আজ গোটা পৃথিবীতে ধর্মহীনতা, অবিশ্বাস ও নাস্তিক্যবাদের বিস্তারের জন্য সর্বপ্রথম যাকে দায়ী করা যায় তা হলো ইউরোপীয় খ্রিস্টান গির্জা। ইতিহাসে দেখা যায়, একসময় গোটা ইউরোপ জুড়ে ছিল গির্জার শাসন। পাদরি আর পুরোহিতরাই ছিলেন রাষ্ট্রের অন্যতম সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ। আর এই সুযোগে তারা তখন নিজেদের ইচ্ছেমতো খ্রিস্টধর্মে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অসংখ্য মিথ্যা, ভোজবাজি আর কুসংস্কার। নিজেদের মন-মগজে আসা অর্থহীন চিন্তা-ভাবনাকে আসমানী পয়গাম বলে চালিয়ে দিতে তাদের বিবেকে বাধতো না। ঈসা আলাইহিস সালাম-কে মানুষ থেকে মা‘বুদের স্তরে পৌঁছে দেওয়া, শূলে প্রাণ বিসর্জন আর গোটা মানবতার ‘পাপমুক্তি’ ইত্যাদির মতো মস্তিষ্কের অসার কল্পনাগুলোকে তারা ধর্মের মূলনীতিতে রূপ দিয়েছিল। ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি এই বিশ্ব, পৃথিবী ও জীবন সম্পর্কেও তারা বিভিন্ন অলীক ধারণা পোষণ করত ও মানুষকে তা জানাত। কিন্তু পরবর্তীতে যখন ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জাগরণ আসে তখন ইউরোপের মাটিতে জন্ম নিতে থাকেন অসংখ্য বিজ্ঞানীগণ। তারা পৃথিবীর রহস্য ও বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ প্রকৃত তথ্য মানুষকে জানাতে শুরু করেন, ঠিক তখনোই গির্জার ন্তঅন্তরালে লুকায়িত খ্রিস্টধর্মের ধ্বজাধারীরা আদাজল খেয়ে তাদের বিরুদ্ধে ময়দানে নামে। গির্জার পুরনো মতামতকে বাদ দিয়ে যারা নতুন নতুন আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক ধারণাকে সত্যায়ন করেছিল তাদেরকে অবিশ্বাসী, ধর্মদ্রোহী আর স্তিনাস্তিক বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। শাসকগোষ্ঠীকে সেসব তথাকথিত ধর্মদ্রোহীকে ধরে ধরে হত্যা ও আগুনে পোড়াতে সুপারিশ করে। এভাবেই কেবল গির্জার মতামতের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে সেসময় অগণিত-অসংখ্য প্রতিভাধর বিজ্ঞানীকে হারায় ইউরোপের মাটি ও মানুষ।
কিন্তু বিজ্ঞানের এই নব-জাগরণের প্রবল স্রোত বালুর বাধ দিয়ে গির্জা তাকে আটকে রাখতে পারেনি। বিজ্ঞানীগণ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য ও আবিষ্কার মানুষের সামনে পেশ করতে থাকেন আর গির্জার পুরোহিতরা একের পর এক হোঁচট খেতে থাকেন। এভাবে এক পর্যায়ে এসে গির্জার গোমর মানুষের সামনে ফাঁস হয়ে পড়ে। ইউরোপের মাটিতে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীগণ উঠে আসেন নেতৃত্বের আসনে। মানুষের মাঝে এক নবতর জাগরণ নামে। তারা সকলে মিলে একযোগে হামলে পড়ে গির্জা ও গির্জার অধিবাসীদের ওপর। আবিষ্কার করে গির্জার দেওয়ালের ভেতরের এক লজ্জাকর দুনিয়া। যেখানে ভালো মানুষের পোশাকের ভেতরে লুকায়িত ছিল পাশবিক চরিত্রের পুরোহিত নামধারী কতগুলো মানুষ। তাদের অশ্লীলতা আর দুশ্চরিত্র দেখে সাধারণ মানুষ ভিরমি খাওয়ার উপক্রম হয়। সিদ্ধান্ত হয়- না এই গির্জার অধীনে আর থাকা যাবে না। এসব লোকদের নেতৃত্ব থেকে আমাদের অবশ্যই আযাদ হতে হবে। আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কর আর চাঁদাবাজিরও অবসান