ইমাম আ’যম আবূ হানীফা নু’মান ইবনু সাবিত (রাহিমাহুল্লাহ) ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ পুস্তিকাটির শুরুতে বলেন:
أَصْلُ التَّوْحِيْدِ وَمَا يَصِحُّ الاعْتِقَادُ عَلَيْهِ يَجِبُ أَنْ يَقُوْلَ: آَمَنْتُ بِاللهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْبَعْثِ بَعْدَ الْمَوْتِ وَالْقَدْرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ مِنَ اللهِ تَعَالَي. وَالْحِسَابُ وَالْمِيْزَانُ وَالْجَنَّةُ وَالنَّارُ حَقٌّ كُلُّهُ. وَاللهُ تَعَالَي وَاحِدٌ، لاَ مِنْ طَرِيْقِ الْعَدَدِ، وَلَكِنْ مِنْ طَرِيْقِ أَنَّهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
বঙ্গানুবাদ
তাওহীদের মূল এবং যার উপর বিশ্বাস বিশুদ্ধ হয় তা এই যে, অবশ্যই বলতে হবে: আমি ঈমান এনেছি আল্লাহে, এবং তাঁর মালাকগণে (ফিরিশতাগণে), এবং তাঁর গ্রন্থসমূহে, এবং তাঁর রাসূলগণে, এবং মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানে এবং তাকদীরে, যার ভাল এবং মন্দ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। এবং হিসাব, মীযান, জান্নাত, জাহান্নাম এ সবই সত্য। মহান আল্লাহ এক। তাঁর একত্ব সংখ্যায় নয়। বরং তাঁর একত্বের অর্থ তাঁর কোনো শরীক নেই। বল, ‘তিনিই আল্লাহ, একক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নহেন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয় নি। এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।[1]
১. ১. তাওহীদ: অর্থ ও পরিচিতি
ইমাম আযম (রাহ) প্রথমেই তাওহীদের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘তাওহীদ’ শব্দটি ‘ওয়াহাদা (وَحَدَ) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত, যার অর্থ ‘এক হওয়া’, ‘একক হওয়া’ বা ‘অতুলনীয় হওয়া’ (to be alone, unique, unmatched, incomparable)। তাওহীদ অর্থ ‘এক করা’, ‘এক বানানো’, ‘একত্রিত করা’, ‘একত্বের ঘোষণা দেওয়া’ বা ‘একত্বে বিশ্বাস করা’। এখানে তাওহীদ বলতে ‘‘আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস’’ বুঝানো হয়েছে।
আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস বলতে ‘‘আল্লাহ এক’’ শুধু এতটুকু বিশ্বাস বুঝানো হয় না। কারণ কুরআন ও হাদীসের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি যে, আরবের কাফিরগণ এবং অন্যান্য যুগের কাফিরগণ প্রায় সকলেই এরূপ একত্বে বিশ্বাস করত। তারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহ এক এবং তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও সর্বশক্তিমান প্রভু-প্রতিপালক।[1] এছাড়া তারা আল্লাহর ইবাদত করত, তাঁকে ডাকত, প্রার্থনা করত এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মানত, কুরবানী ইত্যাদি করত।[2] কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের ‘‘তাওহীদের’’ বিশ্বাস পূর্ণ হয় নি। কারণ তারা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করার পাশাপাশি আল্লাহর ফিরিশতাগণ, নবীগণ, ওলীগণ বা কল্পিত ‘পুত্রকন্যাগণের’ ইবাদত পাওয়ার অধিকার আছে বলে বিশ্বাস করত।[3]
[2] দেখুন: সূরা (৬) আনআম: ১৩৩ আয়াত; সূরা (৮) আনফাল: ৩২ আয়াত।
[3] দেখুন: সূরা (৯) তাওবা: ৩১ আয়াত; সূরা (৩৪) সাবা: ৪০ আয়াত; সূরা (৭১) নূহ: ২৩ আয়াত।
মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلا وَهُمْ مُشْرِكُونَ
‘‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহতে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর সাথে শরীক করে।’’[1]
