদ্দা : দারুস সুরুক, ৫ম সংস্করণ, ১৯৮৭ খ্রি.), পৃ.৮৭।
[4].আব্দুল আযীয আল-মুহাম্মদ আল-সলমান, আল-আসইলাতু ওয়াল আজইবাতিল উসূলিয়্যাতি আলাল ‘আক্বীদাতিল ওয়াসিতিয়্যাতি লি ইবনে তাইমিয়্যাহ; (প্রকাশ বিহীন, ২১ম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ৩২।
[5]. আল-কুরআন, সূরা শু‘আরা : ৯৬-৯৮।
‘রব’ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার গুণগত নাম। আর এ-গুণগত নামবাচক শব্দ থেকেই ‘রুবূবিয়্যাত’ শব্দটি উদগত হয়েছে। এটা ‘রব’ নামের সম্পর্ক বর্ণনাসূচক শব্দ। ‘রব’ শব্দটি আভিধানিক দিক থেকে প্রভু, মালিক, মনিব, প্রতিপালক, কর্তা, অভিভাবক ও দেবতা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়।[1] এ শব্দটি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের বেলায়ও রূপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে আল্লাহ তা‘আলার বেলায়ই এর ব্যবহার হচ্ছে মূল বা আসল। উপরে ‘রব’ শব্দের যে সব অর্থ বর্ণিত হয়েছে, সে সবই মূলত আল্লাহ তা‘আলার ‘রুবূবিয়্যাত’-এর বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বিষয়াদি। তবে শর‘য়ী পরিভাষায় আল্লাহ তা‘আলাকে ‘রব’ বলে স্বীকৃতি দিতে হলে নিম্নে বর্ণিত বিষয়সমূহকে তাঁর রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে এবং এর বিপরীতধর্মী চিন্তা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে হবে :
১. তিনি আমাদের ও এ জগতের ছোট বড় সব কিছুর একক সৃষ্টিকর্তা। যেখানে যা কিছু সৃষ্টি করা প্রয়োজন, সেখানে তিনি নিজেই তাঁর পরিকল্পনানুযায়ী তা সৃষ্টি করেছেন ও করেন। তাঁর ইচ্ছা ও অনুমতি ব্যতীত কোনো সৃষ্ট বস্তুর প্রভাবে অপর কোনো বস্তু আপনা-আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হতে পারে এমন বিশ্বাস করা তাঁকে একক সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিশ্বাসের পরিপন্থী বলে মনে করা।
২. তিনি এ বিশ্বজগতের সব কিছুর একক মালিক, নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক। এ ক্ষেত্রে তাঁর কোনো শরীক ও সাহায্যকারী নেই। এ-জগত পরিচালনা কর্মে তাঁর অনুমতি ব্যতীত শাফা‘আতের নামে তাঁর নিকট অনধিকার চর্চা করার মতও কেউ নেই। ফেরেশতাগণকে কোনো কোনো বিষয় পরিচালনা কর্মে ব্যবহার করে থাকলেও তারা তাঁর নির্দেশানুযায়ীই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন মাত্র। মানুষদের মধ্য থেকে গাউছ, কুতুব ও আবদাল নামের কোন অলিদেরকে কোনো কিছু পরিচালনা করার কোনই কর্তৃত্ব তিনি দান করেন না।
৩. তিনি আমাদের জীবনের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইত্যাদি বিষয়াদি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় হেদায়াত তথা আদেশ ও নিষেধ দানের মালিক। তাঁর বিধানসমূহ বিস্তারিত ও মৌলিক নীতিমালার আকারে বর্ণিত হয়েছে কুরআনুল কারীম ও তাঁর নবীর সহীহ হাদীসে। এগুলো অবতীর্ণ করেছেন সকল স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে বাস্তবায়নের যোগ্য করে। আমরা নীতিগতভাবে তাতে বর্ণিত বিধানসমূহ মানতে বাধ্য। তাতে বর্ণিত কোনো বিধানের বিকল্প কোনো বিধান রচনা করার আমাদের কোনো বৈধ অধিকার নেই। অনুরূপভাবে কোনো বিধান রচনা করার প্রয়োজন দেখা দিলে তাতে বর্ণিত নীতিমালার বাইরে শরী‘আতের উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো বিধান রচনা করারও আমাদের কোনো অধিকার নেই। আমরা যদি নিজেদেরকে সেরকম কিছু করার যোগ্যতাবান বলে মনে করি, তা হলে এতে আমরা প্রকারান্তরে নিজেদেরকে নিজেদের রব বানিয়ে নেব এবং কুরআনুল কারীমের সূরা আল-মায়িদাহ : এর ৪৪, ৪৫, ও ৪৭ আয়াতে বর্ণিত বক্তব্যের মর্মানুযায়ী আমরা এ অপরাধের কারণে ইয়াহূদীদের ন্যায় কাফির, যালেম ও ফাসিকে পরিণত হবো।
১. তিনি আমাদের জীবন ও জীবিকার ভাল ও মন্দ সব কিছু দানের একচ্ছত্র মালিক। আমাদেরকে পরস্পরের প্রতি মুখাপেক্ষী করে রাখা এবং আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা গ্রহণ করার নিমিত্তে আমাদের প্রত্যেকের জন্য যে জীবন ও জীবিকা প্রদান করা উচিত- কাফির, মুশরিক, মুনাফিক ও মুসলিম নির্বিশেষে তিনি সবাইকে সে জীবন ও জীবিকাই দান করে থাকেন।
২. তিনি আমাদের দুনিয়া-আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক। তিনি আমাদের কোনো কল্যাণ করতে চাইলে তা রোধ করার কেউ নেই। আবার তিনি কারো অকল্যাণ করতে চাইলে সে লোকের কল্যাণ করার মতও কেউ নেই। কোন মৃত অলি কারো কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ করাতো দুরের কথা, কোন জীবিত অলি বা কুতুব[2]ও নিজ থেকে তাঁর ইচ্ছার বাইরে কারো কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারেন না। অনুরূপভাবে কোন বস্তুও তাঁর ইচ্ছার বাইরে নিজ থেকে কারো কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারে না।
১. তিনি আমাদের সকলের মৃত্যু ও পুনর্জীবন দানের মালিক।
২. ইহ-আখেরাতে একমাত্র তিনিই আমাদের যাবতীয় অপরাধ মার্জনা করার মালিক। আখেরাতে বিচার দিবসে শাফা‘আতের চাবিকাঠি থাকবে তাঁরই হাতে। তাঁর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত কারো পক্ষে কারো শাফা‘আত করার আদৌ কোন সুযোগ নেই।
৩. তিনি মানুষকে যাবতীয় কর্তৃত্ব ও সম্মান দানের মালিক। তাঁরই ইচ্ছায় জনগণ কোন রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করে। আবার তাঁরই ইচ্ছায় জনগণ সে দলকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে। তাই ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সঠিক ঈমান ও আমলের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন পূর্বক তা প্রতিষ্ঠা করে দেয়ার জন্য তাঁর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। তিনি ইচ্ছা করলে জনগণের সহযোগিতায় সে লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে, অন্যথায় নয়।
উপর্যুক্ত এ বিষয়গুলো যে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বিষয়, এর প্রমাণ আমরা নিম্নে বর্ণিত আয়াতসমূহে দেখতে পাই :
ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর জাতির উপাস্য দেবতাদের সমালোচনা পূর্বক তাদের নিকট স্বীয় উপাস্য প্রভুর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন :
﴿ قَالَ أَفَرَءَيۡتُم مَّا كُنتُمۡ تَعۡبُدُونَ ٧٥ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُمُ ٱلۡأَقۡدَمُونَ ٧٦ فَإِنَّهُمۡ عَدُوّٞ لِّيٓ إِلَّا رَبَّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٧٧ ٱلَّذِي خَلَقَنِي فَهُوَ يَهۡدِينِ ٧٨ وَٱلَّذِي هُوَ يُطۡعِمُنِي وَيَسۡقِينِ ٧٩ وَإِذَا مَرِضۡتُ فَهُوَ يَشۡفِينِ ٨٠ وَٱلَّذِي يُمِيتُنِي ثُمَّ يُحۡيِينِ ٨١ وَٱلَّذِيٓ أَطۡمَعُ أَن يَغۡفِرَ لِي خَطِيَٓٔتِي يَوۡمَ ٱلدِّينِ ٨٢ رَبِّ هَبۡ لِي حُكۡمٗا وَأَلۡحِقۡنِي بِٱلصَّٰلِحِينَ ٨٣ ﴾ [الشعراء: ٧٥، ٨٣]
তিনি বলেন : ‘‘তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষেরা যাদের উপাসনা করছো, তাদের যথার্থতা নিয়ে কি কোন সময় তোমরা ভেবে দেখেছ ? সমগ্র জগতের প্রতিপালক ব্যতীত এদের সবাই আমার শত্রু। সমগ্র জগতের প্রতিপালক তিনিই- যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন, যিনি আমাকে আহার ও পানীয় দান করেন, যখন আমি রোগাক্রান্ত হই তখন তিনিই আরোগ্য দান করেন, যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন অতঃপর পুনর্জীবন দান করবেন, যিনি আখেরাতে আমার অপরাধ মার্জনা করবেন বলে আমি আশাবাদী, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে কর্তৃত্ব দান কর এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্গত কর।’’[3]
উপর্যুক্ত এ আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, উপরে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, এর মধ্যকার সাতটি বৈশিষ্ট্যই এ আয়াতগুলোর মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। যেমন ‘খালাকানী’ خَلَقَنِيْ শব্দের দ্বারা প্রথম বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঈিত করা হয়েছে, ‘ইয়াহদ্বীনী’ يَهْدِيْنِيْ শব্দের দ্বারা তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঈিত করা হয়েছে, ‘ইউত্বইমুনী ওয়া ইয়াছক্বীন’ يُطْعِمُنِيْ وَ يَسْقِيْن শব্দদ্বয় দ্বারা চতুর্থ বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, ‘মারিদতু ফাহুয়া ইয়াশফীন’ ﴾مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفْيْن﴿ বাক্য দ্বারা পঞ্চম বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঈিত করা হয়েছে, ‘ইউমীতুনী ওয়া ইউহয়ীন’يُمِيْتُنِيْ ثُمَّ يُحْيِيْن বাক্যদ্বয় দ্বারা ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঈিত করা হয়েছে, ‘আত্বমাউ আন ইয়াগফিরা লী খাত্বীআতী’ أَطْمَعُ أَن يَّغْفِرَ لِيْ خَطِيْئَتِيْ .. এ বাক্যের দ্বারা সপ্তম বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঈিত করা হয়েছে, ‘রাববী হাবলী হুকমান’ رَبِّ هًبْ لِيْ حُكْمًا.. এ বাক্যের দ্বারা অষ্টম বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঈিত করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ প্রসঙ্গে অন্যত্র বলেছেন :
﴿ يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ إِلَى ٱلۡأَرۡضِ ﴾ [السجدة: ٥]
‘‘তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত যাবতীয় বিষয়াদি পরিচালনা করেন।’’[4]
আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের মৌলিক এ বিষয়গুলোর বর্ণনা কুরআনুল কারীমের অন্যান্য স্থানেও বিক্ষিপ্তভাবে দেয়া হয়েছে। যেমন তিনি যে সৃষ্টিকর্ম এবং যাবতীয় আদেশ ও নিষেধের বিধান দানের মালিক, সে সম্পর্কে অন্যত্র বলেছেন :
﴿أَلَا لَهُ ٱلۡخَلۡقُ وَٱلۡأَمۡرُۗ﴾ [الاعراف: ٥٤]
‘‘জেনে রেখো! সৃষ্টি যার নির্দেশও তাঁর।’’[5]
তিনি যে সকলের জীবিকার মালিক সে সম্পর্কে বলেছেন :
﴿هَلۡ مِنۡ خَٰلِقٍ غَيۡرُ ٱللَّهِ يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِۚ﴾ [فاطر: ٣]
‘‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো সৃষ্টিকর্তা আছে কি যে আকাশ ও পৃথিবী থেকে তোমাদেরকে রেজেক দান করবে।’’[6]
তিনি যে সকলের যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক সে-সম্পর্কে বলেছেন :
﴿قُلۡ فَمَن يَمۡلِكُ لَكُم مِّنَ ٱللَّهِ شَيًۡٔا إِنۡ أَرَادَ بِكُمۡ ضَرًّا أَوۡ أَرَادَ بِكُمۡ نَفۡعَۢاۚ﴾ [الفتح: ١١]
‘‘আপনি (কাফিরদের) বলুন : আল্লাহ যদি তোমাদের কোন অকল্যাণ কামনা করেন, তবে কে তোমাদেরকে সে অকল্যাণের হাত থেকে রক্ষা করার শক্তি রাখে, অথবা তিনি তোমাদের কোন কল্যাণ চাইলে কে তোমাদেরকে সে কল্যাণ থেকে মাহরূম করার শক্তি রাখে’’।[7] এ ভাবে ইচ্ছা করলে আমরা উপর্যুক্ত প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্যের আরো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারবো। তবে যাতে বই এর কলেবর বৃদ্ধি না পায়, সে-জন্য পাঠকদের বুঝার জন্যে এ-পর্যন্ত উপস্থাপন করাকেই যথেষ্ট বোধ করলাম।
যিনি হবেন উপাস্য তিনিই হবেন রব :
কেউ কারো উপাস্য হতে হলে তাকে অবশ্যই তার রব হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের উপর্যুক্ত এসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলেই তিনি আমাদের ‘রব’। আর এ বৈশিষ্ট্যগুণেই তিনি আমাদের উপাস্য বা ইলাহ। যিনি জনগণের ইলাহ হবেন, তাকে যে অবশ্যই তাদের ‘রব’ হতে হবে, এ মহা সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمۡ خَٰلِقُ كُلِّ شَيۡءٖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۖ ﴾ [غافر: ٦٢]