ঘটাতে হবে। এভাবেই ইউরোপের মানুষগুলো এক ধর্মের দোষ সব ধর্মের ওপর চাপিয়ে দেয়। একটি বিশেষ ধর্মকে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে সব ধর্মকেই ছুঁড়ে ফেলে। সকল নবী ও রাসূলই তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। যেকোনো অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি আহ্বানকেই তারা মস্তিষ্কের ঊষর কল্পনা আখ্যায়িত করে নিক্ষেপ করে আস্তকুঁড়ে। ধর্ম পরিণত হয় তাদের প্রধান দুশমনে। আর এটাই ছিল মূলত গোটা বিশ্ব নাস্তিক্যবাদের প্রথম তুফান।
গির্জার প্রভাব থেকে ইউরোপের মানুষগণ তখনও পুরোপুরি মুক্তি লাভ না করলেও বাষ্পের শক্তি আর যন্ত্র আবিষ্কারের ধারাবাহিকতা শুরু হতে না হতেই তাদের জীবনধারা সম্পূর্ণরূপে বদলে যেতে থাকে। মানুষ কৃষিকাজ বাদ দিয়ে শিল্পের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ন্তসামন্তপ্রভু ও জায়গীরদাররা তাদের বাপ-দাদার পুরনো ঐতিহ্য ছেড়ে দিয়ে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে থাকে। এভাবে একপর্যায়ে অনেকটা রাতারাতিই তারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়। সেসব শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের তারা অন্যায়ভাবে ব্যবহার করতে থাকে। তাদের ওপর চাপিয়ে দেয় নানারকম জুলুম-অত্যাচার আর শোষণের খড়্গ। ফলে জালেম পুঁজিবাদী আর মজলুম শ্রমিক নামে মানুষ দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অত্যাচারের এই নতুন পন্থা উদ্ভাবনের ফলে, পাশাপাশি ধর্মের পতাকাবাহীদের অত্যাচারী শ্রেণীদের সহায়তা কিংবা জুলুম-অত্যাচারের ক্ষেত্রে নীরবতা অবলম্বন সাধারণ মানুষের মনে ধর্মের বিরুদ্ধে নতুন করে ক্ষোভ আর ঘৃণার আগুন জ্বালায়। এক পর্যায়ে মানুষ আল্লাহর স্তিঅস্তিত্বে সন্দেহ করতে শুরু করে। ধর্মকে তারা জুলুমের হাতিয়ার কিংবা নিদেনপক্ষ সহায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করে। ধর্ম তাদের পার্থিব সমস্যার কোনো সমাধান দিতে সম্পূর্ণ অক্ষম- এমন বিশ্বাস তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে ওঠে। আর এভাবেই মানুষের জীবন থেকে ধর্মের প্রভাব-বলয় ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যেতে থাকে। ফলে মানুষ নিজেই নিজের পার্থিব সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন উপায়-উপকরণ খুঁজতে থাকে। সত্যি কথা কি- এই ক্ষেত্রেও ইউরোপের গির্জা মানুষের কোনো সহায়তা করতে পারে নি।
নাস্তিক্যবাদের তুফান বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার তৃতীয় উপকরণ ছিল নাস্তিক্যবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভাবন। আর এর মাঝে সবার আগে যে নামটি চলে আসে তা হলো ইয়াহূদী বংশোদ্ভূত জার্মান খ্রিস্টান (পরবর্তীতে নাস্তিক) কাল মার্কসের উদ্ভাবিত কম্যুনিজম। যদিও মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্যই কম্যুনিজমের উৎপত্তি হয়েছিল এবং পুঁজিবাদী দুনিয়া ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধন-সম্পত্তির ধারার বিলোপ সাধন করে সকল মানুষের সমতার ওপর ভিত্তি করে সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তোলার শ্লোগান নিয়ে এটা অস্তিত্বে এসেছিল; কিন্তু এর হর্তাকর্তারা ধীরে ধীরে একে ধর্মীয় পোশাক পরাতে শুরু করেন। ফলে সেখানে আস্তে আস্তে অর্থনীতির সঙ্গে দূরতম সংশ্লিষ্টতা নেই এমন বহু বিষয়েরও অনুপ্রবেশ ঘটে। এক পর্যায়ে তারা ধারণা দিতে শুরু করেন- মানুষের জীবনটা কেবল পার্থিব জগতের জন্যই। প্রভু, পরকাল কিংবা আত্মা বলতে আসলে কিছু নেই। আর তাই সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের আগ্রহ আর আকাঙক্ষার ক্ষেত্র কেবল পার্থিব দুনিয়ার উন্নতি-অগ্রগতি। পরবর্তীতে মানুষকে আরও জানানো হয় যে, জগতের ধর্মগুলো মূলত গরীবকে শোষণের জন্য ধনীদের আবিষ্কৃত হাতিয়ারমাত্র। আমানত, সচ্চরিত্র ইত্যাদি আখলাকগুলো পুঁজিবাদী স্বার্থকে রক্ষার জন্যই চতুর মস্তিষ্কের চিন্তার প্রসবমাত্র। আর এভাবেই সাম্যবাদীদের বিশ্বাসের ভিত্তি গড়ে ওঠে জগতের সকল নবী-রাসূলের দুশমনির ওপর। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে- সমাজের সাধারণ মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে জুলুম-নির্যাতনের পথ সুগম করার জন্যই আম্বিয়ায়ে কিরাম জগতে এসব ধর্মের প্রচার করেছিলেন। আর এভাবেই অর্থনৈতিক এই বিশ্বাসটি এক পর্যায়ে সব ধর্মের দুশমন হয়ে নাস্তিক্যবাদের এক নতুন তুফানরূপে আত্মপ্রকাশ করে। আরও আগে বেড়ে বলা যায়, কম্যুনিজমই ছিল সম্ভবত নাস্তিক্যবাদের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী তুফান। কারণ কম্যুনিজমের মূল শ্লোগান আর দর্শন ছিল সমাজের সাধারণ মানুষের স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করা। বাহ্যিকভাবে যা ছিল ইনসাফপূর্ণ ও মানবতার জন্য পরম উপকারী একটি দর্শন। আর যেহেতু সমাজের অধিকাংশ মানুষই ছিল দরিদ্র ও নিপীড়িত-নিষ্পেষিত সেহেতু নিজেদের মঙ্গল ও স্বার্থের কথা চিন্তা করে সাধারণ মানুষরা হৃদয়ের দুয়ার খুলে একে স্বাগত জানায়। এটা আসন গেড়ে বসে তাদের মনের মণিকোঠায়। বস্তুত কেবল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়; একটি ধর্মবিশ্বাস হিসেবেও এটি স্থান পেয়ে যায় তাদের মস্তিষ্কের গভীরে।
আর এভাবেই নতুন একটি অর্থনৈতিক ধারার ছদ্মাবরণে নাস্তিক্যবাদ পৃথিবীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। পরবর্তীতে রাশিয়ায় সংঘটিত বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্য ও তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাগ্রহণ ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তারা প্রকাশ্যে ধর্মের গলা কাটতে শুরু করে। নাস্তিক্যবাদ অলি-গলি ছেড়ে এবার রাজপথে নেমে হুক্কাহুয়া করতে থাকে। ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এই প্রলয়ংকরী তুফান।
