নাবী (ﷺ) মদ্বীনার ইহুদীদের সাথে একটি সন্ধি চুক্তি রচনা করলেন। এই মর্মে নাবী (ﷺ) ও তাদের মাঝে একটি লিখিত চুক্তিও সম্পাদিত হল। ইহুদীদের একজন বড় আলেম ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন সালাম। তিনি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিলেন। অন্যরা কুফরীর মধ্যেই রয়ে গেল। মদ্বীনাতে ছিল তিনটি ইহুদী গোত্র। বনু কায়নুকা, বনু নযীর এবং বনু কুরায়যা। এই তিনটি ইহুদী গোত্র রসূল (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, চুক্তি ভঙ্গ করেছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু তিনি অনুগ্রহ করে বনু কায়নুকাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তবে বনু নযীরকে মদ্বীনা হতে বহিস্কার করেছেন এবং বনু কুরায়যাকে হত্যা করেছেন। আর বনু কুরায়যার অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদেরকে দাসে পরিণত করেছেন। বনু নযীরের ব্যাপারে সূরা হাশর এবং বনু কুরায়যার ব্যাপারে সূরা আহযাব নাযিল হয়েছে।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা হাফিয ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এর জীবনী কয়েক পৃষ্ঠায় লিখা সম্ভব নয়। তাঁর পূর্ণ জীবনী লিখতে একটি স্বতন্ত্র পুস্তকের প্রয়োজন। আমরা সেদিকে না গিয়ে অতি সংক্ষেপে তাঁর বরকতময় জীবনীর বেশ কিছু দিক উল্লেখ করার চেষ্টা করব।
শাইখের পূর্ণ নাম ও পরিচয়
তাঁর পূর্ণ নাম হচ্ছে, আবু আব্দুল্লাহ্ শামসুদ্দ্বীন মুহাম্মাদ বিন আবু বকর বিন আইয়্যুব ....আদ দিমাশকী। তিনি সংক্ষেপে ‘ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওযীয়া’ বলেই মুসলিম উম্মার মাঝে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর পিতা দীর্ঘ দিন দামেস্কের আল জাওযীয়া মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বলেই তাঁর পিতা আবু বকরকে قيم الجوزيةকাইয়্যিমুল জাওযীয়া অর্থাৎ মাদরাসাতুল জাওযীয়ার তত্ত্বাবধায়ক বলা হয়। পরবর্তীতে তাঁর বংশের লোকেরা এই উপাধীতেই প্রসিদ্ধি লাভ করে।
জন্ম প্রতিপালন ও শিক্ষা গ্রহণ
তিনি ৬৯১ হিজরী সালের সফর মাসের ৭ তারিখে দামেস্কে জন্ম গ্রহণ করেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এক ইলমী পরিবেশ ও ভদ্র পরিবারে প্রতিপালিত হন। মাদরাসাতুল জাওযীয়ায় তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। এ ছাড়া তিনি স্বীয় যামানার অন্যান্য আলেমে দ্বীন থেকেও জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়া (রহঃ) সর্বাধিক উল্লেখ্য। ইবনে তাইমীয়া (রহঃ) এর ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র ইবনুল কাইয়্যিমই ছিলেন তাঁর জীবনের সার্বক্ষণিক সাথী। ঐতিহাসিকদের ঐক্যমতে তিনি ৭১২ হিজরী সালে শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়ার সাথে সাক্ষাত করেন। এর পর থেকে শাইখের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর সাথেই ছিলেন। এমনকি জিহাদের ময়দান থেকে শুরু করে জেলখানাতেও তিনি তাঁর থেকে আলাদা হননি। এভাবে দীর্ঘ দিন স্বীয় উস্তাদের সাহচর্যে থেকে যোগ্য উস্তাদের যোগ্য শিষ্য এবং শাইখের ইলম এবং দার্স-তাদরীসের সঠিক ওয়ারিছ হিসাবে গড়ে উঠেন। সেই সাথে স্বীয় পান্ডিত্য বলে এক অভিনব পদ্ধতিতে ইসলামী আকীদাহ ও তাওহীদের ব্যাখ্যা দানে পারদর্শিতা লাভ করেন।
তাঁর সম্পর্কে বলা হয় যে, শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়া (রহঃ) এর সাথে সাক্ষাতের পূর্বে তিনি সুফীবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। অতঃপর শাইখের সাহচর্য পেয়ে এবং তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি সুফীবাদ বর্জন করেন এবং তাওবা করে হিদায়াতের পথে চলে আসেন। তবে এ তথ্যটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত নয় বলে কতিপয় আলেম উল্লেখ করেছেন। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, তিনি প্রথম জীবনে সুফী তরীকার অনুসারী ছিলেন, তবে এমনটি নয় যে, তিনি বর্তমান কালের পঁচা, নিকৃষ্ট ও শিরক-বিদআতে পরিপূর্ণ সুফীবাদে বিশ্বাসী ছিলেন; বরং তিনি পূর্ব কালের সেই সমস্ত সম্মানিত মনীষির পথ অনুসরণ করতেন, যারা পার্থিব জীবনের ভোগ-বিলাস বর্জন করে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য আত্মশুদ্ধি, উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন, ইবাদত-বন্দেগী ও যিকির-আযকারে মশগুল থাকতেন এবং সহজ-সরল ও সাধারণ জীবন যাপন করতেন। আর এটি কোন দোষণীয় বিষয় নয়।
আল্লামা ইবনে তাইমীয়ার পর ইবনুল কাইয়্যিমের মত দ্বিতীয় কোন মুহাক্কিক আলেম পৃথিবীতে আগমন করেছেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি ছিলেন তাফসীর শাস্ত্রে বিশেষ পান্ডিত্যের অধিকারী, উসূলে দ্বীন তথা আকীদাহর বিষয়ে পর্বত সদৃশ, হাদীস ও ফিকহ্ শাস্ত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী এবং নুসূসে শরঈয়া থেকে বিভিন্ন হুকুম-আহকাম বের করার ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়।
সুতরাং একদিকে তিনি যেমন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমীয়ার ইলমী খিদমাতসমূহকে একত্রিত করেছেন, এগুলোর অসাধারণ প্রচার-প্রসার ঘটিয়েছেন, শাইখের দাওয়াত ও জিহাদের সমর্থন করেছেন, তাঁর দাওয়াতের বিরোধীদের জবাব দিয়েছেন এবং তাঁর ফতোয়া ও মাসায়েলের সাথে কুরআন ও সুন্নাহ্-এর দলীল যুক্ত করেছেন, সেই সাথে তিনি নিজেও এক বিরাট ইলমী খেদমত মুসলিম জাতিকে উপহার দিয়েছেন।
ডাক্তারী বিজ্ঞানের আলেমগণ বলেন- আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) তাঁর লিখিত কিতাব ‘তিবেব নববী’তে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে সমস্ত বিরল অভিজ্ঞতা ও উপকারী তথ্য পেশ করেছেন এবং চিকিৎসা জগতে যে সমস্ত বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন, তা চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে চিরকাল অমস্নান হয়ে থাকবে। তিনি একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার হিসাবেও পারদর্শীতা অর্জন করেছিলেন।
কাযী বুরহান উদ্দ্বীন (রহঃ) বলেন- আকাশের নীচে তার চেয়ে অধিক প্রশস্ত জ্ঞানের অধিকারী সে সময় অন্য কেউ ছিল না।
ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এর কিতাবগুলো পাঠ করলে ইসলামের সকল বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। আরবী ভাষা জ্ঞানে ও শব্দ প্রয়োগে তিনি অত্যন্তনিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন। তার লেখনীর ভাষা খুব সহজ। তাঁর উস্তাদের কিছু কিছু লিখা বুঝতে অসুবিধা হলেও তাঁর কিতাবসমূহের ভাষা খুব সহজ ও বোধগম্য।
তার অধিকাংশ কিতাবেই দ্বীনের মৌলিক বিষয় তথা আকীদাহ ও তাওহীদের বিষয়টি অতি সাবলীল, প্রাঞ্জল ও চিত্তাকর্ষক ভাষায় ফুটে উঠেছে। সুন্নাতে রসূল (ﷺ) এর প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালবাসা। বিদআত ও বিদআতীদের প্রতিবাদে তিনি ছিলেন স্বীয় উস্তাদের মতই অত্যন্তকঠোর। লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে সুন্নাত বিরোধী কথা ও আমলের মূলোৎপাটনে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেন নি। তাওহীদের উপর তিনি মজবুত ও একনিষ্ঠ থাকার কারণে এবং শিরক ও বিদআতের জোরালো প্রতিবাদের কারণে তাঁর শত্রুরা তাকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। তাকে গৃহবন্দী, দেশান্তর এবং জেলখানায় ঢুকানোসহ বিভিন্ন প্রকার মসীবতে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এত নির্যাতনের পরও তিনি স্বীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হতে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়াননি।
কর্মজীবন
জওযীয়া নামক মহল্লার ইমামতি, শিক্ষকতা, ফতোয়া দান, দাওয়াতে দ্বীনের প্রচার ও প্রসার ঘটানো এবং লেখালেখির মাধ্যমেই তিনি তাঁর কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। যে সমস্ত মাসআলার কারণে তিনি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন, তার মধ্যে এক সাথে তিন তালাকের মাসআলা, আল্লাহর নাবী ইবরাহীম খলীল (আঃ) এর কবরে ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করার মাসআলা এবং শাফা‘আত এবং নাবী-রসূলদের উসীলার মাসআলা অন্যতম। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর উপর রহম করুন। এটিই নাবী-রাসূলের পথ। যে মুসলিম আল্লাহর পথে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে, তাঁর জেনে রাখা উচিৎ যে, তিনি ইমামুল মুওয়াহ্হিদ্বীন ইবরাহীম খলীল (আঃ) এবং বনী আদমের সরদার মুহাম্মাদ (ﷺ) এর পথেই রয়েছেন। মুসলিম উম্মার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশাল দ্বীনি খেদমত রেখে গেছেন। তাঁর বেশ কিছু ইলমী খেদমত নিম্নে উল্লেখ করা হল।
(আস্ সাওয়ায়েকুল মুরসালাহ) الصواعق المرسلة ১.
(যাদুল মা‘আদ ফী হাদ্য়ী খাইরিল ইবাদ) زاد المعاد في هدي خير العباد ২.
(মিফতাহু দারিস সাআদাহ )مفتاح دار السعادة ৩.
(মাদারিজুস্ সালিকীন)مدارج السالكين ৪.
(আল-কাফীয়াতুশ শাফিয়া ফীন্ নাহু) الكافية الشافية في النحو ৫.
(আল-কাফীয়াতুশ শাফীয়া ফীল ইনতিসার লিলফিরকাতিন নাজীয়াহ ) الكافية الشافية في الانتصار للفرقة ৬.
(আল-কালিমুত তায়্যিবু ওয়াল আমালুস সালিহু) الكلم الطيب والعمل الصالح ৭.
(আল-কালামু আলা মাসআলাতিস্ সামাঈ )الكلام على مسألة السماع ৮.
(হিদায়াতুল হায়ারা ফী আজভিবাতিল ইয়াহুদ ওয়ান্ নাসারা)هداية الحيارى في أجوبة اليهودوالنصارى ৯.
(আলমানারুল মুনীফ ফীস্ সহীহ ওয়ায্ যঈফ) المنار المنيف في الصحيح والضعيف ১০.