‘‘সেই আল্লাহই তোমাদের রব, তিনি প্রত্যেক বস্তুর সৃষ্টিকর্তা, সত্যিকারের উপাস্য বলতে তিনি ব্যতীত আর কেউ নেই।’’[8] উপাস্য বলতে আর কেউ নেই এ জন্যে যে, যিনি কারো ইলাহ বা উপাস্য হবেন তাঁকে অবশ্যই উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য বলে তার রুবূবিয়্যাতের মালিক হতে হবে। কিন্তু মানুষেরা বাস্তবে যাদেরকে তাদের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে, তারাতো উপর্যুক্ত এসব গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যের কোন একটিরও অধিকারী নয়। আর সে জন্যেই তারা তাদের রব বা উপাস্য কোনটাই নয়। যুগে যুগে মানুষেরা এ ভুলের শিকার হয়েছে বলেই নূহ আলাইহিস সালাম-থেকে আরম্ভ করে শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী ও রাসূলগণ নিজ নিজ জাতির জনগণকে এই বলে আহ্বান করেছেন :
﴿ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥٓ﴾ [الاعراف: ٥٩]
‘‘হে জাতির লোকেরা! তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অপর কোনো হক্ক ইলাহ নেই।’’[9]
উপকারীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মানুষের একটি স্বভাবজাত ধর্ম। মানুষ অপর মানুষের নিকট থেকে যে উপকারই লাভ করুক না কেন সে উপকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ কোন মানুষই অপর কোন মানুষের উপাসনা করতে পারে না। কেননা, মানুষ হিসেবে তারা সকলেই সমান। তারা কেউ কারো রব নয়, তাদের উপকারগুলোও রব হওয়ার জন্য যেসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হয়, সেসব বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বিষয়ও নয়; তাই কাউকে অলৌকিক পন্থায় কারো কোন উপকার করতে দেখলে সে উপকারী ব্যক্তির ব্যপারে এ ধারণা পোষণ করা যাবে না যে, তিনি বোধ হয় আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের কোন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে গেছেন, অথবা আল্লাহ বোধ হয় তাকে তাঁর রুবূবিয়্যাতের কোন বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। অনুরূপভাবে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ এমন কোন কর্মও করা যাবেনা যা তাকে উপাস্যের মর্যাদায় সমাসীন করে। তবে মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার যে দয়া ও করুণা রয়েছে, তা তাঁকে মানুষের রবের আসনে সমাসীন করে। সে কারণেই তিনি মানুষদেরকে কেবল তাঁরই উপাসনা করতে আদেশ করেছেন এবং অপর কারোর উপাসনা করতে নিষেধ করেছেন। এবার একজন মানুষ যখন বলবে ‘আল্লাহ আমার রব’ তখন তাকে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের উপর্যুক্ত এ মৌলিক বিষয়গুলোকে কেবল আল্লাহর জন্যেই নির্দিষ্ট বলে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং জীবনভর এ বিশ্বাসের উপর থেকেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। তার কোন বিশ্বাস, কর্ম, কথা বা অভ্যাসের দ্বারা এ মৌলিক বিষয়গুলোর কোন একটির ক্ষেত্রেও যদি কোন ব্যতিক্রম ঘটে, তা হলে তার উক্ত স্বীকৃতি আপনা আপনি বাতিল বলে গণ্য হবে।
মানব জাতির ধর্মীয় অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই একদল মানুষ আল্লাহকে তাদের ‘রব’ হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে তারা প্রকৃতিবাদী হয়েছে। হূদ আলাইহিস সালাম-এর জাতির জনগণের মাঝে এ-জাতীয় চিন্তা-ভাবনা বিরাজমান ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। জীবন ও জগত সম্পর্কে তাদের ধারণার বহিঃপ্রকাশ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে তারা বলতো :
﴿إِنۡ هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا ٱلدُّنۡيَا نَمُوتُ وَنَحۡيَا وَمَا نَحۡنُ بِمَبۡعُوثِينَ ٣٧ ﴾ [المؤمنون: ٣٧]
‘‘আমাদের পার্থিব জীবনই একমাত্র জীবন, আমরা মরি ও বাঁচি এখানেই এবং আমরা পুনরুত্থিত হবো না।’’[10] বর্তমান সময়েও বিশ্বে এদের উত্তরসূরীদের অভাব নেই। কিন্তু জ্ঞানের এ অভিনব অগ্রগতির যুগে একদল চিন্তাশীল মানুষ যেমন আল্লাহকেই তাদের ‘রব’ বলে স্বীকার করে নিচ্ছে, তেমনি আরেকদল মানুষ আল্লাহকে অস্বীকার করে বলছে- আল্লাহ বলতে কিছুই নেই। এ জগত ও মানুষ এক মহা বিস্ফোরণের ফল। আল্লাহ বলতে কেউ এসব সৃষ্টি করে নি; বরং মানুষই আল্লাহকে সৃষ্টি করেছে।[11]
আবার যারা আল্লাহকে তাদের ‘রব’ বলে স্বীকার করেছে তারা তাঁর উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের অনেক ক্ষেত্রে একত্ববাদী হতে পারে নি; বরং তারা বুঝে হোক আর না বুঝে হোক আল্লাহর কোনো না কোনো সৃষ্টিকে তাঁর কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্যের সাথে শরীক করে নিয়েছে এবং আজও নিচ্ছে। যারা সাধারণ ধার্মিক তারা বিশেষ করে মানব জীবনের কল্যাণ ও অকল্যাণ সম্পর্কিত যে মৌলিক বিষয় রয়েছে, সে ক্ষেত্রে অতি মাত্রায় বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। তাঁর সৃষ্টির মধ্যকার অনেক ছোট-বড় সৃষ্টিকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে উপকারী ও প্রভাব বিস্তারকারী দেখে সেগুলোকে তাঁর এ মৌলিক বৈশিষ্ট্যের সাথে শরীক করে নিয়ে এগুলোকে উপকারী বা অপকারী মনে করে নিয়েছে। এরই ভিত্তিতে তারা চন্দ্র, সূর্য, তারকা, গাছ-পালা, আগুন, পানি, পাথর ও পশু ইত্যাদিকে তাদের উপাস্যে পরিণত করেছে। একইভাবে অতীতের বহু নবী-রাসূল ও সৎ মানুষগণকে মৃত্যুর পরেও অদৃশ্যভাবে সাধারণ মানুষের জীবনের নানা সমস্যাদি সমাধান করতে সক্ষম ভেবে তাঁদেরকেও তারা আল্লাহর সে বৈশিষ্ট্যের সাথে শরীক করে নিয়েছে। এমন কি এ চিন্তাধারা এখনও মুসলিম সমাজের অনেক জ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের মাঝে অত্যন্ত প্রকটভাবে বিরাজমান রয়েছে। এ কথাটি কে না জানে যে, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর উপাসনা করার উদ্দেশ্যে, তাঁর জগত পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁকে সহযোগিতা করার জন্যে নয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও অনেক মানুষকে আউলিয়াদের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করতে দেখা যায় যে, তাঁদের মধ্যে গাউছ, কুতুব, নকীব[12], আবদাল ও আবরার ইত্যাদি পদ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত এমন অনেক বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গ নাকি রয়েছেন, যাদেরকে মহান আল্লাহ এসব পদ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে তাঁদেরকে পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে থাকেন।[13]
এসব ধার্মিকদের মাঝে আবার আরেক ধরনের মানুষ রয়েছেন যারা জ্ঞানী, গুণী, পীর ও মুরব্বীগণের অনুসরণ ও তাকলীদ করার ক্ষেত্রে শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত এর বৈধ সীমারেখা অতিক্রম করে তাঁদের অন্ধ তাকলীদ করার মাধ্যমে তঁদেরকে প্রকারান্তরে নিজের রবের মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছেন।
যারা ধর্ম-কর্ম নিয়ে বেশী চিন্তা ভাবনা করেন না, তাদের অবস্থা হচ্ছে- একটি যন্ত্রকে সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে সে যন্ত্রের সাথে এর নির্মাণ কোম্পানীর দেয়া নির্দেশিকার উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তাকে তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকলেও তাদের নিজেদের জীবন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তাদের রবের দেয়া নির্দেশিকার প্রতি তারা আদৌ কোনো গুরুত্ব দেন না। বরং তাদেরকে সে নির্দেশিকা পরিহার করে নিজেদের জীবন পরিচালনার জন্য সংবিধান ও আইন রচনা করতে সদা তৎপর দেখা যায়। আল্লাহর দেয়া সে নির্দেশিকাকে তারা পার্থিব উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অন্তরায় বলে মনে করে এর অনুসরণ না করে পশ্চিমাদের অনুসরণ ও অনুকরণ করাকে পছন্দ করতে দেখা যায়। এভাবে তারা যে নিজেদেরকে এবং পশ্চিমাদেরকে নিজের রবের আসনে সমাসীন করে নিয়েছেন, সে ব্যপারে এবং এ কর্মের পরিণতি সম্পর্কে তাদের কোনই অনুভূতি নেই। এমন লোকদের ব্যাপারেই মহান আল্লাহ বলেন :
﴿ أَفَرَءَيۡتَ مَنِ ٱتَّخَذَ إِلَٰهَهُۥ هَوَىٰهُ﴾ [الجاثية: ٢٣]
‘‘তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছো যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে।’’[14]
[2] যদিও বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, এ ধরনের উপাধীধারী লোকদের অস্তিত্ব কোথাও নেই। [সম্পাদক]
[3]. আল-কুরআন, সূরা আশ-শু‘আরা :৭৫-৮৪।
[4]. আল-কুরআন, সূরা সেজদাহ : ৫।
[5]. আল-কুরআন, সূরা আল-আ‘রাফ : ৫৪।
[6]. আল-কুরআন, সূরা আল-ফাত্বির : ৩০।
[7]. আল কুরআন, সূরা আল-ফাত্বির : ১১।
[8]. আল-কুরআন, সূরা আল-ফাত্বির : ৩।
[9]. আল-কুরআন, সূরা আল-আ‘রাফ : ৫৯, ৬৪, ৭২, ৮৪।
[10]. আল-কুরআন, সূরা আল-মু‘মিনুন : ৩৭।
[11]. জয়ন্তানুজ বন্দোপধ্যায়, ধর্মের ভবিষ্যৎ; (কলিকাতা : এলাইড পাবলিশারস, ১ম সংস্করণ, তারিখ বিহীন), পৃ. ২৫।
[12] বাস্তবে এগুলো অস্তিত্বহীন। [সম্পাদক]
[13] ইনকিলাব পত্রিকার মালিক একসময়ের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মাওলানা ‘আব্দুল মান্নান এ-প্রসঙ্গে বলেন : ‘‘মানুষ স্বীয় কর্মের দ্বারা সামান্য একজন মানুষ থেকে কুতুবের দরজায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। যার হাতে আল্লাহপাক দুনিয়ার শাসন শৃঙ্খলা বিধানের ভার ন্যস্ত করেন। মনে রাখতে হবে, আল্লাহপাক দুনিয়ার শাসন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে মানুষের মধ্য থেকে কিছু লোককে নিযুক্ত করেন। তাদের সংখ্যা হলো ৩৫০, মতান্তরে চার হাজার। তারা লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে কিছু কাজ করেন।...এই সব লোকেরা একে অপরকে চেনেন না।...এদের প্রথম স্তরে রয়েছেন তিনশ’ ‘আবদাল’, এদের উপর আরো সাত জনকে বলা হয় ‘আবরার’। এদের উপর আরো চার জনকে বলা হয় ‘‘আওতাদ’। এদের উপরে আরো তিন জনকে বলা হয় ‘নকীব’। আর এদের সবার উপরে আছেন একজন যার উপাধি হলো ‘কুতুব’ বা ’গাউছ’। অর্থাৎ আল্লাহপাকের নির্দেশে তারাই সমস্ত পৃথিবী পরিচালনা করেন।’’ দৈনিক ইনকেলাব, ২৫ সেপ্টেম্বর , ১৯৯৭ খ্রি., পৃ.৬। [নাউযুবিল্লাহ, এসবই হিন্দুদের বিশ্বাসের অনুরূপ বিষয়, (সম্পাদক)]
[14].আল-কুরআন, সূরা জাছিয়াহ : ২৩।
‘উলূহিয়্যাত’ শব্দটি ‘ইলাহ’ শব্দমূল থেকে গৃহীত এবং এরই সম্বন্ধ জ্ঞাপক শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে- উপাস্য (مَعْبُوْدُ), যার আনুগত্য করা হয় (مَتْبُوْعُ) ও মান্যবর (مُطَاعُ)। উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- যিনি উলুহিয়্যাতের মালিক হবেন তিনি অবশ্যই তাঁর উপাসকদের রব হওয়ার বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ অধিকারী হওয়ার কারণে তাদের একচ্ছত্র উপাস্য, আনুগত্য লাভের অধিকারী ও মান্যবর হবেন। আমরা পূর্বেই আল্লাহর রুবূবিয়্যাত সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে এ বিষয়টি প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে, কারো মানুষের রব হওয়ার জন্য তাঁর যেসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া অত্যাবশ্যক, তা মহান আল্লাহর মাঝে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই মানুষের প্রতি তাদের রবের অবদানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাদের যাবতীয় উপাসনা ও আনুগত্য কেবল তাঁকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হবে। তারা বেঁচে থাকলে কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি বিধানের জন্য বেঁচে থাকবে, জীবন দিতে হলে কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনকে কেন্দ্র করেই দিতে হবে। প্রকাশ্য ও গোপন আল্লাহর যত রকমের উপাসনা রয়েছে তাতে সে কশ্মিনকালেও কাউকে শরীক করবে না, এ মর্মেরই একটি ইস্পাত কঠিন সংকল্প লালিত হবে প্রতিটি মুসলিমের মনের গভীরে।
