আল্লাহ তা‘আলার এ সব গুণগত নামের বাইরে তাঁর জাতসত্তা ও তাঁর কর্মের সাথে সম্পর্কিত কিছু গুণের বর্ণনা পবিত্র করআন ও সহীহ হাদীসে পাওয়া যায়। জাতসত্ত্বার সাথে সম্পর্কিত গুণাবলীর মধ্যে আল্লাহর হাত, পা, চক্ষু, কর্ণ ও আঙ্গুল থাকার কথা বর্ণিত হয়েছে।
যেমন হাত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :
﴿يَدُ ٱللَّهِ فَوۡقَ أَيۡدِيهِمۡ﴾ [الفتح: ١٠]
‘‘আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে।’’[1]
তাঁর চক্ষু ও কর্ণ সম্পর্কে বলেছেন :
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١]
‘‘কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’[2]
তাঁর পা সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : ‘‘জাহান্নাম যখন বার বার আল্লাহর নিকট জাহান্নামীদেরকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করার জন্য চাইতে থাকবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পা মুবারক জাহান্নামের উপর রাখবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে বলেন :
«لاَ تَزَالُ جَهَنَّمُ تَقُولُ: هَلْ مِنْ مَزِيدٍ، حَتَّى يَضَعَ رَبُّ العِزَّةِ فِيهَا قَدَمَهُ، فَتَقُولُ: قَطْ قَطْ وَعِزَّتِكَ، وَيُزْوَى بَعْضُهَا إِلَى بَعْضٍ»
‘‘মহান প্রতিপালক জাহান্নামের উপরে তাঁর পা মুবারক স্থাপন করবেন, তখন তা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে এবং এর এক অংশ অপর অংশের সাথে নিম্নমুখী হয়ে মিলে যাবে, আর কাত্ব, কাত্ব, কাত্ব করে শব্দ করতে থাকবে।’’[3]
আল্লাহর হাত সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে :
«إِنَّ قُلُوبَ بَنِي آدَمَ كُلَّهَا بَيْنَ إِصْبَعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ الرَّحْمَنِ، كَقَلْبٍ وَاحِدٍ، يُصَرِّفُهُ حَيْثُ يَشَاءُ»
‘‘নিশ্চয় সকল বনী আদমের অন্তরসমূহ একটি অন্তরের ন্যায় আল্লাহ তা‘আলার আঙ্গুল সমূহের দু’টি আঙ্গুলের মাঝে অবস্থিত, তিনি যেমন ইচ্ছা তা পরিচালনা করেন।’’[4]
আল্লাহ তা‘আলার কর্মগত গুণ যেমন ‘কথা বলা’, এ-সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে :
﴿وَكَلَّمَ ٱللَّهُ مُوسَىٰ تَكۡلِيمٗا ١٦٤ ﴾ [النساء: ١٦٤]
‘‘আল্লাহ স্পষ্টভাবে মূসার সাথে কথা বলেছেন।’’[5]
আল্লাহ তা‘আলার হাসা সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :
«يَضْحَكُ اللهُ إِلَى رَجُلَيْنِ، يَقْتُلُ أَحَدُهُمَا الْآخَرَ كِلَاهُمَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ»
‘‘আল্লাহ তা‘আলা দু’ব্যক্তির কর্ম দেখে হাসেন, এদের একজন অপরজনকে হত্যা করে, অবশেষে (হত্যাকারী ইসলাম গ্রহণ করার ফলে) তারা উভয়েই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’[6]
আল্লাহর আনন্দ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে :
«لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ أَحَدِكُمْ، مِنْ أَحَدِكُمْ بِضَالَّتِهِ، إِذَا وَجَدَهَا»
‘‘একজন উটের মালিক মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া তার উট ফেরত পেলে যেরূপ আনন্দিত হয়, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের কারও তাওবা করা দেখে সে ব্যক্তির চেয়েও অধিক আনন্দিত হন।’’[7]
এ ছাড়াও আল্লাহ তা‘আলার আরো কিছু সত্তাগত ও কর্মগত গুণের কথা কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যার বিশদ বর্ণনা ‘আক্বীদার কিতাবাদিতে রয়েছে। এ সব গুণাবলী সম্পর্কে সালাফে সালেহীনগণের ঐক্যবদ্ধ মত হচ্ছে : এ সব গুণাবলীর দ্বারা বাহ্যিক যে অর্থ বুঝা যায়, সেগুলোকে সে অর্থেই গ্রহণ করতে হবে। সাধারণভাবে এ গুলোর অর্থ আমাদের বোধগম্য হলেও এ সবের আকৃতি প্রকৃতির প্রকৃত অবস্থা আল্লাহই ভাল করে জানেন। তবে এ কথা সত্য যে, এ সব গুণাবলীর সাথে আল্লাহর কোনো সৃষ্ট জীবের গুণাবলীর আদৌ কোনো সামঞ্জস্য নেই।
কেননা, তিনি তাঁর পরিচয় প্রদান প্রসঙ্গে বলেছেন :
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١]
‘‘তাঁর অনুরূপ কোন বস্তু নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’[8]
অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ একদিকে যেমন তাঁর নিজের জন্যে শ্রবণ করা ও দেখার দু’টি গুণের কথা স্বীকার করেছেন, অপর দিকে তেমনি এতে কারো সাথে সাদৃশ্য থাকার কথাকেও অস্বীকার করেছেন। এতে দু’টি বিষয় প্রমাণিত হয় :
