তাওয়াক্কুল শব্দটির সাধারণ অর্থ নির্ভর করা বা আস্থা স্থাপন করা। শব্দটি মূলত আরবী ‘উকীল’ শব্দ থেকে গৃহীত, যার অর্থ কার্যপরিচালনাকারী, দায়িত্বপ্রাপ্ত, প্রতিনিধি। বাংলা ভাষায়ও ‘উকিল’ শব্দটি হুবহু একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। ‘তাওয়াক্কুল’ শব্দটির মূল অর্থ উকীল ধরা, কাউকে উকীল বানানো বা কারো উকীল হওয়া।
তাওয়াক্কুল, নির্ভরতা বা উকীল গ্রহণ লৌকিক ও অলৌকিক দু প্রকার হতে পারে। লৌকিক নির্ভরতা জাগতিক উপকরণ নির্ভর। যেমন পিতা, মাতা, পুলিশ, শাসক, ডাক্তার, উকীল, বিচারক, লাঠি, অস্ত্র ইত্যাদি জাগতিক উপকরণ বা ক্ষমতার অধিকারীর উপর নির্ভরতা। ধার্মিক-অধার্মিক বা আস্তিক-নাস্তিক সকলেই এরূপ নির্ভর করেন। এরূপ নির্ভরতা শিরক নয়, তবে মুমিনের জন্য এরূপ নির্ভরতা থেকেও হৃদয়কে মুক্ত করে একমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভরতায় হৃদয়কে পূর্ণ করা প্রয়োজন।
অলৌকিক নির্ভরতা কেবলমাত্র বিশ্বাসীরাই করেন। যে যার মধ্যে ‘অলৌকিক’ ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করেন তার অলৌকিক করুণা লাভের আকুতি তার হৃদয়ে থাকে এবং তিনি তার উপর নির্ভর করেন বা তাকে অলৌকিক ‘উকীল’ বা কার্যনির্বাহী বলে গ্রহণ করেন। মহান আল্লাহ ছাড়া কারো উপর এরূপ নির্ভরতা শিরক। ঈমান ও ইসলামের অবিচ্ছেদ্য দাবি একমাত্র আল্লাহর উপরেই নির্ভর করা। আল্লাহ বলেন:
إِنْ كُنْتُمْ آَمَنْتُمْ بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُسْلِمِينَ
‘‘তোমরা যদি আল্লাহকে বিশ্বাস করে থাক, যদি তোমরা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী হও তবে শুধু তারই উপরে নির্ভর কর।’’[1]
মহান আল্লাহ বারবার বলেছেন:
وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ
‘‘আর কেবল আল্লাহর উপরেই নির্ভর করুক মুমিনগণ।’’[2]
মুশরিকগণ দাবি করত যে, ফিরিশতা, জিন, নবীগণ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদেরকে তারা আল্লাহর দরবারে ‘‘উকীল’’ হিসেবে গ্রহণ করে। তাঁরা তাদের পক্ষ হয়ে আল্লাহর দরবারে ওকালতি করবেন। আর এ উদ্দেশ্যেই তারা তাঁদের বন্দনা বা অর্চনা করেন। এরা তাদের ত্রাণকর্তা (saviour) বা মধ্যস্থতাকারী (mediator)। মুশরিকগণ মহান আল্লাহকে অজ্ঞ, অবিবেচক ও চাটুকার-প্রভাবিত ‘রাজা-বাদশা’ বলে কল্পনা করার কারণেই এরূপ শিরকের মধ্যে নিপতিত হত। অথচ মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার বিষয়ে সর্বজ্ঞ ও তার সবচেয়ে নিকটতম করুণাময় প্রতিপালক। তাঁর কাছে কোনো উকীলের প্রয়োজন নেই। বরং তিনিই বান্দার একমাত্র উকীল।
শাফাআত ও ওকালত এক নয়। মহান আল্লাহর অনুমতিতে যে বান্দার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট তার জন্য নবী-রাসূল, ফিরিশতা ও নেককারগণ শাফাআত করবেন। তবে বান্দার দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও মুক্তির জন্য মহান আল্লাহই তাঁর উকীল। কারো শাফাআতে, দুআয় বা বিনা শাফাআতে বান্দার কল্যাণ ও মুক্তির সকল ‘তদবীর’ ও বন্দোবস্ত তিনিই করেন। আল্লাহ বারবার বলেছেন যে, উকীল হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট;
وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ وَكَفَى بِاللَّهِ وَكِيلا
‘‘আর আল্লাহর উপর নির্ভর কর; উকীল হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’’[3]
মহান আল্লাহকে উকিল ধরতে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন:
لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِيلا
‘‘তিনি ছাড়া কোনো মাবূদ নেই; তুমি তাঁকেই উকীল হিসেবে গ্রহণ কর।’’[4]
আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে উকীল গ্রহণ করা নিষেধ। আল্লাহ বলেন:
أَلاَّ تَتَّخِذُوا مِنْ دُونِي وَكِيلا
‘‘তোমরা আমাকে ছাড়া কাউকে উকীল গ্রহণ করবে না।’’[5]
[2] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১২২; ১৬০ আয়াত; সূরা (৫) মায়িদা: ১১ আয়াত; সূরা (৯) তাওবা: ৫১ আয়াত; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১১ আয়াত; সূরা (৫৮) মুজাদালা: ১০ আয়াত; সূরা (৬৪) তাগাবুন: ১৩ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৭) আ’রাফ: ৮৯ আয়াত; সূরা (১০) ইউনুস: ৮৪, ৮৫ আয়াত; সূরা (১২) ইউসুফ: ৬৭ আয়াত; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১২ আয়াত; সূরা (৬০) মুমতাহিনা: ৪ আয়াত; সূরা (৬৭) মুলক: ২৯ আয়াত।
[3] সূরা (৪) নিসা: ৮১ আয়াত; সূরা (৩৩) আহযাব: ৩; ৪৮ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৪) নিসা: ১৩২; ১৭১ আয়াত; সূরা (১৭) ইসরা/ বনী ইসরাঈল: ৬৫ আয়াত।
[4] সূরা (৭৩) মুয্যাম্মিল: ৯ আয়াত।
[5] সূরা (১৭) ইসরা/ বনী ইসরাঈল: ২ আয়াত।