লগইন করুন
‘রব’ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার গুণগত নাম। আর এ-গুণগত নামবাচক শব্দ থেকেই ‘রুবূবিয়্যাত’ শব্দটি উদগত হয়েছে। এটা ‘রব’ নামের সম্পর্ক বর্ণনাসূচক শব্দ। ‘রব’ শব্দটি আভিধানিক দিক থেকে প্রভু, মালিক, মনিব, প্রতিপালক, কর্তা, অভিভাবক ও দেবতা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়।[1] এ শব্দটি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের বেলায়ও রূপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে আল্লাহ তা‘আলার বেলায়ই এর ব্যবহার হচ্ছে মূল বা আসল। উপরে ‘রব’ শব্দের যে সব অর্থ বর্ণিত হয়েছে, সে সবই মূলত আল্লাহ তা‘আলার ‘রুবূবিয়্যাত’-এর বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বিষয়াদি। তবে শর‘য়ী পরিভাষায় আল্লাহ তা‘আলাকে ‘রব’ বলে স্বীকৃতি দিতে হলে নিম্নে বর্ণিত বিষয়সমূহকে তাঁর রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে এবং এর বিপরীতধর্মী চিন্তা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে হবে :
১. তিনি আমাদের ও এ জগতের ছোট বড় সব কিছুর একক সৃষ্টিকর্তা। যেখানে যা কিছু সৃষ্টি করা প্রয়োজন, সেখানে তিনি নিজেই তাঁর পরিকল্পনানুযায়ী তা সৃষ্টি করেছেন ও করেন। তাঁর ইচ্ছা ও অনুমতি ব্যতীত কোনো সৃষ্ট বস্তুর প্রভাবে অপর কোনো বস্তু আপনা-আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হতে পারে এমন বিশ্বাস করা তাঁকে একক সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিশ্বাসের পরিপন্থী বলে মনে করা।
২. তিনি এ বিশ্বজগতের সব কিছুর একক মালিক, নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক। এ ক্ষেত্রে তাঁর কোনো শরীক ও সাহায্যকারী নেই। এ-জগত পরিচালনা কর্মে তাঁর অনুমতি ব্যতীত শাফা‘আতের নামে তাঁর নিকট অনধিকার চর্চা করার মতও কেউ নেই। ফেরেশতাগণকে কোনো কোনো বিষয় পরিচালনা কর্মে ব্যবহার করে থাকলেও তারা তাঁর নির্দেশানুযায়ীই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন মাত্র। মানুষদের মধ্য থেকে গাউছ, কুতুব ও আবদাল নামের কোন অলিদেরকে কোনো কিছু পরিচালনা করার কোনই কর্তৃত্ব তিনি দান করেন না।
৩. তিনি আমাদের জীবনের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইত্যাদি বিষয়াদি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় হেদায়াত তথা আদেশ ও নিষেধ দানের মালিক। তাঁর বিধানসমূহ বিস্তারিত ও মৌলিক নীতিমালার আকারে বর্ণিত হয়েছে কুরআনুল কারীম ও তাঁর নবীর সহীহ হাদীসে। এগুলো অবতীর্ণ করেছেন সকল স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে বাস্তবায়নের যোগ্য করে। আমরা নীতিগতভাবে তাতে বর্ণিত বিধানসমূহ মানতে বাধ্য। তাতে বর্ণিত কোনো বিধানের বিকল্প কোনো বিধান রচনা করার আমাদের কোনো বৈধ অধিকার নেই। অনুরূপভাবে কোনো বিধান রচনা করার প্রয়োজন দেখা দিলে তাতে বর্ণিত নীতিমালার বাইরে শরী‘আতের উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো বিধান রচনা করারও আমাদের কোনো অধিকার নেই। আমরা যদি নিজেদেরকে সেরকম কিছু করার যোগ্যতাবান বলে মনে করি, তা হলে এতে আমরা প্রকারান্তরে নিজেদেরকে নিজেদের রব বানিয়ে নেব এবং কুরআনুল কারীমের সূরা আল-মায়িদাহ : এর ৪৪, ৪৫, ও ৪৭ আয়াতে বর্ণিত বক্তব্যের মর্মানুযায়ী আমরা এ অপরাধের কারণে ইয়াহূদীদের ন্যায় কাফির, যালেম ও ফাসিকে পরিণত হবো।
