ড. ইব্রাহীম আল-বুরাইকান শির্ক-এর পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন :
‘শির্ক’-এর দু’টি অর্থ রয়েছে :
এক. সাধারণ অর্থ, আর তা হচ্ছে- গায়রুল্লাহকে আল্লাহর বৈশিষ্ট্যের সমকক্ষ করা। সমকক্ষ বলতে এখানে মুক্ত শরীকানা বুঝানো হয়ে থাকে, শরীকানায় আল্লাহর অংশ গায়রুল্লাহের অংশের সমান হতে পারে অথবা আল্লাহর অংশ গায়রুল্লাহের অংশের চেয়ে অধিকও হতে পারে। তিনি আরো বলেন :
শির্কের উপর্যুক্ত সাধারণ অর্থের ভিত্তিতে শির্ক তিন প্রকার :
এক. আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শির্ক। এর সংজ্ঞা হচ্ছে- আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে সমকক্ষ করা অথবা কোনো বৈশিষ্ট্যকে তিনি ব্যতীত অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা। যেমন সৃষ্টি, জীবিকা, জীবন ও মৃত্যু ইত্যাদির সম্পর্ক অন্যের সাথে করা।
দুই. আল্লাহর উলূহিয়্যাতে শির্ক। এর সংজ্ঞা হচ্ছে- আল্লাহর উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে কাউকে সমকক্ষ করা। যেমন : সালাত, সাওম, পশু উৎসর্গকরণ ও মানত ইত্যাদি অন্য কারো উদ্দেশ্যে করা।
তৃতীয়. আল্লাহ তা‘আলার নামাবলী ও গুণাবলীতে শির্ক। এর সংজ্ঞা হচ্ছে- আল্লাহর নামাবলী ও গুণাবলীতে কোনো সৃষ্টিকে তাঁর সমকক্ষ করা।
শির্কের দ্বিতীয় অর্থ :
“আল্লাহর পাশাপাশি গায়রুল্লাহকে উপাস্য ও মান্যবর হিসেবে গ্রহণ করা। কুরআন, সুন্নাহ ও অগ্রবর্তী মনীষীগণের কথায় শির্ক শব্দটি যখন সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন এর দ্বারা শির্কের দ্বিতীয় অর্থই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।’’[1]
আক্বীদার বিভিন্ন কিতাবাদিতে শির্ক-এর যে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, তা অনেকটা ড. ইব্রাহীম বুরাইকান কর্তৃক বর্ণিত উপর্যুক্ত সংজ্ঞারই অনুরূপ। উপর্যুক্ত এ সংজ্ঞার দ্বারা যদিও শির্ক’র পারিভাষিক অর্থ অনুধাবন করা যাচ্ছে, তবে আমরা যদি আরো পরিষ্কারভাবে এর সংজ্ঞা জানতে চাই, তা হলে শির্ককে তাওহীদ-এর সংজ্ঞার বিপরীতে দাঁড় করালে তা জানা যেতে পারে। কেননা, শির্ক শব্দটি তাওহীদ শব্দের অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। আর প্রবাদে রয়েছে ‘প্রত্যেক বস্তুকে তার বিপরীতধর্মী বস্তু দিয়ে পরিচয় করা যায়।’ তাই নিম্নে প্রথমে তাওহীদ-এর পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রদান করা হলো এবং পরবর্তীতে এর সংজ্ঞা থেকেই শির্ক-এর সংজ্ঞা নিরূপণ করা হলো।
তাওহীদ শব্দের পারিভাষিক অর্থ :
‘তাওহীদ’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লামা জুরজানী বলেন: ‘‘তাওহীদ হলো: অন্তরে যা কিছুর কল্পনা বা ধারণা হয়, সে সব থেকে আল্লাহ তা‘আলার জাতসত্তাকে মুক্ত করা। তাওহীদ তিনটি বিষয়ের সমষ্টি : মহান আল্লাহকে রব হিসেবে জানা, তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান করা এবং তাত্থেকে সকল শরীকদের অস্বীকার করা।’’[2]
আল্লামা জাযাইরী বলেন : তাওহীদ হলো : ‘‘মহান আল্লাহ তা‘আলার যাত, তাঁর গুণাবলী ও কর্মসমূহে কারো সমকক্ষ থাকা বা সে সকল ক্ষেত্রে তাঁর কোন সাদৃশ্য হওয়া এবং তাঁর রুবুবিয়্যাত ও উপাসনায় কারো অংশীদারিত্ব থাকা অস্বীকার করাকে তাওহীদ বলা হয়।’’[3]
তাওহীদের উপর্যুক্ত দু’টি সংজ্ঞাই অনেকটা সংক্ষিপ্ত হওয়াতে নিম্নে এর অপর একটি বিস্তারিত সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :
শেখ আব্দুল আযীয বলেন : ‘‘শর‘য়ী পরিভাষায় তাওহীদ হলো : বান্দা এ-কথা স্বীকার করবে যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা হলেন সেই রব যিনি সকল সৃষ্টির জীবিকা প্রদান ও তাদের পরিচালনার কাজ এককভাবেই করে থাকেন, তিনি সকল সৃষ্টির উপাস্য, যাবতীয় উপাসনা ও আনুগত্য এককভাবে তাঁর জন্যেই নিবেদিত। আরো মনে করা যে, তিনি এককভাবে বড়ত্ব, মহত্ব ও সৌন্দর্যের যাবতীয় গুণাবলীর সার্বিক পূর্ণতায় অধিষ্ঠিত।’’[4]