এ সংকল্পের প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ قُلۡ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحۡيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٦٢ لَا شَرِيكَ لَهُۥۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرۡتُ وَأَنَا۠ أَوَّلُ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٦٣ ﴾ [الانعام: ١٦٢، ١٦٣]
‘‘আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার সালাত, কুরবানী, জীবন ও মৃত্যু সবই সমগ্র জাহানের প্রতিপালক আল্লাহের জন্যেই নিবেদিত, তাঁর কোন শরীক নেই। এ ঘোষণা দেয়ার জন্যেই আমি আদিষ্ট হয়েছি, আমিই হলাম সর্বপ্রথম মুসলিম।’’[1] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ সংকল্পের কথা শিক্ষা দেয়া হয়েছে তাঁর উম্মতকে তা শিক্ষা দেওয়ার জন্যেই। এ জন্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে শির্কী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আদেশ করতে যেয়ে বলেন:
«لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ شَيْئًا، وَإِنْ قُطِّعْتَ وَحُرِّقْتَ»
‘‘তুমি আল্লাহর সাথে শির্ক করবে না যদিও তোমাকে কেটে ফেলা হয় বা আগুনে পুড়ে হত্যা করা হয়।’’[2] আল্লাহর উপাসনায় কাউকে শরীক না করার জন্য এতই কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে কেবল এ-জন্যে যে, মানুষের যাবতীয় রকমের উপাসনা পাবার একক অধিকার রয়েছে কেবল আল্লাহ তা‘আলারই। কেননা, কারো উপাসনা পাবার জন্যে উপাস্যের যে-সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া আবশ্যক, সে সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলতে এ-বিশ্বজগতের অন্তরালে কেউ থাকলে আছেন কেবল তিনিই। সে জন্যেই তিনি তাঁর সে বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করে পৃথিবীর সকল মানুষকে কেবল তাঁরই উপাসনা করার দিকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন :
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ﴾ [البقرة: ٢١]
‘‘হে মানব সকল! তোমরা সে প্রতিপালকের উপাসনা কর যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, আশা করা যায় এতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারবে।’’[3]তিনি মানুষদেরকে সৃষ্টি করেছেন বলেই তিনি তাদের রবের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, আর এ মর্যাদা বলেই তিনি তাদের উপাস্যের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছেন। তাঁর একান্ত দয়া ও করুণার উপরেই যখন তাদের জীবন-জীবিকা, এ জগতে আগমন ও নির্গমন এবং তাদের ভাগ্যের যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণ সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল, তখন কারো অবদানের কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রকাশার্থে তারা যদি কারো উপাসনামূলক কোন কাজ করে, তা হলে তা করবে কেবল তাদের রবের জন্যেই। কেননা; তাদের প্রতি তাদের রবের যে অবদান রয়েছে, সে রকম অবদান ব্যতীত কেউ কারো উপাসনা পাওয়ার যোগ্য হতে পারে না। মানুষের জীবনের প্রতি নবী ও অলিগণের যে অবদান থাকে, তা উপর্যুক্ত রকমের নয় বলে তাঁরা কারো উপাসনা পেতে পারেন না। তাই তাঁদের সম্মানে আল্লাহর উপাসনার পদ্ধতিতে কোনো কাজ করা যাবে না। যুগে যুগে সাধারণ মানুষেরা এ বিষয়টি বুঝতে পারে নি বলেই নবী-রাসূল ও অলিদের কবরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উপাসনামূলক কর্মে লিপ্ত হয়েছিল এবং এখনও হচ্ছে।
>[2]. ইবনে মা-জাঃ, মুহাম্মদ ইবন ইয়াজীদ, আস-সুনান; কিতাবুল ফিতান, বাবুস সাবরি আলাল বালা-ই, সম্পাদনা : মুহাম্মদ ফুআদ ‘আব্দুল বাকী, (স্থান বিহীন : দ্বার এহইয়াউত তুরাছিল আরাবিয়্যা :, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ২/১৩৩৬।
[3]. আল-কুরআন, সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১।
কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে :
﴿ وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ﴾ [الاعراف: ١٨٠]
‘‘আল্লাহ তা‘আলার সুন্দর নামাবলী রয়েছে, সুতরাং তোমরা তাঁকে সে সব নামাবলীর মাধ্যমে আহ্বান কর।’’[1]
হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا»
‘‘আল্লাহ তা‘আলার নিরানববইটি নাম রয়েছে।’’[2] কুরআনুল কারীমের সূরা ‘আল-বাকারাহ’-এর ২৫৫ নং আয়াতে, সূরা ‘আল-হাশর’-এর শেষ তিন আয়াতে ও সূরা ‘আল-হাদীদ’-এর দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সে সব নামসমূহের কতিপয় নামের বর্ণনা দিয়েছেন। জামে‘ তিরমিজীতে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এ সব নাম সম্বলিত একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে, ‘‘যে ব্যক্তি এ সব নামসমূহ স্মরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’[3] আল্লাহ তা‘আলার এ সব নামের মধ্যকার কেবলমাত্র একটি নাম হচ্ছে তাঁর জাতি বা সত্তাগত নাম। সে নামটি হচেছ-‘আল্লাহ’। আর অবশিষ্ট নামসমূহ হচ্ছে তাঁর সিফাতী বা গুণগত নাম। গুণগত এ নামগুলো প্রকৃতপক্ষে তাঁর রুবূবিয়্যাতের সাথে সম্পর্কিত।
যেমন তাঁর সে সব নামের মধ্যে রয়েছে- তিনি চিরঞ্জীব ও সব কিছুর ধারক (حَيٌّ و قَيُّوْمٌ), তিনি সকলের সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা خَالِقٌ و رَازِقٌ, তিনি যাবতীয় রকমের কল্যাণ ও অকল্যাণকারী (نَافِعٌ و ضَارٌّ), তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্য সব কিছুর জ্ঞানী (عَالِمُ الْغَيْبِ وَ الشَّهَادَةِ) , তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা (سَمِيْعٌ و بَصِيْرٌ), তিনি সব কিছু পরিচালনাকারী (مُدَبِّرٌ) ইত্যাদি। মহান আল্লাহ এ সব গুণের অধিকারী হয়েছেন বলেই তিনি এ জগতের সব কিছুর রবের আসনে সমাসীন হয়েছেন। তাঁর এ সব নামের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, তাঁর সৃষ্টির মধ্যকার যে যত বড় গুণী আর উপকারীই হোক না কেন কেউই তাঁর এ সব নামে নামান্বিত ও গুণান্বিত হতে পারে না। সে জন্যে যেমন এ সব নামে কারো নাম রাখা যায় না, তেমনি কাউকে এ সব নামে ডাকাও যায় না, আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যমে কেউ এ সব গুণের বিন্দুমাত্র অধিকারীও হতে পারে না। তিনি চিরদিন থেকে এ সব গুণের অধিকারী। এ সব গুণের অধিকারী বলেই তিনি এ বিশ্বজগত পরিচালনা করছেন। এ সব গুণের ক্ষেত্রে তাঁর কোনো শরীক বা সমকক্ষ নেই।
>[2].বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুত তাওহীদ, বাব নং ১২, হাদীস নং- ৬৯৫৭; ৬/২৬৯১; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুয যিকর, বাব নং: ১, হাদীস নং- ২৬৭৭; ৪/২০৬২।
[3]. হাদীসটি নিম্নরূপ :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم: إِنَّ للهِ تَعَالَى تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً غَيْرَ وَاحِدٍ مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ هُوَ اللهُ الَّذِي لا إِلٰهَ إِلاَّ هُوَ الرَّحْمٰنُ الرَّحِيمُ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلاَمُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ الْغَفَّارُ الْقَهَّارُ الْوَهَّابُ الرَّزَّاقُ الْفَتَّاحُ الْعَلِيمُ الْقَابِضُ الْبَاسِطُ الْخَافِضُ الرَّافِعُ الْمُعِزُّ الْمُذِلُّ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ الْحَكَمُ الْعَدْلُ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ الْحَلِيمُ الْعَظِيمُ الْغَفُورُ الشَّكُورُ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ الْحَفِيظُ الْمُقِيتُ الْحَسِيبُ الْجَلِيلُ الْكَرِيمُ الرَّقِيبُ الْمُجِيبُ الْوَاسِعُ الْحَكِيمُ الْوَدُودُ الْمَجِيدُ الْبَاعِثُ الشَّهِيدُ الْحَقُّ الْوَكِيلُ الْقَوِيُّ الْمَتِينُ الْوَلِيُّ الْحَمِيدُ الْمُحْصِي الْمُبْدِئُ الْمُعِيدُ الْمُحْيِي الْمُمِيتُ الْحَيُّ الْقَيُّومُ الْوَاجِدُ الْمَاجِدُ الْوَاحِدُ الصَّمَدُ الْقَادِرُ الْمُقْتَدِرُ الْمُقَدِّمُ الْمُؤَخِّرُ الأَوَّلُ الآخِرُ الظَّاهِرُ الْبَاطِنُ الْوَالِيَ الْمُتَعَالِي الْبَرُّ التَّوَّابُ الْمُنْتَقِمُ الْعَفُوُّ الرَّءُوفُ مَالِكُ الْمُلْكِ ذُو الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ الْمُقْسِطُ الْجَامِعُ الْغَنِيُّ الْمُغْنِي الْمَانِعُ الضَّارُّ النَّافِعُ النُّورُ الْهَادِي الْبَدِيعُ الْبَاقِي الْوَارِثُ الرَّشِيدُ الصَّبُورُ قَالَ أَبُو عِيسَى هٰذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ
তিরমিযী, আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবন ছাওরা : আল-জামেউস সুনান; (বৈরুত : দ্বার এহইয়াউত তুরাছিল ‘আরাবী, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন, কিতাবুদ দা‘আওয়াত, বাব নং ৮৩, হাদীস নং ৩৫০৭; ৫/৫৩০। (তবে হাদীসটির সনদ দুর্বল। বস্তুত এ নামগুলো ইমাম তিরমিযীর কোনো এক উর্ধ্বতন বর্ণনাকারীর পক্ষ থেকে সংযোজিত। যদিও এর অধিকাংশই কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ থেকে নেওয়া। [সম্পাদক])
আল্লাহ তা‘আলার এ সব গুণগত নামের বাইরে তাঁর জাতসত্তা ও তাঁর কর্মের সাথে সম্পর্কিত কিছু গুণের বর্ণনা পবিত্র করআন ও সহীহ হাদীসে পাওয়া যায়। জাতসত্ত্বার সাথে সম্পর্কিত গুণাবলীর মধ্যে আল্লাহর হাত, পা, চক্ষু, কর্ণ ও আঙ্গুল থাকার কথা বর্ণিত হয়েছে।
যেমন হাত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :
﴿يَدُ ٱللَّهِ فَوۡقَ أَيۡدِيهِمۡ﴾ [الفتح: ١٠]
‘‘আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে।’’[1]
তাঁর চক্ষু ও কর্ণ সম্পর্কে বলেছেন :
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١]
‘‘কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’[2]
তাঁর পা সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : ‘‘জাহান্নাম যখন বার বার আল্লাহর নিকট জাহান্নামীদেরকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করার জন্য চাইতে থাকবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পা মুবারক জাহান্নামের উপর রাখবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে বলেন :
«لاَ تَزَالُ جَهَنَّمُ تَقُولُ: هَلْ مِنْ مَزِيدٍ، حَتَّى يَضَعَ رَبُّ العِزَّةِ فِيهَا قَدَمَهُ، فَتَقُولُ: قَطْ قَطْ وَعِزَّتِكَ، وَيُزْوَى بَعْضُهَا إِلَى بَعْضٍ»
‘‘মহান প্রতিপালক জাহান্নামের উপরে তাঁর পা মুবারক স্থাপন করবেন, তখন তা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে এবং এর এক অংশ অপর অংশের সাথে নিম্নমুখী হয়ে মিলে যাবে, আর কাত্ব, কাত্ব, কাত্ব করে শব্দ করতে থাকবে।’’[3]
আল্লাহর হাত সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে :
«إِنَّ قُلُوبَ بَنِي آدَمَ كُلَّهَا بَيْنَ إِصْبَعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ الرَّحْمَنِ، كَقَلْبٍ وَاحِدٍ، يُصَرِّفُهُ حَيْثُ يَشَاءُ»
‘‘নিশ্চয় সকল বনী আদমের অন্তরসমূহ একটি অন্তরের ন্যায় আল্লাহ তা‘আলার আঙ্গুল সমূহের দু’টি আঙ্গুলের মাঝে অবস্থিত, তিনি যেমন ইচ্ছা তা পরিচালনা করেন।’’[4]
আল্লাহ তা‘আলার কর্মগত গুণ যেমন ‘কথা বলা’, এ-সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে :
﴿وَكَلَّمَ ٱللَّهُ مُوسَىٰ تَكۡلِيمٗا ١٦٤ ﴾ [النساء: ١٦٤]
‘‘আল্লাহ স্পষ্টভাবে মূসার সাথে কথা বলেছেন।’’[5]
আল্লাহ তা‘আলার হাসা সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :
«يَضْحَكُ اللهُ إِلَى رَجُلَيْنِ، يَقْتُلُ أَحَدُهُمَا الْآخَرَ كِلَاهُمَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ»
‘‘আল্লাহ তা‘আলা দু’ব্যক্তির কর্ম দেখে হাসেন, এদের একজন অপরজনকে হত্যা করে, অবশেষে (হত্যাকারী ইসলাম গ্রহণ করার ফলে) তারা উভয়েই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’[6]
