উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, তাওহীদুল ইবাদাতের অর্থ সকল প্রকার ইবাদাত- যেমন প্রার্থনা, সাজদা, জবাই, উৎসর্গ, মানত, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি- একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য বলে বিশ্বাস করা। আর কুরআন ও হাদীস থেকে আমরা দেখি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) ও পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূল তাঁদের উম্মাতকে মূলত ‘‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’’ বা ইবাদতের একত্বের দাওয়াত দিয়েছেন। আল্লাহর অস্তিত্বে বা আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের একত্বে বিশ্বাসের দাওয়াত তাঁদের মূল বিষয় ছিল না। কারণ রুবুবিয়্যাত বিষয়ে মূলত কোনো আপত্তি ছিল না। যুগে যুগে কাফিরদের আপত্তি, সংশয়, বিরোধ ও শিরক ছিল মূলত তাওহীদুল ইবাদত কেন্দ্রিক।[1]
এ বিশ্বের একাধিক স্রষ্টা আছেন অথবা কোনো স্রষ্টা নেই- এ ধরনের বিশ্বাস খুবই কম মানুষই করেছে বা করে। সকল যুগে সকল দেশের প্রায় সব মানুষই মূলত বিশ্বাস করেছেন এবং করেন যে, এ বিশ্বের একজনই স্রষ্টা ও প্রতিপালক রয়েছেন। কিন্তু তারা উপাসনা বা ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁর সাথে ফিরিশতা, নবী, নেককার মানুষ, জিন্ন, অন্যান্য দেবদেবী, পাথর, গাছপালা, মানুষের মুর্তি, স্মৃতিবিজড়িত স্থান, দ্রব্য বা স্মৃতিচিহ্নের পূজা, উপাসনা বা ‘ভক্তি’ করেছেন। তারা ভেবেছেন যে, আল্লাহ এদেরকে কিছু দায়িত্ব বা ক্ষমতা প্রদান করেছেন অথবা এদের সাথে আল্লাহর বিশেষ সম্পর্কের কারণে এদের দাবি আল্লাহ না মেনে পারেন না, অথবা এদের মাধ্যম ছাড়া আল্লাহর বন্ধুত্ব, ক্ষমা বা করুণা লাভ সম্ভব না...।
এ বিষয়ে মোল্লা আলী কারী হানাফী (১০১৪ হি) ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় বলেন: ‘‘সকল নবী-রাসূল তো কেবল তাওহীদের বর্ণনা দিতে এবং একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের দাওয়াত দিতে আগমন করেন। এজন্যই তাঁদের সকলের কথা ও দলীল ছিল একটিই: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই)। তাঁরা তাঁদের উম্মাতদের বলেন নি যে, তোমরা বল, আল্লাহ বিদ্যমান। বরং আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই- এ কথাটি পরিস্কার ও প্রতিষ্ঠা করাই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। কারণ এ সকল জাতির মানুষেরা ধারণা করত যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরও ইবাদত করা যায়। এজন্য তারা বলত[2]: ‘‘এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপাশিকারী’’, এবং ‘‘আমরা তো কেবলমাত্র এজন্যই তাদের ইবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর অধিকতর নৈকট্যে দ্রুত পৌঁছে দেবেন।’’[3]
[2] সূরা (১০) ইউনুস: ১৮ আয়াত ও সূরা (৩৯) যুমার: ৩ আয়াত।
[3] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার (ইলমিয়্যাহ), পৃ. ২৪।