কম্যুনিজমের বিশ্বাস ছিল, গোটা পৃথিবী একসময় তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর বিশ্বাসের কাছে অবশ্যই আত্মসমর্পণ করবে। আর সেকারণে এটা শুধু দাওয়াতের ভেতরেই তার কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ রাখেনি; গোটা বিশ্বে এই আদর্শ ছড়িয়ে দিতে এক পর্যায়ে বিপ্লব আর রক্তাক্ত সহিংসতার পথ বেছে নেয়। ফলে দ্রুত গোটা বিশ্বে এই আদর্শিক বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন জাতি নিজের অজান্তেই নাস্তিকতার পথে অগ্রসর হতে থাকে। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল চীনে ও রাশিয়ার সীমানার ভেতরের বিভিন্ন ইসলামী প্রজাতন্ত্রে। আজও মার্কসীয় বিশ্বাসের প্রজ্জ্বলিত নাস্তিক্যবাদের এই আগুন গোটা বিশ্বে দ্রুদ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি ইসলামের দুর্গ হিসেবে খ্যাত আরব দুনিয়ায়ও মার্কসীয় মতাদর্শ একের পর এক হানা দিয়ে যাচ্ছে।
আল্লাহর অস্তিত্বে অস্বীকার আর নাস্তিক্যবাদের দিকে ছুটে যেতে মানুষকে উদ্বুদ্ধকারী আরেকটি উপাদান ছিল নাস্তিক্যবাদের সঙ্গে বস্তুবাদী শক্তির সম্মিলন। কারণ মানুষ দেখলো, যেদিন থেকে গির্জা ও গির্জার বিশ্বাসের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে আযাদ করতে পেরেছে, সেদিন থেকেই ইউরোপ তাদের ধারণা মতে জীবনের সব রহস্য আবিষ্কার করতে পেরেছে আর আরোহণ করেছে বস্তুবাদী শক্তি ও উন্নতি-অগ্রগতির সানুদেশে। একইভাবে রাশিয়াও নিজেকে নাস্তিক্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার পরপরই রাতারাতি পরিণত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী রাষ্ট্রে। তারা আরও দেখলো, যেসব রাষ্ট্র অদ্যাবধি ধর্মকে আঁকড়ে ধরে আছে, বস্তুবাদী শক্তি ও শিল্প ইত্যাদির দিক থেকে সেগুলো অন্যদের তুলনায় যোজন যোজন পেছনে পড়ে আছে। আর এভাবেই তাদের মনে বদ্ধমূল গভীর বিশ্বাস গড়ে ওঠে: নাস্তিক্যবাদই হলো শক্তি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল চাবিকাঠি। ধর্মের নামই হলো মূর্খতা আর পশ্চাৎপদতা। পাশাপাশি বস্তুবাদী বিজ্ঞানের নানা উদ্ভাবন আর আবিষ্কারের ফলে যেহেতু মানব জীবন অধিকাংশ ক্ষত্রেই সহজতর হয়ে পড়েছিল এবং মানুষের জীবন সুন্দর ও সুখময় করার ক্ষেত্রে এর প্রভাব সুস্পষ্টভাবেই যে কোনো মানুষের চোখে ধরা পড়ার মতো ছিল, সে কারণে সহজাতভাবেই মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। বস্তুবাদী জ্ঞান-বিজ্ঞানকেই এক সময় বসিয়ে দেয় মা‘বুদের আসনে। কারণ তাদের পূর্ণ বিশ্বাস জন্মে যে, এই মা‘বুদই পারবে তাদের পার্থিব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান দিতে। আরও আগে বেড়ে, এই নতুন মা‘বুদই তাদের অন্য গ্রহে যাওয়ারও স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। এভাবেই নাস্তিক্যবাদের সঙ্গে নতুন নতুন আবিষ্কার আর বস্তুবাদী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মিলন মানুষের ভেতরে এই প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে, বিজ্ঞান হলো নাস্তিক্যবাদের সহজাত ফলাফল। আর এভাবেই একটি ভ্রান্ত বিশ্বাসের ছদ্মাবরণে এই তুফান মানুষের মনের দরিয়ায় ঝড় বইয়ে দিয়ে তাকে অশান্ত ও সংক্ষুব্ধ করে তোলে।