১. তিনি আমাদের জীবন ও জীবিকার ভাল ও মন্দ সব কিছু দানের একচ্ছত্র মালিক। আমাদেরকে পরস্পরের প্রতি মুখাপেক্ষী করে রাখা এবং আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা গ্রহণ করার নিমিত্তে আমাদের প্রত্যেকের জন্য যে জীবন ও জীবিকা প্রদান করা উচিত- কাফির, মুশরিক, মুনাফিক ও মুসলিম নির্বিশেষে তিনি সবাইকে সে জীবন ও জীবিকাই দান করে থাকেন।
২. তিনি আমাদের দুনিয়া-আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক। তিনি আমাদের কোনো কল্যাণ করতে চাইলে তা রোধ করার কেউ নেই। আবার তিনি কারো অকল্যাণ করতে চাইলে সে লোকের কল্যাণ করার মতও কেউ নেই। কোন মৃত অলি কারো কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ করাতো দুরের কথা, কোন জীবিত অলি বা কুতুব[2]ও নিজ থেকে তাঁর ইচ্ছার বাইরে কারো কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারেন না। অনুরূপভাবে কোন বস্তুও তাঁর ইচ্ছার বাইরে নিজ থেকে কারো কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারে না।
১. তিনি আমাদের সকলের মৃত্যু ও পুনর্জীবন দানের মালিক।
২. ইহ-আখেরাতে একমাত্র তিনিই আমাদের যাবতীয় অপরাধ মার্জনা করার মালিক। আখেরাতে বিচার দিবসে শাফা‘আতের চাবিকাঠি থাকবে তাঁরই হাতে। তাঁর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত কারো পক্ষে কারো শাফা‘আত করার আদৌ কোন সুযোগ নেই।
৩. তিনি মানুষকে যাবতীয় কর্তৃত্ব ও সম্মান দানের মালিক। তাঁরই ইচ্ছায় জনগণ কোন রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করে। আবার তাঁরই ইচ্ছায় জনগণ সে দলকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে। তাই ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সঠিক ঈমান ও আমলের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন পূর্বক তা প্রতিষ্ঠা করে দেয়ার জন্য তাঁর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। তিনি ইচ্ছা করলে জনগণের সহযোগিতায় সে লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে, অন্যথায় নয়।
উপর্যুক্ত এ বিষয়গুলো যে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বিষয়, এর প্রমাণ আমরা নিম্নে বর্ণিত আয়াতসমূহে দেখতে পাই :
ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর জাতির উপাস্য দেবতাদের সমালোচনা পূর্বক তাদের নিকট স্বীয় উপাস্য প্রভুর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন :
﴿ قَالَ أَفَرَءَيۡتُم مَّا كُنتُمۡ تَعۡبُدُونَ ٧٥ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُمُ ٱلۡأَقۡدَمُونَ ٧٦ فَإِنَّهُمۡ عَدُوّٞ لِّيٓ إِلَّا رَبَّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٧٧ ٱلَّذِي خَلَقَنِي فَهُوَ يَهۡدِينِ ٧٨ وَٱلَّذِي هُوَ يُطۡعِمُنِي وَيَسۡقِينِ ٧٩ وَإِذَا مَرِضۡتُ فَهُوَ يَشۡفِينِ ٨٠ وَٱلَّذِي يُمِيتُنِي ثُمَّ يُحۡيِينِ ٨١ وَٱلَّذِيٓ أَطۡمَعُ أَن يَغۡفِرَ لِي خَطِيَٓٔتِي يَوۡمَ ٱلدِّينِ ٨٢ رَبِّ هَبۡ لِي حُكۡمٗا وَأَلۡحِقۡنِي بِٱلصَّٰلِحِينَ ٨٣ ﴾ [الشعراء: ٧٥، ٨٣]
তিনি বলেন : ‘‘তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষেরা যাদের উপাসনা করছো, তাদের যথার্থতা নিয়ে কি কোন সময় তোমরা ভেবে দেখেছ ? সমগ্র জগতের প্রতিপালক ব্যতীত এদের সবাই আমার শত্রু। সমগ্র জগতের প্রতিপালক তিনিই- যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন, যিনি আমাকে আহার ও পানীয় দান করেন, যখন আমি রোগাক্রান্ত হই তখন তিনিই আরোগ্য দান করেন, যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন অতঃপর পুনর্জীবন দান করবেন, যিনি আখেরাতে আমার অপরাধ মার্জনা করবেন বলে আমি আশাবাদী, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে কর্তৃত্ব দান কর এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্গত কর।’’[3]