এ থেকে স্পষ্টতই জানা যায় যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের একাধিক পর্যায় রয়েছে, এক পর্যায়ে ঈমানের সাথে সাথে শিরক্ একত্রিত হতে পারে। এর ব্যাখ্যায় সাহাবী-তাবিয়ীগণ বলেছেন যে, কাফিরগণ আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, রিয্কদাতা ও সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করতো, কিন্তু তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করতো।[2]
এ ভাবে আমরা দেখছি যে, তাওহীদের অন্তত দুটি পর্যায় রয়েছে এবং কাফিরগণ একটি বিশ্বাস করতো এবং একটি অস্বীকার করত। কুরআন কারীমের এজাতীয় অগণিত নির্দেশনা ও সাহাবী-তাবিয়ীগণের এ সকল তাফসীরের আলোকে পরবর্তী যুগের আলিমগণ ‘তাওহীদ’-কে বিভিন্ন ভাবে ভাগ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফাই প্রথম তাওহীদকে (১) রুবূবিয়্যাত (প্রতিপালন) ও (২) উলূহিয়্যাত (উপাসনা) দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করেন। পরবর্তী অধিকাংশ আকীদাবিদ এ বিষয়ে তাঁর অনুসরণ করেন। আল-ফিকহুল আবসাত গ্রন্থে তিনি বলেন:
وَاللهُ تَعَالَى يُدْعَى مِنْ أَعْلَى لاَ مِنْ أَسْفَلَ لَيْسَ مِنْ وَصْفِ الرُّبُوْبِيَّةِ وَالأُلُوْهِيَّةِ فِيْ شَيْءٍ
‘‘মহান আল্লাহকে ডাকতে হয় ঊর্ধ্বে, নিম্নে নয়। নিম্নে থাকা রুবূবিয়্যাত (রবব হওয়ার) এবং উলূহিয়্যাতের (উপাস্য হওয়ার) কোনো বিশেষত্ব নয়।’’[3]
কেউ কেউ দুটি পর্যায়কে আরো বিস্তারিতভাবে তিনটি বা চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ আল্লামা সাদরুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু আলাউদ্দীন আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবিল ইয্য দিমাশকী (৭৩১-৭৯২ হি) তাঁর রচিত ‘শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ’ পুস্তকে তাওহীদকে প্রথমত দু পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন: (১) তাওহীদুল ইসবাত ওয়াল মা’রিফাহ (توحيد الإثبات والمعرفة) বা জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ এবং (২) তাওহীদুত তালাবি ওয়াল কাসদি (توحيد الطلب والقصد) বা কর্ম পর্যায়ের তাওহীদ।[4] অন্যত্র তিনি উক্ত প্রথম পর্যায়ের তাওহীদকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করে তাওহীদকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন: (১) তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত, (২) তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত ও (৩) তাওহীদুল ইলাহিয়্যাহ।[5]
প্রসিদ্ধ ভারতীয় আলিম ও সংস্কারক শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (১১৭৬ হি) প্রথম পর্যায়ের তাওহীদকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেন এবং এভাবে তিনি তাওহীদকে চার পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন:
(১) আল্লাহকে একমাত্র অনাদি অনন্ত সত্তা বলে বিশ্বাস করা।
(২) আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করা।
(৩) আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র পরিচালক হিসেবে বিশ্বাস করা।
(৪) আল্লাহকে একমাত্র মা‘বুদ বা উপাস্য হিসেবে বিশ্বাস করা।[6]
এভাবে আমরা দেখছি যে, তাওহীদের মূলত দুটি পর্যায় রয়েছে এবং প্রথম পর্যায়টির একাধিক পর্যায় রয়েছে। এগুলি অনুধাবন করা ঈমানের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য, অন্যথায় ঈমানের সাথে শিরক মিশ্রিত হয়ে যেতে পারে। আমরা এখন এ পর্যায়গুলো বুঝতে চেষ্টা করব, ইনশা আল্লাহ।
[2] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১৩/৭৭-৭৯।