বস্তুবাদী শক্তি আর ক্ষমতার মালিক হয়ে ইউরোপ যখন তার মাটিতে অসংখ্য শিল্প-কারখানা গড়ে তোলে, তখন এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের বাজার ও কাঁচামালের সন্ধানে তারা গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেসব ভূখণ্ড যেহেতু অল্প পরিশ্রমে কিংবা সম্পূর্ণ মুফতে নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধিতে সর্বদা তৎপর ছিল, যার ফলে সেটা অর্জনের জন্য তারা তাদের সামরিক শক্তি ব্যয় করা শুরু করে। অপরদিকে কপাল খারাপ ছিল ইসলামী দুনিয়ার। এটা তখন দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতা, রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে দুর্বলতার সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। পরিণতিতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক হামলার সামনে এটা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ফলে অস্ত্রের লড়াইয়ে ইউরোপের সামনে আত্মসমর্পণ করে বসলো ইসলামী দুনিয়া। সামরিক পরাজয়ের ধারাবাহিকতা এক সময় আকীদা ও বিশ্বাসের পরাজয় পর্যন্ত গিয়ে ঠেকলো। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক নাস্তিকদের প্রচণ্ড ঝড়ের সামনে ইসলামী দুনিয়ার আকীদার ভীত নড়বড়ে হয়ে ধ্বসে পড়ার উপক্রম হলো। এক পর্যায়ে ইসলামী উম্মাহ নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য পেছনে ছুঁড়ে ফেলে ইউরোপীয় উপনিবেশের অনুসরণ করতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে তাদের ভেতরে অনুপ্রবেশ ঘটলো নাস্তিক্যবাদী এই বিশ্বাসের যে, ধর্মকে পরিত্যাগ করেই ইউরোপ উন্নতির সানুদেশে পৌঁছে গেছে। গোটা বিশ্বব্যাপী নাস্তিক্যবাদের বিস্তারের ক্ষেত্রে ইসলামী দুনিয়ার এই স্খলনও ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।
পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানের জাগরণ দুনিয়ার সামনে আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস আর প্রাচুর্যের এক নয়া দিগন্তের উন্মোচন করেছিল। চোখ ধাঁধানো বাড়ি-গাড়ি, যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্ময়কর বিকাশ আর বিলাস-ব্যসনের সকল উপায়-উপকরণের প্রাচুর্য, পোশাক-আশাকের ঔজ্জ্বল্য, উন্নত মানের খাদ্যদ্রব্যের আড়ম্বর আর জীবনের সকল ভোগ-সামগ্রীর ঘটা মানুষকে তাদের পুরনো পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ এক নতুন পৃথিবীতে নিয়ে গেলো, যেখানে ভোগের সাগরে বুঁদ হয়ে থাকা ছাড়া জীবনের আর কোনো মানে ছিল না তাদের কাছে।
সন্দেহ নেই, জগতের ধর্মগুলো যেই মূলনীতির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল নতুন জীবনের এই সবকিছুই ছিল ঠিক তার বিপরীত মেরুতে। কারণ ধর্ম স্বভাবতই মানুষকে অপচয় থেকে নিষেধ করে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির পথ পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বনের দীক্ষা দেয়। মদ, ব্যভিচার ও নগ্নতাসহ সকল হারাম ও অন্যায়ের পথ বর্জনের নির্দেশ দেয়। আর এতেই মানুষ ধর্মকে ভুল বুঝলো। দীন ও ধর্মের হিকমত ও রহস্য সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষ ধর্মের এই নীতিমালাকে মনে করতে লাগলো তাদের স্বাধীনতার পথের কাঁটা হিসেবে। তাদের মনে বিশ্বাস জন্মালো, ধর্ম তাদের স্বাধীনতার পায়ে শেকল পরিয়ে দিতে চায়। তাদের ভোগ-বিলাসের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে চায়। ফলে এভাবে ধর্মের প্রতি তাদের বিতৃষ্ণা ও বিরাগ আরও বেড়ে গেল। অধিকন্তু, ধর্মের পথে আহ্বানকারীরাও তাদের দুশমনে পরিণত হলেন। যে ব্যক্তিই জাহান্নামের ভয় দেখিয়ে তাদের জান্নাতের দিকে উদ্বুদ্ধ করতো তাকেই তারা ঘৃণা করতে শুরু করলো। আর এভাবেই দিনে দিনে ধর্ম-বিশ্বাস মানুষের মধ্য থেকে বনবাসে চলে গেলো। মানুষের মনের আসনটি দখল করে নিলো নাস্তিক্যবাদ।