উপর্যুক্ত এ আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, উপরে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, এর মধ্যকার সাতটি বৈশিষ্ট্যই এ আয়াতগুলোর মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। যেমন ‘খালাকানী’ خَلَقَنِيْ শব্দের দ্বারা প্রথম বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঈিত করা হয়েছে, ‘ইয়াহদ্বীনী’ يَهْدِيْنِيْ শব্দের দ্বারা তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঈিত করা হয়েছে, ‘ইউত্বইমুনী ওয়া ইয়াছক্বীন’ يُطْعِمُنِيْ وَ يَسْقِيْن শব্দদ্বয় দ্বারা চতুর্থ বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, ‘মারিদতু ফাহুয়া ইয়াশফীন’ ﴾مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفْيْن﴿ বাক্য দ্বারা পঞ্চম বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঈিত করা হয়েছে, ‘ইউমীতুনী ওয়া ইউহয়ীন’يُمِيْتُنِيْ ثُمَّ يُحْيِيْن বাক্যদ্বয় দ্বারা ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঈিত করা হয়েছে, ‘আত্বমাউ আন ইয়াগফিরা লী খাত্বীআতী’ أَطْمَعُ أَن يَّغْفِرَ لِيْ خَطِيْئَتِيْ .. এ বাক্যের দ্বারা সপ্তম বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঈিত করা হয়েছে, ‘রাববী হাবলী হুকমান’ رَبِّ هًبْ لِيْ حُكْمًا.. এ বাক্যের দ্বারা অষ্টম বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঈিত করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ প্রসঙ্গে অন্যত্র বলেছেন :
﴿ يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ إِلَى ٱلۡأَرۡضِ ﴾ [السجدة: ٥]
‘‘তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত যাবতীয় বিষয়াদি পরিচালনা করেন।’’[4]
আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের মৌলিক এ বিষয়গুলোর বর্ণনা কুরআনুল কারীমের অন্যান্য স্থানেও বিক্ষিপ্তভাবে দেয়া হয়েছে। যেমন তিনি যে সৃষ্টিকর্ম এবং যাবতীয় আদেশ ও নিষেধের বিধান দানের মালিক, সে সম্পর্কে অন্যত্র বলেছেন :
﴿أَلَا لَهُ ٱلۡخَلۡقُ وَٱلۡأَمۡرُۗ﴾ [الاعراف: ٥٤]
‘‘জেনে রেখো! সৃষ্টি যার নির্দেশও তাঁর।’’[5]
তিনি যে সকলের জীবিকার মালিক সে সম্পর্কে বলেছেন :
﴿هَلۡ مِنۡ خَٰلِقٍ غَيۡرُ ٱللَّهِ يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِۚ﴾ [فاطر: ٣]
‘‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো সৃষ্টিকর্তা আছে কি যে আকাশ ও পৃথিবী থেকে তোমাদেরকে রেজেক দান করবে।’’[6]
তিনি যে সকলের যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক সে-সম্পর্কে বলেছেন :
﴿قُلۡ فَمَن يَمۡلِكُ لَكُم مِّنَ ٱللَّهِ شَيًۡٔا إِنۡ أَرَادَ بِكُمۡ ضَرًّا أَوۡ أَرَادَ بِكُمۡ نَفۡعَۢاۚ﴾ [الفتح: ١١]
‘‘আপনি (কাফিরদের) বলুন : আল্লাহ যদি তোমাদের কোন অকল্যাণ কামনা করেন, তবে কে তোমাদেরকে সে অকল্যাণের হাত থেকে রক্ষা করার শক্তি রাখে, অথবা তিনি তোমাদের কোন কল্যাণ চাইলে কে তোমাদেরকে সে কল্যাণ থেকে মাহরূম করার শক্তি রাখে’’।[7] এ ভাবে ইচ্ছা করলে আমরা উপর্যুক্ত প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্যের আরো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারবো। তবে যাতে বই এর কলেবর বৃদ্ধি না পায়, সে-জন্য পাঠকদের বুঝার জন্যে এ-পর্যন্ত উপস্থাপন করাকেই যথেষ্ট বোধ করলাম।
যিনি হবেন উপাস্য তিনিই হবেন রব :