(ইলামুল মআক্কীয়িন )أعلام الموقعين عن رب العالمين ১১
(আল-ফুরুসীয়াহ) الفروسية ১২.
(তরীকুল হিজরাতাইন ও বাবুস্ সাআদাতাইন) طريق الهجرتين وباب السعادتين ১৩.
(আত্ তুরুকুল হুকামিয়াহ ) الطرق الحكمية ১৪.
(আল-ফাওয়ায়েদ) الفوائد ১৫.
(হাদীল আরওয়াহ ইলা বিলাদিল আফরাহ) حادي الأرواح إلى بلاد الأفراح ১৬.
(আল-ওয়াবিলুস্ সাইয়্যিব) الوابل الصيب ১৭.
(উদ্দাতুস সাবিরীন ও যাখীরাতুশ্ শাকিরীন) عدة الصابرين وذخيرة الشاكرين ১৮.
(তাহ্যীবু সুনানে আবী দাউদ) تهذيب سنن أبي داود ১৯.
(আস্ সিরাতুল মুসতাকীম) الصراط المستقيم ২০.
(শিফাউল আলীল) شفاء العليل ২১.
(কিতাবুর রূহ্) كتاب الروح ২২.
এ ছাড়াও তাঁর আরও কিতাব রয়েছে, যা এখনও আমাদের নযরে পড়েনি।
তাঁর ইবাদত-বন্দেগী ও আখলাক-চরিত্র
আল্লামা ইবনে রজব (রহঃ) তাঁর ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে বলেন- তিনি ছিলেন ইবাদতকারী, তাহাজ্জুদ গোজার, সলাতে দীর্ঘ কিরাআত পাঠকারী, সদা যিকির-আযকারে মশগুল, আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবা-ইসতেগফারকারী, আল্লাহর সামনে এবং তাঁর দরবারে কাকুতি-মিনতি পেশকারী। তিনি আরও বলেন- আমি তাঁর মত ইবাদত গোজার অন্য কাউকে দেখিনি, তাঁর চেয়ে অধিক জ্ঞানী অন্য কাউকে পাইনি, কুরআন, সুন্নাহ্ এবং তাওহীদের মাসআলা সমূহের ব্যাখ্যা সম্পর্কে তাঁর চেয়ে অধিক পারদর্শী অন্য কেউ ছিলনা। তবে তিনি মা’সুম তথা সকল প্রকার ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন না। দ্বীনের পথে তিনি একাধিকবার বিপদাপদ ও ফিতনার সম্মুখীন হয়েছেন। এ সব তিনি অত্যন্তধৈর্যের সাথে বরদাশত করেছেন। সর্বশেষে তিনি দামেস্কের দূর্গে শাইখ তকীউদ্দ্বীনের সাথে বন্দী ছিলেন। শাইখের মৃত্যুর পর তিনি জেলখানা থেকে বের হন। জেল খানায় থাকা অবস্থায় তিনি কুরআন তিলাওয়াত এবং কুরআনের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় লিপ্ত থাকতেন।
আল্লামা ইবনে কাছীর (রহঃ) তাঁর সম্পর্কে বলেন- আমাদের যামানায় ইবনুল কাইয়্যিমের চেয়ে অধিক ইবাদতকারী অন্য কেউ ছিলেন বলে জানিনা, তিনি অত্যন্তদীর্ঘ সলাত পড়তেন এবং রুকূ ও সিজদাহ লম্বা করতেন। এ জন্য অনেক সময় তাঁর সাথীগণ তাঁকে দোষারোপ করতেন। তথাপিও তিনি স্বীয় অবস্থানে অটল থাকতেন।
তাঁর উস্তাদ বৃন্দ
- আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) যে সমস্ত আলেম-উলামার কাছ থেকে তালীম ও তারবীয়াত হাসিল করেন, তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ
- শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়াহ (রহঃ)।
- আহমাদ বিন আব্দুদ্ দায়িম আল-মাকদেসী (রহঃ)।
- তাঁর পিতা কাইয়্যিমুল জাওযীয়াহ (রহঃ)।
- আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আন্ নাবলেসী (রহঃ)।
- ইবনুস্ সিরাজী (রহঃ)।
- আল-মাজদ্ আল হাররানী (রহঃ)।
- আবুল ফিদা বিন ইউসুফ বিন মাকতুম আলকায়সী (রহঃ)।
- হাফিয ইমাম আয-যাহাবী (রহঃ)।
- শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমীয়ার ভাই শরফুদ্দ্বীন আব্দুল্লাহ্ বিন আব্দুল হালীম ইবনে তাইমীয়াহ্ আন্ নুমাইরী (রহঃ)।
- তকীউদ্দ্বীন সুলায়মান বিন হামজাহ আদ্ দিমাস্কী (রহঃ) এবং আরও অনেকেই।
তাঁর ছাত্রসমূহ
- ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এর হাতে যে সমস্ত মনীষী জ্ঞান আহরণে ধন্য হয়েছিলেন, তাদের তালিকা অতি বিশাল। তাদের কতিপয়ের নাম নিম্নে উল্লেখ করা হল।
- বুরহান উদ্দ্বীন ইবরাহীম বিন ইবনুল কাইয়্যিম।
- ইমাম ইবনে রজব (রহঃ)।
- হাফিয ইমাম ইবনে কাছীর (রহঃ)।
- আলী বিন আব্দুল কাফী আস্ সুবকী (রহঃ)।
- মুহাম্মাদ বিন আহমাদ ইবনে কুদামা আলমাকদেসী (রহঃ)।
- মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব আলফাইরুযাবাদী (রহঃ)।
মৃত্যু
মুসলিম উম্মার জন্য অসাধারণ ইলমী খেদমত রেখে এবং ইসলামী লাইব্রেরীর বিরাট এক অংশ দখল করে হিজরী ৭৫১ সালের রজব মাসের ১৩ তারিখে এই মহা মনীষী এ নশ্বর ইহধাম ত্যাগ করেন। দামেস্কের বাবে সাগীরের গোরস্থানে তাঁর পিতার পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। হে আল্লাহ্! তুমি তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান কর এবং তোমার রহমত দিয়ে তাঁকে ঘিরে নাও। আমীন!
اَلْحَمْدُ ِللهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ وَأَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَه” لَا شَرِيْكَ لَه” وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًاعَبْدُه” وَرَسُوْلُه” أَمَّابَعْدُ:
আল্লাহ্ তা‘আলা সকল সৃষ্টির একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। আর তিনিই মাখলুক হতে যা ইচ্ছা নির্বাচন করেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ مَا كَانَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ سُبْحَانَ اللهِ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْركُون
‘‘হে রসূল! তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং ইখতিয়ার (বাছাই) করেন। এ ব্যাপারে তাদের কোন ইখতিয়ার নেই। আল্লাহ্ পবিত্র এবং তারা যাকে তাঁর শরীক সাব্যস্ত করে, তিনি তা থেকে উর্ধ্বে’’।[1]
এই আয়াতে ইখতিয়ার দ্বারা নির্বাচন, বাছাই ও চয়ন করা উদ্দেশ্য। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ما كان لهم الخيرة অর্থাৎ (আল্লাহ্ তা‘আলার ইখতিয়ার বা নির্বাচনে) বান্দার কোন অধিকার নেই। আল্লাহ্ তা‘আলা যেমন একাই সকল মাখলুক সৃষ্টি করেছেন, তেমনি তিনি একাই সৃষ্টি থেকে যা ইচ্ছা বাছাই ও পছন্দ করেছেন। সুতরাং নির্বাচন, বাছাই ও চয়ন করার ক্ষেত্রসমূহ সম্পর্কে তিনিই অধিক অবগত আছেন। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
اللهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ
‘‘আল্লাহ্ এ বিষয়ে সুপরিজ্ঞাত যে, কোথায় স্বীয় রিসালাত প্রেরণ করতে হবে’’।[2] আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-
وَقَالُوا لَوْلا نزلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا وَرَحْمَةُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ
‘‘তারা বলে, কুরআন কেন দুই জনপদের কোন প্রধান ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ হল না? তারা কি তোমার পালনকর্তার রহমত বণ্টন করে? আমি তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করেছি পার্থিব জীবনে এবং একের মর্যাদাকে অপরের উপর উন্নীত করেছি, যাতে একে অপরকে সেবক রূপে গ্রহণ করে। তারা যা সঞ্চয় করে, তোমার পালনকর্তার রহমত তদপেক্ষা উত্তম’’।[3]
এখানে আল্লাহ্ তা‘আলা মুশরিকদের ইখতিয়ারের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহর পছন্দ ও বাছাইয়ে তাদের কোন দখল নেই। এ বিষয়টি শুধু সেই সত্তার অধিকারে, যিনি তাদের রিযিক বণ্টন করেছেন এবং বয়স নির্ধারণ করেছেন। আর তিনিই সম্মানিত বান্দাদের মাঝে স্বীয় অনুগ্রহ ও রহমত ভাগ করেন। তিনি ভাল করেই জানেন কে নবুওয়াত, রিসালাত এবং অনুগ্রহ পাওয়ার হকদার আর কে এগুলো পাওয়ার হকদার নয়। তিনি স্বীয় বান্দাদের কাউকে অন্য কারও উপর মর্যাদা দিয়েছেন। মুশরিকরা যে শিরক ও যে প্রস্তাব ইখতিয়ার করেছিল, আল্লাহ্ তা‘আলা তার অনেক উর্ধ্বে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
مَا كَانَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ سُبْحَانَ اللهِ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘আল্লাহর ইখতিয়ারে (বাছাইয়ে) তাদের কোন দখল নেই। আল্লাহ্ পবিত্র এবং তারা যাকে তাঁর সাথে শরীক সাব্যস্ত করে, তিনি তার উর্ধ্বে’’।[4] যেহেতু মুশরিকদের শিরকের দ্বারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন স্রষ্টার অসিত্মবত্ব প্রমাণিত হয়না, তাই উপরোক্ত আয়াতে শুধু অন্য সৃষ্টিকর্তা থাকার প্রতিবাদ করা হয়নি; বরং তাদের শিরকী প্রস্তাবেরও প্রতিবাদ করা হয়েছে। মোট কথা, মক্কার মুশরিকরা এটি দাবী করতনা যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সৃষ্টিকর্তা আছে; বরং তারা বিশ্বাস করত, সৃষ্টিকর্তা এবং রিযিক দাতা একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা। এই অর্থেই আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللهِ لَنْ يَخْلُقُوا ذُبَابًا وَلَوِ اجْتَمَعُوا لَهُ وَإِنْ يَسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئًا لا يَسْتَنْقِذُوهُ مِنْهُ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوبُ مَا قَدَرُوا اللهَ حَقَّ قَدْرِهِ إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ
‘‘তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবেনা, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবেনা। প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন। তারা আল্লাহর যথাযোগ্য মর্যাদা বুঝেনি। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ শক্তিধর, পরাক্রমশীল’’।[5] আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَيَوْمَ يُنَادِيهِمْ فَيَقُولُ مَاذَا أَجَبْتُمُ الْمُرْسَلِينَ فَعَمِيَتْ عَلَيْهِمُ الأنْبَاءُ يَوْمَئِذٍ فَهُمْ لا يَتَسَاءَلُونَ فَأَمَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَعَسَى أَنْ يَكُونَ مِنَ الْمُفْلِحِينَ وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ مَا كَانَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ سُبْحَانَ اللهِ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘যেদিন আল্লাহ্ তাদেরকে ডেকে বলবেন, তোমরা রসূলগণকে কি জবাব দিয়েছিলে? অতঃপর তাদের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যাবে এবং তাদের একে অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেনা। তবে যে তাওবা করে, বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আশা করা যায়, সে সফলকাম হবে’’ আপনার প্রতিপালক যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং পছন্দ করেন। এ ব্যাপারে তাদের কোন ইখতিয়ার নেই। আল্লাহ্ পবিত্র এবং তারা যাকে তাঁর শরীক সাব্যস্ত করে, তিনি তার অনেক ঊর্ধ্বে।’’[6] সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা যেমন একাই সৃষ্টি করেছেন, তেমনি তাঁর সৃষ্ট বান্দাদের মধ্য হতে যারা তাওবা করে, ঈমান আনয়ন করে এবং সৎ আমল করে আল্লাহ্ তা‘আলার সর্বোত্তম বান্দায় পরিণত হয় এবং সফলকাম হয়, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে পছন্দ ও নির্বাচন করেন। এই পছন্দ ও বাছাই করার বিষয়টি সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। তিনি স্বীয় হিকমত ও ইলম অনুপাতে যাকে যোগ্য পান, তাকেই পছন্দ করেন ও নির্বাচন করেন। এই সমস্ত মুশরিকদের ইচ্ছা ও প্রস্তাব মোতাবেক তিনি কাউকে বাছাই করেন না। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের শিরক ও শরীকসমূহ থেকে পবিত্র এবং এগুলোর অনেক উর্ধ্বে।
সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা যেমন মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তেমনি তাদের থেকে নাবী-রসূলদেরকে বাছাই ও নির্বাচন করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলার মহান হিকমতের দাবী অনুযায়ী এবং বনী আদমের স্বার্থেই এই বাছাই ও নির্বাচন। এতে আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারও পরামর্শ, প্রস্তাব এবং বাছাইয়ের কোন দখল নেই। আল্লাহ্ তা‘আলার এই বাছাই, পছন্দ ও নির্বাচন পৃথিবীতে তাঁর রুবূবীয়াতের বিরাট এক নিদর্শন, তাঁর একত্বের সর্ব বৃহৎ দলীল, তাঁর পরিপূর্ণ গুণাবলীর প্রমাণ এবং রসূলদের সত্যায়নের সুস্পষ্ট দলীল।
আল্লাহ্ তা‘আলা সাতটি আসমান সৃষ্টি করেছেন। এগুলোর মধ্যে হতে সর্বশেষ ও উপরেরটিকে তাঁর নিকটবর্তী ফিরিস্তাদের অবস্থানের স্থান হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। এটিকে তাঁর কুরসী ও আরশের নিকটে রেখেছেন এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে হতে যাকে ইচ্ছা এখানে বসবাস করিয়েছেন। সুতরাং অন্যান্য আকাশের উপর এই আকাশের রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট ও ফযীলত। তা ছাড়া আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়াই সপ্তম আকাশের ফযীলতের জন্য যথেষ্ট।
আল্লাহ্ তা‘আলার মাখলুক সমূহের কোনটিকে অন্যটির উপর প্রাধান্য দেয়ার ধারাবাহিকতায় সমস্ত জান্নাতের উপর জান্নাতুল ফেরদাউসকে আল্লাহ্ তা‘আলা সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন এবং আল্লাহ্ তা‘আলা আরশকে এর ছাদ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।
এই নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় আল্লাহ্ তা‘আলা ফিরিস্তাদের থেকে কতিপয়কে বাছাই ও পছন্দ করেছেন। যেমন জিবরীল, মিকাঈল এবং ইসরাফীল (আঃ) কে ফিরিস্তাদের থেকে বাছাই করেছেন এবং অন্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। নাবী (ﷺ) বলেন-
اللّٰهُمَّ رَبَّ جِبْرِيلَ وَمِيكَائِيلَ وَإِسْرَافِيلَ فَاطِرَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ اهْدِنِى لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ إِنَّكَ أَنْتَ تَهْدِى مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
‘‘হে আল্লাহ্! তুমি জিবরীল, মিকাঈল এবং ইসরাফীলের প্রভু, আসমান-যমিনের সৃষ্টিকারী, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল বস্ত্ত সম্পর্কে অবগত, তুমি তোমার বান্দাদের মতভেদের বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী। যে হকের ব্যাপারে লোকেরা মতভেদে লিপ্ত রয়েছে, তোমার তাওফীকে আমাকে তাতে দৃঢ়পদ রাখ। তুমি যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করে থাক।[7]
এমনিভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা আদমের সন্তানদের থেকে আম্বীয়ায়ে কেরামদেরকে মুন্তাখাব (চয়ন) করেছেন। তাদের থেকেও আবার কতককে রসূল হিসাবে নির্বাচন করেছেন।
রসূলদের মধ্য হতে আবার পাঁচজন উলুল আয্মকে (সুদৃঢ় ইচ্ছা শক্তি সম্পন্ন রসূলকে) বাছাই করেছেন। এই পাঁচ জনের আলোচনা সূরা আহযাব ও সূরা শুরায় করা হয়েছে। এই পাঁচজন থেকে আবার ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ (ﷺ) কে খলীল (খাস বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
এই নির্বাচন ও বাছাইয়ের ধারাবাহিকতায় আল্লাহ্ তা‘আলা আদমের সকল সন্তান থেকে ইসমাঈল (আঃ) এর বংশধরকে বাছাই করেছেন। তাদের থেকে বাছাই করেছেন বনী কেনানার সন্তানদেরকে। বনী কেনানার সন্তানদের থেকে বাছাই করেছেন কুরাইশ সম্প্রদায়কে এবং কুরাইশ থেকে বনী হাশেমকে। সর্বশেষে বনী হাশেম থেকে আদমের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মুহাম্মাদ (ﷺ) কে সর্বশ্রেষ্ঠ রসূল হিসাবে মনোনীত করেছেন, পৃথিবীর সর্বোত্তম দেশকে তাঁর আবাসস্থল বানিয়েছেন এবং তাঁর উম্মাতকে অন্যান্য সকল উম্মাতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য দিয়েছেন।
এই উম্মাতের প্রথম সারির লোকদেরকে মুহাম্মাদ (ﷺ) এর সাথী নির্বাচন ও নির্ধারণ করেছেন। তাদের মধ্যে আবার বদর যুদ্ধে ও বায়আতুর রিযওয়ানে অংশ গ্রহণকারীগণ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। দ্বীন পালনে তারা ছিলেন অগ্রগামী, শরীয়তের হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নে তারা ছিলেন সর্বাধিক অগ্রসর এবং তাদের আখলাক-চরিত্র ছিল সর্বাধিক পবিত্র ও উন্নত।
মুসনাদে আহমাদে মুআবীয়া বিন হায়দাহ (রাঃ) হতে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রসূল (ﷺ) বলেন- তোমাদের দ্বারা সত্তরটি উম্মাত পূর্ণ হবে। তার মধ্যে তোমরাই আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট সর্বোত্তম এবং সর্বাধিক সম্মানিত।
উম্মাতে মুহাম্মাদীয়ার লোকদের আখলাক, আমল এবং তাওহীদের প্রভাব তাদের প্রাধান্য ও ফযীলতের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। জান্নাতে ও হাশরের ময়দানেও তাদের মর্যাদা হবে সুস্পষ্ট। রসূল (ﷺ) বলেন- কিয়ামতের দিন আমার সমস্ত উম্মাতকে একটি উঁচু স্থানে রাখা হবে। আর বাকী উম্মাতদের রাখা হবে অন্য একটি টিলায়। তবে আমার উম্মাতের স্থানটি অধিকতর উঁচু হবে। তারা আমার উম্মাতের দিকে মাথা উঠিয়ে তাকাবে। তিরমিযী শরীফে বুরায়দা বিন হুসাইব (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, রসূল (ﷺ) বলেন-
أَهْلُ الْجَنَّةِ عِشْرُوْنَ وَمِائَة صف ثَمَانُوْنَ مِنْهَا مِنْ هذِهِ الْأُمَّةِ وَأَرْبَعُوْنَ مِنْ سَائِرِ الْأُمَمِ
‘‘জান্নাতবাসীগণ একশত বিশ কাতার হবে। এই উম্মাত (উম্মাতে মুহাম্মাদী) থেকে আশি কাতার। আর বাকী সমস্ত উম্মাত থেকে হবে চল্লিশ কাতার’’।[8] ইমাম তিরমিযী বলেন- এই হাদীসটি হাসান। অন্য হাদীছে রয়েছে, নাবী (ﷺ) বলেন- আল্লাহর শপথ! আমি আশা করি, তোমরা হবে জান্নাত বাসীদের অর্ধেক। এই হিসাবে ষাট কাতার হওয়ার কথা। এর বেশী নয়। উভয় বর্ণনার মধ্যকার দ্বন্ধের সমাধানে একাধিক কথা রয়েছে। অর্ধেকের বর্ণনাটিই অধিকতর সঠিক। অথবা বলা যায় যে, প্রথমে নাবী (ﷺ) চেয়েছিলেন, জান্নাতবাসীদের অর্ধেক তাঁর উম্মাত থেকে হোক। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রিয় খলীলকে জানিয়ে দিলেন যে, জান্নাত বাসীদের একশত বিশ কাতারের মধ্যে হতে তাঁর উম্মাত হবে আশি কাতার। সুতরাং উভয় হাদীছের মধ্যে কোন দ্বন্দ অবশিষ্ট রইলনা। আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
[2]. সূরা আনআম-৬:১২৪
[3]. সূরা যুখরুফ-৪৩:৩১-৩২
[4]. সূরা কাসাস-২৮:৬৮
[5]. সূরা হাজ্জ-২২:৭৩-৭৪
[6]. সূরা কাসাস-২৮:৬৭
[7]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ রাতের সলাতের দুআ, মুসলিম, হাএ. হা/১৬৯৬ ইফা. হা/১৬৮১, আপ্র. হা/১৬৮৮
আবু দাউদ, আলএ. হা/৭৬৭,নাসাঈ, মাপ্র. হা/১৬২৫ সহীহ আত-তিরমিযী, মাপ্র. হা/৩৪২০