[3] ইমাম আবু হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৫০-৫১।
[4] ইবনু আবিল ইযয, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৮৯।
[5] ইবনু আবিল ইযয, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৮।
[6] শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৭৬।
জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদের দুটি মূল বিষয় রয়েছে: ১) সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্ব, ও ২) নাম ও গুণাবলির একত্ব।
১. ৩. ১. সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্ব
আরবীতে একে ‘তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ্’ (توحيد الربوبية) ‘‘প্রতিপালনের একত্ব’’ বলা হয়।[1] অর্থাৎ এ কথা বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহই এ মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সংহারক, রিযিকদাতা, নিয়ন্ত্রক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
১. ৩. ২. কাফিরগণ এ তাওহীদ বিশ্বাস করত
কুরআন-হাদীসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, কাফির-মুশরিকগণ এ পর্যায়ের তাওহীদ বিশ্বাস ও স্বীকার করত। কুরআনে বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এক স্থানে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ
‘‘যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ডাক তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সে অনুগ্রহ রোধ করতে পারবে? বল, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ নির্ভরকারীগণ আল্লাহর উপরেই নির্ভর করে।’’[2]
এ আয়াত এবং এ অর্থের অন্যান্য আয়াত থেকে আমরা জানছি যে, কাফিররা স্বীকার ও বিশ্বাস করত যে, আল্লাহই বিশ্বের সকল কিছুর একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সকল ক্ষমতার মালিক, সর্বশক্তিমান, তাঁর উপরে কেউ আশ্রয়দাতা নেই, তিনি অনিষ্ট চাইলে কেউ তা দূর করতে পারে না এবং তিনি কল্যাণ চাইলে কেউ তা রোধ করতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরোধিতা করা সত্ত্বেও এ কথা তারা অকপটে স্বীকার করতো। তবে তাদের ধারণা ছিল যে, তাদের উপাস্যগণ আল্লাহর প্রিয়পাত্র। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে সক্ষম না হলেও এবং আল্লাহ চূড়ান্ত ফয়সালা দিলে তা পরিবর্তনের ক্ষমতা না রাখলেও সাধারণভাবে কিছু অলৌকিক নিষ্ট-অনিষ্টের ক্ষমতা তাদের আছে, যা আল্লাহই তাদের দিয়েছেন।
[2] সূরা (৩৯) যুমার: ৩৮ আয়াত।
‘তাওহীদুল আসমায়ি ওয়াস সিফাত’ (توحيد الأسماء والصفات) বা ‘নাম ও গুনাবলির তাওহীদ’ অর্থ: দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ সকল পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিভিন্ন হাদীসে আল্লাহর বিভিন্ন নাম ও বিশেষণের উল্লেখ করেছেন। এ সকল নাম ও বিশেষণের উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে, সকল প্রকার বিকৃতি, অপব্যাখ্যা থেকে মুক্ত থাকতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহর কোনো কর্ম, গুণ বা বিশেষণ কোনো সৃষ্টজীবের কর্ম, গুণ বা বিশেষণের মত নয়, তুলনীয় নয় বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আল্লাহ বলেন:
وَلِلَّهِ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘‘এবং আল্লাহরই নিমিত্ত উত্তম নামসমূহ, তোমরা তাঁকে সে সকল নামেই ডাকবে। যারা তাঁর নামসমূহের বিষয়ে বক্রতা অবলম্বন করে তাদেরকে তোমরা বর্জন করবে। শীঘ্রই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল প্রদান করা হবে।’’[1]