কেউ কারো উপাস্য হতে হলে তাকে অবশ্যই তার রব হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের উপর্যুক্ত এসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলেই তিনি আমাদের ‘রব’। আর এ বৈশিষ্ট্যগুণেই তিনি আমাদের উপাস্য বা ইলাহ। যিনি জনগণের ইলাহ হবেন, তাকে যে অবশ্যই তাদের ‘রব’ হতে হবে, এ মহা সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمۡ خَٰلِقُ كُلِّ شَيۡءٖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۖ ﴾ [غافر: ٦٢]
‘‘সেই আল্লাহই তোমাদের রব, তিনি প্রত্যেক বস্তুর সৃষ্টিকর্তা, সত্যিকারের উপাস্য বলতে তিনি ব্যতীত আর কেউ নেই।’’[8] উপাস্য বলতে আর কেউ নেই এ জন্যে যে, যিনি কারো ইলাহ বা উপাস্য হবেন তাঁকে অবশ্যই উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য বলে তার রুবূবিয়্যাতের মালিক হতে হবে। কিন্তু মানুষেরা বাস্তবে যাদেরকে তাদের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে, তারাতো উপর্যুক্ত এসব গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যের কোন একটিরও অধিকারী নয়। আর সে জন্যেই তারা তাদের রব বা উপাস্য কোনটাই নয়। যুগে যুগে মানুষেরা এ ভুলের শিকার হয়েছে বলেই নূহ আলাইহিস সালাম-থেকে আরম্ভ করে শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী ও রাসূলগণ নিজ নিজ জাতির জনগণকে এই বলে আহ্বান করেছেন :
﴿ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥٓ﴾ [الاعراف: ٥٩]
‘‘হে জাতির লোকেরা! তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অপর কোনো হক্ক ইলাহ নেই।’’[9]
উপকারীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মানুষের একটি স্বভাবজাত ধর্ম। মানুষ অপর মানুষের নিকট থেকে যে উপকারই লাভ করুক না কেন সে উপকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ কোন মানুষই অপর কোন মানুষের উপাসনা করতে পারে না। কেননা, মানুষ হিসেবে তারা সকলেই সমান। তারা কেউ কারো রব নয়, তাদের উপকারগুলোও রব হওয়ার জন্য যেসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হয়, সেসব বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বিষয়ও নয়; তাই কাউকে অলৌকিক পন্থায় কারো কোন উপকার করতে দেখলে সে উপকারী ব্যক্তির ব্যপারে এ ধারণা পোষণ করা যাবে না যে, তিনি বোধ হয় আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের কোন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে গেছেন, অথবা আল্লাহ বোধ হয় তাকে তাঁর রুবূবিয়্যাতের কোন বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। অনুরূপভাবে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ এমন কোন কর্মও করা যাবেনা যা তাকে উপাস্যের মর্যাদায় সমাসীন করে। তবে মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার যে দয়া ও করুণা রয়েছে, তা তাঁকে মানুষের রবের আসনে সমাসীন করে। সে কারণেই তিনি মানুষদেরকে কেবল তাঁরই উপাসনা করতে আদেশ করেছেন এবং অপর কারোর উপাসনা করতে নিষেধ করেছেন। এবার একজন মানুষ যখন বলবে ‘আল্লাহ আমার রব’ তখন তাকে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের উপর্যুক্ত এ মৌলিক বিষয়গুলোকে কেবল আল্লাহর জন্যেই নির্দিষ্ট বলে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং জীবনভর এ বিশ্বাসের উপর থেকেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। তার কোন বিশ্বাস, কর্ম, কথা বা অভ্যাসের দ্বারা এ মৌলিক বিষয়গুলোর কোন একটির ক্ষেত্রেও যদি কোন ব্যতিক্রম ঘটে, তা হলে তার উক্ত স্বীকৃতি আপনা আপনি বাতিল বলে গণ্য হবে।