[8]. মিশকাতুল মাসাবীহ, অধ্যায়ঃ জান্নাত ও জান্নাতীদের বৈশিষ্ট্য হাএ. হা/৫৬৪৪। ইমাম আলবানী রহঃ) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। সহীহ আত-তিরমিযী, মাপ্র. হা/২৫৪৬, সহীহ ইবনে মাজাহ,তাও.হা/৪২৮৯
সুতরাং উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা হতে জানা গেল, আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেক বস্ত্ত হতে কেবল পবিত্র বস্ত্তই পছন্দ করেছেন এবং নিজের জন্য তা নির্বাচন করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র। তিনি পবিত্র বস্ত্ত ছাড়া অন্য কিছুকেই ভালবাসেন না। আল্লাহর দরবারে পবিত্র কথা, পবিত্র আমল এবং পবিত্র দান-খয়রাতই পৌঁছে।
পবিত্র বস্ত্ত সংগ্রহ ও নির্বাচন করা বা না করার মধ্যেই বান্দার সৌভাগ্যবান হওয়া বা দুর্ভাগা হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে। পবিত্র ব্যক্তির জন্য কেবল পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করা শোভনীয়। পবিত্র বান্দা কেবল পবিত্র জিনিষ পেয়েই সন্তুষ্ট হয়, তা পেয়েই স্থির হয় এবং মানুষের আত্মা তা পেয়েই প্রশান্তি লাভ করে।
বনী আদমের কথা-বার্তার মধ্য থেকে আল্লাহ্ তা‘আলা কেবল পবিত্র ও উত্তম কথাগুলোকেই পছন্দ করেন। পবিত্র কথা ছাড়া আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে অন্য কোন কথা উর্ধ্বমূখী হয়না। তিনি অশ্লীল বাক্য, মিথ্যা কথা, গীবত, চোগলখোরী, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া এবং প্রত্যেক অপবিত্র কথাকে ঘৃণা করেন।
বান্দার আমলসমূহের ক্ষেত্রেও একই কথা। তা থেকে পবিত্র ও উত্তম ছাড়া অন্য কিছুকেই আল্লাহ্ তা‘আলা কবুল করেন না। পবিত্র আমল বলতে তাকেই বুঝায়, যাকে অবিকৃত স্বভাব ও রুচি সুন্দর বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, শরীয়তে মুহাম্মাদী যার উপর জোর দিয়েছে এবং সুস্থ বিবেক যাকে পবিত্র বলেছে। আর তা হচ্ছে, বান্দা এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, তার ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক করবেনা, নিজের প্রবৃত্তি ও মর্জীর উপর আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পছন্দকে প্রাধান্য দিবে, আল্লাহর রেযামন্দি হাসিলের জন্য সকল প্রকার প্রচেষ্টা চালাবে, সাধ্যানুসারে আল্লাহর বান্দাদের উপর অনুগ্রহ করবে এবং মানুষের সাথে কেবল সে রকম আচরণই করবে, যা নিজের সাথে করাকে পছন্দ করে।
সেই সাথে স্বভাব-চরিত্রও পবিত্র এবং সুউচ্চ হওয়া আবশ্যক। আল্লাহর প্রিয় ও পবিত্র বান্দা মুহাম্মাদ (ﷺ) এর আখলাক-চরিত্র ছিল পুত-পবিত্র। সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা, দয়া, ওয়াদা-অঙ্গিকার পূর্ণ করা, সত্য বলা, অন্তরের পরিচ্ছন্নতা, বিনয়-নম্রতা, নরম-ভদ্র ব্যবহার, মানুষের কাছে কিছু চাওয়া থেকে চেহারাকে হেফাজত করা এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের কাছে নত হওয়া থেকে বিরত থাকা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ। এই পবিত্র স্বভাব ও চারিত্রিক গুণাবলী আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয়।
এমনি বান্দার উচিৎ কেবল পবিত্র খাদ্যই গ্রহণ করা। আর পবিত্র খাদ্যই হালাল, সুস্বাদু এবং শরীর এবং ‘রূহের জন্য সর্বাধিক উপকারী। সেই সাথে বান্দার ইবাদত-বন্দেগীর জন্যও নিরাপদ।
পবিত্র মুমিন বান্দার উচিৎ বিবাহ-সাদীর ক্ষেত্রেও কেবল পবিত্রকেই বেছে নেওয়া, সুগন্ধির মধ্যে হতে কেবল সর্বোত্তম সুঘ্রাণকেই নির্বাচন করা এবং পবিত্র সাথীকেই নিজের জন্য চয়ন করা। সুতরাং এমন বন্ধু গ্রহণ করা উচিৎ, যার আত্মা পবিত্র, যার শরীর পবিত্র, যার চরিত্র উত্তম, যার আমল ভাল, যার কথা পবিত্র, যার খাদ্য হালাল, যার পানীয় উত্তম, যার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র, যার বিবাহশাদী পবিত্র, যার ভিতর-বাহির পবিত্র, যার প্রস্থান পবিত্র এবং আশ্রয়স্থলসহ সবকিছুই পবিত্র। এমন পবিত্র লোকদের ব্যাপারেই আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلائِكَةُ طَيِّبِينَ يَقُولُونَ سَلامٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
‘‘ফেরেশতাগণ যাদের মৃত্যু ঘটায় পবিত্র থাকা অবস্থায় এই বলে যে, তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা যে আমল করতে, তার প্রতিদান হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ কর’’।[1] কিয়ামতের দিন আল্লাহর ফিরিস্তাগণ এই প্রকার লোকদেরকেই স্বাগত জানিয়ে বলবেনঃ
وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلهِ الَّذِي صَدَقَنَا وَعْدَهُ وَأَوْرَثَنَا الأرْضَ نَتَبَوَّأُ مِنَ الْجَنَّةِ حَيْثُ نَشَاءُ فَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ
‘‘যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করত, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা উম্মুক্ত দরজা দিয়ে জান্নাতে পেঁŠছাবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখে থাক, অতঃপর সদাসর্বদা বসবাসের জন্যে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর। তারা বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের প্রতি তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে এ ভূমির উত্তরাধিকারী করেছেন। আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা বসবাস করব। মেহনত কারীদের পুরস্কার কতই না চমৎকার’’।[2] উপরের আয়াতে فادخلوها এর মধ্যে যে فا অক্ষরটি রয়েছে, তা সাবাবীয়া তথা ‘কারণ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। পবিত্র জিনিষ নির্বাচন ও গ্রহণ করার কারণেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর। আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-
الْخَبِيثَاتُ لِلْخَبِيثِينَ وَالْخَبِيثُونَ لِلْخَبِيثَاتِ وَالطَّيِّبَاتُ لِلطَّيِّبِينَ وَالطَّيِّبُونَ لِلطَّيِّبَاتِ أُولَئِكَ مُبَرَّءُونَ مِمَّا يَقُولُونَ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
‘‘দুঃশ্চরিত্র (অপবিত্র) নারীরা দুশ্চরিত্র (অপবিত্র) পুরুষদের জন্যে এবং দুশ্চরিত্র (অপবিত্র) পুরুষরা দুশ্চরিত্র (অপবিত্র) নারীদের জন্যে। সচ্চরিত্র (পবিত্র) নারীগণ সচ্চরিত্র (পবিত্র) পুরুষদের জন্যে এবং সচ্চরিত্র পুরুষগণ সচ্চরিত্র নারীদের জন্যে। তাদের সম্পর্কে লোকেরা যা বলে, তার সাথে তারা সম্পর্কহীন। তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও সম্মান জনক জীবিকা’’।[3]
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় দু’টি মত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (১) অপবিত্র কথা-বার্তা কেবল অপবিত্র লোকদের জন্যই। আর পবিত্র লোকগণই পবিত্র কথা-বার্তা বলে থাকে। (২) পবিত্র নারীগণ শুধু পবিত্র পুরুষদের জন্যই হালাল ও শোভনীয়। আর অপবিত্র নারীরা কেবল অপবিত্র পুরুষদের জন্যই। উপরোক্ত আয়াতটি উল্লেখিত দুই অর্থ ছাড়া অধিকতর আম (ব্যাপক) অর্থে ব্যবহার করতে কোন মানা নেই। কোন খাস (বিশেষ) অর্থে ব্যবহার করার সুযোগ নেই।
সুতরাং পবিত্র কথা, পবিত্র আমল এবং পবিত্র নারীগণ পবিত্র পুরুষদের জন্য এবং পবিত্র কথা, পবিত্র আমল এবং পবিত্র পুরুষগণ পবিত্র নারীদের জন্য। অপর পক্ষে অপবিত্র কথা, অপবিত্র কাজ ও অপবিত্র নারীগণ অপবিত্র পুরুষদের জন্য। এমনি অপবিত্র কথা, অপবিত্র কাজ এবং অপবিত্র পুরুষগণ অপবিত্র নারীদের জন্য।
আল্লাহ্ তা‘আলা সমস্ত পবিত্র মানুষ ও সকল পবিত্র বস্ত্তকে জান্নাতের জন্য নির্ধারণ করেছেন এবং সকল অপবিত্র বনী আদম ও অপবিত্র জিনিষকে জাহান্নামে রাখবেন।
সুতরাং ঘর বা বাসস্থান মোট তিনটি। (১) এমন একটি ঘর, যা কেবল পবিত্র লোকদের জন্যই তৈরী করা হয়েছে। অপবিত্র লোকদের জন্য এখানে প্রবেশাধিকার নেই। এটি সকল পবিত্র মানুষ ও বস্ত্তকেই নিজের মধ্যে একত্রিত করবে। আর সেটি হচ্ছে জান্নাত। (২) এমন একটি ঘর, যাকে প্রস্ত্তত করা হয়েছে অপবিত্র নারী-পুরুষ ও অপবিত্র বস্ত্তর জন্যে। নিকৃষ্ট লোকেরাই সেখানে প্রবেশ করবে। সেটি হচ্ছে জাহান্নাম। (৩) এমন একটি ঘর, যেখানে পবিত্র-অপবিত্র নর-নারী এবং ভাল-মন্দ সকল জিনিষ এক সাথে মিশ্রিত অবস্থায় রয়েছে। আর সেটি হচ্ছে এই পার্থিব জগত তথা দুনিয়ার ঘর। ভাল-মন্দের মিশ্রণ ও মিলন ঘটিয়েই দয়াময় আল্লাহ্ এখানে বান্দাকে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন। কিন্তু যখন কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা অপবিত্রকে পবিত্র থেকে আলাদা করে ফেলবেন। পবিত্র নিয়ামাত ও নিয়ামাতপ্রাপ্ত লোকদেরকে একটি ঘরে (জান্নাতে) আলাদা করবেন। এতে তাদের সাথে অন্য কেউ থাকবেনা। আরেকটি ঘরে অপবিত্র ও নিকৃষ্ট বস্ত্ত এবং খবীছ (নিকৃষ্ট) লোকদেরকে একত্রিত করবেন। সেখানে তারা ব্যতীত অন্যরা থাকবেনা। পরিশেষে শুধু দু’টি ঠিকানাই অবশিষ্ট থাকবে। প্রথম ঠিকানা হচ্ছে জান্নাত। পবিত্র লোকেরাই সেখানে প্রবেশ করবে। আর দ্বিতীয় ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। অপবিত্র ও পাপিষ্ঠরাই সেখানে প্রবেশ করবে।