আল্লাহর আনন্দ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে :
«لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ أَحَدِكُمْ، مِنْ أَحَدِكُمْ بِضَالَّتِهِ، إِذَا وَجَدَهَا»
‘‘একজন উটের মালিক মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া তার উট ফেরত পেলে যেরূপ আনন্দিত হয়, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের কারও তাওবা করা দেখে সে ব্যক্তির চেয়েও অধিক আনন্দিত হন।’’[7]
এ ছাড়াও আল্লাহ তা‘আলার আরো কিছু সত্তাগত ও কর্মগত গুণের কথা কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যার বিশদ বর্ণনা ‘আক্বীদার কিতাবাদিতে রয়েছে। এ সব গুণাবলী সম্পর্কে সালাফে সালেহীনগণের ঐক্যবদ্ধ মত হচ্ছে : এ সব গুণাবলীর দ্বারা বাহ্যিক যে অর্থ বুঝা যায়, সেগুলোকে সে অর্থেই গ্রহণ করতে হবে। সাধারণভাবে এ গুলোর অর্থ আমাদের বোধগম্য হলেও এ সবের আকৃতি প্রকৃতির প্রকৃত অবস্থা আল্লাহই ভাল করে জানেন। তবে এ কথা সত্য যে, এ সব গুণাবলীর সাথে আল্লাহর কোনো সৃষ্ট জীবের গুণাবলীর আদৌ কোনো সামঞ্জস্য নেই।
কেননা, তিনি তাঁর পরিচয় প্রদান প্রসঙ্গে বলেছেন :
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١]
‘‘তাঁর অনুরূপ কোন বস্তু নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’[8]
অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ একদিকে যেমন তাঁর নিজের জন্যে শ্রবণ করা ও দেখার দু’টি গুণের কথা স্বীকার করেছেন, অপর দিকে তেমনি এতে কারো সাথে সাদৃশ্য থাকার কথাকেও অস্বীকার করেছেন। এতে দু’টি বিষয় প্রমাণিত হয় :
এক. তিনি যে মাধ্যম দিয়ে শ্রবণ করেন ও দেখেন, সেটির নাম কান ও চক্ষু। তবে তাঁর কান ও চক্ষুর প্রকৃতির সাথে তাঁর কোনো সৃষ্টির কান ও চক্ষুর প্রকৃতির কোনই সাদৃশ্য নেই।
দুই. শ্রবণ করা ও দেখার এ দু’টি মৌলিক গুণের ক্ষেত্রে কেউ তাঁর অনুরূপ হলেও উভয়ের শ্রবণ করা ও দেখার মধ্যে আদৌ কোনো সামঞ্জস্য নেই। কেননা, তিনি তাঁর সুমহান আরশে অবস্থান করেই সব কিছু শ্রবণ করেন ও দেখেন। কোন কিছুই তাঁর শ্রবণ করা ও দেখার সামনে আড় বা বাধা হতে পারে না। তাঁর কাছে অদৃশ্য বলতে কিছুই নেই। পক্ষান্তরে তাঁর সৃষ্টির শ্রবণ ও দেখার মাধ্যমকে কান ও চক্ষু বলে নামকরণ করা হলেও তা নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে শ্রবণ করতে ও দেখতে পারে না।সালাফগণ এ আয়াতের মর্মকে সামনে রেখেই কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত আল্লাহ তা‘আলার জাতসত্তার সাথে সম্পর্কিত যাবতীয় গুণাবলীকে এর বাহ্যিক ও সাধারণ অথেই গ্রহণ করেছেন।
‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ এর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : তাঁরা কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত সকল প্রকাশ্যসুস্পষ্ট (صريح) বিষয়াদির কোনো প্রকার তা’বীল ছাড়াই তা বাহ্যিক বা আক্ষরিক অর্থে স্বীকার করেন। জাহমিয়্যাঃ[9] সম্প্রদায়ই সর্বপ্রথম পথভ্রষ্ট ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান, সাবিঈন, মুশরিক ও দার্শনিকদের চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার সত্তাগত ও কর্মগত গুণাবলীসমূহকে অস্বীকার করেছে। হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে এ বাতিল চিন্তাধারা বিশর ইবন গিয়াছ আল-মির্রীছী-এর মাধ্যমে ইসলামী বিশ্বে ব্যাপক আকারে প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে মু‘তাজিলা সম্প্রদায়ও জাহমিয়্যাদের এ চিন্তাধারা অনুসরণ করে। যেমন- তারা আল্লাহর কান ও চক্ষু সম্পর্কে উপরে বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছে : ‘তিনি কর্ণ ছাড়া শুনেন ও চক্ষু ছাড়া দেখেন।’[10] তবে যুগে যুগে ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ এর ইমামগণ এ বাতিল চিন্তাধারার প্রতিবাদ করেছেন এবং আল্লাহ তা‘আলার সত্তাগত গুণাবলীসমূহের ব্যাপারে কী চিন্তা ও বিশ্বাস করতে হবে, তা সুস্পষ্ট ভাষায় জনগণের মাঝে প্রচার করেছেন।
>[2]. আল-কুরআন, সূরা আশ্শুরা : ১১।
[3].বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুততাফসীর, বাবনং-৩৩৩, হাদীস-নং ৬৭;৪/১৮৩৬; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জান্নাহ, বাব নং ১৩, হাদীস নং ২৮৪৬, ৪/২১৮৬; ইমাম আহমদ, মুসনাদ; (বৈরুত : দ্বারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ২/২৭৬।
[4].মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল ক্বাদর, বাব নং ১, হাদীস নং ২৬৫৪, ৪/২০৪৫, তিরমিযী; কিতাবুল ক্বাদর, বাব নং ৫, হাদীস নং ২১৪০, ৪/৪৪৮।
[5]. আল-কুরআন, সূরা আন-নিসা : ১৬৪।
[6]. বুখারী, প্রাগুক্ত, হাদীস নং ২৬৭৫; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জান্নাহ, বাব নং ৩৫, হাদীস নং ১৮৯০, ৩/১৫০৪।
[7]. তদেব ; কিতাবুত তাওবাঃ, বাব নং ১, হাদীস নং ২৭৪৬, ৪/২১০২।
[8]. আল-কুরআন, সূরা আশ্শুরা : ১১।
[9]. মহান আল্লাহর গুণাবলীসমূহকে পূরিপূর্ণভাবে অস্বীকার করার চিন্তাধারা ইসলামী যুগে সর্ব প্রথম জা‘দ ইবন দিরহাম নামের এক ব্যক্তির দ্বারা প্রকাশিত হয়। এই চিন্তাধারা জাহাম ইবন সাফওয়ান নামের এক ব্যক্তি তাত্থেকে গ্রহণ ও প্রকাশ করে। সে জন্যেই এ চিন্তাধারাকে জাহাম ইবন সাফওয়ান এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। আরো বলা হয়ে থাকে যে, জা‘দ ইবন দিরহাম এ চিন্তাধারাটি এব্বান ইবন সিম‘আন নামক এক ব্যক্তির নিকট থেকে গ্রহণ করেছিল এবং এববান তা লবীদ ইবন আ‘সাম নামের সেই ইহুদী থেকে গ্রহণ করেছিল যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জাদু করেছিল। দেখুন : ‘আব্দুল আযীয আল-মুহাম্মদ আস-সালমান, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪০-৪১।
[10]. মুহাম্মদ খলীল হাররাস, শরহুল আক্বীদাতিল ওয়াসিতিয়্যাহ; (মদীনা : মারকাযুদ দাওয়া :, সৌদি আরব, ৭ম সংস্করণ, তারিখ বিহীন), পৃ. ১০০।
এ সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) বলেন :
"وله يد ووجه و نفس ... فهو له صفات بلا كيف... وغضبه ورضاه صفتان من صفاته بلا كيف."
‘‘আল্লাহ তা‘আলার হাত, মুখ ও আত্মা ... গুণাবলী রয়েছে, তবে এর ধরণ নির্ধারণ করা যাবে না। আর তাঁর রাগ ও সন্তুষ্টির গুণদ্বয় রয়েছে, তবে এগুলোর ধরণ ও প্রকৃতির কোনো বর্ণনা দেয়া যাবে না।’’[1]
অপর এক বর্ণনায় তিনি বলেন :
‘‘আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে কারো কোনো কথা বলা ঠিক নয়। তবে আল্লাহ নিজেকে যে গুণে গুণান্বিত করেছেন তাঁকে সে গুণে গুণান্বিত করা উচিত। এক্ষেত্রে নিজের চিন্তা প্রসূত কোনো কথা বলা ঠিক নয়।’’[2]
আল্লামা ইমাম মালিক (রহ.)-কে
﴿ ٱلرَّحۡمَٰنُ عَلَى ٱلۡعَرۡشِ ٱسۡتَوَىٰ ٥ ﴾ [طه: ٥]
‘রহমান আরশের উপর ইসতেওয়া করেন’’ (উঠেন), এ আয়াতে বর্ণিত ‘ইসতেওয়া’ শব্দের অর্থ সম্পর্কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলে তিনি অপর কোনো প্রতিশব্দ দিয়ে এ শব্দের তা’বীল বা ব্যাখ্যা না করে বলেন :
"الاستواء معلوم والكيف مجهول، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة."
‘‘ইস্তেওয়ার অর্থ বোধগম্য, এর প্রকৃতি অজ্ঞাত, এর প্রতি ঈমান আনয়ন ওয়াজিব, এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা বেদ‘আত।’’[3]
ইমাম শাফিঈ (রহ.) কে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন : ‘‘আমি আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে উদ্দেশ্যে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, সে গুলোর উপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করি, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ঈমান এনেছি এবং তাঁর পক্ষ থেকে যে উদ্দেশ্যে আল্লাহর যে সব গুণাবলীর বর্ণনা এসেছে, আমি সেগুলোর উপরেও ঈমান রাখি।’’[4]
এ সম্পর্কে ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন: ‘‘আল্লাহর গুণাবলীসমূহের প্রতি আমি ঈমান আনয়ন করি, এগুলো সত্য বলে বিশ্বাস করি। তবে এগুলোর আকৃতি-প্রকৃতি জানি না, এর কোনো কিছুকে আমি প্রত্যাখ্যানও করি না।’’[5]
আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী সম্পর্কে এটাই হচ্ছে মূল ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ এর অনুসারীদের আক্বীদা বা বিশ্বাস। তবে আব্বাসী খেলাফত আমলে যখন মুসলিম মনীষীগণ গ্রীক দর্শন সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হন, তখন অনেকের কথামতে আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য থেকে রক্ষার জন্য তাঁরা আল্লাহর এ সব গুণাবলীর ব্যপারে তাঁদের পূর্বসূরীদের কথা থেকে সরে এসে এ সবের তা’বীল বা ব্যাখ্যায় লিপ্ত হন। এ মতের পুরোধা ইমাম আবুল হাসান আল-আশ‘আরী (মৃ.৩২৪হি.) প্রথমত আল্লাহর যাবতীয় গুণাবলীর মধ্য থেকে কেবল কান, চক্ষু, ইচ্ছা, সামর্থ্য, কথা, জ্ঞান ও জীবন এ সাতটি গুণকে স্বীকার করে অবশিষ্ট যাবতীয় গুণাবলী যেমন- ইসতেওয়া বা উপরে উঠা, অবতরণ, আগমন করা, হাসা, সন্তুষ্ট হওয়া, ভালোবাসা, অপছন্দ করা, রাগান্বিত ও আনন্দিত হওয়া, এ সব গুণাবলীর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ না করে এ-গুলোর তা’বীল বা ব্যাখ্যা করেন। তাঁরই পথ ধরে ইমাম গাযালী[6], ইমাম রাযী[7] এবং আরো অনেকে মুসলিম বিশ্বে তাঁর এ মতবাদ প্রচার করেন, যা আজও আমাদের দেশসহ অনেক মুসলিম দেশে প্রচলিত রয়েছে।
তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, যার নামে এই মতবাদ প্রচলিত রয়েছে সেই ইমাম আবুল হাসান আল-আশ‘আরী তিনি তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাঁর এ মত পরিবর্তন করেছিলেন এবং ‘আল-এবানাহ ‘আন উসূলিদ দিয়ানাঃ’ নামে একটি গ্রন্থ লিখে তাতে তিনি আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ব মত পরিহার করে সালাফগণের মতের পূর্ণ অনুসরণ করেছিলেন। আমাদের কাছে আশ্চর্য বোধ হয় যে, আমরা যেখানে পদে পদে মহামান্য ইমামগণকে অনুসরণ করে চলেছি, সেখানে কী করে এ ক্ষেত্রে আমরা তাদের বিপরীত চিন্তার অনুসারী হয়ে গেলাম। এর অর্থ কি এ নয় যে, আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে সাহাবাদের থেকে নিয়ে সমস্ত সালাফগণের আক্বীদা সঠিক ছিলনা!! نعوذ بالله রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নিজেই আল্লাহ তা‘আলার সত্তাগত গুণাবলীর ধরণ সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা করেন নি, তখন কারো পক্ষেই এ সবের তা’বীল করা সমীচীন ছিল না।
কেননা, এ সবের তা’বীল করা আর অস্বীকার করা মূলত একই কথা। মু‘তাযিলারা ভেবেছিল- আল্লাহর এ সব গুণাবলী থাকলে তাঁর প্রতিটি গুণকে একেকটি আল্লাহ বলে গণ্য করতে হবে, কিন্তু আল্লাহ এক, সুতরাং আল্লাহর তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাঁকে এ সব গুণাবলী থেকে মুক্ত বলে বিশ্বাস করতে হবে (এ ভ্রান্ত ধারণাই মু’তাযিলাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে)। বস্তুত যারা সিফাত বা আল্লাহর গুণাবলীর তা’বীল করেছেন তাঁদের উদ্দেশ্য আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য থেকে রক্ষা করা। কিন্তু এ সবের তা’বীল না করেও যে আল্লাহ তা‘আলাকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করা থেকে রক্ষা করা যায়, তা তাঁদের চিন্তায় আসে নি।
আল্লাহ তা‘আলার জাতসত্তার সাথে তাঁর কোনো সৃষ্টির সত্তার যখন কোনো সাদৃশ্য নেই, তখন তাঁর জাতের সাথে সংশ্লিষ্ট গুণাবলীর সাথেও তাঁর কোনো সৃষ্টির গুণাবলীর কোনো সাদৃশ্য থাকবে না- এটাই স্বাভাবিক কথা। নামের দিক থেকে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে বাহ্যিক কিছু মিল পাওয়া গেলেও এতে উভয়ের মাঝে আকৃতি ও প্রকৃতিগত মিল হয়ে যাওয়া জরুরী হয়ে যায় না।
কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَلَهُ ٱلۡمَثَلُ ٱلۡأَعۡلَىٰ﴾ [الروم: ٢٧]
‘‘আল্লাহর জন্যেই রয়েছে উৎকৃষ্ট উদাহরণ।’’[8]
তাঁর সত্তা ও গুণাবলীর উদাহরণ সকল কিছুর উর্ধ্বে। এ প্রসঙ্গে মিশরের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সইয়্যিদ সাবেক বলেন :
‘‘আল্লাহ তা‘আলার সাথে তাঁর কোনো কোনো গুণাবলীতে তাঁর সৃষ্টির তুলনা কেবল নামকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, প্রকৃতি বা মূলগতভাবে উভয়ের মাঝে কোনো প্রকার সাদৃশ্য নেই। কারো ব্যপারে যদি বলা হয় যে, তিনি একজন জ্ঞানী, তিনি জীবিত, তিনি আছেন, তিনি সামর্থ্যবান, তিনি বিজ্ঞ ও দয়ালু, তখন এর অর্থ এ দাঁড়াবে যে, তিনি বাহ্যিক দিক থেকে এ সব গুণে গুণান্বিত, তবে তার এ সব গুণাবলী আল্লাহর গুণাবলীর তুলনায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে অবস্থিত; আর আল্লাহর ব্যাপারে এ সব গুণের অর্থ হবে তিনি এ সব গুণের ক্ষেত্রে পূর্ণতার চরম শিখরে অবস্থিত।’’[9]
ড. বুরাইকান বলেন : ‘‘সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে কোনো কোনো গুণাবলীর ক্ষেত্রে এমন একটি সাধারণ অর্থের দিক থেকে মিল রয়েছে যা কারো জন্যে এককভাবে প্রযোজ্য নয়। এ মিল থাকার ফলে উভয়ের মাঝে সেই নিন্দিত তুলনা আবশ্যক হয়ে যায় না, যা শরী‘আতের দলীল ও সুস্থ বুদ্ধি অগ্রাহ্য করে; এ জন্যে যে, প্রতিটি অস্তিত্ববান দু’টি বস্তুর মাঝে অল্প পরিমাণে হলেও উভয়ের মাঝে কিছুটা মিল থাকে। এ মিল থাকাতে প্রত্যেকের যে আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাতে একে অপরের অনুরূপ হওয়া জরুরী হয়ে যায় না। কারণ, বিশেষত্বের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের গুণের যে অবস্থা থাকে, তা উভয়ের যৌথ গুণাবলীর অবস্থার চেয়ে ভিন্নতর হয়ে থাকে এবং প্রত্যেকের সে ভিন্ন গুণাবলীই তখন একের দ্বারা অপরকে বুঝানোর পথে অন্তরায়ের সৃষ্টি করে।’’[10]
আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী সম্পর্কে কোনো অযথা তর্কে লিপ্ত না হয়ে সহজ সরলভাবে যে বিশ্বাস পোষণ করা উচিত, সে সম্পর্কে অবগত হওয়াই আমাদের একান্ত প্রয়োজন। আর সে প্রয়োজনটুকু পূরণ করার জন্যেই আমি নিম্নে মসজিদে নববীর পেশ ইমাম শেখ ‘আব্দুর রহমান আল-হুযাইফী এর বক্তব্য পাঠক সমাজের সম্মুখে সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরলাম। তিনি বলেন :
‘‘আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী মূলত দু’ধরনের রয়েছে:
এক. এমন সব গুণাবলী যা আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে রয়েছে, যেগুলোকে প্রমাণিত বা হাঁ বাচকগুণাবলী (ثُبُوْتِيَّةْ) বলা হয়ে থাকে।
দুই. এমন সব গুণাবলী যা আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে নেই, যেগুলোকে অপ্রমাণিত বা নাবাচক (سَلْبِيَّةْ) বলা হয়ে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলার সত্তা ও কর্ম সংক্রান্ত যে সব গুণাবলীর বর্ণনা কুরআন ও সহীহ হাদীসে এসেছে, সেগুলোকে প্রমাণিত ধরনের গুণাবলী বলা হয়। এ জাতীয় গুণাবলীর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের জন্য এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ পূর্ণতা প্রমাণ করতে চেয়েছেন এবং এর বিপরীতে অবস্থিত যে সব অসম্পূর্ণতা রয়েছে, তাত্থেকে যে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র, তা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। আল্লাহর সত্তাগত গুণাবলী হলো সেগুলোই যদ্দ্বারা তিনি অনন্তকাল থেকে গুণান্বিত রয়েছেন এবং চিরকাল যে সব গুণে তিনি গুণান্বিত থাকবেন। সত্তাগত গুণাবলীর ন্যায় তিনি কর্মগত গুণেও অনন্তকাল থেকেই গুণান্বিত রয়েছেন। উভয় প্রকার গুণের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে- সত্তাগত গুণাবলীসমূহ তাঁর ইচ্ছার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। আর কর্মগত গুণাবলীসমূহ তাঁর ইচ্ছার সাথে সম্পর্কিত। তিনি ইচ্ছা করলে তা করেন, না হয় না করেন। কর্মগত গুণাবলীর মধ্যে এমনও কিছু গুণাবলী রয়েছে যা বিশেষ বচনের ক্ষেত্র ছাড়া আল্লাহর বেলায় তা সাধারণভাবে প্রযোজ্য হয় না। সেরূপ গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে- আল্লাহর চক্রান্তকারী ও বিদ্রূপকারী হওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়া।
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ وَمَكَرُواْ وَمَكَرَ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ ٥٤ ﴾ [ال عمران: ٥٤]
‘‘কাফিররা চক্রান্ত করলো, আল্লাহ তা‘আলাও (তাদের বিপরীতে) চক্রান্ত করলেন। আর তিনি উত্তম চক্রান্তকারী।’’[11]
অপর আয়াতে রয়েছে :
﴿ ٱللَّهُ يَسۡتَهۡزِئُ بِهِمۡ﴾ [البقرة: ١٥]
‘‘আল্লাহ তা‘আলা তাদের সাথে বিদ্রূপ করেন।’’[12]
উপর্যুক্ত দু’টি আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা নিজেকে সাধারণভাবে চক্রান্তকারী ও বিদ্রূপকারী হওয়ার দু’টি গুণে গুণান্বিত করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। তবে সাধারণ অর্থে তিনি এ দু’টি গুণে গুণান্বিত নন। কেননা; প্রকৃতপক্ষে তিনি এ দু’টি কর্ম দ্বারা কাফির ও ইসলামের শত্রুদের ইচ্ছা ও কর্মের বিরুদ্ধে তাঁর কী প্রতিক্রিয়া ও উপযুক্ত পদক্ষেপ গৃহীত হয়ে থাকে, তাই ব্যক্ত করেছেন। উদ্দেশ্য এটা বুঝানো যে, কাফিরদের চক্রান্ত ও বিদ্রূপের মুকাবেলায় আল্লাহ যে পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন, তা যেন তাদের কর্মেরই সমান হয়ে থাকে। এ-জাতীয় গুণ আল্লাহ তা‘আলার জন্যে পূর্ণতা প্রমাণকারী কেবল তখনই হয়ে থাকে যখন তা কাফিরদের কর্মের মুখোমুখি অবস্থানের কথা বর্ণনা প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়। অন্যথায় তা আল্লাহ তা‘আলার জন্যে পূর্ণতা প্রমাণকারী নয়।
যে সকল গুণাবলী অসম্পূর্ণতা (نقص) এর অর্থ বহন করে, সে-সব গুণে আল্লাহ তা‘আলা গুণান্বিত হতে পারেন না। যেমন- তন্দ্রা ও নিদ্রা, এ দু’টি অসম্পূর্ণতার অর্থ বহন করে বিধায়, আল্লাহ তাঁর নিজের পূর্ণতা প্রমাণ এবং নিজ থেকে অসম্পূর্ণতা দূরীকরণের জন্যে তিনি এ দু’টি গুণে গুণান্বিত না থাকার কথা জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন :
﴿ ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡحَيُّ ٱلۡقَيُّومُۚ لَا تَأۡخُذُهُۥ سِنَةٞ وَلَا نَوۡمٞۚ ﴾ [البقرة: ٢٥٥]
‘‘তিনি আল্লাহ, তিনি ব্যতীত অপর কোনো হক্ব উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সব কিছুকে তিনি ধারণ করে রয়েছেন, তন্দ্রা ও নিদ্রা কখনও তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।’’[13]
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের জন্যে ‘হাইউন’ ও ‘কাইউম’ নামের দু’টি গুণ প্রমাণ করেছেন কারণ; এর দ্বারা তাঁর পূর্ণতা প্রমাণিত হয়; পক্ষান্তরে ‘তন্দ্রা’ ও ‘নিদ্রা’ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না বলে এ দু’টি গুণে তিনি গুণান্বিত নয় বলে জানিয়েছেন কারণ; এ দু’টি অসম্পূর্ণতা এবং তা তাঁর পূর্ণতা প্রমাণকারী প্রথম দু’টি গুণের পথে অন্তরায় সৃষ্টিকারী।
উপর্যুক্ত এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা যে সব গুণাবলী তাঁর নিজের জন্য প্রমাণ করেছেন, এর দ্বারা তিনি তাঁর নিজের পূর্ণতা প্রমাণ ও অসম্পূর্ণতা দূর করতে চেয়েছেন। আর যে সব গুণে তিনি গুণান্বিত না থাকার কথা বলেছেন, এর দ্বারা তিনি তাঁর নিজ থেকে অসম্পূর্ণতা দূরীকরণ ও এর বিপরীতে যে পূর্ণতা রয়েছে, তা তাঁর নিজের জন্য প্রমাণ করতে চেয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলার নামাবলী ও গুণাবলীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- কারো সাথে কোনো প্রকার সাদৃশ্য ছাড়াই তিনি এ সব গুণে গুণান্বিত রয়েছেন। এগুলোর ক্ষেত্রে একত্ববাদী হওয়ার অর্থ হচ্ছে- এ কথা মনে প্রাণে স্বীকার করা যে, এ-গুলো দ্বারা মহান আল্লাহ এককভাবে গুণান্বিত। কোনো ভাবেই তাঁকে এ সব গুণাবলী থেকে মুক্ত করা যাবে না। এগুলোর অর্থের ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া যাবে না, এর কোনো তুলনা ও প্রকৃতিও বর্ণনা করা যাবে না।
এ সব ক্ষেত্রে একজন মুসলিমের করণীয় হচ্ছে- কুরআনে কারীম ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত আল্লাহ তা‘আলার এ সব সত্তাগত ও গুণগত গুণাবলী থাকার ব্যাপারে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা এবং এগুলোর আকৃতি-প্রকৃতি সম্পর্কে জানার জন্য কোনোরূপ চিন্তা-ভাবনা না করা, কেননা; আমরা শরী‘আত কর্তৃক এরূপ বিশ্বাস স্থাপনের জন্যেই আদিষ্ট হয়েছি। যারাই এ সব গুণাবলী নিয়ে অধিক চিন্তা-ভাবনা করেছেন, তারা হয় (معطلين) তথা মহান আল্লাহকে তাঁর গুণাবলী থেকে মুক্তকারীদের অন্তর্গত হয়েছেন, নতুবা (محرفين) তথা বিকৃতকারীদের অন্তর্গত হয়েছেন, তা না হয় (ممثلين) তথা সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যকারী অথবা (مكيفين) তথা এর ধরন-প্রকৃতি বর্ণনাকারীদের অন্তর্গত হয়েছেন। এতে করে তারা সালাফে সালেহীন তথা মূল ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর অনুসৃত পন্থা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী থাকার স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে এবং যে সব গুণের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো দলীল প্রমাণ নেই, আল্লাহ তা‘আলার ব্যপারে সে সব গুণ প্রমাণের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাতগণের অনুসৃত পন্থা হচ্ছে- আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য স্বীয় কিতাবে এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখে যে সব গুণাবলী প্রমাণ করেছেন, সে সব গুণাবলী কোনো প্রকার বিকৃতি, অস্বীকৃতি, ধরণ-প্রকৃতি ও সাদৃশ্য বর্ণনা ছাড়াই প্রমাণ করা। আর অস্বীকৃতির ক্ষেত্রে তাঁদের পন্থা হচ্ছে- আল্লাহ তা‘আলা নিজ কিতাবে বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার জন্য যে সব গুণাবলী না থাকার কথা বলেছেন, সেগুলো অস্বীকার করা। এ সব অস্বীকৃত গুণাবলীর বিপরীতে অবস্থিত গুণাবলীর মধ্যেই আল্লাহর পূর্ণতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা। আর যে সব গুণাবলীর প্রমাণে বা অপ্রমাণে কোনো দলীল প্রমাণাদি না থাকা সত্ত্বেও লোকেরা তা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে, যেমন- আল্লাহর শরীর থাকা বা না থাকা, তাঁর জন্য স্থান ও দিক নির্ধারণ করা ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলার জন্য এ সব শব্দ উচ্চারণের ক্ষেত্রে তাঁরা নীরবতা পালন করেন। কুরআন ও হাদীসে এ সবের কোনো বর্ণনা না থাকায় তাঁরা এগুলো স্বীকারও করেন না, আবার অস্বীকারও করেন না। আল্লাহর বেলায় কেউ এগুলো উচ্চারণ করলে তাঁরা সে ব্যক্তির নিকট এর অর্থ জিজ্ঞাসা করেন। জবাবে যদি আল্লাহ তা‘আলাকে পবিত্র রাখা জরুরী এমন কোনো বাতিলের উদ্দেশ্য করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, তা হলে তাঁরা তা অস্বীকার করেন। আর যদি এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে প্রযোজ্য হতে পারে এমন কোনো সত্যকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়, তা হলে তাঁরা তা স্বীকার করেন। আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে যত মত ও পথ রয়েছে, তন্মধ্যে উপর্যুক্ত এ মত ও পথই হচ্ছে অনুসরণের অত্যাবশ্যক পথ। এ মতই হচ্ছে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী ও সাদৃশ্য পোষণকারীদের মতের মাঝে অবস্থিত একটি মধ্যপন্থী মত।’’[14]