পশ্চিমা সভ্যতা জীবনকে উপভোগের যেই দুয়ার পৃথিবীর সামনে খুলে দিয়েছিল তাতে গোটা মানব জাতি উন্মাদ হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। জীবনের ভোগ-বিলাসের হাজারও উপায়-উপকরণ দেখে মানুষের মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম হলো। সেগুলোর ভোগ-সম্ভোগের পথে দৌড়াতে গিয়ে একসময় মানুষ তার চারপাশের সবকিছু বরং একদিন নিজেকেও ভুলে গেলো। জীবনকে সহজ করার জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হলো। আর এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে মানুষ তার পরিশ্রম আর কর্মের পরিধিও আরও বিস্তৃত করলো। একসময় পুরুষের একার শ্রম পরিবারের ব্যাপক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হলে একসময় অন্তঃপূরের নারীও পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার জন্য ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে নেমে এলো। জীবনের প্রলুব্ধকর হাতছানিতে সাড়া দিয়ে ভোগের সাগরে বুঁদ হয়ে থাকার জন্য প্রয়োজন হলো আরও অর্থ ও প্রাচুর্য্যের। ফলে মানুষ আরও বাড়িয়ে দিলো তার কাজের গতি। এভাবে মানুষ একসময় মেশিনে পরিণত হলো। জীবনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যার কাজই দিন-রাত কেবল ঘুরতে থাকা। ফলে একদিন মানুষ তার নিজেকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময়টুকুও হারিয়ে ফেললো। নিজের স্থান ও অবস্থান, নিজের পরিচয় ও গন্তব্য এসব নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগই তার রইলো না। ভোর হতেই সে কাজে নেমে যায়। দিনের শেষ প্রান্তে কাজের শেষে চলে যায় মনের চাহিদা মেটাতে ভোগ-বিলাসের সন্ধানে। এটাই পরিণত হয় তার প্রাত্যহিক রুটিনে। ফলে ধর্ম নিয়ে চিন্তা-ভাবনার কথাও মানুষ একসময় ভুলে যায়। মানুষের জীবনে স্বাভাবিকভাবে তৈরি সহজাত কিছু প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার কথাও তার মনে পড়ে না। তার ভাবনাতেও কোনো দিন আসে না: কে এই পৃথিবীর স্রষ্টা? আমাদের কে সৃষ্টি করেছেন? আর কেনই বা সৃষ্টি করেছেন? আমাদের গন্তব্য কোথায়? এই পৃথিবীর কোনো শুরু বা শেষ আছে কি? মানুষের মাঝে ধনী-গরীব, জালেম-মজলুম আর হত্যাকারী ও নিহতের এই শ্রেণীভেদ কেন? সত্যি কথা হলো, জীবন-চক্রের অবিরাম ঘূর্ণন তাকে এগুলোর জবাব খোঁজার অবসরটুকুও দেয়নি।
এই ছিল নাস্তিক্যবাদের প্রাদুর্ভাব ও দুনিয়াব্যাপী তার ভয়ংকর সয়লাবের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ। এবার আমরা দেখবো, নাস্তিক্যবাদের বিকাশ ও বিস্তারের ফলে আমাদের সমকালীন জীবনে কী প্রভাব পড়েছে? এটা আমাদের জীবনের জন্য কোন ধরনের সর্বনাশ ডেকে এনেছে?