আল্লাহ্ তা‘আলা সৌভাগ্যবান এবং হতভাগ্যের জন্য বেশ কিছু আলামত নির্ধারণ করেছেন। এর মাধ্যমে তাদের মধ্যে পার্থক্য করা সহজ। সৌভাগ্যবান পবিত্র লোক কেবল পবিত্র আমলই করবে এবং পবিত্র কাজ করাই তার জন্য শোভনীয়। তার থেকে পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু বের হয়না, পবিত্র পোশাক ছাড়া সে অন্য পোশাক পরিধান করেনা।
আর হতভাগ্য অপবিত্র লোক কেবল অপবিত্র কাজ করে থাকে এবং অপবিত্র কাজই তার জন্য শোভনীয়। অপবিত্র আমল ব্যতীত তার থেকে অন্য কিছু প্রকাশ পায়না। নিকৃষ্ট এবং অপবিত্র লোকের অন্তর, জবান এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে কেবল নিকৃষ্ট বস্ত্তই বিস্ফোরিত হয়। আর পবিত্র লোকের অন্তর, জবান এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে কেবল পবিত্র বস্ত্তই বিকশিত হয় ও চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কখনও কখনও একই ব্যক্তির মধ্যে উভয় প্রকার অভ্যাসই পাওয়া যায়। এই উভয় প্রকার অভ্যাসের যেটি বান্দার উপর জয়লাভ করে, বান্দা সেই প্রকার লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ যার মধ্যে উত্তম ও পবিত্র গুণাবলী বেশী পাওয়া যাবে, তাকে পবিত্র লোকদের ঠিকানায় স্থান দেয়া হবে। আর যার মধ্যে এর বিপরীত গুণাবলী পাওয়া যাবে, তাকে অপবিত্র লোকদের ঠিকানায় পৌঁছিয়ে দেয়া হবে। আল্লাহ তা‘আলা যদি কোন বান্দার কল্যাণ চান, তাহলে তিনি তার মৃত্যুর পূর্বেই তাকে গুনাহ্ থেকে পবিত্র করে দেন। দোযখের আগুন দিয়ে তাকে পবিত্র করার প্রয়োজন পড়েনা। সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে তাওবায়ে নাসুহ তথা খাঁটি তাওবা করার তাওফীক দেন, পাপ কাজসমূহ মোচনকারী সৎ আমল করার সুযোগ করে দেন এবং এমন মসীবতে ফেলেন, যা গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয়। পরিশেষে এমন অবস্থায় সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করে যে, তার কোন গুনাহ্ থাকেনা।
আল্লাহ্ তা‘আলার হিকমতের অন্যতম দাবী হচ্ছে, কোন বান্দা অপবিত্র আমল নিয়ে তাঁর সান্নিধ্যে আগমণ করবেনা। এই জন্যই যাদের মধ্যে পাক-নাপাক উভয়ের মিশ্রণ ঘটেছে, তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করিয়ে পবিত্র ও পরিষ্কার করা হবে। যখন সে দোষ-ত্রুটি হতে পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে, তখন সে আল্লাহ্ তা‘আলার পাশে এবং তাঁর পবিত্র বান্দাদের জন্য নির্ধারিত বাসস্থানে বসবাসের উপযোগী হবে। এই প্রকার লোকদের জাহান্নামে অবস্থান এবং তা থেকে দ্রুত বা দেরীতে বের হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে তাদের দ্রুত বা দেরীতে পরিষ্কার হওয়ার উপর। তাদের মধ্যে যে দ্রুত পরিষ্কার হতে পারবে, সে অতি দ্রুত জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে। আর যার পরিষ্কার হতে দেরী হবে, সে দেরীতে বের হবে।
মুশরিকরা যেহেতু মূলতই নাপাক, তাই আগুন তাদের নাপাকী দূর করবে না। আগুন থেকে তারা যদি বেরও হয়, তথাপিও পুনরায় তাতে অপবিত্র হয়েই প্রবেশ করবে। যেমন কুকুর সমুদ্রে প্রবেশ করে তাতে ডুব দিয়ে বের হয়ে আসলেও সে নাপাকই থেকে যায়। এ জন্যই আল্লাহ্ তা‘আলা মুশরিকদের উপর জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন।
আর পবিত্র মুমিনগণ যখন অপবিত্র আমল ও আখলাক হতে মুক্ত থাকবে, তখন তাদের উপর জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যাবে। কেননা তাদের মধ্যে এমন কোন খারাপ বিষয় থাকবেনা, যা থেকে তাদেরকে পবিত্র করার প্রয়োজন হতে পারে। সেই সত্তা অতীব পবিত্র, যার হিকমত মানবীয় বিবেক-বুদ্ধিকে ধাঁধায় নিপতিত করে এবং হতবুদ্ধি করে ফেলে।
[2]. সূরা যুমার-৩৯:৭৩-৭৪
[3]. সূরা নূর-২৪:২৬
উপরোক্ত আলোচনা থেকে জানা গেল, রসূল (ﷺ) এবং তিনি যেই সুন্নাত ও দ্বীন নিয়ে আগমণ করেছেন, সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা এবং তাঁর আনুগত্য করার প্রয়োজন হচ্ছে সকল প্রকার প্রয়োজনের উর্ধ্বে। কেননা রসূল (ﷺ)-এর মাধ্যম ছাড়া দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের পথ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা, অপবিত্র বস্ত্ত থেকে পবিত্র বস্ত্তকে পার্থক্য করা এবং আল্লাহর রেযামন্দি অর্জন করা সম্ভব নয়। নাবী (ﷺ) যে বাণী, আমল, আখলাক ও হিদায়াত নিয়ে এসেছেন, তার সবই পবিত্র। সুতরাং তাঁর কথা, কাজ এবং আখলাক দিয়ে উম্মাতের সকল কথা, আমল ও আখলাকসমূহ ওজন করা হবে। তাঁর অনুসরণের মাধ্যমেই হিদায়াত প্রাপ্তগণ পথভ্রষ্টদের থেকে আলাদা হবেন। বান্দার যত প্রয়োজন রয়েছে, তার চেয়ে নাবী (ﷺ)-এর হিদায়াত সম্পর্কে জানা ও তাঁর অনুসরণের প্রয়োজন সর্বাধিক। কেননা তিনি যে পবিত্র সুন্নাত ও হিদায়াত নিয়ে এসেছেন, সে সম্পর্কে যে ব্যক্তি অজ্ঞ থাকবে, তার জীবনে বিভ্রান্তি শুরু হবে এবং সে ঐ মাছের মতই হবে, যাকে পানি থেকে উঠিয়ে ডাঙ্গায় ফেলে রাখা হয়েছে। সুতরাং যে বান্দা নাবী-রসূলের হিদায়াত থেকে দূরে থাকবে, তার অবস্থা এই মাছের ন্যায়ই হবে। শুধু তাই নয়; বরং তার অবস্থা এর চেয়েও অধিক ভয়াবহ হবে। জীবন্ত ও সতেজ আত্মার অধিকারী ব্যতীত অন্য কেউ এই মহান সত্যটি উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। যাদের অন্তর মৃত, তারা এ বিষয়টি অনুভবই করতে পারেনা।
যেহেতু উভয় জগতের (ইহ-পরকালের) সফলতা নাবী (ﷺ)-এর বরকতময় জীবনী এবং তাঁর সুন্নাতে তাইয়্যিবাহ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন ও তা বাস্তবায়নের উপর নির্ভরশীল, তাই প্রত্যেক নাজাত ও সৌভাগ্যকামী লোকের জন্য জরুরী হচ্ছে, নাবী (ﷺ), তাঁর পবিত্র সীরাত, তাঁর সুন্নাতে তাইয়্যিবা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। যাতে করে সে জাহেল ও জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর পবিত্র অনুসারী ও সাথীদের কাতারে শামিল হতে পারে।
কিছু লোক এমন রয়েছে, যে নাবী (ﷺ) এর পবিত্র জীবনী, তাঁর সুন্নাত ও হিদায়াতের আলো থেকে সম্পূর্ণ মাহরূম (বঞ্চিত), কেউ বা তা থেকে খুব সামান্য গ্রহণ করাকেই যথেষ্ট মনে করেছে। আবার কতিপয় লোক এ থেকে পরিপূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে। বস্ত্ততঃ সকল প্রকার ফজল ও করম (অনুগ্রহ ও নিয়ামাত) আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে তা প্রদান করেন। আল্লাহ্ তা‘আলা অফুরন্ত কল্যাণের মালিক।
অধিকাংশ সময় তিনি প্রত্যেক সলাতের জন্য নতুন করে ওযূ করতেন। কখনও এক ওযূ দিয়ে একাধিক সলাত পড়তেন। তিনি এক মুদ (আনুমানিক ৫০০ গ্রাম) পানি দিয়ে ওযূ করতেন। কখনও তার চেয়ে কম বা বেশী পরিমাণ পানি ব্যবহার করতেন। মূলতঃ তিনি ওযূতে সামান্য পানি খরচ করতেন এবং উম্মাতকে ওযূর মধ্যে পানি অপচয় করতে নিষেধ করতেন।
সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি কখনও ওযূর অঙ্গগুলো একবার করে ধৌত করেছেন। আবার কখনও দুইবার করে আবার কখনও তিনবার করেও ধৌত করেছেন।
আরও প্রমাণিত আছে যে, তিনি কোন কোন অঙ্গ দুইবার আবার কোনটি তিনবার ধৌত করেছেন। কখনও তিনি এক অঞ্জলি পানি দিয়ে কুলি করতেন এবং নাক পরিষ্কার করতেন। কখনও দুই অঞ্জলি দিয়ে আবার কখনও তিন অঞ্জলি দিয়েও অনুরূপ করতেন। এক অঞ্জলি পানি দিয়ে তা করার সময় অর্ধেক মুখে দিতেন আর বাকী অর্ধেক নাকে প্রবেশ করাতেন। দুই বা তিন অঞ্জলি পানির মাধ্যমে কুলি করলে এবং নাক ঝাড়লেও প্রত্যেক অঞ্জলির একাংশ মুখে এবং অন্যাংশ নাকে দেয়াও সম্ভব। আর আলাদাভাবে মুখে পানি দিয়ে কুলি করা এবং তারপর আরেক অঞ্জলি পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করাও বৈধ। তিনি ডান হাতের অঞ্জলি থেকে নাকে পানি প্রবেশ করাতেন এবং বাম হাত দিয়ে নাক ঝাড়তেন ও পরিষ্কার করতেন।
ওযূ করার সময় তিনি পূর্ণ মাথা মাসাহ করতেন। দুই হাত দিয়ে মাথার প্রথম থেকে শেষ ভাগ পর্যন্ত মাসাহ করতেন। মাথার শুধু একাংশ মাসাহ করে অন্যান্য অংশ ছেড়ে দেয়ার কথা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়। তবে তাঁর মাথায় যখন পাগড়ি থাকতো, তখন তিনি মাথার প্রথমাংশ মাসাহ করতেন আর পাগড়ির উপর দিয়ে মাসাহ পূর্ণ করতেন।
কুলি করা এবং নাকে পানি দেয়া ব্যতীত তিনি কখনই ওযূ সমাপ্ত করেন নি। প্রত্যেক ওযূতেই তিনি তা করতেন। জীবনে একবারও এই কাজ দুইটিতে ত্রুটি করেছেন বলে প্রমাণিত হয় নি।
ওযূর মধ্যে কুরআনে বর্ণিত নিয়মে ধারাবাহিকভাবে অঙ্গগুলোকে ধৌত করতেন। অর্থাৎ প্রথমে মুখ, তারপর হাত, অতঃপর মাথা মাসাহ এবং সবশেষে পা ধৌত করতেন। অনুরূপভাবে তিনি অঙ্গগুলো পরপর অর্থাৎ একটি শুকিয়ে যাওয়ার আগেই অন্যটি ধৌত করতেন। কখনও তিনি এর ব্যতিক্রম করেন নি। পায়ে চামড়ার বা সাধারণ মোজা না থাকলে তিনি তা ধৌত করতেন। মাথা মাসাহ করার সময় তিনি কানের ভিতর ও বাহিরের অংশও মাসাহ করতেন। নতুন করে পানি নিয়ে কান মাসাহ করার কথা সহীহ লিষ্টসূত্রে প্রমাণিত নয়। ঘাড় মাসাহ করার ক্ষেত্রে কোন সহীহ হাদীস নেই। ওযূর প্রত্যেক অঙ্গ ধৌত করার দু’আর ক্ষেত্রে যতগুলো হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার সবগুলোই বানোয়াট। ওযূর শুরুতে নাবী (ﷺ) শুধু বিসমিল্লাহ্ বলতেন। আর শেষে এই দু’আ পাঠ করতেন।
