ভালবাসার ক্ষেত্রেও জাগতিক ও ঈমানী দুটি পর্যায় আছে। জাগতিক ভালবাসা ইবাদত নয়, তবে জাগতিক ভালবাসা যদি আল্লাহর বিধান পালনের বিপরীতে দাঁড়ায় তবে তা পাপ। পিতামাতা, সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্য মানুষকে মানুষ জাগতিকভাবে ভালবাসে।
ঈমানী ভালবাসার তিনটি দিক: (১) আল্লাহকে ভালবাসা (حب الله), (২) আল্লাহর জন্য ভালবাসা (الحب لله) এবং (৩) আল্লাহর সাথে ভালবাসা (الحب مع الله)। আল্লাহকে ভালবাসা হয় কেবল তাঁরই জন্য এবং এ ভালবাসার সাথে থাকে অলৌকিক ভয়, আশা, অসহায়ত্ব ও ভক্তির প্রকাশ। এরূপ ভালবাসাই ইবাদত। আল্লাহর জন্য ভালবাসতে হয় যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসতে নির্দেশ দিয়েছেন তাদেরকে এবং তাদেরকে ভালবাসার মাধ্যমে তাদের সন্তুষ্টি নয় বরং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি আশা করা হয়। আর আল্লাহর সাথে ভালবাসা শিরক। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে অলৌকিক ভক্তি, ভয় ও অসহায়ত্বের সাথে ভালবাসা বা তার অলৌকিক নেক-নযর লাভের জন্য ভালবাসা শিরক। আল্লাহ বলেন:
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ
‘‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় তাদেরকে ভালবাসে, কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসা দৃঢ়তর।’’[1]
মুশরিকগণ দাবি করত যে, তারা তাদের উপাস্যদেরকে ভালবাসত আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের হৃদয়ে এ সকল উপাস্যের প্রেমই ছিল মূল। এদের প্রশংসায় কিছু বললে তারা খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠত। কিন্তু একমাত্র আল্লাহর মর্যাদা, প্রশংসা ও গুণকীর্তন করলে তারা বিরক্ত হতো। আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ بِالآَخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِنْ دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ
‘‘একমাত্র আল্লাহর কথা বলা হলে যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য উপাস্যদের উল্লেখ করা হলে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়।’’[2]
এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসী হানাফী বলেন: ‘‘মহান আল্লাহ এখানে মুশরিকদের যে বিশেষণ উল্লেখ করেছেন আমরা অনেক মানুষকে সে অবস্থায় দেখতে পাই। এ সকল মানুষ যে সকল মৃতব্যক্তির নিকট ত্রাণ প্রার্থনা করে ও সাহায্য চায় তাদের কথা উল্লেখ করা হলে তারা উৎফুল্ল উল্লসিত হয়। তাদের নামে মিথ্যা কাহিনীগুলি শুনলে তারা উল্লাসে উদ্বেলিত হয়। এসকল কাহিনী তাদের মর্যি ও পছন্দ মত হয় এবং তাদের আকীদার পক্ষে হয় বলেই তারা এরূপ উল্লসিত হয়। যারা এরূপ কাহিনী বর্ণনা করে তাদেরকে তারা খুবই মর্যাদা দেয় এবং ভক্তি করে। আর যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর কথা বলে, একমাত্র তিনিই সকল কার্য পরিচালনা করেন এবং সকল ক্ষমতার মালিক বলে উল্লেখ করে এবং তাঁর মহত্ব ও মর্যাদার পরিচায়ক প্রমাণগুলো উল্লেখ করে তার প্রতি তারা বিতৃষ্ণা বোধ করে। এরূপ কার্য যে করে তার প্রতি তারা অত্যন্ত বিরক্ত হয় এবং তার থেকে দূরে অবস্থান করে। তাকে তারা ঘৃণিত দল-মতের অনুসারী (খারিজী, ওহাবী, বিদাতী ইত্যাদি) বলে অভিযোগ করে। একব্যক্তি একদিন কঠিন বিপদে পড়ে জনৈক মৃত মানুষের নিকট ত্রাণ ও সাহায্য প্রার্থনা করছিল এবং বলছিল, হে বাবা অমুক, আমাকে রক্ষা কর। আমি তাকে বললাম, তুমি আল্লাহকে ডাক, বল: হে আল্লাহ; কারণ মহাপবিত্র আল্লাহ বলেছেন: ‘আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। আহবানকারী যখন আমাকে আহবান করে তখন আমি তার আহবানে সাড়া দেই।’’[3] আমার এ কথায় ঐ ব্যক্তি ক্রোধান্বিত হয়। পরে আমি শুনেছি যে, সে আমার বিষয়ে বলেছে: অমুক ব্যক্তি ওলীগণের মর্যাদা অস্বীকার করে। আমি শুনেছি যে, তাদের কেউ কেউ বলে, আল্লাহর চেয়েও ওলীরা দ্রুত ডাকে সাড়া দেন। এ কথা যে কত বড় কুফরী তা সহজেই বুঝা যায়। আমরা দু‘আ করি যে, মহান আল্লাহ আমাদেরকে বিভ্রান্তি ও অবাধ্যতা থেকে রক্ষা করেন।’’[4]
[2] সূরা (৩৯) যুমার: ৪৫ আয়াত।
[3] সূরা (২) বাকারা: ১৮৬ আয়াত।
[4] আলূসী, রুহূল মা‘আনী ১৭/৪৮৬-৪৮৭।