‘শির্ক’ যখন ‘তাওহীদ’ এর বিপরীত তখন শেখ ‘আব্দুল ‘আযীয কর্তৃক উপরে তাওহীদের যে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, সে হিসেবে এর বিপরীতে ‘শির্ক’ এর পারিভাষিক সংজ্ঞা নিম্নরূপ দাঁড়ায় :
‘‘মহান আল্লাহকে সকল সৃষ্টির জীবন-জীবিকা দানকারী, তাদের ভাগ্যের ভাল-মন্দ ও সমগ্র জগত পবিচালনাকারী একক রব হিসেবে মনে না করা। বরং এক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টির ছোট বা বড় কোনো বস্তু যেমন গ্রহ, নক্ষত্র, বা অলি ও দরবেশ নামের কোনো নেক মানুষকে এর কোনো কিছুর পূর্ণ বা আংশিক মালিক কিংবা শরীক, অথবা তা পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্যকারী বলে মনে করা। আল্লাহর সমীপে তাঁর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত কারো জন্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা অপর কোনো অলির শাফা‘আত উপকারী হয়ে থাকে বলে বিশ্বাস করা। উপর্যুক্ত রকমের ধারণার বশবর্তী হয়ে আল্লাহর একক উপাসনা ও আনুগত্য করার পরিবর্তে তাঁদের ওসীলা ও সুপারিশে উত্তম জীবন, জীবিকা ও সৌভাগ্য লাভ করার জন্য তাঁদের উপাসনা ও আনুগত্য করা। আল্লাহর জ্ঞান, তাঁর বড়ত্ব, মহত্ব ও সৌন্দর্যের যাবতীয় গুণাবলীর ক্ষেত্রে সৃষ্টি জগতের কাউকে তাঁর সমকক্ষ করা।’’
অন্য কথায় ‘‘এমন সব বিশ্বাস, কাজ, কথা ও অভ্যাসকে শির্ক বলা হয় যার দ্বারা বাহ্যত মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত ও গুণাবলীতে অপর কারো অংশীদারিত্ব বা সমকক্ষতা প্রতীয়মান হয়।’’
অপর কথায় বলা যায় : ‘‘গায়রুল্লাহকে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত ও গুণাবলীর বৈশিষ্ট্যে গায়রুল্লাহকে সমকক্ষ করাকে শির্ক বলা হয়।’’ শির্কের এ সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দু’টি কুরআনুল কারীম থেকে প্রমাণ করা যায়।
মহান আল্লাহ বলেন :
﴿ قَالُواْ وَهُمۡ فِيهَا يَخۡتَصِمُونَ ٩٦ تَٱللَّهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ٩٧ إِذۡ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٨ ﴾ [الشعراء: ٩٦، ٩٨]
‘‘তারা (মুশরিকরা তাদের উপাস্য দেব-দেবীদের সাথে) জাহান্নামে কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়ে বলবে: আল্লাহর কসম! আমরা তথায় (পৃথিবীতে) প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্ব-পালনকর্তার সমতুল্য গণ্য করতাম।’’[5]
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুশরিকরা তাদের পাথর ও কাঠ ইত্যাদির মূর্তিসমূহকে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে সমকক্ষ বানিয়ে নেয়ার কারণেই বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে মুশরিক হয়েছিল।শির্ক যখন আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত ও গুণাবলীর বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত, তখন সর্বাগ্রে আমাদেরকে এ তিনটি বিষয়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে হবে কেননা; এতে আমাদের নিকট শির্কের সম্ভাব্য ক্ষেত্রসমূহ পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
[2]. আল-জুরজানী, শরীফ আলী ইবন মুহাম্মদ, কিতাবুত তা‘রীফাত; (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ.৬৭।
[3].আল-জাযাইরী, আবু বকর জাবির, ‘আক্বীদাতুল মু‘মিন; (জেদ্দা : দারুস সুরুক, ৫ম সংস্করণ, ১৯৮৭ খ্রি.), পৃ.৮৭।
[4].আব্দুল আযীয আল-মুহাম্মদ আল-সলমান, আল-আসইলাতু ওয়াল আজইবাতিল উসূলিয়্যাতি আলাল ‘আক্বীদাতিল ওয়াসিতিয়্যাতি লি ইবনে তাইমিয়্যাহ; (প্রকাশ বিহীন, ২১ম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ৩২।
[5]. আল-কুরআন, সূরা শু‘আরা : ৯৬-৯৮।