اَشْهَدُ اَنْ لَّا إِلٰهَ اِلَّا ا للهُ وَحْدَه” لَا شَرِيْكَ لَه” وَ اَشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدًاعَبْدُه” وَ رَسُوْلُه”- اَللّٰهُمَّ اجْعَلْنِيْ مِنَ التَّوَابِيْنَ وَاجْعَلْنِيْ مِنَ الْمُتَطَهِّرِيْنَ
অর্থ: ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মা‘বূদ নাই তিনি একক ও শরীক বিহীন। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রসূল। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর।[1] সুনানে নাসাঈ এ ব্যাপারে আরেকটি দু’আ বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
سُبْحَانَكَ اللّٰهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ
ওযূর শুরুতে তিনি কখনই نَوَيْتُ বলেন নি অর্থাৎ ওযূর নিয়ত মুখে উচ্চারণ করেন নি। তাঁর কোন সাহাবী থেকেও এমনটি করার কথা প্রমাণিত নেই। তিনবারের বেশী কখনই তিনি ওযূর অঙ্গগুলো ধৌত করেন নি। অনুরূপ কনুই এবং টাখনুর সীমানা ছেড়ে উপরের দিকে পানি ঢেলেছেন বলে প্রমাণিত হয় নি। ওযূ করার পর কাপড় দিয়ে ভিজা অঙ্গগুলো মুছে ফেলাও তাঁর অভ্যাস ছিলনা। কখনও কখনও তিনি দাঁড়ি খেলাল করতেন, তবে সব সময় তিনি তা করতেন না। আঙ্গুল খেলালের ক্ষেত্রেও অনুরূপ করতেন। সর্বদা তা করতেন না। হাতে পরিহিত আংটিকে নাড়ানোর বিষয়ে একটি যঈফ হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
সফর ও নিজ বাড়ীতে অবস্থান করার সময় মোজার উপর মাসাহ করার হাদীস সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। মুকীমের জন্য এক দিন এক রাত এবং মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত সময় নির্ধারণ করেছেন। তিনি মোজার উপরের অংশ মাসাহ করতেন। কাপড়ের মোজার উপরও তিনি মাসাহ করতেন। এমনকি জুতার উপর মাসাহ করার হাদীসও সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
তিনি শুধু পাগড়ির উপর মাসাহ করেছেন এবং মাথার প্রথমাংশ মাসাহ করে বাকী অংশের উপর পরিহিত পাগড়ির উপর দিয়েও মাসাহ করেছেন। তবে সম্ভবতঃ বিশেষ প্রয়োজনে তা করেছেন। এও হতে পারে যে মোজার উপর মাসাহ করার ন্যায় সকল অবস্থাতেই তা জায়েয। এটিই অধিক সুস্পষ্ট। আল্লাহই ভাল জানেন।
তাঁর পা দু'টি যখন মোজা দ্বারা ঢাকা থাকত তখন তিনি তার উপর মাসাহ করতেন এবং খালি থাকলে তা ধৌত করতেন।
তায়াম্মুম করার সময় তিনি মাটিতে একবার হাত লাগিয়েই মুখমণ্ডল এবং উভয় হাত মাসাহ করতেন। যেই যমীনের উপর তিনি সলাত পড়তেন তাতেই তিনি তায়াম্মুম করতেন। শুকনো মাটি, বা বেলে মাটি এবং কাদাসহ সকল শ্রেণীর মাটি দিয়েই তায়াম্মুম করা বৈধ। সহীহ সূত্রে নাবী (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন- আমার উম্মাতের কোন ব্যক্তির নিকট যখনই সলাতের সময় উপস্থিত হবে তখন তার সাথেই রয়েছে মসজিদ ও সলাতের জন্য পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ তথা তায়াম্মুমের জন্য মাটি বা মাটি জাতীয় বস্ত্ত। রসূল (ﷺ) এবং তাঁর সাথীগণ যখন তাবুক যুদ্ধে বের হলেন তখন মরুভূমির বালুময় দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন। তাদের সাথে অতি সামান্য পরিমাণ পানি ছিল। তিনি এই সফরে সাথে মাটি নিয়েছিলেন বা মাটি সাথে রাখার আদেশ দিয়েছিলেন বলে কোন কিছুই বর্ণিত হয়নি। তাঁর কোন সাহাবীও এমনটি করেন নি। যে ব্যক্তি এ বিষয়ে চিন্তা করবে সে নিশ্চিতভাবে বুঝতে সক্ষম হবে যে, নাবী (ﷺ) বালি দিয়েই তায়াম্মুম করতেন।
প্রত্যেক সলাতের জন্য নতুনভাবে তায়াম্মুম করেন নি বা তা করার আদেশ দেন নি। বরং তিনি সাধারণতঃ তায়াম্মুম করেছেন এবং তাকে ওযূর স্থলাভিষিক্ত করেছেন। এতে বুঝা যাচ্ছে ওযূর হুকুম-আহকাম তায়াম্মুমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ব্যতিক্রম কিছু থাকলে অবশ্যই তা বর্ণিত হত।
সলাতে দাঁড়ানোর সময় রসূল (ﷺ) ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন। এর পূর্বে তিনি কোন কিছুই পাঠ করেন নি। সলাতের শুরুতে তিনি মুখে নিয়ত উচ্চারণ করেন নি। সাহাবী, তাবেঈ এবং চার মাজহাবের ইমামদের কেউ এটিকে মুস্তাহাব বলেননি।
তাকবীরে তাহরীমা বলার সময় তিনি ألله أكبر ‘আল্লাহু আকবার’ বাক্যটি পাঠ করতেন। এ ছাড়া তিনি অন্য কিছুই পাঠ করতেন না। তাকবীর পাঠ করার সময় তিনি উভয় হাতের আঙ্গুলসমূহ খোলা রেখে এবং কিবলামুখী করে কানের লতি পর্যন্ত উঠাতেন। কাঁধ পর্যন্ত উঠানোর কথাও বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর ডান হাতের কব্জি ও বাহুকে বাম হাতের কবজি ও বাহুর উপর স্থাপন করতেন। উভয় হাত রাখার স্থান সম্পর্কে রসূল (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে কিছুই বর্ণিত হয়নি। তবে ইমাম আবু দাউদ আলী (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, সলাতে এক হাতের কব্জিকে অন্য হাতের কব্জির উপর রাখা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত।[1] তাকবীরে তাহরীমার পর কখনও তিনি এই দু’আটি (ছানাটি) পড়ে সলাত শুরু করতেনঃ
أَللّٰهُمَّ بَاعِدْ بَيْنِيْ وَ بَيْنَ خَطَايَاىَ كَمَا بَاعَدْتَّ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ اَللّٰهُمَّ نَقِّنِيْ مِنَ الْخَطَايَا كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الْاَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ اَللّٰهُمَّ اغْسِلْ خَطَايَاىَ بِالْمَاءِ وَ الثَّلْجِ وَالْبَرَدِ
‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমার এবং আমার পাপসমূহের মাঝে এমন দুরত্ব সৃষ্টি করে দাও যেমন দুরত্ব সৃষ্টি করেছ পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে। হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহসমুহ পানি, বরফ ও শিশির দ্বারা ধৌত করে দাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এমনভাবে পাপাচার থেকে পরিস্কার করে দাও যেমন সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে ধৌত করে পরিচ্ছন্ন করা হয়’’।[2] তিনি কখনও এই দু’আটি পাঠ করতেন-
وَجَّهْتُ وَجْهِىَ لِلَّذِى فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ إِنَّ صَلاَتِى وَنُسُكِى وَمَحْيَاىَ وَمَمَاتِى لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ اللّٰهُمَّ أَنْتَ الْمَلِكُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ. أَنْتَ رَبِّى وَأَنَا عَبْدُكَ ظَلَمْتُ نَفْسِى وَاعْتَرَفْتُ بِذَنْبِى فَاغْفِرْ لِى ذُنُوبِى جَمِيعًا إِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ وَاهْدِنِى لأَحْسَنِ الأَخْلاَقِ لاَ يَهْدِى لأَحْسَنِهَا إِلاَّ أَنْتَ وَاصْرِفْ عَنِّى سَيِّئَهَا لاَ يَصْرِفُ عَنِّى سَيِّئَهَا إِلاَّ أَنْتَ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ كُلُّهُ فِى يَدَيْكَ وَالشَّرُّ لَيْسَ إِلَيْكَ أَنَا بِكَ وَإِلَيْكَ تَبَارَكْتَ وَتَعَالَيْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ
‘‘আমি একমূখী হয়ে স্বীয় মুখমণ্ডল ঐ সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরেকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমার সলাত, আমার কোরবানী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তার কোন অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল। হে আল্লাহ! তুমি এমন বাদশাহ যিনি ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই। তুমি আমার প্রভু, আমি তোমার বান্দা। আমি আমার নিজের উপর জুলুম করেছি।
আমি আমার পাপ স্বীকার করছি। সুতরাং তুমি আমার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দাও। তুমি ব্যতীত গুনাহসমূহ ক্ষমা করার কেউ নেই। তুমি আমাকে সর্বোত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করো। তুমি ব্যতীত আর কেউ উত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করতে পারেনা। তুমি আমার থেকে খারাপ চরিত্রগুলো দূর করে দাও। তুমি ছাড়া আর কেউ আমার থেকে খারাপ চরিত্রগুলো দূর করতে সক্ষম নয়। হে আমার প্রভু! আমি তোমার হুকুম পালন করতে প্রস্ত্তত ও উপস্থিত আছি। আমি তোমার আনুগত্যের জন্য সদা প্রস্ত্তত রয়েছি। সমস্ত কল্যাণ তোমার উভয় হসেত্মই নিহিত। অকল্যাণকে তোমার দিকে সম্পৃক্ত করা শোভনীয় নয়। আমি সম্পূর্ণরূপে তোমার দিকে মুখাপেক্ষী ও নিজেকে তোমার উপর সোপর্দকারী এবং তোমার দিকেই আমি প্রত্যাবর্তনকারী। তুমি বরকমতময় ও মহিমান্বিত। তোমার কাছেই আমি ক্ষমা চাচ্ছি এবং তোমার নিকটই তাওবা করছি।’’[3]
তবে বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে এই দু’আটি তাহাজ্জুদ সলাতের ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। কখনও কখনও তিনি এই দু’আটিও পড়তেন-