উপরে আল্লাহ তা‘আলার উলূহিয়্যাত, রুবূবিয়্যাত, তাঁর নামাবলী ও গুণাবলী সম্পর্কে যা আলোচিত হলো এর দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলার অনেক নাম ও গুণাবলী রয়েছে। এর সাথে তাঁর সৃষ্টির কারো কোনো নামের বা গুণের বাহ্যিকভাবে মিল থাকতে পারে, তবে এ মিল থাকাটা উভয়ের নামের ও গুণের অর্থ ও প্রকৃতির দিক থেকে কোনো অবস্থাতেই এক ও অভিন্ন বা সাদৃশ্যপূর্ণ নয়; বরং উভয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে, যা বর্ণনা করে বুঝাবার মত কোনো উপায় নেই। কারণ, সৃষ্টি আর স্রষ্টা কোনো দিন এক হতে পারে না এবং স্রষ্টার নামের ও গুণের যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তিনি তাঁর কোনো সৃষ্টিকে কোনো দিন সে বৈশিষ্ট্যের অধিকারীও করেন না, কোন সৃষ্টি নিজ প্রচেষ্টায়ও সে বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে না। আল্লাহর এ সব নাম ও গুণাবলীর যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সে বৈশিষ্ট্য গুণেই তিনি আমাদের ও সমগ্র জগতের একমাত্র রব বা প্রতিপালক।
আর তিনি এ জগতের সব কিছুর একক প্রতিপালক হওয়ার কারণেই এ জগতের সব কিছুর একক উপাস্যের স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, কারণ; কাউকে উপাস্য হতে হলে তাঁকে উপাসকের প্রতিপালকের মর্যাদায় আসীন হতে হয়। আল্লাহই যখন আমাদের একক প্রতিপালক, তাঁর হাতেই যখন আমাদের সৃষ্টি, জীবন, জীবিকা, ইহ ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণ নিহিত, তখন তিনি ব্যতীত অপর কেউ আমাদের উপাস্য হতে পারে না। অতএব, যারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যকার কোনো নবী-রাসূল, ফেরেশ্তা, কোনো অলী-দরবেশ, জিন-পরী, কোনো গাছ-পালা বা পাথর ইত্যাদিকে তাঁর নাম ও গুণাবলীর বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে- বুঝে বা না বুঝে তাদের বিশ্বাসে বা কথায় বা কর্মে- শরীক করে নেয়, তারা প্রকারান্তরে তাঁদেরকে ও সে সবকে তাদের প্রতিপালক ও উপাস্য বানিয়ে কোনো না কোনো শির্কে নিমজ্জিত হয়।
[2]. আল-আলূছী, মাহমূদ, রূহুল মা‘আনী; (বৈরুত : দারু এহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৮৫ খ্রি..), ১৫/১৫৬।
[3]. আল-হানাফী, ইবনু আবিল ইজ্জ, শরহুল ‘আক্বীদাতিত ত্বাহাবিয়্যাঃ ; (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৫ম সংস্করণ, তারিখ বিহীন), পৃ. ১২৮; আল-খাযিন, ‘আলা উদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মদ, তাফছীরুল খাযিন; (লাহোর : নু‘মানী কুতুবখানা , সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), ১/১০০।
[4]. ‘আব্দুল আযীয আল-মুহাম্মদ আস-সালমান, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৪।
[5]. তদেব।
[6]. ইমাম গাযালী, ‘আল-ইক্বতেসাদ ফী উসূলিল এ‘তেকাদ’ গ্রন্থের ৬৯ পৃষ্টা দ্রষ্টাব্য।
[7]. ইমাম রাযী ‘ইসতেওয়া’ শব্দের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ না করে ‘ইসতীলা’ শব্দ দ্বারা এর তা‘বীল করেছেন। দেখুন : আর-রাযী, তাফসীরুল কবীর, (স্থান বিহীন, ৩য় সংস্করণ , তাং বিহীন), ১১/৬।
[8]. আল-কুরআন, সূরা আন-নাহাল : ৬০।
[9]. আস-সাইয়্যিদ সাবেক, ‘আল-আক্বাইদুল ইসলামিয়্যাহ; (বৈরুত : দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, সংস্করণ বিহীন, ১৯৭৫ খ্রি..), পৃ. ৫৮।
[10]. ড. ইব্রাহীম আল-বুরাইকান, প্রাগুক্ত; পৃ. ৯৩।
[11]. আল-কুরঅন, সূরা আলে ইমরান : ৫৪।
[12]. আল-কুরআন, সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৫।
[13]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ : ২৫৫।
[14].এ কথাগুলো তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনায় আমাদেরকে আক্বীদা : বিষয়ে পাঠ দান উপলক্ষে ক্লাসে লিখিয়ে দিয়েছিলেন।
শর‘য়ী দৃষ্টিকোণ থেকে শির্ককারীর পরিণতি বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, শির্ক মূলত তিন প্রকার :
প্রথম প্রকার : শির্কে আকবার বা বড় শির্ক
শির্কে আকবার এর সংজ্ঞা :
বিশ্বাস জাতীয় বিষয়াদি ও উপাসনার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক বা সমান করাই মূলত শির্কে আকবার। কুরআনুল কারীমে উপাসনা কেন্দ্রিক শির্ক সম্পর্কে অধিক আলোচনা হওয়ার কারণে অনেকে শির্কে আকবারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এটাকে শুধু উপাসনার সাথেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। যেমন-
কেউ এর সংজ্ঞা প্রদান প্রসঙ্গে বলেন : ‘‘শির্কে আকবার হচ্ছে : আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, যেমন- অন্যকে আহ্বান করা, অন্যের নিকট কিছু কামনা করা, অন্যকে ভয় করা, অন্যকে আল্লাহর ন্যায় ভালোবাসা, অন্যের জন্য পশু উৎসর্গ বা মানত করা।’’
কেউ আরো সংক্ষেপ করে বলেছেন : ‘‘আল্লাহর সাথে গায়রুল্লাহকে আহ্বান করাই হচ্ছে শির্কে আকবার।’’
কেউ বলেন : ‘‘আল্লাহর উপাসনাসমূহের কোনো উপাসনা গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে করাকে শির্কে আকবার বলা হয়।’’[1] তবে যেহেতু শির্কে আকবার কেবলমাত্র উপাসনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে তা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের মধ্যেও হয়ে থাকে, সে জন্য আমার মতে এর সংজ্ঞা নিম্নরূপ হওয়া উচিত :
‘‘আল্লাহ তা‘আলার নামাবলী ও গুণাবলীর যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যে বৈশিষ্ট্যগুণে তিনি আমাদের একক রব ও উপাস্য, আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা কোনো অলি দরবেশ, জিন-পরী বা গ্রহ ও তারকা, গাছ-পালা ও পাথর ইত্যাদিকে সে সব বৈশিষ্ট্যের কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্যের সমান বা আংশিক অধিকারী বলে মনে করা এবং নবী, অলী, গাছ-পালা ও পাথর ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে মুখ, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও অন্তর দ্বারা উপাসনামূলক কোনো কর্ম করাকে শির্কে আকবার বলা হয়।’’
শির্কে আকবারকারীর পরিণতি :
পরিণতির দিক বিবেচনা করে এ শির্ককে বড় শির্ক বলা হয়। কেননা, তা শির্ককারীকে ইসলাম থেকে সম্পূর্ণভাবে বের করে দেয়। কারণ; তা একটা প্রকাশ্য কুফরী কাজ। যেমন- কুরআনুল কারীমে আল্লাহ বলেন :
﴿وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنۡ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَآ إِنَّمَا نَحۡنُ فِتۡنَةٞ فَلَا تَكۡفُرۡ﴾ [البقرة: ١٠٢]
‘‘তাঁরা (হারূত ও মারূত) কাউকে এ কথা বলেই জাদু শিক্ষা দিতেন যে, আমরা তোমাদের জন্য ফেতনা বিশেষ, সুতরাং তোমরা তা শিক্ষা করে কুফরী করো না।’’[2]
আমরা বাহ্যত দেখতে পাচ্ছি যে, এ আয়াতে জাদু শিক্ষা করাকে কুফরী কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে; এটা এ জন্যে যে, তা নিজ থেকে মানুষের অকল্যাণ করতে পারে এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে শিক্ষা করা শির্কের অন্তর্গত কাজ। অনুরূপভাবে হাদীসে কুদসীতে দেখতে পাওয়া যায় যে, তারকার প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয় বলে বিশ্বাস করা শির্কী বিশ্বাস হওয়া সত্ত্বেও এটিকে কুফরী বলে গণ্য করা হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
" أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِي مُؤْمِنٌ بِي وَكَافِرٌ، فَأَمَّا مَنْ قَالَ: مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللَّهِ وَرَحْمَتِهِ، فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِي وَكَافِرٌ بِالكَوْكَبِ، وَأَمَّا مَنْ قَالَ: بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا، فَذَلِكَ كَافِرٌ بِي وَمُؤْمِنٌ بِالكَوْكَبِ "
‘‘আমার বান্দাদের মধ্যে কতিপয় বান্দা আমার উপর বিশ্বাসী আর কতিপয় অবিশ্বাসী হয়েছে, যারা এ কথা বলেছে যে, আল্লাহ তা‘আলার করুণায় আমাদেরকে বৃষ্টি দান করা হয়েছে, তারা আমার উপর ঈমান এনেছে। আর যারা বললো : অমুক অমুক তারকার প্রভাবের ফলে আমাদেরকে বৃষ্টি দান করা হয়েছে, তারা আমাকে অস্বীকার করেছে এবং তারকার প্রভাবের প্রতি বিশ্বাসী হয়েছে।’’[3]
উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদীসের আলোকে জাদু শিক্ষা করা আর কোনো তারকার প্রভাবে বৃষ্টি হয় বলে বিশ্বাস করা যদি কুফরী কর্ম বলে স্বীকৃত হয়, তা হলে জ্ঞানগত, উপাসনাগত, পরিচালনাগত ও অভ্যাসগত অন্যান্য যত সব শির্ক রয়েছে, নিঃসন্দেহে তাও কুফরী কর্ম বলে গণ্য হবে। কেউ যদি এ সব বিষয়ে সতর্ক না হয়ে আল্লাহর কাছে তাওবা করা ছাড়াই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, তবে তার সমগ্র জীবনের যাবতীয় সৎকর্ম নিষ্ফল হয়ে যেয়ে জান্নাত তার জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যাবে এবং জাহান্নামই তার চিরস্থায়ী আবাস স্থলে পরিণত হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿إِنَّهُۥ مَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ ٱلۡجَنَّةَ وَمَأۡوَىٰهُ ٱلنَّارُۖ ﴾ [المائدة: ٧٢]
‘‘যে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং তার আবাসস্থল হবে জাহান্নাম।’’[4]
মানুষেরা যাতে এ ধরনের শির্ক করা থেকে সতর্ক হয়, সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর প্রতি এই বলে সতর্কবাণী দিয়েছেন :
﴿لَئِنۡ أَشۡرَكۡتَ لَيَحۡبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٥ ﴾ [الزمر: ٦٥]
‘‘তুমি যদি শির্ক কর, তবে তোমার যাবতীয় ‘আমল ভষ্ম করে দেয়া হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্গত হয়ে যাবে।’’[5]
শির্কের পরিণতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ ভাবে সতর্ক করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর উম্মতকে এ সম্পর্কে সতর্ক করা। তাদেরকে এ কথা জানিয়ে দেয়া যে, তারা যদি বুঝে বা না বুঝে কোনো শির্কী বিশ্বাস পোষণ করে বা কোন শির্কী কর্ম করে, তা হলে তাদের সালাত, সাওম, হজ্জ, যাকাতসহ জীবনের অন্যান্য যাবতীয় সৎকর্ম আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ মূল্যহীন হয়ে যাবে।
শির্ক করার ফলে যার অবস্থা এই হয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যক্তি যদি স্বীয় শির্ক থেকে স্বেচ্ছায় পরিপূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে ইসলামে নতুন করে প্রবেশ না করে, তা হলে আখেরাতে সে জাহান্নামী হবে। আল্লাহ তা‘আলা করুণার সাগর হয়ে থাকলেও কাফির-মুশরিকদের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোর। তাই তিনি তাদের সৎকর্মের বিষয়টি কোনো বিবেচনায় এনে তাদের প্রতি কোনো করুণার দৃষ্টিতে দেখবেন না। যারা স্বেচ্ছায় তা পরিত্যাগ না করে তিনি তাদেরকে আকস্মিকভাবে পাকড়াও করার জন্যে তাদের অপকর্ম আরো চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। যেমনটি সুযোগ করে দিয়ে পাকড়াও করেছিলেন আরবের কুরাইশ বংশের কাফির ও মুশরিকদের। কুরআনুল কারীমের বর্ণনানুযায়ী যদিও তারা আল্লাহ তা‘আলাকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীসহ সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, জীবন ও মৃত্যুদাতা এবং যাবতীয় বিষয়াদির পরিচালনাকারী বলে অকপটে স্বীকার করতো। যেমন- এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :
﴿ وَلَئِن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُۚ﴾ [الزمر: ٣٨]
‘‘তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেসা করো যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন, তখন তারা বলবে আল্লাহই তা সৃষ্টি করেছেন।’’[6] অপর স্থানে বলেছেন:
﴿قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ﴾ [يونس: ٣١]
‘‘তুমি তাদের জিজ্ঞেস কর, কে তোমাদেরকে জীবিকা দান করে আকাশ ও জমীন থেকে, কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা করেন? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ।’’[7]