মানব জাতির ধর্মীয় অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই একদল মানুষ আল্লাহকে তাদের ‘রব’ হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে তারা প্রকৃতিবাদী হয়েছে। হূদ আলাইহিস সালাম-এর জাতির জনগণের মাঝে এ-জাতীয় চিন্তা-ভাবনা বিরাজমান ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। জীবন ও জগত সম্পর্কে তাদের ধারণার বহিঃপ্রকাশ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে তারা বলতো :
﴿إِنۡ هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا ٱلدُّنۡيَا نَمُوتُ وَنَحۡيَا وَمَا نَحۡنُ بِمَبۡعُوثِينَ ٣٧ ﴾ [المؤمنون: ٣٧]
‘‘আমাদের পার্থিব জীবনই একমাত্র জীবন, আমরা মরি ও বাঁচি এখানেই এবং আমরা পুনরুত্থিত হবো না।’’[10] বর্তমান সময়েও বিশ্বে এদের উত্তরসূরীদের অভাব নেই। কিন্তু জ্ঞানের এ অভিনব অগ্রগতির যুগে একদল চিন্তাশীল মানুষ যেমন আল্লাহকেই তাদের ‘রব’ বলে স্বীকার করে নিচ্ছে, তেমনি আরেকদল মানুষ আল্লাহকে অস্বীকার করে বলছে- আল্লাহ বলতে কিছুই নেই। এ জগত ও মানুষ এক মহা বিস্ফোরণের ফল। আল্লাহ বলতে কেউ এসব সৃষ্টি করে নি; বরং মানুষই আল্লাহকে সৃষ্টি করেছে।[11]
আবার যারা আল্লাহকে তাদের ‘রব’ বলে স্বীকার করেছে তারা তাঁর উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের অনেক ক্ষেত্রে একত্ববাদী হতে পারে নি; বরং তারা বুঝে হোক আর না বুঝে হোক আল্লাহর কোনো না কোনো সৃষ্টিকে তাঁর কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্যের সাথে শরীক করে নিয়েছে এবং আজও নিচ্ছে। যারা সাধারণ ধার্মিক তারা বিশেষ করে মানব জীবনের কল্যাণ ও অকল্যাণ সম্পর্কিত যে মৌলিক বিষয় রয়েছে, সে ক্ষেত্রে অতি মাত্রায় বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। তাঁর সৃষ্টির মধ্যকার অনেক ছোট-বড় সৃষ্টিকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে উপকারী ও প্রভাব বিস্তারকারী দেখে সেগুলোকে তাঁর এ মৌলিক বৈশিষ্ট্যের সাথে শরীক করে নিয়ে এগুলোকে উপকারী বা অপকারী মনে করে নিয়েছে। এরই ভিত্তিতে তারা চন্দ্র, সূর্য, তারকা, গাছ-পালা, আগুন, পানি, পাথর ও পশু ইত্যাদিকে তাদের উপাস্যে পরিণত করেছে। একইভাবে অতীতের বহু নবী-রাসূল ও সৎ মানুষগণকে মৃত্যুর পরেও অদৃশ্যভাবে সাধারণ মানুষের জীবনের নানা সমস্যাদি সমাধান করতে সক্ষম ভেবে তাঁদেরকেও তারা আল্লাহর সে বৈশিষ্ট্যের সাথে শরীক করে নিয়েছে। এমন কি এ চিন্তাধারা এখনও মুসলিম সমাজের অনেক জ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের মাঝে অত্যন্ত প্রকটভাবে বিরাজমান রয়েছে। এ কথাটি কে না জানে যে, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর উপাসনা করার উদ্দেশ্যে, তাঁর জগত পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁকে সহযোগিতা করার জন্যে নয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও অনেক মানুষকে আউলিয়াদের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করতে দেখা যায় যে, তাঁদের মধ্যে গাউছ, কুতুব, নকীব[12], আবদাল ও আবরার ইত্যাদি পদ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত এমন অনেক বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গ নাকি রয়েছেন, যাদেরকে মহান আল্লাহ এসব পদ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে তাঁদেরকে পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে থাকেন।[13]