اللّٰهُمَّ رَبَّ جِبْرِيلَ وَمِيكَائِيلَ وَإِسْرَافِيلَ فَاطِرَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ اهْدِنِى لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ إِنَّكَ أَنْتَ تَهْدِى مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
‘‘হে আল্লাহ! তুমি জিবরীল, মীকাঈল এবং ইসরাফীলের প্রভু। আসমান ও যমীনের স্রষ্টা। অদৃশ্য ও দৃশ্যমান সব বিষয়েই তুমি অবগত। তোমার বান্দারা যে বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হয় তুমি সে বিষয়ের ফয়সালাকারী। যেই সত্য সম্পর্কে মতভেদ করা হয়েছে সে বিষয়ে তুমি আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করো। অর্থাৎ তুমি আমাকে হক ও হিদায়াতের উপর অবিচল রাখো। নিশ্চয়ই তুমি যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ প্রদর্শন করে থাকো’’।[4]
আবার কখনও তিনি তাকবীরে তাহরীমার পর এই দু’আও পড়তেন
اللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ قَيِّمُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ الْحَقُّ وَوَعْدُكَ حَقٌّ وَقَوْلُكَ حَقٌّ وَلِقَاؤُكَ حَقٌّ وَالْجَنَّةُ حَقٌّ وَالنَّارُ حَقٌّ وَالسَّاعَةُ حَقٌّ وَالنَّبِيُّونَ حَقٌّ وَمُحَمَّدٌ حَقٌّ اللّٰهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ وَبِكَ خَاصَمْتُ وَإِلَيْكَ حَاكَمْتُ فَاغْفِرْ لِى مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ أَنْتَ الْمُقَدِّمُ وَأَنْتَ الْمُؤَخِّرُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ
‘‘হে আল্লাহ! তোমার জন্য সকল প্রশংসা। তুমি আসমান-যমীন এবং এ দু’য়ের মধ্যস্থিত সকল বস্ত্তর আলো। তোমার জন্য সকল প্রশংসা। আসমান ও যমীন এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে তুমি ঐ সব বস্ত্তর অধিকর্তা। তোমার জন্য সকল প্রশংসা। তুমি সত্য, তোমার অঙ্গিকার সত্য, কিয়ামতে তোমার সাক্ষাত সত্য, তোমার কথা সত্য, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, নাবীগণ সত্য, মুহাম্মাদ (ﷺ) সত্য এবং কিয়ামত সত্য। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আত্মসমর্পন করেছি। তোমার উপর ভরসা করেছি। তোমার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছি। তোমার নিকট প্রত্যাবর্তন করেছি। তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই তোমার শত্রুর বিরুদ্ধে বিবাদে লিপ্ত হয়েছি। তোমার নিকটই সকল বিষয় মীমাংসার জন্য পেশ করেছি। তুমি আমার পূর্বের ও পরের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দাও। যা আমি গোপনে ও প্রকাশ্যে করেছি। তুমি যাকে চাও আগে কর বা অগ্রসর কর এবং তুমিই যাকে চাও পিছিয়ে দাও। তুমি ছাড়া কোন সত্য মা’বূদ নেই।[5]
উপরে বর্ণিত সবগুলো দু’আই নাবী (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে। আরও বর্ণিত হয়েছে যে, তাকবীরে তাহরীমার পর তিনি নিম্নের দু’আটির মাধ্যমে সলাত শুরু করতেনঃ
سُبْحَانَكَ اللّٰهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ وَلاَ إِلَهَ غَيْرُكَ
‘‘হে আল্লাহ্! প্রশংসা সহকারে তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তোমার নাম বরকতময়, তোমার মর্যাদা সকলের উপরে এবং তুমি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কোন সত্য উপাস্য নেই’’।[6]
তবে পূর্বে উল্লেখিত দু’আগুলো এই দু’আটির চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ। উমার (রাঃ) হতে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রসূল (ﷺ) এর মুসাল্লায় দাঁড়িয়ে এই শেষোক্ত দু’আটি উঁচু আওয়াজে পাঠ করতেন এবং মানুষকে তা শিখাতেন।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) বলেন- উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণনাই আমি গ্রহণ করছি। তবে কোন ব্যক্তি যদি সলাতে দাঁড়ানোর সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম থেকে বর্ণিত যে কোন দু’আ পাঠ করে, তা উত্তম হবে।
সলাত শুরু করার দু’আ তথা ছানা পাঠ করার পর তিনি বলতেন-
أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
‘‘বিতাড়িত শয়তান থেকে আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় কামনা করছি। শুরু করছি সেই আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু’’। অতঃপর তিনি সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন। তিনি কখনও উঁচু আওয়াজে বিসমিল্লাহ্ পাঠ করতেন। তবে অধিকাংশ সময়ই তিনি তা নিরবে বলতেন।
নাবী (ﷺ) প্রত্যেক আয়াত পাঠ করার পর সামান্য সময় থামতেন। আয়াতের শেষ অক্ষর উচ্চারণ করার সময় আওয়াজ লম্বা করতেন। সূরা ফাতিহা পাঠ শেষ হলে আমীন বলতেন। যেই সলাতে উঁচু আওয়াজে কেরাআত পাঠ করা হয়, তাতে তিনি আমীনও উঁচু আওয়াজে বলতেন। তাঁর পিছনের মুসল্লিগণও উঁচু আওয়াজে আমীন বলতেন।[7]
সলাতের প্রথম রাকআতে তাঁর দু’টি সাকতাহ্ (সামান্য বিরতি) ছিল। অর্থাৎ তিনি দুইবার সামান্য সময়ের জন্য বিরতি গ্রহণ করতেন। একটি ছিল তাকবীরে তাহরীমা ও কিরাআতের মাঝখানে। দ্বিতীয়টির ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। এক বর্ণনায় রয়েছে যে, তা ছিল সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর। অন্য বর্ণনায় আছে যে, তা ছিল কিরাআত পাঠ শেষে এবং রুকুতে যাওয়ার পূর্বে। আরও বলা হয়েছে যে, প্রথম সাকতাহ্ ছাড়াও আরও দু’টি সাকতা রয়েছে। তবে বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে সাকতাহ্ মাত্র দু’টি। তৃতীয় সাকতা’র ব্যাপারে কথা হচ্ছে, তা ছিল খুবই সামান্য সময়ের জন্য। শ্বাস নেওয়ার জন্য তিনি এই সাকতাহ্ (সামান্য বিরতি) গ্রহণ করতেন। খুব সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে কতক আলেম এটিকে সাকতাহ্ হিসাবে উল্লেখ করেন নি।[8]
সূরা ফাতিহা পাঠ শেষে অন্য একটি সূরা পড়তে হবে। রসূল (ﷺ) কখনও লম্বা সূরা পাঠ করতেন আবার কখনও সফর অথবা অন্য কোন কারণে সংক্ষিপ্ত কিরাআত পাঠ করতেন। কিন্তু অধিকাংশ সময় তিনি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতেন।
প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উছাইমীন রহঃ) বলেনঃ সলাতে ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখা সুন্নাত। যেমন-
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ كَانَ النَّاسُ يُؤْمَرُوْنَ اَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ الْيَدَ الْيُمْنَى عَلَى ذِرَاعِهِ الْيُسْرَى فِى الصَّلَاةِ
‘‘ অর্থ: সাহাল ইবন সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকদেরকে স্বলাতে ডান হাত বাম হাতের যিরার উপর রাখতে নির্দেশ দেওয়া হত।’’। (বুখারী, অধ্যায়ঃ আযান, অনুচ্ছেদ- ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখা, তাও. হা/৭৪০, আপ্র. হা/৬৯৬, ইফা.হা/৭০৪, মুয়াত্তা মালেক, মাশা. হা/৫৪৬, মিশকাত, হাএ. হা/৭৯৮)। কিন্তু হাত দু’টিকে কোন স্থানে রাখবে? এ প্রশ্নের উত্তরে বিশুদ্ধতম মত হচ্ছে, হাত দু’টি বুকের উপর রাখবে। ওয়ায়েল বিন হুজ্র্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ
كَانَ يَضَعُ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى يَدِهِ الْيُسْرَى عَلَى صَدْرِهِ
‘‘নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর স্থাপন করতেন’’। (দেখুনঃ ইবনে খুযায়মা মাশা. হা/৪৭৯) হাদীসটিতে সামান্য দুর্বলতা থাকলেও এক্ষেত্রে বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের তুলনায় এটিই সর্বাধিক শক্তিশালী। আর বুকের বাম সাইডে অমত্মরের উপর হাত বাঁধা একটি ভিত্তিহীন বিদআত। নাভীর নীচে হাত বাঁধার ব্যাপারে আলী থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু তা দুর্বল। ওয়ায়েল বিন হুজর কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি অধিক শক্তিশালী। বুকের উপর হাত রাখার ব্যাপারে ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) থেকে বর্ণিত সহীহ ইবনে খুযায়মাতে অন্য একটি হাদীছ রয়েছে। ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) বলেনঃ
صَلَّيْت مَعَ رَسُول اللَّه صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَوَضَعَ يَده الْيُمْنَى عَلَى يَده الْيُسْرَى عَلَى صَدْره
আমি রসূল সাঃ) এর সাথে সলাত পড়েছি। তিনি তাঁর ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর স্থাপন করেছেন। সুতরাং এই হাদীসটিও বুকের উপর হাত বাঁধা সুন্নাত হওয়ার একটি শক্তিশালী দলীল। আরও বিস্তারিত জানার জন্য ভারত বর্ষের প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা হায়াত সিন্দি রহঃ) যিনি কুতুবে সিত্তার উপর টিকা লিখেছেন, তাঁর বিরচিত কিতাব فتح الغفور في وضع اليدين فوق الصدور (ফাতহুল গাফুর ফী ওয়ায-ইল ইয়াদাইনে ফাওকাস্ সুদুর) দেখে নেয়া যেতে পারে। আল্লাহই ভাল জানেন।