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[2]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:
فَلا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الأَمْثَالَ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ
‘‘তোমরা আল্লাহর জন্য উপমা স্থাপন করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না।’’[3]
[2] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।
[3] সূরা (১৬) নাহল: ৭৪ আয়াত।
মহান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলি গাইবী বিষয়। মানুষ যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্বের বাস্তবতা অনুভব করতে পারে, কিন্তু যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে তাঁর সত্তা ও গুণাবলির খুঁটিনাটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ এ বিষয়ে দর্শন, যুক্তি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়েছে। যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে কেউ বলেছেন, আল্লাহর কোনো বিশেষণ থাকতে পারে না, তিনি ‘‘নির্গুণ’’। কেউ বলেছেন, তাঁর অমুক গুণ থাকতে পারে, কিন্তু তমুক গুণ থাকতে পারে না। মক্কার কাফিরগণ আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করলেও তাঁকে ‘রাহমান’ বা ‘মহা-করুণাময়’ নামে ডাকতে অস্বীকার করত। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اسْجُدُوا لِلرَّحْمَنِ قَالُوا وَمَا الرَّحْمَنُ أَنَسْجُدُ لِمَا تَأْمُرُنَا وَزَادَهُمْ نُفُورًا
‘‘যখন তাদেরকে বলা হয় ‘সাজদাবনত হও রাহমান-এর প্রতি’, তখন তারা বলে, ‘রাহমান আবার কি? তুমি কাউকে সাজদা করতে বললেই কি আমরা তাকে সাজদা করব?’ এতে তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়।’’[1]
তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত বা মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলির একত্বের বিষয়ে দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভিন্ন বিভ্রান্তির উদ্ভব ঘটে। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) তাঁর এ গ্রন্থে এ জাতীয় অনেক বিভ্রান্তি আলোচনা করেছেন, যা আমরা দেখব ইনশা আল্লাহ।
আরবীতে একে ‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’ বা ‘তাওহীদুল ইবাদত’ বলা হয়। উলুহিয়্যাহ শব্দটি ‘ইলাহ’ থেকে গৃহীত। ‘‘ইলাহ’’ (إله) শব্দের অর্থ ‘‘মাবুদ’’, অর্থাৎ উপাস্য বা পূজ্য। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ আহমদ ইবনু ফারিস (৩৯৫ হি) বলেন:
اَلْهَمْزَةُ وَاللاَمُ وَالْهَاءُ أَصْلٌ وَاحِدٌ، وَهُوَ التَّعَبُّدُ. فَالإِلهُ اللهُ تَعَالَى، وَسُمِّيَ بِذَلِكَ لأَنَّهُ مَعْبُوْدٌ
‘‘হামযা, লাম ও হা=ইলাহ: ধাতুটির একটিই মূল অর্থ, তা হলো ইবাদত করা। আল্লাহ ‘ইলাহ’ কারণ তিনি মা’বুদ বা ইবাদতকৃত।’’[1]
আরবী ভাষায় সকল পূজিত ব্যক্তি, বস্ত্ত বা দ্রব্যকেই ‘ইলাহ’ বলা হয়। এজন্য সূর্যের আরেক নাম ‘আল-ইলাহাহ’ (الإلاهة); কারণ কোনো কোনো সম্প্রদায় সূর্যের উপাসনা বা পূজা করত।[2]
[2] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকাইসিল্লুগাহ ১/১২৭; রাগিব ইসপাহানী, আল-মুফরাদাত, পৃ. ২১।
আমরা দেখলাম যে, উলূহিয়্যাত অর্থ ইবাদাত। ইবাদাত শব্দটি ‘আবদ’ বা ‘দাস’ শব্দ থেকে গৃহীত। দাসত্ব বলতে ‘উবূদিয়্যাত’ ও ‘ইবাদত’ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। উবূদিয়্যাত অর্থ লৌকিক বা জাগতিক দাসত্ব এবং ‘ইবাদত’ অর্থ অলৌকিক বা অপার্থিব দাসত্ব। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ রাগিব ইস্পাহানী (৫০২ হি) বলেন:
اَلْعُبُوْدِيَّةُ إِظْهَارُ التَّذَلُّلِ وَالْعِبَادَةُ أَبْلَغُ مِنْهَا لأَنَّهَا غَايَةُ التَّذَلُّلِ وَلاَ يَسْتَحِقُّهَا إِلاَّ مَنْ لَهُ غَايَةُ الأَفْعَالِ (الإِفْضَالِ)
‘‘‘উবূদিয়াত’ (slavery, serfdom, bondage) হলো বিনয়-ভক্তি-অসহায়ত্ব প্রকাশ করা। আর ‘ইবাদত’ (worship, veneration) এর চেয়েও অধিক গভীর অর্থজ্ঞাপক। কারণ ইবাদত হলো চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি-অসহায়ত্ব প্রকাশ, যিনি চূড়ান্ত কর্ম-ক্ষমতা বা দয়ার মালিক তিনি ছাড়া কেউ এরূপ চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।’’[1]
অন্যান্য আলিমও অনুরূপ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাদের ভাষায়:
اَلْعِبَادَةُ عَلَى الْمَعْنَى اللُّغَوِيِّ غَايَةُ التَّذَلُّلِ وَالاِفْتِقَارِ وَالاِسْتِكَانَةِ
‘‘ইবাদাতের আভিধানিক অর্থ চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি, অসহায়ত্ব ও মুখাপেক্ষিতা।’’[2]
[2] আযীম আবাদী, আউনুল মা’বূদ ৪/২৪৭; মুবারকপূরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/২২০; মুনাবী, আব্দুর রাউফ, ফাইদুল কাদীর ৩/৫৪০।
চূড়ান্ত ভক্তি প্রকাশ করে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারীর জন্য যে কর্ম করা হয় তা বিভিন্ন পর্যায়ের। কিছু কর্ম মানুষ ‘ইবাদত’ হিসেবেই করে। কোনো নাস্তিক তা করে না। শুধু ‘‘বিশ্বাসীরা-ই’’ এরূপ কর্ম করে। যে বিশ্বাসী যার মধ্যে এরূপ অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করে তাকে উদ্দেশ্য করেই এরূপ কর্ম করে। সকল সমাজের সকল ভাষার মানুষই এগুলো জানেন। পূজা, অর্চনা, বলি, কুরবানী, মানত, সাজদা, প্রার্থনা, জপ ইত্যাদি এ জাতীয় কর্ম। পাশাপাশি কিছু কর্ম আছে যা মানুষ ইবাদত হিসেবেও করে এবং জাগতিকভাবেও করে। যেমন প্রশংসা করা, ভয় করা, আনুগত্য করা ইত্যাদি। এগুলো মানুষ হিসেবে জাগতিকভাবে এক মানুষ অন্য মানুষের জন্য করে। আবার ‘মা’বূদ’ বা পূজিত সত্তার জন্যও করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রথম প্রকারের কর্ম আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করাই শিরক। যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য মানত, বলি, উৎসর্গ, জবাই, অলৌকিক সাহায্য প্রার্থনা ইত্যাদি করা। এগুলো কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করলে তা শিরক বলে গণ্য হবে। কারণ, কারো ভিতরে ঈশ্বরত্ব (divinity), ঐশ্বরিক ক্ষমতা, অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা, চূড়ান্ত আধিপত্য, অলৌকিক শক্তি ইত্যাদি কল্পনা না করলে কেউ তার জন্য এরূপ কর্ম করে না। আর দ্বিতীয় প্রকারের কর্ম ইবাদাত কিনা তা নির্ভর করবে কর্মকারীর উদ্দেশ্য বা চেতনার উপর। কাউকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করে চূড়ান্ত ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশের অনুভূতি নিয়ে এরূপ কর্ম করলে তা শিরক বলে গণ্য হবে। এ বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রাহ) বলেন:
اِعْلَمْ أَنَّ الْعِبَادَةَ هِيَ التَّذَلُّلُ الأَقْصَى. وَكَوْنُ التَّذَلُّلِ أَقْصَى مِنْ غَيْرِهِ لاَ يَخْلُو إِمَّا أَنْ يَكُوْنَ بِالصُّوْرَةِ- مِثُلُ كَوْنِ هَذَا قِيَاماً وَذَلِكَ سُجُوْداً- أَوْ بِالنِّيَّةِ بِأَنْ نَوَى بِهَذَا الْفِعْلِ تَعْظِيْمَ الْعِبَادِ لِمَوْلاَهُمْ، وَبِذَلِكَ تَعْظِيْمَ الرَّعِيَّةِ لِلْمُلُوْكِ، أَوِ التَّلاَمِذَةِ لِلأُسْتَاذِ، لاَ ثَالِثَ لَهُمَا.