এসব ধার্মিকদের মাঝে আবার আরেক ধরনের মানুষ রয়েছেন যারা জ্ঞানী, গুণী, পীর ও মুরব্বীগণের অনুসরণ ও তাকলীদ করার ক্ষেত্রে শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত এর বৈধ সীমারেখা অতিক্রম করে তাঁদের অন্ধ তাকলীদ করার মাধ্যমে তঁদেরকে প্রকারান্তরে নিজের রবের মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছেন।
যারা ধর্ম-কর্ম নিয়ে বেশী চিন্তা ভাবনা করেন না, তাদের অবস্থা হচ্ছে- একটি যন্ত্রকে সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে সে যন্ত্রের সাথে এর নির্মাণ কোম্পানীর দেয়া নির্দেশিকার উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তাকে তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকলেও তাদের নিজেদের জীবন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তাদের রবের দেয়া নির্দেশিকার প্রতি তারা আদৌ কোনো গুরুত্ব দেন না। বরং তাদেরকে সে নির্দেশিকা পরিহার করে নিজেদের জীবন পরিচালনার জন্য সংবিধান ও আইন রচনা করতে সদা তৎপর দেখা যায়। আল্লাহর দেয়া সে নির্দেশিকাকে তারা পার্থিব উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অন্তরায় বলে মনে করে এর অনুসরণ না করে পশ্চিমাদের অনুসরণ ও অনুকরণ করাকে পছন্দ করতে দেখা যায়। এভাবে তারা যে নিজেদেরকে এবং পশ্চিমাদেরকে নিজের রবের আসনে সমাসীন করে নিয়েছেন, সে ব্যপারে এবং এ কর্মের পরিণতি সম্পর্কে তাদের কোনই অনুভূতি নেই। এমন লোকদের ব্যাপারেই মহান আল্লাহ বলেন :
﴿ أَفَرَءَيۡتَ مَنِ ٱتَّخَذَ إِلَٰهَهُۥ هَوَىٰهُ﴾ [الجاثية: ٢٣]
‘‘তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছো যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে।’’[14]
[2] যদিও বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, এ ধরনের উপাধীধারী লোকদের অস্তিত্ব কোথাও নেই। [সম্পাদক]
[3]. আল-কুরআন, সূরা আশ-শু‘আরা :৭৫-৮৪।
[4]. আল-কুরআন, সূরা সেজদাহ : ৫।
[5]. আল-কুরআন, সূরা আল-আ‘রাফ : ৫৪।
[6]. আল-কুরআন, সূরা আল-ফাত্বির : ৩০।
[7]. আল কুরআন, সূরা আল-ফাত্বির : ১১।
[8]. আল-কুরআন, সূরা আল-ফাত্বির : ৩।
[9]. আল-কুরআন, সূরা আল-আ‘রাফ : ৫৯, ৬৪, ৭২, ৮৪।
[10]. আল-কুরআন, সূরা আল-মু‘মিনুন : ৩৭।
[11]. জয়ন্তানুজ বন্দোপধ্যায়, ধর্মের ভবিষ্যৎ; (কলিকাতা : এলাইড পাবলিশারস, ১ম সংস্করণ, তারিখ বিহীন), পৃ. ২৫।
[12] বাস্তবে এগুলো অস্তিত্বহীন। [সম্পাদক]
[13] ইনকিলাব পত্রিকার মালিক একসময়ের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মাওলানা ‘আব্দুল মান্নান এ-প্রসঙ্গে বলেন : ‘‘মানুষ স্বীয় কর্মের দ্বারা সামান্য একজন মানুষ থেকে কুতুবের দরজায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। যার হাতে আল্লাহপাক দুনিয়ার শাসন শৃঙ্খলা বিধানের ভার ন্যস্ত করেন। মনে রাখতে হবে, আল্লাহপাক দুনিয়ার শাসন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে মানুষের মধ্য থেকে কিছু লোককে নিযুক্ত করেন। তাদের সংখ্যা হলো ৩৫০, মতান্তরে চার হাজার। তারা লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে কিছু কাজ করেন।...এই সব লোকেরা একে অপরকে চেনেন না।...এদের প্রথম স্তরে রয়েছেন তিনশ’ ‘আবদাল’, এদের উপর আরো সাত জনকে বলা হয় ‘আবরার’। এদের উপর আরো চার জনকে বলা হয় ‘‘আওতাদ’। এদের উপরে আরো তিন জনকে বলা হয় ‘নকীব’। আর এদের সবার উপরে আছেন একজন যার উপাধি হলো ‘কুতুব’ বা ’গাউছ’। অর্থাৎ আল্লাহপাকের নির্দেশে তারাই সমস্ত পৃথিবী পরিচালনা করেন।’’ দৈনিক ইনকেলাব, ২৫ সেপ্টেম্বর , ১৯৯৭ খ্রি., পৃ.৬। [নাউযুবিল্লাহ, এসবই হিন্দুদের বিশ্বাসের অনুরূপ বিষয়, (সম্পাদক)]
[14].আল-কুরআন, সূরা জাছিয়াহ : ২৩।