আল্লাহ তা‘আলাকে সবকিছুর স্রষ্টা, জীবন ও জীবিকা দানকারী ও পরিচালনাকারী বিশ্বাস করার পাশাপাশি তারা নিজেদেরকে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর দ্বীনের যথার্থ অনুসারী বলেও দাবী করতো। সে দ্বীনের উপাসনাদির মধ্যকার কিছু উপাসনা যেমন- কা‘বা গৃহের হজ্জ করা, সাফা ও মারওয়াঃ পর্বতদ্বয়ের মাঝে সা‘য়ী করা, কুরবানী করা, মিনায় অবস্থান গ্রহণ করা ইত্যাদি উপাসনাও তারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই করতো। কিন্তু, তারা শির্ক করতো বলে তাদের এ সব সৎকর্ম তাদের কোন উপকারে আসে নি। বরং তাদের ব্যপারে আল্লাহ তা‘আলার এ-হুকুম জারী হয়েছিল যে, তারা কাফির ও মুশরিক, তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আগুন, যেখানে তারা সবাই প্রবেশ করবে অত্যন্ত নিগৃহীত হয়ে।
দ্বিতীয় প্রকার : শির্কে আসগার বা ছোট শির্ক
শির্কে আসগার এর সংজ্ঞা দান প্রসঙ্গে কোনো কোনো মনীষী বলেছেন : ‘‘শির্কে আকবার নয় এমন যে-সব কর্মকে শরী‘আতের ‘নস’ অর্থাৎ সুস্পষ্ট প্রমাণ দ্বারা শির্ক বলে নামকরণ করা হয়েছে, সেগুলোই হচ্ছে শির্কে আসগার। যেমন- কেউ যদি বলে : (ماشاء الله و شئت)‘আল্লাহ আর আপনি যা চান’, (و لو الله و أنت) আল্লাহ আর আপনি যদি উপস্থিত না থাকতেন তা হলে আমার মহা বিপদ হয়ে যেতো’। অনুরূপভাবে আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো নামে শপথ করা ইত্যাদি।’’[8]
ড. ইব্রাহীম বুরাইকান এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন : ‘‘আমলের ক্ষেত্রে গায়রুল্লাহকে আল্লাহ তা‘আলার সমান করে নেয়াকে শির্কে আসগর বলা হয়, যেমন- কোন কাজে বা কথায় লোক দেখানোর ভাব করা।’’[9]
ইমাম ইবন কাইয়্যিম আল জাওযিয়্যাঃ (৬৯১-৭৫১হিঃ) শির্কে আসগার এর উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেনঃ ‘‘উপাসনায় লোক দেখানো ভাব করা, মানুষের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করা, আমি আল্লাহ ও আপনার উপর ভরসা করেছি এমনটি বলা, আল্লাহ ও আপনি না হলে এমনটি হতো। এ সব উদাহরণ প্রদানের পর তিনি বলেনঃ শির্কে আসগার কখনও কর্তা ব্যক্তির মানসিক অবস্থা ও উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে শির্কে আকবারেও রূপান্তরিত হতে পারে।’’[10]
আমার মতে ‘শির্কে আসগার’এর সংজ্ঞা হলো : ‘‘এমন সব কথা বা কাজ বাহ্যিকভাবে গায়রুল্লাহকে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সমান করে নেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, যদিও এই সমান করাটি প্রকৃতপক্ষে কর্তাব্যক্তির উদ্দেশ্য নয়।’’ ‘শির্কে আসগার’ এর কতিপয় উদাহরণ উপরে বর্ণিত হয়েছে। নিম্নের উদাহরণগুলোও তা পরিচয়ের জন্য লক্ষ্যণীয় : যেমন- কোনো ব্যক্তির কথা : ‘আল্লাহ আর এই পোষা কুকুরটি না হলে আজ রাতে আমার বাড়ীতে চুরি হয়ে যেতো।’ ‘আল্লাহ এবং আপনি না হলে আজকে মহা অঘটন ঘটে যেতো।’ ‘আমি মাটি হাতে নিয়ে বা মায়ের নাম নিয়ে বা সন্তানের মাথায় হাত রেখে শপথ করে বলছি।’ ‘আমি আল্লাহর অনুগ্রহে এবং আপনাদের দু‘আয় ভাল আছি’ ইত্যাদি ধরনের কথা।
শর‘য়ী দৃষ্টিতে শির্কে আসগারকারীর পরিণতি :
এ শির্কটি পূর্বে বর্ণিত ‘শির্কে আকবার’ এর চেয়ে কম বিপজ্জনক। কেননা, এটি কর্তাব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বহিষ্কার করে না বা এতে যে শির্কে আকবার হয়ে থাকে, তাও বলা যায় না। এর প্রমাণ হলো- হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘একজন মুসলিম ব্যক্তি স্বপ্নে এক ইয়াহূদী ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করলে ইয়াহূদী লোকটি তাঁকে বললো : ‘তোমরা অত্যন্ত ভাল জাতি যদি না তোমরা শির্ক করতে। তোমরা বলে থাকো- আল্লাহ যা চান এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা চান’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ স্বপ্নের কথা বলা হলে তিনি বলেন : ‘‘আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের এ বিষয় সম্পর্কে সর্বাধিক অবহিত আছি, তোমরা সে ভাবে কথা না বলে এ ভাবে বলো :
«مَا شَاءَ اللَّهُ، ثُمَّ شَاءَ مُحَمَّدٌ»
‘‘আল্লাহ তা‘আলা যা চান অতঃপর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা চান’’।[11] এ হাদীসটি প্রমাণ করছে যে, ইসলামের প্রারম্ভিক আমলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীদের মাঝে ‘আল্লাহ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা চান’, এ-জাতীয় কথা-বার্তা বলার প্রচলন ছিল। পরবর্তীতে এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে এমন কথা বলা থেকে বারণ করেন এবং এ ধরনের কথার বদলে নিম্নোক্ত কথা বলতে শিক্ষা দেন :
«ما شاء الله وحده»
‘‘আল্লাহ তা‘আলা এককভাবে যা চান’’।[12]
অনুরূপভাবে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদীস দ্বারাও সাহাবীদের মাঝে এ জাতীয় কথা বলার প্রচলন থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন : ‘‘এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কোন বিষয়ে কথা বলা প্রসঙ্গে বললো :
«ما شاء الله وشئت»
‘আল্লাহ এবং আপনি যা চান’।
লোকটির এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন :
«أجعلتني والله عدلا بل ما شاء الله وحده»
‘‘তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে নিলে? বরং একমাত্র আল্লাহ যা চেয়েছেন।’’[13]
এখন কথা হলো: এ জাতীয় কথা-বার্তা যদি তার কথককে ইসলাম থেকে বের করে দেয়ার মত অপরাধ হতো, তা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ থেকেই অন্যান্য শির্কী কর্মকাণ্ড নিষেধ করার সাথে সাথে এ ধরনের কথা বলাও নিষেধ করে দিতেন। কিন্তু তা বিলম্বে নিষেধ করাতে প্রমাণিত হয় যে, এ জাতীয় কথা অপরাধের দিক থেকে ‘শির্কে আকবার’ এর মত বড় অপরাধ নয়। তবে তা যে সাধারণ অপরাধের মত একটি অপরাধ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।[14] তবে এত্থেকে বিরত থাকলে এর দ্বারা যে আল্লাহর তাওহীদের হেফাযত ও সংরক্ষণ হয়, তা বলা-ই বাহুল্য।[15] এ অপরাধ থেকে তাওবা করা ছাড়া কেউ মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে নিজ থেকে তা মাফ করে দিতে পারেন। অথবা এমন অপরাধী ব্যক্তি শাফা‘আতের সুবিধা পেয়ে হাশরের ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আত পেয়ে মুক্তি পেতে পারে। নতুবা অপরাধের মাত্রানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জাহান্নামে প্রবেশ করে পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা অন্য কোনো মু’মিন ও ফেরেশতাদের শাফা‘আত পেয়ে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে বেহেশতে প্রবেশের সুযোগ পাবে।
তৃতীয় প্রকার : শির্কে খফী বা গোপন শির্ক
গোপন শির্ক হচ্ছে সেই সব শির্ক, যার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা এবং সৃষ্টির মাঝে সমকক্ষতার গন্ধ পাওয়া যায়। তবে তা শির্কে আকবার না শির্কে আসগারের অন্তর্গত, তা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় না। এ জন্যে যে, ব্যক্তির মুখের কথা ও তার অন্তরে কী ইচ্ছা রয়েছে তা জানার কোনো উপায় নেই।[16] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের শির্কের প্রতি ইঙ্গিত করেই বলেছেন :
«إِنَّهُ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ»
‘‘এটা পিপীলিকার ধীর পদক্ষেপের চেয়েও গোপন।’’[17]
কর্তাব্যক্তির মনের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রকার শির্কের সাথে উপর্যুক্ত দু’টি শির্কের সম্পর্ক থাকার কারণে কোনো কোনো মনীষী এটাকে শির্কে আসগার এর মধ্যেই গণ্য করেছেন। এ চিন্তার আলোকেই শেখ ‘আব্দুল ‘আযীয আল-মুহাম্মদ আস-সালমান শির্ককে মোট তিন ভাগে বিভক্ত না করে দু’ভাগে বিভক্ত করে শির্কে খফীকে শির্কে আসগারের মধ্যেই গণ্য করেছেন।[18]আমার মতে শির্কের প্রকার বর্ণনা প্রসঙ্গে শেখ ‘আব্দুল ‘আযীয যে মত পোষণ করেছেন সেটাই সঠিক। কারণ, যারা শির্ককে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন তারা তৃতীয় প্রকার শির্ককে দ্বিতীয় প্রকার শির্ক থেকে ভিন্নভাবে পরিচয় করার জন্যে পৃথক কোনো উদাহরণ পেশ করেন নি। তাদের আলোচনা পড়লে মনে হয় যেন শির্কে খফী অতি গোপন থাকার কারণে তারা দ্বিতীয় প্রকারের মধ্য থেকেই তৃতীয় প্রকার শির্কের জন্ম দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এ বিভক্তির মাঝে তেমন কোনো লাভ নেই কারণ; শর‘য়ী হুকুমের দিক থেকে শির্কে আসগার ও শির্কে খফী যে একই পর্যায়ভুক্ত, এ বিষয়ে কারো দ্বি’মত নেই। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, এ দু’টি শির্ককে মূলত যে কোনো একটি নামে নামকরণ করাই যুক্তিযুক্ত ছিল। অথবা শির্কে আকবার নয় এমন যাবতীয় শির্ককে এ দু’টি নামে নামকরণ করা যেতো। শির্কে আসগার এ বিবেচনায় যে, তা শির্কে আকবর এর চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের, আর শির্কে খফী এ বিবেচনায় যে, এ শির্কটি বক্তার মনের গভীরে গোপন থাকায় তা শির্কে আকবার না আসগার এর অন্তর্গত- তা নিরূপণ করা খুবই কঠিন ব্যাপার।
>[2]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ: ১০২।
[3]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল আযান, বাব নং ৭২, হাদীস নং ৮১০, ১/২৯০; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল ঈমান, বাব নং৩২, ১/৮৩।
[4]. আল-কুরআন, সূরা আল-মায়িদাহ : ৭২।
[5]. আল-কুরআন, সূরা যুমার : ৬৫।
[6]. আল-কুরআন, সূরা আয-যুমার : ৩৮।
[7]. আল-কুরআন, সূরা ইউনুস : ৩২।
[8]. আস-শায়খ ‘আব্দুল আযীয আস-সালমান, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৭০।
[9]. ড. ইব্রাহীম আল-বুরাইকান, প্রাগুক্ত; পৃ.১২৬।
[10]. আশ-শায়খ সুলাইমান ইবন ‘আব্দিল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন আবদিল ওয়াহহাব, তাইসীরুল ‘আযীযিল হামীদ ফী শরহে কিতাবিত তাওহীদ; (বৈরুত : আল-মাকতবুল ইসলামী, ১ম সংস্করণ, ১৪০২হি.), পৃ.৪৫; আস-শায়খ আব্দুল ‘আযীয আস-সালমান, প্রাগুক্ত; পৃ.১৭০-১৭১।
[11].ইবনে মাজাহ, সুনান; কিতাবুল : কাফফারাত, বাব নং ১৩; ১/ ৬৮৫। মাজমাউয যাওয়াইদ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, বুখারীর শর্ত অনুযায়ী এ হাদীসের সনদ নির্ভরযোগ্য।
[12]. তদেব।
[13]. ইবনে কাছীর, তাফছীরুল ক্বুর‘আনিল ‘আযীম; (বৈরুত : দ্বারুল মা‘রিফাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৭ খ্রি.), ১/৬০।
[14]. ড. ইব্রাহীম বুরাইকান, প্রাগুক্ত; পৃ.১২৮।
[15]. ইবনে কাছীর, প্রাগুক্ত; ১/৬০।
[16]. ড. ইব্রাহীম বুরাইকান, প্রাগুক্ত; পৃ.১২৭। সংক্ষিপ্ত আকারে।
[17]. আহমদ ইবন হাম্বল, প্রাগুক্ত; ৪/৪০৩।
[18]. আশ-শায়খ ‘আব্দুল ‘আযীয আস-সালমান, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৭০, ১৭১।
শির্কে আকবার ও আসগারের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ :
১. অপরাধের দিক থেকে শির্কে আকবার সবচেয়ে বড় অপরাধের অন্তর্গত। আর শির্কে আসগার সাধারণ কবীরা গুনাহের অন্তর্গত।
২. শির্কে আকবার কর্তাব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বহিষ্কার করে দেয়। সে নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করে থাকলেও বা ধর্মীয় কাজ-কর্ম করলেও আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে সে মুসলিম থাকতে পারে না। কিন্তু শির্কে আসগার কর্তাব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বহিষ্কার করে না।
৩. একটি শির্কে আকবার মু’মিনের অতীতের যাবতীয় নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। শির্কে আসগার শুধু সংশ্লিষ্ট আমলকেই ধ্বংস করে। অন্য আমলকে নয়।