এক. তিনি যে মাধ্যম দিয়ে শ্রবণ করেন ও দেখেন, সেটির নাম কান ও চক্ষু। তবে তাঁর কান ও চক্ষুর প্রকৃতির সাথে তাঁর কোনো সৃষ্টির কান ও চক্ষুর প্রকৃতির কোনই সাদৃশ্য নেই।
দুই. শ্রবণ করা ও দেখার এ দু’টি মৌলিক গুণের ক্ষেত্রে কেউ তাঁর অনুরূপ হলেও উভয়ের শ্রবণ করা ও দেখার মধ্যে আদৌ কোনো সামঞ্জস্য নেই। কেননা, তিনি তাঁর সুমহান আরশে অবস্থান করেই সব কিছু শ্রবণ করেন ও দেখেন। কোন কিছুই তাঁর শ্রবণ করা ও দেখার সামনে আড় বা বাধা হতে পারে না। তাঁর কাছে অদৃশ্য বলতে কিছুই নেই। পক্ষান্তরে তাঁর সৃষ্টির শ্রবণ ও দেখার মাধ্যমকে কান ও চক্ষু বলে নামকরণ করা হলেও তা নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে শ্রবণ করতে ও দেখতে পারে না।সালাফগণ এ আয়াতের মর্মকে সামনে রেখেই কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত আল্লাহ তা‘আলার জাতসত্তার সাথে সম্পর্কিত যাবতীয় গুণাবলীকে এর বাহ্যিক ও সাধারণ অথেই গ্রহণ করেছেন।
‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ এর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : তাঁরা কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত সকল প্রকাশ্যসুস্পষ্ট (صريح) বিষয়াদির কোনো প্রকার তা’বীল ছাড়াই তা বাহ্যিক বা আক্ষরিক অর্থে স্বীকার করেন। জাহমিয়্যাঃ[9] সম্প্রদায়ই সর্বপ্রথম পথভ্রষ্ট ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান, সাবিঈন, মুশরিক ও দার্শনিকদের চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার সত্তাগত ও কর্মগত গুণাবলীসমূহকে অস্বীকার করেছে। হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে এ বাতিল চিন্তাধারা বিশর ইবন গিয়াছ আল-মির্রীছী-এর মাধ্যমে ইসলামী বিশ্বে ব্যাপক আকারে প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে মু‘তাজিলা সম্প্রদায়ও জাহমিয়্যাদের এ চিন্তাধারা অনুসরণ করে। যেমন- তারা আল্লাহর কান ও চক্ষু সম্পর্কে উপরে বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছে : ‘তিনি কর্ণ ছাড়া শুনেন ও চক্ষু ছাড়া দেখেন।’[10] তবে যুগে যুগে ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ এর ইমামগণ এ বাতিল চিন্তাধারার প্রতিবাদ করেছেন এবং আল্লাহ তা‘আলার সত্তাগত গুণাবলীসমূহের ব্যাপারে কী চিন্তা ও বিশ্বাস করতে হবে, তা সুস্পষ্ট ভাষায় জনগণের মাঝে প্রচার করেছেন।
>[2]. আল-কুরআন, সূরা আশ্শুরা : ১১।
[3].বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুততাফসীর, বাবনং-৩৩৩, হাদীস-নং ৬৭;৪/১৮৩৬; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জান্নাহ, বাব নং ১৩, হাদীস নং ২৮৪৬, ৪/২১৮৬; ইমাম আহমদ, মুসনাদ; (বৈরুত : দ্বারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ২/২৭৬।
[4].মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল ক্বাদর, বাব নং ১, হাদীস নং ২৬৫৪, ৪/২০৪৫, তিরমিযী; কিতাবুল ক্বাদর, বাব নং ৫, হাদীস নং ২১৪০, ৪/৪৪৮।
[5]. আল-কুরআন, সূরা আন-নিসা : ১৬৪।
[6]. বুখারী, প্রাগুক্ত, হাদীস নং ২৬৭৫; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জান্নাহ, বাব নং ৩৫, হাদীস নং ১৮৯০, ৩/১৫০৪।
[7]. তদেব ; কিতাবুত তাওবাঃ, বাব নং ১, হাদীস নং ২৭৪৬, ৪/২১০২।
[8]. আল-কুরআন, সূরা আশ্শুরা : ১১।
[9]. মহান আল্লাহর গুণাবলীসমূহকে পূরিপূর্ণভাবে অস্বীকার করার চিন্তাধারা ইসলামী যুগে সর্ব প্রথম জা‘দ ইবন দিরহাম নামের এক ব্যক্তির দ্বারা প্রকাশিত হয়। এই চিন্তাধারা জাহাম ইবন সাফওয়ান নামের এক ব্যক্তি তাত্থেকে গ্রহণ ও প্রকাশ করে। সে জন্যেই এ চিন্তাধারাকে জাহাম ইবন সাফওয়ান এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। আরো বলা হয়ে থাকে যে, জা‘দ ইবন দিরহাম এ চিন্তাধারাটি এব্বান ইবন সিম‘আন নামক এক ব্যক্তির নিকট থেকে গ্রহণ করেছিল এবং এববান তা লবীদ ইবন আ‘সাম নামের সেই ইহুদী থেকে গ্রহণ করেছিল যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জাদু করেছিল। দেখুন : ‘আব্দুল আযীয আল-মুহাম্মদ আস-সালমান, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪০-৪১।
[10]. মুহাম্মদ খলীল হাররাস, শরহুল আক্বীদাতিল ওয়াসিতিয়্যাহ; (মদীনা : মারকাযুদ দাওয়া :, সৌদি আরব, ৭ম সংস্করণ, তারিখ বিহীন), পৃ. ১০০।