[2]. বুখারী, অধ্যায়ঃ তাকবীরে তাহরীমার পর কী বলবে?, বুখারী, তাও. হা/৭৪৪, ইফা. হা/৭০৮, আপ্র. হা/৭০০ মুসলিম, হাএ. হা/১২৪১, ইফা. হা/১২৩০, ইসে. হা/১২৪২, সহীহ ইবনে মাজাহ, মাশা. হা/৬৫৬, নাসায়ী, মাপ্র. হা/ ৮৯৫, মিশকাত, হাএ. হা/৮১২।
[3] .মুসলিম হাএ. হা/১৬৯৭, ইফা. হা/১৬৮২, ইসে. হা/১৬৮৯,
[4] .আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ সলাত শুরু করার দুআ, আবু দাউদ,আলএ. হা/৭৬৭, সহীহ আত-তিরমিযী, মাপ্র. হা/৩৪২০
[5]. বুখারী, অধ্যায়ঃ রাতের তাহাজ্জুদ সলাত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ রাতের সলাতের দুআ, হাএ. হা/১৬৯৩, ইফা.হা/১৬৭৮, ইসে. হা/১৬৮৫,
[6]. আবু দাউদ, আলএ. ও ইফা হা/৭৭৫,৭৭৬, নাসায়ী, মাপ্র. হা/৮৯৯, ইফা.হা/৯০২, তিরমিযী, মাপ্র. হা/২৪৩, মিশকাত, হা/৮১৫, ইরওয়াউল গালীল,হা/ ৩৪০সহীহ , তাহক্বীক্ব: আলবানী
[7]. উঁচু আওয়াজে আমীন বলার বিস্তারিত হাদীছগুলো জানতে দেখুন: বুখারীতে ৩টি = তাও.হা/৭৮০,৭৮১,৭৮২, ইফা. হা/৭৪৪,৭৪৫, ৭৪৬, আপ্র. হা/৭৩৬,৭৩৭, ৭৩৮, মুসলিমে মোট ৮টি= হাএ. হা/৭৯৯ হতে ৮০৬ পর্যন্ত, ইফা. হা/৭৯৬-৮০৩, ইসে. হা/৮০৮-৮১৫, আবু দাউদ,আলএ. হা/৯৩২, ৯৩৬, ইফা. হা/৯৩২, নাসায়ী, মাপ্র. হা/৮৩০, ৯২৮, তিরমিযী, মাপ্র. হা/২৫০, সহীহ ইবনে মাজাহ, মাশা. হা/৬৯৩, ৬৯৪, ৬৯৫, ৬৯৬, মুয়াত্তা মালেক, মাশা. হা/২৮৮, সুনানুল কুবরা আ-বাইহাকী, মাশা. হা/২৫৫৫, মিশকাত, হাএ. হা/৮২৫, ৮২৬)এছাড়াও একাধিক সহীহ হাদীস প্রসিদ্ধ কিতাবগুলোতে বর্ণিত হয়েছে।
[8]. সুতরাং সাকতার সংখ্যা মোট দু’টি। একটি তাকবীরে তাহরীমার পর অন্যটি সূরা ফাতিহা পাঠের পর। ইমাম যখন সূরা ফাতিহা পড়ে সাকতাহ গ্রহণ করবেন তখন মুক্তাদীগণ পূর্বে প্রত্যেক আয়াতের সাথে সাথে না পড়ে থাকলে এই সুযোগে সূরা ফাতিহা পড়ে নিবেন। মনে রাখবেন উক্ত বিরতি মূলত সূরা ফাতিহা পাঠ করার জন্য নয়। তাই যারা শুরু থেকে সলাতে উপস্থিত থাকেন, তাদের ইমামের সাথে তা পড়ে নেয়া উচিত।
ফজরের কিরাআত
ফজরের সলাতে তিনি ষাট থেকে একশ আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করতেন। তিনি উভয় রাকআতেই সূরা ক্ব-ফ, সূরা রোম, সূরা তাকভীর, সূরা যিলযাল পড়েছেন। তিনি সূরা ফালাক ও সূরা নাস দিয়েও ফজরের সলাত পড়েছেন।
তিনি একদা কোন এক সফরে ছিলেন। তখন তিনি ফজরের সলাতে সূরা মুমিনূন পড়তে শুরু করলেন। প্রথম রাকআতে যখন মুসা এবং হারুনের বর্ণনা আসল অর্থাৎ ৪৪ নং আয়াত পর্যন্ত পড়লেন তখন তাঁর কাশি এসে গেল। তখন তিনি কিরাআত পাঠ বন্ধ করে রুকুতে চলে গেলেন।
জুমআর দিন ফজরের সলাতের প্রথম রাকআতে তিনি আলীফ-লাম-মীম সাজদা এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইনসান (সূরা দাহর) তথা هل أتى على الإنسان পাঠ করতেন। কেননা এই সূরা দু’টিতে সৃষ্টির সূচনা, শেষ, আদম সৃষ্টি, মুমিনদের জান্নাতে প্রবেশ ও পাপীদের জাহান্নামে প্রবেশের আলোচনা এবং জুমআর দিনে যা সংঘটিত হয়েছে ও আগামীতে এতে যা কিছু হবে তার বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। সুতরাং জুমআর দিনের বড় বড় ঘটনাগুলো উম্মাতকে ম্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য এই দিনের ফজরের সলাতে সূরা দু’টি পাঠ করতেন। এমনিভাবে তিনি দুই ঈদ এবং জুমআর ন্যায় বড় ধরণের সম্মেলনে সূরা কাফ, সূরা কামার, সূরা আ‘লা এবং গাশিয়া পাঠ করতেন।
যোহরের কিরাআত
যোহরের সলাতে কখনও তিনি লম্বা কিরাআত পাঠ করতেন। আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন- যোহরের সলাতে কিরাআত এত দীর্ঘ করতেন যে, ইকামত শুনে কেউ ইচ্ছা করলে বাকী নামক স্থানে গিয়ে প্রয়োজন সমাধা করে বাড়িতে ফিরে এসে ওযূ করে মসজিদে গিয়ে নাবী (ﷺ) কে প্রথম রাকআতেই পেয়ে যেত।[1] তিনি তাতে কখনও সূরা আলিফ-লাম-মীম সাজদাহ তিলাওয়াত করতেন। কখনও সূরা আলা, কখনও সূরা লাইল এবং কখনও সূরা বুরুজ তিলাওয়াত করতেন।
আসরের কিরাআত
আসরের সলাতের কিরাআত যোহরের সলাতের কিরআতের অর্ধেক পরিমাণ লম্বা করতেন। আসরের লম্বা কিরাআত যোহরের সংক্ষিপ্ত কিরাআতের সমান ছিল।
মাগরিবের কিরাআত
মাগরিবের সলাতের কিরাআতে রসূল (ﷺ) এর সুন্নাত আজ কালের কিরাআতের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। তিনি একবার উভয় রাক‘আতে সূরা আরাফকে দুইভাগ করে পাঠ করেছেন। একবার তিনি এতে সূরা তুর এবং অন্যবার সূরা মুরসালাত পড়েছেন।
মাগরিবের সলাতে সব সময় ছোট সূরা পাঠ করার রীতি উমাইয়া খলীফা মারওয়ান বিন হাকামের যুগ থেকে শুরু হয়েছে। তাই যায়েদ বিন ছাবিত (রাঃ) তার এই কাজের প্রতিবাদ করেছেন। ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রহঃ) বলেন- নাবী (ﷺ) মাগরিবের সলাতে সূরা আলিফ-লাম-মীম সোয়াদ, সাফ্ফাত, দুখান, আলা, তীন, নাস, ফালাক এবং সূরা মুরসালাত পাঠ করেছেন। কখনও তিনি তাতে ছোট ছোট সূরা পড়েছেন। এ সমস্ত বর্ণনার সবগুলোই সহীহ এবং প্রসিদ্ধ।
ইশার কিরাআত
নাবী (ﷺ) ইশার সলাতে সূরা তীন পড়েছেন এবং মুআয (রাঃ) এর জন্য তাতে সূরা শামস্, সূরা আলা, সূরা লাইল এবং অনুরূপ সূরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সূরা বাকারা দিয়ে মুআয (রাঃ) এর ইশার সলাত পড়ানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে নাবী (ﷺ) বলেছেন- হে মুআয! তুমি কি মানুষকে ফিতনায় ফেলতে চাচ্ছ? যারা সলাতে তাড়াহুড়া করতে পছন্দ করে, তারা রসূল (ﷺ) এর এই বাক্যটি দ্বারা দলীল গ্রহণ করার চেষ্টা করে থাকে। অথচ তারা ঘটনার পূর্বের ও পরের সাথে সংশিষ্ট প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টিপাত করেনি।[2]
জুমআর সলাতের কিরাআত
জুমআর সলাতের প্রথম রাকআতে তিনি কখনও সূরা জুমআ এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা মুনাফিকুন পড়তেন। আবার কখনও প্রথম রাকআতে সূরা আলা এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরাতুল গাশিয়া পাঠ করতেন। কিন্তু নাবী সালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম সূরা জুমআ ও মুনাফিকুনের শুধু শেষ আয়াতগুলো দিয়ে কখনও জুমআর সলাত পড়েননি।
দুই ঈদের সলাতের কিরাআত
ঈদের সলাতে কখনও তিনি সূরা কাফ ও কামারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করতেন। কখনও তিনি সূরা আলা ও সূরাতুল গাশিয়া পাঠ করতেন।
এই ছিল সলাতে কিরাআত পাঠের ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত রসূল (ﷺ) এর সুন্নাত। তিনি একেক সময় একেক সূরা দিয়ে সলাত পড়েছেন এবং তাতে কখনও ছোট সূরা আবার কখনও বড় সূরা পাঠ করেছেন। তাঁর পরে খোলাফায়ে রাশেদ্বীনও এই পন্থা অবলম্বন করেছেন। আবু বকর (রাঃ) একবার ফজরের সলাতে সূরা বাকারা পাঠ করেছেন। এতে তিনি সূর্যোদয়ের একটু পূর্বে সালাম ফিরিয়েছেন। আবু বকরের পরে উমার (রাঃ) ফজরের সলাতে সূরা ইউসুফ, সূরা নাহল, সূরা হুদ, সূরা বানী ইসরাঈল এবং অনুরূপ সূরা পড়েছেন।
রসূল (ﷺ) এর বাণী- ‘‘তোমাদের কেউ যখন সলাতে মানুষের ইমামতি করবে তখন সে যেন সংক্ষিপ্ত সলাত পড়ে’’। এ ব্যাপারে জেনে রাখা দরকার যে, রসূল (ﷺ) কর্তৃক সলাত সংক্ষিপ্ত করার বিষয়টি ছিল আপেক্ষিক। অর্থাৎ তিনি সংক্ষিপ্ত করে যে সমস্ত সলাত পড়েছেন বলে বর্ণিত হয়েছে, সে ব্যাপারে কথা হচ্ছে, তাঁর সংক্ষিপ্ত সলাতসমূহ তাঁর দীর্ঘ সলাতগুলোর তুলনায় অধিক সংক্ষিপ্ত ছিল।
এমনটি নয় যে তিনি সব সময় সংক্ষিপ্ত করে সলাত পড়েছেন। দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত করার সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে রসূল (ﷺ) এর আমলের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে, মুক্তাদীগণের দাবী অনুযায়ী কিরাআত ও সলাত দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত করা যাবেনা। রসূল (ﷺ) তাঁর যে সুন্নাত ও তরীকা সব সময় অবলম্বন করেছেন, মতভেদপূর্ণ প্রত্যেক বিষয়ে তাই হবে ফয়সালাকারী। জুমআ ও দুই ঈদের সলাত ব্যতীত অন্যান্য সকল সলাতে তিনি এভাবে সূরা নির্দিষ্ট করে দেন নি যে, তা ছাড়া অন্যটি পড়া যাবে না।
[2]. প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, মুআয (রাঃ) নাবী সাঃ) এর সাথে ইশার সলাত পড়তেন। তারপর তিনি তাঁর মহল্লায় গিয়ে উক্ত সলাতের ইমামতি করতেন। একবার তিনি রসূল সাঃ) এর সাথে ইশার সলাত পড়েও কিছুক্ষণ দেরী করলেন। ঐ দিকে তাঁর মহল্লার লোকেরা তাঁর পিছনে ইশার সলাত পড়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। তিনি বিলম্বে ফিরে এসে সেদিন সূরা বাকারা শুরু করে দিলেন। একজন মুসল্লি দীর্ঘ কিরাআতে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পিছনে গিয়ে একা সলাত পড়ে চলে গেল। এতে মুআয (রাঃ) বললেন- অমুক মুনাফেক হয়ে গেছে। লোকেরা বিষয়টি নাবী সাঃ) এর কাছে পেশ করলে তিনি মুআযকে বললেনঃ হে মুআয! তুমি কি মানুষকে ফিতনায় ফেলতে চাচ্ছ? (বুখারী)
মুআয (রাঃ)এর মহল্লার লোকেরা যেহেতু তাঁর পিছনে ইশার সলাত পড়ার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করতেন, তাই তার জন্য বেশী দীর্ঘ কিরাআত শুরু করা উচিত হয় নি। এ কারণেই নাবী সাঃ) মুআযের কাজকে অপছন্দ করেছেন।