৪. শির্কে আকবার থেকে তওবা করতে না পারলে তা কর্তাব্যক্তিকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের অধিবাসী করে দেয়। সে ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমার অযোগ্য হয়ে যায়। আর শির্কে আসগার থেকে তাওবা না করলেও তা আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমাযোগ্য অপরাধ।
৫. শির্কে আকবার থেকে তাওবা না করলে এবং নতুন করে ইসলামে প্রবেশ না করলে ইসলামী আদালতের রায় অনুযায়ী কর্তাব্যক্তির জীবন ও সম্পদের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না। তবে শির্কে আসগারের কর্তাব্যক্তি ফাসিক মু’মিন হওয়ার কারণে ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে তার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা থাকবে।
শির্কে আকবার এর প্রকার বর্ণনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ [1]এটিকে মোট চার প্রকারে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে :
১. জ্ঞানগত শির্ক (الشرك في العلم)
২. পরিচালনাগত শির্ক (الشرك في التصرف)
৩. উপাসনাগত শির্ক (الشرك في العبادات)
৪. অভ্যাসগত শির্ক (الشرك في العادات) [2]
মুবারক ইবন মুহাম্মদ আল-মীলী এটাকে অন্য আরো চার প্রকারে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে :
১. শির্কুল এহতিয়ায (شرك الاحتياز), এর সংজ্ঞা প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন : আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো কোনো বস্তুর উপর স্বয়ংসম্পূর্ণ মালিকানা রয়েছে বলে বিশ্বাস করাকে শির্কুল এহতিয়ায বলা হয়।
২. শির্কুশ শিয়া‘ (شرك الشياع), এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, এ জগতের কোনো বস্তুতে আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো একচ্ছত্র মালিকানা না থাকলেও কোনো কোনো বস্তুতে আল্লাহর সাথে অন্যের যৌথ মালিকানা রয়েছে। যদিও উভয়ের মাঝে অবস্থান ও মর্যাদার দিক থেকে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
৩. শির্কুল এ‘য়ানত (شرك الإعانة), এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, এ জগতের কোন কিছুতে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো মালিকানা বা শরিকানা না থাকলেও এর কোনো কোনো বিষয়াদি পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্যকারী রয়েছে।
৪. শির্কুশ শাফা‘আত (شرك الشفاعة), এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তাঁর বান্দাদের মাঝে এমন কতিপয় বান্দাও রয়েছেন যারা তাঁদের মর্যাদার বদৌলতে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তাঁর পূর্ব অনুমতি ছাড়াই নিজস্ব শাফা‘আতের মাধ্যমে নিজ নিজ ভক্ত অনুরক্তদের আল্লাহর পাকড়াও থেকে নাজাত দিতে সক্ষম।[3]
তিনি তাঁর এ চার প্রকার শির্ক প্রমাণের জন্যে কুরআনুল কারীমের নিম্ন বর্ণিত আয়াতটি উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَمۡلِكُونَ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا لَهُمۡ فِيهِمَا مِن شِرۡكٖ وَمَا لَهُۥ مِنۡهُم مِّن ظَهِيرٖ ٢٢ وَلَا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ عِندَهُۥٓ إِلَّا لِمَنۡ أَذِنَ لَهُۥۚ﴾ [سبا: ٢٢، ٢٣]
‘‘আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত যাদেরকে তোমরা উপাস্য বলে ধারণা করেছ তারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অণু পরিমাণ ওজনের কিছুরও মালিক নয়, এতে তাদের কোন শরীকানাও নেই, তাদের মধ্য থেকে কেউ আল্লাহর সাহায্যকারীও নয়, যার জন্য তিনি শাফা‘আতের অনুমতি দেবেন কেবল সে ব্যতীত কারো শাফা‘আত কারো জন্যে উপকারে আসবে না।’’[4]
তিনি এ আয়াতটি উদ্ধৃত করে বলেন : এ আয়াত থেকে শির্কের কোন প্রকারই বাদ পড়ে যায় নি।[5] ‘আল-ঈমান ওয়া আ-ছা-রুহু ওয়া আশ শির্কু ওয়া মাজাহিরুহু’ কিতাবের লেখকও অনুরূপ দাবী করেছেন।[6] তবে উপর্যুক্ত আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, এ আয়াতে মূলত পরিচালনাগত শির্ক সম্পর্কেই আলোকপাত করা হয়েছে, যা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত শির্ক। এতে মহান আল্লাহ চার প্রকারের পরিচালনাগত ধারণার শির্কের প্রতিবাদ করেছেন। তিনি কাফিরদের বলে দিয়েছেন যে, যাদেরকে তোমরা তোমাদের ইহকালীন কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের মালিক বলে ধারণা করেছো, তারাতো আসলে তোমাদের কিছুই করার মালিক নয় কারণ; কোন বস্তুর মালিক তার মালিকানার অবস্থানুযায়ী সে বস্তুটি পরিচালনা বা তাতে হস্তেক্ষেপ করে থাকে। আর কোন বস্তুতে কারো মালিকানা সর্বোচ্চ চার ধরনের হতে পারে :
১. হয়তো কেউ এ জগতের কোন বস্তুর পরিপূর্ণ মালিক হবে, ফলে সে তার মালিকানাধীন বস্তুটি যেমন ইচ্ছা পরিচালনা করবে।
২. কোন কিছুতে কারো পরিপূর্ণ মালিকানা না থাকলে হয়তো এর কোন কিছুতে কারো শরীকানা থাকতে পারে এবং সে অনুযায়ী সে তা পরিচালনার ক্ষেত্রে শরীক হতে পারে।
৩. কোন কিছুতে কারো কোন মালিকানা বা শরীকানা কোনটাই না থাকলে হয়তো কোন কিছু পরিচালনার ক্ষেত্রে কেউ কারো সাহায্যকারী হতে পারে।
৪. তাও যদি না হয়, তবে হয়তো বা কেউ নিজের মর্যাদার বদৌলতে কারো কোন কিছু পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বঘোষিত উপদেষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে এবং তার সুপারিশ ও উপদেশ অনুযায়ী কিছু পরিচালিতও হতে পারে।
উপর্যুক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ কাফিরদের বলে দিলেন : তোমরা যাদেরকে তোমাদের ভাগ্যের কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক বলে ধারণা করে বসেছো, তারাতো উক্ত এ চার ধরনের মালিকানার কোনোটিরই মালিক নয়; সুতরাং তারা কিভাবে তোমাদের কল্যাণার্জন বা অকল্যাণ দূরীকরণে কাজ করবে? এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, উপর্যুক্ত আয়াতে কেবল পরিচালনাগত শির্কের যাবতীয় দিক নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। জ্ঞানগত, উপাসনাগত ও অভ্যাসগত শির্ক সম্পর্কে এ আয়াতে কোন আলোকপাত করা হয় নি। কাজেই মুহাম্মদ ইবন মুবারক আল-মীলী উপরে যে দাবী করেছেন, তা যথার্থ বলে মনে হয় না।
আবুল বাকা আল-হানাফী আবার শির্ককে অন্য আরো ছয় ভাগে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো নিম্নরূপ :
১. শির্কুল ইস্তেকলাল (شرك الاستقلال) : এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি বলেন : আল্লাহর পাশাপাশি আরো দু’জন স্বয়ংসম্পূর্ণ শরীক থাকার ধারণা পোষণ করাকে ‘শির্কুল ইস্তেকলাল’ বলা হয়। যেমন- অগ্নিপূজকদের শির্ক; তারা যাবতীয় কল্যাণের বিষয়াদিকে ‘ইয়াজদান’ নামক দেবতার কাজ বলে মনে করতো, আর যাবতীয় অকল্যাণমূলক কাজকে ‘আহরমন’ নামক দেবতার কর্ম বলে মনে করতো।
২. শির্কুত তাবয়ীদ (شرك التبعيض) : একাধিক উপাস্য থেকে এক উপাস্য গঠন করাকে ‘শির্কুত তাবয়ীদ’ বলা হয়। যেমন- খ্রিষ্টানদের শির্ক। তারা বলে : আল্লাহর তিনটি অংশ রয়েছে, যথা : পিতা, পুত্র ও রুহুল কুদুস অথবা মরয়ম, ঈসা ও রুহুল কুদুস। এই তিনে মিলে হলেন এক আল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহ তিন ইলাহের তৃতীয় জন।
৩. শির্কুত তাকলীদ (شرك التقليد) : অন্যের অনুসরণে গায়রুল্লাহের উপাসনা করাকে ‘শির্কুত্ তাকলীদ’ বলা হয়। যেমন- আরব জনগণের শির্ক, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের অনুসরণে মূর্তি পূজা করতো।
৪. শির্কুত্ তাকরীব (شرك التقريب) : আল্লাহ তা‘আলার নিকটবর্তী করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে গায়রুল্লাহের উপাসনা করাকে ‘শির্কুত্ তাকরীব বলা হয়। যেমন- আরবের মুশরিকরা বলতো :
﴿مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ﴾ [الزمر: ٣]
‘‘আমরা দেবতাদের উপাসনা কেবল এ-জন্যেই করছি যে, তারা আমাদেরকে সুপারিশ করে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।’’[7]
৫. শির্কুল আসবাব (شرك الأسباب) : কোনো বিষয় আল্লাহর কারণে হয়েছে এমনটি না বলে অপর কোনো বস্তুর প্রভাবে তা হয়েছে বলে বিশ্বাস করা বা বলাকে শির্কুল আসবাব বলা হয়। যেমন- প্রকৃতিবাদীদের শির্ক, যারা এ-জগত সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য আল্লাহর পরিকল্পনাকে স্বীকার না করে প্রকৃতিকেই এর পরিচালক বলে মনে করে।
৬. শির্কুল আগরাদ (شرك الأغراض) : গায়রুল্লাহের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোন কাজ করাকে ‘শির্কুল আগরাদ’ বলা হয়।[8]
ড. ইব্রাহীম বুরাইকান শির্কে আকবারকে অপর আরো ছয় প্রকারে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে :
(১) আহ্বানগত শির্ক (২) উদ্দেশ্যগত শির্ক (৩) আনুগত্যগত শির্ক (৪) ভালোবাসাগত শির্ক (৫) ভয়ভীতিগত শির্ক (৬) ভরসাগত শির্ক।[9]
বিভিন্ন মণীষীগণ শির্কে আকবার এর প্রকার সম্পর্কে যা বলেছেন সেগুলো নিয়ে একটু ভাবলে দেখা যায় যে, আবুল বাক্বা কর্তৃক বর্ণিত প্রকারসমূহের মধ্যকার প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম প্রকার মূলত পরিচালনাগত শির্কের অন্তর্গত। পঞ্চম প্রকারটি পরিচালনাগত শির্কের অন্তর্গত হওয়ার বিষয়টি নিতান্তই পরিষ্কার। প্রথমটি পরিচালনাগত শির্কের অন্তর্ভুক্ত এভাবে যে, অগ্নিপূজকরা ভাল ও মন্দ সৃষ্টির কর্ম পরিচালনার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ দুই ইলাহে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। আর দ্বিতীয়টি এর অন্তর্ভুক্ত এভাবে যে, খ্রিষ্টানরা আল্লাহকে তিন ইলাহের একজন বলে বিশ্বাস করে এবং এক ইলাহ গঠনের ক্ষেত্রে এ তিন ইলাহের কার্যকর প্রভাব রয়েছে বলে মনে করে। অবশিষ্ট তৃতীয় ও চতুর্থ প্রকার উপাসনাগত শির্কের অন্তর্গত এবং ষষ্ঠ প্রকারটি শির্কে আসগার এর অন্তর্ভুক্ত।
ড. বুরাইকান কর্তৃক বর্ণিত প্রকারগুলোর প্র্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, একমাত্র দ্বিতীয় প্রকারটি ব্যতীত অবশিষ্ট সকল প্রকারই উপাসনাগত শির্কের অন্তর্গত। আর দ্বিতীয় প্রকারের একক কোনো অস্তিত্ব নেই কারণ; উদ্দেশ্যতো সর্বদাই কোনো কর্ম ও উপাসনার সংগী হয়ে থাকে। মানুষ যে উদ্দেশ্যে যে কর্ম করে তার কর্ম সে উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে।
আল্লামা ইসমাঈল শহীদ কর্তৃক বর্ণিত প্রকারগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এ প্রকারগুলো কুরআন ও হাদীস দ্বারা সমর্থিত, কেননা; কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ হওয়ার যুগে আরব সমাজে যে সব শির্কের প্রচলন ছিল, তা এ-চার প্রকার শির্কের অন্তর্গত ছিল। সে জন্যেই কুরআন ও হাদীসে এ চার প্রকার শির্কেরই সমালোচনা করা হয়েছে। যেহেতু আল্লামা ইসমাঈল শহীদ কর্তৃক বর্ণিত প্রকারগুলো কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা দ্বারা সমর্থিত, সেহেতু আমার দৃষ্টিতে শির্কে আকবারকে এ চার প্রকারে বিভক্ত করাই অধিক যুক্তিযুক্ত। আর সে জন্যেই ইনশা আল্লাহ নিম্নে আমরা শির্কে আকবারকে উক্ত চার প্রকারেই বিভক্ত করবো।
">[2].শাহ ইসমাঈল শহীদ, তাক্ববিয়াতুল ঈমান; (দেওবন্দ : মাকতাবা থানভী, সংস্করণ বিহীন, ১৯৮৪ খ্রি.), পৃ. ২৯-৫৬।
[3]. মুবারক ইবন মুহাম্মদ আল-মীলী, আশশির্কু ওয়া মাজাহিরুহু; (মদীনা : আল-জামি‘আতুল ইসলামিয়্যাঃ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৭হি.), পৃ. ৬৫, ৬৬।
[4]. আল-কুরআন, সূরা আস-সাবা : ২২।
[5]. তদেব।
[6]. জাকারিয়া আলী ইউসুফ, প্রাগুক্ত; পৃ. ৮০।
[7]. আল-কুরআন, সূরা আয-যুমার : ৩।
[8]. মুবারক ইবন মুহাম্মদ আল-মীলী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৬৬। তিনি এ প্রকারগুলো আবুল বাকা এর كليات নামক গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করেছেন। অনুরূপভাবে দেখুন : আহমদ রূমী, মাজালিসুল আবরার; (করাচী : দ্বারুল এশা‘আত, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ১৫০।
[9]. ড. ইব্রাহীম বুরাইকান, প্রাগুক্ত; পৃ. ১২৮-১৩৮।