‘‘জেনে রাখ, ইবাদত হলো চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয়। কোন্ ভক্তি-বিনয় চূড়ান্ত এবং কোন্টি চূড়ান্ত নয় তা দুভাবে জানা যায়: (১) ভক্তি-বিনয়ের প্রকার থেকে, যেমন দাঁড়িয়ে ভক্তি করা চূড়ান্ত ভক্তি নয় তবে সাজদা করা চূড়ান্ত ভক্তি এবং (২) নিয়্যাত বা উদ্দেশ্য থেকে, যেমন বান্দা হিসেবে তার মাবূদকে ভক্তি করার উদ্দেশ্যে যে ভক্তি বা বিনয় প্রকাশ করা হয় তা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। আর প্রজা হিসেবে রাজার বা ছাত্র হিসেবে শিক্ষকের ভক্তির নিয়েতে যা করা হয় তা চূড়ান্ত ভক্তি নয় বলে গণ্য। ভক্তি-বিনয় চূড়ান্ত পর্যায়ের কি না তা জানার তৃতীয় কোনো পথ নেই।’’[1]
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, তাওহীদুল ইবাদাতের অর্থ সকল প্রকার ইবাদাত- যেমন প্রার্থনা, সাজদা, জবাই, উৎসর্গ, মানত, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি- একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য বলে বিশ্বাস করা। আর কুরআন ও হাদীস থেকে আমরা দেখি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) ও পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূল তাঁদের উম্মাতকে মূলত ‘‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’’ বা ইবাদতের একত্বের দাওয়াত দিয়েছেন। আল্লাহর অস্তিত্বে বা আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের একত্বে বিশ্বাসের দাওয়াত তাঁদের মূল বিষয় ছিল না। কারণ রুবুবিয়্যাত বিষয়ে মূলত কোনো আপত্তি ছিল না। যুগে যুগে কাফিরদের আপত্তি, সংশয়, বিরোধ ও শিরক ছিল মূলত তাওহীদুল ইবাদত কেন্দ্রিক।[1]
এ বিশ্বের একাধিক স্রষ্টা আছেন অথবা কোনো স্রষ্টা নেই- এ ধরনের বিশ্বাস খুবই কম মানুষই করেছে বা করে। সকল যুগে সকল দেশের প্রায় সব মানুষই মূলত বিশ্বাস করেছেন এবং করেন যে, এ বিশ্বের একজনই স্রষ্টা ও প্রতিপালক রয়েছেন। কিন্তু তারা উপাসনা বা ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁর সাথে ফিরিশতা, নবী, নেককার মানুষ, জিন্ন, অন্যান্য দেবদেবী, পাথর, গাছপালা, মানুষের মুর্তি, স্মৃতিবিজড়িত স্থান, দ্রব্য বা স্মৃতিচিহ্নের পূজা, উপাসনা বা ‘ভক্তি’ করেছেন। তারা ভেবেছেন যে, আল্লাহ এদেরকে কিছু দায়িত্ব বা ক্ষমতা প্রদান করেছেন অথবা এদের সাথে আল্লাহর বিশেষ সম্পর্কের কারণে এদের দাবি আল্লাহ না মেনে পারেন না, অথবা এদের মাধ্যম ছাড়া আল্লাহর বন্ধুত্ব, ক্ষমা বা করুণা লাভ সম্ভব না...।
এ বিষয়ে মোল্লা আলী কারী হানাফী (১০১৪ হি) ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় বলেন: ‘‘সকল নবী-রাসূল তো কেবল তাওহীদের বর্ণনা দিতে এবং একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের দাওয়াত দিতে আগমন করেন। এজন্যই তাঁদের সকলের কথা ও দলীল ছিল একটিই: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই)। তাঁরা তাঁদের উম্মাতদের বলেন নি যে, তোমরা বল, আল্লাহ বিদ্যমান। বরং আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই- এ কথাটি পরিস্কার ও প্রতিষ্ঠা করাই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। কারণ এ সকল জাতির মানুষেরা ধারণা করত যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরও ইবাদত করা যায়। এজন্য তারা বলত[2]: ‘‘এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপাশিকারী’’, এবং ‘‘আমরা তো কেবলমাত্র এজন্যই তাদের ইবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর অধিকতর নৈকট্যে দ্রুত পৌঁছে দেবেন।’’[3]
[2] সূরা (১০) ইউনুস: ১৮ আয়াত ও সূরা (৩৯) যুমার: ৩ আয়াত।
[3] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার (ইলমিয়্যাহ), পৃ. ২৪।