আজ গোটা পৃথিবীতে ধর্মহীনতা, অবিশ্বাস ও নাস্তিক্যবাদের বিস্তারের জন্য সর্বপ্রথম যাকে দায়ী করা যায় তা হলো ইউরোপীয় খ্রিস্টান গির্জা। ইতিহাসে দেখা যায়, একসময় গোটা ইউরোপ জুড়ে ছিল গির্জার শাসন। পাদরি আর পুরোহিতরাই ছিলেন রাষ্ট্রের অন্যতম সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ। আর এই সুযোগে তারা তখন নিজেদের ইচ্ছেমতো খ্রিস্টধর্মে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অসংখ্য মিথ্যা, ভোজবাজি আর কুসংস্কার। নিজেদের মন-মগজে আসা অর্থহীন চিন্তা-ভাবনাকে আসমানী পয়গাম বলে চালিয়ে দিতে তাদের বিবেকে বাধতো না। ঈসা আলাইহিস সালাম-কে মানুষ থেকে মা‘বুদের স্তরে পৌঁছে দেওয়া, শূলে প্রাণ বিসর্জন আর গোটা মানবতার ‘পাপমুক্তি’ ইত্যাদির মতো মস্তিষ্কের অসার কল্পনাগুলোকে তারা ধর্মের মূলনীতিতে রূপ দিয়েছিল। ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি এই বিশ্ব, পৃথিবী ও জীবন সম্পর্কেও তারা বিভিন্ন অলীক ধারণা পোষণ করত ও মানুষকে তা জানাত। কিন্তু পরবর্তীতে যখন ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জাগরণ আসে তখন ইউরোপের মাটিতে জন্ম নিতে থাকেন অসংখ্য বিজ্ঞানীগণ। তারা পৃথিবীর রহস্য ও বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ প্রকৃত তথ্য মানুষকে জানাতে শুরু করেন, ঠিক তখনোই গির্জার ন্তঅন্তরালে লুকায়িত খ্রিস্টধর্মের ধ্বজাধারীরা আদাজল খেয়ে তাদের বিরুদ্ধে ময়দানে নামে। গির্জার পুরনো মতামতকে বাদ দিয়ে যারা নতুন নতুন আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক ধারণাকে সত্যায়ন করেছিল তাদেরকে অবিশ্বাসী, ধর্মদ্রোহী আর স্তিনাস্তিক বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। শাসকগোষ্ঠীকে সেসব তথাকথিত ধর্মদ্রোহীকে ধরে ধরে হত্যা ও আগুনে পোড়াতে সুপারিশ করে। এভাবেই কেবল গির্জার মতামতের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে সেসময় অগণিত-অসংখ্য প্রতিভাধর বিজ্ঞানীকে হারায় ইউরোপের মাটি ও মানুষ।
কিন্তু বিজ্ঞানের এই নব-জাগরণের প্রবল স্রোত বালুর বাধ দিয়ে গির্জা তাকে আটকে রাখতে পারেনি। বিজ্ঞানীগণ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য ও আবিষ্কার মানুষের সামনে পেশ করতে থাকেন আর গির্জার পুরোহিতরা একের পর এক হোঁচট খেতে থাকেন। এভাবে এক পর্যায়ে এসে গির্জার গোমর মানুষের সামনে ফাঁস হয়ে পড়ে। ইউরোপের মাটিতে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীগণ উঠে আসেন নেতৃত্বের আসনে। মানুষের মাঝে এক নবতর জাগরণ নামে। তারা সকলে মিলে একযোগে হামলে পড়ে গির্জা ও গির্জার অধিবাসীদের ওপর। আবিষ্কার করে গির্জার দেওয়ালের ভেতরের এক লজ্জাকর দুনিয়া। যেখানে ভালো মানুষের পোশাকের ভেতরে লুকায়িত ছিল পাশবিক চরিত্রের পুরোহিত নামধারী কতগুলো মানুষ। তাদের অশ্লীলতা আর দুশ্চরিত্র দেখে সাধারণ মানুষ ভিরমি খাওয়ার উপক্রম হয়। সিদ্ধান্ত হয়- না এই গির্জার অধীনে আর থাকা যাবে না। এসব লোকদের নেতৃত্ব থেকে আমাদের অবশ্যই আযাদ হতে হবে। আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কর আর চাঁদাবাজিরও অবসান ঘটাতে হবে। এভাবেই ইউরোপের মানুষগুলো এক ধর্মের দোষ সব ধর্মের ওপর চাপিয়ে দেয়। একটি বিশেষ ধর্মকে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে সব ধর্মকেই ছুঁড়ে ফেলে। সকল নবী ও রাসূলই তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। যেকোনো অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি আহ্বানকেই তারা মস্তিষ্কের ঊষর কল্পনা আখ্যায়িত করে নিক্ষেপ করে আস্তকুঁড়ে। ধর্ম পরিণত হয় তাদের প্রধান দুশমনে। আর এটাই ছিল মূলত গোটা বিশ্ব নাস্তিক্যবাদের প্রথম তুফান।